0

ধারাবাহিক - অসিত কর্মকার

Posted in



পর্ব ৩

শেষ বিকেলের মাটিরঙ আলো। বাতাসে ধুলোপোড়া গন্ধের সঙ্গে মিহি ঠান্ডাভাব। গায়ে হামলে পড়তে ঝগড়ু আরাম বোধ করায় তার উৎসাহ দ্বিগুন বাড়ে। মন তার টগবগ করে ফুটছে এখন। গয়ানের নাতিদুটোও কম যায় না। ভুলন আর ফকরা ঝগড়ুর সঙ্গে সমান তালে কালকের মিটিং-এর জমায়েত বাড়াতে জোর প্রচারে নেমেছে। জোয়ান, হাট্টাগোট্টা চেহারা ওদের। ঘরে ঘরে গিয়ে তো বটেই রাস্তাঘাটে যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে তাকেই মিটিং-এ আসার কথা বলছে। অবশ্যই যেন আসে, আর পাঁচজনকেও যেন আসার কথা বলে। এবার ব্রিজটা ওদের আদায় করা চাইই চাই। ভুলনের হাতে ধরা একটা ভাঙ্গা টিন আর লাঠি। থেকে থেকে সে লাঠিটা দিয়ে টিনটায় বাড়ি মেরে লোকজনের দৃষ্টি ওদের দিকে আকৃষ্ট করে। ফকরা জামরুল গাছের ডালটাকে মাটিতে লুটিয়ে নিয়ে হাঁটতে থাকে। কখনও কখনও ওটাকে মাথার উপর তুলে নাড়িয়ে দূরের মানুষজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মাটিতে লুটোতে ধুলোয় দাগ পড়ে। দাগ নয় তো যেন আগামীকাল মিটিং-এ যাওয়ার পথ এঁকে চলে ওরা। ওই ডালে যত পাতার সমষ্টি ততই মানুষের সমষ্টির ইঙ্গিত যেন। একেকটা পাতা একেকটা মানুষ। একটা ডাল মানে একদল মানুষের ঐক্য। যারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাবি আদায়ে লড়াইয়ে নামবে। আর সবুজ তো তারুণ্য আর উচ্ছ্বাসের প্রতীক। ভুলন বড়ো বড়ো শব্দে ঢ্যাঁড়া পেটায়। সে থামলে ঝগড়ু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ঘোষণা করে, শুন শুন, গাঁয়ের সকলটয় শুন, কাল বিকালটয় বটগাছটর লীচহে মিটিনট আছহে। বিরিজট আদায়ের মিটিন। পাট্টির রঙট ভুলহে গাঁভর মানহুষগুলানের এককাট্টাট হওয়ার মিটিন।

ঝগড়ুর ঘোষণা বাতাসে আন্দোলিত হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে ঘরগুলো থেকে পুরুষ বউ-ঝি বাচ্চাকাচ্চা যত বেরিয়ে আসে। বড়োরা মিটিং-এর বিষয়টাকে ভালো করে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে। ছোটোরা মজা উপভোগ করতে তিনজনের পিছনে পিছনে হল্লাচিল্লা করতে করতে চলে।

একসময় ঝগড়ু বলে, বটগাছটর কাছহে ভি চল ভুলন, কাজহে যাওহা মানহুষগুলানের ঘরহে ফিরার সমহয় ইখন, সাঁকোটর কাছহে দাঁড়ায়ে উয়াদের মিটিনের কথহাট জানাই দিই।

ওদের সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চাদের সংখ্যা আরও বাড়ছে। কিছু কিশোর, যুবক আর বড়রাও জুটেছে। সব মিলিয়ে একটা মিছিলের আকারই নিয়েছে ভিড়টা। ঝগড়ু আর নিজেকে সংবরণ করে রাখতে পারে না। সে উৎসাহভরা গলায় গয়ানের কাছ থেকে পাওয়া তাদের দাবির কথাগুলো শ্লোগানের মতো করে এক এক করে বলতে থাকে চিৎকার করে। বিরিজট লাই তো ভোট লাই, আগহে বিরিজ পরহে ভোট, বিরিজট দাও ভোট লাও, টাকহা লয় বিরিজট দাও ভোট লাও... ইত্যাদি। ঝগড়ুর দেওয়া শ্লোগানের সঙ্গে ভিড়টাও গলা মেলায়। ওদের কণ্ঠস্বর ক্রমশই তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। হ্যাঁ, এখন এই চলমান জমায়েতটাকে একটা মিছিলই বলা চলে। ওরা দক্ষিণ খাঁড়ির দিকে এগিয়ে চলে। এই মিছিলে কোনও পতাকা নেই। না কাপড়ের, না কাগজের। আছে শুধু ফকরার হাতে ধরা ঘন সবুজ ডালটা। ওটা সে বারবার মাথার উপর তুলে আন্দোলিত করে, ওটাই যেন ওদের পতাকা। সবুজ রঙ। মুখে শ্লোগান। মিছিলের সঙ্গে সমান তালে হাঁটতে থাকে ঝগড়ু।

জ্যোৎস্না পক্ষের রাতের আকাশে একফালি ঝকঝকে চাঁদ। তারাদের সমাবেশ। ওদের আলো আছে বলেই না ঘণ্টা দু’য়েকের মধ্যে পুরো গ্রামের মানুষগুলোকে মিটিং-এর কথাটা জানানো গেলো। ঝগড়ু এখন খুব ক্লান্ত কিন্তু সে তা গ্রাহ্যে আনছে না। ঢক্ ঢক্ করে এক ঘটি জল খেয়ে দাওয়ায় একটু আরাম করে বসে। শরীরটা জুড়োতে থাকে। একটু পরে দাওয়ার মাটিতেই শরীরটাকে একটু এলিয়ে দিতে খানিক বিশ্রাম পায়।

ব্যস্, ওটুকুই, ঝট করে উঠে পড়ে ঝগড়ু। পরনের পোশাক ছেড়ে লুঙ্গি পরে নেয়। খালি গা। ফকফকে সাদা একফালি উঠোনের একপাশে উনুন। পাশে টাল করে রাখা শুকনো কাঠ, লতাপাতা থেকে কিছুটা নিয়ে সে উনুনে গুঁজে দিয়ে তাতে আগুন দেয়। ছোটো হাঁড়িতে করে রাতের ভাত বসায়। চাল ফুটে ভাতের গন্ধে চারিদিক ম ম করে ওঠে। হাতা দিয়ে ক’টা ভাত তুলে দু’আঙুলে টিপে পরখ করে দেখে, না, এখনও খানিকটা সময় ফুটবে। এই অবসরে ঝগড়ু ঘর থেকে খবরের কাগজের বান্ডিলটা, বুধনির আলতার শিশি, একটুকরো পাতলা কাপড়, একটা কাঠি আর একটু জল নিয়ে উনুনের কাছটিতে বসে। কাঠিটার মাথায় কাপড়ের টুকরোটা জড়িয়ে একটা তুলির মতো তৈরি করে। আলতার শিশিটায় একটু জল ঢেলে ওটার মুখটাকে বুড়ো আঙুল দিয়ে জোরে চেপে ধরে খুব করে ঝাঁকায়। পুরো জলটা লাল হয়ে ওঠে। তারপর বান্ডিলটা থেকে একটা একটা করে কাগজ বার করে আর উঠোনের বুকে মেলে ধরে। কাঠিতুলি আলতায় চুবিয়ে নিয়ে তাতে গয়ানের বলা দাবির কথাগুলো একটা একটা করে লিখতে থাকে। ওটুকু রঙে ক’টা আর লেখা হয়! আপাতত এই পাঁচ ছ’টা হলেই চলবে মনে করে ঝগড়ু। ভাত এখন টগবগ করে ফুটছে। তার সাদা ধোঁয়া জ্যোৎস্নায় মিলেমিশে একাকার। সে মিলমিশে মিষ্টি গন্ধ। বুকভরে গন্ধটা টানে ঝগড়ু। আজ বড়ো খাটনি গেছে তার। খিদেটা তাই কেমন বড়ো করে চাগাড় দিয়ে ওঠে। এখনও ক’টা লেখা যাবে যেটুকু রঙ আছে। তার আগে দুটো ভাত খেয়ে নিয়ে শরীরটায় বল পেতে চায়। সকালের রান্না করা ডাল আর মাছ দিয়ে গরম ভাত খায়।

শরীরটা তার এখন বেশ চনমনে। কোত্থেকে একটা বাঁশের টুকরো জোগার করে আনে। কাটারি দিয়ে বাঁশের টুকরোটাকে ফেড়ে সরু সরু ছোটো ক’টা কাঠি বার করে। বিড়ি বাঁধার সুতো দিয়ে কাঠিগুলোকে জুড়ে জুড়ে ছোটো ছোটো চৌকো চালা তৈরি করে, সঙ্গে ছোটো হাতল। কড়াইতে আটা গুলে উনুনে বসিয়ে আঠা তৈরি করে নেয়। দাবি লেখা কাগজগুলো একটা একটা করে চালাতে আঠা দিয়ে লাগায়। সবকটা লাগানো হয়ে গেলে ওগুলোকে পরপর দাওয়ার গায়ে সাজায়। চাঁদের আলোয় দাবির কথাগুলো শুকিয়ে আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে থাকে। সেদিকে তাকিয়ে ঝগড়ুর মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। সকাল না হতেই ভুলন আর ফকরা তার ঘরে আসবে। দাবি লেখা এই চালাগুলো নিয়ে গিয়ে ওরা সাঁকোটার গায়ে আর খাঁড়ির পাড়ের গাছে গাছে বেঁধে দেবে। দক্ষিণ খাঁড়ির ওই সাঁকো হলো এই গাঁয়ের মুখ। দুলকিগাঁয়ের মানুষগুলোর গাঁয়ের বাইরের জগতের সঙ্গে যত প্রয়োজন আর লেনাদেনা মেটাতে এই সাঁকোপথেই যাতায়াত করতে হয়। সাঁকোটার অস্তিত্ব নেই তো এতগুলো মানুষকে বুকে ধারণ করে নিয়ে দুলকিগাঁ বিচ্ছিন্ন এক আধাখ্যাঁচড়া দ্বীপ। ভোটবাবুরা গাঁয়ে ভোট মাঙতে এলে প্রথমেই তাদের দাবির কথাগুলো চোখে পড়বে। তাতে করে ওদের টনক নড়বে। আশ্চর্যও হবে হয়তো। কেননা এমন করে দাবি জানানো যে এই গাঁয়ে প্রথম। মুখে তো বটেই সেইসঙ্গে একেবারে লালরঙে লিখিত দাবি! বড়ো বড়ো হরফে গোট গোট করে লেখা ব্রিজের জন্য দাবির কথা।

হঠাৎই ঝগড়ুর উঠোন জুড়ে ছায়া ছড়িয়ে পড়তে থাকে। উঠোন খিইয়ে দলবদ্ধ ছায়ার সারি ঝগড়ুর ঘরের দাওয়ার দখল নেয়। ঘরের দেওয়ালে ছায়ার মাথাগুলো নড়াচড়া করে। ঝগড়ু প্রথমেভাবে, মেঘেদের ছায়া। ওরা আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাড়ি দিতে দিতে মাটির বুকে ছায়া ফেলে চলে। কিন্তু ছায়ার উপস্থিতির সঙ্গে মানুষের পায়ের শব্দ, তাদের গায়ের গন্ধে ঝগড়ু সচকিত হয়ে ওঠে। এত রাতে তার উঠোনে ওরা কারা? কী প্রয়োজনে এসেছে ওরা? কৌতূহলী হয়ে ঝগড়ু চকিতে ঘুরে তাকায়। প্রকৃতিতে আলোছায়ার খেলার মধ্যে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে চিনতে এতটুকুও অসুবিধা হয় না ঝগড়ুর। দলটার সবার সামনে দাঁড়িয়ে হোপনা সোরেন। পিছনে তার দলবল। ওদের হাতে হাতে লাঠিসোঁটা। পাথরকঠিন মুখ-চোখ সবার। যেন একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে সবাই। আঘাত হানার জন্য অনুমতির অপেক্ষা শুধু। হোপনা সোরেন বললেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু কার সঙ্গে কীসের জন্য যুদ্ধ তা বুঝে ওঠতে পারে না ঝগড়ু। সে এখনও উঠোনে বসে ওদের মুখোমুখি তাকিয়ে। আশঙ্কাতাড়িত কণ্ঠে জানতে চায়, অ খুড়া, ইত রাইতটয় তুমহি হামার উঠানটয় কিন গ খুড়া? হামার কাছহে কী দরকারট আছহে গ?

আছহে, আছহে! দরকারট আছহে বুলহেই ত ইত রাতটয় আইসতে হলহ। কঠিন কুটিল কণ্ঠস্বর হোপনা সোরেনের, তু বিরিজটর লাগি গাঁভর মানহুষগুলহানরে খিপাচ্ছিস! ঢ্যাঁড়াট পিটায়ে মিটিনট ভি ডাকিছিস! রাগক্ষোভভরা মারমুখী মেজাজ হোপনা সোরেনের। দলবলটা মুহূর্তে তার পেছন থেকে বেরিয়ে এসে ঝগড়ুকে একরকম ঘিরে ফেলে।

ওদের একজন খিক্ খিক্ করে হেসে বলে, অ খুড়া, দিখহ দিখহ, লিংড়া বিরিজটর দাবিট জানাহে পস্টার ভি লিখ্খেছে গ! তার কথায় বিদ্রুপ ঝরে পড়ে। হাসিও আর থামে না যেন। দলের বাকিরাও ওর সঙ্গে যোগ দেয়। ওরা একে একে দাবির কথাগুলো আওড়ায় আর সমবেত অবজ্ঞা বিদ্রুপে মেতে ওঠে।

ওদের আরেকজন বলে, ই লিংড়ার পেটহে পেটহে ইতহ বিদ্দাট আছ্হে তা আগহে জানিট লাই গ! বলেই সে একচোট মজালোটার হাসি হাসে।

অন্য একজন সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করে, ই কথহাগুলান তর মাথহাট থিকহে আসিছে? হাঁ রে লিংড়া, সত্ তি ট বল?

ঝগড়ু তাদের দাবি আদায়ে কোনওরকম লুকোছাপার মধ্যে থাকতে চায় না। যা কিছু সত্যি তাকে আশ্রয় করেই তারা দাবি আদায়ে নামতে চায়। তারজন্য দুলকিগাঁয়ের সবার প্রতিই তাদের আহ্বান, গাঁয়ের সবার ভালোর জন্যই এ লড়াই, তাতে সবাই যোগ দিক। ঝগড়ু বলে, লা, গয়ানখুড়া বুলহেছে, হামি লিখহে লিয়েছি।

সহসা দপ্ করে জ্বলে ওঠে হোপনা সোরেন, অই বুঢ্ঢাট পিছন থিকহে কলকাঠিট লাড়ছেহে লয়? উয়াকে মজাট দিখাই দিবহ ইবার। বুঢঢার বিরিজট চড়হার ক্ষমতাট লাই তবহু বিরিজট চাই!

ঝগড়ু বলে, গাঁভর মানহুষগুলহান বিরিজট চায় বুলহে গয়ানখুড়াকে ধরিছে। ইতে দোষট কী হল গ খুড়া? গয়ানখুড়া ই গাঁটর মাথহা আছহে। গাঁভর মানহুষগুলহান উয়াকে মান্নিট করে। উয়ার কাছহে ভালমন্দট জানাবেক না ত কাকহে জানহাবে তুমহি বলহ? বিরিজট হক, তুমহি চাহ লা?

এ প্রশ্নে খানিকটা সময় চুপ করে থাকে হোপনা সোরেন। সেইসঙ্গে তার বশংবদরাও। ওরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঝগড়ুর প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। যদিও ওদের সবার মনে এর একটাই উত্তর, ব্রিজটা হওয়া সবার জন্য একান্তই দরকার। কিন্তু ওই যে, ব্রিজটা হোক বা না হোক ভোটটা লুটে প্রার্থীকে জেতাতেই হবে যে! এটাই দলের সিদ্ধান্ত। তা সে যেমন করেই হোক পালন করতেই হবে।

মাথার উপর চাঁদটা এখন আরও বেশি চকচকে। তার দুগ্ধফেনিভ আলোয় ওদের মুখগুলো আরও বেশি পরিষ্কার দেখে ঝগড়ু, সবাই তার চেনা। নিজেদের আড়াল-আবডাল করার এতটুকু চেষ্টা নেই ওদের। নেই ঝগড়ুর কাছে আসার উদ্দেশ্য লুকিয়ে রাখার চেষ্টা। ওরা এমনই বেপরোয়া, নিজেদের ভালো-মন্দ বিচারবোধহীন! ঝগড়ু ওদের সবার মুখের দিকে এক এক করে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে জানতে চায়, তমরা ইতগুলা মানহুষটর কিহ চাও না যে বিরিজট হক, বল গ খুড়া? ঝগড়ুর দু’চোখ এখন হোপনা সোরেনের দু’চোখের উপর স্থির অবিচল। যেন এই ন্যায্য প্রশ্নের উত্তর হোপনা সোরেনকে দিতেই হবে।

একরকম বাধ্য হয়েই যেন মুখ খোলে হোপনা সোরেন। বলে, হাঁ চাই, চাই, কিন্তুক ইখন না। আগহে ভোটট মিটহুক।

ঝগড়ু খেদভরা গলায় বলে, আর কত্ত ভোট মিটবে গ খুড়া? ভোটট আসহে ভোটট যায় কিন্তুক বিরিজট হামাদের ভোটটর আগেও হয় লা পরেও হয় লা। ইবার হামরা লড়াইট দিব। বিরিজট লা হইলে দুলকিগাঁয়ে ভোটট বয়কটট করবক সব্বাই মিলহে।

বাড়াবাড়িট করিস লাই ঝগড়ু, তুর ক্ষতিট হইয়ে যাবেক! ই গাঁয়ে তু টিকতেট পারবিক লাই। ওদের একজন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলে।

শুনে ঝগড়ুর রক্তে যেন আগুন লাগে। ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে সে। ব্রিজটার জন্য লড়াই তারা দেবেই দেবে। বলে, গাঁভর মানহুষগুলহান হামার সঙ্গেট আছহে। হামি কুনও অল্যায়ট করি লাই ঝে তমরা হামার ভিটিট কাড়বেক, ক্ষতিট করবেক। ই দিশে বিচারট লাই লিকি! একরকম গর্জে ওঠে ঝগড়ু।

ই লিংড়া শালোর বড়হ বড়হ কুথা! মার, মার শালোকে! দলবলটা ক্ষিপ্ত হয়ে লাঠিসোঁটা বাগিয়ে ঝগড়ুর দিকে তেড়ে আসে, শালো, তর একটো ঠ্যাং গিছে, আরেকটভি ভিংগে ঘরবসহা করি দিব তুকে। কামকাজট যাবেক, ঘরহে পচহে পচহে মরবিক!

উঠোনে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে ঝগড়ু তার এক পা আর দু’হাত উঁচিয়ে দলবলটার দিক থেকে ধেয়ে আসা লাঠি-সোঁটাগুলোকে আপ্রাণ চেষ্টায় ঠেকাবার চেষ্টা করে। কিছু ঠেকাতে পারে, কিছু পারে না, তার গায়ে মাথায় এসে পড়ে। ঝগড়ু দাঁতে দাঁত চেপে তার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। তার বুকের ভেতরে এখন ওদের দেওতা মারাংবুরু, তিলকা মাঝি, সিধু কানু, বীরসা মুন্ডার কিসসাগুলো তোলপাড় তোলে। মুখে বিড়বিড় করে কীসব বলে। হয়তো ওদের নামে শপথ নেয়, গাঁয়ের মানুষগুলোর ভালোর জন্য লড়াই সেও করবে! তার সঙ্গী বাঁশের লাঠিটা উনুনের কাছ দিয়ে পড়ে আছে। হাতের নাগালের অনেকটা বাইরে। ওদের আক্রমণ প্রতিহত করতে করতেই সে শরীরটাকে হ্যাঁচড়ে হ্যাঁচড়ে লাঠিটার কাছে নিয়ে যেতে থাকে। একবার লাঠিটা হাতে পেলে সে ওদের বিরুদ্ধে আপ্রাণ লড়াই দেবে। মরতে হয়তো লড়াই করেই মরবে। সেবার ভরতপুর বাজার কমিটির দেওয়া সখের যাত্রাপালা, সিঁদুর নিও না মুছে, দেখতে গিয়েছিল ঝগড়ু। সামাজিক পালা। সংসারের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-ভালবাসায় ভরপুর যাত্রাপালা। টিকিটের জন্য হাহাকার, বিক্ষোভ, মারামারি। ঝগড়ু টিকিট না পেয়ে হতাশ হয়ে একটা চায়ের দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চে বসে ছিলো। সেখানে টিকিট না পাওয়া আরও অনেকের ভিড়। কয়েকটা বখাটে চ্যাংড়া ছেলেও ছিলো ওই দলে। ওদের একজন চা পেতে দেরি হওয়ায় দোকানের ফাইফরমাশ খাটার বাচ্চা ছেলেটার গায়ে গরম চা ছুঁড়ে দেয়। বাচ্চাটা যন্ত্রণায় আর্তচিৎকার করে ওঠে। এ ঘটনায় অন্যরা কোনও প্রতিবাদ না করে ভয়ে গুটিয়ে থাকলেও ঝগড়ু প্রতিবাদ না করে থাকতে পারেনি। ওদের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ঝগড়ু। ওরা মারমুখী হয়ে ঝগড়ুর দিকে এগিয়ে আসার উপক্রম করলে ঝগড়ু মুহূর্তের মধ্যে তার একপায়ের উপরই সারা শরীরে ভর রেখে হাতের লাঠিটাকে চারিদিকে বনবন করে ঘোরাতে থাকে। সেইসঙ্গে সে কী তার ভয়ঙ্কর মূর্তি, মুখে হুঙ্কার, আয় শালোরা, দেখহি তদের ক্ষমতাট কতহ!

দোকানের সামনে হল্লাচিল্লা লেগে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে চ্যাংড়া ছেলেগুলো পিঠটান দেয়। বাজার কমিটির প্রেসিডেন্ট দ্বিজপদ মন্ডল ভাবে, টিকিট না পাওয়া মানুষগুলো এবার বুঝি বড়ো আকারে ঝামেলা বাধিয়েছে। সামাল দিতে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ওই দোকানে আসে। দোকানির মুখে পুরো ঘটনাটা শুনে ঝগড়ুকে সে পিঠ চাপড়িয়ে সাবাশি দেয়। ছেলেটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। দোষীকে ধরে শাস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয়। এতগুলো সুস্থসবল স্বাভাবিক মানুষ যা করতে পারেনি তা করে দেখিয়েছে কিনা ঝগড়ুর মতো একজন মানুষ! দ্বিজপদ মন্ডল সেদিন ঝগড়ুকে পাশে বসিয়ে নিয়ে যাত্রাপালা দেখেছিলো।

সে বড়ো গর্বের দিন ছিলো ঝগড়ুর কাছে। পাঁচ গাঁয়ে তার সাহসিকতার কথা ছড়িয়ে পড়ে। লোকে বলে বেড়ায়, শুধু শরীরের জোরে সবকিছু হয় না, তার সঙ্গে সাহস আর মনের জোর যোগ না হলে কোনও লড়াই জেতা যায় না। সাহস আর মনের জোর থাকলে শরীরের তাকৎ এমনিই এসে যায়। সেটা ঝগড়ু দেখিয়ে দিয়েছে। এতগুলো ছেলে, একা ঝগড়ুর লাঠির সামনে দাঁড়াতে পারলো? আজ সেই গর্বের দিনগুলোর স্মৃতি ঝগড়ুর মনে ফিকে হয়ে এসেছে।

হোপনা সোরেনের সাঙ্গপাঙ্গরা যেন ঝগড়ুর মনের উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। ভরতপুর বাজারের মতোই আরেকটি ঘটনা ঘটাতে চায় ঝগড়ু। কিন্তু সেই সুযোগ ঝগড়ুকে ওরা দিতে চায় না। একজন দৌড়ে গিয়ে এক লাথি মেরে লাঠিটাকে উঠোনের অন্য প্রান্তে পাঠিয়ে দেয়। এ অবস্থায়ও একবার অন্তত উঠে দাঁড়াতে চায় ঝগড়ু। কিন্তু সে সুযোগও সে পায় না। অসহায় ঝগড়ু মার খেতেই থাকে। প্রতিহত করার শক্তি তার ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে। গলা দিয়ে আর চিৎকার বার হয় না। জ্ঞান হারাবার আগ দিয়ে সে হোপনা সোরেনের সাবধানী কথা শুনতে পায়। সাঙ্গপাঙ্গদের উদ্দেশ্যে হোপনা সোরেন বলে, ইবার থাম তরা, ই লিংড়া লাশট হইয়ে গিলে ভোটারগুলহানের মনট ঘুইরে যাবেক। ই বার হামাদের লড়াইট কঠিনট আছহে।

হোপনা সোরেন এগিয়ে এসে নিচু হয়ে ঝগড়ুর কানের কাছে মুখ এনে বলে, শুন ঝগড়ু, তুরা মিটিনট যিমন ডিকেছিস তিমনটই হবেক, কিন্তুক মিটিনটয় যা বুলবার তা লিতাবাবুরা বলবেক। উয়াদের খবরট দিইছি। আসবেক বুলহেছে। তু আর গয়ানবুঢ়া লিতাবাবুদের পাশহেট বসহি থাকবিক। তুদের কিছুট বলবার দরকারট লাই। আর অই পস্টারগুলান যিন উখানে না দিখহি! কঠিন গলায় একরকম শাসানি দেয় হোপনা সোরেন।

ঝগড়ুর তরফ থেকে কোনও সাড়া পায় না হোপনা সোরেন। সে মনে করে, ঝগড়ু নিশ্চিত নিজের সিদ্ধান্তে অটল হয়ে আছে। মুখে তাই কিচ্ছুটি বলছে না। ঝগড়ুর কাঁধে জোর এক ধাক্কা দিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, কি, তর কানেট গিলহ লা হামার কথাগুলহা?

ঝগড়ু জ্ঞান হারাবার আগ মুহূর্তে প্রবল চেষ্টায় কোনওরকমে অস্ফুটে বলে, লা!

শুনেই হোপনা সোরেনের সাঙ্গপাঙ্গরা মুহূর্তে রোষানলে জ্বলে ওঠে। দুমদাম লাঠির বাড়ি মেরে ওরা দাবি লেখা চালাগুলো ভাঙ্গে। জ্বলন্ত উনুনটাকে ভেঙ্গে তাতে বাসনপত্রগুলো গুঁজে দেয়। জ্যোৎস্নায় আগুনমাখা ধোঁয়া মেশে। দাওয়ায় উঠে বিড়ি বাঁধার ডালাটাকে ভেঙ্গে উঠোনে ছুড়ে ফেলে। তারপর ঘরে ঢুকে আরেকপ্রস্ত তান্ডব চালায়।


ক্রমশ...

0 comments: