0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















২৮

মিসেস সুজান গত তিন বছর ধরে যুদ্ধটা দেখে আসছেন। প্রথম প্রথম জার্মান সৈন্যদল আর, মিলিটারি ট্রাক, সাঁজোয়া কামানও আসতে দেখেছেন তিনি। ধূসর হেমন্তে সেতু পেরিয়ে পোল্যান্ডের সীমানার দিকে যেত ওরা। তখন ব্যাপারটা সত্যিই যুদ্ধ যুদ্ধ ছিল। নোংরা কালিঝুলি মাখা পদাতিক সৈন্যদল, ঘোড়ায় চড়া ক্লান্ত অফিসার, মোটরবাইকের আনাগোনা। কিছু ইতস্তত বিক্ষিপ্ত শান্ত বিকেল বাদ দিলে সবসময়ের ব্যস্ততা চোখে পড়ত। সৈন্যদল কুচকাওয়াজ করে যেত, সামনে পিছনে গাড়ি কিম্বা মোটরসাইকেলের কনভয়। তবে এখন আর তেমনটি দেখা যায় না।

কিন্তু কিছুদিন পরে ব্যাপারস্যাপার একেবারে বদলে গেল। মাঝেমধ্যে এক দুটো জার্মান মিলিটারি ট্রাক সেতু পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে যায়। মাঠঘাটের নীরবতা ছিন্ন করে ইঞ্জিনের শব্দটা অনেকটা সময় ধরে শোনা যায়। যতক্ষণ না দূরে পাহাড়ের পথ ধরে ট্রাকটা না অদৃশ্য হয়, প্রায় ততক্ষণ, মানে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরেই শোনা যায় শব্দটা। মিসেস সুজানের নিজের শিশুবেলার গ্রামের কথা মনে পড়ে। ওই পাহাড়ের উপরেই সেই গ্রাম। অনেক উঁচুতে গ্রীষ্মের সবুজ উপত্যকা, শীতের হিমেল পাহাড় এসবের কথা মনে পড়ে। ওই পাহাড়ের কোলে চড়াই উতরাইতে খেলা করে কেটেছে তার ছোটবেলা। কিন্তু সে সময় এইসব অঞ্চলে কোনো গাড়িঘোড়া দেখা যেত না বিশেষ। কালেভদ্রে জিপসিদের ক্যারাভান অথবা ইহুদীদের গাড়ি দেখা যেত, যেগুলো পাহাড় পেরিয়ে পোল্যান্ডের দিকে যেত। অনেক পরে, সেই গ্রাম ছেড়ে চলে আসবার অনেক পরে আর কি… রেললাইন পাতা হল। ঝারনির কাছে সেতু পেরিয়ে উপত্যকার মধ্য দিয়ে রেললাইন চলে গেল। ছোটবেলায় পাহাড়ের উপর থেকে সেই উপত্যকার দিকে তাকিয়ে থাকত সে। বহুদিন সে ওই গ্রামের দিকে যায়নি। দশ বছর হয়ে গেল প্রায়। তবুও মিলিটারি গাড়িগুলো যখন পাহাড়ের রাস্তায় উঠে ওই গ্রামের দিকে যায়, সে শুনতে পায় গাড়ির শব্দ। যে পথে সে শৈশবে খেলে বেড়াত, সেই পথ দিয়েই চলে যায় যুদ্ধের ট্রাক। সেই পথে হয়তো এখনও খেলে বেড়ায় তার ভাইয়ের ছেলেরা, তারা হয়ত তাঁরই মত চেয়ে দেখে উপত্যকার পথে। হয়ত তারা দেখতে পায় যে পাহাড়ি পাকদণ্ডীর আঁকাবাঁকা পথে কী ভাবে কষ্ট করে উঠে আসছে গাড়িগুলি।

গত দু মাস ধরে আবার ট্রাক আসছে। কখনো আবার সৈন্য ভর্তি ট্রাক দাঁড়ায় তার এখানে। বিয়ার খায়, তারপর আবার পাহাড়ি পথের দিকে রওনা দেয়। আবার সন্ধেবেলায় পাহাড় থেকে নেমে এসেও গাড়িগুলো দাঁড়ায় তার এখানে, বিয়ার খেয়ে আবার সমতলে নেমে যায়। তবে গাড়িগুলোতে বেশি সেনা থাকে না। সেনা ভর্তি ট্রাক সাকুল্যে বার তিনেক এসেছে। কারণ মিসেস সুজানের বাড়ির ঠিক পিছনদিকে নদীর উপরের সাঁকোটা উড়ে গিয়েছিল। কী বীভৎস আওয়াজ আর চিৎকার চেঁচামেচি হয়েছিল মাঝরাতে, সে আর বলার নয়। মিসেস সুজান নিজেও খুব জোর চেঁচিয়েছিলেন। রাস্তায় নেমে তার প্রতিবেশীরা সবাই চিৎকার করছিল। তার মেয়ে মারিয়া, যার বয়স আঠাশ, সেও ভয়ানক চেঁচিয়েছিল এবং ওই ঘটনার পর থেকেই সে অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করেছিল। জানালাগুলো ভেঙে গিয়েছিল। খামারের গরুগুলি ভয়ে হাম্বা হাম্বা করে প্রবল আর্তনাদ করছিল। কুকুরগুলো সারারাত্তির ডেকে গিয়েছিল। সাঁকোটার মাঝের রাস্তা, রাস্তার পাশে ফুটপাথ, ফুটপাথের রেলিং- সব উড়ে গিয়েছিল। শুধু কংক্রিটের পিলারগুলো জেগে ছিল নদীর বুকে। সাঁকোটার লোহার কাঠামোটা পড়ে গিয়েছিল নদীতে। কোথাও কোথাও মরচে ধরা অংশ জলের উপরে এখনও জেগে আছে। সাঁকোটা উড়ে যাবার পরদিন সকালে এক জার্মান অফিসার জনাপাঁচেক সেনা নিয়ে এলেন এখানে। এই বার্কজাবা গ্রামের সব বাড়িতে খানাতল্লাসি চলল। প্রথমেই মিসেস সুজানের বাড়িতে এসে ঢুকেছিল আর্মির লোকেরা। সবগুলো ঘর, আস্তাবল এমনকি তার অসুস্থ শয্যাশায়ী মেয়ে মারিয়ার ঘরটাও বাদ গেল না। এমনিতেই রাতে সাঁকো উড়ে যাবার শব্দে মারিয়া ভীষণ ঘাবড়ে ছিল। সকালেও তার গোঙানি থামেনি। টেমানদের বাড়িতেও গিয়েছিল তারা। খামারবাড়ির সব খড়ের গাদার মধ্যে ছুঁচ খুঁজবার মত করে খোঁজাখুঁজি করছিল তারা। ব্র্যাকিদের বাড়ি, যেটা প্রায় গত তিন বছর ধরে ফাঁকা, পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, সেখানেও ঢুকেছিল তারা। ব্র্যাকিরা প্রেসবুর্গে চলে গিয়েছে। সেখানেই কাজকর্ম করে তারা। এই গ্রামে এসে এখনও কেউ তাদের ফাঁকা বাড়ি, জমি এসব কিনে নেয়নি।

জার্মানগুলো বেজায় ক্ষেপে গিয়েছিল, কারণ সন্দেহজনক কোনো মানুষ অথবা জিনিস, তারা খুঁজে পায়নি। মিসেস সুজানের বাগানের ছাউনি থেকে নৌকাটা বের করে নিয়ে চলে গিয়েছিল তারা নদী পেরিয়ে জেনকোশিকের দিকে। পাহাড়ের খাড়াই পথ শুরু হবার মুখে একটা ছোট গ্রাম জেনকোশিক। তাদের ঘরের ছাদের জানালা থেকেই জার্মানগুলো বনের পেছনে ওই গ্রামের গির্জার মিনারটা দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু জেনকোশিক গ্রামে গিয়েও তাদের বিশেষ কিছু লাভ হল না। টেসার্জি গ্রামে গিয়েও নয়। আসলে তারা কেউ জানতোই না যে সাঁকোটা উড়ে যাবার পর থেকেই সোয়র্টশিক গ্রামের দুটো ছেলে ফেরার।

সাঁকো উড়িয়ে দেবার ব্যাপারটা মিসেস সুজানের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছিল। এমনিতেই কালেভদ্রে এক দু মাস অন্তর আসে জার্মান ট্রাক। সেনা ভর্তি গাড়ি আসে আরও কম। ওই সাঁকো বেশিরভাগ সময়ে চাষিদের কাজে লাগত, যারা ওপারে জমিতে বা জঙ্গলে আবাদ করে। জার্মানদের আর কি এমন সমস্যা হল ওই সাঁকো উড়িয়ে দেওয়াতে? আধ ঘণ্টা বেশি ঘুরে ঝারনি হয়ে বেরিয়ে যাবে ওদের ট্রাক। ঝারনির রেলরাস্তার সাঁকোর পাশে আরও চওড়া সাঁকো আছে নদী পেরিয়ে যাবার জন্য।

সাঁকো উড়ে যাবার আসল প্রভাবটা মিসেস সুজান আরও বেশ কিছুদিন পরে বুঝতে পেরেছিলেন। প্রথম প্রথম বেশ কিছু কৌতূহলী লোকজন আসা শুরু হয়েছিল। আসল ঘটনা নিজের কানে শুনতে আর নিজের চোখে ভাঙা সাঁকো দেখতে আসা কিছু অত্যুৎসাহী লোকজন আসত, যারা তার দোকানে শ্নাপ অথবা বিয়ার খেত। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে এই বার্কজাবাতে সব কেমন সুনসান হয়ে গেল। চাষি, জন খাটার কিষাণ, জেনকোশিকের গির্জায় রবিবারে প্রার্থনা করতে যাওয়া ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান, কিম্বা জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়া প্রেমিকপ্রেমিকারা- কেউই আর এই পথে আসত না। সৈন্যদেরও আর এ পথে আসার কোনো প্রশ্ন নেই। দু সপ্তাহের মধ্যে তিনি প্রতিবেশী কিপটে টেমানকে মাত্র এক গ্লাস বিয়ার বিক্রি করতে পেরেছিলেন। শ্নাপগুলো পড়ে থেকে থেকে আপনা আপনি একদম নষ্ট হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা হল তার। পুরো বিষয়টা তার কাছে খুব হতাশাজনক ছিল। দু সপ্তাহে একবার শুধু ওই কিপটে টেমানকে এক গ্লাস বিয়ার বিক্রি করে কি তার ব্যবসা চালানো সম্ভব?

কিন্তু এই একদম নির্জন পরিস্থিতি খুব বেশি হলে তিন সপ্তাহ স্থায়ী হয়েছিল। একদিন একটা ধূসর, ছোট, খুব চটকদার মিলিটারি গাড়ি তিনজন জার্মান অফিসারকে নিয়ে এল। তারা উড়ে যাওয়া সাঁকোটার চারদিকের পরিস্থিতি পরিদর্শন করতে এসেছিল। আধ ঘন্টা ধরে নদীর পারের উঁচু রাস্তার উপরে এবং রাস্তার নিচ দিয়ে হেঁটে চলে, হাতে দুরবীন নিয়ে পুরো এলাকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। প্রথমে টেমানদের ছাদে উঠল, তারপর তাদের বাড়ির ছাদে। দুরবীন দিয়ে উপর থেকে এলাকাটা দেখল এবং তারপর তার এখানে একটা শ্নাপ কিনেও না খেয়েই চলে গেল।

তার ঠিক দু দিন পরে ধীর স্থির ধূলিধূসর মেঘের মত চেহারায় একটা গাড়ি এলো বার্কজাবাতে টেসার্জির দিক থেকে। হা ক্লান্ত সাত জন সৈনিক আর একজন সার্জেন্ট। তারা নাকি এখানে থাকবে, এখানেই খাবে, ঘুমোবে। মিসেস সুজান প্রথমে ব্যাপারস্যাপার দেখে ভারি ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু পরমুহুর্তে তার মনে হল যে এটা তো তার জন্য একটা ভালো ব্যবসা হওয়ার ইঙ্গিত। এই কথা বুঝতে পেরেই দৌড়ে তিনি দোতলায় মারিয়ার ঘরে গেলেন, যে তখনো বিছানায়।

সৈনিকদের দেখে মনে হচ্ছিল যে তাদের হাতে অঢেল সময়। তারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল। একটু বেশি বয়স যাদের, তারা পাইপে তামাক ঠুসে, তারপর বিয়ার খেয়ে ধীরে সুস্থে নিজেদের মালপত্র নামাতে লাগল। যতক্ষণ না মিসেস সুজান তিনটে ঘর তাদের জন্য ঠিকঠাক প্রস্তুত করে দিলেন, ততক্ষণ তারা ধীরভাবে অপেক্ষা করেছিল। চাষের কাজের জন্য যখন কেউ আসত, সে যে ঘরে থাকত, সেই ঘরটা গত তিন বছর ধরে খালি পড়ে আছে, কারণ চাষের কাজের জন্য লোক লাগানো ভারি ব্যয়বহুল। আরেকটা ছোট ঘর, যেটা তার স্বামী বলেছিলেন যে কোনো আত্মীয়, বন্ধু কিম্বা অতিথি এলে থাকতে পারে, সেটাও ফাঁকা ছিল। কারণ সেখানে কখনোই কোনো অতিথি আসেনি। এছাড়া বিয়ের পর থেকে তিনি নিজে যে ঘরে থাকতেন স্বামীর সঙ্গে, সেটাকেও তিনি ফাঁকা করে দিলেন। তিনি মারিয়ার সঙ্গে মারিয়ার ঘরে থাকবেন। ঘরগুলো ঠিকঠাক করে নিচে নেমে আসবার পরে সার্জেন্ট মিসেস সুজানকে বোঝাতে লাগল যে তাকে ঘরের ভাড়া হিসেবে কত টাকা দেওয়া হবে। এছাড়া তিনি সৈনিকদের খাবারদাবার রান্না করে দিলে, সেটার জন্য আলাদা টাকা দেওয়া হবে।



(চলবে)

0 comments: