2

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in

(১)

…আঁ আঁ আঁ আঁ...

স্বর বাঁশঝাড়ের পাতা কাঁপিয়ে শীতের নরম রোদে ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র আর্তনাদে। শুধু কি রোদে? শুধু কি বাতাসে? ঝোপঝাড়ের লতাপাতা ফেলে, ঝাঁকড়া আম-তেঁতুলের মাথা চাপিয়ে, শিরীষ-বাবলা-তালের সারিকে ডিঙিয়ে, এপাশের-ওপাশের পুকুর টপকে সেনদের ন’বউয়ের কানে ভেসে আসছে।

ভাত খেয়ে ন’বউ বাসন মাজার জন্য পুকুরের দিকে আসছিলো। শীতের দুপুর। শীতের শুরুও বলা যায়। তেমন ঠান্ডা পড়েনি। হিমেল হাওয়ায় তিরতির করে জলের ঢেউ, পাড়ে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। অন্যদিনে এমন সময় পাড়ার বউরা এঁটো বাসন-কোসন নিয়ে ঘাটে আসে। কিন্তু আজ এ সময় ঘাটে এখনও কেউ আসেনি।

ঘাটের কাছে আসতেই তার চোখ চলে যায় পুকুরের জলে। আলতো ঢেউয়ের উপর জল-ফড়িংরা মাঝে মাঝে লেজ ঠেকিয়ে উড়ে গিয়ে বসছে ঘাসে। জল ছাপিয়ে শান্তি শাকের কয়েকটা ডগাও মাথা দোলাচ্ছে ঢেউয়ের তালে তালে। আর সেই ঘাসের উপর ঐ ফড়িংগুলো একবার বসছে, আবার উড়ছে। এসব দেখে তার বেশ মজা লাগছিলো।

কাপড়ের আঁচলটা কোমরে বেশ করে গোঁজা। এঁটো বাসনগুলো নিয়ে ঘাটের কাছে সবে মাত্র হেঁট হয়ে বসতে যাবে।

তখনই ঐ আকুতিপূর্ণ আর্তনাদ তার কানে ভেসে এল। শোনা মাত্রই হাতের বাসনগুলো হাত থেকে ফসকে পড়লো মাটিতে।ঘটি-বাটি-থালা-হাঁড়ি যা ছিলো, যে যার মতো ছিটকে গেলো।ঝনঝন করতে করতে কোনওটা গেলো পুকুরের জলে, কোনওটা ঘাটে, কোনওটা রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে অনেক দূরে।

আওয়াজ লক্ষ্য করে তাকিয়ে দেখে এ তার ননদ কাজল না? বাঁশ বাগানের ভেতর থেকে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে আসছে।বের হওয়ার মুখটায় হঠাৎ পায়ে পা আটকে গড়িয়ে পড়লো নালার মধ্যে।

ভয়ে আতঙ্কে পড়িমরি করে সে দৌড়ে আসছিলো। কিন্তু গেলো কোথায়? এখন তো আরতাকে দেখা যাচ্ছে না! ন’বউ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সেদিকে। এখন সে আওয়াজও নেই ! তবে কি সে ভুল দেখলো?

না,না সে কি করে হয়! ঐ তো, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঐ তো, এখন ঐ নালা বেয়ে কে যেন উঠে আসছে? ঠিকই দেখছে সে, হাতড়ে যে উঠে আসছে তার কাপড়ে, মুখে, চুলে, বলতে গেলে সারা শরীরে কাদা আর কাদা। চেনাই যাচ্ছে না। কেমন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে তাকে। কেউ যেন তার সারা শরীরে কাদা লেপে দিয়েছে জোর করে। অদ্ভূত রকমে হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসছে এদিকে।

বাঁশ বাগান ও এপারের জিগোল পীঠের ডাঙাটার মাঝে নালা কাটা ছিলো।

বর্ষায় জল পুকুর থেকে বাদার মাঠে বের করে দেওয়া হয় ওটা দিয়েই। সরু করেই কাটা। সেটার জল-কাদা প্রায় মাখো মাখো হয়ে ছিলো। আর পা জড়িয়ে সেটাতেই পড়ে কাজল। কিন্তু যে উঠে আসছে সে কে? এ যেন কাজল নয়! এপারের ডাঙায়, সবুজ ঘাসের বুকে পায়ের ছাপে যে রাস্তা তৈরি হয়েছিলো। সেটা ধরে দৌড়ে আসছে সে। এখন সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি এগিয়ে আসছে ঐ সরু পুকুর পাড় ধরে। তার দু’দিকে পুকুর।পাড়েই তাল-খেজুর-কলাগাছ। সেটার মধ্য দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে আসছে আর আতঙ্কে চেঁচাচ্ছে

…আঁ আঁ আঁ আঁ...

ন'বউয়ের সারা শরীর ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। গায়ের লোম কাঁটা হয়ে উঠলো তার। এমন ভর দুপুরে ঐ বাঁশ বাগান থেকে এমন রূপে ছুটে আসতে দেখে তার মনে হলো সে যেন তাকেই এবার ধরতে আসছে। সে যেন আর কাজল নয়, অন্য কেউ। তার হাড় হিম-শীতলতায় যেন জমে যাচ্ছে। মুখ থেকে আর কথা বের হচ্ছে না। শুধুগো‍ঙানির আওয়াজ ঠোঁটেই আটকে যাচ্ছে।

তার মনে পড়ছে ক’দিন আগেই ঐ পাড়েই ওদের পাড়ার এক বউ গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। সেই থেকে ঐ পাড়ে বউ-ঝিরা যাওয়া প্রায় কমিয়ে দিয়েছে। যদিও বা যায়, তো সঙ্গে কাউকে নিয়ে। তাছাড়া ঐ বাগান, জমিদার বাবুদের পুকুর পাড়, সঙ্গে ওই পোড়া বাড়ি কেমন যেন স্তব্ধ হয়েথাকে। রাতে কত রকমের আলো জ্বলে ঐ বাঁশঝাড়ে, পাড়ের গাছে গাছে।এক এক দিন ঐ বাঁশবাগান থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। শুনলে মনে হবে কেউ বুঝি কঁকিয়ে কঁকিয়ে কাঁদছে। কেউ কেউ আবার বিশ্বাস করে না। বলে

…বাঁশের গায়ে বাঁশের ঘোষা খাওয়ার আওয়াজ।

তবে ঐ বাঁশঝাড়ের উপর বড়ো তেঁতুল গাছ এমন করে মিশে আছে যে দিনের বেলায়ও যেন অন্ধকার করে রাখে। আর তাদের সঙ্গে মিশে আছে একটা খুব পুরনো শ্যাওড়া গাছ। তার আসল শেকড় কোনটা তা কেউ বলতে পারে না। সারি দিয়ে আছে। ভয়ে ভয়ে পাড়ার বউ-ঝি-মেয়েরা সকালে ঐ গাছের নিচু মোটা ডালে সকালে নিত্য কাজ সম্পন্ন করে আসে। তারা এও জানে …ঐ শ্যাওড়া গাছে নাকি শ্যাওড়া ভূতের বাস। ওখানে গেলে সবার গা ছমছম করে ঠিকই, কিন্তু সে কোনওদিন তাদের চোখে দেখেনি।তবে আজ এখন তার মনে হলো কাজলের ঐ কাদা মাখা রূপই যেন সেই শ্যাওড়া ভূত! সে যেন তার ঘাড় মটকেদেবে বলে তার দিকে ধেয়ে আসছে। ন’বউয়ের চোখ স্থির হয়ে গেছে।কাছে পিঠে কেউ নেই যে এসে তাকে উদ্ধার করবে। ভয়ে প্রাণপনে চেঁচাচ্ছে, গলা ছিঁড়ে যেন এখন আওয়াজ বেরিয়ে আসছে।

…আঁ আঁ আঁ আঁ...

প্রাণ হাতে করে দিলো দৌড়।

দৌড়তে গিয়ে মাটির ঠেলায় হোঁচট খেয়ে গড়িয়ে গেলো কিছুদূরে। পা টেনে আর উঠতে পারছে না। মচকে গেছে বুঝি। ভয়ে তার হাত-পা যেন সেঁধিয়ে যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা গলায় চেঁচাচ্ছে।

…কা-কা-কাজলকে ভূ-ভূ-ভূতে ধরেছে গো।কা-কা-কাজলকে ভূ-ভূ-ভূতে ধরেছে।

ন’বউয়ের এমন ভয়ার্ত চিৎকারেবাড়ির থেকে কয়েকজন তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এল। দেখে ন’বউ মাটিতে পড়ে সমানে আর্ত চিৎকার করছে।বাসনপত্র আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ঠিক তখনই পুকুরে ঝপাস করে একটা ভারী কিছু পড়েছে বলে মনে হলো। জলের জোরালো ঢেউ এখন আছড়ে পড়ছে পাড়ের গায়।

এদিকে বাড়ির লোকদের দেখে ন’বউ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জগন ন’বউকে তুলতে গিয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখে, কেউ যেন জলের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। হাত দুটো জলের উপর জেগে জেগে উঠছে। জগন তড়িঘড়ি করে ঝাঁপিয়ে পড়লো পুকুরে।

সাঁতরে তার কাছে যেতেই আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ঘাটের কাছে যারা এল তারাও হকচকিয়ে গেলো। এ কেমন হলো?দু’জন গেলো কোথায়?

জগনকে কি তবে? না, না, না!

ডাঙায় থেকে শিউড়ে উঠছে সবাই। হঠাৎ ভূস করে জগন কাকে একটা টেনে তুললো জলের উপর।

ততক্ষণে পাশাপাশি বাড়ির থেকে কয়েক জন বেরিয়ে এসছে। সকলে মিলে দু’জনকে ঘাটের উপর টেনে তুললো। দেখে, আরে এ তো কাজল যে! তখনও হুঁশ আছে তার। চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তার শরীরে সব জোর যেন কেউ হরণ করে নিয়েছে।শরীর যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। তবু সর্বশক্তি দিয়ে সে বাঁশ বাগানের দিকে হাত বাড়িয়ে কি একটা বলতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

সবাই অবাক হয়ে গেলো, সাঁতার জানা সত্ত্বেও সে কেনই বা হাবুডুবু খাচ্ছিলো! কয়েকজন পাঁজাকোলা করে তাকে নিয়ে গেলো বাড়ির ভেতরে।

ন’বউয়ের চোখে মুখে জলের ছিটে দিতেই ধরমড়িয়ে উঠে বসলো। সারা শরীরে ভয় যেন জড়িয়ে রয়েছে।কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বাগানের দিকে হাত ভয়ে চেঁচাতে লাগলো

…ভূ-ভূত, ভূ-ভূ-ততততততত… কা-কা-কাজল…

জড়ো হওয়া সবাই এখন বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো সেই বাগানের দিকে।


(২)

শীতের বেলা ঝপ করে পড়ে এল। ম‍্যাড়মেড়ে রোদ্দুরে ভয়ের অশরীরী রূপ যেন মৃদু হিমেল বাতাস ভর করে বইতে লাগলো। নিমেষের মধ্যে কাজলের খবর ছড়িয়ে পড়লো এ-বাড়ি থেকে সে-বাড়ি, এ-পাড়া থেকে সে-পাড়ায়, এখনসারা গ্রামে। মেয়ে-ঝি-জোয়ান-বুড়ো কচিকাঁচা যে যেখানে ছিলো দলে দলে এসে হাজির হলো সেন পাড়ায়।

এতক্ষণে বেলাও গড়িয়েছে। পড়ন্ত বিকেলে ঐ বাগানে আর কেউ ঢুকতে চাইছিলো না। কতই বা দূরে ঐ বাঁশবাগান? শরীরে সাহস জোগান দিলেও মনের সাহস বারবার হার মানছিলো।

সাহস করে কেউ এগোতে চাই ছিলো না।

সরু পাড় টপকে, ছোটো ঘাসে ভরা ডাঙ্গা ফেলেই ঐ বাঁশ বাগান। তারপরেই বাবুদের পুকুর। তার খানিকটাপানায় ভরা। কালো জলের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হবে সেই জল যেন টেনে নিয়ে যাবে তার পেটের ভেতরে। মনে হবে এই বুঝি গিলেখেতে আসছে।

ঐ পুকুর পাড়ে নারকেল গাছের সারি। সঙ্গে আম, জাম, বাবলার জমকালো সব শরীর। এই পাড়ের গা জুড়েই অধর বুড়োর কলা বাগান।

তবে এই পুকুরের দক্ষিণ দিকে একটু দূরেই বাবুদের পোড়া জরাজীর্ণ বাড়ি। হৃত-জমিদারি গৌরব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।লতাপাতা বেয়ে বেয়ে উঠেছে তার জীর্ণ শরীরে। কেউ থাকেও না বললে চলে। শুধু বুড়ো ছোটো বাবু যেন সেখানে শেষ দিনের জন্য প্রহর গুনছে।

বিষয়-সম্পদের প্রতি তাঁর আসক্তি নেই। তাই এ পাড়ে নারকেল, লিচু ও আম যেমন পড়ে নষ্ঠ হয়,তেমনি চুরিও হয়। তবে ভয়ে সেখানে কেউ যেতে চায় না সহজে। বুড়ো জমিদার নাকি তার সপরিবারে অশরীরি রূপে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঐ সবকিছুর পাহারা দেয়।

এদিকে বেশ লোক জমে গেছে।তাদের মধ্যে একদল বাঁশ, লাঠি নিয়ে এগিয়ে চললো বাঁশ বাগানের দিকে। মেয়েরা, বাচ্চারা, বয়স্করা ঘাটের কাছে দাঁড়িয়েতাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।

তারা ভয়ে ভয়ে পা ফেললো বাগানের দিকে। শুকনো বাঁশপাতায় এতগুলো লোকের পা পড়তে মচমচ করে উঠছে। বাঁশঝাড়ের নিচটা আরও ঝাপসা হয়ে এসছে।কারও কারও সাহসে ভাঁটা পড়ছে। পা তুলে আর এগোতে চাইছে না। তপন ছিলো সবার পিছনে।

হঠাৎ তার মনে হলো কেউ বুঝি তার গেঞ্জিটা ধরে টানছে। ভয়ে শরীর আড়ষ্ঠ হয়ে আসছে।ঘাড় যেন ঘুরাতে পারছে না। আতঙ্কে চেঁচাতে লাগলো,

…আঁ-আঁ-আঁ-আঁ-আঁ-আঁ-আঁ-আঁ…

সবাই পিছন ফিরে তাকায়। ঠিক তখনই উপর থেকে কিএকটা কালো মতো লাফিয়ে পড়ে তপনের সামনে। পড়েই ওদের মাঝখান দিয়ে দিলো দৌড়।

সবাই ভয়ে হকচকিয়ে গেলো। কেউ কেউ থরথর করে কাঁপছে। কেউ কেউ ছিটকে পড়লো এদিক ওদিক। কেউ কেউ সজোরে রামনাম জপতে শুরু করলো,

…রাম-রাম-রাম-রাম-রাম...

তাদের রাম নাম জপা কানে আসতে ঘাটের কাছে যারা ছিলো তারাও এখন সজোরে চেঁচাতে শুরু করলো

...রাম-রাম-রাম-রাম-রাম... নিমেষে ভয় ছড়িয়ে পড়লো বাতাসে, জঙ্গলে, পাড়ায়-পাড়ায়।

জগন তপনের কাছে এসে দেখে একটা কঞ্চি আটকে রয়েছে তার গেঞ্জিতে।

…শালা, ভয়ে মরছে। ওরে কঞ্চি আটকে আছে তোর গেঞ্জিতে।

তাদের মধ্যে থেকে রাসু বলে উঠলো,

…এই তুই বাড়ি যা বাবা। তোর পায়ে ধরছি। ক্যালানে কোথাকার? আমাদের পিলে চমকে দিলো রে।

সবাই হেসে উঠলো হোহো করে। বলেই

রাসু হাসতে হাসতে বাবুদের পাড়ের দিকে তাকায়। চমকে ওঠে। ভয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে দেখায়,

…ওরে, ওটা কিরে! ঐ নারকেল গাছ থেকে ঝুলছে?

সবাই সেদিকে তাকিয়ে দেখে, নারকেল গাছের অর্ধেক পর্যন্ত একটা সাদা কাপড় ঝুলছে। হাওয়ায় সেটা থেকে থেকে উড়ে উড়ে আসছে ঐ শ্যাওড়া গাছের দিকে।

প্রায় অন্ধকার হয়ে এসছে চারপাশ। মাঠের শাপলা ফুলগুলোর বিবর্ণ হয়ে গেছে। সন্ধ্যা নামছে চুপিসারে। দু’একটা পাখির ডাক এ-গাছ ও-গাছ থেকে কানে ভেসে আসছে। নয় জোড়া সন্দিগ্ধ চোখ অনুসরণ করতে করতে গাছের মাথায় পৌঁছে গেলো। সবার চোখ গাছের মাথায় স্থির হয়ে গেলো নিমেষে। ঘাড় গুঁজে ডালের উপর উপুড় হয়ে আটকে আছে একটা শরীর। কাপড়টা কোমরে বাঁধা। পরনে হ্যাফপ্যান্ট। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। কিসে যেন টেনে টেনে ছিঁড়েছে সেটা। সারা শরীর ফুলে ঢোল। গাছের পাতা বেয়ে মুখ থেকে রস টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে নিচে... মাটিতে,উলু ঘাসে। সেই রসে মাছি বসে ভনভন করছে। ডান হাতের দুটো আঙ্গুল কাটা। পেটের থেকে নাড়ি লম্বা হয়ে ঝুলে রয়েছে গাছের পাতার সঙ্গে। কালো কালো কিসব বসে আছে সেই ঝুলন্ত নাড়ি জুড়ে।মুখটা ঠিক করে দেখাও যাচ্ছে না।

কে যেন ভয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে ক্ষোভ উগরে দিলো,

…এ শালা ঠিক ঐ বুড়ো জমিদারের কাজ। মনে হয় নারকেল পাড়তে উঠেছিলো। দিয়েছে ওমনি ঘাড় মটকে!

তপন থরথর করে কাঁপছে।

…আ-আ-আমি বাড়ি যাব। ঐ শালা বুড়ো আমাদের আর কাউকে ছাড়বে না। সবাইকে মেরে ফেলবে!

জগন তাকে ধমক দিয়ে বলে

…তুই থামবি? এত যদি ভয় তবে এসছিস কেন?

রাসু ভয়ে, রাগে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,

...একে আমরা ভয়ে মরছি। তার উপরে তুই শালা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে...

রাসুর কথা শেষ হবার আগেই কে যেন বলছে,

…তোমরা থাকো আমি টর্চ নিয়ে আসি। বলেই দিলো দৌড়।তপনও রূদ্ধশ্বাসে পিছু নিলো তার।

সেই অন্ধকার বাঁশ বাগানে ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করতে রইলো সবাই। সবার বুক যেন ঢিপঢিপ করছে। সাহসের ভীত একটু একটু করে দুর্বল হচ্ছে। তাদের চোখগুলো রয়েছে সেই গাছের মাথায় মৃত শরীরটার উপর। থেকে থেকে সাদা কাপড়টা উড়ে আসছে তাদের দিকে।

(৩)

ঝিঁঝিঁর ডাক ছড়িয়ে পড়ছে বাঁশ বাগান জুড়ে। দূরের পোড়া বাড়ি থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। জোনাকিরা বেরিয়ে পড়েছে বাঁশঝাড়ে,পানা পুকুরে, পাড়ের গাছে গাছে। কেউ কেউ সমানে

বিড়ি ধরাচ্ছে। গায়ে গায়ে ঘেঁষে রয়েছে। পরস্পর। বাঁশপাতা জড়ো করে যেই আগুন দিলো ওমনি কারা টর্চ নিয়ে দৌড়ে আসছে তাদের দিকে। তাদের একটু দূরেই একটা হ্যাজাক। সঙ্গে বেশ কয়েকজন তার সামনে পিছনে।

আকাশ স্কুল থেকে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলো। তাই বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। গ্রামে ঢুকেই সে জানতে পারে এই ঘটনা। স্কুলের ব্যাগটা বারান্দায় ছুঁড়ে ফেলে হ্যাজাকের পিছু নিল। পিছনথেকে তার মা ডাকছে,

…ওরে, শোন, শোন, যাস না। খেয়ে যা।

কে শুনছে সে বারণ? কে শুনছে সেই অনুরোধ? তাকে যেন কে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই দিকে।

সেদিন রাতের কথা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। রীতি আর চপলা তাকে জোড় করেই এনেছিলো ঐ পাড়ে। সঙ্গে ঐ রমেনদাও।

পাড়ার জ্যেঠুর বাড়িতে পড়তে এসে ছিলো তারা। আরও অনেকেই। রীতি, চপলা তার সমবয়সী।

রমেন তাদের চেয়ে বয়সে বড়ো। কিন্তু রীতি, চপলা, ও আকাশের সঙ্গে সে একই ক্লাসে, একই স্কুলে পড়ে।

হঠাৎ রমেন তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,

…আমি খোঁজ নিয়েছি, কাকা আজ রাত করে বাড়ি ফিরবে। কোথায় নাকি গন্ডগোল হয়েছে, স্কুল করে সেখানে গেছে। কখন ফিরবে তার ঠিক নেই। আজ আর পড়া হবে না। চল, নারকেল পাড়বো। নারকেল পেড়ে এনে আমাদের বাড়িতে সন্দেশ বানাবো। আমাদের বাড়িতে কেউ নেই। মামার বাড়ি গেছে। এই দেখ চাবি!

আকাশ জোরে জোরে মাথা নেড়ে চাপা গলায় বললো,

…না, না, আমি যাব না।

রীতি ও চপলা যেন আগে থেকেই জানতো। দু’জনে তার হাত ধরে হ্যাচকা টানে তুলে বললো,

…যাবে না, চল বলছি।

অগত্যা তাদের সঙ্গ নিল। আগে রমেন, পিছনে আকাশ, মাঝে রীতি ও চপলা। অন্ধকার পাড় দিয়ে তারা এগিয়ে চলেছে চুপিসাড়ে। মনে মনে ভাবছে শীতের সময় সাপেরা নিশ্চয়ই কেউ পথের উপর তাদের জন্যে শুয়ে থাকবে না। তবু ডান হাতের দু’আঙ্গুল দিয়ে টুসকি বাজাতে বাজাতে মনে মনে তিন বার বললো,

…আস্তিক, আস্তিক, আস্তিক।

একটু এগোতেই তার কেমন যেন রোমাঞ্চ রোমাঞ্চ মনে হতে লাগলো।

বাঁশ বাগানের মধ্য দিয়ে হাত ধরাধরি করে তারা এগিয়ে গেলো বাবুদের পাড়ে।

সে আগেও দেখেছে, দুটো গাছে নারকেল পেকে ঝুনু হয়ে আছে। হ্যাঁ, তো সেই গাছের তলায় এসে তারা দাঁড়িয়েছে! আর সেই গাছের নারকেল চুরি তা দিয়ে নিজেরা সন্দেশ বানাবে! ভাবতেই যেমন রোমাঞ্চ হচ্ছে তেমনি তার চেয়ে বেশি ভয় করছে এই দুটো মেয়েকে নিয়ে। তারা দু’জন দুটো সমর্থ মেয়েকে নিয়ে পাড়ে এসেছে যদি কেউ দেখে ফেলে, তাহলে কেলেঙ্কারির আর শেষ থাকবে না। বুক দুরদুর করছে তার।

রমেন ফিস ফিস করে বললো,

…তোরা এখানে দাঁড়া। আমি গাছে উঠছি। চুপচাপ করে থাকবি। ভয় পাবি না। সাড়া করবি না। কেউ ডাকলেও যাবি না।

…কিন্তু নারকেল ফেললে আওয়াজ হবে যে?

রীতির কথায় রমেন জানালো,

…আওয়াজ হবে না। দেখ না কি করি। বলেই কোমরের ধুতিটা খুলে নিয়ে কাছির মতো লম্বা করে তার একপ্রান্ত তাদের হাতে দিয়ে এক খুঁট কোমরে বেঁধে হ্যাফপ্যান্ট পরে তরতরিয়ে গাছে উঠতে লাগলো।

তারা তিন জন অন্ধকারে তাকিয়ে রইলো সেই দিকে।কিছুক্ষণ পরে সে অন্ধকারে গাছের উপরে মিলিয়ে গেলো।

একটু পরেই আকাশদের পাড়ার রাস্তায়, পুকুরের ওপারে একটা টর্চ এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। আলোটা আর কোনওদিকে এগোলও না। কিছুক্ষণ আলোটা নিভেও রইলো। পরে হঠাৎ সেই টর্চের আলো পড়ছে পাড়ের দিকে, এদিক ওদিক। তারা নিচু হয়ে বসে পড়লো। তারা মনে মনে ভাবছে কেউ বুঝি জেনে গেছে যে, তারা এখানে এসেছে। কিন্তু টর্চের আলো বাঁশ বাগানে, ঝোপে-ঝাড়ে আটকে গেলো। কিন্তু তাদের বুক দুরদুর করছে।

একি? টর্চের আলোটা যে সেনদের বাড়ির দিকে মিলিয়ে গেলো!

ওদিকে সেনদের বাড়ি থেকে হ্যারকিন হাতে কে একটা গুনগুন করতে করতে আকাশদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। অল্প আলোয় তার পায়ের কালো কালো লম্বা ছায়া গাছের গায়ে আরও প্রকট হয়ে বাড়িগুলোর আড়ালে মিলিয়ে গেলো। কিন্তু কে গেলো, তা তারা ঠাওর করতে পারলো না।

এমনি করে বেশ কিছুক্ষণ কেটেও গেলো। রমেনের কোনও সাড়া নেই। জোনাকিরা পিটপিট করছে এদিক ওদিক।পুকুরে পানার উপর দিয়ে কি একটা হুড়মুড় করে পাড়ের দিকে এল। চমকে উঠলো তারা।

না, সন্দেশ খাবার সাধ যেন মিটে আসছে। রীতি চুপ করে থাকতে পারলো না। আকাশকে বললো,

…আমার না, ভয় ভয় করছে। ডাক না রমেনদাকে। নেমে আসতে বল না।

চপলাও বলছে,

…ডাক না, ফিরে যাই চ।

রীতি ও চপলা সেখানেই হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে রইলো।

আকাশও মনে মনে তাইই চাইছিলো। তাদের সরব সমর্থনে সে গাছের কাছে এগিয়ে গেলো।

ধুতিটা ঝুলছে গাছের প্রায় মাঝখানে। গাছের গায়ে মুখ ঠেকিয়ে দিয়ে চাপা গলায় ডাকছে।

…রমেনদা, রমেনদা, ওওওওও রমেনদা।

কোনও সাড়া নেই। গাছের পাতা ঝটপট করছে।

আবার ডাকলো একইরকমভাবে,

…রমেনদা, রমেনদা, ওওওওও রমেনদা।

আবারও কোনও সাড়া নেই।

টুপটাপ করে দু’একটা কি ঝরে পড়লো নিচে। নিমেষে ভয় জাঁকিয়ে বসলো তাদের শরীরে।

হিমেল রাতে রোমকূপ দিয়ে ঘাম আসতে লাগলো সবার। চপলা ও রীতি ভয়ে আড়ষ্ঠ ও জড়োসড়ো হয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে,

…এই জন্য বলেছিলাম আসবো না।

…এখন পালাতে পারলে বাঁচি। হ্যাঁ রে,

ওগুলো র-র-রমেনদার হাড় নয়তো?

রীতির ভয়ার্ত শীতল নিঃশ্বাস আকাশের গায়ে এসে পড়ছে।

এখন তার মনে হচ্ছে এ নিঃশ্বাস রীতির নয়। যেন অন্য কারওর।

এখন অন্ধকারও যেন তাদের শরীরগুলোকে জাপ্টে ধরছে। শীতের ঝাপসা অন্ধকার এখন গাছে, ঝোপে ঝাড়ে আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে।

মাঝে মাঝে গাছের ওপর থেকে ঝটপটানির অদ্ভূত আওয়াজ যেন গাছ বেয়ে, অন্ধকার বেয়ে নেমে আসছে অশরীরি রূপ নিয়ে।

আবার, আবার হুড়মুড়িয়ে ছোটো ছোটো অনেকগুলো কি সব গাছের থেকে ছড়িয়ে পড়লো গাছের গোড়ায়, তাদের গায়ে, মাথায়। টপাস টপাস করে কয়েকটা গিয়ে পড়লো পুকুরের জলে, কয়েকটা পড়ল মাঠের জমা জলে। মনে হলো কেউ যেন ওপর থেকে কিছু ফেলে দিচ্ছে এদিক ওদিক। সেই আওয়াজ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে অনুরণিত হয়ে ভেসে যেতে লাগলো শীতের শরীর জুড়ে।

আকাশ ভূতে বিশ্বাস করে না করলেও তবু এদের সাহচর্যে তার সারা শরীর জুড়ে ভয়ের চোরা স্রোত বইতে লাগলো। তখন তার মনে পড়ছে, তার ঠাকুর্দা নাকি এই পাড়েই দু’বার ব্রহ্মাদত্যি দেখেছে।

ইয়া বড়ো, এ পাড়ের গাছ থেকে ও পাড়ের কৎবেল গাছে লম্বা লম্বা পা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে কথা মনে পড়তে ভয় যেন শিরশির করে সারা শরীরে দোলা দিচ্ছে।

ততক্ষণে রীতি ও চপলা আকাশের গায়ের কাছে ঘেঁষে এসেছে। তাদের কিশোরী শরীরের উদ্বেলিত সুডৌল নরম বুকের মোলায়েম স্পর্শ তার শরীরে শিহরণ তুলছে ভেতরে ভেতরে। কোমল শরীরের স্পর্শে সে যেন হারিয়ে যাচ্ছে অনাস্বাদিত নবীনানুভূতিতে।

ঠিক তখনই একটা ভারি কিছু পড়লো গাছ থেকে। কী সব ছিটকে এসে পড়লো তাদের পায়ে-গায়ে-মুখে।

রীতি, চপলা থরথর করে কাঁপছে। তাদের পায়ের তলার মাটি যেন সরে যাচ্ছে।

নিমেষে আকাশের সেই অতৃপ্ত শরীরী অনুভূতি মিলিয়ে গেলো ভয়ার্ত শীতলতায়। শ্যাওড়া গাছের ডালগুলো খুব জোরে নড়ে উঠলো। কোথা থেকে দমকা হাওয়া এসে বাঁশ গাছে আছড়ে পড়লো। নারকেল গাছটাও দুলছে।

সঙ্গে সঙ্গে বাঁশ বাগান থেকে কার যেন মর্মবিদারক কোঁকানির আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে অন্ধকারের শরীর জুড়ে সারা পাড়ে, সারা গাছপাতায়।

চপলা ঠকঠক করে কাঁপছে আর বলছে,

…ভূ-ভূ-ভূত আমার পু-পু-পুত

সা-স-সাকিনি আমার ঝি,

রা-রা-রাম লক্ষণ বুকে আছে

ভয়টা আমার কি?

সবার গা ভয়ে কাঁটা দিচ্ছে।

রীতি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলার কিছু চেষ্টা করলো। কথা যেন আর মুখ থেকে বের হচ্ছে না,

…ওটা ম-ম-ম-ম-ম-ম-ম-মনে হয় র-র-রমেনদার মাথা, ছি-ছি-ছিটকে পড়েছে জলে। আমি আর থাকবো না।

বলেই চপলার হাত ধরে টান মেরে দিলো দৌড়। আকাশ নিরুপায় হয়ে তাদের পিছু নিল।

রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে তারা আর তাদের পিছনে যেন ধেয়ে আসছে সেই আর্ত মর্মবিদারক কোঁকানির সুর।

পরের দিন আকাশ রমেনদের বাড়ি গিয়ে দেখে দরজায় তালা দেওয়া। সে নাকি তার মামার বাড়ি গেছে।

সে তো আজ দু’দিন হয়ে গেছে। কে যেন তাকে টোকা দিলো,

…এই তুই আসছিস যে বড়ো। যা, বাড়ি যা।

এতক্ষণ আকাশ তাদের পিছু নিয়েছিলো। হঠাৎ তাকে টোকা দেওয়ায় সে যেন চমকে ওঠে। কোনও উত্তর দিলো না। তবু তাদের পিছু নিল।

সেনদের পুকুর ঘাটে থেকে লোকে নানান কথা তাদের কানে আসছে।

কারও হাতে হ্যারিকেনের আলো।কারও হাতে কেরোসিনের বাতি। দূর থেকে সেই উদ্বিগ্ন মুখগুলো এই অল্প আলোয় কেমন কেমন কালো কালো লাগছে।

কে যেন আকাশকে বলেছে,

…কিরে তুই আবার আসছিস কেন? যা, বাড়ি যা।

ততক্ষণে সে সবার সঙ্গে গাছের তলায়। টর্চের আলোয় গাছের উপর সেই উপুড় হওয়া উদ্ভাসিত শরীরটা দেখে তার পিলে চমকে ওঠে।কাপড়টা এখনও ঝুলছে সেই একইরকমভাবে।মনে মনে ভাবছে,

…তবে, রমেনদা কি মামার বাড়ি যায়নি?

ওপর থেকে গাছের গোড়ার দিকে তাকিয়ে দেখে, পাড়ার দু’জন তরতরিয়ে গাছে উঠছে।

হ্যাজাকের আলোয় পাড় আলোকিত হয়ে উঠেছে। জোনাকিরা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ঝিঁঝিঁর ডাকা আর নেই। আজ এই অন্ধকারে শ্যাওড়া-তেঁতুল-বাবলা গাছ, বাঁশবাগান, পুকুর সবই যেন থমথমে হয়ে প্রহর গুনছে। কারও মুখে কোনও আওয়াজ নেই।

একটু দূরেই মাঠের মাঝখানে একটা ছেলে পোতা আছে। তার চারদিকে জল আর জল। সেই ডাঙা থেকে এখন শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। ছমছম করছে চারদিক।

শিউড়ে উঠছে আকাশ। এদিকে লোকদুটো গাছের মাঝখানে উঠে কাপড় ধরে টানাটানি করছে। সেই টানে নারকেল গাছের পাতা দুলছে, শরীরটাও দুলছে।

কে যেন বলছে,

…ওরে গাছে ওঠ, না তো পড়বে না।

জগন বলছে,

…পুলিশ আসুক। কাল দিনের বেলায় দেখা যাবে। এখন চল পালাই সব। কি হতে কি হবে? চল বাপু পা...

তার মুখের কথা শেষ হতে না হতে,

হ্যাচকা টানে সেই শরীরটা আছড়ে পড়লও নিচে। পালাতে গিয়ে হ্যাজাক গেলো নিভে। মড়াৎ করে শ্যাওড়া গাছের একটা ডাল পড়লো ভেঙে।

নিমেষে অন্ধকার আর ভয় ঘিরে ধরলো চারপাশ। আর্ত চিৎকারে যে যার মতো পালালো। ভয়ঙ্কর শোরগোলে তেঁতুল গাছের কাকেরা কাঁ কাঁ করে উড়তে সুরু করলো। যে যার মতো পালাতে গেলো... কেউ কেউ পড়লো পুকুরে, কেউ ঝোপের মধ্যে, কেউ বাঁশের ঝাড়ে। কে একটা ভয়ে আর্ত চিৎকার করছে। তার পা ধরে কেউ যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে কাঁদছে আর চেঁচাচ্ছে,

…আমার পা ছাড়ড়ড়ড়ড়ড়ড়ড়…

আমার পা ছাড়ড়ড়ড়ড়ড়ড়ড়…

পড়িমরি করে প্রাণ হাতে রুদ্ধশ্বাসে সব দৌড়াচ্ছে। যারা জলে পড়েছিলো সাঁতার কেটে পাড়ের দিকে আসছে। ঘাটের কাছে যারা ছিলো তারাও কিছু একটা অনুমান করে আঁ আঁ করে চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়ির দিকে পালালো।

বাঁশঝাড়, পুকুর পাড় এখন কুপকুপে অন্ধকারে ঢেকে গেছে। ঝিঁঝিঁ ডাকছে জোরে জোরে।

অশরীরী ভয় যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। একটা কোঁকানির মর্মবিদারক করুন আর্তনাদ বাঁশঝাড় থেকে ছড়িয়ে পড়ছে হিমেল বাতাসে।

2 comments:

  1. ধন্যবাদ। অনেক শুভেচ্ছা জানবেন।

    ReplyDelete