0

বিশেষ প্রবন্ধ - শুভাপ্রসন্ন

Posted in



ছেলেবেলায় ইস্কুলে পড়েছিলাম “নালক” সেই থেকেই তাঁকে জেনেছি। আজও চোখ বুজলে দেখতে পাই গুরুমশাইয়ের পাঠশালা, শান্ত দুপুরে সেই কুব পাখির ডাক শুনতে পাই।

আমার প্রথম পরিচয় সূত্র যা আজও অম্লান তা তাঁর ছবি লেখা থেকে। যদি ভারতের নবজাগরণের সূত্র ধরে বিভিন্ন মনীষার কথা ভাবা যায়— তাহলে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি সবচেয়ে বড়ো দৃষ্টান্ত। সেখানকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ দ্বারকানাথ ঠাকুর। ব্যবসা আর আধুনিকতার শুরু তাঁর হাত ধরেই। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের প্রায় সকলেই নানা প্রতিভায় ভাস্বর হয়ে আছেন। সেই ধারার উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্কের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি বিশ্বকবি হিসাবে স্বীকৃত। যদিও সেটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়— তাঁর অফুরন্ত প্রাণশক্তি সৃষ্টিশীলতা বহুমুখী প্রতিভা বিস্ময়ের। যার ইতিহাস কারও অজানা নয়—। তাঁকে কেন্দ্র করে অসংখ্য সৃষ্টিশীল মানুষের প্রতিভা বিকশিত হয়েছিলো। অবনীন্দ্রনাথ তাঁরই অন্যতম ভাইপো। তাঁর ছোটোকাকা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ছোটোভাই গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র গুণেন্দ্রনাথের পুত্র ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে দশ বছরের ছোটো। জোড়াসাঁকোর বিশাল জমিদার বাড়ির বৃহৎ পরিবারের মধ্যে-বিস্তীর্ণ নানান অন্দর মহলে ছেলেবয়সে নানাধরনের বিচিত্র পরিচারক-পরিচারিকার অধীনে কোলে-পিঠে গড়ে ওঠা। তাদের বিভিন্ন চরিত্র, বর্ণ ব্যবহারের কায়দায় ভালোবাসা-রাগ-অনুরাগ, অভিমান, বচসা এসবই তাঁর মনে বাস্তব আর কল্পনা মিশিয়ে ধরা দিত। কল্প আশ্রিত সৃষ্টিশীল মন চির শৈশবের খোরাক হয়ে গাঁথা হয়ে থাকতো। বড়ো হয়ে তাঁর লেখায়, কথপোকথনে, অনুলিখনের স্মৃতি চারণায় ধরা দিয়েছে তা। অন্য ভাই বা দাদারা যখন নানা কাজে ব্যাস্ত— অবন তখন পুরনো আসবাব বা বড়ো টেবিলের তলায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে বিস্তীর্ণ মাকড়সার জাল থেকে মায়াময় ছবি, রহস্য খুঁজে পেতেন। এভাবেই তাঁর দেখায় ধরা দিতো খুঁটিনাটি কত কিছু। কৌতূহলী জিজ্ঞাসু মনে রসদের অভাব হয় না।

বড়ো হয়ে লেখা ছবির সবচেয়ে বড়ো উৎসাহ দাতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবিকার প্রশংসা তাঁকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করতো। ঠাকুর বাড়ি থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায় যেখানে সম্পাদক থেকে লেখক-লেখিকা অলঙ্করণ সবই তাঁদের আত্মীয়-স্বজন সেখানে একাধারে অবনীন্দ্রনাথ লেখক আর অলঙ্কার শিল্পী হিসাবে যোগদান এক অন্যমাত্রা পেতো।

বাড়িতে চিত্রকলার চর্চা করেছিলেন বিদেশী শিল্পী গিলড ও পামারের কাছে। ফলে, তাঁদের শিক্ষায় পাশ্চাত্য রীতিতে অসাধারণ পোট্রেট আর দক্ষতা অর্জন করলেও তাঁর মনে আমাদের লোকায়ত শিক্ষা, পটচিত্র, পাঁচালীর গান, কীর্ত্তন আর কিছু কিছু মানুষের প্রেরণায় স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এক নিজস্ব শৈলীর রূপ দিতে লাগলেন। সেখানে প্রাধান্য পেতো

দেশীয় উপাদান দেশীয় বিষয়। এভাবেই তিনি একের পর এক চিত্রমালা রচনা করতে লাগলেন। সিস্টার নিবেদিতা, আনন্দকুমার স্বামী প্রমুখের প্রেরণায় গড়ে উঠলো বেঙ্গল স্কুল। পরবর্তীকালে সরকারি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ হ্যাভেলের উৎসাহে অন্তর্মুখি অবন ঠাকুরের ছবি দিল্লীর সর্বভারতীয় প্রদর্শনীতে পাঠিয়ে শ্রেষ্ঠ পুরষ্কারে ভূষিত হয় শাহাজাহানের মৃত্যু ও অন্যান্য ছবি।

পার্শি মিনিয়েচার আর জাপানের নানান টেকনিক থেকে নানান টেক্সচারকে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। ওকাকুরার সাহায্যে জাপান থেকে দুই শিল্পী ইয়াকোয়ামা টাইক্কান আর হিসিদা সুনশো জোড়াসাঁকোয় ছিলেন বেশ কিছুদিন। তাঁদের কাছ থেকে নানান টেকনিক রপ্ত করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে যে ওয়াশ পদ্ধতি আর তুলি চালনার বিশেষ পদ্ধতি তা আয়ত্ত করেছিলেন এ শিল্পীদ্বয়ের কাছ থেকে।

বেঙ্গল স্কুলের আন্দোলন তিনি ও তাঁর সুযোগ্য কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের অবদানে গড়ে উঠেছিলো। বিশেষভাবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য নন্দলাল বসুর অবদানে জীবন ও সমাজে এক রূপ ও রুচির প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো। তাই দ্বিধাহীনভাবে তিনি ছিলেন শিল্প গুরু আর সাহিত্যের কাণ্ডারী। তারই সঙ্গে তিনি ছিলেন জোড়াসাঁকোর মনীষীদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষ্ক। বিস্ময় জাগে রবিরশ্মির এত কাছে থেকেও তাঁর লেখা বা তাঁর সাহিত্যের ভাষা ছিলো সম্পূর্ণ মুক্ত। সম্পূর্ণ অন্য ছবির ভাষা। এক অনবদ্য শিশুর সারল্য, স্বপ্ন-কল্পনা দিয়ে গাঁথা। বুড়ো আংলা, ক্ষীরের পুতুল, নালক, রাজ কাহিনী, মহাবীরের পুঁথি প্রভৃতি অসংখ্য প্রকাশিত, অপ্রকাশিত রচনায় ভরিয়ে ছিলেন তাঁর অন্তরের শিশু মনের জগৎ।

সে সময় রাজা রবিবর্মাও ভারতীয় শিল্পী হিসাবে সর্বত্র প্রচারিত হলেও, আর্য যদিও তাঁর ছবির বিষয় ছিলো নানান ভারতীয় পুরাণ কাহিনী বা সমসাময়িক জীবনচরিত। কিন্তু উপাদান ও শৈলী ছিলো ইউরোপীয়। যেন ভেনাসের গায়ে শাড়ি পরিয়ে শকুন্তলার রূপ। তা থেকে অবনীন্দ্রনাথ কত পৃথক যা সম্পূর্ণভাবে দেশীয় স্টাইল বা ছন্দ।

পরিণত বয়সে তাঁর আঁকা ‘ভারতমাতা’ একটি অনন্য উদাহরণ। একদিকে ভারতীয় শৈলীর নিপুনণতা-অন্যদিকে নির্ভুল শারিরীক ছন্দ। তাঁর অল্প বয়সে পাঠ নেওয়া ইউরোপীয় শৈলীর মিশ্রণে এক অসাধারণ উদাহরণ। যেখানে তথাকথিত পরিপ্রেক্ষিতে অনুপস্থিত। দ্বিমাত্রিকতার আভাস অথচ বাস্তবধর্মী রেখায় আঁকা নারীরূপ।

শেষ বয়সে অনুসন্ধানী শিল্পীমন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া নানান টুকরো কাঠ বা শুকিয়ে যাওয়া শিকড়-বাকড় সংগ্রহ করে, কখনও তাতে কিছু সংযোজন করে বিভিন্ন আকারের মূর্তি গড়ে তুলতেন। সেগুলোর নাম দিয়েছিলেন “কাটুম কুটুম” এখানেও তাঁর শিশু মন খেলা করতো। এক অনবদ্য শিল্প অনুসন্ধান। কিন্তু সেভাবে তিনি স্বীকৃতি পাননি!

কিন্তু অবন প্রতিভা সীমাবদ্ধ থাকে আমাদের পরিসরে।

তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষে এই শিল্পগুরু মহান স্রষ্টা ছবি লেখার মনীষীকে স্মরণ করি।

0 comments: