Next
Previous
Showing posts with label গল্প. Show all posts
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in







 দ্বাদশ পর্ব

-কী ব্যাপার। সকাল সকাল শিকারের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলেন? কিছু পেলেন?

-আমরা এটাকে সকাল বলিনা।

-জানি। আমি ভেবেছিলাম সুন্দরী অফিসে ছিলেন।

সুন্দরী বলল,’ হ্যাঁ, ছিলাম।‘কেলো দারোগা বলল,’ আপনারা কখন যে কী প্যাঁচ মারবেন বলা মুস্কিল। কোথাও বসে একটু কথা বলতে পারি?’ পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ কি ব্যাপারে?’

-একটা খুনের বিষয়ে। ভালো বিষয় নয়? আপনাদের এবং আমার দু’জনেরই বিষয়টা বেশ প্রিয়। তাই নয় কি?

-চলুন, অফিসে বসা যাক।

ওরা সকলে মিলে পানু রায়ের অফিসে গিয়ে বসল। পানু রায় বললেন,’ আমি সিগারেট খাই না। আপনি স্বচ্ছন্দে খেতে পারেন।‘ কেলো দারোগা পানু রায়কে ধন্যবাদ জানিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। পানু রায় বললেন,’ বলুন।‘

-শিবুলাল রেগমি খুন হয়েছে।

-কী করে?

-একটা ০.৩৮ রিভলভার থেকে ক্লোস রেঞ্জে।

-কখন?

-কাল রাত্রে।

-কোথায়?

-একটা ফ্ল্যাটে। যেখানে আপনি কাল রাত্রি আটটা নাগাদ ওর সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

-একদম ঠিক। কিন্তু আপনি জানলেন কোথা থেকে?

-সেটা আমাদের পেশাগত গোপনীয়তা।আমি চেষ্টা করি যতটা সম্ভব সব খবর নিজের কাছেই রাখতে। যাতে আপনি না বুঝতে পারেন আমি কতটা বেশি বা কতটা কম জানি। এতে আমার প্রশ্ন করতে সুবিধে হয়।

-কেন? আপনি মনে করেন আমি আমার উত্তরে সত্য গোপন করা চেষ্টা করতে পারি?

-হ্যাঁ, তাই।আমি জানি আপনি মিথ্যা বলবেন না। কিন্তু আপনি এমন উত্তর দেবেন যাতে আমি যেটা জানতে চাইছি সেটা জানতে পারবো না। আপনি শিবুলালের সঙ্গে কাল রাত্রে দেখা করেছিলেন। কেন দেখা করেছিলেন?

-একটা ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে।

-কী রকম ব্যবসা?

-আমার এক মক্কেলের সঙ্গে জড়িত একটি ব্যবসার ব্যাপারে।

-আপনি আবার কথা ঘোরাচ্ছেন। আমি জানতে চাই আপনি কী কথা বলেছিলেন?

-আমার মক্কেলের ব্যাপার গোপন রাখার জন্য আমি চুক্তিবদ্ধ। সেটাই এই পরামর্শদান ব্যবসার নিয়ম।

-সেটা আপনার পক্ষে এই খুনের ব্যাপারটায় সুবিধেজনক হবে।

-হয়ত হতে পারে।

-শিবুলালের কাল রাত্রে অন্য কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল।

-তাই?

-আপনি জানেন কাদের সঙ্গে?

-আমি জানি কেউ শিবুলালের সঙ্গে দেখা করতে আসছিল। অন্তত শিবুলাল সেরকম আশা করছিল।

-তারা কারা?

- সেটা আমি জানিনা। দুঃখিত, আপনাকে সাহায্য করতে পারছি না।

-আমাকে সাহায্য করতে পারছেন না মানে কী বলতে চাইছেন আপনি?

-আমি যা বলেছি তাই বলতে চাইছি।

-না, আপনার কথার অনেক রকম মানে হতে পারে। হতে পারে আপনি সত্যিই জানেন না। আবার এও হতে পারে আপনি জানেন কিন্তু বলছেন না।

-আরও একটা মানে হতে পারে। অন্য কারুর থেকে কিছু শুনে, তার নিজের মত ব্যাখ্যা করে বা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কিছু বললে সেটার দ্বারা কিছু প্রমাণ করা যায় না।

- বুঝলাম। আচ্ছা সুন্দরী, আপনি বলুন এটা কী ধরণের উত্তর। দেখুন আমি কিন্তু আজ সকালে আপনি কারও সঙ্গে দেখা করার আগেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা তো হলনা। আমার মনে হয় আমার এই দেখা না হওয়ার পিছনে সুন্দরীর বুদ্ধিমত্তার একটা ভূমিকা আছে। দেখুন ,পানু রায় ,আমরা পুলিশরা কিন্তু খুব বোকা নয়। যখন আপনি অফিসে সময়ে এলেন না এবং সুন্দরী তাড়াতাড়ি করে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন আমি তখনই বুঝতে পেরেছি আপনি কিছু একটা প্ল্যান করেছেন। আমি অপেক্ষা করছিলাম। যখন আপনারা ট্যাক্সি থেকে নামলেন তখন আপনারা একটু অসাবধান হয়ে পড়েছিলেন। আপনাদের উচিৎ ছিল একটু আগে নেমে বাকিটা রাস্তা হেঁটে আসা। এই ভুলটার জন্য যেটা হল সেটা হচ্ছে এই যে আমি ট্যাক্সি নাম্বারটা পেয়ে গেলাম। আমি অফিসে জানিয়ে দিলাম যে ঐ ড্রাইভার যেন এক্ষুণি আমাদের অফিসে দেখা করে। ওরা জানতে পারবে আপনারা কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন। আর ড্রাইভারকে একটু চাপ দিলেই আরও অনেক খবর জানা যাবে। আশা করি তারমধ্যে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং খবরও থাকবে।

- অবশ্যই। আমার পক্ষে খুব ভাল হল যে একটা প্রকরণগত ভুল আপনি ধরিয়ে দিলেন

-ওকথা বলবেন না। আমি খুব ভালোভাবে জানি যে আপনি আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজেই বুঝতে পেরেছেন যে কী ভুল আপনি করেছেন। আমার মনে হয় গাড়ির মধ্যে ঐ সুন্দরীর জন্যই আপনি গাড়িটা আগে থামাননি। তাতে ঐ সুন্দরী মহিলার মনে সন্দেহ হত। যাই হোক আমার পরের প্রশ্ন হচ্ছে যে ঐ মহিলা কে? এবং কেন উনি ট্যাক্সি থেকে নামলেন না?

- ঐ মহিলার নাম এলিনা রাই । উনি রোজমেরি অ্যাপার্টমেন্টের ৩১৭ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন। ওনার ফোন নম্বর ৭২৪৮১। উনি আগে আমার মক্কেল কৃষ্ণকালী চৌধুরীর সেক্রেটারি ছিলেন। এখন উনি সিনেমাপাড়ায় যাচ্ছেন। উনি মঞ্চে অভিনয়ের ব্যাপারে আগ্রহী।

-অনেক ধন্যবাদ। আমি পরে মিলিয়ে দেখে নেব।

-তার মানে কী?

-আমার মনে হয় এই খুনের সঙ্গে ঐ মহিলার কোনও যোগাযোগ নেই। অবশ্য যদি আপনি কিছু লুকিয়ে থাকেন আমার কাছে তাহলে বলতে পারবনা। আর কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন?

-আমার মনে হয় এই বিষয়ে এখন আলোচনা করতে আমি বাধ্য নই।

-ঠিক আছে। এলিনা রাই কি কৃষ্ণকালীবাবুর সেক্রেটারি ছিলেন?

-হ্যাঁ।

- আপনার সঙ্গে কৃষ্ণকালীবাবুর শেষ কবে কথা হয়েছিল?

-দেখুন, আমি ওনার আইনি পরামর্শদাতা। কখনও কাজ থাকলে দিনের মধ্যে অনেকবার কথা হয় আবার কখনও মাসের পর মাস কথা হয়না।

কেলো দারোগা সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে বলল,’ আপনি এনার উত্তর শুনলেন তো। অনেক প্রশ্নকারই এইরকম উত্তর শুনে খেই হারিয়ে ফেলবে এবং আসলে প্রশ্নটা কী ছিল ভুলে যাবে। আমার প্রশ্নটা ছিল ওনার সঙ্গে কৃষ্ণকালীবাবুর শেষ কবে কথা হয়েছিল? আপনি কি ওনার শব্দজাল থেকে আমার প্রশ্নের উত্তরটা উদ্ধার করে দেবেন?

পানু রায় বললেন,’ শুনুন, আমি বলছি। আমিই গত সোমবার বিকাল থেকে ওনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি এবং এখনও পর্যন্ত ওনাকে পাইনি।‘

-তাহলে আপনি সোমবার বিকাল থেকে ওনাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছেন এবং এখনও করছেন? বেশ। এবার বলুন সোমবার বিকাল থেকে এখন অবধি আপনার সঙ্গে কি কৃষ্ণকালীবাবুর দেখা হয়েছে?

পানু রায় হাসি সংবরণ করতে পারলেন না। কেলো দারোগা মাথা নেড়ে বলল,’ আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় আপনার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গীর ওপর লক্ষ্য রাখতে হয়। আপনি কী বলছেন নয় আপনি কী বলছেন না সেটাই জানা খুব দরকার। আপনার অবগতির জন্য জানাই কৃষ্ণকালীবাবু গতকাল রাত্রে শিবুলালা রেগমির সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

-তাই নাকি!! গতকাল রাত্রে কৃষ্ণকালীর সঙ্গে শিবুলালের দেখা হয়েছিল?

-এবার আমার একটা ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনি কি গতকাল শিবুলালের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন এবং পিছনের সিঁড়ির কাছে অপেক্ষা করছিলেন? তারপর এক কমবয়সী মহিলাকে গাড়িতে তুলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন? একজন প্রত্যক্ষদর্শী এটা দেখেছে। যদিও আলো কম ছিল তবুও ঐ প্রত্যক্ষদর্শী আপনাকে চিনতে পেরেছেন। সত্যি কথা বলতে কী আপনার জনপ্রিয়তা যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে এখন আপনাকে সবাই চিনে গেছে।

-হ্যাঁ। আপনি যা বলছেন তা সঠিক।

-তাহলে কি এরকম হতে পারে যে ঐ মহিলা কোনও কারণে শিবুলালকে গুলি করে এবং আপনাকে ফোন করে জানায় যে একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে এবং আপনার সাহায্য ওনার দরকার। বা এমনও হত পারে যে আপনি ওনাকে জিজ্ঞাসা করলেন কী হয়েছে। উনি আপনাকে বললেন ওনার সঙ্গে শিবুলালের কথা কাটাকাটি হচ্ছিল এবং ভয় দেখাবার জন্য উনি শিবুলালের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে ধরেন। শিবুলাল ভয় পেয়ে ওনার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নেবার চেষ্টা করে। সেইসময় ধস্তাধস্তি চলাকালীন উনি একটি গুলি চলার শব্দ শুনতে পান এবং দেখেন শিবুলাল গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। এই পরিস্থিতে আপনি ওনাকে বলেন যে সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে কিন্তু আপনি পিছনের দরজায় অপেক্ষা করবেন এবং ওনাকে নিয়ে গাড়িতে তুলে নেবেন। একথাও কি বলেছিলেন যে এই ব্যাপারে সে যেন মুখ না খোলে?

-আপনি বলতে চাইছেন যে ঐ মহিলাকে আমি বলেছি পুলিশকে কিছু না বলতে।

-আমার সেটা মনে হয়। অন্তত এটার একটা সম্ভাবনা আছে।

-মৃতদেহ সম্পর্কে পুলিশকে কিছু না বলতে?

-হ্যাঁ। আমার সেটা মনে হচ্ছে।

-আপনার কি মনে হয়না এটা আমার পক্ষে অনাগরিকসুলভ এবং অপেশাদারি কাজ হবে?

-সেটা নির্ভর করছে আপনি ঘটনাটাকে কী ভাবে দেখছেন বা দেখাবেন তার ওপর। আইনকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সবাই জানে আপনি আপনার মক্কেলের স্বার্থে ব্যাপারটা এমনভাবে ব্যাখ্যা করবেন যাতে আপনার মক্কেলের কোনও ক্ষতি হয়। আসল আইনটা কী সেক্ষেত্রে সেটা গৌণ হয়ে দাঁড়ায়।

-তার মানে আপনি বলছেন মক্কেলকে বাঁচাবার জন্য আমি যে কোনও আইনের অপব্যাখ্যা করতে পারি?

-অনেকটা সেরকমই।

-বেশ কৌতূহলউদ্রেককারী সম্ভাবনা।

-আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর এখনও দেননি।

-তাহলে শুনুন উত্তর হচ্ছে –না।

-আপনি মজা করছেন না তো?

-না, একেবারেই নয়।

-আপনি প্রথম কখন শিবুলালের মৃত্যুসংবাদ পান?

-সুন্দরী টিভিতে আজ সকালে খবরটা দেখে আমাকে জানায়।

-কত সকালে?

-বলতে পারবো না।

-বেশ, তারপর আপনি ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লেন?

-আমি আমার মক্কেলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।

-কোন মক্কেল? কৃষ্ণকালী চৌধুরী? কেন?

-আমি ওকে জানাতে চেয়েছিলাম যে শিবুলাল মৃত। ভেবেছিলাম এই খবরটা ওকে ওর বর্তমান পরিকল্পনা পরিবর্তন করার জন্য দরকার।

-কৃষ্ণকালীর সঙ্গে দেখা হলো?

-না

- ফোনে কথা হলো?

-না

-অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য ওপরতলার নির্দেশ ছিল।

-আপনাদের সঙ্গে আমি সবসময় সহযোগিতা করতে চাই।

-যদি আপনার মত সবাই আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করত তাহলে ওপরওলাদের মাথায় এত চিন্তা থাকত না। যাই হোক আপনাকে কিন্তু আমি খোলাখুলিভাবে সব কিছু বলার সুযোগ দিয়েছি। সেই সুযোগের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার আপনি নিশ্চয়ই করেছেন। তবে আপনি আমরা কী চাইছি জেনেও যদি কিছু লুকিয়ে থাকেন সেটা কিন্তু ভালো হবে না। আমরা এখন কৃষ্ণকালীকে খুঁজছি। আপনার সঙ্গে যদি যোগাযোগ হয় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবেন। বলবেন খুব জরুরি দরকার।‘

কেলো দারোগা উঠে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা হাই তুলে বললো,’ সহযোগিতার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ বা বলা যেতে পারে আপনার অনিচ্ছাকৃত সহযোগিতার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। সে যাই হোক এতে যে আমার অনেক উপকার হল সে কথা বলা বাহুল্য। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা। আপনি নিশ্চয়ই জানেন কৃষ্ণকালীবাবু নিজে ডেপুটি শেরিফ হবার সুবাদে আত্মরক্ষার জন্য সঙ্গে বন্দুক রাখতে পারেন। সেটা অবশ্য সত্যি দরকার। গভীর রাত্রিতে অনেক টাকা সঙ্গে করে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে তো কাছে বন্দুক রাখতেই হবে। তাই না মিঃ রায়? কিন্তু আপনি কি জানেন ওনার বন্দুকটা এখন কোথায়?’

পানু রায় অবাক হয়ে বললেন,’ কোন বন্দুক?’

-যেটা কৃষ্ণকালীবাবু নিজের সঙ্গে রাখেন।

-সেটাতো কৃষ্ণকালীবাবুর কাছে থাকা উচিৎ। তাই নয় কি?

-কে জানে? আমি সত্যিই কিছু জানি না। তবে জানার চেষ্টা করছি। কী হবে সে ব্যাপারে আপনি অবশ্য বাজি ধরতেই পারেন। আজ আসি। অনেক সময় নিলাম। আপনি ব্যস্ত মানুষ তার ওপর এখন নিশ্চয়ই আপনাকে বেশ কিছু ফোন করতে হবে। আমি হঠাৎ এসে পড়ায় ব্যাপারটা একটু ঘেঁটে গেল মনে হয়।

-আপনি আমার টেলিফোনে আড়িপাতার ব্যবস্থা করেননি আশা করি।

-আরে না,না, এখনও অতদূর পর্যন্ত যাইনি। দেখা হবে। আসি।

কেলো দারোগা বেরিয়ে যাবার পর পানু রায় বললেন,’ সুন্দরী মনীষা প্রসাদকে পাও কি না দেখ তো।‘ সুন্দরী বলল,’ মানে মনীষা ঝা। আমি ওর নতুন পদবিটা মনে রাখতে পারি না।‘

সুন্দরী ফোনটা পানু রায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’ মনীষা ঝা মানে মনীষা প্রসাদ।‘

পানু রায় ফোনটা কানে লাগিয়ে বললেন,’ মনীষা, একটা জরুরি ব্যাপারে তোমাকে ফোন করছি। তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হওয়ার পর অনেক কিছু ঘটে গেছে। কৃষ্ণকালী তোমায় ফোন করতে পারে। করলে বোলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আর বোলো খুব সাবধানে যেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে, কারণ পুলিশ কৃষ্ণকালীকে খুঁজছে।‘

-কী সাংঘাতিক!! পুলিশ? কেন?

-হ্যাঁ, পুলিশ।

-আপনার কেন মনে হল উনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন?

- কারণ, আমি কাল রাত্রে ওনাকে বলেছি যে তুমি দু দু-বার ওনার সঙ্গে দেখা করতে চেষ্টা করেছিলে। শুনে তো উনি আকাশ থেকে পড়লেন। এলিনা ওনাকে বলেনি পর্যন্ত যে তুমি ওনার খোঁজ করেছিলে।

-জানিনা কেন ঐ অসভ্য মেয়েটা দু’বারই আমার সঙ্গে এমন করল? রাগে আমার সারা শরীর কাঁপছে।

-সাবধান। অত চাপ নিওনা। শান্ত হও। কৃষ্ণকালী গতরাত্রে এলিনাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছেন।

-যাক। ওনার জন্য ভালোই হয়েছে। এখন কে আফিস চালাচ্ছে?

-কেউ না।

-দেখুন মিঃ রায়। আমি আবার কাজে যোগ দিতে পারি।

-কী বলছ তুমি?

-ঠিকই বলছি। যতদিন না উনি অন্য কাউকে পাচ্ছেন ততদিন আমি কাজ চালিয়ে দিতে পারি।

-মনীষা, সেটা হয় না।

-কেন হয় না? আমার কাছে এখনও অফিসের একটা চাবি আছে।অফিসের কোথায় কী আছে আমার নখদর্পণে। আমি সমস্ত ক্লায়েন্টদের চিনি। যদিও পরিস্থিতি এখন পাল্টে গেছে তবুও ওনার বিনিয়োগ এবং কাজের ধরণ আমার জানা। আমার মনে হয় আমি খব খারাপ একটা কিছু করব না। তবে হ্যাঁ, আমার চেহারার যা অবস্থা তাতে এলিনার মত অফিসের সৌন্দর্যবৃদ্ধি হয়ত আমি করতে পারবো না কিন্তু আমার যা কাজ তা আমি অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে পালন করতে পারব।

-আমার মনে হয় না এটা ঠিক কাজ হবে।

- আপনি একথা কেন বলছেন?

-কিছু অচেনা লোক অফিসে আসতে পারে।

-সে ক্ষেত্রে আমি নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে ঠিক করব কাকে ভেতরে ঢুকতে দেব আর কাকে দেব না।

-কিন্তু তুমি যে সব লোকের কথা ভাবছ এর সেরকম নয়।এরা সাদা পোশাকে আসবে কিন্তু মনে রাখতে হবে এরা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী।

-বুঝতে পেরেছি। আমার স্বামী গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে বেরোচ্ছি। আপনার সঙ্গে যদি কথা হয় ওনাকে বলবেন আমি কাজ শুরু করে দিয়েছি এবং যাতায়তের ট্যাক্সিভাড়া আমার পাওনা।

-ঠিক আছে।

ফোন রেখে পানু রায় সুন্দরীকে বললেন,’ আমি বেরোচ্ছি। আমি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। ট্যাক্সি নয়।‘ সুন্দরী বলল,’ একজন প্রত্যক্ষদর্শীর প্রয়োজন হতে পারে।‘ পানু রায় হেসে বললেন,’ অফিসে তোমার অনেক জরুরি কাজ আছে।‘ কথা শেষ হওয়ার আগেই পানু রায়ের ফোন বেজে উঠল।

-কৃষ্ণকালী? তুমি কোথায়?

-ভালো করে শুনুন। বেশি কথা বলার সময় নেই। হতে পারে আত্মরক্ষার জন্য রেবা কৈরালার চালানো গুলিতে শিবুলাল মারা গেছে। আপনি রেবাকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করুন।

-ঠিক আছে। নিশ্চয়ই করবো। কিন্তু আগে বলো তুমি কোথায়?

-আমি পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছি।

-কিন্তু কেন?

-আমি যদি পুলিশের সন্দেহ আমার দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারি তাহলে সেটা কাটিয়ে রেবাকে সন্দেহ করতে পুলিশের অনেক সময় লাগবে।

-কিন্তু সেটা বিপজ্জনক হবে। তুমি কিন্তু জড়িয়ে পড়বে এবং বেরোতে পারবে না।

-আমি জড়িয়ে পরতেই চাই,মিঃ রায়।

-আমি তোমায় বারণ করছি, কালীকৃষ্ণ। তুমি যদি নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ তৈরি কর তাহলে কিন্তু সেগুলো পুলিশ ওদের সুবিধেমত ব্যবহার করে তোমাকে হেনস্তা করতে পারে।

-ঠিক আছে। আপনি রেবার দিকটা দেখুন। ওটাই সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। আমাকে নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। আমার ব্যাপার আমি সামলে নেব। রেবাকে বাঁচাবার জন্য যা দরকার হয় করুন।

-এমনকি তুমি নিজে জড়িয়ে গেলেও?

-হ্যাঁ, আমি জড়িয়ে গেলেও।

-কিন্তু কেন এসব করছ তুমি? শুধুমাত্র রেবা তোমার ছেলের প্রাক্তন প্রেমিকা বলে?

-না, মিঃ রায়। আমি নিজে রেবাকে ভালোবাসি। সবসময় আমি ওকে ভালোবাসতাম। আমি নিজেও নিজেকে একথা বোঝাতে ভয় পেতাম কিন্তু এটা সত্যি। আমি আপনাকে বিশ্বাস করে একথা বললাম। ঈশ্বরের দোহাই আপনি একথা কাউকে বলবেন না এমনকি সুন্দরীকেও নয়। আপনি জানতে চাইলেন তাই বললাম।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন পানু রায়। ওপার থেকে কৃষ্ণকালীর গলা ভেসে এল,’ আপনি কি লাইনে আছেন?’ পানু রায় বললেন,’হ্যাঁ। আছি। শোনো, তোমাকে আর একটা খবর দিই। আমার সঙ্গে এলিনার কথা হয়েছে।সে আর কোনওদিন তোমার অফিসের ধারেকাছে যাবেনা বলে জানাল। তোমার অফিস এখন তালাবন্ধ।‘

-না না, তসে কী করে হতে পারে। আমার প্রচুর কাজ বাকি পড়ে আছে। দু-একদিনের মধ্যে একগাদা অর্ডার ফাইনাল হবার কথা। অনেক টাকার ব্যাপার। তার চেয়েও বড় কথা আমার এতদিনের সুনাম মাটিতে মিশে যাবে। অফিস কিছুতেই বন্ধ রাখা যাবে না। আপনি একটা কিছু ব্যবস্থা করুন।

- আমি ইতিমধ্যেই ব্যাপারটা এগিয়ে রেকেছি।আমার সঙ্গে মনীষার কথা হয়েছে। ওকে বলেছি এলিনা ছেড়ে দিয়েছে এবং অফিস তালাবন্ধ। একটা ট্যাক্সি নিয়ে ও ইতিমধ্যেই তোমার অফিসের দিকে রওনা দিয়েছে। ওর কাছে একটা চাবিও আছে বলল।

-আপনি আমাকে সত্যিই বাঁচালেন। ঈশ্বর মনীষাকে আশীর্বাদ করুন। আপনি যে বললেন মনীষা মা হতে চলেছে।

-হ্যাঁ। আর মাস দুয়েক বাকি আছে।

-ওকে বলুন যতদিন সম্ভব চালিয়ে যেতে। আপনার সঙ্গে হয়ত কয়েকদিন কথা হবেনা। সামনের কয়েকদিন আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

-কৃষ্ণকালী, তুমি যে কী করতে চাইছ কে জানে! এসব কোরো না।

ওদিক থেকে ফোনটা কেটে গেল। সুন্দরী জিজ্ঞাসু চোখে পানু রায়ের দিকে তাকালো। পানু রায় বললেন,’ বড়কালী কী করতে চায় জানিনা কিন্তু আমাকে জড়িয়ে ফেলেছে। নিজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার এক ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছে আর আমাকে বললো যে আমার দায়িত্ব এটা নিশ্চিত করা যে কোনওভাবেই রেবা যেন জড়িয়ে না যায়।

-আমি তোমার কথা শুনেছি। কিন্তু বড়কালী কী বললো যখন তুমি জিজ্ঞাসা করলে যে কেবলমাত্র ওনার ছেলে রেবাকে ঠকিয়েছে বলেই উনি এত বড় ঝুঁকিটা নিতে চাইছেন?

পানু রায় হেসে বললেন,’ একথা না বলার জন্য আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যদি কাউকে বলি এমনকি তোমাকেও তাহলে বড়কালী আমাকে গুলি করে দেবে বলেছে। আমি একটু বেরোচ্ছি। যদি কেউ আমার খোঁজ করে বলবে তুমি জান না। আমি একঘন্টার মধ্যে ফিরব।‘

-আমি আন্দাজ করতে পারি?

-একশোবার!

-তুমি বড়কালীর অফিসে যাচ্ছ। দেখতে যাচ্ছ যে এমন কোনও প্রমাণ যেন ওখানে না থাকে যাতে কেলো দারোগার সুবিধে হয়।

-খুব ভালো আইডিয়া। শুধুমাত্র দু’টো ভুল ছাড়া।

-কী কী?

-প্রথমত, আমি বড়কালীর আইনি পরামর্শদাতা এবং যে কোনও রকম প্রমাণ লোপ করা বা লোপ করার চেষ্টা করা আইনের চোখে অপরাধ। দ্বিতীয়ত, আমি যে জন্য যাচ্ছি সেটা এর থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরী, তোমাকে দু’টো কথা বলি । এক- যারা আমাকে তাদের পরামর্শদাতা হিসাবে আমাকে নিয়োগ করে তারা গঙ্গাজলে ধোওয়া তুলসীপাতা নয়। দুই- প্রমাণ লুকোনো এবং প্রমাণ লোপ করা দু’টোই অপরাধ।

-বুঝেছি। ভুল বলেছি।

-বেশ, তাহলে তোমায় আরও দু’টো কথা বলে রাখি। এক- আমরা আগে থেকেই জানি আমরা ট্যাক্সিভাড়া করে কোথায় কোথায় গিয়েছিলাম সেটা কেলো দারোগা বের করবে। দুই-বড়কালী অর্থাৎ কৃষ্ণকালীর স্ত্রী চেয়েছিল তাদের প্রথম সন্তানের নামের মধ্যেও যেন কৃষ্ণ এবং কালী থাকে।

সুন্দরী কপাল কুঁচকে বলল,’ দাদু, মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না।‘

‘আমি একঘন্টার মধ্যে আসছি’-বলে পানু রায় বেরিয়ে গেলেন।
0

গল্প - অচিন্ত্য দাস

Posted in












উঁচুনিচু পাহাড়ি জমি, চারিদিকে গাছ, গাছ আর গাছ। এখানকার জাতীয় উদ্যান মানে ন্যাশনাল পার্কে ঢুকে ভারি ভালো লাগছিল। পাথরে বাঁধানো রাস্তা এঁকেবেঁকে অরণ্যের ভেতরে চলে গেছে, সে পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। মায়াকানন বলে একটা কথা আছে – এটা তাই। কোথাও পেল্লায় উঁচুউঁচু সেডার, পাইন, স্প্রুস গাছের ঘন বন, কোথাও ঝিরঝিরে ঝরনা নেমেছে আর তা পার হওয়ার জন্য কাঠের সাঁকো। কোথাও অদ্ভুত ধরনের কিছু ফুল ফুটেছে, কোথাও সবুজ জলের পুকুর। একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াতে হলো – বহু আগুনে পোড়া গাছ ভুলুন্ঠিত, তাদের পুড়ে যাওয়া গায়ে শ্যাওলা জমতে শুরু করেছে। কাছেই দেখলাম একটা বড় ফলকে ছবিটবি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া আছে বনে আগুন লাগার পর কী কী হয়। ক্ষতি কী হয় তা তো মোটামুটি জানা – বায়ু-প্রদূষণ, পশুপাখির প্রাণনাশ ইত্যাদি। কিন্তু শেষের দিকে দেখলাম লেখা আছে আগুনের অনেক উপকারিতাও আছে। দাবানল জিনিসটা প্রকৃতির একটি রীতি বা নিয়ম। জমে থাকা ঝরাপাতার পুরু আস্তর পুড়ে গিয়ে মাটি অনেক কাল পরে পায় আলোর স্পর্শ। মরে যাওয়া পাতার ভেতর যা সার-পদার্থ ছিল তা মাটিতে আবার মিশে গিয়ে নতুন লতাপাতা গাছ-গাছালির পুষ্টি যোগায়। মোটকথা আগুন নতুন সৃষ্টির পথ খুলে দেয়।

এ দেশের সরকার প্রাকৃতিক ব্যাপার-স্যাপার খুব সুন্দর ভাবে সংরক্ষণ করে। এদের দেশে অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ, অবিশ্বাস্য রকমের প্রাকৃতিক শোভা। বিরাট বড়লোকের দেশ, তার মানে অবশ্য এই নয় যে সবার হাতে পয়সা আছে। বহু মানুষ গৃহহীন, রাস্তাঘাটে রেল-স্টেশনে আকছার তাদের দেখা যায়। আর এক শ্রেণী আছে যারা সারাদিন প্রচণ্ড পরিশ্রম করে বেঁচে আছে। হয়তো একটু একটু করে সঞ্চয় করে কোনো রকমে একটা পাকাপাকি আস্তানার ব্যবস্থা করতে পেরেছে। যেমন ফেডেরিক আর মারিয়া।

ফেডেরিকের বাবা ব্রাজিল থেকে ছেলেপিলে নিয়ে এসে এদেশে থিতু হয়েছিলেন। আর মারিয়ারা অনেক প্রজন্ম আগে মেক্সিকো থেকে এসেছিল। দুজনের স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে। বিধির বিধানে দুজনের কোথায় যেন দেখা হলো আর সঙ্গে সঙ্গে চার চোখের মিলন। কিছু দিনের মধ্যেই বিবাহ-বন্ধনে জড়িয়ে পড়ল দুজনে। প্রথম দু-চারমাস বেশ কাটলো, যেমন কাটে। কিন্তু তারপরেই মারিয়া বুঝল ফেডেরিকের পুরুষ-সুলভ গোঁ আছে ভালো রকম। চট করে ক্ষেপেও যায় লোকটা। এদিকে ফেডেরিক বুঝল মারিয়া যেমন অভিমানী তেমনি তার জিভের ধার। সামান্য কথা কাটাকাটি থেকে শুরু হয়ে রোজই তুমুল ঝগড়া লেগে যেত দুজনের। অবশ্য সকাল অবধি গড়াত না, কারণ কত আর ঝগড়া করবে! সকাল থেকে দুজনেরই তো হাড়ভাঙ্গা খাটনি শুরু হবে, চলবে সেই সন্ধে অবধি। আর দুজনের উপার্জন ছাড়া এ দেশে এ বাজারে কিছুতেই চলে না।

দিন কয়েক ধরে শোনা যাচ্ছিল শহরের পশ্চিম দিকটায় বাড়ির দর নাকি নেমে যাচ্ছে। কারণটা হলো আগুন। একটুই দূরেই বন, সেখানে গত পাঁচ বছরে ছোটবড় আগুন লেগেছে সতেরো বার। আগুনের ভয় লোকে বাড়ি বিক্রি করে চলে যাচ্ছে। ফেডেরিক বলল, “মাসে মাসে এতগুলো টাকা ভাড়া গুণছি – এই আমাদের সুযোগ। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে একটা বাড়ি কিনে ফেলি।”

“ওই আগুনের এলাকায়? না, একদম নয়”

ফাটাফাটি চলল টানা দুদিন কিন্তু তারপর বাড়ি কেনাই ঠিক হলো। পয়সা যে বাঁচবে তা তো মিথ্যে নয়, যতই ঝগড়া হোক পয়সার ব্যাপারটাতে এসে দুজনের মত মিলল।

লোন আংশিক পাওয়া যায়, বাকি টাকা তো দিতে হবে। আবার তুলকালাম। এ বলে তোমার অনেক জমানো আছে, ও বলে তুমি তো সংসারে কিছুই দাও না – এবার দাও। যাই হোক শেষমেষ বাড়ি কেনা হয়ে গেল। ছোট একতলা দু-কামরার বাড়ি। সামনে পেছনে খোলা জায়গা একটু। বাড়ি হিসেবে চলনসই, তবে জঙ্গলের বেশ কাছে।

প্রথমে কথা ছিল একটা তাদের শোবার ঘর হবে, আর একটা লিভিং রুম ধরনের। কিন্তু রোজই রাত্তিরে কথা-কাটাকাটির পর হয় ফেডেরিক নয় মারিয়া অন্য ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ত। সাধের ‘লিভিং রুম’ গোঁসা ঘর হয়েই রয়ে গেল।

সেদিন রাতে এত ঝগড়া হয়েছিল যে সকালে ফেডরিক ভাবলো আজ একটা কিছু এসপার-ওসপার করতেই হবে। এ ভাবে আর চলছে না। আরে বাবা, তার নিজেরও তো একটা জীবন আছে! রোজ অশান্তি, রোজ অশান্তি!! বাড়ি কেনার কাগজ বানাতে ক্লড বলে এক ছোকরা উকিলের সাহায্য নিয়েছিল সে। কী ভেবে ফেডরিক ক্লডের কাছে গেল।

“ভাই, ক্লড কী আর বলি তোমাকে – বড় অশান্তি, বড় সমস্যায় ভুগছি গো। রোজই মারিয়ার সঙ্গে ঝগড়া। মারিয়া তো আজকাল আমাকে মানুষ বলেই মনে করছে না…”

“এটা আবার কোনো সমস্যা হলো, বন্ধু! আজকাল ঘরেঘরে তো এই চলছে। দেখো ফেডেরিক, জীবন তোমার একটাই, নষ্ট হতে দিও না। ডিভোর্সের মামলা কর।”

যদিও ফেডেরিক এইরকমই কিছু ভাবতে ভাবতে এসেছিল, ডিভোর্স কথাটা শুনে সে যেন খানিকটা ঘাবড়েই গেল। আমতা আমতা করে বলল, “তা কী করতে হবে…”

ক্লড ছোট ছোট চিরকুটের মত কাগজে খসখস করে কীসব লিখলো, তারপর সাত-আটটা কাগজ একটা খামে ভরে ফেডেরিককে দিল। বললো, “কটা পয়েন্ট আলাদা আলাদা কাগজে লিখে দিলাম। অন্তত তিনটে কি চারটে তোমাকে বাছতে হবে, যেগুলো তুমি কোর্টে প্রমাণ করতে পারবে। আর এই নাও ফর্ম। ভেবেচিন্তে ভর্তি করবে – পয়েণ্টগুলো যেন থাকে। আবার এসো দশ দিন পরে। এখন পঞ্চাশ ডলার বাকসটায় রেখে যাও, আমার ফি। হ্যাঁ, পঞ্চাশ – ফাইভ জিরো…”

এই বাজারে পঞ্চাশটা ডলার গেলো। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো ফেডেরিকের । সন্ধের মুখে বাড়ি ঢুকে ডিনার খেতে বসে ফেডেরিক দেখে স্যুপটা ঠাণ্ডা আর স্বাদটাও কেমন যেন। বলল, “মারিয়া, তুমি রান্নায় মন দিচ্ছো না, স্যুপটা নিজে চেখে দেখেছ? ছাগলেও খাবে না…”

“ছাগলে না খেলেও তুমি খাবে। আমি অত স্পেশাল রান্না করতে পারব না…কাল থেকে তুমি নিজের খাবার বানিয়ে নিও।”
“মানে, তুমি রান্নাটাও করবে না। তাহলে তোমাকে বিয়ে করলাম কেন?”

“সে তুমি জানো, আমি তো বলিনি…”

ফেডেরিকের মাথা গরম হয়ে গেল। বলেই ফেলল, “জানো আজকে আমি উকিলের কাছ থেকে কাগজপত্র সব নিয়ে এসেছি, তোমার থেকে আলাদা হয়ে যাব”

ফেডেরিক ভাবছিল পঞ্চাশ ডলার খরচা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এ না হলে মারিয়াকে চাপে ফেলা যেত না। এইবার মারিয়া কেঁদেকেটে…

ও বাবা! কোথায় কী। মারিয়া তো শুনে হেসেই খুন। বলল, “যাও, তুমি কালকেই কেস ফাইল করো। আমার যাবার অনেক জায়গা আছে, অনেকেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে…”

ফেডেরিক ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে গেল। পঞ্চাশ ডলার খরচা করে ভেবেছিল ভালো ওষুধ পাওয়া গেছে, তার তো উল্টো ফল হচ্ছে …দাঁড়াও না, এবার কেস ফাইল করেই ছাড়বে সে।

আর কী কী করবে ভেবে ওঠার আগেই দুজনের ফোনই তীব্র আওয়াজ করে বেজে উঠল। একসঙ্গে। এ তো ফোন আসা নয়। দুজনে ফোন নিয়ে দেখল লাল লাল বড় বড় অক্ষরে লেখা – বনে আগুন লেগেছে, আগুন শহরের দিকে আসতে পারে। সাবধান, সাবধান!!

ব্যাস, আবার তুলকালাম। মারিয়া বলল, “বললাম এখানে বাড়ি নিও না, সেই তোমার জেদ…”

“হ্যাঁ, শেষে তো বললে… নিয়েই নাও, এর থেকে কমে কি আর পাব...”

ঝগড়ার তাপ বাড়তে লাগল, তারপর যেমন হয়, দুজনে দুঘরে শুয়ে পড়ল।

মোরগ-ডাকা ভোরে মারিয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কালকের মতো তীক্ষ্ণ শব্দে ফোন বাজছে। লাল অক্ষরে লেখাটা পড়েই মারিয়া দৌড়ে গিয়ে ফেডেরিককে ঘুম থেকে তুলল। ওঠো, ওঠো …

বলতে না বলতেই ফেডেরিকের ফোনটাও বেজে উঠল। ভয়ঙ্কর সাবধানবাণী। হাওয়ার গতি শহরের দিকে হওয়ায় আগুন দ্রুত এদিকে এগিয়ে আসছে। এক ঘণ্টার ভেতর বাড়ি ছেড়ে চলে যাও, তার আগে যেতে পারলে ভালো হয়।

ফেডেরিক জানলা দিয়ে দেখল পাহাড়ের ওপারে লাল আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে, আর কালো ধোঁয়া তো আছেই। দুজনে কোনোরকমে দরকারি জিনিসপত্র দুটো স্যুটকেস আর একটা ব্যাগে পড়ি-কি-মরি করে ভরতে লাগলো। যা যা মনে পড়ল তখন।

“এই ফেডেরিক, ওষুধের বাক্সটা আগে নাও...”

“নিচ্ছি। মারিয়া তুমি আলমারি থেকে দুজনের পাসপোর্ট আর কার্ডগুলো তাড়াতাড়ি ব্যাগে ভর ... আমি গাড়ি গেটের সামনে আনছি। দুজনের গরম কোট আর স্লিপিং ব্যাগদুটো নিও… কোথায় কোন শেলটারে ঢোকাবে কে জানে।”

দশ বছরের বৃদ্ধ এবং চারবার হাত বদল করা গাড়ি ওদের একটা ছিল বটে। এখন ওটাই ভরসা। দুজনে মিলে যা পারে, যতটা পারে ভরল। মারিয়া হঠাৎ বলল, “দাঁড়াও, আলমারির চাবি আর জুয়েলারি বাক্সটা নেওয়া হয়নি।” ফেডেরিক বলল, “তুমি অন্য জিনিস দেখ, আমি তাড়াতাড়ি নিয়ে আসছি…”

গাড়ি যখন চলল তখন লাল আভা আরও বেড়েছে, ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছে।

***

টানা পাঁচদিন শেলটারে থাকতে হলো। দমকল, হেলিকপ্টার, এরোপ্লেন থেকে জল আর কেমিকাল ছড়িয়ে আগুন আয়ত্বে আনা হলো বটে কিন্তু ততদিনে ক্ষতি হয়ে গেছে অনেক।


ছ-দিনের দিন সকালে রাস্তা খুলল। বোঁচকা-বুঁচকি গাড়িতে তুলে দুজনে রওনা দিল শহরের দিকে। রাস্তায় যেতে যেতে দেখল আগুনের দাপটে সব তছনছ হয়ে গেছে। ভয় ভয় তারা বাড়ির দিকে এগোল, কী দেখবে কে জানে, কপালে কী যে আছে!

গাড়ি থেকে এক পলক দেখেই মারিয়া কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ফেডেরিক তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল, মারিয়ার কান্না আর থামে না। কী আর সান্ত্বনা দেবে ফেডেরিক! বাড়ির একটা দিক পুড়ে গেছে। কাঠের কাঠামোটা কালো কাঠ-কয়লা হয়ে দাঁড়িয়ে – ফাঁকে ফাঁকে কটা অক্ষত সাদা টালি রাক্ষসের দাঁতের মতো বেরিয়ে রয়েছে।

মিন মিন করে ফেডেরিক বলল, “মারিয়া আমাদের শক্ত হতে হবে, একটা দিক তো ঠিক আছে। ইনশিওরেন্স থেকে কিছু তো পাবো। আবার আমরা গড়ে তুলব, মারিয়া। তুমি শুধু মনের জোর হারিও না।”

এরপরের দিনগুলো ছিল অসম্ভব পরিশ্রমের দিন। মিস্ত্রি লাগানোর খরচ অনেক – তাই বিকেলে কাজ থেকে ফিরে দুজনে হাতে হাতে বেশি-ক্ষতি-না-হওয়া দিকটা মেরামত করত সেই রাত অবধি। কাজের মধ্যেও দ্বিমত হতো ঠিকই কিন্তু এত খাটা-খাটনির পর ঝগড়া করার শক্তি আর অবশিষ্ট থাকত না। ঝগড়া করার আর একটা অসুবিধে ছিল – গোঁসা ঘর তো পুড়ে গেছে, শুতে তো হবে একটাই ঘরে! ভোরবেলা আবার দুজনের কাজে বেরিয়ে যাওয়া। এই করে মাস তিনেক কেটে গেল।

এদিকে বীমা কোম্পানী কিছু কিছু টাকা দিতে শুরু করেছে আর সরকারের পক্ষ থেকে কিছু ঠিকেদার বাড়ি সারাচ্ছে একটু কম খরচে। ঘর-দুয়ারের পোড়া ক্ষতে মলম আর ব্যাণ্ডেজের ব্যবস্থা হওয়াতে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাড়িঘরগুলো অল্প অল্প করে আবার স্বাভাবিকের দিকে মোড় নিচ্ছে।

ক্ষতি হয়ে গেছে অনেক। বাড়ি কেনার পর সঞ্চয় তলানিতে ঠেকে গিয়েছিল আর এ কদিনে ব্যাঙ্কের খাতা প্রায় শূন্য। তবু এরই মধ্যে মারিয়া-ফেডেরিকের জীবনও স্বাভাবিক হয়ে আসছে। আর হপ্তা দুয়েকের ভেতর বাড়ির কাজ হয়ে গেলে দুটো ঘরই ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠবে। ওদের জীবন যে সত্যি স্বাভাবিক হয়ে আসছে সেটা বোঝা গেল সেদিন রাত্তিরে। মারিয়া বলল. “বীমা কোম্পানী কত টাকা দিয়েছে এখন পর্যন্ত?” ফেডেরিক অঙ্কটা জানাতেই মারিয়া সন্দেহের সুরে বলল, “তোমাকে বিশ্বাস নেই, ঠিক বলছ তো! ও টাকা বাড়ির জন্য, কায়দা করে আবার পকেটে পুরো না!”

ফেডেরিক গেল ক্ষেপে। “হ্যাঁ, আমাকে তো তোমার কোনদিনই বিশ্বাস হয় না। পড়তে অন্য লোকের হাতে, বুঝতে কত ধানে কত চাল …”

কলহের দেবতা দেবর্ষি নারদের অবাধ গতি সব দেশেই। তিনি ধর্মাধর্ম, দেশকাল কিছুই মানেন না। কখন যে তিনি অদৃশ্য হয়ে মারিয়া-ফেডেরিকের মাঝখানে এসে “হোক হোক আরও হোক” বলে চলে গিয়েছেন!! বাক-বিতণ্ডা বাড়তে বাড়তে একেবারে তার সপ্তকে চড়ে গেল! ‘জলসা’ চলল অনেক রাত্তির অবধি, সকালেও দেখা গেল তার রেশ ফেডেরিকের ভেতর র‌য়ে গেছে। ঘুম ভেঙ্গেই ফেডেরিক ঘরের জিনিস-পত্র টেনেটুনে ওলোট-পালট করে ক্লডের দেওয়া খামটা খুঁজতে লাগলো, যার ভেতরে ‘পয়েণ্ট’ লেখা চিরকুটগুলো ছিল। কিছুক্ষণ বৃথা জিনিসপত্র সরিয়ে টরিয়ে বুঝল বাড়ির ওপর এতো ধকল গেছে – ও আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু তাতে আত্মবিশ্বাস হারালে চলবে না। ‘পয়েণ্টগুলো’ মনে করার চেষ্টা করতে লাগলো সে – দুএকটা মনে পড়াতে কাগজ পেনসিল নিয়ে লেখার যোগাড় করছিল এমন সময় মারিয়া এসে দাঁড়াল সামনে। “সকালে এসব কী শুরু করেছ, কাজে যাবে না…”

“না যাব না। যাচ্ছি ক্লডের কাছে, কেস ফাইল করব …”

মারিয়া একটুও না দমে ফুঁসে উঠল, “তোমার সব কিছুতেই দেরি। সেই কবে থেকে আস্তিন গুটিয়ে বলেই চলেছ কেস করব, কেস করব … কিছুই তো করলে না…”

“করিনি তো কী হয়েছে, এখন করব, আজই করব!”

“না, করবে না।”

“মানে?”

“খোকা আসছে, কিংবা খুকি।”

ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল ফেডেরিক। পেনসিলটা হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে খাটের তলায় ঢুকে গেল।


*****


ভাবছিলাম ওই ন্যাশানাল পার্কের ফলকটাতে ঠিক কথাই লেখা ছিল। আগুনের সামনে যা থাকে তা পুড়েঝুড়ে ভস্ম হয়ে যায় বটে কিন্তু কী যেন কী এক যাদুতে তাণ্ডবলীলার মধ্যেও অগ্নিদেব নতুন কিছু শুরু করিয়েই দেন।

1

গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in




















শহরের সাজানো ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ট্রেন বাস ট্যাক্সি, প্রতিবেশী আত্মীয় পরিজন – এসব কোনোকিছুই ভালো লাগছিল না লোকটার! তাই ঘর ছেড়ে নীলকন্ঠ বেড়িয়ে পড়লো। ঘুরে ঘুরে কিছুদিন কাটালো গ্রামগঞ্জে। তার ভালো লাগছিল না চারপাশের গাছগাছালি, বনজঞ্জল, জলা। ভালো লাগছিল না কোনো কিছুই!

লোকেরা বললো - নীলকন্ঠবাবু আপনি মানসিক ভাবে অসুস্থ!

মনের দুঃখে নীলকন্ঠ নিজের দেশ ছেড়ে উড়াল দিল সমুদ্রের দিকে। অন্য কোনো দেশের খোঁজে। ভাবলো, পাখি হয়ে আকাশে উড়বে, যতক্ষণ না তার পছন্দ মতো নতুন কোনো দেশ খুঁজে পায়। তাই সে ওড়া শুরু করলো।

আশ্চর্যের ব্যাপার! উড়তে উড়তে নীলকন্ঠ একসময়ে একটা পাখি-মানুষ হয়ে গেলো!

তারপর থেকেই এই দুনিয়ার সীমাহীন সংসারে নীলকন্ঠ উড়ছে আর উড়ছে! নীচে সীমাহীন সমুদ্র, অশান্ত ঢেউ। সে প্রতিজ্ঞা করলো, তাকে উড়তেই হবে, যতক্ষণ না নতুন কোনো দেশের সন্ধান পায়।

অজানা অচেনা পথ, নিচে অথৈ জল। প্রচন্ড ঝড়ঝঞ্জায় নীলকন্ঠ দিক ভ্রান্ত হয়ে গেলো। উড়তে উড়তে তার হাতের কয়েকটা পালক খসে পড়লো!

এমনই বিপন্ন দিনে নীলকন্ঠর সাথে দেখা আরেক ঝাঁক পাখির। সেই দলে ছিল পাখিদের সর্দারণী, তাকে দেখে নীলকন্ঠ চিনতে পারল – সে তার পুরানো প্রেমিকা রাধারাণী!

সেই সর্দারণী, মানে প্রাক্তন প্রেমিকা রাধারাণী, ঘাড় বেঁকিয়ে কিচির মিচির করে বল্লো, একে তো আমাদের দলে নেয়া যাবে না! এ ভিন্ন জাতের, ভিন্ন দলের, ভিন্ন বিচারের প্রাণী!

অগত্যা একাকী নীলকন্ঠ দলছাড়া উড়তে উড়তে খেই হারিয়ে ফেললো। তার মনে পড়লো ফেলে আসা শহর - সেখানকার ঘরবাড়ি, লোকজন, রাস্তাঘাট, ট্রেন বাস ট্যাক্সি; মাথার উপরে উড়ন্ত হাওয়াই জাহাজের কথা।

মাঝ আকাশে সূর্য। ঝড়ো হাওয়া। নিচে অথৈ সমুদ্র। সে আরো জোরে জোরে ডানা ঝাপ্টালো। আকাশ থেকে প্রচন্ড শব্দে বাজ ফাটলো। কেউ বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করলো – ‘নীলকন্ঠ, তাকিয়ে দেখ! সামনেই মুক্তি! অমৃতালোক! যার খোঁজে তুই ঘর ছেড়ে আকাশে উড়েছিস!’

এক সময়ে ধেয়ে এলো চক্রবাত, ঘূর্ণি, এল-নিনো। তার পছন্দ মতো নতুন কোনো দেশ খুঁজে পাবার আগেই সে পৌঁছে গেলো চক্রবাতের কেন্দ্রে! ঘূর্ণির প্রচন্ড আবর্তে লোকটা ঢুকে গেল অতল সমুদ্রের নীচে – মৃত্যুর শহরে! না কি পৌঁছে গেলো নতুন কোনো এক দেশে যার সন্ধানে সে আকাশে উড়ছিল?

ঘূর্ণিঝড় থেমে গেলে কয়েকদিন পরে সমুদ্রের কিনারায় পাওয়া গেলো একটা ভাঙাচোরা নৌকা আর নীলকন্ঠ নস্করের পচাগলা দেহ। দেহটা কোথা থেকে এলো, কি ভাবে এলো, কেউ তার হদিশ দিতে পারলো না।
0

গল্প - পাগলা গণেশ

Posted in







আমি.......আমি হরিদাস পাল। মানে যেই হরিদাস পালের কথা শুনে এসেছেন আপনারা সে নই।এবার প্রশ্ন হচ্ছে তবে আমি কে?


আমি মনে করুন একটা টেবিল,কিংবা একটা টিপট,যাকে বাড়িতে কুটুম এলে বের করা হয়।কিংবা একজন চলচ্ছক্তিহীন কিশোর কিংবা যুবক,যার কিনা সারাটাদিন বিছানায় শুয়েই কাটে।হতে পারি আমি কনজেনিটাল বা জন্মগত পঙ্গু,অথবা কোনো দুর্ঘটনায় চলচ্ছক্তি হারিয়েছি আমি।

আমি ভাবছি জন্মগত চলচ্ছক্তিহীন যুবকটাই ভালো হবে।তাহলে গল্পটা সাজানো যাবে বেশ।অন্যান্য লেখকরা তো আপনাকে প্রথম থেকেই বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করেন এটা সত্যি কথা,আমি নাহয় আপনাকে স্বাধীনতা দিলাম এটাকে গল্পই ধরুন।নিছক নিষ্কর্মা মনের নট সো উর্বর কল্পনা।

ছাড়ুন ওসব;জানেন আমার খুব মন খারাপ হয় মাঝে মাঝে,মেনেই নিয়েছি নিজের ভবিতব্য।জানি সারাটা জীবন আমাকে এই বিছানায় কাটাতে হবে,কিন্তু তবুও ইচ্ছা হয়,একবার নিজের পায়ে হেঁটে বাইরে যাওয়ার,একবার বৃষ্টিতে ভেজা ঘাসে চলার,একবার পাহাড়ের গা বেয়ে ছুটে ওঠার,কোনো পুকুরের ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকার, কিন্তু আমি ওই যে জন্ম থেকে নিজে থেকে নড়তেও অক্ষম।

মা - বাবা যে কেন আমায় বাঁচিয়েছিলেন বুঝতে পারি না।এটাও বুঝতে পারি না,আমার বেঁচে থেকে কী লাভ?আচ্ছা এখন নাহয় ওঁরা আছেন আমার দেখাশোনা করছেন,কিন্তু ওঁরা মারা গেলে?তখন কে দেখবে আমায়?
আমি তো এমন কিছু প্রয়োজনীয় কেউ নই যে লোকে আমার পরোয়া করবে,খেয়াল রাখবে,বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবে?

তবে একটা জিনিস জানেন আমার সব অনুভূতি কিন্তু পুরোমাত্রায় আছে।আমার পুরুষাঙ্গ দাঁড়ায় না বটে,কিন্তু প্রেমের অনুভূতি আমার আছে,আমি প্রত্যক্ষ করেছি অনেকবার।

একবার আমি তখন ওই বারো কি তেরো বছর বয়সের তরতাজা,(এই মাফ করবেন,তরতাজা হবে না।) কিশোর।আমাদের বাড়িতে একটা মেয়ে এসেছিল,আমারই কোনো আত্মীয়ের মেয়ে। সম্পর্কটা কী যেন?........
ও হ্যাঁ,মনে পড়েছে - আমার বাবার জেঠুর মেয়ের ভাসুরঝি।
সে অনেক দূরের সম্পর্ক,দাঁড়িয়ে ঢিল মারলেও মাথায় পড়বে না।

যা বলছিলাম,মেয়েটা ছিল অপূর্ব সুন্দরী।(আমি ঢের তো মেয়ে দেখেছি! ঘর থেকে কোনোদিন বেরোলাম না,মা আর হাতে গোনা গোটা দশেক আত্মীয় ছাড়া আর কটা মেয়ে দেখেছি?)যেমন দেখতে তেমনই দেহগঠন।আমারই বয়সী,ক্লাস সিক্সে পড়ত।কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা ও নিজে থেকে এসে আমার কাছে বসেছিল।বসে জিজ্ঞেস করেছিল,"তোমার নাম কী?"
আমি প্রথমে এত অবাক এবং পরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম,যে কথাই বলতে পারিনি।তারপর একটু সামলে নিয়ে বললাম,"আমার নাম গনেশ।"(এই যা বলা হয় গেল!)
সে একটা পাহাড়ি ঝর্ণার মতো কলকল করে বলল,"গনেশ?খুব সুন্দর নাম,আমার নাম ঈপ্সিতা।তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?আমি সিক্সে পড়ি,ফার্স্ট গার্ল।তোমার রোল কত?"
আমি আবার নির্বাক রইলাম যথারীতি।আসলে আমি এমনিতে কম কথা বলার সুযোগ পাই,সারাদিন শুয়ে থাকি, রাত্রি বেলা মা রান্নাবান্না সেরে এসে বসলে আমাকে গল্প শোনায়,আমি দুচারটে পাল্টা প্রশ্ন করি,এভাবে ঘণ্টা দুই কাটে,আমাকে মা খাইয়ে দেয়,ঘুমিয়ে পড়ি।আর সারাদিন এদিক ওদিক দুচারটে কথা, ব্যস।এবারে এই পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর মতো এই মেয়েটির প্রশ্নের জবাব আমি দিই কী করে?একে তো অপরিচিত,তার উপর কথার ফুলঝুরি।

তবে ও যতক্ষণ পাশে বসেছিল আমার খুব ভালো লাগছিল।মনে হচ্ছিল ও যদি আজীবন বসে থাকত,আর কথা বলে যেত,আমার খুব ভালো লাগত।এমন করে বেঁচে থাকতেও কোনো কষ্ট হতো না,আফসোস হতো না।

মেয়েটি আমাদের বাড়িতে প্রায় আট মাস ছিল।

ওর বাবা ছিল এক মাল। মানে দুনম্বরি মাল।

খুলেই বলি।

ওদের বাড়ি একটা মফস্বল শহরে।যেখানে আমাদের গ্রামের লোকেরা এক কাঠা জমি কেনার স্বপ্ন দেখে,সেখানে ওদের বিঘা খানেক জায়গা ছিল।শুধু ওই জায়গার দামই কয়েক কোটি টাকা।ওদের ওই জায়গা ছাড়াও এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকগুলো দোকান তৈরি করে ভাড়া দেওয়া ছিল।সেই দোকান থেকেই যা ভাড়া পাওয়া যেত তাতেই ওদের এলাহি জীবনযাপন চলত।কিন্তু ওর বাবার তাতে কুলাচ্ছিল না।ওদের যে পৈতৃক ভিটাটি ছিল,সেখানে একটি তিনতলা বাড়ি ছিল। বাড়িটার নিচের দুটো তলা ভাড়া দেওয়া ছিল আর উপরের পুরো একটা তলায় ওরা থাকত।সে বিরাট বড় জায়গা,খান কুড়ি কামরা,প্রতিটি কামরা বিরাট।এক কথায় যাকে বলে স্বর্গসুখ,তাই ওদের ছিল।ওদের বাড়ি ভাড়া থেকেই মাসে আয় ছিল লাখ তিরিশেক টাকা।

কিন্তু ওই বলে না,সুখে থাকতে থাকতে ভূতে কিলোয়!ওর বাবার হয়েছিল তাই। বাপের একমাত্র ছেলে,এক বোন ছিল তার বিয়ে হয় গেছে,সুতরাং নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধর।এদিকে কোনোদিন টাকার কথা চিন্তা করতে হয়নি,তাই অর্থ রোজগারের চিন্তাও নেই।কিন্তু মাথা তো চুপচাপ বসে থাকতে পারে না;ফলে যা হবার তাই হল।ছেলে গেল ফুটে।

ওদের বাড়ির নিচের তলায় একটা ছোট ব্যাংক ছিল।নাম বঙ্গীয় গ্রামীণ বিকাশ ব্যাংক।ছোট মানে খুবই ছোট,ইংরেজিতে যাকে বলে টাইনি বা অতিক্ষুদ্র।সেই ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে ইপ্সিতার বাবার যাওয়া আসা ছিল।ম্যানেজারের হাতে বিশেষ কাজ নেই।তাই বাড়ির মালিক যেতেন,বসে গল্প করতেন।এই করতে করতে ঘনিষ্ঠতা,তারপর বন্ধুত্ব।ওই কুজনদের যেমন বন্ধুত্ব হয় আর কি!

ওই নিচের তলায় ছিল এক স্যাঁকরার দোকান।ওই ব্যাংকের ম্যানেজার, ঈপ্সিতার বাবা(নাম চক্রধর) আর স্যাঁকরা মিলে পরিকল্পনা করে,ওরা ইমিটেশনের গয়নাকে সোনার গয়না বলে ব্যাংকে বন্ধক রাখবে,তারপর যা টাকা পাওয়া যাবে তা ওরা তিনজন ভাগ করে নেবে।

পরিকল্পনা ভালোই ছিল,এমনিতে ছোট ব্যাংক,তার উপরে মফস্বল শহরে,কেউ অত নজর দেয় না।ফলে ওদের এই কারবার বছর তিনেক খুব চলল।কিন্তু ব্যাংকের এক কর্মচারী ব্যাপারটা জানতে পেরে ওপরতলার কর্মকর্তাদের জানায়।তদন্তে ব্যাপারটা ধরা পড়ে,ব্যাংকের ম্যানেজারকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং স্বাভাবিকভাবেই তাকে বরখাস্ত করা হয়।

এদিকে সেই স্যাঁকরা আর চক্রধরবাবু পালিয়ে যান।তিনি এসে আমাদের বাড়িতে ওঠেন। স্যাঁকরার কোনো খবর আর পাওয়া যায়নি।কিন্তু আমার জীবনে একটা সুখস্মৃতি তৈরি হল,যার জন্য এখনও বাঁচতে ইচ্ছা করে।

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে।আর কেউ আসেনি ওরকম আগ্রহ নিয়ে,ভালোবাসা নিয়ে দয়া নিয়ে।আমি আশাও করিনি।আমাকে ও এমন আষ্টেপৃষ্টে মায়ায় জড়িয়েছিল,আমি কাউকে আর দেখতে চাইতাম না।ওরা চলে যাওয়ার পর আমি প্রতিদিন ভেবেছি,এই বুঝি ওরা আসবে - কিন্তু না,ওরা আর কখনোই আসেনি।

তারপর প্রায় বছরখানেক কেটে যাওয়ার পর আমি খেয়াল করলাম,আমার সেই জানালাটা এখনো আমার দিকে উৎসুকভাবে সমান আগ্রহে তাকিয়ে আছে।প্রতিদিন সে পরিপাটি করে নতুন দৃশ্যপট সাজিয়ে বসে,আমাকে দেখাবে বলে।যদি তার মুখ থাকত আমায় বলত,"এই,একবার দেখো!"
কিন্তু সে আমার থেকেও হতভাগা।আমি কথা তো বলতে পারি।সে তাও পারে না।
ওর হাত থাকলে আমার মুখ ঘুরিয়ে দেখাত,সে কী অপূর্ব দৃশ্যাবলির অবতারণা করছে প্রতিদিন,প্রতিক্ষণে।কিন্তু আমি সেই দূরদেশগত উদাসীন একজনের জন্য উদগ্র আশায় বসেছিলাম,যে কখনও আসবে না।

এরপর ওই জানালা আস্তে আস্তে আমাকে নিজের মোহজালে বন্দী করতে আরম্ভ করল।খুব ধীরে ধীরে মাকড়সা যেমন তার শিকারকে জালে বন্দী করে,কিংবা অজগর যেমন তার শিকারকে খুব ধীরে ধীরে পাকরসে জারিত করে হজম করে ঠিক সেভাবে।আবার নয়।

কারণ ওতে শিকার যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়,আর আমি সুখের আবেশে ভাসছিলাম। কী বিশাল যে সেই মুগ্ধতা,মায়া - বোঝানোর কোনো ভাষা পৃথিবীতে আছে কিনা জানি না।

এর মধ্যে একটা কাঠবেড়ালি আমার খুব পরিচিত হয়ে উঠেছিল।সে প্রতিদিন সকালে উঠেই(যদিও ঘুমাত কিনা জানি না।ঘুমাত নিশ্চয়,ঘুমের তো দরকার সবারই হয়।) চারিদিকে ছোট ছোট হঠাৎ ছুট দিয়ে খাবার খুঁজে বেড়াত।তার সাধারণত বিভিন্ন ধরণের বাদাম এবং বীজ পছন্দ ছিল।আমিও ভাবতাম যে ওরা শকাশী।আর নির্দিষ্ট করে বললে, বীজভোজী।কিন্তু একদিন দেখলাম অবাক ব্যাপার।

সেদিন শরতের দুপুর।এবছর একদম বৃষ্টি হয়নি।গাছপালা সেই যে গ্রীষ্মের রোদে পুড়ে ঝামা হয়ে গিয়েছিল,আর নতুন করে গজায়নি।তাই আমাদের বাড়ির চারিদিক এমনিতে যেখানে ঝোপঝাড়ে ভর্তি হয়ে যায় এমন সময়,সেও ফাঁকা পড়েছিল।

আমি কাঠবেড়ালিটাকে বেশ মাসখানেক ধরে দেখছিলাম,প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাবারের খোঁজে মরিয়া হয়ে ঘুরে বেড়ায়।কিন্তু খবর খুব একটা কিছু পায় না।বেশিরভাগ দিন কিছুই পায় না।বেচারি এমনিতে কত বীজ নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখে দেখেছি।এখন সে অনাহারে,অর্ধাহারে কাটাচ্ছে।

আমি জানতাম ও কোথায় বীজ লুকিয়ে রাখে।কিন্তু আমার তো আর উঠে যাওয়ার সাধ্য নেই!মাকে একবার বলেছিলাম,কিন্তু মা এমন এক ধমক দিয়েছিল,আর সাহস হয়নি।তবুও আবার একবার বলতে মা বলেছিল,"তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি বল তো?মানুষের কথা কে চিন্তা করে, ও কাঠবেড়ালির কথা ভাবছে।আর অমন জায়গায় যে হাত দেব,সাপ-টাপ থাকবে এখন,কামড়ে দেবে কোথায়!তোকে অত চিন্তা করতে হবে না,ওরা ঠিক দেখে নেবে নিজেদের।"

আমি মায়ের নিষ্ঠুরতায় হতাশ হলাম।কেন এরা একটু সহানুভূতিশীল হয় না?
কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত?

কিছুদিন পর যা দেখলাম,তাতে খুশিও হলাম আবার একটা দুঃখ আর আতঙ্কের স্রোত আমার শরীর দিয়ে বয়ে গেল।দেখলাম, কাঠবেড়ালিটা একটা ইঁদুরের বাচ্চাকে টেনে বের করছে একটা গর্ত থেকে।তারপর সেটাকে ওই গর্তের মুখে বসেই ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল।

মা ইঁদুরটা বারবার গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে নিজের বাচ্চাটাকে বাঁচাতে চেষ্টা করল,কিন্তু কাঠবেড়ালিটা তাকে এমন তেড়ে গেল আর গর্জন করল, আমারও দেখে ভয় লাগল।আমার সেই পরিচিত,পরিশ্রমী,নিরামিষাশী কাঠবেড়ালিটা শুধু খিদের জন্য এমন বর্বর,নৃশংস খুনিতে পরিণত হয় গেল?
আমার হঠাৎ খুব কান্না পেল।আমার কি কিচ্ছু দায় নেই?আমি কি পারতাম না একটু খাবার দিতে ওকে?
তাহলে তো ও আর এমন হতো না।

এরপর থেকে প্রতিদিন একই দৃশ্যের অবতারণা হতে লাগল।কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আমার আর অত খারাপ লাগছিল না।বরঞ্চ আমি বেশ কৌতূহল অনুভব করছিলাম।একটা আদ্যোপান্ত নিরামিষাশী প্রাণী কী করে মাংস খায়, তা বেশ আগ্রহের সাথে দেখছিলাম আমি।আসলে সবকিছুই মানসিক প্রস্তুতির ব্যাপার,আর গা সওয়া হয়ে যেতে হয়।তাহলে যে খুন প্রথমবার চোখের সামনে দেখে মানুষ শিহরিত হয়,আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে যায়,মাসখানেক প্রায়শই দেখলে তাও আর ততটা আতঙ্কের ব্যাপার থাকে না। তা ভাত খাওয়ার মতোই সাধারণ ব্যাপার হয়ে যায়।

নিজের চারপাশের দেখলেই তো তার ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যায়।

এরপর থেকে ওই জানালা দিয়ে অদ্ভুত সব দৃশ্য প্রতিদিন দেখতে লাগলাম।আমি রাতটুকু কোনোরকমে কাটাতাম,দিনের আলো ফোটামাত্র জেগে উঠতাম,আজকে কী হবে তা জানার জন্য।

ওখানে দেখলাম একদিন একটা লোক নিজের তিনবছরের বাচ্চা মেয়েকে কেটে নিজেও আত্মহত্যা করল।আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি।কিন্তু দুঃস্বপ্নও এত ভয়ানক হয় না।সেই যুক্তিতে নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম,এটা জ্বলজ্যান্ত বাস্তব।

প্রকৃতি বড় নির্বিকার।সে গণহত্যারতে হিহি করে হাসতে পারে,চরম সুখের মুহূর্তে নির্ঝর কাঁদতে পারে।

সেদিন সকাল থেকেই আকাশ একেবারে মেঘমুক্ত,রোদ ঝলমলে।হেমন্তের সকাল,তাই রোদের সেই তাপ নেই,কিন্তু একটা হালকা ঝিরঝিরে উত্তুরে বাতাসের দৌলতে চারিদিকে শীতের আমেজ ছড়িয়ে পড়ছিল।এত সুন্দর ছিল সেই দিনটা,আমি ঈশ্বর হলে সেদিন সব হিংসা পাপ বলে ঘোষণা করতাম,এমনকি আমাকে খুশি করতেও না।

তো সেদিন দেখলাম একজন লোক চুপিচুপি এসে জানালাটার একদম নিচে দাঁড়াল।আমি যেন তার মনের কথা শুনতে পেলাম।মনে হল আমি যেন কোনো বিশেষ ক্ষমতা পেয়েছি;সে যখনই আমার কার্যকর ব্যাসার্ধের মধ্যে আসে,আমি তার মনের কথা শুনতে পাই,আবার দূরে গেলে আমিও বধির হয়ে যাই।ইচ্ছে হয়,যদি হাঁটতে পারতাম,তাহলে নিশ্চয় ওর সব গোপন কথা, গূঢ় রহস্য আমি জেনে নিতাম।

লোকটা একদম ছাপোষা একজন।ওর বাড়িতে নিত্য অশান্তি,রোজগার নেই,স্ত্রী ভালো ছিল,কিন্তু ও নিজেই তাকে বেশ্যাবৃত্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে।যাতে সংসারটা অন্তত চলে,না খেয়ে মরতে যেন না হয়।কিন্তু এখন খুব খারাপ লাগে,গ্লানিতে ভোগে।

বউকে মানা করেছে কয়েকবার।কিন্তু ও শোনে না।বলে,"না করলে খাবে কী?নিজের মুরোদ আছে দুপয়সা রোজগার করার?"
ও আর কিছু বলতে পারে না।তারপরেও কয়েকবার বলেছিল,কিন্তু এবারে বউ আর ওরকম ভালোভাবে বলেনি।রীতিমতো মেজাজ দেখিয়ে,ধমক দিয়ে বলেছিল,"অপদার্থ,কাপুরুষ একটা মানুষ।দুপয়সা আয় করার মুরোদ নেই,বউকে লোকের কাছে পাঠিয়েছিল সাজিয়ে,এখন খুব খারাপ লাগে,না?"
ও মিনমিন করে বলতে চেয়েছিল,"কিন্তু এখন তো আর অত অভাব নেই,ভালোই তো চলছে!"
কিন্তু তাতে ওর বউ বলেছিল,"না চলছে না।আমার চলছে না।আমার তোমার কাছে শুতে ঘেন্না করে।তুমি পারবে প্রতিবারে আমার সাথে শুয়ে সোনার হার দিতে,হিরের গয়না দিতে?পারবে তুমি?একজন আমাকে বলেছে পরের মাসে বাজার একটা এক কাঠা জায়গা আমার নামে লিখে দেবে,সেটা ছেড়ে দেব?তুমি আর এ বিষয়ে একটা কথাও বলবে না।তোমাকে লোকের সামনে স্বামী বলে যে পরিচয় দিই,সেটাকে নিজের সৌভাগ্য বলে মনে করবে।"
ও ভেবেছিল,' আর কিচ্ছু বলব না,আত্মহত্যা করব।'
কিন্তু শেষ চেষ্টা করতে বলেছিল,"প্রিয়া,একবার ভেবে......"
কথাটা শেষ করার আগেই দরজায় ঘণ্টা বেজেছিল,প্রিয়ার খদ্দের। প্রিয়া যেভাবে খুশি হয়ে ছুটে গিয়েছিল,ওর আর একটা কথাও মুখে সরেনি।

ও বেরিয়ে এসেছিল।ভেবেছিল আর নয়,একটা কিছু হেস্তনেস্ত করবেই।

ও গিয়ে দাঁড়িয়েছিল রেললাইনের পাশে,ট্রেন আসতে এখনো আধঘন্টা বাকি।ও নিজের কথা,নিজের জীবনের কথা,অক্ষমতার কথা ভাবছিল।মেয়ের মুখটা মনে পড়ল।কতই আর বয়স,সামনের মাঘে তিন পড়বে।কি সুন্দর,ঠিক যেন মোমের পুতুলটা!ও নিশ্চিত জানে ওটা ওর মেয়ে।কারণ তখন প্রিয়া একগামী ছিল।ওর জন্মের বছরখানেক পরে যখন ও খরচ সামলাতে পারছিল না,তখনই প্রিয়াকে প্রস্তাবটা দেয়। প্রিয়া প্রথমে ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।ভেবেছিল ও বুঝি ইয়ার্কি করছে,কিন্তু ওর মুখে অসহায়তা আর মরিয়া ভাব দেখে প্রিয়ার আর বুঝতে বাকি ছিল না,যে ও(রহিম) ইয়ার্কি করছে না। প্রিয়া উঠে চলে গিয়েছিল।

এর মাঝে মাসখানেক ওদের মধ্যে কোনো কথা ছিল না।এক মাসের মাথায়,একদিন এসে প্রিয়া বলল,"আমি রাজি।"
রহিম ভুলেই গিয়েছিল ব্যাপারটা।আনমনে রুটিটা ঝোলে ডুবিয়ে মুখে তুলতে তুলতে বলেছিল,"কী রাজি?"
প্রিয়া নিঃসংকোচে বলেছিল,"শুতে।"
রহিমের হাঁ করা মুখের থেকে রুটিটা পড়ে গিয়েছিল, থালার কিনারায় লেগে ছড়িয়ে গিয়েছিল চারিদিকে।সে একটু ধাতস্থ হতে জল খেয়েছিল গ্লাস থেকে।তারপর ঢোঁক গিয়ে বলেছিল,"আচ্ছা।"
আর কোনো কথা মুখ দিয়ে বেরোয়নি।

তার কিছুদিন পর থেকে যা শুরু হল,ওর ঘরে থাকা দুর্দায় হয়ে গেল।প্রথম প্রথম প্রিয়া লজ্জা পেত,নিজেকে গুটিয়ে রাখত।কিন্তু যত দিন যেতে লাগল প্রিয়া আরো খোলামেলা আরও নির্লজ্জ হয়ে উঠল।ওর রহিমের উপর যে রাগ ছিল,প্রতিহিংসা সাধনের জন্য ও জোরে জোরে শিৎকার দিত।রহিম প্রথমে কান চেপে থাকত।কিন্তু যখন থেকে প্রিয়া খালি গায়ে কামরা থেকে বেরিয়ে রহিমের সামনে দিয়ে চলাফেরা করতে আরম্ভ করল,রহিমের আর বসে থাকার উপায় রইল না।ও দেখতে পেতো,প্রিয়ার বুকে, পেটে,পিঠে, হাতে,উরুতে নখের দাগ,কামড়ের চিহ্ন।প্রিয়া ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে বেড়াত।প্রথমবারে হয়তো সত্যিই দরকারে এসেছিল,কিন্তু তারপর শুধু দেখানোর জন্য।রাত্রে ওকে ছুঁতে দিত না,প্রতিদিনের কামকাজের গল্প রসিয়ে রসিয়ে শোনাতো দীর্ঘ করে।ওর বাড়ি পাকার হচ্ছিল,জৌলুস বাড়ছিল,সম্পত্তিও বাড়ছিল হুহু।কিন্তু ওই বাড়িতে আর একটা দম্পতি,একটা পরিবার বাস করছিল না।বরং সম্পর্কের একটা ভূত অহরহ ওর গলা টিপে ধরছিল।

ও তবুও বাঁচতে চাইছিল।ও ভেবেছিল,এভাবেই হোক,কিন্তু মেয়েটাকে তো মানুষ করতে পারবে!ওর আর কিছু সাধ নেই।ও যে পাপ করেছে,তার কোনো প্রায়শ্চিত্ত নেই।এর শুধু ভোগান্তি আছে।তাই ভুগছে।

কিন্তু প্রিয়া ওর এই দুর্বলতা যেদিন টের পেল,তারপর থেকে সে ওই জায়গাতেও কোপ মারতে লাগল।প্রথমদিনের কোপে ঘা হল,এরপর সেই কাঁচা ঘায়ে প্রতিদিন একবার করে কোপ দিত প্রিয়া।শেষে একদিন বলল,"তোমার মেয়েকেও বেশ্যা বানাবো আমি;দেখো।"
সেদিন ও আর থাকতে পারেনি।দাঁড়িয়ে উঠে সোজা প্রিয়ার গালে এক চড় মেরেছিল।মেরেই বেরিয়ে চলে এসেছিল বাড়ি থেকে।ও শুনতে পাচ্ছিল,প্রিয়া সমানে ওর বাপ-বাপান্ত করে চলেছে।

তারপর সপ্তাহখানেক কেটে গিয়েছে।ও অনেক ভেবেছে এই কদিন।একবার ভেবেছে অনিন্দ্যাকে নিয়ে কোথাও চলে যাবে,কিন্তু প্রিয়ার অনেক চেনাজানা।ও দেখতে রূপসী,কিন্তু তার থেকেও বড় কথা ও পরীদের বংশজাত।তাই ওর যৌন আবেদন উপেক্ষা করতে পারে এমন মানুষের বাচ্চা এখনও জন্মায়নি।ও চাইলে মরা মানুষের পুরুষাঙ্গ দাঁড় করাতে পারে।তাই পালিয়েও বাঁচা যাবে না।

ওর প্রথমে খুব লাগছিল,এইটুকু বাচ্চা,তাও নিজের।কিন্তু আর কোনো উপায় ওর নেই।

আমি হরিদাস পাল।আমার জীবনে আমার কিছু নেই,কিচ্ছু নেই।আমি একটি পরজীবী,লোকের অনুভূতি ধার করে বাঁচি।সেদিন রহিমের জন্য খুব খারাপ লেগেছিল,ওর দুঃখ আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল।

তবে একথা সত্যি মানুষের মৃত্যু কম উত্তেজক,আনন্দদায়ক বিনোদন নয়। তা নাহলে রোমানরা এত বড়ো বড়ো অ্যামফিথিয়েটার বানিয়েছিল কিসের জন্য!এই যে মানুষেরা দুর্ঘটনায় বীভৎস মৃত্যু দেখতে হন্যে হয়ে ছুটে যায়,হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ক্যামেরাবন্দী করে - এগুলো কি দুঃখ বা সহানুভূতি প্রকাশের জন্য?শুধুই স্মৃতির উদ্দেশ্যে?

আমরা রাখঢাক করে বলি,প্রকৃত সত্যটা এত বেশী পীড়াদায়ক আমরা আড়চোখে দেখি তাকে,পারতপক্ষে সামনে আনি না।কিন্তু তাতে কি সত্যটা পাল্টে যায়?

সেদিন যখন রহিম অনিন্দ্যাকে খুন করেছিল,তার আগে অঝোর ধারায় কাঁদছিল।মেয়েটা রহিমের গলা জড়িয়ে বারবার জিজ্ঞেস করছিল,"কেন কাঁদছ বাবা?কেঁদো না,আমি আছি তো?"
আমি রহিমের অনুভূতি আর মনের কথা দুটোই বুঝতে পারলাম।ওর খুব ইচ্ছে করছিল ও বাড়িতে ফিরে যাবে, আনিন্দ্যাকে ও মারতে পারবে না।কিন্তু তাতে অনিন্দ্যার যা হবে, তা মৃত্যুর থেকেও ভয়ানক।ও বাবা হয়ে যদি সেটাকে না আটকাতে পারে, ও মরেও শান্তি পাবে না।

প্রথমে ও গলা টিপে মারতে চেষ্টা করল।কিন্তু পারল না। অনিন্দ্যা যখন ছটফট করতে লাগল, ও আর নিজেকে সামলাতে পারল না,ভেঙে পড়ল।কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়ের অচেতন,নিস্তেজ শরীরটার উপর।

একটু পরে নিজেকে সামলে ও উঠে গেল।কিছুক্ষণ পর ফিরে এল একটা ছুরি নিয়ে।আগের জায়গায় পৌঁছে সেটি ট্যাঁক থেকে বের করল।কিন্তু আনিন্দ্যাকে কোথাও দেখতে পেল না।

আমি জানি আনিন্দ্যা কোথায়।আমি ডেকে উঠলাম,"এই যে!"
রহিম চমকে উঠে জানালার দিকে তাকাল।আমি তার ভেতরের ভয়টা অনুভব করলাম।বুঝতে পারলাম সে ছুটে পালাবার কথা ভাবছে।আমি তাড়াতাড়ি বললাম,"আনিন্দ্যা ওই ঝোপের দিকে ছুটে গিয়েছে।বেশিদূর যেতে পারেনি বোধহয়।ওদিকটায় কাঁটা আছে তো!"
এবার রহিমের মনে ভয় থাকলেও সে ঝোপ টার দিকে গেল।
আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

আধঘন্টা পরে রহিম ফিরে এল।তার হাত ধরে আনিন্দ্যা।তার মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।রহিম তাকে ঠিক আমার জানালার সামনেটাই নিয়ে এসে দাঁড় করালো।তারপর ওর গলায় ছুরির ফলাটা ঠেকিয়ে মুখটা অন্যদিকে ঘোরাল।এবার ছুরিটা সজোরে একদিক থেকে অন্যদিকে টানল।আমি দেখলাম সুন্দর,ফর্সা,মসৃণ,ছোট্ট গলাটা মাঝখান থেকে ফাঁক হয়ে গেল।সেই ফাঁক থেকে ফিনকি দিয়ে বেরোলো গাঢ় লাল তরল রক্তের ধারা।মাঝখান থেকে শ্বাসনালীর তরুণাস্থির অর্ধবলয়গুলোর সাদা সাদা উপস্থিতি দেখলাম।শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে লাগল।

রহিম কিন্তু থেমে থাকল না।সে এবার ছুরিটা নিজের গলায় ধরল।তারপর একইভাবে গলার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে টেনে দিল।তারপর ছুরিটা ফেলে দিয়ে গলা ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।তারপর মাটিতে পড়ে মেয়ের পাশে ছটফট করতে লাগল।ততক্ষণে আনিন্দ্যার শরীরটা স্থির হয়ে গেছে প্রায়।

রহিমের রক্তের রং একটু বেশি গাঢ়।

আমার যে সে কি অদ্ভুত অনুভুতির ককটেল অনুভূত হল,বোঝানো যাবে না।দুঃখ,হতাশা,গ্লানি,আনন্দ,স্নেহ,রাগ,ঘৃণা, গর্ব আরও কয়েকটা মৌলিক ও যৌগিক অনুভূতি আমার সারা শরীরে নেচে বেড়াতে লাগল।আমি ভাবলাম আমার নিজেকে পর্যালোচনা করা দরকার।

ওই দুটো নিথর শরীর আমাকে নেশার ছোট্ট ছোট্ট একটা শট দিচ্ছিল,যতবার আমি ওদের দিকে তাকাচ্ছিলাম।একবার তাকিয়ে বিভোর হয়ে থাকছিলাম কিছুক্ষণ,আবার খানিক পরে ঘোর কাটলে তাকাচ্ছিলাম,আবার ঘোরে থাকছিলাম।যদি ওরা পচনশীল না হতো,আমি ওদের সারাজীবন আমার জানালার সামনে রেখে দিতাম,নেশা করতাম।কিন্তু বলতেই হল,বলতেই হল ওদের দুঃখজনক পরিণতির কথা।

আর আমি?
ওই বললাম না একটু আগে!আমি পরজীবী।

আমি একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম।ওই ঘটনার পর আমি খেয়াল করলাম,আমি যেন খুব বেশি সংবেদনশীল হয়ে গেছি।স্বাভাবিক পাখির আওয়াজ যেন আমার কাছে মহানিনাদ মনে হয়।ঘুমের ঘোরে মাথার কাছে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনে চমকে জেগে উঠে দেখি মশা ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার মাথার চারপাশে।এবং এই সংবেদনশীলতা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল।আমি এবার দেওয়ালে টিকটিকির চলার আওয়াজ,মাকড়সার জালের উপর দিয়ে চলার শব্দ,ঘরের মধ্য দিয়ে বাতাসের বিয়ে যাওয়ার শব্দ সব শতগুণ হয়ে আমার কানে বাজতে লাগল।

আমার চোখ কম আলোয় মারাত্মক শক্তিশালী হয়ে উঠল।দিনের আলোয় আমার চোখ ধাঁধিয়ে যায়।উপায় নেই তাই প্রথমদিন চোখ বুজে ছিলাম।তারপর মা জিজ্ঞেস করল,"হ্যাঁ রে,চোখ বুজে আছিস কেন? কী হয়েছে?"
আমি বলতে মা একটা আই মাস্ক এনে দিল।তাতে একটু সুবিধা হয়েছে বটে,কিন্তু ওটা খুলে ফেললে?

আমি আমার চামড়ায় বাতাসের কম্পন,এমনকি লোকের ফিসফিসানির ঢেউ অনুভব করতে লাগলাম।আমার মস্তিষ্কে এত বেশি সংকেত যেতে লাগল,আমার মনে হল আমার মাথা ফেটে যাবে।তাই আমি ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।সে যে কি দুর্বিষহ যন্ত্রণা!

আমার কার্যক্ষমতার ব্যাসার্ধ আরও বিস্তৃত হয়েছে।আমি এখন প্রিয়াকেও দেখতে পাই।আমি ভেবেছিলাম রহিমের মৃত্যুতে না হোক, আনিন্দ্যার মৃত্যুতে অন্তত সে কাতর হবে।সে কাতর হয়েছিল,আনিন্দ্যার মৃত্যুর জন্যই হয়েছিল।কিন্তু তা ঠিক হারানোর দুঃখ নয়,বরং নিষ্ফল প্রতিশোধস্পৃহা তার অন্তরকে দাবানলের মতো দহন করছিল।সেই তীব্র শোক কিছুদিনে প্রশম হয়ে গেল।কিছুদিন পর সে আবার তার আনন্দের সাগরে ডুবে গেল।আগে তার তবুও বাধা ছিল,সংকোচ ছিল,কিন্তু এখন কেউ নেই,কিচ্ছু নেই।

সে কি আদৌ দোষী,অন্যায়কারিণী?
আমি জানি না।উত্তরের আশাও করি না।

আমি ওর অসহায়তা,ওর ভয় অনুভব করতে পারি। ও যে এই নিষ্ঠুর সমাজে একটি সুস্বাদু যৌনাঙ্গবিশিষ্ট মাংসপিন্ড বই আর কিছু না,সে তো ও জানে!
ও যদি এই কাজ না চালিয়ে যায়,ওর অবস্থা যে ওই রাস্তার ঘেয়ো কুকুরটার থেকেও খারাপ হবে সেটা ও মনশ্চক্ষে স্পষ্ট দেখতে পায়।প্রায়দিনই ঘুম ভেঙে যায় দুঃস্বপ্ন দেখে। ও রহিমের উপর অনেক অত্যাচার করেছে,প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে।কিন্তু রহিম মরে গিয়ে ওর ওপর চরম প্রতিশোধ নিয়ে গেছে।

আমি কী করে ওকে দোষ দিই?

পরবর্তী আরও কয়েকটা বছর,আমার মরার আগপর্যন্ত ওই জানালা আমার কাছে পৃথিবীর বহিরঙ্গের সচল চিত্রমালা নিয়ে হাজির হয়েছিল।

কিছুদিন পরে আমি এমন একটা মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলাম, তা শুধু আমি খবরের কাগজে,লোকমুখে শুনে এসেছিলাম।চাক্ষুষ কখনো দেখিনি।আর দশটা লোকের মতো আমারও ইচ্ছা ছিল,একদিন দেখব।ওই যে,আমরা সবাই ধর্ষকামী,শুধু আমাদের লেভেলটা আলাদা।

তো যাই হোক,ঘটনাটা বলি।

একদিন আমি আমার জানালার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটার দিকে তাকিয়ে শুয়েছিলাম। মানে যেমন থাকি আর কি!

একটা মেয়েকে দেখলাম ছুটে পালাচ্ছে।আমার ক্ষমতার ব্যাসার্ধের মধ্যে চলে আসার জন্য আমি তার মনের ভাব বুঝতে পারলাম।কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য।তার পেছনে দুজন পুরুষ অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে করতে দৌড়ে গেল একটু পরেই।আমি ভেবেছিলাম ওরা বুঝি ওর পাড়ার কেউ লোক বা শত্রু।কিন্তু ওরা আমার ব্যাসার্ধের মধ্যে আসতেই বুঝতে পারলাম,ওরা মেয়েটার বাবা আর দাদা।কিন্তু এত রাগের কারণ কী, তা বোঝার আগেই ওরা আমার আওতার বাইরে চলে গেল।

আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে রইলাম ওরা আসবে বলে,কিন্তু ওরা আর এল না।সেদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর আমি জেগে রইলাম,এই বুঝি এল,এই বুঝি এল এই ভেবে।কিন্তু ওরা এল না।আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

অন্যদিন আমার ঘুম বিকেল চারটা বাজতে না বাজতেই ভেঙে যায়।সেক্ষেত্রে আমি ঘড়ির থেকেও নিখুঁত,ঘড়ির কাঁটা আমায় দেখে নিশ্চিত হয়।কিন্তু সেদিন আমি একটু দেরি করে ঘুমানোর কারণে,যখন উঠলাম,বোধহয় সাড়ে ছটা বেজে গেছে।বোধহয় বলছি,কারণ সেদিন ঘুমটা নিজে নিজে ভাঙেনি,আর যখন ভাঙল,তখন ঘড়ি দেখার মতো পরিস্থিতিও ছিল না।

আমার ঘুম একজনের ফিসফিস আওয়াজে ভাঙল।একটা নারীকণ্ঠ,আমি প্রথমে ভাবলাম বুঝি স্বপ্ন দেখছি।ঈপ্সিতার মুখটা আমার কানের কাছে,বারবার ডাকছে,"এই,এই,ওঠো।কই ওঠো?"
কিন্তু কণ্ঠস্বরের মরিয়াভাব আর শব্দক্ষেপণের দ্রুততায় আমার তথাকথিত চেনা ঈপ্সিতার ছবি বারবার ভেঙে যাচ্ছিল।শেষে আমার মুখে একটা আঘাত পেয়ে আমি চোখ মেললাম।একটা ঢিল!

আমাকে চোখ খুলতে দেখে সে একটু স্বস্তি পেল।বলল,"মাফ করবেন।কিছু মনে করবেন না প্লিজ।আমাকে একটু লুকানোর জায়গা দিতে পারবেন?"
কথাগুলো সে এক নিঃশ্বাসে বলে গেল।আমি তখন অবাক হয়ে দেখছি, এ তো সেই সকালের মেয়েটা।আমার চেতনা আবার সজাগ হয়ে উঠল।

মেয়েটার নাম পরী।যদিও সে মানুষ,কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর মেয়েটি।পরী নামটা সার্থক হয়েছে।আমাকে কোনো মেয়ে নিজে থেকে ডেকে কথা বলছে,এটা আমার কাছে পশ্চিমদিকে সূর্য ওঠার থেকেও বিরল।আমি তখন কত কথা ভেবে চলেছি মনে।কিন্তু ওর মনের ভেতরের কথাগুলো এত চঞ্চল আর ভীত ছিল,যে তারা বারবার আমার ভাবনার জালগুলোর মধ্য দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে জালের দড়িগুলো ছিঁড়ে ফেলছিল।ক্রমে জালবোনা থামাতে হল।

মেয়েটির বয়স ওই পঁচিশ হবে মনে হয়।তার মনে ভয়ের যে জাল ঘন হয়ে উঠেছে তা একপুরু হয়ে জমে গেছে ইতিমধ্যে।তার মধ্য দিয়ে ঢুকে অপরপ্রান্তে বেরোনোর অনেক চেষ্টা করলাম।চেষ্টা করলাম যদি তার মনের কথা জানতে পারি;কিন্তু না!
যত সময় যেতে লাগল প্রতি ক্ষণে, অণুক্ষণে সেই ভয় তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল।আমি প্রচন্ড রেগে তাকে ধমক দিলাম," আরে থামুন না!"
তাতে তার ভয় তো কমল না,বরং বেড়ে তা আমার দৃষ্টিকেও অস্বচ্ছ করে দিল।আমি তাকে ভেতরে ঢুকতে বললাম।সে জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে আমার বিছানার নিচে ঢুকতে চেষ্টা করল।আমি তাকে মানা করলাম,"এখানে নয়,ওই যে আলমারিটা আছে,ওর ভেতরে ঢুকো।"কিন্তু তাতেও তার ভয় গেল না।আমি তাকে একটু ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করলাম।তাতেও সে শান্ত হল না।একটু পরে রাতের দিকে আমি খেয়েদেয়ে ঘুমোতে যাওয়ার আগে চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম,মেয়েটা ঘুমোচ্ছে।আমি দেখলাম,তার মনে ভয়ের পরত অনেকটাই কমে এসেছে।আমি তার মনের গলিতে টহল দিতে লাগলাম।

ও এখন এমএ লাস্ট ইয়ারে পড়ে।ও যখন কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ত,ওর এক বন্ধুর দাদা ওকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়।ওরও তার প্রতি একটা দুর্বলতা ছিল,তাই ও দেরি করেনি।তবে ও সাবধানী মেয়ে,কদিন সময় চেয়ে নিয়েছিল।অনেক ভেবে দেখছিল, কী কী খারাপ গুণ বা রেড ফ্ল্যাগ আছে ছেলেটার মধ্যে?তেমন কিছু পায়নি।ছেলে লম্বা,সুপুরুষ,দেখতে হ্যান্ডসাম।নিজের ব্যবসা আছে।তবে অন্য ধর্মের,এটাই যা সমস্যা।নাহলে ব্যবহার ভালো,চরিত্রে মেয়েঘটিত কোনো দোষ নেই,নেশা করে না,স্বাস্থ্যসচেতন সবই আছে।কয়েকজন কাছের বন্ধুকেও জিজ্ঞেস করেছিল,কিন্তু তারাও ওই একটিমাত্র সমস্যা ছাড়া আর কিছু বলতে পারেনি। ও আর ভাবেনি,ওই ধর্ম কিছু না।বাবা একটু প্রাচীনপন্থী রক্ষনশীল বটে,কিন্তু ওকে খুব ভালোবাসেন।ওর খুশির জন্য নিশ্চয় মেনে নেবেন।আর তাছাড়া ও নিজের পায়ে দাঁড়ালে বাবা আর মানা করতে পারবেন না।মানা করলেও ও যদি বাড়ি থেকে বেরিয়েও আসে,নিজের খরচ চালিয়ে নেবে।যদি আয়ান না থাকে তবুও।

তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে।বেশ সুখেই ছিল ওরা।ওর কলেজ শেষ হল।মাঝে একবছর ও খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল,তাই ফাঁক গেল,কিন্তু তার পরের বছর ও এমএতে ভর্তি হল।ওই সময়টায় আয়ান ওর মনোবল বাড়িয়ে গেছে।পাশে থেকেছে।প্রায়ই দেখা করতে যেত,অবশ্যই ওই বান্ধবীর সাথে,ওকে(বান্ধবী) ছাড়ার ছুতোয়।বাবা যে সন্দেহ করেছেন ও জানত না।বাবা ঐ বিষয়ে একটা কথাও কোনোদিন উচ্চারণ করেনি।

ওরা রাতের খাবার খাচ্ছিল সেদিন।দাদা কোথা থেকে জানতে পেরে কথায় কথায় ব্যাপারটা তোলে।উল্টোপাল্টা বলতে আরম্ভ করে আয়ানের নামে।ও প্রথমে চুপ ছিল,ভেবেছিল কিছু বলবে না।কিন্তু দাদা এমন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে নিয়ে গেল ব্যাপারটা,যে ও আর চুপ থাকতে পারেনি।
-"বেশ করেছি।তোর কী করার আছে কর।"
ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই গালে একটা তীব্র জ্বালা অনুভব করেছিল।আর মাথাটা টেবিলে ঠুঁকে গিয়েছিল সজোরে।মাথার একটা পাশ কেটে গিয়েছিল।চোখদুটো অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল।যখন স্বাভাবিক হল,দেখল বাবার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে।প্রচণ্ড রাগে ফুঁসছেন,কাঁপছেন। ও কিছু না বলে টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে নিজের ঘরে দরজা দিয়ে শুয়ে পড়েছিল বিছানায়।

বাবা,ওর বাবা!কোনোদিন গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা,একটা বকুনি পর্যন্ত দেয়নি কোনোদিন। মা ছাড়া কথা বলতেন না।সে আজকে ওর গায়ে হাত তুলল! তাও বিনা দোষে! ও এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না।ভাবছে এটা একটা দুঃস্বপ্ন,জেগে উঠলেই দেখবে সব মিথ্যা।হাসি পেল আমার(হরিদাস পাল)।মানুষ কত মিথ্যা আশা করে!

তারপর এরকম ঘটনা দৈনন্দিন হয়ে গেল।ওর জেদ আরো তীব্র,তীব্রতর হয় উঠল।বাবা একদিন ওকে ছুরি নিয়ে মারতে ছুটেছিলেন।ভাগ্যিস সেদিন মা ছিল,নইলে সেদিনই ওর গল্প শেষ হয়ে যেত।এদিকে আয়ান ওকে বারবার বলতে লাগল,"তুমি চলে এস,আমরা বিয়ে করে নিই।তোমার তো আঠারো হয়ে গেছে,কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না।"
কিন্তু পরীর জেদ, ও এমন করে বিয়ে কিছুতেই করবে না।

ওদের বাড়ি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হল।

আয়ান বারবার ওকে চাপ দিতে থাকায়,ও তাকে বলে দেয়, ও যেন আর ফোন না করে।আয়ান অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয়।এদিকে পরী বাড়ির চাপ সহ্য করতে পারে না।সে ভাবে আত্মহত্যা করবে,কিন্তু আয়ানের কথা ভেবে করতে পারে না।ওর বাবা আর দাদা যে একটা খুব খারাপ কিছু করার চেষ্টা করছে ও বুঝতে পারে।কিন্তু তা যে কী,সেটা ও বুঝতে পারে না।ভাবে কী আর করবে?
ঘরে বন্ধ করে রাখবে?
খেতে দেবে না?
সম্বন্ধ করে করো সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে?
মেরে তো ফেলবে না!

কিন্তু আজ সকালে যা হল,তার থেকে মেরে ফেলাও বোধহয় ভালো ছিল।ওর বাবা আর দাদা মিলে ওকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল!
নিজের বাবা আর দাদা!

আজ সকালে ও উঠে ব্রাশ করে যথারীতি খাবার টেবিলে বসল।মাকে বলল,"মা খাবার দাও।"
এই বাড়িতে এখন শুধু মায়ের সাথেই ওর সম্বন্ধ একটু স্বাভাবিক।বাকি বাবা আর দাদা ওকে ' খানকি মাগী' ছাড়া কথা বলে না।কিন্তু তাও ও কিছু বলেনি।শুধু যখনই ওরা আয়ানকে ছাড়ার কথা বলেছে,শান্ত,ধীর,ঠান্ডা গলায় বলেছে,"না।"
ওরা গালাগালি করেছে,কিন্তু জোর করার সাহস করেনি।

আজকের এই ঘটনার জন্য ওরা নিশ্চয় বেশ কিছুদিন ধরে মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল।কারণ, আজকে ও যখন মাকে খাবার দেওয়ার কথা বলল,বাবা টেবিলে বসে খবর খেতে খেতে খবর শুনছিলেন মোবাইলে,দাদা খাচ্ছিল আর ওর গতিবিধির দিকে নজর রাখছিল রাগ রাগ চোখে।ও সেটা লক্ষ্য করেছিল।
হঠাৎ বাবা বললেন,"তা খানকি মাগী, খাবার তো আমার গিলছ,আর চোদাবে ওই হারামজাদাটাকে দিয়ে?"
ও আর সহ্য করতে পারেনি,বাবাকে বলেছিল,"আমি তোমার মেয়ে ভাবতে আমার ঘেন্না করে।তোমরা থাকো,আমি চললাম।"
বলেই উঠে চলে আসতে গিয়েছিল।

দাদা খাবার ফেলে এসে ওর হাতদুটো ধরেছিল এঁটো হাতেই।বাবা রাগে লাল চোখ নিয়ে উঠে এসে ওর গালে এক চড় মেরেছিল ঠাস করে।ওর মাথা ঘুরে গিয়েছিল।তারপর গালটা একহাতে ধরে মুখটা মুখের ঠিক সামনে নিয়ে এসে বলেছিলেন,"কোথায় যাবে? বাইটা আমরাই মিটিয়ে দেব।"
বলে ওর বুকের উপর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে দিতে দিতে বলেছিল,"হারামজাদী,খানকি মাগী,তোর খুব বাড় বেড়েছে,শাস্তি দরকার তোর। আয় তুই আজকে।"
বলে হিড়হিড় করে টানতে আরম্ভ করেছিল।এমন সময় ওর দাদা ওর হাতদুটো একহাতে ধরে, অন্য হাত দিয়ে ঘাড়টা ধরতে গিয়েছিল ধরার সুবিধের জন্য।ও এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে বাবার যে হাতটায় ওর গলাটা ধরা ছিল সেটাতে প্রাণপণ কামড় দেয়,ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামে।তারপর সেই থেকে ছুটে বেড়াচ্ছে।এখন আমার(হরিদাস পাল) বাড়িতে।

আমি পঙ্গু মানুষ।আমি কী করতে পারি মেয়েটাকে বাঁচাতে?আমি ভাবলাম মাকে বলি,কিন্তু মা অন্যকিছু ভাবতে পারে,আমাকেই দোষী বলবে এখন,আমাকেই অপরাধী বানিয়ে দেবে কোনো প্রকারে।বাবাকে বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমি ভাবলাম,যা হোক দেখা যাবে।আজকে ঘুমোক,কাল সকালে উঠে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।মেয়েটাকে কিছু খাওয়াতে পারলে ভালো হতো,কিন্তু রাতের খাওয়া হয়ে গেছে আমার, মায়েরাও নিশ্চয় খেয়ে নিয়েছে এতক্ষণে,বাড়তি খাবার কুকুরকে আর বাকিটা কাল গরুকে দেবে বলে জাবের হাঁড়িতে দিয়ে দিয়েছে।যাক কাল সকালে কিছু একটা ব্যবস্থা হবে'খন।

রাতে ঘুম ভাঙ্গল আবার একটা ফিসফিস আওয়াজে।
-"এই যে উঠুন, আরে উঠুন না।"
আমি ঘুম ভেঙে দেখলাম মেয়েটা।ঘড়ির দিকে তাকালাম,সাড়ে চারটা বাজে।আমি এমন সময় ঘুম থেকে উঠি না।আমার উঠতে উঠতে আটটা বাজে।একটু বিরক্ত হলাম।জিজ্ঞেস করলাম," কী?"
ও খুব করুন মুখ করে বলল," একটু খাবার দিতে পারেন?খুব খিদে পেয়েছে।আজ দুদিন কিচ্ছু খাইনি।সারাদিন লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছি।"
বলতে বলতে মেয়েটির চোখ জলে ঝাপসা হয়ে এল।বুঝতে পারলাম অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে,লজ্জা কাটিয়ে ও কথাটা বলছে আমাকে।কিন্তু এমন সময় খাবার কোথায় পাব?আমার কামরাতে কোনো খাবার নেই।
আমি বললাম,"খুব খিদে পাচ্ছে কী?এখন তো কিছু পাব না,সকাল হোক,মাকে বলব খবর দিয়ে যেতে।"
মেয়েটার মুখ দেখে বুঝলাম,এখন হলেই ভালো হয়,কিন্তু সে একটু মিইয়ে গেল,বলল,"ঠিক আছে।"
বলে আবার আলমারিতে গিয়ে ঢুকল।আমি বলতে গেলাম,আপনি বাইরেই শুতে পারেন,কোনো সমস্যা নেই।কিন্তু ও যা ভয় পেয়ে আছে,ওখানে থাকলেই নিজেকে বেশি সুরক্ষিত মনে করবে ভেবে আর কিছু বললাম না।কিছুদিন যাক।

আমি মাকে বলেছি।মা - বাবা দুজনেই ওকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছেন।ইতিমধ্যে ওর বাবা আর দাদা কয়েকবার খোঁজ নিতে এসেছেন,কিন্তু বাবা "আসেনি," বলে বিদেয় করেছে।আমি জানি ওরা সন্দেহ করেছে,কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।

এরপর একদিন আমার জানালায় একটা পুরুষের মুখ দেখা গেল। চারকোণা মুখ,পরীর মুখে সাথে আশ্চর্য মিল।বয়স আন্দাজ সাতাশ -আঠাশ হবে,জানালায় বুক ঠেকিয়ে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসছিল।আমার বুকে ভেতর শুকিয়ে গেল ভয়ে,শিরদাঁড়া জমে গেল, সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল।এমন হাসি যে হাসতে পারে,সে নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করতে পারে।

হলও তাই।তারও দুদিন পরে সন্ধ্যা আটটার দিকে আমি মায়ের গোঙানির আওয়াজ শুনলাম।তারপর সেই ছেলেটা আমার ঘরে ঢুকে এল,পেছন পেছন একজন বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ়,দুজনের লম্বা,সুগঠিত চেহারা,চোখে জিঘাংসা, চোয়ালে দৃঢ়তা।আমি বুঝতে পারলাম,ওরা তৈরি হয়েই এসেছে।ছেলেটা সোজা আমার কাছে এসে আমার গলায় ছুরি ধরে বলল,"পরী কোথায় বল,নইলে......"
বলে আর কথা শেষ করল না।আমার গলায় একটা তরল,আঠালো কিছু একফোঁটা পড়ল।আমি ভয়ে আরো বিছানার সাথে মিশে গেলাম।মিহিস্বরে বললাম,"ওই আলমারিতে আছে।"
কিন্তু তা এত ধীর স্বরে বলেছিলাম,ছেলেটা শুনতে পায়নি।আমার গালে একটা প্রকান্ড চড় কষাল,দুম করে বোমা ফাটার মতো শব্দ হল,আমার একটা পোকা খাওয়া দাঁত ভেঙে আমার মুখগহ্বরে পড়ল।আমি কিছুক্ষণের জন্য চোখে অন্ধকার দেখলাম,কানটা ঝিঁ ঝিঁ করতে লাগল।ওই অবস্থাতেই শুনতে পেলাম,"শালা, কী বলছিস জোরে বল।"
আমি বললাম,"ওই আলমারিতে।"

ওরা শুনতে পেল,আমাকে ছুঁড়ে ফেলে আলমারির দিকে ছুটে গেল।আমি থু করে আমার ভাঙ্গা পোকাখাওয়া দাঁতটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম।

ওরা পরীকে আলমারি থেকে টেনে বের করল।তারপর ওর দাদা ওকে ধরে রাখল,আর ওর বাবা ফড়ফড় করে ওর গত দুদিনের কাদামাটিতে মাখামাখি জামাটা টেনে ছিঁড়ে ফেলল।ওর সুন্দর সুডৌল স্তনসহ নিখুঁত নিটোল শরীরটা অনাবৃত হয়ে আমার চোখের সামনে প্রকট হল।আমি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চাইলাম,কিন্তু সাক্ষী হওয়ার যে নেশা,মানবিক কৌতূহল আমাকে মুখ ফেরাতে দিল না।

আমি দেখলাম ওর বাবা ওর গালে চড়ের পর চড় মেরে চলেছে আর তার ফাঁকে ফাঁকে স্তনগুলোকে দুহাতে যেন ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে।আমার প্রচন্ড রাগ হল হঠাৎ।আমি চিৎকার করে বলতে চাইলাম,"শুয়োরের বাচ্চা,ওটা না তোর নিজের মেয়ে?"
কিন্তু আমার সেই প্রচণ্ড চড়টা মনে পড়তেই কুঁকড়ে গেলাম।মুখ দিয়ে একটা 'টুঁ' শব্দও বেরোলো না।

ওরা এরপর পরীকে মেঝেতে শুইয়ে ক্রমাগত ধর্ষণ করে যেতে লাগল,আমি পরীর ছটফটানি আর গোঙানি শুনতে পাচ্ছিলাম,কিন্তু দেখতে পাচ্ছিলাম না ভালো করে।এভাবে আধঘন্টা ওরা ধর্ষণ করার পর একটু থামল।ওরা অন্যমনস্ক দেখে ও(পরী) উঠে ছুটে পালাতে গেল,কিন্তু ওর দাদা খপ করে হাতটা ধরে ফেলল।পরী বারবার কাকুতি-মিনতি করতে লাগল,"দাদা ছেড়ে দাও,আমি তোমাদের সব কথা শুনব।যার সাথে বলবে বিয়ে করব,আয়ানের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখব না।আমি তোমার বোন,নিজের মায়ের পেটের বোন।একটু দয়া করো দাদা।"
বাবার দিকেও চোখে আকুতি নিয়ে তাকাল।কিন্তু ওরা নির্বিকার।অনুভূতিশূন্য মুখগুলো যেন পাথরে গড়া।

এরপর ওরা পরীকে আবার শোয়াল।যৌনাঙ্গে আর মলদ্বারে সাথে নিয়ে আসা লাঠি,তারপর ছুরি প্রবেশ করাতে লাগল।চিৎকারে,আর্তনাদে ঘরের বাতাস ভরে উঠল।ওরা হিসহিসিয়ে উঠল,"চুপ মাগী!"
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলল,প্রায় ঘণ্টাখানেক হবে। পরী এবারে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।ক্রমাগত রক্তপাতে শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গেছে,ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে বলতে শুনলাম,"ঈশ্বর তোমাদের বিচার করবেন।"
আমি হাসলাম।

ওরা পরীর অচেতন শরীরটা টানতে টানতে দরজা দিয়ে নিয়ে গেল।পেছনে রক্তের স্মৃতি রেখে গেল।আমি দর্শক হলাম।জানালা বন্ধ রাখতে হবে;আগেই রাখলে হত।তাহলে আজকে অনেক কিছুই এড়ানো যেত।কিন্তু নেশার এটাই তো বিশিষ্টতা।জানি মরব,কিন্তু তবুও ছাড়তে পারি না।

আমার পরীর কথা ভাবতে ভালো লাগছিল না।আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম আমার নিজের মৃত্যুর।ভাবতে লাগলাম,ওরা আমাকে কী কী ভাবে মারতে পারে।আমি একটা,দুটো,তিনটে.....একশ বত্রিশ রকমের উপায়ের কথা ভাবলাম,কিন্তু তখনও ওরা এল না।

আমি ভাবছি,ওরা কী করছে?
এমন সময় জানালার কাছে একটা গোলমাল শুনে তাকিয়ে দেখলাম,একটা জটলা।দেখলাম একদল পুলিশের সাথে পরীর বাবা আর দাদা।পুলিশগুলো বলে দিচ্ছে আর ওরা দুজন পরীর শরীরটা কেটে টুকরো টুকরো করছে।তারপর পুলিশের কুকুরগুলোর দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে। ওরাও নিশ্চয় খুব ক্ষুধার্ত,নইলে সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিয়ে ছেঁড়া-ছিঁড়ি করে খেয়ে নিত না। পুলিশগুলোর তা দেখে সে কী উল্লাস।

ওরা আবার বাজি ধরছে।প্রতিবারে যখন একটা করে মাংসের টুকরো ছুঁড়ে ফেলে তার আগে ওরা বাজি ধরে কোন কুকুরটা খেতে পারবে।খেলার নিয়ম আবার কী,যে ধরেছে তাকে গণ্য করা হবে না,বরঞ্চ যে খাচ্ছে তাকেই ধরা হবে।আর যদি একের বেশি কুকুর খায়,তাহলে যে বেশি খেয়েছে তাকে ধরা হবে।কিন্তু কে বেশি খেয়েছে তা নিয়ে ওদের প্রায়ই লড়াই হতে লাগল।কয়েকজন পুলিশ মরল তাতে।ওদের লাশগুলো কুকুরে ছিঁড়ে খেল।ওদের প্রত্যেকের হাতে নতুন ঘড়ি,সোনার চেন থেকে আলো ঠিকরে এসে আমার চোখ কানা করে দিচ্ছিল।যেকজন মরে গেল,তাদের ঘড়িগুলো অন্য পুলিশে খুলে নিল তড়িঘড়ি।

এই করতে করতে ওদের(পরীর বাবা ও দাদা) কাজ শেষ হল।ওরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে উদ্ধত হাসি হাসল।জ্যান্ত পুলিশগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,"স্যার,চলুন।"

ওরা চলে গেলে জায়গাটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল।আমার খুব একলা লাগল হঠাৎ।হোক না ওরা খুনি,মানুষ তো?
এরপর একপশলা বৃষ্টি নামল।সব ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেল।আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বৃষ্টির জন্য যে দায়ী ছিল,তাকে আজ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।ওকে দেখে আমি আশ্চর্য হলাম।আগেও কয়েকবার দেখেছি,কিন্তু তখন ওর সীমাহীন সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি।কিন্তু এখন দেখলাম ওর শরীরে পচন ধরেছে,সেই পচনশীল শরীরে চরে বেড়াচ্ছে টাকা।তারা খুবলে খুবলে ওর প্রকাণ্ড শরীরের মাংস খাচ্ছে আর পরমানন্দে মলত্যাগ করছে।বৃষ্টিতে চারিদিক ঠান্ডা হয়ে গেল।গত কদিনের যে দাবদাহ গেল!

এরপর কদিন বেশ ভালোই গেল।জানালা দিয়ে এখন শুধু নির্মল প্রকৃতি দেখা যায়। সেই মাংসাশী কাঠবেড়ালিটা আসে।এই কদিন আমি কিচ্ছু খাইনি।মা আর বাবার মৃতদেহটা পচতে আরম্ভ করেছে।তার বিকট দুর্গন্ধ আমার খালি পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বের করে আনার আয়োজন করেছে।কয়েকবার আঁৎকার এসেছে,কিন্তু খালি পেট কি আর বমি হয়?প্রচণ্ড খিদেয় আমার পেট ক্রমাগত বিদ্রোহ করে চলেছে,আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি,কিন্তু ওরা কোনো কথা শুনতে চাইছে না।ওদের খাবার ছাড়া আর কোনো দাবি নেই,অন্য কোনো প্রলোভন নেই।

বাবা মায়ের শরীরদুটো শেয়াল কুকুরে কিছুটা খেয়েছিল,কিন্তু বাকিটা পচে সারা পৃথিবীর সমস্ত মাছি ডেকে এনেছিল।তারা আমার সাথেও দেখা করতে আসছিল নিয়মিত।বলা ভালো আমার ঘরেই কয়েকজন স্থায়ী ঠিকানা গেড়েছিল।তাদের কয়েকজন আমার শরীরকে মৃত ভেবেই তার যথাযোগ্য সৎকার করার বন্দোবস্ত করছিল।কয়েকজন শেয়াল-কুকুর আমার ঘরে এসেছিল,কিন্তু আমি হুট হুট আওয়াজ করতে চলে যেত।

এর পরের কয়েকদিন শুধু আমার নিজের সাথে লড়াই করে আর ভেবে কেটে গেল।খিদের প্রচণ্ড তাড়নার হাত থেকে বাঁচতে আমি বেশি বেশি করে ঘুমাতে লাগলাম।কিন্তু ঘুম আর কত হবে,একটা সময়ের পর ঘুমও আর ধরতে চায় না।আমি শুধু চোখ বুজে শুয়ে খিদে সহ্য করতে লাগলাম।

নিজেকে ভোলাবার জন্য আমি ভাবতে লাগলাম।আমি পরীর বাবা আর দাদার মধ্যে রাগ আর প্রতিহিংসা ছাড়া আরও অনেক কিছু দেখেছি। তারপরে আর ওদের দোষ দিতে ইচ্ছে করে না।

ওরাও মানুষ,নৃশংস বটে,কিন্তু ওদেরও অনুভূতি আছে।আর তা শুধু রাগ নয়।

পরীর বাবা পরীকে সত্যিই ভালোবাসতেন।কিন্তু আর দশটা লোকের মতো উনিও পিতৃতন্ত্রের উৎপাদিত বস্তু। এখন তুমি বলতেই পারো,বুদ্ধি ছিল তো,সেটা ব্যবহার করল না কেন!কিন্তু নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন তো,আপনি ব্যবহার করেন?আপনিও কি আর দশটা লোককে অনুসরণ করেন না,না ভেবে?

আপনিও তো আপনার বাবা,ঠাকুরদার মতো বলেন,"মেয়েদের বুদ্ধি হাঁটুতে।মেয়েরা এসবের কী বোঝে?"
নিজেকে প্রশ্ন করেছেন কখনও,আমি যত রাত্রে বাড়ি ফিরি,আমার বোন কেন ফিরতে পারে না?
আমি যতটা স্বাধীনতা পাই আমার বোন পায় না কেন?
কেন মেয়েদেরকেই রান্না শিখতে হবে,করতে হবে?

মানুষ আর ভেড়ার মধ্যে অদ্ভুত মিল আছে।আর আছে দলছুট হয়ে যাওয়ার ভয়,সমাজচ্যুত হয়ে যাওয়ার ভয়।সে ভয় আমাদের সবার মজ্জাগত।আর যাই হোক আমরা সামাজিক প্রাণী।

আর আছে মানুষ করার,অসহায় অবস্থায় রক্ষা করার অহংকার।সর্বোপরি পিতা হিসেবে অধিকার।সেই অধিকার যখন ছিন্ন হয়ে যায়,যে কেউ হিংস্র হয়ে উঠে।

এসব একসাথে মিশেই পরীর বাবার এমন জানোয়ারে রূপান্তর।আমি তাকে অপরাধকারী বলতে পারি।অপরাধী কোনোভাবেই নয়।এখানে পুরো সমাজটাই একটা প্রাণী হিসেবে কাজ করেছে,আর পরীর বাবা আর তার দাদা সেই সমাজের হাত।

ওরাও মানুষ,আমার মতোই।ওরাও ভালোবাসে,কুকুরকে আদর করে খাওয়ায়,বিড়ালকে কোলে নিয়ে আদর করে, গোরুর ডাগর চোখ দেখে ওদেরও প্রাণ গলে।ওদের আমি দোষ দিই না।নিজেকে দোষ দিই না।

তারপর আমার শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসতে লাগল।তারপর মাছিগুলো যে ক্ষত তৈরি করেছিল,তাতে সংক্রমণ হওয়াতে সেগুলো দ্রুত আরো খারাপ হচ্ছিল,আকারে বড় আর ভয়ংকর হচ্ছিল।মনে হল,এই সব আমার পূর্বকৃত পাপের ফল।যদিও আমি মনে মনে জানি,এসব মিথ্যা।কর্মফল বলে যা হয়, তা শুধু কয়েকজনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।যদি ধরা পড়ে আর যদি গরীব ও নিচু শ্রেণীর হয়।নাহলে কর্মফল পাপরূপে জমা হয়,কাল্পনিক পরলোক বা পরজন্মের জন্য।

মৃত্যু আসছে,আমি তার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি।ধীর কিন্তু প্রত্যয়ী এবং দৃঢ় সে পদক্ষেপ।প্রতি পদক্ষেপে সে আমার কাছে, আরও কাছে আসছে।মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারি,পারি তার অনিবার্যতা অস্বীকার করতে,কিন্তু তা কি করা যায়?
যায় না।

তাই সে একদিন এল।তখন আমার অচেতন অবস্থা।মাথার কাছে এসে দাঁড়ালে আমি তাকে দেখলাম।সে কী ভয়ঙ্কর, কী বিশাল, কী মহান!
কত বুদ্ধিমান, দোর্দণ্ডপ্রতাপ মহাবীর,রাজা - মহারাজা,মন্ত্রী,সেনাপতি,আমলা সবাই তার কাছে পরাভূত হয়েছে।আমি তো সাধারণ একজন মানুষ।নিজেকে স্বান্তনা দিতে লাগলাম,কিন্তু ভয় কি হয়নি?
হয়েছে,প্রচণ্ড রকমের হয়েছে।সে আমার শরীর ছুঁল না,প্রাণ শুঁষে নিতে লাগল।এরপর ধীরে ধীরে সব চেতনা লোপ পেল,সবার আগে বাড়তিগুলো,তারপর স্বাভাবিক।আমি জানতাম আর কোনোদিন এই পৃথিবীতে আসতে পারব না।প্রচণ্ড দুঃখ আমার বুকের ভেতর থেকে দমকা হওয়ার মতো বেরিয়ে এল।একটা হেঁচকি,সাথে চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল আমার।আমি পঙ্গু ছিলাম,কোনোদিন পায়ের তলায় সকালের শিশিরভেজা ঘাসের ছোঁয়া পাইনি,কিন্তু আশা ছিল,একদিন পাব।আমার বাবা ছিল,মা ছিল,এত লোক ছিল আমার চারিপাশে,গাছপালা,পশুপাখি - ওরা ভালো ছিল,কেউ খারাপ ছিল,কিন্তু ছিল তো?ওরা তো আমিই ছিলাম।ওরা সবাই আমার প্রতিচ্ছবি,আর আমি ওদের।

জানি ওই যে মৃত্যুর মূর্তি ওটা সত্যি নয়,নিছক আমার কল্পনা,তাও জানতাম।কিন্তু সবকিছুকে মানুষের রূপে কল্পনা করা ছাড়া আর কোনো রূপ ত জানতাম না।

আমি মরে গেলাম।
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















একাদশ পর্ব

পরেরদিন সকালে পানু রায় ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে দেখল অফিসঘরের দিক থেকে সুন্দরী ডাইনিং হলের দিকে আসছে। সাধারণত সুন্দরী পানু রায় অফিসে আসার পনের-কুড়ি মিনিট আগে চলে আসে। তাড়াহুড়ো করে পানু রায়ের কাছে এসে প্রায় ফিসফিস করে বলল,’ দাদু, অফিসে ঢুকো না। আমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে পিছনের বাগানের দিকে চল।‘

-কী ব্যাপার, সুন্দরী? অফিসে যেতে বারণ করছ কেন? কী হয়েছে?

-অনেক কিছু। চুপচাপ চলো। কেলো দারোগা সামনের রিসেপশনে বসে আছে। তোমার সঙ্গে দেখা করবে বলে। আমি দেখেই চুপিচুপি অফিসের পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে এসেছি তোমাকে বলব বলে। কেলো দারোগা মোবাইল দেখছিল একমনে।আমাকে দেখতে পায়নি।

-কেলো দারোগা কি চায়? হঠাৎ কী ব্যাপার কে জানে?

-অনেক কিছু ঘটে গেছে। শিবুলাল আজ সকালে খুন হয়েছে।

-কী বলছ সুন্দরী? কখন হলো? তুমি কী করে জানলে?

-টিভিতে দেখাচ্ছে। অফিসে টিভি খুলতেই দেখলাম খবরটা। কাজের মাসি এসে দেখে দরজা খোলা। শিবুলাল চিত হয়ে পড়ে আছে। বুকের মাঝখানে গুলির দাগ।

-কখন ঘটেছে?

-আটটার সময়।

-আরে না না। কখন খুনটা হয়েছে? কিছু বলল?

-সে সব কিছু বলছে না।

-কেলো দারোগা কেন এসেছে?

-জানি না। আমি শুধু দুয়ে দুয়ে আট করার চেষ্টা করছি।

-ঐ জন্য তোমায় আমি এত ভালোবাসি, সুন্দরী। এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ম্যান্ডেভিলা অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে রেবার কাছ থেকে কিছু খবর জোগাড় করা। আজ সারাদিন অনেককে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। তার আগে বেশ কিছু খবর চাই আমার।

একটা ট্যাক্সি হাত দেখিয়ে থামিয়ে তাতে উঠে পড়ল সুন্দরী আর পানু রায়। পানু রায় ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললেন,’ ম্যান্ডেভিলা অ্যাপার্টমেন্ট!’ সুন্দরী বলল,’ একটা ফোন করা উচিৎ নয়?’ পানু রায় বললেন,’ না। একদম নয়।‘ সুন্দরী বলল,’ ঠিক বলছো? তোমার মনে হয় না…’ পানু রায় সুন্দরীকে থামিয়ে বললেন,’ এখন কোনও কথা নয়। আগে খবর জোগাড় করতে হবে তারপর ভাবব কী করা যায়। তোমার একেবারে ব্যক্তিগত এবং গোপনীয় অবগতির জন্য জানাই কৃষ্ণকালী কাল রাত্রে ৮-১৫ নাগাদ শিবুলালের সঙ্গে দেখা করেছিল। কিন্তু এই কথাটা সে কোনও কারণে আমাকে বলবার প্রয়োজন মনে করেনি। আমি সেইজন্য কাউকে একথা এখনও বলিনি। আর একটা বিষয় মনে হচ্ছে তুমি ভেবে দেখতে পার। কাল রাত্রে সাড়ে আটটায় যখন রেবা শিবুলালের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল তখন সে একজন মৃত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেছিল। সেই জন্য রেবাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় যে শিবুলাল তাকে কত দাম দিয়েছিল সে নিজের বানানো একটা দাম বলেছিল। সেইজন্য আমাকে শিবুলাল যা বলেছিল তার সঙ্গে রেবাকে যা বলেছিল তার মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

-আমি কিন্তু এইভাবে ব্যাপারটা ভেবে দেখিনি। আমার মাথা সকালবেলা কাজ করে না।

-দিব্য করে। যেভাবে কেলো দারোগাকে ফাঁকি দিয়ে আমাকে পিছনের গেট দিয়ে বের করে আনলে তাতে তোমার মাথা কাজ করে না একথা কোনমতেই বলা যায় না।

- শিবুলালের খবরটা দেখার পরেই কেলো দারগাকে দেখে আমার মাথায় খেলেছিল যে আমার এবং তোমার কারুরই এখন কেলো দারোগার সামনে যাওয়া ঠিক হবে না।

- একদম সঠিক সিদ্ধান্ত। সত্যি খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে তুমি।

পানু রায় ম্যান্ডেভিলা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে ট্যাক্সিটাকে অপেক্ষা করতে বলে বাড়ির মধ্যে ঢুকে সামনের বেঞ্চে বসে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে এমন একটা হাসি দিলেন যেন কতদিনের চেনা। তারপর দু’জনে কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই লিফটের দিকে এগিয়ে এলেন। রেবার ফ্ল্যাটের দরজায় টোকা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে রেবার আওয়াজ ভেসে এল,’কে?’ পানু রায় বললেন,’ আমি পানু রায়।‘ রেবা জিজ্ঞাসা করল,’ আপনি একা?’ পানু রায় বললেন,’ না, সুন্দরী আছে আমার সঙ্গে।‘

দরজা খুলে রেবা ওদের দু’জনকে ভেতরে আসতে বলল। রেবার পরনে হাউসকোট পায়ে হাওয়াই চটি। রেবা বলল,’ দেখুন, সবকিছু একটু এলোমেলো হয়ে আছে। আসলে আমি দেরিতে উঠি। এইমাত্র ব্রেকফাস্ট করলাম। এখনও স্নান করা হয়নি। একটু কফি করে দিই?’

-না, না। ব্যস্ত হবেন না।আমরা কয়েকটা ছোটখাট খবর নিয়েই চলে যাব। আসলে খবরগুলো খুব জরুরি তাই সকালে আপনাকে বিরক্ত করতে হল। কিছু মনে করবেন না।

-কী খবর জানতে চান বলুন।

-কাল রাত্রে যখন আমরা চলে গেলাম তখন কৃষ্ণকালী এখানে ছিলেন। উনি কখন ফিরলেন?

রেবা রেগেমেগে বলল,’ তাতে আপনার কী দরকার?

-দরকার আছে বলেই জিজ্ঞাসা করছি। আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত।আপনি জানেন কি না জানিনা শিবুলালকে আজ সকালে তার ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।

রেবা কিছুটা হতচকিত হয়ে পানু রায়ের দিকে তাকাল। তারপর বাকরুদ্ধ অবস্থায় সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে রইল। সুন্দরী বলল,’ বসুন।‘ রেবা বিছানার ধারে বসে পড়ল। বিছানা তখনও ঠিক করা হয়নি। বালিশ, চাদর অবিন্যস্ত। পানু রায় হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বিছানার দিকে গিয়ে একটা বালিশ ছুঁড়ে সরিয়ে দিতেই দেখা গেল বালিশটা দিয়ে একটা রিভলভার চাপা দেওয়া ছিল। পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’এটা কী?।‘ রেবা উত্তেজিত হয়ে বলল,’ দেখতেই তো পাচ্ছেন যে এটা দাঁত মাজার ব্রাশ নয়।‘

-যদি আমার খুব ভুল না হয় তাহলে কালকে কৃষ্ণকালীর কোটের ভিতরের পকেটে যে রিভলভারটা ছিল সেটা আর এটা অবিকল এক।

পানু রায় রিভলভারটা হাতে নিলেন। রেবা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,’ উনি আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যাপারে খুব চিন্তিত ছিলেন।যেহেতু উনি ঐ লোকগুলো যারা বড় হোটেল বানাতে চায় তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চান তাই আমার নিরাপত্তার ব্যাপারটাও খেয়াল রাখছিলেন।আপনার তো জানেন ঐ লোকগুলো আগে কী করেছে?

পানু রায় ততক্ষণে বন্দুকটা খুলে ফেলেছেন। পানু রায় বললেন,’ আপনি বলছেন আত্মরক্ষার জন্য কাজে লাগতে পারে সেই জন্য উনি এই বন্দুকটা আপনাকে দিয়ে গিয়েছিলেন? কিন্তু এই বন্দুকটার কার্টিজে একটা গুলি কম কেন?

- আমি কিছু জানিনা। এটা আমার বন্দুক নয়। এটা কৃষ্ণকালীবাবু কাল এখানে রেখে গেছেন আমার আত্মরক্ষার কাজে লাগতে পারে ভেবে। আমি এটা চাইনি এবং এখনও চাইনা।

-কিন্তু এটা আপনি আপনার বালিশের তলায় রেখেছিলেন?

-আপনি হলে কোথায় রাখতেন?

পানু রায় চেয়ার থেকে উঠে বালিশের তলায় যেখানে বন্দুকটা ছিল সেখানে রেখে দিয়ে এসে বসলেন। রেবা জিজ্ঞাসা করল,’ এখন কী হবে?’

-দেখুন আমি আপনার উকিল নয়। আমি কোনও পুলিশ অফিসার নয়। সুতরাং আমি আপনাকে কোনও প্রশ্ন করতে পারিনা। শুধু একটা কথা বলুন আপনি কি কাল আমরা চলে যাবার পর কোথাও বেরিয়েছিলেন?

-না, কাল আপনাদের সঙ্গে দেখা হবার পর থাকে আমি বাড়িতেই আছি।

-ঠিক আছে। চল, সুন্দরী।‘

রেবা বলল,’ দেখুন শিবুলাল খুন হয়েছে। ঐ লোকটা আমার বাবাকে খুন করেছে। আপনারা কী মনে করেন? ওর মৃত্যুসংবাদে আমি ভেঙে পড়ব না কান্নাকাটি জুড়ে দেব? আপনি কৃষ্ণকালীবাবুর পরামর্শদাতা।আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। আপনার অনেক খ্যাতি। আমি জানি কৃষ্ণকালীবাবুকে বাঁচাবার জন্য আপনার পক্ষে যা সম্ভব আপনি তাই করবেন। দরকার হলে আমাকে দোষী সাজিয়ে ওনাকে বাঁচিয়ে দেবেন। আমার সব জানা আছে।

-আমাকে দেখে, শুনে বা আমার কাজকর্ম দেখে কি আপনার তাই মনে হয়? এ বিষয়ে আর কথা না বলাই ভালো। চল, সুন্দরী।

পানু রায় এবং সুন্দরী লিফটে করে নিচে নেমে আসার পর সুন্দরী জিজ্ঞাসা করল,’দাদু, এখন আমরা কোথায় যাব?’

-এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কৃষ্ণকালীর সঙ্গে দেখা করতে হবে। পুলিশ পৌঁছনোর আগে দেখা করতে না পারলে কোনও লাভ নেই।

-কেন পুলিশ কি বড়কালীকে সন্দেহের তালিকায় রাখছে?

-রাখবে যদি রেবা পুলিশকে বন্দুকের ব্যাপারে কোনও কথা বলে।

-রেবা কি পুলিশকে বন্দুকের ব্যাপারটা জানিয়ে দেবে বলে তোমার মনে হয়?

-সে ব্যাপারে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই।

-তোমার কী মনে হয় জানতে চাইছি।

-মাথায় বুদ্ধি থাকলে বলবে। ধর যদি ঐ বন্দুকটা দিয়েই খুন করা হয়ে থাকে তাহলে?

-ওটা তোমার নিয়ে আসা উচিৎ ছিল না?

-পাগল হয়েছ? ওসব কথা মাথায় আনাও ঠিক নয়।

টাক্সিতে উঠে পানু রায় ড্রাইভারকে বড়কালীর ঠিকানা দিলেন। সুন্দরী জিজ্ঞাসা করল,’ বাড়ি থাকবে বলে মনে হয়?’ পানু রায় বললেন,’ দেখা যাক পাওয়া যায় কি না। নাহলে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে। এবারে আর কোনও সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলা ঠিক হবে না।‘ ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করিয়ে দু’জনে বড়কালীর বাড়ির সামনের দরজা ঠেলে দেখল দরজা চাবি দেওয়া। পানু রায় বললেন,’ এটা অফিসের দরজা। কেউ না কেউ তো থাকবেই।‘ দরজায় দু-তিনবার ধাক্কা দিতেও ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সুন্দরী বলল,’ দাদু, মনে আছে কাল বড়কালী বলেছিল যে এলিনাকে আর আসতে বারণ করে দিয়েছে।‘-তবুও, কেউ না কেউ তো থাকবেই।‘ বলে পানু রায় পাশের দরজাটায় টোকা দিলেন। এটা বড়কালীর ব্যক্তিগত চেম্বার। কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে পানু রায় বললেন,’ মনে হচ্ছে কেউ নেই। চল বাইরে বেরিয়ে ফোন করা যাক।‘ বাইরে এসে বড়কালীকে ফোনে ধরার চেষ্টা করল সুন্দরী। কিন্তু পাওয়া গেল না। পানু রায় বললেন,’ছোটকালীকে ফোন কর।‘ রেবা বলল,’ ছোটকালী এখন হনিমুনে নিশ্চয়ই।‘ পানু রায় বললেন,’ না, সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ির ব্যবসায় অতো সুখ নেই। তাছাড়া ওদের হনিমুন হয়ে গেছে। শোন , তুমি বল যে তুমি একটা গাড়ি কিনতে চাও এবং তুমি কালীকৃষ্ণের সঙ্গেই কথা বলতে চাও। যদি একান্ত দরকার না হয় তোমার পরিচয় দিওনা।‘ সুন্দরী খানিকক্ষণ চেষ্টা করে ফোনটা পেয়ে গেল। ফোনটা পানু রায়কে দিয়ে বলল,’ ছোটকালী। কথা বল।‘ ওপার থেকে ভেসে এল,’ কালীকৃষ্ণ বলছি। আপনি কে?’ পানু রায় বললেন,’ আমি পানু রায়।‘

-আরে আরে অনেকদিন পরে। কী সৌভাগ্য আমার! কেমন আছেন আপনি?

-খুব ভালো। অনেক অভিনন্দন।

-অনেক অনেক ধন্যবাদ। খুব হঠাৎই হয়ে গেল। অবশ্য আপনি তো জানেন আমার কাজকর্মের ধরণ এরকমই।

-তোমার ওখানে কয়েক মিনিটের জন্য আসতে পারি?

-স্বচ্ছন্দে। সকাল থেকে কাজ করছি। আমারও একটু ব্রেক হবে। কোনও গাড়ি বিক্রীর ব্যাপারে?

-না, আর একটু ব্যক্তিগত ব্যাপার। ঠিক আছে, আসছি।

ট্যাক্সিটা এসে একটা ঘেরা মাঠের গেটে দাঁড়াল। গেটের ওপরে বড় বড় হরফে লেখা –এখানে পুরনো গাড়ি কেনা বেচা করা হয়। মাঠভর্তি হরেকরকমের গাড়ি পার্ক করা আছে। পানু রায় বললেন,’ গেটের ভিতরে ঢুকে ঐ অফিসটার কাছে চলো।‘ টাক্সিটাকে অপেক্ষা করতে বলে পানু রায় একতলা অফিসটার ভিতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে সোজা কালীকৃষ্ণের ঘরের দরজা খুলে ঢুকে গেলেন। পিছন পিছন সুন্দরীও ভেতরে ঢুকল। কালীকৃষ্ণের বয়স সাতাশ আঠাশ হবে।ছ’ফুটের বেশি লম্বা।মাথায় ঘন কালো চুল। পরনে দামি স্যুট। ছোটকালী তখন ফোনে কথা বলছিল। পানু রায় আর সুন্দরীকে দেখতে পেয়ে বলে উঠল,’আচ্ছা আমি এখন রাখছি। একজন অতিথি এসেছেন।আমি পরে ফোন করছি… কখন বলতে পারছি না।আচ্ছা রাখছি।‘ ফোন রেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পানু রায়ের সামনে এসে পানু রায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,’ আপনি কেমন আছেন? আপনার সঙ্গে সত্যিই অনেকদিন দেখা হয়নি।‘ পানু রায় বললেন,’ সত্যিই অনেকদিন পরে দেখা হলো। আন্তরিক অভিনন্দন!’ ছোটকালী হেসে বলল,’খুব সুন্দর মেয়ে। আমি যে কী করে ওকে সম্মোহিত করে ফেললাম কে জানে? আসলে অনেকদিন ধরে লোককে বুঝিয়ে গাড়ি বিক্রী করার অভিজ্ঞতা বোধ হয় কাজে দিয়েছে। সুন্দরী, কেমন আছেন? আপনাকে দেখতে সত্যিই বেশ ভালো লাগছে।‘ সুন্দরী প্রত্যুত্তরে বলল,’ধন্যবাদ।‘ পানু রায় বললেন,’ আমরা তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য গিয়েছিলাম।কিন্তু অফিস বন্ধ।‘

-বন্ধ? কেন বন্ধ থাকার তো কথা নয়। বাবা না থাকলেও এলিনার তো থাকার কথা।

-আমার মনে হয় এলিনা আর তোমার বাবার অফিসে কাজ করছে না। তুমি জান বাবা কোথায়?

-কেন? কাজ করছে না কেন? সত্যি কথা বলতে কি আমি ফেরার পর বাবার সঙ্গে এখনও পর্যন্ত দেখা হয়নি। একটা সামান্য ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপার। মনে হয় সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার ঘন ঘন মত পরিবর্তন বাবার পছন্দ নয়। আসলে আমদের আগের প্রজন্মের মানুষদের পক্ষে বোঝা কঠিন যে এখনকার ছেলেমেয়েরা কী চায়। আমার মনে হয় আমার বাবারও আমার দাদুর সঙ্গে একই সমস্যা হয়েছিল।আমাদের জীবনের গতি অনেক বেড়ে গেছে। আমার ব্যবসার কথাই ধরুন।আমাকে সারাক্ষণ এখানে ওখানে দৌড়তে হয়। আমার নিজের সময় বলে কোনও সময় নেই। এর প্রভাব পারিবারিক জীবনের ওপর পড়তে বাধ্য। আমি আগে যে ভাবে অনুভব করতাম, ভাবতাম এখন আর সেভাবে পারিনা।

-তুমি কি তোমার বাবার সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত মতভেদের কথা বলছো?

-না, ব্যক্তিগত ব্যাপারে। আমি দুঃখিত আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারছি না। যখন এসেই পড়েছেন দু-একটা গাড়ি দেখাই। ভালো গাড়ি। যে রকম আপনার পক্ষে সুবিধেজনক। বড়, এয়ারকন্ডিশন্ড, হাই স্পিড ঠিক যে রকম আপনার দরকার। একেবারে নতুনের মত আছে।

-না, আমার এখন কোনও গাড়ির প্রয়োজন নেই। তুমি এলিনার খবর জান? অফিসে না থাকলে কোথায় থাকতে পারে?

-ওর ফ্ল্যাটে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।

- কোথায় থাকে জান?

-এক মিনিট। দেখে বলছি।

ছোটকালী একটা ড্রয়ার থেকে একটা নোটবুক বের করে কয়েকটা পাতা উলটে বলল,’ রোজমেরি অ্যাপার্টমেন্ট।ফ্ল্যাট নম্বর ৩১৭। ফোন নম্বর ৭৯৭৭০৩২৪৮১। কিন্তু ও অফিসেই থাকবে।হয়ত কোনও কাজে একটু বেরিয়েছে। এলিনা খুব নির্ভরযোগ্য। আমিই ওকে বাবার কাছে পাঠিয়েছিলাম। খুব ভালো কাজ করছে। দারুন এফিসিয়েন্ট।দেখতেও খুব সুন্দর। অফিসে গেলে অবশ্যই দেখতে পাবেন। একেবারে অফিস আলো করে বসে থাকে।‘

-ঠিক আছে দেখছি। বাবার সঙ্গে কথা হলে বলো যে আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। খুব জরুরি।

-নিশ্চয়ই বলব। সুন্দরী, আপনি একটা গাড়ি দেখতে পারেন। আমি আপনার জন্য সত্যিই অনেক কম দামে দেব।শুধু দাম নয় গাড়িটার ইতিহাস আপনাকে বলে দেব। এক হাতেই গাড়িটা চলেছে এতদিন। আপনার আখেরে লাভই হবে।

-দেখি, পরে অন্য কোনও এক দিনে। আপাতত আমি যেখানেই যাই হয় বাড়ির গাড়িতে না হলে দাদুর সঙ্গে। নিজের গাড়ির দরকার হয়নি এখনও।

ছোটকালী ওদের সঙ্গে ট্যাক্সি অবধি এল। বলল,’যত ভাড়া আপনি ট্যাক্সির জন্য দেন তার চেয়ে অনেক কমে…যাই হোক বাবার সঙ্গে কথা হলে বলে দেব।‘

ট্যাক্সিটা দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গেল। ট্যাক্সিটা গেটের বাইরে বেরোতেই সুন্দরী আর হাসি চেপে রাখতে পারল না। খিলখিল করে সশব্দে হেসে উঠলো। পানু রায় বললেন,’ ওর মন্ত্র হচ্ছে- যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।‘

ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল,’ এখন কোথায়?’ পানু রায় বললেন,’ রোজমেরি অ্যাপার্টমেন্ট। কতদূর জানেন?’ ড্রাইভার বলল,’ মিনিট দশেক লাগবে।‘ সুন্দরী বলল,’ আমার মনে হয় ছোটকালী আর বড়কালীর মধ্যে ঝামেলাটা শুরু হয়েছে তখন থেকে যখন ছোটকালী ফোন করে বাবাকে বিয়ের খবরটা দেয়। তোমার মনে হয় না যে বড়কালীর রাগের কারণ হচ্ছে ছোটকালীর রেবার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা?

-অনেক কারণেই মতবিরোধ হতে পারে। কিছুতো একটা হয়েছে নিশ্চয়ই। দেখা যাক বিয়েটার ব্যাপারে এলিনা কিছু বলতে পারে কি না।

-দেখা যাক। এলিনা কিন্তু তোমার সঙ্গে যে খুব একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করবে এমন কথা বলা যাচ্ছে না।

-করবে না ধরে নাও। সেটাই স্বাভাবিক।

-দাদু, ফোন করে আমাদের যাবার ব্যাপারটা জানানো কিন্তু ভদ্রতার মধ্যে পড়ে। মহিলারা সাধারণত সকালে একটু অবিন্যস্ত থাকে।

-যদি ‘না’ বলে দেয় তাহলে কী হবে?

-সেটা যথেষ্ঠ অপমানজনক ব্যাপার হবে।

-সুতরাং আমার মনে হয় ফ্ল্যাট অবধি গিয়ে দেখা যাক কী হয়। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব।

রোজমেরি অ্যাপার্টমেন্টের মূল দরজাটা খোলাই ছিল। ভিতরের লবিতে একজন সিকিউরিটির বসার জায়গা আছে কিন্তু তখন কেউ ছিলনা। লিফটে তিনতলায় উঠে ৩১৭ নম্বর ফ্ল্যাটের দরজায় প্রথমে একটা টোকা তারপর একটু থেমে চারটে ছোট টোকা তারপর একটু থেমে আবার দুটো ছোট টোকা দিলেন পানু রায়। ম্যাজিকের মত কাজ হলো। দরজা হাট করে খুলে গেল । এলিনা দরজায়। নিখুঁত সাজগোজ এবং বেরোবার জন্য সম্পূর্ণ তৈরি। বলল,’আমি অনেকক্ষণ… ওহ আপনারা। আমি অন্য একজনকে আশা করছিলাম।‘ পানু রায় বললেন,’ আমি আপনার সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে চাই। ভেতরে আসতে পারি? ইনি সুন্দরী, আমার সহকর্মী।‘

-আমার কোনও সময় নেই। আমি বেরোচ্ছি। আমার একটা জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।‘

-মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার।

-ঠিক আছে, ভেতরে আসুন।

পানু রায় ফ্ল্যাটে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন,’ আপনি আর কৃষ্ণকালীর অফিসে কাজ করছেন না?’

-আপনাকে ধন্যবাদ। না আর করছি না।

-কিন্তু আমি কী করলাম?

-উনি বললেন যে আমার আপনাকে বলা উচিৎ ছিল যে উনি কোথায় গেছেন এবং কোথায় আছেন।

-আপনি জানতেন?

-হ্যাঁ জানতাম। কিন্তু উনি বলেছিলেন কাউকে না বলতে। আমি তো কাউকে মানে কাউকেই বুঝি। আপনি কী বোঝেন?

-আমি বুঝি প্রায় সবাইকেই। কিন্তু কেন? এই নিয়ে কোনও কথা কাটাকাটি হয়েছিল?

-পুরো পরিবারটাই দুর্গন্ধময়। আমি ভাবতাম ছেলেটাই খারাপ । পরে বুঝলাম যেমন বাবা তেমন ছেলে বা যেমন ছেলে তেমন বাবা।

-আমার খুব খারাপ লাগছে যে এমন একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য আপনি চাকরি হারালেন যার সঙ্গে আমার দেখা করতে আসার একটা সম্পর্ক আছে।

-ওসব নিয়ে ভাববেন না। আমি এখন যথেষ্ঠ ভালো আছি।ঐ দমবন্ধকরা পুরনো অফিসটায় আমার সময় নষ্ট হচ্ছিল। আমার অনেক জায়গায় যাওয়ার এবং অনেক কিছু করার বাকি আছে। এবার শুরু করতে হবে।

-সেদিনের ঘটনা সম্বন্ধে একটু বলবেন?

-সেদিন কাঠমান্ডু থেকে ফিরে ওনাকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। উনি আমাকে বলেছিলেন উনি অফিসে না আসা পর্যন্ত আমি যেন অপেক্ষা করি। যদি দেরি হয় আমি যেন ডিনার করে নিই এবং ডিনারের বিল কোম্পানি অ্যাকাউন্টে জমা করে দিই। ওভারটাইমের ব্যাপারে কোনও উচ্চবাচ্চ্য নেই। ডিনারের আর কী এমন খরচ। আমাকে তো আমার ফিগারের দিকেও নজর রাখতেও হবে। যেখানে আমার একটা চিকেন তন্দুরি এবং দু’টো নান খাওয়ার কথা সেখানে আমি একটু ফল আর একটু চিস স্যালাড দিয়েই ডিনার সারি। যে পেশায় আমি আছি সেখানে শারীরিক সৌন্দর্য এবং লাবণ্যের প্রয়োজন বেশি। যাই হোক আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে ওনার অফিস বাড়ির মতই। বাড়িতে যা যা থাকে ওনার অফিসে সব আছে। অফিসে স্নানঘর, ড্রেসিং রুম , কিচেন তো আছেই। তাছাড়াও বার এবং রাত্রে শোবার ব্যবস্থাও আছে। যদি কোনও কারণে অনেক রাত্রে লং ডিস্টেন্স কল থাকে তাহলে এখানেই থেকে যান উনি। সে কথা থাক। সেদিন উনি অফিসে আসার পর মনে হল উনি কোনও কারণে খুবই ব্যস্ত আছেন এবং হয়ত আমাকে চলে যেতে বলবেন। কিন্তু উনি ওনার ছেলের মতই স্বার্থপর। উনি বললেন উনি খুব ক্লান্ত এবং ওনার এখনই স্নানের এবং পোশাক পরিবর্তনের প্রয়োজন। এই বলে স্নানঘরে চলে গেলেন।আমি বসে আছি তো বসেই আছি। বেশ খানিকক্ষণ পরে স্নান সেরে ,স্যুট পরিবর্তন করে এসে আমাকে নিয়ে পড়লেন।

-আপনি কি বললেন?

-আমি বললাম যে আমাকে কাজ ওনার থেকে শিখতে হবে না। আমাকে উনি যা বলেছেন আমি তাই করেছি। ওনার যদি মনে হয় আমার বদলে অন্য কাউকে উনি কাজটা দেবেন উনি স্বচ্ছন্দে করতে পারেন।

-উনি কী বললেন?

-উনি বললেন সেটাই ওনার পক্ষে সুবিধেজনক হবে। শুনে আমি তখনই অফিস থেকে বেরিয়ে যাই।

-তখন কটা বাজছিল?

-ধরুন পৌনে ন’টা হবে।তারপর আমাকে অযথা বসিয়ে রাখলেন যাতে আরাম করে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। আমার তো পাগল পাগল লাগছিল।

-এম সেকেন্ড। আপনাদের কথা কাটাকাটি আন্দাজ ক’টার সময় শুরু হয়?

-ন’টা পাঁচ-দশ হবে।

-উনি আপনাকে বলেছিলেন যে উনি কাঠমান্ডু থেকে সরাসরি অফিসে এসেছেন?

-উনি তো তাই বলেছিলেন।

-উনি প্লেনে এসেছিলেন না গাড়িতে?

-আমি জানিনা। ওনার সঙ্গে গাড়ি ছিল। ওনার চার পাঁচটা গাড়ি। তা সত্ত্বেও ইচ্ছে হলে ছেলের দোকান থেকে অন্য গাড়িও নিয়ে আসেন।

-কতদিন উনি কাঠমান্ডুতে ছিলেন?

-দু’দিন।

-আচ্ছা আমি কি আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি যে আপনি এখন কী করবেন ভাবছেন?

-আমি এখন তাই করতে চাই যা আমার অনেক আগে থেকেই করা উচিৎ ছিল। মঞ্চাভিনয় ।

-আমি জানতাম না আপনি আগে মঞ্চে অভিনয় করেছেন।

-আমি বলিনি যে আমি করেছি। কিন্তু আমি মঞ্চাভিনয়ের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছি।আমি আজ সকালে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছি এবং আমাকে এক্ষুণি বেরোতে হবে। মিঃ রায় , আমি দুঃখিত। আপনার বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ নেই কিন্তু আমার সঙ্গে মোটেই ঠিক কাজ করা হয়নি।

-কেন ঐ অফিসে কি সত্যিইন আপনি আর যেতে চান না?

-আমি তো যাবই না। আমি পুরো দুনিয়াকে সেকথা বলতে চাই।আমার কিন্তু আপনাদের বের করে দেবার ইচ্ছে নেই। আপনারা দয়া করে আসুন। অনেক সময় নিয়েছেন আপনারা। আপনি কৃষ্ণকালীবাবুকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন উনি বলতে পারবেন কী হয়েছিল।

-না, না। আমি আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই। উনি তো ওনার কথা বলবেন।

-আপনি যদি আমার ক্তহা শুনতে চান তাহলে সারা সকাল কেটে যাবে। ওনার ছোটলোক ছেলে আমাকে জোর করে এখানে নিয়ে এল। তারপর কিছুদিন যেতে না যেতেই বাবার অফিসে সেক্রেটারি করে দিয়ে ভেগে গেল। তারপরে শুরু হল রেবা কৈরালাকে নিয়ে আদিখ্যেতা। হোটেলে, বারে সর্বত্র ওদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখা যাচ্ছিল। তারপর শুনলাম পাটনায় গিয়ে একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। মেয়েটি আসলে কাঠমান্ডুর। কোনও কারণে মেয়েটি ওর পুরনো গাড়ির দোকানে গিয়েছিল।মেয়েটিকে ও একটা পুরনো গাড়ি বিক্রী করেছিল। মেয়েটি তার বদলে নিজেকে দিয়ে দিয়েছে ঐ অসভ্যটার হাতে। আপনি মিলিয়ে নেবেন আমার কথা ছ’মাসের মধ্যেই ওকে ছেড়ে আবার একজনকে পাকড়াবে লোকটা। ও নিজেই জানেনা ও কী চায়। এবার আপনারা দয়া করে আসুন।আমাকে বেরোতে হবে।

-আপনি কিসে যাবেন? আপনার গাড়ি আছে?

-না, একটা ট্যাক্সি নিয়ে নেব।

-আপনি কোথায় যাবেন।

-আমি সিনেমাপাড়ায় যাবো।

-আমাদের একটা ট্যাক্সি নিচে অপেক্ষা করছে। আপনি আমাদের অফিস অবধি আমাদের সঙ্গে আসতে পারেন। আমাদের অফিস সিনেমাপাড়ার পথেই পড়বে। তারপর ওখান থেকে এই ট্যাক্সিটা নিয়ে নেবেন।

-আপনি কিন্তু সত্যিই খুব অদ্ভুত। চলুন।

খুব তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাট বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল এলিনা এবং ওরা দু’জন। ট্যাক্সিটা পানু রায়ের অফিসে পৌঁছলে ওরা দু’জন নেমে পড়ল। পানু রায় ড্রাইভারকে বললেন,’ এখান থেকে সিনেমাপাড়া যেতে যা লাগবে যোগ করে কত হয়েছে বল। এই ভদ্রমহিলাকে সিনেমাপাড়ায় নামিয়ে দিও।‘ তারপর ড্রাইভারকে পয়সা মিটিয়ে ফুটপাথে উঠতেই দেখলেন পাশে কেলো দারোগা।