Next
Previous
Showing posts with label অমৃত সদন. Show all posts
0

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in








একলব্য তীরধনুক নিয়ে প্রতিদিন সেই মৃন্ময় মূর্তির কাছে আসে, পাঠ নেয় আর চলে যায় বনের দুর্গম এলাকায়। মহাদেবের মন্ত্র পড়ে শর নিক্ষেপ করে। এই ভাবে সমগ্র ধনুর্বিদ্যা তার করায়ত্ত হয় কয়েক মাসে। অঙ্গাগ্রণী তখন গর্ভবতী।

এমনই সময় একদিন অরণ্যে বিস্তর কোলাহল দেখা দিল। অনেক লোকজন নানা রকমের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বনের মধ্যে প্রবেশ করল। তাদের দ্রুতগামী রথ বনের প্রান্তসীমায় রাখা। সেই সব লোকজনের কারও হাতে দড়ি, কেউ বা জাল, বল্লম, তীরধনুক ইত্যাদি মৃগয়ার উপকরণ নিয়ে বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল। শিকারী কুকুররা ছূতে বেড়াচ্ছে। লোকজনের মধ্যে কারও কারও বেশভূষা একটু অন্য রকম, তাদের দেখে রাজপুত্র মনে হয়।

একলব্য একমনে ধনুর্বিদ্যার নানা কৌশল ও নিয়মকানুন স্মৃতি থেকে বর্তমান অভিজ্ঞতায় তুলে এনে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন। এমন সময় একটি কুকুরের আওয়াজে তার মনোসংযোগের বিঘ্ন ঘটে। কুকুরটি বোধ হয় এমন মানুষ আগে দেখেনি, সে ক্রমাগত ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে। একলব্য প্রথম দিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু চীৎকার যখন সহ্যের বাইরে চলে গেল, সে একসঙ্গে সাতটি বাণ কুকুরের মুখে নিক্ষেপ করল। একে বলে শব্দহরণ বাণ। যে কোনও জীবের স্বরনির্গমনের দ্বারে এই সপ্ততীর নিক্ষিপ্ত হলে সেই প্রাণীর সপ্তস্বর সাময়িকভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়। কুকুরটিরও তাই হল। সে ছুটে গিয়ে প্রভুদের কাছে উপস্থিত হল। প্রভুরা ছিলেন হস্তিনাপুরের পাণ্ডব রাজকুমার—যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব। শরবিদ্ধ কুকুরটিকে দেখে তাঁরা চমকে গেলেন। কে সেই তীরন্দাজ যে এমন অদ্ভুত শরশাস্ত্র সম্পর্কে বিদ্বান! সম্ভবত তাঁদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যও এই শব্দহরণ শরনিক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত নন। তাঁরা তীরন্দাজের খোঁজে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন।

পাণ্ডবরা দেখলেন, একজন কৃষ্ণবর্ণ, ধূলিধুসরিত, কৃষ্ণজিনজটাধারী যুবক অনবরত বাণক্ষেপ করছে। যুধিষ্ঠির তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে তুমি? কার লোক?

কৃষ্ণজিনজটাধারী একলব্য জবাব দিল, আমি নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র, দ্রোণাচার্যের শিষ্য এবং ধনুর্বেদশিক্ষা সম্পন্ন করেছি।

ভীম বললেন, তুমি কার লোক?

একলব্য উত্তর দিলেন, আমি আমার লোক।

অর্জুন খুব বিস্মিত হলেন। গুরুদেব দ্রোণ তাহলে জঙ্গলের নিষাদদের সঙ্গে ষড় করছেন! এই কথা পিতামহ ভীষ্মের কানে তুলতে হবে। আচার্য তাদের জল আনতে বলে অশ্বত্থামাকে অনেক গুপ্তবিদ্যা শিখিয়েছেন তা অর্জুন বিলক্ষণ জানেন। এখন শত্রু পাঞ্চালরাজকে শায়েস্তা করার জন্য হস্তিনাকে ভরসা না করে আচার্য নিষাদদের শরণাপন্ন হয়েছেন। অর্জুন একলব্যকে শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, আচার্য দ্রোণ এখানে আসেন না তুমি হস্তিনায় যাও শিক্ষা নিতে?

একলব্য জবাব দেয়, আমি একবার গিয়েছিলাম। তার পর থেকে দ্রোণাচার্য স্বয়ং এই বনের মধ্যে আমাকে সমগ্র ধনুর্বেদশাস্ত্র শিখিয়েছেন।

পাণ্ডব ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বিদ্বান সহদেব বললেন, আমাদের মৃগয়া না করে হস্তিনায় ফিরে সব কথা পিতামহ ভীষ্মকে জানানো উচিত।

দ্রুতগামী রথ চলল হস্তিনানগরের দিকে।

হস্তিনায় পৌঁছে অর্জুন সোজা চলে গেলেন পিতামহ ভীষ্মের কাছে। পাণ্ডুর এই পুত্রটিকে পিতামহ অত্যন্ত স্নেহ করেন। অর্জুনের কাছে সব শুনে ভীষ্ম ডেকে পাঠালেন বিদুরকে।

বিদুর কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের পুত্র। তাঁর মা দাসী ও শূদ্রা। সেইজন্য বিদুরকে ক্ষত্তা বলা হয়। বর্ণবিচারে প্রজ্ঞাবান বিদুর পারশব—শবতুল্য, কিন্তু তাঁর বিচক্ষণতা ও কূটবুদ্ধি অপরিসীম। ভীষ্মের ডাকে বিদুর এসে সব শুনে দ্রোণাচার্যকে ডাকা সমীচীন মনে করলেন।

দ্রোণ এলেন, সব শুনলেন। তাঁর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল ভয়ে। তিনি তোতলাতে তোতলাতে বললেন, বিশ্বাস করুন গাঙ্গেয়, আমি একলব্যকে কোনও প্রকার গুপ্ত বা প্রকাশ্য শিক্ষা দিইনি। আপনি যেমন বলেছিলেন, তেমন ভাবেই তাকে প্রত্যাখ্যান করেছি।

ভীষ্ম বললেন, তবে নিষাদপুত্র এই বিদ্যা কোথা থেকে শিখলো?

দ্রোণ উত্তর দিলেন, বিশ্বাস করুন, আমি নিজেই এই বিদ্যা জানি না। কী করে শেখাবো?

অর্জুন বললেন, কিন্তু গুরুদেব, নিষাদপুত্র জানাল যে তার গুরু আপনি, আপনার একটি মূর্তির সামনে সে অস্ত্রশিক্ষা করে থাকে। আপনি অনুমতি না দিলে সে এই সাহস পায় কোথা থেকে!

দ্রোণ ক্ষণকাল চিন্তা করে জানালেন, এখন দেখছি সে বাহ্যত আমার শিষ্য না হলেও ফলত আমারই শিষ্য।

বিদুর এতক্ষণ চুপ করেছিলেন। তিনি এ বার মুখ খুললেন, এই ভাবে কথার খেলা খেললে চলবে না আচার্য!

অর্জুন ক্রোধবশত বলে বসলেন, হে আচার্য! একদা আলিঙ্গন করে প্রীতিপূর্বক আমাকে বলেছিলেন ‘আমার অন্য কোনও শিষ্য তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ হবে না’। অথচ আজ? আপনার ‘বাহ্যত নয় কিন্তু ফলত’-শিষ্য আমার থেকে তো বটেই, সমস্ত বীর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

দ্রোণ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আমাকে একলব্যের কাছে নিয়ে যেতে পারবে?

অর্জুন জবাব দিলেন, পিতামহ আদেশ দিলে নিশ্চয় নিয়ে যাব।

ভীষ্ম অর্জুনসহ অন্যান্য পাণ্ডবদের চলে যেতে বললেন। দ্রোণাচার্য ও বিদুরকে নিয়ে তিনি একটি কক্ষে উপস্থিত হয়ে তার দ্বার রুদ্ধ করে দিলেন।

বিদুর ফিসফিস করে বললেন, হে আচার্য, আপনি যে নির্দোষ তা প্রমাণ করতে পারবেন?

দ্রোণ উত্তর দিলেন, বিশ্বাস করুন আমি একলব্যকে ধনুর্বেদশিক্ষা দিইনি।

ভীষ্ম বললেন, বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের প্রশ্ন এখানে তুলছেন না ক্ষত্তা, তিনি প্রমাণ চাইছেন।

দ্রোণ ভয় পেয়ে বললেন, একলব্যকে কোনও প্রকার শিক্ষা যে দিইনি তা আমি দেবতাদের নামে শপথ করে বলছি।

বিদুর হেসে ফেলে জানালেন, একলব্য বলছে আপনি তার গুরু আর আপনি বলছেন সে আপনার শিষ্য নয়। আচ্ছা এক কাজ করুন, আমরা যা বলব, তাই আপনি করতে পারবেন?

দ্রোণ প্রশ্ন করলেন, কী?

বিদুর বললেন, একলব্যকে হত্যা করতে হবে।

দ্রোণাচার্য ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন, না মানে হত্যা করব, মানে...

ভীষ্ম বললেন, ক্ষত্তা, খামোখা আচার্যকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলো না। হস্তিনাকে সুরক্ষিত রাখার দায় আমার। একলব্য বেঁচে থাকলেও সেই সুরক্ষা সম্ভব।

দ্রোণ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

ভীষ্ম বলতে লাগলেন, আচার্য! আপনাকে ডানহাতি সেই তীরন্দাজের দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে আনতে হবে।

দ্রোণাচার্য অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। বিদুর ও ভীষ্ম হো হো করে হাসতে লাগলেন। প্রাতিকামী এসে দ্রোণের চোখেমুখে জল ছিটিয়ে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিল।

স্ত্রী কৃপী ও পুত্র অশ্বত্থামাকে সব কথা খুলে বললেন আচার্য।

কৃপী উপদেশ দিলেন, এই চাকরি আপনি ছেড়ে দিন ভর্তা।

অশ্বত্থামা বললেন, হে পিতা, সব কথা ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর পুত্রদের অবিলম্বে জানান। আপনার চাকরি চলে গেলে আমরা খাব কী?

ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধন অশ্বত্থামার বিশেষ বন্ধু। দুর্যোধন নিজেকে যুবরাজ বলে ঘোষণা করেছেন কারণ তাঁর পিতা ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনার রাজা। ধৃতরাষ্ট্র যেহেতু অন্ধ, তাই তাঁর অনুজ পাণ্ডু রাজা হওয়ার দাবিদার ছিলেন। কিন্তু তিনি রাজত্ব ছেড়ে বনে চলে যান এবং সেখানেই প্রয়াত হন। তাঁর পাঁচ ছেলে এখন হস্তিনার অর্ধেক দখল নিতে চাইছেন। দুর্যোধন তাঁদের কোনও অংশ দেবেন না বলে ঘোষণা করেছেন। পিতামহ ভীষ্ম এবং বিদুর সব সময় পাণ্ডবদের পক্ষে থাকেন। ভীষ্ম দ্রোণকে অস্ত্রগুরুর পদে বসিয়েছেন বটে, কিন্তু দুর্যোধন বাধা দিলে পিতামহ আচার্যকে সরাতে পারবেন না।

দ্রোণ পুত্রকে বললেন, এক্ষুণি কিছু বলার দরকার নেই। দেখি ঘটনা কোন দিকে যায়।

হঠাৎ রাজসভার দূত এসে দ্রোণকে জানাল, বাইরে দ্রুতগামী রথ প্রস্তুত। এক্ষুণি তিনি যেন প্রস্তুত হয়ে রথে উপবেশন করেন, মহামান্য ভীষ্ম এই আদেশ পাঠিয়েছেন।

দ্রোণাচার্য দূতের সঙ্গে বাড়ির বাইরে গিয়ে দেখেন, রথ প্রস্তুত। সারথি ছাড়া সেখানে বসে রয়েছেন অর্জুন।

রথ চলতে শুরু করল। গুরু-শিষ্য কারও মুখে কোনও কথা নেই। এই ভাবে সারা রাস্তা অতিক্রম করে তাঁরা একলব্যের কাছে পৌঁছলেন।

দ্রোণ দেখলেন, ধূলিধুসরদেহ, জটাধারী ও কৌপীনপরিধায়ী নিষাদ একলব্য একমনে ধনু ধারণ করে অনবরত বাণক্ষেপ করছে।

দ্রোণাচার্যকে আসতে দেখে অভিভূত একলব্য তাঁর কাছে গিয়ে চরণযুগল ধারণ করে মস্তক দ্বারা ভূতল স্পর্শ করল। দ্রোণাচার্য বাধা দিলেন না।

আচার্যকে পূজা করে একলব্য নিজেকে তাঁর শিষ্য বলে ঘোষণা করে কৃতাঞ্জলি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

দ্রোণ বললেন, হে বীর যদি তুমি আমারই শিষ্য হও তবে আমাকে সেই শিক্ষাদানের বেতন দাও।

একলব্য আনন্দিত হয়ে বলল, কী চান গুরুদেব, আদেশ করুন। হে বেদজ্ঞশ্রেষ্ঠ, গুরুকে অদেয় আমার কিছুই নেই।

দ্রোণাচার্য একটু থামলেন। বললেন, আমাকে শব্দহরণ বাণনিক্ষেপের পাঠ দাও।

অর্জুন অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
0

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in





















রাজসভায় পৌঁছে একলব্য যে রাজপুরুষকে দেখলেন তিনি টকটকে ফর্সা। উচ্চতাও চোখে পড়ার মতো। কৃশও নন আবার স্থূলও নন। জলদগম্ভীর কন্ঠে সেই পুরুষ একলব্যকে বললেন, তুমি হস্তিনায় কেন এসেছো?

একলব্য ভাবলো, সত্য কথা বলা ভাল। তাতে ধর্ম রক্ষা পাবে আবার কোনও ঝামেলায় পড়তে হবে না। সে উত্তর দিল, আচার্য দ্রোণের কাছে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা করতে।

রাজপুরুষ মৃদু হাসলেন। তার পর বললেন, আচার্যের কাছে না গিয়ে অস্ত্রবাজারে গেলে কেন?

“আজ্ঞে, ভাবলাম বাজারটা একবার দেখে নিই। নতুন জায়গা কিনা!”

“কোথা থেকে এসেছো?”

“দণ্ডকারণ্য।”

“সেখানে তো জরসন্ধের এক সেনানায়ক হিরণ্যধনু রাজত্ব করেন!”

একলব্য জানায়, সে হিরণ্যধনুর পুত্র, নিষাদ রাজকুমার।

রাজপুরুষ দ্রোণাচার্যকে ডেকে পাঠালেন।

কৃশকায় দাড়িওয়ালা এক প্রৌঢ় এসে দূর থেকে রাজপুরুষকে নমস্কার করে বললেন, আমাকে ডেকেছেন হে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম?

“এই বালক আপনার কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে চায়। জাতিতে নিষাদ, জরাসন্ধের সেনানায়ক হিরণ্যধনুর পুত্র। এর সঙ্গে কথা বলে নিন।”

দ্রোণাচার্য একলব্যকে নিয়ে রাজসভা থেকে বেরিয়ে অস্ত্রশালার কাছাকাছি এলেন। তার পর বললেন, ভালোই তো ঘোঁট পাকিয়েছো বাপু! জরাসন্ধের লোক এসেছে হস্তিনায় অস্ত্রশিক্ষা করতে। কচের অসুরপুরীতে আসার মতো ঘটনা।

একলব্য তাঁর কথার কিছুই বুঝতে পারলেন না। প্রণাম করলেন দূর থেকে। তার পর বললেন, অনেক আশা নিয়ে এসেছি গুরুদেব, আমাকে নিরাশ করবেন না।

দ্রোণ প্রশ্ন করলেন, তুমি নিষাদ?

একলব্য জবাব দেয়, আজ্ঞে।

“জানো, নিষাদ কারা?”

“ওই যারা শিকার করে তারা।”

দ্রোণ বলেন, শিকার তো ক্ষত্র পুরুষরাও করে থাকেন। আমার মতো ব্রাহ্মণও মৃগয়ায় যান।

“তবে আপনিই বলে দিন গুরুদেব, নিষাদ কারা?”

দ্রোণ বললেন, নিষাদ হল অনার্য বর্বর, ছোটজাত। অধার্মিক ও প্রজাপীড়ক রাজা বেণকে মহর্ষিরা হত্যা করেন। মৃত বেণের দক্ষিণ ঊরু মন্থন করলে এক খর্ব কদাকার দগ্ধ কাষ্ঠতুল্য পুরুষের আবির্ভাব হয়। ঋষিরা তাকে বলেন, ‘নিষাদ’—উপবেশন করো। এই পুরুষ থেকে জলজঙ্গলপর্বতবাসী নিষাদ ও ম্লেচ্ছদের উৎপত্তি। আর বেণের ডান হাত মন্থন করে উৎপন্ন হন ক্ষত্রিয় রাজা পৃথু, তিনি ধনুর্বাণধারী শাস্ত্রপারঙ্গম। শস্ত্রবিদ্যায় অধিকার ক্ষত্রিয়দের, নিষাদদের নয়।

একলব্য মনে মনে ভেঙে পড়ে। সে দ্রোণের দগ্ধ কাষ্ঠতুল্য চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। তার পর নিজের অজান্তে প্রশ্ন করে ফেলে, আপনি তো বামুন, তাহলে কী করে অস্ত্রবিদ্যা শেখাচ্ছেন। এই বিদ্যা তো ব্রাহ্মণের নয়।

সহসা দ্রোণাচার্য ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন। নিষাদ বালকের এই ধৃষ্টতা দেখে তিনি হতবাক। ভীষ্ম জানতে পারলে ওর যে কী শাস্তি হবে, তা ও জানে না। ক্রোধ সংবরণ করে তিনি একলব্যকে ফিসফিস করে বললেন, সূতপুত্রকেও আমি শিষ্য করেছি কিন্তু তোমাকে নিতে পারব না। তাহলে আমার চাকরি থাকবে না। ব্যস এটুকুই। বাড়ি যাও। নিজে নিজে ধনুর্বিদ্যা শেখো, নিষাদরা চেষ্টা করলে নগরবাসী ক্ষত্রিয়দের থেকেও অনেক ভাল ধনুর্ধর হতে পারে।

দ্রোণাচার্য স্থান পরিত্যাগ করলেন। একলব্যকে পথে দেখিয়ে রাজসভার চত্বর থেকে বের করে দিল রাজপ্রহরী। নিষাদ রাজকুমার ভাবল, সে আজই নিজের রাজ্যে ফিরে যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করবে। যাওয়ার আগে কামারের বাড়ি যাবে একবার, নিষাদরা কখনও অকৃতজ্ঞ হয় না।

বিদায় দেওয়ার সময় কামারের সঙ্গে ছিল বেশ কয়েক জন সঙ্গী। তাদের কথাবার্তা শুনে একলব্যের কেমন যেন মনে হয় যে তারা তারই লোক, আত্মীয়; অথচ সে আগে এদের কখনও দেখেনি।

কামার তাদের একজনকে বলল, এই যুবক হল জরাসন্ধের সেনানায়ক হিরণ্যের পুত্র। ওর সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জানি, জানাটাই আমার কাজ। ছুরি শান দেওয়ার ফাঁকে আমার কাজ বার্তা সংগ্রহ করা, কেবল ভর্জিত বার্তাকু ভক্ষণ নয়।

একজন সিড়িঙ্গে মতো লোক বলল, রাজপ্রাসাদে শুনছি সব বলাবলি করছে।

তার সঙ্গী খর্বকায় লোকটি বলল, ভয়! শঙ্কাই ওদের শেষ করে দেবে। একলব্য যদি ভাল ধনুর্ধর হয়ে হস্তিনাপুর থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে নগরের শিক্ষা অরণ্যে চলে যাবে, তার পর একদিন অরণ্যবাসীরা ওদের থেকে নেওয়া শিক্ষায় ওদের মেরে ফেলবে।

কামার বলে, না। দ্রোণাচার্য বলেছেন যে একলব্য শিষ্য হিসাবে নিলে অন্য রাজপুত্রদের মধ্যে ওর অনার্যতা সংক্রামিত হবে। আর সেটা হলে দ্রোণের চাকরি থাকবে না। বহু কষ্টে এই চাকরি তিনি পেয়েছেন। এতদিন তো খেতে পরতে পেতো না।

একজন স্থূল লোক জানায়, অরণ্যের লোক মানেই হল হস্তিনার শত্রু। তাদের জ্ঞানগম্যি ভয়ঙ্কর।

কামার বলে, একলব্যের উদ্দেশ্য নিয়ে ওরা সন্দেহ প্রকাশ করেছে। একলব্য ধনুর্বিদ্যা শিখে অপপ্রয়োগ করবে। যেন ওরা অস্ত্রচালনা শিখে মানুষের মৃত্যুর বদলে জন্ম দেবে!

সিড়িঙ্গে বলে, নিষাদরা হল ক্রোধী, ওদের তীরধনুকের শিক্ষা দিলে মানুষ মেরে বেড়াবে।

খর্ব লোকটি খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলে, বামুনের ছেলে অশ্বত্থামা বুঝি খুব শান্ত? ওর মতো রাগী ছেলে নাকি ভারতে আর একজনও নেই!

কামার বলল, কী বললি, ভারত?

খর্ব লোকটি হাত জোড় করে বলে, ভুল হয়ে গেছে কামার মশাই, কুরুপ্রদেশ বলি?

কামার রেগে জবাব দেয়, না! শোন, অশ্বত্থামা ক্রোধী হয়েছে কেন জানিস? ছেলেবেলায় খেতে পেত না বেচারা। যাক গে, একলব্যের বেলা বইয়ে দিয়ে লাভ নেই কোনও। তুমি যাও বাছা। জয় মহাদেবের জয়!

একলব্যের ঘোড়া ছুটতে লাগল টগবগ! কামারের কন্যা তাকিয়ে রইল অপলক, যতক্ষণ না একলব্য দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

নিষাদরাজ্যে ফিরে এসে মন ভাল নেই একলব্যের। সে সর্বক্ষণ ভাবে, কেন দ্রোণ তাকে শিষ্য হিসাবে নিলেন না? সে কি শুধুই রাজনীতির কারণে, নাকি সে জাতিতে ম্লেচ্ছ বলে! ম্লেচ্ছ বা নিষাদের ব্যাপারটা খুব জোরালো প্রমাণ বলে মনে হয় না তার। আসলে রাজরোষের ভয়ে, চাকরি যাওয়ার আশঙ্কায় একলব্যকে দ্রোণ গ্রহণ করতে পারেননি। রাজপ্রাসাদের আশঙ্কা, নিষাদের ছেলে রাজকুমারদের গুরুর কাছে শিক্ষালাভ করবে, এটা কোন ধরণের দুঃসাহস! তার চেয়েও বড় আশঙ্কা হল, নিষাদ মানেই বিদ্রোহী। প্রাসাদ জঙ্গলের মানুষদের ভয় পায়। দ্রোণাচার্যকে মন্দ লাগেনি একলব্যের। না খেতে পাওয়া একজন কৃশকায় মানুষ, নিজের ব্রাহ্মণ্যবৃত্তি ছেড়ে শুধু পেটের দায়ে স্বদেশ পাঞ্চাল ছেড়ে হস্তিনায় এসে বাস করছেন! তিনি একলব্যকে কেন শিষ্যত্বে বরণ করতে পারছেন না, সে কথা ঠারে ঠারে বুঝিয়েও দিয়েছেন।

মূর্তি বানাতে বানাতে এই কথাগুলি ভাবছিল একলব্য আর তার তৈরি মূর্তি যেন একটি বঞ্চনার প্রতিমূর্তি হয়ে উঠছিল ক্রমশ। কৃষ্ণা অঙ্গাগ্রণী মাঝামধ্যে বলছিল, নাকটা ঠিক হয়নি; কাদা দিয়ে কি দাড়ি বানানো যায় নাকি! সে সব কথায় বেশ মজাই পাচ্ছিল একলব্য। মূর্তি তৈরি হতে বেশি সময় লাগল না। কিন্তু শুকনো বেশ ঝামেলার। তখন ফেটে যায় মূর্তির নানা অঙ্গ। সে সময় সেই ফাটল সারতে অনেক হ্যাপা পোহাতে হয়।

দ্রোণাচার্যকে সেই একবারই দেখেছিল একলব্য। রোদে মূর্তি যত শুকোয় তত যেন ফাটল বাড়তে থাকে। একলব্য ভাবে, এই ফাটল আসলে দ্রোণাচার্যের মন। শেষমেশ যখন মূর্তি শুকনো হল, তখন গাছের বাকল আর ফুল নিঙড়ে তারা যে রঙ বানায়, তাই শন দিয়ে আস্তে আস্তে বুলিয়ে দিল অঙ্গা।

অঙ্গাগ্রণীর রঙের বোধ বেশ খারাপ। দাড়ির একদিক করেছে সাদা আর একদিক কালো। এমনকি একটি হাতের রঙ লাল, অন্যটি সবুজ। একলব্য ভেবে পায় না এসবের কী মানে! অঙ্গাকে জিজ্ঞাসা করলে বলে, লোকটা ভাল আবার খারাপ, তাই এমন রঙ। একলব্য একটু রুষ্ট হয়, সে বলে—এই মূর্তি আমার গুরু, তাঁকে লোকটা বলছিস অঙ্গা!

অঙ্গা জবাব দেয়, মূর্তিকে বলিনি, দ্রোণাচার্যকে লোক বলেছি। সে তো লোকই। তবে এই মূর্তিটা তার চেয়ে ভাল, আমাদের বানানো তাই এত সুন্দর। একলব্য ও অঙ্গাগ্রণী দুজনে মূর্তিটির সামনে গড় হয়ে প্রণাম করে।
0

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in







একলব্য কামারের পা চেপে ধরে বলল, তোমার কন্যা মানে আমার ভগ্নী। না কোরো না খুড়ো।



“বেশ, চল তবে। কিন্তু ভাইপো, ঝামেলা করলে, তোর খুড়ি কিন্তু দুজনকেই আঁশবটি দিয়ে কেটে ফেলবে।”

“মা কালীর দিব্যি।”

দুজনে বাজার থেকে বের হয়। বাইরে একলব্যের ঘোড়াটা মাঠে বড় দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। একলব্য কামারকে বলে, কাকা! ঘোড়াটা নিয়ে আসি।

কামার অবাক হয়ে বলে, ওরে রাজপুত্তুর! তোর আবার ঘোড়াও আছে। একেই বলে গরিবের ঘোড়া রোগ।

একলব্য ঘোড়ায় চাপে। পিছনে বসিয়ে নেয় কামারকে। তার পর নির্দেশিত পথে ছুটিয়ে দেয় অশ্ব।

কামারের বাড়ি হস্তিনার উত্তরে। অস্ত্রবাজার থেকে কুরুক্ষেত্র পার হয়ে সে অনেক রাস্তা। বেশ গোছানো বাড়ি। কামারের বউ আর মেয়ে বেশ খাতিরযত্ন করল তার। জল এনে দিল। খেতে দিল যত্ন করে। কামার সদোপবাসী মানুষ—দিনে মাত্র দু বার আহার গ্রহণ করে। যেদিন অস্ত্রবাজারে যান সেদিন সকালে খেয়ে যায় আবার রাতে ফিরে খায়। একলব্যের তেমন হলে চলবে না। ব্রীহি ও যব এদের প্রধান খাদ্য। মাংসভক্ষণ করে না বললেই চলে। কামার মাঝেমধ্যে সুরাপান করে, সে কথা একলব্য তার মুখ থেকেই শুনেছে।

যবাগু আর ভর্জিত বার্তাকু দিয়ে নৈশ ভোজন সেরে কামারের সঙ্গে এক ঘরে শুয়ে পড়ল একলব্য। কামার তাকে বলল, হস্তিনার আখ্যান শুনেছিস?

একলব্য জবাব দেয়, না।

“খুব শীঘ্র একটা যুদ্ধ হবে।”

“কার সঙ্গে কার?”

কামার বলে, ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের। সে অনেক বড় কাহিনি। শুনবি?

“বলো।”

“মৎস্যগন্ধার নাম শুনেছিস?”

একলব্য জবাব দেয়, হ্যাঁ। দাশরাজ জেলের কন্যা।

“বাহ, অনেক জানিস দেখছি! তাহলে ঘুমো।”

একলব্য বলে, তুমি বলো। কিছুই জানি না তার পর। যুদ্ধের কথা বলছিলে না?

“শুনবি?”

“বলছি তো বলো। ঘুম আসছে না।”

কামার কাহিনি বলতে শুরু করে। শোন আমার নাম কানাহাইয়া কুমার, লোকে আদর করে ডাকে কামার। অবশ্য আমি ছুরি বানাই, শান দিয়ে এত তীক্ষ্ণ করে যে কুমড়ো কিংবা মানুষ ফালি করলে কেউ ধরতেই পারবে না মালটা গোটা না অর্ধেক করা! সে যাক গে! রাজবাড়ির অসি থেকে মসী সব ধার দেওয়ার জন্য রাজপেয়াদারা আমার কাছেই আসে। সেই আমি কানহাইয়া কুমার ওরফে কামার শুরু করছি।

মৎস্যগন্ধা আগে নৌকা বাইতো। সেই সময় একজন ঋষি বন থেক হস্তিনার রাজপ্রাসাদে আসতো রাজা শান্তনুকে পরামর্শ দিতে। সে বেশ কিছু কাল আগের কথা। মুনির সেই বন থেকে প্রাসাদে আসতে গেলে যমুনা নদী পার হতে হয়। মৎস্যগন্ধার নৌকাতেই আসত পরাশর। তার পর ভাব-ভালবাসা হয়ে পোয়াতী হয় মৎস্যগন্ধা। সেই ছেলের জন্ম হয় এক দ্বীপে। তার নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। সে থাকে বাপের সঙ্গে। পরাশর মৎস্যগন্ধাকে বলে, তুই রাজা শান্তনুকে বিয়ে কর। মৎস্যগন্ধা জানায়, তা কী করে হয়! অমন বুড়ো লোক। ওর ছেলে দেবব্রত তো আমার বয়সী। পরাশর বলে, যা বলছি শোন। রাণী হতে চাইলে রাজাকেই বিয়ে করতে হয়, তার পর তোর ছেলে রাজা হবে; গঙ্গাপুত্রকে সরিয়ে দেব।

মৎস্যগন্ধা বলে, রাজা কেন রাজি হবে!

“ঠিক হবে।”

তার পর পরাশর মুনি শান্তনুকে বলে, “অনেক দিন হল তোমার স্ত্রী পালিয়েছে। একটা বিয়ে করো, বুড়ো বয়সে নইলে কে দেখবে?

রাজা বলে, আরে রাম রাম! এই বয়সে বিবাহ! আমার পুত্র দেবব্রত এখন যুবক। তার বিয়ে দেব।

পরাশর বলে, সে দাও। কিন্তু তুমিও একখানা যুবতী মেয়ে দেখে বিয়ে করো।

রাজা জানায়, তাকে আর কোন যুবতী পছন্দ করবে!

অপরাহ্নে নদীর তীরে বেড়াতে যেও, মুনি এই কথা বলে চলে যায়।

রাজা শান্তনু বিকেলে মৎস্যগন্ধার দেখা পান। অপূর্ব সাজসজ্জায় ভূষিত সেই কন্যার সারা শরীরে বহিরাগত সুগন্ধের হাতছানি। এমন সুগন্ধী কোথায় পেল কন্যা? গঙ্গার গন্ধবণিক তো এত ভাল গন্ধদ্রব্য সরবরাহ করে না!

শান্তনু ভাবতে লাগলেন, অনেক কাল থেকেই পরাশর মুনি বলছে যে তার মামাতো ভাই অনন্তমুখ নামকরা বৈশ্য, তাকেই হস্তিনার বাণিজ্যের ভার দিন রাজা। কিন্তু গঙ্গার বণিকরা খুব সৎ ও ভাল মানুষ। যমুনার ওই চিত্রমুখ বৈশ্যরা তেমন সুবিধার লোক নয়। কোনও জালে পড়তে চলেছেন কি রাজা শান্তনু?

কিন্তু ওই সুগন্ধ টেনে নিয়ে গেল রাজাকে মৎস্যগন্ধার কাছে। শান্তনু জালে ধরা পড়লেন। মৎস্যগন্ধার বিবাহ হল শান্তনুর সঙ্গে। শান্তনু-গঙ্গার পুত্র দেবব্রত বুদ্ধিমান, তিনি বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তাতে মানও বাঁচে, সংঘাতও এড়ানো যায়। সেই থেকে অস্ত্রবাজার থেকে কাঁচাবাজার সব অনন্তমুখের দখলে। অনন্তর পুত্র দুর্মুখ এখন সব কিছুর দেখভাল করে। সে চাইছে বড় একটা যুদ্ধ হোক।

মৎস্যগন্ধার দুটি পুত্র হয়েছিল শান্তনু রাজার ঔরসে। বড়টির নাম চিত্রাঙ্গদ। সে এক গন্ধর্বের হাতে খুন হয়। ছোটো বিচিত্রবীর্য অনিয়ম করে মারা যায়, রেখে যায় দুই বিধবা স্ত্রীকে। মৎস্যগন্ধার আগের পক্ষের ছেলে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ওই বিধবাদের দেবর। সে পুত্র উৎপাদন করে বিধবাদের গর্ভে। তাদের একজন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, সেই এখন রাজা। কিছুই দেখে না চোখে। তার ১০১ জন ছেলে আর একটি মেয়ে। ধৃতরাষ্ট্রের ছোটো ভাই পাণ্ডু মারা গিয়েছে কিছু দিন আগে। পাণ্ডুর স্ত্রীদের গর্ভে দেবতারা পাঁটি পুত্রসন্তান উৎপাদন করেছে। এখন লড়াই হবে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের সঙ্গে পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্রদের। সেই জন্য নতুন অস্ত্রগুরু এসেছে, তার নাম দ্রোণাচার্য।

একলব্য বলে, আচার্য দ্রোণের সঙ্গে দেখা করা যায়?

কামার উত্তর দেয়, কী হবে সাক্ষাতে! তীরধনুক বেচবে?

“আজ্ঞে!”

“তুমি কি ভেবেছো, নতুন একটা ছেলে বাজারে অস্ত্র বেচছে সে কথা ওদের কানে যায়নি! দেবব্রত ভীষ্ম থেকে দ্রোণ সকলের কাছে খবর পৌঁছে গেছে। নাও এখন ঘুমোও দেখি।!”

একলব্যের ঘুম আসতে চায় না। কামারের নাসিকা গর্জন শুনতে শুনতে এক সময় কখন নিদ্রাদেবী তার উপর ভর করেছেন সে কথা একলব্য জানে না। ঘুম ভাঙলো মোরগের আওয়াজে।

কামারের বউ অনিন্দ্যা এবং কন্যা সুগন্ধা দুজনেই বড় ভাল মানুষ। তারা একলব্যের প্রাতঃরাশের ব্যবস্থা করল। ঘোড়াকে জাবনা দিল। তার পর কামারের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ আর কাজে যেও না। ছেলেটাকে প্রাসাদ দেখিয়ে আনো। ফেরার সময় একটু মাংস কিনে এনো।

একলব্য বেশ অবাক হল। কেননা সে জানে, দুধ-মাংস-তেল এইসব জিনিস বিক্রি হয় না। যদি কোনও দেশে এই সব বস্তুর কেনাবেচা হয় তাহলে জানতে হবে সেই রাজ্য পতিত। সে কামারকে জিজ্ঞাসা করল, কী গো খুড়ো, তোমাদের দেশে মাংস খোলা বাজারে বিক্রি হয়?

কামার জবাব দিল, হ্যাঁ হয়। ব্যাধেরা করে না। মাংস বেচে বৈশ্যরা। এখন তাদের নতুন নাম মাংসবণিক। শোনো ভাইপো, এককালে নদী পারাপার করতে পারানির কড়িও লাগতো না। মৎস্যগন্ধা সে সব চালু করেছেন। রাজা শান্তনুর পিতা প্রতীপ যখন নৃপতি ছিলেন, তখন হস্তিনা ছিল স্বর্ণনগরী। বণিকরা এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিল। আগে বিদেশি বণিকদের আয়ের পরে কর নেওয়া হত। এখন ঢুকতে না ঢুকতে গলায় গামছা দিয়ে সব কেড়েকুড়ে নিচ্ছে। এই দেখো না, তোমার তীরধনুকের অর্ধেক তো নিয়েই নিয়েছে। দু একটা পাঠাবে রাজার অস্ত্রশালায়, বাকিটা নিজেরা বেচে দেবে। যাক গে, প্রস্তুত হয়ে নাও। হস্তিনানগর দেখে আসি চলো।

এমন সময় দরজায় করাঘাত শোনা গেল। কে?

রাজপেয়াদা।

কী সংবাদ?

অতিথির ডাক পড়েছে রাজদরবারে।

‘যাচ্ছি’ বলে কামার একলব্যকে জানালেন, দেরি করা ঠিক নয়; এক্ষুনি বের হও।
0

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in














এই যে দেশ দেখছো, এর নাম চেদি। এই দেশের দু পাশে আছে নর্মদা আর গোদাবরী নদী। এখানকার রাজা উপরিচর আসলে আকাশচর ছিলেন, অনেকটা পাখির মতো। সমাজের উচ্চ স্থানে তাঁর বাস, আমার বা তোমার পিতার মতো রাজা তিনি ছিলেন না যে গরিব-গুবরোদের সঙ্গে সময় কাটাবেন। ইন্দ্রের সখা উপরিচরের ছিল স্ফটিকময় বিমান, অম্লান পঙ্কজের বৈজয়ন্তীমালা এবং একটি বংশনির্মিত ষষ্ঠী।
একলব্য জিজ্ঞাসা করে, বংশনির্মিত ষষ্ঠী মানে কী?
শিশুপাল জবাব দিলেন, বাঁশ, বাঁশের তৈরি লাঠি। এই ষষ্ঠীর নিয়মিত পুজো করা হত। লাঠিকে ভোগ দেওয়া হত। অগ্রহায়ণ মাসে সেই পূজা হত পাঁচ দিন ধরে—ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী। এই সময় সারা রাজ্যে ইন্দ্রের পতাকা উত্তোলন করা থাকতো। উপরিচরের দেখাদেখি বিদেশি রাজা ইন্দ্রের পতাকা অন্য রাজাদের মধ্যেও জনপ্রিয় হল। লাঠিই হল প্রজাদের মহৌষধ। উপরিচরের ছিল পাঁচ পুত্র—তারা পাঁচ দেশের শাসক হয়েছিল। উপরিচরের যে চেদি রাজ্য ছিল তার রাজধানীর নাম শুক্তিমতী। নদীর নামে নগরের এমন নামকরণ। শুক্তির উৎপত্তিস্থল হল স্ত্রীযোনি, তার প্রবাহ শুধু রাজধানীর পাশে কেন সারা রাজ্য জুড়ে ছিল। আর ছিল কোলাহল পর্বত, যারা হল বা কর্ষণের জন্য সর্বদা মুখিয়ে থাকে। শুক্তিমতী নদীর আহ্বানে কোলাহল পর্বত তার সঙ্গে মিলিত হয়। নদীর গর্ভে জন্ম নেয় এক পুত্র আর এক কন্যা।
জ্ঞানীবৃদ্ধরা অবশ্য বলে থাকেন, কামান্ধ কোলাহল পর্বত শুক্তিমতী নদীকে ধর্ষণ করে। ওই যে পুত্রকন্যার জন্ম হল, রাষ্ট্র তাকে নিজের ঘরে স্থান দিল। পুত্রটি হল চেদির সেনাপতি আর কন্যাটি চেদির রাজমহিষী। কন্যার নাম গিরিকা। রাজা গিরিকার সঙ্গে নিয়মিত সঙ্গম করেন, একমাত্র ঋতুস্নাতা অবস্থা ছাড়া। সেই সময় উপরিচর বেরিয়ে যেতেন মৃগয়ায়। এই রকম একবার তিনি শিকারে গিয়েছেন। পথে গিরিকাকে স্মরণ করে তাঁর শুক্রস্খলন হয়। সেই স্খলিত বীর্য এক শ্যেনপক্ষী পত্রপুটে নিয়ে উড়ে যায়। পথে আর এক শ্যেনপক্ষীর আক্রমণে সেই শুক্র যমুনার জলে পড়ে যায়। সেই জলে ছিল এক মৎসী—ব্রহ্মশাপগ্রস্থ অদ্রিকা নামের এক অপ্সরা। ওই শুক্র পান করে মৎসী গর্ভবতী হয়। অপ্সরারা অপ বা জলে বিচরণ করে। দশম মাসে ওই মৎসী ধরা পড়ল এক ধীবরের জালে। অদ্রিকা তখন একটি পুত্র ও একটি কন্যা প্রসব করে আকাশপথে চলে যায়। উপরিচর বসু পুত্রটিকে গ্রহণ করলেন, কন্যাটিকে পরিত্যাগ করলেন। সেই কন্যা বড় হতে লাগল ধীবর দাশরাজের গৃহে। তার নাম মৎস্যগন্ধা। উপরিচরকে চেদি রাজ্য থেকে অনেক কষ্টে সরানো গিয়েছে। তবে তাঁর কন্যা মৎস্যগন্ধা এখন হস্তিনা শাসন করে। সেও পিতার মতো ষষ্ঠীর নিয়মিত পুজো করে, ভোগ দেয়।
এই পর্যন্ত বলে থামলেন চেদির রাজা শিশুপাল। বললেন, বাছা একলব্য এখন ঘুমিয়ে পড়ো। ভোর-ভোর বেরিয়ে উত্তরপানে যাবে। পথে পড়বে ইলাবাস, সেখানে বিশ্রাম নিয়ে বিরাট রাজ্যের ভেতর দিয়ে অনেকটা গিয়ে মৎস্য দেশ পার হয়ে পাবে খাণ্ডব বন। সেই বনের উত্তরে আছে হস্তিনানগরী।
চেদি দেশ থেকে বিদায় নিয়ে নতুন ঘোড়ায় চড়ে একলব্য উত্তর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। পথে শুধু ধু ধু প্রান্তর, বন আর নদীনালা। বেশ কিছু দিন পর তিনি ইলাবাসের প্রয়াগতীর্থ পার হয়ে বিরাট রাজ্যে এসে কয়েক দিন বিশ্রাম নিলেন। সেখানকার রাজার নামও বিরাট। তিনি অলস প্রকৃতির রাজা, সারা দিন পাশা খেলে সময় কাটান। শিশুপালের নাম করে রাজ অতিথিশালায় কিছু দিন বাস করার সুযোগ পেলেন। সেই সুযোগে আলাপ হল বিরাট রাজার প্রধান মহিষী সুদেষ্ণার ভাই কীচকের সঙ্গে। কীচক ভারি মজার লোক। তিনি বিরাট রাজ্যের সেনাপতি। তাঁর সঙ্গে তীরধনুক ও নানা অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে কথা হল একলব্যের। কীচক একলব্যকে বললেন, তুমি এখানে থেকে যাও। বিরাট রাজ্যের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পেলেন একলব্য। হিরণ্যধনুর পুত্র জানালেন, কীচকের প্রস্তাব খুব সম্মানজনক কিন্তু তিনি হস্তিনায় একটি কাজে যাচ্ছেন, সেই কাজ শেষ করে এসে জানাবেন যে সেনাবাহিনীতে তিনি যোগ দেবেন কিনা। কীচক নানা রকমের সুরার ভক্ত, তাঁর সংগ্রহে অনেক রকম সুরা আছে। দু দিন ধরে একলব্যকে তিনি মাংস সহযোগে সেই সব পানীয় চেখে দেখার সুযোগ করে দিলেন। একলব্য তাঁকে কয়েকটি তীর ধনুকের কসরত শিখিয়ে দিলেন।
মৎস্য দেশের অন্দর দিয়ে খাণ্ডব বন পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগল না দ্রুতগামী অশ্বারোহী একলব্যের। পিতা হিরণ্যধনু বলেছিলেন, এখানে বাস করেন তক্ষক ও তার পুত্র অশ্বসেন। ময় দানব, ঋষি মন্দপাল এবং তার সঙ্গিনী জরিতাও থাকেন এই বনে। তাঁদের সঙ্গে দেখা করে, কয়েকটা দিন অরণ্যে বাস করে তবেই সে পৌঁছবে হস্তিনানগরে।
তক্ষকের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল একলব্যের। তিনি একলব্যকে নাগবংশের অনেক কাহনি শোনালেন। অষ্টনাগের অন্যতম তক্ষক ছদ্মবেশে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করেন কারণ নগরের লোকেরা তাঁকে বিদ্রোহী ভেবে হত্যা করতে চায়। শেষ নাগ ও বাসুকিও পাতালে চলে গিয়েছেন বহু দিন, সেখান থেকেই তাঁরা নিজেদের কাজকর্ম পরিচালনা করেন। নগরের ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছেন না কিছুতেই। অথচ কী আশ্চর্য! এখন জাতপাত নিয়ে যারা মাথা ঘামাচ্ছে, তারাও জানে তক্ষক ওরফে অনন্তনাগের পিতা কশ্যপ আর মা কদ্রু। তিনিই একলব্যকে বললেন, নিষাদ হয়ে হস্তিনায় গিয়ে আচার্য দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে যাওয়া আর ইঁদুর হয়ে বেড়ালের গালে চুমু খেতে যাওয়া একই ব্যাপার। তার চেয়ে গুপ্তবিদ্যা শিখে যুদ্ধ করা অনেক ভাল। সম্মুখ সমরে রাজশক্তির সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল। কিন্তু একলব্য নাছোড়বান্দা। তিনি যাবেনই। মন্দপাল ঋষি ও তার সঙ্গিনী জরিতাও অনেক বোঝালেন। ময় দানব অবশ্য একটু চুপাচাপ। অনেক কাল অরণ্যবাস করে তাঁর মনে শান্তি নেই। তিনি বললেন, যাও খোকা! তুমি আচার্যের কাছে যাও।
খাণ্ডব বন পার হতে সময় লাগল না বেশি। হস্তিনার কাছাকাছি পৌঁছে কুরুজঙ্গলের সীমানায় একলব্য দেখলেন একটি অস্ত্রবাজার। সে সবের নিয়ন্ত্রণ করেন বৈশ্য কুলপতিরা। বশিষ্ঠের বৈবাহিক চিত্রমুখ নামের এক বৈশ্য পুরুষের পৌত্র অনন্তমুখ সেই বাজারের মালিক। একলব্য তাঁর তীরধনুক দেখালেন অনন্তমুখের প্রহরীদের। প্রহরী আবার ডেকে আনল দক্ষ বাজারুদের। তারা সব পরীক্ষা করে বলল, অর্ধেক তীরধনুক একলব্য এখানে বেচতে পারবেন, বাকি অর্ধেক তাদের দিতে হবে—এটাই বাজারের নিয়ম।
একলব্য একটু রুষ্ট হল বটে কিন্তু তখনকার মতো মেনে নিল। তার বসার জায়গা হল বাজারের ম্লেচ্ছপট্টিতে। সেখানে বেশির ভাগ লোকের ভাষা বুঝতে পারে না একলব্য। মন দিয়ে শুনলে অবশ্য বোঝা যায়। ম্লেচ্ছপট্টিতে বসে ছুরি বিক্রি করছিল একজন প্রৌঢ় কামার। সে একলব্যকে জিজ্ঞাসা করল, কী ভায়া এই বাজারে নতুন নাকি?
একলব্যের ভাষার সঙ্গে তার কথার খুব মিল। তার পাশের ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসল সে। প্রৌঢ় বলল, তা কত নিল তোমার কাছ থেকে, অর্ধেক? নতুনে তাই নেয়। অনন্তমুখের বিরাট হাঁ।
একলব্য হেসে বসল কামারের পাশে। ধনুকের ফলার ধার দেখতে দেখতে একলব্য জিজ্ঞাসা করে, তা এই অনন্তমুখ লোকটা কে খুড়ো?
“সে অনেক কাহিনি রে ভাইপো! এই লোক হল রাজমাতা মৎস্যগন্ধার আগের পক্ষের আত্মীয়।”
মৎস্যগন্ধা নামটা খুব চেনা চেনা লাগল। তিনিই তো এখন রাজমাতা। তাঁর পৌত্র ধৃতরাষ্ট্র এখন হস্তিনার রাজা।
কামার বলে, অনন্তমুখ সত্যবতীর আগের পক্ষের বর পরাশরের মামাতো ভাই। বয়স হয়েছে ভালোই। তার ছেলে দুর্মুখ এখন বাজার সামলায়। সে আবার সম্পর্কে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের ভাই কিনা!
একলব্য ভাবে, এ তো ভারি জটিল অঙ্ক। সে কথা বাড়ায় না। বেশ কয়েকজন খদ্দের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল কিন্তু তার দিকে ভ্রুক্ষেপই করল না। একলব্য চুপচাপ বসে রইল। ওদিকে কামারের সব ছুরি ভুজালি বিক্রি হয়ে গেল। বাড়ি যাওয়ার আয়োজনের ফাঁকে কামার একটি আতা ফল দিল একলব্যকে। বলল, বাড়ির উঠোনে ফলেছে, তোকে দিয়ে গেলাম। এই আতা খুব ফলদায়ী, দেখিস কাল তোর নসিব খুলে যাবে।
একলব্য কামারকে বলল, ও খুড়ো একটা কথা ছিল।
“বল।”
“রাতটা তোমার বাড়িতে থাকতে দেবে?”
“না রে বাপ! আমার বাড়িতে সোমত্ত কন্যা আছে।”
0

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in





















নির্দিষ্ট সময়ে সভার কাজ আরম্ভ হল। একলব্যের কাকা রজতধনু জঙ্গলের নানা সমস্যার কথা বলতে লাগলেন। দূরে যে নদী বয়ে যায়, সেখানে আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। এমনকি জঙ্গলের কোথাও কোথাও বাইরের লোক আসে, নোংরা করে চলে যায়। সামনাসামনি হলে একদিন মুখের উপর জবাব দেবেন, কিন্তু পাচ্ছেন না, তক্কে তক্কে আছেন!

হিরণ্যধনু বললেন, আমাদের সমাজ তো নগরের মতো নয়। এখানে গাছ, পাহাড়, জঙ্গল, পশুপাখি আমাদের নিজস্ব ধন। তাদের ক্ষতি মানে আমাদের কষ্ট। বাইরের লোকের সেই বিবেচনা নেই, বিশেষ করে নগর থেকে যারা আসে। জানি না, কতদূর এই জলাজঙ্গলপর্বত আর পশুদের রক্ষা করতে পারব আমরা! জঙ্গলে মানুষের বাস করাই উচিত নয়, তাতে জানোয়ারদের ভারি অসুবিধা হয়। কিন্তু আমাদের উপায় নেই। এককালে আমাদের পূর্বপুরুষ হস্তিনানগরে ছিল, এক রকম বাধ্য হয়ে চলে এসেছিল তারা। তার পর এই জঙ্গল।

অঙ্গার বাবা এইবার মুখ খোলেন, কেন চলে এসেছিলাম সেই সব কথা ছেলেছোকরাদের বলা দরকার রাজা!

রাজা বলেন, হ্যাঁ, সে সব কথা পরে বলব; আজকের সভায় নয়।

অঙ্গার পিতা কিরিটিভূষণ পুনরায় বলেন, কিন্তু বলতে তোমাকে হবেই। হস্তিনার বাজারে যখন আমরা যাই শুকনো ডালপালা, ফলমূলের বদলে একটু কাপড়, মশলাপাতি আর সুগন্ধ আনতে, ওরা এমন ভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে যে মনে হয় আমরা বুঝি মানুষ না!

একলব্যের মা জাম্ববতী বলেন, তা মানুষ হবে কী প্রকারে! ওদের মতো যদি আগুনে সেঁকা কাপড় না পরে তুমি বাঘছাল পরো, তবে তো গা থেকে বদবু বের হবে। তোমাকে হয়তো বাঘ ভাবে হস্তিনার লোকেরা!

বলেই খিলখিল করে হাসতে থাকেন জাম্ববতী।

কিরিটিভূষণও হাসতে থাকেন। হাসতে হাসতেই জবাব দেন জাম্ববতীর কথার, বাঘছাল নিয়ে কিছু বোলো না গো দিদি, স্বয়ং বাবা মহাদেবের বসন।

জাম্ববতী দুই হাত তুলে নমস্কার করেন। তাঁর দেখাদেখি সভার প্রত্যেকে বাবা মহাদেবের উদ্দেশে প্রণতি জানায়। একলব্য ভাবে, সে যে হস্তিনায় গিয়ে গুরু দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করবে, সে নিয়ে এই বার কথা হওয়া উচিত।

হিরণ্যধনু নিজেই তুললেন সেই প্রসঙ্গ, রাজকুমার একলব্য চাইছিল যে সে হস্তিনায় গিয়ে গুরু দ্রোণের কাছে ধনুর্বিদ্যা শিখতে যাবে। এই ব্যাপারে প্রত্যেকের মতামত শুনে রাখা ভাল।

অঙ্গাগ্রণী এই বার মুখ খোলে, হস্তিনা হল গিয়ে নগর, আর আমরা থাকি বনে। নগরে কি বনবাসীর থাকা শোভা পায়! আমার বাপু এই ব্যাপারে মত নেই।

অঙ্গার এক বন্ধু শ্রী মুখ টিপে হাসছিল। রাজা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কিছু বলবি মা?

শ্রী হাসি থামিয়ে বলে, যাক না! কিন্তু সেখানে গিয়ে ও খাবে কী, থাকবে কোথায়?

রাজা ভেবে দেখলেন, কথাটা মন্দ বলেনি শ্রী। এই সমস্যার কথা তো তাঁর মাথায় আসেনি।

বাঁকা নামের এক ছোকরা নগরে কাঠ দিতে যায়, সে বলে—কেন, আমরা রাত হলে তো নগরের বাইরে একটি ছাউনিতে থাকি, সেখানেই থাকবে একলব্য। এ আর এমনকি!

শ্রী জিজ্ঞাসা করে, খাবে কী?

বাঁকা বলে, ফলমূল। তাছাড়া, হস্তিনায় অনেক শূদ্র বাস করে নগরের বাইরে। তাদের কারও বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলেই হল।

রাজা হিরণ্যধনু বলেন, সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমাদের আত্মীয়স্বজন কিছু রয়েছেন সেখানে। আমি ভাবছি অন্য কথা।

একলব্য প্রশ্ন করে, কী কথা বাবা?

রাজা বলেন, তোমাকে দ্রোণ শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করবেন না।

বাঁকা বলে, না না নেবে। সূত অধিরথের ছেলেকে নিয়েছে আর নিষাদ রাজার ছেলে রাজকুমারকে নেবে না!

গ্রামবুড়ো চাদর থেকে মুখ বের করে বললেন, একলব্য ক্ষত্রিয়সন্তান—ও শূরসেনের তৃতীয় পুত্র দেবশ্রবার জ্যেষ্ঠ পুত্র। একলব্যের পিসির নাম পৃথা ওরফে কুন্তী, তিনি রাজা পাণ্ডুর বিধবা পত্নী। থাকেন হস্তিনায়।

একলব্য বলেন, না। আমার পিতা হিরণ্যধনু, আমরা জাতিতে নিষাদ।

গ্রামবুড়ো বলেন, তাহলে তোকে নেবে না, যাস নে বাপ!

রাজা হিরণ্যধনু রায় দিলেন, একলব্য যাবে হস্তিনানগরে। দেখা যাক, ভীষ্ম তাকে দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষার অনুমতি দেয় কিনা!

পরদিন সব কিছু গোছগাছ করে নিয়ে একলব্য বেরলো হস্তিনানগরের দিকে, প্রথমে যেতে হবে অনেকটা পশ্চিমে, তার পর উত্তরে হপ্তা খানেকের রাস্তা। ঘোড়ার পিঠে চেপে যাওয়াই মনস্থ করল সে। হাতি বেশ মন্থর প্রাণী। অনেকটা খাবার, আর প্রচুর তীর ধনুক সঙ্গে নিল সে। প্রথমে হস্তিনানগরের বাজারে গিয়ে সে তীর ধনুক বেচবে, তার পর খোঁজখবর নিয়ে যাবে আচার্য দ্রোণের কাছে। এই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে প্রথমে তাকে মহানদী পার হয়ে যেতে হবে চেদি রাজ্যে। সেই সব পথ জেনে নিয়েছে একলব্য।

মহানদী পার হলেই তার গা ছমছম করে। ঘোড়া সমেত এই নদী পেরনো খুব সহজ নয়। এই জলধারাই নিষাদরাজ্যের প্রাণরেখা। পানের জল থেকে মাছ ধরা সব হয় এই নদীকে কেন্দ্র করে। নদী পার হয়ে অনেকটা পথ এগিয়ে গেল একলব্য, তেজি অশ্বের পিঠে চড়ে। নিজের খাবার, ঘোড়ার খাবার সব নেওয়া সম্ভব নয়। ঘোড়া তবু ঘাস খেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু শুধু ঘাসে ঘোড়া তেজিয়ান থাকে না। তাকে ছোলা গুড় খাওয়াতে হয়, দিতে হয় ধেনো মদও। সে সব কোথায় পাবে একলব্য? প্রায় তিন দিন তিন রাত কখনও কখনও চলে, কখনও বিশ্রাম নিয়ে তারা—একলব্য ও ঘোড়াটি পৌঁছলো চেদি রাজ্যে। এখানে রাজত্ব করেন শিশুপাল। তিনি বৃষ্ণিবংশীয় রাজা, পিতা হিরণ্যধনুর বন্ধু মানুষ।

রাজার আতিথ্যে কোনও ত্রুটি ছিল না। কয়েক দিন বেশ আরামে ও আয়াসে কাটিয়ে ঘোড়া বদলে নিয়ে এই বার উত্তরে যাওয়ার পরিকল্পনা করল একলব্য।

শিশুপাল বললেন, কোনও দরকার ছিল না হস্তিনায় যাওয়া। পূর্ব দেশে তীরন্দাজের আকাল পড়েছে নাকি হে যে তুমি ছুটছো উত্তর পানে? আমার রাজ্যেই আছেন অনেক বড় রুস্তম, তারা তোমাকে তীর ধনুক থেকে শুরু করে গদা সব শিখিয়ে দেবে। তাছাড়া, তোমার পিতা হিরণ্যধনু তো মস্ত তীরন্দাজ! রাজা জরাসন্ধ তো এমনি এমনি তাকে সেনানায়ক করেনি!

একলব্য বলে, আমাকে আচার্য দ্রোণের নামখানিই বড্ড টানছে হে পিতৃবন্ধু! শুনেছি তিনি সমগ্র ধনুর্বিদ্যা লাভ করেছেন মহর্ষি পরশুরামের কাছে।

“আমিও শুনেছি। কিন্তু ও সব হল ইন্দ্রজাল। আসল ক্ষমতা হল লাঠি। অতিসামীপ্যের জন্য। অনতিদূর থেকে তীরধনুক। অতিদূরের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র। সব শিখতে পারবে এই চেদি রাজ্যে। এ হল লাঠির রাজা উপরিচর বসুর দেশ।”

“সে কাহিনি শুনতে ইচ্ছা করি।”

শিশুপাল বললেন, বলছি সেই উপাখ্যান। তোমার পিতা হিরণ্য নিশ্চয় এতদিনে তোমাকে বলেছেন যে তোমার পিতা ও আমার মাতা ভাইবোন?

“কই না তো! তবে শুনেছি, আমি নাকি শূরসেনের পুত্র দেবশ্রবার ঔরসে জন্মেছি। ব্যস, এইটুকুই!”

“ঠিক শুনেছো বৎস! আমার মাতা শ্রুতশ্রবা দেবশ্রবার দিদি। তুমি আমার বন্ধুপুত্র হলেও আসলে তুমি আমার মামাতো ভাই!”

একলব্য বলে, এসব আমার মাথায় ঢুকছে না পিতৃব্য!

“শোনো। শূরসেনের দশ পুত্র আর পাঁচ কন্যা। পুত্রদের মধ্যে সবার বড় বসুদেব, তার পর দেবভাগ, দেবশ্রবা, আনক, সৃঞ্জয়, শ্যামক, কঙ্ক, শমীক, বৎসক ও বৃক। শূরসেনের পাঁচ কন্যা—পৃথা, শ্রুতদেবা, শ্রুতকীর্তি, শ্রুতশ্রবা ও রাজাধিদেবী। হস্তিনা গেলে পৃথা মানে আমার মাসি আর তোমার পিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ কোরো।”

একলব্যের মাথায় ঘুরছে অস্ত্রশিক্ষার কথা। তিনি এই সব আত্মীয়তার কূটকচালি শুনতে চান না। শিশুপালকে একলব্য জানালেন, আগামীকাল ভোরে হস্তিনার উদ্দেশে রওনা দেবেন তিনি। আজ রাতে উপরিচর বসুর লাঠি বা দণ্ডের কাহিনি শুনে নিতে চান।

শিশুপাল শুরু করেন কাহিনি।
0

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in







ভীষ্মের কথা মতো ব্রাহ্মণ দ্রোণ ক্ষত্রিয়বৃত্তিতে যোগ দিলেন। দুর্যোধন প্রভৃতি ১০১ জন ভাই; যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব—এই পাঁচ পাণ্ডব; অন্ধক, বৃষ্ণি প্রভৃতি বংশের কুমার, এমনকি সূতপুত্র কর্ণও এসে দ্রোণের কাছে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা করতে লাগলেন।

একলব্য এতক্ষণ মন দিয়ে রাজা হিরণ্যধনুর বলা আখ্যান শুনছিলেন। তার পর এক সময় বলে উঠলেন, আচার্য দ্রোণ কি এখন জীবিত, নাকি এও পুরাকালের কাহিনি?

নিষাদরাজ হিরণ্যধনু বললেন, জীবিত এবং তিনি হস্তিনায় থাকেন। তবে হস্তিনার আকাশে এখন দুর্যোগের কালো মেঘ! আর সেই মেঘ কেটে গিয়ে কবে সূর্য উঠবে, তা কেউ জানে না।

“কেন পিতা?” একলব্য জিজ্ঞাসা করেন।

হিরণ্যধনু জবাব দেন, যে দেশের রাজা অন্ধ হন, সে দেশের ভাগ্য অন্ধকার!

“তবে যে শুনলাম, ভীষ্ম আর রাজমাতা সত্যবতী রাজ্য চালান?”

“সিংহাসনের বাইরের লোক রাজ্য চালালে দেশের ভাল হয় না বৎস! চারদিকে বৈশ্যরা ওৎ পেতে আছে, কবে যুদ্ধ লাগবে সেই প্রতীক্ষায়!”

একলব্যের এ সব কথা শুনতে ভাল লাগে না। তিনি দ্রোণাচার্যের ধনুর্বিদ্যা সম্পর্কে বেশি আগ্রহী। পিতাকে জিজ্ঞাসা করেন, “আমি কি হস্তিনানগরে গিয়ে ধনুর্বিদ্যা শিখে আসতে পারি?”

হিরণ্যধনু বলেন, পারো। কিন্তু দ্রোণাচার্য তোমাকে কি শিষ্য হিসাবে মেনে নেবেন?

“কেন নেবেন না? নিষাদ বলে?”

“না। নিষাদ বলে নয়। সূতপুত্র কর্ণও তো দ্রোণের শিষ্য। ভীষ্ম চাইবেন না, তিনি নিষাদ-ভীলদের ভয় পান। বনজঙ্গলের মানুষরা সব রাজা জরাসন্ধের পক্ষে।”

“একবার চেষ্টা করে দেখা করা যায় না?”

নিষাদরাজ বলেন, আমি তোমাকে বাধা দেব না, আবার যেতেও বলব না। ভীষ্ম কিন্তু সমস্ত খবর রাখেন। তুমি পিতার নাম হিরণ্যধনু বললে কেউ তোমাকে শিষ্য করবে না।

একজন নিষাদ যুবক বলে, ধনুর্বিদ্যা শিখতে নগরে যেতে হবে কেন? আমরাই তো সবচেয়ে ভাল ধনুকতীর চালাতে পারি, ওইজন্য আমাদের নাম ভীল। জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা পশুদের শ্বাসের আওয়াজ পেয়ে তাদের তীরবিদ্ধ করতে পারি। কোন নগরের কোন আচার্য তা শেখাতে পারে, বলো শুনি?

একলব্য বলেন, মহাত্মা পরশুরামের কাছে দ্রোণাচার্য সমগ্র ধনুর্বিদ্যা লাভ করেছেন। সেই শাস্ত্র পাঠ করলে জঙ্গলের ধনুর্বিদ্যা আরও শক্তিশালী হবে।

একলব্যের মা জাম্ববতী বললেন, সে যখন সময় হবে যেও খোকা। এখন চান করে তোমরা চাট্টি খেয়ে নাও দেখি। সূর্য ঢলে পড়ছে মাথা থেকে।

হিরণ্যধনুর অনুমতি নিয়ে নিষাদ পুরুষরমণীরা নিজের নিজের বাড়ি চলে গেল। একটি মেয়ে বসে রইল চুপচাপ। তাঁর নাম অঙ্গা—অঙ্গাগ্রণী।

********************************


অঙ্গা’র নামটি বড় খটোমটো। এমন নাম দিয়েছিলেন পাঠশালার গুরুমশাই। নিষাদ মেয়েরাও ছেলেদের মতো পাঠশালায় যায়। অঙ্গাও যেত ছেলেবেলায়। তখন থেকেই সে একলব্যের অনুরক্ত। পাঠশালা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও তাদের অনুরাগ আগের মতোই রয়ে গেছে। তাই মাঝেমধ্যে নীল মেঘের মতো এক বনে এসে তারা দুজনে বসে। এমনই এক বসন্তকালের বনে অনেক ফুল ফুটে আছে, অঙ্গা সেই ফুল তুলে খোঁপায় গুঁজছে, কখনও বা একলব্যের কানে গুঁজে দিচ্ছে।

একলব্যের সে সবে মন নেই। ধনুর্বিদ্যা শিখতে সে যাবে হস্তিনানগরে। অঙ্গা বার বার বোঝাচ্ছে, হস্তিনা হল নগর, সেখানে অরণ্যচারী নিষাদ থাকবে কী প্রকারে? তাছাড়া ও রাজ্যের নিয়মকানুন জলা-জঙ্গল-পাহাড়ের মতো নয়। সেখানে একজন লোকের গাছ থেকে অন্য লোকে পেড়ে খেলে রাজপেয়াদা ধরে নিয়ে যায়। সকলে বাড়িতে খাবার জমায়। সোনাদানা ভরে রাখে সিন্দুকে। জঙ্গলের নিষাদরা সব ফেলে রাখে। সব প্রাকৃতিক সম্পদের উপর প্রত্যেক লোকের সমান অধিকার। হস্তিনায় গিয়ে একলব্য কী খাবে, কে তাঁকে খেতে দেবে? সে তো জঙ্গল নয়!

একলব্য বলে, কয়েকটা দিন তো মাত্র। শুনেছি, হস্তিনার কাছে কুরুক্ষেত্রে এক কালে কুরুজঙ্গল ছিল। সেই জঙ্গলে পলাশ, তিল, আম্র, চম্পক, দেবদারু, স্থলপদ্ম, অশোক, কুরুবক, নাগকেশর, তিনিশ প্রভৃতি বৃক্ষ ছিল। সেই বনে ফুটে থাকতো ফুল, ফলতো ফল। পারিজাত গাছকে জড়িয়ে থাকতো লতা।

অঙ্গা এসে একলব্যকে জড়িয়ে ধরে।

একলব্য বলতে থাকে, কত পাখি ছিল সেখানে! কোকিল আর ভ্রমর রব করতো!

অঙ্গা বলে, তুমি কবে গিয়েছিলে সেখানে?

একলব্য উত্তর দেয়, যেতে হয় না। জঙ্গল তো এমনই সুন্দর হয়। ঠিক সেই সময় দূর থেকে মৃদুমন্দ বায়ু এসে তাদের কামভাব জাগিয়ে তোলে।

তারা দুজনে উঠে যায় আরও ঘন বনে, যেসব জায়গায় ঢুকতে নিষাদরাও ভয় পায়। সেখানে থাকে জঙ্গলের আসল রাজা পশুরা। সেই ঘন বনের মধ্যেও টের পাওয়া যাচ্ছে যে এখন মধুমাস। অনেক জঙলি ফুল ফুটে আছে সেখানে। আমের মুকুলের অদ্ভুত গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কয়েকটি ঘুঘু পক্ষী আর কিছু শালিখ ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে কীসব আগডুম বাগডুম বলে যাচ্ছে। বনের সকল গাছ যেন কামভারে অবনত। একলব্য ও অঙ্গাগ্রণী সেই বনের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

অঙ্গা একলব্যকে জিজ্ঞাসা করে, আর কতদূরে যাবে একো?

একলব্য উত্তর দেয়, নীল মেঘের মতো এই জঙ্গলের ভিতর একটা গনগনে সূর্য আছে, সেখানে যাব আমরা!

“পুড়ে যাব না?”

“গায়ে বাকল পরে নিলে সূর্যদেব আর পোড়াতে পারেন না!”

“তুমি কি দেবতা যে সূর্য ঠাকুর তোমাকে ছেড়ে দেবেন?”

“না রে কন্যা, আমি নিষাদ, ভীল কখনও দেবতা হয় না!”

অঙ্গা বলে, আর কতদূর যাবে, আমার ভয় করছে!

“ভয়ই যদি পাবে, তবে এলে কেন?”

“কী জানি কে আমাকে তোমার সঙ্গে ঠেলে দিল গো ভীলবীর! সে বোধ হয় তনু ঠাকুর! বড় খতরনক চিজ, তনুর তীর-ধনুক দেখেছো? পাঁচ খানা মুখ তার—একটো মারে ভোরে, আরেকটো দুফরে, বাকিগুলান বিকাল-সাঁঝ আর রাত্তিরবেলা!”

একলব্য থমকে দাঁড়ায়। অঙ্গাগ্রণীর বদনের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে সে।

মনে মনে মা জাম্ববতী আর বাপ হিরণ্যধনুর সম্মতি নিয়ে একলব্য অঙ্গাকে নিয়ে নীল মেঘের ভিতর ঢুকে পড়ে। অঙ্গার অজনবি সুরতে একা তখন ফানা হয়ে গিয়েছে। অঙ্গা একলব্যকে বলে, “এই বলো না গো, আমি নিষাদকন্যা না রাক্ষসী?”

একলব্য জবাব দেয়, “তোমার শরীরখানি নিষাদীর, কিন্তু তুমি আসলে ডানাওয়ালা পরি। রাত গভীর হলে তোমার ডানা গজায়। অঙ্গার ওই বক্ষদেশে আছে যে তনুমন তা আসলে গন্ধর্ব গানের গোলা।’’

“তবে একখান গান গাও, আমার তনুর গান, মন-পসন্দ!”

একলব্য গান ধরে, হতাহমিতি চাক্রুশ্য...।

অঙ্গাগ্রণী তার পাহাড়ী মায়ায় একলব্যকে প্রেমাতুর করে তোলে। এই সেই পিরিতি, যাকে তন্ত্রসাধকরা কামনদী বলে থাকেন। নীল মেঘের মতো বনে একটি ক্ষুরধারা নদী এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। অঙ্গাগ্রণী তার উর্ধ্বদেশের বস্ত্র অনাবৃত করে গেয়ে ওঠে, তীরধারা বয় গো নদীর তীরধারা বয়। তার পর দুজন নেমে পড়ে সেই খরস্রোতা নদীতে। অঙ্গা তার দুই কৎবেলবৎ স্তন দ্বারা একলব্যের বক্ষ মর্দন করতে করতে বলে, তুমি কি দানো না যক্ষ, না গন্ধর্ব, নাকি নক্ষত্রপুরুষ? তুমি আমার ভীল, তুমি আমার তিল এই সব কথা আগে জানলে তোমাকে আমের ননীর মতো চুষে চুষে খেতাম!

একলব্য বলে, তিল থেকে তাল হয় শুনেচি বাপু, কিন্তু তিল থেকে একলব্য হয় কী প্রকারে!

“একলব্য মানে তাল। ফল নয়, এ হল সুরতাল। আমার গোটা দুনিয়া হল সেই একলব্য নামের তাল, আর দুনিয়া ছেনে তুমি যা পাও তাই হল তিল—হৃদয়মন। তোমাকে তালের আঁটির মতো চুষে খেয়ে ফেলতে বাসনা হয় গো জাম্বোর পো!”

“কেন অঙ্গাগ্রৈণী! এই নদীর স্রোতে আমাকে তো তুমি খাচ্ছোই। তবে আমিও ছাড়ার বান্দা নই। আঁটির ভেতরে থাকে যে শাঁস, যাকে তান্ত্রিক বলে রুহ, আমি সেই থানে যেতে চাই।

একলব্য অঙ্গাগ্রণীর ওষ্ঠ পীড়ন করতে লাগল। একলব্যের নিষ্ঠুর আক্রমণে অঙ্গার স্তনবৃন্ত ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। নদীর স্রোত এসে তাদের দুজনের সব বস্ত্র হরণ করে নিয়ে গেল। উর্ধ্বাঙ্গের পীড়নে নিম্নাঙ্গে জ্বলে উঠল কামনা। ঢেউ আসতে লাগল একের পর এক। বাসনার প্রবলতায় তরল এক বাড়বাগ্নি অঙ্গাগ্রণীর জঠরে প্রবেশ করে। আপ্লুত হয়ে ওঠে সে।

তার পর দুজনেই দেখে সেই তীরধারা নদী আর নেই। দূরে বায়ু বইছে মৃদুমন্দ। ছালবাকল খুঁজে পরে নিয়ে তারা ফিরে এল হিরণ্যধনুর নিষাদরাজ্যে। তখন সেখানে গান গাইছে নিষাদরমণীরা। সেই গানের ভাষা নেই কোনও। একটানা সুর যেন আছড়ে আছড়ে পড়ছে নদীর স্রোতের মতো, আর সেই সুরে ভর দিয়ে সূর্যদেব চলে যাচ্ছেন বিশ্রাম নিতে, দূরে কোথাও।

এমন সময় একলব্যের খুব বিষণ্ন লাগে। সূর্যাস্তের এই কালে মনে হয়, জগৎ সংসার সব মিছে। আর একটু পরে ভীলদের সভা বসবে। অঙ্গাগ্রণী বাড়ি চলে গিয়েছে। সন্ধ্যা গাঢ় হলে সে আসবে রাজা হিরণ্যধনুর মাটির ঢিপির কাছে। আজই সভায় ঠিক হবে, একলব্য হস্তিনায় গিয়ে দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করবে কিনা! কয়েকটা লোক ইতিমধ্যে এসে গিয়েছে। মশাল জ্বালানোর তোড়জোড় করছে তারা। এমন সময় মাতব্বরের একটা দল এল। সভায় যে শুধু মাতব্বরদের কথা শোনা হয়, এমন নয়। রাজা হিরণ্যধনু সাধারণ অল্পবয়সীদের কথাও মন দিয়ে শোনেন। ভীল সমাজে কেবল পুরুষ নয়, মহিলারাও সভায় আসেন এবং তাঁদের মতামত দেন। হস্তিনানগরের রাজকার্যে যা হয় না বলেই শোনা যায়।
0

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in





















অঙ্গিরা ও কর্দম ঋষি ব্রহ্মার পুত্র। কর্দমকন্যা শ্রদ্ধার সঙ্গে অঙ্গিরার বিবাহ হয়। অঙ্গিরা-শ্রদ্ধার দুই পুত্র—উতথ্য ও বৃহস্পতি। উতথ্যের বিবাহ হয় মমতার সঙ্গে। একদিন দেবগুরু বৃহস্পতি এলেন উতথ্যের বাড়িতে। উতথ্য মুনি বাইরে ছিলেন, মমতা ছিলেন গৃহে। গর্ভবতী মমতাকে দেখে কামাতুর হয়ে পড়েন বৃহস্পতি। তিনি মমতার সঙ্গম প্রার্থনা করেন। মমতা রাজি হলেন না। কিন্তু বৃহস্পতি বলপ্রয়োগ করলেন। মমতা শত চেষ্টা করেও রেহাই পেলেন না। দেবগুরু ধর্ষণ করলেন। মমতার গর্ভস্থ শিশু বৃহস্পতিকে রেতঃপাত করতে নিষেধ করলেন, কারণ একই গর্ভে দুজনের স্থিতি সম্ভব নয়। বৃহস্পতির বীর্য অমোঘ। বৃহস্পতি তার কথা শুনলেন না। তখন সেই শিশু পা দিয়ে বৃহস্পতির শুক্রকে আটকে দিলেন। বৃহস্পতি তাঁকে অভিশাপ দিলেন, তুমি অন্ধ হও। মমতার সেই পুত্রের নাম দীর্ঘতমা। বৃহস্পতির বীর্য ভূমিতে পড়ে যে পুত্রের জন্ম হল তাঁর নাম ভরদ্বাজ। ভরদ্বাজের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন মমতা। ওদিকে বৃহস্পতিও শিশুটিকে পরিত্যাগ করলে মরুৎগণ তাঁকে লালন পালন করেন। ভরদ্বাজ ঋষি নামকরা পণ্ডিত। তিনি গঙ্গোত্তরী প্রদেশে বাস করতেন। একদিন গঙ্গায় স্নান করার সময় তিনি ঘৃতাচী নামের রূপযৌবনসম্পন্না, যৌবনগর্বিতা, যৌবনমদে মন্দগমনা অপ্সরাকে নগ্ন অবস্থায় দেখে নিজেকে সামলাতে পারেন না। বস্ত্র পরিধান করার সময় নদীতীরের বায়ু এমন ভাবে বইছে যে তাঁর সমস্ত অঙ্গই দেখা যাচ্ছে। ভরদ্বাজের চিত্ত সংসক্ত হয়, তাঁর শুক্রপাত হয়। ভরদ্বাজ মুনি সেই শুক্র হস্তস্থিত কলশের ভিতর রাখেন। ওই কলশে দ্রোণের জন্ম হয়। ভরদ্বাজ মুনি এই পুত্রকে বেদ-বেদাঙ্গের শিক্ষা দেন। মুনি আগ্নেয় অস্ত্র বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন। এক সময় অগ্নিবেশ্য মুনিকে ভরদ্বাজ আগ্নেয় অস্ত্রের শিক্ষা দিয়েছিলেন। অগ্নিপুত্র অগ্নিবেশ্য মুনি দ্রোণকে সেই আগ্নেয়াস্ত্র শিক্ষার পাঠ দিলেন। ভরদ্বাজ মুনির একজন বন্ধু ছিলেন, তাঁর নাম পৃষত—তিনি পাঞ্চাল দেশের রাজা। পৃষতের পুত্র দ্রুপদ ভরদ্বাজের আশ্রমে খেলা করতেন। দ্রুপদের সঙ্গে দ্রোণের খুব বন্ধুত্ব হয়। পৃষতের মৃত্যুর পর দ্রুপদ পাঞ্চাল দেশের রাজা হন। দ্রোণাচার্য শরদ্বানের কন্যা কৃপীকে বিবাহ করেন। কৃপীর অগ্রজ কৃপ হস্তিনার অস্ত্রগুরু। দ্রোণ ও কৃপীর একটি পুত্র জন্মায়, তাঁর নাম অশ্বত্থামা।


একদিন দ্রোণ শুনতে পেলেন, মহাত্মা পরশুরাম যিনি পৃথিবীকে একুশ বার ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন, সেই মহাধনুর্ধর নিজের সব ধনসপম্পত্তি ব্রাহ্মণদের দান করবেন। ধনুর্বেদ এবং অলৌকিক অস্ত্র বিষয়ে পরশুরাম সব কিছু জানতেন। দ্রোণাচার্য কৃপী ও অশ্বত্থামাকে রেখে পরশুরামের কাছে গেলেন মহেন্দ্র পর্বতে। অঙ্গিরা, বৃহস্পতি ও ভরদ্বাজের নাম করে নিজের বংশপরিচয় দিয়ে পরশুরামকে প্রণাম করলেন তিনি। জানালেন, তিনি ভরদ্বাজের পুত্র কিন্তু অযোনিজ, পিতাও তাই, এমনকি তাঁর স্ত্রী কৃপীও অযোনিজ। পরশুরামের কাছে তিনি প্রচুর ধন দান দান হিসাবে চান। পরশুরাম বললেন, দ্রোণ একটু দেরি করে ফেলেছেন, সোনারূপা, মণি যা ছিল সব তিনি ব্রাহ্মণদের দান করে দিয়েছেন। গোটা পৃথিবী দিয়েছেন কশ্যপকে। অবশিষ্ট রয়েছে তাঁর শরীর, অস্ত্র ও শস্ত্র—এই তিনের মধ্যে যা দ্রোণ চাইবেন তাই তিনি দান করবেন।

দ্রোণ বললেন, প্রয়োগের সঙ্কেত, মন্ত্র এবং উপসংহারের উপায় এই সব কিছুর সঙ্গে সমস্ত অস্ত্র ও শস্ত্র আমাকে দান করুন।

পরশুরাম উচ্চারণ করলেন, তথাস্তু! তার পর সঙ্কেত, মন্ত্র ও নিয়মসমেত সমগ্র ধনুর্বেদ দ্রোণকে দান করলেন।

প্রসন্ন দ্রোণ ফিরে এলেন পাঞ্চাল নগরে। বাল্যসখা দ্রুপদের কাছে এসে বললেন, হে বন্ধু! আমি তোমার রাজ্যে সখার মতো থাকতে চাই।

দ্রুপদ বললেন, এক সময় একসঙ্গে অধ্যয়ন ও ক্রীড়া করেছি বলে আমি তোমার সখা হয়ে গেলাম! দরিদ্র-ধনবান, মূর্খ-পণ্ডিত, নপুংসক-বীর, প্রবল-দুর্বল কোনও দিন বন্ধু হয় না।

ক্রুদ্ধ দ্রোণ স্ত্রীপুত্র নিয়ে পাঞ্চাল ছেড়ে হস্তিনানগরে চলে গেলেন। সেখানে শ্যালক কৃপাচার্যের গৃহে প্রচ্ছন্নভাবে বাস করতে লাগলেন। কৃপাচার্য হস্তিনার রাজপুত্রদের অস্ত্রশিক্ষা দিতেন। দ্রোণ নিজের পুত্র অশ্বত্থামাকে শিক্ষা দিতে লাগলেন। অবশিষ্ট সময়ে হস্তিনার রাজপুত্রদের খেলাচ্ছলে অনেক কিছু শেখাতেন বটে, কিন্তু নিজের পরিচয় গোপন রাখতেন। শ্যালক কৃপাচার্যকে বলেও কাজের ব্যবস্থা হল না। এদিকে পরগৃহে থাকতেও আর প্রাণ চায় না। অর্থকষ্ট রয়েছে। স্ত্রীপুত্রের ভরণপোষণও ঠিক মতো করতে পারছেন না বলে দ্রোণের মনে শান্তি নেই, অথচ সমগ্র ধনুর্বিদ্যা তাঁর হাতের মুঠোয়।

একদিন হস্তিনাপুরের এক মাঠে রাজকুমাররা ডাংগুলি খেলছিল। এমন সময় একটি কূপে তাদের গুলিটি পড়ে যায়। কুমাররা সেই গুলি কিছুতেই তুলতে পারছেন না, আবার গুলি না পেলে খেলা শুরু করা যাবে না।

এমন সময় রাজকুমাররা দেখলেন, একজন শ্যামবর্ণ, শুভ্রকেশ ও কৃশশরীর এক ব্রাহ্মণ সামনে আগুন রেখে হোম করছেন। বালকরা সেই ব্রাহ্মণকে ঘিরে ধরলেন।

দ্রোণ জানতে চাইলেন, কেন তাঁকে ঘিরে রয়েছে বালকরা?

তাঁরা বললেন, ওই গুটিটা না তুলে দিলে খেলার ব্যাঘাত হচ্ছে।

দ্রোণ বললেন, আমি তুলে দিতে পারি কিন্তু একটি শর্তে। আমাকে এক সন্ধ্যার খাবার দিতে হবে।

উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্রোণ নিজের আংটিটি খুলে সেই জলহীন কূপে ফেলে দিলেন।

তখন রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ভ্রাতুষ্পুত্র যুধিষ্ঠির বললেন, কৃপাচার্যের অনুমতি হলে আপনি নিয়মিত খাদ্য লাভ করবেন।

দ্রোণ হাসলেন। তার পর একটি ঈষিকা দিয়ে সেই গুটিটিকে বিদ্ধ করলেন, তার পর একটার পর একটা ঈষিকা পরস্পরকে বিদ্ধ করে সেই গুটি উপরে তুলে আনলেন।

রাজকুমাররা বিস্মিত হলেন। এমন ভাবে যে গুটি তোলা যায়, তা তাদের ধারণার বাইরে ছিল। তখন ধৃতরাষ্ট্রপুত্র দুর্যোধন বললেন, হে বিপ্র! আপনি এই বার অঙ্গুরীয় উত্তোলন করে দেখান।

দ্রোণ সেই আংটিও কূপ থেকে তুলে ফেললেন। রাজকুমাররা বিস্ময়ে বললেন, আমরা আপনার জন্য কী করতে পারি?

দ্রোণ জবাব দিলেন, একটাই কাজ করতে পারো তোমরা। এই ঘটনার কথা রাজাকে নয়, ভীষ্মকে জানাও! ভীষ্মই হস্তিনাপুরের আসল রাজা আর তাঁকে চালনা করেন তাঁর বিমাতা সত্যবতী। সত্যবতীর দুই পুত্র মৃত। পৌত্রদের একজন রাজা ধৃতরাষ্ট্র হলেন অন্ধ, কনিষ্ঠ পাণ্ডু কিছু কাল আগে মারা গিয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্রের ১০২ জন সন্তান আর পাণ্ডুর পুত্র পাঁচটি।

ছেলেরা এসে ভীষ্মকে সব কথা খুলে বললেন। ভীষ্ম এমন একজন অস্ত্রগুরু খুঁজছিলেন। কৃপাচার্য মানুষ ভাল, শিক্ষাদানের পদ্ধতিও ভাল কিন্তু বড্ড প্রাচীনপন্থী। ওদিকে শত্রুদের তীক্ষ্ম নজর হস্তিনার দিকে। মগধের রাজা জরাসন্ধের ভয়ে সকলে কম্পমান। পাহাড় ও জঙ্গলের রাজারাও তাঁর পক্ষে। এমন অবস্থায় রাজকুমারদের উপযুক্ত অস্ত্রশিক্ষা না দিতে পারলে বীর তৈরি হবে না। আর বীর তৈরি না হলে কে রক্ষা করবে হস্তিনার সাম্রাজ্য! ভীষ্ম ডেকে পাঠালেন আচার্য দ্রোণকে।

দ্রোণ ভীষ্মের সামনে এসে নিজের দুরাবস্থার কথা বললেন ও দ্রুপদ রাজার বিরুদ্ধে নানা রকমের ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। ভীষ্ম জানালেন, পাঞ্চাল রাজকে তিনি এক্ষুণি চটাতে চান না। আপাতত আচার্য হিসাবে দ্রোণ কুরুবালকদের অস্ত্রশিক্ষা দিন এবং কুরুগৃহে সম্মানের সঙ্গে বসবাস করুন ও ধনসম্পত্তি ভোগ করুন।

দ্রোণ বললেন, তা কী প্রকারে হয়? এই বালকদের অস্ত্রগুরু কৃপাচার্য রয়েছেন। বরং আমাকে কিছু ধন দিন, আমি অন্যত্র চলে যাই।

বুদ্ধিমান ভীষ্ম জানেন যে দ্রোণ হলেন কৃপের ভগ্নীপতি। তাই তিনি বললেন, কৃপাচার্যও সম্মানের সঙ্গে থাকবেন, তাঁর ভরণপোষণও কুরুবংশ করবে, আমরা আপনার মতো উপযুক্ত লোক খুঁজছিলাম যিনি সমগ্র ধনুর্বিদ্যা জানেন।

দ্রোণ অবাক হন। কৃপাচার্য তবে কি উপযুক্ত নন? তিনি কি শ্যালকের পদ কেড়ে নিচ্ছেন! আর সমগ্র ধনুর্বিদ্যার কথাই বা শান্তনু ও গঙ্গার পুত্র ভীষ্ম কীভাবে জানলেন!

ভীষ্ম বললেন, রাজ্য চালাতে গেলে অনেক কিছুর খবর রাখতে হয়। চার দিকে গুপ্তচর নিয়োগ করা হয়েছে রাষ্ট্রের অর্থে, সে কি আর এমনি এমনি! পরশুরামকেও ভীষ্ম ভাল মতো চেনেন। তাঁর সঙ্গে একদা ঝামেলাও হয়েছিল দেবব্রত ভীষ্মের।

চলবে
2

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in






একলব্য একদিন ঘোড়ায় চেপে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এমন সময় নিষাদ পুরুষরা তাঁকে চার পাশ থেকে ঘিরে ধরল। ভালবেসে তারা বলল, এই তো আমাদের রাজা হিরণ্যধনুর পুত্র! এবার একলব্যকে আর ছাড়ছি না, ওকেই রাজা করব। হিরণ্যধনু বুড়ো হয়ে গিয়েছেন, তিনি বৃদ্ধ কথক ঠাকুর সেজে কাহিনি বলবেন।


হইচইয়ের মধ্যে একজন বৃদ্ধ নিষাদ বলে উঠলেন, না! একলব্য চন্দ্রবংশীয়, সে আমাদের রাজা হতে পারে না।


নিষাদ যুবকরা এ ওর মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।


বৃদ্ধ নিষাদ বললেন, আমরা সূর্যবংশীয় ভীল, একলব্য আমাদের ভালবাসার ধন বটে কিন্তু সে রাজা হিরণ্যধনুর পুত্র নয়। রাজা অপুত্রক; রাণী জাম্ববতীও নিঃসন্তান।


বিস্মিত একলব্য ঘোড়া থেকে নামলেন। তাঁর বয়স বেশি নয়, সবে আঠারোয় পা দিয়েছেন গত পূর্ণিমায়। ধনুকের ছিলার মতো কালো শরীরটাকে বাঁকিয়ে তিনি বৃদ্ধ নিষাদকে প্রণাম করে আবার ঘোড়ায় উঠে পড়লেন। বনের পূর্ব দিকে যে শিংশপা গাছের সারি রয়েছে সেখানে রাজার প্রাসাদ, সে দিকেই ঘোড়া ছোটালেন তিনি। প্রাসাদ মানে একটি মাটির বাড়ি, পাতার ছাউনি তার। দাওয়ায় মাটির ঢিপি। সপ্তাহান্তে একদিন সেই ঢিপির উপরে উঠে নিষাদদের সুখ দুঃখ আর সমস্যার কথা শোনেন রাজা হিরণ্যধনু।


ঘোড়া থেকে নেমে প্রাসাদের দাওয়ায় দেখতে পেলেন রাণী জাম্ববতীকে। তিনি উঠোন নিকোচ্ছেন লাল মাটি দিয়ে। ভীলরা গরু পোষে না, তাই গোবর দিয়ে উঠোন কিংবা দাওয়া নিকনো এদের রীতি নয়। একলব্য জাম্ববতীকে প্রণাম করে বললেন, মা! এ কী কথা শুনছি? তবে কি আমি তোমার আর বাবার সন্তান নই? আমার পিতামাতা তবে কারা?


জাম্ববতীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি কাদা হাতের উলটো পিঠে কপালের চুল সরাতে সরাতে বললেন, এই অশৈলি কথা কে বলল তোকে একলব্য? পেটে ধরিনি বলে কি আমি তোর মা নই?


“কে আমাকে পেটে ধরেছিল? আমার পিতাই বা কে?”


এমন সময় হিরণ্যধনু সেখানে এসে পৌঁছলেন। বন থেকে কিছু ফলমূল আর মধু সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন তিনি। ধামাখানি মাথা থেকে নামিয়ে রাজা বললেন, এত দিন আমরাই তো তোমাকে লালনপালন করেছি, তাই আমরাই তোমার মাতাপিতা!


একলব্য ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, তবে যে গ্রামবুড়ো বলল, তোমরা নিঃসন্তান—আমি অন্য লোকের ছেলে!


হিরণ্যধনু বুঝলেন, একলব্য বড় হয়েছে, তাকে সব কথা খুলে বলা দরকার। ইতিমধ্যে জাম্ববতী হাত ধুয়ে মাটির পাত্রে জল এনে দিয়েছেন রাজাকে। রাজা ঢক ঢক করে জল খেয়ে বললেন, শোনো তবে। বড় হলে সব কথা খুলে বলবো, ঠিক করেই রেখেছিলাম। তা যখন নিজে থেকেই শুনতে চাইছো, বলা আমার কর্তব্য।


মথুরায় বাস করেন দেবশ্রবা নামের এক পণ্ডিত মানুষ। জাতিতে ক্ষত্রিয় হলেও তাঁর শাস্ত্রজ্ঞান প্রবল। মথুরার রাজা কংস দেবশ্রবার দাদা বসুদেবের শ্যালক। কিন্তু রাজা বড় অত্যাচারী। যদু বংশের কোনও সন্তান জন্মালেই সে খুন করে ফেলছে। দেবশ্রবারা দশ ভাই, পাঁচ বোন। তাঁদের পিতা হলেন যদুবংশীয় শূরসেন। সবার বড় বসুদেব। বসুদেবের ছয় পুত্রকে হত্যা করেছে রাজা কংস। ধার্মিক বসুদেব কৌশলে সপ্তম ও অষ্টম পুত্রকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা সেখানেই বড় হচ্ছেন। এই রূপ হত্যালীলা দেখে দেবশ্রবা ও তাঁর স্ত্রী মথুরায় থাকতে ভয় পাচ্ছিলেন। দেবশ্রবার স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার পরে পরেই ওই দম্পতি আমাদের রাজ্যে চলে আসেন।


জাম্ববতীর চোখ সজল হয়ে ওঠে। তবে কি পুত্র একলব্য এখন মথুরায় চলে যাবে? রাজা কংসকে বধ করেছেন বসুদেবপুত্র শ্রীকৃষ্ণ। কংসের পিতা উগ্রসেনকে আবার রাজা করা হয়েছে। সে সব কথা শুনেছেন বিদেশি কথক ঠাকুরের মুখে।


রাজা হিরণ্যধনু বলেন, বসুদেবের ভাই দেবশ্রবার পুত্র হলে তুমি। তোমাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়ে তাঁরা নিশ্চিন্তে মথুরায় ফিরে গিয়েছেন। শুনেছি তাঁদের আরও দুটি পুত্রসন্তান হয়েছে। মথুরা থেকে হস্তিনাপুর খুব বেশি দূরে নয়। বসুদেবের এক ভগ্নী পৃথার বিবাহ হয়েছে হস্তিনার রাজপুত্র পাণ্ডুর সঙ্গে। শ্রীকৃষ্ণ সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করেন। তিনি সম্পর্কে তোমার জ্যাঠতুতো দাদা।


একলব্যের কোনও ভাবান্তর হয় না। তিনি যেন অচেনা গল্প শুনছেন! যেমন একদিন চন্দ্রবংশীয় রাজাদের গল্প শুনেছিলেন গ্রামবুড়োর কাছে। বুড়ো শুনেছিল কথক ঠাকুরের কাছে। আকাশের চাঁদ কী করে পুত্রকন্যার জন্ম দিতে পারে, তা একলব্যের মাথায় ঢোকেনি, কিন্তু গল্পটি বেশ লেগেছিল তাঁর! চন্দ্রবংশের একটি অংশ হল যদু, আরেকটি কুরু। না, গৌরব হচ্ছে না মোটেও। বরং আরও বেশি করে মনে হচ্ছে, তিনি হিরণ্যধনু-জাম্ববতীর পুত্র—তিনি সূর্যবংশীয়। শিব তাঁর আরাধ্য দেবতা। তিনি চন্দ্রবংশীয়ও নন, বিষ্ণুর উপাসকও নন।


জাম্ববতী খাবার বেড়ে দিলেন একলব্য ও হিরণ্যধনুকে। নিজেও একটি বেতের ঝুড়ি থেকে ফলমূল নিয়ে খেতে শুরু করলেন। সকালের এই সময়টাতে তাঁরা ফলমূল আর মধু খান। একলব্য জাম্ববতীকে বললেন, মা ওই চাঁদ-তারার গল্পটা বলো না একবার! ছেলেবেলায় একটু শুনিয়ে বলেছিলে, বড় হলে সবটা বলবে?


জাম্ববতী বলেন, সে আখ্যান তোর বাপের কাছে শোন! অত জটিল গল্প আমার মনে থাকে না। চাঁদের বংশধর শুনে আবার নতুন করে তোর ওই কিসসা শুনতে ইচ্ছে হল বুঝি?


মায়ের কথা শোনে একলব্য হাসেন। তার পর পিতার দিকে তাকিয়ে থাকেন।


রাজা হিরণ্যধনু হাত মুখ ধুয়ে কথক সাজলেন। মাথায় বাঁধলেন পাগড়ি, আর হাতে নিলেন একটি লাঠি, তাঁর ডগায় গবয় পশুর লেজের চুল। দাওয়া থেকে একটু দূরে ঘন সবুজ বনে বসে চাঁদ-তারার গল্প শুরু করলেন তিনি। নিষাদরা গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে এমন আসর বড়ই ভালবাসেন। একে একে জড়ো হতে লাগল নিষাদ পুরুষ ও রমণীরা।


অত্রিমুনির পুত্র চন্দ্র দক্ষের সাতাশ জন কন্যাকে বিবাহ করেন। চাঁদ একবার রাজসূয় যজ্ঞ করে প্রবল অহঙ্কারী ও কামাসক্ত হন। দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারার সঙ্গে চন্দ্রের গোপন প্রণয় ছিল। তিনি তারাকে নিয়ে পালিয়ে গেলে বৃহস্পতি অত্যন্ত কূপিত হলেন। তখন ঘোরতর যুদ্ধের উপক্রম হল। ব্রহ্মা সেই মহারণ আটকে দিয়ে তারাকে বৃহস্পতির কাছে ফিরিয়ে দেন। তারার গর্ভস্থ সন্তান চন্দ্রের ঔরসজাত। সেই সন্তানের নাম বুধ। বৃহস্পতির অভিশাপে চাঁদের যক্ষ্মা হয়। চন্দ্রপিতা অত্রিমুনি ছিলেন নামকরা বৈদ্য, তিনি পুত্রকে সারিয়ে তোলেন। চন্দ্রপুত্র বুধ বৈবস্বত মনুর কন্যা ইলাকে বিবাহ করেন।


ইলার কাহিনি ভারি অদ্ভুত। মিত্রাবরুণের কাছে পুত্রের আরাধনা করে মনু একটি সন্তান পান বটে কিন্তু উপাসনায় ভুল থাকায় সেটি কন্যা হয়ে জন্মায়। পরে বিষ্ণুর কৃপায় ইলা পুরুষত্ব পান, তাঁর নাম হয় ইল। তিনি রাজাও হয়েছিলেন। ইল রাজা একবার মৃগয়া করতে গিয়ে ঘন অরণ্যে প্রবেশ করেন, সেখানে মহাদেব ও উমা খেলা করছিলেন। উমার মনোরঞ্জনের জন্য মহাদেব স্ত্রীরূপ ধারণ করেছিলেন এবং তাঁর ইচ্ছায় বনের সব জন্তু এবং বৃক্ষও স্ত্রীভাব প্রাপ্ত হয়। রাজা ইল সেই ঘন বনে ঢুকে নারী হয়ে গেলেন। তখন রাজা ইল শিব ও পার্বতীর সাধনা করতে লাগলেন। মহাদেব বললেন, তুমি পুরুষত্ব ছাড়া অন্য বর চাও, আমি দেব। ইল তখন পার্বতীর কাছে আবেদন করলেন। দেবী বললেন, তুমি অর্ধেক সময়কাল নারী ও অবশিষ্ট সময় পুরুষ হয়ে কাটাবে। স্ত্রীরূপে ইল রাজার নাম হল ইলা। তিনি তপস্যারত বুধের সঙ্গে মিলিত হয়ে এক পুত্রের জন্ম দেন, তাঁর নাম পুরূরবা। তিনি প্রয়াগে রাজধানী স্থাপন করে মায়ের নামে সেই স্থানের নাম দেন ইলাবাস। ওই পুরূরবা একলব্যের পূর্বপুরুষ।


মিত্র ও বরুণের শাপে স্বর্গের অপ্সরা ঊর্বশী মর্ত্যে জন্ম নেন। পুরুরূবা তাঁকে বিবাহ করেন। তাঁদের এক পুত্রের নাম আয়ু। আয়ুর ছেলে নহুষ। নহুষ ছিলেন ধার্মিক রাজা। তাঁর ছয় পুত্রের মধ্যে যযাতি হলেন সবচেয়ে বিখ্যাত। ক্ষত্রিয় রাজা যযাতির ছিলেন দুই স্ত্রী—একজন ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানী, অন্যজন অসুরকন্যা শর্মিষ্ঠা। দেবযানীর দুই পুত্র—যদু ও তুর্বসু। শর্মিষ্ঠার তিন পুত্রের নাম দ্রুহ্যু, অনু ও পুরু। অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর দাসী ছিলেন অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা। দাসীর গর্ভে যযাতি সন্তান উৎপাদন করেছেন জেনে শুক্রাচার্য যযাতিকে জরাগ্রস্থ হওয়ার অভিশাপ দেন। অনেক কাকুতিমিনতি করার পর শুক্র বললেন, যদি তোমার পুত্রদের কেউ তোমাকে যৌবন ধার দেয়, তবেই তুমি জরা থেকে মুক্তি পাবে। রাজা যযাতি তাঁর পুত্রদের কাছে এলেন। যদু, তুর্বসু, দ্রুহ্যু ও অনু কেউ তাঁর কথায় কান দিল না। রাজা যদুকে অভিশাপ দিলেন, তোমার বংশের কেউ রাজা হবে না কোনও দিন। বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণ যদুবংশে জন্মলাভ করেছেন। তুর্বসুর বংশ লোপ পাবে, সে ম্লেচ্ছ ও অন্ত্যজ জাতির রাজা হবে। আমরা হলাম তুর্বসুর বংশের লোক। যদু আর তুর্বসু একই রক্তধারা বহন করেন। যদুর বংশধর হল একলব্য। দ্রুহ্যুর বংশের লোকদের স্থান হয়েছে দুর্গম প্রদেশে। তারাই ভোজ উপাধি নিয়েছে। কংস সেই ভোজের বংশধর। অনু ও তাঁর সন্তানরা যৌবনের পূর্বেই জরাগ্রস্থ হবে।


বাকি রইলেন পুরু। তিনি পিতাকে যৌবন দান করলেন। পুরুর শরীরে একদিকে বইছে চন্দ্রের রক্ত আর একদিকে অসুররাজ বৃষপর্বার খুন। দীর্ঘদিন যৌবন উপভোগ করে পুত্র পুরুকে আবার তা ফিরিয়ে দিলেন যযাতি। পুরু হলেন রাজা, তাঁর বংশের নাম পৌরব। তাঁর তিন পুত্র—প্রবীর, ঈশ্বর ও রৌদ্রাশ্ব। ঈশ্বরের উত্তরপুরুষ দুষ্মন্ত, তাঁর ছেলে ভরত। ভরতের উত্তরপুরুষ বৃহৎক্ষেত্রপুত্র হস্তি। হস্তির নামে হস্তিনাপুর নগর। হস্তির আবার তিন পুত্র। তাঁর চার পুরুষ পর রাজা হন সংবরণ ও তপতীর পুত্র কুরু। তখন থেকে হস্তিনাপুরের রাজারা হলেন কৌরব। কুরুর অধস্তন সপ্তম পুরুষ হলেন প্রতীপ। প্রতীপের পৌত্র ধৃতরাষ্ট্র এখন হস্তিনাপুরের রাজা।


শ্রোতাদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলেন, তবে যদু বংশ কোথা থেকে এল?


রাজা হিরণ্যধনু জবাব দিলেন, সেই কাহিনি অন্য আর একদিন বলব। আপাতত শুনে রাখো, যযাতি ও দেবযানীর পুত্র যদু থেকে বৃষ্ণি নামক এক বংশধর জন্মান। বৃষ্ণির উত্তরপুরুষ দেবমীঢ়, তাঁর পুত্র শূরসেন। শূরসেনের পৌত্র বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণ।


একলব্য মনে মনে ভাবেন, কাহিনি অনুসারে তিনিও শূরসেনের পৌত্র। শূরসেনের তৃতীয় পুত্র দেবশ্রবা তাঁর জৈবিক পিতা। পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা চন্দ্র ও তারার পুত্র না হয় বুধ, কিন্তু বুধ তো আসলে বৃহস্পতির ক্ষেত্রজ পুত্র! দেবগুরু বৃহস্পতির আর কোনও পুত্র ছিল না? শুনেছি, হস্তিনায় এক ব্রাহ্মণসন্তান অস্ত্রশিক্ষা দেন, তিনিই নাকি বৃহস্পতির পৌত্র?”


হিরণ্যধনু বলেন, “ঠিকই শুনেছো বৎস! হস্তিনায় রয়েছেন আচার্য দ্রোণ। তিনি ভরদ্বাজের পুত্র। এই ভরদ্বাজ মুনি দেবগুরু বৃহস্পতির সন্তান। সে কাহিনি বড়োই মর্মন্তুদ।”


এক নিষাদ রমণী বললেন, আমরা সেই আখ্যান শুনতে চাই।


জাম্ববতী বললেন, না রে আজ নয়। দেখছিস না রাজামশাই হাঁফাচ্ছে।


জল আনা হল। ঢক ঢক করে সবটুকু পান করলেন নিষাদরাজ। তার পর পাগড়ি খুলে, লাঠি রেখে বসে পড়লেন। হিরণ্যধনুর বয়স হচ্ছে। একটানা অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। বসে বসেই বললেন, দ্রোণাচার্যের আখ্যান কিন্তু না বললেই নয়।


আবার শুরু হল কাহিনি। একঘেয়ে সেই উপাখ্যান নিষাদ রমণীপুরুষেরা বড় ভালবাসে।