1

গল্প - শমিত বিশ্বাস

Posted in


গল্প


ট্রাম'বাহনে সাঁঝবিহানে 
শমিত বিশ্বাস


চৈত্র সেলের বাজার থেকে অঢেল শাড়ী-ব্লাউজ, চাদর-তোয়ালে, মোজা-রুমাল এবং আরও অনেক কিছু 'একেবারে জলের দরে' কিনে ফেলে, বৌ সুজাতা আর শ্যালিকা মনিকা যখন বীরদর্পে বাড়ি ঢুকলো, তখন আমি আপনমনে দুলছিলাম। হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে আমি ঢুলছিলাম; কিন্তু আসলে আমি দুলছিলাম। প্রায় হপ্তা দুয়েক হলো এই দুলুনিটা আমাকে বশ করেছে। বাড়িতে, সেলুনে, পোষ্টঅফিসে, যখনই দু-দণ্ড কোথাও বসছি, তখনই ঐ নিঃশব্দ, ছন্দময় দুলুনি, এক কুহকীনির মতো আমাকে আবিষ্ট করে ফেলছে। এই নেশায় আমি এখন সর্বদাই বূঁদ হয়ে আছি। তাই সিঁড়িতে সুজাতাদের পায়ের শব্দ পেয়েই আমি আগে থেকেই ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিয়েছিলাম, যাতে অযথা 'বেল' বাজিয়ে আমার এই মৌতাতটা নষ্ট না করে দেয়। কিন্তু সুখ কি আমার সয়?

দরজা খোলা পেয়ে দুজনে সটান ভেতরে ঢুকেই ধপাস করে সোফায় বসে পড়ল আর অগুনতি ছোটো বড়ো প্যাকেট চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তারপরই আমার উদ্দেশ্যে বলল সুজাতা, 'তুমি কি গো! দরজা খোলা রেখে ভেতরে বসে বসে ঘুমোচ্ছ? কতরকমের লোক ওঠানামা করছে! ইঁদূর টিঁদুরও তো ঢুকে পড়তে পারে!' শুঁড়ীর সাক্ষী মাতালের মতো,সঙ্গে সঙ্গে মনিকাও যোগ করে –– 'আর যখন তখন এইর'ম ঘুমিয়েই বা পড়ছেন কেন? শরীর ঠিক আছে তো? কালই একটা চেক্আপ করাতে নিয়ে যাবো।' আমি মনে মনে হাসলাম। বলতে পারলামনা যে, আমি বহাল তবিয়তেই আছি; শুধু তোমরাই দিলে সব চৌপাট করে। বললাম না যে, যেসব 'সেনসিটিভ' মানুষজন ট্রামে চেপে বড়ো হয়েছে, এই দুলুনি তাদের লয়্যালটিরই পুরষ্কার।

হ্যাঁ, এটিকে অনায়াসে ট্রাম-সিন্ড্রোম বলা যেতে পারে। কিন্তু ঐযে বললাম, 'সেনসিটিভ' মন! হুঁ হুঁ বাবা, এর স্বাদ পেতে হলে চাই অনুভূতি আর পরিবেশ।। কিন্তু পরিবেশ কোথায়? একটু শান্তিতে বসে যে দুলবো তার যো আছে? হায় রে পোড়াকপাল ! 

যাক, যেকথা বলছিলাম ––– আমার এই স্বর্গীয় দুলুনির মহান উৎস যে ট্রামই, তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। বৈশাখ-জৈষ্ঠের শুনশান দুপুরে, কলকাতার ফাঁকা ট্রামে যে চড়েনি, সে জানেনা এ ট্রাম-দুলুনির মাহাত্ম। কিংবা, যেসব বয়সহীন প্রেমিক-প্রেমিকারা ঘনঘোর বর্ষায়, যুগলে ট্রামে চেপে ভ্রমণ করেছেন, যখন তাঁদের হৃদয়ের নিঃসীম দোলাচল আর ট্রামের দুলুনি একাত্ম হয়ে এক মহাজাগতিক মূর্চ্ছনায় পরিণত হতো, তারাই জানেন এর অপার্থিব মাধুর্য। সেই অসমাপ্ত স্বপ্নসুখই আমি আর একবার চেখে নিচ্ছি এই মোহানায় এসে,-- তা সুজাতারা যতই বলুক 'বুড়ো বয়সের ভীমরতি। 

বিশুদ্ধ মতে, চিৎপুরই হলো  ট্রামগাড়ীর পীঠস্থান, আর সেই খোদ চিৎপুরেই আমার জন্ম। অর্থাৎ ট্রামের সঙ্গে এক আশৈশব গাঁটছড়া। এবং হেরিডিটারী বললেও ভুল হবে না।। বাবা, জ্যাঠা, কাকা, এঁদের কথা মনে করলেই মনে পড়ে ট্রাম। বাবা আর জ্যাঠা দুজনেই ধুতির ওপর শার্ট অথবা পাঞ্জাবি পরতেন। দুজনেরই খুব চওড়া বুক ছিল, এবং বুকে থাকতো চওড়া বুকপকেট। এর কারণ এই পকেটে সবসময় থাকতো ট্রামের চওড়া মান্থলি টিকিট, প্লাস্টিক খাপের ভেতর। অতএব অবাধে সর্বত্র ওনারা ট্রামে চেপেই ভ্রমণ করতেন; তা সে দু-স্টপ দূরে শোভাবাজারে বাজার করতেই হোক, বা ডালহৌসিতে অফিস যাওয়াই হোক। এবং অফিস যাওয়াটা ছিল অনেকটা বেড়াতে যাবার মতোই। বাবা, সনৎকাকা, বীরুজেঠু সবাই একসঙ্গে , সাড়েদশটার সময় ট্রামে উঠতেন। সকলেরই পকেটে ঐ মান্থ্লি টিকিট। কন্ডাকটররাও চিনত। দেখতেও চাইতোনা। ব্যস। তারপর 'পে-কমিশন, ইন্দিরা গান্ধী, জ্যোতিবাবু, আর টম্ টম টম টম..........। আবার অফিস থেকে ফেরার সময় বাবাকে দেখেছি কেমন দরকার মতো, বিভিন্ন স্টপেজে নেমে, কাজ সেরে ফের ট্রামে উঠে পড়তেন। হয়তো নতুন-বাজারে নেমে, গুড়পট্টি থেকে খাসা নলেনগুড় কিনে, আবার ট্রামে চড়লেন। কিংবা মদনমোহনতলায় নেমে, সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ীতে পুজো দিয়ে, নবীন চন্দ্র দাসের রসগোল্লা কিনে ফের ট্রামে চেপেই বাড়ি। অর্থাৎ সংসারের প্রায় আশিভাগ প্রয়োজনই মিটিয়ে ফেলতেন বাগবাজার থেকে ডালহৌসি ট্রামে যাতায়াতের পথে। আহা কতদিন যে সের'ম নলেনগুড় খাইনি! এদিকে কথায় কথায়, থুড়ি দুলে দুলে আমিও প্রায় কলুটলা পৌঁছে গেছি নির্বিঘ্নে, হঠাৎ মনিকার গলা পেয়ে চমক ভাঙলো। 'ওঃ হাতিবাগানে যা ভীড় আজ! আর পাঁচ মিনিট দেরী হলে জর্জেটের কচি কলাপাতা রঙের শাড়ীটা ঠিক বেরিয়ে যেত। কি সস্তায় পেলাম বল দিদি?' বলেই বিজয়িনীর হাসি হাসে। যেইনা একথা শোনা, অমনি আমার মুখ থেকে ফস করে বেরিয়ে গেল, 'তোমরা হাতিবাগানে গিয়েছিলে বুঝি? তা ট্রাম দেখলে ওখানে?' প্রশ্নটা শুনেই ওদের মুখটা যেন কেমন হয়ে গেল। ভুরু কুঁচকে সুজাতা বললো, 'ওমা ,এ আবার কি ধরনের কথা! হাতিবাগানে ট্রাম দেখব না তো কি হাতি দেখব? তোমার কি দিনদিন বুদ্ধি শুদ্ধি লোপ পাচ্ছে?' বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। মনিকা অমনি, একরাশ বিরক্তি ঝরিয়ে যোগ করে, 'ঐ ট্রামের জন্যেই তো এত দেরী হোল আমাদের। ঠিক ক্রসিংএর মধ্যিখানে এসে, ওনার তার খুলে গেল। ব্যস। চতুর্দিকের বাস, ট্যাক্সি, অটো সব জট পাকিয়ে, সে এক বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপার। সব ঐ হতচ্ছারা ট্রামের জন্যে।' আমি চোখ কুতকুত করে শুনছিলাম। ভেবে দেখলাম, ওদের দোষ নেই। ট্রাম -রোমান্সের কিই বা বোঝে ওরা। ওদের বাবা থাকতেন চিত্তরঞ্জনে, চাকরি সূত্রে। একটা রুখু- সুখু জায়গায় বড়ো হয়েছে। তাই বড্ড রুখু-সুখু মন ওদের। মাঝে মাঝে খুব দুঃখু হয় ওদের জন্যে। যাকগে, বলুকগে যা খুশি। আহা, যদি দেখাতে পারতাম ওদের সেইসব দিন! স্কুলে যখন গরমের ছুটি পড়ত। দুপুর বেলা মা, কাকিমা, ঠাকুমারা, কাঠের সব দরজা জানলা বন্ধ করে, ঘরটাকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার করে দিয়ে, লাল সিমেন্টের মেঝেতে শুয়ে পড়তেন আমাদের নিয়ে। চারিদিক নিশ্চুপ, নিথর। শুধু আলসেতে পায়রাদের বক্ বক্ বকম্। আর ঠিক তখনই দূর থেকে ভেসে আসতো এক মন কেমন করা শব্দ - টং টং, টং টং...টং টং। আমি চুপটি করে শুয়ে শুয়ে শুনতাম আর ভাবতাম ---ও কোথায় যায়! ঐ টং টং টা কে বাজায়? তার মানে হলো এই, যে, একটা ট্রাম-রোমান্টিকতা সেই ছেলেবেলাতেই বাসা বেঁধেছিল মনে।

ঐতিহ্যের কথায় আবার ফিরে আসি। খাঁটি বৃটিশ পেডিগ্রী। কলোনিয়াল কালচার। সেই ডিভাইড অ্যান্ড রুল। ফার্স্টক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস। গদিওয়ালা সীট, মাথার ওপর ফ্যান ---ফার্স্ট ক্লাস; বাবুদের। আর কাঠের সীট, পাখা বিহীন কামরা ...সেকেন্ড ক্লাস। আর্দালি, বেয়ারা পিওনদের জন্য। ভাড়াও কম। এক অলিখিত বিভাজন। মাদের ধারণা ছিল যে, সেকেন্ড ক্লাসে চাপলেই বাড়িতে ছারপোকা আর উকুন আসবেই আসবে। তাই বারণ করতেন উঠতে। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ শিবুকাকু এসে উদয় হতো আমাদের বাড়ি। আর আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত; আর ট্রামে চাপিয়ে নানা জায়গায় টো -টো করে ঘুরত। সব সেকেন্ড ক্লাসে। শিবুকাকুর কাঁধে থাকতো একটা ঝোলা, আর বিড়ি খেত। আমাকে দুটো বই দিয়েছিল উপহার ---গর্কীর 'মা', আর ভিক্টর হুগোর 'লা মিজারেবল'। শিবুকাকুরা যে কেন হারিয়ে যায় খামখা ! 

মৌতাতটা আবার দানা বাঁধছে। সুজাতা আর মনিকা ভেতরে গেছে। একটার পর একটা কালজয়ী সিনেমা ভেসে আসছে চোখের সামনে। সত্যজিত রায় - মৃনাল সেন। 'সীমাবদ্ধ', 'জনঅরণ্য' , 'ইন্টার ভিউ', 'ক্যালকাটা-71'. আহাহা। যেখানেই কলকাতার ছবি, সেখানেই ট্রাম। ফেস অফ ক্যালকাটা। অসাধারণ সব শট্, অসাধারণ সব এ্যাঙ্গল। আমার ঝিমুনিতেও কখনও লং- শট, কখনও বা ক্লোজ-আপ।

হঠাৎ খিঁচড়ে উঠল মনটা। যত দোষ নন্দ ঘোষ। কি? না, জায়গা খেয়ে নিচ্ছে। কেন রে বাপু, সে তো নিজের লাইন ধরে আপনার মনে চলেছে। বিকট হর্ন, বিষাক্ত কার্বন গ্যাস, রেষারেষি, দাপাদাপি, ---সেই তোদের ভালো হলো? হায়রে আত্মঘাতী জাতি! শুনছি কে আবার নাকি আদিখ্যেতা করে নীল রঙের ট্রাম চালাবে বলছে। ঠাকুমা আজ বেঁচে থাকলে নির্ঘাত বলতেন ....'কালে কালে কত হলো,পুলিপিঠের ন্যাজ বেরুলো'। কোনওদিন দেখব ঐ সুমধুর সঙ্গীতের বদলে পঁক পঁক আওয়াজ হচ্ছে। কার কখন কি মতলব হয়, কে বলতে পারে !

না, না, আর দেরী করা ঠিক হবেনা। কবে আছে, কবে নেই। কালই চড়বো আবার। ময়দান, কালীঘাট, জোড়াসাঁকো,বালীগঞ্জ। ভোরের রুপোলি স্নিগ্ধতায় বেরিয়ে পড়বো, গোধৃলীর সোনালি আলোয় ঘুরে আসবো, ঝিম-ধরা দুপুরের আলস্যে একটু জিরিয়ে নেব। সুজাতা -মনিকাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবো। আহা, বড়ো রুখু-সুখু জায়গায় বড়ো হয়েছে ওরা। 

দেখুক নাহয় একবার, আমার স্বপ্ন রাজ্যের অলীককে।

1 comment:

  1. হঠাৎ যেন লুপ্তপ্রায় ভালোবাসার জিনিস ফিরে এল। কিছুটা আবিষ্ট হলাম সহজাত আবেগ নিয়ে । পরিবেশনার মানে নির্ধারিত হয় লেখার গ্রহণযোগ্যতা। সেই মান উচ্চতর হয়ে উঠেছে চমৎকার লেখনীতে। সাবাশ বন্ধু ।

    ReplyDelete