গল্প - অরিজিৎ গাঙ্গুলি
Posted in গল্প
গল্প
আপনার আজকের দিনটি
অরিজিৎ গাঙ্গুলি
সকালের চা আর সঙ্গে ঠিক দু'খানা মেরি বিস্কুট - এই দুটো অনাথবাবুর রোজকার অভ্যাস। বিস্কুটগুলো চায়ে ডুবিয়ে হালকা কামড় দিয়ে তিনি দিন শুরু করেন। চা খেতে খেতে খবরের কাগজে চোখটাও বুলিয়ে নেন একবার। তবে অনাথ বিশ্বাসের অগাধ বিশ্বাস কাগজের দ্বিতীয় পাতার ছোট্ট একখানা সেকশানের ওপর।
"আপনার আজকের দিনটি!"
বিয়ে করেননি। উপায় থাকলেও ইচ্ছের কথা জানাবার আগেই বাবা মা ওপারে চলে যান। তাই আপাদমস্তক ভীতু অনাথবাবুর এই লাইফ রিস্কটা আর নেওয়া হয়ে ওঠেনি, হয়তো বেঁচেই গেছেন। দিনের শুরুতেই আগাম পূর্বাভাস দেখে প্ল্যানিং সেরে ফেলেন। মিলে যাওয়ার স্ট্যাটিস্টিক্স ও বেশ ভালো। অন্তত অনাথবাবু তো সেরকমই মানেন।
তবে আজকের ধনু রাশির প্রেডিকশান কিন্তু বেশ গোলমেলে।
"বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর!"
অদ্ভূত ব্যাপার। আজ পর্যন্ত এইরকম লেখা তো দেখেননি আগে। বেশ থাকতো, "আত্মীয়ের সাথে গোলযোগ, উদর পীড়া, দিনের দ্বিতীয় ভাগে মানসিক শান্তি , বায়ু পিত্ত কফের লক্ষণ, কর্মসূত্রে বিদেশভ্রমণ, বকেয়া অর্থ প্রাপ্তি..." এইসব। তবে আজ কি ছাপতে ভুল করল!
||
বাড়ি থেকে বেরোবার সময় এই রোজকার শনিদর্শন থেকে মুক্তি পান না অনাথবাবু। মুখভর্তি পেস্ট আর গেঞ্জি তোলা ভুঁড়ি নিয়ে নলেন পোদ্দারের ফোকলা হাসি আর সাথে ব্রাশ উঁচিয়ে 'গুড মর্নিং' উইশ। একটা দিনও নিস্তার নেই।
অনাথবাবু গেটে তালা দিয়ে সোজা তাকিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন এই ভেবে যে ডাক পড়ল বলে। কিন্তু অনেকটা এসেও কোনও 'গুড মর্নিং' তো শুনতে পেলেন না। পিছন ফিরে দেখলেন নলেনবাবু একই পজিশনে দাঁড়িয়ে ওঁর দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। ভদ্রলোক কি শুধরে গেলেন নাকি। অনাথবাবু মুচকি হাসলেন ওঁর দিকে তাকিয়ে। কিন্তু নলেনবাবু যেন দেখেও দেখতে পেলেন না।
||
পানুদার সিডির দোকানের পাশেই বকার পান বিড়ির স্টল। টোটোতে ওঠার আগে একটা গোল্ড ফ্লেক মাস্ট অনাথবাবুর। টাকার নোটটা বাড়িয়ে ডাকলেন,
"বকা, জলদি দে, বাসের টাইম হয়ে এসেছে।"
৯ টা ২৫ এর বাসটা ধরতে না পারলে অনেক হ্যাপা। বসে থাকতে হবে আরও আধঘন্টা। তারপর ব্রেক জার্নি।
"কিরে শালা, নোটটা ধরে দাঁড়িয়েই থাকব নাকি?" হুঙ্কার ছাড়লেন অনাথবাবু।
বকা একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার মন দিল পানের পাতায়। পাশ থেকে একটা লোক এসে বিড়ি চাইতেই প্যাকেট বার করে পয়সা নিয়ে নিল বকা।
মটকা গেল গরম হয়ে। "আমাকে অ্যাভয়েড করছিস নাকি রে বকা?" বলে সামনে রাখা পানের পাতাগুলোর ওপর হাত চাপড়ালেন অনাথবাবু। চমকে উঠল বকা। পানের পাতাগুলোর দিকে একবার তাকালো। আর রাস্তার দিকে দেখল। তারপরেই দু'হাত জোড় করে তাকে রাখা মা কালির ছবিতে মাথা ঠেকিয়ে রইল।
||
ঘুমটা ভেঙেছে তো? নাকি স্বপ্ন। সবাই আজ এইরকম ব্যবহার করছে কেন! ভাবতে ভাবতে বাসস্টপের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন অনাথবাবু।
ফুটপাথ থেকে হকারদের সরিয়ে বেশ কাজ দিয়েছে। শান্তিতে হাঁটা যায়। ভিড়টাও কম এদিকে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বেশ হাঁটছিলেন, কিন্তু হঠাৎ সামনে থেকে আসা লোকটা সজোরে ধাক্কা মারল কানার মতো। বোঁ করে ঘুরে গিয়ে রাস্তায় পড়লেন অনাথবাবু। বুকে হাত দিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন সামনের লোকটা ঘাবড়ে গিয়ে রাস্তার এদিক ওদিক দেখছে। কোনওরকমে খিস্তি সামলে অনাথবাবু বললেন, "কানা নাকি? দেখে রাস্তা চলতে পারেন না?" লোকটা যেন দৈববাণী শুনল। উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক তাকিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল।
||
নাহ্, আজকে কোথাও যেন তাল কাটছে কিছুর। কেউ কি তাকে দেখতে পাচ্ছে না? চিমটি কাটলেন একটা নিজেকে সজোরে। বেশ ব্যথা করে লাল হয়ে গেল জায়গাটা। আজগুবি কাণ্ডকারখানায় বাসটা গেছেন মিস করে। অগত্যা বসতে হলো বাসস্টপের বেঞ্চে। পরের বাস ১০ টা ১৫ তে।
খুব একটা ভিড় নেই এদিকে। মনে হয় আগের বাসেই সবাই চলে গেছে। বেঞ্চে ওঁর আশেপাশে গোটা পাঁচজন। জায়গা এখনও খালি বেশ কটা। পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখটা মুছতে যাবেন অনাথবাবু, হঠাৎ খেয়াল করলেন স্থূলকায় এক ভদ্রমহিলা এগিয়ে আসছেন ওঁর দিকে। এক হাত সামনে এসে উনি পেছন দিকে ঘুরলেন এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বসে পড়লেন অনাথবাবুর কোলে।
"আরে আরে, করছেন কি?"
চমকে লাফিয়ে উঠলেন ভদ্রমহিলা, যেন গরম লোহার ওপর বসে পড়েছিলেন। উঠেই সিটটার দিকে তাকালেন। হাত বাড়ালেন অনাথবাবুর পেটের দিকে, কিন্তু আবার সরিয়েও নিয়ে চলে গেলেন বেঞ্চের অন্যপাশে। যেন দেখতেই পেলেন না অনাথবাবুকে।
||
পাবলিক টয়লেটের ভেতর আয়নাটা জল দিয়ে পরিস্কার করলেন। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নিজেকে। মরে গিয়ে যদি ভূতই হয়ে যেতেন, তাহলে আয়না কেন, ছায়াও পড়ত না মাটিতে। আরও সিওর হওয়ার জন্য মোবাইল বার করে সেলফি তুললেন একটা। এই তো, কেমন সুন্দর ছবি এল, যদিও চোখেমুখে বেশ টেনশনের ছাপ।
দাঁড়িয়ে ভাবলেন দু-মিনিট। তারপর মনস্থির করে রাস্তায় নেমে পড়লেন।
~~||~~||~~||~~
কফির কাপটা টেবিলে রেখে সুমন বলে উঠল,
দেখ, যা হয়েছে সেটা একটা আনএক্সপেক্টেড ঘটনা। অনাথবাবুর ভয়-এর থেকেও আমাদের বেশি চিন্তা ছিল ওই বাসস্টপের বৌদিকে নিয়ে, কিন্তু উনি ওনার খেল দেখিয়ে দিয়েছেন।
- কিন্তু সুমনদা, লোকটার জন্য সিরিয়াসলি খারাপ লাগছে। ওইভাবে ট্যাক্সির সামনে লাফিয়ে পড়ল!
- দেখ, আমরা এটা এক্সপেক্টই করিনি। একটা ভিতু মানুষের পক্ষে নিজে বেঁচে আছে কিনা দেখার জন্য চলন্ত ট্যাক্সির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া খুবই আনপ্রেডিক্টেবল। এমন কিছু যে একটা হয়ে যাবে সেটা কি আমরা কাজটা শুরু করার আগে ভেবেছিলাম? তবে যাই হোক, ওনার আত্মার শান্তি কামনা করে চল আমরা এগিয়ে চলি। কেস স্টাডিটা বানিয়ে ফেলিস। সোশাল এক্সপেরিমেন্ট থামালে চলবে না।
- তাহলে পরের প্রোজেক্টের এজেন্ডা আর টার্গেট কি সুমনদা? কিছু ভেবেছ?
- হুম্, পরেরটা বেশ ইন্টারেস্টিং। টার্গেটের নাম রতনলাল মজুমদার। বয়স ৫০ এর বেশি নয়, কলকাতার জিওলজিকাল সার্ভে অফিসের কেরানি। বছরে একবার লম্বা ছুটি নিয়ে উদ্ভট সব জায়গায় বেড়াতে যান। এবারে যাচ্ছেন টাটানগর থেকে ১৫ মাইল দূরে সিনি শহরে।
- ওক্কে, প্ল্যানটা কি?
- একটা লোকের সামনে যদি ঠিক তারই মতো একদম হুবহু কাউকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় যার আচার ব্যবহার, চালচলন, ভালোলাগা, মন্দলাগা সব এক, তাহলে টারগেটের কি রিঅ্যাকশন হয় সেটা দেখাটাই এবারের এক্সপেরিমেন্ট আমাদের।
- কিন্তু লোকটার ব্যাপারে এত খবর জানা যাবে কি করে?
- হুঁ হুঁ বাবা, আমার বন্ধু অনুকূল মিত্তিরের থেকে সব যোগাড় করেছি। ওকেও আমাদের দলে টানলাম বুঝলি। টারগেট কে ট্যুরিস্ট স্পটের সাজেশান আর সেখানকার নিউ মহামায়া হোটেলের রেফারেন্সও ওরই দেওয়া, একই অফিসে কাজ করে তো।
- সবই তো বুঝলুম সুমনদা, কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা কে বাঁধবে? ওনার মতো দেখতে কে আছে আমাদের মধ্যে?
- কালই গোঁফখানা ছাঁট দিয়ে এসেছি। এই অধমের চেহারা ওনার চেহারার সাথে একদম এক। এই দেখ ছবি।
- এ তো অবিকল এক, পুরো যমজ মনে হচ্ছে!
- হেঁ হেঁ, তবে আর বলছি কি। আমার ছদ্মনামও একটা ভেবে রেখেছি, মণিলাল মজুমদার, রতনলালের সাথে মিলিয়ে।
- ফাটাফাটি, তা প্রোজেক্টের নাম কিছু একটা ভেবেছ?
- ভেবেছি তো,
"রতনবাবু আর সেই লোকটা"।
0 comments: