0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন জেনএক্স রকেটপ্যাড
 শিবাংশু দে



যে সমস্ত নমস্য শিল্পী আমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে, বুঝতে ও ক্রিয়াশীলভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে শিখিয়েছেন, তাঁদের সবার নিজস্ব সদগুরু সাধন হয়েছিলো। নিজস্ব সাধনার দ্বারা তাঁরা স্বরলিপির কঙ্কালে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। পঙ্কজকুমার, সুবিনয়, দেবব্রত, হেমন্ত, সাহানাদেবী, কনক দাশ, রাজেশ্বরী দত্ত, কণিকা, সুচিত্রা, নীলিমা , ঋতু এবং আরো বেশ কিছু নাম আসা উচিত এই তালিকায়, যাঁরা আজ আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত বলতে যা বুঝি তার রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছেন। আমরা যদি কৌতূহলী ও প্রশ্নশীল হয়ে নিজেদের মধ্যে খুঁজতে চাই পরিবেশনার ঠিক কোন অঙ্গটির প্রতি মুখ্যত আমরা আকৃষ্ট হই, তবে দেখবো আবেগের শিল্পিত ও সংযত প্রকাশই প্রধান শর্ত। যার শিকড় নিহিত রয়েছে 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্যে'র ভূমিতে। 


সব মুখ্য শিল্পীই নিজেদের সিদ্ধি অনুযায়ী এই শর্তটি সযত্নে অনুপালন করে থাকেন। তবে বোধ ও আবেগের যে আনুপাতিক পরিমাপ, সেখানে প্রত্যেকে নিজস্ব মানদণ্ড স্থির করে নেন। শিল্পী হিসেবে সেখানেই তাঁরা পরস্পরের থেকে ভিন্ন। ঠিক যেমন কবি দিলীপকুমারকে বলেছিলেন, 'আমি যখন সাহানার গান শুনি, তখন নিজের গানের সঙ্গে আমি সাহানার গানও শুনি'। অর্থাৎ একজন সিদ্ধ শিল্পী যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনান তখন কবির সঙ্গে আমরা সেই শিল্পীর গানও শুনি। যে সব শিল্পীদের নাম করলুম, আপাতভাবে তাঁরা আবেগমুখর গানকেও সন্তুলিতভাবে বোধের মাটিতে বেঁধে রাখতে পারেন। সহজাত কুশলতায় বহির্মুখী আবেগ ও অন্তর্মুখী বোধের প্রতি সমান সুবিচার করতে পারেন । সুচিত্রা, কণিকা, নীলিমা বা ঋতুর রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়নে এই সব বৈশিষ্ট্য তাঁদের সমসময়ে ও পরবর্তীকালে সার্থকতার উচ্চতম আসনে বসিয়েছিল। যদি আজকের শ্রোতা ইন্দিরাদেবীর মতো ‘কলকাতা’ ও ‘শান্তিনিকেতন’ নামের দুটি ঘরানা স্বীকার করেন, তবে এঁদের পরিবেশনের মধ্যে দুই সৃষ্টিস্রোতের গঙ্গাযমুনা সমন্বয়ের ধারা খুঁজে পাবেন। গান ধরে ধরে হয়তো তার বিশ্লেষণ করা যায়, কিন্তু তা দীর্ঘ পরিসর প্রত্যাশা করে। সুচিত্রার গান মজিয়ে রাখে আবাল্য, কিন্তু ব্যক্তি আমার কণিকা, নীলিমা, রাজেশ্বরী, ঋতু'র গান 'শুনতে' শেখার শিক্ষা হয়েছে পরবর্তীকালে। এখনও অনেক শেখা বাকি থেকে গেছে। বস্তুতঃ এই শেখার কোনও 'শেষ' নেই। এই উপলব্ধিটি কবির ভাষায় কমলহীরে, যে দিক করেই ফিরে দেখি, নতুন রঙের, নতুন আলোর বিচ্ছুরণ চোখে পড়ে।


'.... লাগলো ভালো, মন ভরালো, এই কথাটাই গেয়ে বেড়াই"

ছোটোবেলা থেকে অসংখ্য মানুষের থেকে শুনেছি 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' শুনলে 'কান্না' পায়। নজরুলগীতির মধ্যে বেশ একটা 'চনমনে' ব্যাপার আছে। একালের বাংলায় এই 'গুণ'টিকে 'সসি পাঞ্চ' বলা যেতে পারে। কবি মলয় রায়চৌধুরির একটি লেখায় পড়েছিলুম, সম্প্রতি সব রবীন্দ্রসঙ্গীতকেই তাঁর শোক সঙ্গীত (মোর্নিং সং) মনে হয়। তিনি অবশ্য স্পষ্ট করেননি ঠিক কোন শিল্পীর গান বা ঠিক কোন কোন লক্ষণ তাঁকে এভাবে ভাবায়। কিন্তু এটা প্রচলিত এবং প্রায় স্বীকৃত একটা ধারণা যে রবীন্দ্রসঙ্গীতে সেই 'পাঞ্চ' নেই যা একালের জীবনযাপনের নবরস'কে ধরে রাখতে পারে। অভিযোগটি খুব অনৃত নয়। নানা ঐতিহাসিক কারণে আমরা দেখি বহুদিন ধরেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নে কণ্ঠ, সুরপ্রয়োগ এবং শব্দ উচ্চারণে প্রত্যাশিত মডিউলেশন শুনতে পাওয়া যায়না। এই অভিযোগটি অবশ্য মূলতঃ অল্পপ্রাণ কিন্তু সংখ্যাগুরু গায়কদের জন্যই প্রযোজ্য। এই গোত্রের গায়কদের 'ফ্ল্যাট' গায়ন, গায়ক হিসেবে তাঁদের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা বা শক্তির অভাবকেই সূচিত করে। কিন্তু প্রশ্ন তুললে তাঁরা 'দিনু'দা' বা 'শৈলজা'দা'কে সাক্ষী মানেন। ততোটা দীক্ষিত নয়, এমন বহুজনশ্রোতাসমাজ টেকনিক্যাল ব্যাপারটা পুরো না বুঝলেও ফাঁকিটা ধরতে পারেন। এইভাবে 'রবীন্দ্রসঙ্গীতে'র বিরুদ্ধে ক্রমাগত অসঙ্গত নানা জনমত গড়ে ওঠে। 


একটা ব্যাপার আমাকে ভাবায়। লোকপ্রিয় বাংলা গানের ঠিক কোন কোন অঙ্গটি মানুষের কাছে অধিকতর আবেদন নিয়ে আসে। স্মার্ট লিরিক, নতুনতর যন্ত্রানুষঙ্গ না সফল মেলোডির জাদু। হয়তো সব গুলিই বিভিন্ন মাত্রায় । তবে সময়ের সঙ্গে দ্রুততর বদলায় লিরিকের প্রকাশভঙ্গি এবং নতুনতর যন্ত্রসঙ্গত বা সহযোগী সুরবিন্যাস। মেলোডির কাঠামোর মধ্যে কিন্তু ততো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেনা। সময়ের সঙ্গে মেলোডির বিবর্তনের অন্যতর সূত্র রয়েছে। লিরিক ও যন্ত্রানুষঙ্গের ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচার করা অনেক সহজ, কিন্তু মেলোডিকে বিকৃত করার ঝুঁকি সুরকাররা নিতে চান'না। কারণ অধিকাংশ শ্রোতা শুধু কানে শুনে সঙ্গীতের মান নির্ধারণ করেন। কাব্যগীতির ক্ষেত্রেও লিরিকের প্রাথমিক আবেদন সুরের সঙ্গে তার নির্ভার মিশে যাওয়ার নৈপুণ্যে। লিরিকের গুণগত মান বা গভীরগামিতার প্রশ্ন আসে পরবর্তী স্তরে। এই স্তরে পৌঁছোনো শ্রোতার সংখ্যা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম। বিশেষতঃ আজকের শ্রোতার কাছে ভাবার সময় অল্প। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতার তাৎক্ষণিক ভালো লাগার মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। সাধারণ শ্রোতার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা আগে ছিল। এখন তার অনুপাত অনেকটা বেশি। প্রশ্ন, আজকের শ্রোতার কাছে পৌঁছোনোর জাদুটি কী? 

কমবয়সে গানবিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু স্বপ্ন ছিলো। তিনি ভেবেছিলেন, কোনও ভবিষ্যতে আমরা 'সঙ্গীতেই কথাবার্তা কহিব' বা ' সঙ্গীতই আমাদের অনুভাব-প্রকাশের ভাষা হইয়া দাঁড়াইবে'। এইসব ভেবেই তিনি শান্তিনিকেতনে ছেলেদের জীবনে গানশেখা বা গাওয়ার ব্যবস্থাটিকে একটা নৈসর্গিক অনিবার্যতার মতো ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। গান যে রোগশয্যায় ওষুধের মতো শুশ্রূষা এনে দিতে পারে, তা তিনি সেই অতীতেও অনুভব করেছিলেন এবং 'গৃহপ্রবেশ' নাটকে সে রকম একটি পরিস্থিতিও সংযোজিত হয়েছিলো। অর্থাৎ সঙ্গীত শুধু একটা শ্রাব্য বিনোদনমাত্র নয়; তাঁর এই ধারণা ও আমাদের আজকের অভিজ্ঞতা বলছে গান শোনা শুধু বিমূর্ত উপভোগ নয়। এ ব্যাপারে একটা ক্রমবিবর্তন আমাদের চোখে পড়ে। সামূহিক শ্রোতাসমষ্টির কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সমাদর হঠাৎ বেড়ে যায় চল্লিশের দশকে যখন পঙ্কজকুমার চলচ্চিত্রে নিজে এবং সহগলসাহেবকে দিয়ে ক্রমাগত রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করতে থাকেন। গানের যে একটা ভিজ্যুয়াল সফলতাও রয়েছে সেটা এভাবে সপ্রমাণ হয়। পরবর্তীকালে হেমন্তকুমার বা কিশোরকুমারের সুবাদে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে জনগণেশের স্বীকৃতিটি পাওয়া সহজ হয়ে যায়। চলচ্চিত্র মাধ্যমটি স্বপ্রতিষ্ঠ হবার পর তাঁদের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতও জনপ্রিয় হতে থাকে। বৃহত্তর শ্রোতাসমাজের কাছে পৌঁছোনোর বাহন হিসেবে দৃশ্যমাধ্যমের সফলতার কিছু অংশ শ্রাব্যমাধ্যমেরও নসিব হয়ে যায়। এর মানে এই নয় যে হেমন্ত ও কিশোরগীত রবীন্দ্রসঙ্গীতের লোকপ্রিয়তা তাঁদের চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংলিপ্ত থাকার সুবাদেই হয়েছে। সেই সব গান অবশ্যই নিজস্ব নৈপুণ্যে উজ্জ্বল। কিন্তু এই মাধ্যমের সঙ্গে তাঁদের সংযোগ থেকে তাঁরা শিখেছিলেন কার্যকরীভাবে অধিকতর শ্রোতার সঙ্গীততৃষ্ণাকে স্পর্শ করা যায়। পরিবেশনে স্পষ্ট, কিন্তু সংযত নাটকীয়তার ছোঁয়া থাকলে সাধারণ শ্রোতার কাছে এই সব গান সহজে গৃহীত হয়। এই সত্যটি দেবব্রত বিশ্বাস, চলচ্চিত্র নয়, তাঁর গণনাট্যের দিনের স্বতোৎসার জনসংযোগের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন। সঙ্গীতের মাধ্যমে সফল জনসংযোগ করতে পারার ক্ষমতাই পঙ্কজকুমার, কুন্দনলাল সহগল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস বা কিশোরকুমারের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাফল্যের মূল কারণ। অবশ্য তাঁদের অতুলনীয় 'ন্যাচরল' কণ্ঠসম্পদ, যার অভিঘাত শ্রোতাদের সহজেই মুগ্ধ করে । নিঃসন্দেহে এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য, পঞ্চাশের দশক থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মুখ হিসেবে সফলতম যে ত্রয়ী শিল্পী নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা মিত্র, তিন জনেই গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে অল্পবিস্তর ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন। অধিকন্তু এর সঙ্গে একটা প্রাসঙ্গিক ব্যাপারও মনে রাখা দরকার, উল্লেখিত শিল্পীদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক অপেক্ষাকৃত কম শক্তির অনুকারকেরা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন চিরকাল। কেউ কেউ কিছু মাত্রায় সফলও হয়েছেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। রবীন্দ্রসঙ্গীত নাটকীয়তার কতোটা চাপ সইতে করতে পারে সেই বোধ পূর্বোক্ত শিল্পীরা সাধনার মাধ্যমে পেয়েছিলেন। কিন্তু নিছক অনুকারী শিল্পীরা সেই বোধ অর্জন করতে পারেননি। গানের চেয়ে নাটকই অধিক উপজীব্য হয়ে পড়েছিলো তাঁদের কাছে। সে কারণে তাঁরা কিছু সাময়িক লোকপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন একটি পর্বে। 


এই যে নাটকীয়তার লক্ষণ, অথবা বলা ভালো, আবেগের পরিমিত নাট্য অভিব্যক্তি, তার সফলতম প্রয়োগ আমরা দেখেছি দেবব্রত বিশ্বাস এবং সুচিত্রা মিত্রের পরিবেশনে। সচরাচর রবীন্দ্রসঙ্গীতের বহু কুশল শিল্পীকেও দ্বিমাত্রিক ( সুর ও লয়/ তাল) পরিবেশনের বাইরে গিয়ে ঝুঁকি নিতে সেকালে বিশেষ দেখা যায়নি। আগেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যেও যে নাট্যমাত্রা আনা যায়, সেটা প্রথম পাই পঙ্কজকুমারের ঘরানায়। গানের মধ্যে যে সংলাপ তার শুদ্ধ বিবরণীপাঠ না করে যদি তাতে 'রক্তমাংস'এর মানবিক মাত্রা (পড়ুন, নাটকীয় আবেগ) যোগ করা যায়, তবে তা দৈবী মন্ত্রপাঠের ঊর্ধে গিয়ে মানুষের কাছে বেশি পৌঁছোয়। এই 'আবেগ' কতোটা স্বীকারযোগ্য তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। প্রশ্নটা আজকের দিনে খুব প্রাসঙ্গিক, কারণ শিল্পীদের মধ্যে এই স্বাধীনতাটির অপপ্রয়োগ বেশ দেখা যাচ্ছে। জর্জদার মেধা ও সংযম ছিলো অতি উচ্চকোটির। কিন্তু তাঁকে হনুকরন করে নিম্ন বা মধ্য মেধার গায়করা শৈল্পিক সীমারেখাটির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারবে না। হয়তো সেটাই ছিল সঙ্গীতবোর্ডের আশঙ্কা। মনস্ক শ্রোতাদের এমত আশংকাও একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না হয়তো। 


এই সব আশঙ্কার কতটা ভিত্তি আছে তা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রবীন্দ্রসংস্কৃতি নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি যথেষ্ট তলিয়ে ভাবেননি। তাঁরা যান্ত্রিকভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনে নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। কিন্তু আশির দশক থেকে সাধারণ বাঙালি শ্রোতার শ্রবণ রুচির একটা ভূমিগত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল। ঘটনাটি এই সব নিয়ন্ত্রকদের নজরে পড়েনি। সেই সময় রবীন্দ্রসঙ্গীতের যাঁরা তারকা শিল্পী ছিলেন, তাঁরা স্বধর্মচ্যুত হয়েছিলেন, আমার এমন কখনো বোধ হয়নি। কিছু শক্তিমান শিল্পী, যেমন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সাগর সেন, চিণ্ময় চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ লোকপ্রিয় শিল্পীদের ঐ সব নিয়ন্ত্রকরা বিশেষ কল্কে দিতেন না। কিন্তু কেন দিতেন না , তার কারণও কখনো স্পষ্ট করেননি। অশোকতরু বন্দোপাধ্যায় বা অর্ঘ্য সেনের মতো শিল্পীদের নিজস্ব অনুরাগী শ্রোতা সমূহ ছিলো। তবে তাঁদের প্রতিও প্রাতিষ্ঠানিক ধ্বজাধারীরা বিশেষ আগ্রহী ছিলেন বলে বোধ হয়নি। এঁদের তালিকার বাইরেও কিছু আরও শিল্পী ছিলেন যাঁরা দু'তিন দশক পরে জন্মালে এই মূহুর্তের মুখ্য শিল্পীদের তুলনায় উৎকর্ষের বিচারে অনেক উপরে থাকতেন। এই মূহুর্তের কিছু বাজারকাঁপানো রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পীর প্রধান কৃতিত্ব তাঁরা তিন/ চার দশক পরে জন্ম নিয়েছেন। এই প্রশ্নে আবেগ যতোটা কাজ করে, মনন ততোটা করেনা। ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে যায় প্রজন্মগত কলহে। ব্যক্তিগত রুচিপছন্দ নিয়ে তর্ক করে কিছু প্রতিষ্ঠা করা যায়না, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত যে মিঠে গলায় গানের ঊর্ধে আরও কিছু দাবি করে, শিল্পী ও শ্রোতা উভয়ের থেকে, এই সত্যটি উপলব্ধি থেকে আসে, তর্ক থেকে নয়। বহুধরনের গান গেয়েও যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের নোঙরে বাঁধা থাকা যায় তার প্রমাণ দিয়েছেন অনেক শিল্পী। পঙ্কজকুমার, কুন্দনলাল ও হেমন্ত ব্যতিরেকে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের নাম তো আনাই যায়। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মে সক্ষম গায়কের অভাব না থাকলেও যে এক্স ফ্যাক্টর থাকলে একটা সাধারণ বাংলা কাব্যগীতির থেকে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে আলাদা করে চেনা যায়, সেই বোধের পর্যায়টি নতুন গায়করা ঠিক ছুঁতে পারেননি। ফুল ফুটিয়ে তোলার সামর্থ্যটি শুধু কণ্ঠসম্পদ, সুর লাগানো বা জনগণেশের সময়বদ্ধ রুচির নিরিখে বিচার করা যায়না। সম্প্রতি রাঘব চট্টোপাধ্যায় নামের একজন লোকপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীর রবীন্দ্রসঙ্গীত মানুষ আগ্রহ নিয়ে শুনছে। টিভির বিভিন্ন 'প্রতিভাসন্ধান' প্রতিযোগিতা থেকে উঠে আসা নবীন শিল্পীরা বিভিন্ন জনবহুল শ্রোতা সমাগমে 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' পরিবেশন করছেন। লোকে শুনছে, তাই বলে কি গায়নধারাটিকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসেবে স্বীকার করা যায়? প্রশ্নটা শুদ্ধতাবাদের নয়। আবার ফিরে আসি যেখান থেকে শুরু করেছিলুম। প্রকাশ্যে কবির গান গাইতে যাবার আগে কী তাঁরা কবিকথিত 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্যে'র সাধনাটি সমাপন করেছেন?


(ক্রমশ)

0 comments: