0

সম্পাদকীয়

Posted in



সম্পাদকীয়


বার বার নষ্ট হয়ে যাই
একবার আমাকে পবিত্র
করো প্রভু, যদি বাঁচাটাই
মুখ্য...

-শক্তি চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত হলো ঋতবাক চতুর্থ বর্ষ, দ্বাদশতম সংখ্যা। অর্থাৎ পায়ে পায়ে পাঁচে পড়লো ঋতবাক। আনন্দে আপ্লুত হয়ে খুশীতে আত্মহারা হওয়ার কথা। কিন্তু, বিশ্বাস করুন, পারছি না। বিস্বাদ লাগছে! সব কিছু! বিবর্ণ পৃথিবী! 

কি অবলীলায় বিশ্বকাপে মেতে উঠি, সেলফি-ঝড়ের বন্যা বইয়ে দিই। ওদিকে ছেলেগুলো মরছে! দশদিন আগে যখন ওরা প্রতিবাদ শুরু করেছিলো, একবার হিসেব করে দেখুন তো - কি করছিলাম আমরা। না, না - তখন সময় ছিলোনা!

ডিগ্রী কলেজে ভর্তির থার্ড লিস্ট বেরলো না। গাল ভরা অ্যানাউন্সমেন্ট - ব্যাকডোর অ্যাডমিশন বন্ধ! ওয়ারেন্ট বেরলো কয়েকটা ছোটো ছোটো বিশ-বাইশ বছর বয়সী ছেলের নামে, যারা দালালি করছিলো। ক্যয়া বাত!

সত্যি বলুন তো, ওরাই কি আসল অপরাধী? 

অবশ্য অনলাইন অ্যাডমিশন আবার খুলেছে... আসলে এখন, মানে বিশেষ করে আজকের দিনটার জন্য অ্যাডমিশন রি-ওপন করা খুব জরুরি ছিলো...

শুধু, মেডিক্যল কলেজের ঘাড়-ট্যারা ছেলেগুলোকে যদি কিছু করে বাগে আনা যেত, অন্তত এই সময়ে...! একটাই যা রক্ষে, মেডিক্যল-পড়া ছেলেগুলো ডিগ্রী কলেজে পড়া ছেলেগুলোর মতো সংখ্যায় অত বেশী নয়! তবে, শহিদও তো চাই! না হলে 'দিবস' পালন হবে কি করে?
-
-
-
-
কতবার তো নষ্ট হলাম, একবার পবিত্র হতে পারছি না কেন!

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - নিলয় কুমার সরকার

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


রাঢ় বাঙলার পটশিল্প ও পটের গান
নিলয় কুমার সরকার


এবারের নবরাত্রে আমি ছিলাম ঝাড়খণ্ড, জামশেদপুর থেকে পনেরাে কিলােমিটার দূরে সুন্দরনগর! পাহাড়ের পাশে সংলগ্ন গ্রামে বসেছে মিনাবাজার! নবরাত্রের কটা দিন চলবে মেলা! মেলায় চাহিদা থাকলে হয়তাে এই মিনাবাজার থেকে যাবে পুরাে এক মাস! মেলায় ঘুরতে ঘুরতে আলাপ হলাে বিচিত্র এক পেশাজীবী মানুষের সাথে! তিনি আমাদের সুখিচিত্রকর! পরিবারিক নিবাস মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম, কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বনায় আট থেকে এগারাে বয়সের জনা তিন নাবালক কে নিয়ে সুখি এসেছেন এই বিকিকিনির হাটে! না তার বিক্রী করার মতাে কোনও উপাদান নেই! একটা বড় পোঁটলার পাশে রাখা ছবি আঁকা কাগজের মস্ত একটা রােল রাখা আছে, সেই রােল গুলাে তুলেই মেলায় সুখির গান গাওয়া, যা হলাে গ্রাম বাংলার লােকায়ত গান ...তথা পটের গান! রংচঙে ছবি আর পুরাণ কেন্দ্রিক কথকতা দেখা ও শােনার জন্যই হাজির হন কিছু স্থানীয় মানুষ! তাদেরই নিয়ে সুখির জীবিকা নির্বাহ, রাঢ়-বাঙলার মাটি ছেড়ে, মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে, গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে, বাঙলার পট শিল্প হেঁটে চলেছে, ঝাড়খণ্ড এর প্রান্তিক বাঙালি অধুষিত তেপান্তর ...

সুখি চিত্রকর ধর্মে মুসলিম কিন্তু ফেরি করেন হিন্দু পুরাণ! উনি একজন তালাক প্রাপ্ত মহিলা দু মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে তার ভ্রাম্যমাণ রুটি রুজির লড়াই! আলাপ চারিতায় জানলাম ওনাদের সমাজে হিন্দু মুসলিম মিশ্র রীতি রেওয়াজ প্রচলিত, যেমন ওঁর এক মেয়ের নাম 'জরিনা', অন্য মেয়ের নাম 'শঙ্করী' -ছেলের নাম 'আল্লারাখা'! ওঁর ফেলে আসা সংসারে হিন্দু মুসলিমের সমস্ত সামাজিক উৎসবই পালিত হতাে! যেমন নববর্ষ, ইদুলফিতর, দোল, দুর্গাপূজা, কালীপুজো, বিশ্বকর্মাপুজো, সবেবরাত, প্রায় সব উতসবই প্রচলিত ওঁদের মহল্লায়!

পট আঁকিয়ে চিত্রকর সমাজ নাকি বিশ্বাস করেন বিশ্বকর্মার ঔরসে ঘৃতাচারীর গর্ভে পটুয়া চিত্রকর সমাজের জন্ম! তাই বিশ্বকর্মা পুজোর দিন চিত্রকর সমাজ খুবই শুদ্ধাচারে তাদের যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে তেল মাখিয়ে রােদে শুকিয়ে, সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া বাস্কে তুলে রেখে, নিষ্ঠার সঙ্গে বিশ্বকর্মার পুজো করেন! পুজো নিজেরাই করেন, কারণ ওঁরা সামাজিকভাবে পতিত হওয়ায় কোনও ব্রাহ্মণ তাদের পুজো করেন না! বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটাতে তারা কোনাও রকম যন্ত্রপাতি না ছুঁয়ে সম্পূর্ণ দিনের কর্মবিরতি পালন করেন।

চিত্রকর সমাজের বিয়ে থা-র সময় কাজী আসেন, দেনমােহর ও হয়! লােকাচার রয়েছে হিন্দু বাড়ী থেকে পায়েস নিয়ে আসা, সত্যনারায়ণের প্রসাদ নিয়ে আসাও হয়! বিয়েতে অবাধ মদ গাঁজার আয়ােজনও থাকে, ছরলা তলা, পুরুল ভরা, জল কাটা, বাজনা বাজানাে, লৌকিক রেওয়াজ প্রচলিত! আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার বিবাহিত মেয়েরা শাঁখা-সিঁদুর কিন্তু ব্যবহার করেন এয়ােতির চিহু স্বরূপ! আবার যখন তখন তালাক প্রথাও হামেশাই হয়ে থাকে।

চিত্রকর কেউ মারা গেলে তাঁর মৃতদেহ সৎকার হয় কবর দিয়ে! দাহ প্রথা নেই বললেই চলে, মৃত্যুর পর সাধারণতঃ সাত বা এগারােটা কুল পাতা সেদ্ধ জলে মৃতদেহ স্নান করানাে হয়! তাদের বিশ্বাস বিদেহী আত্মা এক্ষেত্রে তাদেরই কূলে ফিরে আসতে পারে! কবর দানের দিন সাধ্য মতাে উপস্থিত সবাইকে ভােজের ব্যবস্থা করানাে হয়! কিন্তু এর পরের প্রথা প্রান্তিক হিন্দুদের মতাে! চল্লিশ দিন ধরে চলে পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম, আচার, বিচার, লােকাচার  সমাজে কেন চিত্রকর পরিবারগুলি পতিত তা আর সুখি চিত্রকরের জানা নেই! সে শুধু জানে সে এক ব্রাত্য উপেক্ষিত নারী! এই মেলায় ঘুরে ঘুরেই নির্বাহ করতে হবে চারজন মানুষের জীবন ধারণ সামগ্রী শুরু হয়। তাদের প্রকৌশল শাকিলা একটা ডুগডুগি হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরেই বাজাতে থাকে! সুখি তখন এক মনে ছবি আঁকে! মেলায় বসে যা আঁকেন, সেখানে তিনি বাজারের জল রঙই ব্যবহার করছেন! তার রঙ মেলানাের মায়াজালে, হাজির হয় মেলার মানুষ, শুরু হয় লােকায়ত গান! আমার শুনছিলাম ওদের কণ্ঠে পুরাণ ভাষ্যে পটের গান! প্রথম পর্বের গান শােনার পর, সুখি চিত্রকরকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি যে কাল বললেন, পটে জৈব রঙ ব্যবহার হয়, কিন্তু এখানে তাে দেখছি বাজারের জল রঙেই ছবি আঁকলেন! সুখি হাসলেন বললেন, আমরা যখন দুর্গা বা রাসের অর্ডার পেয়ে কাজ করি, তখন কাজটা হয় সম্পূর্ণ অন্য রকম! তখন সবুজ রঙ তৈরী হয় শিম পাতার রস থেকে, কালো রঙের জন্যে ব্যবহার হয় ধান সেদ্ধ করা হাঁড়ির নীচের কালাে ভুসাে, ব্যবহার হয়। হুলুদ, খয়ের, অনেক রকম পাথরের গুঁড়াে, টাটকা গঁদের আঠা, ইত্যাদি। এ ছাড়াও ব্যাবহার হয় আমলকি, হরিতকি, বহেড়া, কাইবিচি, আধপাকা বেল ও তার আঠা! এই উপাদানগুলাে দিয়ে ছবি একে তার তলায় চিটকানাে হয় পুরনাে পাতলা সুতির কাপড়! এই পটগুলাে মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়!

সাধারণত পট আঁকার কাজ যখন খুশি হয়ে থাকে! তবে যখন দুর্গা বারাসের ঠাকুর গড়ার সময় কাজ চলে খুবই শুদ্ধভাবে! প্রথম স্নান সেরে নিয়ে কাজ ধরতে হয়, কাচা কাপড় পরে, সরস্বতী ও বাবা বিশ্বকর্মাকে স্মরণ ও প্রণাম করে শুরু হয় কাজ, এটা না করলে কোনাও কাজই ঠিক ঠাক হবে না! কাজ শুরুর সময় পটপ্রতিমায় একটু মাটি ছুঁইয়ে প্রণাম করতে হয়! কাজের সময় কোনও কথা বলতে নেই, মুখের থুতু ছিটকাতে পারে, এইজন্যে! কাজ করতে করতে পা লেগে গেলেও পটে আবার প্রণাম করতে হয়! শুধু লক্ষ্য রাখতে হয়, মাথার চুল যেন কোনওভাবেই পটে লেপ্টে না যায়! এর জন্যে বড় রুমাল দিয়ে কাজ চলাকালীন সময়টুকু মাথা বেঁধে রাখা হয়! এর পর চোখ পাকিয়ে সুখি চিত্রকর প্রশ্ন করে, এত শুধােন কেন বাপু, আমার কি কাজ কাম নেই, আপুনি কি কাগজের নােক! এক আতঙ্কিত জিজ্ঞাসু চোখ স্থির তাকিয়ে আছে আমার দিকে! আমি ওঁকে আশ্বস্ত করে বলি, আমার হাতে ব্যাগ পত্তর কই, ক্যামেরা কই, আমি হুগলির লােক এই গাঁয়ে এসেছি আত্মীয়র বাড়ী বেড়াতে, এই অজগাঁয়ে কাগজের লােক আসবে কেনে? কথা গুলাে যেন বিশ্বাস করলাে সুখি...বললাম আমাদের হুগলিতে একবার পট গাইতে যাবে? আমার কথায় হাসি হাসি মুখে বললাে, এই তাে, দু বছর আগেই গিয়েছিলাম আরামবাগের মেলায়!

বাংলার পটের মূল আখ্যানধারাগুলাে এই রকম যেমন রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, শ্রীচৈতণ্যর জীবন কথা, যমের দরবারে বিচার, ওড়িশার পট-জগন্নাথ, বলরাম, শুভদ্রা, পীরমাহাত্য পট, ইসলাম গাজীর পট, এ ছাড়াও রয়েছে খ্রিস্টেরপট নিয়ে চিত্রকলা আর লৌকিকগান! তবে লােকগানে সবচেয়ে প্রধান বিষয়। হলাে আশাবাদ! এই আশায় লােকগান ঘুরে চলে গ্রাম গ্রামান্তর!

আসুন দেখা যাক, পটের গানের লােকগাথা তাহলে কেমন :


রামগাথা পটের গান 

রাম রাম পিভূ রাম কমললােচন
দিব্যাদলে শ্যাম রাম জানকীই জীবন
রথের উপরি রঘুনাথ কিঞ্চিত ভূমিস্থলে
হৃদয় পেসন্ন রাম, মধুর বাক্য বলে।
বামে সীতা বসিবে ডাইনে লক্ষণ
রত্ন সিংহাসনে বসে প্রভু নারায়ণ
যাহার নাম লইলে খণ্ডিবে দেহের পাপ 
পুরাণে ছিলেন বাল্মীকমণি জানিবেন আপনি 
ছিরাম জন্মিবে প্রভু জানিছে আপনি
পিতা হবে দশরথ অজির নন্দন
রামের কথা কিবা কব বাখান
যাহার গুণে বনের বন্দী পাষাণ ভাসে জলে
শিকার করিতে রাজা করিলেন সাজন
সিন্ধুমণির স্তপবনে রাজা দিল দরশন 
সিন্ধুমণিকে বাণ মারে সুরয নদীর কোলে
রাম নামের ধন্যি রাজা কর্ণেতে শুনিল 
হাতের ধেনুক বাণ রাজা ভূমিস্তে রাখিল 
পাতালি কোলে কোরে আসি কন্বমনির নিকটে আসিল!!

নেপুরের উনুঝুনু প্রভু শুনিতে পাইল 
এসাে এসাে বলে কথ সম্ভাষণ করিল 
এক নিবেদন করি গাে, মনি মহাশয় 
তােমার সিন্ধু মারা গেছে সুরয নদীর কূলে
আরে কি কার্যকরিলি রাজা কি কার্যকরিলি
আমার অন্ধের নড়ি রাজা তু কেন ভাঙ্গিলি
আমি যেমন পুত্র শােক পাইলাম আচম্বিতে 
এমনি পুত্রশােক রাজা পাবি অযােধ্যা নগরে
অপুত্রবর ছিল- রাজার পুত্রবর হইল 
সহস্তি সহস্তি করে নাচিতে লাগিল।
মিথিলা নগরে আসি যজ্ঞ আরম্ভিল
ঋশ্যশৃঙ্গ মুনি এসে যজ্ঞ পূর্ণ দিল
যজ্ঞ থেকে দুইটি তরু জুটিল। 
মিথিলা, কৈকয়, কৌশল্যা, বঁটিয়া খাইলাে
রাম, লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্ন চার ভাই জন্মিল।
কত বাদ্য বাজনা বাজিতে লাগিল।
আনন্দেতে দশরথ পুত্র লয়ে কোলে
লক্ষ লক্ষ চুম্ব দেন বদন কমলে
রাম লক্ষণের কথা বিশ্বামিত্র শুনিতে পাইল
শ্রীরাম সইতে প্রভু যাত্রা করিল
রাম লক্ষণ চাইতে দশরথ
রামলক্ষণ লুকায়ে থুয়ে ভরত শত্রুঘ্ন দিল
ভরত শত্রুঘ্ন লইয়া প্রভু যাত্রা করিল
তেমাথা রাস্তায় এসে যাত্রা শুধাইলাে
ছ'দিনের পথে যাবে না ছ'মাসের পথে যাবে?
ছদিনের পথে প্রভু কিবা ভয় আছে?
তাড়কা রাক্ষস বধে হে পরাণে।
তাড়কার নাম যখন ভরত-শত্রুঘ্ন শুনিল
ডরে ডরে কম্পমান কাঁপিতে লাগিল
বিশ্বামনি তখন অভিসম্প করিল
অযােধ্যানগরে মনির শাঁপেতে অগ্নিবৃষ্টি হলাে
রাম-লক্ষণ তাহা জানিতে পারিল।
বিশ্বামিত্র মনি পুনরায় আসি রাম লক্ষণে লইল
আচম্বিতে মেঘবৃষ্টি হয়ে অগ্নি নির্বাণ হইল
তেমাথার রাস্তায় এসে যাত্রা শুধায়
ছ'দিনের পথে যাবে না বাপু ছ'মাসের পথে যাবে?
ছ'দিনের পথে প্রভু কিবা ভয় আছে?
তাড়কা রাক্ষস বধে হে পরাণে
তাড়কা বধিতে রাম চলিল বনেতে
তাড়কার সঙ্গে যুদ্ধ হইল বহুতর
তরনীর ঘাটেতে রামচন্দ্র খেয়ায় পার হইল
কাষ্ঠের তরণীরামের রেনু ঠেকাইতে স্বর্ণময় হইল
পঞ্চবটির বনে এসে রাম দরশন দিল
তাড়কা রাক্ষস বধিল পরাণে
পড়ল বিটী তাড়কা শব্দ গেল দূর
এমত প্রকারে মরে দাতার শত্ত্বর
শ্বেত কাগ বধে রাম বধে উদয়গিরি
কুল ছেড়ে বিবাহ হচ্ছে জানকী সুন্দরী
হরের ধেনুক ভেঙে রাম, সীতা পেলেন দান
বিয়ে করে রাম দোলায় চড়ে যান
ঘরের দুয়ারে অক্ষর দেখিবারে পায়
চৌদ্দ বত্সর রামের বনবাস।
পিতার সত্য পালিতে রাম চলিল বনবাস 
রাজপােশাক ত্যাগ করিল রাম
জটা বাকল পরিধান!


অনেক সময় রামায়ণের একটা মাত্র ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নানান পটচিত্র আঁকা হয়ে থাকে! পটুয়াদের কাজ হলাে সবচেয়ে জনপ্রিয় সর্বজনীন আবেদন ভিত্তিক একটা কাহিনীর সন্ধান! যেমন আর একটা লােকগাথায় পাওয়া গেল, এই পদ :-

পটকথা সিন্ধুমনি বধ

রজ রাজার পুত্র রাজা নামে দশরথ
শােভা করে বসে রাজা যত প্রজাগণ
অপত্রিকা বলে রাজা দেশে নাহি রহিব
আজ হতে অযােধ্যা মােরা পরিত্যাগ করিব 
রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায় 
গিন্নির পাপে গৃহস্থ নষ্ট লক্ষী উড়ে যায়
নারদ মুনি বলে, কথা শুন মহাশয়
শনিকে জিনিতে পারলে রথসজ্জা হয়
নারদের কথা রাজা কর্ণেতে শুনিল
শনিকে জিনিবার তরে রথ সাজাইল
জামা জোড়া নিল ঘােড়া পায়েতে পামরী
গলেতে তুলসীর মালা বিনন্দে লগুরী
শনি রাজা বসে আছেন ধর্ম সিংহাসনে
শনিরি রিষ্টিতে রথ ওড়ে স্বর্গ পানে 
রথ রথী সারথী ঘােড়া উরিতে লাগিল
কোথায় ছিল জটায়ু পক্ষ, রাজ ধরি নামাইল
আপনার গলের পুষ্পমালা জটায়ুর গলে দিল 
জনমে জনমে রাজা মিত্রতা পাতাইল
আমার মিতে, জটা তােমার আমি মিতে
ওগাে বিপদে সম্পদে যেন মনেরেখাে মিতে
বনে থাকি বনের পশু রাজা মিত্ততার কিবা জানি
আমার সঙ্গে মিত্ততা রাজা পাতায়েছ আপনি
এই খানে থাক মিত্ত রথ আগুলিয়া
আজ মৃগ শিকার করে আনি বনল কাননে
ব্রত একাদশী করেছিল বনের অন্ধক ব্রাহ্মণ
পারণের জল আনরে বাপ গুণের সিন্ধমনি
নিত্য নিত্য যাই সরােবরের ঘাটে
আজতাে যাবাে না, পিতা, কি আছে কপালে
কাল গেছে বাপ, একাদশী আজ ব্রাহ্মণ ভােজন
শিগির করে জল আন, বাপ, করিব পারণ
ওই কথা শুনে সিন্ধু কমুণ্ডল লিল হাতে
কাঁদিতে কাঁদিতে জল আনিতে যায় সরােবরের ঘাটে
সরােবরে জল পােরে আনন্দিত আনন্দিত মনে
জলের ভুকভূকি রাজা কর্ণেতে শুনিল 
বনের মৃগয়া হরিণ বলে বাণেতে বধিল
কে মেলি ব্রহ্মাস্ত্র আমার দেহ গেল জ্বলে
মাতাপিতা কাঁদছে আমার ওগাে বনেরি ভিতরে
কাল গেছে ব্রত একাদশী আজ ব্রাহ্মণ ভােজন
শিগির করে জল লয়ে যাও করবে পারণ
এই কথা বলে সিন্ধু প্রাণ পরিত্যাগ করিল 
সরােবরের ঘাটে সিন্ধু ভাসিতে লাগিল 
সিন্ধুকের কথা শুনে রাজা ওগাে ঘােড়া হতে নামিল
আজ মরা সিন্ধুকে রাজা কোলেতে করিল
স্ত্রী হত্যা, ব্রাহ্মণ হত্যা, করিলাম সুরাপান
চার পাপের পাপী হলাম মুখে আনে রাম নাম
মরা-সিন্ধুক কোলে কোরে মুনির দ্বারে গেল 
পাতার মচমােচি মুনি কর্ণেতে শুনিল
কে এলি বাপ সিন্ধুক এলি বলয়ে বচন
মা বলিয়ে ডাক রে বাপ জুরাক রে জীবন
তােমার পুত্র নয় মুনি করি নিবেদন
জানাতে বধ করেছি তােমার নন্দন
কি বেরইল মহারাজ তােমার কি বেরইল মুখে 
আকাশ পাতাল ভেঙ্গে পরে অন্ধকমুনির বুকে 
হায় হায় বলে অন্ধকিনী কপালে মারছে ঘা
কোথায় গেলি গুণের সিন্ধুক একবার মা বলে যা
পাঁচ নয় ছয় নয় আমার একা সিন্ধুক মণি
কি অপরাধ করেছিল জানলে ডন্ড দিতাম আমি
একা সিন্ধুক মেলি না রাজা মেলি রে তিন জন
রাজার যদি না আছিল পুতুর পুত্তর বর পেলি
অপুত্র মহারাজা ওগাে পুত্তর বর পেল।
মরা সিন্ধুক কোলে করে নাচিতে লাগিল 
চার পুত্র পাবি রাজা রাম কে দিবি বন
খাট পালঙ্গ পেড়ে সেদিন আমার মতন তেজিবি জীবন
রাম না জন্মাইতে ছিল ষাঠ হাজার বৎসর 
বাল্মীক মুনি ছিল পুঁথি পেয়ে ব্রহ্মার বর 
ব্রাহ্মণ শাপে অন্ধক মুনি দশরথে দিল
সিন্ধু সিন্ধু বলে প্রাণ পরিত্যাগ করিল
তিনজনের সৎকার্য একন্তে করিল
নিম কাষ্ঠ দিয়া চিতা সাজাইতে লাগিল 
চুয়া চন্দন ঘৃত ঢালিতে লাগিল 
তিন জনের সৎকার্য করে রাজা অযােধ্যাকে গেল
রামচন্দ্র জনম লােকে বলে মুনিগণ যজ্ঞ আরম্ভিল!

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সৌমিত্র বসু

Posted in



প্রবন্ধ


আমাদের কথা 
সৌমিত্র বসু 



তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগে অন্তর্মুখ নামে একটি দল ছিল, নানা অনিবার্য কারণে বন্ধ হয়ে যায়। তিন বছর আগে, অন্তর্মুখ যখন নতুন করে শুরু হলো, এবং আমাকেই দায়িত্ব নিতে বলা হলো, আমার শর্ত ছিল, আর পাঁচটা দলের মতো করে নাটক করব না, নাটকের নতুন নতুন পথ আবিষ্কারের চেষ্টা করব, থিয়েটারের নামে যে বিলাসিতার চর্চা হয়, তার মধ্যে ঢুকব না। কী আশ্চর্য, বেশ কিছু ছেলেমেয়ে রাজি হয়ে গেল এই শর্তে। মিডিয়াস্বীকৃত ধরণের বাইরে নাটক করার তিন বছর পূর্ণ হয়ে গেছে এর মধ্যে, সামান্য দু-একজন ছাড়া কেউ চলে যাবার কথা ভাবেনি। চলে যেতে হয়েছে অবশ্য অনেককে, মেয়েদের বেলায় স্বামী-সংসারের চাপ, ছেলেদের ক্ষেত্রে রুজি রোজগারের জন্যে, কিন্তু তাদের মন যে দলের জন্যে পড়ে আছে, তা বেশ বুঝতে পারা যায়। অন্তর্মুখ কখনও কাউকে বাধা দেয়নি, খুব কষ্ট, খুব অসুবিধে হলেও দেয়নি। সব মিলিয়ে দিব্যি আছি। আমরা, সম্ভবত প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া নিয়ে স্টারদের ডেকে যাঁরা বৈভবের থিয়েটার করেন, তাঁদের চেয়ে ভালোই আছি। এর মধ্যে এই অন্য রকম করে নাটক করার ব্যাপারটা বেশ খানিকটা জানাজানি হয়ে গেছে, অনেকেই মুখে অন্তত সমর্থন করেছেন, মন থেকে পছন্দ করেছেন কিনা জানি না। তবে যাঁরা প্রচলিত ধাঁচায় নাটক করেন, তাঁদের কাউকে নিজেদের দিকে টেনে আনতে পারেনি অন্তর্মুখ, যতই ঘাড় মাথা নেড়ে সায় দিন, বৈভবের থিয়েটারকে ত্যাগ করার ঝুঁকি কেউ নিতে পারেননি বা চাননি। বললাম বটে, কিন্তু ঝুঁকিটা কিসের তা আমার মাথায় অন্তত ঢােকে না। যেমন, একজন আমাকে বলেছিলেন, এই বয়েসে এই রকম একটা কাজ শুরু করতে প্রচুর দম লাগে। বুঝি না, এর মধ্যে আবার দমের কী আছে, করলেই তো হয়। 

মজার ব্যাপার হলো, আমরা যে অন্যভাবে নাটক করার চেষ্টা করছি, সেটাকে বাদল সরকারের পদ্ধতি থার্ড থিয়েটারের পদ্ধতি ইত্যাদি বলে দেগে দেবার একটা প্রবণতা খুব আছে। কিন্তু সত্যিই বলছি, আমরা নির্দিষ্ট কোনও পদ্ধতি মাথায় রাখছি না, পথ চলতে চলতেই পথ চিনে নেব, এই আমাদের ইচ্ছে৷ প্ৰসিনিয়মকে বাদ দেবার কথা ভাবিনি কখনও, উঁচু পাটাতনে নাটক করায় কোনও আপত্তি নেই। বস্তুত, আমাদের মতো দেশে যেখানে থিয়েটার বলতেই উঁচু পাটাতন বা প্রসিনিয়ম মঞ্চ বোঝায়, সেখানে এদের বর্জন করতে চাইলে অভিনয়ের পরিসর সংকুচিত হয়ে যেতে পারে বলে আমাদের ধারণা। উঁচু জায়গায় উঠে নাটক করব না, দর্শকদের সঙ্গে সম উচ্চতাতেই আমাদের স্থান, দর্শনের দিক দিয়ে এ কথার প্রভূত গুরুত্ব থাকতেই পারে, কিন্তু এই ভাবে নাটক করলে অনভ্যস্ত মানুষ একটু সন্দিহান হয়ে ওঠেন দেখেছি। আমাদের থিয়েটারে আরও কিছু কিছু উপাদান রাখা আছে, যার সঙ্গে থার্ড থিয়েটারের দর্শন মিলবে না। বেশ কিছুদিন আগে আয়নার উদ্যোগে একটি নাট্যোৎসবে অভিনয় করার সুযোগ হয়েছিল। আমাদের প্রযোজনা তাঁদের খুব ভালো লেগেছিল, কিন্তু স্বীকার করেছিলেন, তা ঠিক তাঁদের ধাঁচাকে মেনে তৈরি হচ্ছে না। আমরা অল্পস্বল্প সেট ব্যবহার করি, যা ট্যাক্সির পেছনে তুলে নিয়ে যাওয়া যাবে। আমন্ত্রণকারী সংস্থা যেমন যেমন আলো ব্যবস্থা রাখেন সেই অনুযায়ী আলোও ব্যবহার করে থাকি, অচ্ছুৎ বলে মনে করি না মেক আপ বা পোশাককেও। নাটকের শেষে দর্শকদের কাছ থেকে অর্থ দাবি করি, ভিক্ষে না। 

একবার মাথায় একটা পরিকল্পনা এল, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কাজে থিয়েটারকে ব্যবহার করলে কেমন হয়? মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রায়ই আসে, ইতিহাসের এমন তিনটে বিষয় বেছে নেওয়া হলো। চিরস্থায়ী ব্যবস্থা, সাঁওতাল বিদ্রোহ আর সিপাহী বিদ্রোহ। ছোটো বড়ো যা যা প্রশ্ন এসে থাকে তাদের জড়ো করা হলো, তারপর এমন ভাবে নাটকটা লেখা হলো, যাতে নাটকের মধ্যে সব উত্তরগুলো পাওয়া যেতে পারে। পরিকল্পনাটা শুনে অনেকেই উৎসাহ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সরকারের শিক্ষাবিভাগের কর্তাব্যক্তিও কেউ ছিলেন, তিনি আবার আমার এক সময়ের ছাত্র। শুনে বলেছিলেন, নাটকটা তৈরি হয়ে গেলে আপনি আমাকে একবার ফোনে জানাবেন৷ ফোনে পাই নি, এসএমএস করে জানিয়েছিলাম, কোনও সাড়া পাইনি। স্কুলগুলো সার্বিকভাবে খুব উৎসাহী হয়েছে এমন নয়, তার একটা কারণ, বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোর খুবই দৈন্যদশা, সামান্য এক দু’হাজার টাকা দেবার মতো তহবিলও তাঁদের নেই। স্কুলের পরিচালন সমিতিগুলোয় যাদের গলার আওয়াজ বেশি তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্কিত নন, ক্লাস চালানোর বাইরে অপ্রথাগত সব কিছুকেই তাঁরা সময় নষ্ট বলে মনে করেন। তাঁদের যতই বোঝানো হোক, বাগে আনা মুশকিল। তবে কোনও কোনও স্কুল ডেকেছেন, আর বলবার মতো কথা, কোথাও ছাত্ররা আমাদের প্রতি বিমুখ হয়নি। 

একটি স্কুলের কথা বিশেষ ভাবে বলতে ইচ্ছে করছে। আমতার ভেতরের দিকে, খুবই দরিদ্র বাড়ির মেয়েরা পড়ে সেখানে। কর্তৃপক্ষ বলে দিয়েছিলেন, ফান্ডে টাকা নেই, তবে মেয়েরা যদি কিছু দেয় তার জন্যে তাঁরা বলে রাখবেন। প্রায় পাঁচশ মেয়ে দেখল সে নাটক, থলে ভর্তি করে মিলল পারিশ্রমিক, সত্যি সত্যি একটা বড় গোছের বটুয়া, ডট পেন দিয়ে আঁকাবাঁকা হরফে লেখা সনজিদা খাতুন, পাশে ফুলের ছবি আঁকা। দু’হাজার উনিশ টাকা, এক টাকা দু’টাকা পাঁচ টাকার খুচরোয়। সে থলে কী ভারি কী ভারি, বয়ে আনতে পারি না, চোখে জল এসে যায়। অথচ, এ নাটক নিজেদের মহলাঘরে দু’চারজন শিক্ষককে প্রথম দেখিয়েছি, তাঁরা নানা পরামর্শ দিয়েছেন। সে সব কিছু দরকার হয়নি উদ্দিষ্ট দর্শকদের মুগ্ধ করার জন্যে। তা এই ধরণের কাজ সম্পর্কে সাধারণভাবে নাট্যকর্মীদের মনোভাব কী? একটা গল্প বলি। 

পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা কাজে কোচবিহার গেছি, উঠেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালায়। সকালবেলা চায়ের খোঁজে বেরিয়েছি, ওখানকার এক নাট্যকর্মীর সঙ্গে দেখা। আমি তাঁকে চিনি না, তিনিই এগিয়ে এসে আলাপ করলেন, নিয়ে গেলেন চায়ের দোকানে। যা হয়, কী নাটক করছেন সৌমিত্ৰদা? বললাম, তাতে এই ইস্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্যে করা নাটকের কথাও উঠল। সেই নাট্যকর্মী দুঃখিত গলায় বলে উঠলেন, শেষ পর্যন্ত আপনিও নৌকোয় উঠে পড়লেন সৌমিত্ৰদা! 

নৌকোয় উঠে পড়া মানে? বেশ কিছু দল আছেন, যাঁরা নানা রকম প্রকল্প নিয়ে নাটক করেন, তার বদলে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সূত্র থেকে টাকা পান। নান্দীকার এক সময়ে এই ধরণের কাজ প্রচুর করতেন, আরও অনেকে করে থাকেন। সাধারণভাবে এতে অন্যায় কিছু নেই, রাষ্ট্রের টাকায় যদি সমাজের মঙ্গল করার জন্য থিয়েটার করি, তাতে আপত্তির কী আছে। কিন্তু রাষ্ট্র সব সময়ে যে খুব সৎ ইচ্ছার বশে টাকা দেয় এমনটা তো নয়, আর উল্টোদিকে, যা হোক একটা প্রকল্প দেখিয়ে খানিকটা টাকা আদায় করাটাও অনেক সময় কোনও কোনও দলের উদ্দেশ্য হয়ে যায়। দিল্লি থেকে যে টাকা অনুদান হিসেবে বহু দলের কাছে আসে, সেও তো প্রকল্প দেখিয়েই আদায় করতে হয়। সে সব প্রকল্পের বিষয়ে বর্তমান লেখকের পরিষ্কার ধারণা আছে। অন্তর্মুখ অবশ্য ইতিহাসের গপ্পের জন্যে কোনও অনুদান পায়নি, চায়ওনি কখনও। আমাদের মনে হয়েছে, মানুষের উপকার করার দায় কেবলমাত্র রাষ্ট্র বা কোনও বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের নয়, ব্যক্তিমানুষ হিসেবে, ছোটো ছোটো গোষ্ঠী বেঁধে থাকা মানুষজন হিসেবে আমাদেরও এ ব্যাপারে নিজস্ব দায় আছে। 

আগেই জানিয়েছি, স্কুলের প্রকল্পটা খুব সফল হয়েছে এমন কথা বলতে পারব না। গরমের সময়, যখন অভিনয়ের চাপ কমে যাবে, ইচ্ছে আছে, তখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম মাথায় রেখে এই ধরনের প্রযোজনা তৈরি করব। তাঁদের মধ্যে উদার এবং সেই অর্থে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেশি, তাঁদের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ও অনেক বেশি। এমনিতেই, কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি অনুযায়ী বাংলা সাহিত্যের ছাত্রদের নাট্যের প্রায়োগিক দিক নিয়েও পড়াশোনা করতে হয়, বর্তমান লেখককে তাঁরা কেউ কেউ আহ্বান করেন বিষয়টা ছাত্রদের পড়িয়ে দিতে। তারই অঙ্গ হিসেবে হয়তো অন্তর্মুখ ক্লাসরুমের ভেতরেই একটা অভিনয় করল৷ তেমনি করে, কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে বর্তমান লেখককে পেপার পড়া বা আলোচনা করার জন্যে ডাকলে প্রস্তাব দিই, একটা অভিনয়ও করতে চাই, সামান্য পারিশ্রমিকে। কোনও জোর নেই। অনেকে রাজি হয়ে যান। তীর্থঙ্কর চন্দ একে আদর করে বলেন প্যাকেজ সিস্টেম, একই সঙ্গে বক্তা এবং নাটক দুইই পাওয়া গেল। এই সুত্রে ছাত্র এবং অধ্যাপকেরাও এই মাধ্যমটার সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন, আনন্দও পান। এই ধরণের কাজ আমরা বেশ অনেকগুলো করে ফেলতে পেরেছি। তাতে দলের ঘরে টাকা পয়সা এসেছে। আর আমাদের যেহেতু খরচ খুব কম, তাই অল্প টাকাকেই বিরাট মনে হয়। 

প্রতি বছর অন্তর্মুখ নাট্যোৎসব করে, দশঘরা নামে একটি গ্রামে। কেন গ্রাম? কলকাতা বা মফস্বলে তো নাটক হয়, নাট্যোৎসব হয়, গ্রামের মানুষের কাছে নাটক নিয়ে পৌঁছনো তো হয় না আমাদের। উৎসবটা যে দশঘরাতেই করতে হবে এমন কোনও মাথার দিব্যি নেই, এখানে এক ধরণের পরিচিতি আর প্রাথমিক পরিকাঠামোটুকু আছে বলেই করা, অন্য কোথাও সুযোগ পেলে করতে আমরা খুব রাজি। যাঁরা কলকাতার উৎসব দেখে অভ্যস্ত, তাঁরা গ্রামের মানুষের সেই আনন্দ ভাবতেও পারবেন না। কখনও কখনও বেশ পরীক্ষামূলক প্রযোজনা নিয়ে গেছি, সাগ্রহে দেখেছেন গ্রামের দর্শক, নিজের মতো করে ব্যাখ্যাও করেছেন। যেমন তেমন করে তৈরি মঞ্চ, যেমন তেমন আলো, কিন্তু দলগুলো ভরা মন নিয়ে ফিরেছেন অভিনয় করে। অন্যদিকে, গ্রামের মানুষজনের সঙ্গে দেখা হলে নাট্যোৎসবের কথা উঠে আসবেই। কি গো, এবারে হবে তো? কবে করছ? ইত্যাদি। 

আরও কিছু পরিকল্পনা আছে, হয়ে উঠছে না। যেমন, যে মানুষেরা মানসিকভাবে অসুস্থ, তাঁদের অসুখটা তো আসলে আবেগের? আর থিয়েটার তো সরাসরি আবেগের দরজায় ঘা দেয়। তা নাট্যাভিনয়ের মধ্যে দিয়ে এদের চিকিৎসায় সাহায্য করা যায় না, যাকে বলা যেতে পারে ড্রামা থেরাপি? এই কাজের পরিকল্পনা আমরা অনেকদিন আগেই করে রেখেছি, নানা ঝামেলায় হয়ে ওঠেনি, একটু গরম পড়লে সেরে নিতে হবে। 

এইভাবে শুরু করেছে আজকের অন্তর্মুখ। কতদূরে যাব জানি না, কতদিন চলতে পারব তাও জানি না। যাত্রাপথের আনন্দগান শুধু আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেবার জন্যে এই লেখা। 

0 comments:

1

প্রবন্ধ - ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


রস-কাহন 
ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য


"... পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও সন্তোষ মজুমদারকে এ্যামেরিকায় পাঠিয়ে, কৃষি ও গোষ্ঠবিদ্যায় শিক্ষিত করে এনে, রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করলেন পল্লী শিক্ষা ভবন, শ্রীনিকেতনের এক রম্য পরিবেশে। 

অগণিত মানুষ যেখানে অনাদর ও অপমানে লাঞ্ছিত। দারিদ্র্য, অনাহার, অশিক্ষাকে জন্ম জন্মান্তরের নিয়তি মেনে নিয়ে তারা জীবন যাপন করে... সেইসব মূঢ়- ম্লান মুখে ভাষা দিয়ে, তাদের শ্রান্ত- শুষ্ক- ভগ্ন বুকে আশা জাগিয়ে তুলতে..." 

মালা চুমন বই থেকে মুখ তুলে, জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো... দিগন্ত বিস্তৃত পান্না- নীল সমুদ্রের দিকে। 

মালার পূর্বপুরুষেরা বিহারের ভোজপুর ছেড়ে সুদূর মরিশাসের মাটিতে পা রেখেছিলেন, চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে। কতদিন কেটে গেছে, এখন মালার পরিবার মরিশাসে সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতির সান্নিধ্যে বড় হয়ে উঠেছে মালা। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে, এখন তার ইচ্ছে কৃষিবিদ্যা পড়ার...মাতৃভূমি ভারতবর্ষে। রবীন্দ্রনাথ তার দীক্ষাগুরু। তাঁর গানে মালা খুঁজে পায় জীবনদর্শনের সত্য। সব কিছুই ঠিক হয়ে গেছে, ক'দিন পরেই যাত্রা করবে মালা শ্রীনিকেতনের উদ্দেশ্যে। একবার ভারতবর্ষে পৌঁছোতে পারলে হয়... ঘুরে ফিরে দেখবে পুরো দেশটাকে। 

তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরমে এসে পৌঁছলো মালা, চাচা মহেশ চুমনের বাড়িতে। চাচার কাছে কিছুদিন কাটিয়ে সে যাবে কলকাতা এবং শ্রীনিকেতনের কৃষিবিদ্যালয়ে।

রাতে চাচীর কাছে, রান্নাঘরে বসে গল্প করছিল মালা। একটা সাদা রঙের পানীয়ের বোতল আর চারটে গেলাস মালার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চাচী বললেন, 'যা তো চাচাকে দিয়ে আয়...ওর বন্ধুরা এসেছে।'

'এটা কী চাচী?'

'কাল্লু...'

'কাল্লু কী হয়?'

'আমি অতশত জানি না, চাচাকে জিজ্ঞেস কর...দারু বোধহয়।

চাচার কাছে গিয়ে মালা বললো, 'আমি ঢেলে দিই, এটা কী পানীয় চাচা? চাচী বললেন দারু!'

'দারু!' হাসলেন মহেশ চুমন। 'চেখে দেখবি নাকি?'

চাচা আর তাঁর বন্ধুদের গেলাসে কাল্লু ঢেলে দিয়ে মালা নিজের জন্যেও অল্প একটু নিলো, স্বাদ চাখবার জন্যে। 

'আররে চাচা, এ তো পোয়ো...না কি কোকোটি?' 

হাসতে হাসতে চাচা বললেন, 'এথা কাল্লু। খেজুরের রস দিয়ে তৈরি। এতে এ্যালকোহলের মাত্রা খুবই কম, স্বাদও মিষ্টি। থাডি কাল্লু তৈরি হয় তালগাছের রস দিয়ে...সে একটু কড়া পানীয়। স্বাদ টক আর তেঁতো মেশানো। এই পানীয় আমার নিজের বাগানের খেজুরের রস দিয়ে তৈরি।'

'চাচা, আপনে তো মেরা দিন বনা দিয়ে। আমি ভারতে বসে আমার প্রিয় মরিশাসকে ফিরে পেলাম। আমি তো শ্রীনিকেতন যাচ্ছি চাচা, কৃষিবিদ্যা পড়তে। আজ, এক্ষুনি আমি মনস্থির করে ফেললাম, আমার গবেষণার বিষয় হবে "পাম ওয়াইন"। কাল তোমার বাগিচা ঘুরিয়ে দেখাবে তো, আমাকে? এখন তো শীতকাল...এই সময়েই তো খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়, তাই না? মরিশাসে তো এখন গরম, আম পাকছে।' একটু উদাস হয়ে পড়লো মালা, নিজের দেশের কথা মনে পড়াতে।

চাচাকে পাগল করে তুললো মালা। ভোর না হতেই সে তৈরি, বাগান দেখতে যাওয়ার জন্যে। চাচা গাড়ি বের করে ভাইঝিকে নিয়ে চললেন, তাঁর খেজুর ফার্মে। 

'এই দেখ, আমরা পৌঁছে গেলাম খেজুর বাগানে। সংস্কৃত নাম খর্জুরম্‌। এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম 'ফিনিক্স ড্যাক্টিলিফেরা' মানব সভ্যতার ইতিহাসে খেজুর ফলনের গল্প অতি প্রাচীন। মরু এলাকায় এই ফল ভাল হয়। ভারতীয় খেজুর খাওয়ার উপযুক্ত না, সেই জন্যেই বোধহয় এই গাছের রস বার করে নেওয়ার প্রথা চালু হয়েছে। আরব দেশের খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করায় বাধা আছে, কারণ ধার্মিক না কি সামাজিক সে'কথা বলতে পারব না। আমাদের দেশের খেজুর খাওয়া যায় না তাই গাছের পাতা কেটে নিলে বা গাছের গায়ে ক্ষত করে রস বের করে নিলে, বিশেষ সমস্যা হয় না। আরবী খেজুর মিষ্টি আর শাঁসালো তাই গাছগুলিকে বাঁচাবার জন্যে হয়তো রস বার করে নেওয়ার বিরোধিতা করে তারা কিন্তু আমাদের দেশে, পুরো খেজুর গাছটাকে আমরা যেভাবে কাজে লাগাই, তা জানলে তুই অবাক হয়ে যাবি মালা।' 

'তুমি বলো চাচা, আমার খুব ভাল লাগছে শুনতে। আমি বিশদ জানতে চাই, খেজুর জাতীয় সব রকমের পাম গাছের সম্বন্ধে। কিছু আফ্রিকান দেশ ও মরিশাসে তাল গাছের রস থেকে বানানো পানীয়কে পোয়ো আর নারকেল গাছের রস থেকে তৈরি পানীয়কে কোকোটি বলে। মরিশাসে নারকেল আর আখের চাষ তুলনামূলক ভাবে বেশি। চাচা, মরিশাস হলো পৃথিবীর অন্যতম প্রধান চিনি উৎপাদনকারী দেশ আর তোমার নিশ্চয়ই অজানা নেই যে সে দেশ বিখ্যাত 'রম' এর জন্যে... যা আবার তৈরি হয় আখের রস থেকে। কত বিভিন্ন রকমের রম তো তুমি নিয়ে এসেছিলে মরিশাস থেকে।'

ঘুরে ঘুরে দেখছিলো মালা, অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে। কোনও কোনও গাছে চড়ে রয়েছে রস সংগ্রহকারীরা... যে গাছগুলোতে চ্যানেল বানানোর কাজ চলছে, রস নামাবার জন্যে। বাকিগুলোতে হাঁড়ি বাঁধা। রসে ভরে উঠলেই, হাঁড়ি নামিয়ে নেওয়া হবে। 

খেজুরের রসে ভরা হাঁড়ি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো, চাচার ড্রাইভার যাদুকুমার চন্দ্রশেখর। চাচা হেসে বললেন, 'খেজুরের তাজা রস খেয়ে দেখ মালা, খাসনি বোধহয় আগে।'

গেলাসে চুমুক দিয়ে তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেললো মালা। 'কী মিষ্টি রস...কী অপূর্ব স্বাদ চাচা।'

'না রে, তামিল নাডুর খেজুর- রস তত মিষ্টি হয় না। শীত পড়ে না তো এখানে। ভারতের শীতপ্রধান অঞ্চল গুলোর খেজুর- রস তুলনামূলকভাবে ঘন হয় আর মিষ্টিও। তোর যখন এত আগ্রহ, কাল তোকে আমার বন্ধুর তাল-বাগানে নিয়ে যাব। ও পদনীর আর তালগুড়ের ব্যবসা করে।'

'তালগুড়! সে কেমন হয় চাচা? আমি কখনও নামই শুনিনি। খেজুর গুড়ের কথা জানি আমি। আমার বাঙালি বন্ধু আমাকে খেজুর গুড় আর সেই গুড়ে বানানো মিষ্টি খাইয়েছিলো... কলকাতা থেকে মরিশাসে নিয়ে এসেছিলো। আহ হা, সে যে কী স্বর্গীয় স্বাদ। আমি তো এখান থেকে কলকাতায়ই যাব, কী মজা অনেক গুড় আর মিষ্টি খাব।'

উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকে মালা, তাল- খেজুর- নারকেল গাছ আর তার কাণ্ড আর ফুল থেকে উৎপন্ন রস ও তার নানাবিধ ব্যবহার সম্বন্ধে জানবার জন্যে... আর সবুর সইছে না তার। চাচার বাড়িতে তো ইন্টারনেট নেই, থাকগে... পরে ভাবা যাবে। গত রাতে অনেক খোঁজাখুঁজি করে, খেজুর চাষের ওপরে একটা বই পেয়েছে মালা চাচার ঘরে। চাচার অনুমতি নিয়েই সেই বই তৎক্ষণাৎ বাক্সবন্দি করেছে সে। সারা ভারতবর্ষ ঘোরার ইচ্ছে মালার, রেলগাড়িতে করে। প্রকৃতি মায়ের রূপদর্শনের অন্যতম উপায় ট্রেনে- বাসে, গ্রামে- গঞ্জে ঘোরা ফেরা। স্থানীয় মানুষের সঙ্গেও পরিচয় হয়, জানা যায় কত অজানা কথা। 

প্রায় পাঁচ বিঘা জমি জুড়ে শিবরামাকৃষ্ণণের তাল- বাগান। মোটামুটি ইংরিজি বলতে পারেন শিব চাচা। ভাষা শেখার প্রতি মালার আকর্ষণ খুব বেশি। মরিশাসের কসমোপলিটান সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠার ফলে মালা জানে ইংরিজি, হিন্দী, স্থানীয় কথ্য ভাষা ক্রেওল আর ফ্রেঞ্চ। বাঙালি বন্ধুর সংখ্যা বেশী হওয়ায় আর তার রবীন্দ্র প্রীতি তাকে বাংলা ভাষার প্রতিও আকর্ষিত করেছে...বাংলা মালা বুঝতেও পারে মোটামুটি, বলতে পারে না, কিন্তু চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় সে।

শিব চাচার পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকলো মালা। জানতে পারলো এক বিঘা জমিতে প্রায় এক- দেড়শ' তাল গাছ লাগানো হয়। গাছ বাড়তে সময় লাগে প্রায় ছ'- সাত বছর। তার পরেই রস পাওয়া যায় তার ফুল বা জটা থেকে। খেজুর রস শীতকালে পাওয়া গেলেও তালের রস সংগ্রহ করা হয়ে থাকে ফাল্গুন থেকে জৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত। রসের জন্যে হাঁড়ি বাঁধার সময়ে তার মধ্যে কয়েক ফোঁটা চুন দিয়ে থাকেন গাছিরা, রস পরিষ্কার থাকে তাহলে, গেঁজিয়ে ওঠে না চট করে।

তালের রস দিনের তিন ভাগে সংগ্রহ করা হয়, ভোর- দুপুর ও বিকেলে। ভরা মৌসুমে প্রতি দশটি গাছ থেকে প্রায় ৫০-৬০ লিটার রস পাওয়া যায়। এক একটা গাছের রস বিক্রি করে, মাসে মোটামুটি এক থেকে দেড় হাজার টাকা পাওয়া যায়। ১০-১৫ হাজার টাকা লাগিয়ে, মাসে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা যেতে পারে। 

শিব চাচা বললেন, 'তালের রস অত্যন্ত মিষ্টি আর সুস্বাদু। গরম কালে তালের রস ক্লান্তি দূর করে। আমাদের এখানে বিশেষ দেখা না গেলেও বাংলায় তালের রসের উপযোগিতা অনেক রকম। আমাদের এখানে তালের গুড় আর মিছরি বানানো হয়। বাংলাতে নানারকম মিষ্টি খাবার তৈরি হয় তাল- রস দিয়ে। তামিল নাডুর তুলনায়, দক্ষিন ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে তাল খেজুরের চাষ বেশি হয়।' 

সব কিছু খাতায় লিখে নিলো মালা। 

কথা বলতে বলতে শিব চাচা আবেগপ্রবন হয়ে পড়ছিলেন। 

'আমার বাবার কাছে শুনেছি, তিনি একবার গান্ধীবাবার ভাষণ শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন বৃন্দাবন বিহারে, গ্রামশিল্প প্রদর্শনীতে...দাঁড়াও দাঁড়াও মালা, আমার তারিখটাও মনে আছে। ১৯৩৯ সালের ৩রা মে। অন্ধ্রপ্রদেশে ঘরে ঘরে তালগুড় বানানো হয় দেখে গান্ধীজী তাঁর ভাষণে বললেন..."এইভাবেই হয়তো একদিন দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করা যাবে। আখের রস থেকেও তো গুড় তৈরি করা হয়, কিন্তু তার থেকে উত্তম তাল- খেজুর বা নারকেল রসের গুড়। বৈদ্য আমাকে গুড় খাবার নির্দেশ দিয়েছেন, আমি সর্বদা তালগুড়ই খাই। এই দ্রব্য কারখানাতে মেশিনের সাহায্যে বানানো যায় না... গ্রামীণ ও কুটীর শিল্পের উন্নয়ন হয় গুড়ের উৎপাদনে।" 

ফিরতি পথে মালাকে শিব চাচা তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। চাচী এলেন, ঘী-রঙের ঈষদুষ্ণ পানীয়ের গ্লাস নিয়ে। তাঁর হাতের প্লেটে হাল্কা হলুদ রঙের, সাদা চকোলেটের মতো দেখতে চৌকো চৌকো টুকরো। একটা টুকরো তুলে মুখে দিতেই আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে এলো মালার। ফ্রেঞ্চ ক্যারামেল চকোলেটের কথা মনে পড়ে গেলো। মরিশাসে ফ্রান্সীয় প্রভাব বেশী হওয়ায়, এই ধরনের বস্তু সেখানে প্রচুর। 

'কী চাচী এগুলো, এখানেও ফ্রেঞ্চ চকোলেট পাওয়া যায়?' চাচা- চাচীর হাসি আর বন্ধই হতে চায় না। 

'মালা, এগুলো তালগুড়, গরমে তৈরি করা... আমি রেখে দিই, অসময়ে ভাল লাগে। তাল- ফুল থেকে সংগ্রহ করা রস ফুটিয়ে বানানো হয়।'

'আর এই পানীয়, চাচী? কী ভীষণ সুস্বাদু।' অভিভূত মালা বলে ওঠে।

'তাল মিছরী আর ছোট এলাচের গুঁড়ো দিয়ে দুধ ফুটিয়ে নেওয়া। এখন তো তালশাঁস পাওয়া যায় না, গরমের সময়ে এই শরবতে টুকরো করা তালশাঁস দিয়ে অতিথি নারায়ণের আপ্যায়ন করা হয়। কেউ কেউ আবার নারকেলের দুধও ব্যবহার করেন। গরমে কাঁচা তালের শাঁস শরীরকে স্নিগ্ধ করে।' চোখ বড় করে চাচীর কথা শুনতে থাকে মালা। 

'তোমাদের এখানে আসবার আগেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তাল- খেজুরজাত উৎপাদনের ওপরে আমার রিসার্চের ব্যাপারে। তোমার কাছ থেকে এইসব খবর পেয়ে আমার সিদ্ধান্ত আরও দৃঢ় হলো। 

'তালের রস, আর তা' থেকে বানানো গুড় এবং মিছরির অনেক গুণ মালা। ডায়াবেটিক রোগীরাও কিন্তু তালগুড়, তালমিছরি আর তালরস খেতে পারেন, অপকার হয় না। তালরস নানাবিধ ভিটামিন ও মিনারেলে সমৃদ্ধ। তবে অবৈধ ব্যবসায়ীরা আজকাল এই রস থেকে নেশাদ্রব্য তৈরির কাজে মেতে গেছে। সকালের তাজা রস, একটু বেলা হলেই গেঁজিয়ে ওঠে, পরিবর্তিত হয় মাদকদ্রব্যে। এই মাদক খুব হাল্কা, শরীরের বিশেষ ক্ষতি করে না। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সস্তা নেশাদ্রব্য মিশিয়ে কাল্লুকে এক ক্ষতিকর মাদকদ্রব্যে পরিণত করে জন সাধারণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে... বিপথগামী হয়ে পড়ছে কিশোর- যুবকেরা।' 

কলকাতা যাওয়ার পথে, করমণ্ডল ট্রেনে উঠেই গুগল সার্চ করতে বসলো, উত্তেজিত মালা চুমন। তার মনে প্রশ্ন জেগেছে, কবে থেকে আর প্রথম কোথায় এইভাবে তাল- খেজুর- নারকেল রসের ব্যবহার শুরু হলো। 

*(https://sites.google.com/a/myth)

www.fanchildgarden.org

তাল-খেজুরের রসের উৎসের যথার্থ খোঁজ তো পাওয়া গেলো না, তার ইতিহাস বেশ ভালরকম কুয়াশাতে ঢাকা। প্রত্নতত্ত্ববিদেরাও কোনওরকম অবশেষের কথা জানাতে অসমর্থ হয়েছেন, যার থেকে এই রসের উৎসস্থলের সম্বন্ধে খবর পাওয়া যায়। প্রাক হিস্প্যানিক(স্পেন দেশীয়) অধিবাসী 'প্লাইনি দ্য এল্ডার' এর নেচারালিস হিস্টোরিয়াতে(এ ডি ২৩-৭৯) মৌরেটানিয়ার রাজা দ্বিতীয় জুবারের (বি সি ২৫- এ ডি ২৩) উল্লেখ আছে যিনি খেজুর জাতীয় 'পাম উপবনের' হদিশ দিয়েছিলেন... এছাড়াও বেশি রকম মধু উৎপাদনের উল্লেখও পাওয়া যায়, যা কি না 'তাল- খেজুর' পাম জাতীয় বৃক্ষ থেকে প্রাপ্ত মিষ্টি রস হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী কিন্তু মৌমাছি দ্বারা সৃষ্ট মধুর কথাও ফেলে দেওয়া যায় না... তবে এই কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে খৃষ্টজন্মের বহু আগে থেকেই পাম জাতীয় গাছের রস বের করে নেওয়ার চলন শুরু হয়েছিল। বিখ্যাত কাহিনীকার ও ইতিহাসবিদ প্লিনিয়াসের লেখাতেও এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। 

তাল জাতীয় বৃক্ষরসের উৎসস্থল সম্বন্ধে নিশ্চিত কোনও জ্ঞান পাওয়া না গেলেও অনুমান করা হয়, ইন্দোনেশিয়ার উত্তর সুলেওয়াসীতেই প্রথম এই রসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলো। আখের চাষ এবং রসের অনেক আগে থেকেই তালগুড় বা তালচিনির ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে তালগাছের চাষ বিশেষ রকম বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বোত্তম তাল ফলনের সিংহভাগ পাওয়া যায় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়। এই রসে 'বুনো ইস্ট' অথবা বন্য- খামিরের উপস্থিতি রসকে তাড়াতাড়ি গেঁজিয়ে তোলে। গেঁজিয়ে ওঠাকে রোধ করতে, চুনের ব্যবহার দেখা যায়... যা রসকে আরও সুস্বাদু করে তোলে। তাল জাতীয় বৃক্ষ (তাল- খেজুর- নারকেল) থেকে পাওয়া রসের আবিষ্কার প্রাচীন এবং তা ছড়িয়ে আছে আফ্রিকা, এশিয়া ও এ্যামেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন স্থানেও। তাজা রস পান করা হয়, রস থেকে চিনি বা গুড় তৈরি হয়, এই রসকে গেঁজিয়ে তুলে সুরা বা ভিনিগারে পরিবর্তিত করা হয়। জল মেশানো দুধের মতো সাদাটে এই মাদক পানীয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত।

ক্যামেরুনে 'পাম ওয়াইন' কে বলা হয় 'মাতাঙ্গো'। মরিশাস এবং সিয়েরা লিওনে এই পানীয় 'পোয়ো' নামে পরিচিত। 'তান হে' বলে মায়ানমারের অধিবাসীরা। পাম ওয়াইনের জন্য বিখ্যাত ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়ায় এই পানীয়ের নাম 'তুয়াক'। শ্রীলঙ্কানরা বলে 'থাল রা'। উত্তর ও পূর্ব ভারতে এই মাদক পানীয় 'তাড়ি' নামে প্রসিদ্ধ। 

ট্রেনের জালনা দিয়ে বাইরের তাল- খেজুর- নারকেল গাছের সারি দেখতে দেখতে বেশ একাত্মতা বোধ করে মালা, এই বৃক্ষরাজির সঙ্গে। দু'দিনেই তাদের সঙ্গে যেন আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে। এই পাম গাছগুলির কিছু পরিচয় পেয়েছে মালা, অনেক কিছুই রয়ে গেছে অজানা। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়াতে, নিজের মনেই হেসে ওঠে মালা। নাইজিরিয়া থেকে মরিশাসে বেড়াতে আসা একটি ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো একবার, এক বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে। সেখানেই শুনেছিলো মালা, নাইজিরিয়ার অদ্ভুত রীতির কথা... সানি আবাচা বলেছিলো, 'আমার বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে, যখন আমি প্রথমবার আমার হবু শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম... আমাকে পাম ওয়াইন 'ওগুরো' নিয়ে যেতে হয়েছিলো। বিভিন্ন স্থানীয় নাইজিরিয়ান ভাষায় পাম ওয়াইনকে এমু, উকোট, আকোয়া, মান্যা, গ্যা ও বলা হয়। 

সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেলো মালার। বাংলার গ্রাম গঞ্জ দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। রূপসী বাংলার শ্যামলিমায় চোখ আর মন দুইই ভরে গেল তার। কি জানি কোন এক অনামা প্রান্তরে থেমে গেলো হঠাৎ ট্রেনটা... সিগনাল পায়নি বোধহয়। কালো মাটির হাঁড়ি নিয়ে ট্রেনে চড়ে পড়লো কিছু স্থানীয় গ্রামবাসী। আররে তাজা খেজুরের রস, এ কী সমাপতন! কাকতালীয় না কি? পর পর দু'গেলাস খেজুরের রস পান করে উত্তেজিত হয়ে পড়লো মালা। রস খাওয়ার থেকেও বেশী আনন্দ পেলো সে, সেই গাছিদের সঙ্গে আলাপ করে, যাদের নাকি শিউলিও বলা হয়। ভাঙা ভাঙা বাংলা আর হিন্দি মিশিয়ে, তাদের কথোপকথন বেশ ভালই জমে গেলো।

ঝাড়গ্রামের শ্রীরামপুর অঞ্চলের গাছি শ্রীকান্ত মাল একগাল হেসে জানালো, সকাল সকাল খেজুরের মিঠে রসে মাখা মুড়ি দিয়ে পেট ভরিয়ে সে বেরিয়ে পড়েছে রসের হাঁড়ি নিয়ে, বিক্রি করতে। 

'বুইল্যেন দি'ঠারান, ভারতবর্ষে জন্মানো খেজুর শাঁসহীন হয়, খাওয়া যায় না। কোনও কোনও পূজায় লাগে অবিশ্যি। বাংলায় খেজুর গাছের রসই হলো গিয়ে তার প্রধান আকর্ষণ।' 

শ্রীকান্তর কথা মন দিয়ে শুনতে থাকলো মালা, সে ও বলে চলল... এমন আগ্রহী শ্রোতা সে বোধকরি আর কখনও পায়নি আগে। 

'আশ্বিন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ চলতে থাকে। ঠাণ্ডা আবহাওয়া, মেঘলা আকাশ এই রসের যোগানে সহায়তা করে। পৌষ - মাঘের কড়কড়ে ঠাণ্ডায় রস বেশী ঘন আর মিষ্টি হয়। তবে গাছের যত্নের ওপরেও রসের পরিমান ও স্বাদ নির্ভর করে। স্ত্রী বৃক্ষ অপেক্ষা পুরুষ বৃক্ষ থেকে বেশী রস পাওয়া যায় আর তা মিষ্টিও হয় বেশি, কারণ পুরুষ বৃক্ষ তো ফল দেয় না। কার্ত্তিক মাস থেকেই গাছ কাটা শুরু হয়ে যায়। রসের মরশুমে, গাছিরা এতটাই ব্যস্ত থাকে যে তাদের আর মাটিতে পা দেওয়ার অবসর থাকে না। এই রস থেকেই পয়রা, ঝোলা আর পাটালি গুড় বানানো হয়ে থাকে, শেষে তৈরি হয় চিটে গুড়... তিতকুটে স্বাদের জন্যে সে মানুষের খাদ্যতালিকাভুক্ত হয়নি...হ্যাঁ গরুকে খাওয়ানো হয়, বেশ উপকারীও। আমাদের ভাগ্যেও জোটে গুড়ের চা। নাড়ু- মোয়াতে ভাঁড়ার ভরে ওঠে। দি'ঠারান, কথায় কয় 'মাঘের শীত বাঘের গায়'...বাঘা শীতেই রস সংগ্রহ, গুড় তৈরি আর বিক্রিও শেষ করে ফেলতে হয়। বছরের রোজগারও বাক্সবন্দী হয়... তারপরে শুরু হয় টিপে টিপে পথা চলা। আজকাল গাছপালা কেটে রাস্তা, কল- কারখানা, বসতবাড়ি তৈরি হচ্ছে। বর্ষা, শীত সবই কমে গেছে, খেজুরের রস ঘন হচ্ছে না। চাহিদা বেড়ে যাওয়ার জন্যে গাছের সংখ্যা বাড়লেও, রস আর গুড়ের মান নেমে গেছে।'

হাওড়া স্টেশনে নেমে, আতান্তরে পড়লো মালা। বাপ্‌রে বাপ্‌, এ যে জনসমুদ্র। কলকাতায় এক বন্ধুর বাড়িতে ওঠার কথা তার...দ্যুতিশ, সে ও শ্রীনিকেতনে পড়তে যাবে মালার সঙ্গেই। কিন্তু... কীভাবে পৌঁছোবে তার বাড়ি? ভিড় থেকে সরে গিয়ে, একপাশে দাঁড়িয়ে ফোন করলো মালা দ্যুতিশকে। বাড়ির ডায়রেকশন নিয়ে, প্রি- পেড ট্যাক্সিতে পৌঁছে গেলো বারাসত। 

'কী সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে রে তিশু। আন্টি কী রান্না করছেন?'

'ক'দিন বাদেই তো পৌষ সংক্রান্তি। আমরা তো থাকবো না সে'সময়ে, তুই প্রথমবার এলি আমাদের বাড়ি... মা পিঠে বানাচ্ছেন তোর জন্যে।' 

'কী সুইট! আমাকে নিয়ে চল আন্টির কাছে, আমিও শিখব পিঠে বানানো... কী বানাচ্ছো আন্টি? আমাকেও শিখিয়ে দাও।'

'আয় মালা, বোস এখানে। কত দূর থেকে এলি... বিশ্রাম কর একটু। আমি বানাবার চেষ্টা করছি আমার বাপের বাড়ির দেশ, যশোরের খেজুর রসের ভিজা পিঠা।' 

এপ্রিল মাসে সেশন শুরু হবে শ্রীনিকেতনে। মালা ঠিক করলো কয়েকদিন সে তার বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে। সারা ভারতের সংস্কৃতির পরিচয় পেতে চায় সে। দ্যুতিশ বললো, 'যা তবে দেরী করিস না। ফেব্রুয়ারিতে শ্রীনিকেতনের বার্ষিক উৎসব হয়... সে নাকি এক দেখার মতো ব্যাপার। সারা ভারতবর্ষকেই পাবি তুই সেখানে।' 

আরা স্টেশনে নেমে রিক্সা নিলো মালা। ছোট চাচা এখনও থাকেন দেশের বাড়িতে, খেতি- বাড়ি করেন। চাচীর আদর- আপ্যায়নে আপ্লুত হয়ে গেলো মালা। মালপুয়া খেতে খেতে চাচীকে জিজ্ঞাসা করলো, 'এখানে খেজুর বা তালের রস, গুড় পাওয়া যায় না? মালপুয়া চিনির বদলে খেজুরের রসে ডুবিয়ে খেতে কেমন লাগবে চাচী?'

'পাওয়া যায়, তবে বাংলা বা উড়িষ্যার মতো এত বেশী না। আমাদের দাইকে বলে দিচ্ছি, যোগাড় করে আনবে।'

শ্রীনিকেতন যাওয়ার আগে মালা চাচা- চাচীর সঙ্গে পুরী বেড়াতে গেলো। সমুদ্রে ঘেরা দ্বীপ মরিশাসে বড় হয়ে ওঠা মালাকেও কিন্তু পুরীর সমুদ্রের সৌন্দর্য মুগ্ধ করলো। স্থানীয় মানুষের আতিথেয়তায় মোহিত হয়ে গেলো মালা। চাচা রমেশ চুমনের বন্ধু দুর্যোধন মহাপাত্রের বাড়িতে মালা প্রাণভরে খেলো নানারকম পিঠা...গুড়ের। দুর্যোধন চাচার খেজুর প্ল্যান্টেশন আছে তবে সেই যায়গা পুরীর থেকে দূরে রঘুরাজপুর গ্রামে। দুর্যোধন খুড়োর সঙ্গে কথা বলতে বসে গেলো মালা।

'খেজুর গাছের চাষ আর রস- গুড়ের ব্যাপারে আমার কৌতূহল আছে খুড়ো...'

'খেজুর গাছের শাখা একদিক থেকে চেঁচে পরিষ্কার করে কাটা অংশের নীচে দুটি খাঁজ কেটে সরু পথ বার করে বাঁশের নলি লাগিয়ে, মাটির হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয় রসে সংগ্রহের জন্য। প্রতি সকালে রসে ভরা হাঁড়ি নিয়ে রস বিক্রি করা হয়, গুড় বানানো হয় জ্বাল দিয়ে। বেলা হলে রস গেঁজিয়ে ওঠে, পরিবর্তিত হয় তাড়ি জাতীয় মাদক দ্রব্যে। এই মাদক কিন্তু শরীরের জন্য ক্ষতিকর না...'

পার্বতী খুড়িমা চা নিয়ে আসাতে কথায় বাধা পরলো। চায়ে চুমুক দিয়ে মালার মুখ স্বর্গীয় হাসিতে ভরে উঠলো। 'বাহ খুড়িমা, এই চায়ের স্বাদ তো একদম আলাদা।' 

'হ্যাঁ মালা, খেজুর গুড়ে বানানো এই চা। আমরা গেঁয়ো মানুষ, আমাদের বাড়িতে চিনি ব্যবহার হয় না বললেই চলে।' খুড়িমা গেলেন রান্নার ব্যবস্থা দেখতে।

'হ্যাঁ খুড়ো, বল...তারপর?'

'কী যেন বলছিলাম? হ্যাঁ, গাছ কাটার দিন দুয়েক পর থেকেই রস গড়ানো শুরু হয়, হাঁড়ি ভরে ওঠে। প্রথমবার কাটা গাছের রসকে বলে জিরান কাট...রস অতি সুস্বাদু আর পাটালি গুড় খুব ভাল হয়। দ্বিতীয়বার গাছ কেটে রস পেলে তাকে বলে দোকাট, তৃতীয়বারের গাছ কাটা রসকে বলে তেকাট। একবার কাটা গাছ দিন পাঁচ ছয় পরে আবার কাটতে হয়, আর কাটা অংশ শুকোতে সকাল ও বিকালের রোদ পাওয়ার জন্য পূর্ব আর পশ্চিম দিক থেকেই গাছ কাটা হয়ে থাকে, যাতে সকাল আর বিকেল দুই সময়ের রোদটা পাওয়া যায়। 

বাদুড়ের হাত থেকে রসকে বাঁচাবার জন্য আজকাল হাঁড়ি নানারকমের জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হচ্ছে। বাদুড়ের থুথু আর মলমুত্র থেকে রস 'নিপা ভাইরাস' (এন আই ভি) দুষিত হয়ে পড়ে আর মানুষের মধ্যেও রোগ ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে একসময়ে এই রোগ খুব বেশী রকম ছড়িয়ে পড়েছিলো।'

'হ্যাঁ খুড়ো, আফ্রিকায়ও 'পিন টেল্ড শ্রু' নামে এক জন্তুর হাত থেকে তাল জাতীয় গাছের রসকে বাঁচাবার কথা আমি শুনেছি, আর বাদুড় তো সব যায়গায়ই আছে।'

একবছর হয়ে গেলো মালা চুমনের শ্রীনিকেতনে। প্রোফেসর অনিল ভার্গব খুব খুশি হয়েছেন মালার 'তত্ত্বালোচনার' (ডিসার্টেশন) বিষয় নির্বাচনে। মালা তাঁকে জানিয়েছে যে সে 'পাম স্যাপ' আর 'পাম ওয়াইন' নিয়েই গবেষণা করতে চায়। সবরকম সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন অনিল বাবু। 

বাংলাদেশের বন্ধু সাফা সাইমার সঙ্গে খুব ভাব মালার। বাবা- মা'র একমাত্র সন্তান সাফাও কৃষিবিজ্ঞান পড়তে এসেছে, দেশে ফিরে তাদের জমি- জমা, চাষ- বাসের দেখাশোনা করতে চায় সে। সাফার কাছ থেকে কতো যে জ্ঞান আহরণ করেছে মালা এই তাল- খেজুর- নারকেল রসের ব্যাপারে। 

সাফা একদিন মালাকে শোনালো বাংলাদেশের সুমাইয়া বরকতউল্লাহর লেখা কবিতা। আজকাল মালা বেশ স্বচ্ছন্দ বাংলা ভাষাতেও।

'পিঠে- পুলির জেয়ৎ দিলাম
আঙ্গো বাইৎ আইয়ো
বিছায়ে দিমু গরম পাটি
আরাম কইর‍্যা বইয়ো
আইয়ো তোমরা আইয়ো কিন্তু
আইয়ো আঙ্গো বাইত্যে
হরেক রকম পিঠা দিমু
আশ মিটাইয়্যা খাইত্যে 
চিড়া-মুড়ি-দধি দিমু
টাটকা খেজুর রস্যে
দাদীর হাতের পিঠা খাইব্যে
রান্নাঘর‍্যে বইস্যে
দেইখব্যে ঘুর‍্যে এই গেরামের 
মানুষ কত্য ভালোরে
দেইখল্যে মেমান টেনে নিব্যে
মুখটা কইর‍্যে আলোরে...' 

সাফার সঙ্গে বাংলাদেশে বেড়াতে গেলো মালা, বাংলাদেশের প্রাণ 'চিড়ি গুড়া চাল' নবান্ন উৎসবের সময়ে। লোকগাথা অনুসারে সে'দিন হলো বাৎসরিক মাঙ্গলিক দিন। মালা দেখলো বাংলার আর এক রূপ। বিবিধ ব্যঞ্জনে, পিঠেপুলির আয়োজনে মেতে উঠেছে প্রতিটি ঘর... নতুন ধানের ভাত মুখে তোলার আগে মসজিদে সিন্নি চড়াবে মুসলমান কৃষকুল। হিন্দুদের ঘরে চলবে পূজার ধূম। 

ধান বানিরে আমি ঢেঁকিতে পাড় দিয়া
ঢেঁকি নাচে, আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া

অঘ্রাণের নতুন চালের গুঁড়ো আর নতুন খেজুরের রস দিয়ে শুরু হবে পিঠা উৎসব।

অবসর পেয়ে দাদীর কাছে বসলো মালা। 'দাদী, আমাকে একটু বলো বাংলাদেশের তাল- খেজুর- নারকেল সম্বন্ধে। 

তাল- খেজুর- নারকেল গাছ বাঙালির জীবনে ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একটা কবিতা শোনাই তোকে, রথিন ভটচাযের লেখা ...

বিলেতে বেয়ে তালডিঙি
মাছ ধরেছি মাগুর শিঙি।
গরমকালে তালের পাখা
বাতাসটি তার মধুমাখা।
তালপাতার ছাউনি ঘরে
শান্তির নীড় বসত করে।
তালরসেতে জুড়ায় প্রাণ
ভোরবেলাতে তা যদি খান।
তালের তাড়ি অমৃতধারা
খায়নি যে জন বুঝবে তারা?
তাল- পাটালি স্বর্গসম
গন্ধ ছড়ায় মম মম। 

সুযোগ পেলেই মালা ঘুরে বেড়িয়েছে ভারতবর্ষ আর দক্ষিণ এশিয়ার নানা স্থানে। তার অভিজ্ঞতার ঝুলি ক্রমশই ভরে উঠছে সুখ-সম্পদে। মালা জেনেছে তাল গাছের চাষ খুব বেশী হয় দক্ষিণ এশিয়ার কম্বোডিয়া, ভারত আর বাংলাদেশে। খুব ভাল জাতের তাল ও খেজুর বৃক্ষের সন্ধান পাওয়া যায় ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়াতে। তাল- খেজুরের বৃক্ষরসে 'বুনো খামির' (ওয়াইল্ড ইস্ট) এর অবস্থিতি এই রসকে চট করে গেঁজিয়ে তোলে, সুখদায়ক পানীয় বদলে যায় অতিসুখদায়ক পানীয়তে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে তাল জাতীয় বৃক্ষের রস ও মাদক পানীয়র বহুল প্রচার দেখা গেলেও এই গাছের মিষ্টি রসের ব্যবহার সারা পৃথিবীর বহু দেশেই পাওয়া যায়। এই মাদক পানীয় আরও কড়া মাদক দ্রব্যে রূপান্তরিত হয়ে যায় ডিস্টিলেশনের দ্বারা। তাল- খেজুর- নারকেল রসজাত মাদক পানীয় সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির উৎসব- অনুষ্ঠানে... অতিথি আপ্যায়নে, বিয়ে-বাদিতে, নবজাতকের আগমনে এমনকী অন্তিম যাত্রাপথেও এক বিশেষ মাত্রা প্রদান করে। 

নাইজিরিয়ায় 'ওগোগোরো' পানীয়টি পরিবেশন করা হয় ঔষধি দ্রব্যের সঙ্গে মিশিয়ে...এই পানীয় নাকি বহু প্রকার রোগের নিরাময় করে থাকে। 

ফিলিপিন্সে 'লাম্বানোগ' পান করার সময়ে পানীয়ের কিছুটা প্রথমেই, ফেলে দেওয়ার রীতি আছে পরিবারের মৃতজনের আত্মার প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে। স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই এই মাদক পানীয় গ্রহণ করে থাকে। 

ঘানা দেশে মাদক পানীয় 'একপেটেসি' বা 'বুরুকুটু' কিছু বিশেষ মশলার মিশ্রণে পান করা হয়। আবার কিছু বিশেষ ধরণের মশলার প্রয়োগ তাজা রসকে গেঁজিয়ে ওঠার থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। রেফ্রিজারেটরেও রস বেশ কিছুদিন তাজা রাখা যায়। 

মাদক তৈরির জন্য রসকে যদি বেশী মাত্রায় গেঁজিয়ে ফেলা হয়, মোটামুটি ভাবে ২৪ ঘন্টার পরে তা অত্যন্ত টক স্বাদের ভিনিগারে বদলে যায়।

অভয়া বিশ্বনাথনের বাড়িতে এসেছে মালা, ম্যাঙ্গালোরে। অভয়া মালার সঙ্গে পড়ে। গাড়ি নিয়ে তারা দু'জনে পৌঁছে গেলো ৬০ কি মি দূরে কেরলের 'সেন্ট্রাল প্লান্টেশন ক্রপ্স রিসার্চ ইন্সটিট্যুট' (CPCRI)এ। রস সংগ্রহের অতিউন্নত মানের পদ্ধতি তাদের অভিভূত করে দিল। নারকেল ফুলের থেকে রস সংগ্রহে সেখানে আইস বক্স ব্যবহার করা হচ্ছে, রসকে গেঁজিয়ে ওঠা আর কড়া গন্ধ থেকে বাঁচাবার জন্যে। পুরনো পন্থার চুনের জলের পদ্ধতি আর ব্যবহৃত হয় না, বিশেষ কাজ করে না, সে পন্থা অস্বাস্থ্যকরও। কল্পবৃক্ষের এই স্বাস্থ্য- পানীয় 'কল্পরসা' অত্যন্ত পুষ্টিকর। সি পি সি আর আই অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর উপায়ে মধু রঙের, অতিসুস্বাদু পানীয় পৌঁছে দিচ্ছে সমাজের কাছে। 

নারকেল গাছে বছরে ১২ থেকে ১৪ টি পুষ্পগুচ্ছ ধরে, আর এক একটি পুষ্পগুচ্ছ থেকে দিনে প্রায় ২ থেকে ৩ লিটার রস পাওয়া যায়, প্রায় ৪০-৪৫ দিন ধরে যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮০ থেকে ১২০ লিটার রসে। রস সংগ্রহ না করে যদি ফুল থেকে সাধারণ নিয়মে ফল ধরতে দেওয়া হয়, তাহলে পাওয়া যায় ২০-২৫ টি নারকেল এবং ১০-১২ লিটার নারকেলের জল। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে কল্পবৃক্ষের মধুরস অনেক বেশী সাশ্রয়ী। এই পন্থায় শ্রীলঙ্কা নারকেল রস থেকে মাদক পানীয় 'টুবা' প্রস্তুত করে থাকে। 

উত্তর ভারতে সংগ্রহ করা তাজা রসকে 'নীরা' বলে, দক্ষিণ ভারতে এই রসের নাম 'পদনীর'। দক্ষিণ আফ্রিকায় নারকেল জাত মাদক পানীয়ের নাম 'উবুসুলু'। 

আজকের যুগে সারা পৃথিবী প্রাকৃতিক দ্রব্যের ব্যবহারে ফিরে যেতে চাইছে, সে কারণেই আজ দক্ষিণ ভারতে তাল জাতীয় বৃক্ষ (নারকেল- তাল- খেজুর) ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে যার নাম 'অন্ধ্র কল্প ব্রুক্‌শম' এর চাষের ওপরে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে। পুরুষ ও নারী দুই রকমের নারকেল গাছ থেকেই রস সংগ্রহ হয়, কিন্তু যেহেতু পুরুষ গাছ ফল দেয় না, সেই গাছের রসের পরিমাণ ও গুণগত মান অনেক বেশী হয়। যে কোনও তাল জাতীয় বৃক্ষের রস থেকেই মাদক পানীয় প্রস্তুত করা যায়... ঠিকমতো খামির (ইস্ট), তাপমাত্রা আর যথাযোগ্য প্রণালীর উপযোগ করে। প্রাচীন যুগ থেকেই এই তালজাতীয় নীরা বা পদনীর পানের প্রথা চলে আসছে, খালি পেটে এই রস পান অতি মধুর অভিজ্ঞতা। গোয়াতে, কাজু বা এ্যাপ্‌ল ফেনীর মতো কোকোনাট ফেনী প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। 

প্রভূত জ্ঞান-সম্পদে সমৃদ্ধ মালা এবারে মন দিলো তার গবেষণা পত্রে। ভগবানই জানেন কতদিনে শেষ করতে পারবে এই বিশাল কর্মকাণ্ড... যদিও বিষয়টা জড়িয়ে গেছে তার আত্মার সঙ্গে।

1 comments:

0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন জেনএক্স রকেটপ্যাড
 শিবাংশু দে



যে সমস্ত নমস্য শিল্পী আমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে, বুঝতে ও ক্রিয়াশীলভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে শিখিয়েছেন, তাঁদের সবার নিজস্ব সদগুরু সাধন হয়েছিলো। নিজস্ব সাধনার দ্বারা তাঁরা স্বরলিপির কঙ্কালে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। পঙ্কজকুমার, সুবিনয়, দেবব্রত, হেমন্ত, সাহানাদেবী, কনক দাশ, রাজেশ্বরী দত্ত, কণিকা, সুচিত্রা, নীলিমা , ঋতু এবং আরো বেশ কিছু নাম আসা উচিত এই তালিকায়, যাঁরা আজ আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত বলতে যা বুঝি তার রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছেন। আমরা যদি কৌতূহলী ও প্রশ্নশীল হয়ে নিজেদের মধ্যে খুঁজতে চাই পরিবেশনার ঠিক কোন অঙ্গটির প্রতি মুখ্যত আমরা আকৃষ্ট হই, তবে দেখবো আবেগের শিল্পিত ও সংযত প্রকাশই প্রধান শর্ত। যার শিকড় নিহিত রয়েছে 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্যে'র ভূমিতে। 


সব মুখ্য শিল্পীই নিজেদের সিদ্ধি অনুযায়ী এই শর্তটি সযত্নে অনুপালন করে থাকেন। তবে বোধ ও আবেগের যে আনুপাতিক পরিমাপ, সেখানে প্রত্যেকে নিজস্ব মানদণ্ড স্থির করে নেন। শিল্পী হিসেবে সেখানেই তাঁরা পরস্পরের থেকে ভিন্ন। ঠিক যেমন কবি দিলীপকুমারকে বলেছিলেন, 'আমি যখন সাহানার গান শুনি, তখন নিজের গানের সঙ্গে আমি সাহানার গানও শুনি'। অর্থাৎ একজন সিদ্ধ শিল্পী যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনান তখন কবির সঙ্গে আমরা সেই শিল্পীর গানও শুনি। যে সব শিল্পীদের নাম করলুম, আপাতভাবে তাঁরা আবেগমুখর গানকেও সন্তুলিতভাবে বোধের মাটিতে বেঁধে রাখতে পারেন। সহজাত কুশলতায় বহির্মুখী আবেগ ও অন্তর্মুখী বোধের প্রতি সমান সুবিচার করতে পারেন । সুচিত্রা, কণিকা, নীলিমা বা ঋতুর রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়নে এই সব বৈশিষ্ট্য তাঁদের সমসময়ে ও পরবর্তীকালে সার্থকতার উচ্চতম আসনে বসিয়েছিল। যদি আজকের শ্রোতা ইন্দিরাদেবীর মতো ‘কলকাতা’ ও ‘শান্তিনিকেতন’ নামের দুটি ঘরানা স্বীকার করেন, তবে এঁদের পরিবেশনের মধ্যে দুই সৃষ্টিস্রোতের গঙ্গাযমুনা সমন্বয়ের ধারা খুঁজে পাবেন। গান ধরে ধরে হয়তো তার বিশ্লেষণ করা যায়, কিন্তু তা দীর্ঘ পরিসর প্রত্যাশা করে। সুচিত্রার গান মজিয়ে রাখে আবাল্য, কিন্তু ব্যক্তি আমার কণিকা, নীলিমা, রাজেশ্বরী, ঋতু'র গান 'শুনতে' শেখার শিক্ষা হয়েছে পরবর্তীকালে। এখনও অনেক শেখা বাকি থেকে গেছে। বস্তুতঃ এই শেখার কোনও 'শেষ' নেই। এই উপলব্ধিটি কবির ভাষায় কমলহীরে, যে দিক করেই ফিরে দেখি, নতুন রঙের, নতুন আলোর বিচ্ছুরণ চোখে পড়ে।


'.... লাগলো ভালো, মন ভরালো, এই কথাটাই গেয়ে বেড়াই"

ছোটোবেলা থেকে অসংখ্য মানুষের থেকে শুনেছি 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' শুনলে 'কান্না' পায়। নজরুলগীতির মধ্যে বেশ একটা 'চনমনে' ব্যাপার আছে। একালের বাংলায় এই 'গুণ'টিকে 'সসি পাঞ্চ' বলা যেতে পারে। কবি মলয় রায়চৌধুরির একটি লেখায় পড়েছিলুম, সম্প্রতি সব রবীন্দ্রসঙ্গীতকেই তাঁর শোক সঙ্গীত (মোর্নিং সং) মনে হয়। তিনি অবশ্য স্পষ্ট করেননি ঠিক কোন শিল্পীর গান বা ঠিক কোন কোন লক্ষণ তাঁকে এভাবে ভাবায়। কিন্তু এটা প্রচলিত এবং প্রায় স্বীকৃত একটা ধারণা যে রবীন্দ্রসঙ্গীতে সেই 'পাঞ্চ' নেই যা একালের জীবনযাপনের নবরস'কে ধরে রাখতে পারে। অভিযোগটি খুব অনৃত নয়। নানা ঐতিহাসিক কারণে আমরা দেখি বহুদিন ধরেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নে কণ্ঠ, সুরপ্রয়োগ এবং শব্দ উচ্চারণে প্রত্যাশিত মডিউলেশন শুনতে পাওয়া যায়না। এই অভিযোগটি অবশ্য মূলতঃ অল্পপ্রাণ কিন্তু সংখ্যাগুরু গায়কদের জন্যই প্রযোজ্য। এই গোত্রের গায়কদের 'ফ্ল্যাট' গায়ন, গায়ক হিসেবে তাঁদের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা বা শক্তির অভাবকেই সূচিত করে। কিন্তু প্রশ্ন তুললে তাঁরা 'দিনু'দা' বা 'শৈলজা'দা'কে সাক্ষী মানেন। ততোটা দীক্ষিত নয়, এমন বহুজনশ্রোতাসমাজ টেকনিক্যাল ব্যাপারটা পুরো না বুঝলেও ফাঁকিটা ধরতে পারেন। এইভাবে 'রবীন্দ্রসঙ্গীতে'র বিরুদ্ধে ক্রমাগত অসঙ্গত নানা জনমত গড়ে ওঠে। 


একটা ব্যাপার আমাকে ভাবায়। লোকপ্রিয় বাংলা গানের ঠিক কোন কোন অঙ্গটি মানুষের কাছে অধিকতর আবেদন নিয়ে আসে। স্মার্ট লিরিক, নতুনতর যন্ত্রানুষঙ্গ না সফল মেলোডির জাদু। হয়তো সব গুলিই বিভিন্ন মাত্রায় । তবে সময়ের সঙ্গে দ্রুততর বদলায় লিরিকের প্রকাশভঙ্গি এবং নতুনতর যন্ত্রসঙ্গত বা সহযোগী সুরবিন্যাস। মেলোডির কাঠামোর মধ্যে কিন্তু ততো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেনা। সময়ের সঙ্গে মেলোডির বিবর্তনের অন্যতর সূত্র রয়েছে। লিরিক ও যন্ত্রানুষঙ্গের ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচার করা অনেক সহজ, কিন্তু মেলোডিকে বিকৃত করার ঝুঁকি সুরকাররা নিতে চান'না। কারণ অধিকাংশ শ্রোতা শুধু কানে শুনে সঙ্গীতের মান নির্ধারণ করেন। কাব্যগীতির ক্ষেত্রেও লিরিকের প্রাথমিক আবেদন সুরের সঙ্গে তার নির্ভার মিশে যাওয়ার নৈপুণ্যে। লিরিকের গুণগত মান বা গভীরগামিতার প্রশ্ন আসে পরবর্তী স্তরে। এই স্তরে পৌঁছোনো শ্রোতার সংখ্যা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম। বিশেষতঃ আজকের শ্রোতার কাছে ভাবার সময় অল্প। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতার তাৎক্ষণিক ভালো লাগার মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। সাধারণ শ্রোতার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা আগে ছিল। এখন তার অনুপাত অনেকটা বেশি। প্রশ্ন, আজকের শ্রোতার কাছে পৌঁছোনোর জাদুটি কী? 

কমবয়সে গানবিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু স্বপ্ন ছিলো। তিনি ভেবেছিলেন, কোনও ভবিষ্যতে আমরা 'সঙ্গীতেই কথাবার্তা কহিব' বা ' সঙ্গীতই আমাদের অনুভাব-প্রকাশের ভাষা হইয়া দাঁড়াইবে'। এইসব ভেবেই তিনি শান্তিনিকেতনে ছেলেদের জীবনে গানশেখা বা গাওয়ার ব্যবস্থাটিকে একটা নৈসর্গিক অনিবার্যতার মতো ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। গান যে রোগশয্যায় ওষুধের মতো শুশ্রূষা এনে দিতে পারে, তা তিনি সেই অতীতেও অনুভব করেছিলেন এবং 'গৃহপ্রবেশ' নাটকে সে রকম একটি পরিস্থিতিও সংযোজিত হয়েছিলো। অর্থাৎ সঙ্গীত শুধু একটা শ্রাব্য বিনোদনমাত্র নয়; তাঁর এই ধারণা ও আমাদের আজকের অভিজ্ঞতা বলছে গান শোনা শুধু বিমূর্ত উপভোগ নয়। এ ব্যাপারে একটা ক্রমবিবর্তন আমাদের চোখে পড়ে। সামূহিক শ্রোতাসমষ্টির কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সমাদর হঠাৎ বেড়ে যায় চল্লিশের দশকে যখন পঙ্কজকুমার চলচ্চিত্রে নিজে এবং সহগলসাহেবকে দিয়ে ক্রমাগত রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করতে থাকেন। গানের যে একটা ভিজ্যুয়াল সফলতাও রয়েছে সেটা এভাবে সপ্রমাণ হয়। পরবর্তীকালে হেমন্তকুমার বা কিশোরকুমারের সুবাদে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে জনগণেশের স্বীকৃতিটি পাওয়া সহজ হয়ে যায়। চলচ্চিত্র মাধ্যমটি স্বপ্রতিষ্ঠ হবার পর তাঁদের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতও জনপ্রিয় হতে থাকে। বৃহত্তর শ্রোতাসমাজের কাছে পৌঁছোনোর বাহন হিসেবে দৃশ্যমাধ্যমের সফলতার কিছু অংশ শ্রাব্যমাধ্যমেরও নসিব হয়ে যায়। এর মানে এই নয় যে হেমন্ত ও কিশোরগীত রবীন্দ্রসঙ্গীতের লোকপ্রিয়তা তাঁদের চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংলিপ্ত থাকার সুবাদেই হয়েছে। সেই সব গান অবশ্যই নিজস্ব নৈপুণ্যে উজ্জ্বল। কিন্তু এই মাধ্যমের সঙ্গে তাঁদের সংযোগ থেকে তাঁরা শিখেছিলেন কার্যকরীভাবে অধিকতর শ্রোতার সঙ্গীততৃষ্ণাকে স্পর্শ করা যায়। পরিবেশনে স্পষ্ট, কিন্তু সংযত নাটকীয়তার ছোঁয়া থাকলে সাধারণ শ্রোতার কাছে এই সব গান সহজে গৃহীত হয়। এই সত্যটি দেবব্রত বিশ্বাস, চলচ্চিত্র নয়, তাঁর গণনাট্যের দিনের স্বতোৎসার জনসংযোগের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন। সঙ্গীতের মাধ্যমে সফল জনসংযোগ করতে পারার ক্ষমতাই পঙ্কজকুমার, কুন্দনলাল সহগল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস বা কিশোরকুমারের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাফল্যের মূল কারণ। অবশ্য তাঁদের অতুলনীয় 'ন্যাচরল' কণ্ঠসম্পদ, যার অভিঘাত শ্রোতাদের সহজেই মুগ্ধ করে । নিঃসন্দেহে এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য, পঞ্চাশের দশক থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মুখ হিসেবে সফলতম যে ত্রয়ী শিল্পী নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা মিত্র, তিন জনেই গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে অল্পবিস্তর ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন। অধিকন্তু এর সঙ্গে একটা প্রাসঙ্গিক ব্যাপারও মনে রাখা দরকার, উল্লেখিত শিল্পীদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক অপেক্ষাকৃত কম শক্তির অনুকারকেরা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন চিরকাল। কেউ কেউ কিছু মাত্রায় সফলও হয়েছেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। রবীন্দ্রসঙ্গীত নাটকীয়তার কতোটা চাপ সইতে করতে পারে সেই বোধ পূর্বোক্ত শিল্পীরা সাধনার মাধ্যমে পেয়েছিলেন। কিন্তু নিছক অনুকারী শিল্পীরা সেই বোধ অর্জন করতে পারেননি। গানের চেয়ে নাটকই অধিক উপজীব্য হয়ে পড়েছিলো তাঁদের কাছে। সে কারণে তাঁরা কিছু সাময়িক লোকপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন একটি পর্বে। 


এই যে নাটকীয়তার লক্ষণ, অথবা বলা ভালো, আবেগের পরিমিত নাট্য অভিব্যক্তি, তার সফলতম প্রয়োগ আমরা দেখেছি দেবব্রত বিশ্বাস এবং সুচিত্রা মিত্রের পরিবেশনে। সচরাচর রবীন্দ্রসঙ্গীতের বহু কুশল শিল্পীকেও দ্বিমাত্রিক ( সুর ও লয়/ তাল) পরিবেশনের বাইরে গিয়ে ঝুঁকি নিতে সেকালে বিশেষ দেখা যায়নি। আগেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যেও যে নাট্যমাত্রা আনা যায়, সেটা প্রথম পাই পঙ্কজকুমারের ঘরানায়। গানের মধ্যে যে সংলাপ তার শুদ্ধ বিবরণীপাঠ না করে যদি তাতে 'রক্তমাংস'এর মানবিক মাত্রা (পড়ুন, নাটকীয় আবেগ) যোগ করা যায়, তবে তা দৈবী মন্ত্রপাঠের ঊর্ধে গিয়ে মানুষের কাছে বেশি পৌঁছোয়। এই 'আবেগ' কতোটা স্বীকারযোগ্য তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। প্রশ্নটা আজকের দিনে খুব প্রাসঙ্গিক, কারণ শিল্পীদের মধ্যে এই স্বাধীনতাটির অপপ্রয়োগ বেশ দেখা যাচ্ছে। জর্জদার মেধা ও সংযম ছিলো অতি উচ্চকোটির। কিন্তু তাঁকে হনুকরন করে নিম্ন বা মধ্য মেধার গায়করা শৈল্পিক সীমারেখাটির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারবে না। হয়তো সেটাই ছিল সঙ্গীতবোর্ডের আশঙ্কা। মনস্ক শ্রোতাদের এমত আশংকাও একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না হয়তো। 


এই সব আশঙ্কার কতটা ভিত্তি আছে তা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রবীন্দ্রসংস্কৃতি নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি যথেষ্ট তলিয়ে ভাবেননি। তাঁরা যান্ত্রিকভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনে নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। কিন্তু আশির দশক থেকে সাধারণ বাঙালি শ্রোতার শ্রবণ রুচির একটা ভূমিগত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল। ঘটনাটি এই সব নিয়ন্ত্রকদের নজরে পড়েনি। সেই সময় রবীন্দ্রসঙ্গীতের যাঁরা তারকা শিল্পী ছিলেন, তাঁরা স্বধর্মচ্যুত হয়েছিলেন, আমার এমন কখনো বোধ হয়নি। কিছু শক্তিমান শিল্পী, যেমন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সাগর সেন, চিণ্ময় চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ লোকপ্রিয় শিল্পীদের ঐ সব নিয়ন্ত্রকরা বিশেষ কল্কে দিতেন না। কিন্তু কেন দিতেন না , তার কারণও কখনো স্পষ্ট করেননি। অশোকতরু বন্দোপাধ্যায় বা অর্ঘ্য সেনের মতো শিল্পীদের নিজস্ব অনুরাগী শ্রোতা সমূহ ছিলো। তবে তাঁদের প্রতিও প্রাতিষ্ঠানিক ধ্বজাধারীরা বিশেষ আগ্রহী ছিলেন বলে বোধ হয়নি। এঁদের তালিকার বাইরেও কিছু আরও শিল্পী ছিলেন যাঁরা দু'তিন দশক পরে জন্মালে এই মূহুর্তের মুখ্য শিল্পীদের তুলনায় উৎকর্ষের বিচারে অনেক উপরে থাকতেন। এই মূহুর্তের কিছু বাজারকাঁপানো রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পীর প্রধান কৃতিত্ব তাঁরা তিন/ চার দশক পরে জন্ম নিয়েছেন। এই প্রশ্নে আবেগ যতোটা কাজ করে, মনন ততোটা করেনা। ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে যায় প্রজন্মগত কলহে। ব্যক্তিগত রুচিপছন্দ নিয়ে তর্ক করে কিছু প্রতিষ্ঠা করা যায়না, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত যে মিঠে গলায় গানের ঊর্ধে আরও কিছু দাবি করে, শিল্পী ও শ্রোতা উভয়ের থেকে, এই সত্যটি উপলব্ধি থেকে আসে, তর্ক থেকে নয়। বহুধরনের গান গেয়েও যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের নোঙরে বাঁধা থাকা যায় তার প্রমাণ দিয়েছেন অনেক শিল্পী। পঙ্কজকুমার, কুন্দনলাল ও হেমন্ত ব্যতিরেকে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের নাম তো আনাই যায়। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মে সক্ষম গায়কের অভাব না থাকলেও যে এক্স ফ্যাক্টর থাকলে একটা সাধারণ বাংলা কাব্যগীতির থেকে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে আলাদা করে চেনা যায়, সেই বোধের পর্যায়টি নতুন গায়করা ঠিক ছুঁতে পারেননি। ফুল ফুটিয়ে তোলার সামর্থ্যটি শুধু কণ্ঠসম্পদ, সুর লাগানো বা জনগণেশের সময়বদ্ধ রুচির নিরিখে বিচার করা যায়না। সম্প্রতি রাঘব চট্টোপাধ্যায় নামের একজন লোকপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীর রবীন্দ্রসঙ্গীত মানুষ আগ্রহ নিয়ে শুনছে। টিভির বিভিন্ন 'প্রতিভাসন্ধান' প্রতিযোগিতা থেকে উঠে আসা নবীন শিল্পীরা বিভিন্ন জনবহুল শ্রোতা সমাগমে 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' পরিবেশন করছেন। লোকে শুনছে, তাই বলে কি গায়নধারাটিকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসেবে স্বীকার করা যায়? প্রশ্নটা শুদ্ধতাবাদের নয়। আবার ফিরে আসি যেখান থেকে শুরু করেছিলুম। প্রকাশ্যে কবির গান গাইতে যাবার আগে কী তাঁরা কবিকথিত 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্যে'র সাধনাটি সমাপন করেছেন?


(ক্রমশ)

0 comments:

0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


এবারের আলোচ্য বইটির নাম ছিরিছাঁদl লেখক ও প্রকাশক প্রীতম বসুl তিনি থাকেন ভিন দেশেl কিন্তু শেকড় রয়ে গেছে বাংলায়l শুধু যে মনে প্রাণে তিনি বাঙালি তাই নয় , তাঁর উন্মোচনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মায়াl সে মায়ায় তিনি শুধু সাংস্কৃতিক দখলদারির দুর্গে আঘাত করেননি, দেখিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রাচীন সমাজে কি ভাবে তার ঐতিহ্য বহমান হয়েছে প্রাকৃত জনের দ্বারাl

গল্পটি একটি থ্রিলারের আঙ্গিকে লেখাl কলকাতার বিভিন্ন মূল্যবান স্থান থেকে সরছে প্রাচীন পুঁথিl সেগুলির কিছু সংশোধন হয়ে ফিরছেl এই রহস্যের পিছনে চলতে গিয়ে পানু রিপোর্টার কিভাবে খুঁজে পাচ্ছেন এক জিনিয়াসকেl যিনি অবলীলায় সংস্কৃত থেকে অসংখ্য বিস্মৃত বাংলা ছন্দকে শিখিয়ে দিচ্ছেন কবিতা রচেl কখনো তিনি ভোলা নর্তক, কখনো জাঁহাপনা, কখনো বার্নার্ড পঞ্চাশl কখনো বা তিনি প্রীতম বসু! প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যের সঙ্গে ভালোবাসা মিশলে তা সত্যিই নিকষিত হেম! প্রীতম বসু তেমনই একটি আবিষ্কার! 

একটি উপমা দিইl
 
বার্নার্ড পঞ্চাশ বলছেন, ব্যালেন্স রাখাটাই মোস্ট ডিফিকাল্ট l মহাপ্রভু চৈতন্যদেব চলেছেন নদীয়ার পথে, দুই বগলে দুই পাঁড় মাতাল জগাই মাধাইকে চেপে ধরে ব্যালেন্স করে করেl জগাই আর মাধাই হলো ছন্দ আর অন্ত্যমিলl আর মাঝে মহাপ্রভু হলেন রসের সাগরl এই তিন নিয়েই তো হলো কবিতাl জগাই আর মাধাই মাল টেনে দুদিকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে চায়l ছন্দের পিছনে দৌড়বে তো মিল মায়ের ভোগে, আবার বেশি মিল কপচাবে তো ছন্দ ভ্যানিশl এখানেই মহাপ্রভুর ক্যালি – ব্যালেন্সl 

কবিতার এমন সুন্দর ব্যাখ্যা শুনেছেন কেউ? আর লক্ষ্য করুন, ভালোবাসাটা! বাঙালির সবচেয়ে গর্বের মানুষটির সঙ্গে কেমন মিলিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্যাশনকে! দিয়েছেন কতশত বাংলা ছন্দ! সেসব ছন্দের তালিকা ও উদাহরণ মোটেই দেবনাl এ বই বাঙালি মাত্রই সংগ্রহ করা উচিত! তিনি ছন্দ মক্সো করতে উৎসাহিত করছেনl এভাবেই বাঙালি ফিরে পাক তার হারিয়ে যাওয়া গৌরবl আসলে তো বাঙালি স্বভাবকবি! কোনো নাম যশ অর্থের পরোয়া না করেই সে ট্রামের চলা, বৃষ্টি ঝরা থেকে ছন্দ অনুভব করে! কুড়িয়ে আনে ! 

এ বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন শঙ্খ ঘোষl খুব স্বাভাবিক! সে ভূমিকা এতই আশাব্যঞ্জক যে বইটিতে পৌঁছতে এক তিল অপেক্ষা চললনাl থ্রিলারের সমস্ত লক্ষণ বজায় রেখেও প্রীতম বসু আমাদের উপহার দিলেন বাঙালির প্রাণের বস্তু , গর্বের বস্তুl

প্রচ্ছদ সপ্তর্ষি দাশl পুঁথির ওপরে লিখতে উদ্যত একটি কলমl লিখুন প্রীতমl আরো আরো লিখুনl আমরা সমৃদ্ধ হইl 
( বইয়ের জন্য যোগাযোগ 91 8584933858)

0 comments: