0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত


॥১৯॥ 


স্থানুচ্ছেদস্য কেদারমাহুঃ শল্যবতো মৃগম (যে জঙ্গলকে ভালোবেসে চাষবাসের উপযোগী বানায় সেটি তারই হক,যেমন মৃগকে শরবিদ্ধ যে করে সেটি তারই অধিকার)-মনু সংহিতা 


মেজর জেনারেল সৌমজিত দাস 

চারদিক থেকে ভেসে আসা ঢাকের গুঞ্জন তাঁবুর ভিতরে এমারজেন্সি মিটিংএ বসা মিলিটারি অফিসারদের কানে এলেও কেউ তোয়াক্কা করেনি। বরং সেটা একদুজনের উল্লাসের খোরাক হয়ে গিয়েছিল। ওরা ভাবছিল সবতো ঠিকঠাক এগোচ্ছে। ওই আদিবাসীগুলো নিশ্চয় একে অপরকে সতর্ক করে দিচ্ছে ঢাক বাজিয়ে গ্রাম খালি করতে। মরতে কে আবার চায়? এই স্টেপটা সফল হলেই একটা বড়সড় ডীল হবে। মেজর জেনারেল ভাবলো,এমনিতেই প্ল্যানমাফিক স্নাইপার টিমের লিডার বিগ্রেডিয়ার ইকবাল কায়েফ নিজে গত দুদিন ধরে সমস্ত এলাকা তন্নতন্ন করে ঘুরেছে ও বস্তির আদিবাসী মুখিয়াদের সতর্ক করে দিতে সেনাদের অর্ডার দিয়েছে। আজ সকালেই যেন জুগগি ঝোপড়ি খালি করে প্রত্যেকে জিনিষপত্র সহ বউ বাচ্চা গৃহপালিত পশুদের নিয়ে ওই খোলা বিশাল ময়দানে চলে যায়। তা না হলে কামানের গোলা পড়লে কেউ বাঁচাবে না। যেকটা বিগ্রেডিয়ার সুবেদার ল্যান্স নায়েক এই টীমে রয়েছে,তাদের মধ্যে এই ইকবাল তার বিশ্বস্ত। হবেই না বা কেন? সে তো এখন বাধ্য! ইকবালের নাড়ি নক্ষত্র প্রমান সহ তার হাতের মুঠোয়। তাছাড়া ওর সাথে একটা বিনিময় রয়েছে। এই অপারেশন সফল হলেই নেক্সট কাশ্মীর। সেখানে একটা ওকে চান্স দেওয়া হবে। তাতেও একটা ডীল। গোপনে এই শর্ত। তবে পেরোকে তার সামনে হাজির করতে হবে। জীবিত বা মৃত। সৌমজিত নিশ্চিত, এটাইএকমাত্র উপায় পেরোকে পাওয়ার। পেরোকে জীবিত বা মৃত পেলেই হলো। তারপর সে যে একটা হার্ডকোর টেররিস্ট সেটাকে প্রমান করে সরকারের হাতে নথিপত্র তুলে দেওয়ার স্কিল তার আছে। এইসব হওয়ার পর পুরো এলাকা উপদ্রব মুক্ত করে শান্তি স্থাপনা করতে রাশিয়ান বাহিনীর অবদান বিস্তারিতভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হাতে তুলে ধরলেই সে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হয়ে যাবে,তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর একটা বড় পাওনা। এতে করে সার্ভে করা খনিজ আকরের জন্য খনিজ ভূমিসব মুক্ত ও অনধিকৃত হয়ে যাবে। এমনিতেই জিয়লোজিক্যাল সার্ভে ডিপার্টমেন্ট এই এলাকা নো ম্যান্স ল্যান্ড চিহ্নিত করেইছে। সেটাতে জনবসতি আছে কি নেই তার কোনও উল্লেখ নেই। তাই আদিবাসী অধিকৃত ভূমি নিয়ে কোনও কন্ট্রোভার্সি নেই। এরপর ওরা বেঘর হয়ে কোথায় যাবে কি করবে সেসব সৌমজিতের মাথাব্যাথা নেই। 

সৌমজিত এবারে ফাইন্যাল কমান্ড দেবার জন্যে সোজা হয়ে বসল। সবার হাতের কাছে প্ল্যান ফাইল ও ছোটো একটা করে ল্যাপটপ। সবাই মৌন। প্রত্যেকে বুঝে গেছে প্ল্যান অফ একশন অনুযায়ী এবারে কি করতে হবে। প্রত্যেকের স্ক্রীনে দেখা যাচ্ছে তিনটে বক্স। তার ভিতরে লেখা সহমতি অসহমতি এবং কিছুই না। যেকোনও একটাতে ক্লিক করতে হবে মাউস দিয়ে। এটা হলো ভোটিং। কুড়িজন উঁচু পর্যায়ের অফিসার। তারা যেমন বলবেন তেমনিটি করা হবে। কার কি বিচার, সেটা মেজর জেনারেলের স্ক্রীনে রিফলেক্ট করবেনা। তাই সে জানতে পারবেনা কে তার বিরোধী। স্বভাবতই এই ভোটে নিজস্ব স্বাধীন বিবেচনা। অবশ্য সৌমজিত আগে থেকেই জমি তৈরি করে রেখেছে। প্রত্যেকের অতীত কর্মজীবনের সার্ভিস রেকর্ডের কিছু ভুল কিছু পদস্খলন নোট করে রেখে তার ভয় দেখিয়ে রেখেছে, এবং লোভ। তাই সৌমজিত একেবারে শিওর যে ভোট তার ফেভারেই হবে। শিমুলিয়া পাহাড়ের উপরে শর্ট ও লং রেঞ্জের কামান বসানো রয়েছে যেসব অত্যাধুনিক কম্পিউটার চালিত। রিমোট তার সৈন্যের হাতে। ওদের কনট্রোল ও এঙ্গেল প্রিসিশন এখানে এই তাঁবুর নিচে। এখানে কনট্রোল প্যানেলে বোতাম দাবাতেই গোলা ছুটবে। সাথে সাথে মিনিস্ট্রি অফ ডিফেন্সে যাবে তথ্য। সফল প্রক্ষেপন। সেখান থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি প্রশংসা। তারপর সৌমজিত স্বয়ং রাশিয়ান মেজর জেনারেলের সাথে হাত মিলাতে যাবে। রাশিয়ান কামানের সফলতা নিয়ে প্রশংসা করে আসবে। ব্যাস। ওরাও আমার কবজাতে। এসবতো কিছুক্ষণের ভিতরেই ঘটতে চলেছে। আহ হা। 

সৌমজিত কী বোর্ডে হাত নিয়ে গিয়েই হঠাত্‍ থেমে গিয়ে হাত গুটিয়ে নিলো। স্ক্রীনে পলকহীন চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বাঁ হাতে মোবাইল তুলে নিলো। মোবাইলও তাল রেখে বেজে উঠেছে। আর ঠিক এই সময়ে গেটের বাইরের রক্ষীটির ভিতরে প্রবেশ। স্যালুট জানিয়ে মিলিটারী কায়দায় তার ম্যাসেজ। হাতে একটা চিঠি। রক্ষীর কথায় রাশিয়ান বাহিনীর দূত বাইরে দাঁড়িয়ে। চিঠির জবাব এক্ষুনি নিয়ে যাবে। 

সৌমজিত চিঠি ও স্ক্রীনের মেল দুটিই পড়ল। দুটির ভাষা একই। ইন্টারনেটে সেন্ট্রাল ডিফেন্স দপ্তরের এমারজেন্সি ম্যাসেজ। স্টপ অল ওয়েপন একসারসাইজ টিল ফারদার অর্ডার। আর রাশিয়ান মেজর লিখেছে যে আমাদের কাছে উভয়েরই সমস্ত রকমের অস্ত্র অভ্যাসের স্টে অর্ডার আপনাদের বিদেশ মন্ত্রক থেকে এসেছে। এই আদেশে আপনাদের ও আমাদের বিদেশ মন্ত্রীর সিগনেচার রয়েছে যার হার্ড কপি আমি নিজে আপনার কাছে এসে আপনাকে দেখাতে চাই। যত শীঘ্র সম্ভব। সৌমজিতের মুখের ভাব দেখে কয়েকজন উঠে দাঁড়ালেন কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস হলোনা। সৌমজিত দ্রুত কী বোর্ডে আঙুল চালিয়ে একটা জবাব টাইপ করে প্রিন্টার থেকে একটা কপি বার করে নিলো। মুখ নিচু করে বলল রেসপেকটেড কলিগস, সরি টু সে, নো ভোটিং নাউ। ডিটেন্ড ফর ফারদার ইনফরমেশন। মিটিং ইজ ওভার। 

ল্যাপটপ বন্ধ করে একে একে টেবিল ছেড়ে চলে গেলেন। সৌমজিত ধপ করে বসে দুহাত দিয়ে চুলের মুঠি ধরে খুব জোরে জোরে টান মারতে লাগলো। এখন বাজে এগারোটা। মিটিংটা আর একটু আর্লি করতে পারলে কাজ হয়ে যেত। ওঃ ভগবান। তীরে এসে তরী ডুবে যাচ্ছে। মাইন্সওনারগুলোকে কি জবাব দেব? ওই শুওর কালা নিগার। সানফোবিচ। ওটাকে যেমন করেই হোক ধরে মারতেই হবে। ও আমার যথেষ্ট ক্ষতি করেছে। ও আর ওর মা। ওরা বছর দশেক আগে ঠিক এইসময় আমাকে এমন ফাঁসিয়ে ছিল আর একটু হলেই আমার কোর্ট মার্শাল হয়ে যেত। আর এই এখন আমার পিছনে লেগেছে। নিশ্চয়ই ওই দুজনের কাজ এটা। আচ্ছা ওই রাশিয়ান বাঁদরটার কর্ম নয়তো? এই স্টে অর্ডারটা রিলিজ করাতে? না না ওদের এতে কি মাথা ব্যাথা। 

সৌমজিত তার লাল কার্পেট পাতা তাঁবু অফিসে দ্রুত পায়চারি করতে করতে এইসব ভাবছিল। দুয়ারের পর্দা সরিয়ে দুজন দ্বাররক্ষী রাশিয়ান মেজর জেনারেল ও তার দুজন আর্মড ফোর্স ঢুকল। ঘরে ঢুকেই দরজার বাইরে তাকিয়ে ইঙ্গিত করলেন সারগেই। তখন দরজা দিয়ে আরও দুজন ঢুকল। একজন দোভাষী আর আরেকজন গোরাচাঁদ দাস। গোরাচাঁদের দিকে থাকতেই সৌমজিতের মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। সারা শরীর ঝিনঝিন করতে লাগলো। সৌমজিত সারা পৃথিবীর কাউকে তোয়াক্কা করে না। কোনও অস্ত্র কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী তার কাছে কিছুই নয়।একমাত্র গোরাচাঁদকেই তার ভয়। একবার সাহস করে তাকাতেই দেখলো গোরাচাঁদ মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তারদিকে তাকাচ্ছেন না। তবুও সৌমজিতের সাহস হলোনা তাঁর দিকে তাকিয়ে রইতে। মুখ নিচুকরে ফাইল গোছাতে শুরু করল। সারগেই তার এই অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করলেন। তারপর রাশিয়ান ভাষাতে বললেন, আমাদের অনুমতি দিলে আমরা বসতে পারি? তাঁর কথা দোভাষী তর্জমা করে দিতেই ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বলল, 

-ইয়েস স্যার। প্লীজ। সারগেই ধন্যবাদ দিয়ে গোরাচাঁদকে বসতে বললেন। পরিচয় করার ভঙ্গিতে বললেন,-ইনি মিঃ গোরাচাঁদ দাস। এখানকার বিস্তীর্ণ প্ল্যাটু জুড়ে সমস্ত আদিম জনজাতির পুনর্বাস ও তাদের অধিকার নিয়ে তিনি নিজের জীবন উত্‍সর্গ করেছেন। ইনি শহুরে উচ্চশিক্ষিত মানুষ। উজ্জ্বল গৌরবর্ণের পারসোন্যালিটি, কিন্তু রুগ্ন অজ্ঞ কালো অপুষ্টির ও অনাহারের শিকার আদিম মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। ওনাকে হ্যাটস অফ। ইনি বর্ণ বৈষম্য ঘৃণা করেন। ইনি বিশ্বাস করেন, যারা এপারথেডে বিশ্বাসী, বর্ণবৈষম্যের অজুহাতে শোষনকরার লোভ যাদের নেশা, তারা নিজেদের জন্ম উত্‍স পরিচয় ভুলে থাকেন। ইনি সরকারের অনুমোদন নিয়ে আমাদের দুই মিলিটারী হেডের সাথে কিছু আলোচনা করতে চান। তার আগে, এইযে এই এলাকাতে এখন অনুশীলন বিরতির আদেশটির কপি। 

সৌমজিতের মনে হলো বর্ণবৈষম্যের কথার শেষে সারগেইএর ব্যঙ্গোক্তি তাকেই উদ্দেশ্য করে করা। ওর প্রতিটি কথা তার কানে গরম সীসার মতো ঢুকছিল। অন্যদেশের এক অপরিচিত লোক একজনকে তার বাপের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ঘটনা মনে হয় পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম। সৌমজিতের অন্তরের গভীর থেকে এক প্রতিবাদ চিত্কার হয়ে উঠে আসতে চাইছে কিন্তু কী যেন একটা ভারী জড়তা তার মুখ বন্ধ করে রেখেছে। নিজেকে ভীষণ অসুস্থ বোধ হচ্ছে। এরকম কখনও হয়নি জীবনে। 

সৌমজিত হঠাত্‍ উঠে দাঁড়াল। -প্লীজ, এক্সকিউজ মি। আমি একমিনিটে ফিরে আসছি। আপনারা একটু বসুন। 

0 comments: