0

গল্প - নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী

Posted in


গল্প


আলি বাবা ও তার চার চোর
নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী



রাসু ওস্তাদ গাঁজার কলকের মাথাটা একহাতে চেপে ধরে টানটা দিল। কলকেটা ফট করে ফেটে গেল। আলি বাবা বলল - চিচিং ফা- আ - আ- ক।

ভেতরের গাঁজা বেশির ভাগটাই পুড়ে ছাই। রাসু ওস্তাদ গলগল করে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বার করতে করতে বলল - চিতে হারামজাদা কোথায়? এখনও এল না?

চিতু বহুবার কলকে ফাটিয়েছে। রাসু ওস্তাদের আজই প্রথম।

আলি বাবা লাদির দিকে চোখ টিপে বলল - আসবে আসবে! দেকিস রে কী হারামজাদা? ওস্তাদের পেসাদ মেরে দে। 

লাদি কলকেটা একবার মাথায় ঠেকিয়ে ফুক ফুক করে টান দিতে দিতে বলল - - আজগের দিনে এট্টা সিকারেট টানতেই পাত্তে, বলি ও রাসুদা।

নদীর ধারের এ জায়গাটা কারোর চোখেই পড়বে না। আর যা অন্য মানুষের চোখে পড়ে না, তা এদের পড়ে। মানে পড়তেই হয়। না হলে চলে না। রাসু, চান্টু আর লাদি চলে এসেছে। একটু পরেই ওদের মিটিং শুরু হবে।

রাসু এখনও ধোঁয়া ছাড়ছে। এখন পাক্কা পাঁচ সাত মিনিট ধোঁয়া বেরোবে। তৃপ্তির হাসি হেসে নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল - বেসি লবাবি দেকাতে নেই রে পাগলা। চোরের ধম্ম বলে এট্টা জিনিস আছে। আমরা ডাগাতদের মতো লয়। ওই সুকে ডাকাতরে দেকিসনি? একখান দাঁও মাত্তি পাল্লো কি পাল্লো না অমনি শহরে গে পোলাও কাডলেট চপ বিরিয়ানি খায়, সিনেমা থ্যাটার দেখে। কডা দিন খুব বাবুয়ানি। লকনোর পাঞ্জাবি, আলিগড়ের পাজামা। ব্যসস তারপর ধরা পড়ে দুদিন বাদে জেলের লপসি। 

রাসু একটু খকখক করে কাশল। একটু দম নিল। তারপর গলার মধ্যে খুকখুক করে হাসতে হাসতে বলল - আমরা হলাম গে সমাজের অনগো। এই গেরস্তের সাথে বসবাস। জোঁক দেকেছিস, জোঁক? চোর হলো গে জোঁকের মতো। এট্টুস এট্টুস করে চুসি চুসি রক্ত খাবে, যেন কেউ বুজতে না পারে। বুজতে পাল্লেই ইল্লি। পা ঝাড়া দে ফালাই দেবে নে। 

লাদি মন দিয়ে রাসুর কথা শুনছে। রাসু হলো গিয়ে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক চোর, চুল টুল পেকে গিয়ে পাকা ঘাঘু মার্কা চেহারা। সে, চান্টু আর চিতু হলো রাসুর হাঁটুর বয়েসী। তাই লাদি রাসুকে আলাদা একটু খাতির করে চলে। রাসুও বোঝে সেটা। আর এটাও জানে চান্টু আর চিতু তাকে সেই আলাদা কোনও খাতির দেয় না। সমানে সমানে কথা বলে। যদিও তাদের মধ্যে একে অপরের সঙ্গে উপর উপর ভালই আপস। কারোর সঙ্গে কারোর ঝগড়াঝাঁটি নেই। অন্য সব লাইনের মতো চুরিতেও নিজের লাইনের লোকেদের সঙ্গে যত কম ঝামেলা রাখা যায় আখেরে ততই লাভ। 

লাদি দেখল বাবা ঝোলা থেকে আরেকটা পুরনো কলকে বার করেছে। তাদের এই ভাবে গাঁজা খাওয়ার কায়দা শিখিয়েছে আলি বাবা। চোরেদের নাকি দম বাড়ানোর সব কিছুই কাজে লাগে। 

আলি বাবা গুনগুন করে বলল - ব্যোম কালি কলকাত্তাওয়ালি, শুধু খেলি দেলি আর বগল বাজালি, মা, মাগো - বলে একমনে কলকেতে পাতা পুরতে ব্যস্ত হয়ে গেল।

তবে আজ রাসু লাদির কাণ্ড দেখে একটু বিরক্তই হলো। চোরের চোখই হচ্ছে আসল জিনিস। এমন আদেখনোর মতো কারোর কথা শুনে বেঁহুসের মতো ব্যবহার করলে কোনওদিন বড় চোর হতে পারবে না! 

চান্টুও রাসুর কথা শুনছে। কিন্তু তার চোখ পুরনো অশ্বত্থ গাছটার দিকে। ওর গোড়ার দিকটা ফাঁপা। এদিক থেকে ওদিকে যাওয়ার একটা ফোকর আছে সেখানে। নদীর এ জায়গাটায় আসার গোপন আর একমাত্র পথ। ওদিকে গাছের গুঁড়িটার চারপাশ ঝোপঝাড় দিয়ে ঘেরা। অন্যদিক থেকে দেখে কেউ ভাবতেও পারবে না, অশ্বত্থ গাছের এদিকটা এমন চমৎকার একটা জায়গা আছে। এ জায়গাটা চিতুর খুঁজে বার করা। আলি বাবার আদি আস্তানা। আর বর্তমানে চোরেদের আড্ডা। 

রাসু লক্ষ্য করেছে, চিতু এসব জায়গা বার করায় ওস্তাদ। আর সে জন্যেই সে এত অল্প বয়সে এত ভাল চোর। তার কোনও কিছু দেখার নজরই আলাদা। শোনা যায় চিতু যখন ছোট ছিল তখন তার বাবা ঘর ছেড়ে চলে যায়। কেউ বলে সাধু হয়ে গিয়েছে। কেউ বলে বিবাগী। বাবা যাই হোক না কেন, ছেলে হলো চোর। 

আলি বাবা বলে - বৈরাগীর ছেলে হয়েছে চোর। মহা চোর। ওরে বৈরাগীর ছেলে হয়ে তুই এত বড় চোর হলি কী করে? ওরে কী চাস তুই জীবনে? লটারী ও জুয়ার নাম্বার চাই? তদবির কর। কারুর বাড়িতে ঝগড়া লাগাতে চাস্? তদবির কর। মেয়েছেলে বশীভূত করতে চাস? তদবীর কর। নাগেশ্বরী সাধনা শেখাব, ত্রটাকবিদ্যা শেখাব, মারণ কর্ম শেখাব, উচাটন শেখাব, জিন সাধনা শেখাব। খালি তদবির কর। আর তদবির করা যাবে মাত্র পঞ্চাশ হাজার, মাত্র পঞ্চাশ হাজার... সাথে বান মারণ মন্ত্র বিলকুল ফ্রি ফ্রি ফ্রি।

চিতু এখনও আসছে না দেখে চান্টু আসার রাস্তাটার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। রাসু একটা বিড়ি ধরাল। বিড়িতে একটা সুখটান দিতে দিতে বলল - আসবে আসবে। চিতু আর যাই করুক কতার খেলাপ করবে না। 

চান্টু চমকে উঠে বোকার মতো হাসল। রাসুর ধুরন্ধর চোখের থেকে খুব কম ব্যাপারই বাঁচে। ব্যাপারটা সামাল দিতে চানটু বলে উঠল - আরে নাহ ওস্তাদ, আমি ভাবছি ব্যাটা দাঁওটা মারল কোথায়। গতদিনগুলোতে আমি তোমাদের সব খবর পেয়েছি আর নিজেরটা তো নিজেই জানিই। কিন্তু চিতুটা কোথায় দাঁও মারল বুঝতে পারলুম না।

রাসু একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই চান্টু আর চিতেকে সে মনে মনে একটু ঈর্ষা করে। সে আর লাদি হলো পড়ালেখা না জানা একেবারে হদ্দ চোর। তাদের দেখলে লোকে ভাবে হয় চাষাভুষো গ্রাম্য বোকাসোকা ধরনের, নয় ভাবে ছোটোলোক। জিনিসপত্র সামলে সুমলে রাখে। যেন মনে মনে বুঝে ফেলে এর হাতটান দোষ আছে। মোটমাট রাসু জানে সমাজের কাছে তারা ছাপ্পা মারা হাভাতে। আর সেটা লেখা আছে তাদের চোখেমুখে। 

অথচ এই চান্টু আর চিতু দেখতে ভদ্রলোকের মতো। বোধহয়, একটু লেখাপড়াও জানে। চারপাশে অজানা লোকজন তাদের নিজেদের মতোই ভাবে। ভদ্রসভ্য জ্ঞান করে। খারাপ লাগত। চিতু এইবয়সেই গাঁজা খাওয়ায় দড়। আলি বাবার সঙ্গে সেই একমাত্র টক্কর দিয়ে গাঁজা টানতে পারে। রাসু ওস্তাদ একটানে কলকে ফাটাতে পারত না। 

আলি বাবা দুজনকে লড়িয়ে দিয়ে বলত - দম বাড়া! ওরে দম বাড়া। চোরের যদি দমই না থাকল তালে আর থাকল কী?

তবে তার সবচেয়ে দুঃখ হয়েছিল যে দিন সে চিতুকে ইঞ্জিরি বলতে শুনেছিল। 

সেদিনটায় সে আর চিতু বনগাঁর ষ্টেশনের কাছে এগরোল খাচ্ছিল। চিতুকে দোকানের ছেলেটাকে ষ্পষ্ট বলতে শুনেছিল - আর একটু চিলি সস দে না, প্লিজ। 

চোরের মুখে ‘চিলি সস’ আর ‘প্লিজ’ শুনে রাসুর গলায় রোলের টুকরো আটকে গেছিল। সেটা ভালো করে গিলতে না গিলতেই দোকানের ছেলেটা চিলি সস দিতেই তাকে চিতু বলল - থ্যাঙ্কস।

শুনে রোলের দোকানের ছেলেটা ফিক করে হেসে বলেছিল - একটু টম্যাটো সসও দেব নাকি, দাদা?

রাসুর চোখে প্রায় জল এসে গিয়েছিল। একটা চোরকে কিনা লোকে ভদ্রলোকের মতো সেধে খাবার দাবার বাড়িয়ে দিচ্ছে। কই রাসুকে তো কেউ কোনদিন জলটা দিয়েই সাধেনি। রোলটা আর গলা দিয়ে নামাতে পারেনি। পাশের ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে পয়সা মিটিয়ে হনহন করে হাঁটা দিয়েছিল। চিতু পিছন দিয়ে আওয়াজ দিয়েছিল - ও রাসুদা, কী হলো কী? 

ভেবেছিল রাসু বোধহয় কোনও শিকার দেখতে পেয়ে পিছু নিয়েছে। 

রাসু জানে, এখন যদি তার মতো লোক পয়সা না দিয়ে হাঁটা দেয় অমনি দোকানদার হাঁক দেবে - এই ব্যাটা পয়সা না দিয়ে পালাচ্ছিস!

আর এটাই যদি চিতু হতো তাহলে ওই একই লোক মিষ্টি করে ডাকবে - ও দাদা, পয়সাটা- 

তারপর চিতু ফিরে এসে যদি বলত – এঃ দেখেছেন একেবারে ভুলে গেছিলাম।

ওই দোকানদারই একগাল হেসে বলত- তাতে কী হয়েছে? মানুষমাত্রেই ভুল হতে পারে। 

তার সামনে কিনা ইঞ্জিরি বলা! না হয় তুই দুটো কথা শিখেই গেছিস, তাই বলে রাসুর সামনে তা দেখিয়ে ফুটুনি মারা। তোর বাপের বয়সী একটা চোর...মানে লোক। না হয় সে বেশি লেখাপড়া শিখতেই পারেনি। না হয় তুই দেখতে ভদ্দরলোকের মতো আর সে চাষাভুষোর মতো। তা বলে এত অপমান। দিনের শেষে তুই ও চোর আর সেও চোর। দেখা যাবে কে কত আসলে বড়! কার কত দম!

ভগবানের এই একচোখোমির শোধ তুলতে সেদিনই রাসু ঠিক করে নিয়েছিল এই অপমানের জবাব সে দেবেই। আর তার সুযোগও এসে গেল কদিনের মাথায়। 

এ ঘটনার কদিন পরে সেদিন ওরা চারজন এখানটায় বসে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। হঠা ৎ কথা উঠল কে কত বড় চুরি করেছে। রাসু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথাটা তোলাল লাদিকে দিয়ে। 

লাদি বলল - আয়ি গেলবার বানছারাম গুছাইতের বাড়িতে যে হাতখানা মেরেছিলুম না, তা কেউ পারবা না। এদিকে গুছাইতের উকিল ছাওয়ালটা ঘুম দিতেছে, আর ওদিকে গুছাইত আর তার বউ নাক ডাকতেছে। তারই মদ্যিই দিলাম বারান্দায় রাখা তাদের মোটর বাইকখানা ঝেড়ে। 

চান্টু বলল - আরে তুই রাখ রাখ! চিতু সেবার কী করেছিল জানিস? পাঁচু পোদ্দার তার মোটর বাইকটা কোমরে ঠেকিয়ে দিয়ে বাজারে রাধু মাছওয়ালার কাছ থেকে দরদাম করে গলদা চিংড়ি কিনছিল। রাধু তিন কিলো চিংড়ির খোসাটোসা ছাড়িয়ে ঝেড়েঝুড়ে দিতে দামটাম মিটিয়ে পিছন ফিরে পাঁচু দেখে বাইক ধাঁ হয়ে গেছে। চিতু তার পিছনে স্রেফ একটা বাঁশের ঠেকনো দিয়ে বাইক তুলে নিয়েছিল। আছে কারোর এমন বুকের পাটা!

রাসু চুপচাপ দুজনের কথা শুনছিল। এই চান্টু ছোঁড়াটার এই এক মহাদোষ। সব সময় ছোটবেলার বন্ধুর ধুয়ো ধরা। আরে বাবা নিজে কী করছিস তাই বল, তা না খালি চিতু এই করেছে, চিতু ওই করেছে। আচ্ছা ধামাধরা পার্টি যা হোক।

চিতুও বসেছিল। রাসু চিতুর দিকে দেখল। সে দুজনের কথা শুনছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। 

রাসু গলাটা ঝেড়ে নিয়ে চিতুর দিকে ফিরে বলল - হয়ে যাক তালে।

চিতু ঠোঁটের মুচকি হাসিটা নিয়েই তার দিকে তাকাল। শুধু তার চোখটা একটু সরু হয়ে গেল। রাসু মনে মনে হাসল। মুখে বলল - একটা কম…কম...কমটিশন হয়ে যাক!

এই কথাটা গত তিনদিন ধরে সে অনেক ঝালিয়ে এসেছিল। কিন্তু মোক্ষম সময়ে তার জিভ দাগা দিল। চিতু হাসতে হাসতেই বলল - কম্পিটিশন? কীসের? চুরির? আমাদের মধ্যে? কে বড় চোর বোঝার জন্যে?

রাসু একই সঙ্গে চিতুকে বাহবা দিল আর তার উপর রাগে চিড়বিড় করে উঠল। বাহবা দিল চিতুর মাথার জন্যে। এই না হলে মাথা! খাম খোলা হলো না, তার আগেই গোটা চিঠি পড়ে ফেলল। নাঃ ছোকরার এলেম আছে। রাগ হলো এই জন্যে যে, গত পাঁচ দিন ধরে সে এই কথাটা নাটকীয়ভাবে বলার জন্যে সুযোগ খুঁজেছে। একা একা মহড়া দিয়েছে। আর ঠিক শুরুতেই ওই কমিটশন না কীসের জন্যে, তার অমন মাঞ্জা দেওয়া পুরো কথাটা লাট খেয়ে গেল। মাঝখান থেকে তার হাঁটুর বয়েসী এই পাকা ছেলেটা ভোকাট্টা করে তার ভুল কথাটা ঠিক করে দিয়ে পুরোটা বুঝিয়ে বলে দিল।

রাসু একইভাবে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল - হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই কী যেন বলে...পো...পো..পোযগিতা। হয়ে যাক।

চিতু আর ‘প্রতিযোগিতা’ কথাটা ঠিক করে দিল না। সে একইভাবে মুচকি মুচকি হাসছে। আর শান্ত চোখে রাসুর দিকে তাকিয়ে আছে। রাসু একটু অস্বস্তি বোধ করল। এই ছেলেটার চোখে কিছু একটা আছে। সে যেন রাসুর ভিতরটা মেপে দেখার চেষ্টা করছে। রাসু একটু চোখটা সরিয়ে নিল। তারপর আবার মনের জোর জড়ো করে চিতুর দিকে তাকাল। সেও পুরনো চোর। অত সহজে তাকে ভয় খাওয়ানো যায় না। 

আলি বাবা চোখ পিটপিট করে সব শুনছিল। এবার বলল - হুং হুং হ্রীং হ্রীং গুহ্যে কালিকে ক্রীং ক্রীং হূং হূং হ্রীং হ্রীং স্বাহা।কালী মহাকালী কিলি কিলি ফট্ স্বাহা। খেয়ে নে, খেয়ে নে মা, লুটেপুটে নিয়ে চেটেপুটে খা।

চিতু এবার একটু জোরে হেসে উঠল । চিতু চান্টু আর লাদির দিকে তাকিয়ে বলল - তোরা কী বলিস? খেলবি নাকি একবার? দেখা যাবে, আমাদের মধ্যে কে বড় চোর।

এতদিন এই দশখানা গঞ্জে তাদের চারজনকেই সবাই বড় চোর বলে মানে। তাদের এলাকা ভাগ ভাগ করা আছে। নিজেদের মধ্যে মিলমিশ আছে। চারজনেই সুখে চুরিচামারি করছে। লাদি বিয়ে থা করে ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করে। রাসু ওস্তাদ বিয়ে করেনি। শুধু ফি সোমবার আর বেস্পতিবার বিনি বোষ্টমীর কাছে কীর্তণ শুনতে যায়। চান্টুও প্রতি দুপুরবেলা চাকদা গার্লস কলেজের সামনে সাইকেল নিয়ে দাঁড়ায়। ফার্স্ট ইয়ারে পড়া মায়ারানি আর সে একটু ইছামতীর ধারে ঘোরে, কখনও বনশ্রী হলে গিয়ে টুকটাক সিনেমা দেখে, চ্যানাচুর খায়। 

শুধু চিতুরই তিনকুলে কেউ নেই। তার মা শোনা যায় ছোটোবেলায় কারোর সঙ্গে চলে যায়। বাপ ঘর ছাড়ে তার কদিন পরে। তার বিয়ে থা হয়নি। মানে কাজের চাপে করা হয়ে ওঠেনি। আত্মীয় স্বজনেরও বেশি দেখাসাক্ষাৎ নেই। চোরের পক্ষে তা সুবিধারই ব্যাপার। কেন বাবা সুখে থাকতে ভূতে কিলোনো!

শুধু মাঝে মাঝে রাতবিরেতে পুলিশের দরজা ধাক্কানো আর পাশ দিয়ে যাওয়া লোকের ফিসফাস ছাড়া তাদের জীবনে আর কোনও  অসুবিধা নেই। 

লাদি একবার চান্টুর দিকে তাকাল। একবার রাসুর দিকে। রাসুও ওই দুজনকে দেখে নিয়ে বলল - তাহলে ওই কতায় রইল। একমাস পরে দেকা হচ্ছে। আমি ভূপতি সামন্তর ওখানে যাব নে, লাদি তুই বাচ্চু পাটোয়ারের গদিতে, চান্টু তুই ঝাড়বি শেখদের হাভেলি আর চিতু তুই বসাকদের ওখানে। দেখি দিনি কার কত দম?

চারটে জায়গাই বাঘের বাসা। আজ অবধি কোন চোর এসব জায়গাই যাওয়ার সাহস করেনি। চান্টু মনে মনে রাসুর প্রশংসা করল। হ্যাঁ বার করেছে বটে চারটে জায়গা। 

ভূপতি সামন্তর প্রচুর জমিজিরেতের কারবার, বাচ্চু পাটোয়ারের কাজ পাইকারি ব্যবসাদারদের টাকা ধার দেওয়া। কালু শেখ চাল ডালের আড়ৎদার আর বসাকদের বাজারের মাঝখানে সবচেয়ে বড় শাড়ি, জামা কাপড়ের দোকান। কেউ কারোর থেকে কম নয়। প্রত্যেকটা জায়গাই এমন, চুরি করতে পারলে শুধু টাকা পয়সা না, চোর হিসেবে মানইজ্জত প্রচুর বেড়ে যাবে। 

চান্টু তাকাল চিতুর দিকে। সে নদীর দিকে আনমনা হয়ে তাকিয়ে আছে। এই তাকানোর মানে চান্টু জানে। ছোটো থেকে সে চিতুকে চেনে। নিস্পৃহভাবে সে এমন এমন সব কাণ্ড ঘটাতে পারে ভাবা যায় না। এইভাবে তাকিয়েই হয়তো সে পুরো প্ল্যানটা এতক্ষণে ছকে ফেলেছে।

চান্টু রাসুর দিকে তাকিয়ে বলল - রাজি।

রাসু উঠে দাঁড়াল। সবার দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল - তাহলে ওই কতাই রইল। একমাস পরে দেকা হচ্ছে। তখনই তালে হিসেব হবে।

আলি বাবা তার জাব্বাজোব্বা পরা শরীরটা নিয়ে উঠে আড়ামোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলে চিতুর দিকে তাকিয়ে বলল - ওরে কুম্ভক কর, কুম্ভক। তারপর রোজ রাতে ভ্রুর মাঝখানটা টিপে বলবি ওঁম নমো বিস্মিল্লাহী রহিমান রাব্বে ইন্নী মঙ্গল ফন্তসীর। পরী সাধনা কর, পরী সাধনা। ব্যস, তালে আর তোকে চাঁদনি রাতে পরীর দেখা পাওয়া ঠেকায় কে?

ভূপতি সামন্ত যে টাকার কুমির সেটা সবাই জানে। অথচ ভূপতির বাড়ি দেখে বোঝার উপায় নেই। বাড়ির বাইরের দেয়ালে পলেস্তারাও করা হয়নি। ইঁট বার করা হতশ্রী ধরনের বাড়ি। একদিন মাদুর বিক্রি করতে গিয়ে, আরেক দিন নারকেল পাড়ার কাজ করতে গিয়ে রাসু বুঝল এ বাড়িতে কিস্যু নেই।

ভূপতি সামন্ত এদিকে পরম ভক্ত মানুষ। গলায় কন্ঠী ধারণ করে। বাড়ির ঠিক সামনেই রাস্তার ওপারে রাধাকৃষ্ণের মন্দির বানিয়েছে। সামনে নাটমন্দির। তাতে অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তন হয়। বাড়ি আর মন্দির দুটোই বড় রাস্তার উপর। চারপাশে দোকান বাজার। একেবারে জমজমাট এলাকা।

সেদিন একটু দুপুরের দিকে রাস্তাঘাট সামান্য ফাঁকাফাঁকা। মানুষজন দুপুরের খাবার দাবার খেতে নিজের নিজের বাড়িতে গিয়েছে। নাটমন্দিরে সামনে একটা গরুর গাড়ি এসে থামল। গাড়িটা বিরাট। আর তাতে বাঁধা কয়েক মণ খড়। গাড়িতে দুটো যমদূতের মতো ষাঁড় বাঁধা রয়েছে। আসা যাওয়ার পথে লোকজন রীতিমতো ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে ষাঁড়দুটোকে।। নাট মন্দিরের একদম সামনে এসে ষাঁড়গুলো আর নড়তে চাইছে না। মাঝবয়েসী গাড়োয়ানটা গাড়িটাকে সরানোর খুব চেষ্টা করছে। গাড়ি আর নড়ে না। নাটমন্দির থেকে দু তিনটে লোক বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে কাণ্ডটা দেখছে। 

কয়েকজন গাড়োয়ানকে - এই গাড়ি সরা। দরজার সামনে থেকে গাড়ি সরা - বলতে লাগল। 

হঠাৎ খড়ের গাদা থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরোতে লাগল। কয়েকজন - আগুন আগুন বলে চেঁচিয়ে উঠল। নাটমন্দিরের ভিতর যারা নামসংকীর্তণ করছিল তারা ছুটে বেরিয়ে এল। খড়ের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল। নাটমন্দিরেও ঢুকল। ষাঁড়গুলো দড়ি ছিঁড়ে দিগ্বিদিকে ছুটল। রাস্তার লোক ষাঁড় আর আগুনের ভয়ে পালাতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তুমুল বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে গেল।

কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজন মাথা ঠাণ্ডা করে ফিরে এল। বালতি বালতি জল ঢালা হলো। খড়ের আগুন নিভে এল। ধোঁয়া অবশ্য আরও কিছুসময় ধরে রইল। প্রায় ঘন্টাদেড়েক পরে আবার ভূপতি শেঠের লোকজন নাটমন্দিরে ঢুকতে পারল। ব্যাটা গরুর গাড়ির গাড়োয়ানকে কোথাও পাওয়া গেল না। ভূপতি শেঠের লোকেরাই আধপোড়া গাড়িটা পাশে ফেলে রেখে দিল। পরে লোক এসে নিয়ে যাবে বলে। নাটমন্দিরের এতটুকু কোন ক্ষতি হয়নি। 

সব জানলা দরজা খুলে রাখায় ঘন্টাদুয়েকের মধ্যে মন্দির থেকে হাওয়ায় সব ধোঁয়া বেরিয়ে গেল। বিকেলের দিকে ভূপতি এল। সে দুদিনের জন্যে গঞ্জের বাইরে গিয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমেই বাড়িতে ঢোকার আগে সে নাটমন্দিরের দিকে যায়। সেখানে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহকে মূল মন্দিরের দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ প্রণাম করে। একটু দাঁড়িয়ে কীর্তন শোনে তারপর বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে এসে বাড়িতে ঢোকে। 

কিন্তু সেদিন মন্দিরে ঢোকার আগেই সে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। পোড়া গরুর গাড়িটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল - এটা এখানে কে রেখেছে? 

যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সে এসে তাড়াতাড়ি পুরো ঘটনাটা বলল। শুনেই চোখমুখ বদলে গেল ভূপতির। সে প্রায় দৌড়ে গিয়ে মূল মন্দিরের ঢুকে দরজা আটকে দিল। আর তার একটু পরেই শোনা গেল বুকফাটা আর্তনাদ। 

পরের দু একদিনের মধ্যেই আশেপাশের দশটা গঞ্জ জেনে গেল ভুপতি সামন্তের বাড়িতে বিরাট চুরি হয়েছে। যে সে চুরি নয়। ভূপতিকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছে। গ্রাম গঞ্জে ছোটখাট চুরি হয় বটে, তা বলে এযে ঘোগের ঘরে হানা। ঘটনা শুনে কেউ কেউ বলল - সে কী কাণ্ড! ভূপতি টাকাপয়সা নিয়ে বিগ্রহের তলায় লুকিয়ে রাখত! 

আবার কেউ কেউ বলল - তাতে কী হলো? ধনরত্ন হলো মা লক্ষ্মী। মা লক্ষ্মীকে নারায়ণের কাছে রাখত, তাতে ভুল কী হলো?

তবে সবাই এককথায় বলল - - নাঃ চোরের এলেম আছে বটে। 

ঠিক একইভাবে চুরি হলো কালু শেখের বাড়িতে। কালু শেখের ছ ছটা বাঘের মতো কুকুর। তারা সারা রাত বাড়ি পাহারা দেয়। দিন পনেরো আগে একটা ছমছমে চেহারার ছেলে জোগাড়ের কাজ করতে এল। ছেলেটার কথাবার্তা এত মিষ্টি আর এমন চমৎকার বাঁশি বাজায়, যে কালু শেখ তাকে বেশ পছন্দ করে ফেলল। তাকে থাকতে দেওয়া হলো চাকরদের ঘরে। পাকা কাজে বহাল করা হলো। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেল যে বাঘের মতো কুকুরগুলো কালু শেখের হাতে ছাড়া খায় না, সেগুলো ছেলেটার বেশ ন্যাওটা হয়ে উঠেছে।

সেদিন ঠিক ভোররাতের আগে যে সময়ে ঘুমটা সবচেয়ে জাঁকিয়ে ধরে ঠিক সে সময় তখন কয়েকজন হালকা সুরে একটা বাঁশি শুনেছিল। রাতবিরেতে ঘুম আসছে না বলে চাকরটা নিজে নিজে বাঁশি বাজাচ্ছে - ভেবে তারা আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল।

সে ঘুম ভাঙল দুপুরবেলা। কুকুরগুলোকে তো সন্ধের দিকে গায়ে জল ঢেলে ও তোলা যায় না। উঠেও সামনের দু চারদিন ঝিম মেরে রইল। খাবার দিলে ভাল করে খেতে চায় না। এরই মধ্যে দেখা গেল নতুন চাকরটা উধাও। সাথে উধাও সিন্দুক, আলমারির জমানো মালকড়ি।

লোকজন, পুলিশ প্রশাসন নড়েচড়ে বসল। আর ঠিক তখনই হলো তিন নম্বর চুরিটা। 

বাচ্চু মাল নাম করা পাটোয়ার। গা গঞ্জের বিভিন্ন হাটে তার প্রচুর টাকা খাটে। বড় বড় অঙ্কের টাকা সে এক জায়গা থেকে আর জায়গায় নিয়ে যায় অদ্ভূত উপায়ে। বাচ্চু টাকা পয়সার ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস করে না। নিজে হাতে টাকা দেয়। আর নিজে হাতে নেয়। খুব সাদাসিধে ভাবে চলাফেরা করে। বহুবার বহু চোর ডাকাত তার পিছু নেয়। বাচ্চু তাই মাঝে মাঝেই নকলি মুকলি বার হয়। চোর ডাকাত তার পিছু পিছু হদ্দ হয়ে দেখে সে হয়তো ডালপুরির দোকানে আয়েশ করে জলখাবার খাচ্ছে বা চাকদার বাসট্যান্ডের পাশের মাঠে যাত্রা দেখছে। আজকাল আর তারা তার পিছনে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। 

তবু সাবধানের মার নেই। তার কোমরে একটা ছোরা গোঁজা থাকে। নিজের টাকা বাঁচানোর জন্যে বাচ্চু যে কোন লোকের বুকে ছোরা বসাতে পারে। কিন্তু তার দরকার হয় না। গ্রামগঞ্জে চোরের আর কত সাহসই বা হবে।

এই আজ যেমন বাচ্চু বেরোচ্ছে বিচালি নিয়ে। উপর উপর তার একটা লোকদেখানো বিচালি আর খোলের ব্যবসা আছে, সবই গোখাদ্য। তবে বিক্রিবাটা খুব একটা হয় না।

সেদিন সকালে সে ছোট একটা ম্যাটাডোর ডাকাল বাজার থেকে। ম্যাটাডোর তার উঠোনে দাঁড়াল। বাচ্চুর দুজন বিশ্বস্ত লোক সেই গাড়িটাতে বেশ কয়েকটা বিচালির গাঁটরি তুলল। মাঝে বাচ্চুও হাত লাগাল। তার তোলা বিচালির গাঁটরির একটার মধ্যে পাঁচটা বান্ডিল আছে। সব দু হাজারের নোট। সব মিলিয়ে দশ লাখ টাকা। গ্রামে গঞ্জে নগদ টাকারই কারবার বেশি। চেকটেক হাটে বাজারের পাইকারি কাজে কোনদিনই বেশি চলে না।

পাল্লার মহাজন তিনু মল্লিক টাকাটা চেয়েছে। যে কেউ দেখলে ভাববে সে গাড়িতে হাটে বিচালি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

আজ তিনু মল্লিক দশ লাখ টাকা নেবে। এক সপ্তাহ পরে ওই টাকার উপরেই সে দশ টাকা সুদ দেবে। অর্থাৎ দশ লাখ দিয়ে ফেরৎ পাওয়া যাবে এগারো লাখ। তবে মূল টাকা ফেরৎ পাওয়া নিয়ে বাচ্চু বিশেষ ভাবে না। তার নজর হল সুদে। এক সপ্তার বেশি হলেই সে পাবে বারো টাকা সুদ। পনেরো দিনের পরেই তা হবে পনেরো টাকা। এভাবে সুদ বাড়তেই থাকবে। আসল যত দেরিতে পাওয়া যায় ততই ভালো। 

ম্যাটাডোরের সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে সেটাই ভাবছিল বাচ্চু। গাড়ির ভেতরে বসেও গরমে সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে তার গলাটা একটু শুকনো শুকনো লাগছিল। গাড়ি থেকে নামা ঠিক কাজের কাজ হবে না। 

ম্যাটাডোরের ড্রাইভারটাকে বলল - যাঃ একটা থামসাম নিয়ে নায়। দুজনে ভাগ করে খাই। ড্রাইভারটা একটা ঠাণ্ডা পানীয়ের বোতল নিয়ে এল।

ষ্ট্র লাগিয়ে চুকচুক করে বাচ্চু খেতে লাগল। অর্ধেক খেয়েই বাকিটা ড্রাইভারকে দেবে। দু চারবার খেয়েই বাচ্চু ভালোছেলের মতো অগাধ ঘুমিয়ে পড়ল। বিকেলবেলা পুলিশ যখন তাকে রাস্তার পাশে দাঁড় করান ম্যাটাডোরে খুঁজে পেল বাচ্চু তখনও ঘুমোচ্ছে। বোধহয় ঘুমের মধ্যে ভাল ভাল স্বপ্নও দেখছিল। মাঝে মাঝে ফিকফিক হাসছিল। দু দিন পর হাসপাতাল থেকে ফিরে বাচ্চু দেখল বিচালির গাদা যেমন ছিল তেমনই আছে। শুধু তার থেকে একটা খড়ের গাঁটরি উধাও।

পুলিশ পাগলের মতো চোরটাকে খুঁজছে। একটাই চোর না চোরেদের দল বোঝা যাচ্ছে না। মুশকিল হচ্ছে চোরটা বা চোরগুলোকে ভাল করে কেউ খেয়ালই করেনি। ভিড়ের মধ্যে বোঝা যাচ্ছে না কে আসল চোর। কেউ বলছে বুড়ো, কেউ বলে ছুঁড়ো, কেউ বলে লম্বা, কেউ বলে ছোট। রোগা, মোটা, কালো, ধলো সব মিলিয়ে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। 

পুলিশ সব জায়গায় সতর্ক চোখ রেখেছে। রাসু, চানু, লাদিরাও অপেক্ষা করছে চিতুর হাতটা মারার জন্যে। এর মধ্যেই পুলিশ তাদের ঘরে হানা দিয়েছে। তারা কেউ ঘরে থাকছে না। চিতুর কাজটা হলেও তারা এলাকা ছেড়ে পালাবে। সবাই গা ঢাকা দেবে কিছুদিনের জন্যে। যতদিন সব ঠাণ্ডা না হয়ে যায়।

শেষ অবধি চিতু এল। শান্তভাবে, হেলতে দুলতে এসে বসল। তিনজোড়া চোখ তাকে দেখছে। আলি বাবা এক ছিলিম টেনে ভুরু টুরু কুঁচকে চোখ কপালে তুলে বসে আছে। ওতে নাকি ভ্রুর মাঝখানে মাঝে মাঝে টুনি বাল্বের মতো আলো জ্বলে। চিতু আনমনে সামনে নদীর দিকে দেখছে। যেন কোনওদিকে ভ্রুক্ষেপই নেই। রাসু উসখুস করছে। লাদি একবার গলা খাঁকারি দিল। 

কেউ কিছু বলার আগে চিতুই তাদের দিকে তাকাল - কোথায় চুরিটা করলাম, তাই ভাবছ তো? আসলে অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম এসময় একটা জায়গায় চুরি করলেই সবচেয়ে বড় হাত মারতে পারব - বলে মিটিমিটি হাসল। রাসু আর লাদি তাকে সরু চোখে দেখছে। 

চিতু আবার বলে উঠল - আর সেখানে চুরি করলেই কোনও পুলিশ আমায় ধরবে না। 

লাদি বসা অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল। চিতু বলে চলেছে - বুঝলে অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম একটা চোরের ঘরে চুরি করা সবচেয়ে সহজ...

লাদি ঝট করে একটা ছুরি বার করে চিতুর দিকে এগিয়ে গেল। চিতু মাছি তাড়ানোর মতো একটা ভঙ্গি করে হাতটা নাড়াল। দেখা গেল লাদির ছুরিটা চিতুর হাতে। 

চিতু ছুরিটা ভাঁজ করে আবার লাদির হাতে দিয়ে হেসে বলল - করিস কী ভাই! আমরা হলাম চোর। চোরের একটা ধর্ম বলে জিনিস আছে। আমাদের কী এসব জিনিস নিয়ে ছেলেখেলা সাজে - বলে ছুরিটা আবার তার হাতে ফেরৎ দিয়ে দিল। রাসু আবার মনে মনে ছেলেটার প্রশংসা করল। এত সাফ হাতের কাজ দেখা একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার।

চান্টু এতক্ষণ কিছু বলেনি। সে এবার গিয়ে লাদিকে ধরে বলল - কী ছেলেমানুষি করছিস। 

লাদি পাগলের মতো চিৎকার করে বলল - আমি ছেলেমানুষি করছি? শিগগির ওকে বলতে বল, ও কোন চোরের বাড়ি চুরি করেছে। 

রাসু কেটে কেটে বলল - জানিস তো চিতু, কাগে কখনও কাগের মাংস খায় না। আর যদি খেয়েও ফেলে তবে তার কপালে অনেক দুকখু আছে।

বলেই হনহন করে চলে গেল। সবাই জানে সে যাচ্ছে বিনি বোষ্টমীর বাড়ি। তার লুকনো মালপত্র সেখানেই আছে। বিনি বোষ্টমী ভূপতি সামন্তর ওখানে কীর্তন করত। সেখান থেকেই সব খবর এসেছে। লাদিও তার পিছন পিছন গেল। তারও মাল কোথাও গুছিয়ে রাখা আছে। চান্টু এগিয়ে গেল চিতুর কাছে। চিতু আবার শান্ত হয়ে বসে আছে। চান্টু তার কাছে গিয়ে বসল। 

বলল - হ্যাঁরে তোকে ছোট থেকে চিনি। একসাথে বড়ো হয়েছি। মনে আছে আমি বাজারে বাঁশি বাজাতাম। সেদিন কোনও ভিক্ষে পাইনি। তুই খাবার চুরি করে এনে আমায় খাইয়েছিলি। সেটাই বোধহয় ছিল তোর প্রথম চুরি। আমি জানি তুই কোনও ভুল কাজ করিস না। কী হয়েছে বল?

চিতু পা ছড়িয়ে আরাম করে বসল। তার আস্তে আস্তে শুয়েই পড়ল। 
যেন সে নিজের সাথে কথা বলছে এমনি করে বলল - সেদিন রাতে বসাক বাড়িতে ঢুকেছি বুঝলি। বাড়িটাতে ঢুকেই কেন জানি না মনে কিছু গণ্ডগোল আছে। কেন মনে হলো জানি না। আলমারি খুলে গয়ণাগাঁটিঁ বার করলাম। সিন্দুক খুলে টাকাপয়সা। মনে হচ্ছিল এদের বাড়ির সবকিছুও যদি চুরি করে নিয়ে যাই তাহলেও বোধহয় কেউ কিছু বলবে না। পুরো বাড়িটা ফাঁকা। মালটাল সরিয়ে তিনতলা থেকে দোতলায় যেতে গিয়ে দেখি একটা ঘর থেকে গলার আওয়াজ আসছে। 

চুপচাপ জানলার কার্ণিশ বেয়ে উঁকি মেরে দেখি একটা লোক একজন মহিলার পাশে বসে খুব কাঁদছে। বউটা বলছে - কেঁদ না, কেঁদ না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার এত গয়না আছে, সিন্দুকে টাকা আছে, তোমার সব ধার শোধ হয়ে যাবে।

লোকটা বলছে - ওতে কিছুই হবে না। দোকানের লোকেদের দু মাসের মাইনে দিতে পারিনি। বাড়ি, দোকান সব বন্ধক দিয়েছি। আর দু দিনের মধ্যে কিস্তির টাকা শোধ না দিতে পারলে পথে এসে দাঁড়াব। বাজারে এত ধার যে সব টাকা আর গয়না দিয়েও শোধ হবে না। আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। 

শুনে তার বউটাও কাঁদতে শুরু করল। একটু কেঁদে বলল - আমরা কী এবার মেয়েটাকে পাঠাতে পারব? পারব পাঠাতে? 

আমি অবাক হলাম। এত ধারদেনা যে আত্মহত্যার কথা ভাবছে। তা হলে মেয়েকে আবার কোথায় পাঠাতে চাইছে??

কার্ণিশ দিয়ে উঁকি দিয়ে পাশের ঘরে জানলা দিয়ে দেখতেই পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলাম আর কি! দেখলাম একটা ডাগর মেয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আমার চোখে চোখ পড়তে বলল - তুমি চোর?

ছোটোবেলা থেকে বহু বিপদে পড়েছি। তাও গলার কাছটা ধক ধক করছে। তোতলাতে তোতলাতে বললাম - ইয়ে মানে ভুল...ভুল করে বুঝলেন তো - 

মেয়েটা বলল - নিয়ে যাও। নিয়ে যাও সব। নইলে সব আমার শ্বশুরবাড়ির লোক এসে নিয়ে যাবে।

সত্যি বলছি মাইরি, জীবনে বহুদিন না খেয়ে থেকেছি। অনেক মারধোর খেয়েছি। অনেক সময় অনেক দুঃখ হয়েছে। এত দুঃখের গলা কোনওদিন শুনিনি। আমি ওই পিছল কার্ণিশে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করলাম - তো...তোমার কবে বিয়ে?

মেয়েটা বলল - দুবছর হয়েছে। তিনমাস আগে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বিয়ের সময় পঞ্চাশ লাখ টাকার পণ দেওয়া হয়েছে। আরও এককোটি না দিলে বাড়ি ঢুকতে দেবে না। 

চান্টু তার বন্ধুকে ভালো করেই চেনে। তবু বলল - তারপর তুই কী করলি? 

চিতু হেসে বলল - ওদের টাকাপয়সাগুলো গিয়ে রেখে দিলাম। পরদিন গিয়ে আমার জমানো টাকাগুলোও দিয়ে এলাম। কোটি না হোক, কিছু তো হবে।

চান্টু হাসতে হাসতে বলল - ভালোই করেছিস। 

চিতুও হাসছিল । খুব আনন্দের গলায় বলল - মাঝে মাঝে ভাবি, চুরি চামারি ছেড়ে দেব, জানিস। একটা রোলের দোকান দেব। শান্তিতে জীবনটা কাটাব। 

চান্টু বলল - যা বলেছিস। আমিও ভাবি।

চিতু জিজ্ঞেস করল - আচ্ছা তুই শুনলাম কালু শেখের বাড়িতে সবাইকে বাঁশি বাজিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলি। 

চান্টু বলল - আরে না না, সে তো রাতে রান্নার সময় ওদের খাবারে কটা বড়ি...

চিতু বলল - অনেক দিন তোর বাঁশি শুনিনি। শোনা না! 

চান্টু তার বাঁশিটা কোমর থেকে বার করল। এটা সে সবসময়ে সঙ্গে রাখে। চান্টু এদিকে চোখ বুজে তন্ময় হয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে। 

ওদিকে আলি বাবা গাঁজায় ধোঁয়ায় বাদামী হয়ে যাওয়া দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে হেসে কুটিপাটি। খালি বলছে - ওরে বলেছিলাম, তুই পরী দেখবি, দেখবিই দেখবি.. 

চিতু মনে মনে ভাবল - এই আলি বাবার আস্তানায় তো কত আজগুবি কাণ্ডই হয়। একটা আধপাগলা ফকির চারটে চোরের জীবনে জাদু দেখাতে চায়, কোনদিন পারে না। চারটে চোর নিজের মতো করে সুখ শান্তি খোঁজার জন্যে কত পাগলামিই করে বেড়ায় । তাদের কেউ কীর্তন শোনে, কেউ গাঁজা খেয়ে কলকে ফাটায়, আবার কেউ বাঁশি বাজায়। ধরা যাক কোনওদিন সেই ম্যাজিক হয়েই গেল, আর সে রূপার সাথে এই নদীর পাড়ে এসে বসল। পৃথিবীতে কত অদ্ভুত ঘটনাই তো ঘটে।

যেদিন চিতু নিজের টাকাপয়সা নিয়ে গিয়েছিল, সেদিন রূপা খুব অবাক হয়ে বড় বড় চোখে তাকে প্রশ্ন করেছে- তোমার নাম কী?

চিতু বলেছে - চি..মানে চিত্ত। চিত্ত কুমার - তারপর কান টান চুলকে লজ্জায় লাল হয়ে বলেছে - আর আপনার...মানে তো...তোমার?

সামনে নদীর ওপারে তখন সবচেয়ে দামি ব্যাপারটা ঘটছে। সারা আকাশের গায়ে তখন কেউ গলানো সোনা ছড়িয়ে দিয়েছে। সেই সোনা টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে নদীর জলে। চিতু একজন চোর। পাকা চোর। সে সেই সোনাঝরা সন্ধেটা টুক করে নিজের মনের মধ্যে চুরি করে নিল। কোনও একদিন রূপা নামের একটি মেয়েকে দেখাবে বলে। ।

এ গল্পটি পড়ে কারোর কারোর হালকা হাসি পেতেও পারে। কারোর বা সেরকম আহামরি নাও লাগতে পারে। আমি আসলে সে সব ভেবে লিখিনি। এটি আসলে রূপা নামে একটি মেয়েকে মনে করে লেখা। রূপা আমাদের সঙ্গে পড়ত। মা বাবার খুব আদুরে মেয়ে ছিল সে। হি হি করে হাসত। তার বাবা মা প্রচুর পণ দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। রূপাকে বাড়িতে ফেরৎ পাঠান হয়নি। শ্বশুরবাড়িতেই দরজা বন্ধ করে তার গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। শরীরের চামড়া, মাংস যখন পুড়ে যাচ্ছিল, সে হয়ত বীভৎস চিৎকার করেছিল। কেউ তাকে বাঁচাতে আসেনি।

0 comments: