1

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in






ওহ্‌ তুমহারী নজর নহী খঞ্জর থী
শায়দ যো মেরে জিসম্‌ মেঁ সমায়ী
অউর লহুকে ধব্বে লিয়ে
বাহর নিকল আই থী
---মখ্‌ফী ( Makhfi )
তোমার চোখের ইশারা যেন ছুরির কিনারা
যার আঘাতে আমার শরীরে বয় রক্তের ধারা
@Jharna (অনুবাদ)
.
উপরোক্ত শায়রীটির রচয়িতা অনেকের কাছেই এক অজানা- অচেনা কবির, যিনি কবি সমাজে পরিচিত ছিলেন মখ্‌ফী নামে, যার অর্থ রহস্যময় ( অথবা রহস্যময়ী, Mysterious)। এই কবি ছিলেন এক নারী এবং সেই নারীও আবার এমন একজন, যিনি ছিলেন শাহজাদী, সম্রাট আউরঙ্গজেবের কন্যা জেবউন্নিসা।
জেবউন্নিসার জন্ম ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে, তিনি ছিলেন দিল্লীর সম্রাট পিতা আউরঙ্গজেব ও তাঁর প্রথমা পত্নী রাবিয়ার কন্যা। যদিও কারো কারো মতে মায়ের নাম ছিল দিলরস বানু বেগম। পিতার অত্যন্ত প্রিয় সন্তান ছিলেন, কিন্তু সম্রাটের জীবনে কাব্য-সঙ্গীতের স্থান ছিল না। পিতার জ্যেষ্ঠ্য ভ্রাতা দারাশিকোর সংস্পর্শে জেবউন্নিসার কাব্যপ্রতিভা স্ফুরিত হয়। জেবুন্নিসার জীবনী সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। যদিও এটুকু জানা যায় যে জেবুন্নিসা সাত বছর বয়সে সমস্ত কোরান কন্ঠস্থ করে হাফিজ হয়েছিলেন এবং সেই উপলক্ষে সম্রাট আউরঙ্গজেব এক বিশাল দাওয়াতের ব্যবস্থা করেন। তাতে সম্রাটের সমস্ত সেনাধ্যক্ষ্য ও সেনারা দিল্লীর ময়দানে উপস্থিত ছিলেন। তিরিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা বিতরণ করা হয়েছিল গরীব-দুঃখীদের মধ্যে। শাহজাদী জেবুন্নিসা চারবছর আরবী,গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা অধ্যয়ন করেছিলেন এবং তাঁকে মহিলা-অধ্যাপক এই মর্মে ’মিয়াবাই’ (Miyabai) উপাধি দেওয়া হয়েছিল। শাহজাদী জেবুন্নিসা কোরানের টিকা ও ব্যাখ্যা করতেও পারদর্শিনী ছিলেন কিন্তু সম্রাট নিজে কাব্য ও সাহিত্যে কোন রুচি না রাখার জন্য অকস্মাৎ তাঁর সকল রকম অধ্যয়ন বন্ধ করে দেন। এমন কি অন্দরমহলেও এই সকল পাঠ বন্ধের নির্দেশ দেন।
শাহজাদী জেবউন্নিসা অল্পবয়সে আরবীতে এবং পরে পার্সী বা ফারসীতে লিখতে শুরু করেন। তাঁর শিক্ষক শাহ্‌ রুস্তম গাজী তাঁর কাব্য ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ও শাহজাদীর কবিতা (শায়রী) রচনা দেখে মুগ্ধ হন এবং সম্রাট আউরঙ্গজেবকে অনুরোধ করেন দেশের সমস্ত বড় বড় কবিদের আহ্বান করে কবি-সম্মেলন প্রস্তুত করার জন্য। কবি সম্মেলনে জেবউন্নিসা অংশগ্রহণ করলে নিজ কাব্যপ্রতিভার প্রকাশ করতে পারবেন। সম্রাট কাব্য-সাহিত্যে রুচি না রাখলেও, অন্দরমহলে সাহিত্যচর্চা বন্ধের নির্দেশ দিলেও আশচর্যজনক ভাবে তাঁর প্রিয়তমা কন্যার জন্য এই কবি-সম্মেলনের অনুমোদন দেন। সে যুগের বিখ্যাত কবি ও শায়েরগণ তাতে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— কবি নাসির আলি,শায়াব, শামস্‌ আলি উল্লাহ, ব্রাহ্মিন এবং বেহ্‌রাজ। কথিত আছে, সিরহিন্দ এর কবি নাসির আলি ছিলেন কবি মক্‌ফির প্রতিদ্বন্দ্বী । নাসির আলি দিনে দিনে শাহজাদীর একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন।
রূপসী শাহজাদী বড় হয়ে উঠলে তাঁর বিবাহের প্রস্তাব আসে নানা স্থান থেকে। আউরঙ্গজেবের পিতা সম্রাট সাজাহানের ইচ্ছা ছিল জ্যেষ্ঠ্য সন্তান দাদা শিকোর পুত্র সুলেমান শিকোর সঙ্গে (যে কিনা জেবুউন্নিসার সম্পর্কে বড় ভাই, জ্যাঠার ছেলে), শাহজাদী জেবুন্নিসার বিবাহের। কিন্তু পিতা আউরঙ্গজেব দারার প্রতি ঈর্ষা এবং হয়ত দারা তাঁকে বধ করে সিংহাসন দখল করবেন এমনই ভীতি থেকে এই বিবাহ প্রস্তাব নামঞ্জুর করেন।
ইরানের সম্রাট দ্বিতীয় শাহ্‌ আব্বাসের পুত্র মির্জা ফারুকের কাছ থেকেও বিবাহ প্রস্তাব আসে। শাহজাদী পিতাকে অনুরোধ করেন তিনি যেন মির্জা ফারুক কে দিল্লী আসার অনুরোধ করেন, শাহজাদী তাঁর বিদ্যা-বুদ্ধির পরীক্ষা নিতে চান। এবারেও আশ্চর্যভাবে সম্রাট আউরঙ্গজেব তাঁর প্রিয় কন্যার অনুরোধ রক্ষা করেন এবং মির্জা ফারুক সম্রাটের অনুরোধে দিল্লিতে আসেন। দুজনের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। শাহজাদী জিজ্ঞাসা করেন তিনি কি চান?’
উত্তরে একটি শায়রীর মাধ্যমে মির্জা ফারুক তাঁর অভিলাষ ব্যক্ত করেন--
চাঁদও যার কাছে ম্লান
করতে চাই সেই সুধাপান
তুলে দাও আড়াল তোমার
অনুরোধ রাখো আমার।
(অনুবাদ-ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়)
স্পষ্ট ইঙ্গিত। শাহজাদী মির্জা ফারুকের ব্যবহারে সৌজন্য ও সম্ভ্রমের অভাব দেখে রুষ্ট হন এবং পিতাকে বলেন –মির্জা ফারুক বাবুর্চিখানা থেকে কি খাদ্য-পানীয় পেতে চান, তাঁকে যেন জিজ্ঞাসা করা হয়। ভেঙ্গে যায় বিবাহপ্রস্তাব। শাহজাদী কাব্যজগতে মনোনিবেশ করেন।
যদিও রূপসী শাহজাদী ওরফে কবি মখ্‌ফী ব্যঙ্গ করে তার উত্তর দিয়েছিলেন ---
.
আড়াল আমি তুলব না
হয়ত আমার রূপের ছটায়
বুলবুলও আর গাইবে না!
দেবী লক্ষ্মীর ভক্ত যারা
আমার রূপে কাঙ্গাল হয়ে
সেই পুরোহিতও স্তব করবে না!
তাই ঘোমটা আমি খুলব না।
(অনুবাদ-ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়)
.
পিতার অলক্ষ্যে বিভিন্ন কবিতার আসরে (মুশায়েরা ), কবি-সম্মেলনে শাহজাদী তাঁর যাতায়াত শুরু করেন এবং তাঁর যাতায়াত ছিল। কিন্তু সেই আসরে তাঁর পরিচয় ছিল কবি ‘মখ্‌ফী’ নামে। তিনি যে শাহজাদী জেবউন্নিসা এই পরিচয়ে তাঁকে কেউ জানত না। জানা যায় মির্জা গালিবের পূর্বে একমাত্র তাঁরই শের-শায়রী, গজল ইত্যাদি ইংরাজি, ফরাসী, আরবী ও অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়।
চোদ্দ বছর বয়স থেকেই তিনি গজল ও শের রচনা করেন। শের-শায়রী আসরে যাতায়াতের ফলে কয়েকবারই প্রেমে পড়েছেন কবি মখ্‌ফী। এমনই একবার এক আসরে বুন্দেলের ছত্রশাল মহারাজকে দেখেন জেবউন্নিসা। এই দেখা ভালোলাগায় পরিণত হয়। শের-শায়রী ভরা এক প্রেমপত্র পাঠান গোপনে এক সহচরীর হাত দিয়ে কিন্তু সেই গোপনীয়তা রক্ষিত হয়না, সহচরী ধরা পড়েন ও সম্রাটের কাছে তিরস্কৃত হন জেবউন্নিসা। এই ক্রোধের আরো একটি বড় কারণ ছিল ছত্রশালের সঙ্গে আউরঙ্গজেবের দীর্ঘদিনের শত্রুতা। এ যাত্রায় পিতার ক্রোধের সম্মুখীন হয়ে মখ্‌ফী নিজেকে সংবরণ করতে বাধ্য হন।
কিন্তু দ্বিতীয়বারের প্রেমও তাঁর সফল হয়না। এই দ্বিতীয় প্রেমিক ছিলেন স্বয়ং ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ। শিবাজীর শৌর্য, বীর্য, পৌরুষ, রাজ্য ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং একজন তুখোড় যুদ্ধবাজ সৈনিক হওয়ার কারণে শিবাজীর প্রতি জেবউন্নিসার মুগ্ধতার শুরু। একসময় তিনি সংবাদ পান শিবাজী আগ্রায় আসবেন তাঁর পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। শিবাজী আগ্রা আসার পথে বিভিন্ন স্থানে তুমুল সম্বর্ধনা লাভ করেন। আউরঙ্গজেব শিবাজীর এই জনপ্রিয়তায় ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হন। শিবাজী তাঁর রাজসভায় এসে আউরঙ্গজেবকে রীতিমত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করেন। শিবাজীকে দেখে জেবউন্নিসার আরো একবার প্রেমে পড়েন ও আগের মত আবার এক শের-শায়রী পূর্ণ পত্র প্রেরণ করেন শিবাজীর নিকট, কিন্তু এবারের দূত ছিলেন এক বিশ্বস্ত অনুচর। পত্র পৌঁছে যায় কিন্তু বলা বাহুল্য, শিবাজী তাঁর এই প্রেম প্রত্যাখ্যান করেন। শিবাজীর প্রেম প্রত্যাখ্যানে জেবউন্নিসা ভেঙ্গে পড়েন। সম্পূর্ণরূপে কাব্য ও সঙ্গীত রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।
পিতার অজ্ঞাতেই নানা মুশায়েরা ও কবি-সম্মেলনে শাহজাদী জেবউন্নিসা ওরফে কবি মখ্‌ফী কবিতার আনন্দ লাভ করতে থাকেন।
.
কিছুদিন পর কবিতা ও সঙ্গীতের আসরেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আর এক কবির, যাঁর নাম ওকিল খাঁ রাজী। তাঁরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হন ও পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু সম্রাট তা জানতে পেরে দিল্লীর সেলিমগড় দুর্গের পথে ওকিল খাঁকে হাতীর পদতলে পিষে মেরে ফেলার হুকুম দেন এবং ওকিল খাঁয়ের শব লাহোরের কোন এক স্থানে কবর দেওয়া হয়। ওকিল খাঁয়ের মৃত্যুর পর কবিতার পুজারী প্রিয়তমা কন্যা জেবউন্নিসাকে সেলিমগড় দুর্গেই বন্দী করেন পিতা আউরঙ্গজেব। বাকি জীবন তাঁর কাটে সেলিমগড় দুর্গের কারাগারে।
শাহজাদী জেবউন্নিসা কারাগারে বহু শের-শায়রী ও গজল রচনা করেন। রচনার সংখ্যা প্রায় পাঁচহাজারের মত। তাঁর এইসব গজল, শের-শায়রী, রুবাইয়া একত্রিত হয়ে ‘দিওয়ানেঁ মখ্‌ফী’ নামে সংকলিত। জেবউন্নিসা আরো একটি কারণে স্মরণীয়, বিধর্মী হলেও তিনি এইসময় কৃষ্ণভক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর কারাগারের রচনাগুলি অধিকাংশই কৃষ্ণ সংক্রান্ত অথবা কৃষ্ণকে উৎসর্গীকৃত। বহু রচনাতেই কৃষ্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়।
একটি শায়রীতে তিনি লিখছেন--
.
থাকতে চাই এই মন্দিরেই
আমি এখানেই থাকতে চাই।
যেখানে আমি নত হই,
সেখানে আমি শায়িত হব
আমার সুখ, আমার শান্তি লব।
(অনুবাদ—ঝর্না চট্টোপাধ্যায়)
.
শাহজাদী জেবউন্নিসা সেলিমগড় কারাগারেই মৃতুবরণ করেন ইংরাজি ১৭০১ সালের ২০শে মে।
কবি মক্‌ফি ছিলেন প্রেমের পূজারী। আজীবন তার সপক্ষে তিনি রচনা করেছেন তাঁর শায়রী। অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সুফীবাদে বিশ্বাসী। তাই পিতার মত ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সঙ্কীর্ণতা কবি মখ্‌ফীর ছিল না। ধর্মের চেয়েও তাঁর কাছে বড় ছিল প্রেম তথা মানবপ্রেম। তাই তিনিই বলে যেতে পেরেছেন---
.
আমি মুসলমান নই
আমি শুধু প্রেমের পুজারী
তাঁরই কাছে নত হই
তাঁকেই আমি পূজা করি।
আমি ব্রাহ্মণও নই আর
উপবীতকে ভাসিয়ে দিয়ে
প্রেম-কুন্তলে বেঁধেছি কন্ঠহার।
(অনুবাদ—ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়)
.
কাব্যপ্রেমিক জেবউন্নিসা ওরফে কবি মখ্‌ফীর মৃত্যু হয়, কিন্তু তাঁর রচনার মৃত্যু হয়না। তাই বহুযুগ পরেও তিনি স্থান পান শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পী-হৃদয়ে। শাহজাদী-কবির একটি প্রতিকৃতি তিনি অঙ্কন করেন যা আমাদের কাছে এক পরম প্রাপ্তি।


*** রচনায় ব্যবহৃত শাহজাদী-কবি জেবউন্নিসা ওরফে মখ্‌ফীর প্রতিকৃতিটির শিল্পী— অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।

1 comment:

  1. কার্যকরী তথ্যসমৃদ্ধ অসাধারণ একটি লেখা । পড়ে সমৃদ্ধ হলাম

    ReplyDelete