1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সুব্রত ঘোষ

Posted in




















এক শ্বেতাঙ্গিনী সাধ্বী এক দৃষ্টিতে দেখছেন একটি ছবি। ঘরের বড় জানালার আলো ছবির ওপরে এসে পড়েছে। ছবির মধ্যে এক নারী মূর্তি। গৈরিক বসনা সেই নারী কি যোগিনী ? সাধ্বী এই প্রশ্নই করলেন এই ছবির শিল্পীকে। শিল্পী তাঁর ছবির সংক্ষিপ্ত ব্যখ্যা করলেন। নারীমূর্তি র চার হাতের উপস্থিতি লক্ষ্য করলে তাকে মানবী বলা যায় না। সে যেন কোনো স্বর্গের দেবী। শ্বেতাঙ্গিনী ছবিতে নিমগ্ন হয়ে দু’ চোখ বুজলেন। এক গভীর নিশ্বাস তাঁর ওষ্ঠ কেঁপে ধ্বণিত হলো,- ‘হে মাতঃ’।

শ্বেতাঙ্গিনী সাধ্বী আর কেউ নন, তিনি স্বয়ং মহিয়সী ভগিনী নিবেদিতা। এই আইরিশ মহিয়সী স্বামী বিবেকানন্দকে গুরু মেনে এই ভারতবর্ষে এসেছেন। ভারতের জনমানসকে উপলব্ধি করেছেন। এই পরাধীনতার জনাকীর্ণে তিনি নিজেকেও সামিল করেছেন। আজ এই চতুর্ভূজা দেবীচিত্র তাঁকে সম্মোহীত করেছে। ছবিটির থেকে চোখ সরাতে পারছেন না নিবেদিতা। তিনি কতকটা বিস্মিতও হয়েছেন। এ যেন এক আবিষ্কারকে আবিষ্কার করা। এর স্রষ্টা নিজেও তার সৃষ্টিতে বিস্মিত, খুশীও। শিল্পী স্মিত হেসে ওঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন। শিল্পী জানালেন যে, এই ছবির নাম রেখেছেন ‘ভারতমাতা’।

এই চিত্রকর্মের সামনে শিল্পী ও সাধ্বীর এই উপস্থিতির দৃশ্যটি ভারতবর্ষের শিল্পের এবং রাজনীতির ইতিহাসে এক বিশেষ অধ্যায়কে সূচীত করে। এই আলোচীত শিল্পী হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি থেকে সূর্যালোকের মতো যে দ্যূতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তা’ অবনীন্দ্রনাথের কাকা বিশ্ববরেণ্য রবীন্দ্রনাথের খ্যাতির। অবনীন্দ্রনাথ সেই সৌরবলয়ে প্রতিভাত অনন্য একটি গ্রহের মতোই, প্রকাশিত হয়েছেন ক্রমে এবং দীর্ঘ প্রসারী হয়েছেন মানুষের মননে। রবীন্দ্রনাথ, মানে অবনীন্দ্রনাথের ‘রবি কা’ তখন বাঙলা তথা ভারতবর্ষে সাহিত্য – সংস্কৃতির নবজাগরেণের পথিকৃত। ১৯০৫ সালের কথা বলছি। দেশীয় রাজনীতির উতপ্ত অবস্থা। তার আঁচ গিয়ে পড়ল ঠাকুরবাড়িতে। ভারতবর্ষের ভাইসরয় লর্ড কার্জন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বঙ্গ ভঙ্গ করার। এর প্রতিবাদে অতি সক্রীয় হলেন রবীন্দ্রনাথ। হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি করে ইংরেজ শাষক তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে মরিয়া। দেশে ধর্মীয় উন্মাদনায় দিকে দিকে বিদ্বেষের আগুন তখন ছড়িয়ে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ দুই ধর্মের মানুষের মিলনের আহবানে রাস্তায় নামলেন। কলকাতার জনপথে কার্জনের এই জঘন্য নীতির বিরোধিতা করে ঠাকুরবাড়ির সব সদস্যরা রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে পদযাত্রা করলেন। সঙ্গে যোগ দিল অগণিত মানুষ। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে সবাই একে অপরের হাতে ভাতৃত্বের চিহ্ন স্বরূপ রাখী পরিয়ে দিল। সেই শুরু বাঙলার রাখী বন্ধন উৎসবের।

ভগিনী নিবেদিতা
এই ১৯০৫.......কি এক ভীষণ উদ্বেলিত সময় ! এই বছরের শুরুতেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। তিনি শিলাইদহের জমিদার হয়েও অধিক পরিচীতি লাভ করেছিলেন ‘মহর্ষি’ রূপে। মহর্ষির তরুণ বয়সের ধর্ম ও দর্শনের প্রতি গভীর আগ্রহ ক্রমে তাঁকে দেশের মানব কল্যানে পরিচালীত করে। সমাজে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অত্যাচার তাঁর কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। মানুষের অশিক্ষাই যে এই দূরবস্থার মূল, তা’ অনুধাবন করেছিলেন তিনি। এই দূরাবস্থাকে নির্মূল না করলে ভারতবর্ষের মানুষ কোনও দিনই প্রকৃত স্বাধীনতার আলো দেখবে না। এই আলোকদীপ্ত চিন্তার সূত্রপাত করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথের পিতা প্রিন্স্ দ্বারকনাথ ঠাকুর। তিনি ভারতবিখ্যাত শিল্পপতি হয়েও সমাজ সংস্কারে ব্রতী হয়েছিলেন। দ্বারকানাথের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তাঁরই স্বহৃদয় বন্ধুবর, আরেক আলোক প্রসারী ব্যক্তিত্ত রাজা রামমোহন রায়। দেবেন্দ্রনাথের মানব হিতৈষী মন এবং সমাজ সংস্কারে ব্রতী হওয়া অনেকটাই উত্তরাধিকার প্রাপ্তি। বিলেতে জনপ্রিয় দ্বারকানাথের অন্তঃকরণে যে দেশের মানুষের জন্য শোক, তা’ অল্প বয়েসেই বোধকরি তাঁর সুপুত্রের মনের গভীরে স্থান নেয়। দেবেন্দ্রনাথ ভারতীয়ত্ত্ব তথা হিন্দুত্ত্ব নিয়ে বিশেষ গবেষণায় মগ্ন হয়েছিলেন। ক্রমে ধর্মের শাশ্বত দর্শণের মূল মন্ত্রের সন্ধান সমাজকে দিতে চাইলেন। ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রচলন করলেন ব্রাহ্ম ধর্ম। এই ধর্ম মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করে না। নেই পৌত্তলিক পূজার আরোপিত শাষন। যে অর্চণার অলঙ্কারে মানুষ নিজের অন্তরাত্মাকে বন্দি করে রেখেছে, তা’র মুক্তির পথ দেখালেন দেবেন্দ্রনাথ। শ্রেণী অহঙ্কার ত্যাগ করে পরম ব্রহ্মের কাছে নিজেকে নিবেদন করলেন। নিজ পিতার যে’টুকু বৈভব আর পাশ্চাত্তের আবরন তাঁর ওপরে ছিল, জীবনের গোধূলি বেলায় তা’ও বিসর্জণ দিলেন। এই ত্যাগের মধ্যেই খুঁজেছিলেন প্রকৃত হিন্দু ধর্মের মানে। ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারে মহর্ষী তাঁর সঙ্গে পেয়েছিলেন কেশব চন্দ্র সেন কে। পেয়েছিলেন একদল উদ্যোগী শিক্ষিত উন্নত মনের মানুষ। শিক্ষার সচেতনতা এলো বাঙলায়। ব্রাহ্ম ধর্মের জোয়াড় এলো রাজধানী কলকাতা ও অন্যান্য স্থানেও।

ব্রাহ্ম ধর্ম ও শিক্ষিত মননের উত্তরসূরী ঠাকুরবাড়ীর সম্প্রদায় এবং তদঘনীষ্ঠ শিক্ষিত –সচেতন মানুষেরা সমাজে বহু উন্নয়ন মূলক কাজে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তখন ব্রিটিশ শাষণের অন্ধকার যুগ। ব্রিটিশ রাজ ক্রমাগত অন্যায় অবিচার বৃদ্ধি করে চলেছে। ফলতঃ চারিদিক থেকে ব্রিটিশ বিরোধী সন্ত্রাশের খবর আসে সর্বদা। দেশের স্বার্থে বিক্ষিপ্ত আন্দোলন আর আত্ম বলিদান অব্যাহত। এমতাবস্থায় বাঙালী বুদ্ধিজীবিকূলের অনেকেই শাষকদলের বিরুদ্ধে সক্রীয় হলেন। সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথের রাখীবন্ধনের প্রতিকী মর্মার্থ আপামর জনগনকে প্রভাবিত করলো। বাঙলা ও তার বহিরাঞ্চলে এর ঢেউ পৌঁছলো। বলা বাহুল্য যে, এই সাংস্কৃতিক তথা রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক এবং দুই ধর্মের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান এর সাফল্য এনেছিল, ইতিহাস তা’ই বলে। জাতীয়তাবাদের স্বদেশী সচেতনতার পদ্ম এভাবেই প্রস্ফুটিত হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীতে। সমাজের সর্বোচ্চ বর্গের সভ্য হয়েও রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবার স্বদেশী আন্দোলনের সদর্থক ভূমিকা নিতে কখনো দ্বিধা করেননি।


তরুণ অবনীন্দ্রনাথ
১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের ঠাকুরবাড়ীর এই সক্রীয় স্বদেশী ভাবনা অনেকাংশেই ভারতবর্ষে প্রথম সফল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বলে বিবেচনা করা যেতেই পারে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, মহাত্মা গান্ধী তখনও এই দেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে পরিচীত হয়ে ওঠেন নি। জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ রাজের কাছে কিছু দাবি রেখেছিল, স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি তা’তে ছিল না। এদিকে তখন রবীন্দ্রনাথ দেশের মানুষের একতার জন্য লিখছেন। মানুষের আত্ম চেতনার উন্মেষের কথা বলছেন গানে গানে। অবনীন্দ্রনাথও থেমে থাকেন নি। জাতিয়তাবোধের সঞ্জীবনী রস নীরবে জারিত হয়েছে তাঁর মধ্যে, যা’র রসোত্তীর্ণ প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছে তখন তাঁর চিত্র শিল্পে। পাশ্চাত্য শিল্প শিক্ষায় পারদর্শীতা অর্জন করেও অবনীন্দ্রনাথ দেশীয় চিত্রভাষার সন্ধানে ব্রতী হলেন। দেশীয় মাধ্যম অবলম্বন করে নিজের চিত্রশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর তিনি অন্তর্দ্বন্দে ভুগছিলেন। তৈলচিত্রে আলো ছায়ার মায়া তৈরী করা, কিংবা বস্তুর ত্রিমাত্রিক রূপকে যথাযথ ভাবে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা ...এ সবই তিনি সহজ ভাবে করতে পারেন। তাঁর অল্প বয়সে আঁকা রবি কা’র পোর্ট্রেট টি আজও সেই বিরল মুন্সিয়ানার সাক্ষ্য বহন করছে। রয়েছে মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিও, অপূর্ব তার অভিব্যক্তি ! কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ এই সব ছবি তে সন্তুষ্টি পান নি। তিনি দেশজ ভাব, দেশজ বিষয় নিয়ে পরীক্ষা – নিরীক্ষা শুরু করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে অঢেল ঐতিহাসিক ঐশ্বর্য্য। অজন্তা,ঈলোরা, বাঘ, চৈত, অমরাবতী, দিলওয়ারা ...এমনই শিল্পের কত রত্ন সম্ভার ! অবন ঠাকুর সেই সব মনি মুক্তো থেকে রসদ সংগ্রহ করলেন তার ছবির জন্যে। নিজে দিনের পর দিন সেই সব প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান থেকে ড্রইং করে ভারতীয় আদি রূপকলার ভাব আর ভাষা টি আয়ত্ত্ব করলেন। ভারতবর্ষের আদি শিল্পকলার পুনরোথ্থান ঘটালেন তিনি। তাঁর ছা্ত্রদেরও তিনি এই পুনরোথ্থানের পাঠটি শিখিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে গড়ে তুললেন এক নতুন শিল্প বিদ্যায়তন, যা’ ইংরেজ শিল্পশিক্ষা কে তোয়াক্কা না করে এগিয়ে চলল। এই শিল্পের অগ্রগতি নীরবে বিদেশী বস্তু-বিষয় বর্জণ করে স্বদেশী ভাবধারাকে গ্রহণ করে যে এক বিরলতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করল, তা’তে কোনও সন্দেহ নেই। ১৯০৫ সালে কার্জনের বঙ্গ ভঙ্গের ঘোষণা অবনীন্দ্রনাথ কে চরম আহত করে। সেই ব্যাথাতুর হৃদয় জন্ম দেয় এক চতুর্ভূজা মাতৃ মূর্তির। সেই মূর্তির পরিধেয় বস্ত্র অতি সাধারন। নিরলঙ্কার, নাটকীয়তাহীন এক উপস্থিতি। ছবির জমি জুড়ে দেশের তিন রঙ- গেরুয়া, সাদা আর সবুজ দিয়ে সুকৌশলে শিল্পী রাঙিয়ে দিয়েছেন। সব প্রদেশেই এই মা কে যেন মানিয়ে যাবে। মা য়ের কোনও কালিক গন্ডী নেই। তা’ই ভারতবর্ষের সর্বকালের নির্যাসটুকু এই ছবির মাতৃরূপের মধ্যে বিদ্যমান।

অবনীন্দ্রনাথ কৃত রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি
                     
  অবনীন্দ্রনাথ কৃত দেবেন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি


কি আছে এই ছবিতে ? ছবি জুড়ে রয়েছে সেই মাতৃরূপ, ভারতমাতা। দেবীর অভিব্যক্তি কোনভাবেই কোনও উর্বষী, কিংবা কারোর প্রেয়সীর নয়। এই চেহারা এক পূর্ণ যোগিনীর। পরনে তাঁর ঘন লালচে গেরুয়া বস্ত্র। চার হাতে চার উপাদান। ওপরের দু’ হাতে পূঁথি অর্থাৎ বেদ আর বস্ত্র। নীচে নামানো দু’ হাতের একটায় এক গুচ্ছ ধানের ছড়া আর অন্য হাতে রুদ্রাক্ষের মালা। মা এসেছেন চার বরদান নিয়ে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা এবং আধ্যাত্মিক মন – এই চার উপাদানই দেশের মানুষের কাছে সর্বাধিক জরুরী বলে মনে করেছেন শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ। এই চার উপাদান প্রতীকী অর্থে সুপ্রাচীন ভারতীয় জীবনের সারমর্ম। এই সার অস্তিত্ত্ব ফিরে পেলে মানুষের শান্তি ও সুবু্দ্ধি ফিরবে। এই মা য়ের হাতে শাখা – পলা দেখা যাচ্ছে। কপাল প্রান্তে রয়েছে সিঁদূরের ছোঁয়াও। প্রাথমিক ভাবে অবনীন্দ্রনাথ এক বাঙালী মা য়ের রূপই দেখেছিলেন। বাঙলার এই আশু অস্তিত্ত্বের সঙ্কটে এই বাঙালী সাবেকী রূপকে দেবীতে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। সে দেবী যে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে আরাধ্যা হয়ে উঠবেন, শিল্পী তা’ আগে অনুমান করতে পারেন নি।

ভারতমাতা
বাঙলায় মাতৃ সাধনা এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। এই পূজার প্রচলন ডাকাতের আখড়া থেকে পূরোহিতের মন্দিরে, প্রায় সর্ব স্তরে ছিল। আজও বিশ্বের প্রায় সব বাঙালী গোষ্টিতেই মা দুর্গা বা মা কালির পূজো হয়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তেও মাতৃ বন্দনার ইতিহাস সুপ্রাচীন। মা অম্বা, মা শেরওয়ালি, কিংবা মা অন্নপূর্ণা, - সব মা য়েরই অগণিত ভক্ত সমাহার সারা দেশ জুড়ে। এমনকি প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহে স্থূলকায় পাথরের মূর্তি প্রমান করেছে সৃষ্টি শক্তি স্বরূপিনী মাতৃ দেবীর (Fertility Goddess) আরাধনার আাদি চর্চা। এই আদি দেবী প্রকৃতির ফলনের শক্তি দায়িনী। এই শক্তি দায়িনী জীবকূলের বংশবৃদ্ধির উৎস ও বটে। সৃষ্টি – প্রজনন শক্তির এই দেবী আরাধনা শুধুমাত্র ভারত ভূখন্ডেই হয়ে এসেছে, এমনটা নয়। ইওরোপ সহ আরও বহুস্থানে এই দেবী মূর্তির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। তাই আদি মাতৃ শক্তি সমস্ত মানুষের নিজস্ব জন্মাধিকার। পৃথিবীতে মানব সভ্যতার সৃষ্টি এই মাতৃশক্তি থেকে। সেই আদিকালে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ছিল না। তা’ই এই মাতৃ আরাধনা চর্চা সমস্ত ধর্মের উর্ধে। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম-সংস্কৃতিতে নারীশক্তি উপেক্ষিত। কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাসে অসংখ্য বার বহিরাগতদের আক্রমন ও অত্যাচার মাতৃ শক্তি অর্চণাকে মুছে ফেলতে পারে নি। ব্রাহ্ম অবনীন্দ্রনাথ তাই এই মূর্তিকে তাঁর কল্পনা দিয়ে সাজাতে দু’বার ভাবেন নি। এই মাতৃ মূর্তির উন্মুক্ত দুই চরণ মাটিতে। সামনে ফুটে আছে পদ্ম ফুল। মূর্তির মাথার পেছনে জ্যোতির্বলয় পবিত্র আলো এনেছে চারিদিকে। ভারতবর্ষের মাটি যেন স্বর্গ হয়ে গেছে। ..... এমনই দৃশ্যকল্প রচীত হলো। মানুষ ভারতমাতার সন্ধান পেল।

এই শিল্পকর্মের আগে ‘ভারতমাতা’র কোনও অস্তিত্ত্ব ছিল না। শুধু নতুন বিষয়বস্তু সৃষ্টিতেই নয়, নতুন প্রকরণ শৈলী র ব্যবহারে ও ভারতবর্ষের শিল্পকলার ইতিহাসে এক বিশেষ অবদান রেখেছে এই ‘ভারতমাতা’। তৈলচিত্র ও প্যাস্টেল ছেড়ে অবনীন্দ্রনাথ তখন জলরং করছেন। প্রকৃতি থেকে উপাদান সংগ্রহ করে দেশীয় ছবির রং সমূহ তৈরী করছেন। ‘ভগবান বুদ্ধ ও সুজাতা’, ‘শাহাজানের মৃত্যু প্রতীক্ষা’ ইত্যাদি চিত্রে সফলতা আসার পর অবনীন্দ্রনাথ আর পশ্চিমের দিকে ফিরে তাকান নি। এই পর্যায়ের এক বিশেষ সফলতা আসে এই ‘ভারতমাতা’ ছবিতে। অবনীন্দ্রনাথ যে প্রাচ্য শৈলীকে আত্মস্থ করছেন মন প্রান দিয়ে, তা’ও বোঝা যায় এই সফল ছবিটি দেখে। জাপানী চিত্রকর ইওকোইয়ামা তাইকান কলকাতা এসেছিলেন ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে। তার কাছ থেকে জাপানী জলরং এর ওয়াশ পদ্ধতি শেখেন অবনীন্দ্রনাথ। কাগজের জমিতে রং লাগিয়ে জল দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে এক পেলব ও রঙ্গীন কুয়াশার মতন আবহ তৈরী হয় এই পদ্ধতি প্রয়োগে। এই ধরনের রং এর ছায় ও মায়াবী আবেশ প্রকাশিত হয়েছে ‘ভারতমাতা’ র ছবিতে। অবনীন্দ্রনাথের সেই শুরু তাঁর নিজের পথ চলা। সরকারী আর্ট স্কুলে (বর্তমান কলকাতার সরকারী চারু ও কারু কলা মহাবিদ্যালয়) তিনি তখন সহ অধ্যক্ষ। তাঁর শিল্প শিক্ষার আদর্শ নিয়ে নিকটের অনেকের সঙ্গেই সংঘাত। অধ্যক্ষ হ্যাভেল সাহেব (E.V.Havell) তাঁর পাশে ছিলেন। হ্যাভেল সাহেব ভারতীয় শিল্পের নিজের স্বকীয় মহীমায় বিকাশ চেয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ কলেজের শিক্ষাক্রমে ভারতীয় শিল্প ইতিহাস ও তার রিতী র অন্তর্ভুক্তির জন্য বদ্ধপরিকর হলেন। গ্রেকো-রোমান শিল্পধারা যা’ গান্ধার শিল্প কর্মে দেখা যায়, তা’র থেকে ভারতীয় শিল্পকে মুক্ত করতে হ্যাভেল সক্রীয় হয়েছিলেন। তাঁর লেখার সমর্থন দেখা গেল ভগিনী নিবেদিতা এবং আনন্দ কুমারস্বামীর বইয়ে। এই স্বদেশী শিল্প আন্দোলনের ঊষালগ্নে অবনীন্দ্রনাথ এঁদের কাছ থেকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে হাভেল কলকাতা ছাড়লেন। কিছুদিনের মধ্যে অবনীন্দ্রনাথও কলেজের চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে দিলেন। কোনওদিনই তাঁর চাকরী বা পদের লোভ ছিল না। চাকরী ছেড়ে অবনীন্দ্রনাথ যেন অনেক হালকা বোধ করলেন। অবাধে এঁকে চললেন জলরং এ অনেক ছবি। কোথাও রং ঘন, অসচ্ছ, টেম্পারার মতো। আবার কোথাও স্বচ্ছ রং, জাপানী ওয়াশ পদ্ধতিতে লাগানো। এক এক করে কত কালজয়ী চিত্রাবলীর জন্ম হল পরবর্তী কয়েক বছরে। জন্ম নিলো ‘বেঙ্গল স্কুল অফ্ আর্ট’। তাঁর ছাত্ররাও পরবর্তীকালের নক্ষত্রমন্ডলী : নন্দলাল বসু, অসিত হালদার, সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, মুকুল দে, ক্ষিতিন্দ্রনাথ মজুমদার, সারদা উকিল ও আরও অনেকে। এই শিল্পধারাই বাঙলার তথা ভারতবর্ষের রেনেশাঁ শিল্প আন্দোলনে রূপ নেয়।

বুদ্ধদেব ও সুজাতা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর 



                                       
 মৌর্য্য সম্রাট অশোক - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    

ইওকোইয়ামা তাইকান কে জাপান থেকে এ দেশে পাঠিয়েছিলেন বিশিষ্ট জাপানী চিত্র সমালোচক ও লেখক ওকাকুরা কাজুয়া। ওকাকুরা যখন ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতা আসেন, তখন তিনি প্রাচ্যের সংস্কৃতি ও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে তাঁর লেখা বই ‘ The Book of Tea’ এর জন্যে সব জায়গায় বিশেষ আলোচীত ব্যক্তিত্ত্ব। এই বই প্রাচ্যের যে অস্তিত্ত্বকে দেখায়, ইংরেজদের লেখায় তা’ অনুপস্থিত। ওকাকুরা কলকাতায় এসে মুগ্ধ হয়ে যান। এখানে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে অতিথি হয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে এসে এই দেশের প্রতি তাঁর আরও আগ্রহ দেখা দেয়। ভারতবর্ষের দীর্ঘ ঐতিহ্যের কথা লিখতে শুরু করলেন এই জাপানী চিন্তাবিদ। মা কালি র রূপ ও তত্ত্বকথা ওকাকুরাকে আকর্ষণ করে। এই মাতৃ রূপের দীর্ঘ ব্যাখ্যা তাঁর লেখায় আমরা পাই। এই সময় সিস্টার নিবেদিতাও ওকাকুরার সংস্পর্শে আসেন। বলা বাহূল্য যে, ঠাকুরবাড়ী ই এই চিন্তন যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু। নিবেদিতা ওকাকুরার লেখার প্রশংষায় মুখর হয়েছিলেন। তিনি পত্র পত্রিকায় ওকাকুরার প্রাচ্য সচেতনতার বিশেষ দিকের কথা তুলে ধরেছিলেন। সেই উল্লেখে ভারতবর্ষের সনাতনী ধর্ম আর সংস্কৃতির কথা অনিবার্য্য ভাবে উপস্থিত। এমন কি এই মহান জাপানীর দেবী কালিকার রূপকল্পের ও ভারতে এই মাতৃ ভক্তির যথার্থ ব্যাখ্যার পূর্ণ সমর্থন এসেছিল স্বামীজির শ্রেষ্ঠতম শিষ্যার কাছ থেকে। ওকাকুরার অনুরোধে নিবেদিতা তাঁর বই ‘The Ideals Of The East’ য়ের মুখবন্ধ টি লেখেন এবং তা’ পাঠক সমাজে বহূল খ্যাতি অর্জন করে। নিবেদিতা নিজেও ভারতীয়ত্ব তথা হিন্দুত্ব ধর্মের সারতত্ত্ব নিয়ে গভীর গবেষণা করেন। সেই গবেষণায় উৎসাহ যুগিয়েছিলেন ওকাকুরা। নিবেদিতার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Web Of Indian Life’ ওকাকুরার খুব মনোগ্রাহী হয়। এই লেখায় ভারতীয় নারীদের বিশেষ গুনাবলী যা’ পাশ্চাত্য সমাজে বিরল, সেই সত্য প্রকাশিত করেছেন। ভারতীয় রমণীদের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি তাদের উথ্থানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন বারংবার। এমন কি তিনি নিজে নারীদের উন্নতিকল্পে সক্রীয় ভূমিকা নিয়েছেন। এই নারীশক্তিকেই মাতৃরূপে বন্দনা করার যুক্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই যুক্তি ও বিশ্বাসকে শুধু লিখিতই করেন নি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সভায় তাঁর এই বিষয় নিয়ে মানুষকে সচেতন করেছেন। নিবেদিতা এ দেশে এসে এক বছরের মধ্যেই এই সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনেকটাই অবগত হয়েছিলেন। তাঁর ওপরে গুরু স্বামী বিবেকানন্দের অশেষ আশীর্বাদ ছিল। স্বামীজীর শিক্ষায় আলোকিত শিষ্যা সমাজসেবায় ব্রতী হয়েছেন। শ্রী রামকৃষ্ণদেব থেকে সৃষ্ট এই শিক্ষার আলো পরিবাহীত হয়েছে স্বামীজী হয়ে মার্গারেট নিবেদিতায়। মা কালি আরাধনার মাহাত্যও নিবেদিতা নিজের জীবন দিয়ে প্রমান করতে চেয়েছিলেন। কলকাতায় এসে প্রথমদিকে একটা বই লিখেছিলেন মা কালির বিষয়ে। ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে এই বই ‘কালি মাতৃকা’ (‘Kali The Mother’ )তে কি ভাবে মা কালির উপাসনা আমাদের মাতৃশক্তি র মাহাত্য অনুধাবন করতে সাহায্য করে, সে কথাই যুক্তি সহকারে লিপিবদ্ধ করা আছে । বইটি র আনুষ্ঠানিক প্রকাশের পূর্বেই , ১৩ই ফেব্রুয়ারী ১৮৯৯, সিস্টার নিবেদিতা কলকাতার অ্যালবার্ট হলে এক বিপুল জনসভায় এই বিষয় ব্যক্ত করেন। সেখানে তাঁর বক্তব্যের মূল লক্ষ্য ছিল বিদেশী মিশনারি দের সঙ্গে আমাদের দেশের মাতৃবন্দনার দার্শনিক বৈপরীত্বকে প্রকাশ করা। দেশের মানুষের আদর্শগত ভাবে মিশনারিদের ত্যাগ করা উচিৎ। মিশনারিদের উৎসকেন্দ্রে সেই ঔপনিবেশিকতার প্রভুত্বের শক্তিই বিরাজিত। যদিও খ্রীষ্টের গরিমা দিয়ে গড়া সেই শক্তির মোড়ককে আপাতদৃষ্টিতে উদার বলেই মনে হয়।। ভারতবাসীর উচিত জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মাতৃ শক্তি আরাধনায় ব্রতী হওয়া। নিবেদিতার ভারতীয় সনাতন ধর্মের প্রতি সমর্থনকে ইংরেজ সমাজ ‘অন্ধ ভাবাবেগ’ আখ্যা দিয়েছে। শুধু তা’ই নয়, ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়ে অপপ্রচারও করেছে অনেক। কিন্তু নিবেদিতা থেমে থাকেন নি। তিনি ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের দীর্ঘ ঐতীহ্যের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন জনসাধারনকে। সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। স্বামীজীর আদর্শ পালন করেছেন প্রতি পদে। এই সংস্কারের যাত্রায় তা’ই আবিষ্কার করেছিলেন সেই মাতৃশক্তির অমোঘ প্রকাশকে। আর সেই মাতৃশক্তীর কাছে আনুগত্যকেই সমগ্র ভারতবাসীর আশু অবলম্বন বলে বিবেচনা করতে দ্বিধা করেন নি সাধ্বী নিবেদিতা। মাতৃশক্তি সমগ্র মানবজাতির উৎস কেন্দ্র। সেই সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন বিধর্মী ওকাকুরাও ভারতের মাটিতে পা রেখে।

ইওকোইয়ামা তাইকান
      
          ওকাকুরা কাকুজো             আইডিয়ালস অফ দি ঈস্টবইয়ের প্রচ্ছদ
                

ব্রাহ্ম পরিবেশে মানুষ হলেও অবনীন্দ্রাথের শিল্পচর্চায় অন্য ধর্মীয় চিত্র বা কাহিনী কখনো বাধা হয়ে আসে নি। মুঘল চিত্রকলার শৈলী এবং অনেক মুঘল চরিত্র তাঁর শিল্পে উঠে এসেছে। তিনিই আবার কৃষ্ণলীলা চিত্রমালা সৃষ্টি করেছেন। এই চিত্রমালার শৈলী মুঘল মিনিয়েচারের (miniature) মতন অনেকটাই। এইভাবেই এক ভারতীয় নন্দন তত্ত্বের সন্ধান করেছিলেন অবন ঠাকুর। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতেও সেই সৎ অনুসন্ধান লক্ষ্যনীয়। বুড়ো আংলা থেকে রাজকাহিনী, সর্বক্ষেত্রেই এক শিশুমনের অবাধ বিচরন। লেখা পড়লে বিষয়ের রূপকল্প চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এমনই তাঁর চিত্রায়িত ভাষা। নিজের জীবনের নিবীড়তম আবেগ ও মনন তাঁর ছবিতে এমন রূপকল্পে মিশে প্রস্তুত হতো, যা’ দর্শককে এক অন্য জগতের সন্ধান দিত। কিন্তু সে ছবির ভিত হতো তাঁর জীবনের কোনো এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের টুকরো থেকে পাওয়া। এ ভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল এক কালজয়ী ছবি – ‘শাহজাহানের মৃত্যু প্রতীক্ষা’। মৃত্যু শয্যায় বন্দী সম্রাট। তাঁর পায়ের কাছে বসে উদ্বিগ্ন কন্যা জাহানারা। যমুনা নদীর ওপারে – ‘এক বিন্দু নয়নের জলে’র মতন ‘কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এ তাজমহল’। মেঘাবৃত চাঁদের মলিন আলো আবেগঘন করে তুলেছে পুরো দৃশ্যপট। অনেক প্রশংসা পেয়েছিল এই ছবি। সম্মানিত হয়েছিলেন শিল্পী অনেক জায়গা থেকে। বোঝা গেল যে, ভারতবর্ষে শিল্পের নব দিক দর্শনের মানুষ এসে গেছেন। সকলে অবনীন্দ্রনাথকে শিল্পগুরুর পদমর্যাদায় ভূষিত করেছিল। অবনীন্দ্রনাথ নির্লিপ্ত ছিলেন। আপনমনে থাকতেই ভালোবাসতেন। নিজের সঙ্গে নিজে কাটিয়ে দিতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। আর গড়গড়া ছিল নিত্যসঙ্গী। বুকের মধ্যে অনেক অবদমিত ব্যথা বয়ে বেড়াতেন। সেই ব্যাথার সিংহভাগ জুড়ে ছিল তাঁর ছোট্ট মেয়ে শোভা র স্মৃতি। অনেক অল্প বয়সেই সে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ত্যাগ করে চিরতরে। পিতা অবনীন্দ্রনাথ কন্যার মৃত্যু শোক কোনোদিনই ভুলতে পারেন নি। সেই মৃত্যু শোক ই ‘শাহজাহানের মৃত্যু’ ছবিটির জন্মের উৎস। ‘বুকের ব্যথা সব উজার ক’রে ঢেলে’ দিয়েছিলেন এই ছবিতে। ছবিটি সৃষ্টি করতে গিয়ে খুব অল্প সময়ের জন্যে শিল্পী নিজ বাহ্যিক স্বত্তা হারিয়ে ছবির আত্মায় মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। এ কথা অবনীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মকথায় লিখে গেছেন।

শাহজাহানের মৃত্যু প্রতীক্ষা (১৯০০)
এর কিছু পরে অবনীন্দ্রনাথ ক্রমে ব্যাক্তিগত বিষয়ের থেকেও স্বদেশী ভাবনাকে বেশী প্রাধান্য দিতে শুরু করেন। তাঁর উদাসী মন বঙ্গ ভঙ্গ বিষয়ের প্রতিবাদে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সৃষ্টি করেন ‘ভারতমাতা’ ছবির, আকাঙ্খিত ভারতভূমির মাতৃ সাধনার মূর্তি । স্বদেশী আবেগ দিয়ে কিছু লেখার চেয়ে, সেই ভাবাবেগ দিয়ে এক শিল্প আন্দোলন তৈরী করা অনেক কঠীন। সেই কঠীন কাজটি অবন ঠাকুর করেছিলেন। এই ভারতমাতা সকল শ্রেণীর মাতা হয়ে উঠতে পারে, এই সত্যকে নিবেদিতা এই ছবির সামনে উপলব্ধি করে আপ্লুত হয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “‘This is the first masterpiece in which an Indian artist has actually succeeded in disengaging, as it were, the spirit of motherland.” ভগিনী নিবেদিতা এই ছবিকে কাগজে ছেপে পোস্টার বানিয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হলেন। ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দ, অর্থাৎ ভারতমাতা সৃষ্টির চার বছরের মধ্যে সারা বাঙলা জুড়ে এই দেশমাতৃকার মুদ্রিত চিত্র ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। দিকে দিকে ভারতমাতার জয়ধ্বণি শোনা যেতে লাগল। উত্তরপ্রদেশে স্বদেশী আন্দোলনকারীরা অবনীন্দ্রনাথের আঁকা এই ছবির পোস্টার নিয়ে ‘ভারতমাতা কি জয়’ ধ্বণি দিয়ে মিছিল করে রাস্তায় নামলো। মাদ্রাজে নিবেদিতার শিষ্য বিখ্যাত কবি সুব্রামন্যা ভারতী এই ‘ভারতমাতা’কে প্রচারের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তুললেন। লোকমান্য তিলক এবং লালা লাজপৎ রায় যথাক্রমে মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবে অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতার ছবি নিয়ে আন্দোলনে নামেন। ক্রমে সারা ভারতবর্ষ জুরে এই মাতার জয়ধ্বণিতে জাতীয় আন্দোলন জেগে ওঠে। নিবেদিতার একার প্রয়াসে এই ভারতমাতার এত জনপ্রিয়তা হয়েছিল। জনপ্রিয়তার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি অচিরেই এই স্বদেশ মাতৃদেবীর পূজার বেদী স্থাপিত করেছিল। বলা বাহূল্য যে, ফলতঃ ভারতবাসী এই মাতৃমন্ত্রে দিক্ষীত হয়েই দেশ স্বাধীন করার অঙ্গীকার করেছিল। আজ ভারতবর্ষের যে কোনো পরীক্ষার সম্মুখে, যুদ্ধ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতীক খেলার মাঠ অবধি সর্ব ক্ষেত্রে ‘ভারত মাতা কি জয়’ এই ধ্বণি শক্তির স্রষ্টা যে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হয়তো অনেক ভারতবাসীর অজানা।

এই প্রসঙ্গে ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচীত ‘বন্দে মাতরম্’ সঙ্গীত অবশ্য স্মরণীয়। এই সঙ্গীত ভারতবাসীর কাছে দেশ মাতৃকা পূজার মন্ত্র স্বরূপ। ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে সাহিত্য সম্রাট এই মন্ত্র সঙ্গীত কে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ গ্র্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেন। এই গল্পের উৎস ছিল ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দের বাঙলার মন্বন্তর ও আর্থ – রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা। সেই প্রেক্ষাপটে দেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ সন্তানদলের আবির্ভাব উপন্যাসের প্রথম খন্ডের বিষয়। দ্বিতীয় খন্ডে দেখতে পাই সন্তানদলের দীক্ষিত হওয়ার বর্ণনা, তাদের সাংগঠনিক কার্যকলাপ, আত্মসংযম ও সংসার যাপনের চিত্র। সন্তানদলের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ দিয়ে সমাপ্তি হয়েছে তৃতীয় তথা শেষ খন্ডের। জীবনান্তিকে বঙ্কিমচন্দ্রের এই লেখাটি যতটা না শিল্পশৈলীর জন্য আলোচিত, তার চেয়েও বেশী প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তুর জন্য। ঐতিহাসিক ঘটনার আদলে ‘আনন্দমঠ’ রচীত হলেও বঙ্কিমচন্দ্র এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, সুতরাং ঐতিহাসিকতার ভান করি নাই”। কোনও সন্দেহ নেই ইতিহাসের ভিতের ওপরে এ একটি রাজনৈতিক সচেতনতার উপন্যাস। হুমায়ুন কবির বলেছিলেন, “এই উপন্যাসের আখ্যানবস্তু গড়ে উঠেছে উনিশ শতকের শেষার্ধে ভারতীয় রাজনীতিতে আবির্ভূত জাতীয়তাবাদ (nationalism) ও দেশপ্রেমকে (patriotism) কেন্দ্র করে’। তাঁর মতে আনন্দমঠের বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘ঐতিহাসিক কালাসঙ্গতি’ (historical anachronism), যা সমকালের বিকাশমান মধ্যবিত্তের আশা- আকাঙ্ক্ষাকেই মূর্ত করে তুলেছে। আনন্দমঠ উপন্যাসে জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের যে ধারনা আমরা পাই, তা’ বঙ্কিমমানসেরই বিশিষ্ট প্রতিচ্ছবি, পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ নয়। এই দেশপ্রেমকে মুসলমান রাজত্বের অপশাষন, সিপাহী বিদ্রোহ ও ইংরেজ বণিকের রাজদন্ড দখল করার ঘটনক্রমের পরিপ্রক্ষিতে বুঝতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্র এই রচনায় সন্নাসীকেও বিপ্লবীতে পরিনত করেছেন। সন্নাসীর পূজিত দেবী এখানে দেশমাতৃকা হয়েছেন। উপন্যাসের প্রথম খন্ডের একাদশ পরিচ্ছেদে সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে মাতৃমূর্তির তিনটি রূপ দেখিয়েছেন : ‘মা যা’ ছিলেন, মা যা’ হইয়াছেন এবং মা যা’ হইবেন’। মাতৃমূর্তির এই ত্রিকালধর্মী পরিকল্পনা প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেমিক বঙ্কিমের অতীতের জন্য গর্ব, বর্তমানের জন্য বেদনা ও ভবিষ্যতের জন্য আশার প্রতীক। এই আশা বাস্তবায়িত হওয়ার পথ হচ্ছে বিপ্লব সংগঠন, ইন্দ্রিয়জয়ী চরিত্র, বর্ণবৈষম্য লুপ্তি, ঐক্যবোধ ও শক্তিচর্চা। এখন অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ দেখলে সত্যানন্দের ধারনার তৃতীয় মাতৃ রূপকে অনুধাবন করা যায়। এই ছবিতে বিপ্লবের এই আশার প্রতীকের প্রকাশের পূর্বে অবনীন্দ্রনাথের বিভন্ন শিল্পে বাকি দুই রূপের অস্তিত্ত্বকেও খুঁজে পাওয়া যায়। বোধ করি এই ভাবেই অবনীন্দ্রনাথের ওপর বঙ্কিমমানসের গভীর প্রভাব ভারতমাতাকে মূর্ত করতে সক্রীয় হয়েছিল।

আনন্দমঠ’ চলচ্চিত্রের পোস্টার ( ১৯৫২)
 বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


ঠাকুরবাড়ীতে বঙ্কিমবাবুর লেখার ভক্তের অভাব ছিল না। তাঁর লেখায় আধুনিক মানসিকতা এবং অতীতের অলঙ্কৃত গৌরব, এই দুইই পাঠকদের আকর্ষিত করে। আবার এই দুই উপাদান থেকে কোথাও দ্বন্দও তৈরী হয়। এই দ্বন্দের একদিকে পরাধীনতার গ্লানি, অন্যদিকে ইংরেজ – শাসনের সুফল সম্বন্ধে প্রত্যয়। এর দোলাচালে দুলেছে বাঙালী শিক্ষিত সমাজ, উচ্চ বর্গের অনেক মানুষ...... বঙ্কিমচন্দ্র, রাজা রামমোহন, মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ও আরও অনেকেই। অবনীন্দ্রনাথ এই দ্বন্দ থেকে বেড়িয়ে এসেছিলেন তাঁর সৃষ্টির হাত ধরে। তাঁর সৃষ্ট ‘ভারতমাতা’ ই এর প্রমান। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা সাধারন মানুষের কাছে সহজবোধ্য ছিল না। তাঁর লেখা সেইসময়ে উচ্চ শ্রেণীর উচ্চ শিক্ষিতকূলের সম্পত্তি স্বরূপ। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ পৌঁছে গিয়েছিলো সমাজের সকল শ্রেণীর কাছে। অশিক্ষিত নিম্নবর্গীয় মানুষের দল এই ছবি মাথায় নিয়ে ‘ভারত মাতা কি জয়’ ধ্বণি তুলে মিছিল করেছিলো। ‘বন্দে মাতরম্’ সঙ্গীত যেমন আজও ভারতীয় মানুষের ধমনীর মধ্যে, তেমনি ভারতমাতা দেবী রূপটি সকল ভারতীয়ের মনের গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত। ভারত ভাগ হওয়ার পর দেশের মানুষ আরও আবেগ তারিত হয়ে এই ভারতমাতার চরণে আশ্রয় নেয়। সেই সময় থেকে আজ অবধি ভারতের নানা স্থানে ভারতমাতার মন্দির স্থাপিত হয়েছে। সব মন্দিরেই আরাধ্যা দেবী মূর্তি অবন ঠাকুরের সেই ভারতমাতা।

এরকমই এক মন্দিরের উদাহরণ বেনারসের কাশী বিদ্যাপীঠ। এখানে বৃহৎ ঘেরা জায়গায় ভারতমাতার যে মন্দির তা’র নির্মাণ কাল ১৯১৮ থেকে ১৯২৪ এর মধ্যে। তখনও দেশ ভাগ হয় নি। শিল্পপতি ও স্বদেশ সংগ্রামী বাবু শিবপ্রসাদ গুপ্তা এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী স্বয়ং নিজে এই মন্দিরের প্রথাগত ভাবে উদ্বোধন করেছিলেন। যজ্ঞ ও পূর্নাহুতি করে এই স্থানের পবিত্রতা প্রতিষ্ঠার নিয়মাচারও সেরেছিলেন ভারতের তথাকথিত শ্রেষ্ঠ জননায়ক। এর পরে এই মা’য়ের মন্দির তৈরী হয়েছে ভারতের বিভিন্ন স্থানে। হরিদ্বারের বহুতল ভারতমাতার মন্দিরটি পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। তেমনি আকর্ষণীয় মাতৃমন্দির দেখতে পাওয়া যায় উজ্জয়িনী, মান্ডওয়া, কন্যাকুমারী ও আরও অনেক জায়গায়।

   
ভারতমাতার মন্দিরের সম্মুখ দ্বার – কাশী বিদ্যাপীঠ
                                   
                   

ভারতমাতার মন্দির – দৌলতাবাদ
                   

আজ যখন অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ এবং ‘ভারতমাতা’র জয়ধ্বণির বৈধতা সমাজের একাংশের কাছে বিতর্কের বিষয়, তখন মনে হয় দেশমাতৃকা বন্দনা নিয়েও রাজনীতি করতে আমরা ছাড়ি না। এই কালো রাজনীতির ভাইরাস্ স্বদেশী আন্দোলনের সময় থেকেই ছিল। তখন থেকেই গরিবী, দলিত, ধর্মীয় বিভাজন ইত্যাদি সহজ স্পর্শকাতর বিষয়গুলো দিয়ে জনসাধরণকে বোকা বানানো হয়েছে। আজও তার ব্যাতিক্রম দেখি না। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী ভন্ডামীর মুখোশ খুলেছিলেন তাঁর ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে। আর অবনীন্দ্রনাথ, অত্যন্ত শান্ত অথচ বলিষ্ঠ চিত্রভাষায় স্বদেশ ভাবনার দিক নির্ধারন করেছিলেন। অবন ঠাকুরের এই ছবি ফরাসী শিল্পী উ্যগেন দেলাখ্রোয়া (Eugène Delacroix )র কথা মনে করায়। ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে দেলাখ্রোয়া সৃষ্ট ‘পরিচালনরতা স্বাধীনতা’ বা ‘Liberty Leading People’ তৈলচিত্রটি ও তো ফরাসী বিপ্লবের নির্দেশক। শুধু নির্দেশকই নয়, এই চিত্র ফরাসী দেশের পরিচয় চিহ্ন বহন করে। এই জগৎ বিখ্যাত পেইন্টিং এরও প্রধান বিষয় এক দেবীমূর্তি। তিনই দেশের স্বাধীনতার প্রতীকি রূপ। এই দেশ মাতৃকাকে দেখা যাচ্ছে ছবির মধ্য স্থানে এক যুদ্ধক্ষেত্রে। চারিদিকে শবদেহের স্তুপ। তা’রই ওপর দিয়ে উদ্ধত রণংদেহী চলেছেন ‘ব্যারিকেড’ ভেঙ্গে কোনও বাধা না মেনে। হাতে তাঁর তেরঙ্গা পতাকা : লাল-সাদা-নীল। ফরাসী জাতীয় পতাকা। দেবীর উর্ধাঙ্গের পোশাক খুলে গিয়ে তাঁর স্তনযুগল দৃশ্য হয়েছে। তাঁর পাশে এক বালকও বন্দুক হাতে সামিল হয়েছে বিপ্লবে। সব স্তরের মানুষ এসেছে রাজার অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়তে ।
দেবী স্বাধীনতা( Liberty Leading People ) –উ্যগেন দেলাখ্রোয়া (১৮৩০)

ফরাসী বিপ্লবের দেবী মেরিয়্যান (ডাক টিকিট)
স্বপ্রতিকৃতি – উ্যগেন দেলাখ্রোয়া
                               
বলা বাহুল্য, এই ফরাসী ‘Liberty’ চিত্রটির কম্পোজিশন খুবই নাটকীয়। আর অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ অধিকতর শান্ত, যেন যোগিনীর ধ্যান মগ্নতা। উ্যগেন দেলাখ্রোয়া এই আলোচিত ছবিটির জন্যে ফরাসী দেশের সর্বকালের জাতীয় শিল্পীর সম্মান লাভ করেছিলেন।। দেলাখ্রোয়া রোমান্টিক যুগের (Romanticism) সর্বশ্রষ্ঠ শিল্পী বলেও বিবেচীত। তাঁর বহু তৈলচিত্রের বিষয় পৌরানিক এবং ইতিহাসের কোনো ঘটনা কেন্দ্রিক। তাঁর উজ্জ্বল রঙের ও তুলির কায়িক ব্যবহার ছবির চরিত্রদের প্রায় জীবন্ত করে তুলেছিলো। বিখ্যাত কবি ও শিল্প সমালোচক শার্ল্ বদলেয়ার (Charles Baudelaire ) অনেকের মতোই দেলাখ্রোয়ার গুনমুগ্ধ ছিলেন। ঠিক যেমন মার্গারেট নিবেদিতা মুগ্ধ হয়েছিলেন অবন ঠাকুরের ছবি দেখে। ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের এই ‘Liberty Leading People’ ছবিটি অনেক দিক দিয়েই বৈপ্লবিক। ইতিহাসের রোমান্টিকতা ছেড়ে হঠাৎ ই তৎকালীন নিজের দেশের বিপ্লবকে বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন ফরাসী জাতীয় শিল্পী। যুদ্ধক্ষেত্রে যোগদান করতে পারেন নি, তা’ই সেই ক্ষেদ মিটিয়েছিলেন এই স্বাধীনতার প্রতীকি মাতৃমূর্তি সৃষ্টি করে। দেলাখ্রোয়া র এই স্বীকারোক্তি তাঁর ভাইকে লেখা চিঠিতে পাওয়া যায়। একটা গোঁড়া ক্যাথলিক সমাজের মানুষের মননে এই দেবী অর্চনাকে প্রতিস্থাপিত করা নিঃসন্দেহে চরম বৈপ্লবিক। ‘ভারতমাতা’র সৃষ্টিও এরকমই এক বিপ্লব নয় কি ? অবনীন্দ্রনাথ মূর্তি পূজোর সংস্কৃতির বিপরীতে অবস্থান করেও এই মাতৃ রূপ সৃষ্টি করেছিলেন। বিদেশিনী নিবেদিতা তাঁর সৎ আধুনিক মনস্কতা নিয়ে ভারতমাতার জয়যাত্রার কান্ডারী হয়ছিলেন। দেলাখ্রোয়ার দেশমাতাও তেমনি কোনও বাইবেল থেকে উঠে আসে নি। বরং এই ফরাসী মা যা’কে মেরিয়্যান নামে চিহ্নিত করা হয়, তাঁর উপস্থিতি অনেকটাই হেলেনিস্টিক যুগের কোনো গ্রীক দেবীর মতন। শুধু তা’ই নয়। মা মেরিয়্যানের মাথায় ফ্রীজিয়ান টুপি দৃশ্য। এই টুপি তৎকালীন তরুণ উচ্চ বুদ্ধিজিবী মানুষদের প্রতিনিধি স্বরূপ। দেলাখ্রোয়া এমনি এক উন্নত বুদ্ধিমত্তার নবদিশার পথপ্রদর্শকের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নের দেবী একদিন বিপ্লবকে সফল করেছিলো। আজ তাঁরই মুখচ্ছবি ফ্রান্সের ডাক টিকিট থেকে সমস্ত রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে উপস্থিত। আসলে মানব সভ্যতার সর্বাবস্থায় মাতৃশক্তি বন্দনা অপরিহার্য। এর কোনো বিকল্প হয় না। এই শক্তির প্রতি আবেগ তারণা যে কোনো ধর্মের সঙ্কীর্ণতার উর্দ্ধে। ভারতবর্ষকে এই সত্যের মূল্য দিতে হবে। এ দেশের রাজনীতির নেতারা সম্প্রদায়ের বিভাজন করে এসেছেন স্বাধীনতার পূর্ব থেকে আজ অবধি। সব সম্প্রদায়কে এক মায়ের চরণতলে আনার উৎসাহ দেখান নি কোনোদিন। শিল্পগুরুর সৃষ্ট ভারতমাতা যেমন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন, আজ রাজনীতির কলুষতায় তাঁকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের মাকে কি আমরা আর উদ্ধার করতে পারবো ? শিল্পগুরুর আজ স্বার্ধশতবর্ষে এই প্রশ্নটা আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে।

অবনীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে


লেখক পরিচিতি - সমকালীন দৃশ্যশিল্পী, শিল্প শিক্ষক এবং লেখক 

তথ্য ও ছবি ঋণ :
1. Documentation Program, 1985; originally published 1908. Guha-Thakurta 1992 Guha-Thakurta, Tapati: The Making of New Indian Art. Cambridge University Press, 1992.
2. Inaga 2001a Inaga Shigemi, "Okakura Kakuzo's Nostalgic Journey to India and the Invention of 'Asia'." University of British Columbia (2001)
3. Mitter, Partha. Art and Nationalism in Colonial India 1850-1922. Cambridge University Press, 1994
4. Sister Nivedita (Margaret E. Noble) and Ananda Coomaraswamy, Myths of the Hindus and Buddhists. H. Holt & Company, 1914.
5. Sumit 1973 Sumit, Sarkar, The Swadeshi Movement, in Bengal 1903-1908. New Delhi: People s Publication House, 1973.
6. Paintings of Abanindranath by R. Shivakumar.
10. Ananadamath by Bankimchandra Chattopadhaya.



1 comment:

  1. So very detailed and shows a new perspective to the already known history of our legends...Great documentation

    ReplyDelete