স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস
Posted in স্মৃতির সরণী
স্মৃতির সরণী
কথামালা
বিপুল দাস
৭
কোথাও কি ফাঁকি ছিল? না কি যে জনজোয়ারে উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা দেশ, তাকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারেনি পার্টি। আমার মনে হয়েছে পরেরটাই ঠিক। দেশের সেরা শিক্ষায়তন থেকে সেরা মেধা নিয়ে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্রদল। বুকের ভেতরে একটা আদর্শ নিয়ে মরণকে উপেক্ষা করে, সব জাগতিক সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছিল ওরা। অন্ধের চীনের বিপ্লবনীতিকেই অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। তাকে ভারতীয়করণ বা বঙ্গীয়করণের প্রয়োজন আছে কিনা, কেউ সেই প্রশ্ন তোলেনি। সব মাটিতে এক ফসল ফলে না। মাটির চরিত্র আলাদা হলে ফসল ফলানোর তরিকাও আলাদা হয়। চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান -- এই শ্লোগান ব্যর্থ হয়েছে দূরদর্শিতার অভাবে। ভারতীয় জাতীয়তাবোধের অভিমানকে বুঝতে না পারার জন্য। ক্ষেত্র প্রস্তুত – এই ধারণাও সম্ভবত ভুল সংকেত দিয়েছিল বিপ্লবীয়ানাকে।
“আমাদের মনে রাখতে হবে নকশালবাড়ির আন্দোলনই সংশোধনবাদ এবং বিপ্লবী মার্ক্সবাদের পার্থক্য স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে। একটি স্ফুলিঙ্গ যেমন দাবানল সৃষ্টি করতে পারে, তেমনই এই সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গ দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতবর্ষজুড়ে। আমাদের হৃদয়ে জাগিয়ে রাখতে হবে কমরেড মাও সে তুং-এর চিন্তাধারা। এই লাইন মার্ক্সবাদ—লেনিনবাদকে বুর্জোয়া শ্রেণী ও সংশোধনবাদসহ প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীর হাত থেকে রক্ষা করেছে, তাকে বিকশিত করেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবই ভারতবর্ষের মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ”।
এই পথে নেমে এসেছিল যাঁরা, কথাগুলো অন্তর থেকে বিশ্বাস করেছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজ, দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ উত্তাল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদ-মেশিনে তৈরি হচ্ছে দেশি অস্ত্র। ওদিকে তৈরি হতে শুরু করল নক্শালদের জন্য মানবতাবিরোধী দমননীতির পলিসি। নির্বিচারে হত্যা, সন্দেহবশে যে কোনও ব্যক্তিকে আটক করে রাখার ক্ষমতা, লক-আপে খুন, মিথ্যে এন্কাউন্টার দেখিয়ে বন্দী বিপ্লবীদের গুলি করে মেরে ফেলা। অবস্থা পালটে যাচ্ছিল। কিছু ব্যাপারে সাধারণ মানুষ আর তাদের সমর্থন করছিল না। কে শ্রেণিশত্রু, আর কে নয় – এটা বোঝা যাচ্ছিল না। গ্রামের সাধারণ জোতদার, স্কুলের শিক্ষক, বা বিরোধী নেতা – শ্রেণিশত্রুর চরিত্র নির্ধারণে কোথাও গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল। আর, বাংলার সব মেধাবী যুবার উজাড় হয়ে যাওয়া। ক্রমশ বিরোধী প্রচার আরও জোরদার হয়ে উঠছিল। ক্রমশ জনসমর্থন হারাচ্ছিল নক্শাল আন্দোলন। চোরডাকাত, গুণ্ডাবদমাশও অন্যায় করে ‘নক্শাল’ পরিচয় দিয়ে বুক ফুলিয়ে চলে যেতে শুরু করেছিল। এসব মনিটরিং-এর কোনও ব্যবস্থা ছিল না। প্রচলিত শিক্ষা-ব্যবস্থাকে বানচাল করে বিকল্প কোনও শিক্ষা-ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়নি। তার আগে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রয়োজন ছিল। তারপর নীতি-নির্ধারণ। সসমাজসংস্কারক মনীষীদের মূর্তি ভেঙে ফেলা কোথাও যেন লেগেছিল চিরকালের মার্জিত রুচি, ধর্মপ্রাণ, বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে অভিমানী মানুষের। তারা এটা ভাল ভাবে নেয়নি। এর সঙ্গে ছিল সরকারি ধামাধরা বুদ্ধিজীবীদের ক্রমাগত বিরূপ প্রচার। বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা চারু মজুমদারের তত্ত্বের অসারতা প্রমাণের চেষ্টা করে গেছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সামাজিক গুণ্ডামি – এ সবের বিরুদ্ধে সুসংহত ভাবে সংগ্রাম করে সর্বস্তরে সাফল্য অর্জন ক্রমশ অলীক হয়ে উঠছিল। সহানুভূতিশীল অংশও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল।
ভুল খোঁজা হচ্ছিল। কোথায় ভুল ছিল? তত্ত্বে, না প্রয়োগে। এই প্রশ্নের উত্তরে সি এম বলেছিলেন –“আমাদের কি কোনও ভুল হয়েছিল? ভুল হবে না – এ কথা কি কেউ বলতে পারে? কিন্তু তা নিয়ে অনুশোচনার দিন তো আজ নয় – আজ দিন আগুনের মত জ্বলে ওঠার, রক্তের ঋণ রক্তের দামে শোধ করার”।
0 comments: