0

প্রাচীনকথা - ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী

Posted in

প্রাচীনকথা


মিথ-কথন
ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী



গ্রীক পুরাণের বিভিন্ন গল্পে নানা জনপ্রিয় এবং তুলনামূলক কম জনপ্রিয় কিছু চরিত্র বারবার উঠে এসেছে। এই গল্পগুলি জানার জন্য এই চরিত্রগুলির সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা দরকারী। আগামী কিছু পর্বে আমরা গ্রীক পুরাণ নিয়ে কথা বলব। এখানে মূলতঃ পুরাণের বিভিন্ন চরিত্রের পরিচয় এবং তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে একটু আলোচনা করা হল।



পর্ব 8 – আদি দেবদেবীরা এবং আন্ডারওয়ার্ল্ড



আমরা টাইট্যানদের নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম সবার আগে। তারও আগে ছিলেন আদি দেবদেবী বা প্রাইমরডিয়াল ডেইটিরা (Primordial Deity)। এই আদি দেবদেবীরা ছিলেন;ইথার, অ্যানাকে, ক্যাওস, ইরেবাস, ইরস, গায়া, হেমেরা, নিক্স, ফ্যানেস, পন্টোস, টারটারাস, থ্যালাসা, ইউরেনাস। এঁদের মধ্যে গায়া, টারটারাস, ইউরেনাস এঁদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে আগেই। বাকিদের নিয়েও এবার স্বল্পকথায় কিছু আলোচনা করে নিচ্ছি।



ক্যাওস (Chaos) - গ্রীক মিথ অনুযায়ী ক্যাওস হল প্রথম বস্তু যা সৃষ্টি হয়েছিল। ক্যাওস আসলে কিছুই না, খানিকটা অদেখা হাওয়া বা অজানা কুয়াশা। গ্রীক শব্দ ক্যাওসের অর্থ স্বর্গ এবং পৃথিবীর মধ্যেকার ফাঁক বা শূন্যতা। ক্যাওসকে প্রথম সৃষ্টি হিসাবে ধরে নিলে গ্রীকদের সবথেকে আদি দেবতা বা দেবী বলে ধরে নেওয়া হয়। এরকমই আরো কিছু আদি দেবদেবী এঁর পরপরই সৃষ্টি হয়েছিল।



থিসিস (Thesis) - এঁর উল্লেখ গ্রীক মিথে বেশ কম আছে, তবে এঁর কথা লিখতেই হবে, কারণ আদি দেবদেবীর লিস্টে এঁর উল্লেখ না থাকলেও ইনি সৃষ্টির দেবী। এঁর সঙ্গী ছিলেন হাইড্রোস (Hydros) বা জল। এই দেবী হলেন, আদি দেবী অ্যানাকের মা। আমরা না ভেবেই বলে দিই, অমুক থিসিস লিখছেন বা পিএইচডি করছেন। এই থিসিস কথাটা কিন্তু এখান থেকেই এসেছে। মানে কিছু সৃষ্টি করা। থিসিস সবসময় মৌলিক কিছু সৃষ্টি করে, কাজেই এঁকে বাদ দেওয়া একেবারেই সম্ভব নয়। একটি মিথ অনুযায়ী ইনি ক্রোনোস (Chronus) বা সময়ের মা। অর্থাৎ এই মিথে গায়াকে ক্রোনোসের মা বলে স্বীকার করা হয়নি।



এর পরের জনের কথা বলার আগে গ্রীক মিথ অনুযায়ী সৃষ্টির সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া প্রয়োজন। গ্রীকরা মনে করতেন প্রথমে একটা বিশাল ডিম (Orphic Egg or Cosmic Egg) ছিল। সেই ডিমটা দুজন সাপ জড়িয়ে ছিল। সাপেরা নিজেদের প্যাঁচ খুলতেই ডিমটা ফেটে যায়। সেখান থেকে সৃষ্টি শুরু হয়। এবার এই থিয়োরি মাথায় রেখে পরের কয়েকজন দেবদেবীর কথা আসছে।



অ্যানাকে (Anake) - থিসিসের সন্তান বলা হয় এই দেবীকে। এই আদিদেবী হলেন প্রয়োজনীয়তার (Necessity) দেবী। এক মিথ অনুসারে ক্রোনোসের প্রথম সঙ্গিনী (যদি ক্রোনোসকে থিসিসের সন্তান হিসাবে ধরে নেওয়া হয়)। মিথানুসারে, এই কসমিক ডিমকে অ্যানাকে আর ক্রোনোস প্রকান্ড সর্পের আকারে জড়িয়ে ছিলেন। তাঁরা প্যাঁচ খুলতেই ডিম ফুটে ফ্যানেস (Phanes) বেরিয়ে আসেন। ফ্যানেস হলেন প্রাণ। ফ্যানেসকে সবথেকে আদিপুরুষ হিসাবে ধরা হয়। কারণ ফ্যানেস প্রথম নারীপুরুষের সঙ্গমের ফলে নতুন প্রাণ সন্তান সৃষ্টি করার ধারণা নিয়ে আসেন। তার আগে সবাই আবির্ভুত হত সম্ভবত। একটি মতে ফ্যানেসের স্ত্রী হলেন নিক্স।



নিক্স (Nyx) হলেন রাত্রির আদিদেবী। নিক্সের জন্ম সম্পর্কেও কিছু সেরকম জানা যায় না। মনে করা হয় ইনিও সৃষ্টির পরেপরেই আবির্ভুতা হন। গ্রীকমহাকবি হেসিওডের মিথ অনুসারে নিক্স ক্যাওস থেকেই আবির্ভুতা হয়েছেন। আর প্রায় তাঁর সাথেই এসেছেন ইরেবাস (Erebus) বা অন্ধকার। নিক্স এবং ইরেবাসের সন্তান হলেন ইথার (Aether) বা আলো এবং হেমেরা (Hemera) বা দিবস। এঁরা টারটারাসে থাকেন। মা আর মেয়ের বনে না খুব একটা। তাই নিক্স এলেই হেমেরা পৃথিবীতে চলে যান, এবং হেমেরা ফিরলেই নিক্স চলে যান। এইভাবেই দিনরাত্রি চলতে থাকে। নিক্সের আরো কিছু বিখ্যাত সন্তানদের কথায় একটু পরে আসছি।



হেমেরা বা দিবসের সঙ্গী হলেন তাঁরই ভাই ইথার বা আলো। এঁদের সন্তান হলেন থ্যালাসা (Thalassa)। থ্যালাসা হলেন সমুদ্রের আদি দেবী। একেবারে প্রথম পর্বে পন্টোসের (Pontus)কথা বলা হয়েছিল। পন্টোস বা সমুদ্র হলেন গায়ার সন্তান? সেই পন্টোস হলেন থ্যালাসার সঙ্গী। এঁরা দুজনে মিলে মাছ, সামুদ্রিক ঝড়ের জন্ম দিয়েছিলেন। একটি মিথ অনুসারে এঁরা অ্যাফ্রোদিতির মা এবং বাবাও।



এরস (Eros) হলেন আরেকজন আদি দেবতা। ইনি বংশবৃদ্ধির বা যৌনতারও আদিদেব। অনেক মিথে এঁকে এফ্রোদিতির সন্তান হিসাবে মনে করা হয়। ইনিই যৌনতার দেবতা বা কিউপিড (Cupid)। এঁকে অনেকসময় ফ্যানেসের সাথে এক করেও দেখা হয়।



গায়া, ইউরেনাস, টারটারাসের মত এঁরাও এক একটা আদিম জায়গা বা শক্তির প্রতীক। এঁদের স্থান দখল করে টাইট্যানরা। তারপর অলিম্পাসের দেবতারা। কিন্তু আরো অনেক দেবদেবী আছেন, যারা অলিম্পাসের প্রধান বারোর মত বিখ্যাত না হলেও প্রচুর খ্যাতি ছিল এবং প্রচুর মান্যতা পেতেন। সবাই যে অলিম্পাসে থাকতেন তাও নয়। বিভিন্ন স্থানে থাকতেন। তাঁদের কথাও আলোচনা করছি।



অলিম্পাসের প্রধান বারোর পরেই যার কথা বলতে হবে, তিনি হলেন হেডিস। হেডিস হলেন আন্ডারওয়ার্ল্ড বা পাতালের দেবতা। ইনি মৃতমানুষের পাপপুণ্যের হিসাব করেন, খানিকটা আমাদের যমরাজের মত। পাপীদের শাস্তি দেওয়াও এঁর কাজ। এছাড়াও হেডিস উর্বর জমির দেবতা, এর সাথে জমি খনন করে পাওয়া যেকোনো গুপ্তধন বা খনিতে পাওয়া ধাতু বা অধাতুর দেবতাও ইনি। ক্রোনোস এবং রিয়ার সবথেকে বড় পুত্রসন্তান।



এই পাতাল বা আন্ডারওয়ার্ল্ড যায়গাটা তো ছোট নয়, এটা বেশ কিছু ভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে ইরেবাস বা অন্ধকার আছে বেশ কিছুটা অঞ্চলে। সেখানে নিক্স আর ইরেবাসের বেশ কিছু দেবদেবী সন্তানরা থাকেন। তাঁদের কথায় পরে আসছি। এছাড়া আছে স্টিক্স নদী। পৃথিবী ও পাতালের মধ্যে সীমানা নির্দেশ করে স্টিক্স (Styx)। আমাদের বৈতরণীর মত, স্টিক্স পার করলেই মৃত্যুর রাজত্ব শুরু হয়। মনে করা হয় স্টিক্স একজন নদী এবং দেবীও। অসীম শক্তিশালী এই দেবী টাইট্যানযুদ্ধের সময়ে জিউসের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। প্রসন্ন হয়ে জিউস বর দেন স্টিক্সের নামে শপথ করলে সেই শপথ পালন করতেই হবে। আমরা যেমন কথায় কথায় মা কালীর দিব্যি বলি আর তারপর ভুলে যাই, ব্যাপারটা তত সরল মোটেই নয়। উদাহরণ স্বরূপ, ডায়নিউসের মানবী মাতা সিমিলিকে জিউস স্টিক্সের নামে শপথ করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে তিনি সত্যিই দেবতাদের রাজা জিউস, পরিণামে তাঁকে স্বরূপ দেখাতেই হয় এবং সিমিলি মারা যান। এছাড়াও স্টিক্সের জলে অবগাহন করলে সে অপরাজিত হয়। কথিত আছে গ্রীক হিরো আকিলিসের (Achilles) মা থেটিস (Thetis) স্টিক্সের জলে খোকাকে একবার চুবিয়ে নিয়েছিলেন। তাই আকিলিস প্রায় অপরাজিত ছিলেন। একমাত্র তাঁর গোড়ালি ছাড়া। সেখানটাই একমাত্র দুর্বল ছিল কারণ থেটিস ওই জায়গাটাই ধরে ছিলেন। এছাড়াও আছে এক আশ্চর্য যায়গা যার নাম এলাইসিয়াম (Elysium) বা এলাইসিয়ান মাঠ। খানিকটা আমাদের তেপান্তরের মাঠের মত হলেও আসলে এই যায়গা হল ওদের স্বর্গ। কারন যতই পুণ্যাত্মা হও না কেন শরীরে দেবদেবীর রক্ত না থাকলে বা ডাক না পেলে অলিম্পাসে যাওয়া যায় না। এদিকে যারা জীবনে কোনো পাপ করেননি, ডেমিগড বা হিরোর আত্মীয়স্বজনরা তো আর দুষ্টুলোকের মত নরকের কড়াইতে ভাজা হতে পারেন না, তাই তাঁদের জন্য এলাইসিয়াম। সেখানে এঁরা সবাই আনন্দময় জীবন কাটান, যা চান তাই পান এবং যে কাজ করে সবথেকে বেশি আনন্দ পেয়েছেন, সেই কাজই জীবিকা হিসাবে পান। এছাড়া টাইট্যান এবং রাক্ষসজাতীয়রা পরাজিত হলে টারটারাসে বন্দী থাকেন; সে কথা আগেই বলেছি। আদতে পাতাল হলেও আন্ডারওয়ার্ল্ড যায়গাটায় অনেকগুলো বিভাগ আছে, তাই আমরা এর পর থেকে ওই যায়গাকে আন্ডারওয়ার্ল্ডই বলব, পাতাল নয়।



এ হেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের রাজা হওয়ার পর হেডিসের খুব বিয়ে করতে ইচ্ছে হল। সে জিউসকে ধরে বলল, ভাই তোমার একটা সুন্দরী মেয়ে আমায় দাও, বিয়ে করব। জিউস তাঁর আর ডিমিটারের সন্তান পার্সিফোনিকে (Persephone) বিয়ে করতে বললেন। হেডিস বুদ্ধিমান, তিনি বুঝলেন, শ্বাশুড়ী কোনোমতেই মত দেবেন না। হাজার হোক তাঁর নিজের বোন ডিমিটার,তাঁকে তিনি হাড়ে হাড়ে চেনেন। তাই তিনি কোনো ঝুঁকি না নিয়ে পার্সিফোনিকে হরণ করে নিয়ে সোজা তাঁর প্রাসাদে চলে যান। এদিকে ডিমিটার তো মেয়েকে খুঁজে খুঁজে পাগলপারা। রাগের চোটে তিনি পৃথিবীর উপরে দারুণ এক অভিশাপ দিলেন। যতদিন তাঁর মেয়েকে পাওয়া না যাবে ততদিন কোনোপ্রকার ফসল ফলবে না। এরফলে মানবজাতি প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল। শেষে জিউস বাধ্য হয়ে হেডিসকে বলেন পার্সিফোনিকে প্রত্যার্পণ করতে। হেডিস সেটা করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তবে ততদিনে পার্সিফোনি আবিষ্কার করেছেন পাতালে ফাটাফাটি রকমের ভালো বেদানা পাওয়া যায়। তাই তিনি বছরে কিছুদিনের জন্য পাতালে চলে যান। এই সময়ে ডিমিটরের মেজাজ খারাপ থাকে তাই পৃথিবীতে কিছুই ফলে না, শীতকাল চলে।



পার্সিফোনি পাতালের রানী হওয়া ছাড়াও ফলের দেবী। এছাড়াও শীতে পাতালে থেকে তিনি বসন্তকাল নিয়ে আবার ফিরে আসেন, এবং বসন্তে নানারকম ফল ফলে বলে তাঁকে বসন্তকালের দেবীও বলা হয়।



দেবী হেকেটির (Hecate) কথা এখানে বলতেই হবে। ডিমিটারের সাথে হেকেটিও পার্সিফোনিকে জোড়ামশাল হাতে চারদিকে খুঁজে বেরিয়েছেন। হেকেটি হলেন যাদু, কালা-যাদু, রাত, চাঁদ ( গা ছমছমে অর্থে) ভুত এবং ন্যাক্রোম্যান্সির (Necromancy) দেবী। আপনিও নিশ্চয়ই আমার মতই ভাবছেন ন্যাক্রোম্যান্সিটা কি বস্তু? সোজা করে বলতে গেলে মৃত মানুষের সাথে কথা বলা। প্ল্যানচেটের মিডিয়াম হয় না? সেটাই। ইনিও পাতালেই থাকেন। এঁর প্রতীক হল জোড়ামশাল, ছুরি, কুকুর, সাপ ইত্যাদি। হেকেটির নাকি তিনমাথা। তবে রবীন্দ্রনাথ কি কারণে কাদম্বরী দেবীকে হেকেটি বলে ডাকতেন, আমি বুঝিনি।



কথায় কথায় যখন আন্ডারওয়ার্ল্ডের কথা উঠেই গেলো তখন আরো কিছু দেবদেবীর কথা এসে পরে সাথে সাথেই। এঁদের বেশিরভাগই নিক্স আর ইরেবাসের সন্তান। আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্তর্গত ইরেবাস নামক চির অন্ধকারের দেশে এঁরা থাকেন।নিক্স এবং ইরেবাসের সন্তানদের মধ্যে প্রথমেই আসেন হিপনোস (Hypnos)। ইনি ঘুমের দেবতা। ইরেবাস এক বিরাট অন্ধকার গুহা, সেই গুহা থেকে লিথি (Lethe) নদী বয়ে চলেছে। এই নদীর বৈশিষ্ট্য হল এখানে একবার ডুব দিলে বা ডুবে গেলে স্মৃতি পুরোপুরি চলে যায়। আর সেই গুহাতেই দিন আর রাত এসে মেলে, আর এখানেই হিপনোস থাকেন। ইনি মানুষদের গভীরভাবে ঘুম পাড়ান। আর ঘুমোনোর সময়ে মানবজীবনের সেই অর্ধ তাঁর প্রাপ্য হয়।  



থ্যানাটোস (Thanatos) হলেন হিপনোসের জমজ ভ্রাতা। ইনিও ওই বিরাট গুহাতে থাকেন, ইনি মৃত্যুর দেবতা। আমাদের সকলের কাম্য যে মৃত্যু, মানে তাড়াতাড়ি আসবে, রোগে দীর্ঘকাল ভোগাবে না, টপ করে মারা যাব, সেই মৃত্যুর দেবতা ইনি। গ্রীক মিথোলজিতে এঁর উল্লেখ অনেকবার থাকলেও, দেবতা হিসাবে প্রকাশ খুবই কম। মানুষ তো বটেই দেবতারা অমর হলেও এঁকে অপছন্দ করেন। কারণ তাঁর হৃদয় নাকি লোহার, আর আত্মা দস্তার (Bronze)। তাঁর মায়ামমতা কিছুই নেই। হিপিনোস তাঁর সব গল্পেই দয়াবান হয়ে দেখা দিয়েছেন,সেই তুলনায় থ্যানাটোসকে সবাই ভয় পান। থ্যানাটোসকে একা দেখা যায়না , বেশিরভাগ ছবিতেই তিনি যমজভাই হিপনোসের সাথেই আছেন। গভীর ঘুমই মৃত্যুর দ্যোতক এই ধারণা থেকে হয়তো এই ছবিগুলির জন্ম।



হিপনোসের অনেক সন্তান, প্রায় এক হাজার। তাঁদের নাম অনেইরাই (Oneiroi বহুবচনে, একবচনে অনেইরাস)। এঁরা হলেন নানা স্বপ্নের উপদেবতা। এঁদের মধ্যে যে দলপতি তিনি হলেন মরফিয়াস(Morpheus)। মরফিয়াস স্বপ্নের প্রধান দেবতা। ইনিই নাকি রাজাদের স্বপ্নে আসতেন দেবতাদের নির্দেশ নিয়ে। অনেইরাইদের মধ্যে কিছু নাকি সত্যি দেবতাদের নির্দেশ বহন করে সাধারণ মানুষদের স্বপ্নে আসেন, বাকিরা মিথ্যে মিথ্যে। অনেইরাই আসার জন্য নাকি দুটো দরজা আছে। প্রথমটা শিঙের (Horns) তৈরি, সেখান দিয়ে এলে দেবতাদের নির্দেশ বা সত্যি হওয়ার স্বপ্ন। আর অপরটি হাতির দাঁতের তৈরি, সেখান দিয়ে এলে সেই স্বপ্ন একদম মিথ্যে, বা কখনো পুর্ণ হবে না এমন স্বপ্ন; তবে কারোর উপর অনেইরাই রেগে গেলে তখন তাঁরা মেলাস অনেইরাস (melas oneiros) হয়ে যান, অর্থাৎ কালো স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন।



আরেকজন দেবতা আছেন যিনি নিক্স আর এরেবাসের পুত্র। পৃথিবীতে এখন তাঁর বড়ই রমরমা। ইনি হলেন মোমাস (Momus)। চিনতে পারলেন না তো? একদিকে এত রমরমা আর অন্যদিকে চেনা যাচ্ছে না? ইনি হলেন স্যাটায়ার আর ঠাট্টার দেবতা, নির্দোষ ইয়ার্কি না কিন্তু, দস্তুর মত অন্যকে ছোট করার জন্য যে ঠাট্টামস্করা চলে তাই; আজকাল ডার্কমিম নামে যা বিখ্যাত সেটাই। মোমাসের ছবিটি কিন্তু এখনো আমরা প্রায়ই দেখতে পাই। কোথায়? এক প্যাকেট তাসে যে জোকারটি থাকে সেটিই আদতে মোমাস। তাঁর হিসেবমত পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যাকে নিয়ে ঠাট্টা করা যাবে না। শুধুমাত্র অ্যাফ্রোদিতি বাদে। তিনিই নাকি একমাত্র যিনি সমস্ত রকম ঠাট্টামষ্করার ঊর্ধে। ইনি এছাড়াও দোষারোপ (Blame) করার দেবতা। ঝাল ঝাল ব্যঙ্গাত্মক কথা শোনানোর জন্য অলিম্পাস পর্বত থেকে জিউসের দ্বারা নির্বাসিত হয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকেন। আর এঁর যমজ বোন হলেন ওইজিস(Oizys) , তিনি দুঃখ, কষ্ট, উদ্বেগ এবং বিষন্নতার দেবী।



নেমেসিস (Nemesis) - ফসিলসের সেই বিখ্যাত গান আমরা প্রায় সবাই জানি, “আর তোর হয়তো জানা নেই, দৃষ্টান্ত আছে সামনেই, একদম শেষে হানা দেয় নেমেসিস”; এবার প্রশ্ন হলএই নেমেসিস আদতে কি? বিপর্যয়, শাস্তি, খারাপ কাজ এবং অন্যায়ভাবে লাভ করা সৌভাগ্যের দেবী। শেষ কথাটির মানে হল, ধরুন, আপনি প্রচন্ড নচ্ছার টাইপের স্বার্থপর লোক,নিজের বৃদ্ধা পিসির দিকে তাকিয়েও দেখেননি একবারও, কিন্তু পিসি মারা যেতে তার সব সম্পত্তি আপনি পেলেন। এই যে আপনি অন্যায়ভাবে পিসতুতো সম্পত্তির মালিক হলেন, এই সৌভাগ্য আসলে নেমেসিসের দপ্তর। এছাড়া প্রেমের ক্ষেত্রেও এঁর অবাধ আনাগোনা। যে প্রেমিক বা প্রেমিকাকে আপনি একদম ভাগিয়ে দিলেন, একটুও পাত্তা দিলেন না, হয়তো সেএকদম রোগা বলে বা পয়সাকড়ি নেই বলে, বছর পাঁচেক পর তাকে গুবদুগাবদু বাচ্চাসহ শপিংমলের দামী দোকানে কেনাকাটা করতে দেখা হলে যে মনস্তাপ হয় আপনার, সেই মনস্তাপ এই দেবীই সৃষ্টি করেন। প্রতিশোধ এবং শাস্তিও এই দেবীর আনুকুল্যেই সফলতা পায়।



টাইকি (Tyche or Tykhe) – শুনতে নাইকির মত হলেও আদতে নেমেসিসের সাথে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে আছেন এই দেবী। সত্যি বলতে কি নেমেসিসকে টাইকির অবনমিত রূপ বলা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। যদিও জনপ্রিয়তার দিক থেকে টাইকির থেকে নেমেসিস অনেক বেশী উল্লেখযোগ্য। ইনি সৌভাগ্য, সাফল্য এবং স্বাচ্ছন্দ্যের দেবী। এই সৌভাগ্যই অন্যায় ভাবে লাভ করলে নেমেসিস তার দেবী, কিন্তু ভালোভাবে অর্জন করলে টাইকি হবেন দেবী। বিভিন্ন গ্রীক মৃৎপাত্রে আঁকা ছবিতে নেমেসিস আর টাইকিকে একসাথে আঁকা হয়েছে। এই দেবী দুই টাইট্যান ওশেনাস আর টেথিসের সন্তান।



আদিদেবতা আর আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকা দেবদেবীদের লিস্টি এখানেই শেষ। আরো অনেকেই আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকেন, তবে একটু বেশীই উল্লেখযোগ্য এঁরা। পরবর্তী পর্বে আরো এরকম কিছু দেবদেবী নিয়ে আলোচনা হবে, যারা অলিম্পাসের প্রধান বারো নন, কিন্তু প্রায়ই উল্লেখিত হয়েছেন বিভিন্ন মিথে।

0 comments: