0

গল্প - চন্দ্রভানু

Posted in


গল্প


কলকাতা ৯০ 
চন্দ্রভানু


রোজ সকালের মতো আজ‌ও ছেঁড়া ছেঁড়া পাতলা ঘুমটা ভেঙে গেল আলির, কবে শেষ গভীর ঘুমের নসিব হয়েছে মনে করতে পারে না। কালো পলিথিন শিটের চারপাশে ইঁটচাপা দিয়ে তৈরী করা ছাদের ফুটোফাটা দিয়ে ধুলোময় বাঙ্কার গেঁথে দিচ্ছে ছুঁচের মতো সরু সরু অসংখ্য আলোর কাঠি। খুব সন্তর্পণে জমিতে বিছানো চটের বস্তার ওপর ধীরেধীরে আধবসা হয় আলি, দেখলে মনে হবে যেন কাচের তৈরি বিছানা যেন ভেঙে না যায় তাই এত সাবধানতা। কোনওমতে আড় ভেঙে হামাগুড়ি দিয়ে বাঙ্কারের কোনে গিয়ে ছাদের পলিথিনের একটা কোনা প্রায় স্লো মোশনে দুআঙুলে তুলে একটুখানি ফাঁক করে বাইরে তাকায়। চারদিকে মরচে রঙের ভোরের আলো, আজ যেন আরও বেশী বিষণ্ণ মনে হয়। কোনো জনপ্রাণী চোখে পড়ে না, যতদূর দেখা যায় শুধু বিভিন্ন আকারের কংক্রিটের টুকরো ইতস্ততঃ ছড়িয়ে আছে রাস্তায়, ফুটপাথে। রাস্তার ধারে ইতিউতি পড়ে আছে দুমড়ে যাওয়া ঝলসানো কয়েকটা গাড়ি, একটা থেকে এখনও কুণ্ডলী পাকানো কালো ধোঁয়া বের হয়ে নিঃশব্দে মিশে যাচ্ছে ভোরের আলোয়।

আজ ভোররাতে কয়েক ঘন্টা যাবৎ হেভি ফায়ারিং হয়েছে, দূর থেকে ভেসে আসা শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল সরকারী বাহিনীর হাই ক্যাালিবারের মেশিনগান। হাতের বাঁদিকে প্রায় তিনশো মিটার দূরে ভারতীয় জাদুঘরের বিল্ডিংটা দাঁড়িয়ে, উচ্চতায় মাত্র দুটো ফ্লোর কিন্তু অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়ানো এই বিল্ডিং। সাদা রঙ করা বিল্ডিংয়ের গায়ে অজস্র বুলেটের দাগে তৈরী হ‌ওয়া গর্ত দূর থেকে দেখলে এক বিচিত্র ছায়াপথ বলে মনে হবে, দোতলার দেওয়াল জায়গায় জায়গায় ধ্বসে পড়েছে মর্টার সেলের আঘাতে। বিল্ডিংয়ের সামনে লোহার রডের তৈরী ভারী সদর দরজার সামনে একটা মিলিটারি জিপ উল্টো হয়ে পড়ে আছে, চারটে চাকার মধ্যে একটা পড়ে আছে গাড়ি থেকে মিটার দশেক দূরে। কিছুদিন আগে অবধি বিল্ডিংটা থেকে ভোরবেলা ফজরের আযান ভেসে আসত, বাঙ্কারে শুয়ে আধো তন্দ্রার মধ্যেে আলি নিজে একদিন শুনেছে। একমাস আগে ঐ বিল্ডিংয়ে স্বাধীনতা যোদ্ধাদের একটা টিম এসে সেল্টার নিয়েছিল, ওরাই হয়ত। বাঙ্কার থেকে বেরোতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায় আলি, একটা অস্পষ্ট কিন্তু ভীষণ পরিচিত শব্দ ঐ বিল্ডিং-এর দিক থেকে ভেসে আসছে। প্রতিবর্তক্রিয়ায় সড়াৎ করে আবার বাঙ্কারে সেঁধিয়ে যায় সমুদ্রতটের ভিতু কাঁকড়ার মতো আর তার ঠিক কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আলির অভিজ্ঞ কানে ধরা পড়ে জমি থেকে প্রায় দুশো মিটার ওপরে অদৃশ্য আকাশপথে উড়ে যাওয়া দুটো ড্রোনের শব্দ। লুকিয়ে থাকা শত্রুসৈন্য থেকে শুরু করে সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক অবধি যেকোনো কিছু মোকাবিলা করার জন্য হেভি মেসিনগান আর ষোলটা মিসাইলে সাজানো এই ড্রোনগুলো কাজ করে মেসিন লার্নিং আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স সফ্ট‌ওয়‍্যারে। জমি থেকে আট কিলোমিটারের‌ও বেশী উচ্চতা থেকে টার্গেট সনাক্ত করে নেয় এই ড্রোনগুলো আর সেইমত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রনির্বাচনের সাথে সাথে সঠিক উচ্চতায় নিজেদের নিয়ে আসে মুহূর্তের মধ‍্যে, তারপর শত্রুপক্ষের আর বিশেষ কিছু বোঝার বা করার অবকাশ থাকে না। প্রত‍্যেকটি আক্রমণ বা প্রতিআক্রমণের সাথে সাথে পরবর্তী আক্রমণের জন‍্য ড্রোনগুলোকে আরো নির্ভুল হিসেবি করে তোলে মেসিন লার্নিং আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স সফ্ট‌ওয়‍্যার। এ দুটো ড্রোন বিদ্রোহীদের না গভর্মেন্টের কে জানে। কেমন যেন থুম মেরে বসে থাকে আলি, কয়েক মুহূর্তের জন্য সবকিছু অর্থহীন বলে মনে হয়।

ইউনিভার্সিটির দোতলায় ইতিহাসের ক্লাসে প্রোফেসরের গমগমে গলা শোনা যায়। এই ক্লাসরুমেই নাইন মিলিমিটার পিস্তল থেকে বের হ‌ওয়া চারটে বুলেট প্রোফেসরেরকে চুপ করিয়ে দেয় চিরকালের জন্য। সারা ক্লাসরুম জুড়ে শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ, কয়েকজন ছাত্র প্রোফেসরকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে, কিন্তু রাস্তায় গাড়ির মধ্যেই সব শেষ। প্রায় পিতৃবিয়োগের মতন ব্যথা, সেদিনটার কথা ভুলতে পারে না আলি। কি দোষ ছিল প্রোফেসরের? ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে পড়াতেন, তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের কথা বলতেন, নাইজেরিয়ায় বা সিরিয়ায় ঘটা মৌলবাদী ইসলামিক অভ‍্যুত্থানের কুফল বোঝাতেন। অধ‍্যাপকের ধ‍্যানধারণা মেনে নিতে পারেনি ইসলামিক ছাত্রগোষ্ঠীগুলি। সিনেমার মত যেন চোখের সামনে পশ্চিমবাংলার সামাজিক আর রাজনৈতিক বিবর্তন দেখতে পায় আলি। 2085 সনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মসনদ দখল করে মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল গণতান্ত্রিক পার্টি, তার বছর তিনেক আগেই মুসলিম জনসংখ্যা পৌঁছে গেছে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকে। মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজ্যের এক অংশ থেকে দাবী উঠতে থাকে শারিয়া আইন প্রবর্তনের, এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে রাজ্যের শিক্ষিত মুসলমানদের এক অংশ আর সংখ্যালঘু সনাতনধর্মীরা। এই রাজনীতি প্রণোদিত সামাজিক অস্থিরতার সময়ে চীন থেকে বিতাড়িত হ‌য়ে গোপনে অরুণাচল হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বর্ডারে চলে আসা একদল উইঘর মুসলমানদের পুনর্বাসনের দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ অশিক্ষিত মুসলমান, অবশ‍্য‌ এর পেছনে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক উস্কানিও ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণে। প্রায় গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি, বোধহয় এমন সময়ের‌ই সুযোগে বসেছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো আর এশিয়ার স্বঘোষিত দাদা চীন। পৃথক রাষ্ট্রের দাবীতে সোচ্চার হয়ে 2089 সনে ভারতীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে চীন, পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মদতপুষ্ট পশ্চিমবঙ্গ লিবারেশন ফ্রন্ট বা পি এল এফ। অদূর ভবিষ্যতে শাসনক্ষমতার লোভে স্বাভাবিকভাবেই মজলিস-ই-ইত্তেহাদুলের কিছু নেতা পি এল এফে যোগ দেয়। পি এল এফ ঘোষিত সেই স্বাধীনতা লড়াইয়ে আজ আলির জীবন জড়িয়ে গেছে আষ্টেপৃষ্টে। তবু আজ‌ও যেন প্রোফেসরের হত‍্যাকে মেনে নিতে দ্বিধা হয় আলির। প্রোফেসরের স্পষ্ট কথা বলার দোষ কতখানি, অনেক ভেবেও তা ঠিক করতে পারে না আলি। নিজে যত্ন নিয়ে কোরান পড়েছে, সে জানে লোকের কোথায় কোরানের অর্থ বুঝতে ভুল হয়, তবু প্রোফেসরের মতবাদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই একমত হতে পারেনি আলি। স্বাভাবিকভাবে স্নাতকস্তরেই মজলিস-ই-ইত্তেহাদুলের ছাত্রসংগঠনের সাথে আলির যথেষ্ট সখ‍্যতা গড়ে ওঠে, তার পরবর্তীতে ছাত্র সংগঠনের একজন মাথা হয়ে দাঁড়ায় সে। এরপর ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করতে সে ঐ একই ইউনিভার্সিটিতে থেকে গিয়েছিল, আর তার মধ‍্যেই আসে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার হাতছানি, এ আমন্ত্রণ গ্রহণে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনি আলি।

আরও একবার বাঙ্কারের কোনায় গিয়ে বাইনোকুলারটা চোখে লাগিয়ে বাইরে তাকায়। মিনিট পাঁচেক এদিক ওদিক দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে অবশেষে বাঙ্কার থেকে বের হয় আলি, হাতে তার নিত‍্যসঙ্গী স্নাইপার রাইফেল। ফুটপাতের ধারে তার স্নাইপার রাইফেলটা কাত করে শুইয়ে রেখে দুহাত মাথার ওপর তুলে টানটান হয়ে আচ্ছা সে আড়মোড়া ভাঙে আলি। কাল অনেক রাতে হেডকোয়ার্টার থেকে রেডিও নির্দেশ এসেছে, আজ তাকে এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে অন‍্য একটা ছোটো ট্রুপকে লিড করতে হবে। ছোটো ডিজিটাল ন‍্যাভিগেটারে চোখ বুলিয়ে নেয় আলি, জায়গাটা এখান থেকে পূর্বদিকে। গত ছয় মাসে এমন অভিযানের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে, আর সেই অভিজ্ঞতার থেকেই আলি বলতে পারে এই শহুরে রাস্তায় দশ কিলোমিটার অতিক্রম করতে মোটামুটি ছয় থেকে আট ঘন্টা লাগতে পারে আলির। বিল্ডিংয়ের আড়ালে আড়ালে দৌড়ে বা হেঁটে শত্রুপক্ষের ড্রোনকে ফাঁকি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। স‍্যাটেলাইট থেকে ক্রমাগত লাইভ ফিড আসছে ন‍্যাভিগেটারে, যেখানে যেখানে খণ্ডযুদ্ধ চলছে সেই জায়গাগুলো লাল রঙে দাগিয়ে দিচ্ছে স্ক্রিনে। আলি তার যাত্রাপথ আরো একবার পরখ করে নেয়, নাঃ, আপাতত কোনো বড় গড়বড় তার যাত্রাপথের আশেপাশে চোখে পড়ছে না, অন্ততঃ তার ন‍্যাভিগেটার তেমন‌ই জানান দিচ্ছে। মিলিটারি বুটের দড়িটা শক্ত করে বেঁধে নিয়ে শেষবারের মতো শূন‍্যে তুলে স্নাইপারের স্কোপটা পরীক্ষা করে নেয় আলি। তারপর বুলেট, গ্রেনেড আর ড্রাইফ্রুটে ঠাসা মিলিটারি রুকস‍্যাকটা পিঠে তুলে কংক্রিটের জঙ্গলে মিশে যায়। এখন থেকে নিয়ম একটাই, যেনতেন প্রকারেণ নিজেকে বাঁচিয়ে গন্তব্যে পৌঁছনো।

সেলবিধ্বস্ত একটা পরিত‍্যক্ত বিল্ডিংয়ের চার তলায় উঠে আলি তার পিঠের বোঝাটা নামাল, স্নাইপারদের আশ্রয় সব সময় উঁচু জায়গায়, ভ‍্যান্টেজ পয়েন্ট। হাতঘড়ি বলছে এখন দুপুর বারোটা, ন‍্যাভিগেটার অনুসারে সে প্রায় সাত কিলোমিটার চলে এসেছে। এত তাড়াতাড়ি সাত কিলোমিটার চলে আসবে সেটা আশা করেনি আলি, অবশ‍্য রাস্তায় বিশেষ কোনও বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। ভাঙা জানালার সামনে এসে বাইরেটা একবার দেখে নেয়। শুকনো খেজুরের প‍্যাকেটটা একহাতে ধরে অন‍্যহাতে জলের বোতল মুখে তুলতেই মারাত্মক এক ধাক্কায় জলের বোতলটা ছিটকে পড়ে মেঝেতে টাল সামলাতে না পেরে কাঠের গুঁড়ির মত‌ও সটান পড়ে যায় আলি। আর প্রায় সাথে সাথেই গোটা পাঁচেক বুলেট এসে পেছনের দেওয়ালের পলেস্তারা খসিয়ে দ্রুত একের পর এক ছাপ দিয়ে যায়, মৃত‍্যুর সঙ্গে ব‍্যবধান ছিল মাত্র কয়েক মিলিসেকেন্ডের নাকি আরও কম। ধাতস্থ হতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে, মাথা এখনও পুরোপুরি কাজ কছে না। বোতল থেকে গড়িয়ে পড়া জল, ছড়ানো খেজুর আর মেঝের ধুলোর মধ‍্যে দিয়ে নিজের দেহটাকে ঘষটে ঘষটে নিয়ে যায় দেওয়ালের কাছে, বিশ্বাসী স্নাইপারটা চুপচাপ দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মালিকের দুর্দশা দেখে যেন মজা পাচ্ছে। এক অভ‍্যস্ত ঝটকায় আলির হাতে উঠে আসে বিধ্বংসী স্নাইপার, আঙুলের টোকায় খুলে যায় স্কোপের ঢাকনা। মেঝের ওপর দিয়ে সরীসৃপের মত এক দীর্ঘ দশফুটের যাত্রা, দেওয়ালের কাছ থেকে ভাঙা জানালার কাছে। জানলার বাইরে সন্তর্পণে স্নাইপারের নল উঁকি দেয় ধীরে, এরপরে আসে স্কোপ আর তার পেছনে আলির শ‍্যেনদৃষ্টি। 

কোন দিক থেকে এল বুলেটগুলো? নিজেকেই যেন জিজ্ঞেস করে আলি। স্কোপের মধ‍্যে ভেসে ওঠে বহুদূরের কোনও বাড়ির জানালা, স‍্যাটেলাইট অ্যান্টেনা বা ফুলের টব। এই তিনতলার ওপর থেকে শহরটাকে আরো একটু বেশী দেখা যায়, শহরের গায়ে এক বীভৎস রোগের মত ছড়িয়ে পড়েছে এই যুদ্ধের ক্ষত। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর জনমনুষ‍্যহীন, এদিক ওদিকে ছারপোকার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ‍্য গাড়ি, কোথাও কোনও বিল্ডিং বা গাড়ি থেকে ধূসর খয়েরি ধোঁয়া বের হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছোঁয়া নাকি লেগেছিল এই কলকাতাতেও, এমনটাই ব‌ইয়ে পড়েছিল আলি, তখনও কি এমন অবস্থা হয়েছিল কোলকাতার? এমনি কত কথা মনের মধ‍্যেই জেগে উঠে মিলিয়ে যায় আলির, কিন্তু তার সতর্ক নজর খুঁজে চলে টার্গেট। সাধারণতঃ স্নাইপারদের সাথে থাকে স্পটার, স্পটারের কাজ হলো হাই ফিল্ড অফ ভিউ বাইনোকুলারের দৃষ্টি দিয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চল চষে ফেলা এবং টার্গেট খুঁজে পেলে তার লোকেশন জানিয়ে দেওয়া। সেই লোকেশনের ভিত্তিতে স্নাইপার আগে তার স্কোপ ঠিক করবে আর স্কোপের হাই ম‍্যাগনিফিকেশন ঠিক করে দেবে অন্তিম লক্ষ‍্যবিন্দু। সুতরাং স্নাইপারের স্কোপ দিয়ে টার্গেট খোঁজা অনেকটা টুথপিকে বিঁধিয়ে ভাত খাওয়ার মতো সময়সাধ‍্য এবং দুঃসাধ‍্য‌ও বটে। ইতিমধ্যে মাথাটা আবার সাফ হয়ে যেতে ঘষটে ঘষটে আলি ফিরে যায় তার রুকস‍্যাকের কাছে, বাইনোকুলার নিয়ে ফিরে আসে। গত কয়েকমাস যাবদ আলি নিজেই স্নাইপার আর স্পটারের এই যৌথদায়িত্ব সামলাচ্ছে, একশো দেড়শো বছর আগে যেমন হতো আর কি! বাইনোকুলার চোখে তুলতেই গোটা শহরের অনেকখানি অংশ যেন আকারে বেড়ে ওঠে তার চোখের সামনে। কয়েকবার এদিক সেদিক করতেই আলির চোখ আটকে যায় প্রায় আড়াইশো মিটার দূরের এক বিল্ডিংয়ের তিন তলায়। দ্রুতহাতে বাইনোকুলার সরিয়ে রেখে হাতে তুলে নেয় স্নাইপার, আর স্কোপে চোখ রেখে একটু এদিক ওদিক সরাতেই চোখে পড়ে লোকটাকে। লোকটা নিজের রাইফেলটা পাশে নামিয়ে রেখেছে, এত দূর থেকেও আলি নির্দ্বিধায় বলতে পারে ওটা আরেকটা স্নাইপার। লোকটার পোষাক‌-আষাক আধা মিলিটারি টাইপের, কুর্তার ওপর মিলিটারি জ‍্যাকেট। মাথায় সাদা ফেজ টুপি, নমাজ পড়ছে, উবু হচ্ছে। স্কোপের মধ‍্যেকার লালবিন্দু ধরা পড়েছে দূরের সাদা ফেজ টুপিতে, লোকটা নমাজ পড়ছে, হাত কেঁপে যায় আলির। প্রোফেসরের কথা মনে পড়ে আলির, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, সেই লড়াইয়ে সরকারি পক্ষের হয়ে দেশের জন‍্য লড়াই করা আলির স্নাইপার থেকে বের হ‌ওয়া বুলেটটা ছুটে চলে অব‍্যর্থ লক্ষ্যে, এক অতি দীর্ঘ যাত্রায়।

0 comments: