0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - নিলয় কুমার সরকার

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


রাঢ় বাঙলার পটশিল্প ও পটের গান
নিলয় কুমার সরকার


এবারের নবরাত্রে আমি ছিলাম ঝাড়খণ্ড, জামশেদপুর থেকে পনেরাে কিলােমিটার দূরে সুন্দরনগর! পাহাড়ের পাশে সংলগ্ন গ্রামে বসেছে মিনাবাজার! নবরাত্রের কটা দিন চলবে মেলা! মেলায় চাহিদা থাকলে হয়তাে এই মিনাবাজার থেকে যাবে পুরাে এক মাস! মেলায় ঘুরতে ঘুরতে আলাপ হলাে বিচিত্র এক পেশাজীবী মানুষের সাথে! তিনি আমাদের সুখিচিত্রকর! পরিবারিক নিবাস মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম, কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বনায় আট থেকে এগারাে বয়সের জনা তিন নাবালক কে নিয়ে সুখি এসেছেন এই বিকিকিনির হাটে! না তার বিক্রী করার মতাে কোনও উপাদান নেই! একটা বড় পোঁটলার পাশে রাখা ছবি আঁকা কাগজের মস্ত একটা রােল রাখা আছে, সেই রােল গুলাে তুলেই মেলায় সুখির গান গাওয়া, যা হলাে গ্রাম বাংলার লােকায়ত গান ...তথা পটের গান! রংচঙে ছবি আর পুরাণ কেন্দ্রিক কথকতা দেখা ও শােনার জন্যই হাজির হন কিছু স্থানীয় মানুষ! তাদেরই নিয়ে সুখির জীবিকা নির্বাহ, রাঢ়-বাঙলার মাটি ছেড়ে, মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে, গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে, বাঙলার পট শিল্প হেঁটে চলেছে, ঝাড়খণ্ড এর প্রান্তিক বাঙালি অধুষিত তেপান্তর ...

সুখি চিত্রকর ধর্মে মুসলিম কিন্তু ফেরি করেন হিন্দু পুরাণ! উনি একজন তালাক প্রাপ্ত মহিলা দু মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে তার ভ্রাম্যমাণ রুটি রুজির লড়াই! আলাপ চারিতায় জানলাম ওনাদের সমাজে হিন্দু মুসলিম মিশ্র রীতি রেওয়াজ প্রচলিত, যেমন ওঁর এক মেয়ের নাম 'জরিনা', অন্য মেয়ের নাম 'শঙ্করী' -ছেলের নাম 'আল্লারাখা'! ওঁর ফেলে আসা সংসারে হিন্দু মুসলিমের সমস্ত সামাজিক উৎসবই পালিত হতাে! যেমন নববর্ষ, ইদুলফিতর, দোল, দুর্গাপূজা, কালীপুজো, বিশ্বকর্মাপুজো, সবেবরাত, প্রায় সব উতসবই প্রচলিত ওঁদের মহল্লায়!

পট আঁকিয়ে চিত্রকর সমাজ নাকি বিশ্বাস করেন বিশ্বকর্মার ঔরসে ঘৃতাচারীর গর্ভে পটুয়া চিত্রকর সমাজের জন্ম! তাই বিশ্বকর্মা পুজোর দিন চিত্রকর সমাজ খুবই শুদ্ধাচারে তাদের যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে তেল মাখিয়ে রােদে শুকিয়ে, সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া বাস্কে তুলে রেখে, নিষ্ঠার সঙ্গে বিশ্বকর্মার পুজো করেন! পুজো নিজেরাই করেন, কারণ ওঁরা সামাজিকভাবে পতিত হওয়ায় কোনও ব্রাহ্মণ তাদের পুজো করেন না! বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটাতে তারা কোনাও রকম যন্ত্রপাতি না ছুঁয়ে সম্পূর্ণ দিনের কর্মবিরতি পালন করেন।

চিত্রকর সমাজের বিয়ে থা-র সময় কাজী আসেন, দেনমােহর ও হয়! লােকাচার রয়েছে হিন্দু বাড়ী থেকে পায়েস নিয়ে আসা, সত্যনারায়ণের প্রসাদ নিয়ে আসাও হয়! বিয়েতে অবাধ মদ গাঁজার আয়ােজনও থাকে, ছরলা তলা, পুরুল ভরা, জল কাটা, বাজনা বাজানাে, লৌকিক রেওয়াজ প্রচলিত! আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার বিবাহিত মেয়েরা শাঁখা-সিঁদুর কিন্তু ব্যবহার করেন এয়ােতির চিহু স্বরূপ! আবার যখন তখন তালাক প্রথাও হামেশাই হয়ে থাকে।

চিত্রকর কেউ মারা গেলে তাঁর মৃতদেহ সৎকার হয় কবর দিয়ে! দাহ প্রথা নেই বললেই চলে, মৃত্যুর পর সাধারণতঃ সাত বা এগারােটা কুল পাতা সেদ্ধ জলে মৃতদেহ স্নান করানাে হয়! তাদের বিশ্বাস বিদেহী আত্মা এক্ষেত্রে তাদেরই কূলে ফিরে আসতে পারে! কবর দানের দিন সাধ্য মতাে উপস্থিত সবাইকে ভােজের ব্যবস্থা করানাে হয়! কিন্তু এর পরের প্রথা প্রান্তিক হিন্দুদের মতাে! চল্লিশ দিন ধরে চলে পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম, আচার, বিচার, লােকাচার  সমাজে কেন চিত্রকর পরিবারগুলি পতিত তা আর সুখি চিত্রকরের জানা নেই! সে শুধু জানে সে এক ব্রাত্য উপেক্ষিত নারী! এই মেলায় ঘুরে ঘুরেই নির্বাহ করতে হবে চারজন মানুষের জীবন ধারণ সামগ্রী শুরু হয়। তাদের প্রকৌশল শাকিলা একটা ডুগডুগি হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরেই বাজাতে থাকে! সুখি তখন এক মনে ছবি আঁকে! মেলায় বসে যা আঁকেন, সেখানে তিনি বাজারের জল রঙই ব্যবহার করছেন! তার রঙ মেলানাের মায়াজালে, হাজির হয় মেলার মানুষ, শুরু হয় লােকায়ত গান! আমার শুনছিলাম ওদের কণ্ঠে পুরাণ ভাষ্যে পটের গান! প্রথম পর্বের গান শােনার পর, সুখি চিত্রকরকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি যে কাল বললেন, পটে জৈব রঙ ব্যবহার হয়, কিন্তু এখানে তাে দেখছি বাজারের জল রঙেই ছবি আঁকলেন! সুখি হাসলেন বললেন, আমরা যখন দুর্গা বা রাসের অর্ডার পেয়ে কাজ করি, তখন কাজটা হয় সম্পূর্ণ অন্য রকম! তখন সবুজ রঙ তৈরী হয় শিম পাতার রস থেকে, কালো রঙের জন্যে ব্যবহার হয় ধান সেদ্ধ করা হাঁড়ির নীচের কালাে ভুসাে, ব্যবহার হয়। হুলুদ, খয়ের, অনেক রকম পাথরের গুঁড়াে, টাটকা গঁদের আঠা, ইত্যাদি। এ ছাড়াও ব্যাবহার হয় আমলকি, হরিতকি, বহেড়া, কাইবিচি, আধপাকা বেল ও তার আঠা! এই উপাদানগুলাে দিয়ে ছবি একে তার তলায় চিটকানাে হয় পুরনাে পাতলা সুতির কাপড়! এই পটগুলাে মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়!

সাধারণত পট আঁকার কাজ যখন খুশি হয়ে থাকে! তবে যখন দুর্গা বারাসের ঠাকুর গড়ার সময় কাজ চলে খুবই শুদ্ধভাবে! প্রথম স্নান সেরে নিয়ে কাজ ধরতে হয়, কাচা কাপড় পরে, সরস্বতী ও বাবা বিশ্বকর্মাকে স্মরণ ও প্রণাম করে শুরু হয় কাজ, এটা না করলে কোনাও কাজই ঠিক ঠাক হবে না! কাজ শুরুর সময় পটপ্রতিমায় একটু মাটি ছুঁইয়ে প্রণাম করতে হয়! কাজের সময় কোনও কথা বলতে নেই, মুখের থুতু ছিটকাতে পারে, এইজন্যে! কাজ করতে করতে পা লেগে গেলেও পটে আবার প্রণাম করতে হয়! শুধু লক্ষ্য রাখতে হয়, মাথার চুল যেন কোনওভাবেই পটে লেপ্টে না যায়! এর জন্যে বড় রুমাল দিয়ে কাজ চলাকালীন সময়টুকু মাথা বেঁধে রাখা হয়! এর পর চোখ পাকিয়ে সুখি চিত্রকর প্রশ্ন করে, এত শুধােন কেন বাপু, আমার কি কাজ কাম নেই, আপুনি কি কাগজের নােক! এক আতঙ্কিত জিজ্ঞাসু চোখ স্থির তাকিয়ে আছে আমার দিকে! আমি ওঁকে আশ্বস্ত করে বলি, আমার হাতে ব্যাগ পত্তর কই, ক্যামেরা কই, আমি হুগলির লােক এই গাঁয়ে এসেছি আত্মীয়র বাড়ী বেড়াতে, এই অজগাঁয়ে কাগজের লােক আসবে কেনে? কথা গুলাে যেন বিশ্বাস করলাে সুখি...বললাম আমাদের হুগলিতে একবার পট গাইতে যাবে? আমার কথায় হাসি হাসি মুখে বললাে, এই তাে, দু বছর আগেই গিয়েছিলাম আরামবাগের মেলায়!

বাংলার পটের মূল আখ্যানধারাগুলাে এই রকম যেমন রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, শ্রীচৈতণ্যর জীবন কথা, যমের দরবারে বিচার, ওড়িশার পট-জগন্নাথ, বলরাম, শুভদ্রা, পীরমাহাত্য পট, ইসলাম গাজীর পট, এ ছাড়াও রয়েছে খ্রিস্টেরপট নিয়ে চিত্রকলা আর লৌকিকগান! তবে লােকগানে সবচেয়ে প্রধান বিষয়। হলাে আশাবাদ! এই আশায় লােকগান ঘুরে চলে গ্রাম গ্রামান্তর!

আসুন দেখা যাক, পটের গানের লােকগাথা তাহলে কেমন :


রামগাথা পটের গান 

রাম রাম পিভূ রাম কমললােচন
দিব্যাদলে শ্যাম রাম জানকীই জীবন
রথের উপরি রঘুনাথ কিঞ্চিত ভূমিস্থলে
হৃদয় পেসন্ন রাম, মধুর বাক্য বলে।
বামে সীতা বসিবে ডাইনে লক্ষণ
রত্ন সিংহাসনে বসে প্রভু নারায়ণ
যাহার নাম লইলে খণ্ডিবে দেহের পাপ 
পুরাণে ছিলেন বাল্মীকমণি জানিবেন আপনি 
ছিরাম জন্মিবে প্রভু জানিছে আপনি
পিতা হবে দশরথ অজির নন্দন
রামের কথা কিবা কব বাখান
যাহার গুণে বনের বন্দী পাষাণ ভাসে জলে
শিকার করিতে রাজা করিলেন সাজন
সিন্ধুমণির স্তপবনে রাজা দিল দরশন 
সিন্ধুমণিকে বাণ মারে সুরয নদীর কোলে
রাম নামের ধন্যি রাজা কর্ণেতে শুনিল 
হাতের ধেনুক বাণ রাজা ভূমিস্তে রাখিল 
পাতালি কোলে কোরে আসি কন্বমনির নিকটে আসিল!!

নেপুরের উনুঝুনু প্রভু শুনিতে পাইল 
এসাে এসাে বলে কথ সম্ভাষণ করিল 
এক নিবেদন করি গাে, মনি মহাশয় 
তােমার সিন্ধু মারা গেছে সুরয নদীর কূলে
আরে কি কার্যকরিলি রাজা কি কার্যকরিলি
আমার অন্ধের নড়ি রাজা তু কেন ভাঙ্গিলি
আমি যেমন পুত্র শােক পাইলাম আচম্বিতে 
এমনি পুত্রশােক রাজা পাবি অযােধ্যা নগরে
অপুত্রবর ছিল- রাজার পুত্রবর হইল 
সহস্তি সহস্তি করে নাচিতে লাগিল।
মিথিলা নগরে আসি যজ্ঞ আরম্ভিল
ঋশ্যশৃঙ্গ মুনি এসে যজ্ঞ পূর্ণ দিল
যজ্ঞ থেকে দুইটি তরু জুটিল। 
মিথিলা, কৈকয়, কৌশল্যা, বঁটিয়া খাইলাে
রাম, লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্ন চার ভাই জন্মিল।
কত বাদ্য বাজনা বাজিতে লাগিল।
আনন্দেতে দশরথ পুত্র লয়ে কোলে
লক্ষ লক্ষ চুম্ব দেন বদন কমলে
রাম লক্ষণের কথা বিশ্বামিত্র শুনিতে পাইল
শ্রীরাম সইতে প্রভু যাত্রা করিল
রাম লক্ষণ চাইতে দশরথ
রামলক্ষণ লুকায়ে থুয়ে ভরত শত্রুঘ্ন দিল
ভরত শত্রুঘ্ন লইয়া প্রভু যাত্রা করিল
তেমাথা রাস্তায় এসে যাত্রা শুধাইলাে
ছ'দিনের পথে যাবে না ছ'মাসের পথে যাবে?
ছদিনের পথে প্রভু কিবা ভয় আছে?
তাড়কা রাক্ষস বধে হে পরাণে।
তাড়কার নাম যখন ভরত-শত্রুঘ্ন শুনিল
ডরে ডরে কম্পমান কাঁপিতে লাগিল
বিশ্বামনি তখন অভিসম্প করিল
অযােধ্যানগরে মনির শাঁপেতে অগ্নিবৃষ্টি হলাে
রাম-লক্ষণ তাহা জানিতে পারিল।
বিশ্বামিত্র মনি পুনরায় আসি রাম লক্ষণে লইল
আচম্বিতে মেঘবৃষ্টি হয়ে অগ্নি নির্বাণ হইল
তেমাথার রাস্তায় এসে যাত্রা শুধায়
ছ'দিনের পথে যাবে না বাপু ছ'মাসের পথে যাবে?
ছ'দিনের পথে প্রভু কিবা ভয় আছে?
তাড়কা রাক্ষস বধে হে পরাণে
তাড়কা বধিতে রাম চলিল বনেতে
তাড়কার সঙ্গে যুদ্ধ হইল বহুতর
তরনীর ঘাটেতে রামচন্দ্র খেয়ায় পার হইল
কাষ্ঠের তরণীরামের রেনু ঠেকাইতে স্বর্ণময় হইল
পঞ্চবটির বনে এসে রাম দরশন দিল
তাড়কা রাক্ষস বধিল পরাণে
পড়ল বিটী তাড়কা শব্দ গেল দূর
এমত প্রকারে মরে দাতার শত্ত্বর
শ্বেত কাগ বধে রাম বধে উদয়গিরি
কুল ছেড়ে বিবাহ হচ্ছে জানকী সুন্দরী
হরের ধেনুক ভেঙে রাম, সীতা পেলেন দান
বিয়ে করে রাম দোলায় চড়ে যান
ঘরের দুয়ারে অক্ষর দেখিবারে পায়
চৌদ্দ বত্সর রামের বনবাস।
পিতার সত্য পালিতে রাম চলিল বনবাস 
রাজপােশাক ত্যাগ করিল রাম
জটা বাকল পরিধান!


অনেক সময় রামায়ণের একটা মাত্র ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নানান পটচিত্র আঁকা হয়ে থাকে! পটুয়াদের কাজ হলাে সবচেয়ে জনপ্রিয় সর্বজনীন আবেদন ভিত্তিক একটা কাহিনীর সন্ধান! যেমন আর একটা লােকগাথায় পাওয়া গেল, এই পদ :-

পটকথা সিন্ধুমনি বধ

রজ রাজার পুত্র রাজা নামে দশরথ
শােভা করে বসে রাজা যত প্রজাগণ
অপত্রিকা বলে রাজা দেশে নাহি রহিব
আজ হতে অযােধ্যা মােরা পরিত্যাগ করিব 
রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায় 
গিন্নির পাপে গৃহস্থ নষ্ট লক্ষী উড়ে যায়
নারদ মুনি বলে, কথা শুন মহাশয়
শনিকে জিনিতে পারলে রথসজ্জা হয়
নারদের কথা রাজা কর্ণেতে শুনিল
শনিকে জিনিবার তরে রথ সাজাইল
জামা জোড়া নিল ঘােড়া পায়েতে পামরী
গলেতে তুলসীর মালা বিনন্দে লগুরী
শনি রাজা বসে আছেন ধর্ম সিংহাসনে
শনিরি রিষ্টিতে রথ ওড়ে স্বর্গ পানে 
রথ রথী সারথী ঘােড়া উরিতে লাগিল
কোথায় ছিল জটায়ু পক্ষ, রাজ ধরি নামাইল
আপনার গলের পুষ্পমালা জটায়ুর গলে দিল 
জনমে জনমে রাজা মিত্রতা পাতাইল
আমার মিতে, জটা তােমার আমি মিতে
ওগাে বিপদে সম্পদে যেন মনেরেখাে মিতে
বনে থাকি বনের পশু রাজা মিত্ততার কিবা জানি
আমার সঙ্গে মিত্ততা রাজা পাতায়েছ আপনি
এই খানে থাক মিত্ত রথ আগুলিয়া
আজ মৃগ শিকার করে আনি বনল কাননে
ব্রত একাদশী করেছিল বনের অন্ধক ব্রাহ্মণ
পারণের জল আনরে বাপ গুণের সিন্ধমনি
নিত্য নিত্য যাই সরােবরের ঘাটে
আজতাে যাবাে না, পিতা, কি আছে কপালে
কাল গেছে বাপ, একাদশী আজ ব্রাহ্মণ ভােজন
শিগির করে জল আন, বাপ, করিব পারণ
ওই কথা শুনে সিন্ধু কমুণ্ডল লিল হাতে
কাঁদিতে কাঁদিতে জল আনিতে যায় সরােবরের ঘাটে
সরােবরে জল পােরে আনন্দিত আনন্দিত মনে
জলের ভুকভূকি রাজা কর্ণেতে শুনিল 
বনের মৃগয়া হরিণ বলে বাণেতে বধিল
কে মেলি ব্রহ্মাস্ত্র আমার দেহ গেল জ্বলে
মাতাপিতা কাঁদছে আমার ওগাে বনেরি ভিতরে
কাল গেছে ব্রত একাদশী আজ ব্রাহ্মণ ভােজন
শিগির করে জল লয়ে যাও করবে পারণ
এই কথা বলে সিন্ধু প্রাণ পরিত্যাগ করিল 
সরােবরের ঘাটে সিন্ধু ভাসিতে লাগিল 
সিন্ধুকের কথা শুনে রাজা ওগাে ঘােড়া হতে নামিল
আজ মরা সিন্ধুকে রাজা কোলেতে করিল
স্ত্রী হত্যা, ব্রাহ্মণ হত্যা, করিলাম সুরাপান
চার পাপের পাপী হলাম মুখে আনে রাম নাম
মরা-সিন্ধুক কোলে কোরে মুনির দ্বারে গেল 
পাতার মচমােচি মুনি কর্ণেতে শুনিল
কে এলি বাপ সিন্ধুক এলি বলয়ে বচন
মা বলিয়ে ডাক রে বাপ জুরাক রে জীবন
তােমার পুত্র নয় মুনি করি নিবেদন
জানাতে বধ করেছি তােমার নন্দন
কি বেরইল মহারাজ তােমার কি বেরইল মুখে 
আকাশ পাতাল ভেঙ্গে পরে অন্ধকমুনির বুকে 
হায় হায় বলে অন্ধকিনী কপালে মারছে ঘা
কোথায় গেলি গুণের সিন্ধুক একবার মা বলে যা
পাঁচ নয় ছয় নয় আমার একা সিন্ধুক মণি
কি অপরাধ করেছিল জানলে ডন্ড দিতাম আমি
একা সিন্ধুক মেলি না রাজা মেলি রে তিন জন
রাজার যদি না আছিল পুতুর পুত্তর বর পেলি
অপুত্র মহারাজা ওগাে পুত্তর বর পেল।
মরা সিন্ধুক কোলে করে নাচিতে লাগিল 
চার পুত্র পাবি রাজা রাম কে দিবি বন
খাট পালঙ্গ পেড়ে সেদিন আমার মতন তেজিবি জীবন
রাম না জন্মাইতে ছিল ষাঠ হাজার বৎসর 
বাল্মীক মুনি ছিল পুঁথি পেয়ে ব্রহ্মার বর 
ব্রাহ্মণ শাপে অন্ধক মুনি দশরথে দিল
সিন্ধু সিন্ধু বলে প্রাণ পরিত্যাগ করিল
তিনজনের সৎকার্য একন্তে করিল
নিম কাষ্ঠ দিয়া চিতা সাজাইতে লাগিল 
চুয়া চন্দন ঘৃত ঢালিতে লাগিল 
তিন জনের সৎকার্য করে রাজা অযােধ্যাকে গেল
রামচন্দ্র জনম লােকে বলে মুনিগণ যজ্ঞ আরম্ভিল!

0 comments: