3

প্রবন্ধ - ময়ূরী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


বটানি, ল্যাটিন নাম এবং বাংলা সিনেমা ও সাহিত্যে বটানিস্ট চরিত্রেরা
ময়ূরী মুখোপাধ্যায়


মানবসভ্যতার ইতিহাস সবথেকে বেশি কৃতজ্ঞ থেকেছে যে দুটি গাছের কাছে, তাদের অবস্হান দুটি ভিন্ন মহাদেশে, প্রায় হাজার বছরের ব্যবধানে। লিংকশ্যয়রের উলস্থ্রপ ম্যানর আর বুদ্ধগয়া। বুদ্ধগয়ার অশ্বত্থ গাছটি, যার তলায় এক সংসারত্যাগী রাজপুত্র হয়ে উঠেছিলেন দিগদর্শী বোধিসত্ত্ব…আর তার সহস্রাব্দ পরে উলস্থ্রপ ম্যানরের নিভৃত গৃহকোণের নিরীহ আপেলগাছ, একনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিককে সূত্র ধরিয়েছিল অভিকর্ষের।

জীবনে পাঁচবছর টানা যে বিষয়টি নিয়ে পড়েছি, যার জন্য এখনো একটা কেন্দ্রীয় সরকারের ফেলোশিপ জুটিয়ে করেকম্মে খাচ্ছি, তাকে আমি বলি বটানি, আমি বাদে বাকি সবাই বলে বোটানি। বেকার ল্যাবের দোতলা এবং আড়াইতলার অর্ধেকটা জুড়ে চমৎকার একটা ডিপার্টমেন্ট ছিল আমাদের, ছিল প্রতিটা ক্লাসে ছাব্বিশ জন ছাত্র-ছাত্রী আর সবমিলিয়ে তেরোজন বিদগ্ধ শিক্ষকের অকল্পনীয়, প্রায় অবিশ্বাস্য 2:1 অনুপাত। হ্যাঁ, ছিল। এখন আর সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও অন্তর্হিত। আমরা ছিলাম কলেজের লাস্ট ব্যাচ,কলেজ এখন ইউনিভার্সিটি, আমার ডিপার্টমেন্টটাই abolished হয়ে গেছে।

একজন বটানির স্টুডেন্টকে সারাজীবনে সবথেকে বেশিবার যে প্রশ্নটার সামনে পড়তে হয়, তা হল আশপাশে রাস্তার ধারে কোনো গাছ দেখিয়ে গাছটার নাম জানতে চাওয়া। এই গাছ চেনার শিক্ষাটা আমাদের পুরো সিলেবাসের একটা অংশ, ট্যাকসোনমি গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই, কিন্তু একই (কখনও বা বেশিও) গুরুত্ব বায়োকেমিস্ট্রি, ফিজিওলজি, জেনেটিক্স, বায়োটেকনোলজিরাও দাবি করে। মুশকিলটা হচ্ছে, অন্তত শদুয়েক খটোমটো ল্যাটিন নাম মুখস্থ করবার চক্করে অনেকেই প্রাণপণে একে এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে যায়।

বিশ্বাস করুন, গ্রামে বা মফস্বলে ছোটবেলা কাটানো মানুষেরা অনেক বেশি গাছপালা চেনেন, বহু বটানি ডিগ্রিধারীর থেকে অনেক বেশি। আমার নিজের জ্ঞানই আমার মা বাবার পরিধির অর্ধেকও পৌঁছায় না। কিছুটা আগ্রহ ছিল বলে কয়েকটা ল্যাটিন নাম শিখেছিলাম সিলেবাসের বাইরে, তাও তারা গাছ নয়, আগাছা (herbs, not tree)। পাঁচিলের গায়ে, ফুটপাথের পাশে ফুটে থাকা ছোট্ট লিনডেনবার্জিয়া, বেগুনি রুয়েলিয়া দের বাংলা নাম আজও জানা হয়নি আমার। সত্যি বলতে কি, অনেকক্ষেত্রেই আক্যাডেমিক প্রয়োজনের বাইরে খুব একটা প্রাসঙ্গিকও নয়।

নিকট্যানথেস আর্বর-থ্রিস্টিস (Nyctanthes arbor-thristis) শুনলে কস্মিনকালেও কী কারও মাটি বিছিয়ে পড়ে থাকা শিউলি ফুলের কথা মনে পড়ে, না পড়া সম্ভব! ভাসুক না আকাশে যতই পেঁজা তুলোর মত মেঘ, থাকুক না বাতাসে যতই পুজো পুজো গন্ধ। হোক না শিউলি পশ্চিমবঙ্গের স্টেট ফ্লাওয়ার। ভরা বিয়ের মরশুমে ভরপেট খেয়ে যদি ফোয়েনিকুলাম ভালগারে (Foeniculum vulgare) আর এরিকা ক্যাটেচু (Areca catechu) দেওয়া (মৌরি-সুপারি) পানপাতা চিবাতে হয়, পরিতৃপ্তির একটা উদ্গার ও যে উঠবে না!

ল্যাটিন নামের কচকচি বটানি থেকে বাদ দিলে সবার আগে স্কুলপাঠ্য বইয়ের যে না-সঠিক ধারণাটা মনে পড়ে থাকে তা হল “আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস গাছের প্রাণ আছে আবিষ্কার করেছিলেন”। বীজ থেকে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকা গাছপালাকে ফুলেফলে ভরে ওঠার পর শুকিয়ে মারা যেতে দেখেও তাদেরকে জড় পদার্থ ভাবার কোনও কারণ আসলে তার অনেক অনেকদিন আগে থেকেই মানুষের ছিল না। জগদীশচন্দ্র বোসের এই ক্ষেত্রের বিশেষ অবদান হলো যেকোনও উত্তেজনাতে, ব্যথা বেদনাতে, জলকস্ট বা অতিবৃষ্টির সময়ে গাছেরাও তার আঁচ পেয়ে আমাদের মত সাড়া দেয় (যা অব্যক্ত), দিতে পারে — এই হাইপোথিসিসের পরীক্ষা প্রতিষ্ঠিত প্রমাণ। লজ্জাবতীর স্পর্শকাতরতা, সুন্দরবনের লবণাক্ত মাটি ভেদ করে ওঠা ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূল, হলুদ-কমলা- সিঁদুররাঙা রাশিরাশি পাতা ঝরানোর ফলকালার্স এদের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়ার বিভিন্ন ভাষ্য, যা আমার আপনার কাছে অপাঠযোগ্য। উদ্ভিদ মাত্রেই sensible এবং responsive, শুধুমাত্র জীবিতই (living) নয়।

তবে বটানির সবথেকে জনপ্রিয় (অন্তত বাংলাতে) প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছিল শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে, ফিজিক্সের প্রফেসার হয়ে বটানির কলিগ উত্তমকুমারের প্রক্সি দিতে এসে।“গাঁদা আর সূর্যমুখী ফুল নয় কেন?” এই লা-জবাব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ক্রাশকে প্রভাবিত করতে সিনেমার বেচারই চরিত্রটিকে বইচুরি করতে অবধি যেতে হয়। প্রথমে“চিংড়ি মাছ যেমন মাছ নয়, গাঁদাও তেমন ফুল হলেও ফুল নয়” বলে ম্যানেজ করার বিফল চেষ্টা, পরিণামে স্বীকারোক্তি ও অবশেষে অঙ্গুরীয় প্রদানে বাগদান। প্রশ্নের উদ্দেশ্য নাহয় এখানে দোষ স্বীকার করে নেওয়ায় চাপা পড়ে গেল, কিন্তু সবথেকে আফসোসের বিষয়টা হলো এই যে, ছদ্মবেশী উত্তমকুমার সিনেমার শেষে ড্রাইভারের ছদ্মবেশ ঝেড়ে ফেলে স্বভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েও উত্তরটা দিয়ে গেলেননা। ফলতঃ, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অন্তত দশবার আমাকে এই প্রশ্নোত্তর ব্যাখ্যা করতে হয়েছে।

একটা গাঁদা বা সূর্যমুখী আসলে একক ফুল নয়। একেকটি সম্পূর্ণ পুষ্পমঞ্জরী (inflorescence)। কৃষ্ণচূড়া বা রঙ্গনের একগোছা/একথোকা ফুলের কথা মনে করুন, সেখানে মঞ্জরীর ধারণা চাক্ষুষ করা খুব সহজ। গাঁদা, সূর্যমুখীর যে একককে আমরা সাধারণভাবে ফুল ভাবি, তা আসলে অনেকগুলো ফুলের পরিবর্তিত একটা গুচ্ছ, যেখানে প্রতিটা সাধারণ পাপড়ি এক একটা পুষ্পিকা (floret)। গাঁদা, বাহারি ডালিয়া, ক্রিসেন্থেমামের ক্ষেত্রে পুরো মঞ্জরীতে কেবল একই রকম ফ্লোরেট, যেখানে সূর্যমুখীর বা ক্যালেন্ডুলার মঞ্জরী সাজানো দুধরনের ফ্লোরেট দিয়ে (বাইরের উজ্জ্বল হলুদ, ভেতরের গোলাকার অংশে কালো ছোট্ট ফ্লোরেট)। আমার মতো বটানির লোকজন এই বিশেষ ধরনের মঞ্জরীকে বলবে ‘ক্যাপিচিউলাম’(capitulum) বা ‘হেড’(head) , আর আরও অজস্র বিশ্রী বাংলা অনুবাদের মতো এরও পরিভাষা ‘মস্তক’। বিবর্তনের বিচিত্র পথে এই বিশেষ ফুলসজ্জায় অতিথি ভ্রমরের (বা অন্যান্য পরাগসংযোগকারী পতঙ্গের) একবার পরিভ্রমণে একাধিক ফুল গর্ভধারণ করে পরের প্রজন্মের পৃথিবীতে আসা সুনিশ্চিত করার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। কী অনবদ্য নৈপুণ্য!

হিন্দি “চুপকে চুপকে”য় অমিতাভ বচ্চনকে জয়া ভাদুড়ির corolla সংক্রান্ত প্রশ্নটায় তেতো করলার প্রসঙ্গ টেনে মান বাঁচানোর চেষ্টা করতে হয়। যদিও উৎরোয়নি তেমন। আমি ব্যাখ্যা দিলেও উৎরোবে না বিশেষ কারণ corolla ফুলের সবকটি পাপড়ির বটানিক term, যাকে বাংলায় দলমন্ডল বলি, এই মাত্র। একজন কলেজের ছাত্রী এই সামান্য প্রশ্নটা কেন জানতে চাইবে, সেটা আমার মাথায় কখনওই ঢোকেনি।

অনেক ভেবেও বাংলা সাহিত্যে তিন চারজনের বেশী বটানির প্রফেসর এর কথা মনে পড়ল না। বিমল করের কোনও এক সরস গল্পে কুসুমকানন বলে এক ভদ্রলোক ছিলেন, কিন্ত বিষয়টার একটিমাত্র উল্লেখ হয়েছিল একটা জবরদস্তি সম্পর্কের সূচনায়, আমার ভালো লাগেনি। আমার অত্যন্ত প্রিয়, শীর্ষেন্দুর পার্থিবে ছিলেন কৃষ্ণজীবন, পৃথিবীর নিদারুণ অপমানে দুঃখী, অসহায় অথচ অনুপম দরদী হৃদয়ের এক বিষণ্ণ এনভায়রনমেন্টালিস্ট । আমার দুর্ভাগ্য, এই অসামান্য উপন্যাসেও ভারী বটানির বইয়ের একটিমাত্র প্রসঙ্গ এসেছে এক অপ্রীতিকর দাম্পত্য কলহের ইন্ধন হিসেবে।

একমাত্র সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন গল্পে বিভিন্ন ভাবে বটানিস্টরা ঘোরাফেরা করে, মূলত পার্শ্বচরিত্রে। জেরেমি সন্ডার্স, শঙ্কুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে একবারই, একশৃঙ্গ অভিযানে দেখেছি বটানিস্ট হিসেবে, ডুংলুং ডো তে অচেনা পাতা-ফুল-ফলের নমুনা সংগ্রহে। মিরাকিউরলের উৎস স্বর্ণপর্নী সংগ্রহে শঙ্কু ছিলেন একা কিন্তু মানরো দ্বীপের অমৃত ফল অ্যামব্রোজিয়া সন্ধানকারী টীমের একজনও বটানিস্ট না থাকায় দুঃখ পেয়েছি। ভুলে যাইনি, একজন বটানিস্টের আমন্ত্রণেই গল্পের প্রোটাগনিস্টকে বন্দুক ধরতে হয়েছিল ভয়াবহ মাংসাশী সপ্তপাশের ক্ষিদে থেকে বন্ধু অভিজিৎ আর পোষা ম্যাস্টিফ, বাদশাকে বাঁচাতে। বটানিতে একটা ডিগ্রী ছিল যার মৃত্যুকে ঘিরে গ্যাংটকে গণ্ডগোল বাঁধে, সেই শিবকুমার শেলভাঙ্করের, ইন্টারভিউ বোর্ডের কথাবার্তা থেকে জানা যায় প্রতিদ্বন্দ্বীর সিদ্ধার্থ চৌধুরীরও।

বইয়ের পৃষ্ঠায় তেমন উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি নেই বটানিস্টদের, বাংলা সিনেমার পর্দায় তো আরওই শোচনীয়। এই কতিপয় উল্লেখেও সর্বত্র বটানিস্টরা পুরুষ, এবং এই তথ্যের কোনও ব্যতিক্রম নেই, এটা আমাকে একটু পীড়া দেয়। অবশ্য সমগ্র বাংলা গদ্যসাহিত্যের গভীরতার তুলনায় আমার আয়ত্তাধীন অংশ তো বলতে গেলে সিন্ধুতে বিন্দুপ্রায়, তাই এই সামান্য তালিকায় আরও কয়েকজনের নাম যুক্ত হলে আমি নিজে খুশি বৈ দুঃখ পাবনা।

3 comments:

  1. খুব সুন্দর লিখেছিস ৷

    ReplyDelete
  2. সরস সুন্দর রচনা। ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  3. অসাধারণ তথ্যসমৃদ্ধ ও সাহিত্যরসে টইটম্বুর লেখাটি উপভোগ করলাম।

    ReplyDelete