0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত


॥২৩॥



আদিবাসী জঙ্গল সন্তান ফিরে পেতে চায় নিজস্ব মৃত্তিকা


গোরাচাঁদ 

জ্ঞান ফেরার মুহূর্তে মাথার ভিতর জীবনানন্দের কয়েকটা লাইন পরিষ্কার অনুরণন হতে লাগলো।‘মৃত্যু অনেক পরিশ্রমের ফল/সময় কোথাও নিবারিত হয়না, তবু হয়তো ভোরে আমরা সবাই মানুষ ছিলাম/তারি নিদর্শনের সূর্যবলয় আজকের এই অন্ধ জগতে’। গোরাচাঁদ বিচক্ষণ মানুষ। হঠাত্‍ চোখ খুলে এক ভিন্ন পরিবেশ দেখেও বিস্মিত হলেন না। মিটিঙের পর হঠাত্‍ চোখের সামনে সবুজ আঁধার ঘনিয়ে আসতে মনে হয়েছিল এই বুঝি মৃত্যু। না। মৃত্যু হয়নি। তবে হয়েছে শোক নিরাশা ও ধিক্কার।এর চেয়ে মৃত্যু ভালো ছিলো। কিন্তু এখন মৃত্যু চেতনা তাঁকে অনেক বেশি পরিশ্রমের নির্দেশ দিয়ে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে বলছে। অতীতের সেই দ্রোহ আচরণ আবার মনে প্রাণে ফেরাতেই হবে। তবেই পূর্ণতা। সময় কম।

গোরাচাঁদ দেখলেন, অসম্ভব শুভ্র এক কেবিনে তিনি ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে। নাকে অক্সিজেনের পাইপ।ডান হাতে স্যালাইন বইছে।শুভ্র পোশাকে কয়েকজন ফর্সা দেবদূতের মতো ব্যস্ত ইতস্তত। এরা প্রত্যেকে তাঁর সেবায় রত। রাশিয়ান ডাক্তার প্যাডে চার্ট দেখে ইন্জেকশনে ওষুধ ভরছে। গোরাচাঁদের জ্ঞান ফিরেছে অথচ কেউ তাঁর দিকে তাকাচ্ছে না। যেন এটাই স্বাভাবিক। উনি হাত পা নাড়লেন। উঠে বসার চেষ্টা করতেই মাথার দিক থেকে দুটো হাত তাঁর কাঁধ ধরে শুইয়ে দিলেন। পরিষ্কার ইংরাজিতে বললেন,-প্লিজ ডোন্ট মুভ,আপনার একটা সিভিয়ার স্ট্রোক হয়েছে। কোনো প্রশ্ন করবেননা। কোনোরকম উত্তেজনা এখন আপনার শরীরে সহ্য হবে না। 

গোরাচাঁদ কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন।অসম্ভব শীতল নিঃশব্দ কেবিন। নিজেরই হৃত্‍স্পন্দন শোনা যায়। সারগেই গোরাচাঁদের পায়ের কাছে বসলেন। গোরাচাঁদ পায়ের উপর তার গোলাপী হাতের স্পর্শ পেলেন। -ইউ আর এ নাইস পার্সন আই নেভার এভার সিন ইন মাই লাইফ। গ্রেট। মিটিংএ যে আচরণ দেখালেন,হ্যাটস অফ।

কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন গোরাচাঁদ। কিন্তু আর থাকতে পারলেন না। খুব ধীরে মৃদু গলায় রাশিয়ান ভাষায় বললেন,- একটা ছোটো প্রশ্ন করব? মাত্র একটা। সারগেই জবাব না দিয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

-আমি ইন্ডিয়ান ক্যাম্পে ছিলাম আর সেখানেই আমার হার্ট এট্যাক হয়েছিল। কিন্তু আপনারা আমাকে রাশিয়ান ক্যাম্পে কেন আনলেন?

সারগেই এর মুখে একটা বাঁকা হাসি খেলে গেল। -সেটা আপনিই ভালো জানেন মিঃ দাস। তাছাড়া,আপনাকে আমরা এম্বেসেডর করে নিয়ে গেছিলাম। আপনার ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব তো আমাদেরই? আমাদের আর্মি কোড অফ কন্ডাক্টে তো আছেই? সারগেই একটু চুপ করে থেকে আবার বলে উঠলেন,-তাছাড়া আমি ওদের গেশ্চার দেখেই বুঝেছি, ওরা আপনাকে কেয়ার করতো না। মেরে ফেলতো। আপনাকে কোনোমতেই এখন হারাতে চাই না। এখানে যতদিন আছি আমরা, আপনার হেল্প না পেলে একপাও এগোন যাবেনা।

গোরাচাঁদ বিস্মিত হয়ে সারগেইএর মুখের দিকে তাকালেন। আসলে তো এই রাশিয়ান ট্রুপ এখানে যৌথ সৈন্য মহড়া দিতে এসেছে। এছাড়া আছে সারগেইএর নিজস্ব একটা দেশসেবা ভাবনা। নানান ভেষজ ঔষধি সংরক্ষণ ও ভারতীয় সরকারি অনুমোদন নিয়ে নিজের দেশে ওষুধের র মেটিরিয়াল নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এছাড়া আর কি হতে পারে? গোরাচাঁদের চোখে চোখ রেখে সারগেই বললেন,

-আপনি কি ভাবছেন আমার কোনো ডার্টি ইন্টেনশন আছে? আপনাদের শোষণ করার কোনো ফন্দি? না মিঃ দাস। বরং আমি আপনাদের দেশকে দৈহিক ও মানসিক রোগ ও জড়তা থেকে মুক্তির উপায় ভাবছি। এইমাত্র আপনার স্বার্থান্বেষী পুত্র সরকারী অনুমতিকে ভুল ব্যবহার করে কয়েকটি বিস্তীর্ণ ভেষজ ভূমিকে মর্টার ও কামানের গোলায় তছনচ করে দিল। ওই হার্বগুলোর যে মেডিসিন্যাল ভ্যালু ছিল তা দিয়ে বিশ্বের অসংখ্য বিরল রোগ নিরাময় হতে পারতো। এমনকি বিশ্বের জাতি প্রজাতি ভেদাভেদ দূর হবার ওষুধও নিশ্চয় আপনাদের এই সরস ভূমিতে উপজ হয়। এ বিষয়ে আমাদের টীমের বিজ্ঞানীদের ডীপ স্টাডিজ আছে।ওগুলোর কেমিক্যাল এনালিসিস করে লাইফ সেভিং এলোপ্যাথী ড্রাগ হতো। এবার সেগুলো পাওয়ার আশাও মনে হচ্ছে ত্যাগ করতে হবে। 

হঠাত্‍ সারগেইএর কোমরে রাখা ওয়াকি টকি সরব হয়ে গেল। দুর্বোধ্য রাশিয়ান কোডে কিছু মেসেজ উনি কান খাড়া করে নিস্তব্ধ কেবিনে শুনতে লাগলেন। গোরাচাঁদ শুয়ে থেকে বেড ও স্যালাইন ক্ল্যাম্পের মৃদু কম্পন টের পেলেন। ভূমিকম্প নাকি? -‘ওই ওই শুনুন, আর্মির হেভি শেলিং! ডু ইউ ফিল মিঃ দাস ওপেন গ্রাউণ্ডে আপনাদের ড্রাম মেসেজের আদেশ মতো জমায়েত নেটিভদের উপর মর্টার বৃষ্টি হচ্ছে’? 

কিছুক্ষন চুপ। দুজনেই দুজনকে দেখতে লাগলেন। সারগেই গোরাচাঁদের মুখের খুব কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন,-বাট বাট নাউ আই কেম টু নো যেখানে মাস কিলিং এর জন্যে শেলিং হচ্ছে,সেখানে একটাও নেটিভ নেই। আমার কাছে এখনকার রিপোর্ট। আমার পরামর্শ অনুযায়ী ম্যাডাম জেরেকা তার সমস্ত অরণ্যবাসীকে যেখানে জমায়েত হতে টানা দু ঘণ্টা ড্রাম ম্যাসেজ রিলে করিয়েছেন, তার ডিটেলস আগেই আমাদের কাছে ডিসাইফারড হয়ে ছিল। তাই আমরা সেখানে নেটিভদের প্রোটেকশনএর জন্যে পুরো ব্যাটেলিয়ান পাঠিয়েছি। কিন্তু এমেজিং! সেখানে যে নেটিভরা সব জমায়েত হবে একথা ইন্ডিয়ান ট্রুপ কিভাবে জানতে পেরেছিল? আর সেখানে এখন কেন একটা আদিবাসীও নেই! তারা সবাই ঘর ছেড়ে বস্তি ছেড়ে কোথায় জমায়েত হয়েছে? 

সারগেই হঠাত্‍ ব্যস্ত হয়ে ওয়াকি টকি অন করে কথা বলতে শুরু করলেন। বেশ কিছুক্ষন কথা বলে মুখ ঘুরিয়ে উত্তেজিত গলায় বললেন,-মিঃ দাস,জেরেকা ম্যাডামকে ওই ময়দানে নিয়ে যেতে আমাদের দুজন সৈনিক সাথে ছিল। ওরা কেউই সেখানে পৌছয়নি। তাহলে সবাই গেল কোথায়?গোরাচাঁদ চুপকরে রইলেন। সারগেই মুখ খুললেন,-এর উত্তর আপনার কাছেই আছে মিঃ দাস,আয়াম সিওর। হয়,এর উত্তর আপনি এখুনি বলুন,নয় আপনি ও এখনকার প্রতিটি মানুষের ধ্বংসলীলার জন্যে প্রস্তুত হোন। মনে রাখবেন,এই সরকার ঘোষিত উপদ্রুত এলাকার সাফাইএর জন্য আমাদের কাছেও অর্ডার আছে। 

গোরাচাঁদ চোখ নামিয়ে বলতে লাগলেন,-আপনি আমাদের রক্ষক। আপনাকে তো কথাটা বলতামই। কেবল সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। সেইসময় ধামসার বিপদ সংকেতে বার বার একটাই ম্যাসেজ অনেকক্ষণ ধরে ছড়াচ্ছিল। তোমাদের সমূহ বিপদ। তোমাদের বস্তি উচ্ছেদ করার জন্য আজ প্রচুর কামানের গোলা বর্ষণ হবে। তোমরা যদি প্রাণে বাঁচতে চাও তো বিশ্রামবেলার (দুপুর) আগেই দুধ ঝর্ণার পাশে বড় ময়দানে তোমাদের ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে জমায়েত হও। কিন্তু বেশকিছুক্ষন প্রায় ঘণ্টা তিনেক পরই হঠাত্‍ আরএকটা ড্রাম ম্যাসেজ ঘোষিত হয়েছিল। কোথাথেকে এই ম্যাসেজ শুরু হয়েছিল এমনকি জেরেকাও জানেনা। কেউ জানেনা কে এই ম্যাসেজের আদেশকর্তা। তবে, আমি জেরেকা ও পেরো এই ম্যাসেজের সিগনেটরি। তাই আমাদের ধারনা পেরো বেঁচে আছে ও সেই এই ম্যাসেজ ছড়িয়েছে। আমি জেরেকাকে সেখানে নিয়ে যাবার অনুমতি দিয়েছিলাম। সারগেই জিজ্ঞেস করলেন,

-সেই ম্যাসেজটা কি? আমার দুই সৈনিকদের নিয়ে জেরেকা ম্যাডাম কোথায় গেছেন? 

-উপজাতির সকলে যেন অন্য একটি বিশেষ জায়গায়, একটা খাড়া উঁচু স্লেটের মতো মসৃণ চ্যাটালো পাথরপাহাড়ের উল্টো দিকে বন্ধ গুহামুখের কাছে যেন যায়। ও সেখানেই জমায়েত হয়।দুধ ঝর্ণার পাশের মাঠে কেউ যেন ভুলেও না যায়,এই সাবধানতা বারবার ম্যাসেজে বলা হয়েছিল। 

-ওই সৈনিকদুজনের কাছে ওয়াকি টকি নেই। আমি কি করে ওই লোকেশনে যাবার বা সৈন্য পাঠাবার ডাইরেকশন পাবো? এখন আপনিই ভরসা। কিন্তু আপনাকে কি মুভ করা যাবে? 

-আমি এখন সুস্থ। আমাকে আপনাদের জীপ গাড়িতে নিয়ে চলুন। আমার সেখানে যাওয়া দরকার।

-ঠিক আছে মিঃ দাস। একটা ছোটো এমবুলেন্স গাড়িতে একজন ডাক্তার ও দুজন আর্মড ফোর্স নিয়ে আমি আপনাকে নিয়ে যাব দু ঘণ্টা পরে। 

0 comments: