0

গল্প - শমিত বিশ্বাস

Posted in



















২০১৫ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিক। সিকিমে সেবার হাড় কাঁপানো শীত। আমি আর দেবশ্রী গ্যাংটক থেকে জীপে করে যখন পেলিং পৌঁছলাম,তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কলকাতা থেকেই হোটেল বুক করা ছিলো।ছোটো শহরপেলিং।তাই খুঁজে নিতেও কোনও অসুবিধে হলো না। বৌদ্ধ রীতিতে, উজ্জ্বল লাল, নীল, হলুদরঙে রঞ্জিত আর চমৎকার কাঠেরকারুকাজে সাজানো আমাদের হোটেলটি ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন। লবি থেকে ধাপে ধাপে নেমে গিয়ে ঘরগুলো, আবার কোথাও হয়তো একটু উঠে গেছে কয়েক ধাপ; পাহাড়ের ঢাল অনুয়ায়ী। পেলিং শহরটাও যেন পাহাড়ের তিনটে স্তরে তিনটি ঝুলন্ত বারান্দা— আপার, মিডল আর লোয়ার পেলিং। আমাদের হোটেল মিডল পেলিং এ। ঘরে ঢুকে জানলা খুলে পর্দা সরিয়ে দিতেই, দেবশ্রী বাচ্ছা মেয়ের মতো আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো। শেষবিকেলের আলোয় রূপসী কাঞ্চনজঙ্ঘা গাঢ় কমলা আলোয়ানে নিজেকে মুড়ে একেবারে জানলার পাশেই এসে যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে।কিন্তু তখনও বুঝিনি এই পাহাড়ী শহরে, আরও কত রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছে।গরম জলে স্নান করে, একটু জিরিয়ে নিয়ে ‘ফ্রেশ’ হয়ে, আর গরম কফি খেয়ে আমরা হোটেল থেকে বেরোলাম এই সন্ধ্যে উপভোগ করতে। হোটেলের পাশেই এক বাঙালি ভদ্রলোকের রোল-চাউমিনের স্টল। আমাদের ডাকাডাকি করছিলেন।বললাম—“একটু পরে আসছি।” ভদ্রলোক হেসে বললেন—“বেশি দেরি করবেন না। এ কলকাতা নয়, আটটার মধ্যেই সব বন্ধ হয়ে যায়।” আমরা ঘাড় নেড়ে এগিয়ে গেলাম। রাস্তায় লোক কম। শুনলাম এবছর প্রচণ্ড ঠান্ডার জন্য ট্যুরিস্ট কম এসেছে। আমাদের অবশ্য ভালোই লাগছিলো। কলকাতার ভ্যাপসা গরম থেকে বাঁচতেই তো আসা শীতকালে। কিছু শ্বেতাঙ্গবিদেশি ট্যুরিস্টওযথারীতি গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে চলেছে।একটু হতাশ হলাম যখন দেখলাম সাড়ে সাতটা নাগাদইবেশ কিছু দোকান ঝাঁপ বন্ধ করতে শুরু করে দিচ্ছে। দেবশ্রীকে বললাম,“কুছ পরোয়া নেই, কাল সকালেইতো আবার আসবো।” দেবশ্রী বললো, “এত তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে কী করবো? চলো আরও হাঁটি খানিকক্ষন।” হাঁটতে হাঁটতে আমরা প্রায় রাস্তার এক প্রান্তে চলে এলাম। এখান থেকে রাস্তা দু’ভাগ হয়ে গেছে। একটা নেমেছে লোয়ার পেলিং-এর দিকে, আর একটি পাহাড়কে বেড় দিয়ে উঠেছে গিয়ে আপার পেলিং-এ।একজনবিদেশিনীতরুণী আমাদের পাশে পাশেই হাঁটছিলো।চোখে কৌতূহল,মুখে স্মিত হাসি। মনে হলো বেশ উপভোগ করছে এই কনকনে ঠান্ডা, এই পরিবেশ। মেয়েটির সোনালি চুল, আর গায়েআপাদমস্তক লালট্রাউজার্স-জ্যাকেট। কিন্তু সবচেয়ে যেটা অদ্ভূত, তা হলো ওর হাঁটার ধরন। এই দেখছি অনেক পেছনে, আবার পরক্ষনেই একেবারে পাশে। কিন্তু কখনওই একেবারে হারিয়ে যাচ্ছেনা। একটু দূরে দেখলাম একটা দোকানে তখনও আলো জ্বলছে।অমনি দেবশ্রী আমাকে টানতে টানতে নিয়ে চললো সেখানে। ওর কোনও কিছুতেই তর সয়না। কাউন্টারের সিকিমি মেয়ে দুটি, আমাদের আপ্যায়ন করে নানারকম হাতের কাজের জিনিস দেখাতে লাগলো। দেবশ্রীও “এটা কি সুন্দর, ওটা কি দারুণ” বলে দরাদরি করতে লাগলো। দেখতে পেলাম, সেই ভিনদেশী মেয়েটিওকখন কে জানে, ঐ দোকানেই এসে ঢুকেছে। মনে হলো যেন, কেনাকাটার চেয়ে আমরা কি করছি,সেটা দেখতেই ওর বেশি উৎসাহ। একসময় আমাদের একেবারে পাশে এসে দাঁড়িয়ে, আমাদেরকে নিবিষ্ট চোখে দেখতে থাকলো।একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো।কাছ থেকে দেখলাম ওর সমস্ত শরীর এক অতি সূক্ষ্ম, গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা,স্বচ্ছ আবরনে ঢাকা।চোখ দুটোও অস্বাভাবিক বড়ো।দেবশ্রী ভুরু কুঁচকে আমাকে ফিসফিস করে বললো— “মেয়েটা যেন কেমন কেমন।কোনও মতলব-টতলব নেই তো? কি জানি বাবা, আজকালকিছুই বলা যায়না।” যেমনি একথা বলা, অমনি মেয়েটি যেন হাওয়ায় ভেসে বেরিয়ে গেলো।আমি দেবশ্রীকে বললাম— “তোমার কথা শুনতে পেয়েছে মনে হয়।”

“—আহা, কি যে বলো? আমিতো তোমাকে খুব চুপিচুপি বললাম। আর তাছাড়া আমিতো বাংলায় বলেছি। ও বুঝতে পারবে কী করে?দেবশ্রী প্রতিবাদ করে।“—তাহলে থট-রিডিং জানে নির্ঘাত।” আমি বললাম হেসে।

ওখান থেকে বেরিয়ে অবশ্য আর তাকে দেখা গেলো না কোথাও। ততক্ষণে সব দোকান-পসারও বন্ধ হয়ে গেছে। চারদিক নিঝুম, নিস্তব্ধ। মেঘলা আকাশও তারাদের ওপরও পর্দা টেনে দিয়েছেযেন। ঘড়িতেদেখলাম মাত্র সওয়া আটটা বাজে। যাই হোক, “যস্মিন দেশে যদাচার” এই ভেবে অনিচ্ছা আমরাও পা চালিয়ে শুনসান রাস্তা ধরে ফিরতে লাগলুম। দেবশ্রী আমার হাত ধরে বেশ ঘন হয়ে হাঁটতে লাগলো। হোটেলের কাছে এসে দেখি সেই বাঙালি ভদ্রলোক আমাদের জন্যেই দোকান একটু খুলে রেখেছেন। দেখতে পেয়েই বললেন— “আসুন আসুন এই আপনাদের জন্যেই বসে আছি। গরম গরম চিকেন রোল খেয়ে যান।” আমরাতো অভিভূত। এত হাতে চাঁদপাওয়া যাকে বলে। ওনাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আর, স্বর্গীয়চিকেন রোলে কামড় দিতে দিতে মহানন্দেদু’জনে হোটেলে ঢুকতে যাবো,এমন সময় বুকপকেটে হাত দিয়েই দেখি সর্বনাশ! পকেটে আমার দামি মোবাইলটা নেই। একে তো দামি, তা ছাড়াও ওর মধ্যেই যে ‘স্টোর’ করা আছে আমার যাবতীয় দরকারী তথ্য,ফোন নম্বর। দেবশ্রীর মোবাইল থেকে আমার নম্বরে ফোন করতে, এক বিচিত্র শব্দ ভেসে এল। দেবশ্রীর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।ওকে বললাম— “তুমিহোটেলে যাও, আমি একবার ঐ দোকান থেকে ঘুরে আসি। মনে হয় ওখানেই ফেলে এসেছি।” “—ওরা কি এখনও তোমার জন্যদোকান খুলে রেখেছে নাকি?” দেবশ্রীর গলায় উৎকণ্ঠা। “অতটা রাস্তা যাবে-আসবে...,সেতো অনেকটা সময়”—“তবু একবার গিয়েই দেখি।” বলে আমি আর দাঁড়ালাম না।দৌড় শুরু করলাম ফের সেইহ্যান্ডিক্র্যাফটসের দোকানের উদ্দেশ্যে। প্রায় মিনিট কুড়ির রাস্তা।জনমানবহীন। রাস্তা নির্জন হওয়ায়, কুকুর ডাকছে থেকে থেকে।দোকানটাও প্রধান লোকালয় থেকে বেশ দূরে।দ্রুত হাঁটার জন্য,এই ঠান্ডাতেও ঘাম হচ্ছে শরীরে টেরপাচ্ছি। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে দোকান খোলা পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই; তবু এক অদ্ভূতঅনিবার্য আকর্ষণ যেন আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো একাকী, অসীম অন্ধকারে।আমার থামার শক্তিও নেই কোনও।

অবশেষে পৌঁছলাম হাঁফাতে-হাঁফাতে।যা ভাবা গিয়েছিলো তাই। দোকানের শাটার নামানো। ক্লান্তিতেধপাস করে বসে পড়লাম মাটিতে। আর যেন কোনও উদ্যমই অবশিষ্ট নেই শরীরে, মনে।স্থবির,রহস্যময়নিকষ কালো পাহাড় চারপাশে। আর আকাশচুম্বী গাছেদের সারি, রাশি রাশি। এক অতি জাগতিক পরিবেশ যেন। আবার উঠলাম। মনে হচ্ছে এক অশেষ পথ পেরিয়ে ফিরতে হবে হোটেলে। দেবশ্রী একা রয়েছেউদ্বিগ্ন হয়ে। হঠাৎই মনে হলো আমি যেন একা নই। কেউ রয়েছে কাছেই। আর তারপরেই, হতবাক হয়ে দেখলাম যে সেই বিদেশিনী মহিলা অন্ধকার থেকে যেন হাওয়ায় ভেসে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। মুখে অদ্ভূত মধুর হাসি। চমকে উঠে,কোনওরকমে ইংরেজিতে বললাম— “তুমি কে? এই অন্ধকারে তুমি কী করছো?” কিন্তু আমার মনে হলো, ও আমার কথা কিছুই বুঝলো না।আমাকে ইশারায় থামিয়ে পোশাকের ভেতর থেকে বের করলো পেন-ড্রাইভের মতো একটাছোট্ট যন্ত্র। তারপর সেটা নিজের মুখের কাছে নিয়েদুর্বোধ্য ভাষায় কিসব বললো। বলা শেষ হলে আমাকে দিলো সেটা। আমি তাতে চোখ বোলাতেই দেখি অবিশ্বাস্য ব্যাপার। বিশুদ্ধ ইংরিজিতে লেখা রয়েছে—“আমি এক অন্য দেশে থাকি। তবে সেটা তোমাদের পৃথিবীর কোনও দেশ নয়। তাই পৃথিবীর কোনও ভাষাই আমি জানিনা। কিন্তু এই যন্ত্রের সাহায্যে, আমি যে কোনও ভাষাকে আমার ভাষায় তর্জমা করে নিতে পারি এবং আমার কথাও,তার ভাষাতে অনুবাদ করে দিতে পারি। সুতরাং আমরা অনায়াসে কথাবার্তা চালাতে পারি।” এরকম অদ্ভূত কথা আমি জীবনেকখনও শুনিনি, আর এরকম অদ্ভূত যন্ত্র থাকতে পারে বলেও বিশ্বাস হয়না। আমি যাচাই করার জন্য এবার বাংলায় বললাম “তোমার নাম কী? এখানে কোথায় থাকো?” রহস্যময়ী একটু হেসে আবারকিছু বললো ওর ভাষায়। আবার দিলো আমার হাতে।আমি কাঁপা কাঁপা হাতে নিয়ে দেখলাম এবার নির্ভুল বাংলায় লেখা— “আমার নাম মাদ্রিনিসা। আমি থাকি পৃথিবী থেকে প্রায় এক লক্ষ ‘ট্যাকিয়ন- বর্ষ’ দূরে।”

এবার আমার সত্যি সত্যিই মাথা কেমন ঘুলিয়ে যেতে লাগলো। এসব কি বলছে এই আশ্চর্য মেয়ে। “ট্যাকিয়ন?”আমি এইটূকু শুধুশুনেছিলাম যে, ‘ট্যাকিয়ন’ আলোর থেকেও বহু হাজার গুণ বেশি গতিবেগ সম্পন্ন। কিন্তু এর প্রকৃতি বা গুনাগুণ, কিছুই এখনও মানুষের আয়ত্তে আসেনি। বৈজ্ঞানিকরা নিরলস সাধনা করে চলেছেন এনিয়ে। কোনও ক্রমে নিজেকে একটু ধাতস্থ করে জিগ্যেস করলাম— “তুমি কি তবে অন্য গ্রহের মানুষ, মাদ্রিনিসা?” একথা শুনে মাদ্রিনিসা খিলখিল করে হেসে উঠে বললো—“বলতে পারো। তবে আমি নিজেকে অন্য দেশের বলতেই ভালোবাসি।কারণ তুমি, আমি, সবাই তো এই মহাবিশ্বেই নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছি। ঠিক তোমাদের পৃথিবীর নানা দেশের মতো। আর তোমার এখান থেকে কলকাতা পৌঁছতে যা সময় লাগবে, আমি তার চেয়ে অনেক কম সময়ে এক গ্রহ থেকে আর এক গ্রহেচলে যেতে পারি।” আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে অস্ফুটে বললাম— “বলছো কী? এসবতো সায়েন্স ফিকশনে পড়া যায়।সত্যি হয় নাকি কখনও?তোমার এসব বিস্ময়কর, বিচিত্র, কথা, আমার পার্থিববুদ্ধির অগম্য।তবুও,কেন যেন মনে হচ্ছে যে, তোমার কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আজ যদিএখানে না আসতাম, তোমার সঙ্গে দেখাও হতো না আর এ সব আশ্চর্য কাণ্ড চিরকালের জন্যই অজানা থেকে যেত।” মাদ্রিনিসাআমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো— “উঁহুঁ তুমি আসতেই। আমি জানতাম তুমি আসবেই। আর তাইতো আমি তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।”

— “তুমি জানতে আমি আসবো? বলো কী?”— “নিশ্চয়ই। এতে অবাক হবার কিছু নেই।” এই বলে ও আবার ওর পোশাকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে, এবার একটা ছোটো গোল, ঘড়ির মতো জিনিস বার করে আমার হাতে দিলো।যেইনা সেটা ধরেছি অমনি আমার মাথার মধ্যে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেলো ক্ষণিকের জন্য। সবকিছু যেন কেমন ওলটপালট হয়ে গেলো চোখের সামনে।কিন্তু পরক্ষণেই, ফের সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দেখলাম,এইতো আমি দিব্যি দাঁড়িয়ে আছি পেলিং শহরে, আর আমার সামনে জলজ্যান্ত, ভিনগ্রহের এক নারী। কোনও ভুল নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম— “এ আমায়কী করলে?”

— “ও কিছু না।একে বলে এক মস্তিষ্ক থেকে আর এক মস্তিষ্কে আদান-প্রদান। তোমাদের ইংরিজিতে বলে—Transcannial Magnetic stimulation অথবা Brain to brain communication.অর্থাৎ তোমার মস্তিষ্কে যা কিছু সঞ্চিত আছে তা মুহূর্তে আমার মস্তিষ্কে চলে এল।Neuro science-এরএ এক অতি উন্নত পর্যায়।তারপর, আর একবার খিলখিল করে হেসে বললো— “তোমার সম্বন্ধে কোনও কিছুই আর আমার অজানা নেই।শুধু তুমি কেন, তোমার স্ত্রী, বন্ধু, পরিবার সবারই বিশদ তথ্যএখন আমার নখদর্পণে। আর এখন থেকে, ঐভাষা তর্জমা করার যন্ত্রটারও আর প্রয়োজন নেই।তোমার ভাষা, মানে যে যে ভাষা তুমি বলতে পারো, সেসব ভাষাতেই আমিও কথা বলতে পারবো।” আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হলেও, এটুকু বুঝলাম যে ও আর যাই হোক,মিথ্যে বলছে না। আর আমাকে বানিয়ে বলে, ওর লাভই বা কী? নিজেকে বহুকষ্টে একটু গুছিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম— “কিন্তু তুমি আজ এখানে কী প্রয়োজনে এসেছো?” আমার এই প্রশ্নে,প্রথমবারের জন্য মাদ্রিনিসাকে একটু চিন্তান্বিত মনে হলো। তারপর পরিষ্কার বাংলায় বললো— “আমি তো প্রায়ই বেরিয়ে পড়ি ‘ইন্টার গ্যালাক্সি ট্যুরে।’ ঘুরে বেড়াই বিভিন্ন জায়গায়।বিশেষ করে তোমাদের পৃথিবীতে আমাকে আসতে হয় নানা কারণে।”

‘ইন্টারগ্যালাক্সি ট্যুর?’ মানে, ছায়াপথ অতিক্রম করে? তুমিবলছোকী? এসব কি কখনও হতে পারে? নাঃ এবার সত্যিসত্যিই আমি পাগল হয়ে যাব।” এর উত্তরে মাদ্রিনিসাহেসে,আমার একটা হাত ধরে বললো, “আচ্ছা এসো আমার সঙ্গে।” সঙ্গে সঙ্গে, মুহূর্তেরজন্য আমার মনে হলো, আমি যেন ওর সঙ্গে বরফের ওপর স্কেটিং করছি ভেসে ভেসে। কিন্তু তা পলকের জন্য।পরক্ষণেই দেখি আমি সম্পূর্ণ এক ভিন্ন জায়গায়।ঠিক যেমন সিনেমায় আমরা জাম্প-শট্ দেখতে অভ্যস্ত। এ জায়গা পুরোপুরি ঘর-বাড়ি ও জনমানব শূন্য। চারিদিক বরফ-শীতল।একটু আগেই মৃদু তুষারপাত হয়েছে মনে হয়। ঘাসের ওপর, গাছের পাতায় সাদা ফুলের পুঞ্জের মতো পাতলা বরফের আস্তরন। মাদ্রিনিসা আমাকে খাদের কিনারায় নিয়ে গিয়ে বললো “একবার নীচে তাকিয়ে দেখো।” আমি অপার বিস্ময়েমন্ত্রমুগ্ধের মতো নীচে তাকিয়ে দেখলাম, অনেক নীচে ছোটো ছোটো বিন্দুর মতো ফুটকি ফুটকি আলো। জিজ্ঞাসা করলাম— “আমি কোথায়? নীচে কি লোয়ার পেলিং?” মাদ্রিনিসা আমাকে শুধরে দিয়েবললো—না, ওটা আপার পেলিং। আমরা আরও প্রায় হাজার খানেক ফুট উঁচুতে।”

— “সেকি? আমি কীভাবে এলাম এখানে? সর্বনাশ।এখন আমি ফিরবো কী উপায়ে? দেবশ্রী ভীষণ কান্নাকাটি করবে আমি না ফিরলে।” ভীত কণ্ঠে বলি।

— “চিন্তা কোরোনা। তোমার ফিরতে একটুও দেরী হবেনা।” মাদ্রিনিসা আমাকে আশ্বাস দেয়। “তবে,এবার তোমাকে বলি,কেনআজ আমি এসেছি।” আমি পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।ও বলতে লাগলো,

— “তুমি হয়তো তাজ্জব হয়েছো, পৃথিবীর তুলনায় আমাদের অভাবনীয় অগ্রগতির কথা শুনে। কিন্তু জেনে রাখো এই অত্যাশ্চর্য অগ্রগতিই আমাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি নিয়তই লেগেরয়েছে আন্তর্গ্যালাক্সি ভয়াবহ যুদ্ধ। নিমেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে গ্যালাক্সির পর গ্যালাক্সি।আর তাতে প্রতি নিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য কোটি প্রাণ।শুধু তাই নয়, আমরানিদারুণভাবে হারিয়েছি পারস্পরিক ভালোবাসা আর বিশ্বাস।তাই আমি এসেছি এবং মাঝেমাঝেই আসি তোমাদের দেশে।”

— “কেন? আমাদের দেশে কেন? তোমরা তো বহুগুণ এগিয়ে আমাদের থেকে।” আমি রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করলাম কোনওরকমে।

— “না।এএক বিরাট ভুল। আসলে তোমরাই এগিয়ে আছো আমাদের থেকে।”

“ঠাট্টা করছো?” আমি বলি।

— “না গো ঠাট্টা নয়। তোমাদের এখনও আছে ভালোবাসা,প্রেম। যা কবেই নিশ্চিহ্ন হয়েছে আমাদের দেশ থেকে।আসলে তোমাদেরই যে আছে অমূল্য রক্ষাকবচ।যা তোমরা যুগে যুগে পেয়েছোশ্রীকৃষ্ণ, যীশু, মহম্মদ, বুদ্ধ, কনফুসিয়াসবা শ্রীরামকৃষ্ণ-র কাছ থেকে। অথবাসাম্প্রতিককালে,রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর,বিবেকানন্দর লেখা, বাণীও জীবন থেকে। এ মহাবিশ্বে তোমাদের ঋষিরাই এক ও একমাত্র, যারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, এমনকিদেখতেও পেয়েছেন সেই প্রকাণ্ড,অসীম ব্রহ্মকে, যা শুধু দেহ, মন, যুক্তি, বুদ্ধি নয়, জ্ঞানেরও অগম্য।যাঁর কথা লেখা আছে উপনিষদের পাতায় পাতায়। তাঁরাই ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন সৃষ্টির রহস্যকে, জীবনের উদ্দেশ্যকে।সেই পরম সত্যের পথের সন্ধানেই আমাকে বারেবারে আসতে হয় এদেশে। কারণ, তা না জানতে পারলে,এই ধ্বংসলীলা চলতেই থাকবে অবিরত।”

আমি নির্বাক হয়ে মাদ্রিনিসার আশ্চর্য কথা শুনছিলাম, আর ভাবছিলামযে,এই অসীম দূরত্ব, এই অশেষ বৈষম্য সত্ত্বেও, ও আমাদের ছোটো পৃথিবীকে এত ভালোবাসে? এত মূল্য দেয়? এত কিছু জানলোই বা কেমন করে?

চমক ভাঙলো,যখন ও আমার হাত ধরে বললো— “চলো বন্ধু এবার যাওয়া যাক।” এই বলে, ও আমাকে পাহাড়ে ঘেরা এক মসৃণ সমতলে নিয়ে এল যেখানে অস্পষ্ট আলোতে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে ওর ধপধপে সাদা, ডিমের আকৃতির মহাকাশ যান। —এসো, এবার তোমাকে, তোমার হোটেলে পৌঁছে দিই। আমাকে নিয়ে ও এগিয়ে গেলো, আর চকিতে অপূর্ব এক মায়াবী আলোর ইন্দ্রজাল খেলে গেলো আমার চোখের সামনে।পরক্ষণেই মাদ্রিনিসা তা নিভিয়ে দিয়ে বললো “অযথা মানুষের দৃষ্টিবা কৌতূহল আকর্ষণ করার দরকার নেই।নামো আমরা এসে গেছি।” —“সেকি? এর মধ্যেই? আমি স্তম্ভিত হয়ে বললাম।” —“হ্যাঁ, zaptosecond-এর কোটি ভাগেরও কম সময়ে।”—ও বললো।

— ‘zaptosecond?’

“zaptosecond হলো সেকেন্ডেরএকশো কোটি ভাগেরও কম সময়।” আমাকে বুঝিয়ে বললো ও। যদিও কিছুই বোধগম্য হলো না আমার।আমি নামলাম সাদা মহাকাশযান থেকে আর মাদ্রিনিসাও আমার সাথে সাথেনেমে এসে হঠাৎ বললো— “এই নাও তোমার মোবাইল।তোমার পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিলো রাস্তায়।আমি কুড়িয়ে রেখে দিয়েছিলাম।”

এতক্ষণের এই, লোমকূপে শিহরণজাগানো বিচিত্র অভিজ্ঞতার পর মোবাইলের কথা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন আনন্দে,বিস্ময়ে আমার চোখে জল এসে গেলো। মাদ্রিনিসা আমাকে পলকের জন্যএকবারজড়িয়ে ধরে বললো— “আর সময় নেই। বিদায় বন্ধু।”

আমি পাথরের মূর্তির মতো, মোবাইল হাতে নিয়েঅস্ফুটে বললাম—আর কোনওদিনইআমাদের দেখা হবেনা মাদ্রিনিসা?

ও হেসে বললো—‘হতেই পারে। দেখা যাক। ও হ্যাঁ, তোমাকে যে ঘড়ির মতো যন্ত্রটা দিয়েছি,সেটা এখন ঘুমিয়েই থাকবে। যখন আমি আবার আসবো, হয়তো বছর পাঁচেক পর, তখন ওটাতেই জানতে পারবে।—চলি।’ ও আর দাঁড়ালো না। উঠে পড়নোওর অপূর্ব মহাকাশযানে, আর আরও একবার, সেইমায়াবী আলোর বর্ণালী দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে দিয়ে, মুহূর্তেএকটা ছোট্ট আলোর বিন্দুতে পরিণত হয়ে,অদৃশ্য হলোদিগন্তজোড়াকাঞ্চনজঙ্ঘার ওপারে, পুঞ্জীভূত মেঘেদের আড়ালে। এক অতিজাগতিক আলোকঝর্ণার পর ধীরে ধীরে নেমে এল স্তব্ধতা।এক গভীর শূন্যতা যেন গ্রাস করলো আমাকে।আর সেইসঙ্গে এক অনাস্বাদিতপূর্ব রোমাঞ্চকর বিচিত্র অনুভূতি, যে আমি এই মহাবিশ্বেরই একজন মানব,একটি মহান প্রাণ। আমার আর কোনও পরিচয়ের কি প্রয়োজন আছে? বোধহয় না।

আমিসম্মোহিতের মতো হোটেলে ফিরলাম। ক্রমে আমার সম্বিত ফিরে আসতে লাগলো। মনে এল যে দেবশ্রী আমাকে নিশ্চয়ই বকাঝকা করবে এত দেরিরজন্য।

দরজা খুলেই আমাকে দেখেদেবশ্রী বললো— ‘কিগো?পেয়েছো?’

—হ্যাঁ এই নাও। বলে মোবাইলটা দিই ওর হাতে। প্রচণ্ড খুশি হয়ে বললো— “ঐ দোকান অবধি গেলে আবার?”—শুধু দোকান কেন ? একেবারে আপার পেলিং-এরও ওপর থেকে ঘুরে এলাম। আমি বলি।— “হুঁঃ, আমাকে খুব মিথ্যে কথা বলাহচ্ছে বুঝি?তুমি তো এইমাত্রই গেলে আর এলে। বড়োজোর কুড়িমিনিট।দোকান অবধি যেতেই তো কতক্ষন লাগে।” হেসে বললো ও। তারপরেই হঠাৎ আমার দিকে অবাক চোখেতাকিয়ে বলে উঠলো— “একি? তোমার জামা-প্যান্টে এত বরফের কুচি কোত্থেকে লাগলো?”

আমিআপনমনে বিড়বিড় করতে লাগলাম— “zaptosecond, Transcannial stimulation...”দেবশ্রী চোখ বড়ো বড়ো করে আমাকে দেখে বললো— “তুমি কি নেশা-টেশা করে এলে নাকি?”

আমি আর কথানা বাড়িয়েশুধু একটু হেসে বললাম— “এক কাপ গরম কফি খাওয়াও,খুব টায়ার্ড।”লল্ডপরেরদিন সকালে হোটেলের রিসেপশন-লবিতে গিয়ে দেখি টিভির একটা খবর নিয়ে কয়েকজন জোর আলোচনা করছে। কী ব্যাপার? দেখলাম খবরেবলেছে— “গতকাল রাত ৮.৫০ নাগাদ সিকিমের পেলিংশহরের আকাশেপরপর দু’বার এক অলৌকিক আলোর বর্ণচ্ছটা দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়।মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এই অজানা রশ্মিকে এখনও ব্যাখ্যা করতে পারেননি।”

দেবশ্রী আমার কানে কানে বললো— “তুমি ঠিক ঐসময়েই কাল আপার পেলিং গিয়েছিলে, বললে না?”

— “হ্যাঁগিয়েছিলাম বইকি। তবে ঠিক আপার পেলিং নয়, আরও হাজার খানেক ফুট উঁচুতে।আর ঐ বর্ণচ্ছটাও খুব কাছ থেকে দেখেছি।” বললামআমি।

দেবশ্রী হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার মুখের দিকে।

0 comments: