Next
Previous
Showing posts with label গল্প. Show all posts
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in







দ্বাদশ পর্ব

ক্লাইভের পলাশি অভিযান

২২শে জুন অর্থাৎ পলাশি যুদ্ধের আগের দিন ১৭৫৭ সকাল ৭টা নাগাদ ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী যাত্রা শুরু করে প্রথমে ভাগীরথী অতিক্রম করলো। অবিরাম বৃষ্টিতে জলে কাদায় পিচ্ছিল সমস্ত মাঠঘাট। জলীয় বাষ্পে ভারি হয়ে ওঠা বাতাসে উড়ন্ত বস্তুর গতি স্তিমিত হয়ে পড়ছে। বড় বড় ঘাসের নিচে জমে থাকা জল আর কাদা অতিক্রম করে পথ হাঁটা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝেই ঝমঝম করে বৃষ্টি আসছে। এরই মধ্যে দিয়ে ক্লাইভের বাহিনী প্রায় তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে একটু বিশ্রামের জন্য দাঁড়াল। বাহিনীর পিছিয়ে পড়া সৈন্যদের মূল বাহিনীতে এসে যোগ দিতে একটু সময়েরও দরকার। তারপর বিকাল ৪টায় যাত্রা শুরু করে এমনিভাবেই হাঁটতে হাঁটতে ,থামতে থামতে যখন ক্লাইভের বাহিনী পলাশির আমবাগানে পৌঁছল তখন মধ্যরাত্রি।

দৃশ্যতই ক্লাইভ সেদিন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।তার প্রমাণ পাওয়া যায় সেদিন মিরজাফরের কাছ থেকে খবর আসার আগে এবং পরে মিরজাফরকে লেখা দুটো চিঠিতে। সকালে লেখা ক্লাইভের প্রথম চিঠির বয়ান অনেকটা এইরকম,

‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি যদিও আমি জানি আপনি এখনও আমাদের সঙ্গে পুরোপুরি সহযোগিতা করছেন না।আমি আজ নদী অতিক্রম করে পলাশি পৌঁছব। আপনি যদি পলাশিতে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন তবে আমি আরও এগিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব। তখন নবাব এবং তার সেনাবাহিনীর বুঝতে বাকি থাকবে না যে আমি আপনার পক্ষে যুদ্ধে প্রস্তুত। আপনি চিন্তা করে দেখুন এটা আপনার পক্ষে কতটা সম্মানের এবং গৌরবের। আপনি যদি আসেন তা হলে রাজসিংহাসন আপনার।আর যদি না আসেন তাহলে ঈশ্বর সাক্ষী থাকবেন যে সিরাজের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করার জন্য আমার কোনও দোষ নেই। আমি আপনাকে কী করে বোঝাব যে আপনার সাফল্য এবং মঙ্গল আমারও সাফল্য এবং মঙ্গল।‘

ক্লাইভের সেনাবাহিনী যখন নদী অতিক্রম করল তখন মিরজাফরের চিঠি এসে পৌঁছল ক্লাইভের হাতে।

‘রবিবার আমি শহর থেকে যাত্রা শুরু করেছি। পথের মধ্যে আমনিগজ্ঞে একরাত্রি থেকে আরও কিছু সৈন্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছি। নবাব আজ তারকপুর থেকে সসৈন্য যাত্রা শুরু করে মানকারাতে সেতুর পাশে তাঁবু ফেলেছেন। আল্লার কৃপায় আমি কাল যাত্রা শুরু করে মঙ্গলবার পৌঁছে যাব। আমার থাকার ব্যবস্থা আপনার তাঁবুর কাছাকাছি হলে ভাল হয়। আমার মনে হয় যতশীঘ্র সম্ভব মানকারে আক্রমণ করলে ভালো হয়। তাহলে নবাব আক্রমণের পরবর্তী পরিকল্পনা করার সময় পাবে না। তার আগেই আত্মরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আপনি এখনও পরিকল্পনার মধ্যে আছেন। এখন পরিকল্পনা নয় , আক্রমণের সময়। আপনি আর একটু এগিয়ে এলেই আমি আপনার সঙ্গে যোগদান করব। যদি আপনি কাশিমবাজারের দিকে দু-তিনশো সৈন্য পাঠিয়ে দেন তাহলে নবাবের সৈন্যরা পিছু হটতে শুরু করবে। সেক্ষেত্রে বাকি যুদ্ধ আমাদের পক্ষে অনেক সহজ হয়ে উঠবে। আপনার সঙ্গে দেখা হলে আরও কিছু গোপন খবর দেব। আমাকে জানান আপনি কখন যুদ্ধ শুরু করছেন।‘

যে গুপ্তচর চিঠি নয়ে এসেছিল তার হাতে মিরজাফরের উদ্দেশ্যে ক্লাইভ সন্ধ্যাবেলা আর একটি চিঠি পাঠাল। এই গুপ্তচর ছিল মিরজাফরের অত্যন্ত বিশ্বস্ত আমির বেগ। এই আমির বেগই সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় ব্রিটিশ মহিলা এবং শিশুদের পালাবার ব্যবস্থা করে ব্রিটিশদের আস্থা অর্জন করেছিল। এই চিঠিতে যা লেখা ছিল তা মোটামুটি এইরকম,

‘আপনার চিঠি পেয়ে আমি এখনই পলাশির উদ্দেশ্যে যাত্রা করব বলে মনস্থ করেছি।আমার পক্ষে যা করা সম্ভব সব করেছি। আমার আর কিছু করার নেই। আপনি যদি দাউদপুরে আসেন তাহলে আমি পলাশি থেকে দাউদপুরে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব।যদি না আসেন তাহলে নবাবের সঙ্গে আপস করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।‘

২৩শে জুন ভোরবেলা তিনটে নাগাদ সিরাজের বাহিনী পলাশি পৌঁছল। পৌঁছবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাইভ এবং তার দলবল বুঝতে পারল যে সিরাজ এবং তার বাহিনী ইতিমধ্যেই পলাশি পৌঁছে গেছে। আমবাগানে নিজেদের গুছিয়ে নেবার আগেই ক্লাইভকে অবাক করে ক্রমাগত ভেসে আসতে লাগল ড্রাম, সিঙ্গা, মাদলের আওয়াজ। এই আওয়াজ যে নবাবের সেনাবাহিনীর রাতপ্রহরীদের কাছ থেকে আসছে সে কথা ক্লাইভের বুঝতে বিলম্ব হল না। ক্লাইভ এও বুঝলো যে নবাবের বাহিনী এক মাইলের মধ্যেই আছে। আসলে সিরাজের কাছে যখন খবর এসেছিল যে ব্রিটিশরা কাটোয়া দখল করে নিয়েছে তখন সে বুঝেছিল যে এবার ওরা সব শক্তি নিয়ে মুর্শিদাবাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাই মানাকারতে ঘাঁটি করার পরিকল্পনা পরিবর্তন করে দ্রুতগতিতে পলাশি পৌঁছে যাবার পরিকল্পনা করেছিল সিরাজ। ব্রিটিশরা পৌঁছোবার বারো ঘন্টা আগেই সকলের অজান্তে পলাশি পৌঁছে যায় সিরাজ এবং তার বাহিনী। ক্লাইভের কাছে খবর ছিল সিরাজের সৈন্যসংখ্যা প্রায় ছ’ হাজার, ক্লাইভের সৈন্যসংখ্যার চেয়ে অন্তত এক হাজার বেশি। সেইজন্য যুদ্ধজয়ের ব্যাপারে ক্লাইভ সেইমুহূর্তে খুব একটা আশাবাদী ছিল না।

ক্লাইভের নির্দেশমতো সেনাবাহিনী যথেষ্ঠ সাবধানতার সঙ্গে নিজের নিজের জায়গায় পৌঁছে গেল। ২০০ ইউরোপিয়ান, ৩০০ সেপাই এবং দুটো কামান পলাশি হাউসের সামনে রাখা হল। এই পলাশি হাউস হল পলাশির আমবাগানের উত্তর পশ্চিমে নবাবের শিকারাবাস। ব্রিটিশ সেনারা এই খালি বাড়িটাকে দখল করে নিজেদের আস্তানা বানিয়ে নিল। বাড়িটা চারদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।আমবাগানের চারদিকে সেপাই মোতায়েন করা হল। পলাশি হাউসের অভ্যন্তরে সুরক্ষিত ক্লাইভ তিন বিশ্বাসঘাতকের অপেক্ষায় মুহূর্ত গুনতে থাকলো। এই তিন বিশ্বাসঘাতক হলো যথাক্রমে মিরজাফর, রাইদুর্লভ রাম এবং ইয়ার লতিফ।এই ইয়ার লতিফই নবাব হওয়ার দৌড়ে কিছুদিনের জন্য অংশগ্রহণ করেছিল। এদের মধ্যে একজনের সাড়া পাওয়া গেছে এখন অবধি। সর্বাগ্রে একটি বাহিনীকে সিরাজ পাঠিয়েছিল যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবার জন্য।অনেকটা এগিয়ে এসে আগে থেকে সবকিছু প্রস্তুত রাখার এবং পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার দায়িত্ব ছিল এই বাহিনীর। এদের নির্দেশ পেলেই বাকি বাহিনী আগে রওনা হবে। এই বাহিনীর দায়িত্বে ছিল রাইদুর্লভ। রাইদুর্লভকে বাইরে থেকে দেখে যতই মনে হোক না কেন যে সে নবাবের আদেশ পালন করছে আসলে সে ব্যস্ত নিজের আখের গুছোতে। ব্রিটিশদের সঙ্গে তার গোপন চুক্তি ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। এছাড়াও মিরজাফরের সঙ্গে চুক্তিতে ভবিষ্যতে নিজের সুবিধার জন্য আরও কিছু সর্ত যোগ করিয়েছে সে। শুধুমাত্র তাই নয় রোজই নিজের বাহিনীর কিছু অফিসারকেও টাকার লোভ দেখিয়ে ব্রিটিশদের দিকে নিয়ে আসছে রাইদুর্লভ। এর ফলে কেবলমাত্র গতির দিক থেকে এই বাহিনী শ্লথ হচ্ছে না, শক্তির দিক থেকেও দূর্বল হয়ে পড়ছে। বলা বাহুল্য যে রাইদুর্লভের ভূমিকায় ক্লাইভ বেশ খুশি। কিন্তু আরও দু’জনকে কাজে লাগাতে না পারলে যুদ্ধজয় অসম্ভব সে কথা ক্লাইভ ভালো ভাবেই জানে।

ওদিকে সিরাজের শিবিরে আতঙ্কের ছায়া। সকলে ভীত, সন্ত্রস্ত। কে জানে কখন কোনদিক থেকে আক্রমণ নেমে আসে। রাইদুর্লভের কাছ থেকে কোনও খবর নেই। প্রহরীপরিবৃত হয়ে সিরাজ অপেক্ষা করছে অনেকক্ষণ কিন্তু কোনও খবর আসছে না। সিরাজের চোখে মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট । সূর্যাস্তের সময় প্রহরীরা যখন প্রতিদিনের মত একে একে সবাই প্রার্থনা করতে গেল সিরাজ একাই অপেক্ষা করছিল শিবিরে। কিন্তু কী হলো কে জানে হঠাৎ উৎকণ্ঠিত সিরাজ প্রাণভয়ে চিৎকার করে প্রহরীদের ডাকতে থাকল আর বলতে থাকলো ‘ কোথায় গেলি তোরা? তোরা কি আমার মৃতদেহ দেখতে চাস? ‘ সিরাজ বোধহয় বুঝতে পেরেছিল যে পরাজয় আসন্ন। আর পরাজয় মানেই যে মৃত্যু তা কে না জানে? সিরাজ যখন জানতে পেরেছিল যে নদী পেরিয়ে ব্রিটিশবাহিনী এগিয়ে আসছে তখন উপায়ান্তর না দেখে দিদিমা সারফুন্নিসাকে পাঠিয়েছিল মিরজাফরের কাছে তার হয়ে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।মিরজাফর খুব ভালোভাবেই জানে সিরাজের কথা এবং কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আর মিরজাফর তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব হবার স্বপ্নে মশগুল। এর পরেও সিরাজ যখন চুনাখালি থেকে বেরিয়ে পলাশির দিকে আসছিল এবং খবর পেল যে মিরজাফর তার বাহিনী নিয়ে মাত্র দু’ক্রোশ দূরে ঘাঁটি গেড়েছে তখনও তার চোখ খোলেনি। সিরাজের একান্ত বিশ্বস্ত মির মদন যে কিনা সিরাজের জন্য হাসতে হাসতে প্রাণ দিতে পারে সেও বলেছিল মিরজাফরের উস্কানিতেই ব্রিটিশরা যুদ্ধে নেমেছে এবং মিরজাফরকে খতম করে দিলে ব্রিটিশদের পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। তখন মির মদনকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল সিরাজ। এছাড়াও সিরাজের আর এক বিশ্বাসী দেওয়ান মোহনলাল রাগে অন্ধ হয়ে সিরাজকে বলেছিল,’ আমার মৃত্যু এবং আমার সন্তানদের অনাথ হয়ে যাওয়ার জন্য তুমি দায়বদ্ধ থাকবে। আমি বলেছিলাম মিরজাফর আর রাইদুর্লভকে কাটোয়া থেকে না সরাতে। ওদের প্রতি তোমার অন্ধ বিশ্বাস আমার মৃত্যুর কারণ হবে।‘

আজ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সিরাজ নিজের মনেই বললো,’ আমি মূর্খ, মোহনলাল। এতসব জেনেও মিরজাফরকে জীবিত রাখা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আমি বেশ বুঝতে পারছি যে এর মূল্য আমাকে জীবন দিয়ে দিতে হবে।ইংরেজদের স্তোকবাক্যে আমি ভুলেছিলাম। কে জানতো যে ইংরেজরা মিথ্যাবাদির জাত? ওদের কথা মরিচীকার মতই অসত্য।কথায় ওরা যতটা মিষ্টি ,কাজে ওরা ততটাই নিষ্ঠুর এবং নির্মম। তোমায় কথা দিচ্ছি,মোহনলাল, যদি কাল সকাল অবধি আমি বেঁচে থাকি আর মিরজাফর ও বাকি নিমকহারামদের সঙ্গে আমার দেখা হয় তবে ওদের আর ওদের পরিবারের সকলের চোখ আমি উপড়ে নেব, ধড় মুন্ডু আমি আলাদা করে দেব।‘

সকাল ৭টা নাগাদ দেখা গেল সিরাজের বিশাল বাহিনী উত্তর, উত্তরপূর্ব এবং দক্ষিণপূর্ব দিক থেকে সারিবদ্ধ ভাবে দু’টি লাইনে এগিয়ে আসছে।ক্লাইভের কাছে যা খবর ছিল তা ভুল প্রমাণ করে প্রায় ৫০০০০ পদাতিক, ১৮০০০ অশ্বারোহী এবং ৫০টি কামান ব্রিটিশ ঘাঁটির দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। ক্লাইভের ঘাঁটির পশ্চিমে ভাগীরথী। তার পাশের আমবাগানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ব্রিটিশ সেনারা। দক্ষিণে বিশাল অঞ্চলব্যাপী ভূখণ্ড জুড়ে রয়েছে সিরাজের তিন সুবিশাল বাহিনী যার নেতৃত্বে আছে তিন নিমকহারাম। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে এই তিনজনই সিরাজের শ্রেষ্ঠ সেনাপতি এবং এই তিনজনের বাহিনীতেই আছে সিরাজের সবচেয়ে বেশি সৈন্য। বাকি সৈন্যরা উত্তরে যাদের নেতৃত্বে মির মদন এবং মোহনলালের এক জামাতা। প্রায় ৭০০০ পদাতিক এবং ৫০০০ অশ্বারোহী বিশিষ্ট এই বাহিনীই এখন সিরাজের ভরসা। কিন্তু এই বাহিনীর মধ্যে কোনও উদ্দীপনা নেই।যুদ্ধের নেশা আর এই দিনমজুর সৈন্যদের রক্ত উত্তপ্ত করেনা। দিশাহীন এই যুদ্ধ তাদের জীবনে বিপদ ছাড়া যে আর কিছু ডেকে আনবে না সে ব্যাপারে বেশিরভাগ সৈন্যই নিশ্চিত। তার ওপর তাদের অনেক টাকা মাইনে বাকি। বাড়িতে অভুক্ত, অর্ধভুক্ত স্ত্রী-পুত্র। বকেয়া টাকা না পেলে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে আসবে না ঠিক করেছিল এরা সবাই। কিন্তু মির মদন এবং মোহনলালের আদেশ অমান্য করতে না পেরে তারা শেষ অবধি অনিচ্ছাসত্ত্বেও আসতে রাজি হয়েছে। এই বাহিনীর সামনে ১১কেজি আর ১৫কেজির অনেকগুলো ছোট কামান আর তার সঙ্গে আড়াই টনের তিনটে বিশাল কামান । এই বড় কামানগুলো মাটি থেকে প্রায় ছ’ফুট উঁচু চাকাওয়ালা প্ল্যাটফর্মের ওপর রাখা। এগুলোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পূর্ণিয়া থেকে নিয়ে আসা ৪০-৫০টি একধরণের বিশেষ প্রজাতির সাদা ষাঁড়। মাঝখানে আছে একটি প্রশিক্ষিত হাতি। কামানবাহী শকট যদি কোনও কারণে রাস্তায় গর্তে পড়ে তাহলে মাথা দিয়ে ঠেলা মেরে তুলে দিচ্ছে হাতিটি। তার পরে আছে চল্লিশজন ফরাসি সৈনিক। এরা ব্রিটিশ আক্রমণের সময় চন্দননগর থেকে পালিয়ে সিরাজের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। এই বিশাল বাহিনী ব্রিটিশ সৈন্যদের থেকে দু’শ গজ দূরে এসে থামলো।

ওদিকে ৭৫০জন সৈন্য এবং ২১০০ সিপাইবিশিষ্ট ব্রিটিশবাহিনী চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পলাশি হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে রইল পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়। এই চার ভাগের নেতৃত্বে আছে মেজর ক্লিপট্রিক, মেজর গ্রান্ট, মেজর কুটে এবং ক্যাপটেন গাপ। এছাড়া ৮টি কামান এবং একটি হাউইতজার।

পলাশি হাউসের ছাদ থেকে চতুর্দিকে লক্ষ্য রাখছে ক্লাইভ স্বয়ং। অন্যদিকে সৈন্যবাহিনীর একদম পিছনে সুরক্ষিত তাঁবুর মধ্যে অসংখ্য প্রহরীপরিবৃত হয়ে অবস্থান করছে সিরাজ। কথিত আছে সেদিন সিরাজকে ঘিরে শুধু প্রহরীরাই ছিল না , ছিল সিরাজের শতাধিক সঙ্গিনী আর উঠেছিল মদের ফোয়ারা। জীবনের অন্তিম সময়েও নারী ও সুরার নেশা সিরাজকে ছেড়ে যেতে পারেনি। ক্লাইভ এবং কুটের কাছে এখনও খবর এসে পৌঁছয়নি যে সিলেক্ট কমিটি অবশেষে মেজর কুটে এবং ক্লাইভের এই অভিযানকে স্বীকৃতি জানিয়েছে।

দাবার ঘুঁটি সাজানো শেষ। এবার যুদ্ধ শুরুর অপেক্ষা।

পরের সংখ্যায় –পলাশির যুদ্ধ
0

গল্প - সুমন্ত চ্যাটার্জী

Posted in







জংধরা লোহার গেটটা খুলতেই ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে শীর্ণকায় শিম্পাঞ্জী'টি। দীর্ঘ আড়াই মাসের যুদ্ধে কত কি-ই না দেখছে সে!

কিছুটা দূর থেকে তাকিয়ে থাকে বছর কুড়ি-বাইশের বিদ্রোহীরা। কলা এগিয়ে দেয় কেউ, কেউ আওয়াজ করে ডাকে। অসাড় গলা সাড়া দিতে পারে না, তবুও চেষ্টা করে লম্বা লম্বা হাত মাটিতে রেখে ঘুরপাক খেতে, কিন্তু দুর্বল শরীর সায় দেয় না!

চারিদিকে আজ স্বাধীনতার উৎসব! সীমানার দিগন্ত থেকে ভেসে আসে রাইফেলের জয়ধ্বনি, প্রত্যুত্তরে শিম্পাঞ্জী'কে ঘিরে থাকা বিদ্রোহীরাও রাইফেল তুলে ফায়ার করে উল্লাসের সাথে! শীর্ণকায় নীরবে ফিরে যায় খাঁচায়, দরজাটা টেনে বন্ধ করে নেয় নিজেকে, আবার!

4

গল্প - মনোজ কর

Posted in








একাদশ পর্ব

পলাশি যুদ্ধের প্রস্তুতি


চন্দননগর জয়ের পরও ক্লাইভের মনে হল যে সামনে যে পরিকল্পনা রয়েছে তা কার্যকর করা খুব একটা সুবিধের হবে না। মিরজাফর এখনও দোলাচলচিত্ত। যদিও ইতিমধ্যেই মিরজাফরের সঙ্গে এই মর্মে প্রায় একমাস আগে চুক্তি হয়েছে যে সিরাজকে গদিচ্যুত করার এই চক্রান্ত কার্যকর করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে মিরজাফর এবং সেই হবে সিরাজ পরবর্তী নবাব। পরিবর্তে মিরজাফর ইংরেজ এবং অন্য চক্রান্তকারীদের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে সচেতন থাকবে। তবুও ক্লাইভের মন থেকে দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না।

ওয়াটস, ক্লাইভের একান্ত বিশ্বাসী সহকারী সবদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে এবং কোনও কিছু নজরে বা কানে এলে সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভকে তার সম্পর্কে অবহিত করছে। চন্দননগর জয়ের পর ক্লাইভ এবং ওয়াটসনের নেতৃত্বে আলোচনার জন্য সিরাজের প্রতিনিয়ত আমন্ত্রণ উপেক্ষা করে মিরজাফরকে কেন্দ্রে রেখে চক্রান্ত ঘনীভূত হচ্ছে মুর্শিদাবাদে। পাশ থেকে এই চক্রান্তে অংশগ্রহণ করেছে রাইদুর্লভ এবং ইয়ার লতিফ। ইয়ার লতিফ ইংরেজদের কাছে বিশ্বাসঘাতকতার বিনিময়ে সিংহাসনের দাবি করেছিল প্রথমে। পরবর্তীকালে মিরজাফর যুক্ত হওয়াতে লতিফের আবেদন বাতিল করে দিয়েছিল ইংরেজরা। এছাড়াও তাদের নিজস্ব ভঙ্গিমায় এই চক্রান্তে রসদ যোগাচ্ছে জগতশেঠ এবং ঘসেটি বেগম। আর আছে উমিচাঁদ। যদিও উমিচাঁদই ছিল মিরজাফরের সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তির অন্যতম রূপকার তবুও ক্লাইভ কিন্তু কখনই উমিচাঁদকে বিশ্বাস করতে পারেনি। ক্লাইভের অনুমান সত্যি প্রমাণ করে মিরজাফরের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর উমিচাঁদ এই চুক্তির গোপনীয়তা রক্ষার মূল্য হিসাবে ত্রিশ লক্ষ টাকা দাবি করল। ভয় দেখাল যে এর অন্যথা হলে খবর সিরাজের কানে তুলে দেবে সে। ক্লাইভের ভাষায় পৃথিবীর সর্বকালের সেরা শয়তান এই উমিচাঁদ। তার দ্বিচারিতার জন্য সে ইংরেজদের কাছে সন্দেহের পাত্র হয়েছে বারবার। তার সাহায্য নিলেও তার সুবিধাবাদী গতিবিধির ওপর কড়া নজর ছিল ইংরেজদের।

উমিচাঁদ দাবি করল যে সিরাজকে গদিচ্যুত করার পর তাকে যে ত্রিশলক্ষ টাকা দেওয়া হবে সে কথা চুক্তিতে স্পষ্ট করে লেখা থাকতে হবে। উমিচাঁদ চলে ডালে ডালে তো ক্লাইভ চলে পাতায় পাতায়। ক্লাইভ একটির বদলে দু’টি চুক্তিপত্র তৈরি করল। একটি সাদা কাগজে যার মধ্যে উমিচাঁদের কথা উল্লেখ করা নেই। অন্যটি লাল কাগজে যার মধ্যে উমিচাঁদের পাওনার কথা লেখা আছে। কিন্তু গোল বাধল এই নিয়ে যে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন এই লাল চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে রাজি হলনা। ক্লাইভ ওয়াটসনকে বোঝালো যে এই দ্বিতীয় চুক্তি নীতিবিরুদ্ধ হলেও কৌশলগত দিক থেকে এই চুক্তির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এটি একটি পবিত্র এবং প্রয়োজনীয় মিথ্যাচার। তাছাড়া চক্রান্তের ক্ষেত্রে কোনওরকম নৈতিকতা অপ্রাসঙ্গিক। যেন তেন প্রকারেণ যুদ্ধজয়ই একমাত্র লক্ষ্য। এই দীর্ঘ আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়াতে ক্লাইভ ঠিক করল লালচুক্তিতে ওয়াটসনের নকল স্বাক্ষর ব্যবহার করা হবে। এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। কারণ এই চুক্তিতে ওয়াটসনের স্বাক্ষর না থাকলে উমিচাঁদের সন্দেহ বাড়তে পারে এবং সেক্ষেত্রে চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। এই ঝুঁকি নেওয়া এখন অসম্ভব। কিন্তু এই জাল সইএর ঘটনা ওয়াটসনের কানে এলেও যুদ্ধের আগে এবং পরে কোনও প্রতিবাদ জানায়নি সে। ওয়াটসন ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেবল নিজের হাতে এই নকল চুক্তিপত্রে সই করতে চায়নি। পরবর্তীকালে কাউন্সিলে এই নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ক্লাইভ এই নীতিহীন কাজের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেয়। ফলে কাউন্সিল তাকে শুধু ক্ষমা করেনি প্রভূত প্রশংসাও করেছিল। ওয়াটসন স্বয়ং এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ অবগত হওয়ার পর ক্লাইভকে প্রশংসা করে জানিয়েছিল যে সে অত্যন্ত খুশি কারণ মিরজাফরের পক্ষে অনেকে যোগ দিচ্ছে। সে আশা করে এই যুদ্ধে ক্লাইভের জয় নিশ্চিত এবং তার দিক থেকে ক্লাইভকে অভিনন্দন জানানো কেবল সময়ের অপেক্ষা। আর সকলের মত পলাশি যুদ্ধের পর লুটের ভাগ তো ওয়াটসনেরও প্রাপ্য। সেই প্রাপ্য সংরক্ষিত রাখতে এই অন্যায়কে পিছন থেকে সমর্থন করা ছাড়া আর কী কোনও উপায় আছে? যেখানে অর্থ আহরণই মূল লক্ষ্য সেখানে নীতির কথা অবান্তর।

১৯শে মে ইংরেজদের স্বাক্ষরসম্বলিত সাদা এবং লাল দু’টি চুক্তিই মিরজাফরের কাছে পাঠানো হল । সিরাজের চোখ এড়িয়ে মুর্শিদাবাদে বসেই এই চক্রান্তের জাল বিস্তার করছিল সিরাজের দরবারের ইংরেজ প্রতিনিধি ওয়াটস। যুদ্ধের একসপ্তাহ আগে শিকারে যাবার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেনি ওয়াটস। মিরজাফরের সঙ্গে শেষ আলোচনা এবং দু’টি চুক্তিতেই মিরজাফরকে স্বাক্ষর করানোর গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় ওয়াটসের ওপর। পর্দানসীন মহিলার ছদ্মবেশে ভাড়া করা পাল্কিতে চড়ে মিরজাফরের জাফরগঞ্জের বাড়িতে গিয়ে এই গুরুদায়িত্ব পালন করে ওয়াটস।

চুক্তিস্বাক্ষর এই সুপরিকল্পিত এবং দীর্ঘস্থায়ী চক্রান্তের একটি পর্ব মাত্র। ক্লাইভের তথা ইংরেজদের লক্ষ্য কিন্তু সুদূরপ্রসারী। কলকাতা পুনরুদ্ধার এই সুদূরপ্রসারী অভিপ্রায় বাস্তব করার ক্ষেত্রে প্রথম এবং আবশ্যিক পদক্ষেপ ছিল। এখন বাংলা এবং পূর্বভারতে নিজেদের একচ্ছত্র ব্যবসার অধিকার কায়েমের জন্য প্রয়োজন যে ভাবেই হোক ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসিদের সমূলে ধ্বংস করা। সেই কাজ প্রায় সম্পূর্ণ। এবার তৃতীয় এবং এই অধ্যায়ের শেষ পদক্ষেপ নেবার সময়। এই ভূখন্ডে তাদের ব্যবসায় এবং ব্যবসার একচ্ছত্র অধিকার কায়েমের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধক সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুৎ করতে হবে যে কোনও মূল্যে। এই কাজ অত্যন্ত দ্রুত সমাধা করার প্রয়োজন কারণ তাদের কাছে খবর আছে সিরাজ এইমুহূর্তে ফরাসিদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টায় আছে। মিরজাফরের সঙ্গে গোপন চুক্তি এই পদক্ষেপের প্রথম ধাপ। ক্লাইভ জানত যে মিরজাফরকে দিয়ে চুক্তি সই করানো আর তাকে দিয়ে কাজ করানো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। এখনও যেতে হবে অনেকটা পথ। ক্লাইভ জানে এই যুদ্ধজয়ের একমাত্র অস্ত্র বিশ্বাসঘাতকতা যার নাম মিরজাফর। আর সেইজন্যই এত তোড়জোড় এবং চুক্তিস্বাক্ষর। কিন্তু মুস্কিল হল এই যে মিরজাফর এখন বেসুরে বাজছে। ক্লাইভের মনে হচ্ছে সযত্নে এবং বহুপরিশ্রমে সৃষ্ট এই ঐকতানে কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটছে। ক্লাইভ বুঝতে পারছে পায়ের নিচে মাটি ক্রমশ পিচ্ছিল হয়ে উঠছে।

চন্দননগর থেকে যাত্রা শুরু করার পর প্রতিদিন ক্লাইভ মিরজাফরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু মিরজাফর নিরুত্তর। বেশ কিছুদিন পরে গতকাল অর্থাৎ ১৭ই জুন মিরজাফরের কাছ থেকে একটা খবর এসেছে যার অর্থোদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। মিরজাফর জানিয়েছে যে সিরাজের সঙ্গে তার বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে এবং সে সিরাজকে কথা দিয়েছে যে কোনও অবস্থাতেই সে ইংরেজদের সাহায্য বা সমর্থন করবে না। কিন্তু চুক্তি কার্যকর করার ব্যাপারে সে কোনওরকম গাফিলতি করবে না। ক্লাইভ মিরজাফরের ব্যাপারে স্বভাবতই সন্দিহান। যে লোক তার নিজের দেশ এবং নবাবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে সে যে ক্লাইভের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে তার স্থিরতা কোথায়? টাকা এবং ক্ষমতার লোভে নিজেদের যে কোনও জায়গায় নামিয়ে নিয়ে যেতে পারে এরা। যারা কোনওরকম নীতির ধার ধারে না তাদের কাছে চুক্তিভঙ্গ তো সামান্য ব্যাপার। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসাবে ক্লাইভ কাশিমবাজার যাত্রা স্থগিত করে দিল। সিদ্ধান্ত নিল যতক্ষণ পর্যন্ত মিরজাফরের আচরণে এবং কাজে সে নিশ্চিত হয়ে তার প্রতি ভরসা করতে পারবে ততক্ষণ আর এগোবে না যে। চরম উৎকণ্ঠায় দু’দিন কেটে গেল। ইতিমধ্যে আজ ১৮ই জুন বর্ষা শুরু হয়ে গেল বাংলায়। শীত এবং বসন্ত অতিক্রান্ত হলে মার্চ মাসের মাঝামাঝি গরমের প্রকোপ বাড়তে থাকে এই অঞ্চলে। এইসময় একদিন উষ্ণ এবং আর্দ্র দক্ষিণ-পূর্ব হাওয়ার সঙ্গে মিলন ঘটে শীতল এবং শুষ্ক উত্তর-পশ্চিম হাওয়ার। জন্ম হয় বিধ্বংসী ঝড়ের যার নাম কালবৈশাখী। তার কিছু পরেই জুনের মাঝামাঝি বর্ষা নামে। এই বর্ষার গতিপ্রকৃতির ওপর নির্ভর করে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-মৃত্যু।

ইতিমধ্যে ক্লাইভ তার একান্ত বিশ্বস্ত মেজর কুটেকে পাঠিয়েছিল কাটোয়া ফোর্ট অভিযানে। পূর্ব বর্ধমানের অজয় নদের ধারে এই কাটোয়া দূর্গ। তখন ইংরেজরা কলকাতা কেড়ে নিয়েছে সিরাজের কাছ থেকে। সিরাজ পিছু হটেছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। তার কথা এবং আচরণে প্রাণের ভয়ে ইংরেজদের প্রতি বশ্যতাস্বীকারের অভিপ্রায় স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে প্রতিদিন। সিরাজের সৈন্যবাহিনী দ্বিধাগ্রস্থ। সুতরাং এই অবস্থায় যা ঘটার তাই ঘটল। ইংরেজ সেনাদের নদী অতিক্রম করতে দেখে সিরাজের সৈন্যরা নিজেদের অস্থায়ী ছাউনি পুড়িয়ে দিয়ে দূর্গ ছেড়ে চম্পট দিল। ১৮ই জুন কাটোয়া দূর্গ দখল করে কাটোয়া দূর্গ থেকেই পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা করছিল ক্লাইভ। কিন্তু মিরজাফরের আচরণে ও ইঙ্গিতে ক্লাইভের অবস্থা এই মুহূর্তে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা অসহায়। ১৯শে জুন কাটোয়া থেকেই ক্লাইভ ফোর্ট উইলিয়ামে বার্তা পাঠাল যে অবিলম্বে সেই সমস্ত ক্ষমতাবান ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে যারা ব্যবসাসূত্রে বা অন্য কোনও কারণে ইংরেজদের বন্ধু যাদের মধ্যে অবশ্যই আছে মোগলরাজের উজির গাজিউদ্দিন খাঁ যিনি পরবর্তী নবাব হিসাবে মিরজাফরের যোগ্যতা সম্পর্কে গোড়া থেকেই সন্দিহান। এই দু’দিন ক্লাইভকে খুবই ম্রিয়মান দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ক্লাইভ এখন নিজের চাকরি বাঁচাতে ব্যস্ত।

ক্লাইভ জানাল যে তার মনে হচ্ছে যে মিরজাফর যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে বা নবাবের বিরুদ্ধাচরণ করার মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলে তাহলে এই অভিযান বাধাপ্রাপ্ত হবে। সে জানাল যে সে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে মিরজাফর সিরাজের কবল থেকে বেরিয়ে আসে এবং ইংরেজদের পাশে এসে দাঁড়ায়। এই মুহূর্তে যুদ্ধস্থল হিসাবে সে পলাশিকেই নির্বাচন করেছে এবং একথা স্পষ্টভাবে মিরজাফরকে জানিয়ে দিয়েছে যে ইংরেজদের প্রতি তার বিশ্বস্ততা এবং দায়বদ্ধতার যথেষ্ট প্রমাণ না পেলে সে নদী অতক্রম করবে না। সে আরও জানাল যে এই পরিস্থিতিতে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে যাতে তার সৈন্যবাহিনীর মনোবল অটুট থাকে এবং বর্তমান পরিকল্পনা কার্যকর না হলে তাকে অন্য কোনও অন্তর্ঘাতের পরিকল্পনা করতে হবে অর্থাৎ মিরজাফরের মত অন্য কাউকে নবাবির লোভ দেখিয়ে ভাঙ্গিয়ে আনতে হবে।

২০শে জুন খবর পাওয়া গেল যে ওয়াট প্রেরিত জনৈক গুপ্তচর মিরজাফর এবং তার ছেলে মিরানের সঙ্গে গোপনে তাদের প্রাসাদে দেখা করেছে।যখন কথা চলছিল তখন হঠাৎ সিরাজের অনুগত কয়েকজন এসে পড়ায় আলোচনা বিঘ্নিত হয়। তবে সিরাজের লোকেদের বিভ্রান্ত করার জন্য মিরান চিৎকার করে জানায় যে ক্লাইভের বাহিনী যদি নদী অতক্রম করে তবে তার এবং ইংরেজ সৈন্যদের মুন্ডচ্ছেদ করা হবে। ক্লাইভ আর একটু নিশ্চিত হল যখন মিরজাফরের খুব সংক্ষিপ্ত চিঠি এসে পৌঁছল ঐ দিন সন্ধ্যায়। সেই চিঠিতে মিরজাফর জানিয়েছে যে পরেরদিন অর্থাৎ ২১শে জুন সে যাত্রা শুরু করবে এবং তার থাকার স্থান যেন ইংরেজ সৈন্যশিবিরের পাশেই করা হয়। এতদিন তার পক্ষে কোনওরকম সংবাদ প্রেরণ করা সম্ভব হয়নি। সিরাজের লোকেরা তার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে এবং সমস্ত রাস্তা জুড়ে সিরাজের লোকেরা পাহারায় আছে। ইংরেজ শিবিরে যোগদান করে সে সমস্ত খবর জানাবে। ততক্ষণ যেন ক্লাইভ এবং তার সেনাবাহিনী সাবধানে থাকে। মিরজাফরের চিঠি পেয়েও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারল না ক্লাইভ। এই চিঠিতে না আছে মিরজাফরের আগামী পরিকল্পনার ইঙ্গিত, না আছে ইংরেজদের পরবর্তী গতিবিধি সংক্রান্ত কোনও প্রস্তাব। অন্য কোনও উপায় না দেখে ক্লাইভ সিরাজ বিরোধী বর্ধমানের রাজা তিলকচাঁদকে এক হাজার অশ্বারোহী সৈনিক পাঠাবার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠাল। অনেক যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ক্লাইভ জানত যে প্রভূত সংখ্যায় অশ্বারোহী সৈন্য ছাড়া এই যুদ্ধে জয়লাভ অসম্ভব। বীরভূমের রাজা আসাদুজ্জামানের কাছেও তিনশ অশ্বারোহী সৈন্যের অনুরোধ জানিয়ে লিখল যে যদি তার বাহিনী সঠিক সময়ে তার কাছে এসে পৌঁছয় তবে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তার কাছ থেকে কোনওরকম খাজনা নেওয়া হবে না। প্রজাদের কাছ থেকে সংগৃহীত খাজনার পুরোটাই সে নিজের কাছে রাখতে পারবে। তাছাড়াও সৈন্য পাঠানোর যাবতীয় খরচ ইংরেজরা বহন করবে। যদিও ক্লাইভ তার শক্তিবৃদ্ধির এবং তার ছত্রছায়ায় সিরাজবিরোধী সমস্ত শক্তিকে একত্রিত করার সমস্ত রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তবুও আক্রমণের সম্ভাব্য দিন সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত নেবার অবস্থায় সে নেই। সিরাজের শিবিরের কোনও খবর তার কাছে নেই। ক্লাইভের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে চরম অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে। এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিৎ সেই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য ২০জন অফিসার বিশিষ্ট একটি যুদ্ধ পরিষদ গঠন করল ক্লাইভ। আলোচনার বিষয় হল,

প্রথমত, পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য কোম্পানি কাউন্সিলের নির্দেশ চাওয়ার প্রয়োজন আছে কি না?

দ্বিতীয়ত, এই মুহূর্তে সেনাবাহিনীর পক্ষে নদী পেরিয়ে কাশিমবাজার পৌঁছে যাওয়ায় ঝুঁকি পরিমাণ কতটা?

তৃতীয়ত, এই পরিস্থিতিতে আগে না এগিয়ে কাটোয়াতে ঘাঁটি পেতে বর্ষাটা কাটিয়ে দিয়ে তারপর এগোনো গেলে কী রকম হয়? দূর্গে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত করা আছে তাতে ১০০০০ সৈন্যের একবছর স্বচ্ছন্দে চলে যাবে। এর মধ্যে সিরাজের চিরশত্রু মারাঠা প্রধান বালাজি বাজিরাও এবং মারাঠা সেনাপ্রধানকে অনুরোধ জানিয়ে তাদের বহু যুদ্ধজয়ের সাফল্যমন্ডিত অশ্বারোহী বাহিনীকে নবাবের বিরুদ্ধে ইংরেজদের এই অভিযানে অংশগ্রহণ করানো যেতে পারে। এছাড়াও বর্ধমানের রাজার অশ্বরোহী সৈন্যেরাও এসে যাবে খুব শীঘ্রই। ক্লাইভের মাথায় এই ভাবনাটা খেলা করছিল অনেকদিন আগে থেকেই। মিরজাফরের দ্বিধাগ্রস্থতা এবং অনিশ্চয়তা ক্লাইভকে বাধ্য করল এই পথে চালিত হতে। বালাজি বাজিরাও বেশ কিছুদিন আগেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ক্লাইভের কাছে সাহায্যের বার্তা পাঠিয়েছিল। জানিয়েছিল দেড় লক্ষ মারাঠি সৈন্য নিয়ে নানাসাহেব স্বয়ং এই যুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে। নানাসাহেব লিখেছিল যে এই সাহায্য গ্রহণ করা ইংরেজদের কাছে ফরাসিদের বিতাড়ন করার ক্ষেত্রেও কার্যকরী ভূমিকা নেবে। ইংরেজরা জলপথে ফরাসিদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী সে কথা সত্য এবং নবাব এবং ফরাসিরা সে ব্যাপারে অবহিত। কিন্তু স্থলপথে ফরাসিরা ইংরেজদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী এবং ৫০০০০ পদাতিক সৈন্য নিয়ে জিন ল আগামী তিন-চার দিনের মধ্যেই কাশিমবাজার এসে পৌঁছবে।

যুদ্ধ পরিষদের বৈঠকে নিচের তলার অফিসারদের প্রথমে মতামত দেওয়ার প্রচলিত নীতি বদল করে ক্লাইভ নিজেই প্রথমে যুদ্ধ আপাতত বর্ষাকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখার প্রস্তাব দিল। কিন্তু বোঝা গেল যুদ্ধ পরিষদের অনেকেই অবিলম্বে যুদ্ধ শুরু করার পক্ষে। এদের মধ্যে অন্যতম মেজর কুটে। যেহেতু সর্বাধিনায়ক ক্লাইভ নিজের মতামত প্রথমেই জানিয়েছে সুতরাং অনেক অফিসারই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেজর কুটেকে সমর্থন জানাল না। অবশেষে ১৩-৭ ভোটে যুদ্ধ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেল যুদ্ধ পরিষদের বৈঠকে। কুটে কিন্তু হাল ছাড়বার পাত্র নয়। তার যুক্তি হল একের পর এক সাফল্য এসেছে ইংরেজ সেনাবাহিনীর। একের পর এক যুদ্ধ জয় করে ইংরেজ সেনাদের মনোবল এখন তুঙ্গে। পরের যুদ্ধ জয় করার জন্য তারা প্রস্তুত। যুদ্ধজয়ের নেশা তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আরেক যুদ্ধক্ষেত্রে। এমতাবস্থায় তাদের বসিয়ে দেওয়ায় অর্থ তাদের অভ্যাস এবং মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া। পরবর্তী কালে যুদ্ধের সময় সেই মনোবল বাড়ানো অসম্ভব। এই মুহূর্তে তাদের গতি তীব্র এবং দক্ষতা শাণিত। অকারণ দীর্ঘসূত্রতা তাদের গতি মন্থর এবং দক্ষতা হ্রাস করে দেবে। সুতরাং চরৈবতি। এছাড়াও ল-এর বাহিনী কাশিমবাজার পৌঁছে গেলে নবাবের শক্তি অনেক বেড়ে যাবে। তাছাড়াও চন্দননগর আক্রমণের সময় যে সমস্ত ফরাসিদের বন্দি করে এনে জোর করে ইংরেজ সেনাবাহিনীতে ঢোকানো হয়েছে তার বিন্দুমাত্র সুযোগ পেলে যুদ্ধক্ষেত্রে শিবির বদল করবে। এটাই স্বাভাবিক। যা করার ফরাসিরা পৌঁছনোর আগেই করতে হবে। কলকাতা থেকে কাটোয়ার দূরত্ব অনেক বেশি। যেহেতু ইংরেজ সৈন্যরা কাটোয়াতে স্বেচ্ছাবন্দি নবাবের লোকেরা আপ্রাণ চেষ্টা করবে কলকাতার সঙ্গে কাটোয়ার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে। তাদের বাধা দেওয়ার মত যথেষ্ঠ শক্তি কলকাতায় এখন নেই। সৈন্যরা এখন কাটোয়ায় আরাম করছে। একবার কলকাতা আর কাটোয়ার মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কাটোয়ার সেনাবাহিনী ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে। কুটের যুক্তি কেবলমাত্র সুচিন্তিত এবং বাস্তবসম্মতই নয় তার সাহস এবং দায়বদ্ধতা প্রশ্নাতীত এবং সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। ক্লাইভ নিজেও প্রকৃত অর্থে একজন সত্যিকারের নেতা। ক্লাইভ যুদ্ধজয়ের স্বার্থে যুদ্ধ পরিষদের সিদ্ধান্ত যে সিদ্ধান্ত আসলে ক্লাইভ নিজেই নিয়েছিল এবং পরিষদে পেশ করেছিল সেই সিদ্ধান্ত থেকেই সরে আসার ব্যাপারে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। প্রায় একঘন্টা পাশে নির্জন আমবাগানে চিন্তামগ্ন থাকার পর ফিরে এসে ক্লাইভ জানাল যে পরের দিন সকালে ইংরেজ সেনাবাহিনী নদী পেরিয়ে যাত্রা শুরু করবে। তবুও ক্লাইভের অন্তরে কোথাও যেন একটা অনিশ্চয়তা এবং ভয় দানা বেঁধে উঠেছে। কোম্পানি কাউন্সিলকে লেখা চিঠিতে ক্লাইভ জানাল যে মিরজাফরের নিরুত্তর থাকা তাকে বিব্রত করছে এবং সে জানে না এখন তার আশুকর্তব্য কী হওয়া উচিৎ। ইংরেজদের পক্ষ না নিলেও সে যেন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে - মিরজাফরের কাছ থেকে এই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি নেওয়ার কথা ভাবছে সে। তার কাছে খবর আছে সিরাজের সৈন্যসংখ্যা এখন ৮০০০। কিন্তু টাকা বাড়িয়ে এই সংখ্যা বাড়ানো সিরাজের কাছে অসুবিধেজনক নয়। কিন্তু ক্লাইভের বিশ্বাস যে কলকাতা পুনর্দখলের পর থেকে সিরাজ খুব ভয় পেয়ে আছে। সেক্ষেত্রে সিরাজের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রস্তাব আসা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে চন্দননগর দখলের পর সিরাজ আরও ভীত হয়ে পড়েছে। তবুও মোগল উজির গাজিউদ্দিন খান এবং সিরাজের চিরশত্রু বালাজি বাজিরাওকে সহযোগিতা এবং সাহায্যের জন্য আবেদন করা প্রয়োজন। কোম্পানি কাউন্সিল তার এই অনুরোধ রাখবে বলেই সে আশা করে।

পরবর্তীকালে ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ হাউস অফ কমনসে যখন ক্লাইভের ভারতে অবস্থানকালীন আচরণ সম্পর্কে পর্যালোচনা এবং জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল তখন ক্লাইভ বলেছিল যে যদি তার নিজের এবং যুদ্ধ পরিষদের সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে সেদিন সে মেজর কুটের প্রস্তাব মেনে না নিত তাহলে সেদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেওয়া হত। নিজের এবং যুদ্ধ পরিষদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে এই প্রস্তাব মেনে নেওয়া তার জীবনের অন্যতম সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।
0

গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in







রাত সাড়ে আটটা। সমাবেশ ভেঙ্গে গেছে। পার্টি সমাবেশের খবর টবর, খিচিক খিচিক ফটো তোলা, লোকেদের ইন্টারভিউ এসব ফিনিস। এবার ঘরে ফিরবো ফিরবো করছি।

তখনই দেখি রাস্তার সামনের ফুটপাথে যুবতী মেয়েটা। হাতে একটা থলি। মুখে ক্লান্তির ছাপ। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। সন্দেহ হোলো। মেয়েটিকে পরিচয় দিলাম - আমি একজন কাগজের রিপোর্টার।

জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি জানালো - কর্তার সাথে সে মেলায় এসেছিল। তেনাকে খুঁজে পাচ্ছেন না!

বাড়ি কোথায়?

অনেক দূরে বাবু! ওই সুন্দরবনের কাছে। রাঙাসুন্দরি গ্রাম। বিদ্যানদীর ধারে।

তা যাবে কি করে?

তাই তো বুঝতে পারছি না। আমি তো কোলকাতার রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না। আমাদের সাথে আরো যারা মিটিনে এসেছিলো, তাদের কাউকেই দেখছি না।

মেয়েটার কথাবার্তায় গ্রাম্যভাব, চেহারায় নিখাদ সরলতা। ওর জন্যে করুণা হলো। এই অচেনা মেয়েটার জন্যে আমি কিই বা করতে পারি! ঘরে ফেরার জন্যে কয়েক কদম এগোলাম। পেছনে ফিরে দেখলাম, মেয়েটার কাছে আরো কয়েকটা অল্প বয়েসী ছোকরা জড়ো হচ্ছে। কি মনে হলো, আবার পেছনে ফিরে এলাম।

মেয়েটাকে বললাম,- আমার সাথে আসুন। কাছেই পিসির বাড়ি। এ রাতটা সেখানে থেকে যেতে পারেন। এতো রাতে এই শহরে, চেনেন না জানেন না, কোথায় ঘুরতে থাকবেন।

কাঁধে আমার বিশাল ক্যামেরা আর হাতে রাইটিং প্যাড দেখে উপস্থিত ছেলে ছোকরা কয়েকজন একটু উসখুস করলেও আমার গন্তব্য নিয়ে কেউ কিছু প্রশ্ন করতে সাহস পেলো না।

মেয়েটাকে মোটর সাইকেলের পেছনে কোনরকমে বসিয়ে আমার পিসির ঘরে নিয়ে এলাম। সব ঘটনা খুলে বললাম। পিসি খুব উদারমনা, এককালে পার্টি-টার্টি করতো। তিনি আমার কথাটা বুঝলেন। যদিও গোপনে আমাকে বললেন, - আমার পাশের খালি ঘরে দু’এক দিন থেকে যেতে পারে। দেখিস কোনো গড়বড় কেস না তো। মেয়েটা কোনো বিপদে ফেলবে না তো? দরকার হলে থানায় একটা ডায়েরী করিয়ে রাখিস।

রাইকমলিনী পিসির কাছে থেকে গেলো। পিসিও ওর খাবার দাবার ব্যবস্থা করে দিলো। খোঁজ খবর নিতে লাগলো। জানা গেলো, ওর বাড়ি ক্যানিং হয়ে যেতে হয়। লঞ্চে নদী পেরিয়ে ওপারে অনেকটা হেঁটে ওদের গ্রামটা! ওর কর্তা নৌকার মাঝি। জেলেদের সাথে নৌকায় মাছ ধরে। গ্রামের কোনো নেতার অনুরোধে ওরা স্বামী-স্ত্রী আরো অনেকের সাথে কোলকাতায় পার্টি মিটিং-এ এসেছিল।

দিন তিনেক বাদে আমি ক্যানিং লোকালে। তারপরে লঞ্চ। সেখান থেকে হেঁটে আর সাইকেল ভ্যানে একটা নিথর গ্রাম। পৌঁছে গেলাম রাঙাসুন্দরি গ্রামে। দু চারটে বাড়ি। রাইকমলিনীকে নিয়ে গ্রামে পৌঁছাতেই সবাই খুব খুশি। ওর বর নস্কর মাঝিকে খবর দেয়া হলো।

নস্কর মাঝি ঘরে ফিরতেই রাইকমলিনী আমাকে দেখিয়ে বললো, ‘এই দাদাবাবুটার কৃপাতে ঘরে ফিরতে পারলাম! বুড়ো, তোর কি আক্কেল বল তো? তুই কি করে আমাকে ছেড়ে চলে এলি?’

বুড়ো নস্কর মাঝি তরুনী বউটাকে পেয়ে খুব খুশী। সে জানালো, কেমন করে ভীড়ে দল ছুট হয়ে কত খুঁজেছে। পার্টির লোকেরা দল বেঁধে কতগুলো ট্রাকে এসেছিলো। বউকে খুঁজে না পেয়ে ভেবেছে, তার বউ দলের মধ্যেই কোথাও আছে, কিংবা অন্য কোনো ট্রাকে শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে গেছে। শেষমেষ নস্কর মাঝি শেয়ালদা যাবার জন্যে মুখ চেনা দুএকজনের সাথে একটা ট্রাকে উঠে পড়েছিলো। স্টেশনে পৌছে বুঝেছে তার বউ হারিয়ে গেছে! রাত হয়ে গেছিলো। চেনে না জানে না, বয়স্ক মানুষ, তাই সমাবেশের মাঠে দুবারা ফিরে যাবার সাহস হয়নি। রাইকে খুঁজতে গত পরশু কোলকাতায় লোক পাঠিয়েছে। পাশের গ্রামে থাকে পার্টির দাদারা, তাদেরকেও ধরেছে।

বুড়োটা আরো বললো - গতকাল পুলিশে এফআইআর করার জন্যে গেছিলাম; শালারা বললো, যেখানে নিঁখোজ হয়েছে সেখানকার থানায় গিয়ে ডায়েরি করতে হবে।

দেখলাম মাটির দেয়াল, খড়ের চালা। দুটো ঘর আর একটা বারান্দা, দু’জন মানুষ, কয়েকটা গরু-বাছুর ছাগল মুরগী। বুঝলাম, এরা নিঃসন্তান। এদের সংসারে তৃতীয় আর কোনো মানুষ নেই।

রাইকমলিনীকে গ্রামে পৌঁছে দিয়েছি, আমার কাজ শেষ। ফেরত আসার প্লান করছি, বাধ সাধলো রাই। আমার দুহাত ধরে বললো – ‘তোমরা খুব ভালো মানুষ গো। তোমাদের জন্যে আমি এতো ভালো ভাবে ঘরে ফিরে আসতে পারলাম। এয়েছো যখন, দু’তিন দিন এখানে থেকে যাও। তুমি তো সুন্দরবনের নদী-জঙ্গল দেখো নি, নদীর উপরে জেগে থাকা চর দেখোনি। তোমাকে এসব দেখিয়ে আনবো নি।’ সে খুব আবদার, আমার উপরে।

অগত্যা আমার ফেরা হলো না।

ওদের ঘরের পাশেই নদী। সেদিন বিকেলে আমি বিদ্যাধরী নদীর পারে বসে আছি। একা একা। হুহু হাওয়া। নদীর কিনারে কয়েকটা নৌকা বাঁধা। আমি উপভোগ করছি নদী ও নিসর্গের সৌন্দর্য। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। ওপারে জোনাকির মতো জেগে উঠছে দুচারটে আলোর বিন্দু।

দেখলাম, রাইকমলিনী হাতে একটা লন্ঠন নিয়ে নদীর কিনারায় চলে এসেছে। বললো, বুড়োকে খাইয়ে দাইয়ে আসতে ওর একটু সময় লাগলো। নইলে আরো আগেই চলে আসতো!

রাইকমলিনী নিসঙ্কোচে আমার পাশে এসে বসলো। যেন আমার কতদিনের চেনা!

বললো, ‘বাবু তোমার পিসিমা খুব ভালো লোক।’ আমি আর কি বলবো।

বললো, ‘চলো বাবু, আমার সঙ্গে। তোমাকে নদীতে একটু ঘুরিয়ে আনি!’ রাই একটা নৌকায় উঠে গিয়ে লন্ঠনটা ডিম করে রাখলো। খুটায় বাঁধা নৌকার দড়িটা আলগা করলো।

আমার ভয় ভয় করছিল। বললাম – ‘নস্কর বাবুকে ডাকো। রাতে দুজনে যাওয়া সেফ নয়, তিনজনে মিলেই যাই। তাছাড়া তুমি রাতের নৌকা সামলাতে পারবে না!’

-‘ক্লান্ত বুড়োটা মালটাল টেনে ঘুমিয়ে পরেছে। ভয় নেই, আমি পারবো নি। এই মেয়ে নৌকার দাড় বাইতে পারে, হাল ধরতেও জানে। আমার বাপও যে নৌকা চালাতো। নামখানায় আমার বাপের বাড়ি।’

যে মেয়েটা দিশা হারিয়ে কোলকাতার সমাবেশে রাস্তায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো, এখন তার এতো সাহস দেখে অবাক হলাম।

নৌকাতে গিয়ে বসলাম। রাইকমলিনী নদীর কিনার ঘেসে বেশ শক্ত হাতেই নৌকা বাইছে। নদীতে তখন জোয়ারের টান। ফাটাফাটি জ্যোৎস্না আর নদীর দুধারে জঙ্গল। জলে এসে মাথা নুইয়েছে সুন্দরী, গরাণ, ম্যানগ্রোভের পাতা। পুরো পৃথিবীটাকে রহস্যময় মনে হচ্ছিলো। সেদিন কিছুক্ষণ পরেই আমরা ভাটার টানে ঘরে ফিরে এলাম।

পরের দিন আমি কোলকাতায় ফেরত আসবো, কিন্তু রাইকমলিনী আমাকে আবার আটকে দিলো – ‘না বাবু, তোমাকে আজও ফিরে যেতে দেবো না! আজকে তোমাকে নিয়ে যাবো নতুন একটা জায়গায়। বিদ্যার বুকে সুন্দর একটা চর - আমরা বলি সুখচর।’

সেদিন খুব ভোরে নস্কর মাঝি বেরিয়ে গেলো।

আমি ঘুরে বেড়ালাম নদীর পাড়ে, গ্রামে গ্রামে। জঙ্গলকে কাঁপিয়ে ভেসে আসছে জলো হাওয়া। গ্রামের বাড়িঘর কাঁচা, একজায়গায় দেখলাম বনবিবির থান। ঘরে ফিরে দুপুরের খাওয়া দাওয়া হলো। বাকী সময়টা রাইএর সাথে গল্প আর খুনসুটি চললো।

নস্কর মাঝি নৌকা নিয়ে ফিরে এলো বিকেলে। খাওয়া দাওয়া করলো, অভ্যেসমতো বেশ কিছুটা দেশি গিলে বকবক করতে করতে এক সময়ে লোকটা ঘুমিয়ে পড়লো। মানুষটা ঘুমিয়ে পড়তেই রাইকমলিনী আমাকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লো।

গতরাতের মতোই আবার আমাদের নৌকা অভিসার। রাইকমলিনী দাঁড় বাইছে, হাল সামলাচ্ছে।

দূর থেকে আরো একটা নৌকা ফিরছিলো। অন্ধকারে ঠাহর করতে না পেরে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘এতো রাতে নদীতে কে যায় গো?’

রাই গলাটাকে পুরুষালি করে চেঁচিয়ে বললো – ‘রাঙাসুন্দরি গ্রামের নৌকা গো!’

জ্যোৎস্নায় চিক চিক করছে নদীর জল। আমার গলায় শচীন কর্তার ভাটিয়ালি গান। তখন ভাটার টান। আকাশে একটু একটু মেঘ। মাঝে মাঝে হাওয়ায় দিচ্ছে। প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা পরে নৌকাটা ভিড়লো জোছনা-ধবধবে বালু চিক চিক একটা নদীর চরে।

‘ও বাবু গো, নৌকা থেকে নেমে আসো। এর নাম সুখচর।’

জলে পা ভিজিয়ে কোনোমতে নৌকা থেকে নামলাম। রাই একটা মোটা দড়ি দিয়ে চরে পুতে রাখা একটা বাঁশের খুটোর সাথে বেঁধে রাখলো নৌকোটা।

চরটা বিশাল, একদিকে প্রচুর গাছপালা, কিন্তু সমস্তটাই জনশূন্য। মাঝখানে কিছুটা জায়গায় কয়েকটা কংক্রিটের পিলার। মনে হলো, চরের এখানে কোনো সিগন্যাল টাওয়ার বসানোর পরিকল্পনা ছিল। আপাতত সে কাজ অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। কংক্রিটের পিলারগুলোর মাঝে সিমেন্টের ছোট্ট একটা চাতাল।

তার পাশেই শক্ত গাছের গুঁড়ি আর বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরী একটা ছাউনি দেয়া মাচান। মই লাগানো সিঁড়ি। যেখানে দুদন্ড বসা যায়, বিশ্রাম করা যায়।

রাই বললো, এখানে দিনের বেলায় নৌকা নিয়ে মানুষজন ঘুরতে আসে। কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আবার ফেরৎ চলে যায়। সিমেন্টের চাতাল আর মাচানের আশে পাশে ছড়ানো ছিটানো কাগজের টুকরো, মদের বোতল। মানুষের আনাগোনার চিহ্ন।

‘রাই, এতো রাতে তুমি আমাকে নিয়ে এখানে একলা একলা এলে! তোমার ভয় করে না!’

গোলগাল চাঁদ। সমুদ্রগামী নদী মোহনার দিকে তাকিয়ে রাই বলে উঠলো - ‘আমাদের ছোট্ট জীবনটা! এমনি করেই নদীর বুকে নৌকা বাইলে আমাদের জীবনটাও নদীর লম্বা হবে গো! বাবু, এত ভয় করলে নদীর শ্যাওলার মতো আমরাও একদিন হারিয়ে যাবো।’

রাই নৌকার ভেতরে রাখা একটা হোগলার পাটি তুলে এনে চরের বালিয়ারিতে বিছিয়ে দিলো। আমরা বসলাম। ঘর থেকে বানিয়ে এনেছিলো ভাত, কাঁকড়া-চিংড়ি-আলুর তরকারি। শালের পাতায় আমরা খেলাম। নদী চরের নির্জনতা আর ফটফটে জ্যোৎস্নার বাহার আমাকে বিস্মিত করলো।

খোলামেলা চাঁদটার উপর মেঘের লুকোচুরি শুরু হয়েছে। সমুদ্রের দিক থেকে ভেসে আসছে শনশন হাওয়া!

ওই যে কক্ষচ্যুত হয়ে ছোট ছোট জলজ শ্যাওলা ভেসে যাচ্ছে, ওরা কি আর কখনো নিজের জন্মস্থানে ফিরে যেতে পারবে? কোন জেলায় ওদের ঘর ছিলো! কোনটা ওর দেশ? নাকি সেই অর্থে জীবজগতে একটাই দেশ আছে – সেটা এই পৃথিবী! এই চরাচরের কোন এক ক্ষুদ্র বিন্দুতে আমরা দুজন বসে আছি। এখানে আমি আমার কোলকাতা ঠিকানা, বিগত জীবনের সমস্ত পরিচয়পত্র হারিয়ে ফেলেছি!

চরের পাশের সমুদ্রমুখী বিশাল নদী, শন শন হাওয়া, একটা থমমারা খোলা আকাশ। চাঁদ আর ছুটে বেড়ানো মেঘের খেলা – অবাক হওয়ার ক্লান্তিতে আমি হোগলা পাটির উপর শুয়ে পড়লাম। পাশেই বসে রাইকমলিনী। দুহাতের বেড়ে হাঁটুটাকে জড়িয়ে, নিজের মনে গুনগুন করে গাইছে – ‘ও চাঁদ আগলে রেখো জোছনাকে!’ সময় ঘনাতেই দেখলাম, চাঁদে উপরে আছড়ে পড়ছে খন্ড খন্ড মেঘ। মনে হচ্ছে হাওয়ার বেগ বাড়ছে!

এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলো। হাওয়ার বেগ কমবার নামটি নেই – আমার ভয় - আবার কি কোনো ঘূর্নিঝড়, বুলবুল আসছে?চলো ফিরে যাই।

রাইকমলিনী সান্ত্বনা দিয়ে বললো- আরেকটু বসো, বাবু। হাওয়াটা কমলেই আমরা ফিরবো।

আর কিছু সময়ের মধ্যেই থম মারা আকাশের নীচে গর্জন করে ছুটে এলো পাগল হাওয়া। নদীর জল উথাল পাথাল। আমরা দুজনেই উঠে দাঁড়ালাম। সমুদ্রের দিক থেকে উঁচু উঁচু ঢেউ শব্দ করে চরভূমিতে আছড়ে পড়তে লাগলো। রাই আমাকে টাওয়ারের পিলারগুলোর মাঝখানে উঁচু সিমেন্টের চাতালে উঠে যেতে বললো। চাতালের উঁচু জায়গাতে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম, টাল মাটাল নৌকাটাকে রাই পাটের দড়িটা দিয়ে আরো শক্ত করে বাঁধছে! নৌকাটা জলের ঢেউতে নাচছে। নদী চরে অল্প সময়ের মধ্যেই উঠে এলো পায়ের গোড়ালি ডোবানো জল!

নৌকাটাকে বেঁধেসেধে জলের মধ্য দিয়ে কায়দা করে রাই উঠে এসেছে সিমেন্টের চাতালটাতে। ওর শাড়ী ভিজে গেছে। আমরা দেখলাম, ঢেউএর উচ্চতাতে জলস্তর আস্তে আস্তে বাড়ছে।

এবার আমাদের ভরসা পাশের উঁচু মাচানটা। ওটা মোটা গাছের গুড়ির উপর দাঁড়ানো, পাকা বাঁশের বেড়া আর ছাউনি ঢাকা। মুষালধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা ভিজছি! চাতাল থেকে নেমে মই লাগানো সিঁড়ি বেয়ে আমি মাচানে উঠে গেলাম। আমার পেছনে পেছনে উঠে এলো রাইকমলিনী। সাথে ব্যাগের টুকিটাকি আর নিভে যাওয়া লণ্ঠনটা।

জামা কাপড় ভিজে চপচপ করছে। রাই উলটো দিকে মুখ করে শাড়িটা খুলে নিংড়ে নিলো, ছড়িয়ে দিলো মাচানের এক কোণে। ওর দেখাদেখি আমিও ভিজে জামাটা খুলে মেলে দিলাম। ভিজে প্যান্ট, ভিজে সায়া-ব্লাউজ। আমরা দুজনে অপেক্ষা করতে লাগলাম, কখন এ ঝড় বৃষ্টি কমবে! কোন কুক্ষণে যে রাইকমলিনীর সাথে রাতের অন্ধকারে নৌকাবিহারে বেরিয়েছিলাম, নিজের উপর রাগ হলো!

ও আমাকে ভরসা দিতে লাগলো - ভয় পেয়ো না বাবু, এ জল হাওয়া একটু পরেই থেমে যাবে!

ওদিকে রাত বাড়তে লাগলো। নদীর পাগলামি আর কমে না। সাথে হাওয়ার দাপট। মনে হচ্ছে আমাদের মাচানটা ভেঙেচুড়ে উড়ে যাবে। ওদিকে খুটিতে বাঁধা নৌকাটাও পাগলের মতো দাপাচ্ছে।

হঠাৎ দেখতে পেলাম জলের তোড়ে উপড়ে যাওয়া বাঁশের খুটি আর দড়ি সমেত নৌকাটা ভেসে চলেছে! গেলো গেলো বলে চেঁচিয়ে উঠলো রাই! ওকে দেখলাম সায়াটা খুলে উঁচু বুক পর্যন্ত বেঁধে নিল। মুহূর্তের মধ্যে মাচান থেকে নদীর জলে ঝাঁপ দিলো। প্রাণপণে সাঁতরে সাঁতরে ভেসে যাওয়া নৌকোটার দিকে এগোতে লাগলো। কিন্তু মেয়েটার গতির চাইতে হাওয়ার গতিবেগ আরো কয়েকগুন বেশী।

আমি শহুরে মানুষ। ভয়ে চেঁচাতে লাগলাম, ‘রাই ফিরে এসো, জলে ভেসে যাবে, রাই, রাইকমলিনিইই – !’

নৌকাটা জলের তোড়ে অনেকটা দূরে এগিয়ে গেছে। ওটাকে আর বাঁচানো যাবে না। অগত্যা রাই মুখ ঘোরলো। নদীর স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে সাঁতরে ও চরের দিকে এগিয়ে আসছে! শরীরে সমস্ত জান্তব শক্তিকে নিঃশেষিত করে নদীর তীব্র শাসনের বুকে হাতের থাপ্পর আর পায়ের লাথি কষাতে কষাতে মেয়েটি যখন মাচানের খুটি ধরে নদীর চরায় পা রাখলো, তখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, রাই ফিরে এসেছে! মই বেয়ে ও মাচানে উঠে এলো। অর্ধ উলঙ্গ মেয়েটিকে মনে হলো কোনো আদিম যুগের মানবী।

মাচানে উঠে ও আমার দু’হাতে ওর মুখটা গুঁজে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো – ‘বাবু নাওটাকে বাঁচাতে পারলাম না। বাবু, কি করে আমরা ঘরে ফিরবো! কি করে আমি বুড়োমাঝিকে আমার এ পোড়া মুখ দেখাবো!’

নস্কর মাঝিকে ও না বলে পালিয়ে এসেছিলো! ওদের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন নৌকাটা ভেসে সমুদ্রের দিকে হারিয়ে গেছে। ওর ডুকরে ওঠা কান্নাগুলো হাওয়ার গর্জন আর জলস্রোতের কলকলানিতে কোথায় যে হারিয়ে যেতে লাগলো, আমি ছাড়া আর কেউ তার সাক্ষী রইলো না!

আমি রাইকমলিনীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। ‘রাই, চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি নস্কর মাঝিকে বুঝিয়ে বলবো, আমিই তোমাকে নিয়ে জোড়াজুড়ি করে নৌকাতে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম, আমিই তোমাকে নিয়ে এই সুখচরে এসেছি। রাই, কান্না থামাও! ......... নতুন একটা নৌকা বানানোর টাকা আমি তোমাদের জোগাড় করে দেবো। ব্যাঙ্কেও আমার খাতায় কিছু টাকা আছে! আমার পিসিমাও চাইলে নিশ্চয়ই কিছু টাকা দেবে। ভরসা রাখো!’

কিন্তু রাইকমলিনীকে শান্ত করা কি সোজা কথা! ভিজে সায়া ব্লাউজ গায়ে, ও অসহায়ের মতো ফোঁফাতে লাগলো!

চরের মাচানের উপর আমরা আরো ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করলাম। ধীরে ধীরে ঝড় থেমে আসছে। তখন বোধ হয় রাত চারটে হবে।

আমরা এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। কোথাও কোনো জলযান দেখা যাচ্ছে কি? এখন বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়া থেমে গেছে। চাঁদটাকেও পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের নৌকাটা যে জলে ভেসে গেছে! কি করে আমরা ডাঙায় ফিরবো!

আমি আর রাইকমলিনী। একজন আরেকজনের কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে এই নির্জন মাচানে বসে আছি। এই সুখচরের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে, বিদ্যাধরী নদীর খলখল জলস্রোত পেরিয়ে, আমরা কিভাবে কখন ওই রাঙাসুন্দরি গ্রামে ফিরে আসবো?

ভোর হয়ে আসছে! হঠাৎ রাইকমলিনী চেঁচিয়ে উঠলো – ওই, ওই তো একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে, অনেক দূরে, ওই দিকে!
0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in




















( ১ )

সারা স্কুলে হইচই পড়ে গেল একেবারে। হুড় হুড় করে ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে এল কয়েকটা ক্লাস থেকে। টিচাররা আবার জোর করে আটকে রেখেছে কোনো কোনো ক্লাসকে। আটকে পড়া ছেলে-মেয়েরা অস্থির হয়ে উঠেছে রীতিমতো।

ওপরের ক্লাসরুম থেকে আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে সবদিকে। কোণের ঘরটা ক্লাস ফাইভের। এখন তো অঙ্কের ক্লাস চলছে। সৌরেন সমাদ্দাদের গলা না? হেডমাস্টার বেরিয়ে এলেন বাইরে। তাঁকে দেখেই ছেলে-মেয়েরা আরও চেঁচাতে শুরু করেছে, "অঙ্কের স্যার খুব রেগে গেছেন। চেঁচাচ্ছেন।"

কিন্তু তাঁর চেঁচানোর কারণটা কী? সেটাই তো জানতে পারছেন না তিনি। বাধ্য হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছেন। তাঁর পিছু নিলেন আরো দুজন মাস্টারমশাই। নিচের তলার ছেলেরা তাঁদের পিছু নিয়ে উপরে উঠতে চাইছে। কিন্তু তপনবাবু হঠাৎ ফিরে তাকালেন নিচের দিকে। ওমনি সব হুড়মুড় করে পড়ল যে যার গায়ের উপর। হুলস্থুল বেঁধে গেল সিঁড়ি পথেই।

হঠাৎ সেই চিৎকার-চেঁচামেচি স্তব্ধ হয়ে গেল। সৌরেনবাবুর গলা শোনা যাচ্ছে না আর। ঘরের সামনে পা ফেলার আগে ভেতর থেকে ভেসে আসছে, "এবার তিনের দাগের অঙ্কটা কর দেখি। কেউ কারোর দেখবি না কিন্তু। এ ধরনের অঙ্ক পরীক্ষায়…"

মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই হেডমাস্টারের সঙ্গে ক্লাসে ঢুকলেন তপনবাবুরা। তাদের দেখে রীতিমতো জ্বলে উঠলেন, "এ রকম ছেলে আমি জীবনে দেখিনি। আগেও একদিন বারণ করেছি, শোনেনি। আজ আবার সেই একই কাণ্ড। মাথা কি আর ঠান্ডা রাখা যায়, আপনি বলুন?"

কী ঘটেছে? বা কে কি করেছে? সেটাই তো তাঁর অজানা, উত্তর দেবেন কী করে? হেড-মাস্টার সারা ক্লাসের দিকে একবার তাকিয়ে কোনো কিছুর আভাষ পেলেন না। কিন্তু সৌরেনবাবুকে দেখে তো বোঝাই যাচ্ছে, কিছু তো একটা ঘটেছে? শুরু করবেন কী দিয়ে? তবু ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশ্যে গম্ভীর গলায় ফেটে করলেন, "কে, কে এমন করেছিস?"

সৌরেন সমাদ্দার তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করলেন, "না, মানে স্যার, ওরা…"

"না, মানে কী? এভাবে সব পার পেয়ে যাবে নাকি?"

"না, স্যার, আমার কথাটা শুনুন…"

"না, সৌরেনবাবু এভাবে ছাড়লে ওরা লাই পেয়ে যাবে। এরপর মাথায় চড়ে বসবে সব।"

"স্যার…"

"উঠে দাঁড়া, উঠে দাঁড়া বলছি? ওঠ…"

চুপ করে রইল সবাই। মুখ চাওয়া-চাউয়ি করছে পরস্পরে।

সৌরেনবাবু এবার আর বাধা মানলেন না, "স্যার, এরা কেউ কিছু করেনি। ঐ বাইরের ছেলেটা।"

"মানে?"

"আজও গাছে উঠেছিল? বাগানের এই গাছটায়। বারণ করলেও শুনছে না।"

"তাতে আপনার কি?"

তপনবাবুও তাঁর সঙ্গে সায় দিলেন, "বাইরের ছেলের জন্য আপনার এত মাথা ব্যথা কিসের?"

"আছে, নইলে আর বলছি কেন? পড়ে গেলে একটা বিপদ ঘটবে না? তাছাড়া…"

তাঁর মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই তপন রায় বিরক্তি প্রকাশ করলেন, "ঘটলে ঘটবে। কার না কার ছেলে, সে তারা বুঝে নেবে, আপনি খামখা মাথা গরম করছেন কেন শুনি?"

হেডমাস্টার, তপনবাবুর অযাচিত উপদেশ সঙ্গে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের গুজুর ফুসুর… সৌরেন সমাদ্দারের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। চেঁচিয়ে উঠলেন জোরে, "এই কী হচ্ছে এসব? একটা অঙ্ক দিলে কেউ করতে পারে না, আবার গুজুর ফুসুর? এই, তুই দাঁত বের করছিস কেন? দাঁড়া… তোর হাসি একেবারে…"

কী বুঝেই সৌরেনবাবুকে থামিয়ে দিলেন হেডমাস্টার। বললেন, "আর মাত্র কয়েক মিনিট আছে। আপনি আমার সঙ্গে আসুন। এই তপন, তুমি ক্লাসটা একটু সামলে দাও। আপনি আসুন আমার সঙ্গে।"

কিন্তু ব্যাপারটায় কেমন যেন অপমানিত বোধ হতে লাগল তাঁর। বাধ্য হয়ে হেডমাস্টারের পিছু নিলেন। কয়েক মিনিট পরে ঘন্টা পড়ল। তপন রায়ও এসে পৌঁছলেন হেডমাস্টারের ঘরে।

সৌরেনবাবু ও হেডমাস্টারের মধ্যে কথা চলছিল। তপন রায়কে দেখেই হেডমাস্টার বলে উঠলেন, "ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং বুঝলে? একটু খেয়াল করতে হবে আমাদের। কিন্তু..."

"কিন্তু এবার কিসের? ওর নিশ্চয়ই অন্য মতলব আছে স্যার। ঐ দিকটায় আবার মেয়েরা বসে। ভেবে দেখুন!"

সৌরেন সমাদ্দারের কথা একবারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না। আবার সমর্থন যে করবে তেমনটা প্রমাণও নেই তাঁর হাতে। তবুও দ্বিধান্বিত হয়ে বললেন, "ঠিক আছে ব্যাপারটা আমি নজরে রাখব। আপনি এখন আসুন।"

তপন রায় তো অবাক! কী এমন ব্যাপার, যা নজরে রাখতে হবে? কৌতূহল চেপে বসেছে তাঁর মনে। কিছু একটা বলতে যাবেন, তার আগেই এইচ এম বলে উঠলেন, "এসো, বসো। দরকারি কথা আছে।"

তপন রায়ের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করলেন হেডমাস্টার। ধীর পদক্ষেপে বাইরে বেরিয়ে গেলেন সৌরেনবাবু।

( ২ )

নদীর জলে ঢিল এসে পড়ছে থেকে থেকে, টুপ… টুপ… গাছের মাথায় গনগনে রোদ। দু-একটা নৌকা ভেসে আছে মাখখানে। ওপারটা দেখা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অতটা স্পষ্ট নয়। কঞ্চির বোঝা মাথায় তুলে নিল মাধব। হাঁটতে শুরু করল পাড় ধরে।

যত এগিয়ে আসছে, স্কুলটা তত স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে তার চোখের তারায়। সেদিক থেকে নজর ফেরাতে ইচ্ছে করছে না তার। যেদিন থেকে সে এখানে এসেছে, সেদিন থেকেই স্কুলের ছবিটা যেন মনে গেঁথে গেছে একেবারে।

প্রথম দিনেই সে দিদিকে জিগ্যেস করেছিল, "ঐ উঁচু বাড়িটা কাদের রে?"

একটু দূরেই বসেছিল মাধবের বড়দি, অঞ্জনা। তার সামনেই জল চৌকি। কয়েকটা খাতা গোছানো রয়েছে তার উপর। একটা আবার মেলা রয়েছে তার হাতের নিচে। লেখা বন্ধ করে মাধরের দিকে তাকায়। ভায়ের হাতের ইশারা দেখে বলেছিল, "ও… ওটা? ওটা তো স্কুল।" বলেই আবার খাতায় লিখতে শুরু করে দেয়।

মাধবের মা'র কিন্তু তা নজর এড়ায়নি। ছেলের দিকে তাকিয়ে চুপিসাড়ে মাথা নাড়ে। মায়ের ইশারা বুঝতে বাকি থাকেনি মাধবের। অঞ্জনাকে কিছু একটা বলবে বলে কিন্তু মা'র নিষেধ তাকে প্রতিহত করে দিল।

বিকেল হতেই সে বেরিয়ে পড়ে। পিছন থেকে গলা ভেসে আসছে, "আরে, কোথায় চললি? নতুন জায়গা। কারোর সঙ্গে তো যা। আরে এই মাধব…"

শোনেনি মাধব।

পড়ন্ত বিকেলের রোদ্দুর তেজ হারিয়ে এখন আটকে আছে বাড়িটার মাথায়। নদীর পাড় ধরে এগিয়ে গেল মাধব। নজর কিন্তু সেদিকেই। সামনে এসে থমকে গেল সে। চোখ খিলখিল করে উঠল তার। সামনেই বড়ো তোরণ। বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা, কালিকাপুর উচ্চ-বিদ্যালয়। ফাঁকা স্কুল। কেউ কোথাও নেই। এর তিনতলার উপরে ঐ সিঁড়ির ছাদটাই, তার দিদির বাড়ি থেকেই দেখা যাচ্ছিল। নিচে স্কুলের গা ধরে ফুলের বাগান। কত রকমের ফুল। তার পাশে পাশে বড়ো বড়ো দেবদারু। সোজা উঠে গেছে উপরে। ভেতরের মাঠখানা বেশ বড়ো। স্কুলের গেট ধরে সে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছিল তার আগের স্কুলের সঙ্গে। না, কোথাও মিল খুঁজে পেল না সে।

তবে হ্যাঁ। তাদের নবতারা বিদ্যামন্দির এত বড়ো না হলেও এর থেকে কম নয়। সেখানেই তার ভর্তি হওয়ার কথা ছিল এবারে। দাদুর সঙ্গে একদিন ঘুরে দেখে এসেছিল সেটা। তার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল দুজনেই। "কিরে দাদুভাই, কেমন লাগছে? এবার পাশ করলে তোকে ভর্তি করে দেব এখানে। একলা আসতে পারবি তো?"

বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়েছিল মাধব, "হ্যাঁ, হ্যাঁ, পেরে যাব। সঙ্গে পাড়ার ছেলেরাও আসবে না। ও ভাবতে হবে না তোমাকে।"

যেদিন মাধবের রেজাল্ট বের হবে, সেদিন ক্লাসে বসেছিল অন্যদের সঙ্গে। গরমকাল। জোরে জোরে বাতাস বইছে। ফাঁকা স্কুলের মাঠ। ধূলো উড়ছে থেকে থেকে। তারই মধ্যে দিয়ে জোরে জোরে সাইকেল চালিয়ে আসছে একজন। মাধবের নজর পড়ল সেদিকে, "আরে, কাকা না!" বাইরে বেরিয়ে এল সে। সাইকেল এসে থামল গেটের সামনে, "তাড়াতাড়ি বাড়ি চ মাধো।"

"কেন? কি হয়েছে?"

"সে বাড়িতে গেলেই বুঝতে পারবি। সাইকেলে ওঠ। দেরি করিস না। ওঠ…"

একটু পরেই রেজাল্ট দেবে। তা না নিয়ে সে যায় কী করে? ইতস্তত করছে। কিন্তু কাকাকে মুখের উপর না বলতে তার সাহসে কুলাচ্ছে না। "রে-রেজাল্টটা নি-নিয়ে গে…"

কথা বলতে বলতে সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে তার কাকা। চড়ে বসল তার উপরে, "ও আমি কাল এসে নিয়ে যাব। তুই আগে বাড়ি চ…"

অগত্যা চেপে বসল সাইকেলে। পিছন ফিরে ফিরে স্কুলের দিকে বার বার তাকাচ্ছে। সাইকেল চলেছে দ্রুত গতিতে। কিছুক্ষণ পর নজরের আড়ালে চলে গেল স্কুল।

উঠোনে লোকজন ভর্তি। ঠাকমার কান্নার আওয়াজ কানে আসছে তার। ভিড় ঠেলে কাছে যেতেই, তাকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠেন, "ক-কতবার তো-তোকে দেখতে চেয়েছিল। প-পথের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কতবার 'মাধো'... 'মাধো' করে ডাকল। তারপরেই…"

দাদু অন্ত প্রাণ মাধবের। সেই কোন ছোটোবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। মুখটা এখন ঠিক করে মনেও পড়ে না। সেই দাদুই তার সব। সেই তার বাবা, সেই তার মা, সেই তার বন্ধু, সেই তার সুখ-দুঃখের চিরসাথী। দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে সব কিছু ঝাপসা হয়ে গেল তার। পিছন থেকে ন-কাকার হাত পড়ল তার কাঁধে, "শ্মশানে যাব, বাবার ইচ্ছা তুই-ই যেন তার মুখে আগুন দেস। চ… কাঁদিস না।"

শ্রাদ্ধের কাজকর্ম সারতেই মাধবের ঠিকানা হয় মায়ের কাছে, কালিকাপুর, হুগলীতে। এই প্রথম গ্রাম ছাড়া হল সে। গ্রাম ছেড়ে, ঠাকমাকে ছেড়ে, একেবারের জন্য। বছর পাঁচেক পর এই প্রথম মা'র কাছে আসে মাধব। অভাবের সংসার। লোকের বাড়ি কাজ করে দুবেলা। ততদিনে দিদির বিয়ে গেছে। একদিন রাতে খেতে বসে শোনায়, "তুই এখন থেকে দিদির বাড়ি থাকবি। দিদির শন-পাপড়ির কারবার।দেখাশোনা করবি এখন থেকে।"

বুকটা দুমড়ে গেল মাধবের। কী বলছে মা এসব? গালে ভাত তুলতে গিয়ে হাত নেমেই গেল পাতেই। "মা, আ-আমাকে আর স্কুলে ভর্তি করবে না?"

তার মা'র কথা সরল না মুখ থেকে। মাথা নিচু করে রইল। ভেতরটা যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে তার। কোনো উত্তর না পেয়ে মাধব মাথা নিচু করে আবার বলল, "দাদু থাকলে ঠিক ভর্তি করে দিত।"

ভাতের থালা ছেড়ে উঠে গিয়েছিল মাধব। সারারাত ঘুমতে পারেনি। বারবার রেজাল্টের কথা মনে পড়ছে। সেটা রেখে এসছিল ঠাকমার কাছে। বলে এসেছিল আসার সময়, "রেখে দাও। মা টাকা দিলে, ফিরে এসে নবতারায় ভর্তি হব।"

ফেরা আর হয়নি মাধবের।

দুদিন না কাটতে কাটতেই দিদিও ফিরিয়ে দিল তাকে। সেই থেকেই মা'র কাছে। সকাল হলেই বেরিয়ে যায় নদীর পাড়ে। স্কুলের সময়ে গিয়ে হাজির হয় বাগানে। কয়েকদিন ঝোপের আড়ালে বসে বসে তাকিয়ে থাকত ঘরগুলোর দিকে। ছেলেমেয়েদের চেঁচামেচি, মাস্টার দিদিমণির পড়ানোর গলা, কানে এলেই চোখ ছলছল করে উঠত তার। একদিন চড়ে বসল গাছের ডালে। সেখান থেকে বোর্ডটা দেখা যায় ভালো। একদিন চোখাচোখি হয় সৌরেনবাবুর সঙ্গে। ব্যস, বিপদ ঘনালো সেদিনই। রে রে করে উঠলেন সৌরেনবাবু, "কে রে ওখানে? ওখানে উঠেছিস কেন? নাম বলছি, নাম।"

কিছু না বলে মাধব হুড়হুড় করে নেমে গেল গাছ থেকে।

একদিন যায়, দুদিন যায়। মাধব নদীর পাড়ে ঘুরে ঘুরে বেরায়। জ্বালানি ভাঙে, এ বাগান সে বাগান থেকে। ডালপালা ভেঙ্গে নিয়ে গেলেই তবে তাদের রান্না হয়। কিন্তু মনের ভেতরে সেই কালিকাপুর উচ্চ বিদ্যালয় উঁকি দিয়ে বেড়ায়। স্কুলের পাশেই বাঁশঝাড়। সেখানে শুকনো কঞ্চির রাজত্ব যেন। সেটা যেন জ্বালানির স্বর্গ। গেলেই কেল্লাফতে। কিন্তু সেখানে গেলে স্কুলের ঘর, ছেলেমেয়েদের চেঁচামেচি, ক্লাস থেকে স্যারেদের গলা... কেমন যেন টেনে টেনে নিয়ে যায় তাকে। কান যেন খাড়া হয়ে থাকে সেসবে। কিন্তু ওদিনের পর থেকে কেমন একটা ভয়, সঙ্কোচ চেপে বসেছে তার মনে মনে। কিন্তু পা যেন তাকে টেনে টেনে নিয়ে যায় সেদিকে।

কঞ্চির তাড়া বাঁধতে বাঁধতে মন উছাটন হয়ে উঠল মাধবের। চুপিসাড়ে গিয়ে উঠল গাছে। সেই ডালে। ডাল টেনে টেনে আড়াল করে নিল চারপাশটা। কিন্তু কথায় বলে না, যেখানে ভুতের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। সৌরেনবাবু যে তক্কে তক্কে ছিলেন কে জানে? ক্লাস চলছে ক্লাসের মতো। মাধবের কান সেদিকে। চোখ রয়েছে ক্লাসের ভেতরে, বোর্ডে।

সৌরেনবাবু কখন যে এদিকে চলে এসেছি্লেন, টের পায়নি মাধব। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরও তিন চারজন ছাত্র। এমন সুযোগ যেন হাত ছাড়া করতে রাজি নন তিনি। এতদিনের ক্ষোভ আর চাপা থাকেনি- "তোর জন্যেই হেড-মাষ্টার সেদিন আমাকে হেয়ো করেছিলেন।

বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান

এবার পড়েছ ধরা বধিব পরান

ব্যাটা কোন ধান্ধায় আসছে, আমরা কি আর বুঝতে পারিনি? এই দেখিস, যেন পালাতে না পারে।"

ছেলেরা যেন মুখিয়া হয়ে ছিল। "স্যার, ও মনে হয় চুরি করতেই…"

"জানলা দিয়ে ব্যাগ হাতানোর ধান্ধা। বুঝলি না?"

"ওকে আগেও একদিন বারণ করেছি। শোনেনি। আবার এসেছে। নিশ্চয়ই ওর অন্য মতলব আছে।"

"এই নাম... নাম বলছি।"

মাধব জড়সড় হয়ে বসে আছে ডালে। পাশের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাদের চেঁচামেচিতে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল এ ক্লাস থেকে সে ক্লাসে। নিচ থেকে উপরে।

সৌরেনবাবু চেঁচাচ্ছেন, "কিরে নামবি, না উঠবে?"

মাধব ধীরে ধীরে নেমে এল নিচে। ছাত্ররা ঘিরে ধরল তাকে। পাঁচিলের ওপারে তখন অকেনেই জড়ো হয়ে গেছে। ছাত্রছাত্রী থেকে মাষ্টার- দিদিমণি সব সব। সবার চোখ সেদিকে। হেডমাষ্টার চেঁচাচ্ছেন, "সৌরেনবাবু ওকে ছেড়ে দিন। চলে আসুন..."

"না স্যার, ছাড়া যাবে না। মেয়েদের দিকে বসে থাকে, বুঝতে পারছেন না? ওর মতলব কিন্তু আলাদা।"

"আপনি চলে আসুন, অন্য ঝামেলা হতে পারে। ছেড়ে দিন।"

"এদের আপনি চেনেন না,স্যার। ওদিকের ইট ভাটার জিনিস এ। এর শিক্ষা দেওয়ার দরকার। এই ধর কান ধর… উঠ-বস কর... দাঁড়িয়ে রইলি কেন? উঠ-বস কর বলছি…"

চোখ ছলছল করছে মাধবের। এতগুলো ছেলেমেয়ের সন্দিহান চোখ তাকে যেন মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে।

"কিরে দাঁড়িয়ে রইলি? কর..."

কোনো কথা বলল না সে। কান ধরে উঠ-বস শুরু করে দিল সেখানেই। অট্টহাসিতে মুখরিত হতে লাগল সারা স্কুল, উপর থেকে নিচ।

চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে মাধবের। টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। ছেলেদের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে, মাথায় তুলে নিল কঞ্চির বোঝা।


( ৩ )

দু'দিন জ্বরে জ্বরে কাটল মাধবের। জ্বালানিও শেষের পথে। সকাল হতেই সে বেরিয়ে পড়ল। নদীর পাড়ে বসে থাকল অনেকক্ষণ। রাস্তায় ছেলেমেয়েদের দেখা যাচ্ছে। স্কুলের ইউনিফর্ম দেখেই বুকটা ছলাৎ করে ওঠে তার। লুকিয়ে গেল সে গাছের আড়ালে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। হঠাৎ কানে ভেসে এল, "স্যার, ভালো আছেন তো?"

উঁকি মারল মাধব। ফাঁকা রাস্তা। তারই একপাশে দাঁড়িয়ে দুজন। সাইকেলেই বসে মাটিতে পা ঠেকিয়ে কথা বলছেন সৌরেনবাবু, "হ্যাঁ ভালো, তুই?"

"ভালো। স্যার, আপনি সাইকেলে..."

"কয়েকমাস হল, এই স্টেশনের কাছে একটা ভাড়া নিয়েছি। ওখান থেকেই... তা তুই কি করছিস এখন?"

"একটা কোম্পানিতে বছর দুয়েক হল। সেলস ডিপার্টমেন্টে..."

"শোন না, অন্য কোনোদিন কথা বলিয়ে। আজ দেরি হয়ে গেছে একটু... আসছি।"

কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে গেল মাধব। খালি হাতে ফিরতেই তার মা তো অবাক। "কিরে জ্বালানি কোথায়? কোথায় ছিলি এতক্ষণ?"

"বিকেলে এনে দেইয়ে।" বলেই ঘরে ঢুকে গেল সে।

দুপুরে খেয়েই বেরিয়ে পড়ল। নদীর পাড় দিয়ে যেতে যেতে শুকনো ডালপালা ভেঙ্গে ভেঙ্গে দড়িতে বাঁধতে লাগল একে একে। আকাশটা হঠাৎ কালো হয়ে এল। টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে নদীর জলে। কালো হয়ে গেল চারদিক। ছুটির পরে ছেলেমেয়েরাও বেরিয়ে গেছে স্কুল থেকে। জোরে বৃষ্টি এলে জ্বালানিগুলোও ভিজে জাউ হয়ে যাবে একেবারে। মাধব অস্থির হয়ে উঠছে ভেতরে ভেতরে। পথের বাঁকেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একা। ওপাশে নদীর জল যেন উতলা হয়ে উঠছে। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বাঁধানো পাড়ের গায়ে। পালা ভাঙতে ভাঙতে ঝোপের আড়াল থেকে বারবার তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। ফাঁকা রাস্তা।

হঠাৎ তার নজর পড়ল ঝোপের ফাঁক থেকে। একটা সাইকেল এগিয়ে আসছে এদিকে। বেশ জোরে। এক হাতে ছাতা। স্টেশনের যাওয়ার শর্টকাট এটাই। চোখ খিলখিল করে উঠল মাধবের। হাতের মুঠো শক্ত হয়ে উঠল নিমেষেই। সাইকেল বাঁক নেওয়ার আগেই শুকনো ডাল ঢুকিয়ে দিল সামনের চাকায়। আছাড় খেয়ে পড়লেন নদীর পাড়ে। সাইকেল সমেত সৌরেনবাবু গড়িয়ে পড়লেন নদীর জলে।

শুধু স্রোতের টানে ছাতাটা ভেসে চলল।

মাধব বোঝা তুলে নিল মাথায়। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল জোরে।
41

গল্প - অসীম দেব

Posted in







চিঙড়ির বহুদিনের প্রেমিকা মোনালিসার বিয়ে হয়ে গেলো, অন্য এক ছেলের সাথে।


চিঙড়ি উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলের মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, বয়স বেশি নয়, এখন উনিশ চলছে। আর মোনালিসা বড়লোকের মেয়ে। বয়স এখন সতেরো। চিঙড়ি ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়াশুনা করে তারপর পড়াশুনা ছেড়েই দিলো। তাঁর স্বপ্ন, নিজের মতন করে ব্যাবসা করবে, সে যতই ছোট হোক। নিজের স্কুলের সামনে তেলেভাজার দোকান দিয়েই শুরু করলো। আর এই দু’বছরে চপ কাটলেট বিরিয়ানি এরকম আরও কিছু সম্ভার নিয়ে দোকান সে এখন বেশ জমিয়ে নিয়েছে। স্কুলের ছাত্ররা আছেই, পাড়ার অন্যরাও এখন তাঁর নিয়মিত কাস্টমার। ভালোই রোজগার। আর অন্যদিকে মোনালিসা এখন সদ্য কলেজে ঢুকেছে।


চিঙড়ি বখাটে বাজে ছেলে নয়। সুদর্শন, কথাবার্তায় নম্র, ভদ্র, রকবাজ নয়, মেয়েদের সিটি মারে না, গালাগালি খিস্তি মারে না, মদ গাঁজা খায় না। সেজন্য পাড়ার লোকেরাও ভালোবাসে। দোষের মধ্যে একটাই, সে ক্লাস সিক্স থেকেই বিড়ি খায়, তবে লুকিয়ে, পাড়ার বড়দের সামনে খায় না। মোনালিসা জানতো যে চিঙড়ির বিড়ির শখ, কিন্তু মধ্যবিত্ত ঘরের স্বাধীনচেতা ছেলে বাপের পয়সায় বড়লোকি নেশা করবে না। মোনালিসাই চিঙড়িকে সিগারেটের খরচা দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু সে রাজি হয় নি। অনেক হ্যাঁ না হ্যাঁ না’র পরে চিঙড়ি রাজি হয়, তবে সস্তার বিড়ির খরচা নেবে, সিগারেটের নয়। সেই সিস্টেম এখনও চলছে। চিঙড়ির ব্যাবসা এখন ভালো চলা সত্বেও বড়লোকের মেয়ে মোনালিসা এখনও চিঙড়িকে বিড়ির পয়সা দেয়।


ভালোই প্রেমপর্ব চলছিলো, কিন্তু চিঙড়ির এক হিংসুটে প্রতিদ্বন্দ্বী মোনালিসার বাবাকে গোপনে জানিয়ে দিলো যে মোনালিসা চিঙড়ির সাথে লুকিয়ে প্রেম করে। শুধু তাই নয়, চিঙড়িকে নেশা করারও পয়সা দেয়। মোনালিসার বাবা সব শুনলেন। গোপনে চর লাগিয়ে খবর নিলেন যে দুজনের মধ্যে সত্যিই যোগাযোগ আছে। কিন্তু বিড়ির পয়সার ব্যাপারে হাতেনাতে প্রমাণ ধরতে পারলেন না। উনার পিতৃদত্ত নাম কমল মিত্র। এবং বাংলা সিনেমার কমল মিত্রের আদবকায়দা নকল করেন। ভাবলেন, বাংলা সিনেমার সেই কমল মিত্রের স্টাইলেই চিঙড়িকে ডেকে বলবেন, এই নাও, ব্ল্যাংক চেকে সই করে দিয়েছি। টাকার অংকটা তুমিই বসিয়ে নিও, আর এবার আমার মেয়ের থেকে দূরে সরে যাও। কিন্তু ব্যাবসায়ী মানুষ, এক অচেনা তেলেভাজাওয়ালাকে এত অনায়াসে ব্ল্যাংক চেক কেন দেবেন?


মেয়েকে ডাকলেন।

তুমি এই তেলেভাজাওয়ালা চিঙড়িকে চেনো?

মোনালিসা বুঝলো, যে করেই হোক বাবার কানে খবর গেছে, আর লুকিয়ে রাখা যাবে না। আমতা আমতা করে জবাব দিলো, “হ্যাঁ বাবা। কিন্তু সে এখন আরও অনেক কিছুই করে।“

কি রকম?


মানে সকালে চা, লুচি, আলুর দম, ডিম। দুপুরে মাংস, বিরিয়ানি, আর বিকেলের দিকে তেলেভাজা, চপ, ফিস ফ্রাই, বিরিয়ানি, এইসব। হোম ডেলিভারিও দেয়। ভালোই রোজগার করে।


বাঃ, তাহলে তো তিনি একজন শিল্পপতি।

মোনালিসা চুপ করে থাকে। বুঝে গেছে যে, বাবার কাছে আর লুকিয়ে লাভ নেই। বাবা হাঁক দিলেন, “শুনছো, তোমার মেয়ে নিজের বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করে ফেলেছে, একজন শিল্পপতির সাথে।“

শুনেই মা দৌড়ে এলেন, “ও মাঃ, তাই? ছেলে কি করে?”

সে তোমার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করো।


হ্যাঁরে, ছেলে কি করে? বাড়ি গাড়ি আছে তো?

মোনালিসাই জবাব দেয়, “গাড়ি, মানে একটা মোটর সাইকেল কিনেছে।“

মোনালিসার মা শুনে মনে স্বস্তি পেলেন। “সে ঠিক আছে, আমরাই না হয় যৌতুকে একটা গাড়ি দিয়ে দেবো।“

মোনালিসার বাবা থামিয়ে দিলেন, “দাঁড়াও। আগে খোঁজ নিয়ে দেখি গাড়ির তেল ভরার টাকা ওঁর আছে কি না।“


পরের দিন সকালে অফিস যাওয়ার পথে মোনালিসার বাবা চিঙড়ির দোকানে গিয়ে হাজির হলেন। দামী গাড়ি থেকে নামলেন, গায়ে স্যুট, মুখে পাইপ, কে ইনি? চিঙড়ি ভদ্রলোককে ঠিক চিনতে পারে না। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই উনি সোজা প্রশ্ন করলেন, “তোমার নাম চিঙড়ি?”

আজ্ঞে হ্যাঁ, আমিই চিঙড়ি, কাকু আপনাকে তো চিনলাম না।


চিনবে না। তুমি যার থেকে বিড়ি খাওয়ার পয়সা নাও, আমিই তাঁর বাবা।

চিঙড়ি কি করবে ভেবে পায় না। সামনের কাঠের বেঞ্চ দেখিয়ে বলে “কাকু, বসুন বসুন। একটু চা খাবেন?”

না, বসবো না। এরকম কাঠের বেঞ্চে আমার বাড়ির দারোয়ান বসে। আর শোনো, পথেঘাটে আমাকে জোর করে কাকু বানাবে না।

চিঙড়ি চুপ করে থাকে।

মাসে কত পয়সা রোজগার করো?

চিঙড়ি এবার কাকুর থেকে স্যারের সম্বোধনে চলে আসে।

স্যার, সব খরচা, লোকের মাইনে, পুলিশ, তোলা এসব দিয়েও মাসে হাজার পয়ত্রিশ চল্লিশের মতন হাতে থাকে স্যার।


বাজে কথা বলো না। এতো টাকা থাকলে এরকম নোংরা গেঞ্জি আর সস্তার প্যান্ট পড়ে আছো কেনো?

চিঙড়ি চুপ করে গেলো।


প্রেমপর্ব থমকে গেলো। আর অন্য ছেলের সাথে মোনালিসার বিয়েও হয়ে গেলো। বর কোনরকমে একটা ডিপ্লোমা জুটিয়ে ছোটখাটো এক ওষুধ কোম্পানির সেলস রিপ্রেসেন্টেটিভ। যা মাইনে পায়, তাতে মাসের শেষে বাপের থেকেই মোটর সাইকেলের তেলের পয়সা নেয়। কিন্তু মোনালিসার বাবা দেখেছেন ছেলের বাবা বড়লোক। ছেলে ভালো জামাকাপড়, গলায় টাই লাগিয়ে মোটর সাইকেলে করে অফিস যায়। আর ছেলের বাবাও দেখেছেন মেয়ের বাপ মালদার পার্টি। সুতরাং দুই জাঁদরেল বাবার ইচ্ছেয় বিয়েটা হয়েই গেলো। দুঃখে বিরহে চিঙড়ি আর দোকানেই গেলো না। এক সপ্তাহ কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালো। দাড়ি না কামিয়ে নিজের অজান্তেই দেবদাস হয়ে গেলো।


পাড়ার মনু’দা চিঙড়ির দোকানে রোজ সকালে চা খেতে আসেন। চিঙড়ির সাথে হেব্বি দোস্তি। এই মনু’দার অনেক বয়স। কলকাতার ছেলে, ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বিহারে কোল ইন্ডিয়ায় চাকরী করতে গিয়ে কালক্রমে কয়লাখনির ছোট্মাপের মাফিয়া হয়ে যান। এখন সব ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এসেছেন। যেমন প্রচুর টাকা, তেমনই প্রচুর দানধ্যান। অভাবী লোকজনদের নিয়মিত অর্থসাহায্য করেন। অঞ্চলের প্রভাবশালী লোক। কলকাতার অনেক বড় বড় নেতা, মন্ত্রী, পুলিশের সাথে ভালোই ভাব ভালোবাসা আছে। তবে রাজনীতির ঝুট ঝামেলায় থাকেন না। সেই মনু’দা রোজ এসে দেখেন চিঙড়ির দোকান বন্ধ।


হঠাৎ একদিন রাস্তায় চিঙড়িকে পেলেন। “এ কিরে? কি চেহারা বানিয়েছিস? দোকান বন্ধ করে দিয়েছিস কেন?”

চিঙড়ি চুপ করে থাকে। মনু’দা চিঙড়ির প্রেমের উপাখ্যান জানতেন, আর এও জানেন যে সেই মেয়ের কিছুদিন আগেই অন্য ছেলের সাথে বিয়েও হয়ে গেছে। মনু’দা লোকচরিত্র খুব ভালো বোঝেন। চিঙড়ির সমস্যা বুঝতে মনু’দার সময় লাগে না। সামনেই যে চায়ের দোকানটা ছিলো, জোর করে চিঙড়িকে সেখানে নিয়ে গিয়ে সোজা প্রশ্ন করলেন, “মেয়ের শ্বশুরবাড়ি কোথায়?”

চিঙড়ি জানে না, সত্যি জানে না। তবু প্রশ্ন করলো, “কেন? জেনে কি করবে?”

তাহলে শোন। তুই এখন নিজের পাড়ায় একটা ছোট চায়ের দোকানের মালিক। তুই এবার ওঁর বাড়ির সামনেই থ্রি স্টার রেস্টুরেন্ট খুলবি। দেখিয়ে দিবি ব্যাবসা আর পয়সা কাকে বলে। আমিই তোর সব ব্যাবস্থা করে দেবো।

চিঙড়ি বুঝলো না। শুধু বললো, “আর এখনের দোকান?”

সেটাও চলবে। কিন্তু সবার আগে সেই মেয়ের শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা আমার চাই।

চিঙড়ির খেয়াল হলো যে বিয়ের ঠিক আগেই মোনালিসার বাবা গাড়ি হাঁকিয়ে বিয়ের কার্ড দিতে এসেছিলেন। গাড়ি থেকে নামেন নি। বলেছিলেন, “এই যে, আমার মেয়ের বিয়ের কার্ড দিয়ে গেলাম। তোমাকে আর বিয়ের আসরে আসতে হবে না, আমিই তোমার জন্য দই সন্দেশ নিয়ে এসেছি।“ এরপর গাড়ির ড্রাইভার এক হাঁড়ি দই আর এক বাক্স সন্দেশ রেখে চলে গেলো। চিঙড়ি ভাবলো, সেই কার্ডেই হয়তো শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা দেওয়া আছে। আর মনু’দা যদি ইচ্ছে করেন, তাহলে অনেক অসম্ভবকেই সম্ভব করতে পারেন। “মনু’দা, কাল সকালেই আমি দোকান খুলবো, তুমি সকালেই একবার এসো।“


ভাগ্যিস মোনালিসার বিয়ের কার্ডখানা চিঙড়ি রেখে দিয়েছিলো। মনু’দা কার্ড দেখলেন। “আচ্ছা। বাপের নাম কমল মিত্র। তুমি যদি শালা কমল মিত্র হও, তাহলে আমিও চিঙড়িকে উত্তমকুমার বানিয়ে ছাড়বো।“

চিঙড়ি কিছুই বুঝলো না। “তোকে এখন এসব বুঝতে হবে না। এই কমল মিত্র, মানে তোর মোনালিসার এখনের বাড়ি টালিগঞ্জের গলফ গ্রীনে। তোর থ্রিস্টার রেস্টুরেন্ট তাহলে ঐ পাড়াতেই হবে। আমাকে কিছুদিন সময় দে।“

সেদিন এর বেশি আর আলোচনা হলো না।


দিনকয়েক বাদেই মনু’দা ফিরে এলেন। “শোন, তোর জন্য ভালো খবর আছে। আপাতত টালিগঞ্জ টিভি সেন্টারের ক্যান্টিনের বরাত তোকে করিয়ে দেবো। আর বাইরে তার পাশেই একটা খালি জায়গা আছে। কিছুদিন বাদে সেখানেই তুই একটা এক্সটেনশন কাউন্টার দিবি। পাকা কথা সব হয়ে গেছে। আমিই সব ব্যাবস্থা করে দেবো।“

চিঙড়ি কিছুই বুঝলো না। “টিভি সেন্টারের ক্যান্টিন?”

হ্যাঁ, টিভি সেন্টার। টিভির আর্টিস্ট গায়ক গায়িকা মিউজিশিয়ান স্টাফ কর্মচারি এনাদের তুই চা কফি, বিরিয়ানি, ফিস ফ্রাই এসব সাপ্লাই করবি।


আর কি যেন বললে টেনশন কাউন্টার?


শালা, লেখাপড়া ছেড়ে দিলে এই হয়। ওটা এক্সটেনশন কাউন্টার। ওটা পরে হবে। আগে শুধু টিভি সেন্টার দিয়ে শুরু কর।


টিভি সেন্টারের ক্যান্টিন আগেই ছিলো। কিন্তু বন্ধ ছিলো। চিঙড়ি হাজার তিরিশ খরচ করে সেই ক্যান্টিনই মডার্ন করে সাজালো। মনু’দা বুঝিয়েছেন, এঁরা উঁচু ক্লাসের লোক, এঁদের চাই শো বিজনেজ। চায়ের কাপ, প্লেট, জলের গ্লাস, ফ্রিজের কোল্ড ড্রিঙ্কস, বিস্কুট, চিপস সব টপ ক্লাস ব্র্যান্ড চাই, একদম টপ ক্লাস। আর চিঙড়িকে দোকানে নিয়ে গিয়ে ভালো জামাকাপড়ও কিনে দিলেন। টিভি সেন্টারে চিঙড়ির ক্যান্টিন শুরু হয়ে গেলো।


টিভি সেন্টারে চিঙড়ি এখন অর্ডারের ফোন পেলে গুড মর্নিং বা গুড ইভনিং দিয়েই কথা শুরু করে। কিছুদিন আগে যে ভাঁড়ের চা ছ’টাকায় বিক্রি হতো, সেই চা এখন দামী কাপে কুড়ি টাকায় বিক্রি হয়। একটা বছর সতেরো আঠারোর সদ্যযুবতী মেয়েকেও মাইনে দিয়ে রেখেছে, টেবিলে গিয়ে অর্ডারের জিনিষ দিয়ে আসে। রোজকার চা, শিঙাড়া, লুচি পরোটা তরকারি, দুপুরের ভাত মাংস বিরিয়ানি, সন্ধ্যার ফিস ফ্রাই চিকেন মাটন রোল এসব আছেই, আর শ্যুটিং বা রেকর্ডিং থাকলে স্পেশাল মেনু। সব মিলিয়ে প্রথম মাসে চিঙড়ি ভালোই রোজগার করলো। মনু’দার উপদেশে চিঙড়ি নিজেই কিচেন সামলায়, কাউন্টারে বসে, তাই খরচও অনেকটা বেঁচে যায়। চিঙড়ি এখন ভালো জামা পড়ে। চুলে শ্যাম্পু দেয়। দাড়ি কামায়। সেই চায়ের দোকানের চিঙড়ি এখন ক্যান্টিন ম্যানেজার হয়ে গেছে। ওদিকে চিঙড়ির শ্যামপুকুরের চায়ের দোকানে মনু’দাই একটি বিশ্বাসী ছেলেকে কমিশন রেটে লাগিয়ে দিয়েছেন।

মাসের শেষে মনু’দা একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন, “নে এই কাগজটা সবাইকে দিয়ে আয়।“

এটা কি?


ফিডব্যাক ফর্ম। তুই বুঝবি না। কাগজগুলো দু’দিন পরে সকলের থেকে ফেরত নিয়ে তারপর আমাকে সবগুলো দিবি।


কয়েকমাসের মধ্যেই চিঙড়ির ক্যান্টিন দাঁড়িয়ে গেলো। মনু’দা সেলিব্রিটিদের খাওয়ার ভিডিও তুলছেন, আর ইউটিউবে পোস্ট করছেন। এবার মনু’দা বুঝিয়েছেন, “তোর চায়ের ঠেক আছে, টিভি সেন্টারে ক্যান্টিন আছে। এবার থ্রি স্টার রেস্টুরেন্ট খুলবি, জায়গাও ঠিক করা আছে।“

আরও বললেন, “একটা শেফ আর একটা ভালো মেয়ে জোগাড় করতে হবে। শেফ দরকার, দু’জায়গার কিচেন তুই একা সামলাতে পারবি না।“

কিন্তু মেয়ে কেন?


হ্যাঁ, মেয়ে চাই। থ্রি স্টার রেস্টুরেন্টে তোমার শ্যামপুকুরের গেঞ্জি পড়া ছেলে চলবে না।

মেয়েও জোগাড় হয়ে গেলো, নাম পদ্মরাণী। মনু’দা বললেন, এই নাম চলবে না। নাম দিলেন তনুজা। “তোকে আমি উত্তমকুমার বানাবো, সঙ্গে এসব পদ্মরাণী চলবে না।“


চিঙড়ির চায়ের দোকানে রোজগার ভালোই ছিলো। টিভি সেন্টারের ক্যান্টিন থেকেও ভালো রোজগার হচ্ছে। হাতে এখন পয়সা আছে। মনু’দাই ভালো আর্কিটেক্ট ডেকে নতুন রেস্তোরাঁ বানিয়ে দিলেন। রেস্তোরাঁ দেখে চিঙড়ি অবাক। ভেতরটা কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার। “শোন, দিনের বেলায় ভেতরে লাইট জ্বলবে, আর রাতে হাল্কা আলো। আর প্রেম করা ছেলেমেয়েরা এলে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিবি।“

দিনে লাইট আর রাতে মোমবাতি?


হ্যাঁ, মোমবাতির আলোয় প্রেম, তবে শুধুই রাতের সময়।


দেয়ালের চারিদিকে কিসব ছবি, চিঙড়ি আগে এরকম দেখেনি। “শোন, এই লোকটা জর্জ হ্যারিসন, আর এই লোকটা ড্রাগের সম্রাট পাবলো এস্কোবার, ইনি মার্লোন ব্র্যান্ডো, বিসমিল্লা খান, জিমি হেন্ড্রিক্স, ওদিকে আমাজনের জঙ্গল। “

আমার দোকানে ড্রাগের চোরাকারবারির ছবি?


দোকান নয়, এটা তোর রেস্তোরাঁ। কি বলবি? রেস্তোরাঁ। আর এই ছবিগুলো হলো ইন্টিরিয়র ডেকরেশন। এগুলোই আমাদের মার্কেটিং। এখানে তোর দীপিকা পাড়ুকোনের ছবি চলবে না।


কলকাতার কিছু নেই?


ঐ তো, কোনায় পুরনো ট্রামের ছবি।


দেওয়ালে বিরাট এক টিভি। দেখানো হবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ফর্মূলা ওয়ান, স্প্যানিশ লীগ, উইমবল্ডন, বিগ ব্যাশ, আইসল্যান্ডের ভল্কানো। সাউন্ড সিস্টেমে চলবে সাইকেডেলিক মিউজিক, রক মিউজিক। চিঙড়ি শুনছে, কিছুই বুঝছে না। তবে এটা বুঝে গেলো যে, ঘ্যামা কিছু একটা হতে চলেছে। এককোনে একটা মোটা দড়ির জাল, কিছু ঘড়া আর বন্দুক ঝোলানো। “এটা কেন? আমার বন্দুকের লাইসেন্স কোথায়?”

এসব ইন্টিরিয়র ডেকরেশন। বুঝবি না। তুই এবার রেস্তোরাঁ চালু কর।


এবার টিভি সেন্টারের ঠিক বাইরে রাস্তায় লোকজন দেখলো এক ঝাঁ চকচক নতুন রেস্তোরাঁ, মোনালিসা কাফে। ইংরেজিতে মেনু কার্ড ছাপানো হয়েছে, যা চিঙড়ি নিজেই বোঝে না।

Shingnim Cashewnut with Spanish Red Tomato & Sugar, মানে শিঙাড়া নিমকি টমেটোর চাটনি, এক প্লেট ৭৫ টাকা।

Deep-Fried South Asian Puffy Bread Unstuffed মানে লুচি, এক প্লেট ৬০ টাকা।

Deep-Fried Flat Bread Large মানে পরোটা। এক প্লেট ৫০ টাকা।

Andulesian Flat Bread Egprota Small ডিমের পরোটা। এক প্লেট ৫০ টাকা।

Andulesian Flat Bread Egprota Large মানে ডাবল ডিমের পরোটা। এক প্লেট ৭০ টাকা।

Roasted King Veg with White Butter, মানে শুকনো নিরামিষ তরকারি। এক প্লেট ৫০ টাকা।

Continental Salted Mutton Veg Reddish Brewani, মানে বাঙালী বিরিয়ানি। এক প্লেট ১৫০ টাকা।

Rice Soup with Fried Soft Chicken & Onion, মানে পান্তা ভাত, পেঁয়াজ আর এক পিস চিকেন ফ্রাই দিয়ে, ১৫০ টাকা।

Castrated Casual Caprae Escam in Onion Garlic and Masterd Oil. মানে দু’ পিস পাঠার মাংসের ঝোল, এক প্লেট ২০০ টাকা।

Marinated Italian Fish Fried with Yogurt Coating, মানে ফিস ফ্রাই। এক প্লেট ৭০ টাকা।

Exotic Chicken with Curated Lactobacillus Sauce and Garnished Coriandrum. মানে মুরগীর ঝোল, দু’ পিস। এক প্লেট ১৫০ টাকা।




মনু’দা বুঝিয়ে দিলেন। পরোটা মানে Flat Bread, ডিমের পরোটা মানে এগ পরোটা, সেটাকেই Egprota করা হয়েছে, বিরিয়ানিকে Brewani

চিঙড়ি দেখছে, এইরকম সব নাম,আর দাম। প্রতিটি মেনুর সাথে একটা করে রঙচঙে ছবিও দেওয়া আছে। বাংলা নামগুলো মনু’দাই বুঝিয়ে দিলেন, “পাবলিক অচেনা নাম হলেই খেতে আসবে। তোর শিঙাড়া, ডিমের পরোটা খেতে কেউ আসবে না।“

মনু’দা, এগুলো তো আমাদের পাতি বাঙালীদের মেনু! আর যা দাম রেখেছো লোকে কিনবে?”

মনু’দা বিজ্ঞের হাসি দিয়ে বললো, “ভুলে যাস না, থ্রি স্টার রেস্তোরাঁ। শিঙাড়া নিমকির বদলে শিঙনিম খাবে। এগ পরোটা নয়, এগপ্রোটা। এই নামেই কাটবে। লুচি ডিম বললে থ্রি স্টার হবে না।“

কিন্তু পাড়ার ছেলেরা, স্কুলকলেজের ছেলেমেয়েরা, প্রেম করা বেকার ছেলেমেয়েরা এই দাম শুনে আসবে?


বাইরে বোর্ড টাঙিয়ে দেবো, স্টুডেন্ট এন্ড ইয়ং কাপল ডিসকাউন্ট। তাহলেই আসবে।

রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই এসবেস্টস শেডের নীচে কিছু বেতের মোড়া, আর দুটো ছোট ছোট সেন্টার টেবল। “এগুলো বিজয়গড় আর নেতাজীনগর কলেজের ছেলেদের জন্য যারা এক কাপ চা নিয়ে দু’ঘন্টা বসবে, এঁড়ে তক্কাতক্কি করবে, তাঁদের জন্য।“

চিঙড়ি বুঝলো না। “তোকে এসব বুঝতে হবে না। ওঁরা এসে নিকারাগুয়ার কৃষক আন্দোলন, প্যালেস্টাইনের গৃহযুদ্ধ, পাগালু দ্বীপে মার্কিন উপনিবেশ, ইথিওপিয়ায় খরা মোকাবিলা এসব নিয়ে আলোচনা করবে। ওঁদের কথাবার্তা তুই বুঝবি না। তোর কাজ হবে শুধু ওনাদের চা দিয়ে সরে আসা।“


রেস্তোরাঁ চালু হয়ে গেলো। মনু’দার স্ট্র্যাটেজিক উপদেশে কাউন্টারের স্কার্ট পড়া মেয়েটি নিজের নাম বদলে এখনে তনুজা হয়ে গেছে। পথচলতি স্কুলের ছেলেমেয়েরা আর কমবয়সী লোকজন ডিসকাউন্ট দেখে ভিড় করে। মনু’দা ইউটিউবে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দিলেন। প্রতি দশদিন বাদে বাদে পাড়ার বাড়ি বাড়ি ফ্রি হোম ডেলিভারির লিফলেট বিলি করে দিলেন। এখন ফোনে অর্ডার আসছে। দেখা গেলো জনতা দশ টাকার জিনিষ খুশী হয়ে ত্রিশ চল্লিশ টাকায় খেয়েও নিচ্ছে। এক কাপ কফি সত্তর টাকায় খুশী হয়ে খাচ্ছে। সেই খুশীর ভিডিও ইউটিউবেও পোস্ট হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন বাদে যখন ডিসকাউন্টও কমিয়ে দেওয়া হলো, কাস্টমাররা তার কিছুই টের পেলো না।


মোনালিসা কাফের নাম পাড়ায় আর আশেপাশে ছড়িয়ে গেছে। দশ মাসের মাথায় মনু’দার উপদেশে কাউন্টারের মেয়েটি মোনালিসার নাম্বারে একের পর এক ফোন শুরু করলো। ম্যাডাম, একবার চান্স দিন। একবার প্লিজ ভিজিট দিয়ে ট্রাই করুন। এত অনুরোধের পর ম্যাডাম একদিন সত্যিই রেস্তোরাঁয় এলেন, তবে জানতে পারলেন না যে কে রেস্তোরাঁর মালিক? এরপর আরেকদিন এলেন। মোনালিসা খেয়ে খুশী, ওঁর বাড়িতে হোম ডেলিভারি শুরু হয়ে গেলো।


ইতিমধ্যে মনু’দার উপদেশে ব্যাংক লোন নিয়ে চিঙড়ি একটা গাড়িও কিনেছে। আর তার কয়েকদিন বাদেই এলো মোনালিসার বিয়ের বার্ষিকীর দিন। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় রেস্তোরাঁয় কিছু স্পেশাল মেনু তৈরি হয়েছে। রাত আটটায় স্যুট টাই পরে চিঙড়ি আর তাঁর সঙ্গী তনুজা সুন্দর সেজে গাড়ি হাঁকিয়ে স্পেশাল মেনু, হাতে ফুলের গোছা, আর একটা গ্রীটিংস কার্ড নিয়ে মোনালিসার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত। বেল বাজাতেই দরজা খুললেন স্বয়ং মোনালিসা। পিছনে দাঁড়িয়ে কমল মিত্র। মেয়ের বাড়ি এসেছেন, বিয়ের বার্ষিকীতে।

“ম্যাডাম, আমরা পাড়ার মোনালিসা কাফে থেকে এসেছি। আমাদের কম্পিউটার ডাটাবেস বলছে আজ আপনার ম্যারেজ এনিভার্সারি। আপনার নাম দেখলাম মোনালিসা। তাই এটা আমাদের মোনালিসা রেস্তোরাঁ থেকে আপনাদের জন্য আমাদের স্পেশাল স্পেশাল কমপ্লিমেন্টারি।“


মোনালিসার চিনতে কোন অসুবিধা হয় নি, কিন্তু কমল মিত্র চিনতে পারলেন না। বললেন, “কমপ্লিমেন্টারি ফুড? বাঃ বেশ ভালো বিজনেস প্রমোশন তো। থ্যাঙ্কস ইয়ং বয়। কোথায় তোমার কাফে?

স্যার, এই তো টিভি সেন্টারের পাশেই। মোনালিসা ম্যাডাম কয়েকবার ক্যান্ডল লাইট এভনিং স্ন্যাক্স খেতে এসেছিলেন।

মোনালিসা অবাক। বার তিনেক সে বরের সাথে কাফেতে গিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু আশ্চর্য? চিঙড়িকে তো সে খেয়াল করে নি।

কমল মিত্র বেশ ইম্প্রেসড, “কি নাম তোমার?”

স্যার, আমার নাম উত্তমকুমার। আর ইনি আমার ম্যানেজার তনুজা।

কমলবাবু বেশ পুলকিত। “বাঃ, বেশ ইন্টারেস্টিং কম্বিনেশন!!”

স্যার, মাঝে মাঝে প্লিজ অর্ডার দেবেন। আর ম্যাডাম মোনালিসা, মাঝে মাঝে প্লিজ আমাদের কাফেতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে আসবেন।


বলো কি? এই পাড়ায় ক্যান্ডল লাইট ডিনার? কেমন চলছে বিজনেস?


ভালোই স্যার। মোনালিসা ম্যাডামের পাশেই গলফ গ্রীন সি টাওয়ারের ১২ তলার ফ্ল্যাটটা বুক করেছি। খুব তাড়াতাড়িই এখানে চলে আসবো।


আই এম রিয়ালি ইম্প্রেসড মাই বয়। কি যেন বললে, তোমাদের নাম? উত্তমকুমার তনুজা? আমার নামও ফিল্ম স্টারের, কমল মিত্র।


জানি স্যার। আর স্যার, প্লিজ মনে রাখবেন, আমার নাম উত্তমকুমার।


কমল মিত্র আর মোনালিসার চোখের সামনে দিয়ে উত্তমকুমার আর তনুজা সোফার ড্রিভেন গাড়িতে গিয়ে উঠলো।
2

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















দশম পর্ব

ইংরেজ বনাম ফরাসি-বিঘ্নিত সহাবস্থান - অসহায় সিরাজ

জিন ল আর জগতশেঠের কথাবার্তার মধ্যে যখন সিরাজের প্রসঙ্গ এল , যখন তার নিষ্ঠুরতার কথা উঠল কথাপ্রসঙ্গে ল এর বুঝতে অসুবিধে হল না যে জগতশেঠেরা সিরাজের জায়গায় অন্য নবাব চাইছে।কোনরকম রাখঢাক না রেখে একটু নিচু গলায় একজন ল’কে জানিয়ে দিল যে এখানে এই প্রসঙ্গ আলোচনা না করাই ভাল। যদি সত্যি সত্যি জগতশেঠেরা সিরাজকে সরাবার ব্যাপারে আগ্রহী না হত তাহলে অবশ্যই তাদের হাবেভাবে আচারে ব্যবহারে তার প্রকাশ পেত। ইংরেজদের অনুগত ওমনিচাঁদ ওখানে ছিল। ওরা হয়ত সবাই ভেবেছিল যে সিরাজ গদিচ্যুত হলে ফরাসিরাও হয়ত ওদের মত শান্তি পাবে। তখনও পর্যন্ত ইংরেজদের সঙ্গে ফরাসিদের শত্রুতা সেই জায়গায় যায়নি বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। ল পরে বুঝেছিল যে তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছিল। ক্লাইভ ইতিমধ্যেই জগতশেঠের সঙ্গে এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল যে সিরাজকে সরানোর চক্রান্ত যদি কার্যকর হয় তাহলে ফরাসিদের সমস্ত সম্পদ জগতশেঠের হাতে তুলে দেওয়া হবে। ঘটেছিলও তাই। ল পরবর্তীকালে বুঝতে পেরেছিল যে চক্রান্ত আরও গভীর। জগতশেঠ আর ইংরেজদের মিলিত চক্রান্ত শুধু সিরাজের বিরুদ্ধে নয়, ফরাসিদের বিরুদ্ধেও। কিন্তু সেদিন জগতশেঠের সঙ্গে কথা হবার পর ল এর মনে হয়েছিল যে সিরাজ এবং ফরাসিরা নিরাপদ নয় যদিও এই চক্রান্তের গভীরতা সম্পর্কে সেদিন সে কিছু আন্দাজ করতে পারেনি। অনেক ভেবে এই চক্রান্তের খবর নিয়ে সেদিন সন্ধ্যাবেলা ল পৌঁছে গেল সিরাজের দরবারে। সব শুনে সিরাজ হেসে উড়িয়ে দিল। ল এর মনে হল এই অপরিণতমস্তিষ্ক কিশোরের তলিয়ে ভাবার তো কোনও ক্ষমতাই নেই তারপর সবসময় একাধিক স্ত্রী এবং দাসীপরিবৃতা হয়ে থাকে সে। কখন যে কী বলে তার কোনও মাথামুন্ডু থাকেনা বেশিরভাগ সময়। ঘটনাচক্রে সেইসময় ব্রিটিশ ফ্যাক্টরির প্রধান ওয়াটসও এসে উপস্থিত হল। সিরাজ ল এবং ওয়াটস দু’জনকেই শান্তি ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য অনুরোধ করল। ওয়াটস কিন্তু ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে বলল যে নবাব যেন এ ব্যাপারে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের সঙ্গে পত্রালাপ করে। ল নিজেকে সামলাতে না পেরে বলল সে জানে যে আগের মতই নবাবের চিঠিকে কোনরকম গুরুত্ব দেবেনা ওয়াটসন। সিরাজ জ্বলে উঠল। চিৎকার করে বলল তা কী করে সম্ভব।ওরা কি জানেনা সিরাজ কে? কী তার ক্ষমতা? দরবারশুদ্ধু লোক একসাথে যোগ দিল সিরাজের সঙ্গে এবং জানিয়ে দিল যে সিরাজের আদেশ যেন পালন করা হয়।

অ্যাডমিরালের উত্তর সিরাজের কাছে আসার আগেই ওয়াটসন এবং ক্লাইভ চন্দননগর আক্রমণ করল। সে দিনটা ছিল ১৫ই মার্চ, ১৭৫৭। ল সেই রাত্রেই ব্রিটিশদের চন্দননগর আক্রমণের সংবাদ নিয়ে সিরাজের কাছে ছুটে গেল। মাঝরাত্রে এক খোজা এসে নবাবকে খবর দিল যে ব্রিটিশরা চন্দননগর আক্রমণ করেছে। সিরাজ তার সেনাবাহিনীকে চন্দননগর যাবার আদেশ দিল কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আদেশ ফিরিয়ে নেওয়া হল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোনওরকম পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত কিছুতেই নিতে পারল না সিরাজ। ফরাসিরা পিছু হটছে শুনে রাইদুর্লভকে এগোতে বলা হল কিন্তু যেই খবর এল চন্দননগর ব্রিটিশদের দখলে চলে গেছে সিরাজ সে আদেশ প্রত্যাখ্যান করে নিল। দৃশ্যত দ্বিধাগ্রস্ত সিরাজ একবার ভাবলো যে ফরাসিদের সঙ্গে জোট বাধাটা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে আবার পরমুহূর্তে মনে হল চন্দননগর যদি ইতিমধ্যেই দখল হয়ে যায় তাহলে এই জোট অর্থহীন হয়ে যাবে। ল কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারল না। সিরাজের অবস্থাও তথৈবচ। চন্দননগর এখান থেকে ১৫ দিনের রাস্তা। এখন সেনা পাঠিয়ে কোনও লাভ নেই। তার অনেক আগেই ব্রিটিশরা চন্দননগর সম্পূর্ণ দখল করে নেবে।চন্দননগর দখল মানেই আজ হোক বা কাল হোক ইংরেজদের পরবর্তী গন্তব্য মুর্শিদাবাদ। উপায়ান্তর না দেখে ল গুপ্তচর লাগিয়ে ওয়াটস এর চিঠির সন্ধান করতে শুরু করে দিল। পাকা খবর এসে পৌঁছল যে ব্রিটিশরা আর কিছুদিনের মধ্যেই মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করবে। ইংরেজ সেনারা এখন পলায়মান ফরাসি সৈন্যদের ধাওয়া করে বন্দি করতে ব্যস্ত থাকবে। ল সিরাজকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করাল যে এই সময় অন্তত একশ সৈন্য যদি কাশিমবাজারের ফ্যাক্টরিতে পাঠানো যায় তাহলে কাশিমবাজারে যে কয়জন ফরাসি সৈন্য আছে তারা কিছুটা সাহস পাবে। ল সিরাজকে আরও রাজি করাল যে কাশিমবাজার ফ্যাক্টরির চারিধারে পাঁচিল তুলে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সিরাজের আদেশ অনুযায়ী কাজ শুরু হল কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই পুরো ব্যাপারটা প্রহসনে পরিণত হল। ভীতসন্ত্রস্ত সিরাজের মনে হল ইংরেজরা যদি তার এই ফরাসিদের সাহায্য করার ব্যাপারটা জানতে পারে তাহলে বিপদ বাড়তে পারে। সিরাজ তড়িঘড়ি ল’কে ডেকে প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার ব্যবস্থা করতে বলল। সিরাজ ল’কে একথাও জানাল এই পরিস্থিতিতে সরাসরি আক্রমণে যাওয়ার চেয়ে ওদের কথা মেনে নেওয়া ভাল হবে। যদিও এই মেনে নেওয়া তার অনভিপ্রেত তবুও এ ছাড়া এই সময়ে আর কোনও উপায় নেই।

ল স্থির করল কাশিমবাজার ফ্যাক্টরি সে সিরাজকে হস্তান্তর করে দিয়ে সে কাশিমবাজার ছেড়ে চলে যাবে। সিরাজ যা ঠিক মনে করবে তাই করবে। পরিণতির জন্য সিরাজই দায়ী থাকবে। ল যখন মোটামুটি নিজের প্রয়োজনমত কিছু সামগ্রী ও টাকাপয়সা নিয়ে ফ্যক্টরি ছেড়ে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে সিরাজের দরবারের একজন আধিকারিক এসে জানাল যে সিরাজ নির্দেশ দিয়েছে যে সে যে কোনও অবস্থাতেই ফ্যাক্টরি ছেড়ে না যায়। সিরাজ কিন্তু ল কে ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণের কথাও বলেনি। ব্রিটিশদের আক্রমণ যে ক্রমশ অনিবার্য হয়ে উঠছে সে কথা বুঝতে পেরে ল মত পরিবর্তন করল না। বারবার সিরাজকে অনুরোধ করল যে তাকে যেন কোনও নিরাপদ স্থানে যাবার অনুমতি দেওয়া হয় এবং নিরাপত্তাসহকারে সেই জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয়। ৮ই এপ্রিল এই মর্মে ল’কে অনুমতি এবং নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল যে সে যেন পাটনার নিকটবর্তী ফুলবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, অন্য কোথাও নয়। আবার এক অজ্ঞাতকারণে ১০ই এপ্রিল সেই অনুমতি প্রত্যাখ্যান করে নেওয়া হল।

ওদিকে ওয়াটস চুপচাপ বসে না থেকে কাশিমবাজারে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করার কাজে নেমে পড়ল। ছদ্মবেশে নবাবের প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে একে একে সৈন্যরা এসে কাশিমবাজারে জমা হল। কাশিমবাজার ফ্যাক্টরিতে নিয়মিত যাতায়াত আছে এমন একজন লোককে খুঁজে বের করে সিরাজের কাছে এই সৈন্য আমদানির খবর পাঠাল ল।সিরাজ এবং ল এর কপালে ভাঁজ পড়ল যখন খবর এল নদীপথে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ যুদ্ধাজাহাজকে মুর্শিদাবাদের দিকে আসতে দেখা গেছে। যে লোকটা ল এর দূত হয়ে সিরাজের কাছে গিয়েছিল তার হাত দিয়ে সিরাজ খবর পাঠাল যে ল যেন কোথাও না যায়। ল পরে জেনেছিল এই লোকটা ফরাসি এবং ইংরেজ দু’জনের কাছ থেকেই মোটা অর্থের বিনিময়ে গোপন খবর সরবরাহ করত।

উত্তেজনার পারদ যখন বাড়তে থাকল তখন ১৩ই এপ্রিল সিরাজের দরবারে ডাক পড়ল ল এর। প্রবল বৃষ্টি সত্ত্বেও ল সকাল বেরিয়ে পড়ল সকাল দশটায়। সিরাজের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সবসময়েই সন্দিহান থাকে ল। আজ সেই সন্দেহের মাত্রা দ্বিগুন হওয়াই স্বাভাবিক। যাবার আগে সকলকে বলে গেল যে যদি দুপুর দ’টোর মধ্যে সিরাজের দরবার থেকে সে না ফেরে তবে চল্লিশজন প্রহরীকে যেন পাঠানো হয়। বৃষ্টি পেরিয়ে ল যখন দরবারে পৌঁছল তখন সিরাজ মধ্যাহ্নভোজের জন্য হারেমের দিকে রওনা দিয়েছে। ল কে একটা লোকভর্তি হলঘরে নিয়ে গিয়ে অন্য অনেক দর্শনপ্রার্থীদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের পংক্তিতে বসানো হল। বিস্বাদ এবং নিম্নমানের খাবার ও পানীয় দিয়ে কোনওক্রমে ক্ষুন্নিবৃত্তি করার পর অন্য একটি হলঘরে তাকে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে সিরাজ ছিল না। সেখানে ওয়াটস এবং জগতশেঠের অনুগত কয়েকজন মান্যগণ্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিল। প্রথামত কুশল বিনিময়ের পর তাকে জিগ্যেস করা হল যে সে ওয়াটসকে কিছু বলতে চায় কি না। ল জানাল তার ওয়াটসকে কিছু বলার নেই। ওয়াটস তখন নিজেই সরাসরি ল’কে জিজ্ঞাসা করল যে সে তার ফ্যাক্টরি ওয়াটস এর হাতে সমর্পণ করতে চায় না ফ্যাক্টরির বাকি সকলের সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে ইংরেজদের আতিথেয়তা উপভোগ করতে চায়। সেখানে তার এবং তার লোকজনদের থাকতে এবং খেতে যাতে কোনও অসুবিধে না হয় সেদিকে লক্ষ রাখার দায়িত্ব ওয়াটসের। ওয়াটস একথাও জানাল যে সিরাজেরও একই ইচ্ছা। ল পরিস্কার জানিয়ে দিল যে তার এবং তার সহকর্মীদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হাত দেওয়া কেবল অনভিপ্রেতই নয় নীতিবিরুদ্ধ আচরণও বটে। যদি ফ্যাক্টরি সমর্পণ করতেই হয় তবে তা করা হবে সিরাজকে , ইংরেজকে নয়। ওয়াটস তখন দরবারে উপস্থিত দেওয়ানদের উদ্দেশ্যে বলল যে তার পক্ষে ল’কে কিছু বোঝানো অসম্ভব। দেওয়ানেরা চেষ্টা করে দেখতে পারে। তার অনুরোধে দরবারে উপস্থিত বাকি সকলে ল’কে রীতিমত করজোড়ে অনুরোধ করতে শুরু করে দিল যে সে যেন ওয়াটসের কথা শোনে। সিরাজ ইংরেজদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আগ্রহী এবং সিরাজ তাকে বাধ্য করবে ওয়াটসের প্রস্তাব মেনে নিতে। ল কিন্তু তার সিদ্ধান্তে অনড় রইল এবং ওয়াটসের বশ্যতা মানতে রাজি হলনা। সে জানিয়ে দিল যে সে কাশিমবাজারেই থাকবে এবং ইংরেজদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই চালাবে। দরবারের আর সবাই অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়ে কোনও ফল না পেয়ে ওয়াটসের সঙ্গে আলোচনা করে সিরাজের সঙ্গে দেখা করার জন্য অন্দরে গেল। দলে ছিল কয়েকজন দেওয়ান, কয়েকজন ব্রিটিশদের দালাল আর কয়েকজন জগতশেঠের লোক। তারা ফিরে এসে জানাল যে সিরাজ জানিয়েছে ল যেন এই মুহূর্তে নিঃশর্তে ওয়াটসের প্রস্তাব মেনে নেয়। কিন্তু ল তার অবস্থানে অনড়। সে জানিয়ে দিল যে সে সিরাজের এই আদেশ মানা তার পক্ষে অসম্ভব এবং যেহেতু সিরাজ তাকে ডেকে পাঠিয়েছে সুতরাং সিরাজের সঙ্গে দেখা না করে সে দরবার ছেড়ে একপাও নড়বে না। ইতিমধ্যে ল এর নিরাপত্তারক্ষীরা এসে পৌঁছেছে এবং রাজপ্রাসাদের দিকে যেতে শুরু করেছে। ল এর অনড় অবস্থানের কথা যখন সিরাজের কানে এল সিরাজ ল এর সঙ্গে একাকি দেখা করতে রাজি হয়ে গেল।

নিয়মমাফিক সৌজন্য বিনিময়ের পর সিরাজ ল’কে বলল যে হয় তাকে ওয়াটসের প্রস্তাব মেনে নিতে হবে অথবা তার এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। সিরাজ জানাল এই অবস্থার জন্য ফরাসিরাই দায়ী। এখন ইংরেজদের হাতে তাকে ভুগতে হচ্ছে এবং সে কোনও ভাবেই চায়না যে গোটা দেশ ইংরেজদের হাতে ভুগতে শুরু করুক। যেহেতু ফরাসিদের নিজেদের রক্ষা করার সামর্থ্য নেই তাদের উচিৎ ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করা। সিরাজ মনে করিয়ে দিল যে যখন ওয়াটসন এবং ক্লাইভের যুদ্ধজাহাজ ইংরেজদের কলকাতা পুনরুদ্ধারের পর হুগলি নদি ধরে এগিয়ে আসছিল তখন ফরাসিদের কাছে সাহায্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল সে। আজ ল কী করে আশা করে যে সে সিরাজের কাছে সাহায্য পাবে। ল প্রত্যুত্তরে জানাল যে ওয়াটসের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে সে নিজেকে অসম্মান করতে পারবে না। যেহেতু সিরাজ চায় না সে এখানে থাকুক তাই সে পাটনা চলে যেতে পারে। সিরাজই তাকে একসময় পাটনা যাবার অনুমতি দিয়েছিল। সিরাজ বাদে বাকি সকলে ল’কে দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পশ্চিমে মেদিনীপুর বা কটক যাবার পরামর্শ দিল। দৃশ্যত বিচলিত ল সোজাসুজি সিরাজকে জিজ্ঞাসা করল সে কি চায় যে রাস্তায় সে শত্রুদের হাতে বন্দি হয়। সিরাজ জানাল যে এরকম কোনও অসাধু অভিপ্রায় তার কোনওদিন ছিলনা এবং এবং এখনও নেই। ল এর যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারে কেউ সহযোগিতা না করলেও তার নিরাপত্তার দায়িত্ব সিরাজের এবং আল্লা তার মঙ্গল করবেন। ল উঠে দাঁড়িয়ে সিরাজকে অভিবাদন জানিয়ে সৌভাগ্য এবং শুভযাত্রার প্রতীক হিসাবে তার হাত থেকে পানপাতা গ্রহণ করে বিদায় নেবার মুহুর্তে সিরাজ বলল যে এই পরিস্থিতিতে ইংরেজদের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষে না যাবার জন্য সে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি পরিবর্তন হলে সে আবার তাকে ডেকে পাঠাবে। ল তার উত্তরে জানাল যে সে সম্ভাবনা নেই। সে স্থিরনিশ্চিত এটাই তাদের শেষ সাক্ষাৎ।

১৫ই এপ্রিল,১৭৫৭- ল যখন মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যাবার সমস্ত প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে ফেলেছে তখন সিরাজ ক্লাইভকে চিঠি পাঠিয়ে জানাল যে সে ইংরেজদের পরামর্শ অনুযায়ী ল’কে মুর্শিদাবাদ থেকে বহিষ্কারের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করেছে এবং তার একান্ত অনুগত পাটনার নায়েব রাজা রামনারায়ণকে নির্দেশ পাঠিয়েছে যে ল যেন কোনওভাবেই তার এলাকাতে থাকতে না পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে। গুপ্তচর এবং বিশ্বাসঘাতকদের সহযোগিতায় ক্লাইভের চোখ এবং কান তখন সিরাজের দরবার, গুপ্তকক্ষ অতিক্রম করে হারেম অবধি পৌঁছে গেছে। ক্লাইভের কাছে এই খবরও এসে পৌঁছেছে যে সিরাজ বিদায়-উপহার হিসাবে ল’কে শুধু দশহাজার টাকা নগদ নয় এই আশ্বাসও দিয়েছে যে যখন ফরাসি গণ্যমান্য ব্যক্তিরা কটকে আসবে তখন সিরাজ তাকে ডেকে পাঠাবে। ক্লাইভের একান্ত বিশ্বাসভাজন অনুচর ওয়াটস ক্লাইভকে জানিয়েছে যে একশ’ ফরাসি নিরাপত্তারক্ষী, ষাটজন তেলেঙ্গি , ত্রিশটি বলদচালিত শকট এবং চারটি হাতি সহযোগে ল এর বাহিনী মুর্শিদাবাদের রাজপথ দিয়ে শহরের সীমান্তের দিকে চলে গেছে। শতশত মানুষ রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে ল এর এই বর্ণময় শোভাযাত্রা দেখেছে এবং তাকে বিদায় অভিনন্দন জানিয়েছে। কিন্তু ল জানে না যে এই শোভাযাত্রার মধ্যে লুকিয়ে আছে ওয়াটসের দুই গুপ্তচর যাদের কাজ প্রভূত অর্থের বিনিময়ে ল এর বিশ্বাসভাজন নিরাপত্তারক্ষী এবং সহযাত্রীদের বিশ্বাসঘাতকে পরিবর্তন করা।

পলাশির যুদ্ধজয়ের পর ব্রিটিশদের এই ঐতিহাসিক চক্রান্তে ওয়াটসের কার্যকারিতা এবং দক্ষতার প্রশংসা করে ৬ই আগস্ট,১৭৫৭ তে লন্ডনের রাজদরবারে এক সভায় ক্লাইভ জানায় যে পলাশির যুদ্ধজয়, ফরাসিদের নির্মূল করা এবং মিরজাফরের সঙ্গে চুক্তি করার পিছনে ওয়াটসের ভূমিকার প্রশংসা না করা অত্যন্ত অন্যায় হবে।

ল এর এই অভিযানের সময় বারে বারে সিরাজের কাছ থেকে বৈপরীত্যে ভরা বার্তা আসতে থাকে। ২রা মে যখন ল বিশ্রাম নেবার জন্য ভাগলপুরে একটু থেমেছে তখন সিরাজের কাছ থেকে খবর এল যাত্রা ত্বরান্বিত করার জন্য। আবার যখন যাত্রার গতিবৃদ্ধি করা হল তখন খবর এল গতি মন্থর করার জন্য। দোলাচলচিত্ত সিরাজের নির্দেশ পালন করতে করতে ৪৫০ কিলোমটার যাত্রা শেষ করতে প্রায় ৪৫ দিন লেগে গেল। পথিমধ্যে অবশ্য ৪৫ জন ফরাসি যারা চন্দননগর থেকে যুদ্ধের সময় পালাতে পেরেছিল তারা এই দলে যোগ দিল। ল এর তখন একটা আশ্রয় দরকার যেখানে পথশ্রমে ক্লান্ত ল এর নিরাপত্তারক্ষীরা কয়েকদিন একটু বিশ্রাম পায়। সৌভাগ্যক্রমে সিরাজের সহকারী পাটনার ভারপ্রাপ্ত নায়েব রাজা রামনারায়ণ তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাল পাটনায়। ল এবং তার দলবল রাজা রামনারায়ণের আতিথ্যে পাটনাতে অপেক্ষা করতে লাগল পরবর্তী নির্দেশের জন্য।

সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত এখন আর কোনও গোপন ব্যাপার নয়। সমস্ত ব্রিটিশ ছাউনিতে এবং রাজদরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে এখন এটাই আলোচনার বিষয়। কিন্তু অবাক কান্ড এটাই যে সিরাজের তথাকথিত বিশ্বাসী গুপ্তচরেরা সর্বত্র ছড়িয়ে থাকলেও তার কানে এ কথা পৌঁছল না যে তার বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং ক্রোধ ক্রমশ সংঘবদ্ধ হচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্র ইতিমধ্যেই ঘনীভূত হয়েছে। মিরজাফরের সঙ্গে ব্রিটিশদের চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে ১৯শে মে। কিন্তু তার অনেক আগেই ২৬শে এপ্রিল ওয়াটস চিঠি দিয়ে ক্লাইভকে জানিয়েছে যে মিরজাফর প্রস্তুত।

৮ই জুন ল সিরাজের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করে দূত পাঠালে সিরাজ তাকে ফিরিয়ে দেয় এবং জানায় যে এখন দেখা করার কোনও প্রয়োজন নেই। দূত ফিরে এসে জানায় সিরাজের কথায় বা ব্যবহারে তার মনে হয়েছে সিরাজ বেশ নিশ্চিন্তেই আছে এবং অদূর ভবিষ্যতে কোনও বিপদের আশঙ্কা সে করছে না। পলাশির যুদ্ধের মাত্র দু’ সপ্তাহ আগে ১০ই জুন সিরাজকে লেখা ল এর চিঠির আর এক নিষ্পৃহ উত্তর ১৯শে জুন ল এর কাছে এসে পৌঁছয়। পলাশির যুদ্ধের তখন আর কয়েকদিন বাকি। চিঠি এবং উত্তর পৌঁছনোর বিলম্বের জন্য ল রাজা রামনারায়ণের কাছে প্রতিবাদ জানালে রাজা রামনারায়ণের ঔদাসীন্য এবং নিষ্পৃহ মনোভাব ল’কে ভাবিয়ে তুলল। তবে কি চক্রান্তের জাল সিরাজের পরম বিশ্বাসী রাজা রামনারায়ণকেও গ্রাস করেছে?