0

ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী

Posted in


ধারাবাহিক

পায়ের শব্দ
সোমঙ্কর লাহিড়ী



 

বিকেলের মধ্যে একটা ব্যাপার ঘটে গেল খুব নিঃশব্দে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে অ্যান্ডি আর শুব্বুর সেই ভিডিও ক্লীপ দেখানো বন্ধ হয়ে গেল। সব অন্য খবর তার জায়গায় দেখানো চলতে থাকল। 

অ্যান্ডি ব্যাপারটা লক্ষ্য করে কাঞ্চনকে ফোনে বলল, 

দেখলে তো কাঞ্চনদা কোনও চ্যানেল ব্যাপারটাকে আর রান করাচ্ছে না। আসলে কোনও বেস নেই তো। তাই। 

তাই কি? আমার তো মনে হচ্ছে অন্য কথা অনি। 

কী? 

যদি বেস না থাকত তবে মিডিয়া তোর বাড়ির সামনে ওবি ভ্যান ফ্যান পাঠাত না। তোর বাইট নিতো না। অতকিছু করে যখন সেটা দেখাল না, তখন ব্যাপারটা আরো ওপর মহলে ঘটেছে হয়ত। কারণ, শেষে ঐ মহিলা মিসেস বাজোরিয়ার সুইসাইড অ্যাটেম্পট না কি একটা বলল না? হতে পারে তিনি মারা টারা গেছেন। আর পারিবারিক কেচ্ছা কেলেঙ্কারি চাপা দেওয়ার জন্যে ওনারা সব চেষ্টা করেছেন, তাই মিডিয়া চুপ। 

অ্যান্ডি মনে মনে ভাবল সেটা অস্বাভাবিক নয়। 

কাঞ্চন বলতে থাকে, 

তোকে নিয়ে আমার হয়েছে জ্বালা। একদিকে তুই করছিস শয়তানি ইতরামি, সেটা সামলাতে হচ্ছে, অন্যদিকে তোর দিদি এখানে কেঁদে ভাসাচ্ছে তাকে সামলাতে হচ্ছে। আমার কথা না হয় নাই ভাবলি, তোর এই দিদিটার কথা ভেবে একটু নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করতে পারিস না? ও যে তোকে ভীষণ ভালবাসে। নিজের ছেলেমেয়ে না হওয়ার ফলে সেই পুরো দুঃখ ও তোকে নিয়ে ভুলতে চায়, আর তুই একটা অকৃতজ্ঞ তার বদলে ওকে কেবল অসম্মান ই ফিরিয়ে দিস। 

ফোনের অন্যদিকে অ্যান্ডি আবার বিরক্ত হতে শুরু করে। তারপরে গলাটা একটু ভারী করে বলে, 

অলিদিকে বলে দিও, প্লীজ, আমি এই ব্যাপারে কিচ্ছু করিনি। আর আমি চেষ্টা করব ভবিষ্যতে যেন এই ধরনের ব্যাপারে আমার নাম না জড়িয়ে যায় সেটা খেয়াল রাখতে। 

ফোনের দু দিকে দুজনের কেউ কথাটা বিশ্বাস করল না। সম্ভবত। 

ফোনটা রেখেই অ্যান্ডি মুকেশের নম্বর ডায়াল করে জানতে চাইল, রাতে শহরের কোন কোন জায়গাতে বন্য পার্টির খবর আছে? খবর পেয়ে বেশ খুশী মনে অ্যান্ডি বিরুকে ফোন করল, 

কি বস্‌ তোমার এতো বন্ধু বান্ধব এলো, তাদের ভালো করে খাতিরদারি করলাম। প্রশ্নের উত্তর দিলাম, আর তারপরে কোন আওয়াজ নেই। আরে ভাই ওদের জানা যে রাতে স্কচ খাওয়াবি। আরে কুছ তো পাবলিসিটি বনতা হ্যায় বস। 

বিরু খুব সিরিয়াস গলায় বলল, 

অ্যান্ডি, অফ দ্য রেকর্ড, সাম ওয়ান ভেরী আপ ইন দ্য পাওয়ার ল্যাডার ইন্টারভেন্টেড। নারকোটিক্স এর কাছে ব্যাপারটা গেছে। তারাও বেশ ইন্টারেস্টেড, কারণ সেলেব ধরলে তো ডবল ফায়দা। তাই না? সো স্টে লো, ফর আ লং টাইম। আর ঐ ওয়াইল্ড পার্ট ফার্টি গুলো অ্যাভয়েড করো বস্‌। ওর গেট রেডী তো স্ক্রু ইয়োরসেলফ্‌ আপ। 

ফোন রেখে অ্যান্ডি হাসল একটু, তারপরে পার্টিতে যাওয়ার জন্য ড্রেস করা শুরু করে দিল। কনফিডেন্স তখন ওভার এ রান করছে। 

পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। পরদিন মিডিয়া নতুন ব্রেকীং নিউজ পেয়ে গেল। 

“মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ী চালাতে গিয়ে বিখ্যাত গায়ক অ্যান্ডি পুলিসের জালে।” 

আর এবারে খবরটা মিডিয়া সারাদিন ধরে চালালো। রাতে আলচনায় নিয়ে এলো। প্রায় সব কটা চ্যানেলের নজর তখন অ্যান্ডির ঐ ধুসর নিশি যাপনের উপরে। যে যেভাবে পারল তাতে মশলা দিলো। 

যে সব কোম্পানীর সাথে গানের তারপরে প্রোডাক্ট এন্ডোর্সমেন্টের চুক্তি ছিল সেগুলো তারপরে হয়ে গেল বাতিল। আদালতে অনেক টাকা বন্ডের বিনিময়ে অ্যান্ডির বেলের ব্যবস্থা করল কাঞ্চন। যেহেতু এটা তার মাদকাসকক্ত অবস্থায় ধরা পড়ার প্রথম বার। আর আগে কোনো পুলিস রেকর্ডও নেই, তাই বেলটা পাওয়া গেল। 

শুধু একটা ব্যাপার হলো, সেটা হলো ইউ টিউবে অ্যান্ডির গানের হিট গেল মারাত্মক রকমের বেড়ে। আর সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা গেল অ্যান্ডির সমর্থনে বেশ অনেকেই গলা ফাটাচ্ছে। 

চোখের তারা চোখের বালি হল কি না সেই সন্দেহটা থেকেই গেল নগর সভ্যতার মনে। 

অ্যান্ডি যখন নিজের ফ্ল্যাটে ফিরল তখন সে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বদলে গেছে। চোখের কোনে কালি, মুখ শুকনো। সারা গায়ে থানার লকআপের ময়লার দুর্গন্ধ। পিছনে বেশ অনেক অনেক সংখ্যায় মিডিয়ার লোকজন। 

সবচেয়ে অবাক হয়ে গেল যখন অ্যান্ডির অলিদি নিজে এসে তাকে বলল, 

অনি এই অবধি আমি আর তোর কাঞ্চনদা তোর যাবতীয় ঝামেলা সামলালাম। এরপরথেকে আমি আশা করব তুই আর কোনো রকম ব্যাপারে আমাকে আর তোর কাঞ্চনদাকে ফোনে জানাবি না। চলি রে ভালো থাকিস, অ্যাটলিস্ট চেষ্টা করিস। 

অ্যান্ডিকে ছেড়ে যখন অলি আর কাঞ্চন ও চলে গেল তখন ও বুঝল একাকীত্ব কাকে বলে। ইচ্ছে করছিল না তবুও মুকেশকে ফোন করল। 

হাঁ ভাই বোল? 

আর কি বলব? তুই কোথায় আছিস? 

কিঁউ? 

ইয়ার ফ্ল্যাটমে চলে আ না যারা? 

কাহে ইয়ার? 

থোড়া টাইম পাস করনা হ্যায়। শালা সব কৈ মেরে কো ছোড় কে চালা গ্যায়া। 

ইয়ার থোড়া টাইম সব কুছ শান্ত হোনে দে? উস্কে বাদ সব ঠিক ঠাক হো যায়েগা। 

আমায় আর পাউডার দিবি না? 

অন্যদিকের ফোন কেটে যায়। 

অ্যান্ডি ফাঁকা ফ্ল্যাটে চিৎকার করে গালাগালি করে। নিস্তব্ধতা বাড়ে, কমে না। 

নিজের গায়ের জামা কাপড়ের দিকে তাকিয়ে নিজেরই ঘেন্নায় গা গুলিয়ে উঠে, তারপরে ঠিক করে, নাঃ! স্নান করাই উচিত। 

বাথরুমে ঢুকে হাত নিশপিশ করতে থাকে সাদা পাউডার টানার জন্য, অনেকক্ষণ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করার পরে অ্যান্ডি হার মানে, হাতে একটা ছোট হাত আয়না নিয়ে তার উপরে একটাই মাত্র লাইন টানে। তারপরে সোজা নাক দিয়ে টেনে ভেতরে। 

মাথা হালকা লাগে। পেটের ভেতর নাগরদোলার অনুভুতি ফিরে আসে। দরজায় বেল বাজার শব্দ হয়। 

ধুর শালা! কে এল এখন? শালা সবকটাই তো নিজেদের সতী সাজাতে আমার থেকে দূরে গিয়ে বসে মজা দেখছে। শালা অলিদি কাঞ্চনদা অবধি, তা এখন আবার কে প্রেম ঝালাতে এল? 

অ্যান্ডি খালি গায়ে একটা আধ ময়লা তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দরজার দিকে যায়। 

দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ফ্ল্যাটের মধ্যে এক বিশাল চেহারার লোক ঢুকে আসে, মাথায় একমাথা ঝাঁকড়া চুল, দুই ভুরুর পাশে পিয়ারসিং করা সেখান থেকে দুটো রুপালী রঙ্গের দুলের মতো কিছু ঝুলছে। চোখে হ্যারি পটারের মতো গোল চশমা। কাঁচ দুটো কালো। ঠোঁটের দু পাশে দুটো রিং ঝুলছে, কানেও তাই। 

এর নিচে কি আছে সেটা দেখার আগেই লোকটা কেমন যেন কিলবিল করে অ্যান্ডিকে জড়িয়ে ধরতে যায়। 

শরীরের খুব কাছে চলে আসার সাথে সাথে অ্যান্ডির নাকে আসে তীব্র গাঁজার গন্ধ। অ্যান্ডি নিজেকে সরাতে চেষ্টা করে। তোয়ালেটা খুলে যায়। 

অ্যান্ডি বেবী, আমার কাছে চলে এসো, এখন আমি তোমায় সব কিছু থেকে প্রোটেক্ট করব। চলে এসো তোমার বরের কাছে, আমি এসেছি তোমাকে সব বিপদ থেকে বাঁচাতে। এসোওওওও। বলে দূরে সরে যাওয়া অ্যান্ডির দিকে দু হাত বাড়িয়ে লোকটা এগিয়ে যায়। 

অ্যান্ডি পালাতে চেষ্টা করে, লোকটা পিছন থেকে অ্যান্ডির মাথার পিছনের চুল খামচে ধরে পিছনের দিকে টেনে আনে। চুলের মুঠি ধরে অ্যান্ডির মাথাটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে অ্যান্ডির ঠোঁটের উপর নিজের দুটো ঠোঁট চেপে ধরে জীভ দিয়ে ঠেলে অ্যান্ডির মুখ খোলার চেষ্টা করতে থাকে। 

অ্যান্ডি প্রবল ভাবে ধাক্কা মেরে লোকটাকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু নেশাগ্রস্থ থাকার জন্যে সঠিকভাবে পেরে ওঠে না। লোকটার কাছে ক্রমশ হেরে যেতে থাকে অ্যান্ডি। 

আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনা অ্যান্ডি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার, আর কারো নও। এসো আমার কাছে। আমি তোমার সব খেয়াল রাখব অ্যান্ডি, ডার্লিং। আমাকে কষ্ট দিতে নেই। এসো আমরা মিলিত হই। 

অ্যান্ডি বুঝতে পারে লোকটা তাকে মেঝেতে ফেলে দিতে চেষ্টা করছে, তার বাধা দেওয়াও চলতে থাকে। নেশা ততক্ষণে উড়ে গেছে। ক্রমশ লোকটা তাকে মেঝের উপরে শুইয়ে দিতে সক্ষম হয়। 

পিঠের উপর অ্যান্ডি বুঝতে পারে একটা জুতো পরা পায়ের প্রচণ্ড চাপ। অ্যান্ডির মেঝে থেকে উঠতে পারে না। 

উপরে দাঁড়িয়ে সেই লোকটা বলতে থাকে, 

আমি কতদিন ধরে তোমাকে চেয়ে এসেছি অ্যান্ডি, আমার নিজের করে চেয়ে এসেছি। তুমি জানো না কত কষ্ট করে তোমার মেল আইডি জোগাড় করে আমি রোজ তোমাকে আমার মনের কথা, আমার ভালবাসার কথা, আমাদের মিলিত জীবনের কথা জানিয়েছি, তুমি একটার ও উত্তর দাওনি। তোমায় কত কিছু উপহার দিয়েছি তুমি নাও নি। আমার ভালবাসা তুমি বারে বারে ফিরিয়ে দিয়েছ। 

লোকটা বলে চলতে থাকে মাটিতে উবুড় হয়ে পরে থাকা অ্যান্ডির দম আটকে আসতে থাকে। আর বাড়তে থাকে ভয়। লোকটা সমকামী না পাগল, না ঠিক কি সেটাই আন্দাজ করা যাচ্ছে না। কিন্তু গায়ে প্রবল শক্তি আর প্রচণ্ড আগ্রাসী মানসিকতা সেটা বুঝতে অ্যান্ডির কোনও অসুবিধা হচ্ছে না এই মুহূর্তে। 

কিছু ছাড়া পেতেই হবে এই অত্যাচার থেকে, একরকম মরিয়া হয়ে অ্যান্ডি একটা ঝটকা দিয়ে চিৎ হতে চেষ্টা করে। লোকটা বকবক করার দরুন বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল তাই সেই ঝটাকায় ভারসাম্য হারায়। 

অ্যান্ডি চিৎ হয়ে দেখতে পায় লোকটা তার প্যান্ট খুলে নামিয়ে ফেলেছে অনেকটা, জাঙিয়াও। অ্যান্ডি সপাটে পা চালায় লোকটার উত্থিত শিশ্ন লক্ষ্য করে। এই মরিয়া আক্রমণটা আসবে লোকটা ভাবতে পারেনি। খুব অল্প সময়ের এই হতচকিত মুহুর্তের সুযোগটা পায় অ্যান্ডি। উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার দিকে ডাইনিং টেবিলের পাশের একটা চেয়ার ছুঁড়ে মারে। পায়ে লাগে। এবারে লোকটা পড়ে যায় মাটিতে। অ্যান্ডি হাতের চেয়ারটা লোকটার মাথা লক্ষ্য করে চালায়, লক্ষভ্রষ্ট হয়। তারপরে কোনওক্রমে মেঝেতে পরে থাকা তোয়ালেটা জড়িয়ে অ্যান্ডি ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নীচের দিকে প্রাণভয়ে দৌড়তে থাকে। 

0 comments: