অমৃত সদন - শামিম আহমেদ
Posted in অমৃত সদন৫
এই যে দেশ দেখছো, এর নাম চেদি। এই দেশের দু পাশে আছে নর্মদা আর গোদাবরী নদী। এখানকার রাজা উপরিচর আসলে আকাশচর ছিলেন, অনেকটা পাখির মতো। সমাজের উচ্চ স্থানে তাঁর বাস, আমার বা তোমার পিতার মতো রাজা তিনি ছিলেন না যে গরিব-গুবরোদের সঙ্গে সময় কাটাবেন। ইন্দ্রের সখা উপরিচরের ছিল স্ফটিকময় বিমান, অম্লান পঙ্কজের বৈজয়ন্তীমালা এবং একটি বংশনির্মিত ষষ্ঠী।
একলব্য জিজ্ঞাসা করে, বংশনির্মিত ষষ্ঠী মানে কী?
শিশুপাল জবাব দিলেন, বাঁশ, বাঁশের তৈরি লাঠি। এই ষষ্ঠীর নিয়মিত পুজো করা হত। লাঠিকে ভোগ দেওয়া হত। অগ্রহায়ণ মাসে সেই পূজা হত পাঁচ দিন ধরে—ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী। এই সময় সারা রাজ্যে ইন্দ্রের পতাকা উত্তোলন করা থাকতো। উপরিচরের দেখাদেখি বিদেশি রাজা ইন্দ্রের পতাকা অন্য রাজাদের মধ্যেও জনপ্রিয় হল। লাঠিই হল প্রজাদের মহৌষধ। উপরিচরের ছিল পাঁচ পুত্র—তারা পাঁচ দেশের শাসক হয়েছিল। উপরিচরের যে চেদি রাজ্য ছিল তার রাজধানীর নাম শুক্তিমতী। নদীর নামে নগরের এমন নামকরণ। শুক্তির উৎপত্তিস্থল হল স্ত্রীযোনি, তার প্রবাহ শুধু রাজধানীর পাশে কেন সারা রাজ্য জুড়ে ছিল। আর ছিল কোলাহল পর্বত, যারা হল বা কর্ষণের জন্য সর্বদা মুখিয়ে থাকে। শুক্তিমতী নদীর আহ্বানে কোলাহল পর্বত তার সঙ্গে মিলিত হয়। নদীর গর্ভে জন্ম নেয় এক পুত্র আর এক কন্যা।
জ্ঞানীবৃদ্ধরা অবশ্য বলে থাকেন, কামান্ধ কোলাহল পর্বত শুক্তিমতী নদীকে ধর্ষণ করে। ওই যে পুত্রকন্যার জন্ম হল, রাষ্ট্র তাকে নিজের ঘরে স্থান দিল। পুত্রটি হল চেদির সেনাপতি আর কন্যাটি চেদির রাজমহিষী। কন্যার নাম গিরিকা। রাজা গিরিকার সঙ্গে নিয়মিত সঙ্গম করেন, একমাত্র ঋতুস্নাতা অবস্থা ছাড়া। সেই সময় উপরিচর বেরিয়ে যেতেন মৃগয়ায়। এই রকম একবার তিনি শিকারে গিয়েছেন। পথে গিরিকাকে স্মরণ করে তাঁর শুক্রস্খলন হয়। সেই স্খলিত বীর্য এক শ্যেনপক্ষী পত্রপুটে নিয়ে উড়ে যায়। পথে আর এক শ্যেনপক্ষীর আক্রমণে সেই শুক্র যমুনার জলে পড়ে যায়। সেই জলে ছিল এক মৎসী—ব্রহ্মশাপগ্রস্থ অদ্রিকা নামের এক অপ্সরা। ওই শুক্র পান করে মৎসী গর্ভবতী হয়। অপ্সরারা অপ বা জলে বিচরণ করে। দশম মাসে ওই মৎসী ধরা পড়ল এক ধীবরের জালে। অদ্রিকা তখন একটি পুত্র ও একটি কন্যা প্রসব করে আকাশপথে চলে যায়। উপরিচর বসু পুত্রটিকে গ্রহণ করলেন, কন্যাটিকে পরিত্যাগ করলেন। সেই কন্যা বড় হতে লাগল ধীবর দাশরাজের গৃহে। তার নাম মৎস্যগন্ধা। উপরিচরকে চেদি রাজ্য থেকে অনেক কষ্টে সরানো গিয়েছে। তবে তাঁর কন্যা মৎস্যগন্ধা এখন হস্তিনা শাসন করে। সেও পিতার মতো ষষ্ঠীর নিয়মিত পুজো করে, ভোগ দেয়।
এই পর্যন্ত বলে থামলেন চেদির রাজা শিশুপাল। বললেন, বাছা একলব্য এখন ঘুমিয়ে পড়ো। ভোর-ভোর বেরিয়ে উত্তরপানে যাবে। পথে পড়বে ইলাবাস, সেখানে বিশ্রাম নিয়ে বিরাট রাজ্যের ভেতর দিয়ে অনেকটা গিয়ে মৎস্য দেশ পার হয়ে পাবে খাণ্ডব বন। সেই বনের উত্তরে আছে হস্তিনানগরী।
চেদি দেশ থেকে বিদায় নিয়ে নতুন ঘোড়ায় চড়ে একলব্য উত্তর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। পথে শুধু ধু ধু প্রান্তর, বন আর নদীনালা। বেশ কিছু দিন পর তিনি ইলাবাসের প্রয়াগতীর্থ পার হয়ে বিরাট রাজ্যে এসে কয়েক দিন বিশ্রাম নিলেন। সেখানকার রাজার নামও বিরাট। তিনি অলস প্রকৃতির রাজা, সারা দিন পাশা খেলে সময় কাটান। শিশুপালের নাম করে রাজ অতিথিশালায় কিছু দিন বাস করার সুযোগ পেলেন। সেই সুযোগে আলাপ হল বিরাট রাজার প্রধান মহিষী সুদেষ্ণার ভাই কীচকের সঙ্গে। কীচক ভারি মজার লোক। তিনি বিরাট রাজ্যের সেনাপতি। তাঁর সঙ্গে তীরধনুক ও নানা অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে কথা হল একলব্যের। কীচক একলব্যকে বললেন, তুমি এখানে থেকে যাও। বিরাট রাজ্যের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পেলেন একলব্য। হিরণ্যধনুর পুত্র জানালেন, কীচকের প্রস্তাব খুব সম্মানজনক কিন্তু তিনি হস্তিনায় একটি কাজে যাচ্ছেন, সেই কাজ শেষ করে এসে জানাবেন যে সেনাবাহিনীতে তিনি যোগ দেবেন কিনা। কীচক নানা রকমের সুরার ভক্ত, তাঁর সংগ্রহে অনেক রকম সুরা আছে। দু দিন ধরে একলব্যকে তিনি মাংস সহযোগে সেই সব পানীয় চেখে দেখার সুযোগ করে দিলেন। একলব্য তাঁকে কয়েকটি তীর ধনুকের কসরত শিখিয়ে দিলেন।
মৎস্য দেশের অন্দর দিয়ে খাণ্ডব বন পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগল না দ্রুতগামী অশ্বারোহী একলব্যের। পিতা হিরণ্যধনু বলেছিলেন, এখানে বাস করেন তক্ষক ও তার পুত্র অশ্বসেন। ময় দানব, ঋষি মন্দপাল এবং তার সঙ্গিনী জরিতাও থাকেন এই বনে। তাঁদের সঙ্গে দেখা করে, কয়েকটা দিন অরণ্যে বাস করে তবেই সে পৌঁছবে হস্তিনানগরে।
তক্ষকের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল একলব্যের। তিনি একলব্যকে নাগবংশের অনেক কাহনি শোনালেন। অষ্টনাগের অন্যতম তক্ষক ছদ্মবেশে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করেন কারণ নগরের লোকেরা তাঁকে বিদ্রোহী ভেবে হত্যা করতে চায়। শেষ নাগ ও বাসুকিও পাতালে চলে গিয়েছেন বহু দিন, সেখান থেকেই তাঁরা নিজেদের কাজকর্ম পরিচালনা করেন। নগরের ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছেন না কিছুতেই। অথচ কী আশ্চর্য! এখন জাতপাত নিয়ে যারা মাথা ঘামাচ্ছে, তারাও জানে তক্ষক ওরফে অনন্তনাগের পিতা কশ্যপ আর মা কদ্রু। তিনিই একলব্যকে বললেন, নিষাদ হয়ে হস্তিনায় গিয়ে আচার্য দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে যাওয়া আর ইঁদুর হয়ে বেড়ালের গালে চুমু খেতে যাওয়া একই ব্যাপার। তার চেয়ে গুপ্তবিদ্যা শিখে যুদ্ধ করা অনেক ভাল। সম্মুখ সমরে রাজশক্তির সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল। কিন্তু একলব্য নাছোড়বান্দা। তিনি যাবেনই। মন্দপাল ঋষি ও তার সঙ্গিনী জরিতাও অনেক বোঝালেন। ময় দানব অবশ্য একটু চুপাচাপ। অনেক কাল অরণ্যবাস করে তাঁর মনে শান্তি নেই। তিনি বললেন, যাও খোকা! তুমি আচার্যের কাছে যাও।
খাণ্ডব বন পার হতে সময় লাগল না বেশি। হস্তিনার কাছাকাছি পৌঁছে কুরুজঙ্গলের সীমানায় একলব্য দেখলেন একটি অস্ত্রবাজার। সে সবের নিয়ন্ত্রণ করেন বৈশ্য কুলপতিরা। বশিষ্ঠের বৈবাহিক চিত্রমুখ নামের এক বৈশ্য পুরুষের পৌত্র অনন্তমুখ সেই বাজারের মালিক। একলব্য তাঁর তীরধনুক দেখালেন অনন্তমুখের প্রহরীদের। প্রহরী আবার ডেকে আনল দক্ষ বাজারুদের। তারা সব পরীক্ষা করে বলল, অর্ধেক তীরধনুক একলব্য এখানে বেচতে পারবেন, বাকি অর্ধেক তাদের দিতে হবে—এটাই বাজারের নিয়ম।
একলব্য একটু রুষ্ট হল বটে কিন্তু তখনকার মতো মেনে নিল। তার বসার জায়গা হল বাজারের ম্লেচ্ছপট্টিতে। সেখানে বেশির ভাগ লোকের ভাষা বুঝতে পারে না একলব্য। মন দিয়ে শুনলে অবশ্য বোঝা যায়। ম্লেচ্ছপট্টিতে বসে ছুরি বিক্রি করছিল একজন প্রৌঢ় কামার। সে একলব্যকে জিজ্ঞাসা করল, কী ভায়া এই বাজারে নতুন নাকি?
একলব্যের ভাষার সঙ্গে তার কথার খুব মিল। তার পাশের ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসল সে। প্রৌঢ় বলল, তা কত নিল তোমার কাছ থেকে, অর্ধেক? নতুনে তাই নেয়। অনন্তমুখের বিরাট হাঁ।
একলব্য হেসে বসল কামারের পাশে। ধনুকের ফলার ধার দেখতে দেখতে একলব্য জিজ্ঞাসা করে, তা এই অনন্তমুখ লোকটা কে খুড়ো?
“সে অনেক কাহিনি রে ভাইপো! এই লোক হল রাজমাতা মৎস্যগন্ধার আগের পক্ষের আত্মীয়।”
মৎস্যগন্ধা নামটা খুব চেনা চেনা লাগল। তিনিই তো এখন রাজমাতা। তাঁর পৌত্র ধৃতরাষ্ট্র এখন হস্তিনার রাজা।
কামার বলে, অনন্তমুখ সত্যবতীর আগের পক্ষের বর পরাশরের মামাতো ভাই। বয়স হয়েছে ভালোই। তার ছেলে দুর্মুখ এখন বাজার সামলায়। সে আবার সম্পর্কে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের ভাই কিনা!
একলব্য ভাবে, এ তো ভারি জটিল অঙ্ক। সে কথা বাড়ায় না। বেশ কয়েকজন খদ্দের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল কিন্তু তার দিকে ভ্রুক্ষেপই করল না। একলব্য চুপচাপ বসে রইল। ওদিকে কামারের সব ছুরি ভুজালি বিক্রি হয়ে গেল। বাড়ি যাওয়ার আয়োজনের ফাঁকে কামার একটি আতা ফল দিল একলব্যকে। বলল, বাড়ির উঠোনে ফলেছে, তোকে দিয়ে গেলাম। এই আতা খুব ফলদায়ী, দেখিস কাল তোর নসিব খুলে যাবে।
একলব্য কামারকে বলল, ও খুড়ো একটা কথা ছিল।
“বল।”
“রাতটা তোমার বাড়িতে থাকতে দেবে?”
“না রে বাপ! আমার বাড়িতে সোমত্ত কন্যা আছে।”
0 comments: