0

গল্প - ময়ূরী মুখোপাধ্যায়

Posted in


গল্প


নটা কফিমগের গল্প
ময়ূরী মুখোপাধ্যায়



এক প্রাচীন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তত প্রাচীন নয় এক ল্যাবে নটা কফিমগ বাস করে। আর তাদের মালিক মালকিনরা, নিজেদের মধ্যে বকবক করে যেতে যাদের বিষয় বৈচিত্র্যের অন্ত নেই। সমাজনীতি রাষ্ট্রনীতির যাবতীয় সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে ওঁছা সিনেমা, বহুশেয়ারে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া মীম্স বা ক্রমাগত ডবল মিনিংওয়ালা পচে যাওয়া জোকস.. কোনও বিষয়েই এদের গুরুগম্ভীর মতামত দেওয়া থেকে কিছুতেই নিরস্ত করা যায় না। তুচ্ছাতিতুচ্ছ পাতি ব্যাপারগুলো যেমন আজ জন্মদিনের কার্ড-কেক কিনতে কে যাবে বা সমানে বেজে যাওয়া ল্যান্ডফোন কে ধরবে এই নিয়ে ঝগড়া দোষারোপেও তাদের কেউ অন্যের থেকে পিছিয়ে থাকেনা।

ওইখানেই আছে লেট লতিফ হদ্দ কুঁড়ের দল, হাজিরা দিতেই যাদের গায়ে জ্বর চলে আসে। আর নাম না ডাকতেই লাফিয়ে প্রেসেন্ট প্লিজ বলে ওঠা গুটিকয়েক চৌবাচ্চা যারা প্রথমে ল্যাবের চাবি খোলার কম্পিটিশনে নাম লেখায় রোজ। এদের মাঝে ছটা দশ বাজলেই কোনওমতে ঝাঁপিয়ে আগে বালিগঞ্জ, তারপর ডাইরেক্ট ট্রেন ধরতে দৌড় দিত দু একটা ডেলি প্যাসেঞ্জারি পাবলিক; পাঁচদিনের মধ্যে তিনদিন অবধারিত ভাবে কানেক্টিং ট্রেন মিস করায় নিজেকে গালাগালি দিয়ে ভিড়ে ঠাসা গেদে বা বনগাঁ লোকাল জ্বলজ্বল করত যাদের ফাটা কপালে। কারো কারো আছে কাজ/অকাজ করতে করতে শিকড় গজিয়ে যাওয়ার ব্যামো, রাত দশটা বাজলে তবেই এদের মনে পড়ে মেসে যাওয়ার ফাঁকা রাস্তায় দশাসই নেড়িগুলোর চিলচিৎকারের অভ্যেস বরাবরের।

তামিলনাড়ুর চন্দ্রবাবুনাইডু অবধি ক্যান্টিনে "দাদা আমাকে একটু পাঁচশো টাকার কুচরো দেবেন?" বলা শিখে ফেলল, তাকে উৎসাহিত করার বদলে কুচরো/কাবার নিয়ে চলে সমানে পা টানাটানি। এরই মাঝে কাজে ফাঁকি দেওয়া অহেতুক কৌতূহলী, চায়ে চুমুক দিতে দিতে লক্ষ্য করে যায় তবে কি সব তামিলেরাই বর্গের প্রথম আর দ্বিতীয় বর্ণের উচ্চারণ আলাদা করতে পারে না? আর এদিকে যে বাংলা-ঝাড়খণ্ড-আসাম-উড়িষ্যার বাকি আটজনে মিলেও পান্নিকুট্টি আর নান্দ্রে ছাড়া দুটোর বেশি তিনটে তামিল শব্দ শিখতে ফেল করে গেল, দলভারীরা বেমালুম সে কথা চেপে যায়।

দিন আসে দিন যায়, কফির কাপ উপছে পড়ে র, গাড়, চিনি ছাড়া, দুধ ছাড়া, কমদামি ক্যান্টিনের তিন টাকা, বেশিদামি বেশি দুধের সর ভাসানো (ইয়াক) দিদির দোকানের দশ টাকা, মুন্নারের জিঞ্জার কফি, কফি ডে-র কার্ডমম চায়ে। সারাদিন নচিকেতার গান বাজানো ফুটপাথের দোকানে সদলবলে চা খেতে গেলে মুখভার হয় পোষা কফিমগগুলোর। "দিনে তিন লিটার জল খাবোই", রেসলিউসন ফলোকারীর পাল্লায় পড়ে আট দশবার জলে ভরে ওঠে ওদের মধ্যে পেটমোটাটা।

চা নেশাড়ু ফিটনেস অবসেসড পাড়ি দিয়েছে ডায়ানামাইট ভাইকিংদের দূরদেশে। যাওয়ার কদিন আগে অবধি প্রায়ই গুণত "আজ সকাল থেকে ছ কাপ চা/কফি হয়ে গেছে, বড্ড বাড়াবাড়ি বল"? আবার ওখানের গ্রসারি স্টোরে পটল পাওয়া যাবে না এই আক্ষেপে দশ মিনিট পরেই দুঃখ ভুলতে ছুটত সাত নম্বর কফি খেতে । কলকাতা-পাটনা-দিল্লি-রাঁচির বৈবাহিক চতুর্ভুজে থেকেও "চায়ে তো বিলকুল নেহি" আবারো এখানে ফিরে আসে ফেলে যাওয়া কাজ শেষ করতে। গোলাপি রিং রিং কফিমগ হাতবদল হতে হতে পুরোনো মালকিনের কাছে নতুন করে চেনা আদর খায়।

এদের মধ্যেই আছেন পৃথিবী উল্টে গেলেও আমার এক্স/ওয়াই/জেড কাপটাই চাই, চাই, চাইই ছিঁচকাঁদুনে। আবার উল্টোদিকে লাল/সাদা/কালো, আস্ত/হাতলভাঙ্গা/অনাদায়ে পাতলা কাগজের কাপ হলেও হয়, না হলেও হয়; আলুপকোড়ায় আলু না থেকে শুধু ব্যাসনেও চলে, ক্রিম বিস্কুটের ক্রিম না থাকা খসে পড়া দিকটা দিলেও সোনামুখ করে খেয়ে ফেলবে এমন লোকজনদেরও কমতি নেই ।

এদের এককাঠি উপরে কুঁড়ের কুঁড়ে ফাঁকিবাজ পাবলিক, যে সারাদিন ধরে খাওয়া চকলেটের ফয়েল, ফলের বীজ, কমলার খোসা, বাতিল কাগজের পাকানো গুলি ফেলার অস্থায়ী ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করে অত সুন্দর কফিমগটা ( হেঁ হেঁ এর ধরণ ধারণ খুব চেনা চেনা লাগছে না?) । কফিমগের চূড়ান্ত অপব্যবহার দেখে শিউরে ওঠে নিপাট সংসারী ভীষণ শান্তশিষ্ট নিয়মনিষ্ঠ ভদ্রলোক। অবশ্য তাঁর সব কথা শুনতে গেলে তো প্রতিবার চিনামাটির কফিকাপ থেকে আগে তাপসহ বোরোসিল গ্লাস বিকারে চা ঢেলে মাইক্রোওয়েভে গরম করে তবে চা খেতে হয়। পাগল নাকি!

সবার থেকে দূরে বসে থাকে গম্ভীর ভারিক্কি এক কফিমগ। আলাদা কফি মেকার থেকে অভিজাত চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি ঢালা হয় তার গহ্বরে, কখনো জানলার পাতাবাহারি টবের পাশে সাজানো থাকে ধোঁয়া ওঠা ধ্রুপদী গ্রীন টি। স্বাস্থ্যকর, নির্ভেজাল, বিশুদ্ধ (একটু বিস্বাদও নয় কি?)। এত কিছু সত্বেও সে বেচারির জন্য বাকিদের হিংসে তো হয়ই না, উল্টে দুঃখ হয় একটু আধটু। সবকটা মোটা ফর্সা পাতলা লম্বা হাতলভাঙ্গা স্বচ্ছ ঘোলাটে কফিমগ যখনতখন হাসি-ঠাট্টা-আড্ডায় তুফান তুলতে পারে, দরকারমতো আজ ট্রেন থেকে পড়ে যাওয়ার পুরো ছুটি, কাল আধার কার্ড করানোর হাফ ছুটি, পরশু বন্ধুর বিয়ের কোয়ার্টার ছুটির অজুহাত চাইতে পারে। কিন্তু সেই বেচারি ভারিক্কি কফিমগের মিটিং/গ্রান্ট/পেপারের গুরুদায়িত্ব ছেড়ে খুশিমত পালানো মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়।

আসলে এতগুলো কফিমগ মিলে করেটা কী সে গল্প নাহয় পরে কখনও হবে!

0 comments: