0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















( ৩)

তবে এযাবৎকালে বল্লাল সেন, ও লক্ষ্মণ সেন ব‍্যতিরেকে সেন বংশীয় তাবৎ নৃপতিদের নাম আর কেউ তেমন জানে না।

মোগল আমলের পর বর্তমানে এখানে যে সেন বংশীয় শাসকেরা বংশগৌরবের ক্ষীণমাত্রায় বহু রাজনৈতিক পালাবদলের পর (এতদিনে প্রায় পাঁচটি শতাব্দী) একেক জন কেবল কয়েকটি পরগণার সামন্তপ্রভুর মর্যাদায় কেবল অধিষ্ঠিত।

ইতিহাস বড় নির্মম হস্তে নতুনের অভিষেক ঘটাতে চিরদিন উৎসাহী। এক্ষেত্রেও তার অন‍্যথা হয়নি।

....

আজ ভাবতে বসলে অবাক হতে হয় যে গোলকপতির পিতা ও পিতৃব‍্যরা তাহলে লক্ষ্মণ সেনের অন্যতম পত্নী তন্দ্রাদেবী বা তারাদেবীর গর্ভজাত কেশব সেনের বংশজ।

এই কেশব সেনের হাতেই বঙ্গ সাম্রাজ‍্যের ভার তুলে দিয়ে হিমালয় গমন করেন তাঁর অগ্রজ মাধব সেন।

এসব কথা যেমন উত্তরাখণ্ডের আলমোড়ার কোটেশ্বর মন্দির গাত্রের শিলালিপিতে মাধব সেনের নানা কীর্তির সাথে কথিত আছে আবার তেমনই লেখা আছে যে ধর্মরক্ষার্থে দূর্গম হিমালয়ের পাদদেশে তিনি এক রাজত্বের প্রবর্তন করে বঙ্গাল থেকে অনেক কুলীন এবং শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিকে সঙ্গে করে আনয়ন করেছিলেন।

এ যেন ঠিক যেমন রাজা আদিশূর কর্তৃক গৌড়-বঙ্গে একদা কূলীনদের বাসযোগ‍্য ভূমি দান করে বসতির কাজে সহায়তাকে যেন মনে করিয়ে দেয়।

....

আচার্য‍্যদেব দিনান্তে চতুষ্পাঠীর পাট চুকলে সেদিন সন্ধ‍্যায় গৃহের চাতালে উপবিষ্ট হয়ে একটি ধূমায়িত হুঁকোয় পরম তৃপ্তিতে টান দিতে দিতে এসব কথিকার অবতারণা করে গোলকপতিকে সস্নেহে বিশদে বুঝিয়ে বলেছেন।উনি বাল‍্যকালে স্বয়ং যুবরাজ তথা তার পিতৃদেবের একজন ঘনিষ্ঠ সুহৃদ ছিলেন বলে এই বাৎসল‍্যভাষণে কারণটি আজ স্পষ্ট । যদিও সেদিন বর্ণাশ্রমের বিভেদ ওঁদের দুজনের মধ‍্যে বিদ্বেষের শিকড় প্রোথিত করেনি।

......

সেইসব কাহিনী শুনতে শুনতে সেদিন সে ভেবেছিল, আগেকার দিন হলে সেও যদি মূরাতনয় চন্দ্রগুপ্তের মত ভারতেশ্বর হতে পারতো, তাহলে সেদিনের উন্মীলনের পর্যায়ে পরমভট্টারক মহামহিম গোলকপতিরও নিশ্চয় একজন চাণক‍্যও থাকত। সে জানে সেসব সত‍্যি হলে আচার্য‍্য সর্বজ্ঞ শাস্ত্রী হতেন তাঁর সেই গূহ‍্য মন্ত্রণাদাতা ও নবভারতের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক স্বরূপ!

হায় রে অদৃষ্ট! আজ এসব এক অলীক কল্পনামাত্র!

.......

গোলকপতি আর অবস্থান্তর না দেখে এক আশ্বিনের শেষে অবশেষে পাড়ি দিল বর্ধমানের উদ্দেশ‍্যে। তার সাথে এখন কেবল মাত্র কয়েকটি জিনিস সহ একমাত্র জীবন্ত সম্পদ তার স্ত্রী লক্ষ্মীমণি। তার বয়স এখন সবে পনের ছাড়িয়েছে। পতিগতপ্রাণা নিতান্ত এক সহজসরল গ্রাম‍্য বালিকা সে। ক্ষত্রিয়ের কূলে তার জন্ম হলেও সে বাল‍্যে পিতৃমাতৃহীন। ফলতঃ মাতুলালয়ের আশ্রয়ে তার বড় হয়ে ওঠা। মোটা অর্থ বরপণের বিনিময়ে আদি সেন বংশজ জামাতা লাভের সৌভাগ‍্য তাদের কাছে নেহাতই দিবাস্বপ্নমাত্র। তবে দৈবযোগ বলে তো একটা বিষয় আছে! প্রবীণ পন্ডিত আচার্য‍্য সর্বজ্ঞ শাস্ত্রীর সহযোগিতায় তার মাতুল ক্ষেত্রনাথ বিড়াল পার করার উপক্রমে বিগত সৌরবর্ষের জৈষ্ঠ‍্যমাসে তাঁর পুত্রসম শিষ‍্য 'গোলকপতি'র সাথে তার এই বৈবাহিক সম্পর্কটি বাস্তব রূপ পেয়েছে।তবে পঞ্চদশী হওয়া সত্ত্বেও এই একটি বৎসরে তার গর্ভে কোন কোরক সম্ভাবনা সহ উঁকি দেয়নি বলেই এই বিপদের দিনে দম্পতিটি যেন একটু স্বস্তির সাথেই ভূমিত‍্যাগ করতে সক্ষম হল।

....

বর্ধমানের মহারাজা এখন স্বয়ং তেজচাঁদ। তাঁর আটজন স্ত্রী থাকেন রাণী মহলে। তেজচাঁদের পর কে রাজা হবেন তা নিয়ে রাজবাড়ির অন্দরে রাজনীতি তুঙ্গে। রাজার একের পর এক বিয়ে হলেও সন্তান একটিই। সম্ভাব‍্য রাজপুত্রটি হলেন প্রতাপচাঁদ। সে এখন বালক বয়সী। তবে তেজচাঁদের পিতা রাজা রাজবল্লভ সেন বহুদিন গত হলেও তাঁর অন্তঃপুরস্থিত মহারাণী বিষেণকুমারীর বা বিষ্ণুকুমারীর কাছে সব বর্ধমানবাসী চিরদিন ঋণী হয়ে থাকবে। তিনি দক্ষ হাতে রাজত্বের ভার না নিলে এবং পুত্র তেজচাঁদের সঙ্গে পরবর্তীকালে যৌথভাবে সেই রাজত্ব রক্ষার উপায় অবলম্বন না করলে এই বিশাল সম্পত্তির অনেকখানিই শেষ হয়ে যেত।

...

সুদূর পঞ্জাব থেকে এই বঙ্গালে ভাগ‍্যাণ্বেষণে আসা ক্ষত্রিয় পরিবারটি যে আজকাল কয়েক পুরুষ ধরে বর্ধমানের মত জনপদের সর্বেসর্বা তা যেন এক নিছক রূপকথা।

এই রাজপরিবারের এখন যে এত রমরমা তার জন‍্যে অবশ‍্য এই রমণীটিই দায়ী। ইংরেজদের সাথে পা'এ পা দিয়ে তিনি নিজস্ব প্রতাপ অক্ষুণ্ণ রেখেও অনেক জনহিতকর কাজের সাথে বর্ধমানকেও যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী করে তুলেছেন।

বর্তমানে বর্ধমান শহরের অনেক দেবালয়, পুষ্করিণী এই মহারাণী বিষ্ণুকুমারীর হাতেই স্থাপিত। আগামীদিনের ইতিহাস সাক্ষী থাকবে যে ঠিক এঁরই মত আরেকজন বিধবা, তেজস্বী ও বিবাহসূত্রে ধনবতী রমণীরত্ন আগামী একশ বছরের মধ‍্যে সুরেশ্বরী গঙ্গার অন‍্যপ্রান্তে আবির্ভূত হবেন এবং তাঁর বদান‍্যতায় জানবাজার থেকে উত্তরে দক্ষিণেশ্বর সহ ভবিষ‍্যতের কিছু সাধারণ জনপদগুলিকে কালাকালের মহাফেজখানায় দুর্মূল‍্য করে দিয়ে যাবেন।

0 comments: