0

গল্প - মনোজ কর

Posted in






অশ্ববাহিত রাজরথে যাত্রা করিয়া জনপদের পর জনপদ, গ্রামের পর গ্রাম অতিক্রম করিতে করিতে বঙ্গভূমির প্রান্তদেশে এক জনপদের পার্শ্ববর্তী রাজপথে দাঁড়াইলেন কবিকূলচূড়ামণি শিখরাদিত্য। এই জনপদের নিকট দাঁড়াইবার কোনও পূর্বনির্দিষ্ট অভিপ্রায় তাঁহার ছিলনা। রাজকবির ভ্রমণপরিকল্পনার অভ্যন্তরেও এমন কোনও জনপদের উল্লেখ ছিল না। সহসা তবে কী কারণে রাজকবির এই ইঙ্গিতাদেশ? অনুচরবর্গ তাঁহার শারীরিক কোনও প্রয়োজনের কথা অনুমান করিয়া তাঁহার সম্মুখে আসিয়া লক্ষ্য করিলেন সেইরূপ কোনও লক্ষণ নাই। কিন্তু তাঁহার অঙ্গুলিভঙ্গিমা ইঙ্গিত করিতেছে যে এইস্থানে সকলে যেন একটু অপেক্ষা করেন। তাঁহার দৃষ্টি স্থির এবং দূরে একটি শ্যামল ভূখন্ড এবং তাহার পার্শ্ববর্তী এক নির্মল জলাশয়ের প্রতি আবদ্ধ বলিয়া প্রতীতি হইতেছে। একান্তমনে স্থিরদৃষ্টিতে এমন একাগ্রচিত্তে কী অবলোকন করিতেছেন কবিশ্রেষ্ঠ শিখরাদিত্য? এই দৃশ্য কি তাঁহার অন্তরে অতীত কোনও স্মৃতিকে জাগ্রত করিল? না কি তিনি এমন কিছু অবলোকন করিতেছেন যাহা অনুচরবর্গের দৃশ্যগোচর হইতেছে না? তাঁহাকে এই প্রশ্ন করিবার মতো কেহ নাই, থাকিলেও এই মুহূর্তে তাঁহার মানসিক একাগ্রতা বিঘ্নিত করিবার সাহস কাহারও নাই।

রাজকবির দৃষ্টির সমান্তরালে দৃষ্টিনিবদ্ধ করিলে যাহা প্রতীয়মান হয় তাহা এইরূপ। রাজপথের সীমানার পার্শ্বেই এক পরিখা। সেই পরিখার জল বোধহয় প্রয়োজনে কৃষিকর্মে ব্যবহৃত হয়। সতত প্রবহমান এই জলধারা নানা ছোট ছোট শাখা-উপশাখায় বিভক্ত হইয়া অভ্যন্তরস্থ কৃষিজমির পার্শ্ববরাবর সম্বৎসর প্রবাহিত হয়। দিগন্তব্যাপী এই শ্যামলিমার মধ্যে স্থানে স্থানে কতিপয় নারিকেলকবৃক্ষ উন্নতশিরে আপন ঔদ্ধত্য ঘোষণা করিতেছে যেন। পরিখা হইতে বেশ কিছুটা দূরে কিন্তু মনুষ্যদৃষ্টির গোচরে বামপার্শ্বে এক কাকচক্ষুবৎ নির্মল সলিলধারার পুষ্করিণী। সেই পুষ্করিণীর দুইপার্শ্বে নিপুণভাবে পরিকল্পিত সযত্নরোপিত মর্মরিত তরুশ্রেণী। সে যেন বিশ্বশিল্পীর এক অপরূপ শিল্পকর্ম। তৃতীয় পার্শ্বে উন্মুক্ত শ্যামলিমা দিগন্তে বিলীন। চতুর্থপার্শ্বে দীর্ঘপ্রাকারবেষ্টিত এক মর্মরসৌধ। সেই হর্মাভ্যন্তরে কোনও বিশিষ্ট রাজকর্মচারি বসবাস করেন বলিয়া মনে হয়। প্রাকারপ্রান্ত হইতে শ্বেতপাথরের সোপানশ্রেণী শুরু হইয়া দীর্ঘিকার অভ্যন্তরে শেষ হইয়াছে।

আরও গভীরভাবে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলে দেখা যাইবে ঐ পুষ্করিণীর জল কেন্দ্র হইতে তরঙ্গিত হইয়া চতুর্দিকে বিস্তৃত হইতেছে। কী উপায়ে এই তরঙ্গ সৃষ্টি হইতেছে তাহার কারণ অনুসন্ধানে রাজকবি আরও তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখিতে পাইলেন যে সোপানশ্রেণীর নিম্নপ্রান্তে একটি সোপানের উপর বসিয়া এক কিশোর পুষ্করিণীগর্ভে একের পর এক শ্বেতলোষ্ট্র নিক্ষেপ করিতেছে। কিশোরের বয়ঃক্রম সপ্তদশ অথবা অষ্টাদশ হইবে।বর্ণ তপ্তকাঞ্চনের ন্যায় উজ্জ্বল। ঋজুদেহ, বলিষ্ঠ গড়ন। উন্নত ললাট, বুদ্ধিদীপ্ত আয়ত চক্ষু। মুখমন্ডলে বিশেষত কপোলে কারুণ্য এবং মমতা মাখা। শ্মশ্রুগুম্ফের কোমল আভাসে সদ্য প্রস্ফুটিত পৌরুষ। পরণে শুভ্রবাস, গাত্রের পীত উত্তরীয় মৃদুমন্দ বাতাসে উড্ডীন। সময়কাল বসন্ত বলিয়া বোধ হয়। এই কিশোরের নাম কুন্তলনারায়ণ। কুন্তলনারায়ণের পিতা এই রাজত্বের রাজকোষাগারের প্রধান শঙ্করনারায়ণ। রাজার অর্থনীতিসংক্রান্ত যে কোনও সিদ্ধান্ত তাঁহার পরামর্শ ব্যতীত চূড়ান্ত হয়না। কিশোর কুন্তলনারায়ণ পিতার প্রশিক্ষণে ক্রমশ অর্থনীতিতে পারদর্শী হইয়া উঠিতেছে। বয়ঃসন্ধির অনিবার্য প্রভাবে কুন্তলনারায়ণের চিত্ত তাহার জীবনের প্রথম প্রেমানুভূতিতে আলোড়িত। তাই প্রত্যহ গোধূলির প্রারম্ভে সকলের অজান্তে এই নির্মল দীর্ঘিকাসংলগ্ন সোপানশ্রেণীতে তার আগমণ।

কিশোর কুন্তলনারায়ণের চিত্তচাঞ্চল্যের একমাত্র হেতু যে কে তাহা কবিচূড়ামণির তীক্ষ্ণদৃষ্টি অতিক্রম করিতে পারিল না। তিনি স্পষ্টই দেখিতে পাইলেন কাহার আকর্ষণে কিশোর কুন্তলনারায়ণেরর হৃদয় উৎকণ্ঠিত হইতেছে, দৃষ্টি চঞ্চল হইয়া উঠিতেছে। সোপানশ্রেণীর একেবারে ঊর্দ্ধভাগে যে স্থান হইতে এই সোপান শুরু হইয়াছে ঠিক সেই স্থানে দন্ডায়মানা ত্রয়োদশ অথবা চতুর্দশবর্ষীয়া এক বালিকা। পরণে নীলবস্ত্র, ঊর্ধাঙ্গে বাসন্তী উত্তরীয় , মণিবন্ধে কঙ্কণবলয়, কন্ঠে স্বর্ণহার। কেশপাশ সুচারুরূপে অর্ধপ্রস্ফুটিত পদ্মের ন্যায় বদ্ধ। আনত গ্রীবা, নয়নকোণে অশ্রুর আভাস, অধরোষ্ঠ কম্পমান। পশ্চাৎবর্তী হইবার নিমিত্ত বালিকা কিশোর কুন্তলনারায়ণের দৃষ্টিগোচর হইতেছে না। কিন্তু অশ্বশকট হইতে রাজকবি এই দৃশ্য পরম কৌতুকের সহিত উপভোগ করিতেছেন। তাঁহার অনুচরবর্গ তাঁহার এই সহসা গতিরুদ্ধ হইয়া দিগন্তে দীর্ঘক্ষণ দৃষ্টিনিক্ষেপ করিবার অন্তরালবর্তী গূঢ় রহস্য উন্মোচনে অপারগ হইয়া কিঞ্চিৎ হতাশাগ্রস্ত সে কথা বলা বাহুল্য। কিশোর কুন্তলনারায়ণের অগোচরে অতি সন্তর্পণে বিনা পদশব্দে ঐ বালিকা যে সোপানে কুন্তলনারায়ণ উপবিষ্ট সেই সোপানেই কুন্তল্নারায়ণ হইতে কিঞ্চিৎ দূরত্ব রাখিয়া উপবেশন করিল।বালিকা নিক্ষিপ্ত আর একটি লোষ্ট্র পুষ্করিণীতে আর একটি তরঙ্গ সৃষ্টি করিল। বেশ কয়েকটি আত্মমগ্ন মুহূর্ত অতিক্রম হইবার পর কুন্তলনারায়ণের দৃষ্টি ঐ বালিকার উপর পতিত হইল। কিঞ্চিৎ চমকিয়া কুন্তলনারায়ণ বালিকার নিকট সরিয়া আসিল। এই বালিকার নাম সোমদত্তা। সোমদত্তার পিতা রাজপন্ডিত ধর্মাচার্য মুরারীদেব। এই রাজত্বের পন্ডিতকুলশিরোমণি। রাজসভায় রাজসিংহাসনের পার্শ্বেই তাঁর স্থান। কিশোর কুন্তলনারায়ণ আর সোমদত্তার মধ্যে নিম্নগ্রামে কথোপকথন শুরু হইল। সেই কথোপকথন রাজকবির কর্ণগোচর না হওয়ায় তিনি পুনরায় যাত্রা শুরু করিবার আদেশ দিলেন। কবিশ্রেষ্ঠের এই অদ্ভুত কর্মকান্ডে ক্ষণিক বিস্মিত ক্ষণিক বিরক্ত হইয়া অনুচরবর্গ পুনরায় যাত্রা শুরু করিল। কে জানে পথিমধ্যে এই দৃশ্য রাজকবিকে কিয়ৎক্ষণের জন্য তাঁহার কৈশোরে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিল কি না ?



কুন্তল আর সোমার কথাবার্তা কানে আসার আগে পর্যন্ত ওদের দুজনকে পুকুরঘাটে দেখে এমনই একটা দৃশ্যকল্প আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। সময়টা সত্তরের দশকের শুরু তবু অনাদি অনন্তকাল ধরে কিশোরপ্রেমের এই চিত্রটি কি একই? সে প্রেম পরিণতি পাক বা না পাক আম, জারুল আর বড় বড় ঘাস লতাপাতায় ঘেরা, শ্যাওলাধরা ভাঙ্গা শানবাঁধানো পুকুরঘাটের সিঁড়িতে বসে খেলাধুলো সেরে শেষবিকেলে বাড়ি ফেরার আগে কিশোরপ্রেমের এই কাহিনী আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। এর কোনও ব্যত্যয় নেই। নিষ্পাপ কিশোরপ্রেম বোধ হয় একমাত্র সুকুমার অনুভূতি যা কালগর্ভে বিলীন হয়ে যায়নি। শত আঘাত এবং ব্যর্থতা সত্ত্বেও নিষ্কলুশ এই প্রেম আজও আপন মহিমায় ভাস্বর। ওরা আমাকে দেখতে পাচ্ছেনা কিন্তু আমি ওদের দেখতে পাচ্ছি। আমি বসে আছি ওদেরই পাশে সামান্য দূরত্ব রেখে।

তুই শীতের ছুটিতে এখানে থাকবি না?

না, কী করব? আমরা আর মাসিরা এবার শীতের ছুটিতে একসঙ্গে দেওঘর বেড়াতে যাব। বাবা আর মেসোমশাই আগে থেকে সব ঠিক করে রেখেছে। পরীক্ষা শেষ হলেই যাওয়া। ১লা জানুয়ারি ফেরার কথা।

তার মানে পুরো ছুটিটা তুই বাইরে থাকবি? আমরা যে অত প্ল্যান করলাম তার কী হবে?

তোমার বাবাকে বলোনা আমার বাবার সঙ্গে কথা বলতে। তোমরাও তো যেতে পারো আমাদের সঙ্গে।

যাঃ, তা আবার হয় নাকি? বাবার ব্যাঙ্কে খুব কাজের চাপ। বছরের শেষে বাবা কোনও দিন ছুটি পায়না। অ্যানুয়াল ক্লোসিং। ওসব তোর মাথায় ঢুকবে না।

জানি না , আমার একদম ভাল লাগছে না।

মিথ্যে কথা বলিস না। সবাই মিলে বেড়াতে যাবি। কত মজা, তাই না? তোর মত তোর বাবারও স্কুল ছুটি একমাস। আমারও যদি এরকম হত কী ভালো যে হত। একসঙ্গে বেড়াতে যেতাম আমারা দু’জনে ।

তোমাকে ছাড়া আমার একটা দিনও ভাল লাগে না।

সেতো আমারও। কিন্তু কেঁদে আর কী করবি? চ’ বাড়ি যাই। সন্ধ্যে হয়ে গেল।

দু’জনে উঠে পড়ে। একজন আরেকজনের হাত ধরে আস্তে আস্তে মাঠের পথ ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে আমার দৃষ্টিপথ থেকে বিলীন হয়ে যায় ওরা পথের শেষপ্রান্তে। ওখানেই ওদের বাড়ি। প্রায় পাশাপাশি। তিন চারটে বাড়ি ছাড়াছাড়ি। ছোটবেলা থেকেই ওরা একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে। ছিল খেলার সাথী এখন কালের অনিবার্য নিয়মে বয়ঃসন্ধির প্রেম ওদের আরও গভীরভাবে কাছে টেনে রেখেছে। দু’টি জীবন যেন একই- দ্বন্দ্বহীন, দ্বিধাহীন, নির্মল। একজন আরেকজনকে চোখে হারায়। যতক্ষণ জেগে থাকে একে অপরকে দেখার জন্য ব্যাকুল। নিদ্রায় একজন আসে আরেকজনের স্বপ্নে।


সময়কাল চল্লিশের দশকের শেষাশেষি। ভারতবর্ষ সবেমাত্র স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় কফিহাউসের আড্ডায় তখন ছাত্ররা ছাড়াও বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির আনাগোনা। রাজনীতি, সংস্কৃতি , সাহিত্য চর্চার প্রাণকেন্দ্র তখন কফিহাউস। সেই কফিহাউসের কোনের দিকের একটা টেবিলে তিনবন্ধুকে প্রায়ই দেখা যেত। মফঃস্বলের ছেলে তিনজনেই। প্রেসিডেন্সির ছাত্র। বেশ প্রাণখোলা, উজ্জ্বল। রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মতবাদের ভিন্নতা সত্ত্বেও তিনজনের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন নিবিড়। চায়ের টেবিলে তুফান তোলা তর্কের পরেও তিন বন্ধু একসঙ্গেই বাড়ি ফিরতো। ওদের বন্ধুত্বের শুরু স্কুলজীবন থেকে। তিনজনেই পড়াশুনায় বেশ ভাল। তিনজনে মিলে যুক্তি করে স্কুলজীবনের পর একসঙ্গেই প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হলো। কফিহাউসের প্রত্যেক টেবিলেই বিতর্কের ঝড়। কচিৎ কদাচিৎ দু-একজন প্রেমিক প্রেমিকা যে নিচু গলায় প্রেমালাপ করার চেষ্টা করেনা তা নয় তবে নিরন্তর উচ্চগ্রাম তর্ক আর আলোচনায় এখানে নৈঃশব্দের প্রবেশ নিষেধ । কে যে কী বিষয়ে আলোচনা বা তর্ক করছে তা দূর থেকে শোনার বা বোঝার কোনও উপায় নেই। তাই কাছে গিয়ে শুনতে হবে এই মুহূর্তে তিনবন্ধু কী নিয়ে তর্কে মেতেছে। হাত পা নাড়ার বহর দেখে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছেনা যে তিনজনের মধ্যে দু’জনে বেশ উত্তেজিত। কাছে গিয়ে মন দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার আগে ওদের সম্বন্ধে একটু জেনে নিই। ওদের মধ্যে বেশ ফর্সা, লম্বা, রোগামতন ছেলেটা অর্থনীতির ছাত্র। ওর নাম অসীম। ছেলেবেলা থেকেই পড়াশুনায় ভালো। সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। যে মফঃস্বল এলাকায় ওদের বাস সেখানকার অনেক জায়গা জমির মালিকানা ওদের পরিবারের। বড় একান্নবর্তী পরিবার। ঐ এলাকায় অনেক দানধ্যান আছে ওদের। পুরনো আমলের তিন মহলের বাড়িতে প্রায় পাঁচ-ছটি পরিবার একত্রে বসবাস করে। জমি জমা পুকুর ছাড়াও সব কাকা জ্যাঠাদের কিছুনা কিছু ব্যবসা। ঐ এলাকার গভীর নলকূপ, চাষের জমির মধ্যে দিয়ে যাবার জন্য চওড়া উঁচু রাস্তা এমনকি একটা ছেলেদের আর একটা মেয়েদের স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছে ওদের পরিবার। গ্রামের সার্বজনীন দুর্গাপুজো, বিজয়া সম্মেলন, যাত্রা থিয়েটার এসবই হয় অসীমদের বাড়ির দালানে। উঁচু বাঁধানো পুজোমন্ডপ আছে অসীমদের বাড়িতে। সেখানেই দুর্গাপুজো হয় প্রতিবছর। এলাকা আর বাড়ি মিলিয়ে একটাই পুজো। খুব ধুমধাম, খাওয়া দাওয়া পুজোর ক’দিন। অসীমের ছোট কাকা মহিম ছিলেন ওর বাবা জ্যাঠাদের মধ্যে একটু অন্যরকম। মহিম বিয়ে থা করেননি। পড়াশুনা এবং খেলাধুলোয় এলাকার সেরা। কিন্তু পারিবারিক সম্পত্তি আর ব্যাবসার থেকে সম্পূর্ণভাবেই নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। জীবনের প্রায় বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামে । সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বাস করতেন বলে ব্রিটিশ পুলিশের কুনজরে পড়েছিলেন। বেশিরভাগ সময় বাধ্য হয়েই এলাকাছাড়া থাকতে হত। লুকিয়ে চুরিয়ে মাঝে মাঝে বাড়ি আসতেন। অসীমের স্পষ্ট মনে পড়ে অনেক রাতে সারা মাথায় মুখে কাপড় জড়িয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ঠাকুরমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। বাড়ির অন্যসকলের তখন ঘর থেকে বেরুনো বারণ। বড় জ্যাঠামশাই হাতে বল্লম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন সদর দরজায়। পিছনের দরজায় লাঠি হাতে বাবা। ছোট্ট অসীম আর ওর মা জানলার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে দেখেছিল ঠাকুরমা অত রাত্রে কাছে বসিয়ে ছোটকাকাকে নাড়ু , মিষ্টি ,ফল খাওয়াচ্ছেন। অসীম স্পষ্ট দেখেছিল ছোটকাকার জামার পকেট থেকে উঁকি মারছে রিভলভারের নল। ঠাকুরমাকে প্রণাম করে নিঃশব্দে দ্রুতপদে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাবার সঙ্গে ফিসফিস করে দু চারটে কথা বলে অন্ধকারে মিলিয়ে যেত ছোটকাকা। ছোটকাকা চলে গেলে ঠাকুরমার ঘরে লন্ঠনের আলো কমিয়ে সারারাত বসে থাকত বাবা আর জ্যাঠামশাই। কাঁদতে কাঁদতে প্রায় ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়ত ঠাকুরমা। ঠাকুরমা ঘুমিয়ে পড়লে তবেই শুতে যেত বাবা আর জ্যাঠামশাই। তারপর হঠাৎ একদিন খবর এল কোলকাতার এক গুপ্ত আস্তানা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ছোটকাকাকে। বোমা মামলার আসামি সাব্যস্ত হওয়ায় দ্বীপান্তর হয়ে গেল ছোটকাকার। কয়েকবছর আগে বাড়ি ফিরেছে ছোটকাকা। শরীরের সেই তেজ, চোখের সেই ঔজ্জ্বল্য, গতির সেই ক্ষিপ্রতা তার আর কিছুই নেই ছোটকাকার মধ্যে। কিন্তু মস্তিষ্ক এখনও সতেজ আর সক্রিয়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যে পথে এল সে পথ যে ভুল ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে সে কথার ব্যাখ্যা শোনায় পরিচিতদের। কিন্তু জনসমক্ষে রা কাটতে পারবে না সেই সর্তেই ছাড়া পেয়েছেন ছোটকাকা। অসীমের কাছে এই ছোটকাকাই আদর্শ। ছোটকাকার মত অসীমও বিশ্বাস করে রাতের অন্ধকারে সকলের আড়ালে মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষের উপস্থিতিতে যে স্বাধীনতা আমরা পেলাম তার পিছনে লুকিয়ে আছে গভীর কোনও ষড়যন্ত্র। কিসের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা ভারতবাসীকে উপহার দিল ব্রিটিশ সরকার সে প্রশ্নের উত্তর অজানা কেবল নয় সেই প্রশ্নের অবতারণা দেশদ্রোহের সামিল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য যাঁরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করলেন, বন্দিদশায় কাটালেন জীবনের অধিকাংশ তাঁরা কি এই স্বাধীনতা চেয়েছিলেন? কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে যায় অসীম। কাছ থেকে শুনে বেশ বুঝতে পারছি কথাগুলোর মধ্যে শুধু ঝাঁঝ নয় ক্ষুরধার যুক্তি এবং ঐতিহাসিক তথ্যও আছে যথেষ্ট । মুখ লাল হয়ে গেছে অসীমের । একটু থেমে ঢকঢক করে একগ্লাস জল খেয়ে নেয় অসীম।

অসীমের ঠিক ডানদিকে যে শ্যামবর্ণ মাঝারি চেহারার কালোফ্রেমের চশমাপরা শান্ত ছেলেটি বসে আছে ওর নাম শ্যামল। শ্যামল আর অসীমের বাড়ি প্রায় পাশাপাশি। শ্যামলের বাবা ক্ষিতিমোহন ঐ এলাকার ছেলেদের স্কুলের হেডমাস্টারমশাই। স্কুলের চাকরি ছাড়াও ওনাদের বেশ কিছু ধানজমি, ডাঙাজমি এবং পুকুর আছে। জমির ধান আর পুকুরের মাছেই সারাবছর চলে যায় শ্যামলদের। অসীমদের মত জমিদারি না থাকলেও শ্যামলদের অবস্থা বেশ সচ্ছল। ক্ষিতিমোহনের পান্ডিত্য, সততা এবং পরোপকারের জন্য এলাকার সবাই খুব শ্রদ্ধা করে ওনাকে। কারুর কোনও পরামর্শের প্রয়োজন হলে দ্বারস্থ হয় হেডমাস্টারমশাইএর। ক্ষিতিমোহন মন দিয়ে শুনে একটা উপায় বলে দেন। মফঃস্বলের লোক খুব একটা কোর্ট কাছারি পছন্দ করে না। ভাইয়ে ভাইয়ে বা প্রতিবেশিদের সঙ্গে কিছু নিয়ে বিরোধ বাধলে হেডমাস্টারমশাই এর কাছে আসে দু’পক্ষ। সব শুনে ক্ষিতিমোহন যা বিচার করে দেন তাই খুশি হয়ে মেনে নেয় দু’পক্ষ । জল আর বেশিদূর গড়ায় না। শ্যামলের মা গ্রামের মহিলা সমিতির সভানেত্রী। মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অঞ্চলের বয়স্ক মহিলাদের একজোট করে নানারকম হাতের কাজ আর পড়াশোনা করান উনি। এলাকার মহিলাদের যে কোনও রকম অসুবিধা হলে ওনার কাছেই আসে। একেবারে নিজের বাড়ির লোকের মতই ওদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন উনি।

শ্যামলদের পরিবারের সঙ্গে অসীমদের পরিবারের নিবিড় সম্পর্ক। দু’টি পরিবার যেন একই। দু’টি যৌথ পরিবার মিলেমিশে এক বৃহৎ পরিবার। ক্ষিতিমোহন এবং ওনার স্ত্রী দু’জনেই কট্টর গান্ধীবাদি। জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থক। জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও ক্ষিতিমোহন সদস্যপদ নেননি। উনি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করেন যে একজন প্রধান শিক্ষকের উচিৎ স্কুলের উন্নতিবিধানে সবসময় নিজেকে নিয়োজিত রাখা এবং সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখা। তাই জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থক হলেও সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেননি। শ্যামলের জীবনের আদর্শ তার বাবা। সেও বিশ্বাস করে ছাত্রাবস্থায় সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করলে রাজনৈতিক কর্মকান্ড এবং পড়াশুনার মধ্যে সময় ভাগ করে নিতে হবে এবং তাতে পড়াশুনার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেও মহাত্মা গান্ধীর অনুগামী এবং রক্তপাতহীন বিপ্লবে বিশ্বাসী। তার মতে যে কোনও রকম হত্যাই অনভিপ্রেত। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। হত্যার বদলে অহিংস আন্দোলনই সাধারণ মানুষের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য। তাই বেশিরভাগ মানুষই মহাত্মার সমর্থক এবং বিনাযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষপাতি। স্বাধীনতালাভের আগের সভা সমিতিগুলিই তার প্রমাণ। মহাত্মা গান্ধীর ডাক দেওয়া আন্দোলনগুলিতে হাজার হাজার মানুষ যোগ দিয়েছে কিন্তু সশস্ত্র আন্দোলনে হাজার হাজার ছাত্র যুব সামিল হয়নি। সশস্ত্র আন্দোলনে বিশ্বাসী বেশিরভাগ নেতারাই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। কেউ কেউ রাজনৈতিক সন্ন্যাস নিয়েছেন। একথা সত্য যে সশস্ত্র আন্দোলনে নিজেদের জীবন রণক্ষেত্রে বা ফাঁসির দড়িতে যাঁরা বিসর্জন দিয়েছেন তাঁদের দেশপ্রেম স্বার্থহীন এবং তাঁরা প্রকৃতই দেশমাতৃকার বীরসন্তান। দুঃখজনক এটাই যে তাঁরা যে পথে স্বাধীনতা আন্দোলনকে চালিত করতে চেয়েছিলেন সে পথ ভ্রান্ত ছিল এবং সে পথে স্বাধীনতা আসেনি। শেষ অবধি গান্ধী প্রদর্শিত অহিংসার পথেই এসেছে স্বাধীনতা। রাসবিহারী বসু তো এখন জাতীয় কংগ্রেসকে দেশের স্বার্থরক্ষাকারী একমাত্র জাতীয় দল বলে মেনে নিয়েছেন। অরবিন্দ ঘোষের কথা না বলাই ভালো। তিনি তো কবেই সন্ন্যাস নিয়েছেন। তাই দেশজুড়ে এই উৎসবের পরিবেশ। শান্ত অথচ অসাধারণ বাগ্মিতায় নিজের যুক্তিকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে শ্যামলের। আশেপাশের টেবিলে যারা বসে আছে তারা নিজেদের আলোচনা বন্ধ রেখে একমনে শ্যামলের কথা শুনছে। শ্যামলের কথা শেষ হতে ছোটখাট একটা হাততালির রোল উঠলো কফি হাউসে।

এতক্ষণ অসীমের বাঁ দিকে যে ছেলেটি বসে আছে সে চুপ করেই ছিল। ওর নাম রতন। পেটা চেহারা। এক মাথা কোঁকড়ানো চুল। গায়ের রঙ রোদে পোড়া। গোলাকৃতি মুখমন্ডল। রাজনীতি নিয়ে ওর কোনও মাথাব্যাথা নেই এবং মতামতও নেই। শরীরচর্চা এবং খেলাধুলোই ওর ভালোবাসা। অসীম আর শ্যামলের বাড়ি থেকে মাইল দুয়েক দূরে ওদের বাড়ি। ওদেরও যৌথ পরিবার। ওর বাবা বাড়ির বড় ছেলে । রেলে চাকরি করেন। কাকারা পারিবারিক জমি নিজেরাই চাষ করে। বেশ স্বচ্ছল পরিবার। রতনের বাবাও ছুটির দিনগুলোতে ভাইয়েদের সঙ্গে চাষের কাজে হাত লাগান। মূলত কৃষক পরিবার বলা যেতে পারে। রতনের বাবাই পরিবারে একমাত্র শিক্ষিত এবং সেই সুবাদে সরকারি চাকরি। খুব মাখামাখি না থাকলেও অসীম আর শ্যামলের বাড়ির সঙ্গে রতনের বাড়ির সম্পর্ক বেশ ভালোই বলা যায়। আর ওদের তিনজনের তো একে অন্যের বাড়িতে যাতায়াত, থাকা-খাওয়া লেগেই আছে। রতন রাজনীতির ধার ধারে না। ওর দরকার একটা সরকারি চাকরি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। চাষবাস করায় ওর কোনও আগ্রহ নেই। কাকাদের ছেলেরা এরমধ্যেই চাষের কাজে লেগে গেছে। বাবার মত রতনও চায় একটা মাস মাইনের চাকরি। পুলিশের চাকরির ব্যাপারেই ওর উৎসাহ বেশি। ব্রিটিশ পুলিশের অধীনে চাকরি করতে হবে বলে পুলিশের চাকরি নিয়ে আর ভাবেনি এতদিন। এখন দেশ স্বাধীন সুতরাং পুলিশের চাকরিতে বাধা কোথায়? পুলিশের চাকরিতে শরীরচর্চা আর খেলাধুলো দুটোই বজায় রাখা যাবে। পুলিশের চাকরি পেতে গেলে যতটা পড়াশুনা করা দরকার ততটা তো করতেই হবে। পুলিশ অফিসার হবার স্বপ্ন বুকে নিয়েই রতনের কলেজ জীবন কাটছে। রাজনীতির আলোচনা শুনতে ভালো লাগে কিন্তু মতামত দেবার জ্ঞান এবং ইচ্ছা দুটোই নেই ওর। রতন বললো –‘অনেক হয়েছে চায়ের টেবিলে ঝড় তোলা। চল এবার ওঠা যাক’। তিনজনে বিল মিটিয়ে নিচে নামে। গলিটা থেকে বেরিয়ে কলেজ স্ট্রিটে পড়তেই দেখলো একটা মিছিল আসছে। জাতীয় কংগ্রেসের মিছিল। স্বাধীনতার বিজয়মিছিল। সামনের সারিতে জাতীয় কংগ্রেসের বড় বড় নেতারা। জাতীয় পতাকা আর কংগ্রেসের পতাকা হাতে নিয়ে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ হেঁটে চলেছে কলেজ স্ট্রিট ধরে। শ্যামল বললো ,’তোরা একটু দাঁড়া। আমি মিছিলে পা মিলিয়ে একটুখানি হেঁটে এখুনি আসছি। তোরা এখানেই দাঁড়া। আমি না এলে যাসনা কিন্তু’। বলতে বলতে মিছিলের মধ্যে হারিয়ে গেল শ্যামল। ওরা চেঁচিয়ে বললো,’ বেশি দূর যাসনা। তাড়াতাড়ি আয় ।আমরা এখানেই আছি।‘ শ্যামল ফিরে আসার পর একসঙ্গেই বাড়ির পথে রওনা দিল তিন বন্ধু।

অনেকক্ষণ ধরে পুকুরপারে দাঁড়িয়ে আছে সোমা। আজকাল প্রায়ই আসেনা কুন্তল। তিন-চার দিন ছাড়া এক এক দিন আসে। তাও বেশিক্ষণ থাকতে চায়না। কোথাও একটা যাবার জন্য ছটফট করে। সোমার কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে। কান্না দলা পাকিয়ে থাকে গলার কাছে। যে কুন্তল তাকে চোখে হারাতো ইদানিং তার এমন নিস্পৃহ আচরণের কারণ খুঁজে পায়না সোমা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কুন্তলের মাকে জিগ্যেস করে জেনেছে রোজ বিকেলে বেরিয়ে যায় কুন্তল খেলতে যাবে বলে আর ফেরে সন্ধ্যের মুখোমুখি। কোথায় যায় তাহলে কুন্তল? যে কুন্তল আর কাউকে না বললেও সোমাকে সব কথা বলত সেই কুন্তল কেন সব কিছু গোপন রাখতে চাইছে তার কাছ থেকে। তবে কি অন্য কারও সঙ্গে? না না তা কী করে হতে পারে? এমন কারও কথা তো মাথায় আসছে না সোমার। বুকের ভেতর একটা চাপা যন্ত্রণা অনুভব করে সোমা। কী করবে সে এখন? এ কথা তো কাউকে বলতে পারবে না সে। বাড়িতে তো দূরের কথা স্কুলের বন্ধুদের কাছে এ কথা বললে লোক জানাজানি হয়ে যাবে। অনেক ভেবেচিন্তে নিজের মনকে শক্ত করেছে সোমা। আজ যদি দেখা হয় আজই আর যদি আজ দেখা না হয় যেদিন দেখা হবে সেদিনই সোজাসুজি চোখে চোখ রেখে জিগ্যেস করবে সোমা কুন্তলের এই অদ্ভুত আচরণের কারণ। যে কোনও রকম উত্তরের জন্য সে মানসিক ভাবে তৈরি করেছে নিজেকে। এই যন্ত্রণার শেষ হওয়া দরকার। মুখ বুঝে চুপ করে সবকিছু মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সত্য কী তা তাকে জানতেই হবে তা সে যতই কঠিন হোক না কেন। নির্জন পুকুরপাড়ে এককোণে নিভৃতে ছলছল চোখে একবুক যন্ত্রণা আর উপেক্ষার জ্বালা নিয়ে কুন্তলের জন্য গত কয়েকদিন অপেক্ষা করছে সে। দেখা যাক আজ আসে কি না? সোমা জানেনা চূড়ান্ত সত্য জানার আগে আর কতদিন এমনি করে অপেক্ষা করতে হবে তাকে? ধৈর্যেরও একটা সীমা আছে। তার একেবারে শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে সে। প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পর বিকেলের আলো যখন পড়ে আসছে বুকের দুঃখ বুকে চেপে বাড়ির পথে রওনা দিল সোমা। গোধূলিবেলায় দালানে বসে মায়ের কাছে চুল বাঁধা তার প্রতিদিনের অভ্যাস। আর ঠিক তখনই দেখতে পেল সোমা মাঠের আলপথ ধরে ধীরপদে হেঁটে আসছে কুন্তল। বুকটা ধড়াস করে উঠলো সোমার। মুহূর্তের জন্য আবেগবিহ্বল হয়ে পড়লেও নিজেকে আজ শক্ত রাখতেই হবে তাকে। অন্যদিনের মত দু’জনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে আজ বাড়ি চলে যাবেনা সে। ভাবতেই ভাবতেই কুন্তল এসে দাঁড়ালো সামনে। কেমন যেন বদলে গেছে কুন্তল ক’দিনে। চুল উস্কোখুস্কো। দৃষ্টি অস্থির। মুখে বিষণ্নতার ছাপ। ওর মনের মধ্যে যে কিছু একটা নিয়ে লড়াই চলছে সেটা সোমার তীক্ষ্ণদৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারলো না। মনের কথা অনেক সহজে বুঝতে পারে মেয়েরা বিশেষ করে কাছের মানুষদের। এ ক্ষমতা ওদের সহজাত। যতই নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করুক না কেউ মা, দিদি, বৌদি বা প্রেমিকার নজর এড়িয়ে যাওয়া অসাধ্য। অন্তত অন্য কারোর প্রেমে যে কুন্তল পড়েনি সেটা ওর মুখ দেখে বুঝতে পেরেছে সোমা। তা যদি হত সোমার মুখোমুখি হবার সাহস হত না ওর। কিন্তু তা হলে কী ? সোমা হঠাৎই গর্জে ওঠে,’ যেখানে যাও প্রতিদিন সেখান থেকে তাড়িয়ে দিল? আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নে পেয়ে এখানে এলে দেখতে আমি আছি কি না?’ অবাক হয়ে সোমার দিকে তাকিয়ে থাকে কুন্তল। সোমার এমন রূপ আগে কোনওদিন দেখেনি কুন্তল। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না কুন্তল। না থেমে বলেই চলে সোমা,’ শোন, যদি আমার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখতে চাও রেখো না কিন্তু তার আগে পরিস্কার করে বলে যাও বাড়িতে লুকিয়ে, আমাকে লুকিয়ে প্রতিদিন বিকালে কোথায় যাও তুমি? কাকিমাকে বলে গেছ খেলতে যাচ্ছ। কিন্তু খেলে ফিরছ বলে মনে হচ্ছে না তো। সত্যি করে যদি বলতে না পার কোথায় যাও তুমি তবে আজই আমাদের শেষ দেখা।‘ মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে কুন্তল। বেশ কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। দুজনেই নিস্তব্ধ। রাগে অভিমানে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসছে সোমার। কুন্তল শান্ত বরফের মতো। অনেকক্ষণ পর মুখ খুললো কুন্তল ,’ তুই আমাকে বিশ্বাস করিস বা না করিস কোথায় যাই, কাদের সঙ্গে কথা বলি সে কথা কাউকে বলা যাবে না। তবে আমাকে যেতেই হবে । না গিয়ে কোনও উপায় নেই আমার।‘ ‘কী এমন কথা যে আমাকেও বলা যাবে না?’ চিৎকার করে ওঠে সোমা। কুন্তল জবাব দেয়,’ না, বলা যাবে না। শুধু তোকে কেন? কাউকে না । বাবা-মাকেও না।‘ওর গলা বরফের মত কঠিন, ঠান্ডা। সোমা বুঝতে পারে একটা বড় কিছু ঘটতে চলেছে। সবকিছু ওলট পালট হয়ে যেতে পারে এমন একটা ঝড়ের পূর্বাভাস দেখতে পায় সোমা কুন্তলের চোখে মুখে, শুনতে পায় ওর অস্বাভাবিক দৃঢ় আর আবেগহীন কন্ঠস্বরে। সবকিছু কি হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে সোমার? কুন্তলকে কি হারাতে চলেছে ও? এক অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপে সোমার। নিচু গলায় শান্তস্বরে জিজ্ঞাসা করে,’ কী হয়েছে তোমার? কেন এরকম করছো তুমি?’ কুন্তল বলে,’ আমার আর কিছু ভালো লাগে না সোমা।স্কুলে যাওয়া, পড়াশুনা করা এই সবকিছু অর্থহীন মনে হয় আমার। কী লাভ পড়াশুনা করে? সেইতো হয় সরকারের আর নয়ত বড়লোকেদের গোলামি করতে হবে সারাজীবন।‘

- কি বলছো তুমি? তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? এ তো তোমার নিজের কথা নয়। কার কাছ থেকে শিখছো এসব? তুমি স্কুল ছেড়ে দেবে?

- পরাধীন দেশে পড়াশুনা করে কী হবে? আগে এই দেশটাকে স্বাধীন করতে হবে, ব্যবস্থাগুলো পাল্টাতে হবে তারপর সত্যিকারের পড়াশুনা ।

- তোমার কী হয়েছে? কী বলছ তুমি? আমরা স্বাধীন নয়? তাহলে ভোট হচ্ছে কেন? ভোটে যারা জেতে তারাই তো দেশ চালায়।তারা তো এদেশেরই লোক।

-ওসব ধাপ্পাবাজি। ওদের আড়ালে দেশ চালায় আমাদের শত্রুরা।

- কারা আমাদের শত্রু? ইংরেজরা তো কবে দেশ ছেড়ে চলে গেছে।

- তাতে কী? আমেরিকা, রাশিয়া আমাদের ওপর খবরদারি করছে, শুষে খাচ্ছে। দেশি ব্যবসায়ী আর জোতদার, জমিদারেরা লুটেপটে খাচ্ছে শ্রমিক কৃষকের শ্রম। তুই অতশত বুঝবি না।

- কিন্তু কী করতে চাও তুমি এখন? কী করে এইসব পাল্টাবে তুমি? আর কারা আছে তোমার সঙ্গে?

- পাল্টাবার একটাই উপায়।

-কী উপায়?

- সব ধ্বংস করে ফেলতে হবে। গরীব মানুষের যারা শত্রু তাদের এক এক করে খতম করে ফেলতে হবে। যে আইনব্যবস্থা, পুলিশিব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা এই শ্রেণীশত্রুদের স্বার্থরক্ষার জন্য তৈরি হয়েছে তা সমূলে ধ্বংস করতে হবে। যারা এই ব্যবস্থাগুলো চালাচ্ছে তাদেরও খতম করতে হবে। এরা সবাই শ্রেণীশত্রু।

উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে থাকে কুন্তল। চোখমুখের চেহারা পাল্টে যায় ওর। কুন্তলের এমন হিংস্র, অমানবিক, নিষ্ঠুর রূপ দেখে ভয় পেয়ে যায় সোমা। এ কোন কুন্তলকে দেখছে সোমা। মাত্র এই ক’দিনে এত পাল্টে গেছে ও। কে বা কারা যেন ওর সারা শরীরে , রক্তে মিশিয়ে দিয়েছে ঘৃণার বিষ। কুন্তল থামে না , বলেই চলে ,’ স্কুল, থানা সব জ্বালিয়ে দিতে হবে। যারা বাঁচাতে আসবে তাদেরও ছাড়া হবে না। সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নতুন করে শুরু করতে হবে। সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করতে হবে।‘ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চুপ করে কুন্তল। তাকায় সোমার চোখের দিকে। সোমা চুপ করে থাকে। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। কুন্তলের কন্ঠস্বরে এত বিশ্বাস, এত দৃঢ়তা যে এর ওপরে কিছু বলতে পারেনা সোমা। সত্যি কথা বলতে অনেক কিছুই মাথায় ঢোকেনি সোমার। ভাল করে শোনেওনি সে। যে রাগ, অভিমান সঙ্গে নিয়ে সে এসেছিল তা বদলে গেল এক ভয়ানক আশঙ্কায়। কোনওক্রমে নিজেকে সামলে কুন্তলকে বললো,’ কোথাও তোমার একটা ভুল হচ্ছে। তুমি যা বলছ তার কিছুই আমি বুঝিনা কিন্তু আমার ভীষণ ভয় করছে। তুমি ঠিক হয়ে যাও। যেমন ছিলে তোমাকে তেমন দেখতে চাই।‘ কোনওক্রমে কথাগুলো বলে মুখে হাত চাপা দিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় দিল সোমা। হতবাক কুন্তলের দৃষ্টিপথ থেকে দ্রুত মিলিয়ে যায় সোমা। এক দৌড়ে বাড়ি পৌঁছে মায়ের কোলে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সোমা। মা অবাক হয়ে জিগ্যেস করে ,’ কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? কেউ কিছু বলেছে?’ কোনও উত্তর দেয়না সোমা। মা বলে,’ ওঠ এবার। চল, চুল বেঁধে দিই। সন্ধ্যেবেলা খোলাচুলে থাকতে নেই। ‘চোখ মুছে মায়ের কোল ঘেঁসে বসে সোমা। পরম স্নেহে আর মমতায় মেয়ের কোমর অব্দি লম্বা অবিন্যস্ত চুলের মধ্যে চিরুনি চালাতে চালাতে বললো,’ বড় হচ্ছিস মা। আর ধিঙ্গির মত এদিক ওদিক ছুটে বেড়াস না সারা বিকেল। এবার একটু বাড়িতেই থাক।‘সোমা বলে,’ তাই থাকবো মা। কে জানে কেন আজকাল আমার খুব ভয় করে।‘মা বলে,’ দুর পাগলি। ভয়ের কি আছে? আমরা সবাই আছি তো তোর কাছে।‘মায়ের কাঁধে মাথা এলিয়ে চোখ বুজে চুপটি করে বসে থাকে সোমা। দূর থেকে ভেসে আসে সন্ধ্যারতির শঙ্খ ঘন্টার আওয়াজ। দিন শেষে শুরু হল রাত্রি।

বেশ কয়েকমাস কেটে গেছে তারপর। একদিন সকালে শ্যামল তখন স্কুল যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে হঠাৎ এসে হাজির অসীম আর রতন। শ্যামল এখন স্কুলে পড়ায়। একই স্কুলে যেখানকার হেডমাস্টারমশাই ছিলেন শ্যামলের বাবা ক্ষিতিমোহন। শ্যামল এখন এই অঞ্চলের পদার্থ বিদ্যা আর অঙ্কের নামকরা মাস্টারমশাই । অসীম চাকরি করে কলকাতার এক বেসরকারি ব্যাঙ্কে আর রতন পুলিশ অফিসার। এক জেলা থেকে আর এক জেলায় বদলি হতে হয় প্রায়ই । কিন্তু যেখানেই থাকুক পনেরদিন একমাসে দেশের বাড়িতে আসা চাই। শ্যামল একটু অবাক হল ওদের এত সকালে দেখে। সাধারণত শনি-রবিবার দেখা হয় ওদের। কারও বাড়িতে না হয় নদীর ধারে বা খেলার মাঠে গল্প গুজবে সন্ধ্যেটা কেটে যায় ওদের। স্কুল জীবনের বন্ধুত্ব আজও অমলিন। কিন্তু আজ এত সকালে এখানে কেন? দু’জনেই অফিস যায়নি আজ? ওদের চোখে মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট । তবে কি কোনও বিপদ হল?

-কী হলো রে, হঠাৎ এত সকালে? সব ঠিক আছে তো?

-‘না ভাই, বিপদে পড়ে এসেছি তোর কাছে।‘অসীম বলে।

- কী বিপদ? – একরাশ বিস্ময় নিয়ে জিগ্যেস করে শ্যামল।

- একটা কথা জানার জন্য এসেছি তোর কাছে?

-কী কথা? এত কিন্তু কিন্তু করছিস কেন?

- কথাটা আমার ছেলে কুন্তলের ব্যাপারে।

-কী হয়েছে কুন্তলের?

-কিছু হয়নি এখনও কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে ওর মতিগতি চালচলন ভালো লাগছে না আমার। কোনও বদসঙ্গে পড়েছে বলে মনে হয়। মুখ চোখের চেহারা অন্যরকম লাগছে। পড়াশুনার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। বকাবকি করলে চুপ করে থাকে। কোথায় যায় কাউকে বলে না। এমনকি মাকেও নয়। গত কয়েকদিন রাত করে ফিরছে। কাল তো আমি বাড়ি এসে দেখলাম তখনও ফেরেনি। অনেক রাত্রে ফিরল। কিছু খেল না। শুয়ে পড়ল। বকাবকি না করে নানাভাবে বুঝিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জানবার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোনও লাভ হলো না। একটা শব্দও বের করলো না মুখ থেকে। আজ ভোরবেলা উঠে কাউকে কিছু না বলে আমাদের ওঠার আগেই কোথায় চলে গেছে। চিন্তায় সারারাত ঘুম হয়নি আমাদের। ভোরের দিকে চোখটা লেগে গিয়েছিল। উঠে দেখি কুন্তল ঘরে নেই। বাড়িতে এদিক ওদিক খুঁজেও পেলাম না। দৌড়ে রতনের বাড়ি গেলাম। ওর আটটার ট্রেনে যাবার কথা ছিল। সব শুনে এখানকার থানা থেকে অফিসে খবর পাঠিয়েছে আজ আর কাল দু’দিন যাবে না বলে। তারপর দু’জনে দৌড়ে এলাম তোর কাছে।

-কী বিপদ! তুই আগে একটু ঠান্ডা হ। তাড়াহুড়ো করে এখন তো কিছু করা যাবে না। সকালে চা জলখাবার খাসনি নিশ্চয়ই। তোরা বোস, একটু চা জলের ব্যবস্থা করি।

-না না বৌদিকে বিরক্ত করার কোনও দরকার নেই।– বলে উঠলো ওরা দু’জনে

আপত্তি না শুনে ভেতরে গেল শ্যামল। কিচ্ছুক্ষণ বাদে ফিরে এল। অসীম বললো,’ তুইতো স্কুলে দেখিস ওকে রোজ । কিছু লক্ষ্য করেছিস? অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে শ্যামল। তারপর বলে,’ শনিবার দেখা হলে তোকে বলবো বলে ভেবেছিলাম কিন্তু এতটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে আমি বুঝতে পারিনি। শুধু কুন্তল নয় বেশ কিছু ছেলের মধ্যে একটা অ্যারোগ্যান্স লক্ষ্য করছি বেশ কিছুদিন ধরে। যখন খুশি ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। করিডরের কোণে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় কথা বলছে। মাস্টারমশাইদের দেখেও যেন দেখতে পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে পরিকল্পিত ভাবে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইছে। আমি পার্টি মারফত খবর পেয়েছি কলকাতায় বেশ কিছু এলাকায় এর মধ্যেই ভালো গন্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। কয়েকটা স্কুলে ভাঙচুরও হয়েছে। ছাত্র শিক্ষকদের নিরাপত্তার জন্য দু-তিনটে স্কুল বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় এর প্রভাব এখন কলকাতার কাছাকাছি মফস্বঃলগুলোর ওপর পড়বে। পার্টির যা খবর তাতে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। স্কুল কলেজের ছাত্রদের ক্ষেপিয়ে তুলছে ওরা। শোনা যাচ্ছে কলকাতায় দু-তিনটে মহাপুরুষের মূর্তি ভেঙ্গেছে ওরা।‘ রতন এতক্ষণ চুপ করেছিল। সবশুনে রতন যা বললো তা মোটামুটি এইরকম। পুলিশের কাছে খবর আছে যে এর পিছনে কম্যুনিস্ট পার্টি ভেঙ্গে যে নতুন পার্টি হয়েছে তাদের মদত রয়েছে। এদের একটা দল উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় জমিদারদের ওপর আক্রমণ করে তাদের খুন করছে , ঘরবাড়ি , জমিজমা লুটপাট করে নিচ্ছে। আর একটা দল শহরে এসে কমবয়সী ছাত্রদের আবেগ কাজে লাগিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চাইছে। সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের স্লোগান তুলে স্কুল কলেজ বন্ধ করে দেবার প্ল্যান করছে। পাড়ায় পাড়ায় আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে। ওদের মূল লক্ষ্য থানাগুলো আর পুলিশ। থানা আক্রমণ করে অস্ত্র নিয়ে পালাবার পরিকল্পনা করছে। ছাত্রদের ব্যবহার করার জন্য এই শিক্ষাব্যবস্থা ভুল বলে ওদের বিভ্রান্ত করে লেখাপড়া থেকে দূরে সরিয়ে খুন জখম ডাকাতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ট্র্যাফিক পুলিশ বা অন্য যে কোনও পুলিশ যারা রাস্তায় ডিউটি করে তাদের টার্গেট করছে। উদ্দেশ্য ওদের খুন করে অস্ত্র কেড়ে নেওয়া। কিছু সমাজবিরোধী এই সুযোগে এদের দলে নাম লিখিয়ে অবাধে চুরি ডাকাতি লুঠপাট চালাচ্ছে। পুলিশ অফিসারদের অত্যন্ত সাবধানে চলাফেরার জন্য ওপরতলা থেকে নির্দেশ দিয়েছে। এসব শুনে ভয়ে অসীমের গলা শুকিয়ে যায়। গ্লাস থেকে খানিকটা জল খেয়ে জিগ্যেস করে ,’ এত কান্ড হচ্ছে আমি তো কিছুই শুনিনি?’ রতন বলে ,’মিডিয়া সব জানে। ওরা ভয়ে মুখ বন্ধ করে আছে। রিপোর্টারদের রাস্তাঘাটে খুন করার হুমকি দিচ্ছে। তাই কেউ কিছু জানতে পারছে না।‘ এবার অসীম শ্যামলের দিকে তাকায়, বলে,’ তোর কী মনে হয়? কুন্তল এসবের মধ্যে জড়িয়ে গেছে?’ শ্যামলের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। অসীমের দিকে তাকিয়ে বলে,’ সে কথাই শনিবার তোকে বলবো বলে ভেবেছিলাম। গত বৃহস্পতিবার থার্ড পিরিয়ড চলার সময় বাহাদুর এসে টিচার্স রুমে খবর দিল যে সাত-আটটা ছেলে স্কুলের পিছনে জড়ো হয়ে রঙ তুলি নিয়ে দেয়ালে কীসব লিখছে। ও শুনেছে রবিবার যখন স্কুল বন্ধ থাকবে ওরা পাঁচিল টপকে স্কুলে ঢুকে কার্নিশ বেয়ে ওপরে উঠে কিছু একটা অঘটন ঘটাবে। শুনে অন্য সবাই রীতিমত ভয় পেয়ে গেল। রাগে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। এতটুকু টুকু ছেলে তাদের এত সাহস যে স্কুল ভাঙচুর করবে। বাহাদুরকে নিয়ে নিচে নেমে নিঃশব্দে স্কুলের পিছনে গিয়ে দেখি ছেলেগুলো মাঠের দিকের আর পেছনের দেয়ালে কালি দিয়ে কী সব লিখছে। আমাকে দেখেই তুলি কালি ফেলে দৌড় লাগালো। আমি ভাল করে দেখবার আগেই ছেলেগুলো পাঁচিল টপকে পালালো। আমি ওদের মধ্যে চার-পাঁচটাকে পরিস্কার দেখেছি। কুন্তলও ছিল ওদের মধ্যে। দেয়ালে কালি তুলি দিয়ে কিছু শেখানো স্লোগান লিখেছে- বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা মানছি না, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস , ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার দালালেরা সাবধান ইত্যাদি ইত্যাদি।‘ ভয়ে ঘামতে থাকে অসীম । শ্যামল বলে চলে ,’ পরের দিন প্রেয়ারের পরে আমি সব ছেলেদের ডেকে বলে দিয়েছি যারা এইসব করছে তাদের আমি ছাড়বোনা। একটা একটা করে টেনে এনে পুলিশের হাতে তুলে দেব। আমি সেইদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় থানায় সব বলে এসেছি। ওরা নাম চাইছিল। আমি বলেছি একটা ওয়ার্নিং দেব। যদি কাজ না হয় তারপর নাম ঠিকানা পুলিশের কাছে দিয়ে দেব। ওই ছেলেগুলোর গার্জেন কল করেছি আজকে। আর তোকে বলছি কুন্তল ফিরলে বাড়িতে বন্ধ করে রাখ , দরকার হলে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দে। বাকি গার্জেনদেরও সে কথা বলবো বলে ঠিক করেছি।‘ রতন বলে,’ অসীম, তুই কুন্তলকে আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দে। আমার কাছে থাকলে কোনও চিন্তা নেই।‘ শ্যামল বলে,’ ভয় পেয়ে কোনও লাভ নেই। শক্ত হাতে মোকাবিলা না করলে ওরা আরও পেয়ে বসবে। মাঝখান থেকে তোর আমার বাড়ির ছেলেগুলো মরবে। কুন্তল ফিরলে বুঝিয়ে বল নয়ত শক্ত হাতে ব্যাপারটা আটকা।‘ অসীম আর রতন বাড়ি ফিরে যায়। শ্যামল তৈরি হয়ে স্কুলের দিকে রওনা দেয়। যেটা সবার নজর এড়িয়ে গেল সেটা হল দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সোমা আর ওর মা সব কথা শুনলো। ভয়ে, চিন্তায় সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল ওদের কিন্তু শ্যামলকে কিছু বলার সাহস হলনা । আজ স্কুল যায়নি সোমা শরীর খারাপ বলে। সারাদিন ভাল করে খাওয়া হল না মা মেয়ের। গভীর দুশ্চিন্তায় কাটলো দিনটা। বিকাল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যায় স্কুল থেকে ফিরে শ্যামল জানালো কুন্তলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অসীম এসেছিল স্কুলে। রতনের অনুরোধে লোকাল থানা তন্ন তন্ন করেও খুঁজেও পায়নি কুন্তল আর ছ-টা ছেলেকে। বাকি ছেলেগুলোর বাবারাও এসেছিল স্কুলে। পুলিশকে বলা আছে খেয়াল রাখতে।

দেখতে দেখতে প্রায় এক মাস কেটে গেল কারুর সন্ধান পাওয়া গেলনা। অসীম আর কুন্তলের মা খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিল। ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তায় দিন দিন শুকিয়ে যেতে লাগলো দু’জনেই। এই ঘটনার পর একদিনও অফিস যায়নি অসীম। অফিসের লোকেরা এসে মাঝে মাঝে খবর নিয়ে যায়। রতন ফিরে গেছে কাজের জায়গায়। এদিকে এই অঞ্চলে দৌরাত্ম কিছুটা কমলেও কলকাতার আশেপাশে ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে বিশৃঙ্খলা। মূর্তি ভাঙ্গা, স্কুল পোড়ানো, পুলিশ খুনের খবর প্রায় প্রতিদিনই আসছে আশপাশের জায়গাগুলো থেকে। ভয়ে সিঁটিয়ে আছে সবাই। বিশেষ করে শহরতলী এলাকায় বেশিরভাগ লোকজন সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ঢুকে পড়ছে।পুলিশের গাড়ি টহল দিচ্ছে অনবরত। শহর এবং শহরতলীর জীবন বিপন্ন। নিরাপত্তার কারণে বেশিরভাগ স্কুলই বন্ধ। শ্যামল আর কয়েকজন মাস্টারমশাই এর জেদ আর সাহসের ওপর নির্ভর করে ওদের স্কুলটা খোলা আছে এখনও। ছাত্র এবং শিক্ষকের উপস্থিতির সংখ্যা কমতে থাকলেও স্কুলটা খুলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওরা সবাই। পুলিশও সহযোগিতা করতে রাজি হয়েছে। শ্যামলের উদ্যোগে স্থানীয় প্রশাসন সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। কংগ্রেস পার্টির থেকেও এই বিশৃঙ্খলা এবং আতঙ্কসৃষ্টির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। শ্যামলই এদের মধ্যে সবসময় সমন্বয় রক্ষা করে স্কুলটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে চলেছে। সোমা আর সোমার মা সদাসর্বদাই ভয়ে ভয়ে থাকে। শ্যামল ওদের আশ্বাস দেয় যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আবার সবকিছু আগের মত হয়ে যাবে। ওর কিছু হবে না । এত মানুষ ওর সঙ্গে আছে। অন্ধকারের ওপারে আলোর অপেক্ষায় থাকে সবাই।

এদিকে অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। দৌরাত্ম্য বাড়ছে প্রতিদিন। বাড়ি বাড়ি থেকে মুখে কালো কাপড় ঢেকে টাকা, রুটি, চাল, ডাল নিয়ে যাচ্ছে ওরা। চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। মাঝে মাঝেই বোমার আওয়াজে রাতের নৈঃশব্দ ভেঙেচুরে খানখান হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ সংযোগ। সকালবেলা দেখা যাচ্ছে কারা কেটে নিয়ে গেছে মোটা তামার ইলেকট্রিকের তার। পাড়ার দোকানদারদের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। টাকা না দিলে লাশ ফেলে দেবে। স্কুল কতৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্কুল বন্ধ থাকবে। ক’দিন আগে পাশের থানার গেটের বাইরে ডিউটিরত এক কনস্টেবলকে খুন করে রাইফেল ছিনিয়ে গেছে ওরা। সমস্ত অঞ্চল আতঙ্কে কাঁপছে। এমনি একদিন সন্ধ্যের মুখে সোমাদের বাড়িতে দরজা নাড়ার আওয়াজ। শ্যামল বাড়ি নেই। স্ত্রী কাজলের বারণ সত্ত্বেও সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে। বলে গেছে কী একটা জরুরি কাজ সেরে তাড়াতাড়ি চলে আসবে। অন্ধকার হয়ে যাবার পরেও ফিরছে না দেখে একটু চিন্তায় ছিল সোমা আর কাজল। দরজা নাড়ার আওয়াজ পেয়ে ভাবলো শ্যামল ফিরেছে। কিন্তু সোমার মনে হল অন্য কেউ হবে, বাবার দরজা নাড়ার আওয়াজ এরকম নয় । ভয়ে ভয়ে মায়ের পিছু পিছু এল সোমা। কাজল দরজা খুলতেই একজন লোক হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে কাজলকে ঠেলে সরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। বললো,’ ভয় পাবেন না। আমি পুলিশের লোক, লোকাল থানা থেকে আসছি। মাস্টারমশাই কোথায়?’ সোমা উত্তর দিল,’ বাবা তো একটু আগে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে। বলে গেল এক্ষুণি ফিরে আসবে।‘ লোকটার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,’ শুনুন আমাদের কাছে গোপন খবর এসেছে আজ শ্যামলবাবু আর আমাদের রতন স্যারের ওপর হামলা হতে পারে। আমি সেই জন্যই ঝুঁকি নিয়ে আপনাদের বাড়ি এসেছি। ওরা আমাদের ওপর নজর রাখছে। যদি দেখতে পায় আমি এখানে ঢুকেছি ফেরার পথে আমায় অ্যাটাক করতে পারে। জেনেশুনেও ঝুঁকি নিতে হল। রতনস্যারের বাড়ি ফেরার কথা ছিল আজ। ওনাকে স্টেশনেই খবর পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। উনি পরের ট্রেনেই ফিরে গেছেন। আমি চললাম। স্যারকে একদম বাড়ি থেকে বেরোতে বারণ করবেন। আমরা খোঁজ খবর নিয়ে যাব। যা লাগবে আমাদের বলবেন। আমরা পাঠিয়ে দেব। পুলিশ আপনাদের বাড়ির আশেপাশে নজর রাখবে কাল থেকে। আমি এখন যাই।‘ সারা শরীর ভয়ে হিম হয়ে গেল কাজল আর সোমার। কথা বলার শক্তি নেই ওদের দুজনের। স্থাণুর মত বসে রইল দু’জনে। সন্ধ্যে গড়িয়ে গেল। কেন যে শ্যামল আজই এত দেরি করছে! সন্ধ্যে দেওয়া, সোমার চুল বেঁধে দেওয়ার কথা আজ আর মনেই পড়ল না কাজলের। এমন সময় হঠাৎ আলো নিভে গেল। একটা ভয়ঙ্কর আওয়াজে যেন কেঁপে উঠলো গোটা পাড়াটা। একটা- দুটো- তিনটে পরপর বোমার আওয়াজ সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা চুরমার করে দিল। কাজলের মনে হল আওয়াজটা আসছে খুব কাছ থেকেই। আতঙ্কে আর আশঙ্কায় নিজেকে ঠিক রাখতে পারলোনা নিজেকে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ছুটে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।মায়ের পিছন পিছন সোমাও বেরিয়ে গেল এক ছুটে। হাট করে খোলা পড়ে রইল বাড়ির দরজা। চাঁদের আলোয় বেশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছে আশপাশের সবকিছু। পাশের বাড়িগুলোর সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ। চারিদিক সুনসান। কেউ কোথাও নেই। কাউকে যে জিগ্যেস করবে সে পথও বন্ধ। দৌড়ে সামনের রাস্তাটা পেরিয়ে বাঁক নেওয়ার মুখে কাজল আর সোমা যা দেখলো সে এক সাঙ্ঘাতিক দৃশ্য। রাস্তার ওপরে পড়ে আছে শ্যামলের রক্তাক্ত দেহ। সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সাইকেলটা পড়ে আছে একটু দূরে। চশমাটা ছিটকে পড়েছে উল্টোদিকে। মুখটা হাঁ করা। চোখদুটো বন্ধ। পাগলের মত শ্যামলের রক্তাক্ত শরীরটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজল। প্রাণপণে ঝাঁকাতে থাকে শ্যামলের দেহটা। কী এক অস্বাভাবিক শক্তি যেন ভর করেছে ওর ওপর। শ্যামলের বুকে কান দিয়ে বারবার শুনতে চায় হৃদস্পন্দনের শব্দ। কিন্তু কিছুই শুনতে পায়না। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজলের সংজ্ঞাহীন দেহ লুটিয়ে পড়ে শ্যামলের নিথর শরীরের ওপর। বোধশক্তিরহিত হয়ে যায় সোমা। পলকহীন চোখে পাথরের মত দৃষ্টি নিয়ে বাবার মৃতদেহের পাশে বসে সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে সোমা। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় বড় বড় করে লেখা – ‘শ্রেণীশত্রু খতমের অভিযান চলছে চলবে।‘ রাত্রি গভীর হয়ে আসে।



পরিভ্রমণ সমাপ্ত করিয়া অশ্ববাহিত শকটে অনুচরপরিবৃত হইয়া রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করিতেছিলেন কবিশ্রেষ্ঠ শিখরাদিত্য। কিয়ৎকাল পূর্বে যে জনপদের পার্শ্ববর্তী রাজপথে রথ থামাইয়া দূরপানে দৃষ্টিনিবদ্ধ করিয়া কিঞ্চিৎসময় একাগ্রচিত্তে অতিবাহিত করিয়াছিলেন প্রত্যাবর্তনের সময়েও সেইস্থানে পৌঁছাইয়া ইঙ্গিতে শকট থামাইতে নির্দেশ দিলেন। অনুচরবর্গ কিঞ্চিৎ আশ্চর্যান্বিত হইয়া ভাবিতে থাকিল ইহা হয়ত কবিশ্রেষ্ঠের অন্তরে কোনও স্মৃতিকে জাগ্রত করিতেছে এবং এই স্থানের প্রতি কোনও আকর্ষণ অনুভব করিতেছেন। পূর্বের ন্যায় শিখরাদিত্য ঐ পুষ্করিণীর প্রতি গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। হয়ত আশা করিয়াছিলেন ঐ কিশোর-কিশোরী পুনরায় তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইবে। কিন্তু তাঁহার চক্ষুতে যাহা প্রতিভাত হইল তাহাতে তিনি বিস্মিত হইলেন। তাঁহার ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হইল। এক গভীর যন্ত্রণায় তাঁহার হৃদয় মথিত হইলো। সেই যন্ত্রণার অভিব্যক্তি তাঁহার মুখমন্ডলে দর্শন করিয়া তাঁহার অনুচরবর্গ বিচলিত বোধ করিল। তাহারা জিজ্ঞাসা করিল তাহারা কবিবরের কোনও সহায়তায় নিজেদের সমর্পণ করিতে পারে কি না। কবিশ্রেষ্ঠ বোধহয় কিছু শুনিতে পাইলেন না। তিনি স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করিলেন ঐ দীর্ঘিকার কাকচক্ষু জল এখন পঙ্কিল। উহার বর্ণ ঈষৎ রক্তাভ। অনুভব করিলেন পুষ্করিণীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল পূতিগন্ধময়। ঐ জলাশয়ের তীরবর্তী বৃক্ষসমূহ পত্রবর্জিত, যে বিচিত্র পক্ষীকূল ঐ বৃক্ষসমূহে বিরাজ করিত তাহারা এখন মৃত। তাহাদের শব ঐ জলাশয়ে ভাসমান। শ্বেতপ্রস্তর নির্মিত সোপানগুলির উপর পিচ্ছিল জলজ তৃণের আস্তরণ সদাসিক্ত। এইস্থানে মনুষ্যের গতায়াত নাই বলিয়াই বোধ হইতেছে। শিখরাদিত্য লক্ষ্য করিলেন ঐ সোপানের একপ্রান্তে এক ছায়ামূর্তি পদচারণা করিতেছে। আরও গভীর দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া নিশ্চিত হইলেন ঐ ছায়ামূর্তি তাঁহার একান্ত পরিচিত ভ্রাতৃসম বিপ্লবী চিরঞ্জীবের। কৃশকায়, দুর্বল এই যুবক তাঁহার সহোদর ভ্রাতা বুধাদিত্যের পরম সুহৃদ এবং সহবিপ্লবী। সাম্যবাদী বিপ্লবের আহ্বানে ইহারা উভয়েই নিরুদ্দেশ হইয়াছিল। রাজসেনাদের দৃষ্টি হইতে অনেক দূরে গোপনে হয়ত কোনও পর্বতগুহায় অথবা কোনও গভীর অরণ্যে ইহারা আত্মগোপন করিয়া আছে। শিখরাদিত্য ইহাদের বিপ্লবীতত্ত্বকে এবং শত্রু চিহ্নিতকরণকে নৈতিক সমর্থন প্রদান করিলেও প্রয়োগপদ্ধতির যাথার্থ্য প্রসঙ্গে সহস্র প্রশ্ন জন্ম লইয়াছে তাঁহার অন্তরে। সেই প্রশ্নের উত্তরসন্ধানে তিনি বুধাদিত্যের সহিত গোপনে সাক্ষাৎ করিয়া অবগত হইয়াছেন যে চিরঞ্জীব পথভ্রান্ত এবং এতদিনের সহবিপ্লবীর সহিত সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করিতে উদ্যত। শিখরাদিত্য দীর্ঘদিন ধরিয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন চিরঞ্জীবের সহিত সাক্ষাতপূর্বক তাহাকে নিরস্ত করিবার প্রয়াস করিতে। অদ্য প্রভাতে আকস্মিক তাহার দর্শন পাইয়া শিখরাদিত্যের সেই ইচ্ছা প্রবল হইয়া উঠিল। অগ্রজপ্রতিম হিসাবে এক কর্তব্যবোধ তাঁহাকে রাজরথ হইতে রাজপথে নামিতে বাধ্য করিল। অনুচরবর্গ তাঁহার সহযাত্রী হইবার বাসনা জ্ঞাপন করিলেও তিনি একাকী গমন করিতে মনস্থ করিলেন। রাজপথ অতিক্রম করিয়া পদব্রজে জনপদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া অনুভব করিলেন যে জনপদ এখনও নিদ্রিত। কিঞ্চিৎ গমন করিয়া দূর হইতে একটি হৃদয়বিদারক দৃশ্য তাঁহার গোচরে আসিল। পরমাচার্য মুরারীদেবের রক্তাক্ত দেহ পথিমধ্যে শায়িত। তাঁহার মৃত শরীরের উপরে সংজ্ঞাহীনা আচার্যপত্নী কৃষ্ণা আর পিতার মৃতদেহ এবং সংজ্ঞাহীনা মাতার পার্শ্বে স্থাণুবৎ উপবিষ্টা আচার্যকন্যা সোমদত্তা। শিখরাদিত্যের অন্তরের অন্তঃস্থলে এক নিবিড় বেদনা সঞ্চারিত হইল। মুহূর্তের মধ্যে অনুধাবন করিলেন এই নিধনকান্ডের অন্তরালবর্তী নায়ক চিরঞ্জীব ব্যতীত আর কেহ নহে।। তাহার নির্দেশেই এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হইয়াছে। দ্রুত পদচালনা করিয়া তিনি দীর্ঘিকার তীরে উপস্থিত হইয়া লক্ষ্য করিলেন ঘন লতাগুল্মের আড়ালে চিরঞ্জীব আত্মগোপন করিবার চেষ্টা করিতেছে। তাহার দক্ষিণহস্তে উদ্যত শানিত কৃপাণ। শিখরাদিত্যকে দেখিয়া লতাগুল্মের অন্তরাল হইতে বাহিরে আসিল চিরঞ্জীব। প্রশ্ন করিল, ‘ তুমি একাকী? না সঙ্গে করিয়া রাজসৈন্য লইয়া আসিয়াছ?’ মৃদু হাসিয়া শিখরাদিত্য বলিলেন,’ আমি নিরস্ত্র এবং একাকী। যদিও নিরস্ত্র একাকী মানুষকে হত্যা করা তোমার নীতিবহির্ভূত নয় তবুও আমি আশা করিব আমাকে হত্যা করিবার পূর্বে আমার কতিপয় প্রশ্নের সদুত্তর দান করিয়া মৃত্যুর পূর্বে আমার অশান্ত আত্মার শান্তিবিধান করিবে।‘ চিরঞ্জীব জিজ্ঞাসা করিল,’ তুমি এই নির্জন গোপন স্থানের সন্ধান কী করিয়া পাইলে?’ কবিশ্রেষ্ঠ বলিলেন,’ কিছুকাল পুর্ব হইতেই আমি এই স্থানের সহিত পরিচিত। এই দীর্ঘিকার জল পূর্বে নির্মল ছিল , এখন দূষিত, পঙ্কিল। এই বৃক্ষসকল পূর্বে পত্র এবং পুষ্পভারে আনত থাকিত ,এখন তাহারা মৃত্যুপথযাত্রী। বিচিত্র পক্ষীকূলের গুঞ্জনে এই স্থান সদাসর্বদা মুখরিত থাকিত, এখন তাহারা মৃত। তাহাদের অর্দ্ধগলিত শব জলাশয়ে ভাসমান। এই সোপানশ্রেণী ছিল এক কিশোর-কিশোরীর প্রেমাঙ্গন। এখন তাহাদের ভালোবাসা ঐ পরমাচার্যের মতই বিগত, মৃত। অদ্য প্রভাতে রাজপথ হইতে এই দীর্ঘিকাতীরে তোমাকে আত্মগোপন করিয়া থাকিতে দেখিয়া এই ধ্বংসলীলার কারণ অবগত হইলাম।‘

তুমি রাজ অন্নভোগী। তোমার কোনও প্রশ্নের উত্তর প্রদান আমার মত বিপ্লবীর শোভা পায়না।

অন্ন রাজার নয় , বিপ্লবী চিরঞ্জীব। ভূমিকর্ষণপূর্বক শস্য উৎপাদন করে কৃষককুল। সেই অন্নে প্রতিপালিত হই আমরা সবাই। তুমি , আমি এবং রাজা।

তাহলে কৃষক কেন বঞ্চিত? রাজা কেন প্রভূত সম্পদের অধিকারী? তুমি কেন সুবিধাভোগী?

আমি তোমার সহিত একমত যে অর্থের এই অসমবন্টন ঘোরতর অন্যায়। এই অন্যায়বিধানে বিপ্লব অবশ্যপ্রয়োজনীয় । কিন্তু সেই বিপ্লবের পুরোভাগে থাকিবার যোগ্য কাহারা?

অবশ্যই যাহারা বঞ্চিত তাহারা। যে কামার, কুমোর, কারিগরগণ অক্লান্ত শ্রমের বিনিময়ে মৃত্তিকাগর্ভস্থ খনিজ পদার্থ উত্তোলন হইতে শুরু করিয়া নিত্যব্যবহার্য বস্তুসকল উৎপাদন করিয়া মানবসভ্যতার অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করিতেছে অথচ যাহাদের শ্রম রাজা প্রতিনিয়ত লুন্ঠন করিয়া নিজের ভান্ডার পূর্ণ করিতেছে সেই চিরদরিদ্র , নিপীড়িত শ্রমিক এবং কৃষকশ্রেণীই এই বিপ্লবের পুরোভাগে থাকিবার অধিকারী এবং যোগ্য।

তাহা হইলে এই জনপদের নির্জনপ্রান্তে আত্মগোপন করিয়া ইহাকে ধ্বংস করিতেছ কেন? নাগরিক বিপ্লবের নাম করিয়া এই স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ষোড়শ সপ্তদশবর্ষীয় কিশোরদের জঘন্য হত্যাকান্ডে লিপ্ত করিতেছ কেন? তাহাদের পিতৃতুল্য শিক্ষকনিধনে বাধ্য করিতেছ কেন?

এই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা রাজস্বার্থ রক্ষা করে তাই।

তাহা হইলে যে শিক্ষাব্যবস্থায় নিপীড়িত, বঞ্চিত শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা হয় সেই শিক্ষায় তাহাদের শিক্ষিত করিতেছ না কেন? গ্রামের পর গ্রাম জুড়িয়া কৃষকেরা যে অবাধ হত্যালীলায় মত্ত হইয়া উঠিয়াছে তাহার পরিণতি ভয়ঙ্কর হইতে বাধ্য। রাজা আর ভূস্বামীদের হত্যা করা বিপ্লবের নীতিবিরুদ্ধ। ইহাতে উদ্দেশ্য সাধিত হইবে না। জনমত সৃষ্টি করিয়া, কৃষক এবং শ্রমিকদের শিক্ষিত করিয়া, সংগঠিত করিয়া রাজা এবং ভূস্বামীদের নিষ্ক্রিয় করিতে পারিলেই বিপ্লবের উদ্দেশ্য সাধিত হইবে। ব্যক্তিহত্যা সমরবাদেরই নামান্তর।

তুমি যে পদ্ধতির কথা বলিতেছ তাহাতে জয়লাভ সময়সাপেক্ষ। আমাদের হাতে সময় নাই।

দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধই বিপ্লবের সঠিক এবং বিজ্ঞানসম্মত পথ। ইহা সময়সাপেক্ষ সে কথা সত্য কিন্তু জয় সুনিশ্চিত। তোমার শ্রেণীশত্রু হত্যার তত্ত্ব ভ্রান্ত। বিপ্লবের দোহাই, তুমি এ পথ পরিত্যাগ করো। এখনও সময় আছে।

তুমি সুবিধাভোগী। তুমি ভ্রান্ত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিপালিত। তাই তুমি বিপ্লবের পথ হইতে আমাকে নিরস্ত করিতে উদ্যত হইয়াছ । কারণ, তুমি জান আমার হাত হইতে তোমার পরিত্রাণ নাই। তুমিও মধ্যপন্থী এবং শ্রেণীশত্রু।

চিরঞ্জীব, তুমি যাহা বলিতেছ তাহা যদি সত্য হইত তবে রাজসৈন্যদের দূরে রাখিয়া সকলের অগোচরে এই নির্জন স্থানে একাকী তোমার নিকট আসিতাম না। আমার মুহূর্তের ইশারায় রাজার সৈন্যরা তোমাকে বন্দি করিতে পারিত। আমার উপদেশ গ্রহণ কর। বিপ্লবের এতবড় সর্বনাশ সাধন করিও না। তোমার সহবিপ্লবীরাও একই কথা বলিতেছে। এই ব্যক্তিহত্যার পথ ত্যাগ না করিলে উহারাও তোমাকে ত্যাগ করিবে।

তুমি বুধাদিত্যের জ্যেষ্ঠভ্রাতা তাই তাহার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হইয়া প্রতিবিপ্লবী আচরণ করিতেছ।

তুমি আমার অনুজপ্রতিম, চিরঞ্জীব। আমি বিপ্লব এবং প্রকৃত বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। আমি সাম্যবাদের পক্ষে কিন্তু এই মুহূর্তে যে কোনও রকম হত্যার বিরুদ্ধে।

তুমি ফিরে যাও, শিখরাদিত্য। আমিই বিপ্লব। আমি একাই বিপ্লবের নীতিনির্ধারক। যারা আমার নীতির বিরুদ্ধাচরণ করবে তারাই প্রতিবিপ্লবী। আমার বিরুদ্ধতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেই শাস্তি কী তা তুমি নিশ্চয়ই অবগত আছো, শিখরাদিত্য।

আমি ফিরে যাব কি না জানিনা। তবে তোমাকে শেষবারের মত বলে যাই বিপ্লব বিপদাপন্ন। বিপ্লবের স্বার্থে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষকে অন্ধকার ধূলিঝড়ে পরিণত করা থেকে বিরত থাক। তাতে সকলের মঙ্গল।

সেইদিন চিরঞ্জীব শিখরাদিত্যকে হত্যা করিয়াছিল না শিখরাদিত্য আচার্য মুরারীদেবের অন্তিমযাত্রায় যোগদান করিয়াছিলেন তাহা আজও অজ্ঞাত । অনতিকাল পরেই চিরঞ্জীবকে রাজসৈন্যরা বন্দি করিয়া কারাগারে নিক্ষেপ করে এবং কারাগারের অভ্যন্তরেই তাহার মৃত্যু ঘটে। কয়েকবছর পরে অনুতপ্তহৃদয় কুন্তল ফিরে এসেছিল। কিন্তু ততদিনে তার বাবা-মা ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছিলেন। সোমার মনে কুন্তলের জন্য ভালোবাসা না ঘৃণা কী জমেছিল তাও অজানা। এইসব নানান অজানা তথ্যের সন্ধানে ব্যস্ত রইলাম। পরে কোনও এক সময় সেই গল্প নিয়ে আবার হাজির হবো পাঠকদের দরবারে। আজ এখানেই শেষ।

0 comments: