ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
পায়ের শব্দ
সোমঙ্কর লাহিড়ী
৩
শোনা যায় পৃথিবীর সমস্ত জাতে মাতাল নাকি তালে ঠিক হয়। অ্যান্ডি নীচে নেমে গাড়ীতে উঠেই তার টিমের বাকি চারজনকে বলল,
বোর্ডিং পাস নিয়ে দুজন চেপে যা, আর বাকীদুজন একটু হাল্লা মাচানো শুরু করে দে। আমি আর কাঞ্চনদা বেরোচ্ছি। রাজারহাট থেকে বেশীক্ষণ লাগবে না। আর মুকেশ আর শেলীকে যদি দেখতে পাস দলে টেনেনে। সবাই মিলে বাওয়ালটা একটু বেশী করে রাখ। বুঝলি।
কাঞ্চন মুকেশ আর শেলীর নাম শুনেই ওর দিকে তাকাল। অ্যান্ডি বলল,
পার্টি চেয়েছে। ঐ বাজোরিয়ার ছেলেটার নাকি শেলীকে দেখে হেব্বী টসকাচ্ছিল। আর মেয়েটারও খুব টাকার দরকার গো কাঞ্চনদা। তুমি কিছু মনে করো না। আমি আর ওর সাথে কিছু করব না।
অ্যান্ডিদের আর্মাডিলোর প্রথম মিউজিক ভিডিওর একটা গান খুব হীট করেছিল, “বর্ষা” - গানের মান হিসাবে কিছু না বলাই ভালো, অ্যান্ডি আর ঐ শেলী চুড়ান্ত উত্তেজক সিন করেছিল সেটাতে। তারপরে ইউটিউবের দৌলতে সে গান রে রে করে মার্কেটে খেয়েছিল। অবস্থা এমন হলো মাচায় ঐ আইটেম থাকলে অ্যান্ডির দল প্রায় ডবলের কাছাকাছি টাকা ডিমান্ড করলেও অর্গ্যানাইজাররা দিতে রাজী থাকত। এক সিজিন কেটে যাওয়ার পরে এখন আবার সেই শেলীকে নিয়ে প্রোগ্রামে যাওয়া কাঞ্চনের তেমন ভালো লাগল না। কিছু বলাটাও ঠিক মনে করল না সে।
অ্যান্ডি একটা সিগারেট ধরাল। কাঞ্চন জানলার কাঁচ নামিয়ে দিতে বলল ড্রাইভারকে।
এয়ারপোর্টে পৌছে দেখল যথামতো কাজ করেছে অ্যাণ্ডীর সাগরেদরা আর তাই প্লেন কিঞ্চিত লেট। কাঞ্চনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় আরও একবার বলল শিলিগুড়ির সেই রিসর্টে অ্যান্ডি খারাপ কিছু করবে না।
যাদের নাম যশ ইত্যাদি হয়েছে তারা প্রায় সবাই আশা করে যে সবাই তাদের দেখলেই চিনতে পারবে, আর তাদের সাথে গা ঘষার জন্য ল্যা ল্যা করবে।
প্লেনের দরজায় অভ্যর্থনাকারিণী এয়ার হোস্টেসকে অ্যান্ডি দেখেই প্রায় চিৎকার করে,
হাই বেব, চিনতে পারছ?
এই বলাটা সেই মহিলাকে ও বাকীদের বেশ চমকেই দিল বলা চলে। একে প্লেন সামান্য লেট অ্যান্ডি এন্ড পার্টিই শেষ যারা প্লেনে উঠল, সেখানে এই রকম একটা বিদ্ঘুটে ভাবে ভাব জমানোর চেষ্টা কারও যে খুব ভালো লাগল না, সেটা বলাই বাহুল্য।
অ্যান্ডি অবাক হয়ে সেই মহিলাকে বলল,
তুমি আমায় চিনতে পারছ না? আমি অ্যান্ডি!
এয়ারহোস্টেস ভদ্রমহিলা তাঁর পেশাগত সৌজন্য বজায় রেখে মিষ্টি হেসে জানাল অ্যান্ডি যেন তার নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করে।
অ্যান্ডি শেষ প্যাসেঞ্জার হওয়া স্বত্তেও এয়ার হোস্টেস মহিলাটির সামনে থেকে নড়তে রাজী নয়। খুব অবাক গলায় আবার জিজ্ঞাসা করল,
কান্ট ইউ রেমেমবার মি? অ্যায়াম অ্যান্ডি, দ্য লীড সিঙ্গার অফ আর্মাডিলো।
যাত্রিদের মধ্যে থেকে কেউ একটা টিপ্পনী কাটল,
দেন গো এন ইট অ্যান্টস।
মানুষ খবরে থাকার জন্য কত কি যে করতে পারে তার একটা নমুনা হিসাবে অ্যান্ডিকে রাখা যেতেই পারে।
প্রবল চিৎকার চেঁচামিচি জুড়ে দিল অ্যান্ডি। সাথে বাংলা, ইংরাজী ও হিন্দি এই তিন ভাষায় চোখা চোখা গালি বর্ষণ শুরু করল।
ব্যাপারটা এমন জায়গায় পৌছে গেল যে এয়ারক্রাফটের ক্যাপ্টেনকে হস্তক্ষেপ করতে হলো। ব্যাপারটা বেশ উত্তপ্ত করে তোলার পরে অ্যান্ডির যখন বুঝল সবার নজর তার উপরে, সে তখন শান্ত হয়ে গিয়ে নিজের সিটে বসল। শেলীর দিকে তাকিয়ে বলল,
পাশে এসে বস, না হলে গোটা জার্নিটা আমার খারাপ যাবে। আমায় আবার প্লেনে ভয় লাগে, তুই তো জানিস।
শেলী একটু ইতস্তত করায় বেশ চেঁচিয়ে বলল,
আরে এখানে কিছু করব না তোকে, আমি জানি তো এটা প্লেন। আয় আয় বোস এখানে।
শেলী অ্যান্ডির দলের একজনের সাথে সিট বদল করে ওর পাশে এসে বসল। প্লেন উড়ল আকাশে।
কমলা প্রসাদ বাজোরিয়া আদ্যান্ত ব্যবসায়ী মানুষ। যিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে ব্যবসা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। আর সেটাকে নিজের বুদ্ধি ও পরিশ্রমে বাড়িয়েছেন। অনেকগুলো চা বাগানের একটাকে ছেলের আবদারে রিসর্ট বানিয়েছেন বটে, কিন্তু সেটা ঠিক মন থেকে যে মেনে নিয়েছেন, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।
ছেলে দুর্গাপ্রসাদ শিলিগুড়ির একটা খ্রীশ্চান মিশনারি স্কুলে ঢুকেই ডিপি হয়ে গেছে, সেটা বাপের পছন্দ নয়। মায়ের। এই প্রসঙ্গ কমলা প্রসাদ মাঝে মাঝেই স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করার সময় উল্লেখ করে জেতার চেষ্টা নাকি করেন, কিন্তু ব্যাপারটা ফলপ্রসূ হয় কি না সেটা অজানা।
ডিপি তার মায়ের আদরে বখাটে সেটা মোটামুটি বোঝা যায়। ব্যবসার ব্যাপারে বাপ আর ছেলের জেনারাশান গ্যাপ। বাবা চায়ের ও চায়ের সাথে যুক্ত ব্যবসার ব্যাপারে আগ্রহী। কারণ তিনি সেটাই দেখে এসেছেন আর বোঝেন ও বটে। ছেলের হচ্ছে নয়া জামানার সাথে সাথে নয়া তারিকার ব্যবসা। তাই একটা বাগানের ভেতরের বিরাট একটা অংশ নিয়ে বানিয়েছে এক রিসর্ট।
সে এলাহী সব ব্যাপার স্যাপার সেখানে। পাহাড়ের ঢালে কেটে কুটে অনেক কিছুই বানিয়ে দিয়ে গেছে আর্কিটেক্ট এর দল। সেখানে গলফ্ থেকে তাস অবধি সব খেলার সুযোগ সুবিধা, পাহাড়ের উপর থেকে প্যারা গ্লাইডিং থেকে জাকুচি সব মজুদ। যেহেতু জুয়াটা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ, তাই সেটার ব্যবস্থা অন্যভাবে। আর যেটা মজুদ সেটা হলো নেশা। যা চাই আর যেভাবে চাই পাওয়া যাবে, মূল্য ধরে দিলে।
শেষের দুটো যে বাবা কমলা প্রসাদের অগোচরে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার যোগান আসে ভারত নেপাল বাংলাদেশ আর চীন থেকে। কে আনে? সে আজ প্লেন আসছে অ্যান্ডিদের সাথে মুকেশ এন্ড পার্টি। তবে আজ শুধু মুকেশ।
ডিপির এই রিসর্টের ওপেনিং ইত্যাদি আগেই হয়ে গেছে, কিন্তু সেটাকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই এই অনুষ্ঠান ইত্যাদি। ব্যাপারটা যখন কমলা প্রসাদের কানে যায় তিনি বলেছিলেন,
চলতা হুয়া গাড়ীকো ফিরসে ধাক্কে কা ক্যা জরুরত?
যাই হোক সে কথা ডিপি যে শোনেনি সেটা এই গালা পার্টির আয়োজনের বহর দেখেই বোঝা যায়।
দুর্গা প্রসাদের একটা অসুবিধা হচ্ছে ওর শরীর। পয়সা যে সবকিছু সামলাতে পারেনা সেটা ওর চেহারা দেখেলেই মালুম হয়। মাথায় বাড়েনি বেশী, যাবতীয় বাড়বাড়ন্ত ভুঁড়িতে। তার নীচে সরু সরু একজোড়া পা ব্যাপারটাকে আরও বেঢপ করে দিয়েছে। তার এই দুঃখ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে তার বাবা আর মা। তাকে মাত্র চব্বিশ বছর বয়েসে এক পরমা সুন্দরী বৌ এনে দিয়ে। পয়সা যতটা পারে কমলা প্রসাদ ততটুকুই করেছেন, তাতে ফল যে খুব সুবিধের হয়েছে তা নয়। তবে হ্যাঁ বুদ্ধিমতি বৌ মুখে কিছুই প্রকাশ করেনি, বা শ্বশুর শাশুড়িকে বুঝতেও দেয়নি।
এখন ডিপি বত্রিশে এসে বেঢপ চেহারা নিয়ে বৌয়ের পাশে একটু হীনমন্যতায় ভোগে বলেই মনে হতে পারে আশেপাশের লোকজনের আর দশ বছরের পুরানো বৌ...
অন্যত্র অন্যকিছু করার চিন্তাটা ডিপির মাথায় আসে সেই “বর্ষা” নামক মিউজিক ভিডিওটা দেখে। উঠতি মডেল আর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর মধ্যে অনেক সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সেই সব সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে গেলে যে পরিমাণ সময় দরকার, সেটার অভাব ছিল ডিপির। তাই যোগানদার মুকেশকে ব্যাপারটা একদিন বলাতে সে খ্যা খ্যা করে বেশ অনেকক্ষণ হেসে বলেছিল,
দশ বরষ এক বিবি, কুছ তো খালিখালি লাগতা হি হ্যায়। জায়স হ্যায়। হো যায়গা। লেকিন ম্যায় স্রিফ লেকর আউঙ্গা। বাকী আপ।
আর্মাডিলোর জানা কোনও ভাবেই সম্ভব ছিল না যে এই শেলীর জন্যেই তাদের এখানে শো করতে আসা। ব্যাপারটা শেলীর কাছেও মুকেশ খুব একটা খুলে বলেনি। র্যাম্পওয়াক, এঙ্কারিং, এটা সেটা বলে আর একটা মডেলের কাছে একরাত একলাখ যথেষ্ট লোভনীয় একটা অফার। সাথে যাওয়া আসা থাকা খাওয়া সব ফ্রী। টোপের পিছনে বোঁড়শি নিয়ে তাই শেলী কিছু ভাবেওনি, ভাবলেও বলেনি মুকেশকে। এমন তো নয় যে শেলীর কাছে সবকিছুই অজানা।
বাগডোগরায় প্লেন থেকে নামার সময় অ্যান্ডি আরও একবার সেই এয়ারহোস্টেস মহিলাটিকে মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,
তুমি সত্যিই আমায় চিনতে পারোনি?
বিরক্ত সেই মহিলা অন্যদিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নিয়েছিল।
বাগডোগরা থেকে বেরিয়ে তিরহানা টি এস্টেট পেরিয়ে ওদের তিনটে গাড়ী এগিয়ে চলল নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। একটা গাড়িতে অ্যান্ডি, মুকেশ আর শেলী অন্যটায় দলের বাকীরা। পিছনে ওদের জিনিসপত্র।
গাড়ী খানেকটা এগনোর পরেই অ্যান্ডি মুকেশকে জিজ্ঞাসা করল,
কি বস? রেশন কি নিয়ে এসেছ?
মাথা ফাতা গেছে না কি? প্লেনে ওঠার আগে যদি ধরা পরে যেতাম এতক্ষণে লালবাজারে। আচ্ছা অ্যান্ডি তেরে কো হর ওয়াক্ত শ্রিফ নেশা চাহিয়ে হ্যায় না? তু দুস্রা কুছ ভি তো শোচা কর।
দেখ মুকেশ সব ভালো লাগে তোর সতীপনাটা বাদ দিয়ে। শালা আমার চেয়ে বড় কাস্টমার তোর আর কেউ আছে? আর সব নগদে।
বাবু, এটা নগদেরই কারবার। চুপ মার না ইয়ার, শেলী হ্যায়, উসে খারাব লেগে গী।
অ্যান্ডি শেলীর দিকে তাকিয়ে বলল,
কি রে আজ অনেকদিন বাদে তুই ও আছিস আর আমিও, আরও একবার বর্ষাটা করবি নাকি?
এই ঠাণ্ডায়? ভিজিয়ে ফিজিয়ে দিলে তো জ্বর এসে যাবে।
আরে তুই আর আমি শুকনোতেই বর্ষা করে দেবো চল।
গাড়ি পথ ছেড়ে একটা চা বাগানের ভেতরে ঢোকে।
0 comments: