প্রবন্ধ - সুজন ভট্টাচার্য
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
তৃতীয় ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
সুজন ভট্টাচার্য
ঘটনাস্থল কলকাতার গায়ের উপরেই এক বিশাল ঢাকঢোল পেটানো বইমেলা। মাঠে ঢোকার মুখ থেকেই লাইন দিয়ে পরপর বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টল। মাঠে প্রচুর ব্লিচিং পাওডার ছেটানো হয়েছে বলে মারার মতো একটা মশাও হাতের কাছে নেই। কাজেই স্টলের ভিতরের মানুষগুলো হাত গুটিয়ে ব্যাজার মুখে বসে আছেন। বই আছে, বিক্রেতা আছে; খদ্দের নেই, বইয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে দেখার মতো কোনও দরদি মানুষ নেই। ভুল বললাম। আছে, আছে। তবে তারা সকলেই ভিড় জমিয়েছেন ২১ নম্বর স্টলের সামনে। কী বলছেন? সেখানে কোনও নামজাদা সাহিত্যিক এসেছেন? আজ্ঞে না। সেখানে শুধু ইংরেজি বই আছে, ইংরেজি। আগে পরের অন্য সমস্ত স্টলে যে বাংলা বই। কাজেই খদ্দের আসছেন না। হাইলি এডুকেটেড বাঙালীর আজকাল বাংলা বইয়ে অ্যালার্জি হয়ে গেছে তো।
২১ ফেব্রুয়ারি আর ১৯ মে নিয়ে বিস্তর বাতেলা করতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ঠিক যেমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি বাংলা সাহিত্য নিয়ে বাকতাল্লা করতে। পড়ি আর নাই পড়ি, রবীন্দ্রনাথ – জীবনানন্দ – শক্তি – সুনীল – বিনয় নামগুলো তুলসীপাতার মতো নানাবিধ অপকর্মের উপর ছিটিয়ে দিতে আমাদের ভুল হয় না। অতএব বাঙালীর সংস্কৃতি জিন্দাবাদ, বাংলা সাহিত্য জিন্দাবাদ। মিছিলে বাঙালীর টান বহুকালের। সে দুর্গাপুজোর ভাসানই হোক কিংবা চিত্রতারকার শোকযাত্রা। মিছিলে নানান শ্লোগান থাকেই। তাই বাঙালীরও নানান শ্লোগান আছে। তার মধ্যে বাঙালীর বড় ভালবাসার শ্লোগান হলো “আ মরি বাংলা ভাষা”। শ্লোগান মিছিলেই মানায়, ঘরের মধ্যে নয়। তাই মিছিল শেষ হলেই বাঙালীও শ্লোগানগুলো গুছিয়ে তুলে রাখে ঘরের তাকে, পঞ্জিকা অনুযায়ী লগ্ন এলে আবার পরিষ্কার করে নামাবে বলে।
বিষয়টা পরিহাসের নয়। কিন্তু কোনও কোনও সময় আসে যখন তীব্র জ্বালা প্রকাশের ন্যায্য রাস্তা না পেয়ে নিজেকেই বিদ্রূপ করে মশকরার ঢঙে। এই জ্বালার দায় থেকেই কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখে ফেলেছিলেন হুতোম প্যাঁচার নকশা। সেখানে কশাঘাত আছে অবশ্যই। কিন্তু একটু তলিয়ে পড়লেই বোঝা যায়, চাবুকের প্রতিটা আঘাত লেখককেই রক্তাক্ত করছে সবার আগে। নিজের রক্তস্নানে তিনি ঘুম ভাঙাতে চাইছেন আশপাশের মানুষের। কিসের রক্তস্নান? এই তো মাসকয়েক আগের কথা। রাজ্য সরকার ঘোষণা করলেন, মাধ্যম-নিরপেক্ষভাবে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত স্কুলে বাংলা ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। আজ্ঞে না, প্রতিবাদ অবাঙালী সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এল না। এল তাদের কাছ থেকেই যারা নিজেদের আগমার্কা বাঙালী এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডবাদী বলে দাবি করেন। গেল গেল রব উঠে গেল রাস্তাঘাটে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায়। না, সরকারের ঘোষণাটা আদৌ কথার কথা ছিল কিনা বোঝা গেল না এদের হুল্লোড়ের চোটে। যথা সময়ে দেখা গেল সরকারি প্রস্তাবের গঙ্গাযাত্রা হয়ে গেছে।
অথচ তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটকে স্কুলস্তরে যথাক্রমে তামিল ও কন্নড় ভাষাশিক্ষা বাধ্যতামূলক। এমনকি কেন্দ্রিয় বিদ্যালয়েও। সেই নিয়ে কোন তামিল বা কন্নড় তীব্র প্রতিবাদ করেছেন কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় চিমটি কেটেছেন, এমনটা খুব শোনা যায়নি। বাঙালী বুদ্ধিজীবী অক্লেশে করেছে। কারণ বাঙালী বুদ্ধিজীবী মনে করেন ভাষা নিয়ে আন্তর্জাতিক হবার এক্তিয়ার একমাত্র তার নিজেরই আছে। কারণ ২১শে ফেব্রুয়ারির ঢাকা আর ১৯শে মে শিলচরের ভাষাশহীদরা তারই ভাষাতুতো দাদাদিদি। হায়রে! এরা জানেনও না, তার বহু আগেই মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীতে তামিল ভাষার স্বাধিকারের দাবীতে দলেদলে সাধারণ তামিল জনতা পুলিশি অত্যাচারকে পরোয়ানা করেই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।
অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও একটু সেই অজানা ইতিহাসটা একটু ছুঁয়ে দেখা যাক। ভারতবর্ষ তখনো পরাধীন। ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে জিতে কংগ্রেস সরকার গঠন করল মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীতে। না, তখনও তামিলনাড়ু বলে কোন রাজ্য ছিল না। ১৪ই জুলাই চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন। আর এক মাসের মধ্যেই ১১ই আগস্ট সমস্ত স্কুলে বাধ্যতামূলক হিন্দি শিক্ষার নীতি ঘোষণা করা হলো। সঙ্গে সঙ্গেই গোটা মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী জুড়ে শুরু হয়ে গেল গণবিক্ষোভ। আন্দোলনের সর্বজনগ্রাহ্য নেতা হয়ে উঠলেন ই ভি রামস্বামী পেরিয়ার। সত্যাগ্রহ, অনশণ, ধর্না ইত্যাদির মাধ্যমে গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আন্দোলন দমন করার জন্য সরকারও পিছিয়ে রইল না। ১১৯৮ জন আন্দোলনকারী গ্রেপ্তার হলেন। এদের মধ্যে ৭৩ জন মহিলা ও ৩২ জন শিশুরও কারাদণ্ড হলো। জেলখানায় থালামুথু ও নটরাজন নামে দুই আন্দোলনকারীর মৃত্যুও হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৪০ সালে গভর্নর সরকারি নির্দেশ প্রত্যাহার করেন।
যদি ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে হয় তাহলে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীর এই আন্দোলনের কথাই সবার আগে আসা উচিত। এবং ভারতীয় সংবিধানে যে ত্রি-ভাষা সূত্র রাখা হয়, তার পিছনেও তামিল চাপটাই ছিল সবথেকে বেশি। মাথায় রাখতে হবে স্বাধীনতার আগেই গণ পরিষদ ও ভবিষ্যৎ সংবিধানের একমাত্র ভাষা হিসাবে হিন্দিকে বেছে নেবার দাবী উঠেছিল। এই দাবির সমর্থনে ১৯৪৬ সালের ১০ ডিসেম্বর পণ্ডিত রঘুনাথ বিনায়ক ধুলেকরগণ পরিষদের বক্তৃতায় বলেন – “People who do not know Hindustani have no right to stay in India. People who are present in the House to fashion a constitution for India and do not know Hindustani are not worthy to be members of this assembly. They had better leave” (Constitution Assembly Debates – Official Report, LokSabha Secretariat, 1988, Volume – I, P-26-27)।এই পরিস্থিতিতেও যে ভাষা কমিশনের হাত ধরে শেষ পর্যন্ত ত্রি-ভাষা সূত্র সরকারিভাবে গৃহীত হয়েছিল, তার জন্য প্রধান চাপ এসেছিল দক্ষিণ ভারত থেকেই।
ভাষা একটা অঞ্চলের মানুষের মানসিক ও দৈনন্দিন কাজকর্মের প্রধান সংযোগসূত্র। আবার সেই ভাষাই হয়ে ওঠে আত্মনিয়ন্ত্রণ কিংবা অবদমনের হাতিয়ার। অর্থাৎ ভাষা একটা রাজনৈতিক অস্ত্রও হয়ে উঠতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে যে রক্তদানের ঘটনা ঘটেছিল, মাত্র উনিশ বছরের মধ্যেই তার পরিণতি ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়। এই একটা ঘটনাই চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয় ভাষার রাজনৈতিক গুরুত্বের কথা। এই ঘটনাটা হয়তো একটা চরম উদাহরণ। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভুত্বের প্রয়োজনে ভাষাকে ব্যবহার করার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। আবার স্বকীয়তা নির্মাণের জন্য ভাষাকে অবলম্বন করাটাও। মধ্যযুগের ইউরোপে এই কারণেই ছিল ল্যাটিনের দাপট, পোপ-সম্রাট যুগলবন্দীর ক্ষমতার বাহন হিসাবে। যেমন প্রাচীন ভারতে ছিল সংস্কৃতের অপ্রতিহত প্রতাপ কিংবা পরবর্তীকালে ফারসির।
ভাষার সঙ্গে জনগোষ্ঠীর আবেগ, অনুভূতি কিংবা ইতিহাস জড়িয়ে থাকে। সেটাই স্বাভাবিক। যে ভাষার জন্য একজনেরও অন্তর কাঁদে না, সেই ভাষা যতই দাপুটে হোক না কেন, আসলে মৃত। তার কোন ভবিষ্যৎ নেই। আবার একটা ভাষার বিবর্তন মানে একটা ভৌগলিক অঞ্চলের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারাভাষ্য। কথাটা শুনতে কানে হয়তো খটকা লাগছে। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে যে কথাটা পুরো সত্যি। ডলপুতুলের মতো যেসব সুন্দরীদের দেখলে আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই, কখনো ভেবে দেখেছেন কি, ইংরেজরা এদেশে না এলে এই ডলউপমাটা তাদের মুকুটে আর জুটতই না! এমনটাই হয়। হিন্দু-বাঙালীর ঘরের বাচ্চারা তাই বাবা ডাকে; অথচ শব্দটা আদ্যন্তফারসি। আবার মুসলিমরা বলেন আব্বা, যে শব্দটা আবার আরবির বিকৃত উচ্চারণ। এই দুটো আমদানিই সম্ভব হয়েছিল ভারতে তুর্ক আগমনের ফলেই।
ইতিহাস দেখিয়ে দেয়, একটা জনগোষ্ঠীর উপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে সামাজিক বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভাষা ও সাংস্কৃতিক অবদমন খুব জরুরী। এই জন্যই একটা দেশ দখল করার পর বিজয়ী শক্তি সেই দেশের উপর নিজেদের ভাষা চাপিয়ে দেয়। এইভাবেই ভারতে ক্রমান্বয়ে সংস্কৃত, ফার্সি বা ইংরেজির দখলদারি হয়েছে। আবার সেই ক্ষমতার প্রতিষ্পর্ধী জনসত্ত্বার পরিচিতি হিসাবেই আঞ্চলিক ভাষাগুলোর জন্ম ও বিকাশ হয়েছে। এই টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েই ঘটেছে প্রতিটা ভাষার বিকাশ ও পরিবর্তন। যে পরিমাণেঅর্থনীতি ও রাজনীতির পট-পরিবর্তন হয়, সেই মাত্রাতেই একটা জনগোষ্ঠীর ভাষা বদলে বদলে যায়। যে ভাষায় অন্তত হাতগুনতি কিছু মানুষও কথা বলে, তাদের সবার ক্ষেত্রেই এটা ঘটতে বাধ্য। কারণ তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের সংযোগ সাধনের জন্যই ভাষা। যেভাবে আশপাশ বদলায়, সেভাবেই সংযোগের কথন বদলায়, বদলায় শব্দের চরিত্র। আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা জানতেনই না – মেট্রো রেলের কাউন্টার থেকে যে টিকিট কাটা হয়, সেগুলো আসলে প্লাস্টিকের চাকতি। আমিও জানি না – চতুষ্পাঠীতে পাঠান্তে ব্যোপদেবের ভুর্জপত্রের পুঁথি কীভাবে শালুতে মুড়ে রাখতে হয়।
কাজেই আজকের পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা যে দুই শতাব্দী আগের বাংলার সাথে মিলবে না, সেটাই বাস্তব এবং সেটাই কাঙ্খিত। সমস্যাটা সেখানে নয়। বিবর্তনের সীমানা ছাড়িয়ে আজ বাংলা ভাষা অবলুপ্তির সম্ভাবনার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকেই হয়তো আপত্তি জানাবেন, ধুর, এটা আবার হয় নাকি! দুই বাংলা, ঝাড়খণ্ড, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার, আন্দামান, ছত্তিশগড় মিলিয়ে কমসে কম তিরিশ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাহলে বাংলা ভাষা অবলুপ্তির চক্করে পড়ে গেছে কথাটা তো ভিত্তিহীন। আজ্ঞে না। মুখের কথা আর ব্যবহারিক ভাষা এক জিনিষ নয়। ধরুন বিহার। যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয়, বিহারের অধিকাংশ মানুষ কোন ভাষায় কথা বলেন, আপনারা একসুরে উত্তর দেবেন, হিন্দি। পুনশ্চ, না। বিহারের অধিকাংশ মানুষ হিন্দিতে কথা বলেন না। জনসংখ্যার হিসাবে সব থেকে বেশি মানুষের কথ্যভাষা হলো ভোজপুরি; তারপর ক্রমান্বয়ে মৈথিলী, মগহি বা মাগধী এবং অঙ্গিকা। কিন্তু একমাত্র মৈথিলী বাদে আর একটি বিহারী ভাষারও সাংবিধানিক মান্যতা নেই। বিহারের সরকারি ভাষা হলো হিন্দি ও উর্দু। যাবতীয় সরকারি কাজ ইংরেজি ছাড়া এই দুটি ভাষাতেই হয়। পড়াশুনোর মাধ্যমও তাই।
সঙ্গে সঙ্গেই অনেকেই নিশ্চয়ই আঙুল উঁচিয়ে বলবেন, এতটা খারাপ অবস্থা বাংলার কখনই নয়। নয়, ঠিকই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা; যাবতীয় সরকারি কাজ বাংলাতেই হয়। এপারেও বাংলারাজ্যস্তরের সরকারি ভাষা; ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও সরকারি কাজ হবার কথা। কথা, ঐ কথা পর্যন্তই। পঞ্চায়েত বা স্থানীয় প্রশাসনিক স্তরে দরখাস্ত বাংলায় করা যায়। কিন্তু ফাইলের কাজকর্ম হয় সেই ইংরেজিতেই। আর সর্বোচ্চ স্তরের কাজে বাংলার কোন স্থানই নেই। যাবতীয় সরকারি আইন, বিধি বা নির্দেশ প্রকাশ পায় ইংরেজি ভাষাতেই। পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী রাজ্য সরকারি আধিকারিকদের অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ের সঙ্গে হিন্দির একটা পরীক্ষা দিতে হয়; যাতে কৃতকার্য না হলে স্থায়ীকরণ হয় না। এতদিন সে পরীক্ষা খুব নমোনমো করেই হতো। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, সেই পরীক্ষাতে নাকি প্রতিটি প্রশ্নে নির্ধারিত নম্বর না পেলে ফেল করিয়ে দেওয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গের অ-বাংলাভাষী কর্মচারীদের বাংলা ভাষার পরীক্ষাতেও পাশ করতে হয়। সেখানে কিন্তু কোনো বজ্র আঁটুনির গল্প শোনা যাচ্ছে না। কেন?
এখানেই আদত প্রশ্ন। তাহলে কি বাংলার ব্যবহারিক প্রয়োজন কমছে? একটা আঞ্চলিক পরিসংখ্যান নিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১৯৯০ সালে উত্তর চব্বিশ পরগনার জেলা সদরে অনুমোদিত ইংরেজি মাধ্যম সেকেন্ডারি স্কুল ছিল মাত্র একটা। সেই সংখ্যাটা বর্তমানে আট। আর এই সাতাশ বছরেবাংলা মাধ্যম অনুমোদিত স্কুলের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র দুই। প্রতিটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলই বেসরকারি। তারা নিশ্চয়ই জনসেবার জন্য স্কুল খোলেনি; খুলেছে ব্যবসার জন্য। একজনের ভালো ব্যবসা হচ্ছে দেখেই বাকিরাও লাফ দিয়ে চলে এসেছে। ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে কেন? কারণ আজ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী বাবামায়েরাও মনে করছেন, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে গেলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনো বাধ্যতামূলক। এই যে সাংস্কৃতিক বিচলন, এটাকে মাথায় না রাখলে বাংলা ভাষার সঙ্কটকে বোঝা যাবে না। এই সমস্ত স্কুলের বাঙালী ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ বাংলা পড়ে ক্লাস এইট পর্যন্ত, নবম-দশম ক্লাসে হাতগুনতি বাচ্চারই দ্বিতীয় ভাষা থাকে বাংলা। ভাবুন, রাজ্যটার নাম পশ্চিমবঙ্গ; জেলাটার নাম উত্তর চব্বিশ পরগনা; শহরটার নাম বারাসাত, যেখানে পাঁচ বছর ছিলেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র।
কেন এটা হতে পারছে? শিক্ষা নিয়ে যতই বড় বড় গালভরা কথা বলা হোক না কেন, মানুষ আসলে শিক্ষায় আগ্রহী হয় উপার্জনের সুবিধার জন্য। বোধের বিকাশ ইত্যাদি আনুষঙ্গিক প্রাপ্তি; হলেও হলো, নাহলেও ক্ষতি নেই। তাহলে আজ বাঙালী বাবামায়েরা মনে করছেন, তাদের ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত জীবিকা অর্জন করতে হলে বাংলাকে পরিহার করতে হবে। মোদ্দা কারণ বোধহয় এটাই যে পশ্চিমবঙ্গে বসে উচ্চস্তরের জীবিকা সংগ্রহের সম্ভাবনা দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কোনো বিশেষ দলের প্রতি আঙুল না তুলেই বলা যায়, ভারতের আর্থিক মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। আর এইজন্যই পশ্চিমবঙ্গের যুবকযুবতীরা দলে দলে চলে যাচ্ছে তামিলনাড়ু, হরিয়ানা কিংবা কর্ণাটক। স্বভাবতই ইংরেজিতে তাদের দক্ষতা বা অনর্গল কথা বলতে পারার ক্ষমতা বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু তার সাথে বাংলা না পড়ার সম্পর্ক কোথায়?
এখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মাথায় রাখতে হবে। চাকরির প্রয়োজনে বাঙালী সুদূর অতীতেও ভারতবর্ষের সর্বত্র দৌড়েছে। তাতে বরং বাঙালীর সাংস্কৃতিক পতাকাই ছড়িয়েছে। বাংলা সাহিত্যের চর্চা হয়েছে ভাগলপুর থেকে ইম্ফল, সর্বত্র। আর আজ বাঙালীর ছেলেমেয়ে স্রেফ পড়ার জন্য দৌড়চ্ছে বেঙ্গালুরু থেকে ভুবনেশ্বর, দিল্লী থেকে গুয়াহাটি। এটাই বাঙালীর সাংস্কৃতিক জীবনে একটা মস্তবড় ধাক্কা দিয়েছে। আর তার হাত ধরেই এসেছে বাংলা ভাষার প্রতি টান কমে যাওয়া, বাংলা সাহিত্যের চর্চা, বাংলা বই না পড়ার প্রবণতা। আজ বাঙালীর সুযোগ্য পুত্র রেগে গিয়ে ধেত্তেরেকি না বলে উগড়ে দেয় শিট। সে অবশ্য বাঙালী তার বাছাবাছা গালিগালাজের জন্য চিরকালই হিন্দুস্থানী ভাষার কাছে ঋণী। কিন্তু আজ বাঙালীর সন্তান “মমোতা”র বদলে উচ্চারণ করেন “মম্ তা”। খেয়াল করেছেন? হিন্দি উচ্চারণ রীতি কীভাবে গ্রাস করছে আমাদের সন্তানদের? আমরা হিসাবেই রাখি না। কারণ আমরা তো গর্বের সাথে বলি, বাংলাটা খুব টাফ বলে বাচ্চাকে হিন্দিতেই ঠেলে দিলাম।
মাতৃভাষা টাফ? তাহলে তো সেই মানবককে গরুছাগলের ভাষাতেই কথা বলতে দেওয়া উচিৎ। না, এমন কথার কোনো প্রতিবাদ আমরাও করি না। কারণ ভিতরে ভিতরে আমরাও জেনে গেছি, যে ভাষাচর্চায় স্রেফ স্কুলমাস্টারি ছাড়া অন্য কিচ্ছু জোটানো সম্ভব নয়, বিশ্বায়নের যুগে তা স্রেফ অচল। বাংলা ভাষার আসল সঙ্কট এখানেই। বাংলা নিশ্চিতভাবেই সাধারণের মুখের ভাষা হিসাবেই থাকবে। কিন্তু ব্যবহারিক প্রয়োজন যদি এইভাবে কমতে থাকে, তাহলে বাইরের প্রয়োজনে বাংলা না পড়ার প্রবণতা আরো বাড়বে। সেক্ষেত্রে একটা আইনি প্রতিবিধান হয়তো খানিকটা কার্যকরী হতেই পারে। কিন্তু সবার আগে চাই একটা সাংস্কৃতিক উত্থান, আন্দোলন। কিন্তু সেই মানসিক বাতাবরণ কি আজ আর আদৌ অবশিষ্ট আছে?
পূর্ব পাকিস্তান ভাষা আন্দোলনের পথ খুঁজে নিয়েছিল বাইরে থেকে জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেবার কারণে। আসামের বরাক উপত্যকাও পথে নেমেছিল বাংলা ভাষার উপর সরকারি জবরদস্তির কারণে। দুই ক্ষেত্রেই বাইরে থেকে এমন এক ভাষাকে চাপানোর চেষ্টা হয়েছিল যা বাঙালীর স্বাভাবিক অর্জন নয়। কিন্তু আজ তো বাঙালী নিজেই তার ভাষার উত্তরাধিকার খারিজ করে দিচ্ছে। বাঙালী নিজেই গর্ব অনুভব করছে, তার সন্তান বাংলা পড়তে পারে না। এই আত্মঘাতী অবক্ষয় যখন সবকিছু গ্রাস করতে চায়, তখনই ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। হয়তো আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের দেখতে হবে তৃতীয় ভাষা আন্দোলনের মিছিল, পশ্চিমবঙ্গের বুকেই। হয়তো আমাদেরও মিছিলে গলা ফাটিয়ে বলতে হবে – বাঙালী, বাংলা বলো; বাঙালী, বাংলা পড়ো।
লজ্জার সাথে স্বীকার করতেই হচ্ছে, দ্বিমত হওয়ার জায়গা নেই।
ReplyDelete