0

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in



















মনুসংহিতায় নারী

উত্তরভারতে এখন একজনই আরাধ্য— মর্য্যাদাপুরুষোত্তম রামচন্দ্র।

কিন্তু আদর্শপুরুষ রামের পত্নীর প্রতি ব্যবহারও তো আদর্শ হওয়া উচিত। অথচ বাল্মীকি রামায়ণে দেখছি উনি সীতাকে দু’দুবার সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললেন। আসন্ন প্রসবের সময় সীতাকে বনবাসে পাঠালেন। শুধু তাই নয়, লংকা বিজয়ের পর পতির দেখা পেয়ে আনন্দিত সীতাকে কটুবাক্যে বললেন— ‘সীতা, ভেব না আমি তোমার জন্যে এই যুদ্ধ করেছি। আমি রাবণকে পরাজিত করে লংকা দখল করেছি নিজের সম্মান ও হৃতগৌরব উদ্ধার করতে। আজ আমার পৌরুষ তৃপ্ত’। সীতা অবাক, সীতা কাঁদো কাঁদো।

রামের ক্রোধ বেড়ে গেলো। চোখ পাকিয়ে সীতার দিকে তাকিয়ে উনি উপস্থিত সমস্ত রাক্ষস ও বানর সেনার সামনে সীতাকে বললেনঃ

“সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছ, কিন্তু তুমি আমার চক্ষুশূল। কারণ তোমার চরিত্র নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। কাজেই তোমাকে অনুমতি দিলাম-দশদিকের যেকোন দিকে সোজা চলে যাও। দূর হয়ে যাও। পরগৃহে এতদিন ছিলে, কোন উচ্চবংশীয় পুরুষ এমন নারীকে ফিরিয়ে নেবে? তুমি রাবণের অঙ্কশায়িনী। আমি যা বলছি তা অনেক ভেবে বলছি। যদি মন চায় তো লক্ষ্মণ, ভরত, বানরশ্রেষ্ঠ সুগ্রীব বা রাক্ষস শ্রেষ্ঠ বিভীষণ—যার কাছে ইচ্ছে হয় চলে যাও। রাবণ তোমার অপরূপ স্বর্গীয় রূপ দেখেছিল। নিশ্চয়ই ওর গৃহে তোমাকে ছুঁয়েছে”। সীতা কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারালেন। (মূল বাল্মীকি রামায়ণের সংস্কৃত থেকে নীতি আয়োগের প্রাক্তন সদস্য বিবেক দেবরায়ের করা ইংরেজি থেকে বাঙলা অনুবাদ প্রবন্ধকারের)।

যদিও বর্তমান সমাজের মূল্যবোধের মানদণ্ডে পত্নীর প্রতি রামের ব্যবহার ও কটুবচন শুধু অন্যায় নয়, অকল্পনীয়। কিন্ত সেই সময়ের মূল্যবোধে? তখন তো মনুস্মৃতিই পঞ্চম বেদের মর্য্যাদা পেয়েছিল।

সাধে কি “রামচরিতমানস” রচয়িতা ভক্তকবি গোস্বামী তুলসীদাস বলেছেনঃ

“চোর ঢোর গাঁওয়ার শূদ্র অউ নারী,

ইয়ে সব হ্যায় তাড়ণ অধিকারী”।

বাংলায় বললে-“ চোর মোষ গোঁয়ার, শুদ্র ও নারী,

এদের সামলে রাখতে চাই লাঠির বাড়ি”।

এবার নারীদের সম্পর্কে মনুস্মৃতি কী বলে দেখা যাক।

কিন্তু এত ভাবার কী আছে? নীটশে নাকি বলেছেন “I know of no book in which so many delicate and kindly things are said of woman as in the Law book of Manu”

নাঃ, হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। সায়েবসুবো মাথায় থাক, মনুস্মৃতিই খুলে বসা যাক।

গোড়ায় সৃষ্টিতত্ত্বে বলা হচ্ছে স্রষ্টা নিজদেহ দ্বিধা বিভক্ত করে অর্ধভাগে পুরুষ হলেন, বাকি অর্ধে নারী। তার থেকে বিরাট পুরুষ সৃষ্ট হল, যিনি মনুর স্রষ্টা।(১/৩২)।

এত একেবারে কবি নজরুলের লাইনঃ “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর; অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”। (সাম্য)

তাহলে তো নারী পুরুষ সমান সমান, কোন পক্ষপাতের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু পুরুষ যখন সামাজিক প্রথা, আইনকানুন বানাতে শুরু করল তখন নিজেদের দিকে টেনে খেলল। নারী আর সুখে দুঃখে সমান অংশীদার রইল না। ‘ওরা’ এবং ‘আমরা’র খেলা শুরু হয়ে গেলো। ‘এ বাণী প্রেয়সী হোক মহীয়সী তুমি আছ, আমি আছি’ শুধু কবির ইচ্ছেয় রয়ে গেলো। মনুসংহিতায় এবার সেই খেলাটাই পর্বে পর্বে দেখব।

নারীদের স্বভাবই হল পুরুষদের দূষিত করা। সাধু সাবধান! (২/২১৩)

সত্যিই তো, ইডেন গার্ডেনে সাদাসিধে আদমকে আপেল খেতে কে প্ররোচিত করেছিল?

তাই স্ত্রীলোক হল রথ অশ্ব ছত্র ধন ধান্য পশু জিনিসপত্র বা তামার মতোই লুটের মাল; যে জিতে নেবে তার। (৭/৯৬)।

এই জন্যেই বোধহয় পঞ্জিকায় বিশেষ বিশেষ তিথিতে কোন কোন জিনিস সেদিন খাওয়া যাবেনা তার লিস্টিতে “স্ত্রী সম্ভোগ” জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন, মৎস্য মাংস অলাবু বার্তাকু ভক্ষণ এবং স্ত্রীসম্ভোগ নিষিদ্ধ।

রাজা মন্ত্রণাকালে জড়বুদ্ধি, বোবাকালা, অঙ্গহীন, ম্লেচ্ছ, রুগ্ন, অতিবৃদ্ধ, টিয়েপাখি এবং স্ত্রীলোককে ওখান থেকে সরিয়ে দেবেন। কারণ এরা গোপন খবর ফাঁস করতে পারে। (৭/১৪৯-১৫০)।

স্ত্রী, পুত্র ও দাস—এই তিনজনই ধনহীন। এরা যদি কিছু উপার্জন করে তাহলে সেটা তাদের মালিকেরই সম্পত্তি হয়ে যাবে। (৮/৪১৬)।

দেখুন স্ত্রীজাতির উপনয়ন বা দ্বিতীয় জন্ম হয়না, ওরা দ্বিজ ন’ন; তাই ওদের বেদ পাঠে অধিকার নেই। তাহলে ওঁদের সংস্কার বলতে কী রয়েছে?

—স্ত্রীলোকের জন্যে বিবাহবিধিই বৈদিক সংস্কার, পতিসেবাই গুরুগৃহে বাস, এবং গৃহকর্মই তাঁদের যজ্ঞ বা অগ্নি-পরিচর্যার সংস্কার। (২/৬৭)।

দুর্গাপুজোয় অঞ্জলি দিতে গিয়ে অনেকেরই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে পুরুত মশায় বলছেন— ব্রাহ্মণেরা ওঁ বলবেন। অন্যেরা এবং সমস্ত মা-বোনেরা ‘নমঃ’ বলবেন। ঠাকুরমশায়ের দোষ নেই। ‘ওঁ’ হল প্রণব-বৈদিক মন্ত্র; উপবীতধারী বিনা কারও অধিকার নেই উচ্চারণ করার। ব্রাহ্মণের স্ত্রী হলেও নয়। মনুর বিধান যে!

লালন গেয়েছেন— যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীজাতির কী হয় বিধান,

ব্রাহ্মণ চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনি চিনি কিসে রে?

স্ত্রীজাতির ধর্ম

সে না হয় হল, কিন্তু স্ত্রীজাতির ধর্মাচরণ, মানে দৈনন্দিন জীবন কেমন হবে, সে’ব্যাপারে মনু কিছু বলে যাননি? আলবাৎ বলেছেন।

নিজের ঘরেও বালিকা, যুবতী বা বৃদ্ধা নারী স্বাধীনভাবে কিছু করবেন না। (৫/১৪৭)

“বাল্যে পিতুর্বশে তিষ্ঠেৎ পাণিগ্রাহস্য যৌবনে।

পুত্রাণাং ভর্তরি প্রেতে ন ভজেৎ স্ত্রী স্বতন্ত্রতাম।। (৫/১৪৮)

নারী বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রদের অধীন; কখনও স্বাধীনভাবে থাকবেন না।

পতি দুশ্চরিত্র, কামুক বা গুণহীন হলেও তিনি সাধ্বী স্ত্রী‘র কাছে সর্বদা দেবতার মত সেবা পাওয়ার যোগ্য। (৫/১৫৪)।

বোঝাই যাচ্ছে কেন সতী অনুসূয়া কুষ্ঠরোগী স্বামীর ইচ্ছে মেটাতে তাকে কাঁধে করে বেশ্যাবাড়ি নিয়ে গেছলেন; সে রবীন্দ্রনাথ এই আখ্যানটিকে পুরুষের কাপুরুষতার চরম উদাহরণ বলে যতই গালমন্দ করুন না কেন!

স্ত্রীলোকের আলাদা কোন যজ্ঞ, ব্রত বা উপবাস নেই। তিনি যে পতিসেবা করেন তাতেই স্বর্গে পূজো পাওয়ার যোগ্য হন। (৫/১৫৫)

পতি মৃত হলে স্ত্রী পবিত্র ফল মূল খেয়ে দিন কাটাবেন, কিন্তু অন্য পুরুষের নাম পর্য্যন্ত নেবেন না। (৫/১৫৭)

স্ত্রী সন্তানের মা না হলেও পতির মৃত্যুর পরে ব্রহ্মচর্য পালন করে স্বর্গে যাবেন। (৫/১৬০)।

সন্তান লোভে যে নারী স্বামীকে এড়িয়ে ব্যভিচারিণী হন, তিনি ইহকালে নিন্দিত, এবং পরকালে পতিলোক থেকে পতিত হন। (৫/১৬১)।

স্ত্রী স্বামীকে অবহেলা করে ব্যভিচারিণী হলে সংসারে নিন্দে হয়, সে পরের জন্মে শেয়াল হয়ে জন্মায় এবং যক্ষ্মা কুষ্ঠ আদি পাপরোগের শিকার হয়। (৫/১৬৪)।

স্ত্রী মারা গেলে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ স্বামী ওঁর চিতায় আগুন দিয়ে ফের বিয়ে করবেন। (৫/১৬৮)।

যে নারী পিতার ধনের গর্বে বা নিজ সৌন্দর্যের অহংকারে স্বামীকে ত্যাগ করে, তাকে রাজা সবার সামনে কুকুর দিয়ে খাওয়াবেন। (৮/৩৭১)


স্বামী-স্ত্রীর পালনীয় ধর্মঃ

নবম অধ্যায়ে এব্যাপারে বিস্তৃত নির্দেশ দেয়া রয়েছে। এখানে স্থানাভাবে তার কয়েকটি উল্লেখ করছি।

পুরুষেরা স্ত্রীদের দিনরাত পরাধীন রাখবেন (৯/২)

স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয় (৯/৩)।

বিয়ের বয়েস হলে কন্যা সম্প্রদান না করলে পিতা, ঋতুকালে পত্নীগমন না করলে পতি, পিতা মৃত হলে মায়ের দেখাশুনো না করলে পুত্র নিন্দের পাত্র হয় (৯/৪)।

অরক্ষিত স্ত্রীলোক পিতৃ, মাতৃ উভয়কুলের দুঃখের কারণ (৯/৫)।

মদ্যপান, দুষ্টলোকের সংসর্গ, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি, ঘুরে বেড়ানো, অকাল নিদ্রা, পরগৃহে বাস— এই ছয়টি নারীর ব্যভিচারাদি দোষের কারণ (৯/১৩)।

এরা রূপ দেখে না, বয়স দেখে না; পুরুষ রূপবান বা কুরূপ যাই হোক, পুরুষ দেখলেই সম্ভোগরত হয় (৯/১৪-১৫)।

ব্রহ্মা এদের এমন স্বভাব দিয়েই সৃষ্টি করেছেন, কাজেই পুরুষ স্ত্রীলোকের রক্ষার ব্যাপারে বিশেষ প্রযত্ন করবে (৯/১৬)।

মনু স্ত্রীদের স্বভাবে দিয়েছেন– শয়ন, উপবেশন, অলংকার, কাম, ক্রোধ, কুটিলতা, হিংসুটেপনা, মন্দ আচরণ (৯/১৭)।

স্ত্রীলোকের ব্যভিচারের প্রায়শ্চিত্তের শ্রুতি বা বৈদিক মন্ত্র হলঃ আমার মাতা যে অসতী হয়ে পরপুরুষ সম্ভোগ করতে চেয়েছেন, ওই ইচ্ছায় অপবিত্র হওয়া (মাতৃরজঃস্বরূপ) শুক্রকে আমার পিতা শুদ্ধ করুন (৯/২০)।

তবে নীচকুলে জাত স্ত্রী উচ্চকুলের পতির সঙ্গে মিলিত হলে পতির ভাল গুণ প্রাপ্ত হন। যেমন শূদ্রজাতীয় অক্ষমালা বশিষ্ঠের সঙ্গে এবং শারঙ্গী মন্দপালের সঙ্গে মিলিত হয়ে মাননীয় হয়েছিলেন (৯/২৩)।

নারী হল খেত, পুরুষ হল বীজ। দুয়ের মিলনে সন্তান। কখনও খেত প্রধান, কখনও বীজ। উভয়েই সমান হলে সন্তান ভালো হয়ে জন্মাবে। (৯/৩৩,৩৪)।

সন্তানের জন্ম দেয়া, তাদের বড় করা এবং প্রতিদিনের অতিথিসেবা আদি রীতিনীতির জন্যে স্ত্রীলোকেরা লক্ষ্মী (৯/২৬,২৭)।

নিয়োগপ্রথা

প্রাচীন ভারতে নিয়োগপ্রথা ছিল। মহাভারতে কুরুবংশে দুই রাণী অম্বিকা ও অম্বালিকা নিঃসন্তান। তাই মাতা সত্যবতীর আগ্রহে সম্পর্কে দেবর বেদব্যাস এসে দুইরাণীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডু এবং শূদ্রাণীর গর্ভে বিদুরের জন্মের কারণ হয়েছিলেন। এবার দেখুন নিয়োগ নিয়ে মনু কী বলছেনঃ

সন্তানের অভাবে পতি প্রভৃতি গুরুজনের দ্বারা সম্যকরূপে নিযুক্ত হয়ে নারী দেবর বা সপিন্ড (নীচের টীকা দেখুন) কারও থেকে সন্তানলাভ করতে পারে, কিন্তু একটির বেশি নয় (৯/৫৯)।

বিধবা নারীতে, নিয়োগ ব্যাপারটা নিয়মমাফিক সম্পন্ন হলে তারপরে তারা দু’জন পুত্রবধূ ও বড় ভাইয়ের মতো আচরণ করবে (৯/৬২)।

কিন্তু ব্রাহ্মণের বিধবা অন্য পুরুষের সঙ্গে এভাবে ‘নিযুক্ত’ হতে পারে না। তাহলে সনাতন ধর্ম নষ্ট হবে (৯/৬৪)।

মনে হয় নিয়োগ বা বিধবার যৌনতা নিয়ে মনু দ্বিধায় ছিলেন, তাই সাবধান করছেন- একের বেশি সন্তান নয়, এরপর কামবশে ফের মিলিত হওয়া পাপ। (৯/৬১, ৬৩)।

কিন্তু বিবাহ সংক্রান্ত মন্ত্রে কোথাও ‘নিয়োগ’ এর উল্লেখ নেই। বিবাহ বিধায়ক শাস্ত্রে কোথাও ‘বিধবা-বিবাহ’এর কথা বলা হয়নি।

পন্ডিত দ্বিজগণ এই ‘নিয়োগপ্রথা’কে পশুধর্ম বলেছেন। এসব অধার্মিক বেনরাজার কীর্তি। উনিই কামের পরবশ হয়ে এসব শুরু করিয়ে পৃথিবীতে ‘বর্ণসংকর’ (বাস্টার্ড) সৃষ্টি করেছিলেন। (৯/৬৬,৬৭)।

স্বামী-স্ত্রী-নিয়োগ এসব নিয়ে ঢের হল। এবার খোদ বিবাহ নিয়েই মনুর বিধান নেড়েচেড়ে দেখা যাক। এতে অবধারিত ভাবে জাতিভেদের প্রশ্ন উঠবে।

বিবাহঃ

প্রথমে মেয়ে দেখা হোক।

নিজ বর্ণের সুলক্ষণা মেয়ে বিয়ে করা উচিত। যে কন্যা মাতার সপিন্ড এবং পিতার সগোত্র নয়, সেই মেয়েই দ্বিজের ( ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য, যার পৈতে হয়েছে) বিবাহে এবং মৈথুনে উপযুক্ত (৩/৪-৫)।

কিন্তু স্বজাতেও কেমন মেয়েকে বিয়ে করা উচিৎ নয়? নীচের দশ রকমের পরিবারের মেয়ে আনতে নেইঃ

যেসব পরিবার হীন কাজ করে, পুরুষসন্তান নেই, বেদপাঠহীন, শরীর লোমে ভরা, অর্শ, যক্ষ্মা, অ্যাসিডিটি, শ্বেতী বা কুষ্ঠরোগগ্রস্ত (৩/৭)।

যে মেয়ে কপিলবর্ণা, মানে যার গায়ের রঙ পাঁশুটে, হাত-পায়ে বেশি আঙ্গুল, রোগী, লোমহীনা, বেশি লোম, বাচাল আর যাদের নামে নক্ষত্র, বৃক্ষ, নদী, পর্বত, পক্ষী, সর্প, দাস আছে বা ভীতিজনক নাম—তাদের বিয়ে করবে না।

এটা মানলে তো আমাদের ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় অবস্থা হবে (৩/৮-৯)।

বিয়ে করবে এমন মেয়েকে যে অঙ্গহীন নয়, হংসগতি বা গজগামিনী, যার নাম ধরে সহজে ডাকা যায়, যার লোম ও কেশ কোমল, দাঁত ছোট, অঙ্গ মৃদু। (৩/১০)।

উঃ যেন গোহাটে গরু কিনছে!

যে মেয়ের ভাই নেই, পিতা কে জানা যাচ্ছে না, বিজ্ঞ ব্যক্তি তাকে বিয়ে করবে না কারণ কি জানি যদি ও আমার কন্যাসমা হয়! (৩/১১)

এক কন্যা বরকে দেখিয়ে অন্য কন্যা দান করলে এক শুল্ক দিয়েই পাত্র দুজনকেই বিয়ে করতে পারবে—এই হল মনুর বিধান (৮/২০৪)।

প্রথম স্ত্রী তো নিজেদের বর্ণের হতে হবে।(প্রথম বিয়ে তো বংশরক্ষার জন্যে; পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা) কিন্তু কামবশঃ ফের বিয়ে করতে চাইলে কন্যার যোগ্যতা নীচে দেওয়া হলঃ

ব্রাহ্মণ – ব্রাহ্মণী ও তিন বর্ণের মেয়েকে।
ক্ষত্রিয়— ক্ষত্রিয়া এবং বৈশ্য ও শূদ্রের মেয়েকে।
বৈশ্য— বৈশ্য ও শূদ্রের মেয়েকে।
শূদ্র- শুধু শূদ্রে্র মেয়েকে। (৩/১২-১৩)।

কিন্তু ব্রাহ্মণের শূদ্র বৌ নিয়ে মনুমহারাজের বড্ড অস্বস্তি ছিল। গোটা পাঁচেক শ্লোকে অমন বিয়ে করলে ব্রাহ্মণের কী কী ঝামেলা হতে পারে তা’ নিয়ে সতর্ক করেছেন। দুটো তুলে দিচ্ছিঃ

ব্রাহ্মণ শূদ্রাকে শয্যায় নিলে অধোগতি প্রাপ্ত হয়। তাতে পুত্রোৎপাদন করলে ব্রাহ্মণত্বই চলে যায়। (৩/১৭)।

যে ব্রাহ্মণ শূদ্রার অধররস পান করেন, তার শ্বাস নিজের শ্বাসে যুক্ত করেন এবং গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেন, তাঁর শুদ্ধি হয়না (৩/১৯)।

মেয়েও পছন্দ হল, এবার বিয়ে। কিন্তু বিবাহ যে আট রকম। কোনটা করব কীভাবে ঠিক হবে? ঠিক হবে বরের জাত দিয়ে।

কতরকম বিয়ে?

বিয়ে আট রকমঃ ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ। এর মধ্যে প্রথম চারটি (ব্রাহ্ম থেকে প্রাজাপত্য) ব্রাহ্মণের জন্যে, রাক্ষস ও গান্ধর্ব ক্ষত্রিয়ের জন্যে, বৈশ্য ও শূদ্রের জন্যে আসুর প্রশস্ত। পৈশাচ বিবাহ কারোরই করা উচিত নয়। (৩/২১.২৪ ও ২৫)।

কিন্তু কার নাম দুন্দুভি? কাকে বলে অরণি?

ব্রাহ্মঃ বিদ্বান চরিত্রবান পাত্রকে আহ্বান করে কাপড়চোপড় উপহার দিয়ে সম্মানিত করে কন্যাদান। (৩/২৭)

দৈবঃ যজ্ঞের সময় কাপড়ে গয়নায় সাজিয়ে গুছিয়ে কন্যাকে পুরোহিতের নিকট দান। (৩/২৮)

আর্যঃ বরের থেকে ধর্মার্থে একটি করে বৃষ ও গাভী নিয়ে কন্যাদান (৩/২৯)।

প্রাজাপত্যঃ সোজা কথায় প্রজাপতির নির্বন্ধ। ‘দুজনে একত্র হয়ে ধর্মাচরণ কর’ বলে বরের পূজো করে কন্যাদান(৩/৩০)। আজকাল হিন্দুমতে এ’রকম বিয়েই আকছার হচ্ছে।

আসুরঃ বর যদি মেয়ের বাবা বা জ্ঞাতিদের যথাশক্তি ধন দিয়ে নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে। এটাও বহুদিন ধরে আমাদের দেশে চলে আসছে। (৩/৩১)।

গান্ধর্বঃ ‘গান্ধর্বঃ স তু বিজ্ঞেয়ো মৈথুনাঃ কামসম্ভবঃ।। (৩/৩২)

কন্যা ও বরের ইচ্ছানুসারে মিলন, মনুর মতে এই বিবাহ কামবশে মৈথুনেচ্ছায় ঘটে! আজকাল এরকমও হচ্ছে বটে, যাকে আমরা হরদম ‘লাভ ম্যারেজ’ বা প্রেম করে বিয়ে বলে থাকি।

রাক্ষসঃ কন্যাপক্ষের লোকজনকে আহত বা হত্যা করে আর্তনাদ করতে থাকা কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করে বিয়ে করা(৩/৩৩)। এটা হামলা এবং ধর্ষণ, যেমন ডাকাত দলের কান্ড।

পৈশাচঃ নিদ্রিতা, মদ্যাপানে বিহ্বল বা পাগল কন্যাকে নির্জনে সম্ভোগ করলে সর্বাধিক পাপজনক ও নিকৃষ্ট বিয়ে (৩/৩৪)। এটা অবশ্যই ধর্ষণ।

একটা জিনিস খেয়াল করার মত। তখন বরকে কন্যাপণ দিতে হত, যদিও এই প্রথাকে মনু কয়েক জায়গায় গর্হিত এবং মেয়ের বাপের দিক থেকে এটা টাকার লোভে কন্যা বিক্রয় বলে নিন্দে করেছেন। কিন্তু লক্ষণীয় যে তখন আজকের মত মেয়ের বাবাকে যৌতুক দিতে হত না।

অন্ততঃ মনুস্মৃতি তাই বলছে। বিয়ে হয়ে গেলো। এবার সন্তান জন্মের রহস্য জেনে নিন।

প্রথম চারপ্রকারের বিয়ের ফলে ভদ্রজনের মান্য বেদাধ্যয়ন করা তেজস্বী পুত্র হয়। রূপ, গুণ, যশ ও প্রচুর ভোগের অধিকারী হয় এবং তার একশ’ বছর আয়ু হয়। কিন্তু বাকি চারটে নিকৃষ্ট বিয়ের ফলে নিষ্ঠুর, মিথ্যেবাদী এবং বেদ ও যাগযজ্ঞের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন পুত্র জন্মায়। (৩/৩৯.৪০, ৪১)।

শোণিতস্রাবযুক্ত প্রথম চার রাত্রি, একাদশ ও ত্রয়োদশ রাত্রি এবং অমাবস্যাদি মনুর বিধিতে নিন্দিত। বাকি সময়ে গৃহস্থ স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে রতিকামনায় দারগমন করবেন। (৩/৪৫, ৪৬, ৪৭)।

ওই প্রশস্ত রাত্রিগুলোর মধ্যে জোড় সংখ্যার রাতে, যেমন ষষ্ঠ ও অষ্টম, ছেলে হয় এবং বেজোড় সংখ্যার রাতে, যেমন পঞ্চম বা সপ্তম, মেয়ে। তাই ছেলে চাইলে য জোড় সংখ্যার রাত্রিতে দারগমন করিবেন (৩/৪৮)।

পুরুষের শুক্র বেশি হলে পুত্র, স্ত্রীর শুক্র বেশি হলে কন্যা জন্মায়। দু’জনেরই সমান সমান হলে জোড়া সন্তান বা হিজড়ে জন্মায়। কিন্তু দুজনের শুক্র খুব অল্প হলে গর্ভ হয় না। (৩/৪৯)।

কন্যাপণ নেওয়া নিয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে।

কন্যার পিতা সামান্য শুল্কও নেবেন না, নইলে মেয়ে বিক্রয় করা হল। (৩/৫১)

‘আর্যবিবাহে যে গাইবলদ নেবার প্রথা তাকে পণ না বলে কেউ কেউ শুল্ক বলেন। ওটা মিথ্যা। পণ কম বা বেশি যাই হোক, নিলে মেয়ে বিক্রিই হল’। (৩/৫৩)।

“যত্র নার্য্যন্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ”।। (৩/৫৬)

যেখানে নারীগণ সম্মানিত হন, সেখানে দেবগণ প্রীত হন। এঁরা সম্মানিত নাহলে সকল কর্ম নিস্ফল হয়।

মনুস্মৃতিতে নারীর কত উঁচু স্থান প্রমাণ করতে এই শ্লোকটি সর্বত্র উল্লেখ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর “হিন্দুবিবাহ” প্রবন্ধে মনুস্মৃতিতে ওই শ্লোক এবং মনুসংহিতায় আরও কয়েকটি শ্লোক উল্লেখ করে প্রাচীন কোড অব কন্ডাক্টে নারীকে উঁচু স্থানে বসানোর মিথকে কাটাছেঁড়া করেছেন।

এবার নারীরাই ভাবুন তাঁদের মর্যাদা কত উঁচুতে রেখেছে মনুর বিধান। আপনারাই আমার জুরি।

নাউ আই রেস্ট মাই কেস, মিলর্ড!

0 comments: