ধারাবাহিক - ফাল্গুনি ঘোষ
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
বইপাড়ার তন্ত্রধারক
ফাল্গুনি ঘোষ
নব্বই দশকের প্রথম ভাগ। কলেজস্ট্রিট বইপাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু। তারপর একসময়ে বেশ কয়েকবছর চব্বিশ ঘন্টাই কলেজস্ট্রিটের বুকে থেকে যাওয়া। ক্রমশ প্রকাশনার কাজে জড়িয়ে পড়ে আজও নিত্য সঙ্গী বইপাড়া। একদিন মফস্বল থেকে এসে পড়েছিলাম এই মহানগরে। সেই অথৈ সমুদ্রে এই বইয়ে ঘেরা পাড়াটি যে একটু একটু করে আমার পাড়া হয়ে উঠল, তার পিছনে এমন বেশ কিছু মানুষের ভূমিকা প্রবল, যাঁরা প্রচলিত খ্যাতির আলোকবৃত্তে হয়তো দাঁড়িয়ে নেই, কিন্তু আমার জীবনে আমার বইপাড়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের হাত ধরেই আমি বইপাড়াকে চিনেছি- আজও চিনে চলেছি। এই সিরিজ সেইসব মানুষের প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের দুর্বল প্রয়াস।
২
কলেজপড়ুয়াবেলায় কলেজস্ট্রিট মোড়ে নানা পত্রপত্রিকার খোঁজে পাতিরামে ছিল আমাদের নিত্য গতায়াত। অসংখ্য পত্রিকার পাশাপাশি একটা মজার ব্যাপার চোখ টানত। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটা পোস্টার। ইলাস্ট্রেটেড এবং বইপত্র পড়া সংক্রান্ত। মাসে মাসে বদলে যেত সেই পোস্টার। একসময়ে ওই পোস্টার কবে বদলাবে, আসবে নতুন আরেকটা, এর জন্যও একটা অপেক্ষা ঢুকে পড়ল মাথার মধ্যে। ব্যাপারটা বেশ মজাদার। কারণ তখনও হাতে লেখা পোস্টার রাজনীতি বিজ্ঞাপন বইমেলার স্টলসাজানো- এমন বিবিধ ক্ষেত্রে বেশ জাঁকিয়ে জায়গা নিয়ে আছে। ফলে পাতিরামের পত্রপত্রিকার সঙ্গে ওই পোস্টারটা মুদ্রিত আতুরঘরে বেশ আবেগপ্রবণ গতি জুড়ে দিত। তা পোস্টার তো দেখি নিয়মিত। এগুলো আঁকেন কে? অবশেষে একদিন মুখোমুখি দেখা হল অফবিটের ঘরে। লোহার সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলেন একজন ছোটোখাটো মানুষ- সাদা দাড়ি, সাদা গোঁফ, সাদা চুল। দু'কাঁধে দুটো ঢাউস ঝোলা। উঁকিঝুঁকিতে বোঝা গেল, নানা বইপত্র ও আঁকার সরঞ্জামে ভরা। তদ্দিনে ওই পাতিরামের মতো বেশ কয়েকটা পোস্টারের দেখা পেয়েছি অফবিটের ঘরেও। যদিও সেগুলো অত ঘনঘন পাল্টায় না। আর পয়লা বৈশাখ কিম্বা বইমেলায় হাতে পাই হাতে আঁকা বেশ কিছু বুকমার্ক। সেও ওই বই আর বই পড়া নিয়ে লেখা আর আঁকা। যাই হোক, সেদিন যিনি উঠে এলেন সিঁড়ি বেয়ে, তাঁর কপালে ঈষৎ ঘাম, সাদা গোঁফদাড়ির আড়ালে মৃদু হাসি, পরনে প্যান্টের উপর লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি, দোহারা চেহারা। বসলেন একটা টুলে। চলল গল্পগুজব। যদিও অন্যদের তুলনায় একটু নীরব তিনি। কারণ ততক্ষণে পাঞ্জাবির পকেট থেকে বেরিয়ে পড়েছে আঁকার কলম। একটুকরো কাগজে খসখস এঁকে চলেছেন। কিছুক্ষণ পরে টুকরো কাগজটা বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। প্রথম আলাপের উপহার। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে বই পড়ছে। নীচে একটা ছড়া। ছড়াটা অবিকল মনে নেই আর। তবে ব্যাপারটা 'বই যদি ভালোবাসো, দেখা হবে রোজ এসো' - এই ধরনের। নামটা জানা হয়েছে ততক্ষণে। তারপর কতদিন- প্রায় নিত্য- বইপাড়ার নানা কোণে দুই কাঁধে ভারী দুই ব্যাগ সামলে সামনে একটু ঝুঁকে হনহন হেঁটে যেতে দেখেছি। দেখা হয়। কুশল জিজ্ঞাসা করেন। ছড়া কাটেন। কিছু গল্প। কিন্তু ওই বইপড়া আর বইপাড়ার বাইরে কখনও পা ফেলে না তারা। কানে আসে একদা তারাপদ সাঁতরার কৌশিকী, পুস্তকবিপণি, বইয়ের ইলাস্ট্রেশন, ছোটোখাটো আঁকা-শেখানোকে কেন্দ্র করেই বেঁচে থেকেছে ও থাকে তাঁর শরীর। আর রোজ বইপাড়া থেকে ফিরে যায় হাওড়ার কোনো এক তল্লাটে। কিন্তু প্রতিটি সাক্ষাতে বুঝি, শরীরের ভিতরের মহাপ্রাণীটি কখনও ফেরে না বইপাড়া থেকে। মাঝে যক্ষার
পর্ব পেরিয়ে আর আরও কিছুটা বেশি বয়সের সঙ্গে মোলাকাতে ঝোলাদুটোর ভার একটু কমাতে হয়েছে তাঁকে। ইদানিং ঝোলার চেহারাও বদলেছে কিছুটা। তা এই সেদিনও দেখা হল, কাঁঠালতলার চায়ের দোকানে। গোঁফ বাঁচিয়ে ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বললেন, মোবাইলে যতই হোক নড়াচড়া, জানতে হলে কোথায় যাবে বইপড়া ! আসলে রোজ শুধু নয়, প্রতিমুহূর্তে ছবি আঁকেন রমাপ্রসাদ দত্ত। যখন কাগজ-কলম থাকে না হাতে, তখন মনে মনে। আর শুধু নিজের মনে নয়, আমাদের মনেও। সে ছবি বইপাড়ার। পরের পোস্টারটা কবে দেখব, রমাদা ?
0 comments: