Next
Previous
Showing posts with label গল্প. Show all posts
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in



















ষষ্ঠ পর্বঃ

পানু রায় অফিসের দরজা ঠেলে ঢুকতেই সুন্দরী জিজ্ঞাসা করল,’ কিছু খোঁজ পেলে, দাদু?’

পানু রায় বললেন,’ জানিনা আমি কতটা ঠিক তবে বড়কালীর অফিসে কিছুতো একটা ঘটেছে বা এখনও ঘটছে। সুন্দরী, শেষ কবে আমরা বড়কালীর সঙ্গে কথা বলেছি?’

- মনে পড়ছে না। দাঁড়াও কল লিস্ট দেখে বলছি। আমার কাছে সব ফাইল করা আছে।

-দেখে বল। তাড়াতাড়ি।

সুন্দরী দ্রুত হাতে ফাইলের পাতা উল্টোতে উল্টোতে বলল,’ মনে হচ্ছে এক বছর হবে…একটু দাঁড়াও…এই তো পেয়েছি… ঠিকই আন্দাজ করেছি…একবছরের কিছু বেশি, ধর তেরো মাস।‘

পানু রায় বললেন,’ তার মানে এই নতুন সেক্রেটারি আসার পর বড়কালী আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।‘

-এমনতো হতে পারে যে যোগাযোগ করার মত কিছু ঘটেনি?

-হয়তো তাই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এলিনা আসার পর একটা কিছু পরিবর্তন তো হয়েছে বড়কালীর অফিসে। ঠিক আছে। একটা কাজ করো সুন্দরী। কাঠমান্ডুর সাভেরা মোটেলে ফোন করে দেখ বড়কালী ওখানে আছে কি না। যদি থাকে বলো পানু রায় কথা বলতে চায়। যে ফোন করছে তার নামটা যেন ওরা ঠিক করে বুঝতে পারে।

-এখুনি করছি দাদু। এক মিনিট সময় দাও।

সুন্দরী ফোন করল,’ আমি কৃষ্ণকালী চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে পারি? পানু রায়ের অফিস থেকে বলছি।‘অপর প্রান্ত থেকে মনে হয় অপেক্ষা করতে বলল। সুন্দরী মুচকি হেসে পানু রায়ের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। ওপাশ থেকে কৃষ্ণকালীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল ,’মিঃ রায়?’ সুন্দরী বলল, ‘ হ্যাঁ,হ্যাঁ, একটু ধরুন। দিচ্ছি, এখানেই আছেন।‘ পানু রায় সুন্দরীর কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে বললেন,’ আমি পানু রায় বলছি।‘ ওপাশ থেকে চাপা আওয়াজ ভেসে এল,’ আমি কৃষ্ণকালী বলছি।‘

-তুমি কি যেখানে আছ সেখান থেকে কথা বলতে পারবে?

-পারব। তবে বেশিক্ষণ পারবো না।

-শোন, আজ সকালে এক সুন্দরী মহিলা আমার কাছে এসেছিল। সে বলছিল একটা কোম্পানিতে তার চল্লিশ শতাংশ মালিকানা আছে এবং তুমি সেটা কিনতে চাও। তার কাছে নাকি কে একজন এসেছিল যে তোমাদের দু’জনেরই…’ কথা শেষ হবার আগেই ওপাশ থেকে কৃষ্ণকালী বলল,’আর কিছু বলতে হবে না। আমি আপনাকে ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফোন করছি।‘

-ঠিক আছে, আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকব।

কৃষ্ণকালী ফোন কেটে দিল।

পানু রায় বললেন,’ এখন চারটে বাজে।একঘন্টা একটু অন্য কাজ করা যাক। সুন্দরী, তুমি ভেতরে যেতে পার। আমাকে এককাপ কফি পাঠিয়ে দিও। তুমি পাঁচটার সময় একটু অফিসে এস।‘পানু রায় পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলেন। আলমারি থেকে একটা বই টেনে নিয়ে বইএর মধ্যে ডুবে গেলেন। মনে হল সারাদিনে যা যা ঘটেছে তার থেকে এখন অনেক অনেক দূরে তার মন।

ঠিক পাঁচটার সময় সুন্দরী ফিরে এসে দেখল পানু রায় বই এর মধ্যে ডুবে আছেন। সুন্দরী কোনও আওয়াজ না করে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। ঠিক পাঁচটা কুড়িতে ফোন বেজে উঠলো। বড়কালী ফোনের ওপারে।

-কী হয়েছে, মিঃ রায়? আমাকে ডিটেলে বলুন। কিন্তু কারও নাম নেবেন না, প্লিস।

-যে মেয়েটি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তার কাছ থেকে সম্পত্তির মালিকানা কেনার জন্য কোনও রহস্যজনক ব্যক্তি প্রস্তাব দিয়েছে। মনে হয় ঐ ব্যক্তি তুমি এখন যে শহরে আছ সেই শহর থেকেই এসেছে। ঐ ব্যক্তি আগামীকাল মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে চায়। মেয়েটির মনে হয় ওর আর তোমার যৌথভাবেই সিদ্ধান্ত এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। যে কোনও একজন যদি একা সিদ্ধান্ত নেয় এবং মালিকানা বিক্রী করে তাহলে সেটা অপরজনের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করবে।

-বুঝতে পেরেছি।

-আমি তোমাকে অযথা বিরক্ত করলাম না তো? তোমাকে খুঁজে পেতে আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হল। সময়ও গেল অনেক।

- শেষ অবধি আমাকে খুঁজে পেলেন কি করে?

- অবশেষে আমাকে মনীষা ঝা মানে মনীষা প্রসাদের দ্বারস্থ হতে হল।

-কিন্তু ও কী করে জানল আমি কোথায়? আমি তো ওকে কিছু জানাইনি।

-মনীষা জানে সাধারণত তুমি ওখানে গেলে কোথায় থাকো।

-এত কান্ড কেন করতে গেলেন? আমার অফিসে যোগাযোগ করলেই তো পারতেন। এই খবরের জন্য আমার একবছরের পুরনো সেক্রেটারির কাছে যাবার কী দরকার ছিল?

-দাঁড়াও দাঁড়াও, আমি তোমার নতুন সেক্রেটারি এলিনা রাইএর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ও আমাকে কোনও খবর দিতে পারলো না।

-তার মানে?

-মানে আবার কী? বলতেই পারলো না তুমি কোথায়।

-এসব কী বলছেন আপনি? আমি এলিনার সঙ্গে এবং অফিসের অন্যান্য সকলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি।

-এমন হতে পারে যে তুমি এলিনাকে ফোন করার আগেই আমি এলিনার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তখন হয়তো ও জানত না তুমি কোথায়। আমি তোমার অফিসে ধর আড়াইটে –পৌনে তিনটের সময়ে গিয়েছিলাম। ওতো কিছু বলতেই পারলো না।

-কী করে হতে পারে? আমি একবার সাড়ে এগারটার সময় আর একবার পৌনে দু’টোর সময় ওর সঙ্গে কথা বলেছি।

-তাহলে হয়তো এলিনা আমাকে কোনও খবর জানার যোগ্য ব্যক্তি বলে মনে করেনি। যাইহোক, ছেড়ে দাও । এই নিয়ে বেশি ভেবো না।

-জানিনা। তাহলে আপনি যা বলছেন তাই হয়তো ঠিক। আচ্ছা, আপনি ঐ লোকটা যে মহিলাটির সঙ্গে দেখা করতে চাইছে তার নাম জানেন?

-না, মেয়েটি তো বলল ‘জনৈক রহস্যময় ব্যক্তি’।

-আমার মনে হচ্ছে আমি লোকটাকে চিনি। লোকটা আত্মগোপন করে আছে। লোকটা কিন্তু ভয়ঙ্কর। আপনাকে একটা উপকার করতে হবে মিঃ রায়। দেখতে হবে মেয়েটির নিরাপত্তা যেন কোনও ভাবেই বিঘ্নিত না হয়। ওকে বলুন যে আমার পনের শতাংশ বিক্রীর ব্যাপারে যতক্ষণ না আমি ফিরছি ততক্ষণ আপনি আমার প্রতিনিধিত্ব করছেন। সুতরাং ঐ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির নাম এবং ঠিকানা জানার ব্যাপারে আপনার সম্পূর্ণ অধিকার রইল। জানার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে দয়া করে জানাবেন। আপনি সাভেরা মোটেলে ফোন করবেন এবং জুলিকে চাইবেন।জুলিকে নাম আর ঠিকানা দিয়ে দেবেন।

-শুধু জুলি বললেই হবে?

-হ্যাঁ, শুধু জুলি বললেই হবে।

-তুমি কি চাও আমি কোনও দাম বলি?

-না, এখন নয় । আগে দেখা যাক ওরা কত দিতে চায়। আমার মনে হয় ঐ লোকটা দামের কথা তুলবে না। আপনি বলবেন যে আমি এবং আপনি দু’জনেই এর মধ্যে জড়িত। স্পষ্ট করে বলে দেবেন যে ওরা যদি মনে করে ওরা ঐ মহিলার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলছে সেটা ওদের পক্ষে ভুল হবে। আমি এখন রাখছি। আর একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছে।

বড়কালী ফোন রেখে দিল।




সপ্তম পর্বঃ

রেবা কৈরালা পরেরদিন ঠিক দশটার সময় পানু রায়ের অফিসে এসে হাজির হলো। পানু রায় রেবাকে বসতে বলে বললেন,’ আমার সঙ্গে কাল কৃষ্ণকালীর কথা হয়েছে।‘

রেবা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,’ উনি কোথায়?’ পানু রায় বললেন,’ উনি আমাকে কাঠমান্ডু থেকে ফোন করেছিলেন।উনি আমাকে ওনার মালিকানা বিক্রী সংক্রান্ত কথাবার্তার ব্যাপারে দায়িত্ব দিয়েছেন যতক্ষণ না উনি ফিরছেন।আপনি যাকে জনৈক রহস্যজনক ব্যক্তি বলছেন তার সম্বন্ধে আমাকে জানার এবং বোঝার দায়িত্ব দিয়েছেন।যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি পুরো পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে আমার মতামত জানাচ্ছি ততক্ষণ কোনও দাম ঠিক করা যাবে না।‘রেবা কিছু বললোনা। পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ আপনার কিছু বলার আছে?’

-না, আমি অন্য কিছু ভাবছিলাম। কিন্তু কৃষ্ণকালীবাবু যখন এটা চাইছেন তখন আমার কোনও আপত্তি নেই।

-তাহলে, আপনি আমায় বলুন যে ঐ ব্যক্তি কে এবং কোথায় গেলে ওনাকে পাব?

রেবা একটু ইতস্তত করে বলল,’ লোকটার নাম শিবুলাল রেগমি। আজ সন্ধ্যাবেলা ৮-৩০ মিনিটে রিজেন্ট অ্যাপার্টমেন্টে ২১১ নং ফ্ল্যাটে শিবুলালের সঙ্গে আমার দেখা করার কথা আছে। রিজেন্ট অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা ৯৪, ক্যাসুরিনা অ্যাভিনিউ। আপনি কৃষ্ণকালীবাবুকে বলবেন যে এই ব্যাপারে উনি যা বলবেন তাই হবে। আমি শিবুলালের সঙ্গে দেখা করব কিন্তু সেটা কেবলমাত্র আলোচনা চালিয়ে যাবার স্বার্থে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমি এখন আসি।‘মৃদু হেসে ঘর থেকে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল রেবা কৈরালা।

রেবা বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী পানু রায়ের কাছে এসে বলল,’দাদু, আমি বাজি রেখে বলতে পারি ও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল তার কারণ ও ভয় পাচ্ছিল পাছে তুমি ওকে কোনও অস্বস্তিকর প্রশ্ন কর।‘পানু রায় বললেন,’ তার মানে? আমি ওকে কী অস্বস্তিকর প্রশ্ন করতে পারতাম যে ও তাতে ভয় পেয়ে চলে গেল? কষ্টকল্পনার একটা সীমা আছে সুন্দরী।‘ সুন্দরী মুচকি হেসে বলল,’ ওতো জানে না যে তুমি জান না।‘ পানু রায় বললেন,’ সকাল সকাল হেঁয়ালি রেখে বলো কী হয়েছে।‘ সুন্দরী নিজের টেবিলে গিয়ে আজকের খবরের কাগজটা নিয়ে এসে পানু রায়ের সামনে খুলে বলল,’ দেখ, কী হয়েছে!’ পানু রায় দেখলেন খবর বেরিয়েছে যে কালীকৃষ্ণ অর্থাৎ ছোটকালী গতকাল একটি মেয়েকে বিয়ে করে পাটনা থেকে ফিরেছে। খবরের সঙ্গে নবদম্পতির ছবিও ছাপা হয়েছে। খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে পানু রায় বললেন,’ বাঃ, বেশ দেখতে মেয়েটিকে। মেয়েটির সম্বন্ধে কিছু লিখেছে কাগজে?’ সুন্দরী বলল,’ মেয়েটি কাঠমান্ডুতে মডেলিং করত। ওখানেই মাসদুয়েক আগে আলাপ হয়েছিল ছোটকালীর সঙ্গে। পানু রায় হেসে বললেন,’ছোটকালী কোনও কাজে দেরি করেনা দেখছি।‘ সুন্দরী বলল,’ কে জানে? তাড়া কার ছিল? মেয়েটিরও থাকতে পারে।‘পানু রায় বললেন,’ সুন্দরী, একটা কাজ করো। সাভেরা মোটেলে ফোন করে দেখ বড়কালীকে পাও কি না।যদি না পাও জুলি বলে কেউ আছে কি না দেখ।যদি জুলিকে পাও তাহলে ওকে শিবুলালের নাম, ঠিকানা দিয়ে দাও।‘সুন্দরী একটু দূরে গিয়ে ফোন করে খানিকক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল যে বড়কালীকে পাওয়া যায়নি তবে জুলিকে শিবুলালের নাম, ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে।পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ জুলির পুরো নাম বা জুলি কী করে জানতে পারলে?’

-না, তবে কথাবার্তার ধরণ থেকে মনে হল মহিলা ঐ মোটেলের ম্যানেজার বা ঐ জাতীয় কিছু।আমি জুলিকে চাইলাম এবং যে ফোন তুলেছিল সে বলল সেই জুলি।আমি তোমার নাম বলাতে ও জিজ্ঞাসা করল আমি বড়কালীর জন্য কোনও মেসেজ দিতে চাই কি না। আমি ওকে শিবুলালের নাম, ঠিকানা দিলাম। দাদু, এখন তুমি কী করবে ভাবছ?’

-ভাবছি আজ সন্ধ্যাবেলা রেবার আগেই আমি শিবুলালের সঙ্গে দেখা করব। আর তুমি একটা কাজ করো। হাজার পাঁচেক টাকার মধ্যে ছোটকালীর জন্য একটা উপহার কিনে রেখ।

-শিবুলাল তোমার সঙ্গে কথা বলবে মনে হয়?

-জানিনা। তবে ঐ ঠিকানায় শিবুলাল থাকলে আমি নিশ্চয়ই তার সঙ্গে কথা বলবো।
0

গল্প - সুব্রত ঘোষ

Posted in



















শরীর আর চলছে না । তিন বছরের এক্সটেনশন  পেয়ে রোজ ঢাকুরিয়া  থেকে  বিবাদীবাগ আসা যাওয়া  করতে সুবলবাবু র এখন ক্লান্তি আসে । ফেরার সময় মিনিবাসে উঠে কেমন যেন ঝিমুনি ধরে। কন্ডাক্টরের চিৎকারে ঝিমুনি থেকে বেরিয়ে কোন রকমে বুকপকেট থেকে ভাড়ার টাকাটা দিয়ে আবার ঝিমুনিতে চলে যান হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পেয়ে  আবার কোমায় চলে যাওয়া পেসেন্টের মতো । সীটে বসে আগে পিছে ঘাড় লটকে ঝটকা খেতে খেতে একসময় চোখটাকে নরুনচেরা করে পাশের সহযাত্রীর কাঁধটা জরিপ করে নিয়ে আস্তে আস্তে মাথাটা তার কাঁধেই ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হন। কোন অদৃশ্য কারণে প্রায়ই সুবলবাবুর সহযাত্রী মাঝবয়সী মহিলা হন ,যারা সুবলবাবুর ওই বয়সের ঝিমুনি বা ঢুলুনিকে উদ্দেশ্য- প্রণোদিত না মনে করে নিজেদের একঘেয়ে জীবনের কটূস্বাদের মধ্যে একটু সহানুভূতির মিষ্টতা পাঞ্চ করে তাঁকে কিছুটা প্রশ্রয় দিয়ে নিজেদের কাঁধ অফার করে অস্বস্তির মধ্যেও খুশি থাকেন । ফলে বসার জায়গা পেতে অসুবিধা হয় না । যেমন অসুবিধা হয়নি গত শুক্রবার  ।কন্ডাক্টর ভাড়া চাইলে সুবলবাবু  বুকপকেট থেকে দুহাজারের একটা নোট দুআঙ্গুলের চিমটিতে ধরে চোখ বুজে  বাড়িয়ে দিতে সেটা সপাটে প্রত্যাখ্যান করে ছোট নোট দিতে বলায় দুহাজারের নোটটা চোখ বুজেই  পকেটে গুঁজে পাশপকেট থেকে দশ টাকার নোটটা  বার করে দিতে হলো  সুবলবাবুকে । তারপর যথারীতি পাশের সামান্য  পৃথুলা মহিলার কাঁধটি সর্বংসহা ভার্যার কাঁধ মনে করে নিজের মাথাটি রেখে ঝিমোতে লাগলেন বা বলা যায় ঘুমোতে লাগলেন । আবার কন্ডাক্টরের বদান্যতায় তড়বড়িয়ে নিজের স্টপে নামার সময় দেখতে পেলেন কাঁধ অফার  করা মহিলা যেন ঠোঁট টিপে হাসলেন । যদিও উনি পাত্তা দিলেন না । সেদিন বাড়িতে  ফিরে ফ্রেশ হবার সময় দুহাজারের নোটটা দেখলেন বুকপকেটে নেই । আগামীকাল মেয়ে নাতিকে নিয়ে আসবে তাই ফেরার আগে অবনীর থেকে নিয়েছিলেন ডেবিট কার্ডটা বাড়িতে ফেলে গিয়েছিলেন বলে ।যতোই ঝিমোন ,কন্ডাক্টরের হাত থেকে নোটটা ফেরত নিয়ে বুকপকেটে রেখেছিলেন আর দশটাকার নোটটা দিয়ে  বাসভাড়া মিটিয়েছিলেন সেটা মনে আছে । খালি বাসে পিকপকেটের প্রশ্ন নেই । তবে? একবার মনে হলো পাশের মহিলা যেন উনি নামার সময় মুচকি হেসেছিলো,তাহলে? নাকি ওর মুখটাই হাসিহাসি ;অযথা সন্দেহ করা ।এখন নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে বাসে বসে ঢোলা রোগের জন্য । যাইহোক,ব্যাপারটা বাড়িতে চেপে গিয়ে সকালে এ টি এম থেকে টাকা তুলে ম্যানেজ করলেন ।
সোমবার অফিস সেরে সন্ধ্যায় আবার মিনিবাসে ঢাকুরিয়ায় নামলেন ।নেমেই শুক্রবারের সেই মহিলাকে একজন লোকের সঙ্গে পানবিড়ির দোকানের সামনে কথা বলতে দেখলেন । মহিলাও  তাঁকে দেখেছেন ।এগিয়ে এসে সুবলবাবুকে আটকালেন “ একটা কথা ছিলো স্যার” । হকচকিয়ে সুবলবাবু বললেন ‘বলুন ?’ মহিলা ততক্ষণে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে একটা দুহাজারের নোট বার করে সুবলবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে ‘আপনার এই টাকাটা নিয়ে যান ।সেদিন আপনি বাসে ঝিমোতে ঝিমোতে এটা নিজের পকেটে না ঢুকিয়ে আমার বগলের খাঁজে রেখে দিয়েছিলেন । আপনি নেমে যাবার পর দেখেছিলাম ।প্রথমে মনে হয়েছিল আমাকে চেনেন আর আমার বুকিং এর টাকাটা ওইভাবে দিয়েছেন ।পরে মনে হলো মোবাইল নম্বর ঠিকানা না দিয়ে কেনই বা  টাকা ছাড়বেন।‘
সুবলবাবু তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন ‘ না না ওসব নয় । বয়েস হয়েছে , বাসের দুলুনিতে ঘুম এসে যায় -–তাই। যাকগে , ওটাকা তুমি রেখে দাও ।আমার চাই না ।‘ যদিও জানেন এই দুহাজার টাকায় দশদিন সংসার টানা যায় ।
‘ কি করে রাখবো স্যার, ধম্মে সইবে না । গতর খাটিয়ে কামিয়েছি কি? আমি লাইনের  ওপারে বস্তিতে থাকি ।সকালে অফিস পাড়ায় একটা ছোটখাট কাজ করি ।মাইনে কম ।তাই ছুটির পর দুএকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে একটু ফুর্তি করি। উপরি রোজগারে সংসারটা তবু গড়িয়ে  চলে।শরীরটাকে একটু খাটাতে হয় এই যা ।কিন্তু এই টাকাটা তো আমার ন্যায্য পাওনা নয় । আপনার ঝপকি এসেছিলো তাই টাকাটা আমার বগলে গুঁজে দিয়েছিলেন । নিন,ধরুন টাকাটা’ বলে সুবলবাবুর হাতে টাকাটা গুঁজে দিয়ে বললে ‘ বয়েস হয়েছে আর কতদিন জোয়াল টানবেন ? বাড়িতে বসে একটু আরাম করুন । কোথায় থাকেন স্যার ? বলেন তো আপনার বাড়িতে ম্যাডামকে একটু বুঝিয়ে দিয়ে আসি’ । ‘ সুবলবাবু চোখ বড় বড়  করে বলে ওঠেন ‘ না না তার দরকার  নেই । ‘ বলেই  হন হন করে বাড়ির দিকে হাঁটা দেন আর বার বার রুমালে ঘাড় মুখ মোছেন । ওঁনার কেবলই মনে হয় এখানে  নিশ্চয় ওঁনার চেনাজানা অনেকেই আছে যারা মেয়েটাকে চেনে ।তারা হয়তো সুবলবাবুকে ওর সঙ্গে কথা বলতে আর টাকা নিতে দেখে ফেলেছে । কি লজ্জা ! 
এখন আর সুবলবাবু  বাসে খালি সীট পেয়েও বসেন না। ভিড় বাসে সহযাত্রীদের সঙ্গে  গায়ে গা লাগিয়ে  রড ধরে দাঁড়িয়ে  দাঁড়িয়েই যতটা পারেন ঝিমোন । ঢুলতে ঢুলতে মাঝে মাঝে জেগে উঠে চোখ বড় বড় করে আশেপাশে  তাকান ।  হ্যান্ডেল থেকে হাত ফস্কালেও  ভিড়ের চাপে ঠিক দাঁড়িয়ে থাকেন ।তবে বাস ভাড়ার খুচরো টাকাই কেবল পকেটে রাখেন , বড় নোট নিয়ে চলাফেরা করেন না ।

0

গল্প - মনোজ কর

Posted in



















 চতুর্থ এবং পঞ্চম পর্ব




 চতুর্থ পর্ব

পানু রায় বড়কালীর অফিসে ঢুকেই দেখলেন ঘর আলো করে সেক্রেটারির টেবিলে বসে আছে এক লম্বা, ফর্সা, নীলচক্ষু, কৃষ্ণকেশী সুন্দরী। বুঝতে অসুবিধে হলনা এই মহিলাই এলিনা রাই, বড়কালীর নতুন সেক্রেটারি। আসবাবপত্রগুলোর অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। টেবিলটা আগে যেদিকে ছিল সেখান থেকে সরিয়ে উল্টোদিকে রাখা হয়েছে। কুচকুচে কালো মেহগিনির প্রেক্ষাপটে এলিনা রাইএর রঙ যেন ফেটে বেরুচ্ছে। পানু রায় বুঝলেন টেবিলের অবস্থান পরিবর্তনের পিছনে অন্য কিছু ভাবনাচিন্তা কাজ করেছে। পানু রায় নিশ্চিত হলেন যখন দেখলেন যে জানালার পর্দার রঙ এমনভাবে নির্বাচন করা হয়েছে যাতে তার থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে ঘরের উজ্জ্বলতা অনেকগুন বেড়ে যায় আর তার সঙ্গে বেড়ে যায় এলিনার সযত্নে প্রসাধন করা মুখের ঔজ্জ্বল্য। পানু রায় দরজা খুলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অফিসের ফোন বেজে উঠলো। এলিনা হাসিমুখে পানু রায়কে স্বাগত জানিয়ে ফোনটা তুলে নিল। ঠোঁটের কাছে ফোনটা নিয়ে কয়েক মিনিট এত আস্তে কথা বলল এলিনা যে এত কাছে বসে থেকেও কিছুই শুনতে পেলেন না পানু রায়। শুধু শুনতে পাওয়া গেল ফোন রাখার সময় এলিনা বলল,’ কৃষ্ণকালী শহরে নেই। আমি দুঃখিত। আমি জানিনা উনি কবে ফিরবেন। আপনি কোনও মেসেজ দিতে চান? ও আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ।‘ফোন রেখে এলিনা পানু রায়ের দিকে তাকাল। পানু রায় বললেন,’ আমার নাম পানু রায়।‘

-আপনিই পানু রায়। আপনার কথা স্যারের কাছে শুনেছি। আপনিই ওনার আইনি পরামর্শদাতা, তাই না?’

-ঠিক বলেছেন।

-আপনার অফিস থেকে আপনার সেক্রেটারি একটু আগে ফোন করেছিলেন। বললেন আমি যেন স্যার ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ওনাকে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি।

-অনেক ধন্যবাদ। আচ্ছা, আপনি কি টেবিলটা সরিয়েছেন? ওটাতো আগে ওখানে ছিল না।

-না আমি সরাইনি।

-কিন্তু মনীষা যখন ছিল তখন ওটা উল্টোদিকে ছিল।

-হ্যাঁ, মনীষা টেবিলটা যেখানে রেখেছিল সেখান থেকে আমি সরিয়েছি। ও টেবিলটা ভুল জায়গায় রেখেছিল। ওখানে আলো ঠিকমত পৌঁছচ্ছিল না।

-মনীষার সঙ্গে আপনার কথা হয়?

-না, সেরকম কথা হয় না। তবে এখানে দু’বার এসেছিল। তার বেশি কিছু নয়।

-ওর নাম আগে মনীষা ঝা ছিল। এখন ওর পদবি কী হয়েছে জানেন?

-ওর সঙ্গে যার বিয়ে হয়েছে তার নাম পরেশ প্রসাদ।

-ঠিক ঠিক। আমার এবার মনে পড়েছে। আচ্ছা এলিনা, কৃষ্ণকালী এখন কোথায়?

-উনি ব্যবসার কাজে বাইরে গেছেন।

-কবে গেছেন?

-উনি গতকাল বিকাল থেকে অফিসে নেই।

পানু রায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এলিনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনও বিশেষ কারণে গেছেন?’

এলিনা বলল,’ না, বিশেষ কিছু নয়। আপনি তো জানেন উনি প্রায়ই ব্যবসার কাজে বাইরে যান। ওনার বিভিন্নরকম ব্যবসা আছে। তাছাড়া নানা শহরে ওনার সম্পত্তিও আছে।

পানু রায় বললেন,’ আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমি ওনাকে ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে আইনি পরামর্শ দিয়ে থাকি।‘

-হ্যাঁ, আমি ওনাকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে শুনেছি।

-আমার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করার খুব দরকার।

-সেটা কি রেবা কৈরালা সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে?

পানু রায় মুখের ভাবে কিছু প্রকাশ না করে জিজ্ঞাসা করলেন,’ কেন? একথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?’

এলিনা বলল,’ দেখুন সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। আমি চাই না এই আলোচনায় কোনও তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ ঘটে। আমরা কি এই অফিস সামনে থাকে বন্ধ করে পিছনের দরজা খুলে স্যারের ব্যক্তিগত কেবিনে গিয়ে আলোচনা করতে পারি? সেখানে কেউ আসতে পারবে না।

পানু রায় বললেন,’ অবশ্যই।‘এলিনা চেয়ার থেকে উঠে লম্বা লম্বা পা ফেলে বাইরে বেরিয়ে অফিস বন্ধ করে পিছনের দিক দিয়ে গিয়ে একটা মস্ত দরজা খুলে একটা সুসজ্জিত বিশাল ঘরে ঢুকল। পিছনে পিছনে পানু রায়ও ঢুকলেন। এলিনা কৃষ্ণকালীর মস্ত মেহগিনি টেবিলের ওপর ভর দিয়ে সামনে ঘুরে পানু রায়ের দিকে সোজা তাকিয়ে এমন ভাবে দাঁড়াল যেন মনে হল কোনও সিনেমার শট দিচ্ছে।

- স্যার কিন্তু ভীষণ রেগে যাবেন যদি শোনেন যে আমি আপনার সঙ্গে রেবা কৈরালার ব্যাপারে কোনও কথা বলেছি। আপনি মানুষের চরিত্র ভালোই বোঝেন এবং আপনাকে নিশ্চয়ই বলে দেবার প্রয়োজন নেই যে রেবা কৈরালা একজন অত্যন্ত স্বার্থপর এবং ধুরন্ধর মহিলা।আপনি নিশ্চয়ই জানেন রেবা কৈরালার সঙ্গে স্যারের ছেলে কালীকৃষ্ণের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। এখন কালীকৃষ্ণের নজর একটি অন্য মেয়ের দিকে পড়েছে এবং রেবা কৈরালা স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমি বুঝতে পারছি না রেবার আসল উদ্দেশ্য কী? তবে রেবা নিজের লাভ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। আমি রেবার ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে চাই না এবং আশা করি আপনিও চান না। কিন্তু একটা কথা আপনাকে বলি, আপনি কিন্তু খতিয়ে না দেখে ওর গল্পে বিশ্বাস করবেন না।

এতটা বলে এলিনা একটু থামল। তারপর বলল,’ স্যার বা কালীকৃষ্ণ যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায় যে আমি আপনাকে এসব কথা বলেছি তাহলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে তাড়িয়ে দেবে। অবশ্য তাহলেও স্যারের প্রতি আমার দায়বদ্ধতার কোনও পরিবর্তন হবে না। এখন আপনি বলুন আপনি আমাদের এই আলোচনার গোপনীয়তা রক্ষা করবেন না স্যারকে এই আলোচনার কথা জানিয়ে দেবেন।

পানু রায় বললেন,’ আপনি আমাকে বিশ্বাস করে কথাগুলো বলেছেন। কথা দিলাম সেই বিশ্বাস অটুট থাকবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন কোনও তৃতীয় ব্যক্তি ঘুণাক্ষরেও একথা জানবে না।‘

এলিনা পানু রায়ের সামনে এগিয়ে এসে বলল,’ অনেক ধন্যবাদ।‘ তারপর নিজের হাতদু’টো পানু রায়ের দিকে বাড়িয়ে দিল। পানু রায় নিজের দু’ হাতের মধ্যে এলিনার হাতদু’টো নিয়ে বললেন,’ আমার বয়স ১০৫। এখন আমি আসি।‘ বিস্মিত এলিনা অবাক হয়ে দেখল শিরদাঁড়া সোজা করে দৃঢ় পদক্ষেপে দরজার ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন পানু রায়।




 পঞ্চম পর্ব

বড়কালীর অফিস থেকে বেরিয়ে পানু রায় সুন্দরীকে ফোন করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন,’ মনীষা ঝা মানে এখন মনীষা প্রসাদের ঠিকানা আছে তোমার কাছে?’ ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে সুন্দরী বলল,’দাদু, ধরে থাক। আমি তোমাকে মনীষার ফোন নম্বর কিংবা ঠিকানা দিচ্ছি।‘

-আমার ঠিকানা চাই।

কিছুক্ষণ পরে সুন্দরী পানু রায়কে মনীষার ঠিকানা জানিয়ে বলল,’ মনীষাকে আমার আদর আর শুভেচ্ছা জানিও।‘

‘অবশ্যই’ বলে পানু রায় হাত দেখিয়ে একটা ট্যাক্সি থামিয়ে মনীষার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। প্রায় আধঘন্টা পরে ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল,’ এসে গেছি।‘ পানু রায় ভাড়া মিটিয়ে বললেন,’ একটু অপেক্ষা কর। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরব।‘

ট্যাক্সি থেকে নেমে বাড়িটার কাছে পৌঁছে বেল বাজাতে যাবেন ঠিক তখনই একগাল হেসে দরজা খুলে দাঁড়াল মনীষা। বলল,’ পানু রায়!!! আপনাকে কতদিন পরে দেখলাম। কি যে আনন্দ হচ্ছে আমার! ভেতরে আসুন।‘পানু রায় ঢুকতে ঢুকতে বললেন,’ তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে, মনীষা।‘ মনীষা হেসে বলল,’ আপনি আগের মতই রসিক আছেন। আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে আর মাত্র দু’ মাস। আমাকে এখন দেখতে হয়েছে হাতির মত। আমি বাড়ির সব কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। বসার ঘরটাও পরিস্কার করা হয় না। অপরিচ্ছন্নতা ক্ষমা করবেন। এই চেয়ারটায় বসুন। কী নেবেন চা না কফি? ‘

-না না, ঠিক আছে। আমি এসেছিলাম কৃষ্ণকালী সম্বন্ধে কিছু খবর জানতে।

-কী সংক্রান্ত খবর?

-আমি জানতে চাই কী করে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে?

-কেন? উনি কি শহরের বাইরে?

-হ্যাঁ, সেটাই তো সমস্যার কারণ।

-আপনি এলিনার সঙ্গে কথা বলেছেন?

-হ্যাঁ, ওর সঙ্গেই প্রথমে যোগাযোগ করেছিলাম।

-কিন্তু যা জানার ছিল তা জানতে পারলেন না, তাই তো?

-না, আসলে কিছুই জানতে পারলাম না।

মনীষা হেসে বলল,’ আমিও দু’বার অফিসে গিয়েছিলাম।এমনি জানতে সব কী রকম চলছে। কোনও উত্তরই পাইনি। তাই আর যাইনা।

-তোমার সঙ্গে কৃষ্ণকালীর দেখা হয়েছিল?

-না, দু’বারের একবারও না। প্রথমবার আমি জানতাম উনি খুব ব্যস্ত ছিলেন কিন্তু দ্বিতীয়বার এলিনা তো স্যারকে জানাতেই চাইলনা যে আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

-কিন্তু কেন? কিছু আন্দাজ করতে পার?

-আমি জানিনা। আমি স্যারের অফিসে কাজ করেছি প্রায় বারো বছর। বারো বছর সময় ওনার ব্যবসা এবং ওনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার পক্ষে যথেষ্ট, তাই না? ওনার স্ত্রীবিয়োগের পর উনি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। উনি যখন আস্তে আস্তে স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে আসছিলেন তখনই আমার বিয়ের ঠিক হয়। কিন্তু ওনার এই অবস্থায় আমি কিছুতেই ওনাকে লম্বা ছুটি নেবার কথা বলতে পারছিলাম না। বিশ্বাস করুন আমি বিয়ে প্রায় তিন মাস পিছিয়ে দিলাম যাতে ওনার ব্যবসার কোনও ক্ষতি না হয়।

-তারপর?

- উনিই কী ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি কিছু একটা ওনাকে বলতে পারছি না। তারপর আমার আঙ্গুলে হীরের আংটি দেখে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে আমার বিয়ে কবে। তারপর কথায় কথায় বুঝতে পারলেন যে আমি ওনার কাছে ব্যাপারটা লুকোতে চাইছি। উনি ভীষণ রাগারাগি করলেন। বললেন এটা আমার করা উচিৎ হয়নি এবং আর দেরি না করে বিয়েটা সেরে ফেলতে। না হলে, উনি আমাকে আর অফিসে আসতে দেবেন না। এমন মানুষ আজকের দিনে সত্যিই পাওয়া যায় না।

-যখন তুমি ওখানে ছিলে তখন রেবা কৈরালার কথা শুনেছিলে?

-না, রেবা কৈরালা পরে এসেছে। আমি যখন ছিলাম তখন কালীকৃষ্ণের প্রেম চলছিল এলিনা রাইএর সঙ্গে। কিন্তু সম্পর্কটা আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছিল বলে শুনছিলাম। ঘন ঘন সুন্দরী মেয়েদের প্রেমে পড়া কালীকৃষ্ণের স্বভাব। পরে শুনলাম রেবা কৈরালা বলে এক সুন্দরীর আগমণ ঘটেছে কালীকৃষ্ণের জীবনে। তাই এই ভাঙন এলিনার সঙ্গে ভালোবাসার। কালীকৃষ্ণের অনুরোধে স্যার এলিনাকে চাকরিতে বহাল করেন। অফিসের শোভা বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনও কাজে আসেনি এলিনা। নীতিজ্ঞানহীন এবং নাকউঁচু এক মহিলা। টাইপ করা ছাড়া আর কিছু ওর আসেনা। সারাদিন টিভি আর ভিডিওতে সুন্দরী সেক্রেটারিরা কীরকম পোষাক পরে, কীরকম সাজগোজ করে সেইসব দেখে দেখে সময় কাটায়।

-তাহলে, কৃষ্ণকালীর ব্যবসা কী করে সামলাচ্ছে এলিনা?

-আমিওতো সেটাই জানতে চাই।

-আমার মনে হয় কৃষ্ণকালী কাঠমান্ডুতে আছে। কাঠমান্ডুতে গেলে সাধারণত কোথায় থাকে কৃষ্ণকালী?

মনীষা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল,’ সাভেরা মোটেলে থাকার সম্ভাবনা নব্বই শতাংশ। ওটা অপেক্ষাকৃত নতুন কিন্তু খুব ভালো বলে শুনেছি। আমি বারদুয়েক বুকিং করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এলিনা অবশ্যই জানবে স্যার কোথায় উঠেছেন।

-এলিনা বলল ও কিছু জানেনা।

মনীষা ঘাড় নেড়ে বলল,’ হতেই পারেনা। স্যার বাইরে থাকলেও সবসময়ে অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। এমনকি যখন উনি কাউকে না জানিয়ে কোথাও যেতেন তখনও কিন্তু আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। আমাকে জানিয়ে রাখতেন প্রয়োজনে কোথায় ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।‘

-কিন্তু এলিনা বলল এই ব্যাপারে ও সম্পূর্ণ অন্ধকারে। অবশ্য সত্যি কথা নাও বলতে পারে। হয়ত ইচ্ছে করেই জানাল না।

-মিথ্যে বলছে বলেই আমার মনে হয়, মিঃ রায়।আমি আপনাকে এতটুকু প্রভাবিত করতে চাইনা। আপনি নিশ্চয়ই বোঝেন বিয়ের পর একটা মেয়ের অনেক পরিবর্তন হয়। বাড়িতে অনেক বেশি সময় দেবার দরকার হয়। সম্পূর্ণ নিজের সংসার। সব দায়িত্ব নিজের। তবুও ওই অবস্থায় স্যারকে একেবারে ছেড়ে যাবার কথা ভাবিনি। আমি স্যারকে বলেছিলাম সময় করে মাঝেমধ্যে এসে আমি এলিনাকে আস্তে আস্তে সব বুঝিয়ে দেব যাতে কোনও অসুবিধে না হয়। কিন্তু এলিনা কোনও আগ্রহ দেখাল না। আমি চলে এলাম। ভাবলাম কিছু দরকার হলে নিশ্চয়ই ফোন করবে।তার পরেও ফোন এলনা দেখে একদিন ওই অঞ্চলে কিছু কেনাকাটা সেরে ভাবলাম হাতে যখন একটু সময় আছে অফিসে গিয়ে স্যারের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি, অনেকদিন দেখা হয়নি। স্যারের যদি কোনও সাহায্যের দরকার হয় জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারি। কিন্তু এলিনা আমার সঙ্গে বাইরের লোকের মতই ব্যবহার করল। বলল স্যারের সঙ্গে দেখা হবে না। উনি নাকি জরুরী মিটিংএ আছেন। ফিরে এলাম। প্রায় দু’মাস পরে আবার একদিন কী মনে হল অফিসে গেলাম। সেদিন এলিনা আমার সঙ্গে একটু বেশি ভদ্রতাই করল। প্রায় দশ পনের মিনিট বসে রইলাম। এলিনার সঙ্গে টুকটাক কথা চালাচ্ছিলাম। ও কিন্তু স্যারকে জানালই না যে আমি দেখা করতে এসেছি। আমি আর এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাইলাম না।ফিরে এলাম। ভাবলাম যদি দরকার হয় স্যার নিশ্চয়ই আমাকে ফোন করবেন।

-ফোন এসেছিল?

মনীষা রাগে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,’ আমি নিশ্চিত যে আমি চলে আসার পর অন্তত একশ’ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে ওরা যেখানে আমার সাহায্য দরকার ছিল।আমি বুঝতে পারি ঐ নাটুকে, ন্যাকা এলিনা কেন আমাকে ফোন করেনি কিন্তু আমি সত্যিই বুঝতে পারিনা কেন স্যার আমাকে ফোন করলেন না? যে খবরটা আমার দিতে এক সেকেন্ডও লাগবে না সেই খবর এলিনা ফাইল ঘেঁটে খুঁজেই পাবে না, খবর দেওয়া তো দূরের কথা। কোথায় কোন ফাইল আছে তাই ও ভালো করে জানেনা।

- তুমি কৃষ্ণকালীকে তারপর কখনও ফোন করনি?

-না। আমি ভেবেছিলাম দরকার হলে স্যার আমাকে ফোন করবেন। আমি চাইনি ঐ মেয়েটা তৃতীয়বারের জন্য আমাকে হেনস্তা করুক।

-বেশ, আজ তাহলে আমি আসি। তুমি মাঝেমধ্যে ফোন কোরো। আবার সব স্বাভাবিক হয়ে গেলে আমাদের অফিসে এসো। আমি এবং সুন্দরী খুব খুশি হবো তুমি এলে।ভালো থেকো।আশা করি সবকিছু ভালোয় ভালোয় মিটে যাবে।

-নিশ্চয়ই আসবো। খুব ভালো লাগলো আপনার সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হয়ে।খুব ভালো থাকবেন।

মনীষা দরজায় দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না পানু রায় অপেক্ষারত ট্যাক্সিতে উঠে অফিসের দিকে রওনা দিলেন।
0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in



















।। ১ ।।

কোজাগরী জোৎস্না।মাথার উপর থালার মতো চাঁদ। রুপোলি আলোর প্লাবনে হাবুডুবু খাচ্ছে সারা গ্রাম।গাছগাছালি,ঘর-বাড়ি,মাঠ-ঘাট জ্যোৎস্নায় বিভোর। খিলখিল করছে সর্বত্র।তার আভায় পাড়ার খেলার মাঠও এখন টইটুম্বুর।বউ-ঝি,ছেলে-পুলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সেখানে।গোটা মাঠ এখন কয়েকটা ভাগে সীমানা তৈরি করেছে।

এই কোণে বউ-ঝিরা।

বউ-বসান্তি খেলছে। ঐ তো, একটা মেয়ে

কিৎকিৎ কিৎকিৎ করে, বউয়ের মাথা ছুঁয়ে, দৌড়ে তাড়া করছে অপর পক্ষের মেয়েটাকে।সেও আঁক-কেটে, বাঁক-কেটে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।তার দলের অন্যরা তখন বউকে মুনে আছে,যাতে উঠে পালাতে না পারে!

মাঠের মাঝে ছেলে-পুলের দল।

কাবাডি খেলছে। অন্যের কোর্টে ঢুকে একজন লাফাচ্ছে আর কাউকে ছুঁয়ে পালিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে

-কাবাডি,কাবাডি…

-ভোলা, মেরেই আসবি। দম ফেলবি না। যাহ, মেরে এলেই আমার শালী তোর… মার ভোলা। মেরে আয়য়য়য়…

উত্তর দিকটায় মাঝবয়সীরা গল্প-গুজবে মশগুল।কারো কারো হাতে বিড়ির আগুন জ্বলজ্বল করছে। চাঁদের আলোয় তাদেরই একটা দল আবার তাস খেলছে।

রাস্তার কোলটা বয়স্কদের।ইটের রাস্তায় বসে, পা ঝুলিয়ে আছেন মাঠে।একথায় সেকথায় তাঁরাও চন্দ্রতাপে বার্ধক্যকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এমন ফেলে আসা কোজাগরী রাতে।

এ গ্রামের বাড়ি বাড়ি লক্ষ্মীপুজো। বলতে গেলে প্রায় সবাই রাত জাগে। ভরা জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে, হুল্লোড়ে, গল্প করে কাটিয়ে দেয়। এটুকুতে সবার ছাড়।কেউ কাউকে বকেও না।এ রাতটার জন্য সমবচ্ছর অপেক্ষা করে তারা।

সন্ধ্যা থেকেই হরিনামের দল, বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে বেড়ায়। দু'পাড়ার দুটো দল।যেমন পুরোহিত নিয়ে কাড়াকাড়ি,তেমনি ঐ গানের দলের। পুরোহিত না পেলে নিজেরাই সেরে নেয়,কিন্তু হরিনামের দল লাগবেই।বলতে গেলে তারা সারারাত গান গেয়ে, সব বাড়ি তাই শেষ করে উঠতে পারে না। কার বাড়ি আগে যাবে? সেই নিয়ে রাগারাগি। তবুও পুজোর উপাচার নিয়ে অপেক্ষা করে। কি করবে? হরিনামের দল ছাড়া যে পুজো সম্পূর্ণ হয় না।অগত্যায়,অপেক্ষা করতে করতে কারো চোখ ঢুলুঢুলু। 'পুজো দেখব', 'পুজো দেখব' করে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ে শেষে। তবে সারারাত খোল-করতালের আওয়াজের সঙ্গে তাদের সমবেত ক্লান্ত গানও বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়ায়।

রাস্তায় লোকজনেরও কমতি থাকে না। এপাড়া ওপাড়া থেকে কচিকাঁচা তো আছেই, সঙ্গে বউ-ঝি-বুড়িরা। প্রসাদ, নাড়ু তো তারা নিচ্ছেই, সঙ্গে কোনো কোনো বাড়ি থেকে বিলিয়ে দেওয়া বাতাসা-খই-মুড়ি। কারো কোঁচড়ে, কারো বা পুটলিতে।

পীযুষদের বাড়ির পুজো-বাতাসা-খই-মুড়ি বিলিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। লুচি, ছোলার ডাল খেয়ে এসে সে সবেমাত্র মাঠে পা দিচ্ছিল।

অম্লান দৌড়ে এল তার কাছে। হাঁপাচ্ছে।

-ও-দা, যা-যাবে না?

-কোথায় রে?

-সে-সেই, ব-বলেছিলে না !

-অহ! কিন্তু এখন তো অনেক রাত !

-তাতে কি হয়েছে? দিনের আলোর মতো তো দেখা যাচ্ছে সব। চলো…

-হ্যাঁরে, পটকা নেই এখানে? ওকেও নয় ডেকে নে?

-দুর, চলো তো।আর কাউকে জোড়াতে হবে না।

আজ লক্ষ্মীপূজোর বাজার করে ফেরার সময় পীযুষ দেখেছিল ব্যাপারটা। সাইকেল থেকে নেমে মাঠের দিকে তাকিয়ে ছিল অপলকে।

-এ মাঠে শালতি নৌকা? তেলেডোঙা ছাড়া এ বস্তু তো দেখা যায় না! এল কোথা থেকে? মাঠের টলটলে জলে শালতিটা তরতর করে চলছে।

-আরে, ওঠা কে? বারুণকা' না?

ধজি জলের ভেতরে চেপে ধরে নৌকার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় হেঁটে যাচ্ছে।আবার তুলে নিয়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।

তখনই মনটা নেচে ওঠে...

-আজ রাতে যদি ঐ নৌকায় চড়ে সারা মাঠটা ঘোরা যায়? ওহ ,কি যে আনন্দ

হবে! জোৎস্না রাত।ফুরফুরে হাওয়া।জলের ঝিকমিকি !

ওহ,আর সে ভাবতে পারছে না।

-নাহ, আজ রাতে আসতেই হবে। যার নৌকা হোক, আমি চাইলে বরুণকা না করবে না।

পথে অম্লানের সঙ্গে দেখা।তাকেই একথা সে বলেছিল।

-ও দা, নৌকা দেবে তো?

-চল না দেখি।আমি চাইলে হয়তো না করবে না। কিন্তু…

-কিন্তু কি?

-ভরা পূর্ণিমা।তায় আবার এত রাত।

-কার নৌকা জানো?

-না। তবে শুনলাম নাকি রাতে পাহারা দেবার জন্য ওটা ভাড়া করেছে।মাঠে নাকি কারা বেশ কিছুদিন জাল পাতছে। মাছ চুরি হচ্ছে খুব। তাই কাল থেকে রাতে পাহারা দেওয়া শুরু করেছে।

-কারা ভাড়া করেছে?

-আরে, ঐ, স্বর্নজয়ন্তী স্ব-রোজগার যোজনার যে গ্রূপ আছে না,তারাই।ওরাই তো মাছ চাষ করেছে।

কথা বলতে বলতে তারা এখন এপাড়ায়। বরুণদের উঠোনে।

-এরা তো ঘুমিয়ে পড়েছে!

-হ্যাঁ।তাই তো।চল… ফিরে যাই।

-একবার নয় ডেকেই দেখো না? যদি…

-বলছিস। কিন্তু… দাঁড়া, একবার ডেকেই দেখি।…কাকা। ও… কা… কোমর সমান মাটির বারান্দা।একটা বিছানা পাতা রয়েছে। মশারিও খাঁটানো।

ভেতরে কেউ একজন শুয়ে আছে মনে হয়।

পীযুষ হতাশ হয়ে পড়ল।

-নারে, সাড়া দিল না।

-আর একবার ডাকোই না।

আশাভঙ্গের ভয়ে পীযুষ অম্লানের কথা রাখল।

-কাকা, ও কাকা… জেগে আছো? কাকা…

মশারির ভেতর থেকে বিরক্তিকর গলা ভেসে এল

-কে পলাশ? আরে, একটু শুতে দে। ক'টা বাজে? এক্ষনি ডাকছিস?

-সবেমাত্র চোখটা জুড়ে এসেছে।এসে হাজির হলি।

ইতস্তত করছে পীযুষ। আমতা আমতা করে উঠল।

-কা-কাকা আ-আমি। পীযুষ।

এবার মশারির বাইরে মুন্ডুটা বেরিয়ে এল।

-এত রাতে? তোমার তো সেই সন্ধেয় আসার…

-না… মানে… আসলে…

-তোমার কাকীমা তো তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিল, যদি আসো। এই তো কিছুক্ষণ আগেই শুয়ে পড়ল।দাঁড়াও।ডাকি?

-না, না। আসলে আমি… নৌকা চড়ব বলে… একটু দেবে?

-দেখো কান্ড!

-দাও না, কাকা… কি বলবে পীযুষকে? মেয়েটা তার কাছে পড়ে। পাড়ার আর পাঁচটা ছেলের মতো নয় সে। বেশ মেধাবী। কলেজে পড়ছে। নিজের খরচা নিজেই চালায় টিউশন করে। বাজে নেশাও নেই।গ্রামে একটা সুনাম আছে তার।ব্যবহারও ভালো। অনেকেই তাকে স্নেহ করে। বরুণও তাদের মধ্যে একজন। নিজের পাড়ার ছেলেরা বলেছিল

-আজ রাতে নৌকাটা দিও। একটু ঘুরব।

কিন্তু তাদের ভাব-গতিক ভালো ঠেকেনি বরুণের।মাল-খেয়ে কোথায় আবার বিপদ বাধিয়ে বসবে… তাই তাদের না করে দিয়েছে। কিন্তু পীযুষ তো তাদের থেকে আলাদা। কি যে বলবে? ভাবছে।

-ও কাকা,কি হল? দাও না…

-ঠিক আছে। এই দেখো, চাবিটা আবার কোথায় রাখলুম?

টর্চ জ্বেলে বিছানা হাতড়াচ্ছে।

-কিন্তু আমাদের তো আবার একটু পরেই বেরতে হবে… আচ্ছা… সে নয় দেখব'খন।

চাবিটা নাও। কিন্তু মাঠের মাঝখানে যাবে না। বড় বড় পুকুর। বেশ গভীর। আর ঐ পোতাগুলো ভালো নয়। দূরে থেকো। আর সাবধান, ঘোর পূর্ণিমা কিন্তু। সঙ্গে আমি নয় যেতুম। কে আছে আর? সবেমাত্র শুয়েছি। চোখ জ্বালা জ্বালা করছে। একটু না ঘুমলে…

-আমি আর অম্লান। ঠিক আছে,

মনে থাকবে।

চাবিটা হাতে নিল পীযূষ। আহ্লাদে তাদের পা যেন মাটিতে পড়ছে না। এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে।

দুটো বাড়ির পরেই মাঠ। শালতিটা শিকল দিয়ে রাস্তার গাছের সঙ্গে বাঁধা। তালা লাগানো।

অম্লান আগেই উঠে গেছে। পীযুষ তালা খুলে শিকল ছুঁড়ে দিল নৌকায়। দু-হাতে নৌকা ঠেলে লাফিয়ে পড়ল তার খোলে।


।। ২ ।।

তিনটে গ্রাম। তাদেরকে জুড়ে আছে তিনটে রাস্তা। রাস্তা জুড়ে গাছ আর গাছ। আর তাদের মাঝে কয়েকশ বিঘে জমি ঘিরে এই বিশাল মাঠ। মাঠে কয়েকটা পুকুর। সুতিখাল। সবটা জুড়েই ফিসারি।

পঞ্চায়েতের সহযোগিতা আছে বলে মালিকদের সঙ্গে কোনো-প্রকার আলোচনা ছাড়াই এই মাছচাষ। ইনকাম হলে নাকি রাস্তার কাজে লাগাবে। তাই কাউকে একটা পয়সাও দেয়নি। বর্ষায় অনেকেই জাল পেতে মাছ ধরত। সেটাও বন্ধ। তা নিয়ে অনেকের ক্ষোভ। সকলের সন্দেহ লাভের টাকা নাকি ওরাই মেরে দেবে। তাই লোক চুরিচামারী করে, জাল পাতে।

মাঠের কোথাও এক-মানুষ জল। কোথাও বেশি। দু-এক জায়গায় শোলা-চাষ। ধানগাছ নেই বললে চলে। বর্ষায় সব হেজে গেছে। কোথাও কোথাও ঘাস আর ঘাস। বাদ বাকিটায় কেউ যেন রুপো গলিয়ে ঢেলে দিয়েছে। তবে সারা মাঠের বুকে দুটো উঁচু পোতা, তাল-খেজুর-বাবলাকে বুকে নিয়ে দ্বীপের মতো জেগে আছে তারা।

আলতো আলতো বাতাস বইছে। তিরতির করে ঢেউ উঠছে। তাদের নৌকা চলেছে তরতরিয়ে। আকাশ-গঙ্গায় যেন দুই অচিন নাবিক পরিক্রমায় বেরিয়েছে। এ জলরাশি, নদীর মতো দরাজ বুকে তাদের যেন কাছে টেনে নিয়েছে। নৌকার এক মাথায় বসে আছে পীযূষ। যেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র তার স্বর্গরাজ্যে বিরাজ করছেন। নীরবতায় অবিমিশ্র জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে তার শরীর। অম্লান ধজি চেপে এক প্রান্ত থেকে হাঁটতে হাঁটতে তার কাছে আসছে। প্রত্যেকবার এসে যেন সে প্রণাম ঠুকে যাচ্ছে।

-কিরে অম্লান, কেমন লাগছে বললি না তো?

একটু হাঁপিয়ে গেছে সে। তার প্রাণের মাঝে আনন্দের স্রোত বইছে হু হু করে।

-কি বলব দাদা? পারলে যেন সাঁতার দেই। কি যে ভালো লাগছে! রাতে বাড়ি ফিরব না। ও… বরুণকা যা বলে বলুক। সেই সকালে…

-দূর পাগল। রাতে হিম পড়বে।ঠান্ডা লেগে যাবে।

-ও লাগুক গে।

-লাগুক গে? তারপর তোর বাবা-মা যদি জানতে পারে যে সঙ্গে আমি ছিলাম।আমাকে ছাড়বে?

-ওসব আমি জানি না।

আজ অম্লানকে দেখে পীযুষের খুব ভালো লাগছে।

এই তো ক'দিন আগেই পীযুষই তাকে সবার সামনে মেরেছিল। আর মারবেই না কেন?

তার লেখা চিঠিটা পড়বে তো পড়বে একেবারে সুরমার বাবার হাতে। মেয়েকে প্রেমপত্র? মেনে নিতে পারে? সোজা চলে এসেছিল পীযুষের পড়ানোর জায়গায়। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল

পীযুষের। তার আস্কারাতেই অম্লান নাকি এমন করেছে। এখানে সে নাকি গুপ্ত-বৃন্দাবন তৈরি করেছে! পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখানে নাকি এসব শেখানো হয়!

সারা গ্রামে কেউ কোনোদিনই তার দিকে আঙ্গুল তুলতে পারেনি। নিজে অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে এতদূর পর্যন্ত এগিয়েছে।তাও আবার টিউশনি করে। ঠিকমতো মাইনেও দেয় না অনেকেই। তবুও সে কোনোদিন তার দায়িত্ব থেকে সরে আসেনি। অথচ এই লোকটা একঘর ছেলেমেয়ের সামনে তাকে এত বড়ো একটা অপবাদ দিচ্ছে? অপমান করছে?

ডাকিয়ে এনেছিল অম্লানের বাবা-মাকে। তাদের ছেলে এমন করতে পারে সে কথা তারা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না।কিন্তু সুরমার বাবা তোড়পে যাচ্ছে সমানে।

অম্লানও কিছুতেই স্বীকার করতে চাইছে না।

প্রথম থেকেই না না করছে। কিন্তু সুরমা? বাবার ভয়ে আর চুপ করে থাকতে পারেনি। সবার সামনে বলেই ফেলল

-হ্যাঁ, ও আমাকে চিঠি দিয়েছিল।

অম্লান মরিয়া হয়ে ওঠে

-এ-এই মি-মিথ্যে কথা একদম বলবি না।

সুরমার পাশেই ছিল পুটু। সে ফুঁসে উঠল।

-মিথ্যে কথা না? ঠিক আছে,এসব বাদ দে। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে তুই ওর গায়ে হাত দেসনি? কিরে বল, এটাও মিথ্যে?

মাথা আর ঠিক রাখতে পারল না পীযুষ। ঠাস ঠাস করে চড়িয়ে দিল অম্লানকে।

-এসব শেখাই এখানে? কিরে? বল? তোর জন্য আমি অপমানিত হব? এতজনের সামনে আমাকে… ছিঃ ছিঃ…

কাল থেকে আর তুই পড়তে আসবি না। বের হ। দূর হয়ে যা…

অম্লানের চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। মুখে কোনো কথা নেই। মাথা নিচু করে গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অম্লানের মা কেঁদে উঠল।

-আর কত জ্বালাবি? তোর জন্য কারো কাছে কি মুখ দেখাতে পারব না? মর না, মর। মরলে তো আমাদের হাড়ে একটু বাতাস লাগে।

-ওহ, তুমি আর গোল পাকিও না। থামো দেখি।

বলতে বলতে অম্লানের বাবা,এগিয়ে গেল সুরমার বাবার কাছে। তার হাত দুটো ধরে বলল

-দাদা, ছেলে মানুষের কাজ। মাপ করে দিও। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি, ও আর এমন করবে না। সব ভুলে যাও, দাদা। পাঁচ-কান হলে আরো খারাপ হবে… সুরমা, মা রে, মন খারাপ করিস না।পীযুষ, এখন আসি বাবা, পরে কথা বলব।

সপ্তাখানেক পরে অম্লানের বাবা-মা পীযুষের হাতে ধরে বলেছিল

-বাবা, ওকে একবার ক্ষমা করে দিতে পারো না? স্কুলেও যাচ্ছে না। ঘর বন্ধ করে থাকে। ঠিক মতো খায় না। তুমি একবার আমাদের বাড়িতে যদি যেতে....

-ঠিক আছে কাকিমা, আমি যাবো। এতজনের মাঝে ওকে মেরেছি তো, তাই হয়তো ও খুব কষ্ট পেয়েছে।

অম্লান আবার স্কুলে যেতে শুরু করে। পীযুষ তার সেই দগ্ধ ঘায়ে অল্প অল্প করে প্রলেপ লাগিয়ে দিতে থাকল। সেও পীযুষের আরো কাছের হয়ে উঠল।

এখন দেখলে তা আর মনে হবে না যে, সে ক'দিন আগেই এমন একটা কাজ করেছিল।


।। ৩ ।।

জামা স্যাঁতস্যাঁত করছে। চুল ভিজে ভিজে ভাব। হিম ঝরছে। জোলো হাওয়া বইছে ফুরফুর করে। পীযুষের শীত শীত করছে।

-অম্লান, এবার চল ফিরি। ওরা তো আবার পাহারা দিতে বের হবে। চল।

-আর একটু থাকি না দাদা?

-না, চল অনেকক্ষণ হয়ে গেল। এবার তুই বস। তখন থেকে তো বাইছিস। আমি চালাই।

-তুমি চালাবে? পারবে?

-ধজিটা তো দে.....

-হ্যাঁ হ্যাঁ, নাও। সোজা ঐ পোতায় নিয়ে গিয়ে তোলো। তারপর সেই পুস্কর গুনীনের মতো ভুতে আমাদের আটকে রাখুক সারারাত।

-মন্দ হবে না। কি বলিস?

অন্য গ্রাম ঘেঁষেই চলছিল তারা। পুকুর পাড়ের মাচা মাঠের উপর ঝুলছে, জল ছুঁই ছুঁই ভাব। অম্লান কিছু একটা ধরে টান দিল।

-আরে কি ছিঁড়ছিস? চারদিকে জল। মাচায় কি কোথায় উঠে থাকবে কে জানে?

-ওহ, কত বড় শসা! খাবে?

-না, চল। লোকে খারাপ বলবে।এমন করে?

-তথাস্তু বৎস।

-পাকামি করছিস। ওদিকে বরুণকা'রা হয়তো অপেক্ষা করছে। হ্যাঁ রে সোজা যাব?

অম্লানের মতের অপেক্ষা না করে সোজা বাইতে শুরু করল। পীযুষের অপটু হাতে শালতি এঁকে বেঁকে চলছে। চাইছে সোজা নিয়ে যেতে, কিন্তু বেঁকে যাচ্ছে অন্যদিকে।

অম্লান নৌকার মাথায় ছোট্ট বেদির মতো চৌকোয়, উল্টোমুখ করে বসে, পা ঝুলিয়ে দিয়েছে জলের উপর। পীযুষ নাজেহাল হচ্ছে। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। সে আছে নিজের ঘোরে।

অনেকখানি এগিয়ে এসেছে তারা। মাঝমাঠ। পীযুষ অনন্তর পোতা এড়িয়ে যেতে চাইছে, কিন্তু নৌকা যেন সেই দিকেই ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। ভয় করছে তার। পোতার লম্বা লম্বা তালগাছগুলো যেন কোন মায়াবলে তাকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এখন আর শীত শীত করছে না। পোতার একদম কাছেই এসে পড়েছে।

ধজিটা জোরে চাপল পীযুষ।

-একি! থৈ পেল না কেন? পুকুরে পড়লাম নাতো ?

টান পড়ল ধজিতে। টানার চেষ্টা করছে সে।

-জালে আটকায়নি তো? বোধহয় পুকুরের মুখেই জাল পেতেছিল। একি! ধজিটা নৌকার তলায় ঢুকে যাচ্ছে যে!

প্রাণপনে টানছে সে। জোরে টানতে গিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ছে।

-অ-অম্লান, আ-আমরা মনে হয় পুকুরে পড়েছি। ধজিটা জালে আটকেছে মনে

হচ্ছে! কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না।

পোতার কাছে বড়ো পুকুরের উপর তারা ভাসছে। নৌকা দুলতে দুলতে শ্লথ গতিতে এগোচ্ছে পুকুরের ভেতরে। পীযুষ ঝুঁকে পড়ে ধজিটা টানার চেষ্টা করছে সমানে।

-কই রে? দেখ…

অম্লান এগিয়ে এল পীযুষের কাছ। ধাক্কা মারল সজোরে। ঝপাস করে জলে পড়ল পীযুষ। কেঁপে উঠল পুকুরের জল।

-সবার সামনে আর মারবি আমাকে? বল? সুরমার সামনে তুই চড় মেরেছিলি?

পীযুষ ভুস করে ঠেলে উঠল জলের উপর। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতরাচ্ছে। নাকে-মুখে জল ঢুকছে।

-এ-এ-এটা কি ক-ক-করলি তু-ই?

সাঁতরে কাছে আসছে সে। অম্লান রাগে ফুঁসছে। হাতে শিকলটা তুলে নিয়ে পাক দিচ্ছে শূন্যে।

তার মূর্তি দেখে পীযুষ শিউরে উঠছে। সাঁতার ভুলে যাচ্ছে সে। তার উপর এই গভীর পুকুর, পোতা, সঙ্গে ভরা পূর্ণিমা-রাত তার শরীরকে অবশ করে দিচ্ছে।

নৌকার কাছে এল পীযুষ। লোহার শিকলটা সপাট করে আড়ছে পড়ল তার মাথায়।

-আ-আ-আ…

ডুবে গেল পীযুষ।

-তোর জন্য স্কুলে সবাই টিটকারী করেছিল। সেই থেকে স্কুলে ঢুকতে পারিনা। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বেড়াই। পাড়ার লোকও আমার দিকে কেমন করে তাকায়। সব, সব তোর জন্য। মর তুই মর…

-অম্লা…

লোহার শিকলের আঘাতে মাথা ঘুরছে পীযূষের। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। তীব্র যন্ত্রণায় মাথাটা যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে। হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে। অন্ধকারে সে তলিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছে…

অম্লানের খিলখিল হাসি ছড়িয়ে পড়ল জোলো মাঠে।

শূন্যে ঘোরানো শিকল আসতে আসতে গতি হারিয়ে নেমে এল তার কাছে। দরদর করে ঘামছে সে।

অপেক্ষা করছে জলের দিকে তাকিয়ে।

নৌকা এখন পুকুরের মাঝখানে ভেসে আছে স্থির হয়ে।

জলের তোলপাড় ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।

অম্লান জেগে বসে রইল সেখানে।
0

গল্প - রূপশ্রী ঘোষ

Posted in



















মনে হয় একটা দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে। কী হবে কেউ জানে না। সবাই ভাবছে কিনা তাও জানে না সৃজনী। কিন্ত তার নিজের মনে হচ্ছে কিছু একটা দুর্দিন ঘনিয়ে আছে। দূরে একটা ট্রেন, তাও যেন কেমন মন খারাপ করে একা হেঁটে যাচ্ছে, দৌড়চ্ছে না। ঢিমে তাল। দুর্দিনটা কীভাবে আসবে এটা নিয়েও ভাবে সৃজনী। ভূমিকম্প রূপে, প্রলয় রূপে, তীব্র ঝড় ঝঞ্ঝা হয়ে? নাকি অন্যকিছু? কিছুই ভেবে উঠতে পারে না সে, কিন্তু একটা দুর্দিন যে আসবে সেটা সে বোঝে। কারণ আর তাদের বাড়ির উত্তর পুর্ব কোণের ছাদে বসে একটা কাক এক নাগাড়ে ডেকে চলেছে। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে ওটা নাকি খুব খারাপ ব্যাপার! জ্যোতিষ না বললেও, সৃজনীর মনে মনে যেন কিছু একটার আভাস পাচ্ছে। আজ ভোরে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে দেখল একটা শকুন মনমরা হয়ে দূরের একটা বাড়ির ছাদ থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কোথাও কোনো খাবার মেলেনি হয়তো। দুদিন আগেও দেখল সুইমিং পুলের জলে ভোরের চাঁদটা খুব কাঁপছিল। কেন কাঁপছিল সৃজনী জানে না। এই নয় যে, বাইরে খুব জোরে বাতাস বইছিল। বাতাসও কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ঝড়ের পূর্বে বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায়, এটা সি স্তব্ধতা কী কে জানে। সবই কেমন যেন একটা ভাসা ভাসা, অনিশ্চিত ব্যাপার। তবুও একটা দুর্দিন যে ঘনিয়ে আসছে সেটা সে খুবই বুঝতে পারছে। দিনদিন রোদ খুব চড়া হচ্ছে। বারান্দার গাছগুলোয় নিয়মিত জল দিয়েও বাঁচানো যাচ্ছে না। কাগজফুল, অর্কিড আর দু একটা নাম না জানা ফুল তার টবে আছে। সে খুব বেশি গাছ চাষও করেনি, আর গাছেদের নামও বিশেষ জানে না। এরমধ্যে স্নেক প্ল্যান্টটা পুরোই মরে গেল। গোড়া উপড়ে ফেলে দিতে হয়েছে গাছটা টব থেকে। আর একটা পাতাবাহার, রোজই প্রায় পাতা ত্যাগ করে খোলস ত্যাগের মতো। দুদিন ছাড়াই দেখা যায় গাছটার গোড়ার দিক থেকে একটা করে পাতা ব্রাউন হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে, অভিমানে না লজ্জায় বোঝা মুশকিল মাথা নত করেই থাকে। গোড়া থেকে সেই পাতাটা তুলে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় সৃজনী। জানলার ধারে দাঁড়িয়েও সে দেখে দূরের ঘাস, শহরের গাছ, অন্যান্য বাড়ির ছাদের ফুল সব কেমন শুকিয়ে যেন একটা জেহাদ ঘোষণা করছে। কিসের জেহাদ কে জানে। যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত সৃজনী ওই একই জিনিস দেখতে পায়। সবাই যেন প্রতিবাদ করতে করতে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে টাইপের অবস্থা। তবুও কোথাও কি খুশির খবর নেই? আছে তো। আজ মৌমিতা দৌড়ে এসে বলল, সে টিমের ওনার। সে একটা টিম কিনেছে। তাদের কমপ্লেক্সে। হ্যাঁ, একেবারেই আই পি এলের মতো ব্যাপার আর কী। একেবারেই খেলা খেলা ব্যাপার। কারণ খেলোয়াড়রা টাকা পায় না। কিন্তু সব নিয়ম কানুনই হয় ওই আই পি এলের নিয়ম মেনে। এখানেও অকশন বিড হয়, টিম ওনার থাকেন, খেলোয়াড় কেনা হয়, টাকা না পেলেও। একটা মিছিমিছি দাম হাঁকা টাইপের, কিন্তু টিম ওনাররা নাকি টাকা পায় শোনা গেছে। পিচ তৈরি করে, রাতে মাঠে আলো-টালো দিয়েই খেলা হয়। একেবারে ইলাহি ব্যাপার। মৌমিতা দৌড়ে এসে সৃজনীকে বলল,

হাই! হ্যালো! কেমন আছো? গুডমর্নিং

গুডমর্নিং, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো বলো?

ভালো আছি। জানোতো আমি একটা টিম ওনার। কিন্তু সবাই কেমন আমার পিছনে লাগছে। বলছে আমার টিম নাকি হারবে।

ও তাই নাকি? তুমি টিম ওনার? দারুণ ব্যাপার তো। না না জিতবে তোমার টিম চিন্তা কোরো না

সৃজনী মৌমিতার আহ্লাদি আহ্লাদি গলা থামিয়ে দিয়ে তাকে জেতার আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে গেছিল। সৃজনীর মনে হল, মৌমিতা নিজেকে কেমন যে নীতা আম্বানি নীতা আম্বানী ভাবতে শুরু করেছে। খুশিতে টগবগ করছে। খুব এন্থুজিয়াসটিক মহিলা, তাকে দেখলেই বোঝা যায়। কোনো একটা ছুতো নাতা পেলেই সে হইহই করতে ভালোবাসে। খুব মজা করে, ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে এনজয় করে সব ব্যাপার। সৃজনীর দেখে মনে হয়, বাঃ এই তো বেশ ভালো ব্যাপার। কোথাও তো খুশি বেঁচে আছে। তার চারপাশের মানুষজন কেমন আনন্দে আছে। এসব দেখতেও বেশ ভালো লাগে। তবুও তার মধ্যেই তার মনে হয় একটা দুর্দিন এগিয়ে আসছে। কোথায় যেন একটা বিষাদের সুর সে শুনতে পায়। কোথাও কি তাল কেটে গেছে? নাকি একতারার তারটাই ছিঁড়ে গেছে? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সৃজনী। তাহলে কি আর বাউল গান হবে না? আর কি শান্তিকেতন যাবে না সে? ট্রেনে উঠে কত বাউল শুনেছে সে। এ সুরেও তো মন উদাস হয়েই থাকে। এও তো বিষাদ। বিষাদ সুর শুনে আনন্দ কিংবা সুখ হতে পারে কিন্তু খুশি বা উত্তেজনা কি হবে? উন্মাদনা? বাউলরা তো উন্মাদই। বায়ু রোগ। কে জানে। সৃজনীর ফোন বেজে ওঠে। দূরের গ্রাম থেকে আসা এক খবর। একশো কিলোমিটার দূরে এক ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। সেখানে দিঘির শীতল জল আছে। জলের বুকে হাঁস খেলে বেড়ায়। দূরভাষ বেজে ওঠে। দূরভাষের কাজই তাই। দূর থেকে ভেসে আসা, ভেসে যাওয়া। সৃজনীর ভাই জানতে চাইল,

কি রে তুই কী কিছু পার্সেল পাঠিয়েছিস?

হ্যাঁ, গেছে ওটা?

হ্যাঁ, এসেছে তো। আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি, যার জিনিস সে ঠিক বুঝেছে। সে ওটা পেয়ে খুব খুশি। নিয়ে পুরোনো বাড়িতে চলে গেছে। দিদিদের দেখাতে। সে তো আনন্দে লাফাচ্ছে।

যাক ওটা যে পৌঁছেছে সেটাই দেখার ছিল। ওটা একটা পরীক্ষামূলক পাঠানো গিফট। এখন ওখানে অনলাইন জিনিস পাঠানো যায় কিনা সেটাই দেখার ছিল। যাক তাহলে এবার চাইলে এটা সেটা পাঠাতে পারি।

হ্যাঁ, পারিস তো। সব আসে এখন।

বলে আরও একটা কুশলাদির খবর নিয়ে সৃজনী ফোন রেখে দিল। ভাবল, এই তো খুশি আনন্দ এসব কিছু নেই সে ভাবছে কেন? দিব্যি আছে। খুঁজে নিলেই হয়। সৃজনীর একটা ছোট্ট ভাইজি আছে পাঁচ বছরের, সে লিপস্টিক পাগল মেয়ে। সৃজনীকে দেখলেই বলে, ‘পিসিমনি লিপস্টিক কিনে দেবে। তুমি এবার যখন আসবে লিপস্টিক নিয়ে আসবে আমার জন্যে’। ছোট্ট ভাইঝির আবদার মেটাতে সে এই অনলাইন ব্যবস্থার সাহায্য নেয়। সব সময় অতদূরে যাওয়া সম্ভব হয় না। গিয়ে ফেরাটা একটু পরিশ্রম সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই সময় সুযোগ বুঝে যেতে হয়। কিন্তু মন তো খচখচ করে ভাইঝির আবদারে। তাই সে অনলাইনেই পাঠিয়ে দেয়। এভাবে দূর থেকেই একটু তার আবদার ছুঁয়ে নেওয়া। একশো কিলোমিটার দূরের একটা গ্রাম। সেখানেও আজ সব জিনিস অনলাইন পৌঁছে যায়। সব সংস্থা থেকেই। কলকাতা বা কলকাতার কাছে হতে হবে এমনটা আর নয়। চোখের সামনে সব দ্রুত কেমন বদলে যাচ্ছে। দৃশ্যগুলো খুব দ্রুত চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে। একটা একটা দৃশ্য, তার আয়ু খুব ক্ষীণ। যেন আর বেশিদিন করে টিকতে চায় না, রচিত হয়েই শেষ হয়ে যেতে চায়। গ্রাম শহর সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। যেভাবে দেশ বিদেশ হয়েছে। গোটা পৃথিবী এখন গোটা গ্রাম। সত্যিই তো আর তো কোনো তফাৎ নেই। সব কেমন কাছের হয়ে গেছে। কেবল কাছের হচ্ছে না, একজন মানুষের কাছে আর একজন মানুষ। বা কাছের মানুষ বলে যদি কিছু থেকেও থাকে তারা, সব দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু এত দূরে সরে গিয়ে সব যাচ্ছে কোথায়? কেউ জানে না। তবুও একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সৃজনীর সেই এক আশঙ্কা কিছু যেন একটা দুর্দিন আসতে চলেছে। সেই দুর্দিনে কী অপেক্ষা করছে কেউ জানে না। জন্ম যেমন সত্য, মৃত্যুও তেমনি। কিন্তু এ দুটোর মাঝে কি আর কোনো দুর্দিন হতে পারে? যদি হয়, তাহলে সেটাই বা কী? সৃজনী নিজেও জানে না, কিন্তু সে খুব ভালোমতো বুঝতে পারছে একটা দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে, কালবৈশাখীর ঘন কালো মেঘের মতোই। রাস্তা খুব প্যাচপেচে। কদিন টিপটিপ করে বৃষ্টি হল। সে একটু ভিজেও গেছে বেরিয়ে। শোনা যাচ্ছে আরও বড়ো কোনো আশঙ্কার কথা, কারণ সরকার থেকে অরেঞ্জ অ্যালার্ট জারি হয়েছে। এর মধ্যেই সৃজনী তার পরিচিত মানুষদের থেকে মেসেজ পেতে থাকল,

কি রে তোদের ওখানে ভূমিকম্প টের পেলি? খবরে তো দেখাচ্ছে ওদিকের সব সিলিং ফ্যান দুলতে দেখা গেছে…

না, কোনোরকম কম্পনের টের পাইনি। আজকাল ফেসবুক না খুললে বুঝি না যে, ভূমিকম্প হয়েছে।

সে কি? পাসনি?

না, ভূমিকম্প কেবল সোস্যাল মিডিয়ায় হয়। ছোটোবেলার মতো আর শাঁখ বাজিয়ে তুলে দেওয়া হয় না বা কিছুবছর আগে পর্যন্ত যে, কলকাতার হাইরাজগুলো থেকে সব ভয়ে নেমে এসে গেট টুগেদার হত সেসবও হয়। এখন মানুষের অভ্যেস হয়ে গেছে আফটার শকের আর ভয় পায় না…

ভূমিকম্প ঘিরে সৃজনীর অনেক অভিজ্ঞতা আছে। সবার আগে মনে পড়ল তার প্রতিবেশী সোমালিদির কথা। সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রায় অজ্ঞান হয়েই পড়ছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামা তো দূরের কথা। ঘর থেকে বেরিয়ে লবিতে বসে বসে কান্না আর কাঁপ। সৃজনী একটুও ভয় না পেয়ে, তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিচে নামিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই সে ফেসবুক, টিভি সবই অন করল। চোখ কপালে তুলে সৃজনী কেবল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না। দেশলাই বাস্কের মতো গুঁড়িয়ে যাওয়া, ধসে পড়া ধ্বংসস্তুপ আর হাহাকার শুনতে লাগল। থাইল্যান্ডের রজধানী ব্যাঙ্কককের একটা নির্মীয়মান হাইরাইজ চোখের সামনে গুঁড়িয়ে যাওয়ার ভিডিও সে দেখতে পাচ্ছে… এরপর মৃত্যু নিয়ে আর ভাবার কী আছে তার। মায়ানমারে এমন দুর্দিন মানুষ টের পাচ্ছে, তার প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বকলকাতা দিল্লিও তার সামান্য আঁচ পেয়েছে। যা সৃজনী পায়নি। কিন্তু সৃজনী আরও কোনো বড়ো দুর্দিন আসার সঙ্কেত যেন ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে। এটা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোন রূপে তা আসবে সেটার সে আজও টের পায়নি। কিন্তু লোকজন বলাবলি, ভাবনা চিন্তা শুরু করেছে কলকাতা নিয়ে। কলকাতায় এখন অনেক আকাশছোঁয়া বিল্ডিং। সেগুলোও দেশলাই বাক্স হবে কিনা এ বিষয়টা এখন মানুষের বৈঠকি আড্ডার ঢুকে পড়েছে।

সৃজনীর মতো কেউই জানে না সে দুর্দিন কীভাবে আসছে। কিন্তু আসছে। প্রকৃতি নটরাজ হলে কারোর কোনো রেহাই নেই। জীবন এখন গলা পর্যন্ত দুর্দিনে ডুবে থেকেও আরও বড়ো কোনো দুর্দিনের অপেক্ষায়।

কিন্তু কতটা বড়ো কেউ জানে না। সৃজনী কেবল টের পায় একটা দুর্দিন আসছে অবিলম্বে।

এরমধ্যেও তার সেই ছোট্ট ভাইঝি এতটাই খুশি যে, সে রোজ লিপস্টিকের বাক্সটা মাথার কাছে নিয়ে ঘুমোতে যায়। এর থেকে বড়ো শান্তি সৃজনীর কাছে আর কিছু নেই। টিভি বন্ধ করে দেয়।
0

গল্প - দোলা সেন

Posted in



















[১]

“ ও মণিদি, কেমন হয়েছে বলো তো কার্ডটা?”

“এতক্ষণ ধরে একটা কার্ড বানালি? আমারটা দেখ, কি সুন্দর একটা পাখি বানিয়েছি। মিতু, তুই কিছু বানাচ্ছিস না যে!” তিন্নি মুখ না তুলেই বলে উঠল। সে তখন পাখির চোখে পুঁতি বসাতে ব্যস্ত।

“ধ্যেৎ। এগুলো কোনো উপহার হলো? আমি বাপিকে বলব নিউ মার্কেট থেকে একটা খুব সুন্দর গিফ্ট কিনে আনতে”।

মিতু বরাবরই একটু নাক উঁচু। ওর বাবার শাড়ির দোকান আছে। হর হপ্তা কলকাতা যায়।

তিন্নি আর দিয়ার মুখটা ছোট হয়ে গেছে দেখে, মণিদি হাল ধরতে এগিয়ে আসে। সে এতক্ষণ ধরে একটা ফুলসমেত ফুলদানি বানানোর কাজে মেতে ছিল। ওর হাতের কাজ অসাধারণ। সামনে টিচার্স ডে। এই হোস্টেলের মেয়েদের একটা ঐতিহ্য আছে। তারা টিচার্স ডের উপহার আর রাখি কখনো দোকান থেকে কেনে না। ওদের হাতের কাজ বড়দের তত্ত্বাবধানে বরাবরই খুব সুন্দর হয়। যেমন এই ঘরে পাঁচজন তাদের মণিদির কাছে বসে নানারকম জিনিস তৈরি করছিল।

তিন্নি আর দিয়ার মুখটা দেখে মায়া হলো মণিদির। সে হাল ধরল এবার।

‘আসলে কী জানিস, উপহারের আসল দাম তার আন্তরিকতায়। সবসময়েই যে সেটা জিনিসই হতে হবে তার মানে নেই। খুব অন্যরকমভাবেও দেওয়া যায় সেটা”।

দিয়া হালে পানি পেল যেন। খুব উৎসাহভরে বলল – “মণিদিদি, আমি না একটা বিদেশী গল্পে পড়েছিলাম দুটি কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে তাদের মিসকে ভালোবেসে রক গার্ডেন বানিয়ে দিচ্ছিল। একটা দ্বীপ থেকে পাথর আনার সময় নৌকোডুবি হয়ে...”

দিয়ার গলাটা ভারি হযে এল। মণিদিদি সস্নেহে ওর মাথাটা ঘেঁটে দিয়ে বলল – “বিদেশ যেতে হবে কেন রে? এই আমাদের দেশেই...”

গল্পের গন্ধ পেয়ে সক্কলে হাতের কাজ ফেলে মণিদিদির চারপাশে গোল হয়ে বসে – “বলো, বলো”।

মণিদি একটু হেসেই ফেলল – “এটা শুনতে গেলে একটু ইতিহাসের কথা বলতে হবে কিন্তু”।

রিঙ্কু রঙমাখা হাতটা মনের ভুলে মাথায় বুলিয়ে ফেলে বলে – “তা হোক। তুমি বলো”।

অগত্যা ফুলদানিটা টেবিলের ওপর যত্ন করে সরিয়ে রাখে মণিদি। তারপর হাতটা মুছে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসেল

“ বেশ কিছুটা সময় পিছিয়ে যেতে হবে, বুঝলি? ১৯৪৬ এর শেষের দিকে। সে এক অস্থির সময়...”

‘অস্থির কেন?” – দিয়া চুপ থাকতে পারে না মোটেই।

মণিদি তিন্নির দিকে ঘুরল – “এর উত্তর তুই দিতে পারবি?”

তিন্নি আঙুল গোনে – “সাতচল্লিশে ভারতের স্বাধীনতা। তার আগে উমম্... ছেচল্লিশের দাঙ্গা?”

“একদম ঠিক। যার সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, সেই ব্রিটিশ সিংহের আধিপত্য সারা বিশ্বেই অস্তমিত হবার মুখে। ভারতও তার থেকে বাদ নয়। কিন্তু কে চালাবে সেই সদ্য স্বাধীন দেশ? কিভাবে রক্ষা করা যাবে বিচিত্রের মধ্যে ঐক্য?

যতই গান লেখা হোক – বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান _ নানা জাতি, নানা মতের মিলনে সে মহাসাগরে সেতু বাঁধা সহজ কাজ নয়। নানা স্বার্থের সংঘাতে জ্বলে উঠল ভারত। উজ্জ্বল শিখায় নয়, প্রবল জাতিগত দাঙ্গায়। সেই কালো দিনের অবসান ঘটাতে নেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন দেশ ভাগ হোক ধর্মের ভিত্তিতে। সাধারণ মানুষও নেতাদের মতোই বিশ্বাস করল – “স্বরাজ আসিছে চড়ে জুড়িগাড়ি”। ইংরেজ ভারত ছাড়লেই সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে – সূর্যোদয়ের পর যেভাবে রাতের অন্ধকার নিমেষে দূর হয়”।

মিতু চিন্তিতভাবে বলল – “তবে যে বাবা বলে, শাসক বদলালেই উন্নতি হয় না? মানুষদের ভাবনা বদলাতে হয় আগে?”

মণিদি সোজা হয়ে বসল – “কাকু একদম ঠিক বলেছেন রে। তাহলে শোন - ঠিক সেই সময়ে, এই অস্থির চিত্রপট থেকে অনেক দূরে কয়েকজন মানুষ অন্যরকম ভাবছিলেন। তাঁদেরও মনে হয়েছিল, মানুষের মনে যদি চেতনার আলো, শিক্ষার দ্যুতি না পৌঁছানো যায়, তাহলে স্বাধীনতা কথাটির অর্থ বইয়ের পাতাতেই আটকে থাকে। যেমন মনে হওয়া, তেমনি কাজ। তৈরি হলো ‘সেবা সংঘ’। বিভিন্ন অনগ্রসর এলাকায় তাঁরা স্কুল তৈরির কাজে লেগে পড়লেন।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, কাজটা সহজ নয় মোটেই। এই পিছিয়ে পড়া জনজাতিকে শিক্ষিত করে তোলার পথে প্রধান বাধা দ্বিমুখী। এক - বিদায়ী ইংরেজ শাসক, দুই – স্থানীয় ভূস্বামী বা রাজা”।

রিঙ্কু অস্থির হয়ে উঠল – “কেন মণিদি? ইংরেজ কেন? আমাদের আধুনিক শিক্ষায় ওদের অবদান তো কম নয়! বেথুন সাহেবের কথাই ধরো, কিম্বা হ্যালহেড বা উইলিয়াম কেরি...। মেয়েদের স্কুল, বাংলা ব্যাকরণ তৈরিতে এঁদের অবদান তো আমরা ইতিহাসেই পড়েছি। তাহলে ছেচল্লিশে হঠাৎ তারা শিক্ষবিরোধী হয়ে উঠল কেন গো?”

মণিদি বলল – “তোরা একটা শব্দ বোধহয় খেয়াল করিসনি। সেবা সংঘ কাজ করছিল অনগ্রসর এলাকায়। পিছিয়ে পড়া জনজাতির জন্য। যেখান থেকে ইংরেজ শাসকের, ভূস্বামীদের সেবা মেলে। মজুর, চাষী, জেলে...। এরা শিক্ষিত হলে - সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলে চিনলে - নিঃশব্দে রোজের বেগার খাটবে কে?”

দিয়া বিরক্ত হচ্ছিল – “ গল্পের মাঝখানে নিজেদের জ্ঞান জাহির না করলেই নয়? মণিদি গল্প বলো”।

মণিদি হেসে ফেলে শুরু করল – “আসলে পটভূমিটা না জানা থাকলে, এ গল্পের কোনো মানে থাকে না রে। যাই হোক শোন –

রাজস্থানের দক্ষিণ পশ্চিমে ডুংগারপুর রাজ্য। সেখানকার রাজা – মহারাওয়াল লক্ষণসিংহ। যে সে রাজা নন, রাজ্যে তাঁকে সম্মান জানানোর জ্ন্য পনেরখানা গান স্যালুটে হয়। সে এক বিশেষ সম্মান। খোদ ইংল্যান্ডের মহারানী সে অনুমতি দিয়েছেন! তা স্কুল করার জন্যে, সেই রাজ্যের ভীল অধ্যুষিত গ্রাম রাস্তাপালকে বেছে নিয়েছিলেন সেবা সংঘের কিছু নিবেদিত কর্মী।

প্রস্তাব শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন মহারাওয়াল। বুনো ভীলের দল চিরটাকাল মুখ বুজে রাজপুতদের সেবা করে এসেছে। রাজার চাবুককে নতমস্তকে স্বীকার করে নিয়েছে ঈশ্বরের প্রসাদের মতো। যে সব সরল চোখে, ঈশ্বর আর মহারাওয়াল সমার্থক ছিল, সেই চোখ ফোটাতে চায় ওই উটকো আপদগুলো? তারপর কি আর ওরা আগের মতো মান্য করবে মহারাওয়ালকে?

না না, এসব কিছুতেই চলতে পারে না। অতএব তিনি ফতোয়া জারি করলেন – এ রাজ্যেতে নাহি রবে শিক্ষা সদাচার... হাঃ হাঃ হাঃ।

থামানো গেল না কিন্তু! রাজা জমি না দিলে কী হবে, এগিয়ে এলেন নানাভাই কণ্ঠ নামের এক মহাপ্রাণ। নিজের বাড়ি তিনি খুলে দিলেন স্কুলের জন্য। শিক্ষকেরও অভাব হলো না, জানিস? এগিয়ে এলেন সেঙ্গাভাই। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা – রাজদণ্ডের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীও জুটে গেল!”

তিন্নি রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করল – “তারপর? ওরা পড়তে পারল?”

মণিদি বোধহয় শুনতে পেল না। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল এক অদ্ভুত ক্লাসরুম।

[২]

ব্ল্যাকবোর্ডে ‘ক’ লিখতেই...

“ক সে কলম” – নানা স্বরের ঐকতানে ক্লাসরুমটা গমগম করে ওঠে। নানান বয়েসের মানুষের ভিড় সেখানে। খস খস... পেনসিলের প্রবল ঘষায় খাতা যায় যায়। তবু ক লিখতে পারার আনন্দে কালো মুখগুলি বড় উজ্জ্বল। আর সেই আলোয় উদ্ভাসিত সেঙ্গাভাইয়ের মুখ। শ্রেণিকক্ষে ঘুরে ঘুরে সবাইকে উৎসাহ দিচ্ছেন তিনি –

“ইয়ে কলম সামহালকে রখনা। ইসকে তাকত..

জানো তো, এই কলমের জোর রাজার দণ্ড, পুলিশের ডাণ্ডার চেয়েও শক্তিশালী। মনে রেখ, শিক্ষাই শক্তির উৎস। যেদিন নিজেদের চিনতে শিখবে, সেদিন তোমাদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। মহারাওয়ালও নয়”।

“রাম, রাম। এইসা মত বোলিয়ে” – বর্ষীয়ান ছাত্রটির মুখে চোখে ভয় – মহারাওয়াল যে স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিভূ!

“রাজাকে খিলাফ কুছ শুননা ভী পাপ হ্যায়।”

সেঙ্গাভাইয়ের চোখদুটো একবার জ্বলে উঠেই শান্ত হয়ে যায়। শুধু এই অন্ধবিশ্বাসের জন্যেই, এই দুর্মর শক্তিশালী ভীলজাতি যুগ যুগ ধরে রাজপুত শাসকের অত্যাচার সয়ে আসছে নির্বিবাদে। আজও ডুংগারপুরের ভীলেরা চরমভাবে নির্যাতিত।

স্বাধীনতা দরজায় কড়া নাড়ছে – মাসকয়েকের মধ্যেই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হবে। একথা এখন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। কিন্তু মানুষ যদি স্বাধীনতার অর্থই না বোঝে, তাহলে তাদের অধীনতার শিকল কখনো ঘুচবে না। শিকলের মালিকানার হাতবদল ঘটবে শুধু। তাই সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষা। চেতনার যেটি প্রথম ধাপ। এই রাস্তাপাল গ্রামে সেবা সংঘের পাঠশালা প্রতিষ্ঠার কারণ এটাই।

সেঙ্গাভাই বলছিলেন –

“আজ পড়া থাক। একটা গল্প শোন বরং।

এই বনে, পাহাড়ে একসময় শুধু ভীলেরা থাকত। তাদের ছিল – বনের শিকার, খেতির ফসল, চাঁদের আলোয় ঢোলথালের দ্রিমি দ্রিমি, কৌড়ির সুরে ছেলেমেয়েদের নাচ।

প্রায় পাঁচশ বছর আগে গিহ্লোট বংশের এক নির্বাসিত রাজকুমার, তার কিছু অনুচরকে নিয়ে, ভীলরাজা ডুংগারিয়ার আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর একসময় সেই বিশ্বাসঘাতক রাজকুমার, আশ্রয়দাতাকে হত্যা করে, সে নিজেই রাজা হয়ে বসল। সেই ডুংগারিয়ার নাম থেকেই তোমাদের এই রাজ্য - ডুংগারপুর!’

বছর বারোর একটি মেয়ে উঠে দাঁড়ায় এইবার – ‘এই গিহ্লোট বংশের রাজা নাগাদিত্যের অত্যাচারের বিরুদ্ধেই ভীলবিদ্রোহ হয়েছিল না? পুরো রাজবংশ ভীলেদের রোষে ছারখার হয়েছিল। উয়োলোগ দেওতা নেহি হ্যায় বাপু। ইনসান হ্যায়। অগর গলতি করে তো...’

সেঙ্গাভাই সস্নেহে তাকিয়ে থাকেন। আগে বলা কাহিনি ঠিক মনে রেখেছে কালিবাঈ। বড় তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী এই মেয়েটি।

চাষী বাপমায়ের মেয়ে। তার বাবার বড় শখ মেয়ে লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে। সেঙ্গাভাইধের কাছে আসা দিদিমণিদের মতো। এমন অপমানিত দাসের জীবন হবে না তার।

পড়া এগিয়ে চলছিল – নতুন করে নিজেদের চিনতে শিখছিল সরল মানুষগুলো। ক সে কলম থেকে শুরু করে ইতিহাস, ভূগোল, যুগ যুগ ধরে তাদের ওপর হয়ে আসা অত্যাচারের আর তার প্রতিবাদের গল্প...


[৩]

মণিদি বলে চলছিল এক ঘোরের মধ্যে –

“ঠিক এখান থেকেই বিপদের আঁচ পাচ্ছিলেন মহারাওয়াল। স্বাধীনতার সঙ্গে সিংহাসনের মতো ভীলদের নিঃশর্ত আনুগত্যও যদি হারাতে হয়, তাহলে তাঁর প্রতিপত্তিরও অবসান ঘটবে! এই জন্যেই পাঠশালা স্থাপনায় এত আপত্তি ছিল ডুঙ্গারপুরের অধিপতি মহারাওয়াল লক্ষ্মণ সিংহের। তবু কী অসীম দুঃসাহস ওই নানাভাই কণ্ঠের! সে নিজের বাড়ি পাঠশালার জন্য দান করেছে! এর একটা ব্যবস্থা...”

দিয়ার গলা ভারি হয়ে উঠেছে উৎকণ্ঠায় – “ওদের উপর খুব অত্যাচার করল ওই মহারাওয়াল?”

মণিদি কেমন যেন হাসল – “মহারাওয়াল ভয় পেয়েছিলেন, বুঝলি। আসলে রাজপুত আর কজন? ওঁর সব সৈন্য বা রক্ষকদের বেশিরভাগই তো ভীল। তাদের বাড়ির অনেকেই যাচ্ছে ওই স্কুলে। কে জানে কী শিখে আসছে সেখান থেকে! তাদের উপর ভরসা করতে পারছিলেন না তিনি। যদি তারা ঘুরে দাঁড়ায়? না না, এত বড় ঝুঁকি তিনি নিতে পারেন না। বরং খবর পাঠালেন ম্যাজিস্ট্রেটকে। ইংরেজ তখন জানে এবার তাদের ছেড়ে যেতে হবে এই আরাম আয়েশ আর দৌলত। তারাও হিংস্র হয়ে উঠেছিল। ক্ষোভ উগরে দেবার এই সুযোগটা তারা ছাড়ল না।

তারিখ ছিল - ১৯৪৭ এর ১৯শে জুন। পুলিসবাহিনী এলো পাঠশালা বন্ধ করতে। রুখে দাঁড়ালেন নানাভাই আর সেঙ্গাভাই। পুলিশ এটাই চাইছিল। নিরস্ত্র প্রতিবাদীদের উপর বীরত্ব দেখাবার এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে? নির্বিচার লাঠি চলল। নানাভাই ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারালেন। সেঙ্গাভাই মারের চোটে জ্ঞান হারালেন। গ্রামের লোককে ভালোমতো শিক্ষা দিতে সেঙ্গাভাইয়ের আহত অচেতন দেহকে গাড়ির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধল তারা। গাড়ি চালিয়ে অজ্ঞান দেহটাকে রাস্তায় হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগল ব্রিটিশের পুলিস। আর ভয়ে, আতঙ্কে, ঘৃণায় পাথর হয়ে সেই দৃশ্য দেখছিল সারা গ্রামের মানুষজন। রাওয়ালের বিরুদ্ধে, পুলিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করাটাই যে এই অসহায় মানুষগুলির যুগ যুগ বাহিত রক্তের শিক্ষা! তারা অঝোরে কাঁদছিল, যেমন করে কেঁদে এসেছে যুগ যুগ ধরে।

সেই সময়, তখন মাঠে কাজ করছিল কালিবাঈ। গোলমাল শুনে কাস্তে হাতেই দৌড়ে এসেছিল। তার গুরুকে ওরা...

‘বাপজিইইই’ – আর্ত চিৎকার করে কাস্তে হাতেই প্রাণপণে দৌড়াল কালিবাঈ। অন্ধ আবেগের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল পুরুষানুক্রমে বাহিত সংস্কার। পুলিস মজা দেখার জন্য গাড়ি থামাতেই, মেয়েটা ঝাঁপিয়ে পড়ে দড়ি কেটে ফেলল এক কোপে। তাই দেখে চটক ভাঙল অন্য মেয়েদেরও। তার দল বেঁধে এগিয়ে এল সেঙ্গাভাইয়ের পরিচর্যায়। কালিবাঈ জল আনছিল মুখে দেবার জন্যে।

এত সাহস, পুলিসের কাজে, মজা দেখানোয় বাধা? ক্ষিপ্ত পুলিস গুলি চালাল। রক্তে স্নান করা দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। কালিবাঈয়ের আনা জলে মিশে গেল তারই রক্তের ধারা। আর সেই রক্ত তুফান তুলল জমে থাকা অসহায় মানুষগুলোর মনে।

তাদের হতবাক আতঙ্ক ক্ষোভে ফেটে পড়ল এতক্ষণে। শত্রুহননের ডাক দিয়ে, মারু ঢোল বাজতে লাগল উদ্দাম বেগে। সংকেত পেয়ে, ভীলেরা দলে দলে তাদের তীরধনুক, বর্শা নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করল। পালিয়ে বাঁচল পুলিসবাহিনী। সব ভুললেও মারুর ডাক ভোলেনি তারা। পিছু হটলেন রাওয়ালও”।

তিন্নি শুধু বলল – “তারপর?”

মনিদি বলল – “ হ্যাঁ, তারও পর থাকে বইকি। এরপর আরও বড় বাহিনী এসেছিল রাস্তাপালে। ভীলদের গ্রামটাকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ছেড়েছিল। কিন্তু কী জানিস, আলো যখন জ্বলে তখন কিছুতেই অন্ধকার জিততে পারে না। এ লড়াই সেখানেই থামল না। অবশেষে হার মানতে বাধ্য হলেন লক্ষ্মণ সিং। ভীলদের পড়াশোনার অধিকার মেনে নিতে হযেছিল তাঁকে”।

মিতু হাঁটুতে মুখ রেখে শুনছিল এতক্ষণ। এবার মুখ তুলল। জলে ভেজা চোখ না মুছেই, ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল – “ডুঙ্গারপুর মনে রেখেছে কালিবাঈকে?”

মণিদি বলল – শহীদের বলিদান বৃথা যায় না রে মিতু। ডুঙ্গারপুর তাকে শুধু মনে রাখেনি, প্রাণে রেখেছে তার শিক্ষার আর্তিকে। গুরুর জন্য, শিক্ষার অধিকারের জন্য শহীদ হওয়া সেই মেয়ে বেঁচে রইল ডুঙ্গারপুরের মানুষের ভাবনায়, কাজে। সেখানে আজ ৮৪.৩৮% জন স্বাক্ষর”।

লম্বা শ্বাস ছাড়ল মেয়ের দল – “আমরাও আর পড়ায়, কাজে ফাঁকি দেব না মণিদি। যেটা ঠিক বলে জানব, তার জন্য লড়ব”।

মণিদি হাসল – “বিপ্লব আলো ছড়ায় যুগে যুগে। কখনো হারিয়ে যায় না, মনে রাখিস।”

********

স্বাধীনতার পঁচাত্তর বৎসর উদযাপনে মূর্তি গড়ছিলেন ভাস্কর। একহাতে কাস্তে, অপর হাতে বই দিয়ে কালিবাঈয়ের মুখে তৃপ্তির হাসিটি বড় যত্ন করে ফুটিয়ে তুললেন তিনি। বৃত্তটি সম্পূর্ণ হলো।
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in



















তৃতীয় পর্ব

হিন্দোশিয়া থেকে ফিরে এসে পানু রায় ভাবছিলেন কী করে একটু অর্থপূর্ণ ভাবে সময় কাটানো যায়। সহজাত বুদ্ধির সদ্ব্যবহার করে যদি কিছু মানুষের উপকার করা যায় আর সঙ্গে সঙ্গে কিছু রোজগার হয় তাহলে মন্দ কী? তাছাড়া দেশে বিদেশে মানুষকে চেনা এবং বোঝার অর্জিত অভিজ্ঞতাও তো কম নয়। সুন্দরী আর জগাই এর কোনও কাজ নেই। ওরা দু’জনেই সৎ, পরিশ্রমী এবং বুদ্ধিমান। ওদেরও কাজে লাগানো যেতে পারে এই নতুন উদ্যোগে। ওনার নিজের জন্যও যেমন সুন্দরী এবং জগাই এর জন্যও তেমন শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রমের খুবই প্রয়োজন। আর বেশিদিন কেবল খেয়ে আর ঘুমিয়ে কাটালে শরীর এবং মাথা দু’টোই ভোঁতা হয়ে যাবে। তাই কাউকে কিছু বলার আগে একদিন সুন্দরী আর জগাইকে ডেকে নিজের পরিকল্পনার কথা জানালেন পানু রায়। জানালেন যে উনি একটি উপদেষ্টা সংস্থা চালু করতে চান। এই সংস্থার মূল কাজ হবে বিপন্ন মানুষদের সাহায্য করা বা সঠিক পরামর্শ দেওয়া এবং অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে। মূল পরামর্শদাতার কাজ করবেন তিনি নিজে এবং তাকে সহযোগিতা করবে সুন্দরী এবং জগাই। অফিসের ভিতরের কাজ করবে সুন্দরী এবং বাইরের কাজ করবে জগাই। তবে প্রয়োজনে বা ক্ষেত্রবিশেষে এর ব্যতিক্রম হতে পারে। অর্জিত অর্থ পূর্বনির্দিষ্ট অনুপাতে তিনজনের মধ্যে ভাগ হবে। সব শুনে জগাই বলল,’ দাদু, অত হিসেব নিকেশ আমাদের বোঝবার দরকার নেই। তুমি যখন যা বলবে আমরা তখন তা করবো। আমাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে নিও আর ভুলভ্রান্তি হলে ক্ষমা করে দিও। তবে চেষ্টার ত্রুটি হবে না সে তুমি খুব ভালোভাবেই জানো। তোমার সঙ্গে টাকার কোনও হিসেব করতে পারব না। সব তুমি রেখ। দরকার হলে চেয়ে নেব। তুমি আমাদের বাবা, মা, দাদু সবকিছু। পানু রায় বললেন,’ তোদের কথা মানছি। তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে? তবে ব্যবসার একটা নিয়ম থাকা দরকার। সেই নিয়মেই ব্যবসা চলা উচিৎ। না হলে, ব্যবসা টিকে থাকবে না।‘জগাই আর সুন্দরী চুপ করে রইল।

পরেরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর সকলকে ডেকে নিজের পরিকল্পনার কথা জানালেন পানু রায়। সবাই মহা উৎসাহে হৈ হৈ করে উঠল। পচা, কেস্ট, মাধাই সবাই বলে উঠলো,’ দাদু, আমরাও আছি তোমাদের সঙ্গে। দরকার পড়লে শুধু একবার ডেকো।‘ মাধাই বলল,’ দাদু, তোমাকে একটা জরুরি খবর দিই।‘ পানু রায় বললেন,’ কী খবর?’ সকলে উৎসুক হয়ে মাধাই এর দিকে তাকিয়ে রইল। মাধাই বলল,’ কেলো দারোগার পদন্নোতি হয়ে বারৌনিতে পুলিশ প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছে গত সপ্তাহে। আজই পেলাম খবরটা।‘ খবরটা শুনে চুপ করে রইল সবাই। শুধু পচা চিৎকার করে উঠলো ,’ দাদু, খেলা জমে যাবে।‘ ঘরভর্তি সবাই হেসে উঠলো হো হো করে।

দেখতে দেখতে নতুন সংস্থার কাজকর্ম শুরু হয়ে প্রায় দেড় বছর কেটে গেল। বেশ কয়েকটা ছোট ছোট সমস্যার দ্রুত সমাধান করে দিলেন পানু রায়। অবশ্যই সুন্দরী এবং জগাই এর সহযোগিতা ছাড়া যে এই কাজগুলো করা যেত না সেকথা বারবার বলেন পানু রায়। ঘটনাচক্রে বেশ কয়েকবার কেলো দারোগার মুখোমুখিও হতে হয়েছে। হেনস্তার একশেষ হয় লোকটা প্রতিবার। মুখে কিছু না বললেও পানু রায়ের ওপর বেশ চটে থাকে সবসময়। কথাবার্তায় আভাসে ইঙ্গিতে বুঝিয়েও দেয়। সুযোগ পেলে সুদে আসলে তুলে নেবার অপেক্ষায় থাকে সবসময়।

সেদিন সকালে অফিসে একটা মোটা আইনের বইয়ে ডুবে ছিলেন পানু রায়।খেয়াল করেননি অনেকক্ষণ ধরে দরজার সামনে অপেক্ষা করছে সুন্দরী। সুন্দরীও ইচ্ছে করেই পানু রায়ের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে চায়নি। বেশ কিছুক্ষণ পরে বই থেকে মুখ তুলে সামনে সুন্দরীকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,’ সুন্দরী, কিছু বলবে?’ সুন্দরী বলল,’ একজন অবিবাহিতা মহিলা যিনি একজন অবিবাহিত পুরুষের সঙ্গে বসবাস করেন তার আইনগত অবস্থান কী?’ পানু রায় ভুরু কুঁচকে বললেন,’ আইনগত কোনও বিশেষ অবস্থান নেই। কিন্তু হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞাসা করছো কেন?’

-কারণ জনৈকা রেবা কৈরালা বাইরে অপেক্ষা করছেন এবং বলছেন তিনি নাকি কৃষ্ণকালীর সঙ্গে থাকেন।

-কৃষ্ণকালী চৌধুরী –মানে যাঁর সম্পত্তির আইনি সমস্যাটা আমরা কিছুদিন আগে মেটালাম? কিন্তু কৃষ্ণকালী অবিবাহিত বলছ কেন?

- আরে না না, ওনার কথা বলছি না। আমি ওনার ছেলের কথা বলছি।

-তাই বলো। আমি ভাবলাম তোমার হঠাৎ মাথার গোলমাল হল নাকি?

-না, মাথা ঠিক আছে। কিন্তু ঐ বাবা আর ছেলের নাম আমি কিছুতেই মনে রাখতে পারিনা। সবসময়ে কেমন যেন গুলিয়ে যায়।

-শোন বাবার নাম কৃষ্ণকালী আর ছেলের নাম কালীকৃষ্ণ। গুলিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কৃষ্ণকালী মানে বাবা বিবাহিত এ নিয়ে কোনও সংশয় তোমার নেই নিশ্চয়ই। ছেলে কালীকৃষ্ণ অবিবাহিত। বাবা ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ের সন্ধান করছিলেন বলেই শুনেছি। এখন তো দেখছি গল্প অন্য। যাই হোক তোমার যদি নাম মনে রাখতে অসুবিধে হয় তাহলে বাবাকে বড়কালী আর ছেলেকে ছোটকালী বলে আপাতত চালাও।

-সেটাই সুবিধেজনক হবে। ঠিক আছে।

- সুন্দরী, আমার যতদূর মনে আছে ছোটকালী পুরনো গাড়ির ব্যবসা করে। মাধাই এর সঙ্গে যোগাযোগ আছে বলে জানি। কিন্তু রেবা কৈরালার কী সমস্যা?

-সমস্যাটা রেবা কৈরালার ব্যক্তিগত। ওনার মনে হয় ছোটকালীর সঙ্গে ওনার সম্পর্কের ব্যাপারটা বললে তুমি ওর সমস্যাটা শুনতে আগ্রহী হবে।

-বুঝলাম, কিন্তু সমস্যাটা কী?

-রেবা কৈরালার কাঠমান্ডুতে একটা ক্যাসিনো আছে। আমার মনে হয় সমস্যাটা ক্যাসিনো সংক্রান্ত।

-সুন্দরী, ছাব্বিশের ওপর এক হাজার টাকা বাজি ধর।

হিন্দোশিয়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যাসিনোতে কাটিয়েছে ওরা সবাই। সুন্দরী অদৃশ্য সংখ্যাচাকা ঘুরিয়ে একেবারে ধারে অদৃশ্য রৌপ্যগোলক ছেড়ে দিল। পানু রায় এবং সুন্দরী দু’জনেই ঠিক যেমন সত্যিকারের খেলার সময় সবাই চাকার দিকে তাকিয়ে থাকে তেমনি তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। দেখলে মনে হবে সত্যিই যেন খেলছে ওরা। স্তব্ধতা ভেঙে সুন্দরী বলে উঠল,’ দুঃখিত,দাদু। তিন এ থেমেছে চাকা।‘ পানু রায় হেসে বললেন,’ হতভাগ্য আমি পরাজিতের দলে।‘

-আর রেবা কৈরালা?

- চল, বড়কালীকে ফোন করে জানা যাক এই মহিলার আসল পরিচয়। তার আগে বল মহিলার বয়স কত?

-তেইশ-চব্বিশ হবে?

-ফর্সা না শ্যামবর্ণ?

-ফর্সা

-শঙ্খিনী না পদ্মিনী?

-শঙ্খিনী।

-কটিদেশ?

-ক্ষীণ।

-মুখমন্ডল?

-সত্যিই সুন্দরী! দাদু, তুমি পারোও বটে।

-সুন্দরী, জলে নামার আগে বড়কালীকে স্মরণ করা যাক।

-হ্যালো, কৃষ্ণকালী চৌধুরী আছেন? ওনাকে বলুন আমি সুন্দরী, পানু রায়ের অফিস থেকে বলছি। উনি আমাকে চেনেন। হ্যাঁ,সুন্দরী, পানু রায়ের অফিস থেকে।একটু তাড়াতাড়ি করবেন প্লিস। খুব জরুরি দরকার।

সুন্দরী কিছুক্ষণ ধরে রইল। ইশারায় পানু রায়কে বোঝাল ওদিকে কোনও আওয়াজ নেই। কিছুক্ষণ পরে- কী বললেন, দেশের বাইরে? কোথায় গেছেন? কোন নাম্বারে ওনাকে পাওয়া যেতে পারে?

আবার একটু থেমে- ও আচ্ছা, তাহলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ হলে দয়া করে বলবেন আমাকে ফোন করার জন্য। আমার নাম্বার উনি জানেন। খুব দরকার। অবশ্যই বলবেন প্লিস। অনেক ধন্যবাদ।

ফোন রেখে সুন্দরী বলল,’ এলিনা, বড়কালীর সেক্রেটারি। বড়কালী দেশের বাইরে এবং তার ফোন নাম্বার কাউকে দিতে নিষেধ করেছেন বড়কালী।‘

পানু রায় অবাক হয়ে বললেন,’ এলিনা? মনীষার কী হল? ওহো, মনীষার তো বিয়ে হয়ে গেছে।‘

সুন্দরী বলল,’ অনেকদিন আগে। বছরখানেক তো হবেই।‘

-বল কী? এক বছর হয়ে গেল?

-একটা কফি মেসিন আর একটা ইনডাকশন হিটার দেওয়া হয়েছিল। বিল বার করলেই সঠিক তারিখ পর্যন্ত জানা হয়ে যাবে।

- না না, ওসব বাদ দাও। তার মানে কৃষ্ণকালীর সঙ্গে আমরা কোনও কাজ করিনি ঐ নতুন সেক্রেটারি আসার পর অর্থাৎ এক বছর হয়ে গেল আমাদের কৃষ্ণকালীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই।

-মনে হয় আমাদের চুক্তিরও শেষদিন পার হয়ে গেছে। বড়কালী এখন আমাদের ক্লায়েন্ট নয়।

-কী আর করা যাবে? আমার মনে হয় এবার রেবা কৈরালার সঙ্গে কথা বলা যাক। শোনা যাক ওনার কী বলার আছে। ওনাকে ভিতরে নিয়ে এস সুন্দরী।

সুন্দরী উঠে যায় এবং কিছুক্ষণ পরে রেবাকে নিয়ে ফিরে আসে। পানু রায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, ’রেবাদেবী, ইনিই পানু রায়।‘ রেবা কৈরালা, ফর্সা সুন্দরী আস্তে আস্তে পানু রায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। পানু রায় হাত বাড়িয়ে দেন। পানু রায়ের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে,’ আমার সৌভাগ্য, মিঃ রায়।‘ রেবা কৈরালার প্রতিটি পদক্ষেপ এতটাই ধীরস্থির যে সহজেই পানু রায় বুঝলেন যে এই মহিলা আপাদমস্তক পেশাদার। তবে কেন জানি পানু রায়ের মনে হল এই মহিলার পা দু’টি শরীরের তুলনায় একটু বেশি লম্বা। তবে তাতে মহিলার সৌন্দর্য বেড়েছে বই কমেনি। পানু রায় চেয়ারের দিকে হাত দেখিয়ে বসতে বললেন রেবাকে।

-আপনার কথা শোনার আগে আপনাকে জানিয়ে রাখি যে আমি প্রায় একবছর আগে কৃষ্ণকালী চৌধুরীকে আইনি পরামর্শ দেবার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ ছিলাম। কৃষ্ণকালী একজন প্রখর বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী সেইজন্য সম্ভাব্য বিপদ এড়িয়েই উনি সবসময় কাজ করতেন। আইনি পরামর্শ নেবার প্রয়োজন ওনার খুব একটা পড়তো না। যদিও এখন আমরা চুক্তিবদ্ধ নই তবুও ওনাকে সঠিক পরামর্শ দেওয়া এবং সম্ভাব্য বিপদের হাত থেকে ওনাকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য বলে মনে করি। সর্বোপরি উনি ব্যক্তিগতভাবে আমার একজন ভালো বন্ধু।

রেবা সোজা হয়ে একটা পায়ের ওপর আর একটা পা তুলে হেলান দিয়ে বসে বলল,’ ঠিক সেই কারণেই আমি আপনার কাছে এসেছি।‘

পানু রায় বললেন,’ আর একটা কথা বলে রাখি আপনাকে যে কোনও ব্যাপারে পরামর্শ দেবার আগে আমি সমস্ত ব্যাপারটা কৃষ্ণকালীকে জানাব এবং আমার কোনও পরামর্শ বা কাজ যে তার বিরুদ্ধে যাবে না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তবেই কাজে হাত দেব। আশা করি সে ব্যাপারে আপনার কোনও আপত্তি নেই। ‘

-শুধু যে আপত্তি নেই তাই নয় আমি এখানে এসেছি যেহেতু আপনি ওনার আইনি পরামর্শদাতা এবং আমি চাই আপনি ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

-ঠিক আছে। এই কথাই রইল। এবার বলুন কী বলতে চান।

-নেপালে আমি উত্তরাধিকারসূত্রে একটি সম্পত্তির মালিকানা পেয়েছি।

-কী ধরণের সম্পত্তি?

-একটি ছোট হোটেল এবং ক্যাসিনো।

-নেপালের কয়েকটি ক্যাসিনো সত্যিই বিশাল এবং পৃথিবীবিখ্যাত।

-না না, সেরকম কিছু নয়। এটি আপাতত ছোট কিন্তু যে জায়গায় এটি অবস্থিত সেটি ভীষণ সুন্দর।প্রয়োজনে এটি বাড়াবার জন্য চারিদিকে প্রচুর জায়গা রয়েছে।

-এই সম্পত্তির কতটা অংশ আপনি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন? পুরোটা?

-না। এই সম্পত্তিটি একটি ছোট কোম্পানির। আমার বাবা ঐ কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমার ভাগে চল্লিশ শতাংশ আর বাকি ষাট শতাংশ চারজনের মধ্যে ভাগ হবে।

-আপনার বাবা কবে গত হয়েছেন?

প্রশ্নটা শুনে রেবার মুখটা কঠিন হয়ে উঠলো। রেবা ততোধিক কঠিনভাবেই উত্তর দিল,’ ছ’মাস আগে। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।‘

পানু রায় বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,’ খুন?’

-হ্যাঁ, হয়ত খবরের কাগজে পড়েছেন।

-আপনার বাবা কি প্রসাদ কৈরালা?

-আপনি ঠিক বলেছেন। আমি প্রসাদ কৈরালার একমাত্র সন্তান।

-আমি যতদূর জানি এই হত্যারহস্যের আজও কোনও সমাধান হয়নি।

-মিঃ রায়, কোনও হত্যারহস্যেরই সমাধান নিজে নিজে হয়না।

-দেখুন, এটা যদি আপনার কাছে কোনও অস্বস্তিকর বিষয় হয় তাহলে এই নিয়ে আলোচনার দরকার নেই।

-না না, সেরকম কিছু নয়।জীবনে অনেক কিছুই অস্বস্তিকর ঘটে । আমি আপনার কাছে আসার আগে নিজের অনুভূতি প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছি।

-ঠিক আছে। বলুন এই সম্বন্ধে আপনার কী বলার আছে।

-আমার মা মারা যায় যখন আমার বয়স চার বছর। তখনই নাকি শুরু হয় সাতবছরের দুর্ভাগ্যচক্র। অন্তত আমার বাবা তাই বিশ্বাস করত। বাবা সাঙ্ঘাতিকরকম কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল। আমার মনে হয় সব জুয়াড়িরা ঐরকমই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়। আস্তে আস্তে বাবা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং আর্থিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করে। বাবার হাতে তখন না ছিল কোনও টাকা আর না ছিল কোনও কাজ।বাধ্য হয়ে বাবা একটা বেআইনি শুঁড়িখানায় কাজ শুরু করে। কিছুদিন বাদে ঐ শুঁড়িখানার মালিক মারা যায়। বাবা তখন নিজেই শুঁড়িখানাটা চালাতে থাকে। মালিকটার কোনও ছেলে মেয়ে ছিলনা বা থাকলেও কেউ এসে বাবার কাছ থেকে মালিকানা দাবি করেনি। তারপর অনেকদিন বাদে যখন শুঁড়িখানা আইনসিদ্ধ ব্যবসার অন্তর্গত হল তখন বাবা ওটাকে ছোটখাট সুন্দর একটা হোটেল হিসেবে গড়ে তুলল। আমি বাবার দুর্ভাগ্যের গল্প বলে আপনাদের সময়ের অপচয় করছি না তো?

-একেবারেই নয়। আপনি বলুন।

-বাবা পরবর্তীকালে প্রভূত অর্থের অধিকারী হয়। বাবার জুয়ার নেশা ছিল। সৌভাগ্যক্রমে জুয়া থেকেও বাবা অনেক টাকা রোজগার করে। বাবা যে কেবল বেআইনি ব্যবসার ব্যাপারেই উৎসাহী ছিল তা কিন্তু নয়। তবুও শুঁড়িখানার ব্যবসাটা বাবা চালাতেই থাকল। জুয়া আর টাকা ওড়াবার নেশা ছিল বাবার রক্তে। আর সকলের মত জুয়াড়িদের মধ্যে অনেক ভাল গুণও থাকে।জুয়াড়িরা হেরে গিয়েও নিজেদের আবেগ সংবরণ করতে জানে। সর্বস্বান্ত হয়েও তারা নিজেদের আচরণে কথায় তা প্রকাশিত হতে দেয়না। কিন্তু জুয়াড়িরা তাদের পরিবার পুত্র-কন্যাদের সময় দিতে পারে না কারণ জুয়া খেলা হয় রাত্রে। সুতরাং আমিও আমার বাবাকে খুব একটা কাছে পাইনি। বাবা আমাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বড় বড় বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিত। জুয়াড়ির মেয়ের পক্ষে বোর্ডিং স্কুলে ঢোকা সহজসাধ্য ছিল না। তাই বাবা শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারী হিসাবে পরিচয় দিত। শেয়ারবাজারের জুয়া খেলা সমাজের চোখে অন্যায় নয় কিন্তু জুয়ার টেবিলে মাঝরাতে জুয়াখেলা সমাজের কাছে একেবারেই গ্রহনযোগ্য নয়। বাবা কোনওদিন আমাকে ছোট বা মাঝারি মাপের বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করতে চাইত না। আর আমার পক্ষেও ঐসব বড়লোকদের নাকউঁচু ছেলে মেয়েদের সঙ্গে ওঠাবসা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ত। তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কী ভাবে কে জানে বাবার আসল পরিচয় জানাজানি হয়ে যেত আর আমাকে স্কুল ছাড়তে হত। আমিও বাবার কিছু গুণ রপ্ত করেছিলাম। আমার মুখচোখে আমার অনুভূতির কোনও প্রকাশ হতনা। বন্ধুত্বের কোনওরকম তোয়াক্কা করতাম না আমি কারণ আমি বড়লোক হবার ভাণ করতে পারতাম না। এমনি করে স্কুলের পড়া শেষ করে আমি নিজে রোজগারের পথ খুঁজতে আরম্ভ করলাম। পেশাদারি মডেলিং এর কাজ করে বেশ কিছু পয়সা উপার্জন হল আমার। ইতিমধ্যে বাবা কাঠমান্ডুতে চলে গিয়ে কয়েকজন মিলে একটা কোম্পানি বানিয়ে একটা সম্পত্তি কিনে সেখানে একটা মাঝারি মাপের হোটেল বানিয়ে আমাকে কাঠমান্ডুতে চলে আসতে বলল। কিন্তু আমি যা ভেবেছিলাম তা হলো না। বাবা সারারাত বাইরে থাকতো। সকালে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ত। দুপুর তিনটের সময় ঘুম থেকে উঠতো। আবার সন্ধ্যে হতে না হতেই বেরিয়ে যেত। ইতিমধ্যে সম্পত্তির দাম বাড়তে থাকল। দেখলাম আমাদের হোটেলের পাশের বড় জমিটা কিনল একদল লোক। তারা আমাদের হোটেলটা কিনতে চাইল। শুনলাম ঐ জমিদু’টো একত্র করে ওরা নাকি সুইমিং পুল, নাইট ক্লাব সমেত বিশাল পাঁচতারা হোটেল বানাবে। বাবা বিক্রি করতে রাজি ছিল কিন্তু দামে পোষাচ্ছিল না। খবর পাওয়া গেল যারা জমিটা কিনতে চাইছে তারা প্রভাবশালী সমাজবিরোধী। বাবা তাদের কাছে অনেক দাম চেয়ে বসল। ওরা ক্ষেপে গেল। নানারকম ভাবে বাবাকে ভয় দেখাতে শুরু করল।বাবা ওদের পাত্তা না দিয়ে একটা বিশাল অঙ্কের টাকা চেয়ে চেপে বসে রইল। ওটাই ছিল বাবার দিক থেকে মারাত্মক রকমের ভুল।

পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন’ ওরাই কি আপনার বাবাকে খুন করেছিল?’

রেবা বলল,’ আমি জানিনা।কেউ জানে না। বাবা খুন হয়েছিল এবং তাতে অন্য বিনিয়োগকারী যারা ছিল মানে বাবার পার্টনারেরা ভয় পেয়ে গেল। তারা যে কোনও দামে তাদের অংশ বিক্রী করে দিতে রাজি ছিল। কিন্তু বাবার মৃত্যুতে ঐ লোকগুলোর কোনও লাভ হল না।

-তারপর কী হল?

-আমি উত্তরাধিকারসূত্রে চল্লিশ শতাংশ পেলাম।বাকি ষাট শতাংশ রইল অন্য চারজন পার্টনারের কাছে, প্রত্যেকের পনের শতাংশ। আমার কাছে যখন বাবার মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছলো আমি একেবারে ভেঙে পড়লাম। প্রথম ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই একজন লোক মালিকানা অর্জন করার পদ্ধতি শুরু করে দিল।বাকি চারজনের মধ্যে তিনজন ঐ লোকগুলো যা দাম দেবার প্রস্তাব দিয়েছিল তাতেই রাজি হয়ে গেল। বাবার মৃত্যুর আগে থেকেই আমার কালীকৃষ্ণের সঙ্গে আলাপ ছিল এবং মাঝেমাঝেই আমাদের যোগাযোগ হত।

সুন্দরী জিজ্ঞাসা করল,’ ছোটকালী?’ রেবা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল,’ কিছু বললেন?’ পানু রায় বললেন,’না, না। কিছু নয়। আপনি বলুন।

রেবা বলতে থাকল,’ আমি কালীকৃষ্ণের বাবার মধ্যে বিশেষ কিছু দেখতাম। উনি ঠিক আর পাঁচজনের মত নয়। বাবার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই উনি আমার সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইলেন এই ব্যাপারে আমি কী জানি। আমি যা জানি বললাম। কালীকৃষ্ণের বাবা আমার আগেই আন্দাজ করেছিলেন যে অন্য পার্টনারেরা যা দাম পাবে তাতেই তাদের অংশ বিক্রী করে দেবে। তিনি ঐ অদৃশ্য বিনিয়োগকারীকে হারিয়ে দেবার জন্য বেশি দাম দিতে চাইলেন কিন্তু ততক্ষণে তিনজন অংশীদার তাদের অংশ বিক্রী করে দিয়েছে। কালীকৃষ্ণের বাবা চতুর্থজনের কাছ থেকে পনের শতাংশ কিনে নিলেন। এখন পরিস্থিতি এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। কালীকৃষ্ণের বাবা অর্থাৎ কৃষ্ণকালীবাবুর কাছে পনের শতাংশ এবং আমার কাছে চল্লিশ শতাংশ। এখন নতুন একদল লোক পুরো একশ শতাংশ কেনার চেষ্টা করছে।

পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ আপনি কী করতে চান?’

রেবা বলল,’ আমি বিক্রী করতে চাই। কিন্তু আমি চাইনা এরা বাবাকে খুন করে সস্তায় আমার অংশ কিনে নিক।বাবার জীবন গেছে। আমি চাইনা এই লোকগুলো বাবার মৃত্যুর কোনও সুযোগ নিক এবং লাভবান হোক।‘

পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ আর কিছু বলবেন?’

রেবা বলল,’ হ্যাঁ, আরও একটা বিষয় বলার আছে।‘

-বলুন

-একজন লোক যাকে আমি পাখিবাবু বলে উল্লেখ করব সে এই শহরে আছে। বলা বাহুল্য পাখিবাবু ওনার আসল নাম নয়। আমি জানিনা পাখিবাবু ঐ নতুন দলটার প্রতিনিধি কি না কিন্তু আমি পাখিবাবুকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। যখন আমি কাঠমান্ডুতে মডেলিং করতাম তখন থেকেই চিনি। আমি এটুকু জানতাম যে বাবার মৃত্যুর পরে পরেই যখন অন্য তিনজন পার্টনার চরম আতঙ্কিত অবস্থায় ছিল তখন একজন লোক নগদ টাকার বিনিময়ে তাদের অংশ লিখিয়ে নিয়ে চলে যায়। তাকে তারপর আর কেউ দেখেনি। আমি কয়েকদিন আগে পর্যন্ত এটাই জানতাম। এখন জানলাম পাখিবাবু ঐ অংশগুলো নিজের নামে সরকারি খাতায় নথিবদ্ধ করতে চায় এবং দু’দিন আগে আমাকে ফোন করে বলে যে সে আমার এবং কৃষ্ণকালীবাবুর অংশ কিনে নিতে আগ্রহী এবং আমাকে কাল রাত্রি ৮-৩০এ তার সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানিয়েছে।

-আপনি কী করতে চান?

-আমি কৃষ্ণকালীবাবুর সঙ্গে দেখা করে জানতে চাই তিনি রাজি আছেন কি না। আমি চাই উনি এবং আমি একসঙ্গে বিক্রী করি তা না হলে আমার অংশ আগে কিনে নিলে নিয়ন্ত্রণ পাখিবাবুর হাতে চলে যাবে এবং সে ক্ষেত্রে কৃষ্ণকালীবাবুর অনেক লোকসান হয়ে যাবে। আমি কৃষ্ণকালীবাবুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু উনি দেশের বাইরে।ওনার সেক্রেটারি আমাকে সহ্য করতে পারে না এবং আমাকে কোনওরকম ভাবেই সহযোগিতা করছে না।

-ওনার ছেলে কালীকৃষ্ণ কী বলছে? সে কি জানে তার বাবা কোথায়?

-কালীকৃষ্ণ শহরে নেই। ফোন পাওয়া যাচ্ছে না।

-আমার মনে হয় কৃষ্ণকালী ঐ লোকটার সঙ্গে আপনার দেখা করার ব্যাপারটা পছন্দ করবেন না। উনি সম্ভবত চাইবেন আমি পাখিবাবুর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করি।

-আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার কাছে এটা আমরা বাবার সম্মানের ব্যাপার। আমি সেইখানে শুরু করতে চাই যেখানে আমার বাবা শেষ করে গেছে।

-আপনি চান আপনার বাবার খুনী ধরা পরুক?

-অবশ্যই, এবং সেটাই আপনার কাছে আসার অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

- বলুন সে ব্যাপারে যা যা বলতে চান।

-আপনি আমার চেয়ে ভাল জানেন যে এই ধরণের জমিজমাসংক্রান্ত খুনখারাপির ব্যাপারে পুলিশ অনেক বড় বড় কথা বলে। সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এই শহরের শান্তিরক্ষাকারীরা যে এইসব গন্ডগোল একদম সহ্য করবে না সে কথা সকলকে জানায় এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে কয়েকদিনের মধ্যেই খুনের তদন্তের নিষ্পত্তি হবে এবং খুনী উপযুক্ত শাস্তি পাবে। কিন্তু আজ অবধি আমি একটাও খুনের তদন্ত শেষ হতে দেখিনি । একবার শুধু হয়েছিল যেখানে একটা ভুল লোককে খুনী বলে ধরে আনা হয়েছিল।

- তাহলে আপনি আমার কাছ থেকে কী চান?

-আমার অংশীদারত্ব বিক্রীর কাজটা শেষ হলে আমি চাই আপনি আমার বাবার খুনে ব্যাপারটা দেখুন। আমি চাই আপনি কিছু সূত্র বের করে সেটা পুলিশের হাতে দিন যাতে বাকি কাজটা তারা করতে পারে। সূত্রের সন্ধান এবং ব্যাখ্যা করার কাজটা পুলিশের দ্বারা হবে না। ওটা যদি দয়া করে আপনি করেন।

-গোয়েন্দা এবং পুলিশের মধ্যে সমন্বয়সাধনের জন্য একজন আইনি পরামর্শদাতার কোনও প্রয়োজন নেই। পুলিশ যাতে খুনের তদন্তের নিষ্পত্তি করতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্য আমাকে নিয়োগ করার কোনও প্রয়োজন নেই।

-কিন্তু পুলিশ নিজে নিজে আজ অবধি কী করতে পেরেছে?

-আমি জানি না।

-কেউ জানে না।

-আপনি কি মনে করেন যে আপনার পরিচিত এই পাখিবাবু আপনার বাবার খুনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে?

-থাকতেই পারে এবং তার সম্ভাবনা প্রবল।

-সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় আপনি নিজে কথা না বলে কৃষ্ণকালীকে এ ব্যাপারে কথা বলতে দিন।

-আপনি হয়ত জানেন না যখন কৃষ্ণকালীবাবু ওনার পনের শতাংশ কেনেন তখন ভেবেছিলেন আমি ওনার পুত্রবধূ হব এবং আমাদের বিবাহের উপহার হিসাবে এই পনের শতাংশ উনি আমাকে দেবেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পালটে গেছে।

-আপনার সঙ্গে আমি কী করে যোগাযোগ করতে পারব?

-আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না। আমি আপনার সঙ্গে কাল সকাল দশটায় যোগাযোগ করতে পারি?

পানু রায় একবার সুন্দরীর দিকে তাকালেন। বললেন,’ ঠিক আছে। কাল সকাল দশটায়।‘

রেবা সুন্দরীকে জিজ্ঞাসা করল,’আমি কি পিছনে বেরোবার দরজা দিয়ে বেরুবো?’

পানু রায় বললেন, ‘হ্যাঁ’। রেবা দরজা খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে পানু রায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’ কাল কথা হবে। এরমধ্যে দয়া করে যদি কৃষ্ণকালীবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন তাহলে ভীষণ উপকার হয়।‘রেবা কৈরালা বেরিয়ে গেল।দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

পানু রায় বললেন,’ সুন্দরী, আমার মনে হয় না এই মহিলার সঙ্গে জুয়া খেলা ঠিক হবে।‘

সুন্দরী মুচকি হেসে বলল,’দাদু, এতক্ষণ কী খেলছিলে তাহলে?’

পানু রায় বললেন,’ জানি না। আমার মনে হয় এখন আমার বড়কালীর নতুন সেক্রেটারির কাছে যাওয়া উচিৎ। দেখি কোনও নতুন খবর পাওয়া যায় কি না?

সুন্দরী বলল,’ দাদু, রেবা যদি নিজের অংশ বিক্রী করে দেয় এবং তাতে যদি বড়কালী রাজি হয়ে যায় তাহলে কি তুমি ঐ খুনের ব্যাপারটায় মধ্যস্থতা করতে রাজি হবে?

-আমি জানি না, সুন্দরী। সবটাই নির্ভর করবে পরিস্থিতির ওপর। তবে আমার মনে হয়না সে ব্যাপারে আমাকে ওর খুব একটা দরকার লাগবে।

-দাদু, আমার কিন্তু ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না। আমার কেমন যেন বারবার মনে হচ্ছে এই ব্যাপারটায় তোমার না জড়ানোই ভাল।

পানু রায় হেসে বললেন,’ এখনই এত দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আপাতত এলিনা রাইএর সঙ্গে দেখা করে নতুন কিছু জানতে পারি কি না দেখি। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।‘