গল্প - দেবারতি ভট্টাচার্য
Posted in গল্প
গল্প
শহর পেত্রা
দেবারতি ভট্টাচার্য
নেহা ম্যামের বন্ধুরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছেন। গ্রীক বন্ধু গ্রিফিনের ডাকে নেহা রুবিয়াকে নিয়ে পৌঁছে গেলেন খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর পেত্রা শহরে। সরু অন্ধকার গিরিখাত পেরিয়ে প্রথম চোখে পড়ল একটা ইমারৎ। লাল লাইমস্টোনের বিশাল উঁচু ছটা পিলার, তার উপর আরও পিলার। করিন্থিয়ান স্টাইলে বানানো বাড়ি, সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। উল্টোদিকে কোন এক দেবতার বিশাল মূর্তির পাশ দিয়ে রাস্তা পাহাড়ে উঠতে থাকে। পাহাড়ের মধ্যেই পাথর কেটে একটা এম্ফিথিয়েটার বানানো হয়েছে। দেখতে দেখতে রাস্তা পশ্চিমে ঘুরে গেল, এখন রাস্তার সমান্তরালে একটা ছোট নদী বয়ে যাচ্ছে। পাথরের টাইল দিয়ে তৈরি চওড়া রাস্তার আশেপাশে বাড়িঘর দোকানপাট। সবই লাল আর কমলা লাইমস্টোনের তৈরি, গ্রীক স্থাপত্যের মত দেখতে লাগে। প্রত্যেক বাড়িতেই ঝুলবারান্দা আছে, এমনকি দোকানেও। এগোতে থাকেন দুজনে, রাস্তায় প্রচুর লোকজন, বোঝা যাচ্ছে মূল শহর এসে গেছে। এবার কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে দুসারার মন্দির কোথায়, গ্রিফিন বলেছে ওই মন্দিরের সামনে অপেক্ষা করতে।
একজন গ্রীককেই ডেকে জিজ্ঞেস করেন নেহা,
"আমরা দুসারার মন্দিরে যাব, কোনদিকে গেলে সুবিধে হবে?"
"চল, আমি নিয়ে যাচ্ছি।"
ভদ্রলোকের নাম এরোস, তাঁর কাছ থেকে শহর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা হয়ে গেল।
"এখানকার স্থানীয় লোকেদের নাবাতাইন বলে, ওরাই তৈরি করেছে এই শহর। দামাস্কাস থেকে রোমে যাওয়ার রাস্তায় লোকে এখানে খাবার আর জলের জন্য থামে। দক্ষিণ দিকে যে বন্দর আছে, সেখান থেকেও লোকে মাল নিয়ে এই পথে আসে। চারপাশে মরুভূমি তো, জলের জন্য না থেমে উপায় নেই।"
নেহা ম্যামের ভূগোল জ্ঞান খুবই ভাল। তিনি আন্দাজ করলেন এটা লোহিত সাগরের উত্তরে আধুনিক জর্ডনের কোথাও হবে।
"এই নাও, এসে গেছে তোমার দুসারা মন্দির।"
মন্দিরের চূড়াটা অনেকটা টিপটের ঢাকনার মতো দেখতে, এত উঁচু, যে তাকাতে গিয়ে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেল। মন্দিরের সামনে গ্রিফিন সত্যিই অপেক্ষা করছিলেন। তিনজনে মন্দিরে ঢুকলেন। ১৯টা উঁচু উঁচু সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা ল্যান্ডিং, আরও ৮টা সিঁড়ি উঠে মূল মন্দিরে পৌঁছতে হয়। ৮০০০ বর্গফুটের একটা বিশাল চত্তরের শেষপ্রান্তে একধাপ উঠে দেবতাদের আসনে তিনটে পাথর রাখা। গ্রিফিন এবার বলতে শুরু করলেন,
"এইটা দেখে কিছু মনে পড়ছে তোমার,নেহা?"
"এত বড় একটা জায়গায় এসে মন এমনিতেই চুপ করে যায়। আলাদা করে কিছু মনে পড়ছে না।"
"শোন তাহলে। পেত্রায় নানারকম লোক আসে, তাদের নানারকম দেবতারাও এসেছেন। পেত্রায় ঘুরলে গ্রীক, মিশরীয়, রোমান, সব দেবদেবীর মন্দিরই দেখতে পাবে। এই যেখানে নিয়ে এসেছি, ইনি পেত্রার নিজস্ব দেবতা দুসারা। এঁর প্রতীক হিসেবে কালো পাথরের টুকরো পুজো হয়। তাঁর সঙ্গে চাঁদ, সাপ এসবের সম্পর্ক বেশ গভীর। ইনি নাকি একটা পাহাড়ে থাকেন। দুসারার সঙ্গিনী দেবীর নাম আল উজ্জা। তিনি সিংহবাহিনী, শক্তির দেবী, তাঁকে কুমারী যোদ্ধা বলেও পুজো করা হয়।"
গ্রিফিন চুপ করলেন, যেন কিছু ইঙ্গিত করতে চাইছেন।
"কী বলতে চাইছ গ্রিফিন?"
"চেনা চেনা লাগছে না? হিন্দু দেবতা শিব আর দুর্গার সঙ্গে মিল পাচ্ছ না?"
এইবার খেয়াল হলো নেহার। হ্যাঁ, একটা মিল তো আছে।
"শুধু এই নয়, এখানে আল লাত বলে এক দেবী আছেন, যিনি শষ্য, ফসল আর সমৃদ্ধির দেবী। লক্ষ্মী খুব কাছাকাছি, না? নাবাতাইন উপজাতির প্রাচীন দেবী মনতের কথা জানো? তিনি মৃত্যু ক্ষতি আর ধ্বংসের প্রতীক এক ভয়ঙ্করী দেবী। হিন্দু দেবী কালীর কথা মনে পড়ল?"
গ্রিফিন বলতে লাগলেন,
"ভারতে এসব দেবতাদের কথা শুনেছি আমি। আমার মনে হলো এমন তো হতে পারে, যে রাস্তা ধরে চীনের সিল্ক আসে, ভারতের মশলা আসে সেই রাস্তা ধরেই এই দেবদেবীরাও এসেছেন। ৬০০ বছর আগে এই শহর তৈরি হতে শুরু করেছে। হয়ত ভারত থেকেই কেউ এসে শিখিয়েছিল এই স্থাপত্যবিদ্যা, এটা আসলে একটা হিন্দু উপনিবেশ?"
নেহা একটু ভাবলেন।
"না গ্রিফিন, এটা হতে পারে না। তুমি বললে আজ থেকে তিনশো বছর আগে পেত্রা শহরের পত্তন হয়েছে। তখন ভারতে হিন্দুধর্মের অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। এই খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর ভারতে শিব দুর্গা, কালী, লক্ষী, এঁরা সবাই আছেন কমবেশি। কিন্তু এঁরা পৌরাণিক হিন্দুধর্মের দেবদেবী, গুপ্তযুগের আগে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এঁরা ছিলেন না। যে পথের কথা তুমি বলছ, সেই পথকে রেশম পথ বলি আমরা। সেটাও খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে ছিল না, তার চারশো বছর পরে তৈরি হয়েছে। চাঁদ, সাপ, সিংহ, শষ্য, ফসল, ধ্বংস এগুলো খুব পরিচিত ধারণা। সব প্রাচীন সমাজেই এইসব প্রতীক ব্যবহার হয়েছে কোনও না কোনওভাবে।"
ফেরার পথে ম্যাম রুবিয়াকে বললেন,
"এত কথা গ্রিফিন নিজে নিজে ভেবেছে? উঁহু, নিশ্চয় কেউ বলেছে ওকে। আরব উপদ্বীপে একটা হিন্দু উপনিবেশ ছিল প্রমাণ করতে পারলে অনেকেরই ভালো লাগবে। শোন তুই যা শুনলি কলকাতা ফিরে কাউকে বলবিনা, দিনকাল ভালো নয়।"
0 comments: