ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল
Posted in ধারাবাহিক৫
তারপর কাঁদর পেরিয়ে চলে এলাম হেঁটে স্কুলে। তারপর কাজ শুরু হলো। বিশু ঘোষকের ভূমিকায়। বড়ো সুন্দর অনুষ্ঠান পরিচালনা করে বিশু। প্রথমে লীলা উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করলো, আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে”। তারপর সভাপতি নির্বাচন। প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, প্রধান অতিথি বরণ হলো। সকলে কবিগুরুর গলায় মালা দিলেন। তাঁর সম্বন্ধে দু-চার কথা বললেন।
আমি বললাম, সভাপতি নির্বাচন আগে করলে হতো না। বিশু বললো, জানি সব জানি। তবে কি জানিস, আমার প্রিয় কবির জন্মদিনে গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করার মতো তাঁকে আগে বরণ করলাম। বাংলার মাস্টারমশাই বললেন, তুই বিশু যাই করিস আমাদের ভালো লাগে। চালিয়ে যা। তারপর নাটক হতে হতে রাত দশটা বেজে গেলো। বিশু তাড়াতাড়ি স্যারের হাতে দায়িত্ব দিয়ে আমাদের কাছে চলে এল। হস্টেলে খাওয়া হলো। তারপর বেড়িয়ে পড়লাম বাড়ির উদ্দেশ্য।
আমরা দুটো হ্যারিকেন এনেছিলাম। রতন বললো, বিশু হ্যারিকেন দুটো জ্বালিয়েনি। বিশু বললো, অনেকটা পথ। দুটো হ্যারিকেন একসাথে জ্বালাস না। একটা হলেই হবে। আমি সামনে থাকবো। আর সাপ খোপ আছে। সবাই পা ফেলবি পরিষ্কার জায়গায়।
তারপর বিশু সামনে আর আমরা পিছনে। বেশ দ্রুত হাঁটছি আমরা। খিড়কি পুকুর, বটতলার মাঠ, তে-মাথার মাঠ পেরিয়ে আমরা চলে এলাম কাঙরা গাবায়। এখানে একটা কাঁদর আছে। ছোটো নদীর মতো। এবার পার হতে হবে। আমরা গামছা পড়ছি এমন সময় দেখলাম অলক প্যান্ট জামা পরেই জলে নামছে। বিশু বললো, অলক তুই সাঁতার জানিস না। পাকামি করিস না।
বিশু ছুটে গিয়ে অলককে ধরতে গেলো আর সঙ্গে সঙ্গেই এক বিকট হাসি অলকের মুখে। যে অলক সাত চরে রা কাড়ে না সেই অলক ভূতুড়ে হাসি হাসতে হাসতে কাঁদরের জলের উপর দিয়ে হেঁটে পার হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি বললাম, বিশু অলক কই? বিশু বললো, এই কাঙরা গাবায় ভূত আছে। এসব তার কাসাজি। শুনে রতন ও আমি বু বু করতে লাগলাম ভয়ে। বিশু বললো, চল ওপাড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই। আমরা কাঁপতে কাঁপতে জল পার হয়ে ছুটে চলে গেলাম অনেক দূরে। বিশু বললো, হ্যারিকেন দুটো ফেলে এসেছি। চল নিয়ে আসি। আমরা বললাম, বিশু তোর পায়ে পড়ি বাড়ি চল। হ্যারিকেন চুলোয় যাক।
তারপর বিশু ও আমরা অলকের বাড়ি গেলাম। বাড়ি যেতেই ওর বাবা বাইরে এলেন। বিশু বললো, কাকু অলক ফিরেছে। কাকু বললেন, না তো। সে কোথায় গেলো। বিশু সব ঘটনা খুলে বললো। কাকু বললেন, চলো আমরা সবাই থানায় যাই। সেখানে একটা খবর দেওয়া দরকার। আমি জানি কাঙরা গাবায় তেনারা থাকেন। রাতে তোমাদের যাওয়া ঠিক হয় নাই গো।
থানায় মেজবাবু সব শুনে বললেন, কাল সকাল অবধি অপেক্ষা করুন। দেখা যাক লাশ পেলেই সব বোঝা যাবে।
বিশু বললো, ও মরেনি। হাওয়ায় উড়ে গেছে। মেজবাবু বললেন, ঠিক আছে। সব কথাই শুনে রাখলাম। দেখা যাক এটা নিশি ভূতের কাজ কি না?
থানা থেকে বেড়িয়ে আমরা সবাই অলকের বাড়িতে থাকলাম আর বিশু চলে গেলো তার নিজের কাজে। ও বললো, সকালবেলা আমি আপনার বাড়ি চলে আসবো কাকু। আপনি চিন্তা করবেন না। নিশি ভূত কাউকে প্রাণে মারে না।
এই বলে সে চলে গেলো ডোম পাড়ার বুড়িমার কাছে।
কাকু বললেন, বিশু ঠিক বলেছে। আমার অলক ঠিক ফিরে আসবে।
তখন কোনও মোবাইল ছিলো না। ল্যান্ড ফোন দু-একটা বাড়িতে ছিলো। বিশু সকলের বাড়ি গিয়ে বলেছিলো, ওরা সবাই অলকের বাড়িতে আছে। কাল দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ করেছেন কাকু। বিকেলে সবাই চলে আসবে।
আমরা সবাই রাত জেগে গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। অলকের বাবা লিকার চা করে খাওয়ালেন। ধীরে ধীরে পূব আকাশে সূর্য উঠলো। সব ভয় সরে গিয়ে আলো ফুটে উঠলো।
সবাই আমরা উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে আছি। কখন আসবে বিশু। ঠিক সকাল দশটায় পুলিশের গাড়ি চলে এল গ্রামে। আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম পুলিশের গাড়ি থেকে নামছে অলক। এর মধ্যে বিশুও হন্তদন্ত হয়ে আমাদের কাছে এসে বললো, যাক কাকু, অলক এসে গেছে। মেজবাবু কাকুকে বললেন, এটাই আপনার ছেলে অলক তো?
— হ্যাঁ স্যার।
— আমাদের থানার আশেপাশে ঘুরতে দেখে ওকে নিয়ে এলাম। আমাদের স্থির বিশ্বাস ছিলো এটা অলক। ওর মুখে সবকিছু শুনলে বুঝতে পারবেন ওর সমস্যা। যাই হোক, আমরা আসি।
পুলিশের গাড়ি চলে গেলো। প্রায় দু’ঘন্টা হলো অলক ঘুমিয়ে আছে। দুপুর একটায় ওর ঘুম ভাঙ্গলো। বিশু জিজ্ঞাসা করলো, তোর কি হয়েছিলো বল তো অলক?
অলক বলতে শুরু করলো তার অলৌকিক কাহিনী।
সে বললো, আমরা সবাই যখন কাঙরা গাবায় কাঁদর পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই আমাকে খোনা গলায় নিশি ভূতটা বললো, কি রে তোর বাড়ি গিয়ে ডাকলাম। সাড়া পেলুম না। তাই গন্ধ পেয়ে এখানে এলাম। চল আমার সঙ্গে তোকে হাওড়া ব্রীজ দেখিয়ে আনি। আমি বললাম, এই রাতে বন্ধুদের ছেড়ে আমি হাওড়া যাব না। নিশিটা বললো, যা বলবো শুনবি। তা না হলে উঁচু থেকে ফেলে দেবো। আমি আর ভয়ে কথা বলিনি। নিশি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো হাওড়া ব্রীজে। আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। তারপর যখন নিশিটা আমাকে নিচে নামালো তখন জ্ঞান এল। নিশি বললো, কেমন লাগছে। কি খাবি বল। তারপর আবার বললো, গঙ্গার জলে সাঁতার কাটবি নাকি?
আমি বললাম, আমি সাঁতার জানি না।
নিশি বললো, আমি থাকলে ওসব কিছু দরকার হয় না। এই বলে আমাকে ওপর থেকে গঙ্গার বুকে ঝুপ করে ফেলে দিলো। তারপর জামাটা মুঠো করে পুতুলের মতো তুলে নিয়ে ওপরে এল। আমি ভাবলাম, আমার জীবনের শেষ দিন আজকে। নিশি মনের কথা জানতে পেরে বললো, আমরা প্রাণে মারি না কাউকে। শুধু ঘুরে বেড়াই। কাজ করি। তারপর দিনের আলো ফুটতেই নিশিটা পালিয়ে গেলো।
আমি দেখলাম একজন ভদ্রলোক আমার হাতে একশো টাকা দিলেন। তিনি বললেন, তোমাকে দেখে তো ভালো ছেলে মনে হচ্চে। তা তুমি এখানে কেন?
আমি বললাম, আপনি বিশ্বাস করবেন না আমার কথা। আমাকে নিশি ভূতে এখানে এনেছে।
ভদ্রলোক বললেন, আমি বিশ্বাস করি। তুমি সাবধানে যাবে।
আমি বললাম, আমাকে কাটোয়ার ট্রেনে চাপিয়ে দেবেন।
ভদ্রলোক বললেন, নিশ্চয়। ভোর চারটে পাঁচের ট্রেনটা পাবে চলো।
আমি তার সাথে চলে গেলাম। তিনি বললেন, মর্নিং ওয়াকে এই পথেই আমার আসা যাওয়া। তাই তোমার সঙ্গে দেখা হলো। যাও আর কোথাও নাববে না। সোজা বাড়ি চলে যাও।
অলক বললো, বুঝলাম অনেক ভালো লোক কলকাতায় আছেন। তারপর ট্রেন থামলো থানার কাছের স্টেশনে। সেখান থেকেই পুলিশ আমাকে ধরে আর এখানে নিয়ে আসে।
অলক আবার বললো, আমি আরও একটু ঘুমোবো। কাকু বললেন, ভাত খেয়ে নে। অলক বললো, পরে খাবো।
অলক খেলো না বলে বিশু ও আমরা না খেয়ে চলে এলাম। কাকু আর জোর করেননি।
ছোটো থেকে বড়ো হলো। সত্যি কি বড়ো হলো।
বন্ধুরা বলতো ওর বয়স বেড়েছে, মনটা কিন্তু শিশুর মতো রয়ে গেছে। ছোটোবেলায় কেউটে সাপ ধরা, গঙ্গা সাঁতার কেটে পেরোনো, গ্রামে গিয়ে ভূত ধরা সব মনে পরে বন্ধুদের। বাউড়ি বৌকে নিজের খাবার দিয়ে দিতো বিশু। সেই বিশু আজ নিজে একমুঠো খাওয়ার জন্য ছাত্র পড়ায়। বিয়ে করেছে সে। একটা কন্যা সন্তান হয়েছে। তারা গ্রামের বাড়িতে বড়দার কাছে থাকে। বড়দাকে মাসে পাঁচশো টাকা দিয়ে আসে। বিশু বাসা ভাড়া করে থাকে শহরে। একটা বোতল আর বিছানা তার সম্পত্তি। খাওয়াটা বেড়ার সস্তার হোটেলে সেরে নেয়। একটা ট্রেনের যাত্রীর মতো তার জীবন। তবু তার মনে আনন্দের অভাব ছিলো না। আনন্দের ফেরিওয়ালা সে। কারও কোনও অসুবিধা হলেই তার ডাক পড়তো আগে। এবার বিশু চললো গঙ্গার ধারে নীলুদার আশ্রমে। নীলুদা বললেন, ওই তো সামান্য রোজগার। নিজেই সব খেয়ে নিলে পরিবারকে খাওয়াবি কি?
বিশু বললো, দাদা, তোমার ঘাড়ে বোঝা হয়ে যাব আমি। তুমি সাধক মানুষ। তোমার অসুবিধা হবে না তো? নীলুদা বললেন, আমি ওসব বুঝি না। যদি আমি খেতে পাই। তোরও একমুঠো হবে। যা ওপরের ঘরে যা। রাত হলো। বিশুর ঘুম আসে না, গঙ্গার ধারে ওপাড়ে মরা মানুষ পুড়ছে। শবদেহের পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে। হঠাৎ বিশু শুনতে পেলো, কিঁ রেঁ, ভয় পাঁচ্ছিস? বিশু তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এল। নীলুদা বললেন, কি রে ঘুম আসছে না? এই নে খা। তারপর গিয়ে শুয়ে পড়। মোরোব্বা খেয়ে ঠাকুরকে প্রণাম জানিয়ে বিশু শুয়ে পড়লো। ঘুম ভাঙ্গলো একদম সকালে। সকালে হরিনাম শুনলো। মন্দিরের সিঁড়িতে জল দিয়ে ধুয়ে ফুল রাখলো। তারপর চলে গেলো ছাত্র পড়াতে। সেখানে চা বিস্কুট খেলো।
পরপর বারোটা অবধি ছাত্র পড়াতো। যেসব ছাত্ররা স্কুলে যেত না, তারা ফোন করে ডেকে নিত বিশু মাস্টারকে। ছাত্রদের সঙ্গ তার ভালো লাগতো। তবে দু-একটি বাড়িতে ছাত্রের অভিভাবক বসে থাকতেন। পড়ানো পরখ করতেন। তারওপরই মাস্টারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করতো। একবার এক বড়োলোকের বাড়িতে মালকিনের ধমকে সে অপমানিত হয়ে পড়ানো ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো। কারণ, ছাত্র প্রথম স্থান অধিকার করতে পারেনি। বিশু বলেছিলো, এবার পারেনি, আসছে বার পারবে নিশ্চয়। মহিলা বলেছিলেন, সরকারি চাকরি পাবে না, সেকেন্ড হলে। ফার্ষ্ট হতে হবে। আমি অন্য মাস্টার দেখবো। বিশু ছেড়ে দিয়েছিলো পড়ানোটা। তারপর এল সুখবর। নীলুদা বললেন, তুই মায়ের সেবা করে যা। মা তোকে দেখবেন। সত্যি, মা দেখেছিলেন। জীবনের কঠিন সময়ে মা সত্যিই একটা পার্শ্বশিক্ষকের চাকরি পাইয়ে দিয়েছিলেন। বিশুর ভাই খবর পাঠালো, দাদা গ্রামের স্কুলে দু-হাজার টাকায় পার্শ্ব শিক্ষক নেবে। তুমি আ্যপ্লাই করো। বিশু পেয়ে গিয়েছিলো চাকরিটা। টিউশানির থেকে ভালো। মাইনে কম হলেও নিশ্চয়তা আছে। বিশু বন্ধুদের বললো। বন্ধুরা বললো, তুই সকলকে সাহায্য করিস। তোর কোনওদিন অভাব হবে না। মানুষের আশীর্বাদ তোর সঙ্গে আছে। তারপর নীলুদার আশীর্বাদে বিশুর নিজস্ব বাড়ি হলো। আর বাসা বাড়ি নয়। নিজের বাড়িতে নিয়ে এল মেয়ে আর বৌকে। চারদিকে বাঁশের বেড়া। কাছেই একটা গরীব পাড়া আর একটা পুকুর। সাপের রাজত্ব। সেখানে ঘর বাঁধলো বিশু। একবার রাতে বিরাট এক গোখরো ঢুকে পড়লো বিশুর ঘরে। ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করছে সাপটা। মশারির ভেতরে বৌ আর ঘুমন্ত কন্যা। বিশু এক হাতে লাঠি নিয়ে ফণা চেপে ধরলো সাপটার। আর অন্য হাতে সাপের লেজ ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে এল বাইরে।
তারপর বনের ভিতর ছেড়ে দিলো সাপটা। রাত হলেই তার উঠোন দিয়ে চলাচল করতো নানারকম সাপ। ডোমনা, চিতি, শাঁখামুটি, চন্দ্রবোড়া, গোখরো কিছুই বাদ ছিলো না। সকলে বলতো মাঝমাঠে বাড়ি করলে ওইরকমই হয়। বিশু কি করে বোঝাবে, সে প্রকৃতির সন্তান। এই বন, জঙ্গল, সাপ তার বড়ো প্রিয়। সে সবাইকে নিয়ে আনন্দে থাকতে চায় না। কিন্তু মানুষ, সবাইতো আর সমান হয় না। প্রতিবেশিদের একজন তাকে শিক্ষা দিতে চায়, গাড়ি, বাড়ি আর নারী, ভেবেচিন্তে নিতে হয়। বড়ো নিষ্ঠুর কিছু মানুষ। গাড়ি-বাড়ি জড় পদার্থের সঙ্গে মায়ের তুলনা করে। বিড়বিড় করে সে। মনে ভাবে, আমি বিশু, আমার সামনে যা তা কথা বলে পার পেয়ে যায় এখন মানুষ। কিন্তু জানে না, এই বিশু ওদের শায়েস্তা করতে পারে এক মিনিটে। কিন্তু সময় বড়ো বিচারক। সে আজ বিশুকে কঠিন লড়াইয়ে নামিয়ে দিয়েছে। জীবনে টিকে থাকার লড়াই। এই যুদ্ধে ক্রোধের জায়গা নেই। ক্রোধকে জয় করার লড়াইয়ে জিততে হবে। তবেই হবে তার জয়।
সে এখন তার বাড়িতে অনেক ফুল গাছ লাগায়। আর অনেক ফুলের মাঝে সে সহজ হয়ে যায়।
ভাটফুল, ঢোল কলমি, পাহাড়ি কলমি-র ফুলের ঘ্রাণে, প্রাণে ভারতবর্ষের নির্মল সুন্দর গন্ধ ভেসে ওঠে। সুবাসে মন মাতোয়ারা। বসন্তের রঙ বাহারি ফুলের গানে হৃদয় দুলে ওঠে বিশুর।
ফল গাছের মাঝে বসে সেভাবে পুরনো দিনের কথা। সে জানে, change is the only constant in the world.
বিশু ভাবছে পুরনো দিনের কথা, শীতকালে বন্ধুরা গোল হয়ে বসতাম। মাঝখানে জ্বলতো আগুন। পাতা চোতা কুড়িয়ে দিতাম আগুনে। আগুন নিভতো না। সেই আগুনে সেঁকে নিতাম হাত-পা। আবার বাড়িতে গিয়ে মায়ের রান্নাঘরে মাটির তৈরি উনুনে সেঁকে নিতাম শীতল হাত-পা। মা সরজুগুলি, পিঠে বানাতেন। উনুনের ধারে বসে নলেন গুড়ের সঙ্গে আয়েস করে খেতাম। পায়েস খেতাম শেষ পাতে। রকমারি খাবারের সুগন্ধে ম-ম করতো মায়ের হেঁসেল ঘর। পালো, বলে একরকমের খাবার মা বানাতেন যত্ন করে। সকালে উঠেই পালো খেয়ে ভুরিভোজ সারতাম। তারপর পিঠে রোদ লাগিয়ে সরব পড়া বোঝার থেকে চিৎকার হতো বেশি। আনন্দ পেতাম সরব পড়ার প্রতিযোগিতায়। পাশের বাড়ির বন্ধুদের সরব পাঠের আওয়াজ পেলেই, ততোধিক জোরে শুরু করতাম পাঠ। স্কুলে গিয়ে তার আলোচনা হতো ক্লাসে। আরও জোরে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতো মাসের পর মাস। কোনও দুঃখ-কষ্ট আমাদের মনে রেখাপাত করতে পারতো না। জীবনের আনন্দ ছড়ানো থাকতো ধুলো জোড়া পথে। এই ধুলো, মাটির সুগন্ধ আমাদের ভারতবর্ষের প্রাণ।
বিশু ভাবে, জন্মালাম মানুষ হয়ে অথচ মানুষের কিছু করতে পারলাম না, এই শোকে বিশু মনে মনে কাঁদে।
বিশু তার বন্ধু অলকেশকে ভোলেনি। সে বিশুর খুব প্রিয় ছিলো। অলকেশ শান্ত ভদ্র ছেলে। লেখাপড়ায় খুব ভালো। পরোপকারী। ভালো চাকরি করে। তার ভাই নিখিলেশ আরও ভালো চাকরি করে। বাবা পেনশন ভোগী। অলকেশের কাছেই বাবা-মা থাকেন। তারও এক কন্যা। আর আছে তার স্ত্রী। সেও স্কুল শিক্ষিকা। এই অবধি সব ভালো। হঠাৎ মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়লো। ধনেপ্রাণে মারার রোগ। পৃথিবীটা অলকেশের কাছে বড়ো শূন্য হয়ে ঘুরতে লাগলো। জীবন অর্থহীন মনে হলো। মাসে দু’লক্ষ টাকা খরচ। তাহলে কিছুদিন মাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। এখন কোন দিকে যাবে অলকেশ। সব আয় এক করেও তো মাসে দু’লক্ষ হবে না। অলকেশের মা বললেন, আমাকে বাড়ি নিয়ে চ। আমার কিছুই হয়নি। মনের জোরের কাছে ক্যান্সার হেরে গেলো...
0 comments: