Next
Previous
Showing posts with label গল্প. Show all posts
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in

পর্ব-২২

বণিকের মানদন্ড দেখ দিল রাজদণ্ডরূপে

(সময়ানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত বিবরণী)-তৃতীয় অংশ

মারাঠা রাজ্যে তখন পাঁচ সর্দারের মধ্যে তীব্র অন্তর্কলহ। এই পাঁচ সর্দাররা যথাক্রমে পুনার পেশোয়া, নাগপুরের ভোঁসলে, গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া ,ইন্দোরের হোলকার এবং বরোদার গায়কোয়াড়। সর্দারদের অভ্যন্তরীণ কলহে দীর্ণ মারাঠা রাজ্যের অবস্থা তখন শোচনীয় বলা যেতে পারে। নানা ফড়নবীশ পেশোয়াকে কার্যত ক্ষমতাহীন করে রেখেছে তখন।১৭৯৫ সালে তৎকালীন পেশোয়া মাধবরাও নারায়ণ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে মাত্র ২১ বছর বয়সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সমস্যায় সমগ্র মারাঠা রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নতুন পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাও নানা ফড়নবীশের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টা করতে থাকে। এইসময় ১৮০০ সালে নানা ফড়নবীশ পুনাতে দেহত্যাগ করে এবং মারাঠা রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছয়।দৌলত রাও সিন্ধিয়া তখন পেশোয়াকে সমর্থন করলেও হোলকারের সৈন্যসামন্ত মালওয়া অঞ্চলে ব্যাপক লুঠতরাজ চালাতে শুরু করে দিল।নিরুপায় পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাও অগত্যা ইংরেজদের শরণাপন্ন হলো। ওয়েলেসলি ইতিমধ্যে ভারতে এসে গেছে এবং ভারতীয় রাজ্যগুলির প্রতি ব্রিটিশদের মনোভাব অনেকটাই পাল্টে গেছে। হায়দ্রাবাদের নিজাম ইংরেজদের সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতার শর্তাবলী মেনে নিয়েছে। সাবসিডিয়ারি অ্যালায়েন্স বা অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির মূল কথা হল যে— কোন দেশীয় রাজ্যের রাজা ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবেন । দেশীয় রাজাদের অভ্যন্তরীণ অধিকার ক্ষুন্ন না করে তাঁদের নিজেদের অধীনে রাখাই হল অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির মূল কথা । কোনো দেশীয় রাজা এই নীতি গ্রহণ করলে তাঁকে কতকগুলি শর্ত পালন করতে হত, যেমন—

১) অধীনতামূলক মিত্রতায় আবদ্ধ দেশীয় রাজাগুলিকে কোম্পানির বশ্যতা স্বীকার করতে হত ।

২) সংশ্লিষ্ট দেশীয় রাজ্যগুলিতে একদল ইংরেজ সৈন্য এবং একজন ইংরেজ রেসিডেন্ট রাখতে হত ।

৩) সৈন্যবাহিনীর ব্যয়নির্বাহের জন্য মিত্রতাবদ্ধ রাজ্যকে নগদ টাকা বা রাজ্যের একাংশ ছেড়ে দিতে হত।

৪) কোম্পানির বিনা অনুমতিতে অপর কোনো শক্তির সঙ্গে মিত্রতা বা যুদ্ধবিগ্রহ করা যেত না । অর্থাৎ মিত্র রাজ্যগুলির বৈদেশিক নীতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নির্ধারণ করত ।

৫) চুক্তিবদ্ধ রাজ্যে ইংরেজ ছাড়া অন্যান্য সমস্ত ইউরোপীয়কে তাড়িয়ে দিতে হত ।

৬) এই সব বশ্যতার বিনিময়ে কোম্পানি সেই রাজ্যকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, বৈদেশিক আক্রমণ এবং অন্যান্য বিপদ থেকে রক্ষা করত ।

হায়দ্রাবাদ এবং মাইসোরের পর মারাঠাদের মুখোমুখি হবার সুযোগ পেয়ে গেল ব্রিটিশ। ১৮০২ সালে হোলকাররা যখন পেশোয়াকে পর্যুদস্ত করে এবং পুনাতে ব্যাপক লুন্ঠন শুরু করলো তখন পেশোয়া ভাসাই পালিয়ে গিয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষর করে কার্যত ব্রিটিশদের অধীনতা স্বীকার করে নিল। সুরাত দিয়ে দেওয়া হল কোম্পানিকে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাওকে পুনার সিংহাসনে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করলো ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। কিন্তু মারাঠাদের স্বাধীনতা খর্ব করা গেল না। আসলে এখান থেকেই শুরু হলো দ্বিতীয় ব্রিটিশ-মারাঠা যুদ্ধের। মারাঠা রাজত্ব কুক্ষিগত করার জন্য হোলকার অন্য সর্দারদের সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টা শুরু করে দিল। অন্যদিকে ওয়েলেসলি এবং লেক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়লো। প্রায় দু’বছর যুদ্ধের পর ১৮০৫ সালে মারাঠা রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলকে এবং মারাঠা অধিকৃত অন্যান্য অঞ্চলকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে সক্ষম হলো ওয়েলেসলি। রাজপুত, জাঠ, রোহিল্লা এবং উত্তর মালওয়ার বুন্দেলারাও ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রনে এসে গেল। সিন্ধিয়ারাও দিল্লি, আগ্রা, গুজরাট এবং অন্যান্য মারাঠা অঞ্চলকে অধীনতামূলক মিত্রতার আওতায় নিয়ে আসতে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু এতসব কিছু করার পরেও মারাঠা শক্তিকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করা গেল না। বিদ্রোহের আগুন জ্বলতেই থাকলো সর্দারদের মধ্যে।

অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যয়ভার বহন করতে সক্ষম না হয়ে ব্রিটিশ সরকার ওয়েলেসলিকে ১৮০৫ সালে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। নতুন গভর্নর জেনারেল হয়ে আবার এলো কর্নওয়ালিশ। তাকে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া হলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার জন্য। এই সুযোগে হোলকার এবং সিন্ধিয়ারা মালওয়া এবং রাজস্থানের গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক লুন্ঠন চালু করে দিল। এভাবেই চলতে থাকলো যতক্ষণ না ১৮১৩ সালে হেস্টিংস ভারতবর্ষে এল নতুন গভর্নর জেনারেল হয়ে। হেস্টিংস এসেই সর্বপ্রধানত্বের নীতি চালু করে। প্যারামাউন্টসি বা সর্বপ্রধানত্বের নীতি অনুযায়ী কোম্পানিই হচ্ছে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এবং এই ক্ষমতাকে রক্ষা করার জন্য কোম্পানি যে কোনও রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং প্রয়োজনে সেই রাজ্যকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দিতে পারে। এইসময় পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাও আর একবার সর্দারদের সংগঠিত করে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের শেষ চেষ্টা করে। শুরু হয় তৃতীয় ব্রিটিশ মারাঠা যুদ্ধ (১৮১৭-১৯)। এই যুদ্ধে হোলকার এবং পিন্ডারিরা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ব্রিটিশরা পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাও এর অধীনস্থ সমস্ত অঞ্চল নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসে এবং পেশোয়া প্রথা চিরতরে বিলুপ্ত করে দেয়। ভোঁসলে এবং হোলকারদের নিয়ন্ত্রনে থাকা বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধীনতামূলক মিত্রতার আওতায় নিয়ে এসে মারাঠা রাজ্যজয় সম্পূর্ণ করে ব্রিটিশরা।

ইতিমধ্যে উত্তর ভারতেও বিভিন্ন অঞ্চল দখলের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। বক্সারের যুদ্ধ এবং এলাহাবাদ চুক্তির পরবর্তী পর্যায়ে অবধ একটি নিরপেক্ষ রাজ্য হিসাবে ব্রিটিশ অধ্যুষিত বাংলা এবং রাজনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত উত্তর ভারতের মধ্যে অবস্থান করছিল। মারাঠাদের হাত থেকে অবধকে রক্ষা করার অছিলায় ব্রিটিশেরা ১৭৭৩ সালে অবধের দরবারে নিজেদের প্রতিনিধি এবং পাকাপাকি ভাবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নিয়োগ করে। এই প্রতিনিধি এবং সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার বহন করার দায়িত্ব নিতে হয় নবাব সুজাউদ্দৌল্লাকে। এই ব্যয়ের পরিমাণ ক্রমশ বাড়াতে থাকে ব্রিটিশেরা। ব্রিটিশদের এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য করবৃদ্ধি করতে বাধ্য হয় নবাব সুজাউদ্দৌল্লা। করবৃদ্ধির ফলস্বরূপ তালুকদারদের সঙ্গে সংঘাত বাঁধে নবাবের এবং অবধে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতার অজুহাতেই পরবর্তীকালে অবধ দখল করে নেয় ব্রিটিশ। ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭৪ সালে গভর্নর জেনারেল হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয় যে খরচের সমপরিমাণ রাজস্ব ব্রিটিশরা নিজেরাই আদায় করে নেবে এবং তার জন্য অবধ রাজ্যের কিছু কিছু অঞ্চল তারা অধিগ্রহণ করবে। মাইসোরের যুদ্ধ এবং ফরাসিদের মোকাবিলায় বিপুল অর্থব্যয়ের কারণে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ে ব্রিটিশদের। সেইসময় অবধের নবাব বেনারসের উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছিল। অবধের হাত থেকে বাঁচানোর নামে এই টাকা আদায়ের জন্য বেনারসের রাজা চৈত সিং এর উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে ব্রিটিশেরা। ব্রিটিশদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে অবশেষে ১৭৮১ সালে ব্রিটিশদের কাছে বেনারসকে গচ্ছিত রাখতে বাধ্য হয় চৈত সিং। ১৭৭৫ সালে নবাব সুজাউদ্দৌল্লার মৃত্যু হয়। সুজাউদ্দৌল্লার বিশাল সম্পদের অধিকারী হয় তার স্ত্রী বেগম উম্মত উজ জাহারা। হেস্টিংসের নির্দেশে ব্রিটিশদের কাছে প্রয়াত সুজাউদ্দৌল্লার ধার মেটানোর জন্য তার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ মাসোহারা আদায় করতে শুরু করে ব্রিটিশরা। অবধ অধিগ্রহণের পরিকল্পনা ব্রিটিশদের দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। ১৮০১ সালে ওয়েলেসলি এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করে যখন নবাব ওয়াজির আলি খান ব্রিটিশদের চাহিদা মেটোনোর অক্ষমতার কথা সর্বসমক্ষে জানায়। অবশ্য এই অধিগ্রহণের পিছনে অন্যান্য কারণও ছিল। এলাহাবাদ চুক্তির পর নবাব সুজাউদ্দৌল্লা বারবার কোম্পানির কাছে অভিযোগ জানিয়েছিল যে কোম্পানিকে দেওয়া করমুক্ত বাণিজ্যের অধিকারের ব্যাপক অপপ্রয়োগ ঘটাচ্ছে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা এবং তাদের ভারতীয় গোমস্তারা তাদের নিজেদের ব্যবসার জন্য। কোম্পানির অধিকর্তারা এব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেনি।এছাড়াও সমুদ্রপথে বাণিজ্যের জন্য তখন অবধ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। অষ্টাদশ শতাব্দির শেষদিকে লন্ডনে নীলের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই চাহিদার শতকরা ষাট ভাগ আসত অবধ থেকে। অবধের তুলো চিনা বাজারে বিক্রি করা হতো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভারসাম্য ব্রিটিশদের অনুকূলে রাখার জন্য। সুতরাং ১৭৮৮ সালে কর্নওয়ালিশের সঙ্গে অবাধ এবং মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া সত্ত্বেও রপ্তানির উপর নবাবের কর চাপানোর সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবেই অনভিপ্রেত এবং যথেষ্ঠ বিরক্তির কারণ ছিল। সুতরাং অধিগ্রহণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো যখন ওয়েলেসলি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায় সঙ্গে নিয়ে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছলো।

অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে প্রথম হস্তক্ষেপ করার সুযোগ এল ১৭৯৭ সালে সুজাউদ্দিন এর উত্তরসূরী নবাব আসাফুদ্দৌল্লার দেহান্তের পর। ব্রিটিশরা তার ছেলের নবাবের আসনের দাবি না মেনে আসাফুদ্দৌল্লার ভাই সাদাত আলি খানকে সিংহাসনে বসাল। মূল্যবাবদ সাদাত আলি খান ব্রিটিশদের বেশকিছু অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের অধিকার এবং কয়েক কিস্তিতে বছরে ৭৬ লক্ষ টাকা ভর্তুকি দেবার প্রতিশ্রুতি দিল। নতুন নবাব বছর বছর টাকা দিতে রাজি হলেও তার শাসনব্যবস্থায় ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে তীব্র আপত্তি জানালো। ব্রিটিশদের আসল উদ্দেশ্য সাধিত হল না। ১৮০১ সালে ওয়েলেসলি নিজের ভাই হেনরিকে পাঠালো সাদাত আলি খানের সঙ্গে ভর্তুকির প্রসঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে। চুক্তির ফলস্বরূপ অর্ধেক অবধ ব্রিটিশদের হাতে চলে গেল। চুক্তি অনুযায়ী এটা ঠিক হলো যে ভর্তুকির টাকা ব্রিটিশরা সরাসরি রাজস্ব হিসাবে রোহিলখন্ড, গোরখপুর এবং দোয়াব থেকে আদায় করে নেবে। বাস্তবে এই তিনটি অঞ্চল থেকে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল প্রায় এক কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা যা ছিল নির্দ্ধারিত ভর্তুকির প্রায় দ্বিগুন। যদিও যুক্তি হিসাবে দেখানো হল যে সাদাত আলি খানের অপশাসন থেকে অবধকে বাঁচাবার জন্য ব্রিটিশরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আসলে এই পদক্ষেপ রাজস্ব এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক চাহিদা ছাড়া আর কিছু নয়। যদিও এই চুক্তি ভর্তুকি আদায় সংক্রান্ত সমস্যার সম্ভাবনা সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করেছিল তবুও ব্রিটিশদের জুলুমের কোনও অন্ত ছিল না। লক্ষ্ণৌ এর ব্রিটিশ রেসিডেন্সি ধীরে ধীরে অবধের ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে উঠতে থাকলো। অর্থ, সামরিক সহযোগিতা এবং নানারকম সুবিধার বিনিময়ে ব্রিটিশরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন দরবার, প্রশাসক এবং জমিদারশ্রেণী তৈরি করে নিল। ক্রমে ক্রমে পরিকল্পিত ভাবে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে নবাবকে কার্যত ক্ষমতাশূণ্য করে দিল ব্রিটিশ রেসিডেন্সি। অবশেষে ১৮৫৬ সালে অপশাসনের অজুহাতে লর্ড ডালহৌসি অবধের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন নিজেদের করায়ত্ত করে নিল। উত্তর ভারত দখল প্রায় শেষ। বাকি রইল কেবল শিখ অধ্যুষিত পাঞ্জাব। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে ১৭৯৫ থেকে ১৭৯৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে রঞ্জিত সিং এর নেতৃত্বে শিখ সম্প্রদায় সংঘবদ্ধ হয়েছিল । রঞ্জিত সিং এর জীবদ্দশায় ব্রিটিশরা পাঞ্জাবের ধারে কাছে আসতে সাহস করেনি। রঞ্জিত সিং এর মৃত্যুর পর পাঞ্জাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। উত্তরাধিকার নিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত এবং যুদ্ধের শুরু হয়। রঞ্জিত সিং দীর্ঘ প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ভারসাম্য সৃষ্টি করে এক পতাকার তলায় সকলকে সমবেত করেছিলেন সেই ভারসাম্য ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে। এই সুযোগে প্রশাসনের অভ্যন্তরে দুর্নীতি বাসা বাঁধতে থাকে। পাঞ্জাবি এবং ডোগরাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং কারদারদের অবাধ লুন্ঠন পাঞ্জাবের অর্থনীতিকে প্রায় ধ্বংস করে দিল। পাঞ্জাবের বিভিন্ন সম্প্রদায় ক্রমাগত একে অপরের থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগলো এবং পরিস্থিতি ক্রমশ ব্রিটিশ হস্তক্ষেপের অনুকূল হয়ে উঠতে শুরু করলো। সংক্ষেপে বলতে গেলে ১৮৩৯ সালে রঞ্জিত সিং মারা যাওয়ার আগে তার ছেলে খড়ক সিংকে উত্তরাধিকার অর্পণ করে যান। খড়ক সিং নিজে দক্ষ প্রশাসক ছিল না এবং বহুলাংশেই তার ডোগরা উজির রাজা ধ্যান সিং এর উপর নির্ভরশীল ছিল। সম্পর্ক প্রথমে ভালো থাকলেও পরবর্তী কালে খড়ক সিং এর ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য ধ্যান সিং রাজদরবারে ডোগরা বিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে। ধ্যান সিং তখন যুবরাজ নাও নিহাল সিং এর সঙ্গে জোট বেঁধে ডোগরা বিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। কিন্তু এই লড়াই বেড়ে ওঠার আগেই ১৮৪০ সালে খড়ক সিং এর মৃত্যু হয়। তার কিছুদিনের মধ্যেই এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় নাও নিহাল সিং এর মৃত্যু হয়। এমতাবস্থায় সিংহাসনের অধিকার নিয়ে পরিবারের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। একদিকে ছয় জীবিত যুবরাজের একজন যুবরাজ শের সিং অন্যদিকে খড়ক সিং এর পত্নী মহারাণী চাঁদ কাউর। তিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে নিহাল সিং এর বিধবা পত্নীর গর্ভস্থ সন্তানের অধিকার দাবি করেন। ডোগরা সম্প্রদায় শের সিং এর প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করে। অন্যদিকে সিন্ধনওয়ালিয়া সর্দারেরা মহারাণীর পক্ষ নেয়। দু পক্ষই সমর্থন চেয়ে ব্রিটিশদের দ্বারস্থ হয়। ব্রিটিশরা নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশেষে ডোগরাদের চক্রান্তে শের সিং সিংহাসনে বসে এবং উজির ধ্যান সিং এর সাহায্য প্রার্থনা করে। কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিছুদিনের মধ্যেই ধ্যান সিং এর ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা হ্রাসের অভিপ্রায়ে শের সিং তার বিরোধীপক্ষের সিন্ধনওয়ালিয়া সর্দারদের সাহায্য প্রার্থনা করে। সিন্ধনওয়ালিয়া সর্দারেরা বৃহত্তর রাজপরিবারের অংশ ছিল।তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সিন্ধনওয়ালিয়া সর্দারেরা ১৮৪৩ সালে শের সিং , শের সিং এর পুত্র এবং রাজা ধ্যান সিংকে হত্যা করে নিজেদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। ধ্যান সিং এর ছেলে রাজা হীরা সিং ডোগরা সেনাবাহিনীর একাংশের সাহায্যে সিন্ধনওয়ালিয়া নেতাদের হত্যা করে রঞ্জিত সিং এর কনিষ্ঠ সন্তান পঞ্চবর্ষীয় দলীপ সিং কে সিংহাসনে বসিয়ে নিজে উজিরের পদে বসে। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ এবং সর্দারদের পারষ্পরিক শত্রুতা বাড়তেই থাকে। ইতিমধ্যে খালসা সেনাবাহিনী নিজেরা ক্ষমতার কেন্দ্রে এসে পাঞ্জাবের রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করতে শুরু করে। শের সিং এর রাজত্বে সেনাবাহিনীর সদস্যেরা ছোট ছোট দল বা পঞ্চায়েত গঠন করে সরাসরি মহারাজের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে। এইসমস্ত পঞ্চায়েতগুলি এখন রাজদরবারে তাদের চাহিদা বাড়াতে থাকে দিনের পর দিন। তাদের চাহিদা না মিটিয়ে হীরা সিং এর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এইভাবে বেশিদিন চলা সম্ভব নয়। সেনাবাহিনীর মধ্যে ডোগরা বিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে এবং ১৮৪৪ সালে হীরা সিং সেনাবাহিনীর বিক্ষুব্ধ অংশের হাতে নিহত হয়। দলীপ সিং এর মা অর্থাৎ রঞ্জিত সিং এর কনিষ্ঠা স্ত্রী মহারাণী জিন্দন রিজেন্ট নিযুক্ত হয় এবং তার ভাই সর্দার জওয়াহির সিং উজিরের পদে বসে। কার্যত এই দুজনেই সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল ছিল। একদিকে খালসা সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক উত্থান এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নিয়ে তাদের পরিকল্পনা এবং অন্যদিকে লাহোরে কোনও স্থায়ী সরকার না থাকায় ব্রিটিশরা পাঞ্জাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশরা পাঞ্জাবকে একদিকে অধিকৃত উত্তর ভারত এবং অন্যদিকে পার্সিয়া এবং আফগানিস্তানের মুসলমান শাসকদের মধ্যে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশরা বুঝতে পারল এই নীতি আর কাজে লাগবে না। ১৮৪০ সাল থেকেই ব্রিটিশরা শিখদের সঙ্গে যুদ্ধের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিল। ১৮৪৩ সাল থেকে ব্রিটিশরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ১৮৪৫ সালের সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর হাতে জওয়াহির সিং এর হত্যার সঙ্গে সঙ্গে লর্ড হার্ডিঞ্জ পাকাপাকি ভাবে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৩ই ডিসেম্বর ১৮৪৫ শুরু হয় ব্রিটিশদের সঙ্গে শিখদের যুদ্ধ। অসফল যুদ্ধ পরিচালনা এবং কিছু সর্দারদের বিশ্বাসঘাতকার জন্য শিখরা এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়। ১৮৪৬ সালে স্বাক্ষরিত হয় অপমানজনক লাহোর চুক্তি। এই চুক্তি অনুযায়ী জলন্ধর দোয়াবের বিলুপ্তি ঘটে, কাশ্মির দিয়ে দেওয়া হয় ব্রিটিশ তাঁবেদার জম্মুর রাজা গুলাব সিংকে। লাহোর সেনাবিহিনীর সৈন্যসংখ্যা কমিয়ে সেখানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বসানো হয়। দলীপ সিংকে সিংহাসনে রাখা হলো কিন্তু অভিবাবকের আসনে বসানো হলো ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে।মহারাণী জিন্দানকে সরানো হল রিজেন্ট পদ থেকে এবং ব্রিটিশ প্রতিনিধির হাতে সমস্ত বিভাগের সমস্ত সিদ্ধান্ত নেবার একচ্ছত্র অধিকার দেওয়া হলো। রাজা এবং রাজমাতার ভূমিকা কেবলমাত্র প্রতীকী হয়ে রইল। যেহেতু ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ছিল পাঞ্জাবকে সামগ্রিক ভাবে নিজেদের করায়ত্ত করা সেইজন্য ১৮৪৯ সালে দ্বিতীয় ব্রিটিশ- পাঞ্জাব যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই বিদ্রোহী মুলতানের গভর্নর দিওয়ান মুল রাজ, আটারিওয়ালার গভর্নর সর্দার ছত্তর সিং এবং তার পুত্র হরিপুরের রাজা শের সিংকে দমন করার অজুহাতে সমগ্র পাঞ্জাব নিজেদের অধিকারে নিয়ে নিল ব্রিটিশরা। ১৮৪৯ সালের ২৯শে মার্চ মহারাজা দলীপ সিং পাঞ্জাবের স্বাধীনতা ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিয়ে পাঞ্জাবকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত করার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হলো। বিদ্রোহী সর্দারদের একে একে ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনও উপায় রইলো না।

উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলগুলিও ক্রমে ক্রমে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রনে আসতে থাকল। কোম্পানি অধিকৃত এই সাম্রাজ্যের নিরাপত্তাজনিত কারণে ব্রিটিশ আগ্রাসন আরও তীব্র আকার ধারণ করলো। ভারতবর্ষের ব্রিটিশ সামরিক আধিকারিকেরা দেশের বাইরে এবং ভিতর থেকে আক্রমণের আশঙ্কায় বিচলিত হয়ে যত্রতত্র সামরিক ক্ষমতাপ্রদর্শনের নেশায় মেতে উঠলো। এই নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কার কারণেই আগ্রাসন সংক্রান্ত ব্রিটিশ সরকারের এবং লন্ডনের কোম্পানি কর্তাদের সমস্ত বিধিনিষেধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ১৮২৩ সালে আমহার্স্ট যখন ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে আসে তখন তার প্রতি নির্দেশ ছিল যে ভারতবর্ষে ব্যয়সাপেক্ষ রাজকীয় যুদ্ধ এবং আগ্রাসনের প্রক্রিয়া বন্ধ করে যেন শান্তির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু ভারতে পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গেই বাঙলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে বর্মা থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠলো। বর্মার রাজশক্তি অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে রাজ্যবিস্তারের উদ্দেশ্যে ক্রমে ক্রমে পেগু, তেনাসেরিম এবং আরাকানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয়। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে মণিপুর, কাছার এবং আসামে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে। এতদিন বর্মার এইসমস্ত কাজকর্মকে কোম্পানির কর্তারা খুব একটা আমল দেয়নি। কিন্তু এখন ব্রিটিশ সামরিকবাহিনী এলাকাদখলের নেশায় উন্মত্ত। তারা যুক্তি খাড়া করলো যে বর্মার এই আগ্রাসন থেকে অভ্যন্তরীণ শত্রুরা সাহস সঞ্চয় করছে। বিপদের সম্ভাবনা সমূলে বিনষ্ট করার জন্য বর্মাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া খুব দরকার। ১৮২৪ সালে শুরু হলো প্রথম বর্মা যুদ্ধ। আসাম, নাগাল্যান্ড এবং বর্মা অধিকৃত আরাকান এবং তেনাসেরিম ব্রিটিশরা দখল করে নিল। ১৮৩০ সালে কাছার এবং ১৮৩৪ সালে বেন্টিঙ্কের আমলে কুর্গও ব্রিটিশদের দখলে এসে গেল। বর্মা যেমন উত্তর-পূর্ব ভারতে তেমনই রাশিয়া ছিল উত্তর-পশ্চিমে ভয়ের কারণ। সুতরাং উত্তর-পশ্চিমেও আগ্রাসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। অকল্যান্ডের নেতৃত্বে ১৮৩৮ থেকে ১৮৪২ অবধি চলে আফগান যুদ্ধ। ১৮৪২ সালে ব্রিটিশরা নিজেদের অনুগত রাজাকে সিংহাসনে বসিয়ে আফগানিস্থানকে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের অধীনে নিয়ে আসে। এলেনবরো ১৮৪৩ সালে সিন্ধ দখল করে। কিন্তু ঔপনিবেশিক আগ্রাসন চূড়ান্ত রূপ নেয় ডালহৌসির সময় (১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত)। ব্রিটিশ প্রবর্তিত স্বত্ববিলোপ নীতির আশ্রয় নিয়ে অনেক রাজ্যকেই সরাসরি নিজেদের আওতায় নিয়ে আসে ডালহৌসি। এই নীতি অনুযায়ী যদি কোনও রাজা কোনও পুরুষ উত্তরাধিকারী না রেখে দেহত্যাগ করে তাহলে সেই সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশদের হাতে সরাসরি চলে আসবে। এই নীতি ব্যবহার করে ১৮৪৮ সালে সাতারা, ১৮৫০ সালে সম্বলপুর এবং বাঘাট, ১৮৫২ সালে উদয়পুর, ১৮৫৩ সালে নাগপুর এবং ১৮৫৪ সালে ঝাঁসি দখল করে নেয় ব্রিটিশেরা। ১৮৫২-৫৩ সালে দ্বিতীয় বর্মা যুদ্ধ জয় করে পেগু দখল করে ব্রিটিশবাহিনী। সেনাবাহিনীর খরচ আদায়ের জন্য ১৮৫৩ সালে হায়দ্রাবাদ থেকে বেরার বিচ্ছিন্ন করে অধিগ্রহণ করে নেয় ব্রিটিশেরা। ১৮৫৭ সালের মধ্যে ভারতবর্ষের ৬৩ শতাংশ অঞ্চল এবং ৭৮ শতাংশ জনগণ সরাসরি ব্রিটিশদের অধীনে চলে আসে। বাকি অঞ্চলগুলি ইংরেজদের অনুগত রাজাদের অনুশাসনেই থাকে। ব্রিটিশরা এইসময়ে সরাসরি অধিগ্রহণের পথ ছেড়ে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নেয়। খাতায় কলমে স্বশাসিত হলেও আসলে এইসমস্ত রাজারা ছিল ব্রিটিশদের তাঁবেদার এবং প্রতি পদক্ষেপে ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপ তাদের একরকম পুতুল করে রেখেছিল।

অবাধ এবং মুক্ত বাণিজ্যের প্রয়োজনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং অধিগ্রহণ শুরু হলেও শেষ অবধি ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত করে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলই হয়ে ওঠে তাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু ভারতবর্ষের মত এক বিশাল দেশকে সম্পূর্ণ নিজেদের অধীনে নিয়ে আসা সহজসাধ্য ছিলনা। সেই সময় নানা কারণে মোগলেরা দূর্বল হয়ে পড়েছিল কিন্তু যে সমস্ত অন্য রাজ্যেরা সেই সুযোগে সিংহাসন দখলের চেষ্টা করছিল তারা কিন্তু খুব একটা দূর্বল ছিল না। প্রচুর সংখ্যক সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র ছিল এই সব রাজ্যের কাছে যদিও আধুনিকতার নিরিখে এই সব অস্ত্রশস্ত্র ব্রিটিশদের চাইতে অনেক নিম্নমানের ছিল। পৃথিবী জুড়ে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তখন বেড়েই চলেছে। সেই কারণে ভারতে অভূতপূর্ব মাত্রায় ব্রিটিশ সৈন্যের সংখ্যা বাড়তে থাকলো। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো এই সময় ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে ভারতীয়দের ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে নিযুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিল। ব্রিটিশ অফিসারদের দ্বারা প্রশিক্ষিত নতুন সেনাবাহিনী ব্রিটিশদের প্রতিপক্ষ রাজ্যগুলিকে শায়েস্তা করার কাজে নিযুক্ত করা হলো। এই বিশাল সেনাবাহিনীর সাহায্যে ব্রিটিশরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলো এবং অধীনতামূলক মিত্রতার অধীন রাজ্যগুলির থেকে আর্থিক চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো। বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য সীমান্ত সুরক্ষিত রাখা ব্রিটিশদের কাছে আবশ্যিক হয়ে উঠেছিল। সীমান্ত সুরক্ষিত রাখার জন্য সরাসরি রাজ্য দখল করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। চলতে থাকলো একের পর এক রাজ্য দখলের যুদ্ধ। রাজস্বের বেশিরভাগ অংশই খরচ হয়ে যেত যুদ্ধে এবং সেনাবাহিনীর ভরণপোষণে। পরিকল্পিত ভাবে অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃশত্রুর থেকে আক্রমণের আশঙ্কা সৃষ্টি করে এই বিপুল সেনাবাহিনীকে সবসময়ে যুদ্ধে নিযুক্ত রাখা হতো।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল অর্থ এবং রসদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে তাদের প্রতিপক্ষ রাজ্যগুলির থেকে এগিয়ে থাকা। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সৈন্যদের খাওয়া, থাকা এবং নিয়মিত বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা কোনও কার্পণ্য করতো না। এছাড়াও ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশীয় রাজাদের চাইতে ব্রিটিশদের বেশি বিশ্বাস করতো। প্রয়োজনে ব্যাঙ্কগুলির থেকে টাকা ধার পেতে ব্রিটিশদের কোনও অসুবিধে হতো না। যেহেতু রাজ্যগুলিকে সরাসরি দখল করে রাজস্ব আদায় ব্রিটিশরা নিজেরাই করতে থাকল সেইজন্য ব্যাঙ্কের উপর নির্ভরতাও ক্রমাগত কমে যেতে থাকলো। পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকা রাজ্যগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে থাকলো। সমস্ত দেশজুড়ে কায়েম হতে থাকলো ব্রিটিশরাজ। রাজ্যশাসন এবং রাজস্ব আদায় দুইই এখন সরাসরি কোম্পানির হাতে । রাজস্ব আদায়, বাণিজ্য এবং সামরিক অভিযান ভারতবর্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের জন্য একইসূত্রে গ্রথিত ছিল।

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংল্যান্ড ছিল বিশ্বের ধনী দেশগুলির অন্যতম। অন্য ধনী দেশগুলি যখন সাম্রাজ্যবিস্তারে ব্যস্ত ব্রিটিশ শাসকেরা যুদ্ধের পথে সাম্রাজ্যবিস্তারের পথে না গিয়ে বিশ্বব্যাপী মুক্ত এবং অবাধ বাণিজ্যের পথ অবলম্বন করে। ব্রিটিশ সরকার দেশের বড় কোম্পানিগুলিকে অন্যদেশে বাণিজ্যবৃদ্ধির অনুমতি দেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে বাণিজ্যবৃদ্ধির অনুমতি পায়। বিনিয়োগ এবং বাজার দখলই ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এই সম্পদবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় সরকার ছিল কোম্পানির অন্যতম সহযোগী। কোম্পানি এবং সরকারের যুগলবন্দী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যবৃদ্ধি এবং সম্প্রসারণের প্রয়োজনে ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত করে। বাজার দখল দিয়ে শুরু করে গোটা দেশকেই দখল করে নেয় ব্রিটিশ।
0

গল্প - রূপশ্রী ঘোষ

Posted in




















‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’। ‘লড়াই করে বাঁচতে চাই’। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ‘সর্বক্ষয়ী দলের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’। ‘এই লড়াই লড়াই লড়াই চাই’। ‘লড়াই করে বাঁচতে চাই’। পাটুলির ফুটপাত দিয়ে একজন মধ্যবয়সী লোক হেঁটে যাচ্ছে আর নিজের মনে একাই এভাবে স্লোগান আওড়ে চলেছে। মধ্যবয়সী লোক, কিন্তু দেখে এক ঝটকায় কুড়ি পঁচিশ বছরের ছেলেও মনে হতে পারে। খুব শান্তশিষ্ট, ভদ্রসভ্য দেখতে। চোখেমুখে লেখাপড়ার ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু দৃষ্টিতে একটা কুটিল কুটিল ভাব আছে। রুহিও ওইপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। সে বারবার একই স্লোগান শুনতে শুনতেই হাঁটছিল। তারপর আর তার কৌতূহল চেপে থাকতে না পেরে একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলল –

এই? আপনি কে? এমন এভাবে একাই মিছিলের মতো স্লোগান দিচ্ছেন? মিছিলে তো প্রথমে একজন বলে, তারপর পিছনের বহুলোক সমস্বরে ওই কথাটাই বলে বা প্রশ্ন হলে তার জবাব দিয়ে একটা গণগর্জন তুলতে তুলতে হাঁটে। আপনি এমন একাই এসব করছ, কী ব্যাপার?


আমার দল সর্বহারা।


মানে? আপনাকে দেখে একটু চেনা চেনা লাগছে। নাম কী?


আমার নাম এক্স।


এক্স? বললেই হল?


কেন? হবে না কেন? এত এক্স ওয়াই ধরে অঙ্ক করলেন আর আমার নাম এক্স শুনেই চিৎকার করছেন? ওইতো আমার এক মেয়ে বন্ধুর নাম ওয়াই। সেও ওই প্রোলেতারিয়েতদের দল করে।


প্রোলেতারিয়েতদের দল? মানেটা কী?


আরে প্রোলেতারিয়েত, প্রোলেতারিয়েত। যাকে বলে সর্বহারা। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ পড়েছেন? পড়লে ওখানে ওই শব্দটা পেতে্ন। আপনারা তো কিছুই পড়েন না। আমরা যারা সর্বহারাদের দল করি, তারা অনেক লেখাপড়া করি।


ও! তা আপনাদের ওই সর্বহারা দলটা সম্পর্কে একটু বুঝিয়ে দেবেন? কী কাজ করেন শুনি।


আরে ওই তো, আমাদের একটা ম্যা-ম্যা-ম্যানুফেস্টো আছে। সেটা পড়ে নেবেন। সব জেনে যাবেন।


অ। তা একটু গুছিয়ে বলতে কী হয়? একা একাই যখন মিছিলের স্লোগান দিতে দিতে হাঁটছেন তখন তো আপনার ... ওই কী বললেন, ম্যানুফেস্টো সম্পর্কে জ্ঞান দিতেও ভালো লাগা উচিত…


হ্যাঁ তা লাগে, তো আমার অত সময় নেই, সংক্ষেপে যা দাঁড়ায় তা হল আমরা প্রতিবাদ করি। খেটে খাওয়া মানুষদের সমান কাজ, সমান অধিকার চাই। দারিদ্র ঘোচাতে চাই।


ও, তাই নাকি? তা সর্বহারাদের দল যখন, তখন কি সব হারিয়েছেন? নাকি আপনাদের দলটাই হারিয়ে গেছে? চেহারা সাজ পোশাক দেখে তো কিছুই হারিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না।


আরে আমার কথা বলছি নাকি? আমি তো সর্বহারা জনগণের কথা বলছি।


ও, তো আপনি কে? প্রতিনিধি?


হ্যাঁ, বলতে পা্রেন।


আর আপনার ওই বন্ধু ওয়াই, সেও?


হ্যাঁ সেও। তার ইনফ্লুয়েন্সেই আমি এই দলটা করি। নাহলে আমি কোনো দলকেই ভোট দিতাম না।


তাই বলুন। কারণ আমি স্কুল কলেজ থেকেই আপনার মুখ চিনি। আপনি ওই ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছেলেটার মতো স্যুটকেশ হাতে নিয়ে, চুলের বাঁদিকে সিঁথি কেটে, ফার্স্ট বেঞ্চে ভালো ছেলেটার মতোই বসে থাকা বলে জানি। কলেজ টলেজেও ওই একইভাবে দেখেছি। কোনোদিন কোনো ইউনিয়নে টিউনিয়নে হাঁটতেও তো দেখিনি। আর এখন একাই হেঁটে হেঁটে একটা মিছিল বানিয়ে ফেলছেন?


আপনি আমায় চেনেন নাকি?


আমি আপনাকে চিনি। কিন্তু আপনারা আমাদের মতো লোককে চেনেন না। কেন বলুন তো?


এটা মগজ ধোলাই। এটা ওয়াই আমাকে শিখিয়েছে।


তা আপনার ওয়াই কি সর্বহারা?


না, সেও সর্বহারা নয়। তার অনেক টাকা পয়সা সম্পত্তি। বিদেশেও থাকে মাঝে। দেশেও অনেক বাড়ি গাড়ি।


ও বাব্বা! অবাক কাণ্ড তো মশাই। এতকিছু সম্পত্তি বাগিয়ে সে কিনা সর্বহারাদের প্রতিনিধি? আপনার কালটিভেট করতে ইচ্ছে হয়নি মশাই? আপনার সম্পর্কে তো অনেক অনেক ভালো ভালো কথা বলত সবাই। আপনি নাকি গোয়েন্দা গল্প সব গুলে খেতেন। তা আমাদের ফেলু মিত্তির আপনার মাথায় ধাক্কা মারেননি? আপনিও ওই দলে ভিড়ে গেলেন? আমি আসলে আপনারই পাড়ার মেয়ে, আর আপনার স্কুল কলেজেই পড়াশুনো। তাই আপনার সম্পর্কে অনেককিছু জানি।


ও তাই নাকি? তা কী কী জানেন?


সেসব পরে হবে। আপনি এখন আপনার ওই সর্বহারা দল নিয়ে বলুন কী কী জানেন। আমি বরং শুনি।


আরে সর্বহারা দল নিয়ে আর শোনার কী আছে, ও তো সবাই জানে। ওরা দুর্নীতি শুরু করেছিল বলে সব হারিয়েছে। আমি বরং শাসক দল নিয়ে বলি। ওদের সম্পর্কে আমার এখন শুনে শুনে অনেক ধারণা হয়েছে।


তা কী ধারণা হয়েছে শুনি…


আরে ওই যে রেলইয়ার্ডে কী সব ঘটল না, সেটার পিছনে কার হাত, কত বড়ো হাত সব ওয়াই আমাকে বলেছে। আর বলেছে ওই দলের প্রধান যিনি তিনি নাকি কোনো নারীকেই সম্মান করেন না।


ও তাই নাকি? তা আমিও শুনেছি বটে। কিন্তু আপনার সম্পর্কেও নাকি ওই একই কথা শোনা যায়…


মানে? আমার সম্পর্কে কেন শোনা যাবে? আমি কি কোনো বড়ো নেতা বা নেত্রী?


না, আপনি নেত্রী নন তো বটেই। আপনি পুরুষ। আপনার নামও এক্স।


তো? তাহলে কী শুনেছেন? আমি বিখ্যাত কেউ নই।


না, মানে খুব বিখ্যাত কেউ নন। কিন্তু আপনি যতটুকু বিখ্যাত হয়েছেন তা ওই কু কেলেঙ্কারি দিয়েই।


মানে? আপনি আমার সম্পর্কে এসব কোথায় শুনেছেন? কী শুনেছেন? এইজন্য আপনি এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন? এসব বলবেন বলে?

এক্স গজগজ করতেই থাকলেন। রুহি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে এক্সকে উস্কিয়ে দিয়ে হনহন করে হেঁটে গেল। আসলে রুহি আর ভূতের মুখে রামনাম সহ্য করতে পারছিল না। একই পাড়ায় থাকার দৌলতে সে তার সম্পর্কে কিছু কেমন কথা জানে। আর বাঙালির স্বভাবেই তো তা আছে। পরচর্চা পরনিন্দা। কিছু ঘটালে কেউ তা শুনবে না এটা হতে পারে না। খবর হাওয়ার থেকে, আলোর থেকে আগে দৌড়োয়। মুখরোচক খবর হলে তো কথাই নেই। রুহি ভাবছে, লোকটাকে ভালো জবাব দেওয়া গেছে। আবার দেবে একদিন। ও খেয়াল রেখেছে ওখান দিয়ে নাকি ওই ভদ্রলোক দুবেলা হেঁটে যায়। কোনো কোনোদিন দুবেলা না হলেও একবেলা তো মাস্ট। অতএব চিন্তা নেই, আবার ধরা যাবে। ভাবতে ভাবতে রুহি নিজের মনে হাঁটতে লাগল। রুহিও কাজ থেকে ফেরার সময় বা যাওয়ার সময় হাতে টাইম থাকলে একটু হেঁটে নেয়। ওভাবে যাওয়া আসার পথেই তার চোখে পড়ে ওই ভদ্রলোকের মিছিল। কিন্তু কোনোকিছুতেই তার কৌতূহল মেটে না। এই যেমন রান্নাঘরে সে যখন কাজ করে জানলা দিয়ে দেখতে পায়, উপরের তলা থেকে নিচের দিকে কী যেন একটা উড়ে গেল। কী উড়ে যায় সে কোনোদিন দেখতে পায় না। তাই সে ভাবে কালো পাখি বা কালো প্লাসটিক প্যাকেট বা কালো কোনো কাপড়ের টুকরো। কিন্তু কালো যে, সেটা সে স্পষ্ট বুঝতে পারে। অন্য কোনো রঙ নয়। কালোই দেখে সে। এই কালো নিয়ে তার ভয় সারা জীবনেও যায় না। ছোটো থেকেই ভাবত, চা খেলে কালো হয়ে যায়, শাক খেলে কালো হয়ে যায়, কালো লোক দেখে ভয় পায়, কালো ছেলে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না, আর অন্ধকারের কালো দেখলে তো কথাই নেই। সে অন্ধকারকে ভয় পায় কালো বলেই। একবার তো শিয়ালদা থেকে রাজাবাজার যাওয়ার সময় বাসে কন্ডাক্টরকে বলেছিল, ‘কালোটাকা আমি নেব না’। গোটা বাস হো হো করে হেসেছিল কিন্তু সে তার ‘কালো আর ময়লা’র ক্যাবলামির তফাৎ করতে পারেনি। রুহি এসব ভাবতে ভাবতেই আবার এক্সের চিন্তা নিয়ে পড়ল। তার মনে হল, ‘আচ্ছা এক্স যে সর্বহারা দলের প্রতিনিধি বলল, কিন্তু সে তো কই সাদা ফতুয়া আর সায়ার মতো বা তার থেকেও বেশি ঢোলা পাজামা পরে হাঁটতে দেখেনি। মনে মনে ভাবল, ‘ছোটোবেলায় তো পুকুর পাড় দিয়ে যে মিছিল হেঁটে যেত তার নেতাদের বেশিরভাগ লোকই ওইরকম সাদা পোশাক পরে হাঁটত। তাহলে কি যুগের সঙ্গে পোশাক বদলে গেল আর দলটার নাম আর এজেন্ডা এক রয়ে গেল’? রুহির এ আর এক সমস্যা। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যেন নিজেই নিজের পেটের ভিতর থেকে টপিক বের করে আর ভাবতে থাকে। এমন ভাবতে ভাবতে সে কতবার ভাত তরকারি পুড়িয়ে ফেলেছে। তবুও তার ভাবা চাই। যা বলা সত্যিই তাই। ভাতের ফ্যান উপচে পড়ে গোটা রান্নাঘর, গ্যাস ওভেন সব নোংরা হয়ে গেল। আবার সবকিছু ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে হবে। এই নোংরা ব্যাপারটাও তার পছন্দ নয়। নোংরা ঘটনা, নোংরা দৃশ্য, নোংরা ছবি…। অবশ্য ও যেগুলো নোংরা ছবি বা ভিডিও ভাবে সেগুলো আসলে অন্যদের কাছে রোম্যান্টিক। ও নিজেই একটু কেমন খুঁতখুঁতে পুরোনো পন্থী। এই নিয়ে সে ঝাড়ও খায় বন্ধুবান্ধবদের কাছে। এই দ্যাখো পুরোনো কথাটা মাথায় আসতেই সে আবার ভাবতে বসল, ‘এক্স কেন সবুজের কালো হাত বলল? সবুজ তো নিজেই পুরোনো। সেই কবে ক্ষমতা থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। ওরাই তো সাফ করে দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। এখন সে দলও তো সর্বহারা। ইনফ্যাক্ট সর্বহারাদের সঙ্গে তারা জোটও তো বেঁধেছিল দু একবার’। এবার রুহি ঠিক করেই নিল, যেভাবে হোক ওই ভদ্রলোককে রাস্তায় পেতেই হবে। নাহলে চলবে না। যা ভাবা তাই করা। যাওয়া আসার পথে রুহিও যেন ওত পেতে বসেছিল, শিকারীর মত। এক্সকে দেখতে পেয়েই সে খপ করে ধরল –

আরে মশাই দাঁড়ান দাঁড়ান। আপনি ওভাবে সেদিন মিছিলে সবুজের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও বললেন কেন? ও তো অনেক পুরোনো দল, সে তো আপনারাই সাফ করেছিলেন…


না, মানে ইয়ে (প্রথমে রুহিকে এড়িয়ে পালাবে কিনা ভাবছিলেন) মানে, মানে আমরা তো প্রথম থেকে ওই দলটাকেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে শিখেছি, পুরোনো অভ্যেস আর কী। আর তাছাড়া ঘাস পাতা জুড়ে বর্তমান দল ক্ষমতায় এলেও আসলে তো শিকড় ওখানেই পোঁতা ছিল। তাই আমরা ওটা থেকে আর বেরোতে পারছি না…


হ্যাঁ তা বুঝলাম মশাই। কিন্তু ওই দল তো এখন আপনাদের মতোই সর্বহারা। আর আপনাদের সঙ্গেই জোট বেঁধে শক্ত পোক্ত একটা দল গড়তে চাইছে। তা আপনারা যে, এই স্লোগান দিচ্ছেন তাতে তাঁদের নেতা নেত্রীরা রাগ করছেন না?


না, মানে আমাদের এখন একটাই লক্ষ্য। এই ক্ষমতাটাকে সরাতে হবে আর ওই হিন্দু দলটাকে আসতে দেওয়া যাবে না। তাই আমরা যা খুশি তাই বললেও ওরা গায়ে মাখছে না। কারণ লক্ষ্য তো এক। তাই লক্ষ্যবস্তুর দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে যেটা ভালো বা যেমনভাবে এগোলে লক্ষ্যে পৌঁছোনো যাবে আমরা সেভাবেই এগোচ্ছি।


ওরা মেনে নিল? এতবড়ো একটা অপবাদ…?


মানবে না কেন? কালো হাত কী ছিল না? কালোই তো ছিল। তাই মানতে বাধ্য। বলুন তো সেই চালে কাঁকর মেশানো থেকে শুরু করে জরুরি অবস্থা হেনতেন আর কী কী শোনেননি বলুন? ওরাও কি অস্বীকার করতে পারবে? পারলে তো ট্যাঁ ফোঁ করত এই স্লোগান নিয়ে …। কেন করছে না তাহলে... এবার আপনিই বুঝুন। আর শুনুন আপনি এমন মাঝে মাঝেই শিকারীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে অ্যাটাক করবেন না তো? আমার ভয় করে আপনাকে দেখলেই?


কেন? ভয়ের কী হল? আমি কি কামড়ে দেব আপনাকে?


না তা নয়, কিন্তু আপনি বড্ড প্রশ্ন করেন। এই এত প্রশ্ন আমার ভালো লাগে না। এত কৈফিয়ত আপনাকে দিতে যাবই বা কেন?


আরে, এ আপনার দোষ নয়। এটা গোটা পুরুষ জাতির দোষ। তারা প্রশ্নে ভয় পায়। বিশেষ করে ব্যক্তিগত প্রশ্নে। আপনিও তো পুরুষ, তাই আপনার ভয় পাওয়াতে আমি অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না


একি? আপনি আবার জাত তুলে কথা বলছেন? আমি তো কই জাত তুলিনি, আমিও যদি নারী জাতি বলে গালাগাল দিই? আপনার ভালো লাগবে?


ভালো লাগা না লাগার কিছু নেই মশাই। আপনারা এখনো গালাগালি, শাপ শাপান্ত, আধিপত্যবাদ চালিয়েই যাচ্ছেন মেয়েদের উপর। আপনারা তো মেয়েজাত বলেই আর রাত হলেই ধরা বাঁধা কোনো নারী না থাকলে সোনাগাছি ছোটেন। আপনাদের কথা ছাড়ুন মশাই। ও না না সোনাগাছি না, আজকাল কী যেন নতুন নাম শুনি, এসকর্ট গার্ল। তা মশাই আপনিও যান নাকি?

এই শুনে তো এক্স আবার রাগে খাপ্পা। আবার গজগজ করতে করতে চলে গেল। নেহাত শান্তশিষ্ট লোক বলে তাই রুহির রেহাই। নাহলে হয়তো কোনোদিন বলে বসত বাড়িতে গুণ্ডা পাঠাব…। যতই হোক রাজনীতি বলে কথা। রুহি মনে মনে ভাবে, এক্স যতই সর্বহারা দলের হয়ে এখন গুণগান করুক না কেন, ওর নিজস্ব কিছু বুদ্ধি সুদ্ধি আছে বলেই মনে হয়। কারণ কখনো সখনো ওদের দলের খারাপ কাজ নিয়ে সমালোচনা করতেও সে শুনেছে। তাদে।।সর্বক্ষয়ী দলের মতোই বহু খারাপ কাজ, বহু দুর্নীতিকে এক্স সাপোর্ট করে না। এইসব ভাবতে ভাবতেই রুহি সর্বহারা দলের খারাপ কাজ এবং দুর্নীতিগুলোর একটা তালিকা তৈরি করে ফেলল। নেক্সট দিন এক্সকে দেখতে পেলেই সে সরাসরি তার মতামত জানবে বলে। দু একদিন সেই তালিকা নিয়ে আসা যাওয়ার পথে এক্সের খোঁজ করল আপন মনে। কোথাও খুঁজে পেল না তাকে। একটু হতাশ হল রুহি। কী ব্যাপার, আর দেখা যাচ্ছে না কেন এক্সকে। সে কি চাকরি ছেড়ে দিল? এ পাড়া থেকে অন্য পাড়া চলে গেল? নাকি অন্য দেশ? সুস্থ হল না তো? নানান উদ্ভট প্রশ্ন রুহির মাথায় ঘুরতে লাগল। লাগারই কথা। সে তো ভেবে রেখেছে দেখা হলেই সর্বহারা দলের দুর্নীতি বিষয়ে তার মতামত জানতে চাইবে। যতক্ষণ না পাচ্ছে উত্তর ততক্ষণ শান্তি নেই। এইসব ভাবনার মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতেই রুহি অফিস গেল। ফেরার পথে সিমেন্ট ব্রিজের নিচে ভিড় হট্টগোল থেকে সেও থমকে গেল। সে দেখল বিভিন্ন দিক থেকে গাড়ির লম্বা জ্যাম। সে এঁটুলি মোড় থেকে হেঁটে ফেরে বলে তার অসুবিধা হয়নি, মোড়ে জটলার কাছে পৌঁছে সেও হতবাক হয়ে গেল। ওখানে একটা বড়সড়ো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। গোটা রাস্তা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। ওখানে মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে বসে এক্স হাউহাউ করে কেঁদে চলেছে। কিছুতেই তাকে কেউ থামাতে পারছে না। কেন কাঁদছে তাও কেউ তার কাছ থেকে বের করতে পারছে না। রুহি ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল। গিয়েই এক্সের কাছে জানতে চাইল,

কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন এমন করে?


(কেঁদেই চলেছে এক্স, কোনো উত্তর নেই)


আরে বলুন কী হয়েছে? গোটা রাস্তা জ্যাম হয়ে গেছে তো। চারদিক পুরো ব্লকড। কী হয়েছে আপনার ? এমন কী হল যে, পুলিশও তোমাকে তুলতে পারছে না? কলকাতার রাস্তায় এমন অ্যাকসিডেন্ট, রক্ত, এমনকি প্রকাশ্যে দিনের আলোয় শুট আউট করে খুনও তো ঘটে থাকে। আপনি কি সবসময় এমন অ্যাক্সিডেন্ট দেখে শোরগোল বাঁধিয়ে দাও নাকি?

রাস্তার এমন বেহাল অবস্থা দেখেই রুহি জোরে জোরে ধমক দিচ্ছিল এক্সকে। তারপর একটা সময় এক্স নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে শুরু করল, ‘এই রক্তই তো সেই রক্ত, যে রক্ত দিয়ে আমার দল, দলের নেতারা বৃদ্ধা মাকে ভাত মেখে দিয়েছিল। এ তো সেই রক্ত। আমি তো এই রক্তের মধ্যে সেই বৃদ্ধা মায়ের যন্ত্রণা দেখছি। আপনারা তো সাধারণ অ্যাকসিডেন্টের রক্ত বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন, ঘটনাটা তাচ্ছিল করছেন, লঘু করে দিচ্ছেন, কিন্তু আমি তো তা পারছি না। যতই আমার দল হোক, আমি যতই সেই দলের প্রতিনিধি হই না কেন, রক্ত দেখলে আমার সেই বৃদ্ধা মায়ের যন্ত্রণা ছাড়া কিচ্ছু আসে না চোখের সামনে। আমি দেখতে পাই দুয়ার ভেসে যাওয়া সেই রক্ত, উঠোন ভেসে যাওয়া সেই রক্ত, মায়ের বুক ভেসে যাওয়া সেই রক্ত… লাল, চারিদিক লাল, কেবল লাল, টুকটুকে লাল রঙ ছাড়া আমি আর কিচ্ছু দেখতে পাই না, লাল, চারিদিক লাল, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত সব লাল…। দুহাত রাঙিয়ে নিয়ে আমরা সর্বহারা…। আমরা রক্তপতাকা, আমরা লড়াই চাই। লড়াই লড়াই লড়াই চাই। লড়াই করে বাঁচতে চাই…’। এক্সের কান্নার তীব্রতা আরও বেড়ে গেল। রুহি রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মুখে আর কোনো কথা নেই, ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে প্রশ্নের তালিকাটা বের করে ছিঁড়ে কুচিয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে দিল…। ধীর, ক্লান্ত পায়ে রুহি আবার হাঁটতে শুরু করল বাড়ির দিকে…। এক্সের মতামত নিয়ে রুহির আর কোনো বক্তব্য নেই!

মোড়ের মাথায় লাল সিগন্যাল। সব গাড়ি দাঁড়িয়ে। মানুষ কিন্তু চলেছে। পায়ে, পায়ে এগিয়ে চলেছে ক্লান্ত, বিষণ্ণ মানুষ। লড়াই করতে করতে তারা আর লড়াই করতে চায় না। বাইপাসে লম্বা যানজটে গাড়ির পর গাড়ির ভিতর, অ্যাম্বুলেন্সের পর অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের ভিতর দিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস পাক খাচ্ছে চারিদিকে।

সিগন্যালের রঙের বদল হচ্ছে না। সব থমকে আছে।
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in








পর্ব-২১

বণিকের মানদন্ড দেখ দিল রাজদণ্ডরূপে
(সময়ানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত বিবরণী)-দ্বিতীয় অংশ


ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেবলমাত্র এই অন্তর্দ্বন্দের সুযোগে নিজেদের ব্যবসা বাড়িয়েছিল তাই নয় তারা এই সুযোগে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টাও করেছিল এবং বেশকিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও পেয়েছিল।এর আর একটা বড় কারণ হলো যে পারস্পরিক সংঘাত আন্তঃরাজ্য ব্যবসার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করছিল। ১৭৮৪ সালে প্রকাশিত পিটসের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট অনুযায়ী যদিও সামরিকখাতে ব্যয় কমানোর উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক ক্ষমতাদখলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল এবং কোম্পানি অধিকৃত অঞ্চলগুলিকে সুরক্ষিত রেখে রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে ব্যবসাবৃদ্ধির উপরে গুরুত্ব আরোপের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু লর্ড ওয়েলেসলি ১৭৯৮ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই এই আইনকে কার্যতঃ খারিজ করে দিল। ওয়েলেসলির একমাত্র লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা দখল। নিজেকে ভারতবর্ষের একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে দেখার স্বপ্ন নিয়েই এদেশে এসেছিল সে। ১৭৯৮ সালে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ইজিপ্ট এবং সিরিয়া আক্রমণ এবং অধিগ্রহণের চেষ্টা ওয়েলেসলিকে সাহায্য করেছিল ব্রিটিশ সরকারকে ভারত অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে তার সঙ্গে সহমত হবার জন্য। যদিও কারণ হিসাবে ফ্রান্সের ভারত আক্রমণের সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছিল ওয়েলেসলি কিন্তু সে নিজে বিশ্বাস করতো যে ইজপ্ট থেকে স্থলপথে অথবা কেপ অফ গুড হোপের দিক থেকে জলপথে ফ্রান্সের ভারত আক্রমণের কোনও সম্ভাবনা সেই সময় ছিল না। কিন্তু ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারে অনীহাকে মাথায় রেখে ওয়েলেসলি ‘সাবসিডিয়ারি অ্যালায়েন্স’ প্রথা প্রস্তাব করে যাতে বলা হয় কোম্পানি কেবলমাত্র রাজ্যগুলির অভ্যন্তরীন ব্যাপারে নিজেদের নিয়ন্ত্রন কায়েম করবে কিন্তু রাজ্যগুলির রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেবে না। ওয়েলেসলির ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা চরিতার্থ করতে ভারতে কর্মরত অন্যান্য ব্রিটিশ আমলারাও সহযোগিতা করেছিল। অনেক ঐতিহাসিক বলে যে ওয়েলেসলি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ভারতের ব্যবসা করার পরিবেশ অনুকূল করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল যে আবশ্যিক সে কথা নানাভাবে প্রমাণ করতে চেয়েছে। যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত তখন সেটাকে ভয়ঙ্কর বলে আবার যখন পরিস্থিতি শান্ত তখন সেখানে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে ব্রিটিশ সরকারকে বিপথে চালিত করেছিল ওয়েলেসলি। তবে ব্রিটিশ সরকারের গন্যমান্য ব্যক্তিরা এতটা নির্বোধ ছিলনা যে তারা কিছু না ভেবে ওয়েলেসলির এই কর্মকান্ডে মদত দিয়েছিল। অন্য কোনও ইউরোপিয়ন শক্তি যেন কোনওভাবেই ভারতবর্ষ দখল করতে না পারে তার জন্য ওয়েলেসলিকে সবরকম মদত দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। এই যুদ্ধের খরচ যোগাতে যখন ভাঁড়ারে টান পড়লো তখন ওয়েলেসলিকে দেশে ফিরিয়ে নিল ব্রিটিশ সরকার। সেটা ছিল ১৮০৫ সাল।

এই প্রেক্ষাপটে বুঝতে অসুবিধা হয়না কেন মাইসোরে হায়দার আলি এবং টিপু সুলতানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্রিটিশদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়েছিল। দাক্ষিণাত্যে ব্রিটিশদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো। ওদিকে মাইসোরের সীমানা উত্তরে কৃষ্ণা এবং পশ্চিমে মালাবার উপকূল অবধি এগিয়ে গেল। সুতরাং প্রতিবেশী রাজ্য মূলতঃ হায়দ্রাবাদ এবং মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো। এই রাজ্যগুলি প্রায়শই ব্রিটিশদের সাহায্য নিয়ে নিজেদের বাঁচাবার চেষ্টা করতো। ব্রিটিশরা আতঙ্কিত হত এই ভেবে যে মাইসোরের পিছনে ফরাসিদের সমর্থন আছে। কিন্তু এই আতঙ্ক অযৌক্তিক ছিল। মালাবার উপত্যকায় ব্যবসার ক্ষেত্রে মাইসোরের নিয়ন্ত্রন ব্রিটিশরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। গোলমরিচ এবং এলাচের ব্যবসা ছিল মাইসোরের নিয়ন্ত্রনে। ১৭৮৫ সালে টিপু সুলতান গোলমরিচ, এলাচ এবং চন্দনকাঠের আমদানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৭৮৮ সালে টিপু সুলতান ব্রিটিশদের ব্যবসা করার অনুমতি প্রত্যাহার করে নেয়। সেক্ষেত্রে ব্রিটিশদের কাছে মাইসোরের রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানো ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা রইলো না। কিন্তু টিপু সুলতান তখন মাইসোরকে কেন্দ্র করে সমগ্র দাক্ষিণাত্যে রাজ্যবিস্তারের পরিকল্পনায় ব্যস্ত। টমাস মুনরো এবং আলেক্সান্ডার রিডের মত কমবয়সী সামরিক আধিকারিকেরা পরিষ্কার জানিয়ে দিল যে যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। যদিও অসামরিক প্রশাসকেরা ভারসাম্য রক্ষা করার পক্ষে এবং যুদ্ধের বিপক্ষে ছিল তারাও কিছুদিনের মধ্যেই বিপদের আঁচ পেয়ে লর্ড কর্নওয়ালিশ এবং পরবর্তীকালে ওয়েলেসলির সঙ্গে ভারতের মানচিত্র থেকে মাইসোরের চিরকালীন বিলুপ্তির ব্যাপারে ঐকমত্য জানাল। তারপর চারদফা যুদ্ধের পর ১৭৯৯ সালে মাইসোরের দখল নিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। প্রথম যুদ্ধে(১৭৬৭-৬৯) মারাঠা এবং হায়দ্রাবাদের নিজাম ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়ে হায়দার আলির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। পরবর্তীকালে আবার ১৭৯০ সালে তৃতীয় দফার যুদ্ধে এই দুই ভারতীয় শক্তি ব্রিটিশদের পক্ষ অবলম্বন করে এবং লর্ড কর্নওয়ালিশের নেতৃত্বে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। এর কিছুদিন আগেই ব্রিটিশদের আর এক মিত্র রাজ্য ত্রাভাঙ্কোরের রাজাকে আক্রমণ করেছিল টিপু সুলতান। এই যুদ্ধে ডিন্দিগুল, বারামহল এবং মালাবারকে মাইসোর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ব্রিটিশ। এর কিছুদিন পরে ফরাসিদের সাময়িক উত্থান এবং তাদের সঙ্গে টিপু সুলতানের গোপন আলোচনাকে অজুহাত করে মাইসোর আক্রমণ করে ওয়েলেসলি। এই ঔপিনিবেশিক আগ্রাসনের যুদ্ধে মাইসোরের রাজধানী শ্রীরঙ্গাপট্টম দখল করে নেয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। শ্রীরঙ্গাপট্টম রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারায় টিপু সুলতান। মাইসোরকে আবার নিয়ে আসা হয় ওয়েলেসলির অনুগত ওয়েদার রাজবংশের অধীনে। মাইসোর হারালো তার স্বাধীনতা চিরকালের মতো। ওয়েলেসলি প্রবর্তিত চুক্তি অনুযায়ী মাইসোর অন্য কোনও ইউরোপিয়ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না। মাইসোরের রাজদরবারে ব্রিটিশ প্রতিনিধি স্থায়ীভাবে থাকবে এবং তার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবে মাইসোরের রাজা। এই চুক্তির অধীনে থাকতে সম্মত হওয়ার জন্য মাইসোরের কিছু অংশ হায়দ্রাবাদের নিজামকে দিয়ে দেওয়া হয়।

ইতিমধ্যে বোম্বে এবং গুজরাতের মধ্যে দিয়ে চিনের সঙ্গে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান তুলার ব্যবসা তাদের ঐ অঞ্চলের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন করে তোলে। রাজত্বের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত এক পারিবারিক বিবাদকে হাতিয়ার করে ব্রিটিশরা ঐ অঞ্চলের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। রঘুনাথ রাও চক্রান্ত করে তার ভ্রাতুষ্পুত্র পেশোয়া নারায়ণ রাওকে হত্যা করলে ঐ অঞ্চলের মারাঠা সর্দারদের রোষের মুখে পড়ে এবং বাঁচবার জন্য ব্রিটিশদের দ্বারস্থ হয়। ১৭৭৫ সালে রঘুনাথের বাহিনী গুজরাতে বিদ্রোহীদের হাতে পরাজিত হয় এবং তাকে উদ্ধারের জন্য মাদ্রাজ এবং বোম্বে থেকে বিশাল সেনাবাহিনী গুজরাতে এসে পৌঁছোয়। রঘুনাথের বিরোধীরা কোম্পানিকে রঘুনাথের থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সর্তে বেশ কিছু ব্যবসায়িক সুবিধা দেবার প্রস্তাব করে পুরন্দর শান্তিচুক্তির খসড়া পেশ করে। কিন্তু পুরন্দর চুক্তি কলকাতার কোম্পানি অধিকর্তারা বাতিল করে দিলে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। ইতিমধ্যে মারঠারা নানা ফাডনিস, সিন্ধিয়া এবং হোলকারের নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং ১৭৭৯ সালে ওয়াদগাঁও এর যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে ব্রিটিশদের পর্যুদস্ত করে। এরপর বাঙলা থেকে বিশাল বাহিনী এসে এলাকা পুনরুদ্ধার করে। নানা ফাডনিস এবং ভোঁসলে পরিবার ১৭৮১ সালে নিজাম এবং হায়দার আলির সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধে। কিন্তু ১৭৮২ সালে এই যুদ্ধের ফলাফল ব্রিটিশদের অনুকূলে যায় এবং ১৭৮২ সালে সালবাই চুক্তির মধ্য দিয়ে মারাঠারা ব্রিটিশদের আনুগত্য স্বীকার করে নেয় এবং মাইসোরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষ নিতে সম্মত হয়।              

0

গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য

Posted in






“হেলো”!

ব্যারিটোন ভয়েস কানে যেতে, এতোক্ষণ প্রকৃতিতে মগ্ন শ্রুতি, তাকিয়ে দেখে তার সামনের সীটে এক ভদ্রলোক বসে তার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন।

কখন এসে বসলেন ভদ্রলোক ! এতোক্ষণ তো ছিলেন বলে মনে হচ্ছে না! ইন ফ্যাক্ট শ্রুতি যখন ট্রেনে ওঠে তখন এই ফার্স্টক্লাস কোচটা একরকম ফাঁকাই ছিল। কোচের শেষ দিকে বোধহয় দু’ একজন ছিলেন।

এই সুন্দর আরামদায়ক কোচখানা প্রায় পুরোপুরি তার দখলে, ভেবেই শ্রুতির ইন্ট্রোভারটেড চিত্ত আনন্দে নেচে উঠেছিল। আ:, কী শান্তি! ভিড়ভাট্টা, বাচ্চাদের চিৎকার, কান্না কোনো ঝামেলা নেই। প্রকৃতি দেখতে দেখতে একা একা সুন্দর সময় কাটানো যাবে !

কিন্তু হা হতোস্মি! তার সেই আশায় এবং একাকীত্বে জল ঢালতে কে এই মূর্তিমান আবির্ভূত হলেন!

আর তার সামনে এসে বসলোই বা কখন.কে জানে! হয়তো শ্রুতি যখন এটেন্ডেন্ট মহিলার সঙ্গে কথা বলতে ওপাশে গেছিলো তখন এসে বসেছে।

অবশ্য আগে পরেও হতে পারে, কারণ ট্রেনের চারপাশের সৌন্দর্যে শ্রুতি এমনই বুঁদ হয়েছিল, যে অন্য কোনো দিকে মন দেবার মতন অবস্থাতেও সে যে ছিলনা, এটাও ঠিক।

আর এরকমটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। এই প্রথমবার গ্রিন্ডেলওয়াল্ড যাচ্ছে শ্রুতি। উ:, কী রোমাঞ্চকর! গ্রিন্ডেলওয়াল্ড আর তার আশেপাশের সৌন্দর্য , যা সে এতোদিন শুধু ছবিতে দেখেছে, এবার চাক্ষুষ দেখবে। ভাবা যায়!

এখনো তো গ্রিন্ডেলওয়াল্ড আসতে একটু দেরী আছে, অথচ এখনই চারদিক কী অপরূপ হয়ে উঠেছে!

ট্রেনের বাইরে যেদিকেই তাকাও বরফের পাহাড় আর পাহাড়। মনে হচ্ছে স্নো পিক গুলোকে, ট্রেনের মস্ত মস্ত কাঁচের জানলার গায়ে কেউ যেন আঠা দিয়ে ছবির মতো সেঁটে রেখেছে।

আর ট্রেনের সঙ্গে ছুটে চলা চোখ ঝলসানো রকমের সাদা বরফ পাহাড়ের নীচে দিগন্ত ছোঁয়া , ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা এমন গাঢ় সবুজ তৃণভূমি।

আর সেই সবুজ মেডো তে চরে বেড়াচ্ছে বাদামী সাদা ছোপ ছোপ গরু, দারুণ মিষ্টি বাচ্চা ভেড়া, মা-ভেড়া, পক্ষীরাজের মতো ঘোড়ারা-কোনোটা ধপধপে সাদা, কোনোটা কুচকুচে কালো,কোনোটা বাদামী, তাছাড়া মেশামেশি রঙের তো আছেই। ঠিক যেন রূপকথার দেশ।

গরুগুলো আবার একটু বেশি সাহসী। ট্রেনের প্রায় কাছ ঘেঁষে চরে বেড়াচ্ছে। আর তাদের গলায় সব বড়ো বড়ো ঘন্টা বাঁধা। সে সব ঘন্টার আবার কী সুরেলা আওয়াজ! শ্রুতির মনে হচ্ছে ওরা যেন গান গেয়ে গেয়ে তাকে ডাকছে।

হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ছে দূরে দূরে একেকখানা কটেজ । ছোটবেলায় শ্রুতি ড্রয়িং খাতায় যেমন আঁকতো,ঠিক তেমনি ছবির মতো তাদের ঢালু ছাদ, আর ছাদের কোনায় একটা করে চিমনি। ওপরে আশ্চর্য নীল আকাশ…

“ প্রথম বার কি”?

উল্টোদিকের সীটের ভদ্রলোকের কথায় সম্বিত ফেরে শ্রুতির। রূপকথার দেশ থেকে তার মন ঝপ করে ফিরে আসে ট্রেনের কামরায়।

শ্রুতির বিভোরতা দেখেই কিনা কে জানে,

ভদ্রলোক একদৃষ্টিতে একভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কী গভীর নীল চোখ! আর সেই চোখদুটোয় আশ্চর্য কিছু যেন ঝিকমিক করছে! মুখে মৃদু হাসি।

ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকিয়ে শ্রুতির সারা শরীর হঠাৎ অকারণে কেন যেন কেঁপে উঠল।

কী হ্যান্ডসাম দেখতে! মনে হয় ছ'ফুটের কাছাকাছি লম্বা হবেন, গ্রীক গডের মতো মুখ, মাথার চুল অনেকটা পাতলা হয়ে এলেও তার গাঢ় সোনালী রঙ, সূর্যের পড়ন্ত আলোয় আগুন একেবারে।

হ্যান্ডসাম , আকর্ষক বিদেশি পুরুষ, শ্রুতি তো আর প্রথম দেখছেনা, কিন্তু এই ভদ্রলোকের ভেতর কী যেন আছে! চোখে চোখ পরা মাত্র তাকে পাগলের মতন টানছে। ভদ্রলোকের আকর্ষণের কাছে, এতোক্ষণ তাকে বুঁদ করে রাখা আশপাশ, প্রকৃতি সবকিছু একেবারে ফিকে, আলুনি লাগছে।

টেবিলের উপর রাখা ভদ্রলোকের গ্লাভস পরা হাতদুটো একবার ছোঁয়ার জন্য তার সমস্ত শরীর যেন আকুলি বিকুলি করে উঠলো। সামনের ভদ্রলোকের শরীরের ভাষাতেও যেন সেই একই আকুলতা!

এটা কি হচ্ছেটা কি? আর এই চল্লিশের ওপরে এসে? লাভ এট ফার্স্ট সাইট?

ফু:.!..সে সব গল্প কথা মাই ডার্লিং। বাস্তবে হয়না,, বলে মনে মনে নিজেকে কষে এক ধমক দিলো শ্রুতি

“ প্রথম বার?”-

আবার সেই স্বর।

“ হ্যাঁ,… মানে অফিসের কাজে বার্লিন এসেছিলাম, তো ভাবলাম গ্রিন্ডেলওয়াল্ড টা দেখেই যাই। আমার ছোটবেলার স্বপ্ন “

“স্বাভাবিক '

”স্যরি'?

শ্রুতির কথার উত্তর না দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে তাঁর সেই আশ্চর্য হাসিটি হাসেন ভদ্রলোক।

“আপনি চা খাবেন? আমি একটু চায়ের অর্ডার দিচ্ছি “

“ নো, থ্যাংকস “

শ্রুতির অনুরোধ উপেক্ষা করেই একমনে খুব খেয়াল করে শ্রুতির আপাদমস্তক জরিপ করতে লাগলেন ভদ্রলোক। ঠোঁটের কোনের হালকা হাসিতে খানিকটা অবয়সোচিত দুষ্টুমির আভাস।

,” নাউ ইউ হ্যভ নাইস অলিভ স্কিনকালার”-

আবার শ্রুতির অন্ত:স্থল ছুঁয়ে যাওয়া, গভীর অথচ মজার ভঙ্গিতে বলা পাগল করে দেওয়া সেই ব্যারিটোন ভয়েস।

একমুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেল শ্রুতি। তারপরেই খানিকটা নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টায়, আর খানিকটা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, একটু বেশিই জোরে হেসে উঠলো , “না,না, আপনি ভুল করছেন,। আমার স্কিন ট্যানড হয়ে এরকম হয়নি। আমার স্কিন টোন এরকমই। আমি ভারতীয় তো, আমাদের চামড়ার স্বাভাবিক রঙ এরকমই হয় সাধারণত “

মজাদার ভঙ্গিটা মুছে গিয়ে বিষন্নতার মতো কিছু ভদ্রলোকের মুখে ছড়িয়ে পড়লো।

অন্যমনস্ক ভাবে বার দুয়েক যেন ঘোরের মধ্যে “ ইন্ডিয়া… ইন্ডিয়া “ বলে চুপ করে গেলেন।

“আচ্ছা, আগে কি আমাদের কোথাও দেখা হয়েছে ? “

কিন্তু শ্রুতি তার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই গ্রীন্ডেলওয়াল্ডের আগের স্টেশন থেকে স্টার্ট করেও ট্রেনটা হঠাৎ থেমে গেল। ভদ্রলোক ও উঠে, কোচের পিছনে, বোধহয় রেস্টরুমের দিকে চলে গেলেন।

শ্রুতি এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

কি হলো আবার! বিদেশের ট্রেন তো সাধারণত যেখানে সেখানে, যখন তখন থেমে যায়না! ব্যাপারটা কি হলো?

তখনই ট্রেনের অ্যনাউন্সমেন্ট সিস্টেমে জানানো হলো যে অপ্রত্যাশিত ভাবে ইন্জিনে কিছু অসুবিধা দেখা দিয়েছে। তাই স্টেশন থেকে ছাড়তে একটু দেরী হবে; অবশ্য খুব তাড়াতাড়ি, মানে আধঘন্টা খানেকের মধ্যেই ট্রেন পরের স্টেশন, গ্রীন্ডেলওয়াল্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবে। প্যাসেঞ্জারদের এই অসুবিধার জন্য তারা নিতান্ত দুঃখিত।

শ্রুতি এদিক ওদিক তাকিয়ে কী করবে ভাবছে এমন সময় অ্যাটেনডেন্ট মেয়েটি, যার নাম মারিয়া _মানে শ্রুতি এই মাত্র ই খেয়াল করলো তার আইডিতে লেখা রয়েছে , শ্রুতির পাশ দিয়ে যাছিল। শ্রুতি ও ওমনি খপ করে তাকে ধরে ফেললো। “ “এক্সকিউস মি, ট্রেনের ইঞ্জিন ঠিক হতে তো একটু দেরি আছে, এই সময়টায় আমি কি নীচে নামতে পারি?”

মেয়েটি একটু ইতস্তত করে তাকে নামার পারমিশন দিলো। কিন্তু সেই সঙ্গে সাবধানও করে দিল, সে যেন দূরে না যায়। এই কথা শুনে একটু ভয় পেয়েই শ্রুতি জিগ্যেস করলো, “ কেন বলুন তো? জায়গাটা কি সেফ নয়?”

“না, না এই জায়গাটা খুব ই সেফ। আমার বাড়িও এখানে। এখন অবশ্য আমি আর আমার পার্টনার ইন্টারলেকেনে থাকি। গেছেন? না গেলে একবার ঘুরে নেবেন। ভারী সুন্দর শহর।

যাইহোক, এখানে ভয়ের কিছু নেই। নিশ্চিন্তে কাছাকাছি ঘুরুন ফিরুন। নো প্রব্লেম।

বরং একটা কাজ করুন। আপনার মোবাইল নম্বরটা আমাকে দিয়ে যান। ট্রেন ছাড়ার আগে আমি আপনাকে কল করে ডেকে নেব “

তাই সই।

সেটা অবশ্য খারাপ ও হবেনা। ওই সবুজ মেডোতে হাঁটা মানে এক অপার্থিব অনুভূতি! ভালোলাগায় ভরপুর হয়ে পাহাড় ছোঁয়া সবুজ মেডোর দিকে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলো শ্রুতি।

অন্য কোচ থেকেও কয়েকজন নেমে এসে পায়চারি করছেন দেখা গেল। একটা বছর তিনেকের বাচ্চা মনের আনন্দে সবুজ ঘাসে ছুটে বেড়াচ্ছে। সত্যি এখানে ভয়ের কিছু নেই। চমৎকার জায়গা আর লোকজন।

হঠাৎ ঝপ করে শেষ বিকেলের রোদটা মরে গেলো আর চারদিকে কেমন যেন চাপা অন্ধকার ঘনিয়ে এলো, সঙ্গে হাড়কাঁপানো হিমেল হাওয়া। শ্রুতি কোটের পকেট থেকে বের করে টুপিটাও পরে নিলো।

শুধু যে সন্ধ্যে নেমে আসছে তা নয়, আকাশ জুড়ে গভীর কালো মেঘ করেছে। শ্রুতি দু এক পা সবে হেঁটেছে তার মধ্যেই ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।

“ আমার বাড়ি এক মিনিটের রাস্তা। এখানে ঠান্ডায় কষ্ট না পেয়ে, আসুন আমার সঙ্গে “

ও মা, আবার ট্রেনের সেই ভদ্রলোক!

কথাটা বলেই ভদ্রলোক পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এসে শ্রুতির সামনে সামনে চলতে লাগলেন।

হঠাৎ এমন একটা প্রস্তাবে শ্রুতি তো একদম হকচকিয়ে গেল , আর তার সঙ্গে খানিকটা চিন্তায় ও পড়ে গেল। গা টা একটু ছমছম করে উঠলো।

ট্রেনের আলাপ…না ঠিক আলাপ ও বলা যায়না কারন এখনও তারা কেউ কারুর নাম পর্যন্ত জানেনা। এই অবস্থায় ভদ্রলোকের তাকে একেবারে বাড়ি যেতে বলাটা… স্বাভাবিক কি?

সুইটজারল্যান্ডে ছুটকো ছাটকা পিকপকেট ছাড়া ট্যুরিস্টদের সঙ্গে অন্য রকম ক্রাইম হয়না বললেই চলে। তাহলেও বলা তো যায়না। এই ভদ্রলোকের ধান্দা অন্যরকম হতেও তো পারে!

“ শ্রুতি! তোমার যখন এতোই ভয়, একা একা বেড়াতে এসেছো কেন?”-

মায়ের গলায় শ্রুতি নিজেই নিজেকে একটা ধমক দ্যায়।

“ ভয় করছে? “

আবার সেই মদির ব্যারিটোন ভয়েস।

ভদ্রলোক কি মনের কথাও পড়তে পারেন? মনে ভাবে শ্রুতি।

মুখে অবশ্য বলে, “ না, ভয় করবে কেন? “

আর সত্যি বলতে কি এখন ওর ততো ভয়ও লাগছেনা। এমন একজন নাইস এন্ড হট ভদ্রলোকের সঙ্গে সবুজ ঘাসের মখমলি কার্পেট মাড়িয়ে একসঙ্গে হেঁটে চলার সম্ভাবনা…না: মন্দ নয়!

ঠোঁটের কিনারে একটু হালকা হাসির রেখাও ফুটে উঠলো শ্রুতির।

যদিও তার স্বাভাবিক স্বভাব চরিত্রের সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত ঠিক মেলেনা, তাহলেও এইমুহূর্তে কোনো এক আশ্চর্য কারণে, এই চিন্তা তার কাছে দারুণ, দারুণ আকর্ষক লাগছে।

তার বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় কী ভীষণ যে ঢিপঢিপ করছে!

আহা হা…এই পথ যদি না শেষ হয়..

“এই যে বাড়ি। আসুন “

শ্রুতি ভদ্রলোকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে, সুখ কল্পনায় গা ভাসিয়ে কখন একখানা দারুন কটেজের সামনে চলে এসেছে, খেয়াল ই করেনি।

“ আসুন “

এবার পুরোপুরি সম্বিত ফেরে শ্রুতির।

ঠিক যেন গল্পের বই থেকে তুলে আনা একখানা কটেজ । দরজায় বড় সাদা নেমপ্লেটে উজ্জ্বল লাল রঙে লেখা-“ ডঃ লিয়াম বাখম্যান “, আর তার নীচে, “পেট্রা বাখম্যান”।

“পেট্রা আপনার স্ত্রী?”


আবার সেই রহস্যময় হাসি।

“ভালোই হলো আলাপ হয়ে যাবে।আপনার স্ত্রী কি এখন বাড়িতে?’- অধিকাংশ ভারতীয় মহিলার মতন ই কৌতুহলে শ্রুতি জিগ্যেস করলো।

“ এক মিনিটে ঢুকে যাবে। এসেই পড়েছে।“

সেই আকর্ষক দৃষ্টিতে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠেন ডঃ লিয়াম বাখম্যান। আর শ্রুতি এই প্রথম লক্ষ্য করে , লিয়ামের শ্বাদন্ত দুটো অন্য দাঁতের তুলনায় অনেকটা বেশী লম্বা আর ছুঁচলো।


বাড়ির ভেতরে ঢুকে শ্রুতি একেবারে মোহিত হয়ে যায়। কী সুন্দর সাজানো ঘর! জানলায় সাদা লেসের পর্দা, সিলিং থেকে অপূর্ব কারুকাজ করা ঝাড়লন্ঠন ঝুলছে, নীচে নরম কার্পেট , ছবি, ডেকরেটিং পিস…সব মিলিয়ে এ ঘর যে অনেক ভালোবাসায় সাজানো , তার ছাপ সর্বত্র।

এইরকম, ঠিক এই রকম বাড়িই তার চিরকালের ইচ্ছে ছিল। তার রূপকথার সংসার! এমন একটা বাড়ি আর এমন রোম্যান্টিক একজন পার্টনার পেলে শ্রুতিও হয়তো বিয়েটা করেই ফেলতো। আর তাহলে মা ও খুশ। বাবাও।

আচ্ছা, লিয়ামের বউ পেট্রাকে তো এখনো দেখা গেলোনা! বোধহয় কিচেনে চা কফি কিছু বানাচ্ছে।

লিয়াম এসেই ভেতরের দিকে চলে গিয়েছিল।

এখন বেড়িয়ে এসে সোফায় বসলো।

মুখোমুখি দুটো সোফায় বসে আছে শ্রুতি আর লিয়াম। লিয়ামের চোখে সেই আকর্ষণ, আকুলতা আরও অজানা কী যেন মেশা আশ্চর্য দৃষ্টি, স্থির হয়ে আছে শ্রুতির চোখে।

সারা ঘর জুড়ে সুরের হিল্লোল ছড়িয়ে বিজিসের গান প্রেম ছোঁয়ানো মদিরার মতো বাজছে,”হাউ ডিপ ইস ইয়োর লাভ”

শ্রুতির খুব প্রিয় গান। গানটা শুনতে শুনতে শ্রুতির সারা শরীর মন জুড়ে কী সাংঘাতিক উন্মাদনা! তার শরীর কাঁপছে, মুখচোখ লাল হয়ে যাচ্ছে… আর কেন কে জানে চোখ জ্বালা করছে…খুব…খুব”

“ আমার স্ত্রীর প্রিয় গান”- বলতে গিয়ে লিয়ামের গলা যেন ধরে আসে।

, *আমারও “

ধরা গলা শ্রুতির।

“ একটা অনুরোধ আছে। আপত্তি শুনবোনা”- আবেগপূর্ণ গলা লিয়ামের।


লিয়ামের ওই গলা শুনে শ্রুতির হৃদপিন্ড এক মুহূর্তের জন্য আবারও স্তব্ধ হয়ে গেল কথা বলার শক্তি নেই যেন। তার দুচোখ জুড়ে শুধুই লিয়াম।

“ একটা গিফট আছে। আমার স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। কিন্তু বুঝতে পারছিনা আঙুলে পরলে কেমন লাগবে। পছন্দ হবে কিনা। আপনার আঙুল টা একটু..”

নিঃশব্দে মোহগ্রস্তের মতো হাতটা বাড়িয়ে দেয় শ্রুতি। আংটি টা শ্রুতির অনামিকায় পরিয়ে দেয় লিয়াম। একমুহুর্তের জন্য লিয়ামের গ্লাভস ছুঁয়ে থাকে শ্রুতির হাত।

“ আপনার সঙ্গে আগে কখনও কি আমার দেখা হয়েছে”?

আবারও জিজ্ঞেস করে শ্রুতি।

কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর পাবার আগেই

ঝনঝন করে মোবাইল বেজে ওঠে।

ট্রেন পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে।

আকাশ গম্ভীর অন্ধকার আগেই হয়েছিল। এখন অল্প অল্প বরফ পড়ছে। জোরে হাওয়া ও দিচ্ছে।

ট্রেনে উঠে শ্রুতি সীটের দিকে যেতে যেতে পিছন ফিরে দেখে লিয়াম দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।

অবাক শ্রুতির চোখে প্রশ্নের ইশারা।

শ্রুতির চোখের দিকে কষ্টে ভরা গভীর চোখে তাকিয়ে নরম গলায় লিয়াম বললো, “ আমার গন্তব্য এই পর্যন্ত ই। আই হ্যাভ রিচড মাই ডেস্টিনেশন।“

“আর কোনো দিন কি আমাদের দেখা হবেনা লিয়াম “- শ্রুতির হৃদপিন্ড যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে।

“ হয়তো হবেনা…হয়তো হবে…গ্যালাক্সি অন্তহীন “

বলতে বলতে শ্রুতির কাছে এসে তাকে বুকের মধ্যে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো লিয়াম। হালকা পালকের মতো শ্রুতির ঠোঁটে লিয়ামের ঠোঁট।ও:, কী হালকা স্পর্শ, ছুঁয়ে আছে কী নেই যেন বোঝা যায়না। শুধু তার ভালোবাসার উত্তাপ বিস্মিত, আকুল শ্রুতিকে ছুঁয়ে থাকে মুহুর্তের জন্য। তারপর আস্তে আস্তে সরে যায় লিয়াম।

তার সাগর নীল চোখ থেকে জল উপছে ওঠে।

সুখ দুঃখ মেশা গভীর বিষন্ন স্বর লিয়ামের , “গুডবাই মাই লাভ “

ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

“ আপনাকে একটু চা দিই ম্যাম?” মারিয়া এসে জিজ্ঞেস করে শ্রুতিকে।

“আচ্ছা মারিয়া, আপনার বাড়িতো এখানেই বলেছিলেন। আমার সামনের সীটে যে ভদ্রলোক বসেছিলেন, তাঁকে চেনেন আপনি ?”

আকুল আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে শ্রুতি। যেন এর উপরে তার জীবন মরণ নির্ভর করছে।

“আপনার সামনের সীটে…!”

খানিকটা বিভ্রান্ত শোনায় মারিয়ার গলা..” না ম্যাম কেউ তো ছিলেননা “

“ বুঝতে পারছি , আপনি হয়তো খেয়াল করতে পারেননি। নাম বললে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন। ভদ্রলোকের নাম লিয়াম বাখম্যান। ডঃ লিয়াম বাখম্যান”

আতংক বিস্ফারিত চোখে এমনভাবে চেয়ে থাকে মারিয়া, যেন ভূত দেখেছে।

“ ডঃ লিয়াম?!...কিন্তু উনি তো অনেক দিন আগেই মারা গেছেন।“

“কি বলছেন কি ?!আমি তো এখুনি ওনার বাড়ি থেকেও ঘুরে এলাম”

“কিছু মনে করবেননা ম্যাম, এটা অসম্ভব। ১৯৭৭/৭৮ সাল নাগাদ ডঃ লিয়াম আর ওনার স্ত্রী পেট্রার বিবাহবার্ষিকীর দিন পেট্রা ইন্টারলেকেন থেকে এই ট্রেনে করে ফিরছিল। দূর্ভাগ্যবশত এই ট্রেনের একটা সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্ট হয়। পেট্রা শুধু যে মারা যায় তাই নয়, তার দেহ এমন ভাবে তালগোল পাকিয়ে গেছিলো যে তাকে আর চেনাই যায়নি। ওই সামান্য পোশাক আশাক দেখে আর কী… “

“ এসব কী বলছেন আপনি?” প্রায় না শুনতে পাওয়ার মতো অস্ফুট স্বর শ্রুতির।

“ সেই শোক ড:লিয়াম সহ্য করতে পারেননি। ওঁরা দুজনে দুজনকে খুব ভালো বাসতেন। একরকম লিজেন্ডারি লাভ বলতে পারেন। তারপর থেকে ড: লিয়াম কাজকর্ম প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রতিদিন এই ট্রেনের ভেতর পেট্রাকে খুঁজে বেড়াতেন। মাথাটাই আরকি…

বারবার বলতেন, “ ওর মুখ আমাকে আর একবার দেখতেই হবে। ওকে প্রপারলি গুডবাই না করতে পারলে আমি মরেও শান্তি পাবোনা। ওকে আমার কাছে আসতেই হবে।“

শোকের যন্ত্রণাতেই হয়তো স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই ডঃ লিয়ামও মারা যান।

ওনাদের অতো ভালোবাসা দিয়ে তৈরি করা কটেজটাও একদম ভেঙে চুরে পড়ে আছে।“

“আপনি ভুল লোকের কথা বলছেন মারিয়া। এ হতে পারেনা।

আমি অন্য লিয়ামের কথা বলছি। আমি এইমাত্র লিয়ামের বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম যে”।

শ্রুতির দিকে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে চলে যাবার আগে মারিয়া বলে গেল – “আপনি জানলা দিয়ে দেখুন, ট্রেনটা বাঁক নেবার মুখে ডঃ লিয়ামের বাড়িটা দেখা যায়। দেখুন তাকিয়ে ।“

জানলা দিয়ে আকুল হয়ে বাইরে তাকায় শ্রুতি। দুহাত দিয়ে, মুখ দিয়ে ট্রেনের জানালার কাঁচ আঁকড়ে ধরে পলকহীন চোখে বাইরের দিকে কটেজ খানা খুঁজতে থাকে।

হ্যাঁ, ওইতো, ওইতো কটেজ টা, কিন্তু একমুহুর্তে এ কী অবস্থা!

ভাঙাচোরা ছাত…তার খানিকটা আবার উড়েই গেছে। শুধু মাত্র আধভাঙা একপাশে হেলে থাকা দরজার গায়ে লাল রঙে লেখা ডঃ লিয়াম বাখম্যান। নামটা কালচে হয়ে গেলেও এখনও পড়া যাচ্ছে।

শ্রুতির মনে হয় সে বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছে।

সে কি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে!

নাকি হ্যালিউসিনেট করছে!


কিন্তু তার বুকটা এমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে কেন! বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে.. ফোঁপানোর মতো কিছু বুকের একেবারে ভেতর থেকে উঠে আসছে… ইচ্ছে করছে, চিৎকার করে কেঁদে উঠতে।

নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে করতে সামনের টেবিলে রাখা টিস্যু পেপারের দিকে হাত বাড়াতেই শ্রুতির চোখ আটকে গেলো আংটিটাতে। যেটা লিয়াম একটু আগেই তার অনামিকায় পরিয়ে দিয়েছে।

আংটিটার ' এল ' আর '- পি' অক্ষর দুটো পরস্পরকে জড়িয়ে মিশে আছে যেন,

আর তাদের চারপাশ ঘিরে গোল করে এমবস করা একটাই শব্দ –' Liebe ' ।

শ্রুতি জানে তার মানে 'ভালোবাসা'।।
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in








পর্ব ২০

বণিকের মানদণ্ড দেখ দিল রাজদণ্ডরূপে

(সময়ানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত বিবরণী)-প্রথম অংশ

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন হয়েছিল বাঙলাতেই। এশিয়াতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার ষাট শতাংশ উপকরণই ছিল বাঙলার। ভারতবর্ষে কোম্পানির ব্যবসা ত্বরান্বিত হতে থাকল যখন আওরঙ্গজেব ১৬৯০ সালে বার্ষিক তিনহাজার টাকার বিনিময়ে কোম্পানিকে নিঃশুল্ক ব্যবসার অনুমতি দিল। ১৬৯৬ সালে কলকাতায় দূর্গ নির্মানের অনুমতি এবং তার দু’বছর পরে কলিকাতা, সূতানুটি এবং গোবিন্দপুর গ্রামের জমিদারি কোম্পানিকে লিখে দিল মোগলসম্রাট আওরঙ্গজেব। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সাময়িকভাবে কিছু সমস্যা দেখা দিলেও ১৭১৭ সালে সম্রাট ফাররুক্সিয়ার আবার নিঃশুল্ক ব্যবসার এবং কলকাতার নিকটবর্তী আটত্রিশটি গ্রামের জমিদারির অনুমতি দিল কোম্পানিকে।সেই সঙ্গে নবাবের ট্যাঁকশাল ব্যবহারের অনুমতি পেল কোম্পানি। কিন্তু অনতিবলম্বেই এই অনুমতি নিয়ে কোম্পানির বিবাদ শুরু হলো বাঙলার নবাব মুর্শিদকুলি খানের সঙ্গে। কোম্পানির আধিকারিকেরা কোম্পানির ব্যবসার বাইরে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসাও চালাত। এই ব্যক্তিগত ব্যবসাগুলিকে নিঃশুল্ক ব্যবসার বাইরে রাখার জন্য কড়া আইন প্রবর্তন করলো মুর্শিদকুলি। কোম্পানি আধিকারিকরা কিন্তু নানা ছলছুতোয় নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসাগুলির থেকে কর ফাঁকি দিতে থাকলো। ক্রুদ্ধ মুর্শিদকুলি আটত্রিশটি গ্রামের জমিদারি এবং ট্যাঁকশালের ব্যবহার সম্পর্কিত আদেশনামা প্রত্যাহার করে নিল। ১৭১৭ সাল থেকেই বাঙলার নবাব এবং কোম্পানির মধ্যে বৈরিতার সূত্রপাত।

১৭৪০ সালে অস্ট্রিয়া উত্তরাধিকার যুদ্ধের ফলস্বরূপ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। বাঙলার নতুন নবাব আলিবর্দি খান ব্রিটিশ এবং ফরাসি উভয়পক্ষকেই কড়া নিয়ন্ত্রনে রাখে এবং কোনওরকম যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু দাক্ষিনাত্যে ফরাসিদের বিজয়লাভ ব্রিটিশদের বাঙলার ফরাসিদের প্রতি সন্দিহান করে তোলে। যদি কোনওভাবে ফরাসিদের হাতে ব্রিটিশরা আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে আলিবর্দি কতটা তাদের সাহায্য করতে পারবে সে ব্যাপারেও অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকতে থাকে ব্রিটিশরা। এছাড়াও ব্যবসার ক্ষেত্রে এশিয়ার ব্যবসায়ীদের সাহচর্যে ফরাসিদের ব্যবসাও বৃদ্ধি পেতে থাকায় কোম্পানির ব্যবসাও বেশ বড়রকমের ধাক্কা খেয়েছে। সব মিলিয়ে ফরাসিদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উত্থানে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ১৭৫৫ সালে নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করে কলকাতা দূর্গকে আরও শক্তিশালী করার জন্য খনন এবং নির্মাণের কাজ শুরু করে ব্রিটিশরা। এমনকি নবাবের দরবার থেকে বহিষ্কৃত এবং পলাতক লোকেদেরও কলকাতায় নিরাপদ আশ্রয় দিতে থাকে ব্রিটিশরা। বাঙলার নবাবের সঙ্গে বিরোধ চরম আকার নেয় যখন ১৭৫৬ সালে সিরাজদ্দৌল্লা নবাবের আসনে বসে। সিরাজ কোম্পানি আধিকারিকদের ব্যক্তিগত ব্যবসাকে নিঃশুল্ক ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য নতুন করে আদেশ জারি করে। সিরাজের সঙ্গে বিরোধিতা চরম পর্যায়ে পৌঁছোয় মূলতঃ দু’টি কারণে প্রথমত রাজস্ব আত্মসাৎ করার দায়ে অভিযুক্ত কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয়দান এবং দ্বিতীয়ত নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করে দূর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করা। এই দু’টিকেই রাজদ্রোহিতার সামিল বলে ঘোষণা করে সিরাজ। সিরাজের সাবধাবাণীতে কর্ণপাত না করার শাস্তি হিসাবে সিরাজ কাশিমবাজারে কোম্পানির ফ্যাক্টরি দখল করে নেয়। সিরাজের ক্ষমতা সম্পর্কে গভর্নর ডেকের ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে ২০শে জুন সিরাজ কলকাতা দখল করে নেয়।

এই সঙ্কটের হাত থেকে ব্রিটিশদের রক্ষা করতে মাদ্রাজ থেকে বিশাল সৈন্যসমভিব্যাহারে কলকাতায় এসে পৌঁছোয় রবার্ট ক্লাইভ। ব্রিটিশদের ভয় ছিল যে সিরাজ ফরাসিদের সহায়তায় তাদের ব্যবসার ক্ষতি করতে পারে এবং ফরাসিদের সঙ্গে মিলে তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। তাই কোনওরকম ঝুঁকি না নিয়ে রবার্ট ক্লাইভ আক্রমণের রাস্তা বেছে নেয় এবং হুগলি ও চন্দননগর ফরাসিদের কাছ থেকে দখল করে নেয়। আবদালির নেতৃত্বে আফগান আক্রমণের আশঙ্কায় সিরাজ ব্রিটিশদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে মীমাংসা প্রক্রিয়া শুরু করতে চাইলে ক্লাইভ তা প্রত্যাখ্যান করে এবং যুদ্ধের পথেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কোম্পানির আধিকারিকেরা কোনওভাবেই কমবয়সী সিরাজের অত্যাচারের কাছে মাথা নত করে নিজেদের ব্যবসা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সঙ্গে আপস করতে রাজি হলোনা। এছাড়াও নবাবের দরবারে সিরাজের বিরুদ্ধে একটা শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। সিরাজের ঔদ্ধত্য এবং অপমানজনক ব্যবহারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে বেশ কিছু ব্যবসায়ী এবং জমিদার ক্লাইভের সঙ্গে হাত মেলালো। এদের মধ্যে প্রধান ছিল জগতশেঠ মোহতাব রাই, স্বরূপচাঁদ, রাজা জানকিরাম, রাইদুর্লভ, রাজা রামনারায়ণ, রাজা মাণিকচাঁদ প্রমুখ। তাছাড়া অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী ব্রিটিশদের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসায় নিযুক্ত ছিল এবং অনেকে ব্যবসার জন্য ব্রিটিশ জলযান ব্যবহার করতো। এরা সকলেও ব্রিটিশদের পক্ষে ছিল। জগতশঠের কথামতো সিরাজের জায়গায় তার অন্যতম সেনাধিপতি মিরজাফরকে নবাব করার পরিকল্পনা করে চক্রান্ত দানা বেঁধে উঠলো। নবাবের দরবারে চক্রান্ত আগে থেকেই চলছিল যার সদ্ব্যবহার করেছিল ব্রিটিশরা না ব্রিটিশরাই এই ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল সে প্রশ্ন অবান্তর। এই ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশির যুদ্ধে ক্লাইভের হাতে পরাজিত হলো সিরাজ। পলায়নরত সিরাজকে বন্দি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো এবং ব্রিটিশদের হাতের পুতুল মিরজাফরকে নবাবের আসনে বসালো ক্লাইভ। এখানেই শুরু হলো ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক উত্থানের ইতিহাস।

এরপরে শুরু হলো বহু আলোচিত ‘পলাশি পরবর্তী লুন্ঠন’ । যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই তখনকার হিসাবে ২,৭৫,০০০ পাউন্ড ভাগ করে দেওয়া হলো জল এবং স্থলবাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০সালের মধ্যে কোম্পানি মিরজাফরের কাছ থেকে আদায় করলো তখনকার হিসাবে আড়াই কোটি টাকা। ক্লাইভ ব্যক্তিগতভাবে মিরজাফরের কাছ থেকে যে ভূখন্ডের জায়গিরদারি পেয়েছিল তার মূল্য তখনকার হিসাবে প্রায় ৩৫০০০ পাউন্ড। কোম্পানি তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে বেশ বড় রদবদল নিয়ে এলো। ১৭৫৭ সালের আগে কোম্পানি বাঙলায় ব্যবসা করার জন্য দেশ থেকে বুলিয়ন আমদানি করতো। পলাশি যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শুধু বুলিয়ন আমদানি বন্ধ হলো না , তার পরিবর্তে বাঙলা থেকে চিনে এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে বুলিয়ন রপ্তানি শুরু হলো। ব্রিটিশরা এর ফলে অন্যান্য ইউরোপিয়নদের থেকে বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছে গেল। অন্যদিকে পলাশি যুদ্ধের পর কোম্পানি আধিকারিকদের সৌভাগ্যের দরজা খুলে গেল। প্রজাদের ওপর সরাসরি নিপীড়ন ছাড়াও নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় কোম্পানিকে প্রদত্ত কর সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধার অপব্যবহার করে টাকার পাহাড় গড়ে তুললো। কিছুদিনের মধ্যেই মিরজাফরের পক্ষে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়লো। ১৭৬০ সালের অক্টোবর মাসে মিরজাফরকে সরিয়ে মসনদে বসানো হলো তার জামাতা মিরকাসিমকে। অল্পদিনের মধ্যেই আবার দ্বন্দ্বের শুরু হলো কোম্পানিকে দেওয়া করছাড়ের সুযোগের ব্যক্তিগত ব্যবসায় যথেচ্ছ অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে। উপায় না দেখে মিরকাসিম করপ্রথা বিলোপ করে দিল যাতে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও সমান সুযোগ পায়। ব্রিটিশরা নবাবের এই স্বাধীন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলো না। ফলস্বরূপ মিরকাসিমকে সরিয়ে আবার মিরজাফরকে নবাবের আসনে বসানো হলো।

১৭৬৩ সালের ডিসেম্বরে মিরকাসিম বাঙলা থেকে পালিয়ে মোগলসম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এবং অবধের রাজা সুজাউদ্দৌল্লার সঙ্গে জোট বাঁধলো। যুবরাজ দ্বিতীয় শাহ আলম পূর্ব ভারতে স্বাধীন সাম্রাজ্য গড়ার লক্ষ্যে ১৭৫৮ সালে দিল্লী ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৭৫৯ সালের ডিসেম্বরে পিতার হত্যার সংবাদ পেয়ে সে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে এবং সুজাউদ্দৌল্লাকে নিজের উজির হিসাবে নিযুক্ত করে। মিরকাসিম যখন বাঙলা থেকে পালিয়ে তার কাছে আশ্রয় চায় তখন দীর্ঘ আলোচনার পর তারা যৌথভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহমত হয়। সুজাউদ্দৌল্লা বিহারের রাজত্ব, রাজকোষের পূর্ণ অধিকার এবং যুদ্ধজয়ের পর নগদ তিন কোটি টাকার শর্তে যুদ্ধে যোগদান করতে রাজি হয়। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে এই তিনজনের জোট ব্রিটিশদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ব্রিটিশরা পরাজিত সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের সঙ্গে কারারুদ্ধ করে। যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে মুক্তিলাভের পরিবর্তে ১৭৬৫ সালে এলাহাবাদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে সম্রাট বাঙলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দিওয়ানি ব্রিটিশদের লিখে দেয়। এই চুক্তির বলে ব্রিটিশরা বাঙলা, বিহার এবং উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করে। মুর্শিদাবাদের দরবারে ব্রিটিশরা এসে গেল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এবং ১৭৭২ সালে বাঙলায় পরোক্ষভাবে কোম্পানিরাজ চালু হয়ে গেল। এলাহাবাদ চুক্তির শর্তানুযায়ী সুজাউদ্দৌল্লা এবং ব্রিটিশরা নিজ নিজ সাম্রাজ্যরক্ষার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলো এবং সম্মানের সঙ্গে মুক্তিলাভের বিনিময়ে সুজাউদ্দৌল্লা ব্রিটিশদের ৫০ লক্ষ টাকা নজরানা দিল। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অবধের দরবারে একজন ব্রিটিশ প্রতিনিধি নিযুক্ত হলো এবং কোম্পানি অবধে নিঃশুল্ক ব্যবসার অধিকার লাভ করলো। চুক্তির এই বিশেষ শর্তের কারণেই পরবর্তীকালে অবধ সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে।

১৭৬৫ সালে পূর্ব ভারত কোম্পানির সম্পূর্ণ অধিকারে আসে এবং দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশ আগ্রাসনের প্রস্তুতি শুরু হয়। ব্রিটেন-ফ্রান্স বিরোধ এই আগ্রাসনে অণুঘটকের কাজ করে। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে ফরাসিরা সবার শেষে ভারতে আসে এবং সর্বপ্রথম এই উপমহাদেশে নিজেদের শাসন কায়েম করার পরিকল্পনা শুরু করে। ফরাসিদের মূল কেন্দ্র পন্ডিচেরিতে স্থাপিত হয় ১৬৭৪ সালে। ডুপ্লেইক্সের গভর্নর জেনারেল থাকার সময় ফরাসিরা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৭৩১ সালে ডুপ্লেইক্স প্রথমে চন্দননগরের গভর্নর হয়। দশ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে ফরাসি ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। ডুপ্লেইক্স কাজপাগল লোক ছিল। যদিও ভারতবর্ষকে সে ঘৃণার চোখেই দেখতো তবুও এই সুযোগে নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসা থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ডুপ্লেইক্স। ১৭৪২ সালে পন্ডিচেরির দায়িত্ব পায় ডুপ্লেইক্স। কালবিলম্ব না করে ডুপ্লেইক্স নিজের ব্যবসা এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপকে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে চলে। ডুপ্লেইক্সই প্রথম ইউরোপিয়ন রাজনীতিক যে ভারতীয় শাসকদের অন্তর্কলহকে ব্যবহার করে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বিস্তার করে। পরবর্তীকালে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশরাও একই পথ অনুসরণ করে নিজেদের প্রতিপত্তি কায়েম করে।১৯৭০ সালে ইউরোপে অস্ট্রিয়ান উত্তরাধিকার যুদ্ধ ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। সেই বিভেদের প্রভাব ভারতবর্ষেও এসে পৌঁছোয়। বাঙলায় এই বিভেদকে কড়া হাতে দমন করে আলিবর্দি খান। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে মরিশাস থেকে আগত নৌসেনা ফরাসিদের হাত শক্ত করে এবং ফরাসিরা মাদ্রাজে ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ চালায়। ব্রিটিশরা ফরাসিদের হাতে মাদ্রাজ সমর্পণ করে এবং কর্ণাটকের নবাবের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করে। নবাব ফরাসিদের আক্রমণের জন্য সৈন্য পাঠায় কিন্তু সেই সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু এই সময়ে ডুপ্লেইক্স এবং মরিশাস থেকে আগত অ্যাডমিরাল লা বোরদোনেয়ার্সের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ হয় এবং বোরদোনেয়র্স ব্রিটিশদের হাতে মাদ্রাজ সমর্পণ করে মরিশাস ফিরে যায়। ১৭৪৬ সালে ডুপ্লেইক্স আবার মাদ্রাজ আক্রমণ করে এবং দক্ষিণ পন্ডিচেরিতে ব্রিটিশ অধিকৃত সেন্ট ডেভিড ফোর্ট দখল করে নেয়। ইতিমধ্যে আইক্স লা চ্যাপেল চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ এবং ফরাসি বৈরিতার সমাপ্তি ঘটে। চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা ভারতে তাদের ফরাসিদের হাতে হারানো অধিকার ফিরে পায় এবং উত্তর আমেরিকায় ফরাসিরা তাদের ব্রিটিশদের হাতে হারানো অধিকার ফিরে পায়। যুদ্ধ আর আগে এগোতে পারেনা।

ভারতবর্ষে সিংহাসন দখলের জন্য পারিবারিক বিবাদ সর্বজনবিদিত। সেই বিবাদের কারণেই ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিবাদ বাড়তে থাকে দক্ষিণ ভারতে। কর্ণাটক এবং হায়দ্রাবাদে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিবাদের সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে নেয় ফরাসি গভর্নর জেনারেল ডুপ্লেইক্স। কর্ণাটকে চন্দা সাহিব এবং হায়দ্রাবাদে মুজফফর জংকে রাজা হবার লড়াইতে সমর্থন করে ফরাসিরা। ব্রিটিশরা সমর্থন করে এদের বিরোধি নাসির জং এবং মহম্মদ আলিকে। ফরাসি সমর্থিত দু’জনেই বিজয়ী হয় এবং নাসির জং-এর মৃত্যু হওয়ায় হায়দ্রাবাদের নতুন নিজাম হয় মুজফফর জং। মুজফফর ফরাসিদের মাসুলিপটম এবং আরও বেশ কয়েকটি গ্রামের জায়গির দান করে। এমনকি নিজের দরবারেও ফরাসি প্রতিনিধির জন্য একটি আসন নির্দিষ্ট করে দেয়। অবশ্য মুজফফর জংও বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেনি। ১৭৫১ সালের ফেব্রয়ারিতে মুজফফর মারা যায় এবং সালাবত জং নতুন নিজাম হয়। আতঙ্কিত ব্রিটিশদের সহায়তার জন্য কলকাতা থেকে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী কর্ণাটক এসে পৌঁছোয় এবং ১৭৫২ সালের শুরু হয় দ্বিতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধ। ব্রিটিশরা জয়ী হয় এবং মহম্মদ আলি কর্ণাটকের সিংহাসনে বসে। ডুপ্লেইক্স দক্ষিণ ভারত পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাতে চায় কিন্তু প্রচুর অর্থনৈতিক লোকসানের কারণে ফরাসি সরকার ডুপ্লেইক্সকে যুদ্ধ বন্ধ করে দেশে ফিরে যেতে বলে । ১৭৫৪ সালে ডুপ্লেইক্স দেশে ফিরে যায়। নতুন গভর্নর জেনারেল হয় চার্লস গডেহিউ। গডেহিউ ১৭৫৪ সালেই ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং মুজফফর প্রদত্ত জায়গির এবং রাজদরবারের আসন নিজেদের জন্য সংরক্ষণ করে।

১৭৫৬ সালে ইউরোপে সপ্তবর্ষীয় যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষে আবার ব্রিটিশ ফরাসি বিরোধ শুরু হয় এবং তৃতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। ফরাসিদের আর্থিক দুর্বলতার কারণে সৈন্যদের বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ফরাসি সরকার উপায়ান্তর না দেখে কাউন্ট ডি লালির নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী পাঠায় ভারতবর্ষে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফরাসিরা একের পর এক জায়গা হারাতে থাকে ব্রিটিশদের হাতে। প্রথমে হাতছাড়া হয় চন্দননগর। বাসিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় লালিকে সাহায্যের জন্য কিন্তু নর্দান সরকারের অন্তর্গত বিস্তীর্ণ অঞ্চল, মাসুলিপটম, ইয়ানাম এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা ফরাসিদের হাত থেকে দখল করে নেয় ব্রিটিশরা।১৭৬০ সালের জানুয়ারিতে তৃতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ওয়ান্ডুইশ যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজয়ের অব্যবহিত পরেই ব্রিটিশরা পন্ডিচেরি দখল করে। মালাবার উপত্যকার মাহে এবং কর্ণাটকের জিঞ্জি ও থিয়াগড়ের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই ফরাসিদের পায়ের তলার মাটি বরাবরের মত সরে যায়।

ফরাসিদের পরাজয়ের মূল কারণগুলি হল, প্রথমত কাউন্ট ডি লালির ঔদ্ধত্য এবং অসংযত আচরণ যে কারণে পন্ডিচেরির অন্যান্য ফরাসি আধিকারিকারেরা লালির থেকে দূরে সরে যায় এবং কার্যত নিষ্ক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। দ্বিতীয়ত প্রচন্ড অর্থাভাবের কারণে সামরিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত বিপর্যয়। তৃতীয়ত বাসিকে দক্ষিণ ভারত থেকে সরিয়ে নেওয়ার ভুল সিদ্ধান্ত এবং সর্বোপরি সদ্য যুদ্ধজয়ী ব্রিটিশ নৌবাহিনীর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। ১৭৬৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত হয় প্যারিস চুক্তি এবং সেই চুক্তি অনুসারে ফরাসিরা ১৭৪৯ সালের আগে নির্মিত সমস্ত কারখানা এবং অন্যান্য সম্পত্তি ফেরত পায়। শুধুমাত্র চন্দননগরের দূর্গনির্মাণ সংক্রান্ত কোনও রকম কাজের অধিকার ফরাসিদের দেওয়া হলোনা। ক্ষমতার এই নতুন বন্টনের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ ব্রিটিশ কোম্পানির অগ্রগতি ঘটতে থাকলো অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এবং ভারতবর্ষ থেকে ফরাসি কোম্পানি ১৭৬৯ সালে সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্ত হয়ে গেল। ব্রিটিশরাই কার্যত কর্ণাটকের আধিপত্য লাভ করলো যদিও প্যারিস চুক্তির শর্তানুযায়ী নবাবকেই তার সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হল। নবাবের জীবদ্দশায় ব্রিটিশরা তাকে নবাবের স্বীকৃতি ও প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত না করলেও ১৮০১ সালে তার মৃত্যুর পরে তার সাম্রাজ্য ব্রিটিশরা দখল করে নিল এবং নবাবের উত্তরাধিকারীদের জন্য ভাতা ব্যবস্থা চালু হল। হায়দ্রাবাদের নিজাম শক্তিশালী প্রতিবেশীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে বাধ্য হল এবং তার পরিবর্তে নর্দার্ন সরকারের অধিকার ব্রিটিশদের দান করে দিল। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর শক্তি যেহেতু ভারতবর্ষের অন্য সমস্ত প্রদেশের মিলিত শক্তির চেয়ে অনেক বেশি ছিল সেইজন্য ভারতবর্ষে ক্ষমতার ভারসাম্য ব্রিটিশদের দিকেই ঝুঁকে রইলো।

অষ্টাদশ শতকে ভারতবর্ষের প্রদেশগুলি ছিল পারষ্পরিক দন্দ্বে বিদীর্ণ। প্রদেশগুলি রাজস্ব বৃদ্ধি করার জন্য একে অপরের অঞ্চল অধিকার করার জন্য সবসময়ে যুদ্ধে মেতে থাকতো। সমস্ত প্রদেশ একত্রিত হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একেবারেই সম্ভব ছিল না। বরঞ্চ পার্শ্ববর্তী প্রদেশকে দখল করার জন্য অনেকেই কোম্পানির দ্বারস্থ হত। ব্যবসায়িক স্বার্থ ছাড়াও প্রদেশগুলির মধ্যেকার এই পারষ্পরিক বৈরিতা ব্রিটিশদের সুযোগ করে দিল ভারতবর্ষের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার।
0

গল্প - অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in






আজ পয়লা এপ্রিল। আজ থেকেই শুরু করব খেলাটা। আমার বেডসাইড টেবিলে একটা স্বচ্ছ কাঁচের শিশি। শিশির মধ্যে একই রকম দেখতে তিরিশটা ক্যাপসুল। রাত বারোটায় প্রতিদিন শুতে যাওয়ার আগে একটা করে ক্যাপসুল খাব। তারপর টেবিলেই রাখা ডেস্ক-ক্যালেন্ডারে সেই তারিখের পাশে একটা টিক দিয়ে শুয়ে পড়ব। খেলাটায় একটা সাসপেন্স আছে। কতগুলো তারিখে টিক পড়বে তা অনিশ্চিত। একটা মাত্র পড়তে পারে আবার তিরিশটাও পড়তে পারে। তবে ক্যালেন্ডারের এই পাতাটা ওলটাতে হবে না কোনোদিনই। পয়লা মে আমাকে দেখতে হবে না সেটা নিশ্চিত। এই তিরিশটার মধ্যে ঊনত্রিশটা ভিটামিন ক্যাপসুল হলেও একটার খোলে ভরা আছে পটাসিয়াম সায়ানাইড।

***

ইন্ডিয়ান সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটে সিনিয়ার সায়েন্টিস্ট হিসাবে কাজ করছি আজ প্রায় পনের বছর হয়ে গেল। তার আগে এখানেই জুনিয়ার সায়েন্টিস্ট পদে ছিলাম পাঁচ বছর। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার বছরখানেক পর আমাকে সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মন্ত্রকের প্রধান সচিব পদে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আমি সেই পদ নিতে অস্বীকার করে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সরকার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে বিশেষ বেতনক্রম দিয়ে আমাকে এই পদেই রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা প্রায় তিন বছর আগের কথা। বিশেষ বেতনক্রম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার আমকে একটি বিশেষ প্রোজেক্টের দায়িত্বও অর্পণ করে। চূড়ান্ত গোপনীয় প্রোজেক্ট। তিন মাস অন্তর এই প্রোজেক্টের প্রোগ্রেস রিপোর্ট বিভাগীয় মন্ত্রীর হাতে আমাকে নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে। কাজ শুরুর আগে এই গবেষণায় আমার সহকারী হিসাবে একজন জুনিয়ার বিজ্ঞানীকে নিযুক্ত করেছে সরকার। নিয়ম অনুসারে ইউপিএসসি একটি ইন্টারভিউ বোর্ড গঠন করেছিল ঠিকই। কিন্তু বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে সেই পদে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করার সম্পূর্ণ অধিকার ও দায়িত্ব আমাকেই দেওয়া হয়েছিল। কোনো সন্দেহ নেই আমিই পছন্দ করেছিলাম মধুমিতাকে। সে অক্সফোর্ডের ডক্টরেট। অবশ্য সে ছাড়া আরও দুজন প্রার্থী বিষয়ের উপর যাবতীয় প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিয়েছিল। কিন্তু কোঁকড়ানো চুলের মেয়েটির হাই-পাওয়ার চশমার পিছনে বুদ্ধিদীপ্ত দুই চোখের আত্মবিশ্বাসী চাহনিই শেষ পর্যন্ত পার্থক্যটা গড়ে দিল। কাজ শুরু হওয়ার পর উপলব্ধি করেছিলাম আমার প্রার্থী-নির্বাচন নির্ভুল। মধুমিতা মেধাবী, পরিশ্রমী, দায়িত্ববান এবং বিষয়ের উপর যথেষ্ট দখল আছে তার। আমি ভাবতেই পারিনি সে আমার বিশ্বাসভঙ্গ করতে পারে।

***

আমি নিজেও বুঝি আর পাঁচজন মানুষের সঙ্গে আমার মিলের চাইতে অমিল অনেক বেশি। আমি অমিশুক, সামাজিকতায় স্বচ্ছন্দ নই, এবং কোনো ঘনিষ্ঠ বা আন্তরিক সম্পর্কে ঢুকে পড়ায় আমার স্বাভাবিক অনীহা আছে। আমার বাল্য ও কিশোরকাল অত্যন্ত অবহেলায় কেটেছে বলেই হয়তো আমার চরিত্রটা এমনই গড়ে উঠেছে। অত্যন্ত ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে অনাগ্রহী কাকার পরিবারে আশ্রয় জুটেছিল। সেখানে দুবেলা খাওয়ার বিনিময়ে সংসারের বহুরকম কাজ করতে হত। আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ রাখতে বাড়ির কাছে একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন কাকা। ভাগ্য ভালো, মেধা আর ইচ্ছের জোরে পড়াশুনাটা অব্যাহত ছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতে অসাধারণ রেজাল্ট করার পর আমাকে আর ভাবতে হয়নি। কাকার বাড়ি ছেড়ে ছাত্রাবাসে উঠেছিলাম। সেখানে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একজন স্বাভাবিক তরুণের মতো হয়ে উঠতে পারলাম না। পড়াশোনার জগতে একা একা কাটানোই আমার নিয়তি হয়ে উঠল। একজন সাধারণ মানুষের মতো বিয়ে-থা, সংসার ইত্যাদির চিন্তা কোনোদিনই আমার মনে ঠাঁই পায়নি। এই করেই প্রৌঢ়ত্বে প্রায় পৌঁছে গেলাম। আগামী পয়লা মে পঁয়তাল্লিশে পা দেওয়ার কথা। সেদিন আমার এই প্রোজেক্টের কাজের সময়সীমাও অতিক্রান্ত হবে। আর ঠিক তিরিশ দিন বাকি আছে সেই দিনটি আসতে। সে-পর্যন্ত যেতে পারলে জন্মদিনই হতে পারে আমার মৃত্যুদিন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা তিরিশের মধ্যে মাত্র এক।

***

এই ইন্সটিটিউটে মধুমিতার যোগদান করার দিন থেকেই আমি প্রোজেক্টের কাজ শুরু করেছিলাম। এর জন্যে বিশেষভাবে তৈরি ল্যাবরেটরিটি ইন্সটিটিউট-চত্বরের এক প্রান্তে অবস্থিত। এখানে আমরা দুজন ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের একজন সিনিয়ার ইনস্পেকটরকে এই পরীক্ষাগারের সুরক্ষা-ব্যবস্থা তদারকি করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। আমার থাকার জন্য পরীক্ষাগারের লাগোয়া দুই-ঘর বিশিষ্ট একটি আবাসও আছে। খাবারের ব্যবস্থা ইন্সটিটিউটের ক্যান্টিনে।

প্রথম বছরটা প্রায় শেষ হয়েছিল গবেষণার কাজে নিমগ্ন থেকে। আমার স্বভাব অনুযায়ী মধুমিতার সঙ্গে সম্পর্কটা কাজের স্তরেই আটকে ছিল। মধুমিতা চেষ্টা করেও আমার নিরাসক্তির বর্মে আঁচড় কাটতে পারেনি। আমি তার কাজে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলাম কিন্তু সে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তোলার উপক্রম করলেই আমার দীর্ঘকালীন অভ্যাসে রপ্ত করা উদাসীন চাহনিটি ঝুলিয়ে দিতাম চোখে।

আমার রক্ষণ আলগা হতে শুরু করল ঠিক দশ মাসের মাথায় যখন অপ্রত্যাশিত অল্প সময়ে প্রোজেক্টের প্রথম ধাপে সফলতা এসে গেল। এই ধাপে আমার লক্ষ্য ছিল মানুষের জেনোমে এমপ্যাথি বা সহমর্মিতার জিনগুলিকে শনাক্ত করা। পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই ‘অপর’ একজনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, ব্যথাযন্ত্রণাইত্যাদি নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারে। তার জন্যে যে-জিনগুলি দায়ি সেগুলিই হল এমপ্যাথির জিন। এগুলো শনাক্ত করা খুব সহজ কাজ ছিল না। আমার অবশ্য একটা সুবিধে ছিল যে আমার পুরনো কাজের সূত্রেই আমি নিশ্চিত ছিলাম এই জিনগুলো কেবলমাত্র মস্তিস্কের নিওরন-কোষেই অবস্থান করে। ফলে আমার অনুসন্ধানের কাজটা একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও আমার ধারণা ছিল প্রোজেক্টের সিংহভাগ সময় নেবে এই শনাক্তকরণ। দ্বিতীয় ধাপের কাজটা তুলনায় সহজ। এই ধাপে এমপ্যাথির জিনে মিউটেশন ঘটিয়ে সেগুলোকে স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে হবে। এটা সহজ, কারণ মাইক্রোইভোলিউশন ন্যাচারাল সিলেকশনের একটা অঙ্গ, যার ফলে কোনো কোনো কার্যক্ষম জিন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, আবার উলটোটাও ঘটে থাকে। অর্থাৎ, যেটা স্বাভাবিকভাবে এবং দীর্ঘ সময়ান্তরে ঘটে সেটা আমাকে কৃত্রিমভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে হবে।

যেদিন এই শনাক্তকরণ নিঃসংশয়ে প্রতিষ্ঠিত হল, সেদিন আনন্দের আতিশয্যে আমি বোধহয় খানিকটা লঘুচিত্ত হয়ে পড়েছিলাম। সেই সুযোগে মধুমিতা আমার কাছে একটা প্রস্তাব রেখেছিল। বলেছিল, - এই সাফল্যটা আমাদের সেলিব্রেট করা উচিত স্যার।

সেদিনই সম্ভবত প্রথম আমি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে মধুমিতাকে লক্ষ করলাম। তার দৃষ্টিতে একটা সহজ আন্তরিকতা ছিল, সে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। চশমা খোলার জন্যেই কি না জানি না, তার চোখের পাতা ভারী, দৃষ্টি গভীর। সহসা তার মুখটিকে আকর্ষণীয় মনে হল আমার। উদার হয়ে বললাম, - বেশ, কী করতে চাও বলো।

সে বলল, - কাল কোনো কাজ নয়, আমাদের অনেক ছুটি পাওনা হয়ে গেছে। ক্যান্টিনে খেতে খেতে আপনার জিভে নিশ্চয়ই কড়া পড়ে গেছে। কাল বাড়ি থেকে আমাদের দুজনের জন্য একটা স্পেশাল ডিশ বানিয়ে এনে একসঙ্গে বসে খাব। আর সারাদিন গল্প করব। কাজের কথা কিন্তু নয় স্যার। সেটা বাদ দিয়ে আমাদের দুজনের যা ইচ্ছে হবে সেসব নিয়েই কথা হবে।

আমার অস্বস্তি হলেও আপত্তি জানাতে পারলাম না।

***

সেই শুরু। আস্তে আস্তে দেখা গেল প্রতি সপ্তাহে একটা দিন তার বাড়ির রান্না-করা খাবার নিয়ে এসে একসঙ্গে খাওয়াটা রুটিন করে ফেলেছে মধুমিতা। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত কথাবার্তার আদানপ্রদান খুবই সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগল। একদিন সে দুম করে জিজ্ঞেস করে বসল, - আপনি বিয়ে করেননি কেন স্যার?

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা ছিল না। আমি চুপ করে বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলাম। সেই অবসরে আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টুকটাক প্রশ্ন করে যাচ্ছিল মধুমিতা। আমি আনমনা হয়ে উত্তর দিয়ে চলেছিলাম। পরে বুঝলাম আমার ছেলেবেলা থেকে শুরু করে এ-পর্যন্ত আমার জীবনকাহিনির পুরোটাই জেনে নিল সে। আমার বিয়ে না করা নিয়ে আর কোনোদিন কোনো প্রশ্ন সে করেনি। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে মধুমিতার ব্যক্তিজীবন নিয়ে আমারও একটা আগ্রহ জন্মাচ্ছিল। জানতে চাওয়ার ব্যাপারে আমি সংকোচহীন হতে পারিনি ঠিকই কিন্তু মধুমিতা যেন টের পেয়ে গিয়েছিল আমার আগ্রহটা। ফলে ধীরে ধীরে জেনে গেলাম তার মা-বাবা কর্মসূত্রে ইউ কে-তে আছেন দীর্ঘকাল। মধুমিতার স্কুলশিক্ষা কলকাতায় হস্টেলে থেকে সমাপ্ত হলেও গ্র্যাজুয়েসন, মাস্টার্স এবং ডক্টরেট ডিগ্রি সে অক্সফোর্ড থেকে করেছে। কিন্তু তারপরেই সে মা-বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এদেশে চলে এসে কর্মজীবন শুরু করে আজ থেকে বছর ছয়েক আগে। এখানে সে পৈতৃক ফ্ল্যাটে একাই থাকে। একদিন বলল, - আপনি তো বাইরে বেরনই না। চব্বিশ ঘণ্টা কাজ আর পড়াশোনা নিয়ে থাকতে একঘেয়ে লাগে না? একদিন চলুন না আমার ফ্ল্যাটে?

আমি বললাম, - তুমি একা থাকো – যাওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না।

মধুমিতা কৌতুকের সুরে বলল, - একা থাকি না স্যার। সঙ্গে থাকে একজন। তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। চলুন না –

একটি যুবতী মেয়ের প্রাইভেট লাইফ নিয়ে কৌতূহল হওয়া ঠিক নয় কিন্তু অন্যায্যভাবে সেটাই জেগে উঠল মনে।

একদিন সে নিয়ে গেল তার ফ্ল্যাটে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তার সেই ‘একজন’-কে। পাঁচ-ছ’ বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে। ঢলোঢলো মুখে মায়াভরা চোখ নিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সেই মেয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, - কে?

একচোখ হাসি নিয়ে মধুমিতা বলল, - আমার মেয়ে।

--তুমি বিবাহিতা – বলোনি তো –

--মা হতে গেলে বিবাহিত হতেই হবে স্যার?

--না – মানে – আমি কথা খুঁজে গেলাম না।

মাধুমিতার ফ্ল্যাটে একজন সাহায্যকারীও আছেন। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। চব্বিশ ঘণ্টাই থাকেন। মধুমিতা জানাল তিনি প্রশিক্ষিত পালিকা। মেয়ের দেখাশোনা করাই তাঁর প্রধান কাজ। চুক্তির বাইরে গিয়ে গৃহকর্মের কাজেও সাহায্য করেন। মেয়ের সঙ্গে স্কুলে যাতায়াত তাঁকেই করতে হয় বেশির ভাগ সময়।

সেদিন তার বাড়িতে দুপুরের খাওয়া শেষে তার মা হওয়ার গল্প শোনাল মধুমিতা। অক্সফোর্ডের পড়াশুনা শেষ করে মা-বাবার সঙ্গে এক মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিল মধুমিতা। ওখানে কয়েকটা কাজের অফার ছিল। ফিরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এমনটাই ঠিক ছিল। এখানে থাকতে একদিন পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সুন্দরবন ঘুরতে গিয়েছিল মধুমিতা। একটা লঞ্চ ভাড়া করে তিনদিনের ভ্রমণ। সেই লঞ্চে চালকের সহযোগীদের মধ্যে তার বউও ছিল। বউ-এর কোলে তিন-চার মাসের একটা বাচ্চা। মধুমিতা লক্ষ করল বয়স্ক চালকের যুবতী বউটি প্রায়ই বাচ্চাটাকে ইঞ্জিন ঘরের মেঝেতে শুইয়ে রেখে অন্য একজন তরুণ সহযোগীর সঙ্গে হাসিগল্পে মজে থাকছে। বাচ্চাটা তারস্বরে কেঁদেই চলেছে, কোনো হুঁশ নেই বউটার। বাচ্চাটার কান্না মধুমিতার বুকে এসে বিঁধতে লাগল। থাকতে না পেরে বউটাকে গিয়ে ধরল, - তোমার বাচ্চা কাঁদছে, শুনতে পাচ্ছো না?

বউটা বলল, - আমার বাচ্চা কেনে হবে, ননদটা বিয়োতে গিয়ে মরেচে, তার সোয়ামিটাও খ্যাপাপাগলা। কেউ দায়িত্ব নিলনিকো – আমার ইনি সাধু সেজে মেয়েটাকে আমার ঘাড়ে চাইপ্পে দিল। আমার নিজেরই তিনটা আছে। সেগুলাকে ঘরে থুয়ে এসচি, এই কচিটার ভার কে লেবে? খিদার জ্বালায় কেন্দে মচ্চে, কত আর দুধ গুলে খাওয়াই!আমার মাই তো শুককে গেছে।

বাচ্চাটার কান্না মধুমিতার বুকে স্থায়ী হয়ে গেল। ফেরার সময় চালকের সঙ্গে কথা বলে তার ফোন নম্বর নিয়ে এসেছিল। কলকাতায় ফিরেই একজন অ্যাডভোকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করল। দত্তক নেওয়ার আইনকানুন বুঝে নিয়ে চালককে সব জানাল। এদিকে লন্ডনে ফেরার সময় এসে গিয়েছিল। মধুমিতা গেল না। এই নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে তিন দিন ধরে বাদানুবাদ চলল। মধুমিতা সংকল্প থেকে নড়ল না। তাঁরা ফিরে যাওয়ার পর দত্তক দলিল তৈরি হল। নির্দিষ্ট দিনে চালক মেয়েটাকে নিয়ে একাই এসেছিল। রেজিস্ট্রি হওয়ার পর লোকটির চোখে জল। বলল, - আমার অভাগী বুনের আত্মাটা শান্তি পাইল মা। একটা সোন্দর জীবন অনাথ মেয়েটার কপালে লেখা হয়ে গেল।

একটা বিখ্যাত পালিকা কেন্দ্রের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করেছিল মধুমিতা। এই ভদ্রমহিলা সেদিন থেকেই বাচ্চাটির দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন।

***

প্রোজেক্টের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ বেশ উৎসাহের সঙ্গে শুরু করেছিলাম। একের পর এক উৎসেচকের ব্যবহার এবং ডিএনএ-এর বেস বদল করতে করতে এগিয়ে চলেছিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই পদ্ধতিতেই জিন ফ্রিকোয়েন্সির এমন পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব যাতে উদ্দিষ্ট জিনগুলি স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় হবে। বছরখানেকের মধ্যেই আংশিক সফলতা এল। এমপ্যাথির জিন নিষ্ক্রিয় হল কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সেগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠল। আমি বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা চালিয়েও নিস্ক্রিয়তাকে স্থায়ী করতে পারছিলাম না। দিনের পর দিন একই ফল পেতে পেতে আমার মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধল। ভালো করে খতিয়ে দেখে মনে হল, নিষ্ক্রিয় জিনের সক্রিয় হয়ে ওঠা স্বাভাবিক নয়, কেউ যেন এদের উপর রিভার্স পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করছে। একটু ভাবতেই যেন ইলেকট্রিক শক লাগল মাথায়! মধুমিতা ছাড়া আর কারোর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। তবে কি মধুমিতাই! কিন্তু কেন?

নিমেষেই মনে পড়ে গেল মধুমিতা একদিন কথাপ্রসঙ্গে বলেছিল, - এই প্রোজেক্টের পিছনে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে ভেবেছেন স্যার? সহমর্মিতাহীন মানুষ মানে তো ভয়ংকর এক জীব। তাদের বুদ্ধি থাকবে, দক্ষতা থাকবে অথচ মানবিক বোধ থাকবে না। যে কোনও ধরনের পৈশাচিক কাজে তাদের ব্যবহার করতে পারবে সরকার। ধরুন এদের নিয়ে কোনো গুপ্ত বাহিনী গঠন করল সরকার। তারপর সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের সব ধরনের প্রতিবাদ, বিক্ষোভে এদের ব্যবহার করতে লাগল।

আমি বলেছিলাম, - এসব তো রাজনীতির কথা। আমরা বিজ্ঞানী, প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করাই আমাদের একমাত্র কাজ।

তর্ক না বাড়িয়ে চুপ করে গিয়েছিল মধুমিতা। প্রসঙ্গ পালটে অন্য কথায় ঢুকে পড়েছিল। এই মুহূর্তে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। মধুমিতা আগেভাগেই আমাকে সন্দেহপরায়ণ করে তুলতে চায়নি। তাহলে তাকে গবেষণা থেকে ছেঁটে দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

প্রোজেক্টের সময়সীমা শেষ হতে দুটো মাসও বাকি নেই। মধুমিতাকে ছেঁটে দিয়ে নতুন করে আরম্ভ করার সুযোগ মিলছে না। আমার ক্যারিয়ারে এর আগে কোনোদিন ব্যর্থতার মুখ দেখতে হয়নি। সরকারের অগাধ আস্থা ছিল আমার উপর। সেটা তো গেলই, সেই সঙ্গে বিজ্ঞানী হিসাবে আমার বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে। এতখানি বিশ্বাসঘাতকতা করল মধুমিতা! নিমেষে সব রক্ত যেন মাথায় উঠে গেল আমার। রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠলাম। দ্রুত পায়ে ল্যাব থেকে বেরিয়ে অফিস ঘরে ঢুকলাম। মধুমিতা তার চেয়ারে বসে কিছু একটা করছিল। আমি তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিলাম, তারপর ডান আর বাঁ হাত দিয়ে সপাটে চড় কষাতে লাগলাম তার দুই গালে।

কতক্ষণ পরে থেমেছিলাম জানি না। মধুমিতা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি, যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে এক চুলও সরেনি। আমি থামার পর ধীরে ধীরে বসল চেয়ারে। তার রক্তলাল দুই গাল বেয়ে ঝরে চলল অশ্রুধারা। তার ভেজা চোখ তখনও নিবদ্ধ আমারই দু-চোখে। জানি না সহসা কী দেখলাম সেই দৃষ্টিতে, তীক্ষ্ণ কিছু একটা এসে বিঁধে গেল আমার বুকে। আর আমার মন জুড়ে অনুভবের পরিব্যক্তি ঘটে চলল। আমি মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে মধুমিতার কোলে মুখ গুঁজে দিলাম।

***

সেদিনের পর মধুমিতা আর আসেনি। ক্যুরিয়ার মারফৎ তার পদত্যাগপত্র আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেটা আজ অব্দি আমার ড্রয়ারেই পড়ে আছে। ইতিমধ্যে ঠাণ্ডা মাথায় আমি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। ল্যাবে উপাদান ছিলই। পটাসিয়াম সায়ানাইড তৈরি করতে সময় লাগেনি। দোকান থেকে পঞ্চাশটা ক্যাপসুলের একটা শিশি কিনলাম। ল্যাবে গিয়ে কুড়িটা ক্যাপসুল বের করে বাস্কেটে ফেলে দিয়ে একটা ক্যাপসুলের খোল খুলে সেটা খালি করে তার মধ্যে পটাসিয়াম সায়ানাইড ভরে নিলাম। শিশির বাকি ঊনত্রিশটা ক্যাপসুলের সঙ্গে সেটা মিশিয়ে বিছানার পাশের টেবিলে রেখেছি। বিজ্ঞানী হিসেবে আমি অনির্দেশ্য তত্ত্বে বিশ্বাসী। মৃত্যু নিশ্চিত করেছি বলে তার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করার অধিকার আমার নেই।

আজ পয়লা এপ্রিল। বেশ কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা হয়েছে। ফাঁকা মগজ, শরীরময় আলস্য। মোবাইল বেজে উঠল। হাতে নিয়ে দেখি এখানের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা ইনস্পেকটর। বললেন, - মধুমিতা ম্যাডাম এসেছেন, কিন্তু সঙ্গে একটি ছোটো মেয়ে। কোনো অসুবিধে নেই তো স্যার?

অবাক হওয়ার উদ্যমও বুঝি অবশিষ্ট নেই আমার। একটি পরেই মধুমিতা তার মেয়েকে নিয়ে ঢুকল। আমি তাদের শোয়ার ঘরে নিয়ে এসেই বসালাম। নিচু হয়ে মেয়ের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। মধুমিতা বলল, - সরি স্যার।

কেন দুঃখপ্রকাশ জানতে চাইলাম না। মধুমিতা বলল, - সেকেন্ড ফেজের কাজ নতুন করে শুরু করেছেন তো স্যার। আমার মনে হয় বাকি এই এক মাসেই আপনি লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন।

মধুমিতা সোফায়। মেয়েটি আমার গা ঘেঁষে বিছানায় বসেছে। আমি তার চুলে হাত ডুবিয়ে বললাম, - মন্ত্রকে আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নেওয়াও অসম্ভব হবে না, কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত বদল করেছি মধুমিতা। তোমার মতো আমিও পদত্যাগপত্র লিখে রেখেছি। দুটো চিঠি একসঙ্গেই অফিসের ড্রয়ারে রাখা আছে। দুটোর স্বাক্ষর একই তারিখের। আমি দৈবাৎ ভুলে গেলে তুমি মন্ত্রকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিও।

মধুমিতার চোখে যেন একটা চমক দেখলাম। তারপরেই তার চঞ্চল দৃষ্টি সারা ঘরে ঘুরতে লাগল। এই প্রথম এই ঘরে ঢুকেছে সে। তাই কি খুঁটিয়ে দেখছে? একটু পরে সোফা আর বিছানার মাঝখানে রাখা টেবিলে তার দৃষ্টি স্থির হল। সামান্য অস্বস্তি বোধ করলাম আমি। সে একটু ঝুঁকে ক্যাপসুলের শিশিটা খুঁটিয়ে দেখল। বলল, - রোজ খান?

উত্তর দিতে গিয়ে একটু থমকালাম। সামলে নিয়ে বললাম, - মাঝে মাঝে।

কয়েক মিনিট নীরবতা। মধুমিতার মেয়ে একটা মোটা বই খুঁজে বের করেছে। রঙিন ছবিওলা অ্যানাটমির বই। একমনে পাতা উলটে উলটে ছবি দেখে চলেছে। খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে। হঠাৎ মধুমিতা উঠে দাঁড়াল। বলল, - একবার ল্যাবে যেতে পারি স্যার?

আমি হাসলাম, - যাও না – স্যাবোটেজ করার কোনো সুযোগ তো আর নেই।

কোনো কথা না বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল মধুমিতা। তখনই আমার মাথায় একটা দুশ্চিন্তা ঢুকল। ক্যাপসুলের কাজ করে আসার পর থেকে আর তো যাইনি ল্যাবে। সব এলোমেলো পড়ে আছে। বাস্কেটে অতগুলো ক্যাপসুল - কেসিএন তৈরির কোনো ক্লু ছেড়ে আসিনি তো?

বোধহয় মিনিট পনেরো পরে ফিরে এল মধুমিতা। সোফায় বসে খানিক আনমনা স্বরে বলল, - আপনার কোনোদিন কোনো মেজর অপারেশন হয়েছে স্যার?

--হঠাৎ এই প্রশ্ন?

--না, অচেতন থেকে চেতনায় ফেরার কথা ভাবছিলাম। একটা অপূর্ব অভিজ্ঞতা!

--তুমি কী অর্থে বলছো?

মধুমিতা কেমন যেন একটা হাসল। বলল, -- না না, অন্য কিছু নয়। মেজর অপারেশনের আগের অ্যানেস্থেসিয়ার কথাই বলছি। আমার হয়েছিল। লন্ডনে। তখন মাস্টার্স করছি। য়ুফেরেক্টমি, সিস্টের জন্য ওভারি বাদ দিতে হল। দুটোই।

আমি হতভম্ব। যতোটা না এই নিদারুণ সংবাদে, তার চেয়ে বেশি সেটা জানানোর সময় বাছার জন্য। কোনো একটা কার্যকারণ সম্পর্কের হদিশ হাতড়াচ্ছিলাম। তখনই সোফা থেকে উঠে এল মধুমিতা। যেন ছোঁ মেরে ক্যাপসুলের শিশিটা তুলে নিল হাতে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শিশি হাতে ঘরের লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে গেল। একটু পরেই ফ্লাশ টানার শব্দ পেলাম। চোখের সামনে দ্বিতীয় অন্তর্ঘাতটি ঘটাল মধুমিতা।

***

বারটা বাজল বোধহয়। ইংরাজি ‘বোকা দিবস’ অস্তে গেল। পয়লা মে যে আমার জন্মদিন সে-খবরটাও মধুমিতার জানা। এই মুহূর্তে সে সোফায় আধশোয়া। তার মেয়ে আমার কোলে মাথা রেখে বহুক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি মধুমিতা এবং আমার মাঝখানে থাকা টেবিলের শূন্যজায়গাটার দিকে তাকিয়ে মধুমিতার চূড়ান্ত অন্তর্ঘাতের প্রতীক্ষা করছি।


সৃষ্টির একুশ শতক, মার্চ ২০২১