0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in



















এবার ইউরোপ – ৫

অনেক আলস্য ভেঙে একবছর আগে এই ধারাবাহিক যখন শুরু করেছিলাম, শেষ পর্যন্ত কতদূর এগোতে পারবো, তার অভিমুখ কী হবে, সবচেয়ে বড় কথা এই লেখা কেন, এরকম অনেক প্রশ্ন ছিল। কয়েকজনের উৎসাহমিশ্রিত চাপেই এইসব দ্বিধা এড়িয়ে যে আজকের দিনটিতে পৌঁছতে পেরেছি, এ নিয়ে আলোচনার কোনও জায়গা নেই।

শুরুতেই যে ধন্দ কাটিয়ে ওঠা খুব কঠিন মনে হয়েছিল, লিখবোটা কী? এ লেখার শরীর আর মন কেমন হবে? এমন পরিস্থিতিতে সম্পাদক বললেন, বেশি চিন্তা না করে শুরু করে দিতে। শেষ অবধি তাই করলাম। এবং অনেক ধানাই-পানাই করার পর এই বারো নম্বর কিস্তি।

আগেরবার এ লেখা থামিয়ে দিয়েছিলাম মিউনিখ শহরের এক পড়ন্ত বিকেলে। সেখান থেকে সেবার আমরা চলে গিয়েছিলাম স্টুটগার্ট আর ট্যুবিঙ্গেন হয়ে পশ্চিম জার্মানির দিকে। স্টুটগার্টে সেসময় বসবাস আমাদের আরেক বন্ধুনি কাটারিনা ওটানির। কাটারিনার সঙ্গেও আমাদের আলাপ ও বন্ধুত্ব কলকাতাতেই। সে আরেক পর্ব। কাটারিনা সেইসময় স্টুটগার্টের একটা থিয়েটার কোম্পানিতে কাজ করে। আমাদের জায়গা হলো তার আস্তানাতেই, যার জার্মান নাম ‘হ্বোনগেমাইনশাফট’ (Wohngemeinschaft) আর বাংলায় বলা যেতে পারে মেস। আমরা সম্ভবত সেযাত্রায় স্টুটগার্টে ছিলাম দিনতিনেক আর তার মধ্যে একদিনের জন্য গিয়েছিলাম ট্যুবিঙ্গেন। মহাকবি হ্যোল্ডারলিনের (১৭৭০-১৮৪৩) স্মৃতি-মায়া জড়ানো ট্যুবিঙ্গেন। যে কবিকে নিয়ে অলোকদা লিখেছিলেন সেই অসামান্য জীবনালেখ্য, ‘নিয়তি ও দেবযান’। ছবির চেয়েও সুন্দর, জার্মানির বুক চিরে বয়ে যাওয়া নেকার নদীর ধারে যে বাড়িতে হ্যোল্ডারলিন কাটিয়েছিলেন জীবনের শেষ ৩৬ বছর আর লিখেছিলেন কালজয়ী কিছু কবিতা, যার অধিকাংশই স্কারদানেলি ছদ্মনামে, কাটারিনার এক বান্ধবী, সেও ক্রিটিনে, আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল সেই ট্যুবিঙ্গেনে। স্টুটগার্ট থেকে ট্যুবিঙ্গেনের দূরত্ব বেশি নয় – ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই পৌঁছনো যায়। স্বল্পভাষী ক্রিস্টিনের সঙ্গে আমাদের দেখা হলো হ্যোল্ডারলিনের বাড়ি, যা এখন যাদুঘর আর সারা পৃথিবীর মানুষের গন্তব্য, যে ভবনের দেওয়ালে একসময় একঝাঁক স্রোতের বিপরীতে চলা ছেলেমেয়ে লাতিন ভাষায় লিখে দিয়েছিল, ‘এই কবি কখনওই পাগল নয়’ – কারণ সেসময় রটে গিয়েছিল সৃষ্টিশীল এই মানুষটি উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন। নাট্যকোলাজটিতে অভিনয়ের সময় থেকেই যে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল, তা যথাসম্ভব মিটিয়ে ঘোর লাগা চোখে মিউজিয়ামটির বাইরে যখন পা ফেললাম, ততক্ষণে খাওয়ার সময় হয়েছে। ছোটোখাটো একটি রেস্তোরাঁ, যেখানে মূলত অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের কোলাহল, সেখানে একটা টেবিল দখল করলাম আমরা তিনজন - ঠিক করলাম পাস্তা খাবো। খাওয়া যখন প্রায় শেষ, ক্রিস্টিনে হঠাৎ জিগ্যেস করলো আইসক্রিম খাবে? সে এক বিচিত্র পরিস্থিতি কারণ আইসক্রিম খাওয়া তো অনেক বড় ব্যাপার, তার নাম শুনলেও অনেকে আর নিজেকে সামলাতে পারে না। ক্রিস্টিনে আর আমাকে বাদ দিলে আমাদের মধ্যে তৃতীয় জন সেই গোত্রের। আর তিনি চেয়ে বসলেন ‘বানানা স্প্লিট’। বছরখানেক আগে এই বস্তুটির সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলের কফিশপে – কুর্ট, মারথেডিস আর বারবারার সৌজন্যে, ওদের প্রথম এবং একমাত্র কলকাতাবাসের সময়। সেবার দেখেছিলাম সোনালী নকশাকরা সবুজ-হলুদের হালকা আভাওলা বোন চায়নার প্লেটে তিনি এলিয়ে রয়েছেন। লম্বা হৃষ্টপুষ্ট একটি কলাকে মাঝখান থেকে চিরে দেওয়া হয়েছে, তার ওপরে দেওয়া হয়েছে ভ্যানিলা আইসক্রিম আর তার ওপরে উদার হস্তে কাজু, কিসমিস, আমন্ড আর চেরি ছড়ানো আর সবশেষে যেন এক জ্যামিতিক নিয়মে ঢেলে দেওয়া হয়েছে চকোলেট সস, যা আইসক্রিম আর কলার গা বেয়ে নেমে এসে প্লেটের মধ্যে সদ্য তৈরি করা শুরু করেছে আশ্চর্য-রঙা এক আধা-তরল। আর সেই অপরাহ্নে ট্যুবিঙ্গেন শহরে যিনি আমাদের সম্মুখে হাজির হলেন, তাঁকে দেখতে শুনতে একইরকম হলেও কলেবরে অনেক বৃহৎ, বলা যায় তাঁর জন্মস্থান যে আমেরিকা, সেই আমেরিকান স্টেকের মতোই বিপুলায়তন। সাধারণ মাপের কোনও মানুষের পক্ষে সে জিনিস একা খেয়ে শেষ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রেও তাইই হলো। যাঁর অতি উৎসাহে এই পদটি অর্ডার করা হয়েছিল, তিনি দেখামাত্র বুঝতে পারলেন তাঁর একার পক্ষে এটি গলাধঃকরণ করা অসম্ভব। অতঃপর শুরু হলো কাকুতি মিনতি। আমাদের সবাইকেই তাই সেদিন শেষ পর্যন্ত হাত লাগাতে এবং মুখ চালাতে হয়েছিল।

ট্যুবিঙ্গেন থেকে স্টুটগার্ট হয়ে আমরা রওনা হলাম ক্যোলনের দিকে। জার্মানির এই রাইনলান্ড অঞ্চলটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে এক কথায় অপূর্ব। সন্ধের মুখে যখন ট্রেন যখন ক্যোলন অভিমুখে, ডানদিকের জানালার ধারে যদি বসার সুযোগ পাওয়া যায়, চোখ ফেরানো মুশকিল হয়। ট্রেনলাইনের ধার ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলে গেছে রাইন নদী, তার ওপর অজস্র নানা বর্ণের ছোটোবড়ো নৌকো এবং প্রমোদ তরণী। আর নদীর অপর পাড়ে, পাহাড়ের ঢালে বাড়িগুলোয় জ্বলে উঠেছে সাঁঝবাতি। ট্রেন আরেকটু এগোলে দিগন্তে জেগে ওঠে আকাশ ছুঁয়ে থাকা ক্যোলন ক্যাথিড্রালের চূড়া। আটশো বছর ধরে যাকে নিয়ে মানুষের উন্মাদনার শেষ নেই। উন্মাদনার শেষ নেই অবশ্য ‘ক্যোলশ্‌’(Koelsch) নিয়েও। বিয়ার প্রসঙ্গে জার্মানদের দুর্বলতা বিশ্ববিদিত। প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের রয়েছে গর্বিত হওয়ার মতো নিজস্ব বিয়ার সংস্কৃতি। ‘ক্যোলশ্‌’ তেমনই এক বস্তু। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ক্যোলনের একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে থাকা কিছু ভাঁটিখানায় বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি বিয়ারকেই ‘ক্যোলশ্‌’- এর মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে। এ নিয়ে আলাদা আইনি সুরক্ষাও আছে। কিছু শব্দের মাধ্যমে হালকা সোনালী রঙের, স্বচ্ছ, ফেনাসমৃদ্ধ এই তরলটির স্বাদের বর্ণনা করার চেষ্টা না করাই ভালো। বরং ক্যোলশের তুলনা ক্যোলশ্‌ - এইভাবে বললে হয়ত ব্যাপারটা খানিকটা বোঝা যায়। সেবার ক্যোলনে গিয়ে আমরা যাঁদের অতিথি হয়েছিলাম, তাঁরা তেমন পানীয়বিলাসী ছিলেন না। এই ক্যোলশ্‌ এর ব্যাপারে ঠিকঠাক জ্ঞানলাভ করতে লেগে গিয়েছিল আরও কিছু সময় এবং ততদিনে আমাদের খাদ্য এবং পানীয়রসিক বন্ধু রলফ্‌ ট্যোপ্পারহ্বিন-এর কাছ থেকে জেনেছি যে ছোটো হেরিং মাছের গ্রিল, বেক, পিকল্ড বা স্মোকড- এর সঙ্গে এই ক্যোলশ্‌ অনবদ্য। হেরিং মাছের প্রসঙ্গ যখন এসেই পড়ল তখন এ বিষয়ে দু-চার কথা না লিখলেই নয়। উত্তর অতলান্ত এবং বল্টিক সাগরে অক্টোবর মাস থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়তে থাকে আমাদের অতি আদরের ইলিশ পরিবারের এই মাছটি আর এই সমুদ্রের কাছাকাছি বসবাস করা মানুষজন কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ হয়ে ওঠেন। রূপালী শস্যের দেখা পেলে ঠিক যা হয় বঙ্গ সন্তানের। বর্ষার সময় সপ্তাহান্তে আকাশে মেঘ দেখা গেলে আমরা অনেকেই যেমন বেরিয়ে পড়ি ডায়মন্ডহারবার বা কোলাঘাটের দিকে, ওদেশেও দেখেছি কোনও বন্দর শহরে গিয়ে হেরিং মাছ খাওয়া এবং খাওয়ানোর জন্য দুশো-আড়াইশো কিলোমিটার গাড়ি চালানোর ধকল নিতে। বছর কুড়ি আগে রলফ্‌ ঠিক এই কাজটাই করেছিল। হামবুর্গ থেকে গাড়ি নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে দুপুর নাগাদ আমরা পৌঁছেছিলাম বল্টিক সাগরের ধারে একটি ছোট্ট শহরে। অদ্ভুত সেই শহরটির একধারে ছিল সারিসারি বৃদ্ধাবাস আর কেন্দ্রে বিশাল গাড়ি রাখার জায়গা ঘিরে শুধুই হেরিং রেস্তোরাঁ। খাওয়া-দাওয়ার বিষয়টি যে কেবল উদরপূর্তি নয়, এটি যে আমাদের যাপনের, আমাদের সামগ্রিক বেঁচে থাকার এক অতি জরুরি অধ্যায়, সেদিন আরেকবার তার উপলব্ধি হয়েছিল।

ক্যোলন্‌ থেকে বাসে করে সেযাত্রায় আমরা রওনা হয়েছিলাম ইংল্যান্ড অভিমুখে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মণিকা কাকিমা আর নানুকাকা। এই দেশটি ইউরোপের মধ্যে থেকেও যেন নানাকারণে একটু বিচ্ছিন্ন। তার ইতিহাস জটিল এবং সুদীর্ঘ। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সৌজন্যে হেঁশেল সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখতে বসে একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে ‘ব্রিটিশ ফুড’ স্বতন্ত্র একটি আলোচনার বিষয়। যে ভূখণ্ডে আমাদের প্রবেশ ঘটলো মণিকা কাকিমার হাত ধরে। প্রথমদিন প্রাতরাশের টেবিলে, ইতালিয়ান অলিভ অয়েলে হালকা করে ভাজা বেকন আস্বাদনের মধ্যে দিয়ে। পরে অনেক জায়গায় ওই বস্তুটি খেয়েছি, নিজেও করে অন্যদের খাইয়েছি, কিন্তু ওই স্বাদটি আর খুঁজে পাইনি। মায়ের হাতের রান্না কি একেই বলে?

0 comments: