1

প্রবন্ধ - ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


রস-কাহন 
ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য


"... পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও সন্তোষ মজুমদারকে এ্যামেরিকায় পাঠিয়ে, কৃষি ও গোষ্ঠবিদ্যায় শিক্ষিত করে এনে, রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করলেন পল্লী শিক্ষা ভবন, শ্রীনিকেতনের এক রম্য পরিবেশে। 

অগণিত মানুষ যেখানে অনাদর ও অপমানে লাঞ্ছিত। দারিদ্র্য, অনাহার, অশিক্ষাকে জন্ম জন্মান্তরের নিয়তি মেনে নিয়ে তারা জীবন যাপন করে... সেইসব মূঢ়- ম্লান মুখে ভাষা দিয়ে, তাদের শ্রান্ত- শুষ্ক- ভগ্ন বুকে আশা জাগিয়ে তুলতে..." 

মালা চুমন বই থেকে মুখ তুলে, জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো... দিগন্ত বিস্তৃত পান্না- নীল সমুদ্রের দিকে। 

মালার পূর্বপুরুষেরা বিহারের ভোজপুর ছেড়ে সুদূর মরিশাসের মাটিতে পা রেখেছিলেন, চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে। কতদিন কেটে গেছে, এখন মালার পরিবার মরিশাসে সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতির সান্নিধ্যে বড় হয়ে উঠেছে মালা। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে, এখন তার ইচ্ছে কৃষিবিদ্যা পড়ার...মাতৃভূমি ভারতবর্ষে। রবীন্দ্রনাথ তার দীক্ষাগুরু। তাঁর গানে মালা খুঁজে পায় জীবনদর্শনের সত্য। সব কিছুই ঠিক হয়ে গেছে, ক'দিন পরেই যাত্রা করবে মালা শ্রীনিকেতনের উদ্দেশ্যে। একবার ভারতবর্ষে পৌঁছোতে পারলে হয়... ঘুরে ফিরে দেখবে পুরো দেশটাকে। 

তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরমে এসে পৌঁছলো মালা, চাচা মহেশ চুমনের বাড়িতে। চাচার কাছে কিছুদিন কাটিয়ে সে যাবে কলকাতা এবং শ্রীনিকেতনের কৃষিবিদ্যালয়ে।

রাতে চাচীর কাছে, রান্নাঘরে বসে গল্প করছিল মালা। একটা সাদা রঙের পানীয়ের বোতল আর চারটে গেলাস মালার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চাচী বললেন, 'যা তো চাচাকে দিয়ে আয়...ওর বন্ধুরা এসেছে।'

'এটা কী চাচী?'

'কাল্লু...'

'কাল্লু কী হয়?'

'আমি অতশত জানি না, চাচাকে জিজ্ঞেস কর...দারু বোধহয়।

চাচার কাছে গিয়ে মালা বললো, 'আমি ঢেলে দিই, এটা কী পানীয় চাচা? চাচী বললেন দারু!'

'দারু!' হাসলেন মহেশ চুমন। 'চেখে দেখবি নাকি?'

চাচা আর তাঁর বন্ধুদের গেলাসে কাল্লু ঢেলে দিয়ে মালা নিজের জন্যেও অল্প একটু নিলো, স্বাদ চাখবার জন্যে। 

'আররে চাচা, এ তো পোয়ো...না কি কোকোটি?' 

হাসতে হাসতে চাচা বললেন, 'এথা কাল্লু। খেজুরের রস দিয়ে তৈরি। এতে এ্যালকোহলের মাত্রা খুবই কম, স্বাদও মিষ্টি। থাডি কাল্লু তৈরি হয় তালগাছের রস দিয়ে...সে একটু কড়া পানীয়। স্বাদ টক আর তেঁতো মেশানো। এই পানীয় আমার নিজের বাগানের খেজুরের রস দিয়ে তৈরি।'

'চাচা, আপনে তো মেরা দিন বনা দিয়ে। আমি ভারতে বসে আমার প্রিয় মরিশাসকে ফিরে পেলাম। আমি তো শ্রীনিকেতন যাচ্ছি চাচা, কৃষিবিদ্যা পড়তে। আজ, এক্ষুনি আমি মনস্থির করে ফেললাম, আমার গবেষণার বিষয় হবে "পাম ওয়াইন"। কাল তোমার বাগিচা ঘুরিয়ে দেখাবে তো, আমাকে? এখন তো শীতকাল...এই সময়েই তো খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়, তাই না? মরিশাসে তো এখন গরম, আম পাকছে।' একটু উদাস হয়ে পড়লো মালা, নিজের দেশের কথা মনে পড়াতে।

চাচাকে পাগল করে তুললো মালা। ভোর না হতেই সে তৈরি, বাগান দেখতে যাওয়ার জন্যে। চাচা গাড়ি বের করে ভাইঝিকে নিয়ে চললেন, তাঁর খেজুর ফার্মে। 

'এই দেখ, আমরা পৌঁছে গেলাম খেজুর বাগানে। সংস্কৃত নাম খর্জুরম্‌। এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম 'ফিনিক্স ড্যাক্টিলিফেরা' মানব সভ্যতার ইতিহাসে খেজুর ফলনের গল্প অতি প্রাচীন। মরু এলাকায় এই ফল ভাল হয়। ভারতীয় খেজুর খাওয়ার উপযুক্ত না, সেই জন্যেই বোধহয় এই গাছের রস বার করে নেওয়ার প্রথা চালু হয়েছে। আরব দেশের খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করায় বাধা আছে, কারণ ধার্মিক না কি সামাজিক সে'কথা বলতে পারব না। আমাদের দেশের খেজুর খাওয়া যায় না তাই গাছের পাতা কেটে নিলে বা গাছের গায়ে ক্ষত করে রস বের করে নিলে, বিশেষ সমস্যা হয় না। আরবী খেজুর মিষ্টি আর শাঁসালো তাই গাছগুলিকে বাঁচাবার জন্যে হয়তো রস বার করে নেওয়ার বিরোধিতা করে তারা কিন্তু আমাদের দেশে, পুরো খেজুর গাছটাকে আমরা যেভাবে কাজে লাগাই, তা জানলে তুই অবাক হয়ে যাবি মালা।' 

'তুমি বলো চাচা, আমার খুব ভাল লাগছে শুনতে। আমি বিশদ জানতে চাই, খেজুর জাতীয় সব রকমের পাম গাছের সম্বন্ধে। কিছু আফ্রিকান দেশ ও মরিশাসে তাল গাছের রস থেকে বানানো পানীয়কে পোয়ো আর নারকেল গাছের রস থেকে তৈরি পানীয়কে কোকোটি বলে। মরিশাসে নারকেল আর আখের চাষ তুলনামূলক ভাবে বেশি। চাচা, মরিশাস হলো পৃথিবীর অন্যতম প্রধান চিনি উৎপাদনকারী দেশ আর তোমার নিশ্চয়ই অজানা নেই যে সে দেশ বিখ্যাত 'রম' এর জন্যে... যা আবার তৈরি হয় আখের রস থেকে। কত বিভিন্ন রকমের রম তো তুমি নিয়ে এসেছিলে মরিশাস থেকে।'

ঘুরে ঘুরে দেখছিলো মালা, অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে। কোনও কোনও গাছে চড়ে রয়েছে রস সংগ্রহকারীরা... যে গাছগুলোতে চ্যানেল বানানোর কাজ চলছে, রস নামাবার জন্যে। বাকিগুলোতে হাঁড়ি বাঁধা। রসে ভরে উঠলেই, হাঁড়ি নামিয়ে নেওয়া হবে। 

খেজুরের রসে ভরা হাঁড়ি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো, চাচার ড্রাইভার যাদুকুমার চন্দ্রশেখর। চাচা হেসে বললেন, 'খেজুরের তাজা রস খেয়ে দেখ মালা, খাসনি বোধহয় আগে।'

গেলাসে চুমুক দিয়ে তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেললো মালা। 'কী মিষ্টি রস...কী অপূর্ব স্বাদ চাচা।'

'না রে, তামিল নাডুর খেজুর- রস তত মিষ্টি হয় না। শীত পড়ে না তো এখানে। ভারতের শীতপ্রধান অঞ্চল গুলোর খেজুর- রস তুলনামূলকভাবে ঘন হয় আর মিষ্টিও। তোর যখন এত আগ্রহ, কাল তোকে আমার বন্ধুর তাল-বাগানে নিয়ে যাব। ও পদনীর আর তালগুড়ের ব্যবসা করে।'

'তালগুড়! সে কেমন হয় চাচা? আমি কখনও নামই শুনিনি। খেজুর গুড়ের কথা জানি আমি। আমার বাঙালি বন্ধু আমাকে খেজুর গুড় আর সেই গুড়ে বানানো মিষ্টি খাইয়েছিলো... কলকাতা থেকে মরিশাসে নিয়ে এসেছিলো। আহ হা, সে যে কী স্বর্গীয় স্বাদ। আমি তো এখান থেকে কলকাতায়ই যাব, কী মজা অনেক গুড় আর মিষ্টি খাব।'

উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকে মালা, তাল- খেজুর- নারকেল গাছ আর তার কাণ্ড আর ফুল থেকে উৎপন্ন রস ও তার নানাবিধ ব্যবহার সম্বন্ধে জানবার জন্যে... আর সবুর সইছে না তার। চাচার বাড়িতে তো ইন্টারনেট নেই, থাকগে... পরে ভাবা যাবে। গত রাতে অনেক খোঁজাখুঁজি করে, খেজুর চাষের ওপরে একটা বই পেয়েছে মালা চাচার ঘরে। চাচার অনুমতি নিয়েই সেই বই তৎক্ষণাৎ বাক্সবন্দি করেছে সে। সারা ভারতবর্ষ ঘোরার ইচ্ছে মালার, রেলগাড়িতে করে। প্রকৃতি মায়ের রূপদর্শনের অন্যতম উপায় ট্রেনে- বাসে, গ্রামে- গঞ্জে ঘোরা ফেরা। স্থানীয় মানুষের সঙ্গেও পরিচয় হয়, জানা যায় কত অজানা কথা। 

প্রায় পাঁচ বিঘা জমি জুড়ে শিবরামাকৃষ্ণণের তাল- বাগান। মোটামুটি ইংরিজি বলতে পারেন শিব চাচা। ভাষা শেখার প্রতি মালার আকর্ষণ খুব বেশি। মরিশাসের কসমোপলিটান সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠার ফলে মালা জানে ইংরিজি, হিন্দী, স্থানীয় কথ্য ভাষা ক্রেওল আর ফ্রেঞ্চ। বাঙালি বন্ধুর সংখ্যা বেশী হওয়ায় আর তার রবীন্দ্র প্রীতি তাকে বাংলা ভাষার প্রতিও আকর্ষিত করেছে...বাংলা মালা বুঝতেও পারে মোটামুটি, বলতে পারে না, কিন্তু চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় সে।

শিব চাচার পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকলো মালা। জানতে পারলো এক বিঘা জমিতে প্রায় এক- দেড়শ' তাল গাছ লাগানো হয়। গাছ বাড়তে সময় লাগে প্রায় ছ'- সাত বছর। তার পরেই রস পাওয়া যায় তার ফুল বা জটা থেকে। খেজুর রস শীতকালে পাওয়া গেলেও তালের রস সংগ্রহ করা হয়ে থাকে ফাল্গুন থেকে জৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত। রসের জন্যে হাঁড়ি বাঁধার সময়ে তার মধ্যে কয়েক ফোঁটা চুন দিয়ে থাকেন গাছিরা, রস পরিষ্কার থাকে তাহলে, গেঁজিয়ে ওঠে না চট করে।

তালের রস দিনের তিন ভাগে সংগ্রহ করা হয়, ভোর- দুপুর ও বিকেলে। ভরা মৌসুমে প্রতি দশটি গাছ থেকে প্রায় ৫০-৬০ লিটার রস পাওয়া যায়। এক একটা গাছের রস বিক্রি করে, মাসে মোটামুটি এক থেকে দেড় হাজার টাকা পাওয়া যায়। ১০-১৫ হাজার টাকা লাগিয়ে, মাসে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা যেতে পারে। 

শিব চাচা বললেন, 'তালের রস অত্যন্ত মিষ্টি আর সুস্বাদু। গরম কালে তালের রস ক্লান্তি দূর করে। আমাদের এখানে বিশেষ দেখা না গেলেও বাংলায় তালের রসের উপযোগিতা অনেক রকম। আমাদের এখানে তালের গুড় আর মিছরি বানানো হয়। বাংলাতে নানারকম মিষ্টি খাবার তৈরি হয় তাল- রস দিয়ে। তামিল নাডুর তুলনায়, দক্ষিন ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে তাল খেজুরের চাষ বেশি হয়।' 

সব কিছু খাতায় লিখে নিলো মালা। 

কথা বলতে বলতে শিব চাচা আবেগপ্রবন হয়ে পড়ছিলেন। 

'আমার বাবার কাছে শুনেছি, তিনি একবার গান্ধীবাবার ভাষণ শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন বৃন্দাবন বিহারে, গ্রামশিল্প প্রদর্শনীতে...দাঁড়াও দাঁড়াও মালা, আমার তারিখটাও মনে আছে। ১৯৩৯ সালের ৩রা মে। অন্ধ্রপ্রদেশে ঘরে ঘরে তালগুড় বানানো হয় দেখে গান্ধীজী তাঁর ভাষণে বললেন..."এইভাবেই হয়তো একদিন দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করা যাবে। আখের রস থেকেও তো গুড় তৈরি করা হয়, কিন্তু তার থেকে উত্তম তাল- খেজুর বা নারকেল রসের গুড়। বৈদ্য আমাকে গুড় খাবার নির্দেশ দিয়েছেন, আমি সর্বদা তালগুড়ই খাই। এই দ্রব্য কারখানাতে মেশিনের সাহায্যে বানানো যায় না... গ্রামীণ ও কুটীর শিল্পের উন্নয়ন হয় গুড়ের উৎপাদনে।" 

ফিরতি পথে মালাকে শিব চাচা তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। চাচী এলেন, ঘী-রঙের ঈষদুষ্ণ পানীয়ের গ্লাস নিয়ে। তাঁর হাতের প্লেটে হাল্কা হলুদ রঙের, সাদা চকোলেটের মতো দেখতে চৌকো চৌকো টুকরো। একটা টুকরো তুলে মুখে দিতেই আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে এলো মালার। ফ্রেঞ্চ ক্যারামেল চকোলেটের কথা মনে পড়ে গেলো। মরিশাসে ফ্রান্সীয় প্রভাব বেশী হওয়ায়, এই ধরনের বস্তু সেখানে প্রচুর। 

'কী চাচী এগুলো, এখানেও ফ্রেঞ্চ চকোলেট পাওয়া যায়?' চাচা- চাচীর হাসি আর বন্ধই হতে চায় না। 

'মালা, এগুলো তালগুড়, গরমে তৈরি করা... আমি রেখে দিই, অসময়ে ভাল লাগে। তাল- ফুল থেকে সংগ্রহ করা রস ফুটিয়ে বানানো হয়।'

'আর এই পানীয়, চাচী? কী ভীষণ সুস্বাদু।' অভিভূত মালা বলে ওঠে।

'তাল মিছরী আর ছোট এলাচের গুঁড়ো দিয়ে দুধ ফুটিয়ে নেওয়া। এখন তো তালশাঁস পাওয়া যায় না, গরমের সময়ে এই শরবতে টুকরো করা তালশাঁস দিয়ে অতিথি নারায়ণের আপ্যায়ন করা হয়। কেউ কেউ আবার নারকেলের দুধও ব্যবহার করেন। গরমে কাঁচা তালের শাঁস শরীরকে স্নিগ্ধ করে।' চোখ বড় করে চাচীর কথা শুনতে থাকে মালা। 

'তোমাদের এখানে আসবার আগেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তাল- খেজুরজাত উৎপাদনের ওপরে আমার রিসার্চের ব্যাপারে। তোমার কাছ থেকে এইসব খবর পেয়ে আমার সিদ্ধান্ত আরও দৃঢ় হলো। 

'তালের রস, আর তা' থেকে বানানো গুড় এবং মিছরির অনেক গুণ মালা। ডায়াবেটিক রোগীরাও কিন্তু তালগুড়, তালমিছরি আর তালরস খেতে পারেন, অপকার হয় না। তালরস নানাবিধ ভিটামিন ও মিনারেলে সমৃদ্ধ। তবে অবৈধ ব্যবসায়ীরা আজকাল এই রস থেকে নেশাদ্রব্য তৈরির কাজে মেতে গেছে। সকালের তাজা রস, একটু বেলা হলেই গেঁজিয়ে ওঠে, পরিবর্তিত হয় মাদকদ্রব্যে। এই মাদক খুব হাল্কা, শরীরের বিশেষ ক্ষতি করে না। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সস্তা নেশাদ্রব্য মিশিয়ে কাল্লুকে এক ক্ষতিকর মাদকদ্রব্যে পরিণত করে জন সাধারণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে... বিপথগামী হয়ে পড়ছে কিশোর- যুবকেরা।' 

কলকাতা যাওয়ার পথে, করমণ্ডল ট্রেনে উঠেই গুগল সার্চ করতে বসলো, উত্তেজিত মালা চুমন। তার মনে প্রশ্ন জেগেছে, কবে থেকে আর প্রথম কোথায় এইভাবে তাল- খেজুর- নারকেল রসের ব্যবহার শুরু হলো। 

*(https://sites.google.com/a/myth)

www.fanchildgarden.org

তাল-খেজুরের রসের উৎসের যথার্থ খোঁজ তো পাওয়া গেলো না, তার ইতিহাস বেশ ভালরকম কুয়াশাতে ঢাকা। প্রত্নতত্ত্ববিদেরাও কোনওরকম অবশেষের কথা জানাতে অসমর্থ হয়েছেন, যার থেকে এই রসের উৎসস্থলের সম্বন্ধে খবর পাওয়া যায়। প্রাক হিস্প্যানিক(স্পেন দেশীয়) অধিবাসী 'প্লাইনি দ্য এল্ডার' এর নেচারালিস হিস্টোরিয়াতে(এ ডি ২৩-৭৯) মৌরেটানিয়ার রাজা দ্বিতীয় জুবারের (বি সি ২৫- এ ডি ২৩) উল্লেখ আছে যিনি খেজুর জাতীয় 'পাম উপবনের' হদিশ দিয়েছিলেন... এছাড়াও বেশি রকম মধু উৎপাদনের উল্লেখও পাওয়া যায়, যা কি না 'তাল- খেজুর' পাম জাতীয় বৃক্ষ থেকে প্রাপ্ত মিষ্টি রস হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী কিন্তু মৌমাছি দ্বারা সৃষ্ট মধুর কথাও ফেলে দেওয়া যায় না... তবে এই কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে খৃষ্টজন্মের বহু আগে থেকেই পাম জাতীয় গাছের রস বের করে নেওয়ার চলন শুরু হয়েছিল। বিখ্যাত কাহিনীকার ও ইতিহাসবিদ প্লিনিয়াসের লেখাতেও এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। 

তাল জাতীয় বৃক্ষরসের উৎসস্থল সম্বন্ধে নিশ্চিত কোনও জ্ঞান পাওয়া না গেলেও অনুমান করা হয়, ইন্দোনেশিয়ার উত্তর সুলেওয়াসীতেই প্রথম এই রসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলো। আখের চাষ এবং রসের অনেক আগে থেকেই তালগুড় বা তালচিনির ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে তালগাছের চাষ বিশেষ রকম বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বোত্তম তাল ফলনের সিংহভাগ পাওয়া যায় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়। এই রসে 'বুনো ইস্ট' অথবা বন্য- খামিরের উপস্থিতি রসকে তাড়াতাড়ি গেঁজিয়ে তোলে। গেঁজিয়ে ওঠাকে রোধ করতে, চুনের ব্যবহার দেখা যায়... যা রসকে আরও সুস্বাদু করে তোলে। তাল জাতীয় বৃক্ষ (তাল- খেজুর- নারকেল) থেকে পাওয়া রসের আবিষ্কার প্রাচীন এবং তা ছড়িয়ে আছে আফ্রিকা, এশিয়া ও এ্যামেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন স্থানেও। তাজা রস পান করা হয়, রস থেকে চিনি বা গুড় তৈরি হয়, এই রসকে গেঁজিয়ে তুলে সুরা বা ভিনিগারে পরিবর্তিত করা হয়। জল মেশানো দুধের মতো সাদাটে এই মাদক পানীয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত।

ক্যামেরুনে 'পাম ওয়াইন' কে বলা হয় 'মাতাঙ্গো'। মরিশাস এবং সিয়েরা লিওনে এই পানীয় 'পোয়ো' নামে পরিচিত। 'তান হে' বলে মায়ানমারের অধিবাসীরা। পাম ওয়াইনের জন্য বিখ্যাত ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়ায় এই পানীয়ের নাম 'তুয়াক'। শ্রীলঙ্কানরা বলে 'থাল রা'। উত্তর ও পূর্ব ভারতে এই মাদক পানীয় 'তাড়ি' নামে প্রসিদ্ধ। 

ট্রেনের জালনা দিয়ে বাইরের তাল- খেজুর- নারকেল গাছের সারি দেখতে দেখতে বেশ একাত্মতা বোধ করে মালা, এই বৃক্ষরাজির সঙ্গে। দু'দিনেই তাদের সঙ্গে যেন আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে। এই পাম গাছগুলির কিছু পরিচয় পেয়েছে মালা, অনেক কিছুই রয়ে গেছে অজানা। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়াতে, নিজের মনেই হেসে ওঠে মালা। নাইজিরিয়া থেকে মরিশাসে বেড়াতে আসা একটি ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো একবার, এক বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে। সেখানেই শুনেছিলো মালা, নাইজিরিয়ার অদ্ভুত রীতির কথা... সানি আবাচা বলেছিলো, 'আমার বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে, যখন আমি প্রথমবার আমার হবু শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম... আমাকে পাম ওয়াইন 'ওগুরো' নিয়ে যেতে হয়েছিলো। বিভিন্ন স্থানীয় নাইজিরিয়ান ভাষায় পাম ওয়াইনকে এমু, উকোট, আকোয়া, মান্যা, গ্যা ও বলা হয়। 

সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেলো মালার। বাংলার গ্রাম গঞ্জ দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। রূপসী বাংলার শ্যামলিমায় চোখ আর মন দুইই ভরে গেল তার। কি জানি কোন এক অনামা প্রান্তরে থেমে গেলো হঠাৎ ট্রেনটা... সিগনাল পায়নি বোধহয়। কালো মাটির হাঁড়ি নিয়ে ট্রেনে চড়ে পড়লো কিছু স্থানীয় গ্রামবাসী। আররে তাজা খেজুরের রস, এ কী সমাপতন! কাকতালীয় না কি? পর পর দু'গেলাস খেজুরের রস পান করে উত্তেজিত হয়ে পড়লো মালা। রস খাওয়ার থেকেও বেশী আনন্দ পেলো সে, সেই গাছিদের সঙ্গে আলাপ করে, যাদের নাকি শিউলিও বলা হয়। ভাঙা ভাঙা বাংলা আর হিন্দি মিশিয়ে, তাদের কথোপকথন বেশ ভালই জমে গেলো।

ঝাড়গ্রামের শ্রীরামপুর অঞ্চলের গাছি শ্রীকান্ত মাল একগাল হেসে জানালো, সকাল সকাল খেজুরের মিঠে রসে মাখা মুড়ি দিয়ে পেট ভরিয়ে সে বেরিয়ে পড়েছে রসের হাঁড়ি নিয়ে, বিক্রি করতে। 

'বুইল্যেন দি'ঠারান, ভারতবর্ষে জন্মানো খেজুর শাঁসহীন হয়, খাওয়া যায় না। কোনও কোনও পূজায় লাগে অবিশ্যি। বাংলায় খেজুর গাছের রসই হলো গিয়ে তার প্রধান আকর্ষণ।' 

শ্রীকান্তর কথা মন দিয়ে শুনতে থাকলো মালা, সে ও বলে চলল... এমন আগ্রহী শ্রোতা সে বোধকরি আর কখনও পায়নি আগে। 

'আশ্বিন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ চলতে থাকে। ঠাণ্ডা আবহাওয়া, মেঘলা আকাশ এই রসের যোগানে সহায়তা করে। পৌষ - মাঘের কড়কড়ে ঠাণ্ডায় রস বেশী ঘন আর মিষ্টি হয়। তবে গাছের যত্নের ওপরেও রসের পরিমান ও স্বাদ নির্ভর করে। স্ত্রী বৃক্ষ অপেক্ষা পুরুষ বৃক্ষ থেকে বেশী রস পাওয়া যায় আর তা মিষ্টিও হয় বেশি, কারণ পুরুষ বৃক্ষ তো ফল দেয় না। কার্ত্তিক মাস থেকেই গাছ কাটা শুরু হয়ে যায়। রসের মরশুমে, গাছিরা এতটাই ব্যস্ত থাকে যে তাদের আর মাটিতে পা দেওয়ার অবসর থাকে না। এই রস থেকেই পয়রা, ঝোলা আর পাটালি গুড় বানানো হয়ে থাকে, শেষে তৈরি হয় চিটে গুড়... তিতকুটে স্বাদের জন্যে সে মানুষের খাদ্যতালিকাভুক্ত হয়নি...হ্যাঁ গরুকে খাওয়ানো হয়, বেশ উপকারীও। আমাদের ভাগ্যেও জোটে গুড়ের চা। নাড়ু- মোয়াতে ভাঁড়ার ভরে ওঠে। দি'ঠারান, কথায় কয় 'মাঘের শীত বাঘের গায়'...বাঘা শীতেই রস সংগ্রহ, গুড় তৈরি আর বিক্রিও শেষ করে ফেলতে হয়। বছরের রোজগারও বাক্সবন্দী হয়... তারপরে শুরু হয় টিপে টিপে পথা চলা। আজকাল গাছপালা কেটে রাস্তা, কল- কারখানা, বসতবাড়ি তৈরি হচ্ছে। বর্ষা, শীত সবই কমে গেছে, খেজুরের রস ঘন হচ্ছে না। চাহিদা বেড়ে যাওয়ার জন্যে গাছের সংখ্যা বাড়লেও, রস আর গুড়ের মান নেমে গেছে।'

হাওড়া স্টেশনে নেমে, আতান্তরে পড়লো মালা। বাপ্‌রে বাপ্‌, এ যে জনসমুদ্র। কলকাতায় এক বন্ধুর বাড়িতে ওঠার কথা তার...দ্যুতিশ, সে ও শ্রীনিকেতনে পড়তে যাবে মালার সঙ্গেই। কিন্তু... কীভাবে পৌঁছোবে তার বাড়ি? ভিড় থেকে সরে গিয়ে, একপাশে দাঁড়িয়ে ফোন করলো মালা দ্যুতিশকে। বাড়ির ডায়রেকশন নিয়ে, প্রি- পেড ট্যাক্সিতে পৌঁছে গেলো বারাসত। 

'কী সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে রে তিশু। আন্টি কী রান্না করছেন?'

'ক'দিন বাদেই তো পৌষ সংক্রান্তি। আমরা তো থাকবো না সে'সময়ে, তুই প্রথমবার এলি আমাদের বাড়ি... মা পিঠে বানাচ্ছেন তোর জন্যে।' 

'কী সুইট! আমাকে নিয়ে চল আন্টির কাছে, আমিও শিখব পিঠে বানানো... কী বানাচ্ছো আন্টি? আমাকেও শিখিয়ে দাও।'

'আয় মালা, বোস এখানে। কত দূর থেকে এলি... বিশ্রাম কর একটু। আমি বানাবার চেষ্টা করছি আমার বাপের বাড়ির দেশ, যশোরের খেজুর রসের ভিজা পিঠা।' 

এপ্রিল মাসে সেশন শুরু হবে শ্রীনিকেতনে। মালা ঠিক করলো কয়েকদিন সে তার বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে। সারা ভারতের সংস্কৃতির পরিচয় পেতে চায় সে। দ্যুতিশ বললো, 'যা তবে দেরী করিস না। ফেব্রুয়ারিতে শ্রীনিকেতনের বার্ষিক উৎসব হয়... সে নাকি এক দেখার মতো ব্যাপার। সারা ভারতবর্ষকেই পাবি তুই সেখানে।' 

আরা স্টেশনে নেমে রিক্সা নিলো মালা। ছোট চাচা এখনও থাকেন দেশের বাড়িতে, খেতি- বাড়ি করেন। চাচীর আদর- আপ্যায়নে আপ্লুত হয়ে গেলো মালা। মালপুয়া খেতে খেতে চাচীকে জিজ্ঞাসা করলো, 'এখানে খেজুর বা তালের রস, গুড় পাওয়া যায় না? মালপুয়া চিনির বদলে খেজুরের রসে ডুবিয়ে খেতে কেমন লাগবে চাচী?'

'পাওয়া যায়, তবে বাংলা বা উড়িষ্যার মতো এত বেশী না। আমাদের দাইকে বলে দিচ্ছি, যোগাড় করে আনবে।'

শ্রীনিকেতন যাওয়ার আগে মালা চাচা- চাচীর সঙ্গে পুরী বেড়াতে গেলো। সমুদ্রে ঘেরা দ্বীপ মরিশাসে বড় হয়ে ওঠা মালাকেও কিন্তু পুরীর সমুদ্রের সৌন্দর্য মুগ্ধ করলো। স্থানীয় মানুষের আতিথেয়তায় মোহিত হয়ে গেলো মালা। চাচা রমেশ চুমনের বন্ধু দুর্যোধন মহাপাত্রের বাড়িতে মালা প্রাণভরে খেলো নানারকম পিঠা...গুড়ের। দুর্যোধন চাচার খেজুর প্ল্যান্টেশন আছে তবে সেই যায়গা পুরীর থেকে দূরে রঘুরাজপুর গ্রামে। দুর্যোধন খুড়োর সঙ্গে কথা বলতে বসে গেলো মালা।

'খেজুর গাছের চাষ আর রস- গুড়ের ব্যাপারে আমার কৌতূহল আছে খুড়ো...'

'খেজুর গাছের শাখা একদিক থেকে চেঁচে পরিষ্কার করে কাটা অংশের নীচে দুটি খাঁজ কেটে সরু পথ বার করে বাঁশের নলি লাগিয়ে, মাটির হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয় রসে সংগ্রহের জন্য। প্রতি সকালে রসে ভরা হাঁড়ি নিয়ে রস বিক্রি করা হয়, গুড় বানানো হয় জ্বাল দিয়ে। বেলা হলে রস গেঁজিয়ে ওঠে, পরিবর্তিত হয় তাড়ি জাতীয় মাদক দ্রব্যে। এই মাদক কিন্তু শরীরের জন্য ক্ষতিকর না...'

পার্বতী খুড়িমা চা নিয়ে আসাতে কথায় বাধা পরলো। চায়ে চুমুক দিয়ে মালার মুখ স্বর্গীয় হাসিতে ভরে উঠলো। 'বাহ খুড়িমা, এই চায়ের স্বাদ তো একদম আলাদা।' 

'হ্যাঁ মালা, খেজুর গুড়ে বানানো এই চা। আমরা গেঁয়ো মানুষ, আমাদের বাড়িতে চিনি ব্যবহার হয় না বললেই চলে।' খুড়িমা গেলেন রান্নার ব্যবস্থা দেখতে।

'হ্যাঁ খুড়ো, বল...তারপর?'

'কী যেন বলছিলাম? হ্যাঁ, গাছ কাটার দিন দুয়েক পর থেকেই রস গড়ানো শুরু হয়, হাঁড়ি ভরে ওঠে। প্রথমবার কাটা গাছের রসকে বলে জিরান কাট...রস অতি সুস্বাদু আর পাটালি গুড় খুব ভাল হয়। দ্বিতীয়বার গাছ কেটে রস পেলে তাকে বলে দোকাট, তৃতীয়বারের গাছ কাটা রসকে বলে তেকাট। একবার কাটা গাছ দিন পাঁচ ছয় পরে আবার কাটতে হয়, আর কাটা অংশ শুকোতে সকাল ও বিকালের রোদ পাওয়ার জন্য পূর্ব আর পশ্চিম দিক থেকেই গাছ কাটা হয়ে থাকে, যাতে সকাল আর বিকেল দুই সময়ের রোদটা পাওয়া যায়। 

বাদুড়ের হাত থেকে রসকে বাঁচাবার জন্য আজকাল হাঁড়ি নানারকমের জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হচ্ছে। বাদুড়ের থুথু আর মলমুত্র থেকে রস 'নিপা ভাইরাস' (এন আই ভি) দুষিত হয়ে পড়ে আর মানুষের মধ্যেও রোগ ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে একসময়ে এই রোগ খুব বেশী রকম ছড়িয়ে পড়েছিলো।'

'হ্যাঁ খুড়ো, আফ্রিকায়ও 'পিন টেল্ড শ্রু' নামে এক জন্তুর হাত থেকে তাল জাতীয় গাছের রসকে বাঁচাবার কথা আমি শুনেছি, আর বাদুড় তো সব যায়গায়ই আছে।'

একবছর হয়ে গেলো মালা চুমনের শ্রীনিকেতনে। প্রোফেসর অনিল ভার্গব খুব খুশি হয়েছেন মালার 'তত্ত্বালোচনার' (ডিসার্টেশন) বিষয় নির্বাচনে। মালা তাঁকে জানিয়েছে যে সে 'পাম স্যাপ' আর 'পাম ওয়াইন' নিয়েই গবেষণা করতে চায়। সবরকম সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন অনিল বাবু। 

বাংলাদেশের বন্ধু সাফা সাইমার সঙ্গে খুব ভাব মালার। বাবা- মা'র একমাত্র সন্তান সাফাও কৃষিবিজ্ঞান পড়তে এসেছে, দেশে ফিরে তাদের জমি- জমা, চাষ- বাসের দেখাশোনা করতে চায় সে। সাফার কাছ থেকে কতো যে জ্ঞান আহরণ করেছে মালা এই তাল- খেজুর- নারকেল রসের ব্যাপারে। 

সাফা একদিন মালাকে শোনালো বাংলাদেশের সুমাইয়া বরকতউল্লাহর লেখা কবিতা। আজকাল মালা বেশ স্বচ্ছন্দ বাংলা ভাষাতেও।

'পিঠে- পুলির জেয়ৎ দিলাম
আঙ্গো বাইৎ আইয়ো
বিছায়ে দিমু গরম পাটি
আরাম কইর‍্যা বইয়ো
আইয়ো তোমরা আইয়ো কিন্তু
আইয়ো আঙ্গো বাইত্যে
হরেক রকম পিঠা দিমু
আশ মিটাইয়্যা খাইত্যে 
চিড়া-মুড়ি-দধি দিমু
টাটকা খেজুর রস্যে
দাদীর হাতের পিঠা খাইব্যে
রান্নাঘর‍্যে বইস্যে
দেইখব্যে ঘুর‍্যে এই গেরামের 
মানুষ কত্য ভালোরে
দেইখল্যে মেমান টেনে নিব্যে
মুখটা কইর‍্যে আলোরে...' 

সাফার সঙ্গে বাংলাদেশে বেড়াতে গেলো মালা, বাংলাদেশের প্রাণ 'চিড়ি গুড়া চাল' নবান্ন উৎসবের সময়ে। লোকগাথা অনুসারে সে'দিন হলো বাৎসরিক মাঙ্গলিক দিন। মালা দেখলো বাংলার আর এক রূপ। বিবিধ ব্যঞ্জনে, পিঠেপুলির আয়োজনে মেতে উঠেছে প্রতিটি ঘর... নতুন ধানের ভাত মুখে তোলার আগে মসজিদে সিন্নি চড়াবে মুসলমান কৃষকুল। হিন্দুদের ঘরে চলবে পূজার ধূম। 

ধান বানিরে আমি ঢেঁকিতে পাড় দিয়া
ঢেঁকি নাচে, আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া

অঘ্রাণের নতুন চালের গুঁড়ো আর নতুন খেজুরের রস দিয়ে শুরু হবে পিঠা উৎসব।

অবসর পেয়ে দাদীর কাছে বসলো মালা। 'দাদী, আমাকে একটু বলো বাংলাদেশের তাল- খেজুর- নারকেল সম্বন্ধে। 

তাল- খেজুর- নারকেল গাছ বাঙালির জীবনে ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একটা কবিতা শোনাই তোকে, রথিন ভটচাযের লেখা ...

বিলেতে বেয়ে তালডিঙি
মাছ ধরেছি মাগুর শিঙি।
গরমকালে তালের পাখা
বাতাসটি তার মধুমাখা।
তালপাতার ছাউনি ঘরে
শান্তির নীড় বসত করে।
তালরসেতে জুড়ায় প্রাণ
ভোরবেলাতে তা যদি খান।
তালের তাড়ি অমৃতধারা
খায়নি যে জন বুঝবে তারা?
তাল- পাটালি স্বর্গসম
গন্ধ ছড়ায় মম মম। 

সুযোগ পেলেই মালা ঘুরে বেড়িয়েছে ভারতবর্ষ আর দক্ষিণ এশিয়ার নানা স্থানে। তার অভিজ্ঞতার ঝুলি ক্রমশই ভরে উঠছে সুখ-সম্পদে। মালা জেনেছে তাল গাছের চাষ খুব বেশী হয় দক্ষিণ এশিয়ার কম্বোডিয়া, ভারত আর বাংলাদেশে। খুব ভাল জাতের তাল ও খেজুর বৃক্ষের সন্ধান পাওয়া যায় ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়াতে। তাল- খেজুরের বৃক্ষরসে 'বুনো খামির' (ওয়াইল্ড ইস্ট) এর অবস্থিতি এই রসকে চট করে গেঁজিয়ে তোলে, সুখদায়ক পানীয় বদলে যায় অতিসুখদায়ক পানীয়তে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে তাল জাতীয় বৃক্ষের রস ও মাদক পানীয়র বহুল প্রচার দেখা গেলেও এই গাছের মিষ্টি রসের ব্যবহার সারা পৃথিবীর বহু দেশেই পাওয়া যায়। এই মাদক পানীয় আরও কড়া মাদক দ্রব্যে রূপান্তরিত হয়ে যায় ডিস্টিলেশনের দ্বারা। তাল- খেজুর- নারকেল রসজাত মাদক পানীয় সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির উৎসব- অনুষ্ঠানে... অতিথি আপ্যায়নে, বিয়ে-বাদিতে, নবজাতকের আগমনে এমনকী অন্তিম যাত্রাপথেও এক বিশেষ মাত্রা প্রদান করে। 

নাইজিরিয়ায় 'ওগোগোরো' পানীয়টি পরিবেশন করা হয় ঔষধি দ্রব্যের সঙ্গে মিশিয়ে...এই পানীয় নাকি বহু প্রকার রোগের নিরাময় করে থাকে। 

ফিলিপিন্সে 'লাম্বানোগ' পান করার সময়ে পানীয়ের কিছুটা প্রথমেই, ফেলে দেওয়ার রীতি আছে পরিবারের মৃতজনের আত্মার প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে। স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই এই মাদক পানীয় গ্রহণ করে থাকে। 

ঘানা দেশে মাদক পানীয় 'একপেটেসি' বা 'বুরুকুটু' কিছু বিশেষ মশলার মিশ্রণে পান করা হয়। আবার কিছু বিশেষ ধরণের মশলার প্রয়োগ তাজা রসকে গেঁজিয়ে ওঠার থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। রেফ্রিজারেটরেও রস বেশ কিছুদিন তাজা রাখা যায়। 

মাদক তৈরির জন্য রসকে যদি বেশী মাত্রায় গেঁজিয়ে ফেলা হয়, মোটামুটি ভাবে ২৪ ঘন্টার পরে তা অত্যন্ত টক স্বাদের ভিনিগারে বদলে যায়।

অভয়া বিশ্বনাথনের বাড়িতে এসেছে মালা, ম্যাঙ্গালোরে। অভয়া মালার সঙ্গে পড়ে। গাড়ি নিয়ে তারা দু'জনে পৌঁছে গেলো ৬০ কি মি দূরে কেরলের 'সেন্ট্রাল প্লান্টেশন ক্রপ্স রিসার্চ ইন্সটিট্যুট' (CPCRI)এ। রস সংগ্রহের অতিউন্নত মানের পদ্ধতি তাদের অভিভূত করে দিল। নারকেল ফুলের থেকে রস সংগ্রহে সেখানে আইস বক্স ব্যবহার করা হচ্ছে, রসকে গেঁজিয়ে ওঠা আর কড়া গন্ধ থেকে বাঁচাবার জন্যে। পুরনো পন্থার চুনের জলের পদ্ধতি আর ব্যবহৃত হয় না, বিশেষ কাজ করে না, সে পন্থা অস্বাস্থ্যকরও। কল্পবৃক্ষের এই স্বাস্থ্য- পানীয় 'কল্পরসা' অত্যন্ত পুষ্টিকর। সি পি সি আর আই অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর উপায়ে মধু রঙের, অতিসুস্বাদু পানীয় পৌঁছে দিচ্ছে সমাজের কাছে। 

নারকেল গাছে বছরে ১২ থেকে ১৪ টি পুষ্পগুচ্ছ ধরে, আর এক একটি পুষ্পগুচ্ছ থেকে দিনে প্রায় ২ থেকে ৩ লিটার রস পাওয়া যায়, প্রায় ৪০-৪৫ দিন ধরে যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮০ থেকে ১২০ লিটার রসে। রস সংগ্রহ না করে যদি ফুল থেকে সাধারণ নিয়মে ফল ধরতে দেওয়া হয়, তাহলে পাওয়া যায় ২০-২৫ টি নারকেল এবং ১০-১২ লিটার নারকেলের জল। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে কল্পবৃক্ষের মধুরস অনেক বেশী সাশ্রয়ী। এই পন্থায় শ্রীলঙ্কা নারকেল রস থেকে মাদক পানীয় 'টুবা' প্রস্তুত করে থাকে। 

উত্তর ভারতে সংগ্রহ করা তাজা রসকে 'নীরা' বলে, দক্ষিণ ভারতে এই রসের নাম 'পদনীর'। দক্ষিণ আফ্রিকায় নারকেল জাত মাদক পানীয়ের নাম 'উবুসুলু'। 

আজকের যুগে সারা পৃথিবী প্রাকৃতিক দ্রব্যের ব্যবহারে ফিরে যেতে চাইছে, সে কারণেই আজ দক্ষিণ ভারতে তাল জাতীয় বৃক্ষ (নারকেল- তাল- খেজুর) ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে যার নাম 'অন্ধ্র কল্প ব্রুক্‌শম' এর চাষের ওপরে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে। পুরুষ ও নারী দুই রকমের নারকেল গাছ থেকেই রস সংগ্রহ হয়, কিন্তু যেহেতু পুরুষ গাছ ফল দেয় না, সেই গাছের রসের পরিমাণ ও গুণগত মান অনেক বেশী হয়। যে কোনও তাল জাতীয় বৃক্ষের রস থেকেই মাদক পানীয় প্রস্তুত করা যায়... ঠিকমতো খামির (ইস্ট), তাপমাত্রা আর যথাযোগ্য প্রণালীর উপযোগ করে। প্রাচীন যুগ থেকেই এই তালজাতীয় নীরা বা পদনীর পানের প্রথা চলে আসছে, খালি পেটে এই রস পান অতি মধুর অভিজ্ঞতা। গোয়াতে, কাজু বা এ্যাপ্‌ল ফেনীর মতো কোকোনাট ফেনী প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। 

প্রভূত জ্ঞান-সম্পদে সমৃদ্ধ মালা এবারে মন দিলো তার গবেষণা পত্রে। ভগবানই জানেন কতদিনে শেষ করতে পারবে এই বিশাল কর্মকাণ্ড... যদিও বিষয়টা জড়িয়ে গেছে তার আত্মার সঙ্গে।

1 comment:

  1. Swati banerjee29 July 2018 at 20:58

    Apurba likhonshoili
    Lekhikar aro lekha porar ashay roilam.

    ReplyDelete