Next
Previous
Showing posts with label গল্প. Show all posts
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in








পর্ব-২১

বণিকের মানদন্ড দেখ দিল রাজদণ্ডরূপে
(সময়ানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত বিবরণী)-দ্বিতীয় অংশ


ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেবলমাত্র এই অন্তর্দ্বন্দের সুযোগে নিজেদের ব্যবসা বাড়িয়েছিল তাই নয় তারা এই সুযোগে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টাও করেছিল এবং বেশকিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও পেয়েছিল।এর আর একটা বড় কারণ হলো যে পারস্পরিক সংঘাত আন্তঃরাজ্য ব্যবসার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করছিল। ১৭৮৪ সালে প্রকাশিত পিটসের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট অনুযায়ী যদিও সামরিকখাতে ব্যয় কমানোর উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক ক্ষমতাদখলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল এবং কোম্পানি অধিকৃত অঞ্চলগুলিকে সুরক্ষিত রেখে রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে ব্যবসাবৃদ্ধির উপরে গুরুত্ব আরোপের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু লর্ড ওয়েলেসলি ১৭৯৮ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই এই আইনকে কার্যতঃ খারিজ করে দিল। ওয়েলেসলির একমাত্র লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা দখল। নিজেকে ভারতবর্ষের একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে দেখার স্বপ্ন নিয়েই এদেশে এসেছিল সে। ১৭৯৮ সালে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ইজিপ্ট এবং সিরিয়া আক্রমণ এবং অধিগ্রহণের চেষ্টা ওয়েলেসলিকে সাহায্য করেছিল ব্রিটিশ সরকারকে ভারত অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে তার সঙ্গে সহমত হবার জন্য। যদিও কারণ হিসাবে ফ্রান্সের ভারত আক্রমণের সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছিল ওয়েলেসলি কিন্তু সে নিজে বিশ্বাস করতো যে ইজপ্ট থেকে স্থলপথে অথবা কেপ অফ গুড হোপের দিক থেকে জলপথে ফ্রান্সের ভারত আক্রমণের কোনও সম্ভাবনা সেই সময় ছিল না। কিন্তু ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারে অনীহাকে মাথায় রেখে ওয়েলেসলি ‘সাবসিডিয়ারি অ্যালায়েন্স’ প্রথা প্রস্তাব করে যাতে বলা হয় কোম্পানি কেবলমাত্র রাজ্যগুলির অভ্যন্তরীন ব্যাপারে নিজেদের নিয়ন্ত্রন কায়েম করবে কিন্তু রাজ্যগুলির রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেবে না। ওয়েলেসলির ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা চরিতার্থ করতে ভারতে কর্মরত অন্যান্য ব্রিটিশ আমলারাও সহযোগিতা করেছিল। অনেক ঐতিহাসিক বলে যে ওয়েলেসলি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ভারতের ব্যবসা করার পরিবেশ অনুকূল করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল যে আবশ্যিক সে কথা নানাভাবে প্রমাণ করতে চেয়েছে। যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত তখন সেটাকে ভয়ঙ্কর বলে আবার যখন পরিস্থিতি শান্ত তখন সেখানে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে ব্রিটিশ সরকারকে বিপথে চালিত করেছিল ওয়েলেসলি। তবে ব্রিটিশ সরকারের গন্যমান্য ব্যক্তিরা এতটা নির্বোধ ছিলনা যে তারা কিছু না ভেবে ওয়েলেসলির এই কর্মকান্ডে মদত দিয়েছিল। অন্য কোনও ইউরোপিয়ন শক্তি যেন কোনওভাবেই ভারতবর্ষ দখল করতে না পারে তার জন্য ওয়েলেসলিকে সবরকম মদত দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। এই যুদ্ধের খরচ যোগাতে যখন ভাঁড়ারে টান পড়লো তখন ওয়েলেসলিকে দেশে ফিরিয়ে নিল ব্রিটিশ সরকার। সেটা ছিল ১৮০৫ সাল।

এই প্রেক্ষাপটে বুঝতে অসুবিধা হয়না কেন মাইসোরে হায়দার আলি এবং টিপু সুলতানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্রিটিশদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়েছিল। দাক্ষিণাত্যে ব্রিটিশদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো। ওদিকে মাইসোরের সীমানা উত্তরে কৃষ্ণা এবং পশ্চিমে মালাবার উপকূল অবধি এগিয়ে গেল। সুতরাং প্রতিবেশী রাজ্য মূলতঃ হায়দ্রাবাদ এবং মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো। এই রাজ্যগুলি প্রায়শই ব্রিটিশদের সাহায্য নিয়ে নিজেদের বাঁচাবার চেষ্টা করতো। ব্রিটিশরা আতঙ্কিত হত এই ভেবে যে মাইসোরের পিছনে ফরাসিদের সমর্থন আছে। কিন্তু এই আতঙ্ক অযৌক্তিক ছিল। মালাবার উপত্যকায় ব্যবসার ক্ষেত্রে মাইসোরের নিয়ন্ত্রন ব্রিটিশরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। গোলমরিচ এবং এলাচের ব্যবসা ছিল মাইসোরের নিয়ন্ত্রনে। ১৭৮৫ সালে টিপু সুলতান গোলমরিচ, এলাচ এবং চন্দনকাঠের আমদানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৭৮৮ সালে টিপু সুলতান ব্রিটিশদের ব্যবসা করার অনুমতি প্রত্যাহার করে নেয়। সেক্ষেত্রে ব্রিটিশদের কাছে মাইসোরের রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানো ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা রইলো না। কিন্তু টিপু সুলতান তখন মাইসোরকে কেন্দ্র করে সমগ্র দাক্ষিণাত্যে রাজ্যবিস্তারের পরিকল্পনায় ব্যস্ত। টমাস মুনরো এবং আলেক্সান্ডার রিডের মত কমবয়সী সামরিক আধিকারিকেরা পরিষ্কার জানিয়ে দিল যে যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। যদিও অসামরিক প্রশাসকেরা ভারসাম্য রক্ষা করার পক্ষে এবং যুদ্ধের বিপক্ষে ছিল তারাও কিছুদিনের মধ্যেই বিপদের আঁচ পেয়ে লর্ড কর্নওয়ালিশ এবং পরবর্তীকালে ওয়েলেসলির সঙ্গে ভারতের মানচিত্র থেকে মাইসোরের চিরকালীন বিলুপ্তির ব্যাপারে ঐকমত্য জানাল। তারপর চারদফা যুদ্ধের পর ১৭৯৯ সালে মাইসোরের দখল নিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। প্রথম যুদ্ধে(১৭৬৭-৬৯) মারাঠা এবং হায়দ্রাবাদের নিজাম ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়ে হায়দার আলির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। পরবর্তীকালে আবার ১৭৯০ সালে তৃতীয় দফার যুদ্ধে এই দুই ভারতীয় শক্তি ব্রিটিশদের পক্ষ অবলম্বন করে এবং লর্ড কর্নওয়ালিশের নেতৃত্বে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। এর কিছুদিন আগেই ব্রিটিশদের আর এক মিত্র রাজ্য ত্রাভাঙ্কোরের রাজাকে আক্রমণ করেছিল টিপু সুলতান। এই যুদ্ধে ডিন্দিগুল, বারামহল এবং মালাবারকে মাইসোর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ব্রিটিশ। এর কিছুদিন পরে ফরাসিদের সাময়িক উত্থান এবং তাদের সঙ্গে টিপু সুলতানের গোপন আলোচনাকে অজুহাত করে মাইসোর আক্রমণ করে ওয়েলেসলি। এই ঔপিনিবেশিক আগ্রাসনের যুদ্ধে মাইসোরের রাজধানী শ্রীরঙ্গাপট্টম দখল করে নেয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। শ্রীরঙ্গাপট্টম রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারায় টিপু সুলতান। মাইসোরকে আবার নিয়ে আসা হয় ওয়েলেসলির অনুগত ওয়েদার রাজবংশের অধীনে। মাইসোর হারালো তার স্বাধীনতা চিরকালের মতো। ওয়েলেসলি প্রবর্তিত চুক্তি অনুযায়ী মাইসোর অন্য কোনও ইউরোপিয়ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না। মাইসোরের রাজদরবারে ব্রিটিশ প্রতিনিধি স্থায়ীভাবে থাকবে এবং তার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবে মাইসোরের রাজা। এই চুক্তির অধীনে থাকতে সম্মত হওয়ার জন্য মাইসোরের কিছু অংশ হায়দ্রাবাদের নিজামকে দিয়ে দেওয়া হয়।

ইতিমধ্যে বোম্বে এবং গুজরাতের মধ্যে দিয়ে চিনের সঙ্গে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান তুলার ব্যবসা তাদের ঐ অঞ্চলের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন করে তোলে। রাজত্বের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত এক পারিবারিক বিবাদকে হাতিয়ার করে ব্রিটিশরা ঐ অঞ্চলের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। রঘুনাথ রাও চক্রান্ত করে তার ভ্রাতুষ্পুত্র পেশোয়া নারায়ণ রাওকে হত্যা করলে ঐ অঞ্চলের মারাঠা সর্দারদের রোষের মুখে পড়ে এবং বাঁচবার জন্য ব্রিটিশদের দ্বারস্থ হয়। ১৭৭৫ সালে রঘুনাথের বাহিনী গুজরাতে বিদ্রোহীদের হাতে পরাজিত হয় এবং তাকে উদ্ধারের জন্য মাদ্রাজ এবং বোম্বে থেকে বিশাল সেনাবাহিনী গুজরাতে এসে পৌঁছোয়। রঘুনাথের বিরোধীরা কোম্পানিকে রঘুনাথের থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সর্তে বেশ কিছু ব্যবসায়িক সুবিধা দেবার প্রস্তাব করে পুরন্দর শান্তিচুক্তির খসড়া পেশ করে। কিন্তু পুরন্দর চুক্তি কলকাতার কোম্পানি অধিকর্তারা বাতিল করে দিলে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। ইতিমধ্যে মারঠারা নানা ফাডনিস, সিন্ধিয়া এবং হোলকারের নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং ১৭৭৯ সালে ওয়াদগাঁও এর যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে ব্রিটিশদের পর্যুদস্ত করে। এরপর বাঙলা থেকে বিশাল বাহিনী এসে এলাকা পুনরুদ্ধার করে। নানা ফাডনিস এবং ভোঁসলে পরিবার ১৭৮১ সালে নিজাম এবং হায়দার আলির সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধে। কিন্তু ১৭৮২ সালে এই যুদ্ধের ফলাফল ব্রিটিশদের অনুকূলে যায় এবং ১৭৮২ সালে সালবাই চুক্তির মধ্য দিয়ে মারাঠারা ব্রিটিশদের আনুগত্য স্বীকার করে নেয় এবং মাইসোরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষ নিতে সম্মত হয়।              

0

গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য

Posted in






“হেলো”!

ব্যারিটোন ভয়েস কানে যেতে, এতোক্ষণ প্রকৃতিতে মগ্ন শ্রুতি, তাকিয়ে দেখে তার সামনের সীটে এক ভদ্রলোক বসে তার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন।

কখন এসে বসলেন ভদ্রলোক ! এতোক্ষণ তো ছিলেন বলে মনে হচ্ছে না! ইন ফ্যাক্ট শ্রুতি যখন ট্রেনে ওঠে তখন এই ফার্স্টক্লাস কোচটা একরকম ফাঁকাই ছিল। কোচের শেষ দিকে বোধহয় দু’ একজন ছিলেন।

এই সুন্দর আরামদায়ক কোচখানা প্রায় পুরোপুরি তার দখলে, ভেবেই শ্রুতির ইন্ট্রোভারটেড চিত্ত আনন্দে নেচে উঠেছিল। আ:, কী শান্তি! ভিড়ভাট্টা, বাচ্চাদের চিৎকার, কান্না কোনো ঝামেলা নেই। প্রকৃতি দেখতে দেখতে একা একা সুন্দর সময় কাটানো যাবে !

কিন্তু হা হতোস্মি! তার সেই আশায় এবং একাকীত্বে জল ঢালতে কে এই মূর্তিমান আবির্ভূত হলেন!

আর তার সামনে এসে বসলোই বা কখন.কে জানে! হয়তো শ্রুতি যখন এটেন্ডেন্ট মহিলার সঙ্গে কথা বলতে ওপাশে গেছিলো তখন এসে বসেছে।

অবশ্য আগে পরেও হতে পারে, কারণ ট্রেনের চারপাশের সৌন্দর্যে শ্রুতি এমনই বুঁদ হয়েছিল, যে অন্য কোনো দিকে মন দেবার মতন অবস্থাতেও সে যে ছিলনা, এটাও ঠিক।

আর এরকমটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। এই প্রথমবার গ্রিন্ডেলওয়াল্ড যাচ্ছে শ্রুতি। উ:, কী রোমাঞ্চকর! গ্রিন্ডেলওয়াল্ড আর তার আশেপাশের সৌন্দর্য , যা সে এতোদিন শুধু ছবিতে দেখেছে, এবার চাক্ষুষ দেখবে। ভাবা যায়!

এখনো তো গ্রিন্ডেলওয়াল্ড আসতে একটু দেরী আছে, অথচ এখনই চারদিক কী অপরূপ হয়ে উঠেছে!

ট্রেনের বাইরে যেদিকেই তাকাও বরফের পাহাড় আর পাহাড়। মনে হচ্ছে স্নো পিক গুলোকে, ট্রেনের মস্ত মস্ত কাঁচের জানলার গায়ে কেউ যেন আঠা দিয়ে ছবির মতো সেঁটে রেখেছে।

আর ট্রেনের সঙ্গে ছুটে চলা চোখ ঝলসানো রকমের সাদা বরফ পাহাড়ের নীচে দিগন্ত ছোঁয়া , ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা এমন গাঢ় সবুজ তৃণভূমি।

আর সেই সবুজ মেডো তে চরে বেড়াচ্ছে বাদামী সাদা ছোপ ছোপ গরু, দারুণ মিষ্টি বাচ্চা ভেড়া, মা-ভেড়া, পক্ষীরাজের মতো ঘোড়ারা-কোনোটা ধপধপে সাদা, কোনোটা কুচকুচে কালো,কোনোটা বাদামী, তাছাড়া মেশামেশি রঙের তো আছেই। ঠিক যেন রূপকথার দেশ।

গরুগুলো আবার একটু বেশি সাহসী। ট্রেনের প্রায় কাছ ঘেঁষে চরে বেড়াচ্ছে। আর তাদের গলায় সব বড়ো বড়ো ঘন্টা বাঁধা। সে সব ঘন্টার আবার কী সুরেলা আওয়াজ! শ্রুতির মনে হচ্ছে ওরা যেন গান গেয়ে গেয়ে তাকে ডাকছে।

হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ছে দূরে দূরে একেকখানা কটেজ । ছোটবেলায় শ্রুতি ড্রয়িং খাতায় যেমন আঁকতো,ঠিক তেমনি ছবির মতো তাদের ঢালু ছাদ, আর ছাদের কোনায় একটা করে চিমনি। ওপরে আশ্চর্য নীল আকাশ…

“ প্রথম বার কি”?

উল্টোদিকের সীটের ভদ্রলোকের কথায় সম্বিত ফেরে শ্রুতির। রূপকথার দেশ থেকে তার মন ঝপ করে ফিরে আসে ট্রেনের কামরায়।

শ্রুতির বিভোরতা দেখেই কিনা কে জানে,

ভদ্রলোক একদৃষ্টিতে একভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কী গভীর নীল চোখ! আর সেই চোখদুটোয় আশ্চর্য কিছু যেন ঝিকমিক করছে! মুখে মৃদু হাসি।

ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকিয়ে শ্রুতির সারা শরীর হঠাৎ অকারণে কেন যেন কেঁপে উঠল।

কী হ্যান্ডসাম দেখতে! মনে হয় ছ'ফুটের কাছাকাছি লম্বা হবেন, গ্রীক গডের মতো মুখ, মাথার চুল অনেকটা পাতলা হয়ে এলেও তার গাঢ় সোনালী রঙ, সূর্যের পড়ন্ত আলোয় আগুন একেবারে।

হ্যান্ডসাম , আকর্ষক বিদেশি পুরুষ, শ্রুতি তো আর প্রথম দেখছেনা, কিন্তু এই ভদ্রলোকের ভেতর কী যেন আছে! চোখে চোখ পরা মাত্র তাকে পাগলের মতন টানছে। ভদ্রলোকের আকর্ষণের কাছে, এতোক্ষণ তাকে বুঁদ করে রাখা আশপাশ, প্রকৃতি সবকিছু একেবারে ফিকে, আলুনি লাগছে।

টেবিলের উপর রাখা ভদ্রলোকের গ্লাভস পরা হাতদুটো একবার ছোঁয়ার জন্য তার সমস্ত শরীর যেন আকুলি বিকুলি করে উঠলো। সামনের ভদ্রলোকের শরীরের ভাষাতেও যেন সেই একই আকুলতা!

এটা কি হচ্ছেটা কি? আর এই চল্লিশের ওপরে এসে? লাভ এট ফার্স্ট সাইট?

ফু:.!..সে সব গল্প কথা মাই ডার্লিং। বাস্তবে হয়না,, বলে মনে মনে নিজেকে কষে এক ধমক দিলো শ্রুতি

“ প্রথম বার?”-

আবার সেই স্বর।

“ হ্যাঁ,… মানে অফিসের কাজে বার্লিন এসেছিলাম, তো ভাবলাম গ্রিন্ডেলওয়াল্ড টা দেখেই যাই। আমার ছোটবেলার স্বপ্ন “

“স্বাভাবিক '

”স্যরি'?

শ্রুতির কথার উত্তর না দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে তাঁর সেই আশ্চর্য হাসিটি হাসেন ভদ্রলোক।

“আপনি চা খাবেন? আমি একটু চায়ের অর্ডার দিচ্ছি “

“ নো, থ্যাংকস “

শ্রুতির অনুরোধ উপেক্ষা করেই একমনে খুব খেয়াল করে শ্রুতির আপাদমস্তক জরিপ করতে লাগলেন ভদ্রলোক। ঠোঁটের কোনের হালকা হাসিতে খানিকটা অবয়সোচিত দুষ্টুমির আভাস।

,” নাউ ইউ হ্যভ নাইস অলিভ স্কিনকালার”-

আবার শ্রুতির অন্ত:স্থল ছুঁয়ে যাওয়া, গভীর অথচ মজার ভঙ্গিতে বলা পাগল করে দেওয়া সেই ব্যারিটোন ভয়েস।

একমুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেল শ্রুতি। তারপরেই খানিকটা নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টায়, আর খানিকটা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, একটু বেশিই জোরে হেসে উঠলো , “না,না, আপনি ভুল করছেন,। আমার স্কিন ট্যানড হয়ে এরকম হয়নি। আমার স্কিন টোন এরকমই। আমি ভারতীয় তো, আমাদের চামড়ার স্বাভাবিক রঙ এরকমই হয় সাধারণত “

মজাদার ভঙ্গিটা মুছে গিয়ে বিষন্নতার মতো কিছু ভদ্রলোকের মুখে ছড়িয়ে পড়লো।

অন্যমনস্ক ভাবে বার দুয়েক যেন ঘোরের মধ্যে “ ইন্ডিয়া… ইন্ডিয়া “ বলে চুপ করে গেলেন।

“আচ্ছা, আগে কি আমাদের কোথাও দেখা হয়েছে ? “

কিন্তু শ্রুতি তার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই গ্রীন্ডেলওয়াল্ডের আগের স্টেশন থেকে স্টার্ট করেও ট্রেনটা হঠাৎ থেমে গেল। ভদ্রলোক ও উঠে, কোচের পিছনে, বোধহয় রেস্টরুমের দিকে চলে গেলেন।

শ্রুতি এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

কি হলো আবার! বিদেশের ট্রেন তো সাধারণত যেখানে সেখানে, যখন তখন থেমে যায়না! ব্যাপারটা কি হলো?

তখনই ট্রেনের অ্যনাউন্সমেন্ট সিস্টেমে জানানো হলো যে অপ্রত্যাশিত ভাবে ইন্জিনে কিছু অসুবিধা দেখা দিয়েছে। তাই স্টেশন থেকে ছাড়তে একটু দেরী হবে; অবশ্য খুব তাড়াতাড়ি, মানে আধঘন্টা খানেকের মধ্যেই ট্রেন পরের স্টেশন, গ্রীন্ডেলওয়াল্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবে। প্যাসেঞ্জারদের এই অসুবিধার জন্য তারা নিতান্ত দুঃখিত।

শ্রুতি এদিক ওদিক তাকিয়ে কী করবে ভাবছে এমন সময় অ্যাটেনডেন্ট মেয়েটি, যার নাম মারিয়া _মানে শ্রুতি এই মাত্র ই খেয়াল করলো তার আইডিতে লেখা রয়েছে , শ্রুতির পাশ দিয়ে যাছিল। শ্রুতি ও ওমনি খপ করে তাকে ধরে ফেললো। “ “এক্সকিউস মি, ট্রেনের ইঞ্জিন ঠিক হতে তো একটু দেরি আছে, এই সময়টায় আমি কি নীচে নামতে পারি?”

মেয়েটি একটু ইতস্তত করে তাকে নামার পারমিশন দিলো। কিন্তু সেই সঙ্গে সাবধানও করে দিল, সে যেন দূরে না যায়। এই কথা শুনে একটু ভয় পেয়েই শ্রুতি জিগ্যেস করলো, “ কেন বলুন তো? জায়গাটা কি সেফ নয়?”

“না, না এই জায়গাটা খুব ই সেফ। আমার বাড়িও এখানে। এখন অবশ্য আমি আর আমার পার্টনার ইন্টারলেকেনে থাকি। গেছেন? না গেলে একবার ঘুরে নেবেন। ভারী সুন্দর শহর।

যাইহোক, এখানে ভয়ের কিছু নেই। নিশ্চিন্তে কাছাকাছি ঘুরুন ফিরুন। নো প্রব্লেম।

বরং একটা কাজ করুন। আপনার মোবাইল নম্বরটা আমাকে দিয়ে যান। ট্রেন ছাড়ার আগে আমি আপনাকে কল করে ডেকে নেব “

তাই সই।

সেটা অবশ্য খারাপ ও হবেনা। ওই সবুজ মেডোতে হাঁটা মানে এক অপার্থিব অনুভূতি! ভালোলাগায় ভরপুর হয়ে পাহাড় ছোঁয়া সবুজ মেডোর দিকে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলো শ্রুতি।

অন্য কোচ থেকেও কয়েকজন নেমে এসে পায়চারি করছেন দেখা গেল। একটা বছর তিনেকের বাচ্চা মনের আনন্দে সবুজ ঘাসে ছুটে বেড়াচ্ছে। সত্যি এখানে ভয়ের কিছু নেই। চমৎকার জায়গা আর লোকজন।

হঠাৎ ঝপ করে শেষ বিকেলের রোদটা মরে গেলো আর চারদিকে কেমন যেন চাপা অন্ধকার ঘনিয়ে এলো, সঙ্গে হাড়কাঁপানো হিমেল হাওয়া। শ্রুতি কোটের পকেট থেকে বের করে টুপিটাও পরে নিলো।

শুধু যে সন্ধ্যে নেমে আসছে তা নয়, আকাশ জুড়ে গভীর কালো মেঘ করেছে। শ্রুতি দু এক পা সবে হেঁটেছে তার মধ্যেই ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।

“ আমার বাড়ি এক মিনিটের রাস্তা। এখানে ঠান্ডায় কষ্ট না পেয়ে, আসুন আমার সঙ্গে “

ও মা, আবার ট্রেনের সেই ভদ্রলোক!

কথাটা বলেই ভদ্রলোক পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এসে শ্রুতির সামনে সামনে চলতে লাগলেন।

হঠাৎ এমন একটা প্রস্তাবে শ্রুতি তো একদম হকচকিয়ে গেল , আর তার সঙ্গে খানিকটা চিন্তায় ও পড়ে গেল। গা টা একটু ছমছম করে উঠলো।

ট্রেনের আলাপ…না ঠিক আলাপ ও বলা যায়না কারন এখনও তারা কেউ কারুর নাম পর্যন্ত জানেনা। এই অবস্থায় ভদ্রলোকের তাকে একেবারে বাড়ি যেতে বলাটা… স্বাভাবিক কি?

সুইটজারল্যান্ডে ছুটকো ছাটকা পিকপকেট ছাড়া ট্যুরিস্টদের সঙ্গে অন্য রকম ক্রাইম হয়না বললেই চলে। তাহলেও বলা তো যায়না। এই ভদ্রলোকের ধান্দা অন্যরকম হতেও তো পারে!

“ শ্রুতি! তোমার যখন এতোই ভয়, একা একা বেড়াতে এসেছো কেন?”-

মায়ের গলায় শ্রুতি নিজেই নিজেকে একটা ধমক দ্যায়।

“ ভয় করছে? “

আবার সেই মদির ব্যারিটোন ভয়েস।

ভদ্রলোক কি মনের কথাও পড়তে পারেন? মনে ভাবে শ্রুতি।

মুখে অবশ্য বলে, “ না, ভয় করবে কেন? “

আর সত্যি বলতে কি এখন ওর ততো ভয়ও লাগছেনা। এমন একজন নাইস এন্ড হট ভদ্রলোকের সঙ্গে সবুজ ঘাসের মখমলি কার্পেট মাড়িয়ে একসঙ্গে হেঁটে চলার সম্ভাবনা…না: মন্দ নয়!

ঠোঁটের কিনারে একটু হালকা হাসির রেখাও ফুটে উঠলো শ্রুতির।

যদিও তার স্বাভাবিক স্বভাব চরিত্রের সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত ঠিক মেলেনা, তাহলেও এইমুহূর্তে কোনো এক আশ্চর্য কারণে, এই চিন্তা তার কাছে দারুণ, দারুণ আকর্ষক লাগছে।

তার বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় কী ভীষণ যে ঢিপঢিপ করছে!

আহা হা…এই পথ যদি না শেষ হয়..

“এই যে বাড়ি। আসুন “

শ্রুতি ভদ্রলোকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে, সুখ কল্পনায় গা ভাসিয়ে কখন একখানা দারুন কটেজের সামনে চলে এসেছে, খেয়াল ই করেনি।

“ আসুন “

এবার পুরোপুরি সম্বিত ফেরে শ্রুতির।

ঠিক যেন গল্পের বই থেকে তুলে আনা একখানা কটেজ । দরজায় বড় সাদা নেমপ্লেটে উজ্জ্বল লাল রঙে লেখা-“ ডঃ লিয়াম বাখম্যান “, আর তার নীচে, “পেট্রা বাখম্যান”।

“পেট্রা আপনার স্ত্রী?”


আবার সেই রহস্যময় হাসি।

“ভালোই হলো আলাপ হয়ে যাবে।আপনার স্ত্রী কি এখন বাড়িতে?’- অধিকাংশ ভারতীয় মহিলার মতন ই কৌতুহলে শ্রুতি জিগ্যেস করলো।

“ এক মিনিটে ঢুকে যাবে। এসেই পড়েছে।“

সেই আকর্ষক দৃষ্টিতে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠেন ডঃ লিয়াম বাখম্যান। আর শ্রুতি এই প্রথম লক্ষ্য করে , লিয়ামের শ্বাদন্ত দুটো অন্য দাঁতের তুলনায় অনেকটা বেশী লম্বা আর ছুঁচলো।


বাড়ির ভেতরে ঢুকে শ্রুতি একেবারে মোহিত হয়ে যায়। কী সুন্দর সাজানো ঘর! জানলায় সাদা লেসের পর্দা, সিলিং থেকে অপূর্ব কারুকাজ করা ঝাড়লন্ঠন ঝুলছে, নীচে নরম কার্পেট , ছবি, ডেকরেটিং পিস…সব মিলিয়ে এ ঘর যে অনেক ভালোবাসায় সাজানো , তার ছাপ সর্বত্র।

এইরকম, ঠিক এই রকম বাড়িই তার চিরকালের ইচ্ছে ছিল। তার রূপকথার সংসার! এমন একটা বাড়ি আর এমন রোম্যান্টিক একজন পার্টনার পেলে শ্রুতিও হয়তো বিয়েটা করেই ফেলতো। আর তাহলে মা ও খুশ। বাবাও।

আচ্ছা, লিয়ামের বউ পেট্রাকে তো এখনো দেখা গেলোনা! বোধহয় কিচেনে চা কফি কিছু বানাচ্ছে।

লিয়াম এসেই ভেতরের দিকে চলে গিয়েছিল।

এখন বেড়িয়ে এসে সোফায় বসলো।

মুখোমুখি দুটো সোফায় বসে আছে শ্রুতি আর লিয়াম। লিয়ামের চোখে সেই আকর্ষণ, আকুলতা আরও অজানা কী যেন মেশা আশ্চর্য দৃষ্টি, স্থির হয়ে আছে শ্রুতির চোখে।

সারা ঘর জুড়ে সুরের হিল্লোল ছড়িয়ে বিজিসের গান প্রেম ছোঁয়ানো মদিরার মতো বাজছে,”হাউ ডিপ ইস ইয়োর লাভ”

শ্রুতির খুব প্রিয় গান। গানটা শুনতে শুনতে শ্রুতির সারা শরীর মন জুড়ে কী সাংঘাতিক উন্মাদনা! তার শরীর কাঁপছে, মুখচোখ লাল হয়ে যাচ্ছে… আর কেন কে জানে চোখ জ্বালা করছে…খুব…খুব”

“ আমার স্ত্রীর প্রিয় গান”- বলতে গিয়ে লিয়ামের গলা যেন ধরে আসে।

, *আমারও “

ধরা গলা শ্রুতির।

“ একটা অনুরোধ আছে। আপত্তি শুনবোনা”- আবেগপূর্ণ গলা লিয়ামের।


লিয়ামের ওই গলা শুনে শ্রুতির হৃদপিন্ড এক মুহূর্তের জন্য আবারও স্তব্ধ হয়ে গেল কথা বলার শক্তি নেই যেন। তার দুচোখ জুড়ে শুধুই লিয়াম।

“ একটা গিফট আছে। আমার স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। কিন্তু বুঝতে পারছিনা আঙুলে পরলে কেমন লাগবে। পছন্দ হবে কিনা। আপনার আঙুল টা একটু..”

নিঃশব্দে মোহগ্রস্তের মতো হাতটা বাড়িয়ে দেয় শ্রুতি। আংটি টা শ্রুতির অনামিকায় পরিয়ে দেয় লিয়াম। একমুহুর্তের জন্য লিয়ামের গ্লাভস ছুঁয়ে থাকে শ্রুতির হাত।

“ আপনার সঙ্গে আগে কখনও কি আমার দেখা হয়েছে”?

আবারও জিজ্ঞেস করে শ্রুতি।

কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর পাবার আগেই

ঝনঝন করে মোবাইল বেজে ওঠে।

ট্রেন পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে।

আকাশ গম্ভীর অন্ধকার আগেই হয়েছিল। এখন অল্প অল্প বরফ পড়ছে। জোরে হাওয়া ও দিচ্ছে।

ট্রেনে উঠে শ্রুতি সীটের দিকে যেতে যেতে পিছন ফিরে দেখে লিয়াম দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।

অবাক শ্রুতির চোখে প্রশ্নের ইশারা।

শ্রুতির চোখের দিকে কষ্টে ভরা গভীর চোখে তাকিয়ে নরম গলায় লিয়াম বললো, “ আমার গন্তব্য এই পর্যন্ত ই। আই হ্যাভ রিচড মাই ডেস্টিনেশন।“

“আর কোনো দিন কি আমাদের দেখা হবেনা লিয়াম “- শ্রুতির হৃদপিন্ড যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে।

“ হয়তো হবেনা…হয়তো হবে…গ্যালাক্সি অন্তহীন “

বলতে বলতে শ্রুতির কাছে এসে তাকে বুকের মধ্যে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো লিয়াম। হালকা পালকের মতো শ্রুতির ঠোঁটে লিয়ামের ঠোঁট।ও:, কী হালকা স্পর্শ, ছুঁয়ে আছে কী নেই যেন বোঝা যায়না। শুধু তার ভালোবাসার উত্তাপ বিস্মিত, আকুল শ্রুতিকে ছুঁয়ে থাকে মুহুর্তের জন্য। তারপর আস্তে আস্তে সরে যায় লিয়াম।

তার সাগর নীল চোখ থেকে জল উপছে ওঠে।

সুখ দুঃখ মেশা গভীর বিষন্ন স্বর লিয়ামের , “গুডবাই মাই লাভ “

ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

“ আপনাকে একটু চা দিই ম্যাম?” মারিয়া এসে জিজ্ঞেস করে শ্রুতিকে।

“আচ্ছা মারিয়া, আপনার বাড়িতো এখানেই বলেছিলেন। আমার সামনের সীটে যে ভদ্রলোক বসেছিলেন, তাঁকে চেনেন আপনি ?”

আকুল আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে শ্রুতি। যেন এর উপরে তার জীবন মরণ নির্ভর করছে।

“আপনার সামনের সীটে…!”

খানিকটা বিভ্রান্ত শোনায় মারিয়ার গলা..” না ম্যাম কেউ তো ছিলেননা “

“ বুঝতে পারছি , আপনি হয়তো খেয়াল করতে পারেননি। নাম বললে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন। ভদ্রলোকের নাম লিয়াম বাখম্যান। ডঃ লিয়াম বাখম্যান”

আতংক বিস্ফারিত চোখে এমনভাবে চেয়ে থাকে মারিয়া, যেন ভূত দেখেছে।

“ ডঃ লিয়াম?!...কিন্তু উনি তো অনেক দিন আগেই মারা গেছেন।“

“কি বলছেন কি ?!আমি তো এখুনি ওনার বাড়ি থেকেও ঘুরে এলাম”

“কিছু মনে করবেননা ম্যাম, এটা অসম্ভব। ১৯৭৭/৭৮ সাল নাগাদ ডঃ লিয়াম আর ওনার স্ত্রী পেট্রার বিবাহবার্ষিকীর দিন পেট্রা ইন্টারলেকেন থেকে এই ট্রেনে করে ফিরছিল। দূর্ভাগ্যবশত এই ট্রেনের একটা সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্ট হয়। পেট্রা শুধু যে মারা যায় তাই নয়, তার দেহ এমন ভাবে তালগোল পাকিয়ে গেছিলো যে তাকে আর চেনাই যায়নি। ওই সামান্য পোশাক আশাক দেখে আর কী… “

“ এসব কী বলছেন আপনি?” প্রায় না শুনতে পাওয়ার মতো অস্ফুট স্বর শ্রুতির।

“ সেই শোক ড:লিয়াম সহ্য করতে পারেননি। ওঁরা দুজনে দুজনকে খুব ভালো বাসতেন। একরকম লিজেন্ডারি লাভ বলতে পারেন। তারপর থেকে ড: লিয়াম কাজকর্ম প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রতিদিন এই ট্রেনের ভেতর পেট্রাকে খুঁজে বেড়াতেন। মাথাটাই আরকি…

বারবার বলতেন, “ ওর মুখ আমাকে আর একবার দেখতেই হবে। ওকে প্রপারলি গুডবাই না করতে পারলে আমি মরেও শান্তি পাবোনা। ওকে আমার কাছে আসতেই হবে।“

শোকের যন্ত্রণাতেই হয়তো স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই ডঃ লিয়ামও মারা যান।

ওনাদের অতো ভালোবাসা দিয়ে তৈরি করা কটেজটাও একদম ভেঙে চুরে পড়ে আছে।“

“আপনি ভুল লোকের কথা বলছেন মারিয়া। এ হতে পারেনা।

আমি অন্য লিয়ামের কথা বলছি। আমি এইমাত্র লিয়ামের বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম যে”।

শ্রুতির দিকে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে চলে যাবার আগে মারিয়া বলে গেল – “আপনি জানলা দিয়ে দেখুন, ট্রেনটা বাঁক নেবার মুখে ডঃ লিয়ামের বাড়িটা দেখা যায়। দেখুন তাকিয়ে ।“

জানলা দিয়ে আকুল হয়ে বাইরে তাকায় শ্রুতি। দুহাত দিয়ে, মুখ দিয়ে ট্রেনের জানালার কাঁচ আঁকড়ে ধরে পলকহীন চোখে বাইরের দিকে কটেজ খানা খুঁজতে থাকে।

হ্যাঁ, ওইতো, ওইতো কটেজ টা, কিন্তু একমুহুর্তে এ কী অবস্থা!

ভাঙাচোরা ছাত…তার খানিকটা আবার উড়েই গেছে। শুধু মাত্র আধভাঙা একপাশে হেলে থাকা দরজার গায়ে লাল রঙে লেখা ডঃ লিয়াম বাখম্যান। নামটা কালচে হয়ে গেলেও এখনও পড়া যাচ্ছে।

শ্রুতির মনে হয় সে বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছে।

সে কি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে!

নাকি হ্যালিউসিনেট করছে!


কিন্তু তার বুকটা এমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে কেন! বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে.. ফোঁপানোর মতো কিছু বুকের একেবারে ভেতর থেকে উঠে আসছে… ইচ্ছে করছে, চিৎকার করে কেঁদে উঠতে।

নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে করতে সামনের টেবিলে রাখা টিস্যু পেপারের দিকে হাত বাড়াতেই শ্রুতির চোখ আটকে গেলো আংটিটাতে। যেটা লিয়াম একটু আগেই তার অনামিকায় পরিয়ে দিয়েছে।

আংটিটার ' এল ' আর '- পি' অক্ষর দুটো পরস্পরকে জড়িয়ে মিশে আছে যেন,

আর তাদের চারপাশ ঘিরে গোল করে এমবস করা একটাই শব্দ –' Liebe ' ।

শ্রুতি জানে তার মানে 'ভালোবাসা'।।
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in








পর্ব ২০

বণিকের মানদণ্ড দেখ দিল রাজদণ্ডরূপে

(সময়ানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত বিবরণী)-প্রথম অংশ

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন হয়েছিল বাঙলাতেই। এশিয়াতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার ষাট শতাংশ উপকরণই ছিল বাঙলার। ভারতবর্ষে কোম্পানির ব্যবসা ত্বরান্বিত হতে থাকল যখন আওরঙ্গজেব ১৬৯০ সালে বার্ষিক তিনহাজার টাকার বিনিময়ে কোম্পানিকে নিঃশুল্ক ব্যবসার অনুমতি দিল। ১৬৯৬ সালে কলকাতায় দূর্গ নির্মানের অনুমতি এবং তার দু’বছর পরে কলিকাতা, সূতানুটি এবং গোবিন্দপুর গ্রামের জমিদারি কোম্পানিকে লিখে দিল মোগলসম্রাট আওরঙ্গজেব। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সাময়িকভাবে কিছু সমস্যা দেখা দিলেও ১৭১৭ সালে সম্রাট ফাররুক্সিয়ার আবার নিঃশুল্ক ব্যবসার এবং কলকাতার নিকটবর্তী আটত্রিশটি গ্রামের জমিদারির অনুমতি দিল কোম্পানিকে।সেই সঙ্গে নবাবের ট্যাঁকশাল ব্যবহারের অনুমতি পেল কোম্পানি। কিন্তু অনতিবলম্বেই এই অনুমতি নিয়ে কোম্পানির বিবাদ শুরু হলো বাঙলার নবাব মুর্শিদকুলি খানের সঙ্গে। কোম্পানির আধিকারিকেরা কোম্পানির ব্যবসার বাইরে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসাও চালাত। এই ব্যক্তিগত ব্যবসাগুলিকে নিঃশুল্ক ব্যবসার বাইরে রাখার জন্য কড়া আইন প্রবর্তন করলো মুর্শিদকুলি। কোম্পানি আধিকারিকরা কিন্তু নানা ছলছুতোয় নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসাগুলির থেকে কর ফাঁকি দিতে থাকলো। ক্রুদ্ধ মুর্শিদকুলি আটত্রিশটি গ্রামের জমিদারি এবং ট্যাঁকশালের ব্যবহার সম্পর্কিত আদেশনামা প্রত্যাহার করে নিল। ১৭১৭ সাল থেকেই বাঙলার নবাব এবং কোম্পানির মধ্যে বৈরিতার সূত্রপাত।

১৭৪০ সালে অস্ট্রিয়া উত্তরাধিকার যুদ্ধের ফলস্বরূপ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। বাঙলার নতুন নবাব আলিবর্দি খান ব্রিটিশ এবং ফরাসি উভয়পক্ষকেই কড়া নিয়ন্ত্রনে রাখে এবং কোনওরকম যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু দাক্ষিনাত্যে ফরাসিদের বিজয়লাভ ব্রিটিশদের বাঙলার ফরাসিদের প্রতি সন্দিহান করে তোলে। যদি কোনওভাবে ফরাসিদের হাতে ব্রিটিশরা আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে আলিবর্দি কতটা তাদের সাহায্য করতে পারবে সে ব্যাপারেও অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকতে থাকে ব্রিটিশরা। এছাড়াও ব্যবসার ক্ষেত্রে এশিয়ার ব্যবসায়ীদের সাহচর্যে ফরাসিদের ব্যবসাও বৃদ্ধি পেতে থাকায় কোম্পানির ব্যবসাও বেশ বড়রকমের ধাক্কা খেয়েছে। সব মিলিয়ে ফরাসিদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উত্থানে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ১৭৫৫ সালে নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করে কলকাতা দূর্গকে আরও শক্তিশালী করার জন্য খনন এবং নির্মাণের কাজ শুরু করে ব্রিটিশরা। এমনকি নবাবের দরবার থেকে বহিষ্কৃত এবং পলাতক লোকেদেরও কলকাতায় নিরাপদ আশ্রয় দিতে থাকে ব্রিটিশরা। বাঙলার নবাবের সঙ্গে বিরোধ চরম আকার নেয় যখন ১৭৫৬ সালে সিরাজদ্দৌল্লা নবাবের আসনে বসে। সিরাজ কোম্পানি আধিকারিকদের ব্যক্তিগত ব্যবসাকে নিঃশুল্ক ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য নতুন করে আদেশ জারি করে। সিরাজের সঙ্গে বিরোধিতা চরম পর্যায়ে পৌঁছোয় মূলতঃ দু’টি কারণে প্রথমত রাজস্ব আত্মসাৎ করার দায়ে অভিযুক্ত কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয়দান এবং দ্বিতীয়ত নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করে দূর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করা। এই দু’টিকেই রাজদ্রোহিতার সামিল বলে ঘোষণা করে সিরাজ। সিরাজের সাবধাবাণীতে কর্ণপাত না করার শাস্তি হিসাবে সিরাজ কাশিমবাজারে কোম্পানির ফ্যাক্টরি দখল করে নেয়। সিরাজের ক্ষমতা সম্পর্কে গভর্নর ডেকের ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে ২০শে জুন সিরাজ কলকাতা দখল করে নেয়।

এই সঙ্কটের হাত থেকে ব্রিটিশদের রক্ষা করতে মাদ্রাজ থেকে বিশাল সৈন্যসমভিব্যাহারে কলকাতায় এসে পৌঁছোয় রবার্ট ক্লাইভ। ব্রিটিশদের ভয় ছিল যে সিরাজ ফরাসিদের সহায়তায় তাদের ব্যবসার ক্ষতি করতে পারে এবং ফরাসিদের সঙ্গে মিলে তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। তাই কোনওরকম ঝুঁকি না নিয়ে রবার্ট ক্লাইভ আক্রমণের রাস্তা বেছে নেয় এবং হুগলি ও চন্দননগর ফরাসিদের কাছ থেকে দখল করে নেয়। আবদালির নেতৃত্বে আফগান আক্রমণের আশঙ্কায় সিরাজ ব্রিটিশদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে মীমাংসা প্রক্রিয়া শুরু করতে চাইলে ক্লাইভ তা প্রত্যাখ্যান করে এবং যুদ্ধের পথেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কোম্পানির আধিকারিকেরা কোনওভাবেই কমবয়সী সিরাজের অত্যাচারের কাছে মাথা নত করে নিজেদের ব্যবসা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সঙ্গে আপস করতে রাজি হলোনা। এছাড়াও নবাবের দরবারে সিরাজের বিরুদ্ধে একটা শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। সিরাজের ঔদ্ধত্য এবং অপমানজনক ব্যবহারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে বেশ কিছু ব্যবসায়ী এবং জমিদার ক্লাইভের সঙ্গে হাত মেলালো। এদের মধ্যে প্রধান ছিল জগতশেঠ মোহতাব রাই, স্বরূপচাঁদ, রাজা জানকিরাম, রাইদুর্লভ, রাজা রামনারায়ণ, রাজা মাণিকচাঁদ প্রমুখ। তাছাড়া অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী ব্রিটিশদের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসায় নিযুক্ত ছিল এবং অনেকে ব্যবসার জন্য ব্রিটিশ জলযান ব্যবহার করতো। এরা সকলেও ব্রিটিশদের পক্ষে ছিল। জগতশঠের কথামতো সিরাজের জায়গায় তার অন্যতম সেনাধিপতি মিরজাফরকে নবাব করার পরিকল্পনা করে চক্রান্ত দানা বেঁধে উঠলো। নবাবের দরবারে চক্রান্ত আগে থেকেই চলছিল যার সদ্ব্যবহার করেছিল ব্রিটিশরা না ব্রিটিশরাই এই ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল সে প্রশ্ন অবান্তর। এই ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশির যুদ্ধে ক্লাইভের হাতে পরাজিত হলো সিরাজ। পলায়নরত সিরাজকে বন্দি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো এবং ব্রিটিশদের হাতের পুতুল মিরজাফরকে নবাবের আসনে বসালো ক্লাইভ। এখানেই শুরু হলো ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক উত্থানের ইতিহাস।

এরপরে শুরু হলো বহু আলোচিত ‘পলাশি পরবর্তী লুন্ঠন’ । যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই তখনকার হিসাবে ২,৭৫,০০০ পাউন্ড ভাগ করে দেওয়া হলো জল এবং স্থলবাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০সালের মধ্যে কোম্পানি মিরজাফরের কাছ থেকে আদায় করলো তখনকার হিসাবে আড়াই কোটি টাকা। ক্লাইভ ব্যক্তিগতভাবে মিরজাফরের কাছ থেকে যে ভূখন্ডের জায়গিরদারি পেয়েছিল তার মূল্য তখনকার হিসাবে প্রায় ৩৫০০০ পাউন্ড। কোম্পানি তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে বেশ বড় রদবদল নিয়ে এলো। ১৭৫৭ সালের আগে কোম্পানি বাঙলায় ব্যবসা করার জন্য দেশ থেকে বুলিয়ন আমদানি করতো। পলাশি যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শুধু বুলিয়ন আমদানি বন্ধ হলো না , তার পরিবর্তে বাঙলা থেকে চিনে এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে বুলিয়ন রপ্তানি শুরু হলো। ব্রিটিশরা এর ফলে অন্যান্য ইউরোপিয়নদের থেকে বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছে গেল। অন্যদিকে পলাশি যুদ্ধের পর কোম্পানি আধিকারিকদের সৌভাগ্যের দরজা খুলে গেল। প্রজাদের ওপর সরাসরি নিপীড়ন ছাড়াও নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় কোম্পানিকে প্রদত্ত কর সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধার অপব্যবহার করে টাকার পাহাড় গড়ে তুললো। কিছুদিনের মধ্যেই মিরজাফরের পক্ষে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়লো। ১৭৬০ সালের অক্টোবর মাসে মিরজাফরকে সরিয়ে মসনদে বসানো হলো তার জামাতা মিরকাসিমকে। অল্পদিনের মধ্যেই আবার দ্বন্দ্বের শুরু হলো কোম্পানিকে দেওয়া করছাড়ের সুযোগের ব্যক্তিগত ব্যবসায় যথেচ্ছ অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে। উপায় না দেখে মিরকাসিম করপ্রথা বিলোপ করে দিল যাতে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও সমান সুযোগ পায়। ব্রিটিশরা নবাবের এই স্বাধীন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলো না। ফলস্বরূপ মিরকাসিমকে সরিয়ে আবার মিরজাফরকে নবাবের আসনে বসানো হলো।

১৭৬৩ সালের ডিসেম্বরে মিরকাসিম বাঙলা থেকে পালিয়ে মোগলসম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এবং অবধের রাজা সুজাউদ্দৌল্লার সঙ্গে জোট বাঁধলো। যুবরাজ দ্বিতীয় শাহ আলম পূর্ব ভারতে স্বাধীন সাম্রাজ্য গড়ার লক্ষ্যে ১৭৫৮ সালে দিল্লী ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৭৫৯ সালের ডিসেম্বরে পিতার হত্যার সংবাদ পেয়ে সে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে এবং সুজাউদ্দৌল্লাকে নিজের উজির হিসাবে নিযুক্ত করে। মিরকাসিম যখন বাঙলা থেকে পালিয়ে তার কাছে আশ্রয় চায় তখন দীর্ঘ আলোচনার পর তারা যৌথভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহমত হয়। সুজাউদ্দৌল্লা বিহারের রাজত্ব, রাজকোষের পূর্ণ অধিকার এবং যুদ্ধজয়ের পর নগদ তিন কোটি টাকার শর্তে যুদ্ধে যোগদান করতে রাজি হয়। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে এই তিনজনের জোট ব্রিটিশদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ব্রিটিশরা পরাজিত সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের সঙ্গে কারারুদ্ধ করে। যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে মুক্তিলাভের পরিবর্তে ১৭৬৫ সালে এলাহাবাদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে সম্রাট বাঙলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দিওয়ানি ব্রিটিশদের লিখে দেয়। এই চুক্তির বলে ব্রিটিশরা বাঙলা, বিহার এবং উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করে। মুর্শিদাবাদের দরবারে ব্রিটিশরা এসে গেল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এবং ১৭৭২ সালে বাঙলায় পরোক্ষভাবে কোম্পানিরাজ চালু হয়ে গেল। এলাহাবাদ চুক্তির শর্তানুযায়ী সুজাউদ্দৌল্লা এবং ব্রিটিশরা নিজ নিজ সাম্রাজ্যরক্ষার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলো এবং সম্মানের সঙ্গে মুক্তিলাভের বিনিময়ে সুজাউদ্দৌল্লা ব্রিটিশদের ৫০ লক্ষ টাকা নজরানা দিল। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অবধের দরবারে একজন ব্রিটিশ প্রতিনিধি নিযুক্ত হলো এবং কোম্পানি অবধে নিঃশুল্ক ব্যবসার অধিকার লাভ করলো। চুক্তির এই বিশেষ শর্তের কারণেই পরবর্তীকালে অবধ সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে।

১৭৬৫ সালে পূর্ব ভারত কোম্পানির সম্পূর্ণ অধিকারে আসে এবং দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশ আগ্রাসনের প্রস্তুতি শুরু হয়। ব্রিটেন-ফ্রান্স বিরোধ এই আগ্রাসনে অণুঘটকের কাজ করে। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে ফরাসিরা সবার শেষে ভারতে আসে এবং সর্বপ্রথম এই উপমহাদেশে নিজেদের শাসন কায়েম করার পরিকল্পনা শুরু করে। ফরাসিদের মূল কেন্দ্র পন্ডিচেরিতে স্থাপিত হয় ১৬৭৪ সালে। ডুপ্লেইক্সের গভর্নর জেনারেল থাকার সময় ফরাসিরা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৭৩১ সালে ডুপ্লেইক্স প্রথমে চন্দননগরের গভর্নর হয়। দশ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে ফরাসি ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। ডুপ্লেইক্স কাজপাগল লোক ছিল। যদিও ভারতবর্ষকে সে ঘৃণার চোখেই দেখতো তবুও এই সুযোগে নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসা থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ডুপ্লেইক্স। ১৭৪২ সালে পন্ডিচেরির দায়িত্ব পায় ডুপ্লেইক্স। কালবিলম্ব না করে ডুপ্লেইক্স নিজের ব্যবসা এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপকে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে চলে। ডুপ্লেইক্সই প্রথম ইউরোপিয়ন রাজনীতিক যে ভারতীয় শাসকদের অন্তর্কলহকে ব্যবহার করে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বিস্তার করে। পরবর্তীকালে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশরাও একই পথ অনুসরণ করে নিজেদের প্রতিপত্তি কায়েম করে।১৯৭০ সালে ইউরোপে অস্ট্রিয়ান উত্তরাধিকার যুদ্ধ ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। সেই বিভেদের প্রভাব ভারতবর্ষেও এসে পৌঁছোয়। বাঙলায় এই বিভেদকে কড়া হাতে দমন করে আলিবর্দি খান। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে মরিশাস থেকে আগত নৌসেনা ফরাসিদের হাত শক্ত করে এবং ফরাসিরা মাদ্রাজে ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ চালায়। ব্রিটিশরা ফরাসিদের হাতে মাদ্রাজ সমর্পণ করে এবং কর্ণাটকের নবাবের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করে। নবাব ফরাসিদের আক্রমণের জন্য সৈন্য পাঠায় কিন্তু সেই সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু এই সময়ে ডুপ্লেইক্স এবং মরিশাস থেকে আগত অ্যাডমিরাল লা বোরদোনেয়ার্সের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ হয় এবং বোরদোনেয়র্স ব্রিটিশদের হাতে মাদ্রাজ সমর্পণ করে মরিশাস ফিরে যায়। ১৭৪৬ সালে ডুপ্লেইক্স আবার মাদ্রাজ আক্রমণ করে এবং দক্ষিণ পন্ডিচেরিতে ব্রিটিশ অধিকৃত সেন্ট ডেভিড ফোর্ট দখল করে নেয়। ইতিমধ্যে আইক্স লা চ্যাপেল চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ এবং ফরাসি বৈরিতার সমাপ্তি ঘটে। চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা ভারতে তাদের ফরাসিদের হাতে হারানো অধিকার ফিরে পায় এবং উত্তর আমেরিকায় ফরাসিরা তাদের ব্রিটিশদের হাতে হারানো অধিকার ফিরে পায়। যুদ্ধ আর আগে এগোতে পারেনা।

ভারতবর্ষে সিংহাসন দখলের জন্য পারিবারিক বিবাদ সর্বজনবিদিত। সেই বিবাদের কারণেই ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিবাদ বাড়তে থাকে দক্ষিণ ভারতে। কর্ণাটক এবং হায়দ্রাবাদে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিবাদের সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে নেয় ফরাসি গভর্নর জেনারেল ডুপ্লেইক্স। কর্ণাটকে চন্দা সাহিব এবং হায়দ্রাবাদে মুজফফর জংকে রাজা হবার লড়াইতে সমর্থন করে ফরাসিরা। ব্রিটিশরা সমর্থন করে এদের বিরোধি নাসির জং এবং মহম্মদ আলিকে। ফরাসি সমর্থিত দু’জনেই বিজয়ী হয় এবং নাসির জং-এর মৃত্যু হওয়ায় হায়দ্রাবাদের নতুন নিজাম হয় মুজফফর জং। মুজফফর ফরাসিদের মাসুলিপটম এবং আরও বেশ কয়েকটি গ্রামের জায়গির দান করে। এমনকি নিজের দরবারেও ফরাসি প্রতিনিধির জন্য একটি আসন নির্দিষ্ট করে দেয়। অবশ্য মুজফফর জংও বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেনি। ১৭৫১ সালের ফেব্রয়ারিতে মুজফফর মারা যায় এবং সালাবত জং নতুন নিজাম হয়। আতঙ্কিত ব্রিটিশদের সহায়তার জন্য কলকাতা থেকে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী কর্ণাটক এসে পৌঁছোয় এবং ১৭৫২ সালের শুরু হয় দ্বিতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধ। ব্রিটিশরা জয়ী হয় এবং মহম্মদ আলি কর্ণাটকের সিংহাসনে বসে। ডুপ্লেইক্স দক্ষিণ ভারত পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাতে চায় কিন্তু প্রচুর অর্থনৈতিক লোকসানের কারণে ফরাসি সরকার ডুপ্লেইক্সকে যুদ্ধ বন্ধ করে দেশে ফিরে যেতে বলে । ১৭৫৪ সালে ডুপ্লেইক্স দেশে ফিরে যায়। নতুন গভর্নর জেনারেল হয় চার্লস গডেহিউ। গডেহিউ ১৭৫৪ সালেই ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং মুজফফর প্রদত্ত জায়গির এবং রাজদরবারের আসন নিজেদের জন্য সংরক্ষণ করে।

১৭৫৬ সালে ইউরোপে সপ্তবর্ষীয় যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষে আবার ব্রিটিশ ফরাসি বিরোধ শুরু হয় এবং তৃতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। ফরাসিদের আর্থিক দুর্বলতার কারণে সৈন্যদের বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ফরাসি সরকার উপায়ান্তর না দেখে কাউন্ট ডি লালির নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী পাঠায় ভারতবর্ষে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফরাসিরা একের পর এক জায়গা হারাতে থাকে ব্রিটিশদের হাতে। প্রথমে হাতছাড়া হয় চন্দননগর। বাসিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় লালিকে সাহায্যের জন্য কিন্তু নর্দান সরকারের অন্তর্গত বিস্তীর্ণ অঞ্চল, মাসুলিপটম, ইয়ানাম এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা ফরাসিদের হাত থেকে দখল করে নেয় ব্রিটিশরা।১৭৬০ সালের জানুয়ারিতে তৃতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ওয়ান্ডুইশ যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজয়ের অব্যবহিত পরেই ব্রিটিশরা পন্ডিচেরি দখল করে। মালাবার উপত্যকার মাহে এবং কর্ণাটকের জিঞ্জি ও থিয়াগড়ের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই ফরাসিদের পায়ের তলার মাটি বরাবরের মত সরে যায়।

ফরাসিদের পরাজয়ের মূল কারণগুলি হল, প্রথমত কাউন্ট ডি লালির ঔদ্ধত্য এবং অসংযত আচরণ যে কারণে পন্ডিচেরির অন্যান্য ফরাসি আধিকারিকারেরা লালির থেকে দূরে সরে যায় এবং কার্যত নিষ্ক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। দ্বিতীয়ত প্রচন্ড অর্থাভাবের কারণে সামরিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত বিপর্যয়। তৃতীয়ত বাসিকে দক্ষিণ ভারত থেকে সরিয়ে নেওয়ার ভুল সিদ্ধান্ত এবং সর্বোপরি সদ্য যুদ্ধজয়ী ব্রিটিশ নৌবাহিনীর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। ১৭৬৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত হয় প্যারিস চুক্তি এবং সেই চুক্তি অনুসারে ফরাসিরা ১৭৪৯ সালের আগে নির্মিত সমস্ত কারখানা এবং অন্যান্য সম্পত্তি ফেরত পায়। শুধুমাত্র চন্দননগরের দূর্গনির্মাণ সংক্রান্ত কোনও রকম কাজের অধিকার ফরাসিদের দেওয়া হলোনা। ক্ষমতার এই নতুন বন্টনের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ ব্রিটিশ কোম্পানির অগ্রগতি ঘটতে থাকলো অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এবং ভারতবর্ষ থেকে ফরাসি কোম্পানি ১৭৬৯ সালে সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্ত হয়ে গেল। ব্রিটিশরাই কার্যত কর্ণাটকের আধিপত্য লাভ করলো যদিও প্যারিস চুক্তির শর্তানুযায়ী নবাবকেই তার সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হল। নবাবের জীবদ্দশায় ব্রিটিশরা তাকে নবাবের স্বীকৃতি ও প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত না করলেও ১৮০১ সালে তার মৃত্যুর পরে তার সাম্রাজ্য ব্রিটিশরা দখল করে নিল এবং নবাবের উত্তরাধিকারীদের জন্য ভাতা ব্যবস্থা চালু হল। হায়দ্রাবাদের নিজাম শক্তিশালী প্রতিবেশীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে বাধ্য হল এবং তার পরিবর্তে নর্দার্ন সরকারের অধিকার ব্রিটিশদের দান করে দিল। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর শক্তি যেহেতু ভারতবর্ষের অন্য সমস্ত প্রদেশের মিলিত শক্তির চেয়ে অনেক বেশি ছিল সেইজন্য ভারতবর্ষে ক্ষমতার ভারসাম্য ব্রিটিশদের দিকেই ঝুঁকে রইলো।

অষ্টাদশ শতকে ভারতবর্ষের প্রদেশগুলি ছিল পারষ্পরিক দন্দ্বে বিদীর্ণ। প্রদেশগুলি রাজস্ব বৃদ্ধি করার জন্য একে অপরের অঞ্চল অধিকার করার জন্য সবসময়ে যুদ্ধে মেতে থাকতো। সমস্ত প্রদেশ একত্রিত হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একেবারেই সম্ভব ছিল না। বরঞ্চ পার্শ্ববর্তী প্রদেশকে দখল করার জন্য অনেকেই কোম্পানির দ্বারস্থ হত। ব্যবসায়িক স্বার্থ ছাড়াও প্রদেশগুলির মধ্যেকার এই পারষ্পরিক বৈরিতা ব্রিটিশদের সুযোগ করে দিল ভারতবর্ষের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার।
0

গল্প - অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in






আজ পয়লা এপ্রিল। আজ থেকেই শুরু করব খেলাটা। আমার বেডসাইড টেবিলে একটা স্বচ্ছ কাঁচের শিশি। শিশির মধ্যে একই রকম দেখতে তিরিশটা ক্যাপসুল। রাত বারোটায় প্রতিদিন শুতে যাওয়ার আগে একটা করে ক্যাপসুল খাব। তারপর টেবিলেই রাখা ডেস্ক-ক্যালেন্ডারে সেই তারিখের পাশে একটা টিক দিয়ে শুয়ে পড়ব। খেলাটায় একটা সাসপেন্স আছে। কতগুলো তারিখে টিক পড়বে তা অনিশ্চিত। একটা মাত্র পড়তে পারে আবার তিরিশটাও পড়তে পারে। তবে ক্যালেন্ডারের এই পাতাটা ওলটাতে হবে না কোনোদিনই। পয়লা মে আমাকে দেখতে হবে না সেটা নিশ্চিত। এই তিরিশটার মধ্যে ঊনত্রিশটা ভিটামিন ক্যাপসুল হলেও একটার খোলে ভরা আছে পটাসিয়াম সায়ানাইড।

***

ইন্ডিয়ান সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটে সিনিয়ার সায়েন্টিস্ট হিসাবে কাজ করছি আজ প্রায় পনের বছর হয়ে গেল। তার আগে এখানেই জুনিয়ার সায়েন্টিস্ট পদে ছিলাম পাঁচ বছর। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার বছরখানেক পর আমাকে সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মন্ত্রকের প্রধান সচিব পদে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আমি সেই পদ নিতে অস্বীকার করে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সরকার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে বিশেষ বেতনক্রম দিয়ে আমাকে এই পদেই রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা প্রায় তিন বছর আগের কথা। বিশেষ বেতনক্রম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার আমকে একটি বিশেষ প্রোজেক্টের দায়িত্বও অর্পণ করে। চূড়ান্ত গোপনীয় প্রোজেক্ট। তিন মাস অন্তর এই প্রোজেক্টের প্রোগ্রেস রিপোর্ট বিভাগীয় মন্ত্রীর হাতে আমাকে নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে। কাজ শুরুর আগে এই গবেষণায় আমার সহকারী হিসাবে একজন জুনিয়ার বিজ্ঞানীকে নিযুক্ত করেছে সরকার। নিয়ম অনুসারে ইউপিএসসি একটি ইন্টারভিউ বোর্ড গঠন করেছিল ঠিকই। কিন্তু বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে সেই পদে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করার সম্পূর্ণ অধিকার ও দায়িত্ব আমাকেই দেওয়া হয়েছিল। কোনো সন্দেহ নেই আমিই পছন্দ করেছিলাম মধুমিতাকে। সে অক্সফোর্ডের ডক্টরেট। অবশ্য সে ছাড়া আরও দুজন প্রার্থী বিষয়ের উপর যাবতীয় প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিয়েছিল। কিন্তু কোঁকড়ানো চুলের মেয়েটির হাই-পাওয়ার চশমার পিছনে বুদ্ধিদীপ্ত দুই চোখের আত্মবিশ্বাসী চাহনিই শেষ পর্যন্ত পার্থক্যটা গড়ে দিল। কাজ শুরু হওয়ার পর উপলব্ধি করেছিলাম আমার প্রার্থী-নির্বাচন নির্ভুল। মধুমিতা মেধাবী, পরিশ্রমী, দায়িত্ববান এবং বিষয়ের উপর যথেষ্ট দখল আছে তার। আমি ভাবতেই পারিনি সে আমার বিশ্বাসভঙ্গ করতে পারে।

***

আমি নিজেও বুঝি আর পাঁচজন মানুষের সঙ্গে আমার মিলের চাইতে অমিল অনেক বেশি। আমি অমিশুক, সামাজিকতায় স্বচ্ছন্দ নই, এবং কোনো ঘনিষ্ঠ বা আন্তরিক সম্পর্কে ঢুকে পড়ায় আমার স্বাভাবিক অনীহা আছে। আমার বাল্য ও কিশোরকাল অত্যন্ত অবহেলায় কেটেছে বলেই হয়তো আমার চরিত্রটা এমনই গড়ে উঠেছে। অত্যন্ত ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে অনাগ্রহী কাকার পরিবারে আশ্রয় জুটেছিল। সেখানে দুবেলা খাওয়ার বিনিময়ে সংসারের বহুরকম কাজ করতে হত। আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ রাখতে বাড়ির কাছে একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন কাকা। ভাগ্য ভালো, মেধা আর ইচ্ছের জোরে পড়াশুনাটা অব্যাহত ছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতে অসাধারণ রেজাল্ট করার পর আমাকে আর ভাবতে হয়নি। কাকার বাড়ি ছেড়ে ছাত্রাবাসে উঠেছিলাম। সেখানে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একজন স্বাভাবিক তরুণের মতো হয়ে উঠতে পারলাম না। পড়াশোনার জগতে একা একা কাটানোই আমার নিয়তি হয়ে উঠল। একজন সাধারণ মানুষের মতো বিয়ে-থা, সংসার ইত্যাদির চিন্তা কোনোদিনই আমার মনে ঠাঁই পায়নি। এই করেই প্রৌঢ়ত্বে প্রায় পৌঁছে গেলাম। আগামী পয়লা মে পঁয়তাল্লিশে পা দেওয়ার কথা। সেদিন আমার এই প্রোজেক্টের কাজের সময়সীমাও অতিক্রান্ত হবে। আর ঠিক তিরিশ দিন বাকি আছে সেই দিনটি আসতে। সে-পর্যন্ত যেতে পারলে জন্মদিনই হতে পারে আমার মৃত্যুদিন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা তিরিশের মধ্যে মাত্র এক।

***

এই ইন্সটিটিউটে মধুমিতার যোগদান করার দিন থেকেই আমি প্রোজেক্টের কাজ শুরু করেছিলাম। এর জন্যে বিশেষভাবে তৈরি ল্যাবরেটরিটি ইন্সটিটিউট-চত্বরের এক প্রান্তে অবস্থিত। এখানে আমরা দুজন ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের একজন সিনিয়ার ইনস্পেকটরকে এই পরীক্ষাগারের সুরক্ষা-ব্যবস্থা তদারকি করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। আমার থাকার জন্য পরীক্ষাগারের লাগোয়া দুই-ঘর বিশিষ্ট একটি আবাসও আছে। খাবারের ব্যবস্থা ইন্সটিটিউটের ক্যান্টিনে।

প্রথম বছরটা প্রায় শেষ হয়েছিল গবেষণার কাজে নিমগ্ন থেকে। আমার স্বভাব অনুযায়ী মধুমিতার সঙ্গে সম্পর্কটা কাজের স্তরেই আটকে ছিল। মধুমিতা চেষ্টা করেও আমার নিরাসক্তির বর্মে আঁচড় কাটতে পারেনি। আমি তার কাজে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলাম কিন্তু সে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তোলার উপক্রম করলেই আমার দীর্ঘকালীন অভ্যাসে রপ্ত করা উদাসীন চাহনিটি ঝুলিয়ে দিতাম চোখে।

আমার রক্ষণ আলগা হতে শুরু করল ঠিক দশ মাসের মাথায় যখন অপ্রত্যাশিত অল্প সময়ে প্রোজেক্টের প্রথম ধাপে সফলতা এসে গেল। এই ধাপে আমার লক্ষ্য ছিল মানুষের জেনোমে এমপ্যাথি বা সহমর্মিতার জিনগুলিকে শনাক্ত করা। পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই ‘অপর’ একজনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, ব্যথাযন্ত্রণাইত্যাদি নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারে। তার জন্যে যে-জিনগুলি দায়ি সেগুলিই হল এমপ্যাথির জিন। এগুলো শনাক্ত করা খুব সহজ কাজ ছিল না। আমার অবশ্য একটা সুবিধে ছিল যে আমার পুরনো কাজের সূত্রেই আমি নিশ্চিত ছিলাম এই জিনগুলো কেবলমাত্র মস্তিস্কের নিওরন-কোষেই অবস্থান করে। ফলে আমার অনুসন্ধানের কাজটা একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও আমার ধারণা ছিল প্রোজেক্টের সিংহভাগ সময় নেবে এই শনাক্তকরণ। দ্বিতীয় ধাপের কাজটা তুলনায় সহজ। এই ধাপে এমপ্যাথির জিনে মিউটেশন ঘটিয়ে সেগুলোকে স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে হবে। এটা সহজ, কারণ মাইক্রোইভোলিউশন ন্যাচারাল সিলেকশনের একটা অঙ্গ, যার ফলে কোনো কোনো কার্যক্ষম জিন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, আবার উলটোটাও ঘটে থাকে। অর্থাৎ, যেটা স্বাভাবিকভাবে এবং দীর্ঘ সময়ান্তরে ঘটে সেটা আমাকে কৃত্রিমভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে হবে।

যেদিন এই শনাক্তকরণ নিঃসংশয়ে প্রতিষ্ঠিত হল, সেদিন আনন্দের আতিশয্যে আমি বোধহয় খানিকটা লঘুচিত্ত হয়ে পড়েছিলাম। সেই সুযোগে মধুমিতা আমার কাছে একটা প্রস্তাব রেখেছিল। বলেছিল, - এই সাফল্যটা আমাদের সেলিব্রেট করা উচিত স্যার।

সেদিনই সম্ভবত প্রথম আমি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে মধুমিতাকে লক্ষ করলাম। তার দৃষ্টিতে একটা সহজ আন্তরিকতা ছিল, সে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। চশমা খোলার জন্যেই কি না জানি না, তার চোখের পাতা ভারী, দৃষ্টি গভীর। সহসা তার মুখটিকে আকর্ষণীয় মনে হল আমার। উদার হয়ে বললাম, - বেশ, কী করতে চাও বলো।

সে বলল, - কাল কোনো কাজ নয়, আমাদের অনেক ছুটি পাওনা হয়ে গেছে। ক্যান্টিনে খেতে খেতে আপনার জিভে নিশ্চয়ই কড়া পড়ে গেছে। কাল বাড়ি থেকে আমাদের দুজনের জন্য একটা স্পেশাল ডিশ বানিয়ে এনে একসঙ্গে বসে খাব। আর সারাদিন গল্প করব। কাজের কথা কিন্তু নয় স্যার। সেটা বাদ দিয়ে আমাদের দুজনের যা ইচ্ছে হবে সেসব নিয়েই কথা হবে।

আমার অস্বস্তি হলেও আপত্তি জানাতে পারলাম না।

***

সেই শুরু। আস্তে আস্তে দেখা গেল প্রতি সপ্তাহে একটা দিন তার বাড়ির রান্না-করা খাবার নিয়ে এসে একসঙ্গে খাওয়াটা রুটিন করে ফেলেছে মধুমিতা। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত কথাবার্তার আদানপ্রদান খুবই সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগল। একদিন সে দুম করে জিজ্ঞেস করে বসল, - আপনি বিয়ে করেননি কেন স্যার?

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা ছিল না। আমি চুপ করে বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলাম। সেই অবসরে আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টুকটাক প্রশ্ন করে যাচ্ছিল মধুমিতা। আমি আনমনা হয়ে উত্তর দিয়ে চলেছিলাম। পরে বুঝলাম আমার ছেলেবেলা থেকে শুরু করে এ-পর্যন্ত আমার জীবনকাহিনির পুরোটাই জেনে নিল সে। আমার বিয়ে না করা নিয়ে আর কোনোদিন কোনো প্রশ্ন সে করেনি। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে মধুমিতার ব্যক্তিজীবন নিয়ে আমারও একটা আগ্রহ জন্মাচ্ছিল। জানতে চাওয়ার ব্যাপারে আমি সংকোচহীন হতে পারিনি ঠিকই কিন্তু মধুমিতা যেন টের পেয়ে গিয়েছিল আমার আগ্রহটা। ফলে ধীরে ধীরে জেনে গেলাম তার মা-বাবা কর্মসূত্রে ইউ কে-তে আছেন দীর্ঘকাল। মধুমিতার স্কুলশিক্ষা কলকাতায় হস্টেলে থেকে সমাপ্ত হলেও গ্র্যাজুয়েসন, মাস্টার্স এবং ডক্টরেট ডিগ্রি সে অক্সফোর্ড থেকে করেছে। কিন্তু তারপরেই সে মা-বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এদেশে চলে এসে কর্মজীবন শুরু করে আজ থেকে বছর ছয়েক আগে। এখানে সে পৈতৃক ফ্ল্যাটে একাই থাকে। একদিন বলল, - আপনি তো বাইরে বেরনই না। চব্বিশ ঘণ্টা কাজ আর পড়াশোনা নিয়ে থাকতে একঘেয়ে লাগে না? একদিন চলুন না আমার ফ্ল্যাটে?

আমি বললাম, - তুমি একা থাকো – যাওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না।

মধুমিতা কৌতুকের সুরে বলল, - একা থাকি না স্যার। সঙ্গে থাকে একজন। তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। চলুন না –

একটি যুবতী মেয়ের প্রাইভেট লাইফ নিয়ে কৌতূহল হওয়া ঠিক নয় কিন্তু অন্যায্যভাবে সেটাই জেগে উঠল মনে।

একদিন সে নিয়ে গেল তার ফ্ল্যাটে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তার সেই ‘একজন’-কে। পাঁচ-ছ’ বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে। ঢলোঢলো মুখে মায়াভরা চোখ নিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সেই মেয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, - কে?

একচোখ হাসি নিয়ে মধুমিতা বলল, - আমার মেয়ে।

--তুমি বিবাহিতা – বলোনি তো –

--মা হতে গেলে বিবাহিত হতেই হবে স্যার?

--না – মানে – আমি কথা খুঁজে গেলাম না।

মাধুমিতার ফ্ল্যাটে একজন সাহায্যকারীও আছেন। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। চব্বিশ ঘণ্টাই থাকেন। মধুমিতা জানাল তিনি প্রশিক্ষিত পালিকা। মেয়ের দেখাশোনা করাই তাঁর প্রধান কাজ। চুক্তির বাইরে গিয়ে গৃহকর্মের কাজেও সাহায্য করেন। মেয়ের সঙ্গে স্কুলে যাতায়াত তাঁকেই করতে হয় বেশির ভাগ সময়।

সেদিন তার বাড়িতে দুপুরের খাওয়া শেষে তার মা হওয়ার গল্প শোনাল মধুমিতা। অক্সফোর্ডের পড়াশুনা শেষ করে মা-বাবার সঙ্গে এক মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিল মধুমিতা। ওখানে কয়েকটা কাজের অফার ছিল। ফিরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এমনটাই ঠিক ছিল। এখানে থাকতে একদিন পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সুন্দরবন ঘুরতে গিয়েছিল মধুমিতা। একটা লঞ্চ ভাড়া করে তিনদিনের ভ্রমণ। সেই লঞ্চে চালকের সহযোগীদের মধ্যে তার বউও ছিল। বউ-এর কোলে তিন-চার মাসের একটা বাচ্চা। মধুমিতা লক্ষ করল বয়স্ক চালকের যুবতী বউটি প্রায়ই বাচ্চাটাকে ইঞ্জিন ঘরের মেঝেতে শুইয়ে রেখে অন্য একজন তরুণ সহযোগীর সঙ্গে হাসিগল্পে মজে থাকছে। বাচ্চাটা তারস্বরে কেঁদেই চলেছে, কোনো হুঁশ নেই বউটার। বাচ্চাটার কান্না মধুমিতার বুকে এসে বিঁধতে লাগল। থাকতে না পেরে বউটাকে গিয়ে ধরল, - তোমার বাচ্চা কাঁদছে, শুনতে পাচ্ছো না?

বউটা বলল, - আমার বাচ্চা কেনে হবে, ননদটা বিয়োতে গিয়ে মরেচে, তার সোয়ামিটাও খ্যাপাপাগলা। কেউ দায়িত্ব নিলনিকো – আমার ইনি সাধু সেজে মেয়েটাকে আমার ঘাড়ে চাইপ্পে দিল। আমার নিজেরই তিনটা আছে। সেগুলাকে ঘরে থুয়ে এসচি, এই কচিটার ভার কে লেবে? খিদার জ্বালায় কেন্দে মচ্চে, কত আর দুধ গুলে খাওয়াই!আমার মাই তো শুককে গেছে।

বাচ্চাটার কান্না মধুমিতার বুকে স্থায়ী হয়ে গেল। ফেরার সময় চালকের সঙ্গে কথা বলে তার ফোন নম্বর নিয়ে এসেছিল। কলকাতায় ফিরেই একজন অ্যাডভোকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করল। দত্তক নেওয়ার আইনকানুন বুঝে নিয়ে চালককে সব জানাল। এদিকে লন্ডনে ফেরার সময় এসে গিয়েছিল। মধুমিতা গেল না। এই নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে তিন দিন ধরে বাদানুবাদ চলল। মধুমিতা সংকল্প থেকে নড়ল না। তাঁরা ফিরে যাওয়ার পর দত্তক দলিল তৈরি হল। নির্দিষ্ট দিনে চালক মেয়েটাকে নিয়ে একাই এসেছিল। রেজিস্ট্রি হওয়ার পর লোকটির চোখে জল। বলল, - আমার অভাগী বুনের আত্মাটা শান্তি পাইল মা। একটা সোন্দর জীবন অনাথ মেয়েটার কপালে লেখা হয়ে গেল।

একটা বিখ্যাত পালিকা কেন্দ্রের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করেছিল মধুমিতা। এই ভদ্রমহিলা সেদিন থেকেই বাচ্চাটির দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন।

***

প্রোজেক্টের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ বেশ উৎসাহের সঙ্গে শুরু করেছিলাম। একের পর এক উৎসেচকের ব্যবহার এবং ডিএনএ-এর বেস বদল করতে করতে এগিয়ে চলেছিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই পদ্ধতিতেই জিন ফ্রিকোয়েন্সির এমন পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব যাতে উদ্দিষ্ট জিনগুলি স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় হবে। বছরখানেকের মধ্যেই আংশিক সফলতা এল। এমপ্যাথির জিন নিষ্ক্রিয় হল কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সেগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠল। আমি বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা চালিয়েও নিস্ক্রিয়তাকে স্থায়ী করতে পারছিলাম না। দিনের পর দিন একই ফল পেতে পেতে আমার মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধল। ভালো করে খতিয়ে দেখে মনে হল, নিষ্ক্রিয় জিনের সক্রিয় হয়ে ওঠা স্বাভাবিক নয়, কেউ যেন এদের উপর রিভার্স পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করছে। একটু ভাবতেই যেন ইলেকট্রিক শক লাগল মাথায়! মধুমিতা ছাড়া আর কারোর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। তবে কি মধুমিতাই! কিন্তু কেন?

নিমেষেই মনে পড়ে গেল মধুমিতা একদিন কথাপ্রসঙ্গে বলেছিল, - এই প্রোজেক্টের পিছনে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে ভেবেছেন স্যার? সহমর্মিতাহীন মানুষ মানে তো ভয়ংকর এক জীব। তাদের বুদ্ধি থাকবে, দক্ষতা থাকবে অথচ মানবিক বোধ থাকবে না। যে কোনও ধরনের পৈশাচিক কাজে তাদের ব্যবহার করতে পারবে সরকার। ধরুন এদের নিয়ে কোনো গুপ্ত বাহিনী গঠন করল সরকার। তারপর সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের সব ধরনের প্রতিবাদ, বিক্ষোভে এদের ব্যবহার করতে লাগল।

আমি বলেছিলাম, - এসব তো রাজনীতির কথা। আমরা বিজ্ঞানী, প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করাই আমাদের একমাত্র কাজ।

তর্ক না বাড়িয়ে চুপ করে গিয়েছিল মধুমিতা। প্রসঙ্গ পালটে অন্য কথায় ঢুকে পড়েছিল। এই মুহূর্তে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। মধুমিতা আগেভাগেই আমাকে সন্দেহপরায়ণ করে তুলতে চায়নি। তাহলে তাকে গবেষণা থেকে ছেঁটে দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

প্রোজেক্টের সময়সীমা শেষ হতে দুটো মাসও বাকি নেই। মধুমিতাকে ছেঁটে দিয়ে নতুন করে আরম্ভ করার সুযোগ মিলছে না। আমার ক্যারিয়ারে এর আগে কোনোদিন ব্যর্থতার মুখ দেখতে হয়নি। সরকারের অগাধ আস্থা ছিল আমার উপর। সেটা তো গেলই, সেই সঙ্গে বিজ্ঞানী হিসাবে আমার বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে। এতখানি বিশ্বাসঘাতকতা করল মধুমিতা! নিমেষে সব রক্ত যেন মাথায় উঠে গেল আমার। রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠলাম। দ্রুত পায়ে ল্যাব থেকে বেরিয়ে অফিস ঘরে ঢুকলাম। মধুমিতা তার চেয়ারে বসে কিছু একটা করছিল। আমি তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিলাম, তারপর ডান আর বাঁ হাত দিয়ে সপাটে চড় কষাতে লাগলাম তার দুই গালে।

কতক্ষণ পরে থেমেছিলাম জানি না। মধুমিতা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি, যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে এক চুলও সরেনি। আমি থামার পর ধীরে ধীরে বসল চেয়ারে। তার রক্তলাল দুই গাল বেয়ে ঝরে চলল অশ্রুধারা। তার ভেজা চোখ তখনও নিবদ্ধ আমারই দু-চোখে। জানি না সহসা কী দেখলাম সেই দৃষ্টিতে, তীক্ষ্ণ কিছু একটা এসে বিঁধে গেল আমার বুকে। আর আমার মন জুড়ে অনুভবের পরিব্যক্তি ঘটে চলল। আমি মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে মধুমিতার কোলে মুখ গুঁজে দিলাম।

***

সেদিনের পর মধুমিতা আর আসেনি। ক্যুরিয়ার মারফৎ তার পদত্যাগপত্র আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেটা আজ অব্দি আমার ড্রয়ারেই পড়ে আছে। ইতিমধ্যে ঠাণ্ডা মাথায় আমি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। ল্যাবে উপাদান ছিলই। পটাসিয়াম সায়ানাইড তৈরি করতে সময় লাগেনি। দোকান থেকে পঞ্চাশটা ক্যাপসুলের একটা শিশি কিনলাম। ল্যাবে গিয়ে কুড়িটা ক্যাপসুল বের করে বাস্কেটে ফেলে দিয়ে একটা ক্যাপসুলের খোল খুলে সেটা খালি করে তার মধ্যে পটাসিয়াম সায়ানাইড ভরে নিলাম। শিশির বাকি ঊনত্রিশটা ক্যাপসুলের সঙ্গে সেটা মিশিয়ে বিছানার পাশের টেবিলে রেখেছি। বিজ্ঞানী হিসেবে আমি অনির্দেশ্য তত্ত্বে বিশ্বাসী। মৃত্যু নিশ্চিত করেছি বলে তার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করার অধিকার আমার নেই।

আজ পয়লা এপ্রিল। বেশ কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা হয়েছে। ফাঁকা মগজ, শরীরময় আলস্য। মোবাইল বেজে উঠল। হাতে নিয়ে দেখি এখানের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা ইনস্পেকটর। বললেন, - মধুমিতা ম্যাডাম এসেছেন, কিন্তু সঙ্গে একটি ছোটো মেয়ে। কোনো অসুবিধে নেই তো স্যার?

অবাক হওয়ার উদ্যমও বুঝি অবশিষ্ট নেই আমার। একটি পরেই মধুমিতা তার মেয়েকে নিয়ে ঢুকল। আমি তাদের শোয়ার ঘরে নিয়ে এসেই বসালাম। নিচু হয়ে মেয়ের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। মধুমিতা বলল, - সরি স্যার।

কেন দুঃখপ্রকাশ জানতে চাইলাম না। মধুমিতা বলল, - সেকেন্ড ফেজের কাজ নতুন করে শুরু করেছেন তো স্যার। আমার মনে হয় বাকি এই এক মাসেই আপনি লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন।

মধুমিতা সোফায়। মেয়েটি আমার গা ঘেঁষে বিছানায় বসেছে। আমি তার চুলে হাত ডুবিয়ে বললাম, - মন্ত্রকে আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নেওয়াও অসম্ভব হবে না, কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত বদল করেছি মধুমিতা। তোমার মতো আমিও পদত্যাগপত্র লিখে রেখেছি। দুটো চিঠি একসঙ্গেই অফিসের ড্রয়ারে রাখা আছে। দুটোর স্বাক্ষর একই তারিখের। আমি দৈবাৎ ভুলে গেলে তুমি মন্ত্রকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিও।

মধুমিতার চোখে যেন একটা চমক দেখলাম। তারপরেই তার চঞ্চল দৃষ্টি সারা ঘরে ঘুরতে লাগল। এই প্রথম এই ঘরে ঢুকেছে সে। তাই কি খুঁটিয়ে দেখছে? একটু পরে সোফা আর বিছানার মাঝখানে রাখা টেবিলে তার দৃষ্টি স্থির হল। সামান্য অস্বস্তি বোধ করলাম আমি। সে একটু ঝুঁকে ক্যাপসুলের শিশিটা খুঁটিয়ে দেখল। বলল, - রোজ খান?

উত্তর দিতে গিয়ে একটু থমকালাম। সামলে নিয়ে বললাম, - মাঝে মাঝে।

কয়েক মিনিট নীরবতা। মধুমিতার মেয়ে একটা মোটা বই খুঁজে বের করেছে। রঙিন ছবিওলা অ্যানাটমির বই। একমনে পাতা উলটে উলটে ছবি দেখে চলেছে। খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে। হঠাৎ মধুমিতা উঠে দাঁড়াল। বলল, - একবার ল্যাবে যেতে পারি স্যার?

আমি হাসলাম, - যাও না – স্যাবোটেজ করার কোনো সুযোগ তো আর নেই।

কোনো কথা না বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল মধুমিতা। তখনই আমার মাথায় একটা দুশ্চিন্তা ঢুকল। ক্যাপসুলের কাজ করে আসার পর থেকে আর তো যাইনি ল্যাবে। সব এলোমেলো পড়ে আছে। বাস্কেটে অতগুলো ক্যাপসুল - কেসিএন তৈরির কোনো ক্লু ছেড়ে আসিনি তো?

বোধহয় মিনিট পনেরো পরে ফিরে এল মধুমিতা। সোফায় বসে খানিক আনমনা স্বরে বলল, - আপনার কোনোদিন কোনো মেজর অপারেশন হয়েছে স্যার?

--হঠাৎ এই প্রশ্ন?

--না, অচেতন থেকে চেতনায় ফেরার কথা ভাবছিলাম। একটা অপূর্ব অভিজ্ঞতা!

--তুমি কী অর্থে বলছো?

মধুমিতা কেমন যেন একটা হাসল। বলল, -- না না, অন্য কিছু নয়। মেজর অপারেশনের আগের অ্যানেস্থেসিয়ার কথাই বলছি। আমার হয়েছিল। লন্ডনে। তখন মাস্টার্স করছি। য়ুফেরেক্টমি, সিস্টের জন্য ওভারি বাদ দিতে হল। দুটোই।

আমি হতভম্ব। যতোটা না এই নিদারুণ সংবাদে, তার চেয়ে বেশি সেটা জানানোর সময় বাছার জন্য। কোনো একটা কার্যকারণ সম্পর্কের হদিশ হাতড়াচ্ছিলাম। তখনই সোফা থেকে উঠে এল মধুমিতা। যেন ছোঁ মেরে ক্যাপসুলের শিশিটা তুলে নিল হাতে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শিশি হাতে ঘরের লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে গেল। একটু পরেই ফ্লাশ টানার শব্দ পেলাম। চোখের সামনে দ্বিতীয় অন্তর্ঘাতটি ঘটাল মধুমিতা।

***

বারটা বাজল বোধহয়। ইংরাজি ‘বোকা দিবস’ অস্তে গেল। পয়লা মে যে আমার জন্মদিন সে-খবরটাও মধুমিতার জানা। এই মুহূর্তে সে সোফায় আধশোয়া। তার মেয়ে আমার কোলে মাথা রেখে বহুক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি মধুমিতা এবং আমার মাঝখানে থাকা টেবিলের শূন্যজায়গাটার দিকে তাকিয়ে মধুমিতার চূড়ান্ত অন্তর্ঘাতের প্রতীক্ষা করছি।


সৃষ্টির একুশ শতক, মার্চ ২০২১
0

গল্প - গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্য

Posted in







কে? কে ওখানে?

হাল্কা সুতির পর্দার ওপারে কার যেন অবয়ব দেখা যাচ্ছে। রামেসিস একটু খাড়া হয়ে উঠে বসল।

কে?…তিয়ে! তিয়ে তুমি এসেছ? সত্যি? দূরে দাঁড়িয়ে কেন? আমার কাছে এস।

বয়সের সাথে বোধহয় মানুষের বুদ্ধিও ভোঁতা হয়ে যায়। নাহলে রামেসিস কখনও তিয়ের গায়ের সুগন্ধি চিনতে না পারে!

কি হল তিয়ে, কাছে আসবে না?

তিয়ে যেন একটু ইতস্তত করছে। তারপর ধীরে ধীরে পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এল। যেন নববধূটি।

রামেসিস নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে। আজও তিয়ের রূপ তাকে পাগল করে দেয়। সেই কাজলটানা মদির চোখ, পাটে বসা সূর্যের চেয়েও লাল ঠোঁট, গোলকধাঁধার মতো রহস্যময় হাসি...

কি এক দুঃখ হঠাৎ তীর হয়ে তার বুকে বিঁধে যায়।

তুমি আর আমার কাছে আস না কেন, তিয়ে?

তিয়ে ধীরে ধীরে রামেসিসের কাছে এসে দাঁড়াল। আবার সেই রহস্যের চেয়েও গভীর হাসি – যা সহজ উত্তরকেও গোলমাল পাকিয়ে দেয়।

“তুমি জান না কেন আসি না?”

রামেসিস তিয়ের হাত দুটো টেনে একেবারে নিজের কোলের কাছে বসিয়ে নিল।

“জান তিয়ে, তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম পদ্মপুকুরের ধারে…পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছিল তোমার মুখের ওপর, সন্ধের হাওয়া তোমার চুলের সুগন্ধ সারা বাগানে ছড়িয়ে দিয়েছিল...আমার মনে হয়েছিল তোমার চেয়ে সুন্দর এই পৃথিবীতে কেউ নেই!”

তিয়ের চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল।

“সত্যি? আমি এত সুন্দর? কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তো আইসিস আর তিয়িতির নাম লেখা হবে বলে শুনছি।”

রামেসিস তিয়েকে নিজের হাতের মধ্যে জড়িয়ে নেয়। ইয়ামোসে যেমন করে হাতে সাপ জড়িয়ে খেলা দেখায়।

“তুমি সাধারণ গৃহবধূ নও তিয়ে। তুমি রাজার স্ত্রী। এইসব কথা কি তোমার মুখে মানায়? আইসিসকে আমার বিয়ে করতে হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। আর তিয়িতি আমার বোন, তাকে তো স্বীকৃতি দিতেই হবে। সেসব তো প্রেমের বিয়ে নয়, তুমি সেকথা ভালোভাবেই জান।”

“তোমার অন্তঃপুরে কি শুধু আমরা তিনজনেই আছি?”

রামেসিস হেসে ফেলে। আজও মেয়েটার ছেলেমানুষী গেল না।

“আরো অনেকে আছে। কিন্তু তুমি আমার নেফারতারি। নেফারতারি তার স্বামীর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী ছিল, জান তো? আমিও তোমার চোখে চাঁদ সূর্য উঠতে দেখি!”

তিয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘোরাল।

“কই, নেফারতারির মতো আমার কোন মন্দির তো এখানে দেখছি না। আমাকে দেবী হাথরের প্রতিমূর্তি বলে আঁকা কোন ছবিও দেখছি না।”

“যার নামে আমার নামকরণ হয়েছিল, সেই রামেসিসও কি নিজের রাজধানীতে নেফারতারিকে স্বীকৃতি দিতে পেরেছিলেন? তাই তো মরুভূমি পেরিয়ে অতদূর যেতে হয়েছিল মন্দির বানানোর জন্য।”

তিয়ির চোখে ছায়া নেমে আসে।

“আমাদের ছেলেও তো শুনলাম রাজা হবে না।”

রামেসিসের হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে আসে।

“নিয়ম অনুযায়ী আমার বড় ছেলেই রাজা হবে। এ নিয়ে তুমি আর জেদ ক'র না।”

“বড় ছেলে, তাই রাজা হবে, না তিয়িতির ছেলে তাই রাজা হবে?”

“এসব ঈর্ষা মনে পুষে রেখে তুমি কি পাচ্ছ, তিয়ে? দিন দিন তোমার আর আমার মধ্যের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। পেন্তাওয়ারেতকে আমিও ভালোবাসি। সে আমারও ছেলে। কিন্তু ঐতিহ্য আর যোগ্যতা, দু'দিক থেকেই এই রাজ্য রামেসিসকেই যুবরাজ বলে দাবি করছে।”

তিয়ে রামেসিসের হাতের ওপর আঙুল বোলায়।

“তোমার আর আমার মধ্যের সব সমস্যা ওই সিংহাসনকে ঘিরে। তুমি আমার ছেলেকে যুবরাজ ঘোষণা করে দাও, আমি আবার আগের মতো তোমার কাছে ফিরে আসব। তুমি চাও না, আমি আবার আসি?”

“চাই…খুব চাই…”

কিন্তু…

“তুমি জান না তুমি কি চাইছ, তিয়ে। সিংহাসন চেয়ে তুমি পেন্তাওয়ারেতের জন্যে সুখের চাবিকাঠি কিনছ না।”

আমি রাজ্য অধিকার করে নিয়েছি, কিন্তু তোমাকে সুখের চাবিকাঠি দিয়ে যেতে পারব না...

হঠাৎ করে তিয়ের মুখটা পালটে গিয়ে বাবার মুখ হয়ে যায়। কিভাবে তা সম্ভব হল তা নিয়ে রামেসিস প্রশ্ন করে না। বরং ভাবে, কতদিন বাবাকে দেখেনি! তিরিশ বছরের ওপর তো বটেই।

“চারিদিকে শত্রুরা থাবা মেরে বসে আছে। রাজ্যের মানুষ যুদ্ধে যুদ্ধে জর্জরিত। বাড়িঘর ছেড়ে সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে আছে। এই সময়টা সিংহাসন কেড়ে নেওয়ার পক্ষে প্রশস্ত, সিংহাসন ধরে রাখার পক্ষে নয়। পারবে তুমি, নিজের পুরুষকার দিয়ে পরিস্থিতির গতি বদলে দিতে?”

“পেরেছি।”

নিজের গলা শুনে রামেসিসের কেমন অসঙ্গতি বোধ হয়। তারপর বুঝতে পারে। বাবা যখন মৃত্যুশয্যায় এই কথাগুলো বলেছিল তখন তা শুনেছিল তরুণ রামেসিস। আজ বর্ষিয়ান রামেসিস তার জবাব দিচ্ছে – যার যুদ্ধ জেতা বলিষ্ঠ হাত এখন কুঁচকে গেছে, দাড়িতে পাক ধরেছে, পেটের ডানদিকে চিনচিনে ব্যথা। রাজবৈদ্য গোপনে জানিয়েছে, রাজার দিন এখন হাতে গোনা মাত্র।

সেতনাখতে সামনে রাখা মদের পাত্র তুলে নিলেন। ঈষৎ ভুরু নাচিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,

“বটে? পেরেছ? তা কিভাবে পারলে?”

রামেসিস সামান্য ঝুঁকে বসল। এটা বাবার মৃত্যুশয্যা নয়। বরং দু'জন রাজা মুখোমুখি দুটো আরামকেদারায় বসে আছে, শুধুই খোশগল্প হচ্ছে।

“তুমি মারা যাওয়ার পরে রাজ্য জুড়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছিল।”

সেতনাখতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

“রাজ্য দখল করেছিলাম শুধু। শাসন করার সময় পাইনি।”

“সেই জন্যই তো প্রথম কিছু বছর যুদ্ধ, বাণিজ্য, সবকিছু মুলতবি রেখে রাজ্যে ঐক্য আনার আর সেনাকে মজবুত করার কাজে লেগে পড়ি। পাঁচ বছর বাদে যখন লিবিয়ার শত্রুরা আক্রমণ করে, আমাদের সেনা তখন প্রস্তুত। সহজেই তাদের হারিয়ে দেয়। সেখান থেকে শুরু।”

সেতনাখতের মুখে কৌতুক ঝিলিক দিল।

“ওহো! লিবিয়ার ওরা আবার হেরে বাড়ি গেল বুঝি? জান নিশ্চয়ই, রাজা মারনেপ্টাহের সময়েও একই ব্যাপার হয়েছিল।”

রামেসিসের সামনেও ভেল্কির মতো মদের পাত্র এসে গেছে। সে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিল।

“সে তো কিছুই না। আসল বিপদ ঘটল যখন সমুদ্র মানবরা আক্রমণ করল।”

“সমুদ্র মানব? কারা তারা?”

“পেলেসেত, দেনিয়েন, শারদানা, মেশোয়েশ – অসভ্য বর্বর জাতি সব। শুনেছি অনেক বড় বড় সভ্যতাকে নষ্ট করতে করতেই আসছিল। রাজ্যে এসে প্রথমে তারা স্থলপথে আক্রমণ করেছিল। জাহির যুদ্ধে তাদের হারিয়ে দিই। তখন তারা জলপথে আক্রমণ করে।”

“সেকি! আমাদের নৌবাহিনী তো খুবই দুর্বল! তুমি কি তাদেরও মজবুত করেছ?”

রামেসিস মাথা নেড়ে 'না' বলল।

“সেই সুযোগ পাই নি। আক্রমণের কথা জানতে পেরেই রাজ্যের সব জাহাজকে হুকুম দিলাম নীলনদের মোহনার মুখে চলে যেতে। সেনা না পৌঁছনো অবধি কেউ যেন জায়গা থেকে না নড়ে। জাহাজের পেছনে তীরন্দাজদের দাঁড় করিয়ে দিলাম। শত্রুর জাহাজ আসামাত্র তীরন্দাজরা নির্মম আক্রমণ শুরু করল। শত্রুপক্ষ তীরের জবাব দিতে ব্যস্ত এমন সময়ে আমাদের নৌসেনা ওদের জাহাজে উঠে পড়ে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করে দিল। ওরা পালানোর পথ পেল না।”

“সাবাশ! এতো ঐতিহাসিক বিজয়!”

রামেসিস মনে মনে সম্মতি জানায়। আবার মদে চুমুক দেয়।

“লিবিয়ার নির্লজ্জগুলো আরেকবার আক্রমণ করেছিল, আবার গোহারান হেরে ফেরত গেছে। তারপর থেকে সীমান্ত সুরক্ষিতই রয়েছে।”

সেতনাখতে নাকের ডগাটা চুলকে নিলেন। রামেসিসের মনে পড়ল, কোন অপ্রিয় প্রসঙ্গ তোলার আগে এটা করা বাবার অভ্যেস ছিল।

“তা, রাজ্যের লোকজন এসব ঘটনার ব্যাপারে কি মনে করে?”

“যুদ্ধ হলে স্বাভাবিকভাবেই ভাণ্ডারে টান পড়ে। সবাই তাই নিয়ে খুশী হয় না। বিশেষ করে যুদ্ধ যখন নিজের সীমান্তে হয় তখন ক্ষয়ক্ষতির আকড় লুকিয়ে রাখা একটু মুশকিল হয়ে যায়। তার ওপর ভালো শস্য না হওয়ার দরুন সেত মা'আত হের ইমেনতি ওয়াসেতের কবর খননকারী আর চিত্রশিল্পীদের মাইনে আর খাবার পৌঁছাতে কিছু দেরি হয়েছিল।”

“তাই নিয়ে তারা বিদ্রোহ শুরু করে?”

“বিদ্রোহ ঠিক নয়, কর্মবিরতি বলতে পার। মন্দিরের সামনে ধর্না দিয়েছিল বলে শুনেছি।”

“কর্মবিরতি? ধর্না? এমন অদ্ভুত কথা জীবনে শুনিনি!”

“সব খবর আমার কানেও আসেনি। আমার মন্ত্রীরাই সামলে নিয়েছে।”

“এখন পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হয়েছে?”

রামেসিস আরামকেদারায় হেলে বসল।

“সমস্যা এখনো চলছে। কিন্তু পুন্তের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রেখেছি। তিমনার খনি থেকে প্রচুর পরিমাণ তামা আনিয়েছি। সাইনাই থেকে দামী পাথর এসেছে।”

“আর মন্দির? নতুন স্থাপত্য কিছু বানিয়েছ?”

“আমার জন্য 'তৃতীয় রামেসিসের কোটি বছরের আবাসন, চিরকালের জন্য আমুন ভগবানের রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত' বানিয়েছি। তাছাড়া রাজ্যের অনেক মন্দিরে জমি দান করেছি, সোনার মূর্তি বসিয়েছি।”

“তার মানে আমি রাজ্যকে যে অবস্থায় রেখে গেছিলাম তুমি তার আমূল পরিবর্তন করে ফেলেছ। তোমার ছেলের জন্য সুরক্ষিত, শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি রেখে যাচ্ছ, যা আমি তোমার জন্য করে যেতে পারিনি।”

রামেসিস গালের ওপর হাত বুলিয়ে নিল।

“জানিনা, বাবা। রামেসিস বার বছর বয়স থেকেই যুবরাজ হয়েছে। অনেক কাজ শিখেও উঠেছে। কিন্তু রাজা হওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। মোটে একুশ বছর বয়স ছেলেটার। ও কি পারবে সামলাতে?”

“আলবাত পারবে!” সেতনাখতে হাঁটুতে চাপড় মেরে বলেন। “একুশ বছর বয়সে জানার আগ্রহ থাকে, শেখার আগ্রহ থাকে। রাজার ভূমিকা পালন করতে করতে অভিজ্ঞতা আপনেই এসে যাবে। কিন্তু তুমি…”

দেখতে দেখতে সেতনাখতের মুখ এক দিব্য আভায় ভরে উঠল।

“তুমি যেভাবে আমার বংশে গরিমা এনেছ, যেভাবে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছ, তার জন্য ইতিহাস তোমাকে চিরকাল মনে রাখবে। আমার আশির্বাদ আর মা'আতের কৃপায় তুমি অনন্তকাল আমুনের রাজ্যে বাস কর।”

“সত্যি? সত্যি বলছ?”

কিন্তু সেতনাখতে ততক্ষণে মিলিয়ে গেছেন। তাঁর জায়গায় রাখা আছে তুলাদণ্ড। তার একদিকে মা'আতের পালক। অন্যদিক ফাঁকা। রামেসিসের হৃৎপিণ্ড সেখানে রেখে যাচাই করা হবে। সামনে আনুবিস দাঁড়িয়ে৷ আর কিছু দূরে হোরাস।

এ তো শেষের বিচার…

“রামেসিস,” আনুবিস গম্ভীর গলায় ডাক দেন, “তুমি কি পেরেছ রাজা হিসেবে সফল হতে? মা'আতকে ধরে রাখতে পেরেছ? তুমি দেশের রাজা – অন্য সব পরিচয়ের থেকে এটাই কি তোমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হয়েছে?”

রামেসিস ভুরু কুঁচকে চিন্তা করে। চোখের সামনে এক এক করে ছবি ভাসতে থাকে – সমুদ্র মানবদের বিরুদ্ধে লড়াই, লিবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই, রামেসিসকে যুবরাজ ঘোষণা করা, দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের বরখাস্ত করা, মন্দির বানানো…

তারপর হঠাৎ করে সব মুছে গিয়ে তিয়ের মুখটা ভেসে ওঠে।

“তোমার বাবার প্রশংসার এখানে কোন জায়গা নেই,” আনুবিস কঠোর স্বরে বলে চলেন, “তোমার নিজের হৃদয়কে যাচাই করে দেখ, তুলাদণ্ডে ফেললে তার কি পরিণতি হবে।”

রামেসিস তিয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিষ্পলক।

প্রিয়তমা স্ত্রী তিয়ে…আমার নেফারতারি…

কিন্তু…

রামেসিস আর তিয়ের মধ্যে যোজনব্যাপী দূরত্ব তৈরী করা সেই 'কিন্তু'…

আমাকে ক্ষমা কর তিয়ে, শুধু তোমার স্বামী হয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমাকে যতই ভালোবাসি না কেন, রাজার কর্তব্যকে অবহেলা করে তোমার অন্যায় আবদার মানতে পারব না।

“এটাই কি তোমার সিদ্ধান্ত?” আনুবিস প্রশ্ন করেন।

“…হ্যাঁ…”

পর্দার আড়ালে টুংটাং আওয়াজ ওঠে। ঘরের মধ্যে পদ্মের সুগন্ধ ফেলে রেখে তিয়ের অবয়ব মিলিয়ে যায়। শুধু তেরচা করে আসা চাঁদের আলো রামেসিসের বন্ধ চোখের ওপর আলতো করে আঙুল বোলায়।

রাত আরো গভীর হলে ধারাল অস্ত্র হাতে আততায়ীর দল রাজার ঘরে ঢুকে আসে। রাজা তখন আরামের বিছানায় অঘোরে ঘুমিয়ে। মুখে প্রশান্তির হাসি।

****

সেদিন সন্ধেবেলায় গুপ্তচর এসেছিল। রামেসিস তখন রাজ্যের করব্যবস্থা দেখতে মগ্ন। গুপ্তচরকে দেখে ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কি সংবাদ?

গুপ্তচর কয়েক পা এগিয়ে এল। গলা নীচু করে বলল,

“সংবাদ ভালো নয়, মহারাজ। রানী তিয়ে তাঁর ছেলে রাজপুত্র পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার জন্য চক্রান্ত করছেন। রাজপ্রাসাদেরই কয়েকজন সদস্য চক্রান্তের মধ্যে আছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।”

“কেমন চক্রান্ত?”

গুপ্তচর গলা আরো নামিয়ে আনল।

“মহারাজের প্রাণ সংশয় হতে পারে।”

“কবে?”

“সে খবর এখনো পাইনি। সম্ভবত কিছু ঠিক হয়নি এখনো।”

“বুঝলাম।”

রামেসিস চোখ বন্ধ করে বসে রইল।

তিয়ে? শেষটায় তিয়ে আমাকে মারতে চায়?

সেটা অবশ্য বিষ্ময়কর নয়। খুব ঈর্ষা, খুব অভিমান তার। আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাও খুব। নিজেই কতবার বলেছে পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার কথা। রামেসিস প্রত্যেকবার হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু… এবার তো মহা ফ্যাসাদ হল।

“ইহজগতের দুঃখ আর আপনাকে বেশীদিন ভোগ করতে হবে না।”

রাজবৈদ্যের বলা কথাগুলো রামেসিসের কানে বাজতে থাকে।

কারা চায় না আমার পরে রামেসিস রাজা হয়? যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে রাজভাণ্ডার খালি হয়ে যাচ্ছে বলে যারা অনুযোগ করছে তারা? নাকি তাদের অন্য কোন দাবি আছে? তাদের বিরুদ্ধে, বিশেষতঃ তিয়ে আর পেন্তাওয়ারেতের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় হওয়ার আগেই যদি আমার দিন ফুরিয়ে যায়?

তাহলে আমার মৃত্যুর পরে গৃহবিবাদ লেগে যাবে। রামেসিসের বিরুদ্ধে পেন্তাওয়ারেতকে সদস্য খাড়া করে চক্রান্ত চলতে থাকবে। আমার অন্য ছেলেরাও সুযোগ বুঝে দাঁও মারার চেষ্টা করবে। রামেসিসের মাত্র একুশ বছর বয়স। এই বয়সে রাজার দায়িত্ব বুঝে নিতেই ওর সময় চলে যাবে। তার ওপর গৃহবিবাদ সামলানো ওর দ্বারা সম্ভব হবে না। আর এসব খবর বাইরে গেলে শেয়াল কুকুরের দলের থাবা মারতে ছুটে আসতে সময় লাগবে না। আমার সারা জীবনের চেষ্টায় রাজ্যে যে শান্তি, যে সুরক্ষা এনেছি, এক মূহুর্তে তা নষ্ট হয়ে যাবে।

টুকরো টুকরো ছবি পরপর বসে গালিচা বনে যায়। রামেসিসের মাথায় সমাধানটা স্পষ্ট হয়।

নাঃ, আমাকে তিয়ের চক্রান্তেই মরতে হবে। আর তিয়ে আর পেন্তাওয়ারেতকে আমার সঙ্গে মরতে হবে। রাজদ্রোহের দায়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড পেতে হবে। গুপ্তচরের খবর এতক্ষণে রামেসিসের কাছেও পৌঁছে গেছে। কাল আমার মৃতদেহ পাওয়া গেলে রামেসিস অনুসন্ধান শুরু করতে পারবে। উত্তরাধিকারের লড়াই তখন খুনের মামলায় রূপান্তরিত হবে। চক্রান্তকারীরা হয়ে যাবে রাজদ্রোহী। তবেই রামেসিসের হাতে সুরক্ষিত রাজ্য তুলে দিতে পারব। আমার পূর্বপুরুষদের কাছে মুখ দেখাতে পারব। বলতে পারব, নিজের পুরুষকার দিয়ে ভাগ্যের প্রতিকুলতাকে জয় করতে পেরেছি।

রামেসিস যখন চোখ খুলল ঘর তখন খালি। গুপ্তচর রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে প্রধান পরিচারক পেবেক্কামেনকে ডেকে পাঠাল।

তিয়ে যদি সত্যিই আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে থাকে, তাহলে আমার প্রধান পরিচারককে দলে না নিয়ে তার উপায় নেই। একটা হিসেবের খেলা খেলে দেখি, কি হয়।

“মহারাজ ডেকেছেন?” মার্জিত দূরত্বে দাঁড়িয়ে পেবেক্কামেন মাথা নোয়াল।

“হ্যাঁ। আজ আমার রাতের খাবারের পরে তুমি মদের ব্যবস্থা করবে।”

“যথা আজ্ঞা।”

“সে মদ যেন এমন হয় যে হাজার ডাকাডাকিতেও আমার সারারাত ঘুম না ভাঙে।”

মূহুর্তের জন্যে পরিচারকের মুখের অভিব্যক্তি কি পালটে গেল, না তা শুধুই রাজার কল্পনা?

“অবশ্যই, মহারাজ।”

“যাও, প্রস্তুতি শুরু কর।”

পেবেক্কামেন চলে গেলে রাজা মিটিমিটি হাসে। সুখের চাবিকাঠি পরপারের সম্পত্তি। এই পৃথিবী শুধুই দুঃখ ভোগ করার জন্য। একদিন চলে যেতে হবে সবাইকেই।

কিন্তু রাজার চাল চেলে যাওয়ার মতো সৌভাগ্য হয় ক'জনের?



· হারেম চক্রান্ত : প্রাচীন মিশরের রাজা তৃতীয় রামেসিসের স্ত্রী তিয়ে এবং রাজার হারেম এবং প্রাসাদের কিছু সদস্য মিলে রাজাকে হত্যা করেন, তিয়ের ছেলে পেন্তাওয়ারেতকে রাজা করার জন্য। কিন্তু চক্রান্তকারীরা ধরা পড়ে যান, এবং অধিকাংশই মৃত্যুদণ্ড পান। তৃতীয় রামেসিসের হত্যার পর তাঁর ছেলে চতুর্থ রামেসিসই রাজা হন।
0

গল্প - বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়

Posted in






সে বালিকা না কিশোরী সে নিজেই জানে না। অট্টালিকার প্রাচুর্য তাকে টানে না। কিন্তু এই হর্ম্যের রহস্য তাকে আকর্ষণ করে।কেন করে সে বোঝেনা।
এই যে পাখিটি বারান্দায় উড়ে এসে জুড়ে বসল তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয়... তার গায়ে এত রঙের বাহার।সে এগিয়ে যায়।তার কৌতুহল আন্তরিক। পাখি তাকে বিশ্বাস করেনা।সে একটা বিচিত্র শব্দ করে উড়ে যায়। সকালের অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। উদ্যান পরিপাটি। তার চোখে মুখে মৃদু আনন্দ ও বিস্ময়।সে এখন কী করে? প্রত্যেক নারী কি এই সংশয়ে ভোগে? সদ্য বালিকার সব প্রশ্নের উত্তর হয়না।
সে নিজের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়। তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে নিজের কক্ষে দর্পণে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।তার চোখ এতো গভীর আর টানা টানা? ভুরু আর চোখের পাতা এতো সুন্দর?এতো দীর্ঘ আর কালো তার চুলের ঐশ্বর্য?সে এখনই ৫ ফুট ৫, আরও লম্বা হবে?,,,তার আঙুল, তার নখ,তার কটিদেশ, তার পায়ের গড়ন এ সব কবে হল? কীভাবে হল?সে রঙ লাগায় না। তবু তার ওষ্ঠ, তার হাত ও পায়ের নখগুলো এতো উজ্জ্বল।সদ্য অঙ্কুরোদগম হয়েছে তার। ব্যথা লাগে কোথাও তবু সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই সামান্য উদ্ভাসিত মুকুলের দিকে।যেন এক মহা সমারোহে প্রকৃতির মতো সেও বেড়ে উঠছে। শুধু সেই অদৃশ্য জায়ফলটিকে সে চেনেনা।
তার একটাই অভাব যে তার কোনো অভাব নেই।
স্নানের ঘর থেকে পরিচ্ছন্ন হয়ে আসার পর সে‌ কিছুক্ষণের জন্য একাকীত্ব হারিয়ে ফেলবে। এটাই এ বাড়ির নিয়ম। প্রাতরাশ টেবিলে সাজিয়ে রাখা টাটকা ফল,ফলের রস,দুধ, ডিমের পোচ, ওটস ইত্যাদির মধ্যে সে পছন্দ মতো খাবার বেছে নিতে পারে। সেই স্বাধীনতা সে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে দুবছর আগে।
তার মা একজন গরিষ্ঠ সমাজ কর্মী.. ব্যস্ত মানুষ।
তার বাবা এই উপনগরীর সম্মানীয় আইনজীবী।সে একমাত্র সন্তান। পৈতৃক সূত্রে অর্জিত এই সুরম্য অট্টালিকা রক্ষা করতে লোকবল ও অর্থ লাগে।যা তাদের আছে।
সে এখানকার সবচেয়ে অভিজাত বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে।
গাড়িতে করে ইস্কুলে যাওয়া আসার ফাঁকে সে দেখতে পায় পায়ে হেঁটে, সাইকেল রিক্সায় , ভ্যানে চেপে মেয়েরা ইস্কুলে যায়। তাদের বিনুনির মধ্যে খেলা করে হালকা রোদ্দুর,পাশ থেকে উড়ে আসে পতঙ্গের মৃদু গুঞ্জন।দূর থেকে এসব দেখতে ভালোই লাগে।
এই বালিকার কোনো নাম নেই? অবশ্যই আছে। নামে কি আসে যায়?

তার ক্লাসে মহিমা নামে একটি বালিকা আছে। তথাকথিত সুন্দরী নয়। কিন্তু পড়াশোনায় তুখোড়।সে অবলীলায় প্রথম হয় পরীক্ষায়.. অবহেলায় সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
মহিমার সঙ্গে তার সহজ সম্পর্ক। অথচ কোথায় একটা দূরত্ব আছে।