প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন কথা
ধ্রুব জাতক
অনিন্দিতা মণ্ডল
পর্ব ১
শ্রাবস্তী থেকে রাজগৃহ সাড়ে সাত যোজন দূরত্ব। কিন্তু শ্রেষ্ঠী সুদত্ত এই পথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত। মগধের রাজগৃহের বণিক চন্দ্রাশীষ তাঁর প্রিয় সখা। এমনিই বাণিজ্যের প্রয়োজনে দুই সখায় বিস্তর আলাপ হয়। এখন চন্দ্রাশীষ সুদত্তকে তাঁর গৃহে কিছুদিনের জন্য আতিথ্যের নিমন্ত্রন জানিয়েছেন। সুদত্ত শ্রাবস্তীর বণিক সুমনের পুত্র। অল্প বয়সে মেধা আর কর্মদক্ষতার জন্য তিনি বেশ সম্পন্ন হয়েছেন। যদিও চন্দ্রাশীষ তাঁকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তবু সুদত্ত কর্মহীন জাপনে বিশ্বাসী নন। এবার রাজগৃহের বণিকদের সমিতি তাঁর কাছে নালিশ জানিয়েছে। বজ্জীসঙ্ঘের বণিকরা গঙ্গার কাছাকাছি থাকার দরুন সমস্ত উৎকৃষ্ট পণ্য আগেই ক্রয় করে নেন। এবারে তাই নিমন্ত্রণের ছোলে রাজগৃহের বণিকদের জন্য গোপনে কিছু পণ্য নিয়ে চলেছেন সুদত্ত।
সবে বর্ষা শেষ। শ্রাবস্তী থেকে রাজগৃহে যাবার অনুকূল সময় এটি। বৃক্ষে বৃক্ষে সবুজের সমারোহ। চতুর্দিকে শস্যে শ্যামল বসুন্ধরা। দুগ্ধবতী গাভীরা গোচারণ ক্ষেত্রে সুখী হয়ে বিচরণ করছে। বাতাসে শীতল প্রলেপ। সুদত্ত অতএব যাত্রার আয়োজন করলেন। সখা জানিয়েছেন এ যাত্রায় তাঁকে নাকি তিনি এমন আলোর সন্ধান দেবেন যে সুদত্ত জাগতিক সব প্রাচুর্য ছেড়ে শুধু সেই আলোর পিছনে ছুটে যাবেন। সুদত্ত নিজের মনকে নানাভাবে নাড়াচাড়া করেছেন। কিন্তু বৈভবের চেয়ে বেশি সুখ কিসে, তা খুঁজে পাননি। তিনি দানশীল। মানুষের দুঃখে করুণায় দ্রব হয়ে যান। এই একটি মহৎ গুণ তাঁর আছে। আপাতত তাঁর সঙ্গে পণ্যপূর্ণ পঞ্চশত শকট বাণিজ্যের কারণে রাজগৃহে এসেছে।
শ্রান্ত অথচ পূর্ণচিত্তে সুদত্ত পৌঁছিয়েছেন রাজগৃহে। কোনও এক অজানা কারণে তিনি নিজের অন্তরেই একপ্রকার শান্তির ফল্গুধারা অনুভব করছেন। চন্দ্রাশীষ সখার সঙ্গে আলাপে লক্ষ্য করলেন তাঁর সেই শান্ত স্বভাবটি। তাঁর অধরে একটি লুকানো হাসি খেলে যায়। এখনও দর্শন ঘটে ওঠেনি। তাইতেই সুদত্ত এমন অদ্ভুত শান্তি লাভ করেছেন। দর্শন ঘটলে, শ্রবণ ঘটলে না জানি কি অপূর্ব অনুভূতি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু সুদত্ত দেখলেন, প্রতিবারের মতো সখা এবারে তাঁর প্রতি তত মনোযোগ দিতে পারছেন না। কেমন যেন উদাসীন অবহেলায় তিনি অট্টালিকার বাতায়নবর্তী একটি কক্ষে বদ্ধ রইলেন। মানুষের মন! দুঃখ পেলেন। সখা এতটা উদাসীন কেন? কেনইবা তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন তবে? শেষে স্থির করলেন বাণিজ্য সমিতির সভায় যোগদান করে নির্দিষ্ট কর্ম সমাধা করে ফিরে যাবেন। এরপর সখার নিমন্ত্রন রক্ষা করার আগে ভেবে দেখবেন। তাঁর দিক থেকে বন্ধুত্বে তো কোনও ত্রুটি নেই!
চন্দ্রাশীষের অট্টালিকার উন্মুক্ত বাতায়নে বসে সুদত্ত সেদিন প্রভাতে দিনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মপন্থা স্থির করছেন, এমন সময়ে ব্যাস্তসমস্ত চন্দ্রাশীষ প্রবেশ করলেন। সুদত্তর মুখের ভাবে এমন কিছু ছিল যে তিনি অনুভব করলেন সুদত্ত তাঁর উদাসীনতার কারণে দুঃখিত। চন্দ্রাশীষ সুদত্তর সম্মুখে তাঁর হাত দুটি ধরে বসে পরলেন। হায়, কেন যে বলেননি! তিনি আসল কারণটি ব্যক্ত করলেন। অদূরে রাজগৃহের বেলুবন বিহারে বর্ষাবাসে অবস্থান করছেন এক মহামানব। শাক্যমুনি গৌতম সিদ্ধার্থ। চন্দ্রাশীষ তাঁকে আদরের সঙ্গে শাস্তা বলে অভিহিত করছেন। তিনি বলছেন, সখা কাল প্রত্যূষে চলো তোমায় শাস্তার নিকটে নিয়ে যাই। কিছুটা শুনেছেন সুদত্ত। তবে তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেননা। মহাজনপদগুলিতে এখন নানান ধর্মের তীর্থিক নিজেদের ধর্ম প্রচার করে চলেছেন। তাঁদের উপদেশ শ্রবণ করতে আগ্রহী গৃহীরা উপাসক হচ্ছেন। আর যারা সংসার ছেড়ে তাঁদের অনুসরণ করছেন তাঁরা হচ্ছেন শ্রাবক ও শ্রমণ। সুদত্ত শুনেছেন গৌতম এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হচ্ছেন। তবে নিজে এখনও তাঁকে চাক্ষুষ করেননি। চন্দ্রাশীষ একমনে লক্ষ করছিলেন সখাকে। শ্রাবস্তীর বণিকশ্রেষ্ঠ সুদত্ত এতই সম্পন্ন যে সমস্ত মহাজনপদগুলি তাঁকে তোষণ করে। তাঁর স্বর্ণসঞ্চয়ে ঈর্ষা করে। একমাত্র চন্দ্রাশীষ এসবে একেবারে নিরাসক্ত। তিনি জানেন, যতটুকু গ্রাসে ধরে তার চেয়ে বেশি ভক্ষণ প্রকৃতিকে শোষণ করার সামিল। অতিরিক্ত যা কিছু তাইই বর্জনীয়। সুদত্তও চন্দ্রাশীষের এই অনাসক্ত মোহহীনতা উপলব্ধি করেন। আর তাই তিনি তাঁর প্রিয়সখা। এখন এই প্রস্তাবে সায় দিয়ে ফেললেন।
অতি প্রত্যূষে দুই সখা প্রস্তুত হয়েছেন। সাধু সন্দর্শনে যাওয়া হবে। তাই সুদত্ত সঙ্গে নিয়েছেন প্রচুর উপহার। চন্দন, সুগন্ধি, পুষ্পমালা, মধু, তৈল, গুড়, বস্ত্র, ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে একটি গোশকটে আরোহণপূর্বক দুই সখা চললেন বেলুবন।
বেলুবনের বৃক্ষছায়ায় বসে তথাগত তখন ধ্যানমগ্ন। সবে পুত্র রাহুলকে সঙ্ঘে স্থান দিয়েছেন। প্রব্রজ্যা নিয়েছেন রাহুল। সেই বিভা যেন পিতা ও আচার্যর আননে দৃশ্যমান। সম্মুখে তাঁর অসংখ্য শ্রাবক বসে। কারো নিমীলিত নয়ন। কেউ বা তথাগতর অনির্বচনীয় দেহকান্তি দর্শন করে, তাঁর শরীর থেকে উদ্ভুত পদ্মগন্ধ অনুভব করে মুগ্ধ হয়ে বসে আছেন। সুদত্ত সেখানে পৌঁছে অনুচরদের আজ্ঞা দিতে যাবেন উপহার একত্রিত করে তথাগত চরণে অর্পণ করবার, কিন্তু বাধা অনুভব করলেন। এমন শান্ত নিস্তব্ধ স্থানে অমন কোলাহল কি বিসদৃশ নয়? তিনি চুপ করে বসে পড়লেন। আর ঠিক তখনই তথাগত তাঁর দুটি আয়তনয়ন মেলে দেখলেন তাঁকে। কী যে ছিল সেই চাহনিতে! সুদত্ত যেন স্থানকাল ভুলে এক অদ্ভুত অস্তিত্বে ডুবে গেলেন।
গৌতম দেখলেন এক মহৎহৃদয় তাঁর সম্মুখে স্তব্ধ হয়ে বসে। এত সহজে সে তার জাগতিক অহংকে ছেড়ে নির্বাসনা হয়ে বসে আছে? শুধু তাঁর সান্নিধ্যে এ বস্তু ঘটে উঠেছে? তবে তো আধার প্রস্তুত! তিনি কাছে ডাকলেন সুদত্তকে। বহুমূল্য বস্ত্র বেশভূষা ও অলঙ্কারে সজ্জিত বণিক তাঁর আরও নিকটে গেলেন। ইতিমধ্যে তথাগতর কাছে চন্দ্রাশীষ নিবেদন করেছেন একটি তথ্য। এই সেই শ্রাবস্তীবাসী বণিক, সুদত্ত। যিনি নিজের ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দেন দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণের জন্য। এমন দানশীল শ্রেষ্ঠী জগতে বিরল। অনাথকে পিণ্ডদানকারী এই বণিক সত্যই মহৎহৃদয়। তথাগতর চন্দ্রাননে মধুর স্মিত হাসি। তিনি সুদত্তর মস্তকে হাত রাখলেন। ডাকলেন, অনাথপিণ্ডদ, তুমি আজ থেকে ত্রিশরণ নাও। উপাসক অনাথপিণ্ডদকে সকল বৌদ্ধ আজ থেকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে। যে ব্রত তুমি নিজের অজ্ঞাতেই গ্রহণ করেছ তা থেকে বিচ্যুত হয়োনা।
বাণিজ্যের কাজ সেরে বাকি সময়টুকু সুদত্ত তথাগতসকাশেই রইলেন। একভাবে শুনে গেলেন তাঁর উপদেশ। মধুর বাণী। মহান মানবের কাছে শিক্ষা নিলেন অমূল্য পাঠের। এ জীবন নশ্বর। পঞ্চভূতে গঠিত দেহের বিনাশে পঞ্চভুতেই বিলীন হয়ে যেতে হবে। সমস্ত অনিত্য বস্তুর মাঝে অবিচ্ছিন্ন সুখ বলে কিছু নেই। দুঃখ বলেও কিছু নেই, যদি কেউ সেরকম নির্লিপ্ত হতে পারে। নির্লিপ্ততার সাধনা গৃহী উপাসকের জন্য কঠিন। তবে সুদত্তর কাছে নয়। কারণ তিনি এর পূর্বেই নির্লিপ্ততার পরিচয় রেখেছেন। তাঁর উপার্জিত অর্থ তিনি দান করে থাকেন। এই ত্যাগই জীবনের আদর্শ।
তথাগতর মহিমা, তাঁর রূপ ও বাক্যে মোহিত হলেন সুদত্ত। ফিরে আসার আগে একটি নিবেদন রাখলেন। “হে গৌতম, আপনি শ্রাবস্তীতে বর্ষাবাসের আতিথ্য গ্রহণ করুন। আমাদের একান্ত সৌভাগ্য হবে, যদি আপনি আপনার সমস্ত শিস্য সমভিব্যাহারে শ্রাবস্তীতে এসে আতিথ্য গ্রহণ করেন। গৌতম স্মিত আননে চেয়ে রইলেন। এই বণিকের সম্পদ এতটাই, যে তিনি এতগুলি ভিক্ষুসহ গৌতমকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। মহৎ প্রাণ সন্দেহ নেই। তিনি অনুমতি দিলেন।
শান্ত স্থির মনে সুদত্ত ফিরে চললেন শ্রাবস্তী। তাঁর গন্তব্য রাজপুত্র জেতকুমারের ভবন। তাঁর উদ্যানটি ক্রয় করতে পারলে একটি বৃহৎ বিহার নির্মাণ করতে সমস্যা হবেনা।
0 comments: