0

সম্পাদকীয়

Posted in





আরও একটি বছর শেষ হয়ে গেলো কিছু বোঝার আগেই! এ মাসের ৩০ তারিখ সাত পূর্ণ করে আটে পা দেবে ঋতবাক। নানান ঝড় ঝাপটার মধ্যেও লক্ষ্য স্থির রাখা গেছে, তার মূল কারণ কেবলই দৃঢ় সংকল্প আর বন্ধুদের সাহচর্য। শুধু অপরিসীম কৃতজ্ঞতাই নয়, অফুরান ভালোবাসাও ।

অতিমারীর দাপটে একবছর বইমেলা হলো না। চারদিকে বিবিধ অস্থিরতা সত্ত্বেও পরবর্তী মেলায় দেখা হোক আমাদের। শুধু বাণিজ্যিক কারণেই নয়, বাৎসরিক মিলনোৎসব বলেও!

এই ব্লগ প্রকাশিত হওয়ার একদিন পরই জন্মদিন আমাদের এক চিরকালীন অহংকার শম্ভু মিত্রর। এবারের ক্রোড়পত্রে তাঁর প্রতি আমাদের বিনম্র প্রণাম।

এমাসের পত্রিকার ক্ষুদ্র পরিসরে আরও স্মরণ করি বাঙলার নিজস্ব শিল্প সংস্কৃতির ধারার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। এবছর তাঁর ১৫০তম জন্মজয়ন্তী উদ্‌যাপন বর্ষ।

সচেতন থাকুন, সৃজনে থাকুন

শুভেচ্ছা নিরন্তর।

0 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সুব্রত ঘোষ

Posted in




















এক শ্বেতাঙ্গিনী সাধ্বী এক দৃষ্টিতে দেখছেন একটি ছবি। ঘরের বড় জানালার আলো ছবির ওপরে এসে পড়েছে। ছবির মধ্যে এক নারী মূর্তি। গৈরিক বসনা সেই নারী কি যোগিনী ? সাধ্বী এই প্রশ্নই করলেন এই ছবির শিল্পীকে। শিল্পী তাঁর ছবির সংক্ষিপ্ত ব্যখ্যা করলেন। নারীমূর্তি র চার হাতের উপস্থিতি লক্ষ্য করলে তাকে মানবী বলা যায় না। সে যেন কোনো স্বর্গের দেবী। শ্বেতাঙ্গিনী ছবিতে নিমগ্ন হয়ে দু’ চোখ বুজলেন। এক গভীর নিশ্বাস তাঁর ওষ্ঠ কেঁপে ধ্বণিত হলো,- ‘হে মাতঃ’।

শ্বেতাঙ্গিনী সাধ্বী আর কেউ নন, তিনি স্বয়ং মহিয়সী ভগিনী নিবেদিতা। এই আইরিশ মহিয়সী স্বামী বিবেকানন্দকে গুরু মেনে এই ভারতবর্ষে এসেছেন। ভারতের জনমানসকে উপলব্ধি করেছেন। এই পরাধীনতার জনাকীর্ণে তিনি নিজেকেও সামিল করেছেন। আজ এই চতুর্ভূজা দেবীচিত্র তাঁকে সম্মোহীত করেছে। ছবিটির থেকে চোখ সরাতে পারছেন না নিবেদিতা। তিনি কতকটা বিস্মিতও হয়েছেন। এ যেন এক আবিষ্কারকে আবিষ্কার করা। এর স্রষ্টা নিজেও তার সৃষ্টিতে বিস্মিত, খুশীও। শিল্পী স্মিত হেসে ওঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন। শিল্পী জানালেন যে, এই ছবির নাম রেখেছেন ‘ভারতমাতা’।

এই চিত্রকর্মের সামনে শিল্পী ও সাধ্বীর এই উপস্থিতির দৃশ্যটি ভারতবর্ষের শিল্পের এবং রাজনীতির ইতিহাসে এক বিশেষ অধ্যায়কে সূচীত করে। এই আলোচীত শিল্পী হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি থেকে সূর্যালোকের মতো যে দ্যূতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তা’ অবনীন্দ্রনাথের কাকা বিশ্ববরেণ্য রবীন্দ্রনাথের খ্যাতির। অবনীন্দ্রনাথ সেই সৌরবলয়ে প্রতিভাত অনন্য একটি গ্রহের মতোই, প্রকাশিত হয়েছেন ক্রমে এবং দীর্ঘ প্রসারী হয়েছেন মানুষের মননে। রবীন্দ্রনাথ, মানে অবনীন্দ্রনাথের ‘রবি কা’ তখন বাঙলা তথা ভারতবর্ষে সাহিত্য – সংস্কৃতির নবজাগরেণের পথিকৃত। ১৯০৫ সালের কথা বলছি। দেশীয় রাজনীতির উতপ্ত অবস্থা। তার আঁচ গিয়ে পড়ল ঠাকুরবাড়িতে। ভারতবর্ষের ভাইসরয় লর্ড কার্জন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বঙ্গ ভঙ্গ করার। এর প্রতিবাদে অতি সক্রীয় হলেন রবীন্দ্রনাথ। হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি করে ইংরেজ শাষক তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে মরিয়া। দেশে ধর্মীয় উন্মাদনায় দিকে দিকে বিদ্বেষের আগুন তখন ছড়িয়ে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ দুই ধর্মের মানুষের মিলনের আহবানে রাস্তায় নামলেন। কলকাতার জনপথে কার্জনের এই জঘন্য নীতির বিরোধিতা করে ঠাকুরবাড়ির সব সদস্যরা রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে পদযাত্রা করলেন। সঙ্গে যোগ দিল অগণিত মানুষ। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে সবাই একে অপরের হাতে ভাতৃত্বের চিহ্ন স্বরূপ রাখী পরিয়ে দিল। সেই শুরু বাঙলার রাখী বন্ধন উৎসবের।

ভগিনী নিবেদিতা
এই ১৯০৫.......কি এক ভীষণ উদ্বেলিত সময় ! এই বছরের শুরুতেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। তিনি শিলাইদহের জমিদার হয়েও অধিক পরিচীতি লাভ করেছিলেন ‘মহর্ষি’ রূপে। মহর্ষির তরুণ বয়সের ধর্ম ও দর্শনের প্রতি গভীর আগ্রহ ক্রমে তাঁকে দেশের মানব কল্যানে পরিচালীত করে। সমাজে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অত্যাচার তাঁর কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। মানুষের অশিক্ষাই যে এই দূরবস্থার মূল, তা’ অনুধাবন করেছিলেন তিনি। এই দূরাবস্থাকে নির্মূল না করলে ভারতবর্ষের মানুষ কোনও দিনই প্রকৃত স্বাধীনতার আলো দেখবে না। এই আলোকদীপ্ত চিন্তার সূত্রপাত করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথের পিতা প্রিন্স্ দ্বারকনাথ ঠাকুর। তিনি ভারতবিখ্যাত শিল্পপতি হয়েও সমাজ সংস্কারে ব্রতী হয়েছিলেন। দ্বারকানাথের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তাঁরই স্বহৃদয় বন্ধুবর, আরেক আলোক প্রসারী ব্যক্তিত্ত রাজা রামমোহন রায়। দেবেন্দ্রনাথের মানব হিতৈষী মন এবং সমাজ সংস্কারে ব্রতী হওয়া অনেকটাই উত্তরাধিকার প্রাপ্তি। বিলেতে জনপ্রিয় দ্বারকানাথের অন্তঃকরণে যে দেশের মানুষের জন্য শোক, তা’ অল্প বয়েসেই বোধকরি তাঁর সুপুত্রের মনের গভীরে স্থান নেয়। দেবেন্দ্রনাথ ভারতীয়ত্ত্ব তথা হিন্দুত্ত্ব নিয়ে বিশেষ গবেষণায় মগ্ন হয়েছিলেন। ক্রমে ধর্মের শাশ্বত দর্শণের মূল মন্ত্রের সন্ধান সমাজকে দিতে চাইলেন। ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রচলন করলেন ব্রাহ্ম ধর্ম। এই ধর্ম মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করে না। নেই পৌত্তলিক পূজার আরোপিত শাষন। যে অর্চণার অলঙ্কারে মানুষ নিজের অন্তরাত্মাকে বন্দি করে রেখেছে, তা’র মুক্তির পথ দেখালেন দেবেন্দ্রনাথ। শ্রেণী অহঙ্কার ত্যাগ করে পরম ব্রহ্মের কাছে নিজেকে নিবেদন করলেন। নিজ পিতার যে’টুকু বৈভব আর পাশ্চাত্তের আবরন তাঁর ওপরে ছিল, জীবনের গোধূলি বেলায় তা’ও বিসর্জণ দিলেন। এই ত্যাগের মধ্যেই খুঁজেছিলেন প্রকৃত হিন্দু ধর্মের মানে। ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারে মহর্ষী তাঁর সঙ্গে পেয়েছিলেন কেশব চন্দ্র সেন কে। পেয়েছিলেন একদল উদ্যোগী শিক্ষিত উন্নত মনের মানুষ। শিক্ষার সচেতনতা এলো বাঙলায়। ব্রাহ্ম ধর্মের জোয়াড় এলো রাজধানী কলকাতা ও অন্যান্য স্থানেও।

ব্রাহ্ম ধর্ম ও শিক্ষিত মননের উত্তরসূরী ঠাকুরবাড়ীর সম্প্রদায় এবং তদঘনীষ্ঠ শিক্ষিত –সচেতন মানুষেরা সমাজে বহু উন্নয়ন মূলক কাজে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তখন ব্রিটিশ শাষণের অন্ধকার যুগ। ব্রিটিশ রাজ ক্রমাগত অন্যায় অবিচার বৃদ্ধি করে চলেছে। ফলতঃ চারিদিক থেকে ব্রিটিশ বিরোধী সন্ত্রাশের খবর আসে সর্বদা। দেশের স্বার্থে বিক্ষিপ্ত আন্দোলন আর আত্ম বলিদান অব্যাহত। এমতাবস্থায় বাঙালী বুদ্ধিজীবিকূলের অনেকেই শাষকদলের বিরুদ্ধে সক্রীয় হলেন। সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথের রাখীবন্ধনের প্রতিকী মর্মার্থ আপামর জনগনকে প্রভাবিত করলো। বাঙলা ও তার বহিরাঞ্চলে এর ঢেউ পৌঁছলো। বলা বাহুল্য যে, এই সাংস্কৃতিক তথা রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক এবং দুই ধর্মের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান এর সাফল্য এনেছিল, ইতিহাস তা’ই বলে। জাতীয়তাবাদের স্বদেশী সচেতনতার পদ্ম এভাবেই প্রস্ফুটিত হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীতে। সমাজের সর্বোচ্চ বর্গের সভ্য হয়েও রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবার স্বদেশী আন্দোলনের সদর্থক ভূমিকা নিতে কখনো দ্বিধা করেননি।


তরুণ অবনীন্দ্রনাথ
১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের ঠাকুরবাড়ীর এই সক্রীয় স্বদেশী ভাবনা অনেকাংশেই ভারতবর্ষে প্রথম সফল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বলে বিবেচনা করা যেতেই পারে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, মহাত্মা গান্ধী তখনও এই দেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে পরিচীত হয়ে ওঠেন নি। জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ রাজের কাছে কিছু দাবি রেখেছিল, স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি তা’তে ছিল না। এদিকে তখন রবীন্দ্রনাথ দেশের মানুষের একতার জন্য লিখছেন। মানুষের আত্ম চেতনার উন্মেষের কথা বলছেন গানে গানে। অবনীন্দ্রনাথও থেমে থাকেন নি। জাতিয়তাবোধের সঞ্জীবনী রস নীরবে জারিত হয়েছে তাঁর মধ্যে, যা’র রসোত্তীর্ণ প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছে তখন তাঁর চিত্র শিল্পে। পাশ্চাত্য শিল্প শিক্ষায় পারদর্শীতা অর্জন করেও অবনীন্দ্রনাথ দেশীয় চিত্রভাষার সন্ধানে ব্রতী হলেন। দেশীয় মাধ্যম অবলম্বন করে নিজের চিত্রশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর তিনি অন্তর্দ্বন্দে ভুগছিলেন। তৈলচিত্রে আলো ছায়ার মায়া তৈরী করা, কিংবা বস্তুর ত্রিমাত্রিক রূপকে যথাযথ ভাবে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা ...এ সবই তিনি সহজ ভাবে করতে পারেন। তাঁর অল্প বয়সে আঁকা রবি কা’র পোর্ট্রেট টি আজও সেই বিরল মুন্সিয়ানার সাক্ষ্য বহন করছে। রয়েছে মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিও, অপূর্ব তার অভিব্যক্তি ! কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ এই সব ছবি তে সন্তুষ্টি পান নি। তিনি দেশজ ভাব, দেশজ বিষয় নিয়ে পরীক্ষা – নিরীক্ষা শুরু করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে অঢেল ঐতিহাসিক ঐশ্বর্য্য। অজন্তা,ঈলোরা, বাঘ, চৈত, অমরাবতী, দিলওয়ারা ...এমনই শিল্পের কত রত্ন সম্ভার ! অবন ঠাকুর সেই সব মনি মুক্তো থেকে রসদ সংগ্রহ করলেন তার ছবির জন্যে। নিজে দিনের পর দিন সেই সব প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান থেকে ড্রইং করে ভারতীয় আদি রূপকলার ভাব আর ভাষা টি আয়ত্ত্ব করলেন। ভারতবর্ষের আদি শিল্পকলার পুনরোথ্থান ঘটালেন তিনি। তাঁর ছা্ত্রদেরও তিনি এই পুনরোথ্থানের পাঠটি শিখিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে গড়ে তুললেন এক নতুন শিল্প বিদ্যায়তন, যা’ ইংরেজ শিল্পশিক্ষা কে তোয়াক্কা না করে এগিয়ে চলল। এই শিল্পের অগ্রগতি নীরবে বিদেশী বস্তু-বিষয় বর্জণ করে স্বদেশী ভাবধারাকে গ্রহণ করে যে এক বিরলতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করল, তা’তে কোনও সন্দেহ নেই। ১৯০৫ সালে কার্জনের বঙ্গ ভঙ্গের ঘোষণা অবনীন্দ্রনাথ কে চরম আহত করে। সেই ব্যাথাতুর হৃদয় জন্ম দেয় এক চতুর্ভূজা মাতৃ মূর্তির। সেই মূর্তির পরিধেয় বস্ত্র অতি সাধারন। নিরলঙ্কার, নাটকীয়তাহীন এক উপস্থিতি। ছবির জমি জুড়ে দেশের তিন রঙ- গেরুয়া, সাদা আর সবুজ দিয়ে সুকৌশলে শিল্পী রাঙিয়ে দিয়েছেন। সব প্রদেশেই এই মা কে যেন মানিয়ে যাবে। মা য়ের কোনও কালিক গন্ডী নেই। তা’ই ভারতবর্ষের সর্বকালের নির্যাসটুকু এই ছবির মাতৃরূপের মধ্যে বিদ্যমান।

অবনীন্দ্রনাথ কৃত রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি
                     
  অবনীন্দ্রনাথ কৃত দেবেন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি


কি আছে এই ছবিতে ? ছবি জুড়ে রয়েছে সেই মাতৃরূপ, ভারতমাতা। দেবীর অভিব্যক্তি কোনভাবেই কোনও উর্বষী, কিংবা কারোর প্রেয়সীর নয়। এই চেহারা এক পূর্ণ যোগিনীর। পরনে তাঁর ঘন লালচে গেরুয়া বস্ত্র। চার হাতে চার উপাদান। ওপরের দু’ হাতে পূঁথি অর্থাৎ বেদ আর বস্ত্র। নীচে নামানো দু’ হাতের একটায় এক গুচ্ছ ধানের ছড়া আর অন্য হাতে রুদ্রাক্ষের মালা। মা এসেছেন চার বরদান নিয়ে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা এবং আধ্যাত্মিক মন – এই চার উপাদানই দেশের মানুষের কাছে সর্বাধিক জরুরী বলে মনে করেছেন শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ। এই চার উপাদান প্রতীকী অর্থে সুপ্রাচীন ভারতীয় জীবনের সারমর্ম। এই সার অস্তিত্ত্ব ফিরে পেলে মানুষের শান্তি ও সুবু্দ্ধি ফিরবে। এই মা য়ের হাতে শাখা – পলা দেখা যাচ্ছে। কপাল প্রান্তে রয়েছে সিঁদূরের ছোঁয়াও। প্রাথমিক ভাবে অবনীন্দ্রনাথ এক বাঙালী মা য়ের রূপই দেখেছিলেন। বাঙলার এই আশু অস্তিত্ত্বের সঙ্কটে এই বাঙালী সাবেকী রূপকে দেবীতে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। সে দেবী যে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে আরাধ্যা হয়ে উঠবেন, শিল্পী তা’ আগে অনুমান করতে পারেন নি।

ভারতমাতা
বাঙলায় মাতৃ সাধনা এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। এই পূজার প্রচলন ডাকাতের আখড়া থেকে পূরোহিতের মন্দিরে, প্রায় সর্ব স্তরে ছিল। আজও বিশ্বের প্রায় সব বাঙালী গোষ্টিতেই মা দুর্গা বা মা কালির পূজো হয়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তেও মাতৃ বন্দনার ইতিহাস সুপ্রাচীন। মা অম্বা, মা শেরওয়ালি, কিংবা মা অন্নপূর্ণা, - সব মা য়েরই অগণিত ভক্ত সমাহার সারা দেশ জুড়ে। এমনকি প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহে স্থূলকায় পাথরের মূর্তি প্রমান করেছে সৃষ্টি শক্তি স্বরূপিনী মাতৃ দেবীর (Fertility Goddess) আরাধনার আাদি চর্চা। এই আদি দেবী প্রকৃতির ফলনের শক্তি দায়িনী। এই শক্তি দায়িনী জীবকূলের বংশবৃদ্ধির উৎস ও বটে। সৃষ্টি – প্রজনন শক্তির এই দেবী আরাধনা শুধুমাত্র ভারত ভূখন্ডেই হয়ে এসেছে, এমনটা নয়। ইওরোপ সহ আরও বহুস্থানে এই দেবী মূর্তির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। তাই আদি মাতৃ শক্তি সমস্ত মানুষের নিজস্ব জন্মাধিকার। পৃথিবীতে মানব সভ্যতার সৃষ্টি এই মাতৃশক্তি থেকে। সেই আদিকালে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ছিল না। তা’ই এই মাতৃ আরাধনা চর্চা সমস্ত ধর্মের উর্ধে। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম-সংস্কৃতিতে নারীশক্তি উপেক্ষিত। কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাসে অসংখ্য বার বহিরাগতদের আক্রমন ও অত্যাচার মাতৃ শক্তি অর্চণাকে মুছে ফেলতে পারে নি। ব্রাহ্ম অবনীন্দ্রনাথ তাই এই মূর্তিকে তাঁর কল্পনা দিয়ে সাজাতে দু’বার ভাবেন নি। এই মাতৃ মূর্তির উন্মুক্ত দুই চরণ মাটিতে। সামনে ফুটে আছে পদ্ম ফুল। মূর্তির মাথার পেছনে জ্যোতির্বলয় পবিত্র আলো এনেছে চারিদিকে। ভারতবর্ষের মাটি যেন স্বর্গ হয়ে গেছে। ..... এমনই দৃশ্যকল্প রচীত হলো। মানুষ ভারতমাতার সন্ধান পেল।

এই শিল্পকর্মের আগে ‘ভারতমাতা’র কোনও অস্তিত্ত্ব ছিল না। শুধু নতুন বিষয়বস্তু সৃষ্টিতেই নয়, নতুন প্রকরণ শৈলী র ব্যবহারে ও ভারতবর্ষের শিল্পকলার ইতিহাসে এক বিশেষ অবদান রেখেছে এই ‘ভারতমাতা’। তৈলচিত্র ও প্যাস্টেল ছেড়ে অবনীন্দ্রনাথ তখন জলরং করছেন। প্রকৃতি থেকে উপাদান সংগ্রহ করে দেশীয় ছবির রং সমূহ তৈরী করছেন। ‘ভগবান বুদ্ধ ও সুজাতা’, ‘শাহাজানের মৃত্যু প্রতীক্ষা’ ইত্যাদি চিত্রে সফলতা আসার পর অবনীন্দ্রনাথ আর পশ্চিমের দিকে ফিরে তাকান নি। এই পর্যায়ের এক বিশেষ সফলতা আসে এই ‘ভারতমাতা’ ছবিতে। অবনীন্দ্রনাথ যে প্রাচ্য শৈলীকে আত্মস্থ করছেন মন প্রান দিয়ে, তা’ও বোঝা যায় এই সফল ছবিটি দেখে। জাপানী চিত্রকর ইওকোইয়ামা তাইকান কলকাতা এসেছিলেন ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে। তার কাছ থেকে জাপানী জলরং এর ওয়াশ পদ্ধতি শেখেন অবনীন্দ্রনাথ। কাগজের জমিতে রং লাগিয়ে জল দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে এক পেলব ও রঙ্গীন কুয়াশার মতন আবহ তৈরী হয় এই পদ্ধতি প্রয়োগে। এই ধরনের রং এর ছায় ও মায়াবী আবেশ প্রকাশিত হয়েছে ‘ভারতমাতা’ র ছবিতে। অবনীন্দ্রনাথের সেই শুরু তাঁর নিজের পথ চলা। সরকারী আর্ট স্কুলে (বর্তমান কলকাতার সরকারী চারু ও কারু কলা মহাবিদ্যালয়) তিনি তখন সহ অধ্যক্ষ। তাঁর শিল্প শিক্ষার আদর্শ নিয়ে নিকটের অনেকের সঙ্গেই সংঘাত। অধ্যক্ষ হ্যাভেল সাহেব (E.V.Havell) তাঁর পাশে ছিলেন। হ্যাভেল সাহেব ভারতীয় শিল্পের নিজের স্বকীয় মহীমায় বিকাশ চেয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ কলেজের শিক্ষাক্রমে ভারতীয় শিল্প ইতিহাস ও তার রিতী র অন্তর্ভুক্তির জন্য বদ্ধপরিকর হলেন। গ্রেকো-রোমান শিল্পধারা যা’ গান্ধার শিল্প কর্মে দেখা যায়, তা’র থেকে ভারতীয় শিল্পকে মুক্ত করতে হ্যাভেল সক্রীয় হয়েছিলেন। তাঁর লেখার সমর্থন দেখা গেল ভগিনী নিবেদিতা এবং আনন্দ কুমারস্বামীর বইয়ে। এই স্বদেশী শিল্প আন্দোলনের ঊষালগ্নে অবনীন্দ্রনাথ এঁদের কাছ থেকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে হাভেল কলকাতা ছাড়লেন। কিছুদিনের মধ্যে অবনীন্দ্রনাথও কলেজের চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে দিলেন। কোনওদিনই তাঁর চাকরী বা পদের লোভ ছিল না। চাকরী ছেড়ে অবনীন্দ্রনাথ যেন অনেক হালকা বোধ করলেন। অবাধে এঁকে চললেন জলরং এ অনেক ছবি। কোথাও রং ঘন, অসচ্ছ, টেম্পারার মতো। আবার কোথাও স্বচ্ছ রং, জাপানী ওয়াশ পদ্ধতিতে লাগানো। এক এক করে কত কালজয়ী চিত্রাবলীর জন্ম হল পরবর্তী কয়েক বছরে। জন্ম নিলো ‘বেঙ্গল স্কুল অফ্ আর্ট’। তাঁর ছাত্ররাও পরবর্তীকালের নক্ষত্রমন্ডলী : নন্দলাল বসু, অসিত হালদার, সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, মুকুল দে, ক্ষিতিন্দ্রনাথ মজুমদার, সারদা উকিল ও আরও অনেকে। এই শিল্পধারাই বাঙলার তথা ভারতবর্ষের রেনেশাঁ শিল্প আন্দোলনে রূপ নেয়।

বুদ্ধদেব ও সুজাতা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর 



                                       
 মৌর্য্য সম্রাট অশোক - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    

ইওকোইয়ামা তাইকান কে জাপান থেকে এ দেশে পাঠিয়েছিলেন বিশিষ্ট জাপানী চিত্র সমালোচক ও লেখক ওকাকুরা কাজুয়া। ওকাকুরা যখন ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতা আসেন, তখন তিনি প্রাচ্যের সংস্কৃতি ও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে তাঁর লেখা বই ‘ The Book of Tea’ এর জন্যে সব জায়গায় বিশেষ আলোচীত ব্যক্তিত্ত্ব। এই বই প্রাচ্যের যে অস্তিত্ত্বকে দেখায়, ইংরেজদের লেখায় তা’ অনুপস্থিত। ওকাকুরা কলকাতায় এসে মুগ্ধ হয়ে যান। এখানে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে অতিথি হয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে এসে এই দেশের প্রতি তাঁর আরও আগ্রহ দেখা দেয়। ভারতবর্ষের দীর্ঘ ঐতিহ্যের কথা লিখতে শুরু করলেন এই জাপানী চিন্তাবিদ। মা কালি র রূপ ও তত্ত্বকথা ওকাকুরাকে আকর্ষণ করে। এই মাতৃ রূপের দীর্ঘ ব্যাখ্যা তাঁর লেখায় আমরা পাই। এই সময় সিস্টার নিবেদিতাও ওকাকুরার সংস্পর্শে আসেন। বলা বাহূল্য যে, ঠাকুরবাড়ী ই এই চিন্তন যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু। নিবেদিতা ওকাকুরার লেখার প্রশংষায় মুখর হয়েছিলেন। তিনি পত্র পত্রিকায় ওকাকুরার প্রাচ্য সচেতনতার বিশেষ দিকের কথা তুলে ধরেছিলেন। সেই উল্লেখে ভারতবর্ষের সনাতনী ধর্ম আর সংস্কৃতির কথা অনিবার্য্য ভাবে উপস্থিত। এমন কি এই মহান জাপানীর দেবী কালিকার রূপকল্পের ও ভারতে এই মাতৃ ভক্তির যথার্থ ব্যাখ্যার পূর্ণ সমর্থন এসেছিল স্বামীজির শ্রেষ্ঠতম শিষ্যার কাছ থেকে। ওকাকুরার অনুরোধে নিবেদিতা তাঁর বই ‘The Ideals Of The East’ য়ের মুখবন্ধ টি লেখেন এবং তা’ পাঠক সমাজে বহূল খ্যাতি অর্জন করে। নিবেদিতা নিজেও ভারতীয়ত্ব তথা হিন্দুত্ব ধর্মের সারতত্ত্ব নিয়ে গভীর গবেষণা করেন। সেই গবেষণায় উৎসাহ যুগিয়েছিলেন ওকাকুরা। নিবেদিতার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Web Of Indian Life’ ওকাকুরার খুব মনোগ্রাহী হয়। এই লেখায় ভারতীয় নারীদের বিশেষ গুনাবলী যা’ পাশ্চাত্য সমাজে বিরল, সেই সত্য প্রকাশিত করেছেন। ভারতীয় রমণীদের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি তাদের উথ্থানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন বারংবার। এমন কি তিনি নিজে নারীদের উন্নতিকল্পে সক্রীয় ভূমিকা নিয়েছেন। এই নারীশক্তিকেই মাতৃরূপে বন্দনা করার যুক্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই যুক্তি ও বিশ্বাসকে শুধু লিখিতই করেন নি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সভায় তাঁর এই বিষয় নিয়ে মানুষকে সচেতন করেছেন। নিবেদিতা এ দেশে এসে এক বছরের মধ্যেই এই সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনেকটাই অবগত হয়েছিলেন। তাঁর ওপরে গুরু স্বামী বিবেকানন্দের অশেষ আশীর্বাদ ছিল। স্বামীজীর শিক্ষায় আলোকিত শিষ্যা সমাজসেবায় ব্রতী হয়েছেন। শ্রী রামকৃষ্ণদেব থেকে সৃষ্ট এই শিক্ষার আলো পরিবাহীত হয়েছে স্বামীজী হয়ে মার্গারেট নিবেদিতায়। মা কালি আরাধনার মাহাত্যও নিবেদিতা নিজের জীবন দিয়ে প্রমান করতে চেয়েছিলেন। কলকাতায় এসে প্রথমদিকে একটা বই লিখেছিলেন মা কালির বিষয়ে। ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে এই বই ‘কালি মাতৃকা’ (‘Kali The Mother’ )তে কি ভাবে মা কালির উপাসনা আমাদের মাতৃশক্তি র মাহাত্য অনুধাবন করতে সাহায্য করে, সে কথাই যুক্তি সহকারে লিপিবদ্ধ করা আছে । বইটি র আনুষ্ঠানিক প্রকাশের পূর্বেই , ১৩ই ফেব্রুয়ারী ১৮৯৯, সিস্টার নিবেদিতা কলকাতার অ্যালবার্ট হলে এক বিপুল জনসভায় এই বিষয় ব্যক্ত করেন। সেখানে তাঁর বক্তব্যের মূল লক্ষ্য ছিল বিদেশী মিশনারি দের সঙ্গে আমাদের দেশের মাতৃবন্দনার দার্শনিক বৈপরীত্বকে প্রকাশ করা। দেশের মানুষের আদর্শগত ভাবে মিশনারিদের ত্যাগ করা উচিৎ। মিশনারিদের উৎসকেন্দ্রে সেই ঔপনিবেশিকতার প্রভুত্বের শক্তিই বিরাজিত। যদিও খ্রীষ্টের গরিমা দিয়ে গড়া সেই শক্তির মোড়ককে আপাতদৃষ্টিতে উদার বলেই মনে হয়।। ভারতবাসীর উচিত জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মাতৃ শক্তি আরাধনায় ব্রতী হওয়া। নিবেদিতার ভারতীয় সনাতন ধর্মের প্রতি সমর্থনকে ইংরেজ সমাজ ‘অন্ধ ভাবাবেগ’ আখ্যা দিয়েছে। শুধু তা’ই নয়, ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়ে অপপ্রচারও করেছে অনেক। কিন্তু নিবেদিতা থেমে থাকেন নি। তিনি ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের দীর্ঘ ঐতীহ্যের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন জনসাধারনকে। সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। স্বামীজীর আদর্শ পালন করেছেন প্রতি পদে। এই সংস্কারের যাত্রায় তা’ই আবিষ্কার করেছিলেন সেই মাতৃশক্তির অমোঘ প্রকাশকে। আর সেই মাতৃশক্তীর কাছে আনুগত্যকেই সমগ্র ভারতবাসীর আশু অবলম্বন বলে বিবেচনা করতে দ্বিধা করেন নি সাধ্বী নিবেদিতা। মাতৃশক্তি সমগ্র মানবজাতির উৎস কেন্দ্র। সেই সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন বিধর্মী ওকাকুরাও ভারতের মাটিতে পা রেখে।

ইওকোইয়ামা তাইকান
      
          ওকাকুরা কাকুজো             আইডিয়ালস অফ দি ঈস্টবইয়ের প্রচ্ছদ
                

ব্রাহ্ম পরিবেশে মানুষ হলেও অবনীন্দ্রাথের শিল্পচর্চায় অন্য ধর্মীয় চিত্র বা কাহিনী কখনো বাধা হয়ে আসে নি। মুঘল চিত্রকলার শৈলী এবং অনেক মুঘল চরিত্র তাঁর শিল্পে উঠে এসেছে। তিনিই আবার কৃষ্ণলীলা চিত্রমালা সৃষ্টি করেছেন। এই চিত্রমালার শৈলী মুঘল মিনিয়েচারের (miniature) মতন অনেকটাই। এইভাবেই এক ভারতীয় নন্দন তত্ত্বের সন্ধান করেছিলেন অবন ঠাকুর। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতেও সেই সৎ অনুসন্ধান লক্ষ্যনীয়। বুড়ো আংলা থেকে রাজকাহিনী, সর্বক্ষেত্রেই এক শিশুমনের অবাধ বিচরন। লেখা পড়লে বিষয়ের রূপকল্প চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এমনই তাঁর চিত্রায়িত ভাষা। নিজের জীবনের নিবীড়তম আবেগ ও মনন তাঁর ছবিতে এমন রূপকল্পে মিশে প্রস্তুত হতো, যা’ দর্শককে এক অন্য জগতের সন্ধান দিত। কিন্তু সে ছবির ভিত হতো তাঁর জীবনের কোনো এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের টুকরো থেকে পাওয়া। এ ভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল এক কালজয়ী ছবি – ‘শাহজাহানের মৃত্যু প্রতীক্ষা’। মৃত্যু শয্যায় বন্দী সম্রাট। তাঁর পায়ের কাছে বসে উদ্বিগ্ন কন্যা জাহানারা। যমুনা নদীর ওপারে – ‘এক বিন্দু নয়নের জলে’র মতন ‘কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এ তাজমহল’। মেঘাবৃত চাঁদের মলিন আলো আবেগঘন করে তুলেছে পুরো দৃশ্যপট। অনেক প্রশংসা পেয়েছিল এই ছবি। সম্মানিত হয়েছিলেন শিল্পী অনেক জায়গা থেকে। বোঝা গেল যে, ভারতবর্ষে শিল্পের নব দিক দর্শনের মানুষ এসে গেছেন। সকলে অবনীন্দ্রনাথকে শিল্পগুরুর পদমর্যাদায় ভূষিত করেছিল। অবনীন্দ্রনাথ নির্লিপ্ত ছিলেন। আপনমনে থাকতেই ভালোবাসতেন। নিজের সঙ্গে নিজে কাটিয়ে দিতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। আর গড়গড়া ছিল নিত্যসঙ্গী। বুকের মধ্যে অনেক অবদমিত ব্যথা বয়ে বেড়াতেন। সেই ব্যাথার সিংহভাগ জুড়ে ছিল তাঁর ছোট্ট মেয়ে শোভা র স্মৃতি। অনেক অল্প বয়সেই সে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ত্যাগ করে চিরতরে। পিতা অবনীন্দ্রনাথ কন্যার মৃত্যু শোক কোনোদিনই ভুলতে পারেন নি। সেই মৃত্যু শোক ই ‘শাহজাহানের মৃত্যু’ ছবিটির জন্মের উৎস। ‘বুকের ব্যথা সব উজার ক’রে ঢেলে’ দিয়েছিলেন এই ছবিতে। ছবিটি সৃষ্টি করতে গিয়ে খুব অল্প সময়ের জন্যে শিল্পী নিজ বাহ্যিক স্বত্তা হারিয়ে ছবির আত্মায় মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। এ কথা অবনীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মকথায় লিখে গেছেন।

শাহজাহানের মৃত্যু প্রতীক্ষা (১৯০০)
এর কিছু পরে অবনীন্দ্রনাথ ক্রমে ব্যাক্তিগত বিষয়ের থেকেও স্বদেশী ভাবনাকে বেশী প্রাধান্য দিতে শুরু করেন। তাঁর উদাসী মন বঙ্গ ভঙ্গ বিষয়ের প্রতিবাদে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সৃষ্টি করেন ‘ভারতমাতা’ ছবির, আকাঙ্খিত ভারতভূমির মাতৃ সাধনার মূর্তি । স্বদেশী আবেগ দিয়ে কিছু লেখার চেয়ে, সেই ভাবাবেগ দিয়ে এক শিল্প আন্দোলন তৈরী করা অনেক কঠীন। সেই কঠীন কাজটি অবন ঠাকুর করেছিলেন। এই ভারতমাতা সকল শ্রেণীর মাতা হয়ে উঠতে পারে, এই সত্যকে নিবেদিতা এই ছবির সামনে উপলব্ধি করে আপ্লুত হয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “‘This is the first masterpiece in which an Indian artist has actually succeeded in disengaging, as it were, the spirit of motherland.” ভগিনী নিবেদিতা এই ছবিকে কাগজে ছেপে পোস্টার বানিয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হলেন। ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দ, অর্থাৎ ভারতমাতা সৃষ্টির চার বছরের মধ্যে সারা বাঙলা জুড়ে এই দেশমাতৃকার মুদ্রিত চিত্র ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। দিকে দিকে ভারতমাতার জয়ধ্বণি শোনা যেতে লাগল। উত্তরপ্রদেশে স্বদেশী আন্দোলনকারীরা অবনীন্দ্রনাথের আঁকা এই ছবির পোস্টার নিয়ে ‘ভারতমাতা কি জয়’ ধ্বণি দিয়ে মিছিল করে রাস্তায় নামলো। মাদ্রাজে নিবেদিতার শিষ্য বিখ্যাত কবি সুব্রামন্যা ভারতী এই ‘ভারতমাতা’কে প্রচারের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তুললেন। লোকমান্য তিলক এবং লালা লাজপৎ রায় যথাক্রমে মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবে অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতার ছবি নিয়ে আন্দোলনে নামেন। ক্রমে সারা ভারতবর্ষ জুরে এই মাতার জয়ধ্বণিতে জাতীয় আন্দোলন জেগে ওঠে। নিবেদিতার একার প্রয়াসে এই ভারতমাতার এত জনপ্রিয়তা হয়েছিল। জনপ্রিয়তার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি অচিরেই এই স্বদেশ মাতৃদেবীর পূজার বেদী স্থাপিত করেছিল। বলা বাহূল্য যে, ফলতঃ ভারতবাসী এই মাতৃমন্ত্রে দিক্ষীত হয়েই দেশ স্বাধীন করার অঙ্গীকার করেছিল। আজ ভারতবর্ষের যে কোনো পরীক্ষার সম্মুখে, যুদ্ধ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতীক খেলার মাঠ অবধি সর্ব ক্ষেত্রে ‘ভারত মাতা কি জয়’ এই ধ্বণি শক্তির স্রষ্টা যে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হয়তো অনেক ভারতবাসীর অজানা।

এই প্রসঙ্গে ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচীত ‘বন্দে মাতরম্’ সঙ্গীত অবশ্য স্মরণীয়। এই সঙ্গীত ভারতবাসীর কাছে দেশ মাতৃকা পূজার মন্ত্র স্বরূপ। ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে সাহিত্য সম্রাট এই মন্ত্র সঙ্গীত কে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ গ্র্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেন। এই গল্পের উৎস ছিল ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দের বাঙলার মন্বন্তর ও আর্থ – রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা। সেই প্রেক্ষাপটে দেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ সন্তানদলের আবির্ভাব উপন্যাসের প্রথম খন্ডের বিষয়। দ্বিতীয় খন্ডে দেখতে পাই সন্তানদলের দীক্ষিত হওয়ার বর্ণনা, তাদের সাংগঠনিক কার্যকলাপ, আত্মসংযম ও সংসার যাপনের চিত্র। সন্তানদলের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ দিয়ে সমাপ্তি হয়েছে তৃতীয় তথা শেষ খন্ডের। জীবনান্তিকে বঙ্কিমচন্দ্রের এই লেখাটি যতটা না শিল্পশৈলীর জন্য আলোচিত, তার চেয়েও বেশী প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তুর জন্য। ঐতিহাসিক ঘটনার আদলে ‘আনন্দমঠ’ রচীত হলেও বঙ্কিমচন্দ্র এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, সুতরাং ঐতিহাসিকতার ভান করি নাই”। কোনও সন্দেহ নেই ইতিহাসের ভিতের ওপরে এ একটি রাজনৈতিক সচেতনতার উপন্যাস। হুমায়ুন কবির বলেছিলেন, “এই উপন্যাসের আখ্যানবস্তু গড়ে উঠেছে উনিশ শতকের শেষার্ধে ভারতীয় রাজনীতিতে আবির্ভূত জাতীয়তাবাদ (nationalism) ও দেশপ্রেমকে (patriotism) কেন্দ্র করে’। তাঁর মতে আনন্দমঠের বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘ঐতিহাসিক কালাসঙ্গতি’ (historical anachronism), যা সমকালের বিকাশমান মধ্যবিত্তের আশা- আকাঙ্ক্ষাকেই মূর্ত করে তুলেছে। আনন্দমঠ উপন্যাসে জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের যে ধারনা আমরা পাই, তা’ বঙ্কিমমানসেরই বিশিষ্ট প্রতিচ্ছবি, পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ নয়। এই দেশপ্রেমকে মুসলমান রাজত্বের অপশাষন, সিপাহী বিদ্রোহ ও ইংরেজ বণিকের রাজদন্ড দখল করার ঘটনক্রমের পরিপ্রক্ষিতে বুঝতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্র এই রচনায় সন্নাসীকেও বিপ্লবীতে পরিনত করেছেন। সন্নাসীর পূজিত দেবী এখানে দেশমাতৃকা হয়েছেন। উপন্যাসের প্রথম খন্ডের একাদশ পরিচ্ছেদে সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে মাতৃমূর্তির তিনটি রূপ দেখিয়েছেন : ‘মা যা’ ছিলেন, মা যা’ হইয়াছেন এবং মা যা’ হইবেন’। মাতৃমূর্তির এই ত্রিকালধর্মী পরিকল্পনা প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেমিক বঙ্কিমের অতীতের জন্য গর্ব, বর্তমানের জন্য বেদনা ও ভবিষ্যতের জন্য আশার প্রতীক। এই আশা বাস্তবায়িত হওয়ার পথ হচ্ছে বিপ্লব সংগঠন, ইন্দ্রিয়জয়ী চরিত্র, বর্ণবৈষম্য লুপ্তি, ঐক্যবোধ ও শক্তিচর্চা। এখন অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ দেখলে সত্যানন্দের ধারনার তৃতীয় মাতৃ রূপকে অনুধাবন করা যায়। এই ছবিতে বিপ্লবের এই আশার প্রতীকের প্রকাশের পূর্বে অবনীন্দ্রনাথের বিভন্ন শিল্পে বাকি দুই রূপের অস্তিত্ত্বকেও খুঁজে পাওয়া যায়। বোধ করি এই ভাবেই অবনীন্দ্রনাথের ওপর বঙ্কিমমানসের গভীর প্রভাব ভারতমাতাকে মূর্ত করতে সক্রীয় হয়েছিল।

আনন্দমঠ’ চলচ্চিত্রের পোস্টার ( ১৯৫২)
 বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


ঠাকুরবাড়ীতে বঙ্কিমবাবুর লেখার ভক্তের অভাব ছিল না। তাঁর লেখায় আধুনিক মানসিকতা এবং অতীতের অলঙ্কৃত গৌরব, এই দুইই পাঠকদের আকর্ষিত করে। আবার এই দুই উপাদান থেকে কোথাও দ্বন্দও তৈরী হয়। এই দ্বন্দের একদিকে পরাধীনতার গ্লানি, অন্যদিকে ইংরেজ – শাসনের সুফল সম্বন্ধে প্রত্যয়। এর দোলাচালে দুলেছে বাঙালী শিক্ষিত সমাজ, উচ্চ বর্গের অনেক মানুষ...... বঙ্কিমচন্দ্র, রাজা রামমোহন, মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ও আরও অনেকেই। অবনীন্দ্রনাথ এই দ্বন্দ থেকে বেড়িয়ে এসেছিলেন তাঁর সৃষ্টির হাত ধরে। তাঁর সৃষ্ট ‘ভারতমাতা’ ই এর প্রমান। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা সাধারন মানুষের কাছে সহজবোধ্য ছিল না। তাঁর লেখা সেইসময়ে উচ্চ শ্রেণীর উচ্চ শিক্ষিতকূলের সম্পত্তি স্বরূপ। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ পৌঁছে গিয়েছিলো সমাজের সকল শ্রেণীর কাছে। অশিক্ষিত নিম্নবর্গীয় মানুষের দল এই ছবি মাথায় নিয়ে ‘ভারত মাতা কি জয়’ ধ্বণি তুলে মিছিল করেছিলো। ‘বন্দে মাতরম্’ সঙ্গীত যেমন আজও ভারতীয় মানুষের ধমনীর মধ্যে, তেমনি ভারতমাতা দেবী রূপটি সকল ভারতীয়ের মনের গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত। ভারত ভাগ হওয়ার পর দেশের মানুষ আরও আবেগ তারিত হয়ে এই ভারতমাতার চরণে আশ্রয় নেয়। সেই সময় থেকে আজ অবধি ভারতের নানা স্থানে ভারতমাতার মন্দির স্থাপিত হয়েছে। সব মন্দিরেই আরাধ্যা দেবী মূর্তি অবন ঠাকুরের সেই ভারতমাতা।

এরকমই এক মন্দিরের উদাহরণ বেনারসের কাশী বিদ্যাপীঠ। এখানে বৃহৎ ঘেরা জায়গায় ভারতমাতার যে মন্দির তা’র নির্মাণ কাল ১৯১৮ থেকে ১৯২৪ এর মধ্যে। তখনও দেশ ভাগ হয় নি। শিল্পপতি ও স্বদেশ সংগ্রামী বাবু শিবপ্রসাদ গুপ্তা এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী স্বয়ং নিজে এই মন্দিরের প্রথাগত ভাবে উদ্বোধন করেছিলেন। যজ্ঞ ও পূর্নাহুতি করে এই স্থানের পবিত্রতা প্রতিষ্ঠার নিয়মাচারও সেরেছিলেন ভারতের তথাকথিত শ্রেষ্ঠ জননায়ক। এর পরে এই মা’য়ের মন্দির তৈরী হয়েছে ভারতের বিভিন্ন স্থানে। হরিদ্বারের বহুতল ভারতমাতার মন্দিরটি পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। তেমনি আকর্ষণীয় মাতৃমন্দির দেখতে পাওয়া যায় উজ্জয়িনী, মান্ডওয়া, কন্যাকুমারী ও আরও অনেক জায়গায়।

   
ভারতমাতার মন্দিরের সম্মুখ দ্বার – কাশী বিদ্যাপীঠ
                                   
                   

ভারতমাতার মন্দির – দৌলতাবাদ
                   

আজ যখন অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ এবং ‘ভারতমাতা’র জয়ধ্বণির বৈধতা সমাজের একাংশের কাছে বিতর্কের বিষয়, তখন মনে হয় দেশমাতৃকা বন্দনা নিয়েও রাজনীতি করতে আমরা ছাড়ি না। এই কালো রাজনীতির ভাইরাস্ স্বদেশী আন্দোলনের সময় থেকেই ছিল। তখন থেকেই গরিবী, দলিত, ধর্মীয় বিভাজন ইত্যাদি সহজ স্পর্শকাতর বিষয়গুলো দিয়ে জনসাধরণকে বোকা বানানো হয়েছে। আজও তার ব্যাতিক্রম দেখি না। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী ভন্ডামীর মুখোশ খুলেছিলেন তাঁর ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে। আর অবনীন্দ্রনাথ, অত্যন্ত শান্ত অথচ বলিষ্ঠ চিত্রভাষায় স্বদেশ ভাবনার দিক নির্ধারন করেছিলেন। অবন ঠাকুরের এই ছবি ফরাসী শিল্পী উ্যগেন দেলাখ্রোয়া (Eugène Delacroix )র কথা মনে করায়। ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে দেলাখ্রোয়া সৃষ্ট ‘পরিচালনরতা স্বাধীনতা’ বা ‘Liberty Leading People’ তৈলচিত্রটি ও তো ফরাসী বিপ্লবের নির্দেশক। শুধু নির্দেশকই নয়, এই চিত্র ফরাসী দেশের পরিচয় চিহ্ন বহন করে। এই জগৎ বিখ্যাত পেইন্টিং এরও প্রধান বিষয় এক দেবীমূর্তি। তিনই দেশের স্বাধীনতার প্রতীকি রূপ। এই দেশ মাতৃকাকে দেখা যাচ্ছে ছবির মধ্য স্থানে এক যুদ্ধক্ষেত্রে। চারিদিকে শবদেহের স্তুপ। তা’রই ওপর দিয়ে উদ্ধত রণংদেহী চলেছেন ‘ব্যারিকেড’ ভেঙ্গে কোনও বাধা না মেনে। হাতে তাঁর তেরঙ্গা পতাকা : লাল-সাদা-নীল। ফরাসী জাতীয় পতাকা। দেবীর উর্ধাঙ্গের পোশাক খুলে গিয়ে তাঁর স্তনযুগল দৃশ্য হয়েছে। তাঁর পাশে এক বালকও বন্দুক হাতে সামিল হয়েছে বিপ্লবে। সব স্তরের মানুষ এসেছে রাজার অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়তে ।
দেবী স্বাধীনতা( Liberty Leading People ) –উ্যগেন দেলাখ্রোয়া (১৮৩০)

ফরাসী বিপ্লবের দেবী মেরিয়্যান (ডাক টিকিট)
স্বপ্রতিকৃতি – উ্যগেন দেলাখ্রোয়া
                               
বলা বাহুল্য, এই ফরাসী ‘Liberty’ চিত্রটির কম্পোজিশন খুবই নাটকীয়। আর অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ অধিকতর শান্ত, যেন যোগিনীর ধ্যান মগ্নতা। উ্যগেন দেলাখ্রোয়া এই আলোচিত ছবিটির জন্যে ফরাসী দেশের সর্বকালের জাতীয় শিল্পীর সম্মান লাভ করেছিলেন।। দেলাখ্রোয়া রোমান্টিক যুগের (Romanticism) সর্বশ্রষ্ঠ শিল্পী বলেও বিবেচীত। তাঁর বহু তৈলচিত্রের বিষয় পৌরানিক এবং ইতিহাসের কোনো ঘটনা কেন্দ্রিক। তাঁর উজ্জ্বল রঙের ও তুলির কায়িক ব্যবহার ছবির চরিত্রদের প্রায় জীবন্ত করে তুলেছিলো। বিখ্যাত কবি ও শিল্প সমালোচক শার্ল্ বদলেয়ার (Charles Baudelaire ) অনেকের মতোই দেলাখ্রোয়ার গুনমুগ্ধ ছিলেন। ঠিক যেমন মার্গারেট নিবেদিতা মুগ্ধ হয়েছিলেন অবন ঠাকুরের ছবি দেখে। ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের এই ‘Liberty Leading People’ ছবিটি অনেক দিক দিয়েই বৈপ্লবিক। ইতিহাসের রোমান্টিকতা ছেড়ে হঠাৎ ই তৎকালীন নিজের দেশের বিপ্লবকে বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন ফরাসী জাতীয় শিল্পী। যুদ্ধক্ষেত্রে যোগদান করতে পারেন নি, তা’ই সেই ক্ষেদ মিটিয়েছিলেন এই স্বাধীনতার প্রতীকি মাতৃমূর্তি সৃষ্টি করে। দেলাখ্রোয়া র এই স্বীকারোক্তি তাঁর ভাইকে লেখা চিঠিতে পাওয়া যায়। একটা গোঁড়া ক্যাথলিক সমাজের মানুষের মননে এই দেবী অর্চনাকে প্রতিস্থাপিত করা নিঃসন্দেহে চরম বৈপ্লবিক। ‘ভারতমাতা’র সৃষ্টিও এরকমই এক বিপ্লব নয় কি ? অবনীন্দ্রনাথ মূর্তি পূজোর সংস্কৃতির বিপরীতে অবস্থান করেও এই মাতৃ রূপ সৃষ্টি করেছিলেন। বিদেশিনী নিবেদিতা তাঁর সৎ আধুনিক মনস্কতা নিয়ে ভারতমাতার জয়যাত্রার কান্ডারী হয়ছিলেন। দেলাখ্রোয়ার দেশমাতাও তেমনি কোনও বাইবেল থেকে উঠে আসে নি। বরং এই ফরাসী মা যা’কে মেরিয়্যান নামে চিহ্নিত করা হয়, তাঁর উপস্থিতি অনেকটাই হেলেনিস্টিক যুগের কোনো গ্রীক দেবীর মতন। শুধু তা’ই নয়। মা মেরিয়্যানের মাথায় ফ্রীজিয়ান টুপি দৃশ্য। এই টুপি তৎকালীন তরুণ উচ্চ বুদ্ধিজিবী মানুষদের প্রতিনিধি স্বরূপ। দেলাখ্রোয়া এমনি এক উন্নত বুদ্ধিমত্তার নবদিশার পথপ্রদর্শকের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নের দেবী একদিন বিপ্লবকে সফল করেছিলো। আজ তাঁরই মুখচ্ছবি ফ্রান্সের ডাক টিকিট থেকে সমস্ত রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে উপস্থিত। আসলে মানব সভ্যতার সর্বাবস্থায় মাতৃশক্তি বন্দনা অপরিহার্য। এর কোনো বিকল্প হয় না। এই শক্তির প্রতি আবেগ তারণা যে কোনো ধর্মের সঙ্কীর্ণতার উর্দ্ধে। ভারতবর্ষকে এই সত্যের মূল্য দিতে হবে। এ দেশের রাজনীতির নেতারা সম্প্রদায়ের বিভাজন করে এসেছেন স্বাধীনতার পূর্ব থেকে আজ অবধি। সব সম্প্রদায়কে এক মায়ের চরণতলে আনার উৎসাহ দেখান নি কোনোদিন। শিল্পগুরুর সৃষ্ট ভারতমাতা যেমন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন, আজ রাজনীতির কলুষতায় তাঁকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের মাকে কি আমরা আর উদ্ধার করতে পারবো ? শিল্পগুরুর আজ স্বার্ধশতবর্ষে এই প্রশ্নটা আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে।

অবনীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে


লেখক পরিচিতি - সমকালীন দৃশ্যশিল্পী, শিল্প শিক্ষক এবং লেখক 

তথ্য ও ছবি ঋণ :
1. Documentation Program, 1985; originally published 1908. Guha-Thakurta 1992 Guha-Thakurta, Tapati: The Making of New Indian Art. Cambridge University Press, 1992.
2. Inaga 2001a Inaga Shigemi, "Okakura Kakuzo's Nostalgic Journey to India and the Invention of 'Asia'." University of British Columbia (2001)
3. Mitter, Partha. Art and Nationalism in Colonial India 1850-1922. Cambridge University Press, 1994
4. Sister Nivedita (Margaret E. Noble) and Ananda Coomaraswamy, Myths of the Hindus and Buddhists. H. Holt & Company, 1914.
5. Sumit 1973 Sumit, Sarkar, The Swadeshi Movement, in Bengal 1903-1908. New Delhi: People s Publication House, 1973.
6. Paintings of Abanindranath by R. Shivakumar.
10. Ananadamath by Bankimchandra Chattopadhaya.



1 comments:

0

বিশেষ প্রবন্ধ - শুভাপ্রসন্ন

Posted in



ছেলেবেলায় ইস্কুলে পড়েছিলাম “নালক” সেই থেকেই তাঁকে জেনেছি। আজও চোখ বুজলে দেখতে পাই গুরুমশাইয়ের পাঠশালা, শান্ত দুপুরে সেই কুব পাখির ডাক শুনতে পাই।

আমার প্রথম পরিচয় সূত্র যা আজও অম্লান তা তাঁর ছবি লেখা থেকে। যদি ভারতের নবজাগরণের সূত্র ধরে বিভিন্ন মনীষার কথা ভাবা যায়— তাহলে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি সবচেয়ে বড়ো দৃষ্টান্ত। সেখানকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ দ্বারকানাথ ঠাকুর। ব্যবসা আর আধুনিকতার শুরু তাঁর হাত ধরেই। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের প্রায় সকলেই নানা প্রতিভায় ভাস্বর হয়ে আছেন। সেই ধারার উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্কের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি বিশ্বকবি হিসাবে স্বীকৃত। যদিও সেটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়— তাঁর অফুরন্ত প্রাণশক্তি সৃষ্টিশীলতা বহুমুখী প্রতিভা বিস্ময়ের। যার ইতিহাস কারও অজানা নয়—। তাঁকে কেন্দ্র করে অসংখ্য সৃষ্টিশীল মানুষের প্রতিভা বিকশিত হয়েছিলো। অবনীন্দ্রনাথ তাঁরই অন্যতম ভাইপো। তাঁর ছোটোকাকা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ছোটোভাই গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র গুণেন্দ্রনাথের পুত্র ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে দশ বছরের ছোটো। জোড়াসাঁকোর বিশাল জমিদার বাড়ির বৃহৎ পরিবারের মধ্যে-বিস্তীর্ণ নানান অন্দর মহলে ছেলেবয়সে নানাধরনের বিচিত্র পরিচারক-পরিচারিকার অধীনে কোলে-পিঠে গড়ে ওঠা। তাদের বিভিন্ন চরিত্র, বর্ণ ব্যবহারের কায়দায় ভালোবাসা-রাগ-অনুরাগ, অভিমান, বচসা এসবই তাঁর মনে বাস্তব আর কল্পনা মিশিয়ে ধরা দিত। কল্প আশ্রিত সৃষ্টিশীল মন চির শৈশবের খোরাক হয়ে গাঁথা হয়ে থাকতো। বড়ো হয়ে তাঁর লেখায়, কথপোকথনে, অনুলিখনের স্মৃতি চারণায় ধরা দিয়েছে তা। অন্য ভাই বা দাদারা যখন নানা কাজে ব্যাস্ত— অবন তখন পুরনো আসবাব বা বড়ো টেবিলের তলায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে বিস্তীর্ণ মাকড়সার জাল থেকে মায়াময় ছবি, রহস্য খুঁজে পেতেন। এভাবেই তাঁর দেখায় ধরা দিতো খুঁটিনাটি কত কিছু। কৌতূহলী জিজ্ঞাসু মনে রসদের অভাব হয় না।

বড়ো হয়ে লেখা ছবির সবচেয়ে বড়ো উৎসাহ দাতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবিকার প্রশংসা তাঁকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করতো। ঠাকুর বাড়ি থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায় যেখানে সম্পাদক থেকে লেখক-লেখিকা অলঙ্করণ সবই তাঁদের আত্মীয়-স্বজন সেখানে একাধারে অবনীন্দ্রনাথ লেখক আর অলঙ্কার শিল্পী হিসাবে যোগদান এক অন্যমাত্রা পেতো।

বাড়িতে চিত্রকলার চর্চা করেছিলেন বিদেশী শিল্পী গিলড ও পামারের কাছে। ফলে, তাঁদের শিক্ষায় পাশ্চাত্য রীতিতে অসাধারণ পোট্রেট আর দক্ষতা অর্জন করলেও তাঁর মনে আমাদের লোকায়ত শিক্ষা, পটচিত্র, পাঁচালীর গান, কীর্ত্তন আর কিছু কিছু মানুষের প্রেরণায় স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এক নিজস্ব শৈলীর রূপ দিতে লাগলেন। সেখানে প্রাধান্য পেতো

দেশীয় উপাদান দেশীয় বিষয়। এভাবেই তিনি একের পর এক চিত্রমালা রচনা করতে লাগলেন। সিস্টার নিবেদিতা, আনন্দকুমার স্বামী প্রমুখের প্রেরণায় গড়ে উঠলো বেঙ্গল স্কুল। পরবর্তীকালে সরকারি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ হ্যাভেলের উৎসাহে অন্তর্মুখি অবন ঠাকুরের ছবি দিল্লীর সর্বভারতীয় প্রদর্শনীতে পাঠিয়ে শ্রেষ্ঠ পুরষ্কারে ভূষিত হয় শাহাজাহানের মৃত্যু ও অন্যান্য ছবি।

পার্শি মিনিয়েচার আর জাপানের নানান টেকনিক থেকে নানান টেক্সচারকে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। ওকাকুরার সাহায্যে জাপান থেকে দুই শিল্পী ইয়াকোয়ামা টাইক্কান আর হিসিদা সুনশো জোড়াসাঁকোয় ছিলেন বেশ কিছুদিন। তাঁদের কাছ থেকে নানান টেকনিক রপ্ত করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে যে ওয়াশ পদ্ধতি আর তুলি চালনার বিশেষ পদ্ধতি তা আয়ত্ত করেছিলেন এ শিল্পীদ্বয়ের কাছ থেকে।

বেঙ্গল স্কুলের আন্দোলন তিনি ও তাঁর সুযোগ্য কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের অবদানে গড়ে উঠেছিলো। বিশেষভাবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য নন্দলাল বসুর অবদানে জীবন ও সমাজে এক রূপ ও রুচির প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো। তাই দ্বিধাহীনভাবে তিনি ছিলেন শিল্প গুরু আর সাহিত্যের কাণ্ডারী। তারই সঙ্গে তিনি ছিলেন জোড়াসাঁকোর মনীষীদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষ্ক। বিস্ময় জাগে রবিরশ্মির এত কাছে থেকেও তাঁর লেখা বা তাঁর সাহিত্যের ভাষা ছিলো সম্পূর্ণ মুক্ত। সম্পূর্ণ অন্য ছবির ভাষা। এক অনবদ্য শিশুর সারল্য, স্বপ্ন-কল্পনা দিয়ে গাঁথা। বুড়ো আংলা, ক্ষীরের পুতুল, নালক, রাজ কাহিনী, মহাবীরের পুঁথি প্রভৃতি অসংখ্য প্রকাশিত, অপ্রকাশিত রচনায় ভরিয়ে ছিলেন তাঁর অন্তরের শিশু মনের জগৎ।

সে সময় রাজা রবিবর্মাও ভারতীয় শিল্পী হিসাবে সর্বত্র প্রচারিত হলেও, আর্য যদিও তাঁর ছবির বিষয় ছিলো নানান ভারতীয় পুরাণ কাহিনী বা সমসাময়িক জীবনচরিত। কিন্তু উপাদান ও শৈলী ছিলো ইউরোপীয়। যেন ভেনাসের গায়ে শাড়ি পরিয়ে শকুন্তলার রূপ। তা থেকে অবনীন্দ্রনাথ কত পৃথক যা সম্পূর্ণভাবে দেশীয় স্টাইল বা ছন্দ।

পরিণত বয়সে তাঁর আঁকা ‘ভারতমাতা’ একটি অনন্য উদাহরণ। একদিকে ভারতীয় শৈলীর নিপুনণতা-অন্যদিকে নির্ভুল শারিরীক ছন্দ। তাঁর অল্প বয়সে পাঠ নেওয়া ইউরোপীয় শৈলীর মিশ্রণে এক অসাধারণ উদাহরণ। যেখানে তথাকথিত পরিপ্রেক্ষিতে অনুপস্থিত। দ্বিমাত্রিকতার আভাস অথচ বাস্তবধর্মী রেখায় আঁকা নারীরূপ।

শেষ বয়সে অনুসন্ধানী শিল্পীমন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া নানান টুকরো কাঠ বা শুকিয়ে যাওয়া শিকড়-বাকড় সংগ্রহ করে, কখনও তাতে কিছু সংযোজন করে বিভিন্ন আকারের মূর্তি গড়ে তুলতেন। সেগুলোর নাম দিয়েছিলেন “কাটুম কুটুম” এখানেও তাঁর শিশু মন খেলা করতো। এক অনবদ্য শিল্প অনুসন্ধান। কিন্তু সেভাবে তিনি স্বীকৃতি পাননি!

কিন্তু অবন প্রতিভা সীমাবদ্ধ থাকে আমাদের পরিসরে।

তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষে এই শিল্পগুরু মহান স্রষ্টা ছবি লেখার মনীষীকে স্মরণ করি।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সুবল দত্ত

Posted in







বিষয়ে যাওয়ার আগে

কোভিড উনিশ বিষানু মানব জীবনে আসার পর একটি প্রত্যক্ষ অনুভব হল।এমন অদৃশ্য শত্রুও হয়, যাকে অনুভবে বোঝা যায় কোথায় কোথায় সে থাকতে পারে। সে চায় সমগ্র মানবজাতির সংক্রমন,বিনাশ।অনুমানে সচেতনতায় আন্দাজে শরীরে ও মনে তার আক্রান্ত প্রতিহত করার কৌশল শিখে নিল মানুষ।মানুষ শিখল হাওয়ার সাথে পাল্লাবাজি করে বাঁচার কৌশল। সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে পদেপদে গা বাঁচিয়ে চলতে হয়। মানুষ আবার করেশিখলো জলের উপযোগীতা ও ব্যবহার। হাওয়াকে ছেঁকে পরিশ্রুত করে ফুসফুসে ভরে নিতে মাস্ক পরা অভ্যেস করলো। সমাজে থেকেও সামাজিক দূরত্ব রেখে মানসিক ও মানবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে শিখলো। এই একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিজ্ঞান এতটাই উন্নতির শিখরে,এই নতুন শত্রুটির বিষয়ে নাড়ি-নক্ষত্র আমরা জেনে ফেলেছি। সঙ্গে সঙ্গে এও জানতে পারছি আমাদের কার শরীরে কেমন প্রতিরোধ ক্ষমতা।এখন বেশিরভাগ মানুষকে বীজানু ও বিষানুর তফাতটা বুঝিয়ে দিতে হয় না,জেনে গেছে।গুটি বসন্ত একটি ভাইরাস। তার টিকা আবিষ্কার হয়ে গেছে এবং সেই ভাইরাসটি বলা যায় পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত।কিন্তু প্রায় চল্লিশ বছর আগে একটি মারণ বিষানু এইচ আই ভি আবিষ্কার হওয়ার পরও যেমন এখনওকোনও প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কার হয়নি,তেমনি এই ভাইরাসটিরও ভ্যাকসিন আবিষ্কার দুরস্ত। কিন্তু এডসের মতো পেণ্ডেমিক অসুখ থেকে বাঁচতে মানুষ নিজে নিজেই তার সামাজিক চরিত্র শুধরে নিয়েছে। সেই সঙ্গে সামাজিক সুস্থতা এসেছে।ওই রোগটি থেকে বাঁচার নিয়ম পালনে অনেকগুলি বীজানুঘটিত যৌনরোগ প্রায় লোপ পেতে বসেছে। মানুষের উগ্র যৌনক্ষুধা অনেক কম হয়েছে। অনেক সংযত হয়েছে মানুষ। ঠিক তেমনিই এই কোভিড ভাইরাসটিও মানুষকে অনেকটাই সংযত চরিত্রের হতে সাহায্য করছে এবং করবেও। আর সত্যিই আশ্চর্য রকমভাবে দেখা যাচ্ছে অনেকরকম বীজানু ঘটিত রোগের প্রভাব ইদানিং কমে গেছে। অনেক উত্কণ্ঠা জনিত রোগ লকডাউনে থাকায় নিরাময় হয়েছে।

এত গেলো বিষানুর কথা। যেগুলির প্রতিষেধকেরআজ দ্রুত আবিষ্কার হলো। মানুষ সত্বর এগুলো থেকে নিষ্কৃতি পাবেই। কিন্তু এই রোগগুলো এসে এসে জানান দিয়ে যাচ্ছে মানব প্রজাতিকে পৃথিবীতে থাকতে গেলে নিঃস্বার্থ সতর্ক সামাজিক হয়ে থাকতে হবে। কিন্তু ব্যবসায়িক সূত্রে মুনাফাখোরেরা রাষ্ট্রীয়স্তরে হোক বা অন্তরাষ্ট্রীয় স্তরে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য বা শক্তি প্রদর্শনের জন্যই হোক, বিষ অনু এবং বিষানু মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার প্রবণতা আরও বেশি বেড়েছে।একথা অস্বীকার করা যায় না। এসব সৃষ্টির ক্রমবিকাশের উদ্দেশ্য হনন করার লোভ। মানুষের দৈহিক ও মানসিক ক্রমবিকাশ বিঘ্নিতকরার মারন ইচ্ছা। উদাহরণ স্বরূপ জৈবিক অস্ত্র। উন্নতশীল দেশে অর্বুদ অর্বুদ মুদ্রা খরচ করে বিশাল পরীক্ষাগারে বিষানু তৈরি বা তাকে পোষ মানানোর উপায় খোঁজা কীসের উদ্দেশ্যে? এমন এমন মারক গ্যাস আবিষ্কার করা হয়েছে এবং অনুন্নত দেশগুলির উপর সামুহিক মানুষের উপর প্রয়োগ হয়েছে যার নজির অতীতে আছে এবং যেগুলি মানবতা বিরুদ্ধ। ইউরেনিয়ামের খোঁজ ও তার ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক শক্তির আবিষ্কার সেই ধনতন্ত্র দেশেই হয়েছে ও কেবল মাত্র তার সাম্রাজ্য বিস্তারের লোভের জন্য এ খবর আমাদের সবার জ্ঞাত। এই সর্বনাশা বিষ ধাতুটি নিষ্প্রাণ। তার কোনও বোধ নেই। মানুষই তাকে বিধ্বংসের কাজে লাগিয়েছে এবং লাগানোর পরিকল্পনা বিশ্বজুড়ে ঢাক পেটাচ্ছে।পরমাণু অস্ত্রে সেই দেশ কত শক্তিশালী।আবার পরে মানুষই তাকে সৃজনাত্মক কাজে লাগিয়েছে ও লাগাচ্ছে।প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে মানুষ নিজেদের অসুরক্ষিত মনে করে বা নিজেদের শক্তিশালী প্রমাণিত করতে অনেক রাসায়নিক বিষ অণু আবিষ্কার করেছে। যেমনটি এখন চীনদেশে কোভিডকে নিয়ে হচ্ছে বলে অনেক দেশের সন্দেহ।তা নাহলে চীনদেশে ভাইরলোজির এত বিশাল ল্যাবরেটরিতে আমেরিকা অর্বুদ টাকা লাগায় কেন?মোটকথা সেই ট্রেন্ড সমানে চলছে।


দয়াবান ঘাতক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিকআগে থেকে একটি উপকারী অধাতুর বাণিজ্যিক বিষপ্রয়োগ হচ্ছে এখনও অব্দি,যেটি এখন আমাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেটির অতি ব্যবহার এখন মানবকুলের ধ্বংসের প্রত্যক্ষ কারণ হতে পারে। এটি আবিষ্কার হয়েছিলো ১৮৮৬ সালে। এবং এই আবিষ্কারের জন্য আবিষ্কারকর্তা হেনরি মইসানকে নোবেল পুরস্কারে সন্মানিত করা হয়েছিলো। যে পদার্থটি আমাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তার নাম ফ্লোরিন। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ক্লোরিন ও আয়োডিন যা সোডিয়ামের সাথে সাধারণ নুন হয়ে বিশাল সমুদ্রে ছড়িয়ে রয়েছে, এবং ফ্লোরিন ব্রোমিন ও এস্টেটিন এই পাঁচটি মৌল পদার্থ একই পরিবারভুক্ত।এদের চরিত্র প্রায় এক কিন্তু গুণাগুণ আলাদা। আমাদের বিষয় ফ্লোরিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্লোরিনের রাসায়নিক যৌগ আবিষ্কার নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা এতবেশি মেতে উঠেছিলোযে পরপর বেশ কয়েকটি ভয়ানক অমঙ্গল বস্তু পরীক্ষাগারে সৃষ্টি হলো। একটি হলো,ইউ এফ সিক্স, ইউরেনিয়ামের সাথে ফ্লোরিন পাঞ্চ করা এমন একটি যৌগ যা ইউরেনিয়ামের ধ্বংসাত্মক গুণকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়এবং ইউরেনিয়াম পরিশোধন করে। যার ধ্বংসলীলা হিরোশিমা নাগাসাকিতে দেখেছি। এখন তো আরও নিখুঁত ও পরিশীলিত। দ্বিতীয়টি সি এফ সি, ক্লোরোফ্লুরোকার্বন যা আলাদীনের প্রদীপ দৈত্যের মতো আমাদের সুখের খেয়াল রাখে। সি এফ সি আমাদের জন্যে কী না করে। বিনা সি এফ সি গ্যাসে ফ্রিজ চলবে না এসি চলবে না।সেই যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়প্রশান্ত মহাসাগরের যুদ্ধ ময়দানে বোমারু বিমান ওড়াতে এরোসোল প্রোপেলেণ্ট ব্যবহার শুরু হলো,এখনও সমস্ত উড়োজাহাজগুলোতে তাইই ব্যবহার হচ্ছে। সেইসময় সি এফ সির আবিষ্কার হতেই তাকে নাম দেওয়া হয়েছিলো‘বাগ বম্ব’। এখন সেই বোমার সর্বত্র ব্যবহার। হেয়ার স্প্রে,রূপচর্চার জন্যে সবরকম কসমেটিক আইটেম তৈরিতে, ঘর পরিষ্কার করার লিকুইড,পেণ্ট তৈরিতে, ওষুধ তৈরিতে, বীজানুনাশক ইঁদুর মারা বিষ আরও আরও অনেককিছুতে সি এফ সি-র ব্যবহার।মোটের উপর এটি একটি এমন বস্তু যে আমাদের সুখ চাহিদা অনায়াসে মেটায়,বিশ্ববাণিজ্যের বাজারে একেবারে হট জিনিস। তাহলে এর প্রোডাকশন? ধরুন, ১৯৭০-৮০ সালে সারা বিশ্বে এর প্রোডাকশন ছিলো নয় লক্ষ টন।তা দেখেই বৈজ্ঞানিকদের হাহাকার।এই জিনিষটির এমন বাড়-বাড়ন্তে প্রাণীকূল রসাতলে যাবে। পৃথিবীর আবহমন্ডলে স্ট্রটোস্ফেয়ারে রক্ষাকবচ ওজোনস্তর এই সি এফ সি-র জন্যেই পাতলা হয়ে যাচ্ছে। ওই স্তরের ছিদ্র দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি পৃথিবীর বুকে পড়লে মানুষের দ্রুত ক্ষয় অবশ্যম্ভাবী। তখন থেকে প্রোডাকশন ধাপে ধাপে কমতে লাগলো। কিন্তু সেটির ব্যবহার মানুষ কি কমিয়েছে? জানিনা কোভিড ভাইরাসের মতো এই বস্তুটি কবে শিক্ষা দেবে।

অবশ্য মানুষের দৈহিক-মানসিক স্তরে ফ্লোরিনের অবদান অপরিসীম। আমরা এর ব্যবহার থেকে বিরত হতে পারিনা। অপারেশনের সময় যে এনেস্থেসিয়া ব্যবহার হয়,সেটি ফ্লোরিনেরই যৌগ। মানসিক ভারসাম্য হারালে যে ওষুধ দিয়ে উপাচার হয় সেটিও ফ্লোরিনের যৌগ। এরকম বহু মানসিক অসুস্থতার ওষুধ তৈরি হয় ফ্লোরিন দিয়ে।ফার্মাকোলজিতে প্রচুর ফ্লোরিনেটেড ওষুধ যেগুলোর অনেকগুলিই জীবনদায়ী।বেশ কয়েকবছর ধরে কৃত্রিম রক্তের ব্যবহার চলছে। সেটিও ফ্লোরিনের যৌগ। নাম পি এফ সি,পারফ্লুরোকার্বন। গুরুত্বপূর্ণ সার্জারীতে এই সিন্থেটিক রক্তের ব্যবহার সম্বন্ধেডাক্তারের বক্তব্য: ব্লাড টেস্টের দরকার হয় না,হাতের কাছেই পাওয়া যায়।ফ্রিজে ঠান্ডা করার দরকার হয় না। বহিরাগত রক্তের জন্য ঘটিত কোনও হাড়ের ইনফেকশন হয় না। ইত্যাদি। তবে হতে পারে ঈশ্বর না করুন,অদূর ভবিষ্যতে বিকট আকারে কোনও পেণ্ডেমিক রোগের জন্যে এই কৃত্রিম রক্তের প্রয়োজন হতে পারে।


আত্মবোধে বাধক

হিরোশিমা নাগাসাকির পর কয়েক প্রজন্ম জাপানের প্রচুর মানুষ দুরারোগ্য ক্যান্সার পীড়িত হয়ে জীবনযাপন করছিলো। কিন্তু হৃদয়ে ছিলো দেশপ্রেম,ঈশ্বরপ্রেম,বেঁচেথাকার অনুপ্রেরণা,আত্মজ্ঞান। তাই সেই দেশ এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যদি আত্মজ্ঞান সম্পন্ন দূরদর্শী কোনও মানুষকে বলা হয়, তোমার কাছে দুটো মাত্র অপশন আছে, সুস্থ শরীর কিংবা সুস্থ মন। কোনটা নেবে? এই দুটির মধ্যে একটিকে বেছে নাও। তখন সে নিশ্চয় বলবে,সুস্থ মন চাই। সুস্থ মন মানেই বিকশিত মানবতা। পৃথিবীতে ক্রমবিকাশের শেষ পর্যায়ে মানব প্রজাতি। বিজ্ঞানীরা বলেন,ক্রমবিকাশ থেমে নেই। এবার প্রকৃতিতে যে বিকাশ হচ্ছে, তা হল বুদ্ধির বিকাশ,ব্রেন ইভালুয়েশন। এবং তা হচ্ছে মস্তিষ্কের পিনিয়াল ও পিটুইটারি গ্ল্যাণ্ড কেন্দ্র করে। এখানেই বুদ্ধির বিকাশ ঘটে,আত্মজ্ঞান হয়। এই পিনিয়াল গ্রন্থিটি দুই ভুরুর মাঝখানে এক ইঞ্চি ভিতরে মস্তিষ্কে অবস্থান করে বলে এর আরেক নাম তৃতীয় নয়ন বা থার্ড আই। একে মনের চোখও বলে থাকে লোকে। অধ্যাত্মিকতা ও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এখান থেকেই স্ফুরিত হয়। হৃদয় থেকে যে নিঃস্বার্থ অকৃত্রিম ভালোবাসা স্ফুরিত হয় তা এই পিনিয়ালের কামাল।

দেখা গেছে ফ্লোরাইড যুক্ত কসমেটিক ও পানীয় জল শরীরে গেলে তার অধিকাংশই এই পিনিয়াল গ্ল্যাণ্ডে জমা হয়ে সেটিকে শক্ত করেতোলে।প্রথমে ঘুম ও জাগরণের সমস্যা দেখা দেয়। তারপর উল্লেখিত সূক্ষ্ম জ্ঞান ও অনুভুতিগুলি কমে যায়। এছাড়াওস্কেলেটালফ্লুরোসিস,আর্থারাইটিস,অস্টিওপোরেসিস ইত্যাদিবেশ কয়েকটি রোগবয়েস চল্লিশের পর দেখা দেয়।বিদেশে পানীয় জলে ফ্লোরাইড মেশানোর রেওয়াজ আছে। সেখানে অনেক মানুষের দাঁতে ক্যাভিটিও দাঁতের এনামেল খারাপ। তাই দাঁতের মাজনে ফ্লোরাইড নুন মেশানো হয় এবং পানীয় জলে ও দুধে ফ্লোরাইড মেশায়।এখন সারা পৃথিবীর ৩৭২ মিলিয়ন মানুষ ফ্লোরাইড মিশ্রিত জল পান করছে। আমাদের ভারতের ভূমিজ জলে যেহেতু প্রচুর পরিমাণে ফ্লোরাইড রয়েছে,তাই পানীয় জলে এখানে ফ্লোরাইড মেশানো হয় না। তবে অনেক রাজ্যে স্কেলেটাল ও ডেন্টাল রোগ এণ্ডেমিক।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন,বিষয়-সম্পত্তি,স্ট্যাটাস,লোকাচার, এমনকি দেশ-বিদেশের জ্ঞান এইসবের জন্যে রয়েছে আমাদের মস্তিষ্ক।বিজ্ঞানীরা বলেন ব্রেন হচ্ছে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবচেয়ে জটিলতম বস্তু।ব্রেনের ভিতরে রয়েছে অসীম মনো-আকাশ, চিদাকাশ, জ্ঞান-বুদ্ধি, স্মৃতি আবেগ সৃষ্টি ও মহা সময়।কম্পিউটারের সাথে ব্রেনের তুলনা করা যায়।কম্পিউটারেরজন্য দরকার হার্ডওয়ার আর হার্ডওয়ার চালানোর জন্য চাই সফটওয়ার। কিন্তুমস্তিষ্কও মন এই দুটিই কম্পিউটারেরচাইতে বহুগুণ জটিল।আমাদের জ্ঞানত-অজ্ঞানত একটি বিষ অনু ফ্লোরিন যদি ক্রমে ক্রমে বংশানুক্রমে সৃষ্টির বিস্ময়কর দান ব্রেনের অতি কোমল সূক্ষ্ম পিনিয়াল গ্রন্থিটি খারাপ করে ফেলি তো ভবিষ্যতে মানুষের কী দশা হবে ভাবতে পারেন? আমরা প্রকৃতির কাছে কী জবাব দেবো?

0 comments:

0

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in



















মনুসংহিতায় নারী

উত্তরভারতে এখন একজনই আরাধ্য— মর্য্যাদাপুরুষোত্তম রামচন্দ্র।

কিন্তু আদর্শপুরুষ রামের পত্নীর প্রতি ব্যবহারও তো আদর্শ হওয়া উচিত। অথচ বাল্মীকি রামায়ণে দেখছি উনি সীতাকে দু’দুবার সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললেন। আসন্ন প্রসবের সময় সীতাকে বনবাসে পাঠালেন। শুধু তাই নয়, লংকা বিজয়ের পর পতির দেখা পেয়ে আনন্দিত সীতাকে কটুবাক্যে বললেন— ‘সীতা, ভেব না আমি তোমার জন্যে এই যুদ্ধ করেছি। আমি রাবণকে পরাজিত করে লংকা দখল করেছি নিজের সম্মান ও হৃতগৌরব উদ্ধার করতে। আজ আমার পৌরুষ তৃপ্ত’। সীতা অবাক, সীতা কাঁদো কাঁদো।

রামের ক্রোধ বেড়ে গেলো। চোখ পাকিয়ে সীতার দিকে তাকিয়ে উনি উপস্থিত সমস্ত রাক্ষস ও বানর সেনার সামনে সীতাকে বললেনঃ

“সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছ, কিন্তু তুমি আমার চক্ষুশূল। কারণ তোমার চরিত্র নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। কাজেই তোমাকে অনুমতি দিলাম-দশদিকের যেকোন দিকে সোজা চলে যাও। দূর হয়ে যাও। পরগৃহে এতদিন ছিলে, কোন উচ্চবংশীয় পুরুষ এমন নারীকে ফিরিয়ে নেবে? তুমি রাবণের অঙ্কশায়িনী। আমি যা বলছি তা অনেক ভেবে বলছি। যদি মন চায় তো লক্ষ্মণ, ভরত, বানরশ্রেষ্ঠ সুগ্রীব বা রাক্ষস শ্রেষ্ঠ বিভীষণ—যার কাছে ইচ্ছে হয় চলে যাও। রাবণ তোমার অপরূপ স্বর্গীয় রূপ দেখেছিল। নিশ্চয়ই ওর গৃহে তোমাকে ছুঁয়েছে”। সীতা কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারালেন। (মূল বাল্মীকি রামায়ণের সংস্কৃত থেকে নীতি আয়োগের প্রাক্তন সদস্য বিবেক দেবরায়ের করা ইংরেজি থেকে বাঙলা অনুবাদ প্রবন্ধকারের)।

যদিও বর্তমান সমাজের মূল্যবোধের মানদণ্ডে পত্নীর প্রতি রামের ব্যবহার ও কটুবচন শুধু অন্যায় নয়, অকল্পনীয়। কিন্ত সেই সময়ের মূল্যবোধে? তখন তো মনুস্মৃতিই পঞ্চম বেদের মর্য্যাদা পেয়েছিল।

সাধে কি “রামচরিতমানস” রচয়িতা ভক্তকবি গোস্বামী তুলসীদাস বলেছেনঃ

“চোর ঢোর গাঁওয়ার শূদ্র অউ নারী,

ইয়ে সব হ্যায় তাড়ণ অধিকারী”।

বাংলায় বললে-“ চোর মোষ গোঁয়ার, শুদ্র ও নারী,

এদের সামলে রাখতে চাই লাঠির বাড়ি”।

এবার নারীদের সম্পর্কে মনুস্মৃতি কী বলে দেখা যাক।

কিন্তু এত ভাবার কী আছে? নীটশে নাকি বলেছেন “I know of no book in which so many delicate and kindly things are said of woman as in the Law book of Manu”

নাঃ, হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। সায়েবসুবো মাথায় থাক, মনুস্মৃতিই খুলে বসা যাক।

গোড়ায় সৃষ্টিতত্ত্বে বলা হচ্ছে স্রষ্টা নিজদেহ দ্বিধা বিভক্ত করে অর্ধভাগে পুরুষ হলেন, বাকি অর্ধে নারী। তার থেকে বিরাট পুরুষ সৃষ্ট হল, যিনি মনুর স্রষ্টা।(১/৩২)।

এত একেবারে কবি নজরুলের লাইনঃ “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর; অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”। (সাম্য)

তাহলে তো নারী পুরুষ সমান সমান, কোন পক্ষপাতের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু পুরুষ যখন সামাজিক প্রথা, আইনকানুন বানাতে শুরু করল তখন নিজেদের দিকে টেনে খেলল। নারী আর সুখে দুঃখে সমান অংশীদার রইল না। ‘ওরা’ এবং ‘আমরা’র খেলা শুরু হয়ে গেলো। ‘এ বাণী প্রেয়সী হোক মহীয়সী তুমি আছ, আমি আছি’ শুধু কবির ইচ্ছেয় রয়ে গেলো। মনুসংহিতায় এবার সেই খেলাটাই পর্বে পর্বে দেখব।

নারীদের স্বভাবই হল পুরুষদের দূষিত করা। সাধু সাবধান! (২/২১৩)

সত্যিই তো, ইডেন গার্ডেনে সাদাসিধে আদমকে আপেল খেতে কে প্ররোচিত করেছিল?

তাই স্ত্রীলোক হল রথ অশ্ব ছত্র ধন ধান্য পশু জিনিসপত্র বা তামার মতোই লুটের মাল; যে জিতে নেবে তার। (৭/৯৬)।

এই জন্যেই বোধহয় পঞ্জিকায় বিশেষ বিশেষ তিথিতে কোন কোন জিনিস সেদিন খাওয়া যাবেনা তার লিস্টিতে “স্ত্রী সম্ভোগ” জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন, মৎস্য মাংস অলাবু বার্তাকু ভক্ষণ এবং স্ত্রীসম্ভোগ নিষিদ্ধ।

রাজা মন্ত্রণাকালে জড়বুদ্ধি, বোবাকালা, অঙ্গহীন, ম্লেচ্ছ, রুগ্ন, অতিবৃদ্ধ, টিয়েপাখি এবং স্ত্রীলোককে ওখান থেকে সরিয়ে দেবেন। কারণ এরা গোপন খবর ফাঁস করতে পারে। (৭/১৪৯-১৫০)।

স্ত্রী, পুত্র ও দাস—এই তিনজনই ধনহীন। এরা যদি কিছু উপার্জন করে তাহলে সেটা তাদের মালিকেরই সম্পত্তি হয়ে যাবে। (৮/৪১৬)।

দেখুন স্ত্রীজাতির উপনয়ন বা দ্বিতীয় জন্ম হয়না, ওরা দ্বিজ ন’ন; তাই ওদের বেদ পাঠে অধিকার নেই। তাহলে ওঁদের সংস্কার বলতে কী রয়েছে?

—স্ত্রীলোকের জন্যে বিবাহবিধিই বৈদিক সংস্কার, পতিসেবাই গুরুগৃহে বাস, এবং গৃহকর্মই তাঁদের যজ্ঞ বা অগ্নি-পরিচর্যার সংস্কার। (২/৬৭)।

দুর্গাপুজোয় অঞ্জলি দিতে গিয়ে অনেকেরই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে পুরুত মশায় বলছেন— ব্রাহ্মণেরা ওঁ বলবেন। অন্যেরা এবং সমস্ত মা-বোনেরা ‘নমঃ’ বলবেন। ঠাকুরমশায়ের দোষ নেই। ‘ওঁ’ হল প্রণব-বৈদিক মন্ত্র; উপবীতধারী বিনা কারও অধিকার নেই উচ্চারণ করার। ব্রাহ্মণের স্ত্রী হলেও নয়। মনুর বিধান যে!

লালন গেয়েছেন— যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীজাতির কী হয় বিধান,

ব্রাহ্মণ চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনি চিনি কিসে রে?

স্ত্রীজাতির ধর্ম

সে না হয় হল, কিন্তু স্ত্রীজাতির ধর্মাচরণ, মানে দৈনন্দিন জীবন কেমন হবে, সে’ব্যাপারে মনু কিছু বলে যাননি? আলবাৎ বলেছেন।

নিজের ঘরেও বালিকা, যুবতী বা বৃদ্ধা নারী স্বাধীনভাবে কিছু করবেন না। (৫/১৪৭)

“বাল্যে পিতুর্বশে তিষ্ঠেৎ পাণিগ্রাহস্য যৌবনে।

পুত্রাণাং ভর্তরি প্রেতে ন ভজেৎ স্ত্রী স্বতন্ত্রতাম।। (৫/১৪৮)

নারী বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রদের অধীন; কখনও স্বাধীনভাবে থাকবেন না।

পতি দুশ্চরিত্র, কামুক বা গুণহীন হলেও তিনি সাধ্বী স্ত্রী‘র কাছে সর্বদা দেবতার মত সেবা পাওয়ার যোগ্য। (৫/১৫৪)।

বোঝাই যাচ্ছে কেন সতী অনুসূয়া কুষ্ঠরোগী স্বামীর ইচ্ছে মেটাতে তাকে কাঁধে করে বেশ্যাবাড়ি নিয়ে গেছলেন; সে রবীন্দ্রনাথ এই আখ্যানটিকে পুরুষের কাপুরুষতার চরম উদাহরণ বলে যতই গালমন্দ করুন না কেন!

স্ত্রীলোকের আলাদা কোন যজ্ঞ, ব্রত বা উপবাস নেই। তিনি যে পতিসেবা করেন তাতেই স্বর্গে পূজো পাওয়ার যোগ্য হন। (৫/১৫৫)

পতি মৃত হলে স্ত্রী পবিত্র ফল মূল খেয়ে দিন কাটাবেন, কিন্তু অন্য পুরুষের নাম পর্য্যন্ত নেবেন না। (৫/১৫৭)

স্ত্রী সন্তানের মা না হলেও পতির মৃত্যুর পরে ব্রহ্মচর্য পালন করে স্বর্গে যাবেন। (৫/১৬০)।

সন্তান লোভে যে নারী স্বামীকে এড়িয়ে ব্যভিচারিণী হন, তিনি ইহকালে নিন্দিত, এবং পরকালে পতিলোক থেকে পতিত হন। (৫/১৬১)।

স্ত্রী স্বামীকে অবহেলা করে ব্যভিচারিণী হলে সংসারে নিন্দে হয়, সে পরের জন্মে শেয়াল হয়ে জন্মায় এবং যক্ষ্মা কুষ্ঠ আদি পাপরোগের শিকার হয়। (৫/১৬৪)।

স্ত্রী মারা গেলে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ স্বামী ওঁর চিতায় আগুন দিয়ে ফের বিয়ে করবেন। (৫/১৬৮)।

যে নারী পিতার ধনের গর্বে বা নিজ সৌন্দর্যের অহংকারে স্বামীকে ত্যাগ করে, তাকে রাজা সবার সামনে কুকুর দিয়ে খাওয়াবেন। (৮/৩৭১)


স্বামী-স্ত্রীর পালনীয় ধর্মঃ

নবম অধ্যায়ে এব্যাপারে বিস্তৃত নির্দেশ দেয়া রয়েছে। এখানে স্থানাভাবে তার কয়েকটি উল্লেখ করছি।

পুরুষেরা স্ত্রীদের দিনরাত পরাধীন রাখবেন (৯/২)

স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয় (৯/৩)।

বিয়ের বয়েস হলে কন্যা সম্প্রদান না করলে পিতা, ঋতুকালে পত্নীগমন না করলে পতি, পিতা মৃত হলে মায়ের দেখাশুনো না করলে পুত্র নিন্দের পাত্র হয় (৯/৪)।

অরক্ষিত স্ত্রীলোক পিতৃ, মাতৃ উভয়কুলের দুঃখের কারণ (৯/৫)।

মদ্যপান, দুষ্টলোকের সংসর্গ, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি, ঘুরে বেড়ানো, অকাল নিদ্রা, পরগৃহে বাস— এই ছয়টি নারীর ব্যভিচারাদি দোষের কারণ (৯/১৩)।

এরা রূপ দেখে না, বয়স দেখে না; পুরুষ রূপবান বা কুরূপ যাই হোক, পুরুষ দেখলেই সম্ভোগরত হয় (৯/১৪-১৫)।

ব্রহ্মা এদের এমন স্বভাব দিয়েই সৃষ্টি করেছেন, কাজেই পুরুষ স্ত্রীলোকের রক্ষার ব্যাপারে বিশেষ প্রযত্ন করবে (৯/১৬)।

মনু স্ত্রীদের স্বভাবে দিয়েছেন– শয়ন, উপবেশন, অলংকার, কাম, ক্রোধ, কুটিলতা, হিংসুটেপনা, মন্দ আচরণ (৯/১৭)।

স্ত্রীলোকের ব্যভিচারের প্রায়শ্চিত্তের শ্রুতি বা বৈদিক মন্ত্র হলঃ আমার মাতা যে অসতী হয়ে পরপুরুষ সম্ভোগ করতে চেয়েছেন, ওই ইচ্ছায় অপবিত্র হওয়া (মাতৃরজঃস্বরূপ) শুক্রকে আমার পিতা শুদ্ধ করুন (৯/২০)।

তবে নীচকুলে জাত স্ত্রী উচ্চকুলের পতির সঙ্গে মিলিত হলে পতির ভাল গুণ প্রাপ্ত হন। যেমন শূদ্রজাতীয় অক্ষমালা বশিষ্ঠের সঙ্গে এবং শারঙ্গী মন্দপালের সঙ্গে মিলিত হয়ে মাননীয় হয়েছিলেন (৯/২৩)।

নারী হল খেত, পুরুষ হল বীজ। দুয়ের মিলনে সন্তান। কখনও খেত প্রধান, কখনও বীজ। উভয়েই সমান হলে সন্তান ভালো হয়ে জন্মাবে। (৯/৩৩,৩৪)।

সন্তানের জন্ম দেয়া, তাদের বড় করা এবং প্রতিদিনের অতিথিসেবা আদি রীতিনীতির জন্যে স্ত্রীলোকেরা লক্ষ্মী (৯/২৬,২৭)।

নিয়োগপ্রথা

প্রাচীন ভারতে নিয়োগপ্রথা ছিল। মহাভারতে কুরুবংশে দুই রাণী অম্বিকা ও অম্বালিকা নিঃসন্তান। তাই মাতা সত্যবতীর আগ্রহে সম্পর্কে দেবর বেদব্যাস এসে দুইরাণীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডু এবং শূদ্রাণীর গর্ভে বিদুরের জন্মের কারণ হয়েছিলেন। এবার দেখুন নিয়োগ নিয়ে মনু কী বলছেনঃ

সন্তানের অভাবে পতি প্রভৃতি গুরুজনের দ্বারা সম্যকরূপে নিযুক্ত হয়ে নারী দেবর বা সপিন্ড (নীচের টীকা দেখুন) কারও থেকে সন্তানলাভ করতে পারে, কিন্তু একটির বেশি নয় (৯/৫৯)।

বিধবা নারীতে, নিয়োগ ব্যাপারটা নিয়মমাফিক সম্পন্ন হলে তারপরে তারা দু’জন পুত্রবধূ ও বড় ভাইয়ের মতো আচরণ করবে (৯/৬২)।

কিন্তু ব্রাহ্মণের বিধবা অন্য পুরুষের সঙ্গে এভাবে ‘নিযুক্ত’ হতে পারে না। তাহলে সনাতন ধর্ম নষ্ট হবে (৯/৬৪)।

মনে হয় নিয়োগ বা বিধবার যৌনতা নিয়ে মনু দ্বিধায় ছিলেন, তাই সাবধান করছেন- একের বেশি সন্তান নয়, এরপর কামবশে ফের মিলিত হওয়া পাপ। (৯/৬১, ৬৩)।

কিন্তু বিবাহ সংক্রান্ত মন্ত্রে কোথাও ‘নিয়োগ’ এর উল্লেখ নেই। বিবাহ বিধায়ক শাস্ত্রে কোথাও ‘বিধবা-বিবাহ’এর কথা বলা হয়নি।

পন্ডিত দ্বিজগণ এই ‘নিয়োগপ্রথা’কে পশুধর্ম বলেছেন। এসব অধার্মিক বেনরাজার কীর্তি। উনিই কামের পরবশ হয়ে এসব শুরু করিয়ে পৃথিবীতে ‘বর্ণসংকর’ (বাস্টার্ড) সৃষ্টি করেছিলেন। (৯/৬৬,৬৭)।

স্বামী-স্ত্রী-নিয়োগ এসব নিয়ে ঢের হল। এবার খোদ বিবাহ নিয়েই মনুর বিধান নেড়েচেড়ে দেখা যাক। এতে অবধারিত ভাবে জাতিভেদের প্রশ্ন উঠবে।

বিবাহঃ

প্রথমে মেয়ে দেখা হোক।

নিজ বর্ণের সুলক্ষণা মেয়ে বিয়ে করা উচিত। যে কন্যা মাতার সপিন্ড এবং পিতার সগোত্র নয়, সেই মেয়েই দ্বিজের ( ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য, যার পৈতে হয়েছে) বিবাহে এবং মৈথুনে উপযুক্ত (৩/৪-৫)।

কিন্তু স্বজাতেও কেমন মেয়েকে বিয়ে করা উচিৎ নয়? নীচের দশ রকমের পরিবারের মেয়ে আনতে নেইঃ

যেসব পরিবার হীন কাজ করে, পুরুষসন্তান নেই, বেদপাঠহীন, শরীর লোমে ভরা, অর্শ, যক্ষ্মা, অ্যাসিডিটি, শ্বেতী বা কুষ্ঠরোগগ্রস্ত (৩/৭)।

যে মেয়ে কপিলবর্ণা, মানে যার গায়ের রঙ পাঁশুটে, হাত-পায়ে বেশি আঙ্গুল, রোগী, লোমহীনা, বেশি লোম, বাচাল আর যাদের নামে নক্ষত্র, বৃক্ষ, নদী, পর্বত, পক্ষী, সর্প, দাস আছে বা ভীতিজনক নাম—তাদের বিয়ে করবে না।

এটা মানলে তো আমাদের ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় অবস্থা হবে (৩/৮-৯)।

বিয়ে করবে এমন মেয়েকে যে অঙ্গহীন নয়, হংসগতি বা গজগামিনী, যার নাম ধরে সহজে ডাকা যায়, যার লোম ও কেশ কোমল, দাঁত ছোট, অঙ্গ মৃদু। (৩/১০)।

উঃ যেন গোহাটে গরু কিনছে!

যে মেয়ের ভাই নেই, পিতা কে জানা যাচ্ছে না, বিজ্ঞ ব্যক্তি তাকে বিয়ে করবে না কারণ কি জানি যদি ও আমার কন্যাসমা হয়! (৩/১১)

এক কন্যা বরকে দেখিয়ে অন্য কন্যা দান করলে এক শুল্ক দিয়েই পাত্র দুজনকেই বিয়ে করতে পারবে—এই হল মনুর বিধান (৮/২০৪)।

প্রথম স্ত্রী তো নিজেদের বর্ণের হতে হবে।(প্রথম বিয়ে তো বংশরক্ষার জন্যে; পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা) কিন্তু কামবশঃ ফের বিয়ে করতে চাইলে কন্যার যোগ্যতা নীচে দেওয়া হলঃ

ব্রাহ্মণ – ব্রাহ্মণী ও তিন বর্ণের মেয়েকে।
ক্ষত্রিয়— ক্ষত্রিয়া এবং বৈশ্য ও শূদ্রের মেয়েকে।
বৈশ্য— বৈশ্য ও শূদ্রের মেয়েকে।
শূদ্র- শুধু শূদ্রে্র মেয়েকে। (৩/১২-১৩)।

কিন্তু ব্রাহ্মণের শূদ্র বৌ নিয়ে মনুমহারাজের বড্ড অস্বস্তি ছিল। গোটা পাঁচেক শ্লোকে অমন বিয়ে করলে ব্রাহ্মণের কী কী ঝামেলা হতে পারে তা’ নিয়ে সতর্ক করেছেন। দুটো তুলে দিচ্ছিঃ

ব্রাহ্মণ শূদ্রাকে শয্যায় নিলে অধোগতি প্রাপ্ত হয়। তাতে পুত্রোৎপাদন করলে ব্রাহ্মণত্বই চলে যায়। (৩/১৭)।

যে ব্রাহ্মণ শূদ্রার অধররস পান করেন, তার শ্বাস নিজের শ্বাসে যুক্ত করেন এবং গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেন, তাঁর শুদ্ধি হয়না (৩/১৯)।

মেয়েও পছন্দ হল, এবার বিয়ে। কিন্তু বিবাহ যে আট রকম। কোনটা করব কীভাবে ঠিক হবে? ঠিক হবে বরের জাত দিয়ে।

কতরকম বিয়ে?

বিয়ে আট রকমঃ ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ। এর মধ্যে প্রথম চারটি (ব্রাহ্ম থেকে প্রাজাপত্য) ব্রাহ্মণের জন্যে, রাক্ষস ও গান্ধর্ব ক্ষত্রিয়ের জন্যে, বৈশ্য ও শূদ্রের জন্যে আসুর প্রশস্ত। পৈশাচ বিবাহ কারোরই করা উচিত নয়। (৩/২১.২৪ ও ২৫)।

কিন্তু কার নাম দুন্দুভি? কাকে বলে অরণি?

ব্রাহ্মঃ বিদ্বান চরিত্রবান পাত্রকে আহ্বান করে কাপড়চোপড় উপহার দিয়ে সম্মানিত করে কন্যাদান। (৩/২৭)

দৈবঃ যজ্ঞের সময় কাপড়ে গয়নায় সাজিয়ে গুছিয়ে কন্যাকে পুরোহিতের নিকট দান। (৩/২৮)

আর্যঃ বরের থেকে ধর্মার্থে একটি করে বৃষ ও গাভী নিয়ে কন্যাদান (৩/২৯)।

প্রাজাপত্যঃ সোজা কথায় প্রজাপতির নির্বন্ধ। ‘দুজনে একত্র হয়ে ধর্মাচরণ কর’ বলে বরের পূজো করে কন্যাদান(৩/৩০)। আজকাল হিন্দুমতে এ’রকম বিয়েই আকছার হচ্ছে।

আসুরঃ বর যদি মেয়ের বাবা বা জ্ঞাতিদের যথাশক্তি ধন দিয়ে নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে। এটাও বহুদিন ধরে আমাদের দেশে চলে আসছে। (৩/৩১)।

গান্ধর্বঃ ‘গান্ধর্বঃ স তু বিজ্ঞেয়ো মৈথুনাঃ কামসম্ভবঃ।। (৩/৩২)

কন্যা ও বরের ইচ্ছানুসারে মিলন, মনুর মতে এই বিবাহ কামবশে মৈথুনেচ্ছায় ঘটে! আজকাল এরকমও হচ্ছে বটে, যাকে আমরা হরদম ‘লাভ ম্যারেজ’ বা প্রেম করে বিয়ে বলে থাকি।

রাক্ষসঃ কন্যাপক্ষের লোকজনকে আহত বা হত্যা করে আর্তনাদ করতে থাকা কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করে বিয়ে করা(৩/৩৩)। এটা হামলা এবং ধর্ষণ, যেমন ডাকাত দলের কান্ড।

পৈশাচঃ নিদ্রিতা, মদ্যাপানে বিহ্বল বা পাগল কন্যাকে নির্জনে সম্ভোগ করলে সর্বাধিক পাপজনক ও নিকৃষ্ট বিয়ে (৩/৩৪)। এটা অবশ্যই ধর্ষণ।

একটা জিনিস খেয়াল করার মত। তখন বরকে কন্যাপণ দিতে হত, যদিও এই প্রথাকে মনু কয়েক জায়গায় গর্হিত এবং মেয়ের বাপের দিক থেকে এটা টাকার লোভে কন্যা বিক্রয় বলে নিন্দে করেছেন। কিন্তু লক্ষণীয় যে তখন আজকের মত মেয়ের বাবাকে যৌতুক দিতে হত না।

অন্ততঃ মনুস্মৃতি তাই বলছে। বিয়ে হয়ে গেলো। এবার সন্তান জন্মের রহস্য জেনে নিন।

প্রথম চারপ্রকারের বিয়ের ফলে ভদ্রজনের মান্য বেদাধ্যয়ন করা তেজস্বী পুত্র হয়। রূপ, গুণ, যশ ও প্রচুর ভোগের অধিকারী হয় এবং তার একশ’ বছর আয়ু হয়। কিন্তু বাকি চারটে নিকৃষ্ট বিয়ের ফলে নিষ্ঠুর, মিথ্যেবাদী এবং বেদ ও যাগযজ্ঞের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন পুত্র জন্মায়। (৩/৩৯.৪০, ৪১)।

শোণিতস্রাবযুক্ত প্রথম চার রাত্রি, একাদশ ও ত্রয়োদশ রাত্রি এবং অমাবস্যাদি মনুর বিধিতে নিন্দিত। বাকি সময়ে গৃহস্থ স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে রতিকামনায় দারগমন করবেন। (৩/৪৫, ৪৬, ৪৭)।

ওই প্রশস্ত রাত্রিগুলোর মধ্যে জোড় সংখ্যার রাতে, যেমন ষষ্ঠ ও অষ্টম, ছেলে হয় এবং বেজোড় সংখ্যার রাতে, যেমন পঞ্চম বা সপ্তম, মেয়ে। তাই ছেলে চাইলে য জোড় সংখ্যার রাত্রিতে দারগমন করিবেন (৩/৪৮)।

পুরুষের শুক্র বেশি হলে পুত্র, স্ত্রীর শুক্র বেশি হলে কন্যা জন্মায়। দু’জনেরই সমান সমান হলে জোড়া সন্তান বা হিজড়ে জন্মায়। কিন্তু দুজনের শুক্র খুব অল্প হলে গর্ভ হয় না। (৩/৪৯)।

কন্যাপণ নেওয়া নিয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে।

কন্যার পিতা সামান্য শুল্কও নেবেন না, নইলে মেয়ে বিক্রয় করা হল। (৩/৫১)

‘আর্যবিবাহে যে গাইবলদ নেবার প্রথা তাকে পণ না বলে কেউ কেউ শুল্ক বলেন। ওটা মিথ্যা। পণ কম বা বেশি যাই হোক, নিলে মেয়ে বিক্রিই হল’। (৩/৫৩)।

“যত্র নার্য্যন্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ”।। (৩/৫৬)

যেখানে নারীগণ সম্মানিত হন, সেখানে দেবগণ প্রীত হন। এঁরা সম্মানিত নাহলে সকল কর্ম নিস্ফল হয়।

মনুস্মৃতিতে নারীর কত উঁচু স্থান প্রমাণ করতে এই শ্লোকটি সর্বত্র উল্লেখ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর “হিন্দুবিবাহ” প্রবন্ধে মনুস্মৃতিতে ওই শ্লোক এবং মনুসংহিতায় আরও কয়েকটি শ্লোক উল্লেখ করে প্রাচীন কোড অব কন্ডাক্টে নারীকে উঁচু স্থানে বসানোর মিথকে কাটাছেঁড়া করেছেন।

এবার নারীরাই ভাবুন তাঁদের মর্যাদা কত উঁচুতে রেখেছে মনুর বিধান। আপনারাই আমার জুরি।

নাউ আই রেস্ট মাই কেস, মিলর্ড!

0 comments:

0

বিশেষ ক্রোড়পত্র - শম্ভু মিত্র

Posted in


‘জাগতে রহো’ ছবির জন্য শম্ভু মিত্র ১৯৫৭ সালের কারলভি ভ্যারি চলচ্চিত্র উৎসবে ক্রিস্টাল গ্লোব পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। এই ছবিটির কাহিনী ও চিত্রনাট্য রচনা ছাড়াও সহপরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। এর পরও বহুবিধ চরিত্রে রূপোলী পর্দায় দেখা গেছে তাঁকে। কিন্তু তাঁকে কি আমরা চলচ্চিত্রাভিনেতা হিসাবে মনে রেখেছি? এমনকি লোকান্তরের পর প্রায় আড়াই দশক কেটে যাওয়ার পর বাংলা নাটকের ইতিহাসে তাঁর স্মৃতিধার্য এবং প্রায় অনতিক্রম্য ভূমিকার কথা মনে রেখেও বলতে হবে নাট্য প্রযোজনার সেই বিশিষ্ট ঐতিহ্যের ধারাটিও সম্ভবত এই মুহূর্তে বেশ ক্ষীণ। এ মাসের বাইশ তারিখ রবীন্দ্রনাথের নাটককে সম্পূর্ণ আলাদা চোখ দিয়ে দেখতে শেখানো এই মানুষটির ১০৭ তম জন্মদিন। তাঁকে কি আমরা এক অসামান্য অভিনেতা এবং বাচিক শিল্পী বলে মনে রাখবো, নাকি যাঁর মস্তিষ্কনির্ভর নির্দেশনা বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে খুলে দিয়েছিল অজস্র জানালা, সেই অসীম প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব হিসাবে? না ‘চাঁদ বণিকের পালা’র নাট্যকার শম্ভু মিত্রকে?

ঋতবাকের এই তর্পণে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা।




সূচিপত্র

শম্ভু মিত্র ও ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ – পবিত্র সরকার
ব্যক্তিগত স্বল্প পরিচয়ে শম্ভু মিত্র – শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়
পথ ও পথিক – দেবাশিস মজুমদার
শম্ভু মিত্র – সুনীল দাশ
শম্ভু মিত্র – নাট্যের ভাষা – সৌমিত্র বসু
ঘূর্ণি - বাঁকের মুখে শম্ভু মিত্র – অংশুমান ভৌমিক
শম্ভুদার কাছে – সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
শম্ভু মিত্র আর আমি – রাজা সেন




শম্ভু মিত্র ও ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ
পবিত্র সরকার

১. দুয়ের স্বল্পস্থায়ী যোগ ও বিচ্ছেদ : এখন কীভাবে দেখব ?

ধরেই নিচ্ছি বিষয়টি একটু স্পর্শকাতর। কিন্তু স্পর্শকাতরতাকে উত্তীর্ণ হয়েও যা থাকে তা হল ইতিহাসে ঘটে যাওয়া কিছু অবিস্মরণীয় ঘটনা। বলা বাহুল্য, সব ঘটনা যেমন অবিস্মরণীয় নয়, তেমনই সব ঘটনা এই স্পর্শকাতরতার বিপদ এড়াতে পারে না। কিন্তু কিছু ঘটনা পারে, এবং সেখানে সেই ঘটনাকে বিচার করার জন্য আমাদের অন্যভাবে প্রস্তুত হতে হয়। এই রকমই একটি ঘটনা হল ১৯৪৪ সালের ২৪শে অক্টোবর কলকাতার শ্রীরঙ্গম মঞ্চে বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘নবান্ন’ নাটকের অভিনয়। এ নাটক যুগ্মভাবে পরিচালনা করেছিলেন নাট্যকার এবং শম্ভু মিত্র। সমকালীন নানা বিবরণ থেকে এই দুই ব্যক্তির মধ্যে একটা শ্রমবিভাজনের ছবি বেরিয়ে আসে। বিজন ভট্টাচার্য মূলত অভিনয় আর সংলাপ শেখানোর দায়িত্বে ছিলেন, অর্থাৎ মঞ্চের মানবসম্পদ নিয়ে ছিল তাঁর কাজ ; আর শম্ভু মিত্রের দায়িত্ব ছিল “মঞ্চ, সংগীত ইত্যাদি।”১ এই বিভাজন কাজের ক্ষেত্রে কতটা রক্ষা করা হত তা আমরা জানি না, কিন্তু শম্ভু মিত্রের সর্বাঙ্গীণ অভিজ্ঞতা ও কুশলতার কথা অনেকেই বলেছেন, পেশাদার রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের একটি ইতিহাস তিনি বহন করেছেন, কাজেই ‘নবান্ন’-র প্রযোজনায় সেই সর্বাঙ্গীণতার কোনো ভূমিকা থাকবে না তা আমাদের মনে হয় না। বরং শ্রীসুধী প্রধানের কথায় শ্রীমিত্রের এই ভূমিকার ব্যাপকতা অনেক বেশি স্পষ্ট হয়—“দৃশ্যগুলির পরিবর্তনে শম্ভু বাবুর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং মঞ্চসজ্জা যতদূর সম্ভব কল্পনার সাহায্যে সরল কয়ার ব্যাপারেও তিনি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য কর্তৃক চট ব্যবহারের সুপারিশ পেয়েই বাস্তবায়িত করেন। চট দিয়ে তিনটি চেম্বার করা এবং চটের ফালি করে বাঁশের সাহায্যে কখনো কৃষকের বাড়ী, কখনও গণেশের ছবি দিয়ে চালের আড়ত করা, চটের ফালির দরজার দুই পাশে মঙ্গল ঘট কলাগাছ এবং ফুলের সাজ দিয়ে বিয়েবাড়ী এবং তার পাশে কার্ডবোর্ডের ডাস্টবিন, বাঁশের রেলিং তৈরী করে তার পাশে বেঞ্চি দিয়ে পার্কের আভাষ (‘মূলে এই’) সৃষ্টি করা প্রভৃতি খুঁটিনাটি কাজ তিনিই করেছেন। নাটকের সংলাপ প্রধানতঃ বিজনও শেখাতেন। কিন্তু অভিনয়ের কোনো সূক্ষ কাজ করতে হলে মনোরঞ্জন বাবু (ভট্টাচার্য), শম্ভু বাবু, বিজন (ভট্টাচার্য) সকলেই অভিনেতা, অভিনেত্রীদের মনে ধারণা জন্মিয়ে দিয়ে ছেড়ে দিতেন নিজেদের চেষ্টার উপর। ‘নবান্ন’ অভিনয়ে সফলতার জন্য প্রধানতঃ নিয়মিত রিহার্সালই দায়ী এবং এ ব্যাপারে শম্ভু বাবু কখনও পরিশ্রান্ত হতেন না। কয়েক কাপ চা খেলে তিনি রাত্রি ১২টা পর্যন্ত রিহার্সাল দিতে রাজী হতেন।” (১৯৮৯, ৩৬-৩৭ জগন্নাথ ঘোষ, উদ্ধৃত ২১ পৃ.)

এই অভিনয় ইতিহাস হয়ে আছে, নিজে ইতিহাসের দিগ্‌বদল ঘটিয়েছে বলেই। দিগ্‌বদল শুধু নয়, বলা যায় নতুন ইতিহাসের নির্মাণ। আমরা আগেও বলেছি, ‘নবান্ন’-এর অভিনয় বাংলা নাটকের ইতিহাসকে মুমূর্ষু পেশাদার রঙ্গমঞ্চের আশ্রয় থেকে সবলে ছিনিয়ে নিয়ে এক নতুন সরণিতে স্থাপন করে। শিশিরকুমারের ম্লান ও বিলীয়মান উপস্থিতি ছিল পঞ্চাশের বছরগুলির অন্ত্যপর্ব পর্যন্ত, আর পঞ্চাশ আর ষাটের বছরগুলিতে পেশাদার রঙ্গমঞ্চ যেন প্রদীপ নিবে যাওয়ার আগের উজ্জ্বলতা দেখিয়ে কয়েকটি নাটকে কয়োকশো রাত্রির তুমুল সাফল্য পায়, তারপর সত্তরের বছরগুলিতে ক্যাবারের করুণ ব্যর্থতা বহন করে অপ্রতিবাদ আত্মসমর্পণে এক স্বাভাবিক মৃত্যুকে গ্রহণ করে।

এর পর বাংলা নাটকের বিবর্তনে পেশাদার রঙ্গমঞ্চের কোনো ভূমিকা থাকবে না। এই ভূমিকা যে ক্রমশ অবান্তর হয়ে যাবে, ‘নবান্ন’ থেকেই যেন তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। তার কৃতিত্ব শুধু একজনকে দেওয়া যায় কি না জানি না, কিন্তু সে কৃতিত্বের একটা বৃহৎ অংশ যে শম্ভু মিত্র দাবি করতে পারেন তাতে সন্দেহ নেই।

শম্ভু মিত্র আর গণনাট্য সঙ্ঘের স্বল্পস্থায়ী কিন্তু বর্ণাঢ্য ও দায়বদ্ধ মিলনে যে ইতিহাস তৈরি হয়েছিল সে ইতিহাস কিন্তু স্বল্পস্থায়ী হয়নি। সে ইতিহাস ছয় দশকেরও বেশি সময় তার সজীব প্রবাহ রক্ষা করে বর্তমানেও সমান সজীব এবং ভবিষ্যতেও দীর্ঘদিন বাংলা নাট্যচর্চাকে জীবন্ত রাখবে, এ বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। কাজেই দুয়ের সম্মিলিত কাজের ক্ষণস্থায়িত্বের জন্য, অপরিবর্তনীয় অতীতের জন্য, হা-হুতাশ না করে দুয়ের মিলন বাংলা নাট্যসংস্কৃতিতে যে সুদূরপ্রসারী সুফল নির্মাণ করেছে সেটাই এ নিবন্ধে আমাদের উদ্‌যাপনের বিষয় হবে।২

২. পরস্পরের কাছে আসার সূত্র : দুই ভিন্ন উৎস থেকে ?

শ্রীমিত্র যে মূলত রাজনীতির মানুষ ছিলেন না, তিনি নাটককে শিল্প হিসেবে গুরুত্ব দিতেন এবং তার জন্য নিজের জীবন ও শ্রম সমর্পণ করতে প্রস্তুত ছিলেন সে কথা তাঁর জীবনবৃত্তান্ত থেকে নানাভাবেই উঠে আসে। আসলে নাটকযাপনই ছিল তাঁর বেঁচে থাকার শর্ত। তাই এলাহাবাদ থেকে কলকাতায় ফিরে শরৎকুমার মিত্র ও শতদলবাসিনী মিত্রের এই কলেজছুট তরুণ ও জীবিকাহীন সন্তান তখনকার পেশাদার রঙ্গমঞ্চের প্রসিদ্ধ অভিনেতা ভূমেন রায়ের সহযোগিতায় রঙমহলে বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘মাটির ঘর’ নাটকে (১৯৩৯) প্রথম অভিনয় করেন, আর তার পরে অভিনয় করেন একই নাট্যকারের ‘মালা রায়’ নাটকে। তার পরে গৌর শী-র ‘ঘূর্ণি’ এবং বিধায়কের নাট্যরূপায়িত ‘রত্নদীপ’ (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়) নাটকে অভিনয় করার পর তিনি রঙমহল ত্যাগ করে মিনার্ভায় যোগ দেন। মিনার্ভায় ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘জয়ন্তী’ নাটকে তাঁর নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ হয়, তাঁর অভিনয় প্রশংসিতও হয়। মিনার্ভাতে তাঁর পরিচয় হয় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গে, যাঁকে তিনি অতঃপর গুরু ও পিতার আসনে বসিয়েছেন। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের প্রতি কোনো একটি অসম্মানের ঘটনার প্রতিবাদেই তাঁর মিনার্ভা ত্যাগ এবং নাট্যনিকেতনে যোগদান। এই ঘটনাতে এই মানুষটি যে নিজের নীতিনিষ্ঠায় কিছুটা অনমনীয় তার পরিচয় পাওয়া যায়। সেখানে তারাশঙ্করের ‘কালিন্দী’ এবং বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘মাটির ঘর’-এ অভিনয়। ১৯৪১ সালে শিশিরকুমারের নেতৃত্বে শ্রীরঙ্গম মঞ্চের উদ্‌বোধন হলে তিনি তার সঙ্গে যুক্ত হন এবং ‘জীবনরঙ্গ’, ‘উড়োচিঠি’ (নিতাই ভট্টাচার্য), ‘সীতা’ (যোগেশ চৌধুরী)-র নবনির্মাণে অভিনয় করেন। ‘আলমগীর’এবং ‘রীতিমত নাটক’-এও তাঁর নানা অভিনয়-ভূমিকা ছিল।

এর পরে ভূমেন রায়ের ভ্রাম্যমাণ নাট্যদলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু খুব বেশি দিন তাতে স্থায়ী হননি। “সেই দলের সঙ্গে দু-একটি অভিনয়ের পর শম্ভু মিত্র আবার দল ছাড়েন। এই সময়ে যখন তিনি চুপচাপ বাড়ীতে বসে আছেন তখন একদিন বিনয় ঘোষ ও বিজন ভট্টাচার্য তাঁর কাছে এসে হাজির। তাঁরা এসে সদ্য-প্রতিষ্ঠিত ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের কথা শম্ভু মিত্রকে বলেন। শ্রীমিত্রের নিজের কথায়, “আমি এই Association-এ এসেছিলুম বিনয় ঘোষ আর বিজন ভট্টাচার্য এরা এসেছিল বলে তাই। আর নির্দেশক হবোটবো এ আকাঙ্ক্ষা আমার একদমই ছিলো না। আমার আকাঙ্ক্ষা ছিলো অভিনয় করবো।”৩ ১৯৪২ সালের ২৮ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ।

এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস স্পষ্ট করে না, কিন্তু ইঙ্গিত করে যে, পেশাদার মঞ্চের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে লগ্ন হলেও শম্ভু মিত্র বিনয় ঘোষ বা বিজন ভট্টাচার্যের অপরিচিত ছিলেন না, তৎকালীন কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ব্যাপক ক্ষেত্রে সমবয়স্ক এই যুবকেরা পরস্পরের কাজ ও লক্ষ্য সম্বন্ধে সন্ধান রাখতেন। বস্তুতপক্ষে শম্ভু মিত্রের শক্তি ও সম্ভাবনা সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় আস্থা না থাকলে বিনয় ঘোষ বা বিজন ভট্টাচার্য তাঁর কাছে আসতেন বলে মনে হয় না। শম্ভু মিত্রের মধ্যে নিছক অভিনয়ক্ষমতা ছাড়াও নিশ্চয় অন্যান্য নিজস্বতা কিছু ছিল যা পেশাদার নাট্যজগতের বাইরের মানুষকেও তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করেছিল। ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের নাট্যপ্রকল্পে শম্ভু মিত্রের অভিনয়সামর্থ্য যে একটি সম্পদ হয়ে উঠবে এ বিশ্বাস তাঁদের নিশ্চয়ই ছিল। তাঁর অন্য সম্ভাবনাগুলি গণনাট্যের সংস্পর্শে এসেই বিকশিত হতে শুরু করল, এমন কথা নিশ্চয়ই বলা যায়। হয়তো এ কথাও বলা যায় যে, উভয়ের পরস্পরকে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে প্রয়োজন ছিল। এই সংযোগে কে কতটা উপকৃত হয়েছে সে হিসাব নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু মনে রাখা জরুরি যে, গণনাট্য সঙ্ঘের ইতিহাস একটু ভিন্ন। এ কথা সকলের জানা, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বামপন্থী অংশ এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ উদ্যোগে ১৯৩৬-এ প্রগতি লেখক সঙ্ঘ বা প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুন্‌শি প্রেমচন্দ ছিলেন তার প্রথম সভাপতি। এটাও লক্ষণীয় যে, তার সূত্রপাত হয় লখনউয়ে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের লখনউ অধিবেশনের পাশাপাশি। পরে ঢাকায় ১৯৪২-এর ৮ মার্চ ফ্যাসিস্ট সমর্থক রাজনৈতিক শক্তির হাতে শক্তিশালী তরুণ লেখক সোমেন চন্দের নৃশংস হত্যার পর ২৮ মার্চ তারিখে কলকাতায় গড়ে ওঠে ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ। এই সঙ্ঘও সাধারণভাবে অন্নদাশঙ্কর রায় বা বুদ্ধদেব বসুর মতো অরাজনৈতিক লেখকদের এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অকমিুনিস্ট লেখকদেরও আকৃষ্ট করে, এবং হয়ে ওঠে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের এক মিলিত মঞ্চ। এই সঙ্ঘই আবার অবিভক্ত বাংলায় ভারতের প্রগতি লেখক সঙ্ঘের শাখা হিসেবে স্বীকৃত হয়। সুধী প্রধান গণনাট্য সঙ্ঘকে “মূলত প্রগতি লেখক আন্দোলনের প্রভাবে সৃষ্ট” (সুনীল দত্ত, ১৯৮৭ : ১২) বলেছেন। তাঁর বয়ানে “বাংলা দেশে প্রগতি লেখক সঙ্ঘ উঠে গিয়ে যখন ফ্যাশিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ হল (১৯৪২ সাল) তখন দেখা গেল তার একটি শাখার নাম গণনাট্য সঙ্ঘ। ১৯৪৩ সালে বোম্বাইয়ে কমিউনিস্ত পার্টি কংগ্রেসের অধিবেশনের পাশে পাশে সর্বভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম অধিবেশন হ’ল—এবং বাংলা দেশে এবং বাংলা দেশের ফ্যাশিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের গণনাট্য শাখাকে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের শাখা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হল” (ওই, ১২-১৩)।

লক্ষ করুন, প্রগতি লেখক সঙ্ঘের প্রথম অধিবেশন হয়েছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের পাশাপাশি, আর গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম অধিবেশন হল (২৫ মে, ১৯৪৩) ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অধিবেশনের সঙ্গে। অর্থাৎ গণনাট্যের রাজনৈতিক চরিত্র প্রগতি লেখক সঙ্ঘের প্রাথমিক চরিত্র থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবু চোখে পড়ে, প্রগতি লেখক সঙ্ঘের চতুর্থ ম্যানিফেস্টোতে ৬ প্রস্তাবে বলা হচ্ছে যে সঙ্ঘের অন্যতম কর্তব্য হল “To cooperate with the Indian People’s Theatre Association and to assist by writing plays which might be staged by the said Association’ (Pradhan, 1979 :144)। শম্ভু মিত্রের মতো মানুষেরা, কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হলেও, এই সব উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত আছেন, সম্ভবত এক বৃহত্তর মানবিক দায়বোধ থেকে আর ভালো নাটক করার স্বপ্ন পোষণ করে, পেশাদার রঙ্গালয় থেকে বিপুলভাবে দূরবর্তী এক নাট্যস্বপ্নপ্রকল্পের আশা নিয়ে। পেশাদার রঙ্গালয় নানা কারণে তাঁকে হতাশ এবং নিরুৎসাহিত করেছিল, এক শিশিরকুমারের প্রযোজনা কখনও কখনও তাঁর কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করেছে—সে কথা জানাতে তিনি কখনও দ্বিধা করেননি। কিন্তু শিশিরকুমারের নাটকের নির্বাচন সম্বন্ধে তাঁর বিশেষকোনও আলোচনা নেই। সুধী প্রধান তাঁর ইংরেজি বইয়ে ১ জুলাই ১৯৪৩ তারিখে প্রকাশিত আইপিটিএ বুলেটিন যুক্ত করেছেন, তাতে কলকাতায় ইউথ কালচারাল ইন্‌সটিটিউট ও ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের নানা একাঙ্ক নাটকের অভিনয়ের কথা মনে রেখেই সম্ভবত বলা হয়েছে যে, A strong People’s Theatre movement was, however, yet to be born in India” (148), তাতে চিনের দু-লক্ষ ‘নাট্যসেনা’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এবং স্বীকার করা হয়েছে যে, এ পর্যন্ত এ সব নাটক, অধিকাংশত একাঙ্ক, যা হয়েছে তা ব্যাপক সাধারণ মানুষের কাছে কোনো আবেদন তৈরি করতে পারেনি। পাঠকেরা জানেন, সেই একাঙ্কগুলির কয়েকটি হল বিনয় ঘোষের ‘ল্যাবরেটরি’ (প্রফেসর মামলকের আখ্যান অবলম্বনে), মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের ‘হোমিয়োপ্যাথি’, বিজন ভট্টাচার্যের ‘জবানবন্দী’ ইত্যাদি। মনে হয় এগুলি সবই ‘নবান্ন’এ পৌঁছানোর প্রস্তুতি। এর আগে কলকাতার ইয়ুথ কালচারাল ইন্‌স্টিটিউটের (১৯৪০-১৯৪২) উদ্যোগে পরিবেশিত সুবোধ ঘোসের ‘ফসিল’ অবলম্বনে ‘অঞ্জনগড়’, In the Heart of China’, ‘The Shop Keepers’ ইত্যাদি—যেগুলি মূলত ইতিহাসের উল্লেখমাত্র হয়ে আছে।

৩ ‘নবান্ন’

তার পর ঘটল ‘নবান্ন’-এর বিস্ফোরণ। ‘নবান্ন’-এর অভিনয়ের ইতিহাস বহুচর্চিত, এখানে তার পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন দেখি না। কিন্তু সংক্ষেপে ‘নবান্ন’ কোথায় কোথায় পুরানোকে আমূল বদলে দিল তার একটা তালিকা করা যেতে পারে। এ তালিকা আমরা অল্পবিস্তর অন্যত্রও দিয়েছি (সরকার, ২০০৮ : ২৬৫-৬৬)। এক, নাটকে একই সঙ্গে সমসাময়িকতা, বিশ্বব্যাপী ইতিহাসের সংকট আর তার ফলে সৃষ্ট স্থানীয় স্তরে বঞ্চিত দরিদ্রের বাস্তব উঠে এল—সেই বাস্তব যা শুধু দারিদ্র্যকে দেখায় না, ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে—বিশ্বজাগতিক রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক যে ঘটনা আর যে সব শ্রেণি বাংলার গরিব মানুষের দুর্গতি আর মৃত্যুর জন্য দায়ী কারা (সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসন আর কালোবাজারিদের সক্রিয় দায় আর শহুরে মধ্যবিত্তের নির্মম উদাসীনতা) তাও দেখিয়ে দেয়। তখনকার পেশাদার মঞ্চের পৌরাণিক আর ঐতিহাসিক আর গার্হস্থ্য মেলোড্রামা আর ভাঁড়ামোভর্তি প্রহসনের৪ তুলনায় এ এক অভিনব আস্বাদন। দুই, এই প্রথম একজন-দুজন অমিতশক্তিধর নায়ক, তার প্রতিনায়ক এবং রূপবতী নায়িকার বদলে দুর্বল ও বঞ্চিত মানুষের দল যৌথভাবে নাটকের নায়কনায়িকা হয়ে ওঠে। ‘গণনাট্যে পিপ্‌ল বা জনগণই নায়ক হবে’ রোমাঁ রলাঁর এই স্লোগান সত্য হয়ে ওঠে। ফলে এ নাটকে অনেকে আমাদের মনোযোগ ভাগ ভাগ করে নেয়—কোনো একজন বা দুজনের দিকে নাটক আমাদের নজর টানে না। এর প্রতিক্রিয়ায় এ নাটক হয়ে ওঠে দলগত-অভিনয়-ভিত্তিক। নাটকের শেষে এতকাল পিছিয়ে থাকা মানুষের নেতৃত্ব কী ভাবে তৈরি হয় তা নাট্যকার অত্যন্ত মনোজ্ঞভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন।৫ এত বেশি চরিত্রও বাংলা নাটকে এতাবৎকাল কম দেখা গিয়েছে। তৃতীয়ত, নাটকের রূপ বা গ্রন্থনাতেই এল এক বিপুল নতুনত্ব—তিন বা পাঁচ অঙ্কের ত্রিভুজাকৃতি নাট্যসংগঠন পরিহার করে, ঘটনাগুলিকে সিঁড়ি দিয়ে তুলে এক ক্লাইম্যাক্‌স বা সংকটে পৌঁছে দিয়ে তার পর সংকট নিরসনে আবার না নামিয়ে এনে, বিজন ভট্টাচার্য পর পর কতকগুলি দৃশ্যের মালায় গেঁথেছেন, আর প্রায় প্রতিটি দৃশ্যেই নাট্যতীব্রতা বণ্টিত হয়েছে, একটি দুটিতে হয়তো একটু বেশি। নাটকের এই সংগঠন—যাকে শ্রীমিত্র ‘এপিসোডিক ক্যারেক্টার’৬ বলেছেন—তা বাংলা নাটকে আগে আগে দেখা যায়নি (হয়তো রবীন্দ্রনাথে ছিল, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে তো ১৯৫৪-৪ আগে নাট্যকার বলেই মনে করা হত না) বলে তখনকার সমালোচকদের কারও কারও মনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল, এমনকি হিরণকুমার সান্যালের মতো মানুষও একে নাটকের নেতিবাচক লক্ষণ বা দুর্বলতা বলে মনে করেছিলেন৭। শেক্সপিয়ারের সর্বাঙ্গীণ প্রভাবে ফরাসি নাট্যতাত্ত্বিক ব্রুনেতিয়ের কথিত ত্রিভুজাকৃতি, কার্যকারণসংবদ্ধ নাট্যগঠনকেই বাঙালি দর্শক-সমালোচক নাটকের একমাত্র আদর্শ বলে ধরে নিয়েছিলেন। অথচ পরে ব্রেশ্‌টের নাট্যরীতি ও নাট্যদর্শন মেনে নিতে তাঁদের আপত্তি হয়নি। শ্রী মিত্র সংগতভাবেই এ ধরনের সমালোচনাকে “আমাদের ‘বুদ্ধিজীবী’দের ‘সাহেবদের প্রতি...বিশ্বাস আর স্বদেশী যাবতীয় মৌলিক সৃষ্টির বিষয়ে সন্দেহ” বলে বিদ্রুপ করেছেন৭। চতুর্থত, আমরা পুরোটাই শ্রীমিত্রের কথা অপরিবর্তিত বানানে ব্যবহার করব—“মঞ্চসজ্জা শুধু বাস্তবানুগ ছিলো না তাই নয়, রঙ্গমঞ্চে একই দৃশ্যে দুটি ভিন্ন [ঘটনা উপস্থাপনার জন্য] স্তরের প্রয়োগ হয়। স্তরগুলি স্থানের ভিন্নতা বোঝাবার জন্য, অর্থাৎ দুটো স্তর স্থানগত ভিন্নতা নির্দেশ করতো (আমরা জানি, পরে ‘চাঁদবণিকের পালা’তেও শ্রী মিত্র মঞ্ছের এই বিভিন্ন স্তর অংশত একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন—প. স.)। কিন্তু স্তরদুটির প্রয়োগে আরও যে-একটি অর্থ ছিলো তা চরিত্রচিত্রণের। মঞ্চের সম্মুখভাবের চরিত্রগুলি ছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তি, আর মঞ্চের পেছনে ওপরের স্তরের চরিত্রগুলি সমষ্টি,--জনতার অংশ,-- “তারা ব্যক্তি হিসেবে ছিল না।” পঞ্চমত, (আবার শ্রীমিত্রের কথা তুলছি আমরা) “নাটকটির আগাগোড়া অভিনয়রীতি তখনকার প্রতিষ্ঠিত অভিনেতাদের রীতির চেয়ে অনেক বেশি স্বাভাবিক ছিলো : এই স্বাভাবিকতার মধ্য দিয়েই নাট্যটিতে অনেক গভীর কাব্যমুহূর্তের সৃষ্টি হ’তো। শুধু নীরবতার মাধ্যমে নয়,...আবেগময় দৃশ্যে কথা বলার বিশিষ্ট ভঙ্গীতেও এই অনুভূতি জাগতো।” আর ‘নবান্ন’ নাট্যে যে ‘নীরবতা’-র প্রচুর ও পরিকল্পিত ব্যবহার হয়েছিল সে সম্বন্ধেও বিশদভাবেই বলেছেন এই প্রবন্ধে।

৪. অতঃপর

‘নবান্ন’-এর বিপুল সাফল্যের পর অন্তত চার বছর শ্রীমিত্র গণনাট্যের সঙ্গে ছিলেন। পিছনে তাকিয়ে এই সময়টা তাঁর পক্ষে সম্পূর্ণ স্বস্তিকর ছিল না তা আমরা বুঝতে পারি। এই ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ এখনও অপেক্ষিত, কিন্তু তার সূত্রগুলি নানা জনের কথা থেকে পাওয়া যায়। ভালো হত সমসাময়িক কালে উভয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনও বন্ধু, হয়তো বিনয় ঘোষ, যদি এ দুয়ের সম্পর্কের ইতিহাস লিখতেন। এই জল্পনা ছেড়ে আমাদের হাতের কাছের সূত্রগুলিই আমরা ব্যবহার করি। স্বয়ং শম্ভু মিত্র যা বলেছেন তাতে সবচেয়ে বড়ো সূত্রটি পাওয়া যায়—“কিন্তু ১৯৪৮ সালে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের মধ্যে কোনো কোনো শক্তি এটাকে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতের প্রচার বাহনে পরিণত করতে চাইলেন। এই সংগঠন, যা এতোদিনে এতো দক্ষ, কুশলী ব্যক্তিকে আকর্ষণ করেছিলো,---এর ফলে তার সেই রূপ ভেঙে গেল” (‘সস’, ১৪৮)। বস্তুতপক্ষে ‘সস’-র প্রথম প্রবন্ধ “নিবারণ পণ্ডিত”-এই তাঁকে কিছুটা মৃদু আত্মব্যঙ্গের সুরে বলতে শুনি, “তার উপর আবার আমার সেই সময়কার অবস্থা খুবই করুণ। গণনাট্য সঙ্ঘে ঢুকে নতুন ক’রে তখন আমায় বুঝতে হচ্ছে, যে শিল্প কী, আঙ্গিকের সঙ্গে বিষয়বস্তুর সম্পর্ক কী, শিল্পের আবেদনের লক্ষ্য কী, ইত্যাদি। নানা তর্কের মধ্যা এ আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনে কোনো-না-কোনোও সময়ে করতে হয়েছে। আমূল ভেঙে হয়তো ফের ভিত থেকে গ’ড়ে তুলতে হয়েছে কাউকে। কারো বা সহজে হয়েছে,--নিবিড় সহজবুদ্ধির দরুন। আর কারও বা দেরি লেগেই চলেছে, একটা ইঁটের ওপর আর একটা চাপিয়ে কর্নইক হাতে ভাবতে থেকেছে, (যেমন আমার ক্ষেত্রে) ঘিলু নামক পদার্থের কিঞ্চিৎ খামতির দরুন। এ হেন লোকটার অতীতের সব আন্দাজ-ভরসা যখন ভগ্ন ও বিস্রস্ত ক’র দেবার কোমর-বাঁধা প্রচেষ্টা চলেছে, এবং ভাবী আন্দাজ-ভরসা যখন চোখের সামনে কোনোই নকশা পায়নি, যখন সে-বেচারীর কানের চারপাশে প্রতিদিন চিনে পটকার মতো উত্তেজিত আপ্তবাক্য সব ফুট্‌তে থেকে তাকে আরও দিশেহারা ক’রে দিচ্ছে”...(‘সস’ ১)। এ থেকেই বামপন্থী শিল্পদর্শনের সঙ্গে তাঁর টেনশনের ইতিহাসটি খানিকটা ধরা যায়। যে মানুষটি এর মধ্যে এ সব বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করে (তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন তা সকলেরই জানা) নিজের মতো একটি শিল্পদর্শন তৈরি করেছিলেন, আমাদের ধারণা তাতে মানুষের প্রয়োজন বা উপকার বা উন্নয়ন অনুপস্থিত ছিল না, কিন্তু নিখুঁত শিল্পকৃতি নির্মাণের উপর যে প্রবল আপোষহীন মনোযোগ ছিল, হযতো পার্টির কর্মপদ্ধতিতে ততটা সময়ের এবং অন্যান্য অবকাশ ছিল না। শম্ভু মিত্রের সংযত বয়ানে যা আছে তার একটা কারণ বোঝা যায়। যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন জানেন তাঁরা পার্টির ফ্রন্ট বা মাস্‌ অরগানিজেশনগুলির ভূমিকা সম্বন্ধেও জানবেন—সেগুলি পার্টির ব্যাপক জনভিত্তি নির্মাণ করার অঙ্গ মাত্র, পার্টির লক্ষ্যগুলিকেই বহন এবং বিস্তার করে। এবং সেখানে উপস্থিত প্রয়োজনের বিবেচনায় শিল্প ও শিল্পীর নিজস্ব তাগিদকে কেবল আপেক্ষিক মূল্য দেওয়া হয়, সে কথাও মিথ্যা নয়। শ্রীস্বপন মজুমদার রবিশংকরের আত্মজীবনীর অংশ যেটুকু তুলেছেন (১০-১১) তাতেও দেখি, রবিশংকর কেন্দ্রীয় গণনাট্য প্রশাসন সম্বন্ধে বলছেন, “ক্রমে পার্টি অফিসের প্রস্তাবগুলো একটু যেন বেশীই আসতে লাগল...ওদের কালচারাল স্কোয়াডের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামে গ্রামে শো দেখাবে, মোটর বা লরি নিয়ে নিয়ে লরির পিছনে একটা অস্থায়ী স্টেজের মত করে মানুষকে সচেতন করার জন্য কিছু কিছু নাটক, ট্যাবলো প্রেজেন্ট করবে। ...প্রায়ই এ নির্দেশ আমার কাছে পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল।”

শ্রীস্বপন মজুমদার আরও কিছু সাংগঠনিক এবং ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়েছেন। সংগঠনগত অন্তঃকলহ তৈরি হয়েছিলে কোথাও কোথাও, “নাট্য ও নৃত্য সংগোষ্ঠীর অসুস্থ প্রতিযোগ এবং শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র প্রমুখ শিল্পী এবং সুধী প্রধান প্রভৃতি সংগঠকদের মতান্তর সংঘের ক্রিয়াকর্মকে ব্যাহত করল তীব্রভাবে” (‘বহু’ ১০)। পরে ‘সস’-তে “রাজার কথায়” নামক রচনায় শ্রীমিত্র আরও স্পষ্টভাবে লিখেছেন (৭৯) যে, ‘নবান্ন’-র অভিনয়ে যে “আবেগের কাব্য”, “মানুষের নিঃসহায়তার কাব্য, তার ভালোবাসার কাব্য” তৈরি হত “সেটা সফলতার পথে আর এগুতে পারল না। নানান্‌ দিক থেকে বাধা দেওয়া হতে লাগলো। তার মধে অস্থির রাজনীতি ও রাজনীতির নামে ব্যক্তিগত আক্রোশ ও অসূয়া যেন ভীমাকৃতি হ’য়ে উঠলো। ফলে হ’লো না। ধুলো উড়লো, কাদা ছুটলো, কিন্তু ঠাকুরঘরটিকে কেউ সাফ করতে এগিয়ে এলো না।”

শ্রীজগন্নাথ ঘোষ সুধী প্রধান এবং দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবরণের উপর নির্ভর করে গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে শ্রীমিত্রের বিচ্ছেদের পশ্চাৎপট আর-একটু বিশদ করার চেষ্টা করেছেন। শ্রীপ্রধানের সূত্র থেকে আমরা জানি যে ‘নবান্ন’র কলকাতায় ৪০টির মতো অভিনয় হয়েছিল, তা ছাড়া কলকাতার বাইরেও, বহরমপুরে, চন্দননগরে, বর্ধমানের হাটগোবিন্দপুরে, যশোরে বিপুল জনসমাগমে অভিনীত হয়েছিল এই নাটক। তবু কলকাতার বাইরে, ঘূর্ণমান মঞ্ছের বাইরে শ্রীমিত্রের ‘নবান্ন’ অভিনয়ে অনুৎসাহ, দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নব-নাট্যরূপে ‘নীলদর্পণ’ নাটকে শ্রীমিত্রের সংশোধনে শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তি—“এই সব কারণে ক্ষুণ্ণ হয়ে শম্ভু মিত্র গণনাট্য সঙ্ঘ ছেড়ে বহুরূপী নামে আলাদা সংস্থা গড়েন।”

বলা বাহুল্য, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের উদ্দেশ্যের বিষয়টি যদি আমরা সম্যক বুঝি, তা হলে তার কাছে এই পরিপূর্ণ শিল্পমনস্কতা এবং রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকারের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে নামিয়ে আনা—খুব অভ্যর্থিত হওয়ার কথা নয়। শ্রীঘোষ সুধী প্রধানের ইংরেজি বই থেকে চারুপ্রকাশ ঘোষের সমালোচনা উদ্ধার (২৪) করেছেন—They seem to ignore that in their zeal for the setting new standards, traditions and principles in the culture and development of Art, they are tending to drift away from the party and to develop lamentable lack of elementary loyalty to party.” আমরা জানি, শ্রীশম্ভু মিত্র কখনোই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেননি। এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে গণনাট্যের অন্যান্যদের কী বোঝাপড়া ছিল তা এখন অনুমান করে লাভ নেই। কিন্তু তিনি এবং আরও কেউ কেউ যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে অতিক্রম করে নাট্যকলার একটা ব্যাপকতর উৎকর্ষের সন্ধানে ছিলেন, এ কথা তিনি কোনো দিন গোপন করেননি। ফলে তাঁর রাজনৈতিক আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা এখানে যায় কি না সন্দেহ।

কিন্তু গণনাট্য সঙ্ঘের তো রাজনৈতিক আনুগত্য ছিল, সব ফ্রন্ট অরগানাইজেশনেরই যেমন থাকে, তাই সেখানে ওই শিল্পকে প্রাথমিকতা দেওয়ার লক্ষ্যের সমালোচনা করা হয়। গণনাট্যের ১৯৪৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ক্ষোভের সঙ্গে অনুযোগ করা হয় যে, “More attention was centered on technical perfection, skill, and, as a result, the popular aspect, popular demand, people’s living contact came to be counted less important”. এতে আরও বলা হয়েছে যে, এর ফলে, গণনাট্য সঙ্ঘের কাজকর্ম কলকাতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, “to well constructed stages with lighting arrangements, and, therefore had to be staged before only a restricted number of people.” (MCMI, I, pp. 290-91)

ফলে দুয়ের বিচ্ছেদ অনিবার্য হল, ব্যক্তিগত আবেগ তাতে ইন্ধন জোগাল মাত্র। এর মধ্যে কংগ্রেস সরকারের দমননীতিও আরম্ভ হয়েছে, কমিউনিস্ট পার্টি বে-আইনি ঘোষিত হয়েছে।৮ গণনাট্য সঙ্ঘের ষষ্ঠ সর্বভারতীয় সম্মেলনের প্রতিবেদনে তাই কিছুটা তিরস্কার ও নিন্দার ভাষায় বলা হল—“গননাট্য সঙ্ঘের বর্তমান অগ্নিপরীক্ষার সামনে পড়ে আরও অনেক পুরাতন সভ্য হয়তো ছেড়ে চলে যাবেন। গণনাট্য সংঘ যখন শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত জনগণের মধ্যে স্থান করে নিতে বদ্ধপরিকর, তখন এইসব মুখোসধারী দরদীদের সরে পড়াই স্বাভাবিক। এই সব রসশোষক পরগাছা নির্মূল হ’লেই গণনাট্য সংঘের মঙ্গল” (সুনীল দত্ত, ৩৬)।


৫. বিচ্ছেদের পর

উপরের তীব্র ভাষাব্যবহার আমরা সমর্থন করি আর না করি, তার ভবিষ্যদ্‌বাণী সত্য হোক আর না হোক, এটা আমাদের লক্ষ করতে হবে যে, শম্ভু মিত্রের সঙ্গে গণনাট্য সংঘের শারীরিক বিচ্ছেদ ঘটলেও মানসিক বিচ্ছেদ ঘটতে দেরি হয়েছে। বহুরূপীর প্রথম দিকের নাটকগুলি, ‘নবান্ন’ তো বটেই, ‘পথিক’, ‘উলুখাগড়া’, ‘ছেঁড়া তার’ ভাবনার দিক থেকে গণনাট্যেরই নাটক। চার অধ্যায়’ হয়তো তির্যকভাবে ব্যক্তির নৈতিক আর শারীরিক ধ্বংসের জন্য সংঘকে দায়ী করার এক নাটক—যা তখন তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। ‘চার অধ্যায়’ আর ‘দশচক্র’ (১৯৫২) থেকে বহুরূপী সমূহের জীবন থেকে ব্যক্তির জীবন আর সংকট, কখনও কখনও ব্যক্তির সঙ্গে সমূহের সংঘাত দেখানোর দিকে এগোলে সে সব প্রচেষ্টা রাজনৈতিক পক্ষের দ্বারা সমালোচিত হয়, কিন্তু সে সব সমালোচনা এখন একটু অপরিণত বলে মনে হয়। এ কথা হয়তো যোগ করা দরকার যে, বেশ কিছুদিন পর্যন্ত শ্রীমিত্র বামপন্থী বৃত্তের অন্তর্ভূত ছিলেন, ১৯৫৫-তে ‘রক্তকরবী’-তে বিদ্রোহী শ্রমিকদের হাতে তিনি লাল পতাকা পর্যন্ত তুলে দিয়েছিলেন যার ফলে বাংলার জনপ্রিয় একটি সংবাদপত্র তাঁকে সমালোচনা করেছিল। তাঁর আজীবন বন্ধুদের মধ্যে, চিন্মোহন সেহানবীশের মতো, অনেকেই ছিলেন বামপন্থী। গণনাট্যের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ পরবর্তীকালে তাঁর নিজের হাতে গড়া নাট্যসংগঠন বহুরূপীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদেও পুনরাবৃত্ত হয়েছে।

কিন্তু যে কথা সুনিশ্চিত হয়ে ওঠে তা হল, শ্রীশম্ভু মিত্র পরবর্তী বাংলা নাটকের, যে নাটকের জীবন্ত ধারা এখনও প্রবহমাণ, সৎ নাট্য, নব নাট্য, গ্রুপ থিয়েটার যে নামেই হোক, তার অবিসংবাদী নেতা, দিগ্‌দর্শক এবং পিতৃপুরুষ হিসেবে ইতিহাসে স্থান নিয়েছেন। মঞ্চের জন্য রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার আর প্রতিষ্ঠা তো তাঁর এক অভূতপূর্ব কীর্তি।

তাঁর উপস্থিতি গণনাট্যের এক গৌরবময় আত্মপরিচয় গড়ে তুলেছিল, এ কথাও ঠিক যে, পরে কয়েকটি সুপ্রযোজনা সত্ত্বেও ‘নবান্ন’-এর মহিমা পরবর্তী গণনাট্যে অক্ষুণ্ণ থাকেনি। ইতিহাসের সত্য রক্ষার জন্য এ কথা হয়তো বলা যায় যে, পরেকার গণনাট্য বাংলা নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে কোনো সময়েই অন্যান্য বাংলা নাট্যদলের দর্শনীয় প্রতিযোগী হয়ে ওঠেনি, তার কোনো প্রযোজনাও সে ভাবে স্মরণীয় হয়নি। অবশ্যই গণনাট্যের দলগুলি তাদের রাজনৈতিক আনুগত্যে নিষ্ঠা বজায় রেখেছে। এও লক্ষ করতে হবে যে, গণনাট্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো কোনো ব্যক্তি বা কোনো কোনো গণনাট্য সংঘ পরে গণনাট্য থেকে পৃথক হয়েছেন তাও ১৯৪৮-৪৯ থেকেই ঘটতে শুরু করেছিল। বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, শেখর চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অনেকেরই নাম করা যেতে পারে। এর ফলে গণনাট্যের রাজনৈতিক আদর্শের কাছাকাছি এবং ‘শিল্প’ হিসেবে নাট্যকলাকে দেখতে আগ্রহী—এ রকম দুটি সীমানার সৃষ্টি হয়, যদিও অনেকেই দু-দিকে চলাচল করেছেন। আর ‘শিল্প’-এর বিষয়টিতে, অর্থাৎ যে রকম নাটকই করি তা এক নতুন নিষ্ঠা নিয়ে করব—এই ধারণাও পরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আমাদের মতে এই আদর্শটি প্রথমে ‘নবান্ন’ তৈরি করে দিয়েছিল, পরে পরে নিজের নিজের দলের নাটকে শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁদের শিষ্যপ্রশিষ্যেরা তাকে অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে চলেছেন। প্রচুর রিহার্সাল, প্রম্‌টারের ভূমিকা বর্জন, পোশাক-আশাক, রূপসজ্জা ইত্যাদিতে গভীর মনোযোগ, কোনোরকম শিথিলতার অবকাশ কোথাও না রাখা—এই চিহ্নগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘নবান্ন’ ও শম্ভু মিত্রের যুগ্ম নির্মাণ।

তাই ১৯৫০-এর বছরগুলি থেকে সাধারণভাবে অব্যবসায়ীদের বাংলা নাটক, যদি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি না-ও হয়, গভীরভাবে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার যেমন, তেমনই শিল্পের প্রতি গভীর নিষ্ঠার প্রমাণ রেখে এসেছে। বাংলা নাটকের এই দায়বদ্ধ চলমান ধারাকে আমরা শম্ভু মিত্র আর গণনাট্য উভয়ের মিলিত উত্তরাধিকার বলেই মনে করি।


টীকা

১. এ বিষয়ে শ্রীমতী শোভা সেনের মন্তব্য উদ্ধার করেছেন জগন্নাথ ঘোষ, দ্র. জগন্নাথ ঘোষ (১৯৯৮। আমরা এর পরে যে সব উদ্ধৃতি আনব তাতে মূলের বানান অপরিবর্তিত রাখা হবে। তবে চারুপ্রকাশ ঘোষের ইংরেজি প্রতিবেদনে একটু সংশোধন করতে হয়েছে। ২. বর্তমান লেখক, হয়তো কোনো বিকৃতবুদ্ধিবশে, তাঁর একটি রচনায় নাট্যদলের ভাঙনকে একটি ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে দেখতে চেয়েছিল ( পবিত্র সরকার, ২০০৮ : ৩১১-১২)। রাজনৈতিক ভাঙনকে তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। শ্রীমিত্র নিজে তাঁর ‘সন্মার্গ সপর্যা’-র একাধিক প্রবন্ধে, বিশেষত “আন্দোলনের প্রয়োজনে”-তে দল ভাঙার কারণগুলি সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করেছেন। ৩. সুবীর রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার, ‘যুগান্তর’, ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৯০ (জগন্নাথ ঘোষ-এ উদ্ধৃত, ১৭)। ৪. সরকার, ২০০৮-এ তখনকার পেশাদার মঞ্চে প্রচলিত নাটকগুলির কিছু উল্লেখ আছে। ৪. দ্র. দে’জ পাবলিশিং প্রকাশিত ‘নবান্ন’ গ্রন্থের শেষে বর্তমান লেখকের সংযোজন (১৬৩-১৬৪)। ৫. দ্র. শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সাক্ষাৎকারের উল্লেখ, ‘নবান্ন’ (দে’জ সংস্করণ), ১৭ পৃ.। ৬. ওই, ৭-৮ পৃ. ৭. ‘সন্মার্গ সপর্যা’, ১৪৭ পৃ. ৮. সুধী প্রধান তাঁর ইংরেজি বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে (৫৪ পৃ.) পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি গোপন সার্কুলার উদ্ধার করেছেন (১৭ জুন, ১৯৪৯) যাতে গণনাট্য নাটক করছে “with the objective of spreading communist propaganda” এমন কথা বলা হয়েছে। কাজেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের এগুলি বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।

উৎসনির্দেশ

জগন্নাথ ঘোষ, ‘শম্ভু মিত্রের নাট্যচর্চা’, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯৮ পবিত্র সরকার, ‘নাটমঞ্চ নাট্যরূপ’, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, ২০০৮ বিজন ভট্টাচার্য, ‘নবান্ন’, কলকাতা, দে’জ পাবলিষিং, ২০০৪ শম্ভু মিত্র, ‘সন্মার্গ সপর্যা’ (‘সস’), কলকাতা, এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, বাং ১৩৯৬ সুনীল দত্ত, ‘নাট্য আন্দোলনের ৩০ বছর’, কলকাতা, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, ১৯৮৭, দ্বিতীয় প্রকাশ স্বপন মজুমদার, ‘বহুরূপী ১৯৪৮-১৯৮৮’ (‘বহু’), কলকাতা, বহুরূপী, ১৯৮৮

Pradhan, Sudhi, Marxist Cultural Movement in India, Vol. 1, Calcutta, Pustak Bipani, 1979 (MCMI) -----, Marxist Cultural Movement in India, Vol. II, Calcutta, Navana 1982

লেখক পরিচিতি - অধ্যাপক, ভাষাবিদ



ব্যক্তিগত স্বল্প পরিচয়ে শম্ভু মিত্র
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা থিয়েটারে শম্ভু মিত্রের অসামান্য কীর্তির মূল্যায়নে, লেখায় বা ভাষণে দু-একবার প্রয়াসী হয়েছি। সে মূল্যায়ন অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। ভবিষ্যতে সেই প্রয়াস সম্পূর্ণ করার দায় রয়ে গেছে। এই লেখায় সেদিকে যাব না। আমার প্রথম যৌবনে বছর দশেক তাঁকে সামান্য চেনাজানার যে দুর্লভ সুযোগ ঘটেছিলো, তাঁরই স্মৃতিচারণ করবো এই লেখায়। ১৯৬১ সালে যখন সবে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. উত্তীর্ণ আমি, তখন থিয়েটার-সিনেমার রসে প্রথম অবগাহনের উত্তেজনা লাভ করে ফেলেছি ১৯৫৪ সালে বহুরূপীর রক্তকরবী ও ১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী দেখে। থিয়েটার-সিনেমা দেখা শুরু হয়ে গেছে তার আগেই। দেখেছি থিয়েটারে বে-আইনি গণনাট্য সংঘের প্রযোজনায় সলিল চৌধুরীর জনান্তিকে; ১৯৫২ সালে মহম্মদ আলি পার্কে বহুরূপীর ছেঁড়া তার (যার প্রথম দৃশ্যেই দেবব্রত বিশ্বাস ও শম্ভু মিত্র দুই বন্ধুর ভূমিকায়); ১৯৫৫ সালে শ্রীরঙ্গম মঞ্চে শিশির কুমার ভাদুড়ি পরিচালিত ও অভিনীত মাইকেল মধুসূদন; গণনাট্য সংঘের যাত্রাপালা রাহুযুক্ত; লিট্‌ল থিয়েটার গ্রুপের প্রথম বাংলা প্রযোজনা, উৎপল দত্ত, কালিন্দী সেন, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত ইবসেনের ঘোস্টস ও ডলস্‌ হাউস (বিদেশী পরিচ্ছদে); সিনেমায় ভুলি নাই, পরিবর্তন, রত্নদীপ, গোলড রাশ, মঁসিয়ে ভের্দু, লাইম লাইট, প্রিজনার অব জেনডা, অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট । কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে উত্তরণের সেই অপরণিত পর্বে— বিশেষত কলেজে ঢুকেই মহামহীয়ান মাস্টারমশাইদের দাক্ষিণ্যে ও প্রাণদ শিক্ষাদানে— সাহিত্য ও ইতিহাসের যে উন্মাদনায় নিত্য প্রাণিত ছিলাম, তার মধ্যে সিনেমা-থিয়েটার সেইভাবে স্থান করে নিতে পারেনি রক্তকরবী ও পথের পাঁচালী-র আগে, অকপটে স্বীকার করবো।

তখন থেকেই বহুরূপী ও শম্ভু মিত্রের অন্ধ ভক্ত, তাঁদের সব নাটক দেখি, একাধিকবার এক-একটি।

বহুরূপী ও শম্ভু মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগের একটা অন্য সূত্র বন্ধন ঘটলো ১৯৬১-৬২ সালে। ১৯৫৯-৬১ সালে যখন আমি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র, তখন আমি নতুন দুই বন্ধু পেয়ে যাই— আগরতলা থেকে আগত সরোজ চৌধুরী, কলকাতার কালীপ্রসাদ ঘোষ। আড্ডায়, চিন্তা বিনিময়ে তখন আমাদের অনেকটা সময় কাটে একসঙ্গে— দু’জনেই গভীর সংবেদী মানুষ, শিল্পানুরাগী, বিচারশীল। কালী বহুরূপীর সক্রিয় সদস্য, অভিনয়ে তখনও ততটা আগ্রহী নন, বহুরূপীর তৎকালীন প্রযোজনায় আলোক সম্পাতে তাপস সেনের সহকারী, সযত্নে লিখে নিচ্ছেন থিয়েটারে আলোক সম্পাতের জটিল কারিগরি। কালীর পরিশীলিত সাহিত্য রুচি ও পাঠ চর্চা তার কারিগরি বিদ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থিয়েটারে আলোক প্রক্ষেপণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে, এমন এক প্রত্যাশায় আমরা তখন বেশ উদ্দীপিত। তারই মধ্যে কালী একদিন জানালো, রবীন্দ্রশতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে ভারত সরকার পরকল্পিত এক জাতীয় সমারোহে রবীন্দ্রনাটকের কোনও নতুন প্রযোজনার জন্য অযান্ত্রিক, বহুরূপী, বিসর্জন প্রযোজনা করবেন স্থির করেছেন, তাতে আলোক সম্পাত পরিকল্পনার একক দায়িত্ব কালীর। ফলে ওই গুরুভারের চাপে কালী ডিসেম্বরে আমাদের সঙ্গে এম.এ. পরীক্ষা দিতে পারবে না। কালী আমায় বললো, ‘আমাকে কিন্তু সামনের বছর পরীক্ষাটা দিতেই হবে। তুই কথা দে, আমাকে পড়িয়ে দিবি।’ খানিকটা শ্লাঘাভরেই আমি কথা দিলাম। শ্লাঘার কারণ, ওই ঐতিহাসিক প্রযোজনায় আমারও যেন কোথায়ও কোনওভাবে একটা যৎসামান্য ভূমিকা থেকে যাবে এই ভাবনা।

প্রথম অভিনয় সন্ধ্যায় বিসর্জন দেখলাম, নিউ এম্পায়ার থিয়েটারে, আবার এম.এ. পরীক্ষা শেষ হবার পরেরদিন। পরের দিন সকালে কালী ফোন করতে বলতেই হলো, বিসর্জন আমার একেবারে ভালো লাগেনি। বহুরূপীর প্রযোজনা খারাপ লাগলো, জীবনে এই প্রথমবার। কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতি বিচারে চর্চা ও চিন্তার প্রসাদে আমি তখনও কেবলমাত্র সাহিত্যের কিছু প্রদেশে (তার মধ্যে নাটক তখনও অন্তর্গত নয়) সমালোচনায় অধিকারী, সেই সমালোচনার ভাষায় প্রশিক্ষিত।

বহুরূপীর প্রযোজনার বিরূপ সমালোচনা করবার অধিকার অর্জন করতে আমার নাট্য বিচারের বোধ শৃঙ্খলায় স্বদীক্ষিত হওয়া আবশ্যক। বিসর্জন প্রযোজনা বিষয়ে ‘মত’ প্রকাশ করতে গেলে আমাকে তৈরি হয়ে নিতে হবে। তার জন্য সময় লাগবে। পরীক্ষা শেষে মাসখানেকের জন্য সবকিছু থেকে ছুটি নিয়ে মুম্বাইতে গিয়ে অনেকটা ভেবে-চিন্তে কালীকে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখি— যা কার্যত আমার জীবনে আমার প্রথম নাট্য সমালোচনা তথা নাট্য নিবন্ধ। ওকে বলে দিই, ‘আমি এখনও অনধিকারী। এটা কেবল তোরই জন্য।’ মুম্বই থেকে ফিরে এসে গঙ্গাপদ বসুর একটি চিঠি পাই। তাতে তিনি লেখেন, আমার নিষেধ সত্ত্বেও আমার চিঠিটি বহুরূপীতে পড়ে শোনানো হয়। তাঁরা আমার মতের সঙ্গে সহমত না হলেও আমি যেভাবে থিয়েটার নিয়ে চিন্তা করেছি, ভেবেছি, যুক্তি বিন্যাস করেছি, তাতে তাঁদের মনে হয়েছে, আমি ‘বহুরূপী’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক হলে তাঁরা খুশি হবেন। গঙ্গাদা তখন পত্রিকার সম্পাদক। ওই সূত্রেই কালী আমাকে বহুরূপী মহলা ঘরে - দপ্তরে নিয়ে গিয়ে বহুরূপীর সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। গঙ্গাদাকে বলি, থিয়েটার নিয়ে আমায় অনেকটা পড়াশোনা করে নিতে হবে। তবে লিখবার সাহস পাবো। বহুরূপীর গ্রন্থাগার থেকে বই ধার করে বাড়িতে এনে আমার নাট্যপাঠচর্চার সূচনা, বছরখানেক পরে ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় আমার প্রথম প্রকাশিত নাট্য প্রবন্ধ সদ্য প্রয়াত চীনা অভিনেতা মেই লাল ফাং প্রসঙ্গে, যাঁর অভিনয় প্রতিভা মুগ্ধ করেছিলো একই সময়ে স্তানিস্লাভস্কি, ব্রেখ্‌ট্‌ ও রবীন্দ্রনাথকে।

এরপর থেকেই শম্ভুবাবু মাঝে মাঝে ফোন করে ডেকে পাঠান, গল্পগাছা করতে। আমরা তরুণরা কী পড়ছি, কী ভাবছি, থিয়েটারে কী খুঁজছি, তাই নিয়ে ওঁনার কৌতূহল। বিবাদী মতকে স্বীকার করে এই সংলাপের উদারতা একুশ বছর বয়সে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিলো। আমিও অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে প্রশ্নে-তর্কে খোলামেলা আলোচনার যে পরিসর পেয়ে গিয়েছিলাম, তার সুযোগ নিয়ে পুরাতন বাংলা থিয়েটারের, বিশেষত শিশির যুগের অভিজ্ঞতার স্বাদ ও ভাব আহরণ করে নিতে চেয়েছিলাম। ততদিনে আমার প্রথম থিয়েটার পাঠে বুঝে গেছি, থিয়েটারের পরম্পরা এমনই শ্রুতিস্মৃতিবাহিত যে শুধু ছাপা হরফে তার হদিশ পাওয়া যায় না। আমার কৌতূহল নিরসনার্থে শম্ভুবাবু শিশিরকুমার, অহীন্দ্র চৌধুরী, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, যোগেশ চৌধুরী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের অভিনয়ের অংশ শুনিয়ে তাঁদের বৈশিষ্ট্য চিনিয়ে দিয়েছেন, শিক্ষকের মতো। মনে আছে, ‘সিরাজউদৌল্লা’ থেকে নির্মলেন্দু লাহিড়ীর ‘এ বাংলা হিন্দুর নয়, মোসলমানের নয়...’ উচ্চারণ করে আবার বলেছেন, ‘দেখো, দেখো, আমার রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে।’ তারপরেই যত্ন ভরে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আবেগের এই অতিরেক যথার্থ নাটকীয়তাকে কীভাবে ক্ষুন্ন করে।

সৃষ্টিমগ্ন যেসব বড়ো মানুষদের সঙ্গে আমার সঙ্গ সাহচার্য ঘটেছে, পারতপক্ষে নিজ উদ্যোগে তাঁদের সময়ের উপর চাপ ফেলতে আমি পরাঙ্মুখ থেকেছি। শম্ভুবাবুর ক্ষেত্রেও তাই। উনিই প্রতিবার ফোন করে ডেকেছেন। কোনও কারণে মহলা থেকে ছুটি নিয়ে, একলা সন্ধ্যায় বাড়ি থাকলে, নয়তো, বাড়ির কাছেই মহলা কক্ষের ছাদে ভোরবেলা প্রাত্যহিক ব্যায়ামের সব নিজের তৈরি লাল চা পানের অবকাশে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি তখন থেকেই অদ্যাবধি একটা কথার উপর জোর দিয়ে চলেছি, ভালো থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে নাট্যকর্মকে ঘিরে বোধ ও ভাবনার একটা বাতাবরণ রচনা করে দর্শকমন্ডলীকে সেই বাতাবরণের মধ্যে ধারণ করতে হবে। এই ভাবনা থেকেই ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় ‘রাজা অয়দিপাউস’ প্রযোজনাকালে দর্শকদের মানসিক তথা বৌদ্ধিক পটপ্রস্তুতি সাধন করতে পত্রিকার পাতায় সুচিন্তিত নিবন্ধাবলির সমাবেশ। শম্ভুবাবু পত্রিকা সম্পাদনায় তখন প্রবল সক্রিয়। তিনি আহ্বান করেছেন সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান ক্ষেত্রের চিন্তকদের, থিয়েটারের পত্রিকায় লিখতে, থিয়েটারেরই সীমাকে রুদ্ধ করতে। পত্রিকায় আমার লেখার বিষয়ও তিনি অনেক সময়ই নির্দেশ করেছেন, প্রায়ই আমার সঙ্গে আড্ডায় আমার আগ্রহ বা সদ্য আবিষ্কারের ইঙ্গিত থেকে।

ষাটের দশক জুড়ে এই সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। একটা সময় ছিলো, যখন শম্ভুবাবুর ডাকে আমি তাঁর সঙ্গে আড্ডায় বসি; তৃপ্তিদিকে ‘হ্যামলেট’ পড়াই (সপ্তাহে দু-দিন, একদিন আমার বাড়িতে, একদিন ওঁর বাড়িতে); দীর্ঘ রোগ যন্ত্রণার ভার থেকে সদ্য মুক্ত শাঁওলী তখন সবে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে, সব ক্লাস করতে পারার মতো পুরোপুরি সুস্থ নয়, আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কথা দিয়েছি ওর ‘বাকি পড়া’ আমি পড়িয়ে দেবো, ওকে ইংরেজি সাহিত্য পড়াই, থিয়েটারের ইতিহাস পড়াই। শাঁওলী শম্ভু মিত্রের জীবন কথায় লিখেছে, একটা সময় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নাসিরুদ্দিন রোডে আত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন।’

পরে এই ‘অনাত্মীয়’তায় ভাটা পড়ে, শম্ভুবাবুর সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়, আসা-যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়, কারণটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি কখনও। শম্ভুবাবুর প্রতিভার দ্যুতিও নাট্যসৃজন ক্ষেত্রে স্তিমিত হতে থাকে, তারপর কার্যত স্বেচ্ছাবসরে স্বেচ্ছা নির্বাসন। আমার সঙ্গেই এক সাক্ষাৎকারের শেষে শিশিরকুমার সম্পর্কে তাঁর সেই অমোঘ উচ্চারণঃ ‘কিন্তু এই সমস্ত প্রচণ্ড সুন্দর নাট্য প্রয়োগ তাঁর জীবনের প্রথমদিকের। প্রায় বলা যায়, প্রথম দশ-বারো বৎসরের মধ্যে। তারপরে এই অলৌকিক প্রয়োগ প্রতিভা আর তেমন করে বোধ হয় প্রকাশ পায়নি। এটা অবশ্য একেবারেই আমার ব্যক্তিগত কথা। আমার মনে হয়, এসব ক্ষমতা তো প্রকৃতি চিরকালের জন্যে কাউকে দেয় না, তাই শিশিরবাবুর সেই সমস্ত নাট্যসৃষ্টি দেখে আমরা যারা লাভবান হয়েছি তাদের কাছে থিয়েটারের রেফারেন্স-ই বোধ হয় আলাদা। এরই জন্যে আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।’

শম্ভু মিত্র সম্পর্কে ওই একই কথাগুলি যদি নিবেদন করি!

লেখক পরিচিতি - শিল্প সাহিত্য সমালোচক, সম্পাদক



পথ ও পথিক
দেবাশিষ মজুমদার

১০ মে ১৯৫৪ রেলওয়ে ম্যানসন ইনস্টিটিউটে প্রথম প্রদর্শনী হলো ‘রক্তকরবী’ নাটকের। প্রযোজনা ‘বহুরূপী’ নাট্যসংস্থার। নির্দেশনা শম্ভু মিত্র। রবীন্দ্রনাথের নাটক সুতরাং বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতির দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথ যেন অক্ষুন্ন থাকে। তাই তিনটি অভিনয়ের অনুমতি দিয়েছিলেন তাঁরা। দুটি অভিনয় শেষে কোনও এক সর্দার কিংবা মোড়ল অথবা ছোটো সর্দারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পড়লো গলদ, ভয়ঙ্কর গলদ আছে এই অভিনয়ে! সঙ্গে সঙ্গে চিঠি এল নৃপেন্দ্র চন্দ্র মিত্র সলিসিটরের। এখুনি বন্ধ করতে হবে ‘রক্তকরবী’ অভিনয়। অভিযোগ- ‘মূলের থেকে বিচ্যুত ও বিকৃত’র। কেউ কেউ এই কথাও লিখলেন, ‘রক্তের আধিক্য বেশি করবীর তুলনায়।’ তৃতীয় অভিনয় শেষে শম্ভু মিত্র বললেন, “ ‘রক্তকরবী’র এই অভিনয়ই সম্ভবত শেষ অভিনয়।” হলো না শেষ বরং ১৯৫৪ সাল আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের ল্যান্ডমার্ক-এর সম্মানে চিহ্নিত হয়ে রইলো।

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ‘রক্তকরবী’র একটি মাত্র (বাংলায়) অভিনয় হয়েছিলো, যা দেখে তৃপ্ত হতে পারেননি নাটককার রবীন্দ্রনাথ। নিজে প্রবল আগ্রহে চেষ্টা করেছিলেন মঞ্চে এই নাটকটির অভিনয় করবার। যে নাটকটির দশবার পান্ডুলিপি পরিবর্তন করেন অভিনেতা-নির্দেশকরূপী রবীন্দ্রনাথের এই প্রত্যাশা ছিলো খুবই স্বাভাবিক। ভেবেছিলেন ভিন (নতুন) এক অভিনয় রীতির কথা। পছন্দ ছিলো না আর বাস্তব অনুকরণের মঞ্চ ভাবনা। যেটুকু লগ্ন হয়েছিলো কথা-বাস্তবতা ‘রাজা’, ‘ডাকঘর’, ‘অচলায়তন’-এর সংলাপে তার গঠন পাল্টে তৈরি করেছেন কাব্য-সংলাপ, যা ‘বিসর্জন’ বা ‘রাজা ও রানী’র কবিতা গঠন নয়। কবিতা সম্পৃক্ত এক গদ্য যার শুরু ‘লিপিকা’য়। ১৯২৬-এ (রক্তকরবী বই আকারে প্রকাশ কাল) বাংলার পেশাদার থিয়েটার এই ‘রচনাটি’র মধ্যে কোনও নাট্যগুণ আছে বলেই মনে করেনি। শিশিরকুমারের উক্তি নিয়ে নানান বিতর্ক আছে। অকারণে শিশিরকুমারকে আগলে রাখবার চেষ্টা না করে দেখা যায় কোনওভাবেই ১৯২৬ থেকে ১৯৩৫-এর মধ্যে এই ‘রচনা’কে নাট্য হিসাবে গ্রাহ্য করে শিশিরকুমার কোনওভাবেই অভিনয়ের কোনও চেষ্টা করেননি। ‘নাচঘর’ জানিয়েছে (১৩ ভাদ্র ১৩৩১)ঃ ‘রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুগ্রহে শিশিরকুমার তাঁর নূতন ও অপূর্ব্ব নাটক “রক্তকরবী” অভিনয় করবার অধিকার পেয়েছেন।’ সে অধিকার অগ্রাহ্য করেছেন তিনি। এই অগ্রাহ্যের জন্য শিশিরকুমারকে যে খুব বেশি অভিযুক্ত করা যায় তাও বোধহয় না। ১৯২৬-এ শিশিরকুমার ‘বিসর্জন’ মঞ্চস্থ করছেন (২৬ জুন, ১৯২৬)। অল্প কয়েক সন্ধ্যা অভিনয় হয়। সাধারণ দর্শক প্রতিক্রিয়াও তেমন অনুকূল ছিলো না। তার অন্যতম কারণ, ঠিক তিন বছর আগে (১৯২৩) চারদিন এম্পায়ার রঙ্গমঞ্চে ‘জয়সিংহ’-এর ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করেছিলেন। সেই স্মৃতি তখনও প্রখর! এরপর দশ বছরের মধ্যে শিশিরকুমার রবীন্দ্রনাথের চারটি নাটক অভিনয় করেছেন। কিন্তু তার মধ্যে ‘শারদোৎসব’, ‘ডাকঘর’, ‘রাজা’ কিংবা ‘অচলায়তন’ নেই। অথচ রবীন্দ্র নাটকের আধুনিক যাত্রাপথ-এর বিস্তার তখন ছড়িয়ে আছে এই নাটকগুলির মধ্যে। তাদের না ছুঁয়ে ‘রক্তকরবী’তে পৌঁছনো সম্ভব নয়। শিশিরকুমার আনুমানিক ৭৫টি নাটক অভিনয় করেছেন, সেখানে গিরিশচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল, ক্ষীরোদ প্রসাদ, মনিলাল, যোগেশচন্দ্র, অমরেন্দ্রনাথ প্রভৃতি প্রধান নাটককার। অর্থাৎ গিরিশ আবর্তেই বৃত্ত সম্পূর্ণ করছেন শিশিরকুমার— যিনি সেই পর্বের সব থেকে ক্ষমতাসম্পন্ন অভিনেতা এবং ভারতীয় থিয়েটারের প্রথম ‘নির্দেশক’ (শম্ভু মিত্র সে কথাই বলেছেন)। আর তাই কি ১৯২৯ সালে (১৩৩৫ বঙ্গাব্দের ২৬ আশ্বিন) ‘নাচঘর’ পত্রিকায় লিখতে হচ্ছে, ‘আধুনিক নাটক সম্বন্ধে কিছু বলতে যাওয়ার একটা মস্ত অসুবিধে আছে, সেটা হচ্ছে আধুনিক নাটকের অনস্তিত্ব। রাম না জন্মাতে রামায়ণ-রচনা বরং সম্ভব হয়েছিলো, কিন্তু যে বস্তু আদৌ নেই, তার সমালোচনা তত সহজ নয়।’ গিরিশ পরবর্তী রবীন্দ্রনাথকে স্বীকৃতি জানিয়ে শিবরাম চক্রবর্তী ওই রচনায় লিখছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে জন্মগ্রহণ করেচে কেবলমাত্র এই দাবীর জোরে কোনো নাটককে আধুনিক বলা চলে না।’ ‘আধুনিক নাট্যকারকে এই সুলভ যশের সরল পথ বর্জন করে’ নিজের জন্য নতুন পথ কেটে চলতে হবে। নাট্যরূপের দিক দিয়ে তিনি যেমন আনবেন নতুন কিছু, নাট্যরসের উদ্বোধনের দিক দিয়েও তীর প্রয়োগ কৌশলে থাকবে অপূর্ব-কিছু।’ সঠিক ব্যবহার করতে না পারার জন্য তাঁর মনে হয়েছে ওই সময়ের বানলা থিয়েটারে যথাযথ মননের অভাবে পোকায় কাটছে ‘রবীন্দ্রনাথের’ রক্তকরবী ও মুক্তধারা প্রভৃতি।’

নাটক ‘রক্তকরবী’কে আঠারো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে আধুনিক মঞ্চ মুক্তির জন্য। শম্ভু মিত্র যখন এই ঘটনার পুরধাপুরুষ তাঁর বয়স ৩৯ বছর সম্পূর্ণ হয়নি তখনও। থিয়েটারের কাজ শুরু হয়েছিলো বাংলা পেশাদার থিয়েটারের সঙ্গে, সম্ভবত ১৯৩৯-৪০ সাল নাগাদ। শম্ভু মিত্রের এটিএম প্রস্তুতি, থিয়েটার মনন ওই থিয়েটার আবহাওয়ার প্রেক্ষিতে ছিলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ১৯৩১ সালে স্কুলের পরীক্ষা পাশ করলেন প্রথম বিভাগে। শাঁওলী মিত্র লিখছেন, ‘শম্ভু মিত্র এরপরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। পুরো সিলেবাস দেখে তাঁর মনে হলো এর চেয়ে অনেক কম সময়ে অনেক বেশি কিছু পড়ে ফেলা যায়। কলেজে গিয়ে সময়ের অপব্যবহার করার কোনো অর্থ হয় না। ছেড়ে দিলেন কলেজ। ডিগ্রী অর্জন নয়, জ্ঞানার্জনই ছিলো তাঁর অভীষ্ট।’

জ্ঞানার্জনের জন্য সামনে শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, এসেছে ‘কল্লোল’ (১৯২৩), ‘কালি-কলম’ (১৯২৭), প্রগতি (১৯২৭) সাহিত্য পত্রিকা। কিছুদিনের মধ্যে আসছে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’। লেখা হচ্ছে ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ (বিভূতিভূষণ), ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ (মানিক), ‘তৃণখণ্ড’ (বনফুল), জাতিস্মর (শরদিন্দু)। পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিন নতুন ফসলে ভরে যাচ্ছে বাংলার ভূমি পীঠ— বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, অজিত দত্ত থেকে সমর সেন। বদল হয়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক বাতাবরণ। শুরু হয়েছে আধুনিক কাব্যের পথ অন্বেষণ। যেখানে জড়িয়ে আছে ‘বিদেশী চিন্তাধারার প্রভাব এবং দেশীয় অবস্থার অভিঘাত।’ এসেছেন ইয়েট্‌স-এলিয়ট থেকে ফ্রয়েড, ফ্রেজার, আইনস্টাইন, মার্কস এবং নিত্য নতুন বদল হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। এই শহরের (সাংস্কৃতিক) নাগরিক শম্ভু মিত্র স্বাভাবিকভাবেই অনেকটাই বহিরাগত হয়ে থাকতে হয় ‘পেশাদার থিয়েটার’-এর মঞ্চ কিংবা সাজঘরে। এই সময়ের কিছু ঘটনার কথা শুনেছিলাম শম্ভু মিত্রের গোলপার্কের বাড়িতে কাছে বসবার কয়েকটি দিন ও সন্ধ্যায়। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য এবং শম্ভু মিত্র যখন বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন, তখন ওখানকার অনেক অভিনেতা-শিল্পী কর্মী বিশ্বাস করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক উঁচু ডিগ্রী নিয়ে শুধুমাত্র থিয়েটারের ঝোঁকে এখানে এসে পড়েছেন এই তরুণ। মহর্ষির সঙ্গে শম্ভু মিত্রকেও একটু দূরে রেখে সমীহ করা হতো। অনেকে একটু বেশি তৎপর হয়ে উঠতেন এই আশঙ্কায়। এই বিপন্ন পরিবেশের শিকার যেন না হন এই ব্যতিক্রমী যুবক। শিশিরকুমারের সঙ্গে অভিনয় এবং তাঁর নির্দেশনার কাজে নিজেকে সমৃদ্ধ করবার বহু অভিজ্ঞতার কথা আমরা পড়েছি শম্ভু মিত্রের রচনা বা সাক্ষাৎকারে। শম্ভু মিত্র প্রয়োগগত প্রাথমিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন নিশ্চয়ই। কিন্তু শিশিরকুমার যে দুটি নাটক করছেন ‘জীবনরঙ্গ’ (১৯৪১ তারাকুমার মুখোপাধ্যায়) এবং ‘উড়োচিঠি’ (১৯৪২ নিতাই ভট্টাচার্য) সঙ্গে থাকছে সেই পুরনো নাটকের অভিনয়। এরমধ্যে কোনও নাটকেই পাওয়া যাচ্ছে না আধুনিক জীবন জটিলতার কোনও রেখা চিত্র! ১৯২৯-৩০-এর অর্থনৈতিক বিপর্যয়, গোটা বিশ্বে জীবন জড়িয়ে আছে অনিশ্চয়তা বা সংশয়ের কালো ছায়ায়। তার কোনও প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে না বাংলা মঞ্চে। পশ্চিমের নাটক, নাট্যভাবনা তো অনেক দূরের অবস্থানে তার এই প্রাঙ্গনে, যদিও শিশিরকুমার সে সংবাদ রাখেন না তা তো নয়, এমনকি নিজে তিনি নাট্যদল নিয়ে আমেরিকা সফর করে এসেছেন (১৯৩০)। ‘জীবন রঙ্গ’, বা ‘উড়ো চিঠি’-র পাশে ‘দিবারাত্রির কাব্য’ (১৯৩৫), ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ (১৯৩৬) কিংবা ‘তাসের দেশ’-কে (১৯৩৩) অনেক দূরবর্তী শিল্প কর্ম বলে মনে হয়। এর কিছুদিনের মধ্যে (১৯৪১) শম্ভু মিত্র একটি নাটক লিখতে শুরু করেন ‘উলিখাগড়ী’। ১৯৯৬ সালে নাটকটি গ্রন্থাকারে প্রকাশকালে ভূমিকায় লেখেন-

তখন ১৯৪১ সাল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। একদিন রাত্রে ঘুমোতে যাবার সময়ে, নিষ্প্রদীপ কলকাতা শহরের আকাশে গুট গুট করে শব্দ করতে করতে কয়েকটি জাপানি বোমারু বিমান এসে বোমা ফেলে গেলো।

সেই অন্ধকারে সামান্য কিছু অ্যান্টি এয়ার ক্রাফট গান্‌-এর (যাকে বলা হতো স্যাক্‌-স্যাক্‌ গান্‌), তার দোদমা গোলার শব্দ সত্ত্বেও যে কী ভীষণ অসহায় লেগেছিলো সে কথা আজও মনে পড়ে।

সেই সময় নাগাদই আমি হঠাৎই আমার প্রথম নাটক লিখতে আরম্ভ করি।

তাছাড়া সেই সময়ে পেশাদারি মঞ্চের অভিনয়ভঙ্গি পরিত্যাগ করে যেন একটা ভিন অভিনয় ধারা আমার মধ্যে আকার পেতে থাকছিলো। সেটা তৎকালীন অনেক নাটকের সংলাপ ও সংলাপগত বিষয়ের সঙ্গে এ নাটকের তুলনা করে যদি কেউ পড়েন তাহলে হয়তো তাঁর কাছে এ চিন্তা খানিক ধরা পড়বে।

তখন আমি শ্যামবাজারের থিয়েটার ছেড়ে দিয়েছি এবং ফ্যাসি-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের সঙ্গে পরিচিত হইনি।

পেশাদার থিয়েটারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিলো আপাতভাবে থিয়েটার যাপনে রুচির পার্থক্যে। তারই সঙ্গে বেশ বড়ো আকারে যুক্ত হয়েছিলো থিয়েটার বোধের অসংগতি। নাটক, অভিনয় নির্দেশনা কোনও কিছুতেই আবিষ্কারের তৃপ্তি নেই। নেই সমকালের স্পন্দন।

তরুণ অভিনেতা বাধ্য হচ্ছেন ‘ভিন অভিনয় ধারার আকার দেবার জন্য।’ ভিন অভিনয়ভঙ্গি-র সঙ্গে পরিচয় ঘটে সাধারণ জনের ১৯৫০ সালে। ‘বহুরূপী’র প্রযোজনা মাধ্যমে। যদিও আমার বিশ্বাস তখন ‘অভিনয়ভঙ্গি’র তারও পরিবর্তন ঘটেছে। এই দশ বছরে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে অভিনেতা নির্দেশক শম্ভু মিত্রের। ‘ভূমিকা’য় ‘তৎকালীন অনেক নাটকের সংলাপ ও সংলাপগত বিষয়ের সঙ্গে এ নাটকের তুলনা করে পড়বার কথা লিখেছেন অভিনেতা নাটককার। সেই সময় স্পষ্টতই দুটি প্রধান ধারা আমরা দেখি, একটি গিরিশ নির্মিত ধারা এবং দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ। গিরিশ-ক্ষীরোদপ্রসাদ-দ্বিজেন্দ্রলাল-যোগেশচন্দ্র-শচীন্দ্রনাথ-তারাকুমার-বরদাপ্রসন্ন-নিতাই ভট্টাচার্য-জলধর চট্টোপাধ্যায়সহ এই পর্বের সকল নাটককারের সংলাপের তুলনায় অনেকটাই ‘আরেকরকম’ হলেও, তখনও শম্ভু মিত্র আধুনিকতার অনুভাবী, কিন্তু সক্রিয় সন্ধানী নন। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ থেকে ’৪০-এর মধ্যে তিনটি নাটক লিখছেনঃ ‘কালের যাত্রা’ (রথের রশি ও কবির দীক্ষা, ১৯৩১), তাসের দেশ (১৯৩৩), বাঁশরী (১৯৩৩)। গীতিনাট্য তিনটি ‘নবীন’ (১৯৩১), ‘শাপমোচন’ (১৯৩১), ‘শ্রাবণ গাথা’ (১৯৩৪)। তিনটি নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৯৩৬), ‘চণ্ডালিকা’ (১৯৩৮) এবং শ্যামা (১৯৩৯)। ‘উলুখাগড়া’ পাঠে রবীন্দ্র অনুষঙ্গের কথা ভাবা একটু শক্ত। যদিও শাঁওলী মিত্র জানিয়েছেন, ১৯৪২ সালে ‘জ্যোতিনাথদাদাকে রবীন্দ্রনাথের “রাজা” নাটকটি পড়ে শোনাবার কথা। এই পাঠে শ্রোতা মুগ্ধ হয়েছিলেন। তবু ‘তুলনা’য় দূরে থাকেন রবীন্দ্রনাথ।’

ডিসেম্বর ১৯৪৭-এ শম্ভু মিত্র ‘যুদ্দ্বোত্তর যুগে বানলা মঞ্চে সংকট’ শিরোনামে প্রবন্ধ লিখলেন। তিনি তর্ক তুলতে চাইলেন,

কিছু লেখক বন্ধু এ ধরনের তর্ক তোলেন যে, ভালো অভিনেতা না থাকলে ভালো নাটক কখনো লেখা যায় না, কী হবে লিখে! তাঁদের উত্তরে আবার একথাও বলা যায় যে ভালো নাটক না হলে ভালো অভিনেতাও পাওয়া যায় না। এ দু’টো জিনিস এমনি পরষ্পর মুখাপেক্ষী।

কে বলে ভালো অভিনেতা নেই আমাদের দেশে? মনে করুন শিশির কুমারের নাদির শাহ, আলমগীর, রঘুবীর অভিনয়ের কথা। মনে করুন তাঁর ‘দিগ্বিজয়ী’, ‘রমা’, ‘সীতা’ নাটকে প্রয়োগ নৈপুণ্যের কথা। ...কলেজের ছাত্রদের মনে হত রবীন্দ্রনাথ আর শিশিরকুমার একই পঙ্‌তির যেন দুটো নাথ।

অতএব, ছিল অভিনেতা। দুরন্ত প্রতিভা নিয়েই ছিলো। কিন্তু রইলো না। বুঝি তো প্রতিভা দুরন্ত বলেই আত্মঘাতী হল। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিল জাতির সাংস্কৃতিক স্রোত থেকে। শরৎচন্দ্রের নাটকের পর আর এগোল না সম্মুখে। আটকে রইল অপসৃয়মান অতীতের বালুচরে।

আমাদের মনে হয়, তবে কী এই ছয়-সাত বছরের ব্যবধানে শম্ভু মিত্র নতুন পথের সন্ধান পেয়েছেন? ‘১৯৪৭, ডিসেম্বর’ তখনও ‘বহুরূপী’ তৈরি হয়নি। কিন্তু শম্ভু মিত্র বিপুল কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সর্বভারতীয় অভিনয় জগতে তখন পরিচিত ব্যাক্তি। ‘ফ্যাসি বিরোধী’ লেখক ও শিল্পী সংঘ-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ১৯৪২–এ। বিনয় ঘোষের ‘ল্যাবরেটরি’, বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’, ‘জবানবন্দী’ থেকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ-এর ‘নবান্ন’-এর অন্যতম প্রধান সৃজক শিল্পী। বোম্বাইতে সক্রিয় চলচ্চিত্র-শিল্পী। শুধু নাটক আর চলচ্চিত্র নয়, এক ঝাঁক তরুণ আধুনিক মনন ও সৃষ্টির ঝোড়ো হাওয়ায় উত্তাল দিনযাপনে তিনিও অংশীদার। পাশে এসেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিষ্ণু দে, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, সোমনাথ হোর, সলিল চৌধুরী, হিরণ সান্যাল, রবিশঙ্কর, মেনিচন্দ্র জৈন, বলরাজ সাহানি বন্ধু চিন্মোহন মেহানবীশ আরও আরও অনেক। এই সাত বছরে গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে শম্ভু মিত্রের প্রতি দৈনিক পরিমন্ডলে। তাহলে ‘সাবেক’ অভিনেতা শিশির কুমারের ‘অপসৃয়মান অতীতের বালুচরে’ আটকে পড়ার পরিবর্তে তিনি, শম্ভু মিত্র কোন পথের সন্ধানী? যেতে চাইছেন ইবসেন-সিজ্ঞ-ব্লিফোর্ড অডেটস-এর কাছে। ‘অ্যাক্‌শন’ চাইছেন নাটকে, ‘কাব্যিক নাটক’ নয়। তাহলে রবীন্দ্রনাথ? ওই প্রবন্ধেই শম্ভু মিত্র লিখছেন,

উপন্যাসের সংলাপ মঞ্চে চালালে খুব কম সময়ই সেগুলো উতরোয়। কারণ উপন্যাসের সংলাপ হচ্ছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অভিনেতার সেগুলো চেঁচিয়ে বলা ছাড়া আর প্রায় কিছুই করবার থাকে না। উদাহরণস্বরূপ মনে করুণ রবীন্দ্রনাথের বহু নাটকের বহু লাইনের কথা। কিন্তু যথার্থ নাটকীয় সংলাপ কখনোই এ ধরনের হয় না।

এর ঠিক চার বছর পর (২১.০৮.১৯৫১) রবীন্দ্র উপন্যাস ‘চার অধ্যায়ে’র সংলাপ প্রায় অপরিবর্তিত রেখে অভিনয় করবেন শম্ভু মিত্র। সে পথে পৌঁছতে তাঁকে ক্রমাগত সৃষ্টির যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে। ‘নবান্ন’ (গণনাট্য সংঘ এবং বহুরূপী প্রযোজনা) অভিনয় ‘পথিক’ এবং ‘উলুখাগড়া’ পার করে ‘ছেঁড়া তার’-এ পৌঁছে শম্ভু মিত্র ‘ভিন অভিনয়ে’র প্রকাশ ক্ষেত্রে জড়িয়ে নিচ্ছেন নাটকের সংলাপ নয় শুধু সঙ্গে বিষয়ের বিন্যাসকে। ‘ছেঁড়া তার’-এ এসে প্রায় সম্পূর্ণ ছিন্ন হচ্ছে সবরকম ‘সাবেক’ অভিনয়রীতি। ১৯৫০ ডিসেম্বরে যখন ‘ছেঁড়া তার’ প্রথম অভিনয় হচ্ছে, তখন স্রষ্টা শম্ভু মিত্র মনের গভীরে দুই দ্বন্দ্বে দীর্ণ হচ্ছেন। ১৯৫০-এর ‘বাংলা থিয়েটার’ প্রবন্ধে একই সঙ্গে তাঁকে লিখতে হচ্ছে-

রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ রুচিজ্ঞান তাঁকে ফর্ম সম্বন্ধে অত্যন্ত সযত্ন রেখেছে। এবং কাঠামো নিয়ে এত তজরুবা বোধহয় আর কেউ করেনি এদেশে। কিন্তু তাঁর অদ্ভুত ও অভূতপূর্ব নাট্যাভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ রঙ্গালয়ে তখন দীনবন্ধুবাবুর, গিরিশবাবুর নাটক হচ্ছে। সেগুলোয় ঠাকুরবাড়ির রুচিবোধ ছিল না, কিন্তু তারও দাম ছিল। আজও আছে। এই সমস্ত নাটকে তদানীন্তন বাংলার-কলকাতার- এমন একটা রূপ পাওয়া যায় যার মধ্যে মাটির গন্ধ স্পষ্ট। শিল্পের সত্য সেখানেও বর্তমান। রবীন্দ্রনাট্যাভিনয়ের কাঠামোয় এই মাটির গন্ধ নেই। তিনি দিতেই চাননি। তাঁর রুচিবোধ তাঁর ফর্মকে এত কঠোর করেছে যে সাধারণ লোকের কাছে ‘কাব্যিক বাড়াবাড়ি’ বলে মনে হয়েছে। ঐ ফর্মটাই দূরে ঠেলে রেখেছে সাধারণ মনকে, রসাস্বাদন ঘটতে দেয়নি। আজ অবশ্য সে বাধা ক্রমশ কমছে। কিন্তু তবু রবীন্দ্রনাথ অসম্পূর্ণ। তদানীন্তন সাধারণ রঙ্গালয়েও তাঁকে মেলাবার দায়িত্ব আছে এই বর্তমানে।

এই প্রবন্ধ শেষ করেছেন ‘রবীন্দ্রনাথের পরীক্ষার অভিজ্ঞতা আয়ত্ব করে আমরা গড়ে তুলতে পারব’ ‘একান্ত বাংলার- সমগ্র ভারতের তথা সর্ব পৃথিবীর’ নতুন নাটক-থিয়েটারের প্রত্যাশা নিয়ে। ঠিক একবছর পরে ‘বহুরূপী’ তথা শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় দুটি নাটক অভিনীত হচ্ছেঃ বিভাব এবং চার অধ্যায়। ‘বিভাব’-এর অভিনয় সংখ্যা হয়তো তুলনায় বেশি ছিলো না, কিন্তু ভাবনার প্রাচুর্যে বাংলা থিয়েটারকে কয়েক দশক জুড়ে বিস্তার ঘটিয়ে দিয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথ ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধ এবং পরবর্তী পর্বে ‘তপতী’র ভূমিকায় যে মঞ্চ চিত্রণ-চিত্তপটের কথা বলতে চেয়েছেন। শঙ্খ ঘোষ বারবার আমাদের সামনে নিয়ে আসতে চেয়েছেন আধুনিক থিয়েটারের নির্মাণ প্রেক্ষিতে। রবীন্দ্রনাথের বিষয়-সংলাপ-অভিনয় (নির্দেশনা) মিশ্রণে যে সহজ থিয়েটারের ছবি তৈরি করতে চেয়েছেন- তার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভার পরিহার করে ‘বিভাব’-এর জন্ম। এই নাটকের অভিনয় করতে গিয়ে শম্ভু মিত্র আরও একটু লগ্ন হয়ে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাট্য ভাবনায়। মঞ্চ চিত্রণ ছেড়ে, পোশাকের বাহুল্য ত্যাগ করে, স্থানের বাস্তবতার নকলরূপ পরিবর্তে সামান্য উল্লেখ দর্শককে অভাবী বোধে দূরে সরিয়ে দেয় না। অবশ্যই তার জন্য প্রয়োজন ‘ঠিকমতো ইঙ্গিতটি’র। এই ইঙ্গিতটিকে সাম্প্রতিক আবিষ্কার না বলে রবীন্দ্রনাথ ফিরে যেতে চেয়েছেন ঐতিহ্যের বিস্তারে। ‘বিভাব’ ধারায় সেদিন থিয়েটার সৃজন যদি ছড়িয়ে যেত তাহলে বোধহয় সাতের দশকে অকারণ তত্ত্বের তর্কে ‘থার্ড থিয়েটার’ নতুন বলে চিহ্নিত করবার প্রয়োজন হতো না। ‘বিভাব’ নতুন পথ বা নতুনরীতির এক পৃথক সৃষ্টি শম্ভু মিত্র দাবি না করে স্পর্শ করেছেন রবীন্দ্রনাথকে। আর রবীন্দ্রনাথ স্পর্শ করেছেন অভিনয় ঐতিহ্যকে। এখানে স্থান পায়নি পশ্চিমের–বিদেশের কোনো বিশেষ চলনের রেফারেন্স! এই ‘বিভাব’ থেকেই ইঙ্গিতের পথ ধরে শম্ভু মিত্র পৌঁছতে চেয়েছিলেন ‘চার অধ্যায়’ নাটকে। [বিভাব-এ] যেমন পুলিশ বোঝাতে এমনি পোশাকের ওপর মাত্র একটা ক্রসবেল্ট। ভীষণ মজার বস্তু নয় কি? আসলে দেখতে পাওয়া গেল ইঙ্গিত। ঠিকমতো ইঙ্গিতটি দিতে পারলেই আর কিচ্ছুর দরকার হয় না। বাকি কাজ হচ্ছে নাটকের মুভটা দর্শকের মনে চালিয়ে দেওয়া। সেই চেষ্টাই করা হয়েছিলো ‘চার অধ্যায়’-এ। [নাটক, ১৯৫৪]।

১৯৩৪ সালে লেখা হয় ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাস। ‘ঘরে বাইরে’র পর রবীন্দ্রনাথকে আবার বিশেষত উপন্যাস লিখে দীর্ঘ কৈফিয়ত লিখতে হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় (বৈশাখ ১৩৪২) ‘চার অধ্যায় সম্বন্ধে কৈফিয়ত’ শীর্ষক এক দীর্ঘ লেখা প্রকাশ করতে হলো। কারণ, ‘বিপ্লবী সমাজের ক্ষোভ বেশ ব্যাপক আকার নিয়েছিল।’ রাষ্ট্র চেয়েছিল তার স্বার্থে-বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য এই উপন্যাসকে ব্যবহার করতে। ঘরে বাইরে আক্রান্ত হলেন রবীন্দ্রনাথ। আবার খুব অল্পদিনের মধ্যেই ছাপতে হলো দ্বিতীয় সংস্করণ (আষাঢ়, ১৩৪২)।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কৈফিয়তের শুরুতে বলেছেন আলোচনায় ‘অধিকাংশই সাহিত্য বিচারের বাহিরে পড়ে গেছে।’ দীর্ঘ সেই লেখার প্রান্তে এসে রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন,

‘অবশেষে সংক্ষেপে আমার মন্তব্যটি জানাই-
চার অধ্যায়ের রচনায় কোনো বিশেষ মত বা উপদেশ আছে কি না সে তর্ক সাহিত্য বিচারে অনাবশ্যক। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে এর মূল অবলম্বন কোনো আধুনিক বাঙালি নায়ক-নায়িকার প্রেমের ইতিহাস। সেই প্রেমের নাট্য রসাত্মক বিশেষত্ব ঘটিয়েছে বাংলাদেশের বিপ্লব প্রচেষ্টার ভূমিকায়। এখানে সেই বিপ্লবের বর্ণনা অংশ গৌণমাত্র; এই বিপ্লবের ঝোড়ো আবহাওয়ায় দুজনের প্রেমের মধ্যে যে তীব্রতা যে বেদনা এনেছে সেটাতেই সাহিত্যের পরিচয়। তর্ক ও উপদেশের বিষয় সাময়িক পত্রের প্রবন্ধের উপকরণ। ৮ চৈত্র ১৩৪১’

সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি এই কৈফিয়ত। বিশেষত প্রথম প্রকাশের সময় ‘আভাস’ শিরোনামে যে ‘ভূমিকা’টি ছিলো (সাময়িক পত্রে তার তীব্র সমালোচনা হওয়ায় দ্বিতীয় সংস্করণে তা সরিয়ে নেওয়া হয়) সেখানে স্পষ্ট ছিলো রাষ্ট্র বিরোধী আন্দোলনে ‘বিভীষিকা-পন্থার’ মর্মান্তিক পরিণতির কথা। আজও এই সত্যবোধ-এর আদৌ কোনও স্থির মীমাংসার ছবি পাওয়া গেছে বলে মনে হয় না।

উপন্যাসটি প্রকাশের ঠিক সতেরো বছর পর, স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র তিন পার করে চার বছর বয়স। তখন বহুরূপী, শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রনাথে এলেন এই উপন্যাসকে অবলম্বন করে। তাঁকে আক্রান্ত হতে হলো স্বাধীনতা সংগ্রামীর একাংশের সঙ্গে বাংলার সাম্যবাদী-সংগঠনগুলির দ্বারা। সেদিনের তর্ক বিচার আজ মুছে গেছে। আমরা লক্ষ্য করি ‘চার অধ্যায়’- দর্শক আলোড়িত হলেন তুমুল বিষয় সম্পৃক্ত অভিনয় উপস্থাপনের খণ্ড মুহূর্তের অনুভব থেকে প্রায় সম্পূর্ণ থিয়েটারের আনন্দে- যন্ত্রণায়। ‘চার অধ্যায়’-এর দর্শক আর বিনোদনের জন্য প্রেক্ষাগৃহে আসছেন না। জেনে বা না জেনে নাটক দেখবার পর উপলব্ধি করছেন— মননে একে বহন করতে হবে অনির্দিষ্ট সময় বা কালে এই নাটকের অভিঘাত।

শম্ভু মিত্র এই উপন্যাসকে অবলম্বন করে যখন রবীন্দ্রনাথের কাছে এলেন আমরা দেখি ভাবনার নানান পরিবর্তন ঘটে গেছে। বদল হয়েছে থিয়েটারের ভাষার অক্ষর বিন্যাস এবং পাঠে। একটি জরুরি প্রশ্ন উঠে আসে। শম্ভু মিত্র পূর্ববর্তী রবীন্দ্রনাটক বিষয়ক বিপরীত ভাবনা-ধারণা তাঁর প্রয়োগ ও ক্রমাগত অনুসন্ধানে বদল হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে এসে দাঁড়ালে, প্রশ্ন থাকে ‘চার-অধ্যায়’-এর একটি কারণ হতে পারে গণনাট্য সংঘে ‘মুক্তধারা’ অভিনয়ের ব্যার্থতা! তাহলেও উপন্যাস ‘গোরা’, না হলে যথেষ্ট ‘অ্যাকশন’ আছে জীবনের জটিলতা আছে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে কিংবা ‘শেষের কবিতা’? ‘অ্যাকশন’ হয়তো ‘চতুরঙ্গ’-এর তুলনায় কম থাকলেও, ‘চার-অধ্যায়’-এর তুলনায় অনেকটা ‘মাটির গন্ধ’ আছে সংলাপে, আছে ‘অতি-আধুনিক সাহিত্য এবং প্রেমের’ দ্বন্দ্ব। আছে আবৃত্তি করবার জন্য অনেক কবিতা। শম্ভু মিত্র তখন শুধু অভিনেতা নন আধুনিক আবৃত্তি-শিল্পী মর্যাদায় লোকপ্রিয়। বহুরূপী’র অনুষ্ঠানপত্রী-তে লেখা হয়েছে-

এই নাটকের পটভূমিকায় প্রচণ্ড Violence। আর সেই রক্তাক্ত পটের উপরেই দু’জন মানুষের প্রেম। ...
... দেশে যখনই কোনো আন্দোলন ভুলপথ অবলম্বণ ক’রে তাদের অন্তরের সত্যকে হারাবে তখনই এ ঘোষণার সত্যতা বারবার পুনর্জীবিত হবে। এই ধরনের সামাজিক দৃষ্টি আছে বলেই আমরা ‘চার অধ্যায়’কে ভালোবাসি।

রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদের চাপে(?) যেভাবে দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে ‘আভাস’ লেখাটি সরিয়ে নিচ্ছেন কৈফিয়তে ‘স্থাপত্য’ সাহিত্য বিচারের গন্ডি বা ‘সাহিত্যরূপ’-এর স্পষ্টতা প্রসঙ্গ এলে রাষ্ট্র-বিরোধী ‘বিভীষিকা-পন্থার’ প্রসঙ্গটিকে ‘গল্পের ভূমিকা’ উল্লেখে সরে আসতে চেয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে হাল আমলে স্পষ্ট দুটি ভাবনার কথা মনে করতে পারি। অশোক সেন রাজনীতির পাঠক্রমে রবীন্দ্রনাথ বইটিতে লিখছেন, ‘তাঁর [রবীন্দ্রনাথের] “স্বদেশী সমাজ”-এর পরিসর ছিলো অনেক বেশি বিস্তৃত। তাই সাংস্কৃতিক প্রকরণের মধ্যে কথকতা, যাত্রা, ম্যাজিক লণ্ঠন ইত্যাদির তাৎপর্য প্রথম থেকেই লালন করেন রবীন্দ্রনাথ। যাই হোক ‘নেশান-কল্পনার’ সাংস্কৃতিক প্রকরণ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাজের তালিকা দিতে আলাদা রচনা লাগবে। বড়ো বেশি জায়গার ব্যাপার। দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি প্রশ্ন করে রাখি। গোরা, “ঘরে-বাইরে”, “চার অধ্যায়”, বা এমনকি “চতুরঙ্গ”-এসব উপন্যাসে আমাদের ‘নেশান কল্পনার’ উপস্থিতি কি বেশ সড়োগড়ো নয়?’ বিস্তৃতির পরিসরে রবীন্দ্র রাজনীতিকে দেখতে চেয়েছেন অশোক সেন, তার থেকে সরে এসে সমকালীন প্রতিক্রিয়ার অনুভবে বিশ্লেষণ করেছেন নিত্যপ্রিয় ঘোষ। ‘যাঁর বাণী বিপ্লবীদের অন্তিম দিনের পাথেয় সেই রবীন্দ্রনাথই, চরম রহস্যের বিষয়, ১৯৩৪ সালে লিখলেন ‘চার অধ্যায়’, যে ১৯৩৪ সাল অ্যান্ডারসনী চামুণ্ডা নীতিতে বাংলাদেশ সন্ত্রস্ত’ ... বিপ্লবীদের এই বিকৃতি আজ হাস্যকর মনে হয়...।’ এখানেই শেষ করেননি নিত্যপ্রিয় ঘোষ। তিনি জানাচ্ছেন, ‘রবীন্দ্রনাথও আবার এগিয়ে এসেছিলেন আত্মত্যাগী বিপ্লবীদের সমর্থনে।’ তিনি এই ধরনের একাধিক উদাহরণ উল্লেখে লিখেছেন, ‘বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান দিয়ে, কবিতা দিয়ে, বক্তৃতা দিয়ে। রবীন্দ্রনাথকেও উদ্বুদ্ধ করলেন বিপ্লবীরা তাঁদের আত্মত্যাগ দিয়ে, সহিষ্ণুতা দিয়ে নিঃশঙ্ক কর্মের মধ্য দিয়ে।’ রবীন্দ্রনাথের তৎকালীন সামাজিক ভূমিকার সঙ্গে শম্ভু মিত্রের অবস্থানগত সম্পর্ক খুঁজে দেখবার অহেতুক শ্রমে না গিয়ে, শম্ভু মিত্রের রাজনৈতিক ভাবনাকে বোঝবার প্রয়োজন। ‘ঘূর্ণি’ নাটক লেখা প্রসঙ্গে ১৯৫০ সালে বোম্বের এক নির্জন হোটেল ঘরের স্মৃতি নিয়ে ‘‘চার অধ্যায়’-এর মঞ্চরূপের ছবি মনের মধ্যে জাগতে থাকে। যে কথাগুলো তখন বলবার জন্যে মনের মধ্যে অস্থির লাগছিলো তারই এক গভীর চিত্র ফুটে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের এই অতুলনীয় আখ্যানে।’ যে কথাগুলো বলবার জন্য মন অস্থির লাগছিলো তা নিশ্চয় রাষ্ট্র বিরোধী অতি বিপ্লবী পটভূমিতে প্রেমের আখ্যান নয়, এই ‘কথাগুলো’-ই আমরা পাই ওই ‘লেখাটি’তে -

১৩৫০ সালে এক ভয়ঙ্কর মন্বন্তর হল। মানুষের তৈরি সেই মন্বন্তর। লক্ষ লক্ষ লোক না খেতে পেয়ে শহরের রাস্তায় মারা গেল। বিশ শতকের ’৪৩ সাল। আমাদের চোখের সামনে। — তারপর ’৪৬ সালে বীভসৎ দাঙ্গা হল হিন্দু-মুসলমানের। ’৪৭ সালের ১৪ অগাস্টে কলকাতার গলিতে গলিতে নাকি কোলাকুলি হয়েছে, আতর ছড়ানো হয়েছে— হিন্দু-মুসলমানে মিলে। মনে হয়েছিল রাত বুঝি কেটেই গেল। কিন্তু কোথায়? হিন্দু-মুসলমানের সেই আগুন ধিকি-ধিকি জ্বলতে থেকেছে। আজ পর্যন্ত। প্রথমেই শোনা গেল এ আজাদি সত্য নয়, এটা মিথ্যা। দলে দলে ছিন্নমূল লোকেরা এসে পশ্চিমবঙ্গের স্বল্প পরিসরকে ভরিয়ে রেখেছে এবং এখনও রাখছে। তখন সকলে মিলে মানুষের দুর্দশা দূর করবার চেষ্টার বদলে রাজনৈতিক দলের ছিনমূলদের নিয়ে ব্যবসা শুরু করল। গড়া নয়, ভাঙা— এই যেন হল স্পর্ধিত প্রগতির কথা। ট্রাম জ্বালানো, ট্রেন ওড়ানো, পুলিশের গুলি চালানো, — সব যেন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠল। পার্লামেন্টারি ডিমোক্র্যাসির প্রাথমিক সভ্য নিয়মগুলো দেশের লোক বোঝবার আগেই অ্যাসেম্বলিতে চটি ছোঁড়াছুঁড়ি হতে লাগলো। লোকে শিখল, যেমন করে পার মেরে, নাও।

এ কথা ভাবলে যেমন ভুল হবে রাজনৈতিক ভাবনার আবর্তে শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রনাথের কাছে আসছেন। আবার রাজনীতি বিচ্ছিন্ন শুদ্ধ কোনও ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা ‘বিভাব’-কে বিশেষভাবে বুঝতে চেয়েছি কেবল ‘ফর্মে’র আধুনিকতার বিচ্ছিন্ন কোনও ভাবনা থেকে নয়। আধুনিক মননে গড়ে উঠতে চাইছে নতুন থিয়েটার। পেশাদার থিয়েটারের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে শুধু মঞ্চে নয়, তৈরি হচ্ছে নতুন দর্শক অর্থাৎ প্রেক্ষাগৃহে। ‘টোটাল থিয়েটার’ কাকে বলে আমি জানি না। মনে হয় প্রতিমুহূর্তের অন্বেষণ থিয়েটারের অন্বিষ্ট। জড়িয়ে থাকে সমাজ ও সময়। লোকায়তিক ভুবনেই তার সৃষ্টি। এই সত্যে পৌঁছে যাচ্ছেন শম্ভু মিত্র তিথা বহুরূপী কেবলমাত্র নয়, শম্ভু মিত্র তথা বহুরূপী পৌঁছে দিতে চাইছে বাংলা থিয়েটারকে। গণনাট্য সংঘ, ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ যে রাজনৈতিক নাট্য-থিয়েটার গড়ে তুলতে চেয়েছিলো, প্রাক্তন কর্মী শম্ভু মিত্র সেই রাজনৈতিক বোধে আরও-আরও শৈল্পিক প্রাচুর্যে-সৃষ্টির বোধভাষ্যিক প্রয়োগে, নিপুন নির্মাণে নতুন এক নাট্যপ্রতিমার সাধনা শুরু করলেন। নতুন বলে স্বীকৃতি পেলেও তখনও আধুনিকতার শিরোপা পাওয়া যায়নি। বাহুল্য বোধ হলেও এখানে স্পষ্ট করা প্রয়োজন ‘রাজনৈতিক’ শব্দটির ব্যবহার সম্পর্কে। প্রয়োজন আমার লেখবার দুর্বলতার কারণেই (তেমনি আশঙ্কা) ‘রাজনৈতিক নাটক’ হিসেবে সাধারণত একটি মতবাদ বা দর্শনের আনুগত্যে, কখনও একটি বিশেষ সম্প্রদায় বা সংগঠনের দলের প্রচারে বিশ্বাসে এমনকি কোনও বিশেষ ইশতাহারের সঙ্গে যুক্ত শিল্পকর্মকেই আমরা রাজনৈতিক আখ্যা দিতে চাই। রাজনীতির তো ঠিক ততটা সংকীর্ণ হবার কথা নয়। আজ আমাদের দেশে যে সাম্প্রদায়িক ভয়াবহ আক্রমণ চলছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উত্থানকালে শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছেন অনন্ত মূর্তি চেয়েছিলেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘গোরা’ উপন্যাস নিয়ে আলোচনার আয়োজন করতে। আজকের ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার প্রতিবাদে ‘তাসের দেশ’- কিংবা ‘নটীর পূজা’ অভিনয় করলে— সে প্রতিবাদ তো রাজনৈতিক হবে। সমাজ ও সময়ের আবর্তে ‘গোরা’, ‘তাসের দেশ’ কিংবা ‘নটীর পূজা’ ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনৈতিক কারণে। বলা যায়, তাই বলে এর কোনওটাই রাজনৈতিক শিল্পকর্ম নয়। নিশ্চয়ই। কিন্তু এদের মধ্যে সংগঠিত যে স্ফুলিঙ্গ আছে— আজ যা আগুন হয়ে জ্বালানো যাচ্ছে— তা রাজনৈতিক। এই মুহূর্তের দ্বিতীয় স্রষ্টার নির্মাণে সে রাজনৈতিক।

‘ছেঁড়া তার’, ‘বিভব’ আর ‘চার অধ্যায়’ নবতর নাট্যনির্মাণে নিয়ে এল ইবসেনকে। পরবর্তী সময়ে ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাস পরিসরে যে বিস্তৃতির কথা বলবেন, অশোক সেন তারই অভিষেক ঘটে ‘দশচক্র’ মঞ্চায়নের মধ্যে। যেখানে আবিষ্কারের চেষ্টা রইলো, ‘দেশীয় নাট্য-পদ্ধতি’র আর প্রেক্ষাপটে ‘বিশেষ করে আজ আমাদের দেশে যে-কালে গণতন্ত্রের গভীরে না গিয়ে তার আবরণটুকু আশ্রয় করে যে সুবিধাবাদের জন্ম হয়েছে তা কী ব্যাক্তিক, কী সামাজিক, কী রাজনৈতিক— সবক্ষেত্রেই ভয়াবহরূপে প্রকট।’ [ইবসেন কেন? ১৯৬২]। এই সময় (প্রথম অভিনয় ০১.০৬.১৯৫২) একদিন দেখা হলো কমিউনিস্ট পার্টির নেতা বঙ্কিম মুখার্জির সঙ্গে ধর্মতলার পথে। সামান্য কথালাপের পর বঙ্কিম মুখার্জি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী নাটক হচ্ছে এখন আপনাদের?’ উত্তরে শম্ভু মিত্র বললেন, ‘আপনারা অ্যাসেমব্লিতে তো এখন রুট মেজোরিটির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। আমরা তেমনি এক মেজোরিটির বিরুদ্ধে একলা মানুষের লড়াইয়ের কথা বলছি।’ এই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ আয়োজন করছে ‘বাংলা থিয়েটার’ বিষয়ক আলোচনা সভা। আমন্ত্রিত আলোচক শিশিরকুমার ভাদুড়ি এবং শম্ভু মিত্র। ছাত্র-শ্রোতা অসম্ভব কৌতূহল নিয়ে সভায় জড়ো হচ্ছেন, দুই পর্বের, দুই কালের থিয়েটারের ‘তুল্যমূল্য’ আলোচনা শোনবার জন্য। অর্থাৎ সামাজিকভাবে ‘ভিন্ন ধারার’ শুধু নয়, বাংলা থিয়েটারের নতুন তথা সমসাময়িক শিল্পের প্রতিনিধি শিরোপায় অভিষিক্ত হচ্ছেন শম্ভু মিত্র। তাঁরই নেতৃত্বাধীন ‘বহুরূপী’। এই স্বীকৃতি অর্জন করছে অভিনয়-নির্দেশনার নতুন উদ্‌ভাবনে। সঙ্গে প্রবলভাবে মিশে আছে নাটকের ‘আণুবিক’ বিষয়। শুধু মঞ্চ উপস্থাপন নয়, টিকিট-বিজ্ঞাপন-প্রেক্ষাগৃহ নিয়ন্ত্রণ সংগঠন— পারিপাট্যে লগ্ন হয়ে আছে সৃষ্টি সৌন্দর্যের (এ পর্যন্ত) অপরিচিত মনন। ‘চার অধ্যায়’ পর্বে শম্ভু মিত্রের মনে হতে থাকে -

ধর্মীয় উপলক্ষে আমাদের দেশে নানান জায়গায় নানা মেলা বসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ধর্ম বহু সময়েই মানুষকে মেলায় না। পৃথক করে। তাই আমাদের এই নানা ধর্মের দেশে যদি সামাজিক ক্রিয়াকলাপকে কেন্দ্র করে এই উৎসব মেলাগুলো হয় তাহলে সকল ধর্মের লোকই নির্বাধা হয়ে মিলতে পারে। তাই কবি বৃক্ষরোপন, হলকর্ষণ, বসন্তোৎসবের মতো secular উৎসবের প্রচলন করেন। কিন্তু আমাদের সমাজ সেগুলো গ্রহণ করেনি। বরঞ্চ হাতে যত পয়সা বাড়তে থেকেছে ততই নানারকম ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জাঁকজমক বারোয়ারীভাবে বাড়তে থেকেছে।

কিন্তু কবি যে এই যেটা করেছিলেন এটা যেদিন হৃদয়ঙ্গম হলো সেদিন যে কী পরিমাণ অভিভূত হয়েছিলুম তা বলতে পারি না। কী মহৎ লোক!

অর্থাৎ ‘অসম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথে’র ভাবনা দ্রুত বদল হতে শুরু করেছে এই কাল পর্বে। শম্ভু–তৃপ্তি বহুরূপীর সঙ্গে এই সময়ের বিভিন্ন শিল্প পথের স্রষ্টা ও বুদ্ধিজীবীর সংযোগ গড়ে উঠছে, তৈরি হচ্ছে পারস্পরিক সম্মান বোধ— এরই পাশাপাশি স্বাধীনতা-উত্তর ভাঙা বাংলার ‘মেট্রোপলিটন মধ্যবিত্তের নির্দিষ্ট একাংশ আত্মপরিচয় আর আত্মকথনের নতুন উৎসব সন্ধান পাচ্ছেন এই নাটকগুলির মধ্যে। নাটককার অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন ঘোষ ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪- এই সময়ে (পেশাদার প্রধানত) অন্যান্য মঞ্চে কী ধরনের নাটক হচ্ছে তার তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন। যাকে আগেই আমরা ‘গিরিশ আবর্তে’র নাটক বলেছি তারই প্রতিধ্বনি সেখানে স্পষ্ট। অথচ বাঙালি মধ্যবিত্তের যে অংশ শিল্প সংযোগী-শহুরে, তাঁদের কাছে ‘জাগরী’ (সতীনাথ ভাদুড়ী), শ্রীমতী কাফে (সমরেশ বসু), চোরাবালি (বিষ্ণু দে) কিংবা ‘দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’কে আর অচেনা লাগছে না। খুলে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের জানালা। আধুনিকতার আলো প্রায় প্রতিদিন ঝাপটা মারছে অস্থির জীবনে। বাংলার নতুন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে থিয়েটার আত্মমর্যাদায় অন্যতম প্রধান বাতিঘর হয়ে উঠলো। ‘বহুরূপী’ থেকে একাধিক নাট্য সংস্থার সংখ্যাগত প্রযোজনা পুষ্ট করতে চাইলো এই আলোক দিপ্তীকে। অবশ্যই প্রথমে-পথিকৃতের ভূমিকায় ইতিহাস গ্রহণ করলো শম্ভু মিত্র এবং বহুরূপীকে। আর শম্ভু মিত্র এবং বহুরূপী অর্জন করলেন ‘রবীন্দ্রনাথ’কে। নাটকের আবিষ্কারে। ‘রক্তকরবী’র উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে বাংলা থিয়েটার ‘আধুনিকতা’র শিরোপা অর্জন করলো। মুছে গেলো ‘রক্তকরবী’ নাটকের গায়ে জমে থাকা অবহেলার ধুলো। মাত্র ছ-মাসের মধ্যে এই নাটক সর্বভারতীয় পটভূমিতে শ্রেষ্ঠ আধুনিক নাটকের পরিচয়ে স্থায়ী উপাদানের তকমা নিয়ে প্রবেশ করলো সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সংগ্রহালয়ে। শম্ভু মিত্র এক নতুন বোধে ক্রমশ পৌঁছতে চাইলেন এই রক্তকরবী অভিযাত্রায়-

রক্তকরবী করবার সময়েই ক্রমশ মনে হতে থাকলো যে ভারতীয় নাট্যপ্রকাশের একটা ধরন যেন আমরা দেখতে শিখলুম।

এই ভারতীয়ত্ব নিয়ে বোধহয় একমাত্র থিয়েটার প্রসঙ্গেই তর্ক আছে প্রবল। তার কারণ কি শুধু সংলাপ? নাকি ভাষা জ্ঞানের অক্ষমতা। প্রায় অন্যান্য শিল্প তার বিস্তারে এই ধরনের সমস্যাকে অতিক্রম করেছেন প্রায় প্রকৃতিগত বিস্তারে। থিয়েটার বিষয়ক এই অসম্পূর্ণতায় ক্ষতি হয়েছে এই অঞ্চলের পরবর্তী শিল্পকর্মের। অযৌক্তিক তর্কজালে বাড়িয়েছে জড়িয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা। হারিয়েছে পথ সন্ধানের সাহস। ‘রক্তকরবী’ পরবর্তী ‘পুতুল খেলা’র সাযুজ্য এবং ‘মুক্তধারা’ এবং ‘বিসর্জন’-এর ব্যার্থতার পর রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ (সঙ্গে রাজা অয়দিপাউস) তাঁকে সাধনার যে পীঠে স্থিত করলো— সেখানে দীর্ঘ অতীত অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যত-স্বপ্নের স্ফূরিত সংঘর্ষে উৎসারিত হলে সৃষ্টির আরও একটি মৌলিক দিক। ১৯৬৫ সালে লিখলেন (রাজা-র বলা) -

আমাদের মঞ্চ নানাকারণে রবীন্দ্র-নাট্যের গুন সমসাময়িককালে ব্যাখ্যা করতে পারেনি। আর তাই তাঁর পরে এখনো পর্যন্ত নতুন নাটক আমরা কেউ লিখতে পারিনি। এই কালের মধ্যে আমাদের দেশের বিখ্যাত উপন্যাসিক ও নাটককার যাঁরা— শরৎচন্দ্র থেকে আধুনিক সাহিত্যকার পর্যন্ত— কেউই নাটকের কোনো নতুন ফর্ম ব্যক্ত করতে পারেননি।

সাবেক-ফর্ম অর্থে যাকে বলেছি ‘গিরিশ আবর্তের নাটক’। অর্থাৎ শেক্সপীয়ার অনুসৃত নাট্য গঠন। ‘শারদোৎসব’ থেকে যে কাঠামো ভেঙেছেন। ভাঙন শুরু হয়েছে ‘মালিনী’ (মা-৯৬) থেকে। সেই রবীন্দ্রনাথও তো এক সময়কাল পর্যন্ত এড়িয়ে যেতে পারেননি শেক্সপীয়ারকে। তারপর এক দীর্ঘ যাত্রায় পৌঁছেছেন নৃত্যনাট্য ‘চন্ডালিকা’, ‘শ্যামা’-য় । ‘একটি দৃশ্য’, ‘ঘূর্ণি’, ‘উলুখাগড়া’র নাট্যকার ‘রাজা’ পর্বে প্রবেশ করলেন রবীন্দ্রানুভাবী আবর্তে। কিন্তু অনুকরণের পরিবর্তে ঐতিহ্যের আধুনিক সঞ্চয়নে নতূন পথ-সন্ধান। শুরু হলো “চাঁদ বণিকের পালা”-লিখন।

তখন শুরু হয়েছে বাংলা থিয়েটারের দ্বিতীয়-পর্বের সূচনা।

লেখক পরিচিতি - নির্দেশক। নাট্য চিন্তাবিদ



শম্ভু মিত্র
সুনীল দাশ

“... অভিনয়ে বা নাট্যে বাস্তবের এমন একটা রূপ প্রকাশ পায়, যা কেবল লিখিত ভাষার দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। সেই বহু স্তরে একই সঙ্গে চলিষ্ণু বাস্তবের যে জীবন্ত প্রকাশ, তাকেই প্রকাশ করার জন্যে উপন্যাসকার বা গল্পকাররা তখন সাহায্য চান অভিনয়ের। যেখানে তাঁর সূত্র অবলম্বন করে আবার একটা নতুন সৃষ্টি হবে নাট্য।... ” ‘নাটক রক্তকরবী’ গ্রন্থের গোড়াতেই (পৃষ্ঠা ১৩) একথা লিখেছেন শম্ভু মিত্র। আর ওই ‘আবার একটা নতুন সৃষ্টিই নাট্যমঞ্চের নির্দেশক এবং অভিনয় শিল্পীর সহযোগিতায় প্রকৃত প্রাণের স্পর্শ।’

শম্ভু মিত্রের জন্ম ১৯১৫-এর ২২শে অগাস্ট। বাবা শরৎকুমার মিত্র চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন যখন সেই সময় কুড়ি বছরের যুবক শম্ভু মিত্র এন্টার্নস পাশ করে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ পাঠরত। কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নিয়ে শরৎকুমার মিত্র এলাহাবাদ চলে গেলে শম্ভু মিত্রকেও পড়াশোনা বাতিল করে বাবার সঙ্গে কলকাতা ছেড়ে এলাহাবাদ গিয়ে থাকা শুরু করতে হয়। তবে সেটা বেশিদিনের জন্যে। অল্প কিছুদিন পরে ই কাজের খোঁজে তার ফেরা কলকাতায়। আর এই অল্প সময় থেকেই থিয়েটার তাঁকে টানতে থাকে।

ঐসময় অভিনেতা হিসাবে বেশ সুনাম ছিলো ভূমেন রায়ের। ভূমেন রায় সুযোগ করে দেন শম্ভু মিত্রকে রং মহল থিয়েটারে অভিনয় শিল্পী হিসাবে কাজ করার। প্রথমদিকে পুরনো গোটা কয়েক নাটকে কাজ পেলেন। তারপর অভিনয় করলেন বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘মালা রায়’ প্রযোজনায়। বিধায়ক ভট্টাচার্য (১৯০৭-১৯৮৬)-এর দেওয়া আরও একটি প্রযোজনা ‘রত্নদীপ’ নাটকেও অভিনয় করার পর শম্ভু মিত্র রং মহল থিয়েটারে আরও একটি প্রযোজনায় অভিনয় করেছিলেন। রং মহল রঙ্গালয়ে তার ওই শেষ প্রযোজনাটি ছিলো গৌর শীর ‘ঘূর্ণি’।

এরপরের অভিনয় শম্ভু মিত্রের সেই মিনার্ভা থিয়েটারের ‘জয়ন্তী’ নাটকে। ‘জয়ন্তী’ নাটকে একটি প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করে প্রভুত প্রস্বস্তি পেলেন। কিন্তু এই পর্বে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেলো। মিনার্ভা থিয়েটারে সেই সময় অভিনয় করতেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। ছাত্র জীবন থেকে অত্যন্ত মেধাদীপ্ত মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ছিলেন অনুশীলন সমিতির পুলিনবিহারী দাস থেকে শুরু করে বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘাযতীন), আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখের প্রীতিধন্য। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ির ‘সীতা’ নাটকে মহর্ষি বাল্মিকীর ভূমিকায় অভিনয়ের খাতিরে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য শিশিরকুমার ও সমগ্র বঙ্গ রঙ্গ জগতে ‘মহর্ষি’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন।

মিনার্ভা থিয়েটারে কোনও একজন ‘মহর্ষি’-কে অপমান করায় শম্ভু মিত্র প্রতিবাদে মিনার্ভা থিয়েটার ত্যাগ করেছিলেন।

কাজ চলে যাওয়া শম্ভু মিত্রকে এবারেও অভিনয়ের কাজ দিয়ে সক্রিয় রাখলেন অভিনেতা ভূমেন রায়।

রংপুরের ছেলে ভূমেন রায় (১৮৯৯-১৯৫৩) তখনকার নামকরা নটরবি রায়ের ভাই। নাট্যমন্দিরের ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকে পর্তুগীজ জলদস্যু রডার ভূমিকায় অভিনয় করে খুব খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অনুরূপ ভূমিকায় ‘কেদার রায়’ নাটকে কার্ভালো, ‘টিপু সুলতান’ নাটকে মঁসির লালি এবং ‘মেঘনাদ’, ‘গোড়া’, ‘রাবণ’ ইত্যাদি নাট্য প্রযোজনায় নামভূমিয় অভিনয় ভূমেন রায়ের সুনাম প্রসারিত করেছিলো। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধায়ের ‘কালিন্দী’ প্রযোজনায় ঐ সময় মিস্টার মুখার্জীর চরিত্রে নিয়মিত অভিনয় চলছিলো তার নাট্যনিকেতন রঙ্গালয়ে। শম্ভু মিত্রকে ভূমেন রায় কাজ দিলেন নাট্যনিকেতনে। কিন্তু কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে গেলো নাট্যনিকেতন। শিশিরকুমার ভাদুড়ি সেইখানে শুরু করলেন ‘শ্রীরঙ্গম’। ওখানে প্রথম প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হলো নাটক ‘জীবনরঙ্গ’। ‘জীবনরঙ্গ’ নাট্যাভিনয়ে শম্ভু মিত্র অভিনয় করলেন নাটক রচয়িতার চরিত্রে।

বিভিন্ন নাট্য প্রযোজনায়বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের কাজ চলছে তাঁর একটার পর একটা। কিন্তু তাঁর অভিনয় তৃষ্ণার— অন্তরের শিল্প সাধের তৃপ্তি পাচ্ছেন না। সেই প্রচলিত অভিনয় ধারায় কাজ করে ১৯৪৩-এর ২৫শে মে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ভাগমাস বা ভারতীয় গণনাট্য বামপন্থী আদর্শ এবং প্রগতিশীল শিল্পকর্মে অনুপ্রাণিত ফ্যাসী বিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের সহযাত্রী সাংস্কৃতিক সর্বভারতীয় সংগঠন। এই IPTA অর্থাৎ ইন্ডিয়ান পিপলস্‌ অ্যাসোশিয়েসনে বাংলা থেকে ছিলেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, বিজন ভট্টাচার্য, বিষ্ণু দে, দিলীপ রায় প্রমুখ। শম্ভু মিত্র যুক্ত হয়েছিলেন এদের সংগঠনে। এই ভাগনাস প্রযোজনা করলো বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’, ‘জবানবন্দী’, ‘নবান্ন’-এর মতো ভিন্নধারার অভিনয়। ‘নবান্ন’ প্রযোজনা বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন।

পরবর্তী উত্তরণ বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে প্রকৃত অর্থে প্রথম গ্রুপ থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা— ‘বহুরূপী’ নাট্য গোষ্ঠীর দল— ১লা মে, ১৯৪৮-এর আগে ১৯৪৪-এ ‘নবান্ন’ নাটকের অভিনয়ের পরের বছর, ১৯৪৫-এর ১০ই ডিসেম্বর মুম্বাই-এ চলচ্চিত্রকার খাজা আহমেদ আব্বাসের ‘সমুদ্র তরঙ্গ’ ভবনে অভিনেতা বলরাজ সাহানির উপস্থিতিতে শম্ভু মিত্র তাঁর সহ অভিনেত্রী তৃপ্তি ভাদুড়ি (১৯২৫-১৯৮৯)-এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে যুক্ত হয়েছিলেন।

নাট্যাভিনয়ের মঞ্চ ছাড়া প্রত্যক্ষ মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ সেমিনারে প্রশ্নোত্তর যোগমুক্তায় উৎপল দত্তের সঙ্গে যেমন করা সম্ভব হয়েছে আমার, শম্ভু মিত্রের সঙ্গে তেমনটা হয়নি। নাট্যানুষ্ঠানে অভিনয় শিল্পীর ভূমিকায় ছাড়া মঞ্চে কাছাকাছি যে কয়েকবার শম্ভু মিত্রের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানে থেকেছি সেগুলো তাঁর আবৃত্তির আসর। সেখানে তাঁর নাট্যভাবনা নিয়ে নানা জিজ্ঞাসার আগ্রহী হওয়া এবং সরাসরি জবাব পাওয়ার অবকাশ থাকেনি। তাঁর নাট্যবোধ সম্পর্কিত আমার যাবতীয় ধারণা তাঁর নির্দেশিত বিভিন্ন প্রযোজনা দেখে, তাঁর অভিনয় চাক্ষুষ করে, একই প্রযোজনা বারবার দেখে এবং শম্ভু মিত্র প্রণীত ‘অভিনয় নাটক মঞ্চ’, ‘প্রসঙ্গ - নাট্য’, ‘সন্মার্গ-সপযা’, ‘কাকে বলে নাট্যকলা’ এবং ‘নাটক রক্তকরবী’ গ্রন্থগুলো পাঠ করে।

মনে আছে, তরুণ বয়সে ইডেন গার্ডেনে, বিশাল মুক্তমঞ্চে যুব-উৎসবের আসরে আবৃত্তি শুনতে গিয়েছিলাম শম্ভু মিত্রের। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সুদীর্ঘ কবিতা ‘মধুবংশীর গলি’ আবৃত্তি করেছিলেন শম্ভু মিত্র। সেই সন্ধ্যায় শ্রোতা হিসেবে আমার সঙ্গে আমার পাশে বসে শম্ভু মিত্রের আবৃতি শুনতে এসেছিলেন আমাদের কবি বন্ধু শুভ বসু।

স্মৃতি থেকে আবৃত্তি। ওই সুদীর্ঘ কবিতা দরাজ গলায় শুনতে শুনতে আচমকা এক জায়গায়— একটি পংক্তির পর মুহূর্তের জন্যে থামা পরবর্তী শব্দটি বিস্মৃত হয়ে মাইক্রোফোনের সামনে আটকে ছিলো শম্ভু মিত্রের কণ্ঠ অপ্রত্যাশিতভাবে।

শম্ভু মিত্র আটকে যাওয়ার পর মুহূর্তেই আমার পাশে বসা শুভ বসু চকিতে দাঁড়িয়ে গিয়ে শম্ভু মিত্রের উচ্চারিত ‘মধুবংশীর গলি’-র পরের পংক্তি চেঁচিয়ে বলে ওঠামাত্র অতর্কিতে থেমে যাওয়া শ্রুতিমোহন অপ্রতিম শম্ভু মিত্র স্বর তার স্বাতন্ত্রে ঝংকৃত হতে থাকে। আবৃত্তি অনুষ্ঠান ঈপ্সিত সমোজ্জ্বল মহিমায় শেষ হয়।

সামান্য বদল করে মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের দেওয়া নাম ‘বহুরূপী’ গ্রুপ থিয়েটারে প্রথম প্রযোজনা তুলসী লাহিড়ীর (১৮৫৭-১৯৫৯) ‘পথিক’। ১৯৪৯-এর অক্টোবরে ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় ‘পথিক’ নাট্যাভিনয়ের সমালোচনায় লেখা হয়েছিলো “... Sambhu Mitra and his wife Tripti who inputed into their characterization a vital force that could not be distinguished from actual living....”

‘ছেঁড়া তার’ এবং ‘উলুখাগড়া’ প্রযোজনাতেও পাওয়া গেলো বাংলা নাটকের পালাবদলের পদধ্বনি। এরপর বহুরূপীর শম্ভু মিত্রের এই অন্যধারার অভিঘাত রচনার অন্যন্যতায় বাংলা মঞ্চের অভিনব এক অধ্যায়— রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’।

উপন্যাসের নাট্যরূপে; সংলাপে রবীন্দ্র গদ্যের অন্তর্গত কাব্যিক ঝংকারকে ঠিক ঠিক বাজিয়ে তোলার জন্য শম্ভু মিত্র ও বহুরূপীর নিরন্তর সাধনা বাংলা থিয়েটারকে অনাস্বাদিত এক ঐশ্বর্য দিয়েছেন। সেই ইতিহাস শম্ভু মিত্র যেমন লিখেছেন— তেমন আমরা শুনেছি কুমার রায়ের মুখ থেকে।

সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটার (১৯৭১-) এর অন্যধারায় রবীন্দ্র নাটক ‘ডাকঘর’ শম্ভু মিত্রকে দেখানো সম্ভব হয়নি আমাদের। ১৯ মে, ১৯৯৭-তে, শম্ভু মিত্র শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। তার সাত মাস আগে, শম্ভু মিত্রের দীর্ঘকালের নাট্যসঙ্গী, সহযোদ্ধা, বহুরূপীর আর এক শক্তিমন্ত নাট্যব্যক্তিত্ব কুমার রায় এসেছিলেন ৮ অক্টোবর, ১৯৯৬, একাডেমি অফ ফাইন আর্টস মঞ্চে, সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারে ২৫তম প্রতিষ্ঠা উৎসবে জার্মানির প্রবীণ নাট্যনির্দেশক ভোলফরাম মেরিং-এর সঙ্গে যৌথ নির্দেশনায় ‘ডাকঘর’ নাটকের ৮০-তম অভিনয় সন্ধ্যায়। অভিনয়ের আগে ওই সন্ধ্যায় ‘রবীন্দ্রনাট্যের প্রযোজনা প্রসঙ্গ’ বিষয়ক আলোচনা চক্রে ভিন্নমাত্রার বক্তব্য রেখেছিলেন কুমার রায়। কুমার রায়ের আরও দু’জন সেইদিনের আলোচনায় বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন— বিভাস চক্রবর্তী ও ডঃ অরুণ কুমার বসু।

শম্ভু মিত্র নির্দেশিত ও অভিনীত রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ প্রযোজনায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেন, সংলাপের অন্তর্গত সংবেদনকে প্রকাশ করার জন্য অভিনয় শিল্পীকে চিৎকৃত উচ্চারণের বদলে তন্ময়তার গভীরতা রচনায় কত নিষ্ঠাময় অনুশীলনে ব্রতী হতে হয় সেই সন্ধ্যায় তা অত্যন্ত বিশদভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন কুমার রায়। শুনিয়েছিলেন শম্ভু মিত্রের নির্দেশনা রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’, ‘মুক্তধারা’, ‘বিসর্জন’, ‘রাজা’ প্রমুখ বহুরূপী প্রযোজনার সমুজ্জ্বল শিল্প সাধনার ইতিকথা।

উৎপল দত্ত সঠিকভাবেই লিখেছেন, ‘...রবীন্দ্রনাট্য মঞ্চ সফল নয়’ এই ধারণা ভেঙ্গে চুরমার করে শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রনাথকে বাংলার নাট্যামোদী মানুষের খুব কাছে এনেছিলেন। বিস্মৃত হয়ে বাংলার মানুষ লক্ষ্য করলো যে রবীন্দ্র নাটকের যে মুন্সীয়ানা, ব্যঞ্জনা, তার সমকম নাটক আজও সৃষ্টি হয়নি। ...১

গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় আমার নাট্যদীক্ষা উৎপল দত্তের ঘরানায় যখন পিএলটি থেকে বেরিয়ে এসে রবি ঘোষ (১৯৩১-১৯৯৭), শ্যামল সেন (১৯৩৬-১৯৯৩), ভোলা দত্ত, উমানাথ ভট্টাচার্য প্রমুখেরা বললেন চলাচল নাট্যগোষ্ঠী (১৯৬৩)। আবার একই সময় একলব্য ঐকান্তিকতা নিয়ে ফিরে ফিরে দেখেছি শম্ভু মিত্রের নাট্যসৃজন।

রবীন্দ্রনাট্য নির্মাণে শম্ভু মিত্রের শীর্ষচূড় সৃষ্টি রক্তকরবীর পাশাপাশি বাংলা থিয়েটারকে বিশ্বনাট্য প্রযোজনার ধারায় একাত্ম করতে তাঁর অভিনিবেশ। ‘পুতুল খেলা’, ‘রাজা অয়দিপাউস’, ‘দশচক্র’, ‘গ্যালিলেওর জীবন’, ‘স্বপ্ন’, ‘বিভাব’ ইত্যাদি নাট্যাভিনয়ের আন্তর্জাতিক নাট্যাভাবনায় শম্ভু মিত্রের অভিমুখ ভাস্বর।

‘নাটক রক্তকরবী’ গ্রন্থে শম্ভু মিত্র লিখেছেন, ‘রবীন্দ্র নাটক যখন আমরা’ আমাদের বাস্তব প্রতিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে পড়ি তখন দেখি যে সংলাপগুলো একই সঙ্গে দুটো স্তরে সঞ্চরন করে এবং আজকের বাস্তবকে একেবারে নিকট থেকে দেখা, আর একটু দূরত্ব এনে তাকে যেন প্রতীকের আভাসে দেখা। তার চরিত্রগুলোও। বিশু নন্দিনী— এরা সব জীবন্ত মানুষও বটে। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এক একটি। কিন্তু মাঝে মাঝেই এরকম সব কথায় (যেমন, নন্দিনীর মুখে রঞ্জন ও রাজার বর্ণনায়) যেন আমাদের অনুভবের মধ্যে আর একটা দরজা খুলে যায়, যেখানে গিয়ে আমরা— পাঠক ও দর্শকরা- সত্যের আর একটা ডাইমেনশনে পৌঁছায়।

আন্তর্জাতিক ম্যাগসাইসাই পুরষ্কার (১৯৭৬) পাওয়ার আগে সঙ্গীত নাটক একাডেমী পুরষ্কার (১৯৫৯) পেয়েছেন, শম্ভু মিত্র। তিনি সঙ্গীত নাটক একাডেমীর ফেলো নির্বাচিত হয়েছে (১৯৬৬)। পেয়েছেন ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান (১৯৭০/১৯৭৭)-এ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে ভিজিটা ফেলোর গৌরবে বিভূষিত করে। ১৯৮৩-তে শম্ভু মিত্র ‘কালিদাস সম্মান’এ সম্বধিত হয়েছিলেন। ১৯৮৪ এবং ১৯৮৬-তে তাঁকে জব্বলপুর রাণী দুর্গাবতী এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডি-লিট’ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে।

শম্ভু মিত্র তাঁর শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্র নাটক প্রযোজনা ‘রক্তকরবী’ নিয়ে লেখা গ্রন্থ ‘নাটক রক্তকরবী’-তে বলেছেন, ‘এত নাকি আমাদের উন্নতি হয়েছে যে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য বা ধর্মগ্রন্থ লক্ষ লক্ষ সংখ্যায় ছাপা হয়ে কত ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে, তবু সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন যে পৃথিবীতে যুদ্ধও নাকি তেমনই দ্রুত গতিতে বেড়ে যাচ্ছে। প্রথম মহাযুদ্ধের উৎপত্তি এবং তার পরবর্তী অবস্থা দেখেই এই নাটক লেখা। কিন্তু আমরা আজ জানি যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণার পর থেকে এই ৯১ সাল পর্যন্ত এই পৃথিবী কখনও যুদ্ধ শূন্য হয়নি। কোথাও না কোথাও যুদ্ধ চলেইছে। অবিরত। এ কার অভিসম্পাতে?’

শম্ভু মিত্রের লেখা ওই বইয়ের লেখা আরও একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত না করলে তাঁর অনন্য সাধারণ রবীন্দ্র নাটক মঞ্চায়নের অন্তর্গত জীবনদর্শনকে যথাযথ উন্মোচন করা সহজ হবে না। তিনি লিখেছেন, ‘কবি দেখেছিলেন যে এই “শোষণজীবী সভ্যতার ক্ষুধাতৃষ্ণা দ্বেষহিংসা বিলাস বিভ্রম সুশিক্ষিত রাক্ষসেরই মতো।” আজকের পৃথিবীর সমস্ত বড়ো শহরগুলোর ক্রমবর্ধমান অপরাধের সংখ্যা, বলাৎকারের সংখ্যা যখন জানি; যখন জানতে পারি যে যৌন যথেচ্ছার আর ড্রাগসই হলো আমাদের সমস্ত সুসভ্য মানুষের সমাজস্বীকৃতি সুখলাভের পন্থা, তখন খুবই মনে হয় যে, ঠিক রাক্ষসেরই মতো, আমরা সবাই এবং এই সুসভ্য রাক্ষসীয় সভ্যতাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে যক্ষপুরীর শাসনকর্তাদের একটা ভয় দেখাবার ব্যবসা চালু রাখতেই হয়। আজ তো আমরা স্পষ্ট জানতে পেরেছি যে ডাইনের হক বা বামের হক সকল শাসন কর্তাদেরই (সর্দারদেরই) যে দেখানোর ভিত্তিতেই যক্ষপুরীকে অটুট রাখতে হয়। কারণ এর কোনওটাই লক্ষ্মীপুরী নয়।’

‘মরণের পরে’, ‘মানিক’, ‘শুভ বিবাহ’ ইত্যাদি কয়েকটি চলচ্চিত্রতে শম্ভু মিত্রের অভিনয় ধরা আছে। ১৯৯৭-এর ১৯ মে মৃত্যুর আগে ইচ্ছাপত্রে তিনি ‘নীরবে, একটু ভদ্রতার সঙ্গে, সামান্য বেশে, বেশ একটু নির্লিপ্তের সঙ্গে গিয়ে পড়ে যেতে চাওয়ার কথা লিখেছেন।’

লেখক পরিচিতি - লেখক



শম্ভু মিত্র: নাট্যের ভাষা
সৌমিত্র বসু

শম্ভু মিত্র বেশ কিছু নাটক লিখেছেন, তাদের মধ্যে অন্তত একটি, চাঁদ বণিকের পালাকে তো বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা নাটক হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেকগুলি প্রবন্ধ আছে তাঁর, আছে গোনাগুনতি কয়েকটি ছোটোগল্প। কিন্তু সকলেই নিশ্চয় মানবেন যে মানুষটির আসল পরিচয় লেখক হিসেবে নয়, নির্দেশক এবং অভিনেতা হিসেবে। সেলিম আল দীনের কথা মনে রেখে বলা যেতে পারে, একটা সময়ে নাট্যাভিনয় ছিলো মৌখিক সাহিত্যের উপস্থাপনা নির্ভর রূপ, কিন্তু আধুনিককালে তার ভাষা সাহিত্যের ভাষার থেকে বেশ কিছুটা দুরে চলে গেছে। সাহিত্যের সৃজন মানুষের উচ্চারণযোগ্য ভাষা নিয়ে, নাট্য তার সঙ্গে আরও অনেকগুলো উপাদানকে যুক্ত করে। সমস্যা হলো, সাহিত্য কেমন করে ব্যঞ্জনা তৈরি করে তা ব্যাখ্যা করার একাধিক তরিকা তৈরি হয়ে গেছে, কিন্তু নাট্য প্রযোজনা আর অভিনয় কীভাবে তার উপভোক্তার মনে রসের জন্ম দেয় তা বর্ণনা করার উপায় এখনও পর্যন্ত ঠিক ঠিক পাওয়া গেছে এমনটা নয়৷ এই লেখায় আমি এমন কয়েকটি নাট্যমুহুর্তের বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করবো, দেখবার চেষ্টা করবো কেমন করে সেই মুহূর্তগুলি নির্মাণের মধ্যে দিয়ে শন্তু মিত্রের প্রযোজনা তাঁর মনের কথাগুলিকে প্রকাশ করতে পারছে।

তার আগে বলা দরকার, খুব স্বাভাবিক কারণেই শম্ভু মিত্রের সব প্রযোজনা বা অভিনয় আমার দেখবার

সুযোগ হয়নি। বস্তুত, আমার জন্মের মধ্যেই তাঁর করা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ মঞ্চের আলো দেখে ফেলেছে, যখন নাটক দেখার বয়সে পৌঁছেছি তার আগেই তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন নতুন নাটকের প্রযোজনা করা। পুরনো প্রযোজনাগুলি পরে অভিনয় করেছেন মাঝে মাঝে, তাদের মহলা এবং অভিনয় দেখবার সুযোগ ঘটেছে, কখনও হয়তো তাই নিয়ে দুটো কথা বলবার সৌভাগ্যও পেয়েছি। চাঁদ বণিকের পালার মহলা দিতে শুরু করেন তিনি সাতের দশকের মাঝামাঝি থেকে, সেখানে আমার ভাগ্যে জুটেছিলো লখীন্দরের পার্ট, তার বেশ কিছু স্মৃতি মনের মধ্যে অক্ষয় হয়ে আছে। তার বাইরে বহুরূপীর বড়োদের মুখে অনেক কথা শুনেছি, তারাও চলে আসতে পারবে আলোচনার মধ্যে। এই সব নিয়েই এই লেখা, শম্ভু মিত্রের নাট্যভাষা— এ তাঁর নাট্যভাষার সম্পুর্ণ মূল্যায়ন নয়।

তার আগে দু’একটা তত্ত্বকথা বলে নেওয়া দরকার। ভাষা বলতে বুঝি যা দিয়ে মানুষ তার মনের ভাব

প্রকাশ করে। তা যে শুধুই মানুষের উচ্চারণযোগ্য শব্দ দিয়েই হতে হবে তার কোনও মানে নেই। পশুও শব্দ করে তার মনের ভাব প্রকাশ করে, তাকে তার ভাষা বে মনে করতে বাধা নেই। তার বাইরেও, আকার ইঙ্গিত, এমন কি নৈঃশব্দ দিয়েও মনের ভাব অন্যের কাছে পৌছে দেওয়া যায় তা আমরা সকলেই জানি। মুখের ভাষা, যা নিয়ে মুখ্যত ভাষাবিজ্ঞানীদের কাজ, নাট্যভাষা তার আওতা ছাড়িয়ে আরও বহুদুর প্রসারিত হতে পারে। নাট্য, আমরা জানি, চোখ দিয়ে দেখতে হয় এবং শুনতে হয় কান দিয়ে। কিন্তু ভাবলে দেখা যাবে, শুধু চোখ আর কান নয়, অর্থবহ যা কিছু আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় দিয়ে প্রবেশ করতে পারে তার সবটাই ভাষার অন্তর্গত। শম্ভু মিত্রের কাজ থেকে তার উদাহরণ দেওয়া যাবে, তার আগে বলে নিতে চাই, আওয়াজ দিয়ে তৈরি করা এক একটি শব্দের যে আমরা এক একটি অর্থ ধরে নিয়ে থাকি, তার পেছনে কোনও অনিবার্ধ যুক্তি নেই। কাগজ

বললে যা বুঝি তার নাম অন্য কিছুও হতে পারতো, কলম বললে যে ছবি ভেসে ওঠে, সে ছবির বদলে জানলার ছবি মনের মধ্যে যে জেগে ওঠে না তার একমাত্র কারণ শব্দগুলির ওই অর্থ আমাদের ছোটোবেলা থেকে শেখানো হয়েছে, এখন তারা আমাদের সংস্কারের অন্তর্গত হয়ে গেছে। যখন কোনও লেখায় সেই শব্দ বা শব্দগুলি পড়ি, অথবা কারুর মুখে শুনি, তখন সেই শব্দের ব্যঙ্গার্থ আমরা নিজের নিজের বুদ্ধি বিবেচনামতো বার করবার চেষ্টা করি বাক্য বা গোটা রচনার তাৎপর্যের ভিত্তিতে। তাই, বাক্যটি এক হওয়া সত্ত্বেও, দু’জন সম্পন্ন সুখী বন্ধুর মধ্যে কথা হওয়ার সময় একজনের মুখে আমি ভালো আছি বাক্যটি যে মানে প্রকাশ করে, ধরা যাক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া স্বামী-স্ত্রী, এই বিচ্ছেদ যাদের অন্তত একজনের জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে, তার মুখে ওই একই বাক্য অন্য অর্থ তৈরি করে৷

এই নিয়ে সাহিত্যের কাজ, এই নিয়ে নাট্যেরও কাজ। শুধু উচ্চারিত শব্দ দিয়ে নয়, নাট্য আরও নানা শব্দ দিয়ে অর্থ তৈরি করতে পারে, তৈরি করতে পারে নানা দৃশ্য দিয়েও। শম্ভু মিত্রের প্রযোজনা থেকে একটা উদাহরণ দিই। ইবসেনের আ ডলস হাউস নাটকের বাংলা রূপান্তর পুতুল খেলায় দুটি চরিত্রের কথা হচ্ছে, ডাক্তার রায় আর বুলু। ডাক্তারের পূর্বপুরুষের নানা ব্যভিচারের ফল হিসেবে তাঁর শরীরে মারাত্মক অসুখ বেঁধেছে, নিজে ডাক্তার বলে তিনি তাঁর আশু মৃত্যু বিষয়ে নিশ্চিত। তিনি মনে মনে বুলুকে ভালোবাসেন, বুলু তপনের স্ত্রী, আপাতদৃষ্টিতে খুবই সুখী দাম্পত্য তাদের। দৃশ্যটি হলো, ঘরের মধ্যে ডাক্তার আর বুলু, মেঘলা বিকেল। একটা বড়ো রকমের সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে বুলুবেশী তৃপ্তি মিত্র বললেন, ডাক্তার রায় আপনি তো জানেন ও আমার জন্যে প্রাণ পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে। ডাক্তার একটু খাদের গলায় কিছুটা গাট় স্বরে বলেন, ও কেবল একলাই তা পারে? বুলু একলাই— বলে থমকে যায়, যেন বুঝতে পারে কোনও একটা অকথিত সংলাপ ডাক্তারের কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। ডাক্তার বলেন, হ্যাঁ, ও কেবল একলাই তোমার জন্যে সবকিছু করতে পারে বুলু? একটু থেমে বুলু? তারপর অন্যরকম চড়া গলায় মিসেস চ্যাটার্জি! আমি ঠিক করেছিলাম একেবারে চলে যাবার আগে এই কথাগুলো আপনাকে জানিয়ে দিয়ে যাব৷ এখন তো আপনি সব জানতে পারলেন, এখন কি আপনি আমাকে বিশ্বাস করে সব কথা বলতে পারেন না? বুলু ব্যথিত কণ্ঠে বলে, এই কথাগুলো আপনি কেন বললেন ডক্টর রায়। আমরা কী রকম বন্ধু ছিলাম। ততক্ষণে মেঘলা বিকেল সন্ধ্যের দিকে ঢলে পড়েছে, ঘর আবছা হয়ে এসেছে। বুলু হঠাৎ ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে বলে— এখন আপনার একটু একটু লজ্জা করছে না?

অনেক দিন আগের দেখা, সংলাপের কিছুটা এদিক ওদিক হতে পারে। ছাপা বইয়ের সাহায্য নিয়ে লাভ নেই, অভিনেতা সব সময়েই যে হুবহু সংলাপ বলবেন তা নাও হতে পারে। কিন্তু এই যে দু’জন মানুষের মনের গহন স্তরকে উন্মোচিত করার মুহূর্ত, তার সঙ্গে শম্ভু মিত্র একটি মেঘলা, নিবিড় বিকেলকে পশ্চাৎপটে রাখলেন, মুহূর্তটির ব্যঞ্জনা আরও গভীর হয়ে উঠলো। পুতুল খেলাতেই শম্ভু মিত্রের করা এমন বাঙ্ময় দৃশ্যের কথা আরও মনে পড়ে৷ বিজয়া সম্মিলনীর সন্ধ্যেবেলা তপন আর বুলুর ঘরে আসেন ডাক্তার রায়। সেদিন তিনি নিশ্চিত হয়ে গেছেন নিজের মৃত্যু সম্পর্কে। তপনের কাছে সিগারেট চান, যা তিনি কখনও খান না। বুলু আসে সিগারেট ধরিয়ে দিতে। মুখে সদ্য আগুন লাগানো সিগারেট, তার আভা অল্প পড়েছে মুখের ওপর, ডাক্তাররাপী কুমার রায় বলতেন, ধন্যবাদ। আগুনটা জ্বালিয়ে দিলেন বলে ধন্যবাদ। নমস্কার... নমস্কার বলতে বলতে চলে যেতেন। আগুন শব্দের যে নানা স্তরের মানে তৈরি হতো ওই সংলাপটিকে ঘিরে, তার পেছনে তৃপ্তি মিত্রের ওই জ্বলন্ত দেশলাই নিয়ে হাত বাড়িয়ে রাখার একটা ভূমিকা তো থাকতোই। এই প্রসঙ্গে খালেদ চৌধুরীর করা মঞ্চনির্মাণ প্রসঙ্গেও বলতে হবে। বলা বাহুল্য, শম্ভু মিত্র অনুমোদন করেছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে এমন মঞ্চ পরিকম্পনা করা সম্ভব হয়েছিলো। নাটকের প্রথমার্ধে, হাসিখুশি বুলু প্রচুর বাজার করে ঘরে আসে। সুখী একটি জীবন তাদের, খালেদ চৌধুরী বেডকভার বা জানলার পর্দার রঙ করেছিলেন ঝকঝকে, উজ্জ্বল। দ্বিতীয়ার্ধে ঘটনা যখন সঙ্কটের দিকে বাঁক নিয়েছে, তখন তাদের রঙ হয়ে যায় খানিকটা দমচাপা, গায়ে আঁকা থাকে জালের আঁকিবুকি। কোথাও দর্শকের মনের মধ্যে এই রঙের বিষন্নতা ছায়া ফেলতে থাকে, ওই জালের অলঙ্করণ যেন বুলুকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরতে চায়।

চার অধ্যায়ের নাট্যরূপ করেছিলেন বহুরূপী, শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায়। তার দ্বিতীয় দৃশ্য এলার ঘর। সেখানে অন্তু আর এলা বসে আছে৷ পেছনে গেরুয়া রঙের একটি আকাশী পট, ইন্দ্রনাথের কাছে এলা কথা দিয়েছিলো, সে আজীবন কুমারী থাকবে। একটি নিচু সোফায় বসতেন তৃপ্তি মিত্র, শন্তু মিত্রের অতীন বসতেন তাঁর পায়ের কাছে। নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে বলতে উঠে পড়ে মোকামা ঘাটের স্মৃতি, অতীন আবৃত্তি করে— প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস/ তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ। সেই মুহূর্ত থেকে চরিত্রদের মুখের ওপর থেকে আলো মুছে যায়, সূর্যাস্তের আলোর রঙে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পেছনের গেরুয়া কাপড়। এলার ঘর মুহুর্তের মধ্যে একটা অনন্তের বিস্তৃতি পায় আলোর সামান্য কারিকুরিতে। এই দৃশ্যের শেষে, হঠাৎই চিঠি পেয়ে ঘর থেকে চলে যায় অতীন, এলা তখন ভেতরের ঘরে গেছে। ফাঁকা মঞ্চে প্রবেশ করে এলা, তার অন্তুকে ডাকতে থাকে, আলো ম্লান হয়ে যায়। শুধু মঞ্চের এককোণে রাখা বুক কেসের ওপরে রাখা একটি কালীর ছবি থাকতো, জবাফুল দিয়ে ঢাকা, সব আলো নিভে গিয়ে সেই জবাফুলের আড়াল থেকে একটু আলো পড়ে দেবীর মুখে, নিচ থেকে পড়া আলোয় সে মুখ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তখন মনে পড়ে, নাটকের সুচনায়, তৃতীয় ঘণ্টা বাজবার পরে ঘোর অন্ধকারে শোনা গিয়েছিলো এক, ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা, শুষ্ক মাংসে অতি ভয়ঙ্কর, রক্তহিমকরা হুঙ্কারে চতুর্দিক প্রকম্পিত করা এক দেবীর বর্ণনা। এও মনে পড়ে, আমাদের হিংসাশ্রয়ী স্বদেশীদের পুজ্য ছিলেন দেবী কালী, চার অধ্যায়ের উপন্যাসে নেই, কিন্তু প্রযোজনায় সেই কালীর রূপকে নানাভাবে আভাসিত করে তোলা হয়েছে৷ আর একটি ছবির কথা বিশেষ করে মনে পড়ে। চার অধ্যায় নাটকের এ হলো শেষ দৃশ্য। দৃশ্যটি ঘটছিলো এলার বাড়ির ছাদে। বাড়িতে তখন কেউ নেই, রাত তখন প্রায় এগারোটা।

মঞ্চ প্রায় ফাঁকা থাকতো, যেমন থাকে বাড়ির ছাদ। পেছনের মঞ্চে থাকতো নিচু ছাদের পাঁচিল, তার ওপারে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির আলো। দুটি জানলা থেকে চৌকো দুটি আলো দেখা যাচ্ছে, আর মাঝখানে একটা লম্বাটে আলোর রেখা, সিঁড়ির আলো বলে বোঝা যায়। এলাকে খুন করতে এসেছে অন্তু, দলের নির্দেশে। নানা কথা হয় দু’জনের মধ্যে, রাত বারোটার ঘণ্টা পড়ে, জানলাদুটির আলো নিভে যায়, শুধু মাঝবরাবর সিঁড়ির আলো জ্বলতেই থাকে। যেন এই দুটি পরস্পরের প্রতি উৎসুক নরনারী, যাদের ঘিরে আছে অনিবার্য মৃত্যু, তাদের ওপর পাহারাদারি করছে কোনও একচোখো দানব। সামনের মঞ্চে, দর্শকের ডানদিকে একটি শ্যাওলাধরা ফুলের টব, তাতে আছে ক্যাকটাস, মোটা পাতায় কঠিন, অনমনীয়, কাঁটাওয়ালা। কথা বলতে বলতে পুরনো দিনের কথা ওঠে, এলা অন্তুকে ছেড়ে বাইরে যায়, হাতে করে নিয়ে আসে মুঠো মুঠো সাদা ফুল। অন্তুর কাছে এসে সেই ফুল সে ছুঁড়ে দেয় শুন্যে। দু’জনের গায়ে মাথায় এসে পড়ে সেই ফুল, গোল হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে থাকে, অবধারিতভাবে ফুলশয্যার অনুষঙ্গ মনে পড়ে যায়।

এমন উদাহরণ আরও দেওয়া সম্ভব। তার আগে অন্য দু-একটি কথা বলে নিতে হবে। শিল্পীরা জানেন, নানাধরনের রেখা মানুষের মনে নানাধরনের মনোভাব তৈরি করে। সোজা সরল একটি রেখা, উল্লম্ব হয়ে উঠে গেছে ওপরের দিকে, দেখলেই মনে আসে ঋজুতার অনুষঙ্গ। ঠিক তেমনি নিচের দিকে ঝুঁকে পড়া কোনও রেখা তৈরি করে আনুগত্য বা বশ্যতার অনুষঙ্গ। রাজা অয়দিপাউস নাটকে মুল মঞ্চের একটু পেছন থেকে তৈরি করা হতো নানা আকারের কয়েক ধাপ বেদী। সেই সব বেদীর একেবারে ওপরে, মুল মঞ্চ থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে থাকতো সূর্য অঙ্কিত একটি তোরণ। দেশে মড়ক দেখা দিয়েছে, তাই প্রজারা এসেছে রাজার কাছে দেশকে দুর্দশা থেকে মুক্ত করার প্রার্থনা জানাতে। প্রার্থীরা থাকতো নিচে, মূল মঞ্চে, তাদের মাথা থাকতো নিচু, আর তাদের আহ্বান শুনে অয়দিপাউস বেরিয়ে আসতেন সেই উঁচু তোরণে, দু’হাত দিয়ে তোরণের দুটি থামকে স্পর্শ করে।

উল্লম্ব সরলরেখার বহু নিচে থাকতো প্রার্থীরা, এইভাবে রাজার মহিমার সামনে নতজানু প্রার্থীদের বিন্যস্ত করা হতো।

নাটকের শেষে, সেই উঁচু তোরণ দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে নেমে আসতো অসহায় অয়দিপাউস, প্রথম দৃশ্যের ঋজুতা তখন অন্তর্হিত— এইভাবে, শুধু দুটি দৃশ্যের বিন্যাসে গৌরবময় অধিকার থেকে পতনের ছবি তুলে ধরা হতো। আর একটি অসাধারণ নাট্য মুহুর্তের কথা বলতে ইচ্ছে করছে। অয়দিপাউসকে হত্যা করার জন্য যার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিলো সেই মেষপালককে আনা হয়েছে মঞ্চে, সে বসে আছে মুল মঞ্চে, আর তার দু’ধাপ ওপরের বেদী থেকে তাকে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে অয়দিপাউস। চরম সত্য আবিষ্কারের ঠিক আগে মেষপালক হাহাকার করে ওঠে, রাজা, আমি যে আজ এক সর্বনাশের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছি। অয়দিপাউসরূপী শল্ভু মিত্র বলতেন, আমিও যে সেই সর্বনাশের কিনারায়, বলে লাফ মারতেন বেদী থেকে, টিপে ধরতেন মেষপালকের গলা।

শুধু অভিনয় নয়, এই অংশে প্রযোজনারও একটি কারুকাজ ছিলো। বেদীর ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা রাজাকে ধরে থাকতো আলো, আর নিচে মেষপালককে, মাঝখানের অংশটি থাকতো অন্ধকার। ফলে, মেষপালকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার সময় শম্ভু মিত্র একটা অন্ধকারের স্তর পার হয়ে আসতেন, দেখে মনে হতো যেন অনেক উঁচু থেকে নিচে লাফিয়ে পড়লেন তিনি। মনে হয়, এ লাফ কি কেবলমাত্র মেষপালকের গলা টিপে ধরার জন্য?

আমিও এক সর্বনাশের কিনারায় বলে যখন লাফ দেন অয়দিপাউস, তখন মনে না হয়ে পারে না, সেই কিনারা থেকে তিনি যেন লাফ দিয়ে পড়লেন সর্বনাশের মধ্যে।

অয়দিপাউসের সঙ্গে একই নাট্যোৎসব প্রযোজিত হয়েছিলো রাজা। একেবারেই অন্য রকম এই নাটক, রাজা অয়দিপাউসের তুলনায় তো বটেই, এর আগে করা বহুরূপীর রবীন্দ্র প্রযোজনাগুলির থেকেও এর জাত আলাদা। চার অধ্যায় বা বিসর্জনে একটা স্পষ্ট আখ্যান আছে, রক্তকরবীতেও তাই, সেই সব নাটকে দ্বন্দ্বের ধরন কম-বেশি দর্শকের অভিজ্ঞতার কাছাকাছি। রাজা কিন্তু এদের তুলনায় একেবারেই আলাদা ধাঁচের নাটক, যার সম্পর্কে রাজার কথায় নামের প্রবন্ধে শম্ভু মিত্র বলছেন, প্রায় নিরাভরণ একটি মঞ্চে অভিনীত হতো এই নাটক। প্রযোজনার চোখে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এ নাটকে আলো অন্ধকারের একটি বহু স্তরায়িত দ্বন্দ্ব আছে৷ সুদর্শনা আর রাজার ঘর অন্ধকার। বসন্তোৎসবের রাজপথ আলোকময়, আবার মোহ ভেঙে সত্যিকারের বাইরে চলে আসা, আলোয় চলে আসার পরের যে আলো, তার ধরন বসন্তোৎসবের থেকে তো খানিকটা আলাদাই হতে হবে।

নির্দেশক জীবনের শেষ পর্বে শম্ভু মিত্র ফিরে এসেছিলেন আধুনিক সময়ের দিকে। অন্তত তাঁর চোখে সে

সময় জুড়ে ছিলো অন্ধকার, যে অন্ধকারের ছবি আমরা দেখতে পাবো চাঁদ বণিকের পালার মধ্যে। তখন তিনি সুস্থ নন, চোখে ভালো দেখতে পান না। তা সত্যেও কী করে ভোলা যাবে বাকি ইতিহাস নাটকে সেন্টার টেবিলের তলা থেকে বেরিয়ে আসা আলোয় শরদিন্দুর ভয়ার্তমুখ, পেছনে আত্মহননের পক্ষে সীতানাথের সওয়াল, যে আসলে সেই শরদিন্দুরই মনের চেপে দেওয়া অংশ? কী করে ভোলা যাবে পাগলা ঘোড়া নাটকের কথা, যেখানে একটিমাত্র চৌকিতে বসে থাকা মদ্যপানরত চারটি চরিত্রের বিবিধ সংস্থাপন বা কম্পোজিশনে নানা অর্থময় মূর্তি তৈরি হয়ে উঠতো?

এটা আসলে একটা অর্থহীন প্রবন্ধ। নাট্য কেমন করে মঞ্চের ওপর তার ভাষা তৈরি করে, উচ্চারণযোগ্য

ভাষায় সে রহস্যের বিবরণ দেওয়ার সাধ্য এই লেখকের নেই। যাঁরা এই প্রযোজনাগুলি দেখেছেন, এ লেখা শুধু তাঁদের স্মৃতিকেই উসকে দিতে পারে৷

লেখক পরিচিতি - অভিনেতা



ঘূর্ণি: বাঁকের মুখে শম্ভু মিত্র
অংশুমান ভৌমিক

তাঁর নট ও নির্দেশক পরিচয় এতই কূলপ্লাবী যে নাটককার শম্ভু মিত্রকে আমরা বড়ো একটা মনে রাখি না। কেউ কেউ চাঁদ বণিকের পালার কথা বলেন। চাঁদ বণিকের পালা তাঁর সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী রচনা। এর মঞ্চায়ন যে হতে পারেনি এ আক্ষেপ তাঁকে আমৃত্যু দগ্ধ করেছে। ইদানীং তাঁর আরেকটি নাটক – বিভাব – পশ্চিমবঙ্গে উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরে বাংলা ‘ক’ ভাষার অবশ্যপাঠ্য হয়েছে। বিভাব অবশ্যি প্রযোজিত হয়েছিল, বহুরূপীর বরস্পর্শে।

এছাড়াও তাঁর আরও কিছু নাটক আছে। সম্প্রতি তাঁর কন্যা শাঁওলীর সম্পাদনায় খণ্ডে খণ্ডে শম্ভু মিত্রের রচনাসমগ্র বেরোচ্ছে। এর দরুন নতুন করে পড়া যাচ্ছে অনেক লেখা। একেবারেই পড়া হয়নি বা পড়ার উপায় ছিল না এমন সব লেখাও এখন হাতের নাগালে এসে গেছে। এসবের মধ্যে একটি নাটকের কথা আমরা বিশেষভাবে বলতে চাই। নাটকটির নাম ঘূর্ণি।

প্রয়াণের ঠিক এক বছর আগে, ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে কলেজ স্ট্রিটের খানদানি প্রকাশক এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স থেকে প্রারম্ভিক নামে তাঁর দুটি নাটক সংকলিত হয়। এই বইয়ের একটি নাটক উলুখাগড়া, অপরটি ঘূর্ণি। এই বইয়ে ‘নিবেদন’ শিরোনামে যে বয়ান ছেপেছিলেন শম্ভু তার থেকে জানা যাচ্ছে – ‘ঘূর্ণি লেখা শুরু হয়, যতোদূর মনে পড়ে, ১৯৫০ সালের শুরুতে, বোম্বের এক হোটেলের নির্জন ঘরে’, আর ‘তার পরের বছর বোধহয় একটা কঠিন ব্যাধিতে শয্যাগত হবার পর এ নাটক শেষ হয়।’ তখন বোম্বেতে কী করছিলেন শম্ভু? পল জিলসের পরিচালনায় আওয়ার ইন্ডিয়া (হিন্দিতে হিন্দুস্তান হামারা) ছায়াছবিতে অভিনয় করছিলেন। ফিরে সদ্যগঠিত বহুরূপীর একের পর এক নাটক নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। এক বছরের মধ্যে উলুখাগড়া, ছেঁড়াতার, বিভাব, চার অধ্যায় প্রযোজনা করেন বহুরূপী। এরপর ঘূর্ণি লেখায় ফিরে যাবার ফুরসত পেয়েছিলেন শম্ভু। এ নাটকের প্রথম অঙ্কের সঙ্গে শেষ দুটি অঙ্কের এত ফারাক – গড়নের দিক থেকে তো বটেই, তার রকমসকমও এত আলাদা গতের – যে ওই কালান্তর আমাদের চোখ এড়ায় না।

বহুরূপী পত্রিকার ত্রয়োবিংশ সংখ্যায় এটি ছেপে বেরিয়েছিল, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে। বই হয়ে বেরোয় বছর খানেক বাদে, ১৩৭৩ বঙ্গাব্দের ৩১ ভাদ্র, ২০৯বি বিধান সরণির ‘গ্রন্থপীঠ’ প্রকাশন সংস্থা থেকে।

ঘূর্ণি কখনও মঞ্চস্থ হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এ নিয়ে বড়ো একটা লেখালেখি হয়েছে এমনও নয়। শম্ভু মিত্রের প্রয়াণের পর রথীন চক্রবর্তী সম্পাদিত নাট্যচিন্তা পত্রিকা যে শম্ভু মিত্র সংখ্যা বের করেছিল, তাতে শেখর সমাদ্দার ‘নাট্যকার শম্ভু মিত্র’ শিরোনামে একটি মূল্যবান বিশ্লেষণ করেছিলেন। তাতে শম্ভুর অন্যান্য নাটকের পাশাপাশি ঘূর্ণির কথাও আলোচিত হয়। তাঁর ভেতরে নট ও নাট্যকার সত্তার লাগাতার দ্বন্দ্বের কথা তুলে শেখরের মনে হয়েছিল, ‘হয়তো ... অভিনয়ের সমগ্র রূপটিকে ধরা যায়নি বলেই তাঁর লেখা বেশ কিছু নাটকের অভিনয় হতে পারেনি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ঘূর্ণি’ ও ‘চাঁদ বণিকের পালা’।’

হালে সত্য ভাদুড়ি সম্পাদিত নাট্য আকাদেমি পত্রিকার ‘শম্ভু মিত্র জন্মশতবর্ষপূর্তি সংখ্যা’য় ‘ক্ষমতা, অন্ধকার ও একক কণ্ঠস্বর: শম্ভু মিত্র-র পাঁচটি নাটক’ শিরোনামে একটি আলাদা গতের প্রবন্ধ লিখেছেন অর্ণব সাহা। তাঁর মনে হয়েছে – ‘খুব সচেতনভাবেই শম্ভু মিত্র সদ্য স্বাধীনতা-পরবর্তী বাঙালির বাম মতাদর্শগত লিগ্যাসি থেকে বের করে আনলেন বিশ্বযুদ্ধ-দুর্ভিক্ষ-দাঙ্গা-সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির সংস্পর্শে শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্দ্বন্দ্ব, পিছুটান, দ্বিচারিতা এবং স্বপ্নের ভগ্নাবশেষকে। সেই ‘নবান্ন’ (১৯৪৪) থেকে শুরু করে তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’ (১৯৫০) পর্যন্ত বাংলা থিয়েটারের ‘প্রগতিশীল’ ধারায় সমাজবাস্তবতার উপস্থাপন এবং সামাজিক সংগ্রামের যে প্রাধান্যমূলক এসেনসিয়ালিস্ট ছক, সামাজিক শোষণ এবং তার বিরুদ্ধে সমষ্টিগত প্রতিরোধের যে চালু ফর্মুলা, নাট্যজীবনের সেই প্রারম্ভিক পর্যায়েই শম্ভু মিত্র তা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন।’ একেবারে ‘বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন’ কিনা বা আদৌ বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন কিনা – এ নিয়ে আমাদের সংশয় আছে। তবে উত্তর-১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের যে সামাজিক পটভূমিতে শম্ভু এ নাটক সাজিয়েছিলেন তার সম্পর্কে ১৯৯৬তে তিনি কী লিখেছিলেন সেটি এখানে স্মরণ করতে চাই।

প্রথমেই শোনা গেল এ আজাদী সত্য নয়, এটা মিথ্যা। দলে দলে ছিন্নমূল লোকেরা এসে পশ্চিমবঙ্গের স্বল্প পরিসরকে ভরিয়ে রেখেছে, এবং এখনো রাখছে। তখন সকলে মিলে মানুষের দুর্দশা দূর করার চেষ্টার বদলে রাজনৈতিক দলেরা ছিন্নমূলেদের নিয়ে ব্যবসা শুরু করল। গড়া নয়, ভাঙা – এই যেন হল স্পর্ধিত প্রগতির কথা। ট্রাম জ্বালানো, ট্রেন ওড়ানো, পুলিশের গুলি চালানো, - সব যেন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠল। পার্লামেন্টারি ডিমোক্র্যাসির প্রাথমিক সভ্য নিয়মগুলো দেশের লোক বোঝবার আগেই অ্যাসেম্বলিতে চটি ছোঁড়াছুঁড়ি হতে লাগল। লোকে শিখল যেমন করে পারো মেরে খাও। তখন কাকে না গালি দেওয়া হয়েছে? রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে? এরই পটভূমিকায় এবং নাট্যপ্রযোজনায় একটা নতুন ভঙ্গি আবিষ্কারের চেষ্টায় – ঘূর্ণি লেখবার কষ্টকর প্রচেষ্টা।

পাঠক, খেয়াল করুন যে ‘নাট্যপ্রযোজনায় একটা নতুন ভঙ্গি আবিষ্কারের চেষ্টায়’ কীভাবে মেতে উঠেছেন বহুরূপীর প্রয়োগপ্রধান। শুধু ভালো করে ভালো নাটক করা নয় বা সামাজিক দায়িত্ববোধের প্রকাশ ঘটানো নয়। ‘নতুন ভঙ্গি’ খুঁজছেন শম্ভু। বদলে দিতে চাইছেন নাট্য প্রযোজনার আঙ্গিক। একে সাহেবি ধাঁচার প্রসেনিয়াম থিয়েটারকে ছুঁড়ে ফেলার মতো অবিমৃষ্যকারিতা ভাবলে ভুল হবে। আবার সে আমলে শিশির কুমার ভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরী, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত যে ‘জাতীয় নাট্যশালা’র কথা ভাবছেন তার পন্থাপদ্ধতির সঙ্গে এই খোঁজকে মেলানো যাবেনা। এমনকি বছর পাঁচেক আগে বিজন ভট্টাচার্যকে পাশে নিয়ে তৈরি নবান্নর প্রয়োগপ্রকরণকেও আর ইস্তেমাল করতে চাইছেন না শম্ভু। ভঙ্গির খোঁজ একটু একটু করে তাঁকে নতুন বিষয়বস্তুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নতুন ভারত রাষ্ট্রের উপযোগী এক নাট্যরীতির নীলনকশা ছকে ফেলতে চাইছেন দ্রুত। এই বাঁকের মুখে ঘূর্ণির আবির্ভাব।

এই ধরতাইটুকু নিয়ে আমরা নাটকের আলোচনায় ঢুকে পড়তে চাই।


ব্রিটিশ ঘরানার প্রসেনিয়াম থিয়েটার যাকে ড্রয়িংরুম ড্রামা বলে এ নাটকের শুরু একেবারে সেই রকমের। প্রথম অঙ্ক প্রথম দৃশ্যের যে মঞ্চনির্দেশ দিচ্ছেন শম্ভু তা ব্রিটিশ রিয়্যালিস্টিক ড্রামার কেতা মেনেই। দক্ষিণ কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ‘বাইরের ঘর’কে দেখাতে চাইছেন নিবিড় অনুপুঙ্খতায়। মনে রাখতে হবে যে ১৯৪৯-৫০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার দক্ষিণ সীমানা বালিগঞ্জ, কালীঘাট অবধি।

নাটক শুরু হতেই প্রিন্টিং প্রেসের কারবারি দেবেন মুখুয্যের মেয়ে খুকু ‘হাতে টোস্ট আর চা নিয়ে ঢুকল গান গাইতে গাইতে।’ কী গান? ‘চা চাই গো, চা চাই’। একটু তলিয়ে ভাবলে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে গানটি চণ্ডালিকা নৃত্যনাট্যের ‘দই চাই গো, দই চাই’ ভেঙে গড়া। এর বছর দশেক আগে কলকাতায় প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছে চণ্ডালিকা এবং ব্রাহ্ম সমাজ ঘনিষ্ঠ কিছু পরিবারের উৎসাহে তা একটু একটু করে ছড়াতে শুরু করেছে। আমরা বুঝি যে মহানগর কলকাতার সাংস্কৃতিক মানচিত্রে তাঁর নাটকের কুশীলবদের অবস্থান ঠিক করে নিয়েই সুতো ছড়াতে শুরু করছেন শম্ভু।

দেবেন মুখুয্যের এক ছেলে প্রণব। ‘সিনেমা-রেডিয়োতে আধুনিক বাংলা গান গায়।’ এ নাটক তাঁকে নিয়ে বেশি একটা ভাবে না। আত্মকেন্দ্রিক যুবশ্রেণির এক প্রতিনিধি হিসেবে চেনায়। তারপর সরিয়ে দেয়। দেবেনের দুই মেয়ে খুকু আর সুসি। পিঠোপিঠি দুই বোন। ছোটো জন জানে যে দেনার দায়ে ছাপাখানা বেচতে হচ্ছে দেবেনকে, তাই সে টুইশানির চেষ্টা দেখে। বড়ো বোন খুকু এ সবের ধার ধারে না। বোনের গুণপনা নিয়ে বাড়িতে যে কথা চালাচালি হয় এ তার অসহনীয় মনে হয়। অন্যভাবে সে নজর কাড়ে। তাঁদের মামা অবিনাশ চাটুয্যে – যাঁর কোম্পানির কাছে বাঁধা আছে ওই ছাপাখানা – এলে সে মামার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অকৃতদার অবিনাশ ভাগ্নিকে প্রশ্রয় দেন, উপরন্তু প্রকাশ্যেই ‘পুষ্যি’ নিতে চান খুকুকে। খুকু-সুসির মা বীণা নিজের সহোদরের আপাত ভালোমানুষির আড়াল সরিয়ে দেন। নাটককার শম্ভুও বুঝিয়ে দেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলে ফাটকা খেলে ফুলেফেঁপে ওঠা এই ব্যাবসায়ী শ্রেণির প্রতি তাঁর কোনো দরদ নেই। তাঁর সব সহানুভূতি আদর্শবান দেবেনের প্রতি। দেবেনের মধ্যে গোরা উপন্যাসের পরেশের একটা আদল তৈরি করেন শম্ভু। সুসির মধ্যে সুচরিতার। তাঁদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ দুই যুবক – বিকাশ ও সমীরের মধ্যেও গোরা-বিনয়ের কিছু বৈশিষ্ট্য আলগা ভাবে ধরা পড়ে।

সাধারণ ঘরের ছেলে বিকাশ বোস সাংবাদিক। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী। খুকুর হবু স্বামী, সুসির রাজনৈতিক দীক্ষাগুরুও বটে। ‘সমীর রায়, বাংলা রাগসংগীতের দক্ষ তরুণ শিল্পী’, ‘একুশখানা বাড়ির বাড়িওয়ালার একমাত্র ছেলে’। সুসির সংগীত শিক্ষক, তাঁকে পাণিপ্রার্থী।

এই অবস্থান থেকে নাটক শুরু হয়। প্রথম অঙ্ক দ্বিতীয় দৃশ্যে দেবেনের সঙ্গে বিকাশের দীর্ঘ আলাপ থেকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কলকাতায় মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণির ভেতরকার ছবি ফুটে উঠতে থাকে। শাসনক্ষমতার হস্তান্তর নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির কট্টর অবস্থান, পার্টি নিষিদ্ধ হওয়া, এ নিয়ে পার্টির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি – এসব বেরিয়ে আসে বিকাশ-সুসির কথাবার্তায়। আর এসবের মধ্যেই মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন বীণা। পাশাপাশি খুকু-সমীরের হঠাৎ ঘনিষ্ঠতা পুরোনো সব হিসেব আরও গুলিয়ে দেয়। প্রণব খবর আনে – ‘লোক ক্ষেপে উঠেছে। মুসলমান দেখলেই মারছে। - হাওড়া – চন্দননগর’।

আমরা বুঝতে পারি কতটা বিষিয়ে রয়েছে কলকাতার আবহাওয়া।

দ্বিতীয় অঙ্কের সময়কাল ক মাস পরের। কতক নবান্নর অনুবর্তনে এক পার্কের মধ্যে কলকাতার এক বিচিত্র সব ছবি ফুটে উঠতে থাকে। ‘একদল আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে উচ্চৈঃস্বরে আলোচনা করতে করতে’ চলে – ‘আরে বাবা, ও কংগ্রেস, কমিউনিস্ট বলো, সব জানা আছে, যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ।’ ২০২১ খ্রিস্টাব্দের কলকাতায় এমন আলোচনা প্রকাশ্যে অতি সুলভ, কিন্তু ১৯৫১র কলকাতায় এমন আলোচনার প্রেক্ষিত বুঝতে আমাদের বেগ পেতে হয়। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ও কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে নাটককারের মোহভঙ্গের এক চকিত ঝলকানি হিসেবে একে দেখা যায়।

এসব ভাবতে ভাবতেই এক ‘শীর্ণ প্রৌঢ় লোক’কে দেখতে পাই আমরা। ছেঁড়া ছাতা হাতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে এসে বিকাশকে তিনি বলেন – ‘বাবুমশয়! – আমি খুব নিকটেই থাকি। আমার একডা মাইয়া আছে – ষুলো বছরের, - আর আমি থাকি। একখান আলায়দা ঘর পাইছি। রোজগারপাতি কিছুই নাই ...।’ নাটকের রং বদলে যায়। সলিল সেনের ক বছর আগেই ‘নতুন ইহুদী’র আবির্ভাব ঘটে বাংলা নাটকে। জানা যায়, দেশভাগের পর ছিন্নমূল হয়ে কলকাতায় মাথা গুঁজেছেন তারিণী মাস্টার। পেটের জ্বালায় মেয়েকে দেহব্যাবসায় নিয়োগ করেছেন। নিজেই দালাল হয়েছেন। এই অদ্ভুত মানুষটির মুখ দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ঘনায়মান শরণার্থী সংকট নিয়ে শম্ভুর গভীর উদ্বেগ বেরিয়ে আসে যখন বিকাশের ‘আপনি কি refugee’ প্রশ্নের উত্তরে তারিণী বলেন –

(তিক্ত হেসে) বাবুমশয়, ডিক্‌শনারিতে refugee মানে দেখছি। তাতে ল্যাখে one who flies to a foreign country or power for safety। কিন্তু এই যে কইলকাতায় আসছি, একি বিদ্যাশে আসছি? Foreign country? আর এই যদি বাংলা দ্যাশ হয়, - আমার দ্যাশ হয়, - তো সেই যে বোরোধানের খ্যাতের পাশে ভিটেখান ছাইড়্যা আসছি, সেইডা কী? সেইডা কি বিদ্যাশ? (আবার হাসে অস্বাভাবিক ভাবে হি হি ক’রে) বাবুমশয়, কথায় আর কথার মানে নাই, যা ইচ্ছা কইতে পারেন।

হে মহানুভব পাঠক, ভেবে দেখুন যে ১৯৫০এ ঋত্বিক কুমার ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা সুদূরপরাহত, অথচ সেই ছবিতে বিজন যে ভূমিকায় দেখা দেবেন, তারিণী মাস্টারের মধ্যে তার বারো আনা জ্যান্ত। ১৯৫০এ সবে বেরিয়েছে নিমাই ঘোষের ছিন্নমূল। তাতে সহকারীর কাজ করেছেন ঋত্বিক। কিন্তু সাম্প্রদায়িক নীতির ওপর দাঁড়িয়ে দেশভাগের ফলে যে বীভৎস বাস্তবতা চোখের সামনে দেখছেন শম্ভুর মতো সংবেদনশীল শিল্পী, তার থেকে নজর ঘুরিয়ে নাটক তৈরির কথা তাঁরা ভাবতেই পারছেন না। সরাসরি বুঝতে চাইছেন জ্বলন্ত সমাজব্যবস্থাকে। বহুরূপীর ঘনিষ্ঠ তুলসী লাহিড়ী একই সময় ছেঁড়া তার লিখছেন। বিজন ভট্টাচার্য লিখছেন গোত্রান্তর।ঘূর্ণি লিখতে বসে শরণার্থী সংকটকে এড়াতে চাইছেন না শম্ভুও, তাকে অঙ্গাঙ্গী করে নিচ্ছেন।

আরও দেখাচ্ছেন যে কলকাতার আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। বাহুবলী সংস্কৃতি মাথা তুলছে। ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়া মুসলমানদের খুলে-এ-আম কতল করছে জনসঙ্ঘের ধ্বজাধারী জগবন্ধু ভট্‌চাযের দলবল। বিকাশ বাঁচাতে পারছে মুসলমান ডিমওয়ালাকে, অবমাননা থেকে বাঁচাতে পারছে না তাঁর বোন বাণীকেও। নিজের পুরুষত্ব নিয়ে গভীর সংকটে ডুবে যাবার আগে সে সুসিকে বলছে তাঁর ভেতরে ঘুলিয়ে ওঠা মতাদর্শগত সংকটের কথা।

... আমরা বিশ্বাস করি এক জিনিস, ভালোবাসি আর এক জিনিস। প্রেমে যখন পড়ি তখন মধ্যবিত্ত মেয়ের প্রেমেই পড়ি, অথচ উপন্যাসে কবিতায় নায়িকা করবার চেষ্টা করি চাষার মেয়েকে, মজুরের মেয়েকে। যাকে ভালোবাসিনি, যার সঙ্গে ঘর করিনি, বিছানায় চাঁদের আলোয় যার মুখ দেখিনি। আর তাই সব ব্যর্থ। আমার লেখা ব্যর্থ, লেখবার উদ্দেশ্য ব্যর্থ, - আমি ব্যর্থ।

গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে নান্দনিক বিচ্ছেদ পূর্ণ না হলে এমনভাবে নিজেকে নিংড়ে এ কথা লিখতে পারতেন না শম্ভু। তা বলে কংগ্রেসি বা জনসঙ্ঘের রাজনীতির দিকে ঝোল টেনে একটি কথাও ঘূর্ণিতে লেখেননি তিনি।

যত এগোচ্ছে তত জটিল হচ্ছে ঘূর্ণির বুনোট। জোনাল লাইটিং কাজে লাগাতে শুরু করেন নাটককার। এই কলকাতা ছেড়ে পালাতে চায় খুকু, অবিনাশের কাছ থেকে টাকা আদায় করে সমীরকে নিয়ে চলে যায় সাঁওতাল পরগনায়। একা হয়ে পড়া অবিনাশ আপন মনে প্রলাপ বকেন – ‘মানুষের জন্যে সমাজ বাঁচে, না সমাজের জন্যে মানুষ?’ ওদিকে সংসারী হয়ে মা হতে চায় সুসি। দেবেনের সঙ্গে তারিণীর সখ্য জমাট বাঁধে। তাঁদের মধ্যে ঢুকে পড়ে বিকাশ। তাঁর মনে অস্তিবাদী জিজ্ঞাসা – ‘মানুষ বাঁচে কেন, আদপে?’ দেবেন বলেন, ‘আশায়। সুখের আশায়।’ তাঁকে খণ্ডন করে তারিণী বলেন, ‘না, সুখের জইন্য না। মানুষ বাঁচে মুক্তির জইন্য। ... নিজের থিক্যা মুক্তি।’ এবারে দার্শনিক জিজ্ঞাসার মর্মমূল ছুঁয়ে ফেলে ঘূর্ণি। অস্তিবাদ-ভাববাদ-বাস্তববাদের লড়াইতে শেষমেশ বাস্তববাদ জিতে যায়।

তৃতীয় অঙ্কে শহর থেকে দূরে নাটকের পালা পড়ে। ইতিমধ্যে কিছুকাল কেটে গেছে। ইউনিয়ন বোর্ডের গোলমালে চাষীদের পক্ষ নিয়ে লড়াই করেছে বিকাশ। তেভাগার কসম খেয়েছে। মেহনতি মানুষের মধ্যে মিশে গেছে। সেখানেই খুকু, সুসি, তারিণীর সঙ্গে আবার মোলাকাত হয় তাঁর। নাগরিক অস্তিত্বের সাধুকংকাল সরে যায়। আরও স্বচ্ছভাবে নিজেদের চিনতে পায় তাঁরা। নাটক শেষ হবার পর আমাদের মনে হয় চার অধ্যায়ের অতীন-এলার প্রেমের অন্তরদ্বন্দ্ব যেন ঘূর্ণিকে আরও তীব্রতা দিল।

প্রযোজনা হিসেবে চার অধ্যায় সফল হল। সম্ভবত এই সাদৃশ্য ঘূর্ণিকে মঞ্চ থেকে দূরে রাখল। চিরতরে।




অথচ মঞ্চায়নের জন্য আটঘাট বেঁধেই ঘূর্ণি লিখেছিলেন শম্ভু। নিজেই কবুল করেছেন যে লিখতে লিখতে এ নাটকের সম্ভাব্য কুশীলবদের তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁরা সকলেই বহুরূপীর সাংগঠনিক বৃত্তের কিংবা অতি-ঘনিষ্ঠজন ছিলেন।

এ-নাটক লেখবার সময়েও কিছু লোকের কথা আমাদের মনের মধ্যে ছিল। যেমন – দেবেন্দ্র হবেন মহর্ষি; অবিকাশ – কালী সরকার মশায়; সমীর – সবিতাব্রত দত্ত; প্রণব – শোভেন মজুমদার; খুকু – শ্রীমতী তৃপ্তি মিত্র; এবং তারিণী মাস্টার করবার জন্যে বিজন (ভট্টাচার্য)-কে বলব। পার্কের মধ্যে মহর্ষি ও বিজনের দৃশ্যটা আমি যেন দেখতে পাই; কিন্তু এ-নাটক আমি কখনো অভিনয় করাইনি।

বলাই বাহুল্য, ‘মহর্ষি’ এখানে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। ঘূর্ণির দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের কথা তোলেননি শম্ভু। একটি সুসি। অন্যটি বিকাশ। প্রকৃত প্রস্তাবে বিকাশই এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ঘূর্ণি যতই পাকিয়ে ওঠে ততই তা বিকাশকে ঘিরে আবর্তিত হতে থাকে। নিজের হাতে লিখে না দিলেও এ চরিত্র যে নিজের জন্যই ভেবেছিলেন শম্ভু তা হলফ করেই বলা যায়। সহৃদয় পাঠক, একটু তলিয়ে দেখলে বিকাশের মধ্যে আড়াই দশক বাদের যুক্তি তর্ক গপ্পো ছায়াছবির নীলকণ্ঠ বাগচীর আদিকল্পকে দেখতে পাবেন।

ঘূর্ণি মঞ্চে আসেনি এ সত্যি। আবার ঘূর্ণি থেকেই সামাজিকভাবে একক ও সঙ্ঘচ্যুত পুরুষের যে কেন্দ্রীয় অবস্থান সেই অবস্থানের প্রতি নির্দেশক শম্ভু মিত্রের আস্থা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তাঁর করুণ পরিণতি শম্ভুকে টেনেছে। পরবর্তীকে এই প্রবণতাই শম্ভুকে হেনরিক ইবসেনের দিকে ঠেলেছে, রক্তকরবী-রাজা কিংবা রাজা অয়দিপাউস ছুঁয়ে, অ্যাবসার্ড থিয়েটারের সঙ্গে স্বল্পস্থায়ী সহবাসের পর শেষমেশ চাঁদ বণিকের পালার সাগর কিনারে পৌঁছে দিয়েছে।

স্রষ্টা ও শিল্পী শম্ভু মিত্রের দার্শনিক ও নান্দনিক অবস্থান নিয়ে কোনো আলোচনা করার সময় ঘূর্ণির এই মোড়-ঘোরানো ভূমিকার কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। এও যে মনে রাখি যে বাম-মতাদর্শগত বিভ্রান্তি তাঁকে ও তাঁর প্রজন্মের শিল্পীদের যে চোরাবালির দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে লড়াই করেই শিল্পরচনা করে গেছেন তাঁরা। ওই ছটফটানি তাঁদের রক্তবাহ থেকে শিল্পে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এই নিরিখে শম্ভু মিত্রের সঙ্গে সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক কুমার ঘটক, বা উৎপল দত্তর বিরাট কোনো ফারাক নেই।

৯ শ্রাবণ ১৪২৮ ব / ২৫ জুলাই ২০২১ খ্রি


লেখক পরিচিতি - নাট্য সমালোচক



শম্ভুদার কাছে
সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটারের প্রবাদ— শম্ভু মিত্রের সঙ্গে আমার যোগ ১৯৯০ সালে। আমাদের বাগবাজারে থাকতেন সংস্কৃতির পাদপীঠে বিচরণকারী গৌতম হালদার (অভিনেতা নন), তাঁর মাধ্যমে। কখনও নান্দীকার জাতীয় নাট্যমেলায় নাটক দেখতে আসা শম্ভুদাকে বিরতির সময় অ্যাকাডেমির যাদুঘরে নিয়ে যাওয়া, কখনও গৌতমদার গাড়িতে তাঁকে গোলপার্কের আবাসনে পৌঁছে দেওয়া— এভাবেই কখন শম্ভু মিত্রের কাছে আমি ডাক নামে পরিচিত হয়ে গিয়েছি। আর তাঁর তো মানুষকে সম্মান দেওয়া এক বিশেষ চরিত্র বৈশিষ্ট্য। যেভাবেই তিনিও আমার মতামত শুনতেন। শুধরে দিতেন। এভাবেই একদিন গৌতমদার ডায়েরি ওল্টাতে পাল্টাতে গিয়ে দেখলাম তাঁর জন্মদিন ২২ আগস্ট। এবার ৭৫ বছর। তখন আমি যুগান্তর পত্রিকায় ফ্রিল্যান্সিং করি। তখন যুগান্তর-এর অন্তিমকাল। তবুও সাহসে ভর করে কথাটি জানাই তৎকালীন যুগান্তর-এর ভারপ্রাপ্ত কর্তা বিশেষ প্রফুল্ল কান্তি ঘোষ মহাশয়কে। তিনি প্রাক্তন খাদ্য মন্ত্রীও ছিলেন। যাই হোক তিনি শুনে এককথায় রাজি। শম্ভু মিত্রের ৭৫ বছর উদযাপন সংখ্যা প্রকাশিত হলো ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৯০। এর ফলে শম্ভুদার সঙ্গে আমার যোগ আর একটু নিবিড় হলো। অনেকক্ষণ কথা হতো। অনেক কিছু শিখেছি।

ছোটোবেলায় বেতার নাটকে তাঁর অভিনয় শুনে তাঁর প্রতি একটা মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিলো। তারপর যখন শেষবারের মতো তাঁর মঞ্চাভিনয় দেখলাম— দশচক্র, তখন সেই মুগ্ধতা তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।

তাই মানুষটি যখন কথা বলতেন, তখন আমার অন্তর আত্মা ব্লটিং পেপারের মতো যে সব শুষে নিতো। অভিনয় করতে শুরু করি ১৯৮৫ সাল থেকে। কিন্তু কোনও নাট্য দলে স্থিত থাকতে পারিনি। তারপর যখন শম্ভুদার সঙ্গে পরিচয় তখন আমি থিয়েটার করি না— তবে থিয়েটার ছেড়ে নেই। কখনও নান্দীকার কখনও নাট্যরঙ্গ কখনও পঞ্চম-বৈদিকের বিভিন্ন কাজে অংশ নিই। এর মধ্যেই জল গড়িয়েছে অনেক। আমিও যুগান্তর থেকে সদ্য প্রকাশিত দৈনিক ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ যুক্ত হয়েছি। ২২ আগস্ট তখন আমারই উদ্যোগে শম্ভু মিত্রের জন্মদিন পালিত হচ্ছে বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে। অনেকে ওই দিন শম্ভু মিত্রকে শুভেচ্ছা জানাতে যেতে শুরু করেন। কারণ এতদিন তাঁর জন্মদিন অপ্রকাশিতই ছিলো। তার জন্য শম্ভুদার কাছে মিষ্টি বকুনিও খেয়েছি। এরপর শাঁওলী মিত্র জ্যোতিষ রায় রোডে বাড়ি কিনে শম্ভু মিত্রকে গোলপার্ক থেকে নিয়ে গেলেন নিজের কাছে। তখন আবার সেখানে যাতায়াত। কত স্পর্ধার কথা আবার কত আত্মার কথা বলে ফেলেছি দীর্ঘ মেলামেশার অলিখিত দাবিতে। বলেছিলাম বেতারে কর্ণ-কুন্তী সংবাদ পাঠাভিনয়ে আপনার থেকে শাঁওলীদিকে বেশি ভালো লেগেছে। উনি কী যত্ন নিয়ে শুনেছেন এবং প্রশ্ন করেছেন কেন? বলেছিলাম আমার অভিনয়ের বোধ থেকে, ‘আপনি বোধহয় শাঁওলীদির চেয়ে কণ্ঠের বয়স কমাতে গিয়ে কোথাও কর্ণর গম্ভীর নিরাশক্তির প্রতি অবিচার করে ফেলেছেন।’ তার উত্তরে বলেছিলেন ‘হতে পারে।’

একবার মঞ্চে তাঁর কবিতা পাঠ শুনে কেমন লাগলো, এ প্রশ্ন করায় বলেছিলাম ‘চোখে বারবার জল আসছিলো।’ উনি শুনে বললেন আমাদের ইমোশান অনেক সময় অনেক তুচ্ছ তাৎক্ষনিক কারণেও চোখে জল আনে। তার গভীরতা বা স্থায়িত্ব কিন্তু থাকে না।’ আমি অগোছালোভাবে বলেছিলাম ‘আসলে চোখ থেকে যখন আমার জল পড়ছিলো তখন নিজেকে খুব মহান মনে হচ্ছিলো। একটা বড়ো অনুভব।’ তার বেশ কিছুদিন পরে তিনি আমায় বলেছিলেন, ‘কে বেশ বললে, যে চোখের জল পড়লে মনটা বড়ো পবিত্র হয় সে চোখের জল বড়ো দামি গো।’ আমি আর লজ্জায় বলিনি অগোছালোভাবে কথাটা আমারই।

এভাবেই কাটছিলো। তিনি এবার আমাকে আর একটু সাহস দিয়ে বললেন, ‘শোনো, এতদিনে আমি আমার ওপর ডক্যুমেন্টারি তোলার কাজে যায় দিয়েছি। রাজা সেন করছে।’ বললাম ‘কাগজে লিখতে পারি?’ বললেন, ‘যদি তোমার কাগজে তোমার দাম বাড়ে তবে লিখতে পারো।’ এই প্রশ্রয়ই আমার কাল হলো। ‘প্রতিদিন’ পত্রিকায় আমি লিখে ফেললাম, তিনি একান্তে আমাকে রাজনীতি ব্যক্তি সম্পর্কে যা যা বলেছিলেন। সব। এমনকি অপর্ণা সেন তাঁকে মতিলাল পাদ্রী করার অফার দিয়েছিলেন, তাও। ব্যস সম্পর্ক শেষ। টেলিফোনে তিনি আমায় বলেছিলেন, ‘তোমার বেতন বাড়লো?’ যদিও ওই লেখার মধ্যে তেমন ভয়ানক কিছু বিতর্কিত ছিলো না। তবুও যখন শম্ভু মিত্রকে নিয়ে নাটক লিখি, তখন নাম না করে নিজেকে কষাঘাত করতে ছাড়িনি। কেউ কেউ মঞ্চে নাটকটি দেখে বলেছিলেন, নামটা বললেন না কেন? আমার উত্তর ছিলো তাহলে দেবী দুর্গার পদতলে অসুরের মতো এক চালচিত্রে পূজিত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। নিজের কলমে নিজেকে পূজিত করার আয়োজন না-ই বা করলাম। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার আদান-প্রদান সব যে মাটি হয়েছিলো তা নয়। নাট্যরঙ্গ এবং পরিচালক স্বপন সেনগুপ্তের কাছে আমি এর জন্য কৃতজ্ঞ। তাঁরা নাটকটি সমারোহের সঙ্গে মঞ্চস্থ করেছিলেন। এবং যে নাটক দেখে শম্ভু মিত্রেরা সকল ঘনিষ্ঠ মানুষজন অকুণ্ঠ সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। তাঁরা অনেকেই বলেছিলেন এরকম অভিনয় ভারতীয় বায়োপিকগুলিতেই বড়ো একটা দেখা যায়নি। অন্য থিয়েটার প্রথমে ভেবেছিলো ‘হ্যামলেট’-এর জন্য আমাকে তাঁরা সম্মানিত করবেন কিন্তু ‘শ্রী শম্ভু মিত্র’ নাটক দেখে বিভাসদা মত বদলান। বলেন, না ‘শম্ভু মিত্রের চরিত্রে এইরকম রূপদান এই মুহূর্তে ভারতে কোনও অভিনেতার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অন্য থিয়েটার সম্মান দেওয়া হয় ‘শ্রী শম্ভু মিত্র’ নাটকের জন্য।

সবচেয়ে বড়ো অ্যাওয়ার্ড পেলাম তাঁর কন্যা শাঁওলী মিত্রের কাছে। তিনি দেখতে এলেন অবশেষে। এবং দেখার পর বললেন ‘এরকম একটা কঠিন বিষয় নিয়ে এমন উৎকৃষ্ট নাটক এতগুলো মানুষ পিন-পতন স্তব্ধতায় দেখলেন।’ আর আমার অভিনয় নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি আমার ঘনিষ্ঠ সাহায্যকারিনীকে নিয়ে নাটকটি দেখতে এসেছিলাম। সেই সাহায্যকারিনী বাবার ছবি, দূরদর্শনে বাবার সাক্ষাৎকার, অডিওতে বাবার আবৃত্তি— এসব বহুবার দেখেছেন। আর আমার মুখে বাবার গল্প। এ নাটকে তোর অভিনয় দেখা শেষে আমাকে বললেন, ‘এতদিনে তোমার বাবাকে চাক্ষুষ দেখলাম।’ এর চেয়ে বড়ো অ্যাওয়ার্ড আর কি-ই বা হতে পারে।’

কৃতজ্ঞতা কবি শঙ্খ ঘোষের কাছে। যিনি নাটকটি প্রথম শুনেছিলেন এবং সেদিন থেকে আর মঞ্চে যাওয়া পর্যন্ত সমানে আমাকে নানাবিধ উপদেশ দিয়ে ঋদ্ধ করেছিলেন।

শম্ভু মিত্র আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। তাঁর চরিত্রাভিনয় করে আমি যে আবার একদল তরুণকে শম্ভু মিত্র পাঠে আসক্ত করতে পেরেছিলাম, সেই আমার ঢের।

লেখক পরিচিতি - অভিনেতা




শম্ভু মিত্র আর আমি 
রাজা সেন

ঋতবাক - প্রথমেই ঋতবাকের তরফ থেকে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদের প্রস্তাবে রাজি হওয়ার জন্য। যে বিষয়টা নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলবো, সেটা তো আপনাকে আগেই জানিয়েছিলাম, যে শম্ভু মিত্রের ওপর আমরা একটা ক্রোড়পত্র করছি আমাদের ব্লগের জন্য। আগস্ট মাসে ওঁর জন্মমাসে বের হবে। সে বিষয়ে আপনার কাছে জানতে চাইছি।

আপনি যেহেতু ওঁর ওপরে একটা ডকুমেন্টারি করেছেন, সেটার প্রেক্ষাপটটা একটু জানতে চাই। এটা একদিক থেকে একটা স্বাভাবিক ভাবনা যে, এত বড়ো একটা ব্যক্তিত্বকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করতে চাওয়া।

রাজা সেন - বিষয়টা হচ্ছে, সত্যি কথা বলতে কি, এটা আমার ভাবনার মধ্যে ছিলো না। এটা আপনাকে বলছি। এটা সত্যি কথাই বলছি। বানিয়ে বলার কোনও মানে হয় না। প্রথমত আমি ছবিতে, থিয়েটারের সাথেও যুক্ত ছিলাম। ওঁনার সঙ্গে বিশেষ করে, আমি প্রথমত একটা আমার মোটামুটি থিয়েটারের অভিজ্ঞতার দিক থেকে অজিতেশ বাবুর সঙ্গে থিয়েটারে আমি ছিলাম নান্দীমুখে। পরবর্তীকালে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে চার্বাকে। চার্বাকের সূত্রে আমি এটা করি গ্যালিলিওর জীবন ডিরেকশন-এর সময়। যেটায় শম্ভু মিত্র অভিনয় করেছিলেন।

ঋতবাক - সেখানে আপনি ছিলেন? আপনি অভিনয় করেছিলেন?

রাজা সেন - হ্যাঁ হ্যাঁ। গ্যালিলিওর জীবন-এ অভিনয়ের সূত্রে শম্ভুদার সাথে আলাপ, পরিচিতি এবং শম্ভুদাকে আনা-নেওয়ার দায়িত্ব আমার ছিলো। সেই সূত্রে একটু সখ্যতা বাড়ে। আমার সঙ্গে আস্তে আস্তে একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়। থিয়েটারের বাইরে তাঁর কাছে যাতায়াত, তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব করা আমার হয়। আমাকে পছন্দ করতেন খুব। তাঁর পরবর্তীকালে আমি পাশাপাশি সহকারী চলচ্চিত্র পরিচালনার কাজ করি। কারণ আমি হোল টাইমার ছিলাম থিয়েটারে। স্থায়ীভাবে থিয়েটার তো পয়সা দিতে পারতো না সেভাবে। তখনকার গ্রুপ থিয়েটারে আমরা পয়সা পেতাম না। ন্যাচারালি আমার সঙ্গে পাশাপাশি চলচ্চিত্র সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেছি। যেমন মোহিত চট্টোপাধ্যায় একটা ছবি করেছিলেন ‘মেঘের খেলা’ বা মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত— এঁদের সঙ্গে কাজ করেছি। যা হোক এসব করতে করতে সুবর্ণলতা বলে একটা সিরিয়াল করি। সেই সূত্রে আমার মহিলাদের ওপর কর্মকাণ্ডে একটা কনফিডেন্স বাড়ে — যে নারী সংক্রান্ত ইমেজ বা নারীর সেন্টিমেন্ট নিয়ে ভালো কাজ করতে পারি। আমি সুবর্ণলতা করার ফলে মানুষের একটা বিশ্বাস হয়, আমি হয়তো হিউম্যান ফোক-এর ওপর ভালো কাজ করবো, এরকম একটা কনফিডেন্স আসে। সেখান থেকেই হয়তো কোনও কারণে সুচিত্রা মিত্রের ওপর ডকুমেন্টারি করতে যান ওঁরা। সেটার জন্য পরিচালক হিসাবে আমাকে নিযুক্ত করেন। আমি সুচিত্রা মিত্রের ওপরে তথ্যচিত্রটা করি এবং তার জন্যে আমি শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্র নির্মাতা হিসাবে আমি রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পাই। সেই সবগুলোর ঘটনা সাক্ষী শম্ভুদা দেখেন টিভিতে। ছবিটাও দেখেন বা আমাকে যে রাষ্ট্রপতি থেকে পুরষ্কার নিতে দেখেন। তাছাড়া আমার চলচ্চিত্র জগৎ-এ যাতায়াত। আমি কাজ করছি। এইসব খবরগুলি উনি নিয়মিত রাখতেন বা আমি দিতাম। আমার সঙ্গে শ্যুটিং করে এলেই গল্প। — এইসব হতো। তারপরে শম্ভুদাকেই ইজেডসিসি থেকেই একটা প্রস্তাব দেয়। একটা তথ্যচিত্র করতে চান তখন যিনি দায়িত্বে ছিলেন। সম্ভবত চম্পক চ্যাটার্জী বা অন্য কেউ। তিনি তথ্যচিত্র যখন শম্ভুদার ওপর করতে চায় তখন শম্ভুদা বলে, ঠিক আছে তোমরা একটা কাজ করো, তোমরা রাজাকে বলো। রাজা যদি করে তাহলে আমার কোনও আপত্তি নেই। সেখান থেকে আমার কাছে প্রস্তাবটা আসে যে, শম্ভুদার ওপর একটা ডকুমেন্টারি হবে। এটা আপনি করুন। এরকম শম্ভুদার ইচ্ছা। তখন আমি বললাম যে খুব ভালো। আমার সঙ্গে সবসময় চিত্রনাট্যের মোহিতদা কাজ করতেন মোহিত চট্টোপাধ্যায়। আমি মোহিতদাকে বললাম, বললেন হ্যাঁ খুব ভালো। তো শম্ভুদার সঙ্গে মোহিতদা, আমার একটা দিন বসে বসে একটা চিত্রনাট্যের খসড়া তৈরি হয়। শম্ভুদা নিজেও যথেষ্ট গাইড করেন। শম্ভুদা, মোহিতদা এবং ক্যামেরার পিছনে থাকা সৌমেন রায়, ক্যামেরা ম্যান ছিলেন। এবং এটাকে একটা ডকুমেন্টারি না বলে একটা ডকুমেন্টেশন বলা যায়। কারণ, ঐ ছবিটা দীর্ঘ হয় তিন ঘণ্টা এবং নিজের স্মৃতি থেকে বলছি যা পয়সা দিয়েছেন, সাধারণত পয়সা থেকে একটা আয়ের হিসাব থাকে। কিন্তু আমি কোনও আয় করিনি। আমি সম্পূর্ণ টাকাটা ঢেলে আমি একটা ডকুমেন্টেশন ফিল্ম করি। এবং সেটা এডিট করে শম্ভুদাকে দেখানো হয়। খুব এপ্রিশিয়েট করেনও। তখন দূরদর্শনেরও প্রচুর কাজ করছি দেখে দূরদর্শনের যোগাযোগ হয়। তখন আমি দূরদর্শনে একটা প্রস্তাব দিই, আমি তো একটা বড়ো ডকুমেন্টেশন করছি, পাশাপাশি কি একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম করতে পারি? যদি দূরদর্শন আমায় অনুমতি দেয়। তখন দূরদর্শনের ডিরেক্টর ছিলেন রথীকান্ত বাগচি। ওনার সঙ্গে কথা বলি। তিনি তখন বলেন যে, ঠিক আছে। ঐ ছবিটা একটু আলাদা। ওটা পৃথ্বী জায়েন ডিরেক্টর ছিলেন। পৃথ্বী জায়েন ইন্টারভিউগুলো করেন। আর এখানে অবশ্য বিভিন্ন মানুষ থিয়েটারগুলো পারফর্ম করে। তিন ঘণ্টার ব্যাপার। আর একটা ৫০ থেকে ৬০ মিনিটের ছবি হয়। ওখানে আছে সেই ছবিটা, দূরদর্শনে আছে। ক্যাসেটটা পাওয়া যায়। তিন ঘণ্টার ছবি কলকাতায় অনেক দেখানো হয়েছে। কিন্তু আমি অনেক থিয়েটার দলকে বলেছিলাম, খুব যে একটা আগ্রহ প্রকাশ করেছে তা নয়। বাংলাদেশকেও বলেছি। ছবিটা দেখানো হয়েছে একাডেমী অফ ফাইন আর্টস-এ বা এটার ক্যাসেট বিক্রি হয়। আর দূরদর্শনও মাঝেমাঝে দেখায়। এই হচ্ছে মোটামুটি একটা প্রারম্ভের ইতিহাস বলা চলে।

ঋতবাক - এটা করার সময় আপনার, এই যখন তৈরি করেন প্রোজেক্টগুলো, তখন বিশেষ অভিজ্ঞতা কী হয়েছিলো? আপনার তো একটা ঘনিষ্ঠতা ছিলো ওনার সঙ্গে আপনি বললেন।

রাজা সেন - আমার আগে থেকেই ছিলো। যথেষ্ট ছিলো। সুবিধে বলতে, যে কাজগুলো উনি করতে দিতেন না। ওঁর একটা মতামত ছিলো স্ট্রং, নিখুঁত পরিষ্কার একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে, পরিষ্কার একটা জীবন দর্শন ছিলো।

ঋতবাক - সেইটা কী?

রাজা সেন - দেখুন না ধরুন, আজকে যদি ওনার মৃত্যুর কথাই আমরা ভাবি, যেটা আমাদের দেশে বা পৃথিবীতে ক’জন মানুষ আছে যারা বলেন, লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন যে মৃত্যুটা যেন কোনও খবরে না দেওয়া হয় এবং তাঁকে কাউকে না জানিয়েই প্রায় তাঁকে দাহ করা হয় এবং কোনওরকম পাবলিসিটি কোথাও নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি, মালা দেওয়া ইত্যাদি তিনি পছন্দ করেন না। এই যে নিজেকে থিয়েটার থেকে সরিয়ে নেওয়া বা থিয়েটারের তথাকথিত লোক থেকে সরিয়ে নেওয়া। একটা উত্তরণ একটা ঋষি তুল্য ব্যাপার ছিলো। যেমন ধরুন, মাঝে এক সময় ছিলো আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে উনি আর মারাঠি থিয়েটার থেকে, পুনের থিয়েটার থেকে ওনাকে একটা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তখন আবার উনি বলেছিলেন যে, ঠিক আছে আমি যাব। কিন্তু আমার সঙ্গে রাজা যাবে। আমাকে উনি প্রায় পিতৃবৎ স্নেহ করতেন এবং এটার সঙ্গে ডকুমেন্টারি-র যোগ না থাকলেও উনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলেন আমার যাতায়াত খরচা, থাকার দায়িত্ব এবং শম্ভুদার ব্যক্তিগত সহকারী হিসাবে আমি থাকবো। আমি তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলাম এখান থেকে বোম্বে গিয়ে ফ্লাইটে। সেখান থেকে গাড়ি করে পুনেতে থাকা। সেখানে দেখেছি পুনের যে থিয়েটারের বড়ো বড়ো ব্যক্তিত্ব শ্রীরাম লাগু থেকে শুরু করে তাঁরা সবাই শম্ভুদাকে কীভাবে সম্মান করেন। বিশেষ করে যেদিন সংবর্ধনা জানানো হয় সেদিন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী এসে সংবর্ধনা দিতে গিয়ে প্রথম স্পীডে এসেই তাঁর (শম্ভু মিত্রকে) পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পায়ে হাত দিয়ে শম্ভু মিত্রকে প্রণাম করছে এটা খুব একটা ভাবা যায় না। যে কোনও মুহূর্তে কোনও মুখ্যমন্ত্রী। ওখানে কিন্তু মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ওনাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছেন। তারপরে যেটা বললাম ড. শ্রীরাম লাগু থেকে শুরু করে। তারপর আমি আর দীণা পাঠক ইন্টারভিউ নিয়েছি ওখানে। অনেক থিয়েটারের বড়ো বড়ো ব্যক্তিত্বের অমল পালেকর ইত্যাদি। তারা সবাই শম্ভু মিত্রকে থিয়েটারে বড়ো একটা ব্যাক্তিত্ব বলে মনে করেন। পুতুল খেলা থেকে শুরু করে সব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক বা অন্যান্য যে সেখানকার আধুনিক নাটক। সেই নাটকগুলোর সিলেকশন-এর পিছনেই দেখা যাবে যে তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটা থেকে বোঝা যাবে যে তাঁর ইবসেন থেকে সফোক্লেস একসূত্রে বাঁধা ছিলো। সেই জীবনদর্শনের উনি অনেক উঁচু একটা জায়গায় বিচরণ করতেন এবং যখন আমরা গ্যালিলিওর জীবন করি তখন এতগুলো নিয়মের থিয়েটারের পার্সোনালিটি ছিলেন, তো সব থিয়েটার পার্সোনালিটি-র উপরে উনি কীভাবে বিচরণ করতেন, সেটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়েছে। কারণ কতগুলো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সেগুলো ঠিক পাবলিকলি শেয়ার করা যায় না। সেগুলো ব্যক্তিগতভাবে বলা যায়। ব্যাক্তিগতভাবে আমি জানি যে তিনি বহুক্ষেত্রে প্রত্যেকটি থিয়েটার জানে শম্ভু মিত্র কোন জায়গায় বিচরণ করে। শুধু জীবনদর্শনের দিক থেকেও একটা অসাধারণ জায়গায় উনি বিচরণ করতেন। এই হচ্ছে আমার অভিজ্ঞতা।

ঋতবাক - কিন্তু একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করবো যে, একদিকে ওর এই জনপ্রিয়তা বাংলা থিয়েটারে, ভারতবর্ষের থিয়েটারে ওর জায়গা ওর একটা অবিসংবাদী একটা ইমেজ। কিন্তু তার পাশাপাশি, ওর বিক্ষিপ্ততা আমরা কি অনেক সময় ভুল বুঝেছি? আমরা কি অনেক সময় ওকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছি? আমার মনে হয়েছে, আমার ব্যক্তিগত ধারণা, অনেক ক্ষেত্রে অনেকে, আমি একদম সরাসরি বলছি, ওকে দাম্ভিক বলে লোকে মনে করতো।

রাজা সেন - শুনুন একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। যখন উনি ম্যাগসাইসাই পেলেন। তখন আমাদের কিছু থিয়েটার ব্যক্তিত্ব যারা মাথায় আছেন, এইসব বিতর্কিত বলে নামগুলো উল্লেখ করা মুশকিল। আপনি ধরে নিন, একদম প্রথম সারির ৩-৪ জন, তাঁরা বললেন যে তাঁরা একটা সমবেত সংবর্ধনা জানাতে চায়। আমার সামনে তাঁরা বলেছেন। উনি বললেন যে তোমরা কে কে? তো আমাদের যারা নিজেদেরকে সবচেয়ে বড়ো মাথা, শিরোমণি মনে করে, যে দাদারা। মনে করুন গ্যালিলিও যখন হয় তখন কারা করেছিলো সঙ্গে, আপনার মনে পড়ে সেইসব?

ঋতবাক - হ্যাঁ নিশ্চয়ই মনে পড়ে। আমরা দেখেছি সেই প্রোডাকশন।

রাজা সেন - কে কে ছিলেন বলুন?

ঋতবাক - প্রায় সবাই ছিলেন। সমসাময়িক সেসময় যারা, যেটা বলছেন আপনি, যারা মাথা প্রত্যেকেই ছিলেন প্রায় ঐ প্রোডাকশনের সঙ্গে। পুরো একটা ল্যাবরোটারি-র মতো তৈরি হয়েছিলো।

রাজা সেন - ক্যালকাটা রিপোর্টার থিয়েটার নামটা। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত, অরুণ মুখোপাধ্যায়, যতীন দস্তিদার আর এইরকম ছিলো।

ঋতবাক - অজিতেশ বাবু কি তখন ছিলেন? অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়?

রাজা সেন - না না। অজিতেশ বাবু তখন বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। এঁনারা ধরুন এদেরই মতো যারা আমাদের সবচেয়ে সিনিয়ার এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তাঁরা বললেন শম্ভুদাকে একটা সংবর্ধনা দেবেন। এটা তাঁদেরই বর্তায়, তাঁদেরই কৌলিন্য আছে, তাঁরাই এই সংবর্ধনাটা দিতে পারে এবং তাতে যে কোনও লোকই মানুষেই খুশি হবে। কারণ এঁরাই বাংলা থিয়েটারকে তখন রিপ্রেজেন্ট করছে। কিন্তু উনি বললেন যে কে কে দিচ্ছো? তখন নামগুলো মোটামুটি, এখান থেকে কয়েকজনের নাম হবে। কেন আর সবাই নেই কেন? অর্থাৎ সবাই থিয়েটারের সবাই, বাংলা থিয়েটারের সব মিলে কেন সংবর্ধনা দেওয়া হবে না। সবাই মিলে যদি দিতো তাহলে উনি নিতেন। সবাই মিলে না দিলে উনি নিতে চাইলেন না। একটা ৪-৫ জনকে নিয়ে, বাকিরা সবাই জানে, তাঁরা দিতে পারলো না বা তাঁদের দেওয়ার ইচ্ছে নেই। যদি তাঁদের দেওয়ার ইচ্ছে নেই। তোমরা ৪ জন দিতে চাইছো কেন, আর ২ জন হয় নেই বা তাঁদের ইচ্ছে নেই। সবার দিতে যেহেতু ইচ্ছে নেই, আমি নেবো না। এই যে নেবো না, কথাটা, আপনি দাম্ভিকতা হিসাবে নিতেই পারেন। দাম্ভিকতা যদি হয় তাহলে এটা দাম্ভিকতা।

ঋতবাক - এটা যদি আমি ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করি আমি জানি না ওর যে ব্যক্তিত্বের নিজস্ব ধাঁচ ছিলো, একটা নিজস্ব গড়ন ছিলো এবং সেটা উনি কোনও অবস্থাতেই খোয়াতে চাইতেন না।

রাজা সেন - না। এই দেখুন, আমরা কিছুটা পেলেই ভাবি যে, গর্বিত হই যাক আমার তো কিছু প্রাপ্য হলো। আমার ১০০-এর জায়গায় ২৫ পেয়েছি, ২৫শেই আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু উনি হয়তো ছিলেন সবকিছুতেই, থিয়েটার থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবনের সর্বত্রই যে, ১০০ তে আমি যদি ১০০ পাই তবেই থাকবো। নয়তো থাকবো না। নয়তো ছেড়েই দেবো। করবোই না। গ্যালিলিওর জীবনের অভিনয় সম্পর্কেও ওঁর একটা কিছু কিছু একটা বিতর্ক এসছিলো। ঘরের মধ্যেই বিতর্ক এসছিলো। তখন উনি বলেছিলেন তাহলে আমি করবো না। হয় আমার ১ থেকে ১০০-ই ভালো, তা না হলে ভালো না। অমুক জায়গাটা একটু অন্যরকম করলে ভালো হয়, তমুক জায়গাটা আর একটু এরকম হওয়া উচিৎ ছিলো। ওরকম হয় না। একটা মানুষ হলে সর্বাঙ্গ সুন্দর হতে হবে। মাথার চুল হতে পায়ের নখ পর্যন্ত সে মাপে সব ঠিক আছে। সেই সৌন্দর্যতা থাকলেই সে সুন্দর। অর্থাৎ অভিনয়ের দিক থেকেও শুরুতে, মঞ্চে প্রবেশের প্রথম প্রবেশ থেকে শুরু করে প্রস্থান পর্যন্ত। সম্পূর্ণ নাটকে সে এক এবং একমেবাদ্বিতীয়ম। তাঁর ঠিক ঠিক চরিত্রায়ণ হয়েছিলো। অনেক সময় আমরা বলি, তোর ঐ জায়গাটা না ৯ নম্বর ফেসের অমুক জায়গাটা একটু ঐরকম হওয়াটা ঠিক হয়নি। এটা কিন্তু এরকম হবে। এমতে উনি বিশ্বাসী ছিলেন না। উনি ছিলেন ৯ নম্বরে আমি যেটা করেছি সেটা ১ নম্বর থেকেই তৈরি হয়েছে। এবং ১৩-রটায় যেখানে আমি যাব সেটা যাওয়ার জন্যই ৯ নম্বর ওরকমই হয়। কিন্তু সেটা যদি ৯ নম্বর ঠিক না হয় তাহলে আমার কোনওটাই ঠিক নয়। বা বলা যায় যে তোর সব জিনিস ভালো শুধু তোর দাঁতটা উঁচু। দাঁতটা উঁচু থাকলে আর সুন্দর কী হলাম? চোখ দুটো ভালো নাক দুটো ভালো দাঁতটা উঁচু তো হয় না। তার মানে আমি সুন্দর নই। সুতরাং আমি করবো না। এই কথাগুলো জীবনে আমি ওর থেকেই শুনলাম। ওর থেকে শোনাটাই আমি আওড়াচ্ছি। ফলে এটাকে দাম্ভিকতা বলে মনে করেন তাহলে দাম্ভিকতা আছে।

ঋতবাক - সামগ্রিক বিচারে উনি কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন সেই ব্যাপারে তো আপনার একটা মতামত শুনলাম। আজকে ধরুন উনি মারা গেছেন কতদিন হলো? বোধহয় প্রায় ২০ বছর।

রাজা সেন - আমার এক্সাক্ট মনে নেই।

ঋতবাক - আমারও আন্দাজ। এক্সাক্ট মনে নেই। আজকে দাঁড়িয়ে আপনার কী মনে হয়? এরকম কিন্তু একটা কি মনে হয় না যে অনেকটাই উনি এখন বিস্মৃতির মধ্যে চলে গেছেন?

রাজা সেন - ভীষণভাবে মনে হয়। উনি বলেছিলেন একটা কথা, এই ডকুমেন্টেশন-টা করা থাকলো এটা এখন ইউএসিজি-তে পাওয়া যায়। কোনও দলই এটা দেখতে খুব একটা আগ্রহই প্রকাশ করে না। মুখে খুব বলে শম্ভু মিত্র শম্ভু মিত্র। আগ্রহ প্রকাশ করে না। কিন্তু এটা ইউএসিজি থেকে ডিভিডি যোগাড় করে দেখতে পারতো। যাই হোক কতটা কে দেখে। তবে উনি বলেছিলেন কোনওনা কোনওদিন কেউনা কেউ হয়তো আগ্রহ দেখাবে আমার থিয়েটারের প্রতি। যখন আগ্রহ হবে, তখন সে একটা কিছু পেলো, সে দেখবে। যেটুকু আছে সেটুকু দেখবে। সেটার ওপর আশা করেই উনি ছিলেন। উনিও আশা করতেন না যে তাঁকে নিয়ে, যার জন্য উনি থিয়েটারটা ছেড়েও দিয়েছিলেন। যে সব থিয়েটারের লোকেরা তাঁকে একেবারে মাথায় করে রাখবে। তাঁর থিয়েটার নিয়ে জয়গান করবে। সে অনেক থিয়েটার কিন্তু থিয়েটার বলে মনে করতো না। এই একই দাম্ভিকতা থেকে এবং দর্শনের দিক থেকে ফলে তাঁরা যে তাঁকেও সেরকম সম্মান দেবে না। এই সম্পর্কে ওনার পরিষ্কার ধারণা ছিলো।

ঋতবাক - দুটো প্রশ্ন করবো আপনাকে আর মূলতঃ। প্রথমত উনি যা করেছেন ওনার সামগ্রিক কাজের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের নাটক একটা খুব বড়ো জায়গা নিয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি ওঁর দৃষ্টিভঙ্গী কেমন ছিলো? নাট্যকার হিসাবে উনি রবীন্দ্রনাথকে কোন জায়গায় রাখতেন? এই যে উনি বারবার রবীন্দ্রনাথকে নির্বাচন করেছেন নাট্যকার হিসাবে, এটা কেন?

রাজা সেন - ভারতীয় থিয়েটার করতে গেলে, ভারতীয় থিয়েটারে উনি যেটুকু প্রযোজনা করেছেন তার মধ্যে অবশ্যই শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই বেছেছেন।

ঋতবাক - পরবর্তীকালে আমরা জানি যে গিরীশ কান্ডারীর মতো বড়ো মাপের ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথের নাট্যকার হিসাবে প্রায় বাতিল করে দিয়েছেন।

রাজা সেন - কিন্তু উনি করেননি। উনি করেননি না, বলা যায় যে উনি মনে করতেন পৃথিবীর অন্যতম সেরা নাট্যকার হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ঋতবাক - আর ওর উত্তরসূরী কাউকে কি উনি রেখে গেছেন? ওঁর লেগেসি কি কেউ বহন করছেন? না শম্ভু মিত্রের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেটা শেষ হয়ে গেলো?

রাজা সেন - সেটা ঠিক জানি না। ভিতরের ইনসিডেন্ট অনেকরকম হয়। উত্তরসূরী আর কারই বা কি থাকে? জানি না। যেমন আজকে উৎপল দত্ত বা অজিতেশবাবু। উৎপল বাবুর সাথেও আমি থিয়েটার করেছি। তাঁর উত্তরসূরী কোথায়? আমরা যে অজিতেশ বাবুর নাটক দেখেছি, কতজন দেখেছেন আমি জানি না।

ঋতবাক - আমি দেখেছি।

রাজা সেন - অজিতেশ বাবুর থিয়েটার দেখা সেটা একটা জীবনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। তারপরে বাংলা মঞ্চ কেন ভারতীয় মঞ্চে, বিদেশ মঞ্চে কয়জন অভিনেতা এইরকমভাবে স্টেজটাকে দখল করে নিয়ে এরকম একটা অসাধারণ অভিনয় যেটা সারাজীবনের স্মৃতিতে থেকে যায়। যেটা শম্ভুদার অভিনয়ের সাথে ছিলো। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ ওরকম মঞ্চ অভিনেতা। যার অভিনয়তে আমরা, তার পরেও সেই অভিনয় ধারাটা আসেনি। আমি দেখতে পারিনি। কোনও উত্তরসূরি নেই।

ঋতবাক - নেই। আমি যেটা জানতে চাইবো সরাসরিভাবে যে, অভিনেতা না পরিচালক কোন শম্ভু মিত্রকে আপনি মনে রাখবেন?

রাজা সেন - দুটোতেই তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন। সেইজন্যই শম্ভু মিত্র।

 
লেখক পরিচিতি - চলচ্চিত্র নির্দেশক

0 comments: