0

প্রবন্ধ - সৌমিত্র বসু

Posted in



প্রবন্ধ


আমাদের কথা 
সৌমিত্র বসু 



তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগে অন্তর্মুখ নামে একটি দল ছিল, নানা অনিবার্য কারণে বন্ধ হয়ে যায়। তিন বছর আগে, অন্তর্মুখ যখন নতুন করে শুরু হলো, এবং আমাকেই দায়িত্ব নিতে বলা হলো, আমার শর্ত ছিল, আর পাঁচটা দলের মতো করে নাটক করব না, নাটকের নতুন নতুন পথ আবিষ্কারের চেষ্টা করব, থিয়েটারের নামে যে বিলাসিতার চর্চা হয়, তার মধ্যে ঢুকব না। কী আশ্চর্য, বেশ কিছু ছেলেমেয়ে রাজি হয়ে গেল এই শর্তে। মিডিয়াস্বীকৃত ধরণের বাইরে নাটক করার তিন বছর পূর্ণ হয়ে গেছে এর মধ্যে, সামান্য দু-একজন ছাড়া কেউ চলে যাবার কথা ভাবেনি। চলে যেতে হয়েছে অবশ্য অনেককে, মেয়েদের বেলায় স্বামী-সংসারের চাপ, ছেলেদের ক্ষেত্রে রুজি রোজগারের জন্যে, কিন্তু তাদের মন যে দলের জন্যে পড়ে আছে, তা বেশ বুঝতে পারা যায়। অন্তর্মুখ কখনও কাউকে বাধা দেয়নি, খুব কষ্ট, খুব অসুবিধে হলেও দেয়নি। সব মিলিয়ে দিব্যি আছি। আমরা, সম্ভবত প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া নিয়ে স্টারদের ডেকে যাঁরা বৈভবের থিয়েটার করেন, তাঁদের চেয়ে ভালোই আছি। এর মধ্যে এই অন্য রকম করে নাটক করার ব্যাপারটা বেশ খানিকটা জানাজানি হয়ে গেছে, অনেকেই মুখে অন্তত সমর্থন করেছেন, মন থেকে পছন্দ করেছেন কিনা জানি না। তবে যাঁরা প্রচলিত ধাঁচায় নাটক করেন, তাঁদের কাউকে নিজেদের দিকে টেনে আনতে পারেনি অন্তর্মুখ, যতই ঘাড় মাথা নেড়ে সায় দিন, বৈভবের থিয়েটারকে ত্যাগ করার ঝুঁকি কেউ নিতে পারেননি বা চাননি। বললাম বটে, কিন্তু ঝুঁকিটা কিসের তা আমার মাথায় অন্তত ঢােকে না। যেমন, একজন আমাকে বলেছিলেন, এই বয়েসে এই রকম একটা কাজ শুরু করতে প্রচুর দম লাগে। বুঝি না, এর মধ্যে আবার দমের কী আছে, করলেই তো হয়। 

মজার ব্যাপার হলো, আমরা যে অন্যভাবে নাটক করার চেষ্টা করছি, সেটাকে বাদল সরকারের পদ্ধতি থার্ড থিয়েটারের পদ্ধতি ইত্যাদি বলে দেগে দেবার একটা প্রবণতা খুব আছে। কিন্তু সত্যিই বলছি, আমরা নির্দিষ্ট কোনও পদ্ধতি মাথায় রাখছি না, পথ চলতে চলতেই পথ চিনে নেব, এই আমাদের ইচ্ছে৷ প্ৰসিনিয়মকে বাদ দেবার কথা ভাবিনি কখনও, উঁচু পাটাতনে নাটক করায় কোনও আপত্তি নেই। বস্তুত, আমাদের মতো দেশে যেখানে থিয়েটার বলতেই উঁচু পাটাতন বা প্রসিনিয়ম মঞ্চ বোঝায়, সেখানে এদের বর্জন করতে চাইলে অভিনয়ের পরিসর সংকুচিত হয়ে যেতে পারে বলে আমাদের ধারণা। উঁচু জায়গায় উঠে নাটক করব না, দর্শকদের সঙ্গে সম উচ্চতাতেই আমাদের স্থান, দর্শনের দিক দিয়ে এ কথার প্রভূত গুরুত্ব থাকতেই পারে, কিন্তু এই ভাবে নাটক করলে অনভ্যস্ত মানুষ একটু সন্দিহান হয়ে ওঠেন দেখেছি। আমাদের থিয়েটারে আরও কিছু কিছু উপাদান রাখা আছে, যার সঙ্গে থার্ড থিয়েটারের দর্শন মিলবে না। বেশ কিছুদিন আগে আয়নার উদ্যোগে একটি নাট্যোৎসবে অভিনয় করার সুযোগ হয়েছিল। আমাদের প্রযোজনা তাঁদের খুব ভালো লেগেছিল, কিন্তু স্বীকার করেছিলেন, তা ঠিক তাঁদের ধাঁচাকে মেনে তৈরি হচ্ছে না। আমরা অল্পস্বল্প সেট ব্যবহার করি, যা ট্যাক্সির পেছনে তুলে নিয়ে যাওয়া যাবে। আমন্ত্রণকারী সংস্থা যেমন যেমন আলো ব্যবস্থা রাখেন সেই অনুযায়ী আলোও ব্যবহার করে থাকি, অচ্ছুৎ বলে মনে করি না মেক আপ বা পোশাককেও। নাটকের শেষে দর্শকদের কাছ থেকে অর্থ দাবি করি, ভিক্ষে না। 

একবার মাথায় একটা পরিকল্পনা এল, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কাজে থিয়েটারকে ব্যবহার করলে কেমন হয়? মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রায়ই আসে, ইতিহাসের এমন তিনটে বিষয় বেছে নেওয়া হলো। চিরস্থায়ী ব্যবস্থা, সাঁওতাল বিদ্রোহ আর সিপাহী বিদ্রোহ। ছোটো বড়ো যা যা প্রশ্ন এসে থাকে তাদের জড়ো করা হলো, তারপর এমন ভাবে নাটকটা লেখা হলো, যাতে নাটকের মধ্যে সব উত্তরগুলো পাওয়া যেতে পারে। পরিকল্পনাটা শুনে অনেকেই উৎসাহ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সরকারের শিক্ষাবিভাগের কর্তাব্যক্তিও কেউ ছিলেন, তিনি আবার আমার এক সময়ের ছাত্র। শুনে বলেছিলেন, নাটকটা তৈরি হয়ে গেলে আপনি আমাকে একবার ফোনে জানাবেন৷ ফোনে পাই নি, এসএমএস করে জানিয়েছিলাম, কোনও সাড়া পাইনি। স্কুলগুলো সার্বিকভাবে খুব উৎসাহী হয়েছে এমন নয়, তার একটা কারণ, বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোর খুবই দৈন্যদশা, সামান্য এক দু’হাজার টাকা দেবার মতো তহবিলও তাঁদের নেই। স্কুলের পরিচালন সমিতিগুলোয় যাদের গলার আওয়াজ বেশি তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্কিত নন, ক্লাস চালানোর বাইরে অপ্রথাগত সব কিছুকেই তাঁরা সময় নষ্ট বলে মনে করেন। তাঁদের যতই বোঝানো হোক, বাগে আনা মুশকিল। তবে কোনও কোনও স্কুল ডেকেছেন, আর বলবার মতো কথা, কোথাও ছাত্ররা আমাদের প্রতি বিমুখ হয়নি। 

একটি স্কুলের কথা বিশেষ ভাবে বলতে ইচ্ছে করছে। আমতার ভেতরের দিকে, খুবই দরিদ্র বাড়ির মেয়েরা পড়ে সেখানে। কর্তৃপক্ষ বলে দিয়েছিলেন, ফান্ডে টাকা নেই, তবে মেয়েরা যদি কিছু দেয় তার জন্যে তাঁরা বলে রাখবেন। প্রায় পাঁচশ মেয়ে দেখল সে নাটক, থলে ভর্তি করে মিলল পারিশ্রমিক, সত্যি সত্যি একটা বড় গোছের বটুয়া, ডট পেন দিয়ে আঁকাবাঁকা হরফে লেখা সনজিদা খাতুন, পাশে ফুলের ছবি আঁকা। দু’হাজার উনিশ টাকা, এক টাকা দু’টাকা পাঁচ টাকার খুচরোয়। সে থলে কী ভারি কী ভারি, বয়ে আনতে পারি না, চোখে জল এসে যায়। অথচ, এ নাটক নিজেদের মহলাঘরে দু’চারজন শিক্ষককে প্রথম দেখিয়েছি, তাঁরা নানা পরামর্শ দিয়েছেন। সে সব কিছু দরকার হয়নি উদ্দিষ্ট দর্শকদের মুগ্ধ করার জন্যে। তা এই ধরণের কাজ সম্পর্কে সাধারণভাবে নাট্যকর্মীদের মনোভাব কী? একটা গল্প বলি। 

পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা কাজে কোচবিহার গেছি, উঠেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালায়। সকালবেলা চায়ের খোঁজে বেরিয়েছি, ওখানকার এক নাট্যকর্মীর সঙ্গে দেখা। আমি তাঁকে চিনি না, তিনিই এগিয়ে এসে আলাপ করলেন, নিয়ে গেলেন চায়ের দোকানে। যা হয়, কী নাটক করছেন সৌমিত্ৰদা? বললাম, তাতে এই ইস্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্যে করা নাটকের কথাও উঠল। সেই নাট্যকর্মী দুঃখিত গলায় বলে উঠলেন, শেষ পর্যন্ত আপনিও নৌকোয় উঠে পড়লেন সৌমিত্ৰদা! 

নৌকোয় উঠে পড়া মানে? বেশ কিছু দল আছেন, যাঁরা নানা রকম প্রকল্প নিয়ে নাটক করেন, তার বদলে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সূত্র থেকে টাকা পান। নান্দীকার এক সময়ে এই ধরণের কাজ প্রচুর করতেন, আরও অনেকে করে থাকেন। সাধারণভাবে এতে অন্যায় কিছু নেই, রাষ্ট্রের টাকায় যদি সমাজের মঙ্গল করার জন্য থিয়েটার করি, তাতে আপত্তির কী আছে। কিন্তু রাষ্ট্র সব সময়ে যে খুব সৎ ইচ্ছার বশে টাকা দেয় এমনটা তো নয়, আর উল্টোদিকে, যা হোক একটা প্রকল্প দেখিয়ে খানিকটা টাকা আদায় করাটাও অনেক সময় কোনও কোনও দলের উদ্দেশ্য হয়ে যায়। দিল্লি থেকে যে টাকা অনুদান হিসেবে বহু দলের কাছে আসে, সেও তো প্রকল্প দেখিয়েই আদায় করতে হয়। সে সব প্রকল্পের বিষয়ে বর্তমান লেখকের পরিষ্কার ধারণা আছে। অন্তর্মুখ অবশ্য ইতিহাসের গপ্পের জন্যে কোনও অনুদান পায়নি, চায়ওনি কখনও। আমাদের মনে হয়েছে, মানুষের উপকার করার দায় কেবলমাত্র রাষ্ট্র বা কোনও বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের নয়, ব্যক্তিমানুষ হিসেবে, ছোটো ছোটো গোষ্ঠী বেঁধে থাকা মানুষজন হিসেবে আমাদেরও এ ব্যাপারে নিজস্ব দায় আছে। 

আগেই জানিয়েছি, স্কুলের প্রকল্পটা খুব সফল হয়েছে এমন কথা বলতে পারব না। গরমের সময়, যখন অভিনয়ের চাপ কমে যাবে, ইচ্ছে আছে, তখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম মাথায় রেখে এই ধরনের প্রযোজনা তৈরি করব। তাঁদের মধ্যে উদার এবং সেই অর্থে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেশি, তাঁদের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ও অনেক বেশি। এমনিতেই, কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি অনুযায়ী বাংলা সাহিত্যের ছাত্রদের নাট্যের প্রায়োগিক দিক নিয়েও পড়াশোনা করতে হয়, বর্তমান লেখককে তাঁরা কেউ কেউ আহ্বান করেন বিষয়টা ছাত্রদের পড়িয়ে দিতে। তারই অঙ্গ হিসেবে হয়তো অন্তর্মুখ ক্লাসরুমের ভেতরেই একটা অভিনয় করল৷ তেমনি করে, কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে বর্তমান লেখককে পেপার পড়া বা আলোচনা করার জন্যে ডাকলে প্রস্তাব দিই, একটা অভিনয়ও করতে চাই, সামান্য পারিশ্রমিকে। কোনও জোর নেই। অনেকে রাজি হয়ে যান। তীর্থঙ্কর চন্দ একে আদর করে বলেন প্যাকেজ সিস্টেম, একই সঙ্গে বক্তা এবং নাটক দুইই পাওয়া গেল। এই সুত্রে ছাত্র এবং অধ্যাপকেরাও এই মাধ্যমটার সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন, আনন্দও পান। এই ধরণের কাজ আমরা বেশ অনেকগুলো করে ফেলতে পেরেছি। তাতে দলের ঘরে টাকা পয়সা এসেছে। আর আমাদের যেহেতু খরচ খুব কম, তাই অল্প টাকাকেই বিরাট মনে হয়। 

প্রতি বছর অন্তর্মুখ নাট্যোৎসব করে, দশঘরা নামে একটি গ্রামে। কেন গ্রাম? কলকাতা বা মফস্বলে তো নাটক হয়, নাট্যোৎসব হয়, গ্রামের মানুষের কাছে নাটক নিয়ে পৌঁছনো তো হয় না আমাদের। উৎসবটা যে দশঘরাতেই করতে হবে এমন কোনও মাথার দিব্যি নেই, এখানে এক ধরণের পরিচিতি আর প্রাথমিক পরিকাঠামোটুকু আছে বলেই করা, অন্য কোথাও সুযোগ পেলে করতে আমরা খুব রাজি। যাঁরা কলকাতার উৎসব দেখে অভ্যস্ত, তাঁরা গ্রামের মানুষের সেই আনন্দ ভাবতেও পারবেন না। কখনও কখনও বেশ পরীক্ষামূলক প্রযোজনা নিয়ে গেছি, সাগ্রহে দেখেছেন গ্রামের দর্শক, নিজের মতো করে ব্যাখ্যাও করেছেন। যেমন তেমন করে তৈরি মঞ্চ, যেমন তেমন আলো, কিন্তু দলগুলো ভরা মন নিয়ে ফিরেছেন অভিনয় করে। অন্যদিকে, গ্রামের মানুষজনের সঙ্গে দেখা হলে নাট্যোৎসবের কথা উঠে আসবেই। কি গো, এবারে হবে তো? কবে করছ? ইত্যাদি। 

আরও কিছু পরিকল্পনা আছে, হয়ে উঠছে না। যেমন, যে মানুষেরা মানসিকভাবে অসুস্থ, তাঁদের অসুখটা তো আসলে আবেগের? আর থিয়েটার তো সরাসরি আবেগের দরজায় ঘা দেয়। তা নাট্যাভিনয়ের মধ্যে দিয়ে এদের চিকিৎসায় সাহায্য করা যায় না, যাকে বলা যেতে পারে ড্রামা থেরাপি? এই কাজের পরিকল্পনা আমরা অনেকদিন আগেই করে রেখেছি, নানা ঝামেলায় হয়ে ওঠেনি, একটু গরম পড়লে সেরে নিতে হবে। 

এইভাবে শুরু করেছে আজকের অন্তর্মুখ। কতদূরে যাব জানি না, কতদিন চলতে পারব তাও জানি না। যাত্রাপথের আনন্দগান শুধু আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেবার জন্যে এই লেখা। 

0 comments: