0

গল্প - শঙ্খদীপ ঘোষ

Posted in


গল্প


চন্দনা পাগলি
শঙ্খদীপ ঘোষ



চন্দনা পিসিকে আমরা ছোটো থেকে দেখছি। ছোটোবেলায় যখন আমাদের পারসোনাল কথাবার্তা বলে কিছু ছিল না, যখন বাচ্চারা অতটাও টিভি-ভক্ত হয়ে ওঠেনি, যখন কম্প্যুটার বাড়ি বাড়ি আসেনি, সাইবার ক্যাফে কথাটাও অতবেশি পপুলার হয়নি, তবে ভিডিও গেমের নাম আমরা শুনেছি, তার কিছু পরে পরে, যখন মোবাইলের বাড়বাড়ন্ত মানুষের মুখের ভাষার প্রতি "মিউট" বোতাম টিপে ধরেনি, তবে খেলার সময় একটু একটু করে চুরি হতে আরম্ভ করেছে -- তখন খেলাধুলো বাদে আমাদের পাকামোর, নিজেদের বড়ো বলে প্রতিপন্ন করার উপাদান ছিল চন্দনা পিসিকে "চন্দনা পাগলি" বলে খ্যাপানো।

তবে এ প্রথম নয়, বা আমাদের জেনেরেশনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এমনটাও নয়; বড়ো হতে হতে বাবার কাছে শুনেছি বাবাদের ছোটোবেলায় আমাদের পাড়ায় এক ভদ্রলোক নাকি ভাড়া থাকতেন, তাঁর ভীষণ ফোড়া হতো; বাবারা তাকে 'ফোড়াগালানি' বলে রাগাত। হয়ত প্রতি জেনেরেশনেই, যারা আলাদা, তাদের রাগানোর মধ্যে একটা পাকামো উপভোগ করার বিষয় থাকে। খেলা খেলা ভাব... ইয়ারকি, তার মধ্যেই বড়ো হওয়ার স্বাদ পাওয়া, একটু শক্তিশালী হয়ে ওঠা। তখন বাবাদেরও এ বুদ্ধি ছিলনা যে যাকে সবাই খ্যাপাচ্ছে তার মনের কি হচ্ছে সেটা ভেবে দেখার। একই কথা আমাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। হয়ত, যতদিন না নিজেকে ঐ জায়গাটায় দাঁড়াতে হয়, সমাজ যখন আমাদের দিকে তর্জনী তুলে প্রতি পদে আমাদের আলাদা করে দেওয়ার চক্রান্ত করে... ঠিক চক্রান্তও না, চক্রান্ত সাধারণত পিছনে অজ্ঞাতসারে করা হয়, বলা ভালো, আমাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে জেহাদ ঘোষণা করে, ততদিন হয়ত আমাদের অন্যের কথা ভাবার, তার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখার কথা মাথায় আসেনা। আমার বাবাকে দাঁড়াতে হয়নি-- তাই বড় বয়েসেও সে হেসে আমাদের কাছে তাদের ঐ লোকটিকে 'ফোড়াগালানি' বলে উত্যক্ত করবার কথা বলতে পেরেছে। আমাকেও যতদিন সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়নি, আমি তা উপভোগ করেছি, চন্দনা পিসিকে 'চন্দনা পাগলি' বলে খেপিয়েছি এবং তাতে বিন্দুমাত্র আফশোষের অবকাশ দেখিনি বরং বন্ধুমহলে এইসব পাগলা-পাগলি-দের প্রসঙ্গ উঠলেই বাকিদের সবার সঙ্গে আমিও চন্দনা পাগলির কথা বলতাম। কিন্তু অবশেষে, যে কারণেই হোক, নিজেকে সমাজের উদ্ধত তর্জনীর সামনে দাঁড়াতে হলো-- তখন একটু একটু বোধ হলো, হয়ত নিজের স্বার্থেই, যে আমরা সমাজকে যেভাবে দেখি, জরুরি নয় সবাই সেভাবে দেখবে, আমাদের সমাজ আমাদের যেভাবে একটা "আদার" বা "অন্য" তৈরি করে নিতে শিখিয়েছে সেটাকে প্রশ্রয় দিলে নিজেকেই একদিন সেই আদার-এ পড়ে যেতে হয়। শুধু আমি নয়, সবাইকে পড়তে হয়। আসলে সংগ্রামটা এই আদারে-আদারে। যে আদার যে যুগে শক্তিশালী তারা রাজত্ব করে, তারাই আসল, তারাই পরাকাষ্ঠা আর যারা শোষিত হয় তারা হয় পাগল, নয় অসুস্থ, নয়ত আরও কত কি...

যাই হোক, চন্দনা পিসির কথা বলতে গিয়ে কত কথা বলা হয়ে গেল। যেখানে ছিলাম, চন্দনা পিসিকে আমরা ছোটবেলা থেকে দেখছি। তেল জ্যাপজ্যাপে, জটলা পাকানো, বাঁধনছাড়া চুল। কিছুটা তরঙ্গায়িত। পরনে বেশিরভাগ সময়ই একটা ম্যাক্সি, পায়ে মাঝে মাঝে হাওয়াই চটি থাকত, তাও প্রায় ক্ষয়ে আসা, প্রতিমুহূর্তে যার রবারের বেল্ট ছিঁড়ে যাওয়ার প্রবণতা ছিল প্রকট, তবে বেশিরভাগই তার পা থাকত নগ্ন। ধূলিধুসরিত পা ফেটে চৌচির, যেন রুক্ষ দেশের কেউ। থপথপ করে দুদিকে হেলে দুলে হাঁটত। 

চন্দনা পিসিকে ঠিক পাগলি বলা যায় না। সে হেবলা। কথাবার্তা পরিস্কার। থেমে থেমে বলে... কিন্তু অসংলগ্ন নয়। মানে গোছানো নয়। কিন্তু আমাদের দ্বারা তাকে আলাদা করে দেওয়ার সমস্ত উপাদান তার ছিল।যে দেশের লোকেরা মানসিক হাসপাতালকে "পাগলাগারদ" বলে, তারা যে নিজেদের থেকে আলাদা কাউকে দেখলে নির্দ্বিধায় এবং স্বাভাবিকভাবে তাকে "পাগলা" বলে আখ্যায়িত করে দেবে তাতে আর বিস্ময়ের কি! 

চন্দনা পিসি কতদূর লেখাপড়া করেছে আমরা জানি না। তবে পড়াশোনা বেশি করেনি, তা বোঝা যেত। সে পড়াশোনা করেনি, নাকি করতে পারেন, নাকি তাকে করতে দেওয়া হয়নি -- সে কারণ অনুমান করার বয়স আমাদের তখন হয়নি। আমরা সব স্কুলপড়া ছেলেপুলে, বুঝতাম স্কুলে পড়লে এক অদৃশ্য ক্ষমতা চলে আসে, যার জেরে আমরা আমাদের থেকে আলাদা কাউকে "পাগলি" বলে খ্যাপাতে পারি। খ্যাপিয়ে ভাবতাম আমরা খুব বড়ো হয়ে গেছি, আমরা আর ছোটো নেই, কারণ খ্যাপিয়ে যে পৈশাচিক সুখ পাওয়া যায়, তা তখন আমরা বুঝতাম না।

আলাদা ছিল বলে আলাদার মতো ব্যবহার সে পেত ঠিকই তবে পাগলিদের মতো ভ্রাম্যমাণ নিষ্ক্রিয় জীবন তার ছিল না। ঘরবাড়ির কাজকাম সে যথেষ্ট করত। টুকিটাকি দোকানপাটও করত -- দুটো ডিম, একটা জিরের প্যাকেট, পাঁচ টাকার পাঁচফোড়ন ইত্যাদি। তবে যে কাজ তার ভাগ্যে ধরাবাঁধা ছিল, তা হলো কাচাকাচি। মাঝে মাঝেই গামলা ভরে কাপড় নিয়ে চলে আসত পাড়ার কলে। আর আমরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেতাম। যতক্ষণ কাচত ততক্ষণ যেন বিভীষিকা -- চারিদিক থেকে বর্শার মতো যেন ছুটে আসছে-- চন্দনা পাগলি... চন্দনা পাগলি! আমরা দোতলায় সেজোকাকার ঘরের বক্স জানলা থেকে যে কতবার "চন্দনা পাগলি" বলে লুকিয়ে পড়তাম তা গুনে বলতে পারি না। 

সে এদিক ওদিক দেখত। কিন্তু কতদিকে তাকাবে সে? বুঝতে পারলে বাড়ি বয়ে এসে মাকে বা সেজো-মা'কে বলে যেত "দ্যাখো না বৌদি... আমাকে রাগাচ্ছে!" মা কিংবা সেজোমা বকত আমাদের। আমরা শোনার পাত্র ছিলাম না। আর আমরা শুনলেও পাড়ায় তো আর শুধু আমাদের বাস না। আমরা চুপ করে গেলে তারা বলত। পিঠ ঠেকে গেলে তার অস্ত্র ছিল খিস্তি। উদুম খিস্তি দিত সে। এতক্ষণে যাদের টনক নড়ছিল না, তখন তাদের টনক নড়ত। বেড়িয়ে এসে চন্দনা পিসিকে বকত " এই চন্দনা... এই, কি পেয়েছিস টা কি! বাড়িতে ছোট ছোট ছেলে মেয়েগুলো কি শিখবে...!" 

সে আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলতে গেলে তখন মেয়ে-বৌ'রাও বাদ যেত না। তারাও বলত " হুর.. পাগলি! চুপ কর... যা কেচে বাড়ি যা!" 

আমার ঠাকুমার সঙ্গে তার বিশেষ সদ্ভাব ছিল। সন্ধ্যার দিকে মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি আসত। এসে হাঁক পাড়ত "মাসিমা..?" গলাটা একটু ভারী মতো ছিল। আমরা মাঝে মাঝে মস্তানদের নকল করে যেরকম কৃত্রিমভাবে গলাটা ভারী করি, অনেকটা সেরকম শোনাত। মাঝে মাঝে আবার আমাদের বারান্দার চেয়ারটায় বসে মেজোপিসির সঙ্গে গ্যাঁজাতো। সুখ দুঃখের কথা। কোনদিনও শোনার কথা মনে হয়নি। আমার ভাই, মানে সেজোকাকার ছেলে ছিল মহা বদমাইশ। ইচ্ছে করে উপর থেকে নেমে একবার বাড়ির বাইরে যেত। পরক্ষণেই এসে "চন্দনা পাগলি" বলে ছুটতে ছুটতে উপরে উঠে যেত।

চন্দনা পিসি, মেজো পিসিকে বলত "দেখলি তো আল্লাদি, বাবুর ছেলেটা কেমন বদমাশ! "

পিসি হয়ত চেঁচাল কিছুক্ষণ "এই ক্যান্ রে তুই ওকে ওরম বলিস... দাঁড়া তোর মাকে বলছি, তোর বাপের থেকে বয়সে বড় হয় জানিস!" 

একদিন সন্ধ্যাবেলা এসেছে। দেখা গেল সামনের দাঁতটা ভাঙা। কথায় কথায় বলল "আর বলিস না আল্লাদি, দাদার ছেলেটা মহাবিচ্চু তো! সকালে খাচ্ছিল না, সে কি কান্না... খুব তেজ না! খুব তেজ তো! বাটি ঘটি যা পায় মা'কে ছুড়ে মারে!"

"তোর মা কে?"

"না না... ওর মা'কে!... আজকে আমি খাওয়াচ্ছিলাম, কাঁসের গেলাসটা ছুঁড়ে মারল... সোজা এসে দাঁতে লাগল আর ভেঙে গেল! সে কি যন্ত্রণা! আল্লাদি... তোর কাছে ব্যাথার ওষুধ থাকলে দিস তো!" 

পাগলিদের বয়স হয়? তারা তো শুধু পাগলিই হয়। তাই আমরা কোনদিন চন্দনা পিসিকে চন্দনা পাগলি বলার আগে ভাবিনি সে আমাদের থেকে বয়সে অনেক বড়, আমার বাবা-কাকাদের থেকেও বড়! যাই হোক, চন্দনা পিসির সামনের দাঁতটা এমনিতেই উঁচু ছিল-- তাই একটা দাঁতের অনুপস্থিতি সবার নজরে আসতে বেশি সময় লাগল না। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে : একে মা মনসা, তার উপর ধুনোর গন্ধ। যথারীতি, "পাগলি"তেই তাকে খ্যাপানো আর থেমে থাকল না। সঙ্গে যোগ হলো, "কি রে চন্দনা... দাঁতটা কে খুলে নিল? "

কিছু বললে বলত --"কি? কি বলছিস?... সব হাওয়া তো বাইপাস হয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে!" 

চন্দনা পিসির মেজাজ ভাল থাকলে হাসে। বলে "রাগাস না কিন্তু... ভাল হবে না বলে দিচ্ছি!" মেজাজ খারাপ থাকলে খিস্তি মারে!

চন্দনা পিসির চোখগুলো যেন কেমন ছিল-- হ্যাবলা হ্যাবলা মতো। ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি। কোথায় বেশ শুনেছিলাম যারা নাকি প্রচণ্ড  পরিমাণে ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল তাদের চাহনি নাকি ওরম ফ্যালফ্যালে হয়ে যায়। চন্দনা পিসি ঈশ্বরের প্রতি প্রচণ্ড নির্ভরশীল ছিল কি না জানা নেই, তার চোখদুটোয় আমি অভিমান দেখেছি। যেন অভিমানে ঠাসা। হয়ত তাঁর ওপরই। কেন সে'ই? হামেশাই বলতে শুনেছি জন্মেছ যখন একটা দাগ রেখে যাও, মনুষ্যজন্ম বিরল জন্ম, হ্যানাত্যানা... সে এইসব তত্ত্বকথা জানে না, কিন্তু সে কি এই প্রশ্ন একবারও করেনি যে কেন সে'ই এরম জন্ম পেল! আমরা যারা বাইরের দ্রষ্টা মাত্র তাদের কাছে চন্দনা একজন নয়, হাজারো চন্দনা আছে, কিন্তু চন্দনা পিসির কাছে, চন্দনাদের কাছে তার জন্ম তো একটাই। সে যে জন্মে একটা দাগ রেখে যেতে পারত, বা দাগ না রাখুক একটা সাধারণ জীবন পেতে পারত, আর সকল মেয়েরা যেরকম পায় -- একটা স্বামী, সংসার, সন্তান, সেসব পেতে পারত -- কেন সে এই সব থেকে বঞ্চিত হলো?

আমাদের সমাজে দুধরণের মানুষ আছে : সাধারণ আর অসাধারণ। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, ভাগ তিনটে। অসাধারণ - সাধারণ -অ-সাধারণ। অসাধারণেরা সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর অ-সাধারণেরা সারাজীবন সাধারণও হয়ে উঠতে পারে না... চন্দনা পিসি দ্বিতীয় প্রকার অসাধারণের বাসিন্দা। সে অসাধারণ হওয়ার মতো কিছু করেনি-- আর সাধারণ আমরা তাকে হতে দিইনি। অগত্যা সে জায়গা পেয়েছে তৃতীয় চত্বরেই। 

সেই চন্দনা পিসিই একবার অসাধারণ হওয়ার মতোই একটা কাজ করে ফেলল! ঘটনাটি এইরকম : 

চন্দনা পিসির মা তখন সবে সবে মারা গেছেন। বাচ্চাটাকে চন্দনা পিসির কাছে রেখে তার দাদা বৌদি গেছিল বাজারে। শ্রাদ্ধের কাজ। তাই নিমন্ত্রণ করতে গেছিল হয়ত। কথা ছিল তাড়াতাড়ি চলে আসবে। বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছিল, তাই রাখার অসুবিধা হওয়ার কথা না। চন্দনা পিসি কি করছিল জানা নেই... হঠাৎ পাশের বাড়ির কাকিমার চিৎকার -- চন্দনা... এই চন্দনা! আছিস? দেখ তোদের বাড়ি দিয়ে ধুঁয়ো বেড়চ্ছে... আগুন ফাগুন লাগল নাকি দেখ! ওমাগো... ঐ তো ফুলকি ছুটছে! 

চন্দনা পিসিদের বাড়িটা ছিল বি.টি.রোডের ধারে। বি. টি. রোড যারা চেনে তারা জানে বি.টি.রোড রাস্তাটাই গ্যারেজাকীর্ণ! চন্দনা পিসিদের পাশের বাড়ির তলাতেই গ্যারেজ। তার বাড়ির তলাতেও গ্যারেজ ভাড়া দেওয়া। ওখানকার ছেলেগুলোও চ্যাঁচাতে লাগল -- নেমে আসো... নেমে আসো! 

চন্দনা পিসির ভাবনা চিন্তা করতে সময় লাগে। নেড়া ছাদে দাঁড়িয়ে আশেপাশের চিৎকারে তার বেহাল দশা! মাথায় কিছু ঢুকছে না। এত শব্দ চারিদিকে। এত কথা। তার মধ্যে দিয়ে গলা চড়িয়ে গাড়িগুলো চলে যাচ্ছে অসভ্যের মতো। গ্যারেজের ছেলেগুলো ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চ্যাঁচাতে লাগল -- কি গো নেমে আসো! 

নামবে কি সে? আগুন তো সিঁড়ির মুখে। কতকালের পুরোনো মিটার বক্স। এক জায়গায় তিন-চারটে মিটার। তাতে দলা পেকে আছে তার, বটের ঝুরির তার মতো নেমেছে দেওয়াল থেকে। পরে জানা গেছিল, শর্ট সার্কিট থেকেই আগুন লেগেছিল। 

হঠাৎ মনে পড়েছিল, বাচ্চাটা যে ঘরে শুয়ে আছে। সে বলল "দাঁড়া..." বলে সে ঘরে ঢুকে গেল। কারেন্ট চলে গেছে। ঘরে ধোঁয়া। বাচ্চাটা তখনও বেঘোরে ঘোমাচ্ছে। ঘেমে স্নান হয়ে আছে। সে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে বাইরে এল। নেড়া ছাদটায়।

সবাই থ। পাশের বাড়ির কাকিমা চ্যাঁচিয়ে কাদের যেন শুনিয়ে শুনিয়ে বলল "ঐ দেখো কাণ্ড... বাচ্চাটাকে রেখে গেছে!" কেউ কেউ বলল " ওর দাদা বৌদিক কি আক্কেল অ্যাঁ... ওই হেবলি মেয়ের কাছে কেউ বাচ্চাকে রেখে যায়?" 

গ্যারেজের ছেলেগুলো নীচ থেকে বলতে লাগল " ওকে ফেলে দাও... ওকে আমরা লুফে নিচ্ছি! "

চন্দনা পিসি ছাড়ল না। সে কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। ততক্ষণে পাড়ার মুখে ভিড় জমেছে। আশেপাশের গ্যারেজের হিন্দিভাষী ছেলে ছোকরা লোকরাও এসে হাজির। 

কার বেশ গলা শোনা গেল "আরে পাগলি... বাচ্চাটাকে ফ্যাল... ওরা লুফে নিক!" 

পাশের গ্যারেজের হিন্দিভাষী লোকগুলো তখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে "উ অউরত পাগলি হ্যায় না?"

" হা। ওহি তো... ক্যায় করেগি কুছ পাতা নেহি... বাচ্চে কোই না মার ডালে...!" 

না... বাচ্চাটাকে সে মারেনি। এক অপরূপ মাতৃত্ব যেন বাচ্চাটাকে আড়াল করছিল সেদিন। পেছনে আগুন। সামনে দাবানল। অত মানুষ... তাদের অত কথা... কটুক্তি... বিভীষিকার চেয়ে কম কি? বাচ্চাটা এত চিৎকারে হতভম্ব হয়ে গেছে। চোখ ছলছল করছিল। মুখ ইতোমধ্যেই কেঁদো-কেঁদো হয়ে এসেছে। চারিদিকে তখন চন্দনা পিসির নামে গালাগালির ফোয়ারা ছুটছে। এরই মধ্যে বাচ্চাটাকে কিভাবে বুকের আড়ালে লুকিয়ে ছাদ থেকে ঝাঁপ দিল সে। মাটিতে পড়তেই কারা যেন বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নিল। বাচ্চাটা বেঁচে গেল, শরীরে তার একটা আঁচও আসেনি। আঁচ লাগল চন্দনা পিসির। হাত পা ভাঙল। কোমড় একটুর জন্য রেহাই পেল। 

তারপর অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। সেদিনের সাহসের কথা কেউ মনে রাখে নি। সেই বাচ্চাটি এখন সদ্য দাড়ি-গোঁফ গজানো কিশোর।বাপ-মায়ের মতো সে'ও পিসিকে উঠতে বসতে হুকুমতামিল করে, মাঝে মাঝে গালিগালাজও করে। হাড় জোড়া লেগে যায়। চন্দনা পিসিরও লেগেছে... কিন্তু চোখদুটো আগের থেকে ভেবলে গেছে। হয়ত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিমানের বোঝাটা বেড়েছে। 

প্রজন্মের পর প্রজন্ম চন্দনা পিসিকে "চন্দনা পাগলি" বলে বড়ো হয়। হয়ত বড়ো হয়ে আমার মতো কেউ কেউ নিজের স্বার্থেই নিজের ভুল বুঝতে পারে। বেশিরভাগই বোঝে না। তাদের থেকে তাদের ছেলেপুলেরা শিখে নেয়। তারাও চন্দনা পিসির বয়েসের খোঁজ রাখে না, পিসি বলার ধার দিয়ে যায় না। প্রজন্ম আসে... তারা বড়ো হয়। কেউ সম্মান করতে শেখে কেউ শেখে না। কিন্তু শেখার ট্রেনিংটা বরাবর চন্দনা পাগলির ওপর দিয়েই যায়। সে যে মানুষ নয়-- সে তো পাগলি, অতয়েব তার মন নেই-- আমাদের ধরে নেওয়া এই সত্য যুগযুগান্ত ধরে চলে এসে চন্দনা পিসির মতোই আরও কত মনহীন মানুষের জন্ম দিয়েছে, জন্ম দেবে-- তার হিসাব কেউ রাখে না!

0 comments: