0

সম্পাদকীয়

Posted in







দিনকয়েক হল সূচি ঘোষণা হয়েছে। আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের দোরগোড়ায় আমরা। বলা হয়ে থাকে গণতন্ত্রের বৃহত্তম পার্বন এই প্রক্রিয়া। ভোট কী এবং কেন? প্রায় ঋতুচক্রের নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এই নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা কতদূর? আমজনতার কাছে সত্যিই কি এই প্রহসনের কোনও তাৎপর্য আছে? 

'নির্বাচন' মানে যদি হয় 'বেছে নেওয়া', তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কাকে বা কাদের বেছে নেব আমরা? কেনই বা নেব? স্বাধীনতার পর সাতাত্তর বছর অতিক্রান্ত প্রায়। এতগুলি দশক অতিবাহিত হওয়ার পরও কেন তবে সমাধান হয়নি বহু মৌলিক সমস্যার? একদিকে যেমন 'ডিজিটাল ভারতে'র বিজ্ঞাপন ফুলে ফেঁপে উঠেছে, অন্যদিকে অনাহার আর অশিক্ষার করুণ চিত্রটিতে আমাদের লজ্জিত হতে হয় বারংবার। যে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল আমাদের কোহিনুর, তার গরিমা এখন অপসৃয়মান! 

বিপুল যে অর্থ ব্যয় করে নির্মাণ করা হয় একটি মন্দির অথবা মূর্তি, তাতে গড়ে তোলা যেত অগণন বিদ্যালয় বা হাসপাতাল। নির্বাচিত যেসব জনপ্রতিনিধি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেইসব সৌধ স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা নিলেন, তাঁরা কি একমুহূর্তের জন্যও ভেবেছিলেন সেইসব মানুষগুলির কথা, যাঁরা নিরন্ন কিংবা বস্ত্রহীন অবস্থাতেও গণতন্ত্রের এই সুবিশাল স্তম্ভটিকে রক্ষা করে এসেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে? প্রশ্নগুলি মাথাচাড়া দেবে আবার চাপাও পরে যাবে বেআইনি কোনও নির্মাণের ধ্বংসস্তূপের তলায়।

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে রাশিয়ার নির্বাচনের ফলাফল। পঞ্চমবারের জন্য প্রায় পঁচাশি শতাংশ গরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় এসে ভ্লাদিমির পুতিন জানিয়েছেন বিশ্বের পরিস্থিতি এমন যে ঘটে যেতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর আরেকটি নির্বাচনযুদ্ধের সম্মুখীন হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়ে রেখেছেন, তিনি জয়ী না হতে পারলে বইবে রক্তগঙ্গা।

প্রাজ্ঞ এক বন্ধু বলছিলেন, আমরা যা দেখছি, শুনছি, প্রকৃত রাজনীতির পরিধিটা নাকি তার চেয়ে অনেক বড়। আমাদের দেশে বা অন্যত্র যা ঘটমান, তার কোনও কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়, সবকিছুই সেখানে অদৃশ্য একটিই সুতোয় গ্রন্থিত। রাম জন্মানোর আগেই যেমন রচিত হয়েছিল 'রামায়ণ', আগামী দিনে চারপাশে আমরা কী দেখবো, একটি সামগ্রিক নকশার অঙ্গ হিসাবে তা নির্ধারিত হয়ে আছে অনেক আগেই।

রঙের উৎসবও আসন্ন। আমাদের চেতনা যেন রামধনু-রঙা হয়ে ওঠে!

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in







এই আন্তর্জাতিক মানবতার যুগে দাঁড়িয়ে কোনও জাতিগত গৌরবের কথা বলাটা একটু কম আধুনিক। তবু হালখাতা প্রসঙ্গে যে কটা কথা বলতেই হয়, তার মধ্যে বাঙালীর কিছু গৌরবের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। ইতিহাস জানে, কতটা পথ চললে কোনও জাতি তার সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক চেতনায় পৌঁছতে পারে। হালখাতা উৎসব আদতে বাঙালীর নিজস্ব একটি পালন। যেকালে সাধারণ মানুষ তার জমিতে ফসল ফলিয়ে খাজনা দিতে যেত জমিদারকে, সম্বৎসরের দেয় খাজনা মিটিয়ে জমিদার বা ছোটখাট রাজার বাড়িতে বসে নিমন্ত্রন খেয়ে আসত, পরনে থাকত ভালো জামা, সেইকাল থেকে হালখাতার শুরু। এখন সেই বিশেষ দিনটি কিভাবে চিহ্নিত করি?

ইতিহাস বলছে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক ৫৯৪ খৃষ্টাব্দের ১২ই এপ্রিল, সোমবার, প্রথম বৈশাখ বঙ্গাব্দের সুচনা করেন (বঙ্গাব্দের উৎস কথা - শ্রী সুনীল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)। আমরা জানি শশাঙ্কপূর্ববর্তী সময়ে গৌড়ের তেমন কোনও ইতিহাস নেই। শশাঙ্কই প্রথম, যিনি গৌড়কে, তথা তাবৎ বাঙালীকে মর্যাদা দিলেন। সেসময় ভারতে নানা সনের প্রচলন ছিল। শকাব্দ, বিক্রম সংবৎ, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রান্তরাজ্য গৌড়ও নিশ্চয় এমনই কোনও সন তারিখ মেনে ব্যবসাসংক্রান্ত কাজকর্মগুলো করত। শশাঙ্ক প্রথম গৌড়ের জন্য একটি পৃথক বঙ্গাব্দ প্রচলন করলেন। কিন্তু সংশয় তো জাগেই! বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করলেও, এর আগে যে বাংলায় মাসের নাম প্রচলিত ছিলনা তা মনে করা হয়না। যাই হোক, বৈশাখের পয়লা তারিখ শুরু হয় নতুন বছরের। এরপর বৌদ্ধ রাজাদের সময় শশাঙ্কের এই সনের হিসেব যায় হারিয়ে। পালরাজাদের নতুন হিসেবে বঙ্গাব্দের প্রচলন দেখতে পাইনা। যদিও লক্ষনাব্দ শুরু হয়েছিল, তবু অনেকেই মনে করেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ আবার বঙ্গাব্দ ফিরিয়ে আনেন। তাঁর মৃত্যুর একশো বছর পরে সম্রাট আকবর ৯৯২ হিজরীতে, ইংরাজি ১৫৮৪ সালে আবার বঙ্গাব্দ ফিরিয়ে আনেন। যদিও কর্ণসুবর্ণে শশাঙ্কর রাজধানীপ্রতিষ্ঠার দিনটি এই বছর শুরুর দিন বলে যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন তবু ধারাবাহিকভাবে বঙ্গাব্দ সেই সময় থেকে প্রচলিত হতে পারেনি। ছেদ অবশ্যই পড়েছিল।

এসব তো হোল আমাদের বাংলা বছরের শুরুর ইতিহাস। যা নিয়ে পণ্ডিতমহলে বিস্তর মতের অমিল আছে। কিন্তু হালখাতা নিয়ে আমরা নিঃসন্দেহ। আগেকার দিনে চাষাভুষো মানুষ তাদের জমিদারের খাজনা মেটাত চৈত্রের শেষে। আর তাই জমিদার বাড়িতে পাত পেড়ে খাওয়ার নিমন্ত্রণ পেত। জমিদার বাড়ি বলে কথা। যেটুকু ভালো কাপড়চোপড় থাকত তাইই পরে যেত তারা। নেমন্তন্নয় যেত পুরুষ ও বাচ্চারা। বাড়ির মেয়েরা নয়। এরপর জমিদারি গেলো বণিকের হাতে। বেণের পো জমিদারের চেয়ে বুদ্ধি ধরে বেশি। তারা খাতকদের যা ধারকজ্জ দিতো সেসব উশুল করত সারাবছর ধরেই। যে ধার রয়ে যেত, জমিদারের দেখাদেখি সেটুকু উদ্ধারের জন্য তারা প্রচলন করল হালখাতার। অর্থাৎ, সারাবছর যে দেনদার ধারে মালপত্র নেবে, বছর শুরুর এই দিনে সে গত বছরের সব দেনা সুদে আসলে মিটিয়ে দেবে।

এই প্রথা আমরা বাল্যেও দেখেছি। আমাদের ছোটবেলায়, দোকানে ধার থাকুক বা না থাকুক, পয়লা বৈশাখ, কিংবা অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে আমরা ক্যালেন্ডার ও মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসতাম। সেসব নেহাতই ছোটখাট দোকান। আমাদের পাড়ার বইখাতার দোকান বা ষ্টেশনারী, মুদিখানা পর্যন্ত গতি। এছাড়া কাপড়ের দোকান বা সোনার দোকানে গতি ছিল বাবার। সেখান থেকে বচ্ছরকার দিনে মায়ের একটা শাড়ি বা ছোট দুল আসত মিষ্টির প্যাকেটের সঙ্গে। আমরা অবাক হতাম। কই, আমাদের তো নতুন একটা বইও দিলনা পরিমলকাকু? মা বলেছিল, ওটা কথা নয়। কথা হোল, বাবা আগের বছরের খাতা বন্ধ করে নতুন খাতা খুলে এসেছে। সেখানে বাবার নামে আবার এই বছরের হিসেব শুরু হবে। এই যে বাবা সোনার দুল কিনে আনল, এতে সোনার দোকানের মালিক, সুবোধকাকুর ভালো হবে। ব্যবসায়ে উন্নতি হবে। আর তাই, খুশি হয়ে দোকানের মালিক বাবাকে মজুরীতে ছাড় দেবে। নতুন কাপড়েও ছাড় দেয়।

এই ব্যবসাপদ্ধতি এখন অবশ্য সারাবছর জুড়ে চলছে। নতুন বছরের শুরুতে লাল শালুতে মোড়া লম্বা হিসেবের খাতার প্রথম পাতায় সিঁদুরে ডোবানো কয়েনের ছাপ দিয়ে সিদ্ধিদাতা গনেশ ও মা লক্ষ্মীকে স্মরণ করে সেই যে হালখাতার উৎসব, সেসব এখন খানিক রঙ হারিয়েছে। আছে এখনও, মিষ্টির বদলে কেউ কেউ বিরিয়ানির প্যাকেটও দেন দেখতে পাই, কিন্তু সেভাবে আর নেই। এখন সাধারণ মধ্যবিত্ত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন। দোকানে গিয়ে ধার করেননা। কার্ডের মাধ্যমে ধার হয় সরাসরি ব্যাংকে। দোকানদার আর ক্রেতার মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে ব্যাংক। ফলে যে ছাড় ক্রেতা পেতেন সেই লাভের অংশ, কি তার চেয়েও বেশি, ঢোকে ব্যাংকে। ক্রেতা বুঝতেই পারেননা আসলে জিনিসটার লিখিত দামের চেয়েও বেশি মূল্যে তিনি কিনছেন। একটা দেখনদারিতে ঠেকেছে আমাদের কেনাকাটা থুড়ি শপিং। আমরা মোবাইল খুললেই দেখতে পাই শপিংমলে সেল চলছে। অনলাইন পোর্টালে সেল চলছে। কোথাও বিশেষ বিশেষ উৎসবের মরশুমে। কোথাও সপ্তাহান্তিক সেল। বাই টু গেট ওয়ান ফ্রির ছড়াছড়ি। সাবেক পাড়ার দোকানী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছেন। তাঁর দোকানে অমন চাকচিক্য কই? চীনে জিনিসের মতন অমন রঙিন অথচ পলকা বস্তুতে বাজিমাত করার শিক্ষা তো তাঁর নেই। তিনি তো জানেন অটুট মজবুত জিনিসের বেচাকেনা। অটুট সম্পর্কের মতোই। যা ইউজ এন্ড থ্রো’র যুগে অচল। তাঁর তো ধরা খদ্দের! এ পাড়ার হলদে তেতলা বাড়ি থেকে শুরু করে ও পাড়ার সবুজ একতলা পর্যন্ত। তিনি তো জানেন কোন বাড়ির লোকেরা কোন কোন জিনিস নেন। সেইমত মালপত্র তোলেন। হঠাৎ পরিবর্তনে তিনিও দিশেহারা। তাঁর ছেলেরা হয় অন্য কাজে যুক্ত, দোকান ধুঁকছে, নয়ত এই দোকানকে আধুনিক করে তুলতে বদ্ধপরিকর। তাঁর যুক্তি খাটেনা। ক্রমে আমাদের একান্ত নিজস্ব সৌহার্দ্যের উৎসবরীতি পর্যবসিত হয়েছে বছরজোড়া কেনাকাটায়। তার স্বাদ হারিয়েছে অসময়ের ফলের মতো। হালখাতার যে ভিত্তি, পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা, সেটির আর প্রয়োজন নেই এখন। মানুষের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছাড়াও যে ব্যক্তিগত সৌহার্দ্যের সম্পর্ক ছিল সেটি এখন অনুপস্থিত।

একান্ত বাঙালী এই উৎসবরীতি কিভাবে স্বর্গে পৌঁছেছে তাই নিয়ে খুব ভাবি। যমের রাজ্যে চিত্রগুপ্ত কেরানি। কেমন করে তিনি আমাদের কৃতকর্মের হিসেব রাখেন? যেমন দেখেছি আশৈশব, তেমনই একটা লাল খাতা কি তাঁর হিসেবের খাতা? কিন্তু অনন্ত কালের অসংখ্য মানুষের কর্মফলের হিসেব রাখা তো চাট্টিখানি কথা নয়! গল্পকথা, কিন্তু তার শেকড় জল মাটি পায় বাস্তব থেকেই। নিশ্চয় চিত্রগুপ্ত বাঙালী। তাঁর শিক্ষাদীক্ষা বাংলায়। নইলে এই বুদ্ধি তাঁর মাথায় আসলো কি করে?

আমজনতা তাহলে এইসব ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের বাইরে? প্রশ্ন থেকে যায়। লাল শালুতে মোড়া একটা হিসেবের খাতা আমরা কি নিজেরাও রেখে দিইনা? সেখানে শুরু থেকে লিখতে থাকি নানা দেনাপাওনার কথা? সেসব দেনাপাওনা অবিশ্যি স্থুল চোখে তেমন ধরা পরেনা। কখনও কখনও মনের সিন্দুকে সেই খাতাটা ধুলো ঝেড়ে উঠতে চায়। আমরা গোপনে খুলি। হিসেব মেলাতে হবে। কাকে দিতে হবে ছাড়? যে অনুজ তার বাল্যে আমাকে না জেনে আঘাত দিয়েছে, ছাড় তার প্রাপ্য। যে অগ্রজ আমাকে জীবনের পাঠ দিতে গিয়ে অকারণ নিষ্ঠুর হয়েছে, তাকে ছাড়। না, সুদ কেন, আসলটুকুও ছেড়ে দিতে হবে। হিসেব মিলবেনা নইলে। আমারও যে দেনা মেটাবার থাকে! কিন্তু পাওনাদার হয়ত তার লাল খাতাখানা হারিয়ে ফেলেছে। কিংবা হয়ত না ফেরার দেশে সেখানা আর বয়ে নিয়ে যায়নি। তাই আমিও চেষ্টা করি।

[যুগশঙ্খ নববর্ষ ক্রোড়পত্র ২০১৯]

0 comments:

1

প্রবন্ধ - প্রমিত বসু

Posted in






এই বছর দুশো পূর্ণ করলেন মধুকবি। প্রথম বাঙালি রংবাজ কবি। এক সৃষ্টিশীল রংবাজ, যিনি আজীবন কোনো আপোষ করেননি নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যর সঙ্গে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যর সঙ্গে যখনই কোনো আপোষের প্রশ্ন এসেছে, তখন তার মূল্য রাখতে নিজের পরিবার, বন্ধু বা নিশ্চিত সুখের জীবন ত্যাগ করতে তাঁকে এক মুহূর্ত ভাবতে হয় নি।

তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ হোক অথবা কাব্য সৃষ্টি হোক, সর্বক্ষেত্রেই আপোষহীন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা বজায় রেখেছেন জীবনভর। তার জন্য নিজের স্থিতিশীল জীবন এক ঝটকায় ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, কিন্তু তা বলে নিজের অবস্থান থেকে একটুও সরার কথা মনে হয়নি কখনও।

সেই সাহসেরই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় তাঁর ভাষায়, কাব্যে এবং সৃজনশীলতায়। যা কিছু প্রচলিত, তাকে ভেঙে ফেলে নতুন ছাঁদে, নতুন আঙ্গিকে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেন যা চমকে দেয় আপামর সাহিত্য জগৎকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি যখন বাংলা সাহিত্য আটকে আছে সেই মঙ্গলকাব্যের বাঁধা ছকে আর পাঁচালির ছন্দে, ঠিক সেই সময় নিয়ে এলেন ইউরোপীয় ধাঁচে অমিত্রাক্ষরের ঝড়। সেই ছাঁদে মেলালেন খাঁটি ভারতীয় দেব-দেবী, রামায়ণ, মহাভারত কিংবা পুরাণকে।

১৮৫৭ থেকে ১৮৬১ এই চার বছরের মধ্যে পর পর তৈরী করলেন শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী নাটক, তিলোত্তমা কাব্য, মেঘনাদবধ কাব্য, কৃষ্ণকুমারী, ব্রজাঙ্গনা কাব্য এবং বীরাঙ্গনা কাব্যের মতো একের পর এক সৃষ্টি। 'শর্মিষ্ঠা' লেখার পর পরই বলেন 'আমাদের নাটক গদ্যে না লিখে অমিত্রাক্ষরে লেখা উচিত।.. যত দিন না বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রচলিত হচ্ছে, ততদিন বাংলা নাটকের উন্নতি আশা করা যায় না'। পয়ার আর ত্রিপদীর কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে শুরু করলেন অমিত্রাক্ষর। বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষরের অনুপ্রবেশ ঘটানোর সাথে সাথে আধুনিক করলেন বাংলা নাটককে। নাটকে এবং কাব্যে কমেডি, ট্র্যাজেডি, বীররস, করুণরসের নতুন মাত্রা যোগ করলেন।

কোনোদিন তোয়াক্কা করেন নি গতানুগতিক কাঠামোকে, সেটা সাহিত্যেই হোক বা সমাজে। পৌরাণিক কাহিনীগুলোকে বেছে নিলেন নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে পুরাণকে পরিবেশন করতে, নিজের রচনার মধ্যে দিয়ে তার আধুনিক মানবিক মূল্যবােধকে প্রকাশ করার জন্য। কাব্যে বা নাটকে যতই পৌরাণিক গল্প ব্যবহার করুন না কেন, চরিত্রগুলোর অতিমানবিক রূপগুলোকে কেটেছেঁটে তৈরী করেন রক্তমাংসের সাধারণ মানুষ। সেখানে পরতে পরতে দেখালেন যে সভ্যতার আদিকাল থেকেই মানুষ সাদা বা কালোর বিভাজনে বিভক্ত নয়, বরং প্রত্যেকেরই চরিত্রে রয়েছে ভিন্ন মাত্রায় ধূসর উপাদান (shades of grey)।

আজ থেকে প্রায় ১৬৩ বছর আগে ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্য লিখলেন রামকে সরিয়ে রাবণকে লাইমলাইটে নিয়ে এসে, নতুন ভাব-ভাষা-রূপকল্পে। এখানে রাম অথবা রাবণ কেউই আসল মহাকাব্যের মতো নিজেদের দেবত্বে বা দানবত্বের ঘেরাটোপে বাঁধা থাকে না। রাক্ষসরা বিকটরূপী কোনো ক্যানিবেল নয়, বরং তারা আর্যদের মতোই যজ্ঞ করে, পুজো করে, বর প্রার্থনা করে। আনন্দ বা দুঃখে তাদের মানুষের মতোই প্রতিক্রিয়া থাকে। আবার বানররাও কোনো রোমশ বিশালদেহী পশু নয়, সাধারণ মানুষদের সঙ্গে তাদের কোনো ফারাক নেই। তেমনই রাম বা সীতা কোনো অবতার নয়, বরং আর পাঁচজন মানুষের মতোই তাদের জীবন চলে।

রবীন্দ্রনাথের এক উদ্ধৃতিতে এই তাৎপর্য সার্থকভাবে প্রকাশ পেয়েছে: “মেঘনাদবধ কাব্যের কেবল ছন্দোবন্ধে ও রচনাপ্রণালীতে নহে, তাহার ভিতরকার ভাব ও রসের মধ্যে একটা অপূর্ব পরিবর্তন দেখিতে পাই। এ পরিবর্তন আত্মবিস্মৃত নহে। ইহার মধ্যে একটা বিদ্রোহ আছে। কবি পয়ারের বেড়ি ভাঙ্গিয়াছেন এবং রামরাবণের সম্বন্ধে অনেকদিন হইতে আমাদের মনে একটা যে বাঁধাবাঁধি ভাব চলিয়া আসিয়াছে স্পর্ধাপূর্বক তাহার শাসন ভাঙ্গিয়াছেন। এই কাব্যে রামলক্ষ্মণের চেয়ে রাবণ-ইন্দ্রজিৎ বড় হইয়া উঠিয়াছে। যে ধর্মভীরুতা সর্বদাই কোনটা কতটুকু ভাল ও কতটুকু মন্দ তাহা কেবলই অতি সূক্ষ্মভাবে ওজন করিয়া চলে, তাহার ত্যাগ দৈন্য আত্মনিগ্রহ আধুনিক হৃদয়কে আকর্ষণ করিতে পারে নাই।”

একদম ছোট বয়স থেকেই নারীদের প্রতি তিনি ছিলেন চরম শ্রদ্ধাশীল। ১৮৪২ সালে স্ত্রী-শিক্ষা বিষয়ে একটি রচনা লিখে তিনি স্বর্ণপদক পান। সেখানে তিনি বিশেষভাবে লেখেন যে দেশের সভ্যতার আর উন্নতির প্রতীক হলো এই নারীশিক্ষা এবং সেইটা হলেই সমাজের পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটতে পারে।

“Extensive dissemination of knowledge amongst women is the surest way that leads a nation to civilization and refinement… the happiness of a man who has an enlighten partner is quite complete..”

সেই যুগে সমাজের অনেক বড়ো বড়ো সংস্কারকরাও নারীদের উন্নতির কথা বললেও নিজেদের স্ব-স্ব বিবাহের ক্ষেত্রে কিন্তু সেই চিরাচরিত প্রথাকেই মেনে নিয়েছিলেন। এমনকি ঠাকুর পরিবারও তার ব্যতিক্রম নয়। সেই সময়ে তাঁর সোজা কথা - বিলিতি কায়দায় কোর্টশিপ না করলে সে কি আর প্রেম, আর প্রেম করে বিয়ে না করলে সে কি আর বিয়ে!

পদাবলীর ছাঁদে লেখা ব্রজাঙ্গনা কাব্যে আধ্যাত্মিক প্রেমলীলা থেকে বেরিয়ে এসে রাধা হয়ে ওঠে এক সাধারণ নারী, বিরহ, আক্ষেপ বা হতাশায় আকুল এক বিরহিণী, যার প্রেমের আন্তরিকতায় কোনো ভেজাল নেই। গীতরসসমৃদ্ধ এক ভক্তিরসের এই পদাবলিতে নিয়ে এলেন এক নতুন আস্বাদ, যেখানে নারীর অনুভূতিগুলোকে ঘিরে।

সেই নারীবাদী চিন্তাধারা থেকেই বোধহয় সৃষ্টি হলো 'বীরাঙ্গনা কাব্য', যা বাংলা সাহিত্যে নারীবাদের একটা জলজ্যান্ত বেঞ্চমার্ক। বীরাঙ্গনা কাব্য যে সময় লেখা হয় তখন বাংলায় মেয়েদের স্কুল হাতে গোনা কয়েকটি আর বিধবা বিবাহ শুরু হয়েছে সবে তিন চার বছর আগে। কত বড়ো অদম্য সাহসী মানুষ না হলে সেই সময় দাঁড়িয়ে পৌরাণিক নারীদের নিয়ে লেখেন পত্রকাব্য। প্রণয়ীদের লেখা পত্রে তাদের বৈচিত্র্যময় অনুভূতি বেরিয়ে আসে। কুদর্শনা সুর্পণখা রামায়ণের থেকে বেরিয়ে এসে কবির হাতযশে রূপান্তরিত হয় এক সাধারণ নারীতে, যে কিনা লক্ষণের মহান-রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে প্রেম নিবেদন করে বসে। অকুতোভয় তারা চন্দ্রের সঙ্গে প্রেমের স্বীকৃতি চায় জোর গলায়, আবার শকুন্তলা বা কৈকেয়ী প্রণয়ীদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য তাদের সরাসরি দোষারোপ করে ওঠে। সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থেকে মহিলাদের এই দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টি করেছিলেন দত্তকবি।

আজীবন সাহিত্যে ভেঙেছেন গড়েছেন, চেষ্টা করেছেন ইম্প্রোভাইজেশনের। তিনি বুঝেছিলেন যে যতি এবং অন্ত্যমিলের কঠোর নিয়মের যাঁতাকলে বাংলা ভাষা তার সহজ মাধুর্য এবং স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে ফেলতে বাধ্য। একটি চিঠিতে এই সম্পর্কে বলেন যে চীনা মেয়েদের যেমন লোহার জুতো পরিয়ে তাদের পায়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে আটকে রাখা হয়, বাংলা ছন্দের নিয়মও তেমনি ভাষার স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করে। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে হাজির করেন সনেট। সেখানেও দেখান নিজের কেরামতি। প্রথাগত ইউরোপিয়ান ধাঁচের পেত্রার্কীয় বা শেক্সপীয়রীয় সনেটকে যেমন গ্রহণ করলেন, তেমনি সেটা আবার নতুন করে ভেঙে তৈরী করলেন নতুন গড়ন (যেমন 'হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব')।

ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রেখেছেন চিরকাল। মাদ্রাজে থাকাকালীন যখন মিশনারিদের অধীনে চাকরিরত, সেই সময়ও মুসলিম শাসনের কিছু ভালো দিক তুলে ধরে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনের সমালোচনা করলেন (“India under the Moslem rule was more prosperous than the Leadenhall rule. Sir Charles may disguise the fact, but history is against him.” - Leadenhall হল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির লণ্ডনের সদরদপ্তরের ঠিকানা)। আবার একই সাথে মুঘল রাজত্বের শেষের নবাবদের বিলাসবহুল জীবনের কড়া সমালোচনা করলেন।

যে খৃস্ট ধর্মের জন্য একদিন সব ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেখানে দেখেছেন পদে পদে বৈষম্য। তিনি এটা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন যে ধর্মশিক্ষা কখনও প্রকৃত শিক্ষার আলো হতে পারে না। তাই ‘নেটিভ এডুকেশন’ প্রবন্ধে এর বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়েছিলেন মধুসূদন। স্কুলগুলিতে বাইবেল পড়ানোর মতো জবরদস্তিকে তিনি ঘৃণ্য কাজ বলেছেন— “শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাইবেল পড়লেই খ্রিষ্টধর্মের প্রসার ঘটবে এমনটা ভাবা নিতান্ত বোকামি।” তার ফলস্বরূপ যা হওয়ার তাই হয়েছে। কোনো ধর্মের মাথারাই তাঁকে ধর্মীয় স্বীকৃতি দেন নি। খ্রিস্টান সমাজে ব্রাত্য হয়েছেন, হিন্দু সমাজে চিরকাল বিধর্মীর তকমা জুটেছে।

সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বিদ্রুপ হয়েছে। মেঘনাদকাব্যের ব্যঙ্গ করে লেখা হয় 'ছুচুন্দর বধ কাব্য'। ঈশ্বর গুপ্তের মতো মানুষও তাঁর কড়া সমালোচক ছিলেন। কিন্তু তাতে কীই বা এসে যায় এই রকম মানুষের। উল্টে তাঁকেই শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিতা লেখেন:

'আছিলে রাখালরাজ কাব্য ব্রজধামে
জীবে তুমি; নানা খেলা খেলিলে হরষে'

সাচ্চা রংবাজের মতোই প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে স্বীকার করেছেন তাঁর ঋণ। কাব্যের গুরু ভেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন বাল্মীকি, ব্যাস এবং কালিদাসকে। বীরাঙ্গনা কাব্য উৎসর্গ করেছেন স্বয়ং বিদ্যাসাগরকে। কতটা বুকের পাটা থাকলে কেউ তাঁর নিজের এপিটাফ নিজেই লিখতে পারেন, সেটা উপলব্ধি করার ক্ষমতাই আমাদের থাকে না। শহরের খ্রিস্টান সমাজের কাছে তিনি এমনই চক্ষুশূল ছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতার কোনও সমাধিক্ষেত্রে তাঁর ঠাঁই হবে কি না সেই অনিশ্চয়তায় কেটে যায় অনেকটা সময়। শেষমেশ লোয়ার সার্কুলার রোডে সমাধিস্থ হলেন, হেনরিয়েটার পাশেই। গৌরচন্দ্র বসাক-সহ কয়েক জন বন্ধু বহু বছর পরে স্মৃতিফলক বসিয়েছিলেন, তাতে মাইকেলেরই লেখা নিজের প্রয়াণলেখ: ‘দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব/ বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল!...।’

প্রতি বছরই এই সময়ের অন্য ছুটির উচ্ছ্বাসে তিনি চলে যান সব রকম জমকের আড়ালেতে। এই বছর এমনই আয়রনি যে তাঁর দ্বিশতক পূর্ণের ঠিক আগেই রাজকীয় আড়ম্বরে স্থাপিত হল সেই পৌরাণিক চরিত্রের যাকে তিনি বরাবর বিচার করেছেন মানবতার মাপকাঠিতে। অবতারের বাইরে বেরিয়ে এসে মানুষের ন্যায়-অন্যায়ের ধর্মনীতির মধ্যে রেখে মূল্যায়ন করেছেন। হয়ত আজকের সময়ে জন্মালে শাসকের নিরাপত্তাহীনতার দরুণ তাঁকে মিথ্যে দেশদ্রোহিতার মামলায় জেল খাটতে হত।

নিজের শর্তে ক'জনই বা বাঁচতে পারে? মধুসূদনও পারেননি, তা বলে ইচ্ছেটা মরে যায়নি। শিল্পের দুনিয়ায় বহু প্রবল প্রতিভাও পরিস্থিতির চাপে চুপ করে গিয়েছেন, আপস করে নিয়েছেন সময়ের সঙ্গে। মধুসূদন করেননি। মধুসূদনকেও যে একেবারে করতে হয় নি তা নয়। কাব্যচর্চায় সাময়িক বিরতি দিয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের তাগিদে সংবাদপত্রে বা পুলিশেও চাকরি করেছেন, ওকালতি করেছেন। কিন্তু পরিস্থিতির অল্প পরিবর্তনেই ফিরে এসেছেন নিজের কাব্যরচনায়। তাই জীবনের অনেক আশা অপূর্ণ থেকে গেলেও কালজয়ী কবি হওয়ার বাসনা পূর্ণ হয়েছে।

মধুসূদন তার সমসাময়িক কালেই অনেক বিরোধিতার মধ্যেও শিক্ষিত সমাজের বড়ো অংশের কাছে শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন। তার মর্যাদা যে কত বড় তা বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে একালে। এক ধাক্কায় বাংলা ভাষার বিশ্বায়নের দরজা প্রথম খুললেন। সুগভীর স্বাজাত্যবােধ, সর্বমানবযোগ একসাথে মিলিয়ে দেবত্ব আর ভাগ্যের উর্ধ্বে তিনি তুলে ধরেছেন মানুষের পৌরুষের মহিমা। একজন আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক মানুষ হয়ে আজীবন প্রেমের ধর্ম চর্চা করে মানবতার পাঠ পড়ালেন ভবিষ্যতের শতাব্দীকে।

1 comments:

0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in







গণিত— বিষয়টি অনেকের কাছে বেশ জটিল ও কঠিন। আবার অনেকের কাছে বেশ সোজা ও মজার। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গণিত বেশ জড়িয়েই আছে সে যেকোনো জিনিস কেনার জন্যে হোক বা কটা বাজে অর্থাৎ সময় দেখার জন্যে হোক বা পুজোর নৈবেদ্য হিসেবে কটা ফুল বা বেল-তুলসী পাতা লাগবে বা কত উপকরণ লাগবে, আবার রান্নায় কত চামচ নুন লাগবে বা চায়ে কত চামচ চিনি লাগবে ইত্যাদি সবই বেশ হিসেবনিকেশের ব্যাপার। আমরা তো হিসেবনিকেশেই আছি— প্রতিনিয়ত, প্রতিমূহুর্তে। তবুও, কেন গণিত আমাদের কাছে এত জটিল ও এত অধরা? এর কারণ অবশ্য এর শিক্ষণপদ্ধতি ও একে ভালোভআবে জানার জন্যে আমাদের কারুর তীব্র অনীহা। আসলে, স্কুলে ও কলেজ স্তরে বেশ কিছু অর্ধশিক্ষিত শিক্ষক-শিক্ষিকা তাঁদের পড়ানোর ত্রুটি এবং পরিমার্জিত জ্ঞান ও সৃজনশীলতার অভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে গণিত বিষয়টি বেশ জটিল করে তুলে বড়সড় গোল করে বসেন। আদৌ কিন্তু বিষয়টি জটিল বা কঠিন নয়। খেলাচ্ছলে বা আগ্রহবশত বিষয়টিতে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠা যায়। আর হয়ে ওঠা যায় একজন গণিতজ্ঞ বা গণিএ পারদর্শী ব্যক্তি। আর গণিতবিদ হতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশভারী ডিগ্রি যে প্রয়োজন তা কিন্তু নয় বরং রোজ অধ্যবসায় দরকার। অর্থাৎ নিয়মিত অঙ্কচর্চার মাধ্যমে যে কেউ যে কোনও অবস্থায় হয়ে উঠতে পারে গণিতবিদ। আর নিয়মিত চর্চা বা অধ্যবসায় আসবে কোথা থেকে? গণিতের প্রতি এক নিখাদ ভালোবাসার মাধ্যমে। আর এই প্রবন্ধে আমরা এমনই একজনকে নিয়ে আলোচনা করব যিনি গণিতকে ভালোবেসে, গণিতের কথাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করে বিশ্বশ্রুত গণিতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তিনি একজন অনন্যা মহীয়সী নারী, নাম তাঁর হাইপেশিয়া। গোঁড়া পিতৃতন্ত্রের ধারক ও বাহকেরা বেশ নিন্দার সাথে নারীজাতিকে হেয় করার জন্য কুৎসা করে বেড়ায় যে, নারীরা গণিতজ্ঞ হতে পারে না, নারীরা গণিত-বিমুখ। অথচ এদিকে রান্নার নুন-চিনির হোক কিংবা সংসারের সমস্ত জটিল হিসেবনিকেশ নারীরাই খুব সুন্দরভাবেই সামলান। আর তাই এইসব অশিক্ষিত গোঁড়াদের প্রতি এক প্রতিবাদের নাম হলেন হাইপেশিয়া বা তাদের গোঁড়ামি, কুৎসা ও উগ্র পিতৃতন্ত্রের প্রতি এক থাপ্পড় স্বরূপ হলেন হাইপেশিয়া ও তাঁর কাজকর্ম। যিনি স্বমহিমায় দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে— হ্যাঁ, মেয়েরা বা নারীরাও পারেন গণিতের অতল জ্ঞানের সমুদ্রে তলিয়ে গণিতের মুক্তগুলো সামনে নিয়ে আসতে। পুরুষের মতো গণিতের জগতে তাঁদেরও অবাধ যাতায়াত। আর তাঁর প্রতি রাগ ও প্রতিশোধের জন্য বা নারীজাতিকে পিছিয় দিয়ে সমাজকে অন্ধকার করে রাখার জন্যেই ধর্মীয় গোঁড়া কিছু অমানুষ হত্যা করে হাইপেশিয়াকে। তবুও হাইপেশিয়াই জিতেছেন, জিতেছে শুভবুদ্ধি, নারীরা পুরুষদের সাথেই এগিয়ে চলেছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে আর আবিষ্কার করে চলেছে অজানা সত্যকে — এটাই হয়তো প্রকৃতির গাণিতিক নিয়ম।


প্রাচীন মিশরের রাস্তায় ভিড়ের মাঝেই গণিতের কথা শোনাতেন হাইপেশিয়া। তাঁকে ঘিরে সাধ্রণ মানুষের ভিড়। তারা শুনছে মহীয়সী এই গণিতজ্ঞ ভদ্রমহিলার কাছ থেকে গণিতের নানা কথা। অনেকেই হয়তো অবাক হচ্ছেন এটা ভেবে যে, যে যুগে অর্থাৎ প্রাচীন মিশরে যেখানে মহিলাদের চিন্তাভাবনা ও কাজকর্মের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল না, বেশিরভাগ মহিলারাই গণিত ও বিজ্ঞান পড়তেন না বা বলা ভালো আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তাঁদের পড়তে দেওয়া হত না এমনকি রাজনৈতিক প্রাঙ্গণেও তাঁদের প্রবেশ নিষেধ ছিল, সে যুগের রাস্তায় দাঁড়িয়ে একজন নারী তাঁর গাণিতিক সুন্দর ও সবলীল বক্তৃতার মাধ্যমে প্রচুর মানুষকে অনায়াসে আকৃষ্ট করে চলেছেন। এ যে রীতিমতো বিস্ময়ের ব্যাপার! কিন্তু, এই বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল কিভাবে? কিভাবে সম্ভব হল একা একজন নারীর পক্ষে সমাজের গোঁড়ামি ও অসম্ভবকে বুড়ো আঙুল দেখানো?


এইসব সম্ভব হয়েছিল একজনের জন্য। তিনি হলেন হাইপেশিয়ার বাবা থেওন। যেমন একজন সফল পুরুষের পেছনে একজন নারী থাকেন ঠিক তেমনি একজন সফল নারীর পেছনেও একজন পুরুষ থাকেন। হাইপেশিয়ার পেছনে যেমনটি ছিলেন তাঁর বাবা থেওন। থেওন নিজেও একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ ছিলেন এবং ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার মিউজিয়ামের প্রধান। হাইপেশিয়াও তাঁর বাবার মৃত্যুর পরে মিউজিয়ামের প্রধান হন। যাইহোক, হাইপেশিয়া যাতে এক মুক্তমনা নারী হয়ে উঠতে পারেন সেইজন্য গতানুতিক সমাজের বিপরীত শ্রোতে গিয়ে থেওন তাঁর মেয়ে হাইপেশিয়াকে প্রচুর স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যা সেই যুগের অন্যান্য মেয়েদের কাছে ছিল বিরল। হাইপেশিয়া তাই হয়ে উঠেছিলেন নারীদের মধ্যে অন্যতম প্রথম গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ এবং দার্শনিক। মিশর (অপর নাম ইজিপ্ট)-এর আলেকজান্দ্রিয়া নগরীতে ৩৫০ খ্রীষ্টাব্দে এই মহান বিদূষী নারী জন্মগ্রহণ করেছিলেন।


হাইপেশিয়ার জীবনে তাঁর পিতা থেওনের বিরাট প্রভাব ছিল। থেওন তাঁর মেয়েকে চেয়েছিলেন একজন ‘আদর্শ মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলতে। তিনি সর্বদা চাইতেন তাঁর মেয়ে সর্বদা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও সবল থাকুক কেননা তা থাকলে তবেই তো একজন আদর্শ মানুষ হতে পারা যাবে। মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য গণিতচর্চা অন্যতম অপরিহার্য। তাই, তিনি গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে তাঁর জানা যাবতীয় জ্ঞান মেয়েকে শেখালেন। আর এর পাশাপাশি তৈরি করলেন সুবক্তা বা প্রভাবশালী বক্তা হিসেবে। আর সেই শিক্ষার রেশ থেকেই হাইপেশিয়া হয়ে উঠেছিলেন একজন প্রভাবশালী গাণিতিক সুবক্তা ও সুলেখক। তার পাশাপাশি হয়ে উঠেছিলেন বাবার সুযোগ্যা সহকারিণী। হাইপেশিয়া তাঁর বাবার সাথে পুরনো গণিতের পাঠ্যপুস্তকগুলো জ্যামিতি, বীজগণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার নতুন নতুন তথ্য দিয়ে আধুনিক বা আপডেট করে তুলেছিলেন। খুব জটিল ও দুরূহ গাণিতিক বিষয়কে খুব সহজ-সরলভাবে বোঝানোর ক্ষমতা ছিল হাইপেশিয়ার। খুব কঠিন ও বৃহৎ বিষয়কে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভেঙে নিতেন যাতে খুব সহজে বিষয়টি বোঝা যায়। এইসব গুণাবলীর জন্যে, হাইপেশিয়া ও তাঁর পিতার কৃত গাণিতিক কাজগুলি বহু যুগ ধরেই বহু গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদকে প্রভাবিত ও উৎসাহিত করেছিল। গোটা শহর থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী আসত হাইপেশিয়ার কাছে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা শিখতে। হাইপেশিয়া দিগন্ত ও কোনও নক্ষত্র বা গ্রহের মধ্যে কোণ মাপার জন্যে বহনীয় যন্ত্র ‘অ্যাস্ট্রোলেবেল’ ব্যবহারের শিক্ষা দিতেন। জানা যায় যে, এই অসাধারণ যন্ত্রটি নাবিকরা দুশো বছর ধরে মহাসমুদ্রে থাকাকালীন ব্যবহার করতেন সময় ও অবস্থান জানার জন্যে। হাইপেশিয়ার বক্তৃতায় প্রচুর জনসমাগম হত। আর এভাবেই তিনি তথাকতিত নীরস গণিতকে জনসাধারণের মাঝে জনপ্রিয় ও রসালো করে তুলতেন। তৎকালীন সমাজে হাইপেশিয়া একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। যিনি একজন শিক্ষিতা মুক্তমনা নারী হিসেবে নারীদের শিক্ষা এবং অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন।


দর্শনে গণিতকে প্রয়োগ করেছিলেন হাইপেশিয়া। তিনি নব্য-প্লেটোবাদ চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে এমন একটি চিন্তাভাবনা সৃষ্টি করেন যা খুবই কার্যকারী। সেই চিন্তাভাবনা এটাই বিশ্বাসটা করে যে, মানুষ তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা তৈরি করে। এই যেমন, আমরা ১ + ১ = ২ যে হয় তা শিখতে পারি, এক জোড়া পেন, মোজা বা যেকোনও একজোড়া বস্তু একসাথে রেখে।


কিন্তু এত কিছু অবদানের শেষে হাইপেশিয়া শিকার হলেন ধর্মান্ধতার এক চরম নির্মম পরিস্থিতির। তাঁর দেওয়া শিক্ষাগুলো ছিল তৎকালীন আলেকজান্দ্রিয়ার প্রধান ধর্ম খ্রিস্টধর্মের থেকে আলাদা। ৪১২ খ্রিস্টাব্দে সিরিল নামক একজন নতুন খ্রিস্টান বিশপ হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। আর এর সাথে আলেকজান্দ্রিয়ার মানুষ দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়। সিরিলের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার গভর্নর অরেস্টেস। এই অরেস্টেস ছিলেন হাইপেশিয়ার বন্ধু। সিরিল ও তাঁর কট্টর খ্রিস্টান অনুগামীদের বিশ্বাস ছিল যে, আলেকজান্দ্রিয়া শহরটাকে অরেস্টেস চালাচ্ছেন হাইপেশিয়ার দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। তাই, সেই অনুগামীরা হাইপেশিয়াকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেইমতো, ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসের এক সকালে এক জনসভায় যখন হাইপেশিয়া বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন সিরিলের একদল অনুগামী তাঁকে হত্যা করে। এইভাবে দ্বন্দ্বের মাঝে চিরকালের মতো নিভে যায় এক মহান দার্শনিক, গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদের জীবনের প্রদীপ। আলেকজান্দ্রিয়ার খ্রিস্টান বিশপ সিরিলের অনুসারীরা তথা সন্ত্রাসীরা তাঁকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় চার্চ সিজারিয়ামে। হাইপেশিয়া হয়তো ভাবতেও পারেননি মানুষ তাঁকে এত নির্মমভাবে হত্যা করবে। সেই সন্ত্রাসীরা সেখানে তাঁকে নগ্ন করিয়ে ঝিনুকের খোল দিয়ে তাঁর দেহের চামড়া চেঁছে ফেলে। হাইপেশিয়ার দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে বিভক্ত করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সেই সন্ত্রাসীরা এরপর তাঁর টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া মৃতদেহটি পুড়িয়ে ছাই করে উড়িয়ে ছিল। এই বর্বর অমানুষগুলো হাইপেশিয়াকে এতটাই ভয় পেয়েছিল যে এভাবে অমানুষের মতো নির্মমভাবে হত্যা করে ক্ষান্ত থাকেনি। হাইপেশিয়াকে হত্যা করার কয়েক দিন পরেই ওরা আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলেছিল আর তার সাথে হাইপেশিয়ার সব কাজও নষ্ট করে দিয়েছিল। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম হাইপেশিয়া ও তাঁর কাজকে আর জানতে না পারে। কিন্তু ধ্রুব সত্যকে কি আর আটকানো যায়? হাইপেশিয়ার মৃত্যুর পরে তাঁর ছাত্ররা তাঁর কাজটি চালিয়ে বা এগিয়ে নিয়ে যায়। বলাবাহুল্য, হাইপেশিয়ার গবেষণা ও লেখাগুলো আজও গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং দর্শনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।


নিঃসন্দেহে, হাইপেশিয়ার মৃত্যু ইতিহাসের পাতায় একটি বড়সড় ট্র্যাজেডি। তাঁকে কেন হত্যা করা হয়েছিল সেই ব্যাপারে দুটো প্রধান তত্ত্ব রয়েছে। প্রথম তত্ত্বটির মতে, বিশপ সিরিলের সাথে আলেকজান্দ্রিয়ার গভর্নর অরেস্টেসের রাজনৈতিকভাবে প্রবল মতবিরোধে ছিলেন। এর কারণ অবশ্য হাইপেশিয়া। কেননা, সিরিল বিশ্বাস করতেন যে, হাইপেশিয়া ও তাঁর দর্শন হল গোঁড়া খ্রিস্ট ধর্মবিরোধী প্যাগান(প্রাচীন ধর্ম প্যাগানিজম-এর ধারক)তথা চার্চদ্রোহী আর অরেস্টেস ও তাঁর শাসন প্রভাবিত হচ্ছে হাইপেশিয়া ও তাঁর দর্শন দ্বারা। তাই নরকের কীট সিরিল ও তাঁর অনুগামীরা হাইপেশিয়াকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আর এর সাথে আছে দ্বিতীয় আরেক তত্ত্ব তা হল, হাইপেশিয়া একজন শিক্ষিতা এবং স্বাধীনচতা নারী ছিলেন যিনি পুরুষদের সাথে সমান স্তরে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও দর্শন ইত্যাদি গুরুগম্ভীর বিষয়ে আলোচনা করতেন। এমনকি তিনি খ্রিস্টান ধর্মের অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরে তার বিরোধিতাও করেছিলেন, যা তখনকার সময়ে সমাজে বেশ প্রভাব বিস্তার করছিল। হাইপেশিয়ার এই মহান নারীত্ব ও মুক্তচেতনা গোঁড়া পিতৃতান্ত্রিক ও ধার্মিক সিরিল এবং তাঁর অনুসারীরা মেনে নিতে পারেননি। তাই, তাঁকে বর্বরভাবে হত্যা করে নারীদের অধিকার এবং শিক্ষার জন্য একটি ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন। আসলে, নারীজাতির শিক্ষা বন্ধ করে দিয়ে, সমাজের মুক্তচিন্তার পথ বন্ধ করে দিয়ে এভাবেই সমাজকে অনেক পেছনে এক অন্ধকারময় যুগে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চায় কিছু পাশবিক আসুরিক অমানুষের দল। তবুও, সত্যের জয় হয়। আসুরিক শক্তির পরাজয় ঘটে দেবত্ব শক্তির কাছে। অনুসন্ধিৎসু অসংখ্য নারী-পুরুষের দ্বারাই জ্ঞানের আলো প্রজ্জ্বলিত হতে থাকে গাণিতিক নিয়মেই ধর্মীয় সহ সমস্ত গোঁড়ামিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই।


হাইপেশিয়ার জীবন ও কর্ম এটাই দেখিয়ে গেছে যে, পুরুষের মতো নারীরাও জনসমক্ষে কথা বলতে পারেন। এমনকি জটিল ও দুরূহ বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক বিষয় নিয়েও তাঁরা অনায়াসে চিন্তাভাবনা ও আলোচনা করতে পারেন। গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত হাইপেশিয়ার চিন্তাভাবনা ও কথাগুলো পরবর্তী সময়ের গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদদের কাজে লেগেছে এবং অনুপ্রাণিত করে সাহায্য করেছে নতুন নতুন উন্নত তত্ত্ব তৈরি করার ক্ষেত্রে। বলাই যায় যে, হাইপেশিয়ার কাজ আজও আমাদের কাজে লাগে ও ভাবিয়েও তোলে। শুধু গণিত বা বিজ্ঞানের ইতিহসেই নয় গোটা মানব জাতির ইতিহাসের পাতায় হাইপেশিয়া অতি সম্মানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছেন। তিনি সমগ্র নারীজাতির আদর্শ তো বটেই এমনকি মানবমুক্তির দিশারীও বটে।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার

Posted in







‘হিন্দু পেট্রিয়টে’র বিখ্যাত সম্পাদক , রাজনৈতিক সাংবাদিকতার অগ্রদূত হরিশ মুখার্জীর মৃত্যুর ২ বছর পরে ১৮৬৩ সালে মুম্বাইএর এলফিনস্টোন কলেজের এক পার্শি অধ্যাপক ফ্রামজি বোমানজির যে বইটি প্রকাশিত হয় , তার নাম ‘Lights and Shades of the Life of Baboo Hurish Chunder Mookerjee and passing thoughts on India and its people , their present and future.’ এই বইটিকে আমরা প্রথম হরিশ-জীবনী বলতে পারি । তবে স্বাভাবিক কারণে এতে পর্যাপ্ত তথ্য ছিল না । এর পরে ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত হয় রামগোপাল সান্যালের হরিশ-জীবনী । মাত্র ৫৬ পাতার এই পুস্তিকাকে সঠিকভাবে জীবনী-গ্রন্থ বলা যায় না । এই পুস্তিকায় বিক্ষিপ্তভাবে হরিশের জীবনের কিছু বিবরণ সংকলিত হয়েছে। রামগোপাল ১৮৮৯ সালে রচনা করেন ‘A General Biography of Bengal Celebrities –both living and dead .’ এই বইতে দেশের মোট আটজন খ্যাতনামা ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত জীবনকথা বর্ণিত হয়েছে ।

এর পরে ১৯১০ সালে কলকাতার ধর্মতলার চেরি প্রেস থেকে আইনজীবী ও লেখক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় : ‘SELECTION FROM THE WRITINGS OF HURRISH CHUNDER MOOKERJI.’ কোন অনুপ্রেরণায় নরেশচন্দ্র এই সংকলনে ব্রতী হয়েছিলেন , আমরা তার কোন হদিশ পাই না । তবে ভূমিকায় নরেশচন্দ্র উত্তরপাড়ার রাজা প্যারীমোহন মুখার্জীর নামোল্লেখ করেছেন , তাঁর সাহায্যের কথা বলেছেন ( ‘ I have great pleasure in acknowledging the great assistance I have derived from the never failing kindness of Raja Pyri Mohan Mookerji C.S.I , under whose directions mainly the compilation has been made . ’ ) এই প্যারীমোহন ছিলেন হরিশ মুখার্জীর বন্ধু জয়কৃষ্ণ মুখার্জীর পুত্র । ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার দুটি খণ্ড থেকে প্যারীমোহন হরিশের কয়েকটি রচনা সংকলন করেছিলেন , যা নরেশচন্দ্র ব্যবহার করেছেন তাঁর সংকলন গ্রন্থে ।

‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকায় রচনাকারের নাম থাকত না । এই পত্রিকায় হরিশ মুখার্জী ছাড়াও রামগোপাল ঘোষ , কিশোরীচাঁদ মিত্র , রাজেন্দ্রলাল মিত্র , দ্বারকানাথ মিত্র , জয়কৃষ্ণ মুখার্জী , গিরীশচন্দ্র ঘোষ প্রভৃতির রচনা প্রকাশিত হত । এত রচনার মধ্য থেকে হরিশ মুখার্জীর রচনা সনাক্ত করা সহজ ছিল না । রচনারীতির আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য বিচার করেই সংকলন করা হয়েছে , নরেশচন্দ্র বলেছেন –‘ In making this selection , internal evidence has been our sole guide and pre-eminently we have relied upon style .’ এই সংকলনের সব রচনাই যে নিশ্চিতভাবে হরিশচন্দ্রের, সে দাবি সম্পাদক করেন নি , তবে –‘ But there is no doubt that most of them are , if one may judge from style.’

রচনাগুলি বিষয়ানুযায়ী ১০টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত , শেযে আছে পরিশিষ্ট । প্রথম অধ্যায় ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ ( The Mutiny) । এই অধ্যায়ে How Annexation Worked , The Mutiny , The Causes of the Mutiny , The Panic in Calcutta , The Lucknow Refugees , The Crises and the Native Princes , The Oude Proclamation , The Atrocity Mongers and the Sepoys , English Opinion , Retribution , English Opinion and Indian Facts , The Atrocitirs , Indiscriminate Retribution and the ‘ Antagonism of Race’ ইত্যাদি মোট ৩৫টি রচনা সংকলিত হয়েছে ।

দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম ‘ক্ষমতার হস্তান্তর’ ( The Transfer to the Crown) । এই অধ্যায়ে The Future of the Indian Government , The East India Company , The New India Bill , The Proclamation , The Transfer , India and House of Commons , The Reconciliation , The Amnesty , The Pacification of the Country ইত্যাদি মোট ১৬টি রচনা সংকলিত হয়েছে ।

তৃতীয় অধ্যায়ের নাম ‘সৈন্য বাহিনী’ ( The Army) । এই অধ্যায়ে আছে তিনটি রচনা – Native Gentlemen Officers, The Europeans Troops , The Old Sepoy Army .

চতুর্থ অধ্যায় ‘ভূমি আইন’ ( Land Law) । এই অধ্যায়ে আছে ৭টি রচনা – The New Sale Law Bill , The Sale Law and the Zaminders , The Rent Bill , The Parmanent Settlement প্রভৃতি ।

পঞ্চম অধ্যায়ের নাম ‘নীল চাষ ‘( Indigo ) । নীল আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই হরিশ মুখার্জীর খ্যাতি , অথচ এই সংকলনে নীল বিষয়ক মাত্র ৭টি রচনা আছে । এটা বিস্ময়ের ব্যাপার । এই অধ্যায়ে আছে : Indigo Planting in Nudia , Indigo Planting in Rajshaye , Indigo Planting , The Zaminder and the Planter , Planter’s Portraits , Indigo Planting and Mofussil Justice , The Planters and Official .

ষষ্ঠ অধ্যায়ে বাণিজ্যিক বিষয় ( Industrial and Commercial) আলোচিত হয়েছে , যেমন Blowing the Trumpet , Capital and Enterprise , Merchant and Banian , Workmen and Servants .

সপ্তম অধ্যায়ে ইংরেজের ‘ভারত শাসন’ ( Administration of India ) আলোচিত হয়েছে । এতে মোট ১৮টি রচনা স্থান পেয়েছে । যেমন : An Indian Parliament , Federalization , The Indian Debate , The Patriarchal System, Constitutionalism in India , The Civil Service , The Mandarins , Employment of Natives, A Native Judge for the High Court , The Civil Service and the Natives ইত্যাদি ।

অষ্টম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘ ভারতীয় ও ইউরোপীয়’ ( Indians and Europeans) । এই অধ্যায়ে The Penal Code , The Black Acts , The Native Meeting in the Town Hall , Our legislator Judges , Popular Fallacies , Who is to Blame , Treatment of Natives , The Position of the Europeans প্রভৃতি মোট ১৭টি রচনা স্থান পেয়েছে ।

দেশের সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয় ( Social and Religious ) নিয়ে মোট ৭টি রচনা আছে নবম অধ্যায়ে ; যেমন : Divisions in Hindu Society , A plea for Caste , The Social Progress of India , Christianity in India, English and Hindoo Civilization—A contrast প্রভৃতি ।

দশম অধ্যায়ে দেশের শিক্ষা ( Educational) নিয়ে ৮টি রচনা সংকলিত হয়েছে ; যেমন : The Sanskrit and Vernacular Language , Matters Educational , Our Educational Policy , The Indian Universites প্রভৃতি।

পরিশিষ্টাংশে আছে ১৫টি রচনা , যেমন : The Army , The First Indian Debate , The New Danger, The English in India , The Indian Bill , Vernacular Newspaper প্রভৃতি ।

সংকলিত রচনাগুলি প্রমাণ করে যে কোম্পানির শাসনাধীন দেশের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে হরিশ নিজের মতামত লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন তাঁর রচনায় । এ দেশের সাংবাদিকতার , বিশেষ করে রাজনীতিবিষয়ক সাংবাদিকতার অগ্রদূত হরিশ মুখার্জী । ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকা তাঁর সম্পাদনায় দেশে সৃষ্টি করেছিল অ।লোড়ন । নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত সঠিকভাবে বলেছেন , ‘ But never before he took charge of Hindu Patriot was Indo-English journalism conceived as capable of rising to the height that the Patriot achieved under him and never did this class of journalism exercise a wholesome influence upon the small educated community of the day or on the Government . ’

যে সময়কালের মধ্যে হরিশচন্দ্র ‘হিন্দু পেটিয়ট’ সম্পাদনা করেছেন , সেই ১৮৫৬ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে দেশের ইতিহাসে অনেকগুলি বড় বড় ঘটনা ঘটেছিল । যেমন : সনদের পুনর্নবীকরণ , রেভিনিউ সেল আইন , সিপাহি বিদ্রোহ , ক্ষমতার হস্তান্তর , ব্ল্যাক অ্যাক্ট আন্দোলন , নীল বিদ্রোহ , বিধবা বিবাহ আইন , বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা , স্বত্ববিলোপ নীতি ইত্যাদি । হরিশচন্দ্র এই সব ঘটনায় তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ।

নরেশচন্দ্র বলেছেন যে সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে হরিশ মুখার্জীকে চমৎকার ‘publicist’-এর ভূমিকায় দেখা গেছে। কখনও তিনি বিদ্রোহের কারণ সন্ধান করার চেষ্টা করছেন , কখনও সিপাহিদের অত্যাচারের অতিরঞ্জিত ঘটনা পরিবেশন করার জন্য সাংবাদিক ও প্রচারকদের নিন্দা করছেন , কখনও অবিমৃশ্যকারিতার জন্য সিপাহিদের সমালোচনা করছেন , কখনও ডালহাউসির কার্যকলাপের –বিশেষ করে অযোধ্যা অভিযানের নিন্দা করছেন , কখনও আবার ক্যানিংএর দূরদৃষ্টির প্রশংসা করছেন , কখনও ইংরেজের জাতিগর্ব ও ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ করছেন । নরেশচন্দ্র তাই বলেছেন , ‘ The courage and statesmanship that he displayed on this occasion , the comprehensive knowledge and fearless enthusiasm for the right that characterize his writings of this period at once mark him out as a man far above the ordinary run--- a man who in other circumstances might have made his mark in far higher spheres .’

হরিশচন্দ্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে সমর্থন করেছেন । বেশ জোর গলায় তিনি বলেছেন যত ত্রুটি থাকুক না কেন , এই ব্যবস্থাই ভারতবর্ষের পক্ষে উপযুক্ত ও কর্যকরী ব্যবস্থা ; এই ব্যবস্থা ব্রিটেন ও ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করবে ( ‘Whatever the faults of the Permanent Settlement . it is the only system of landed tenure , it is clear, which is suited to India .’ ) । তিনি আসলে এই ব্যবস্থার রাজনৈতিক তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে পারেন নি বলেই মনে হয় । তাঁর মনে হয়েছিল যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে দেশের রায়তদের উপকার হবে । বাস্তবে তার বিপরীত হয়েছিল । নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেছেন যে বহুক্ষেত্রে হরিশ জমিদারদের পক্ষ সমর্থন করেছেন বটে , কিন্তু সমানভাবে রায়তদের উপর জমিদারদের অত্যাচারেরও প্রতিবাদ করেছেন ( ‘ Hurrish Chunder was no less a friend of the ryot than that of the Zaminder , His anxious solicitude to protect the interests of Khudkhast and Kudimee ryots whose title was most insecure in those days , finds expression in many of his articles .’ ) । কৃষকদের প্রতি তাঁর আন্তরিক দরদ ও সহানুভূতির প্রমাণ পাওয়া যায় নীল বিদ্রোহের সময়ে । রিক্ত , বঞ্চিত , অত্যাচারিত রায়তদের তিনি আশ্রয় দিয়েছেন , আহার দিয়েছেন , দরখাস্ত লিখে দিয়েছেন , নীলকরদের বিরুদ্ধে মামলায় সাহায্য করেছেন । সিপাহি বিদ্রোহের মধ্যে তিনি বঞ্চিত কৃষকদের জমি হারাবার ক্ষোভকে প্রতিফলিত হতে দেখেছেন । তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাদের শিক্ষার দাবিতেও সোচ্চার হয়েছেন ।

হরিশচন্দ্রের মতো রাজনীতিমনস্ক , বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন , আপোসহীন , শ্রেণিস্বার্থহীন , মানবদরদী , দেশপ্রেমিক মানুষ দেশে তাঁর যোগ্য সম্মান লাভ করেন নি বলে সংকলনের সম্পাদক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন । নরেশচন্দ্র বলেছেন যে হরিশ জনস্বার্থের জন্য যে কাজ করেছেন , অন্য দেশের মানুষ হলে সেখানকার জনসাধারণ তাঁকে মাথায় তুলে রাখত ( ‘ In any other country , a career such as his would be a cherished treasure to the historian and a bye-word to every patriotic citizen .’ ) । কিন্তু নিজের দেশে হরিশচন্দ্র অবহেলিত হয়ে থেকেছেন । তাঁরা লেখা ও চিঠিপত্র সংকলিত হয় নি , তাঁর কোন ছবি রাখা হয় নি , তাঁর বসতবাড়ির কোন হদিশ করা হয় নি । নরেশচন্দ্র বলেছেন , ‘Whose intellectual eminence no less than his great public services demanded more adequate recognition than we have been able to give him ; for he was the first exponent and , in a very true sense , the father of the new life whose throbbings are felt today all through the length and breadth of the land.’

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in






অনেক ধৈর্য, অধ্যাবসায় আর নিজের যোগ্যতা ও সুযোগ লাভের ফলে সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়েছেন গুলজার। অনেক ঘাতপ্রতিঘাতকে মোকাবিলা করে তাকে গুলজার নামে বিখ্যাত হতে হয়েছে।
গুলজার হিন্দি ও উর্দু ভাষার ভারতীয় কবি, গীতিকার, সুরকার, ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবে আজ বিশেষভাবে খ্যাতিমান। তিনি মূলত হিন্দী ভাষায় গল্প, কবিতা ও শায়েরী রচনা করেন। তবে উর্দু ভাষায় কবিতা ও শায়েরী রচনাতেও তিনি বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে।
এজন্য তাকে এই যুগের শ্রেষ্ঠ উর্দু কবি হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি সঙ্গীত পরিচালক এস.ডি. বর্মন ১৯৬৩ সালের চলচ্চিত্র বন্দিনীতে গীতিকার হিসেবে এবং আর.ডি. বর্মন, সলিল চৌধুরী, বিশাল ভরদ্বাজ এবং এ.আর. রহমান সহ অনেক সঙ্গীত পরিচালকের সাথে কাজ করেছিলেন। গুলজার কবিতা, সংলাপ এবং স্ক্রিপ্টও লেখেন। তিনি ১৯৭০-এর দশকে আন্ধি এবং মৌসম এবং ১৯৮০-এর দশকে টিভি সিরিজ মির্জা গালিবের মতো চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ১৯৯৩ সালে কির্দার পরিচালনা করেন।
গুলজারের বহুমাত্রিক প্রতিভার কথা বিষদ ভাবে আলোচনার আগে তার ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে বলা প্রয়োজন।
সম্পূরণ সিং কালরা গুলজারের আসল নাম। তিনি ১৯৩৪ সালের ১৮ আগস্ট অবিভক্ত ভারতের (বর্তমান পাকিস্তান)ঝিলম জেলার দিনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাখন সিং। তার মায়ের নাম সুজান কৌর, তার মা ছিলেন তার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। তিনি ছিলেন মায়ের একমাত্র পুত্র ।
মায়ের মৃত্যুর পর তিনি বেশিরভাগ সময় বাবার সাথে থাকতেন। মায়ের মৃত্যুতে তার শৈশব জীবন সুখের ছিল না। বৈমাত্রেয় ভাইবোনদের সাথে তাকে বসবাস করতে হয়েছিল নিঃসঙ্গতার মাঝে। বাবার টুপি ও ব্যাগের দোকানে রাতে থাকতে হত। সে পাড়ার লাইব্রেরির বইগুলো তাকে কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে। সে-সময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার সংকলন দ্য গার্ডেনারের উর্দু সংস্করণ পড়ে পালটে যায় তাঁর জীবনবোধ। স্কুলে থাকতেই সাহিত্য এবং কবিতার প্রতি গুলজারের অনুরাগ জেগে ওঠে। গুলজার এক সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, ‘খামোশ সওয়াল’ এই দুটো শব্দ যে পাশাপাশি যেতে পারে কোনও দিন ভেবে দেখেননি । ‘নিঃশব্দ প্রশ্ন’। আর সেটিই তাঁর গান লেখার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তবে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও এক গল্প। কেন বাংলা শিখেছিলেন গুলজার? সেই কাহিনি।
গুলজার সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যখন তার বয়স অনেক কম- এইট নাইনে পড়েন সেই সময়ে রাতে সময় কাটানোর জন্য পাড়ার এক লাইব্রেরি থেকে বই ধার করে আনতেন রোজ রাতে ৪ আনার বিনিময়ে একটি করে বই নিয়ে আসতেন গুলজার। প্রথমদিকে তিনি গোয়েন্দা কাহিনী ও রোমাঞ্চকর কাহিনীর বই পড়তেন। একদিন লাইব্রেরিতে কোনও বই পছন্দ হচ্ছিল না। তখন লাইব্রেরির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিটি বললেন, 'একটি বই দিচ্ছি, পড়ে দেখতে। তারপর তিনি খুব উপর দিকের এক তাক থেকে একটা বই বার করে সেটি দিলেন গুলজারের হাতে। সেই বইটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ইংরেজি সংকলন ‘দ্য গার্ডেনার’-এর উর্দু অনুবাদ।
বাড়ি ফিরে সেই বইয়ে ডুবে গেলেন গুলজার। এতই ভালো লেগে গেল। সেই বইটি থেকেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর আকর্ষণ! গুলজারের জীবন বদলে দেওয়া সেই বইটিই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ইংরেজি সংকলন ‘দ্য গার্ডেনার’-এর উর্দু অনুবাদ। ওই লাইব্রেরী থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মুন্সী প্রেমচাঁদ প্রমুখের অনেক বই পড়েছিলেন।
তারপরেই তিনি ঠিক করে নেন জীবন সমপর্ণ করবেন রবিঠাকুরকে। কয়েক বছর আগে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গুলজার জানিয়েছেন, এক সময়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা হিন্দিতে অনুবাদ করেছেন ইংরেজি অনুবাদ থেকে। কিন্তু তাঁর মন বলত, রবিঠাকুরের মূল বাংলা শব্দগুলির মধ্যে যে গভীর সৌন্দর্য আছে, তা ইংরেজি অনুবাদে টের পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তিনি বাংলা শিখতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মন দখল করে নেন এর পরে। রাত-দিন শুধু বাংলা শিখতে শুরু করেন তিনি। লক্ষ্য একটাই রবিঠাকুরের লেখা হিন্দিতে অনুবাদ করা।
সেই থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি অনুরাগ বর্তমান সময়ে ভারতের অন্যতম সেরা কবির। রবীন্দ্রনাথ চর্চায় এক সময়ে বহু সময় কাটিয়েছেন তিনি। এখনও রবীন্দ্রনাথ তাঁর পথচলার সঙ্গী, সেটাও জানান গুলজার সাহেব।

সে সময়টায় ভারত বিভাগের ফলে দাঙ্গা হাঙ্গামায় তাদের পরিবারটাও খারাপ অবস্থায় পড়ে।
দেশভাগের পর চলে আসেন দিল্লীর রওশন আরা বাগে। সেখানেই ইউনাইটেড খৃস্টান স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন। ইন্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে বিদায় জানান তিনি। সঙ্গীহীন মাতৃহারা বিষণ্ণ এক কিশোর বইয়েয় মধ্যেই খুঁজে পান বন্ধুত্বের দুনিয়া। সাহিত্যের প্রতি তীব্র পিপাসা তাকে আরও গভীর পড়াশোনায় ডুবিয়ে দেয়। সাহিত্যের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও চিত্রকলার প্রতি গভীর মনোযোগী হয়ে পড়েন তিনি।ভারতীয় সুর,শব্দ ও চিত্রের জগতকে তিনি এক সুতোয় বেঁধেছেন। একাধারে সুকবি, গায়ক অন্যদিকে চিত্র পরিচালক। হিন্দি ও উর্দু ভাষায় লেখা ছোটগল্পে তিনি তৈরি করেছেন এক অনির্ণীত জগত।
দিল্লিতে পড়াশোনার পর তিনি মুম্বাইতে চলে যান রোজগারের জন্য। সেখানে তিনি বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন। পোড়খাওয়া জীবন থেকে তিনি দিনে দিনে স্বমহিমায় উজ্জ্বল শিখরে আরোহন করেন।
গাড়ির পেইন্টার হিসেবে কাজ করেন গুলজার।কাজ ছিল দুর্ঘটনায় কবলিত গাড়িগুলোকে নতুন করে পেইন্টিং করা।
তার মতে, এই কাজের পাশাপাশি তিনি অনেক সময় পেতেন। আর সেই সময়টা তিনি পড়া ও লেখার কাজে লাগাতেন।
দারিদ্র্যের জোয়ারে ভাসতে থাকা গুলজার তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন লেখক হওয়ার। সেজন্য গুলজার দীনভী এবং পরবর্তীতে গুলজার নাম ধারণ করেন তিনি।
এক সময় তিনি ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন , প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং পাঞ্জাবি সাহিত্য সভার সঙ্গে যুক্ত হন। এসব অ্যাসোসিয়েশনে সরদার জাফরী, কৃষণ চন্দর, কাঈফী আজমী, সাহির লুধিয়ানভি, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, গুরওয়েল সিং পান্নু, সুখবীর, রাজিন্দর সিং বেদি এবং বলরাজ সাহানির মতো কবি, লেখক, অভিনেতা ও শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব হয় তাঁর। আর এ থেকেই তার জীবনের মোড় পালটে যায়।
ষাটের দশকের প্রথম দিকের কোনো এক রোববার প্রোগ্রেসিভ রাইটারস অ্যাসোসিয়েশনের মিটিংয়ে গীতিকার শৈলেন্দ্র ও নির্মাতা বিমল রায় তাকে বলেন, চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য। তাদের উৎসাহে গুলজার রাজি হন। বিমল রায়ের ‘বন্দিনী’ সিনেমায় গান লিখলেন গুলজার। সে গানে সঙ্গীত পরিচালনা করলেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মন । বিমল রয় ছাড়াও আরো অনেক গুণী মানুষদের সংস্পর্শে এসে তিনি কাজ করেছেন। সুরকার শচীন দেব বর্মণ, নির্দেশক হৃষিকেশ মুখার্জী তার মাঝে অন্যতম।
বিমল রয়ের সাথে প্রথম দেখা করতে যাওয়ার ঘটনাটি ছিল দারুণ। দেবু সেন নামে একজন কবি গুলজারকে একটি চলচ্চিত্রে কাজের জন্য বিমল রয়ের অফিসে নিয়ে যায়। অফিসের রুমে যাওয়ার পর গুলজারের সম্পর্কে সব জেনে বাংলায় দেবু সেনকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, বৈষ্ণব কবিতা কী, এর মর্ম কী, এসবের কিছু কি এই লোক বুঝবে? দেবু তখন বিমল রয়কে বলে, দাদা, উনি বাংলা বুঝেন, বাংলার অনেক গল্প-উপন্যাস তিনি পড়ে এসেছেন। এ কথা শুনে বিমল রায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যান। এক সাক্ষাৎকারে গুলজার বলেন, এখনো বিমল রয়ের মুখের সেই অপ্রস্তুত ভাব তিনি ভুলতে পারেন না। এরপর থেকেই গুলজার তার সাথে কাজ করা শুরু করেন। বিমল রয়ের কাছে গুলজার অত্যন্ত ঋণী, কারণ তিনিই প্রথম গুলজারের প্রতিভা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাকে কাজ করতে ভরসা দিয়েছিলেন। এগুলো তাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।
চলচ্চিত্রে এসেও গুলজার ঝুঁকে যাননি কথিত কমার্শিয়াল ভুবনে। তিনি বেছে বেছে সাহিত্য নির্ভর এবং মানসম্মত কাজেই নিজেকে যুক্ত করলেন। গান লেখার পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও লেখা শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে ‘আশীর্বাদ’ সিনেমায় তিনি প্রথম সংলাপ লিখেছিলেন। এরপর থেকে গুলজার যেসব চরিত্রের সৃষ্টি করেছেন, সেগুলোতে অভিনয় করে বহু অভিনেতা পেয়েছেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
১৯৬৯ সালের আগ পর্যন্ত গুলজারের গান সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি। তার রচিত প্রথম জনপ্রিয় গান ‘হামনে দেখি হ্যায় উন আখো কি মেহেকতি খুশবু’। ১৯৭১ সালের ‘গুড্ডি’ সিনেমায় গুলজার দুটি গান লেখেন। তার মধ্যে ‘হামকো মান কি শক্তি দেনা’ শিরোনামের প্রার্থনা সঙ্গীতটি এতোটাই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে যে, এটি এখনো ভারতের বিভিন্ন স্কুলে বাচ্চাদের গাওয়ানো হয়।
গীতিকার হিসেবে গুলজার কাজ করেছেন উপমহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকদের সাথে। আগেও সেকথা কিছুটা বলা হয়েছে। আর ডি বর্মন, এস ডি বর্মন, শংকর জয়কিশান, হেমন্ত কুমার, লক্ষ্মীলাল-পেয়ারেলাল, মদন মোহন, রাজেশ রোশান ও অনু মালিকের মতো সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের সাথে তিনি কাজ করেছেন।
লেখক-পরিচিতি এলো পরে। । কবি গুলজারের প্রথম প্রকাশিত বইটি ছোটগল্পের বই, যেটির নাম চৌরাস রাত (১৯৬২)। ১৯৬৩-তে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতার বই জানম। একই সঙ্গে উর্দু ও হিন্দি ভাষায় তিনি রচনা করে চলেন কবিতা ও ছোটগল্প। রাত প্যশমীনে কী কবিতার বইটি তেমনি একটি বই, যেটি একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে দুই ভাষাতেই।
এবার গুলজারের লেখা কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘ছাইয়া ছাইয়া’। বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমানের সুরে এই গান ছিল শাহরুখ-মনিশা কৈরালা অভিনীত সিনেমা ‘দিল সে’-এর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান। এ আর রহমানের সুরে ২০০৭ সালে গুলজার গান লিখলেন ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ সিনেমায়। ‘জয় হো’ শিরোনামের সেই গানের জন্য উপমহাদেশের একমাত্র গীতিকার হিসেবে অস্কার জয় করেন গুলজার। একই গানের জন্য তিনি অর্জন করেন বিশ্ব সঙ্গীতের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার গ্র্যামি-ও।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গুলজার অসংখ্য সিনেমায় গান লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘দ্য স্কাই ইজ পিঙ্ক’, ‘রাজি’, ‘রাঙ্গুন’, ‘ওকে জানু’, ‘মিরজা’, ‘তালভার’, ‘দৃশ্যাম’, ‘হায়দার’, ‘যাব তাক হ্যায় জান’, ‘ সাত খুন মাফ’, ‘স্ট্রাইকার’, ‘ইশকিয়া’, ‘ভীর’, ‘রাজনীতি’, ‘বিল্লু’, ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’, ‘ঝুম বারাবার ঝুম’, ‘জান-এ-মান’, ‘ওমকারা’, ‘রেইনকোট’, ‘বান্টি অউর বাবলি’, ‘মাকবুল’, ‘দিল সে’, ‘মাসুম’, ‘সদমা’, ‘খাট্টা মিঠা’, ‘মৌসাম’, ‘নামাক হারাম’ ইত্যাদি।
গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজের পাশাপাশি গুলজার আসেন চলচ্চিত্র নির্মাণেও। ১৯৭১ সালে তিনি প্রথমবারের মতো নির্মাণ করলেন ‘মেরে আপনে’ সিনেমাটি। এরপর তিনি ‘পরিচয়’, ‘কোশিশ’, ‘আচনক’, ‘আন্ধি’, ‘খুশবু’, ‘লিবাস’, ‘মাচিস’, ‘হু তু তু’ ইত্যাদি সিনামগুলো নির্মাণ করেন তিনি। গুলজার তার সিনেমাগুলোতে মানুষের সম্পর্ককে সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুর সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরতেন।
কবি গুলজারের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো তিনি সাহিত্য বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। ভিন্ন ধারার সিনেমাগুলো তৈরি হতো ভালো কোনো সাহিত্যিকের গল্প-উপন্যাস থেকে। গুলজারের ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি আগে থেকেই সেসব গল্প-উপন্যাস পড়ে রেখেছেন। গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের সাথে পরিচয় থাকার কারণে চরিত্রগুলোর আবেগ, অনুভূতি সম্পর্কে তার ভালো ধারণা থাকতো। সে কারণে চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোকে মূল গল্পের চরিত্রের সাথে মিলিয়ে অভিনয় করতে কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সমস্যা হতো না।
কোশিশ চলচ্চিত্রে সঞ্জীব কুমার এবং জয়া ভাদুড়ীর বাকশক্তিহীন দুই দম্পতির অভিনয় কিংবা আঁধি চলচ্চিত্রে সঞ্জীব কুমার এবং সুচিত্রা সেনের অভিনয় দেখে কে মুগ্ধ হয়নি? সত্তর দশকে হিন্দি সিনেমার জগতে যখন শুধুই মারপিট আর এংরি ইয়াং ম্যানের যুগ চলছিল তখন ভিন্ন ধাঁচের গল্প, ভিন্ন ধাঁচের প্রেক্ষাপট ও ভিন্ন আখ্যানভাগের এ দুটি সিনেমা দর্শকদের মনে আলাদা দাগ কেটেছিল
কোশিশ চলচ্চিত্রের একটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এতে বোবা এবং বধিরদের কথা বলার যে সংকেতগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তা পুরোপুরি সঠিক। এ সম্পর্কে রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিয়ে তা অভিনয়ে আনা হয়। তখনকার সময়ে এরকম সিনেমা একদমই হতো না। কিন্তু গুলজার গতানুগতিক চলচ্চিত্র না বানিয়ে ভিন্ন ধাঁচের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র বানাতেন, যা দর্শকদের ভালো লাগতো। এগুলো সমালোচকদেরও পছন্দ হতো। বেশ কিছু চলচ্চিত্র অবশ্য অর্থনৈতিকভাবে সফলতার মুখ দেখেনি। তবে অর্থনৈতিকভাবে সফল না হলেও পরবর্তীতে সেগুলো ক্লাসিকের মর্যাদা অর্জন করেছে।
আন্ধি (অনুবাদ. 'ঝড়') হল একটি ১৯৭৫ সালের ভারতীয় রাজনৈতিক ড্রামা চলচ্চিত্র যেখানে সঞ্জীব কুমার এবং সুচিত্রা সেন অভিনীত এবং গুলজার পরিচালিত। সেই সময়ে অভিযোগ করা হয়েছিল যে ছবিটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জীবন এবং তার বিচ্ছিন্ন স্বামীর সাথে তার সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে, শুধুমাত্র চেহারাটি রাজনীতিবিদ তারকেশ্বরী সিনহা এবং ইন্দিরা গান্ধী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। গল্পটি বেশ কয়েক বছর পর একটি বিচ্ছিন্ন দম্পতির সুযোগে সাক্ষাতের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যখন স্ত্রী আরতি দেবী, এখন একজন নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ একটি নির্বাচনী প্রচারণার সময় তার স্বামীর দ্বারা পরিচালিত হোটেলে থাকতেন। মুভিটি রাহুল দেব বর্মনের রচিত গানের জন্য বিখ্যাত, গুলজার লিখেছেন এবং কিশোর কুমার এবং লতা মঙ্গেশকর গেয়েছেন।
পড়াশোনা করা লোকজনদের খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখেন গুলজার। তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মেরে আপ্নে’তে কোনো পরিচিত মুখ নেননি। ভারতের National School of Drama থেকে অভিনয় শিখে আসা অভিনেতাদের নিয়ে তিনি চলচ্চিত্রটি তৈরি করেন। এ চলচ্চিত্রটি পরবর্তীতে প্রভাবশালী ও শক্তিশালী চলচ্চিত্রের মর্যাদা অর্জন করে।
১৯৯৬ সালে বৈপ্লবিক চলচ্চিত্র ‘মাচিস’ নির্মাণ করেন গুলজার। চলচ্চিত্রের বিখ্যাত গান চাপ্পা চাপ্পা চারখার
তার কবিতা এবং লেখনী নিয়ে কেউ কখনো নেতিবাচক মন্তব্য করেনি। যারা তার কবিতা ও গান পড়েছে কিংবা শুনেছে তারা একটি বিষয় স্বীকার করেছে- তার প্রতিটি লেখার কোনো না কোনো অংশের সাথে তাদের জীবনের কোনো একটি ঘটনার মিল রয়েছে। সাধারণ মানুষকে যেন পড়তে পারেন গুলজার। তিনি এমন এক কবি যাকে জনসাধারণের কবি বললে ভুল হবে না। চলচ্চিত্র জগতে তিনিই একমাত্র মানুষ যিনি সাহিত্যকে জনসাধারণের জন্য নির্মাণ করতে পেরেছেন। আর তিনি এ কাজটি করেছেন তার সংলাপ, গান এবং চলচ্চিত্র দিয়ে।
একবার কবিতা লেখা নিয়ে তাকে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল- কবি হতে গেলে এবং কবিতা লিখতে হলে কি কাউকে উদাস হতেই হবে? উদাসী না হলে কি কবিতা লেখা যাবে না? তখন কবি গুলজার চমৎকার একটি উত্তর দিয়েছিলেন- মানুষের জীবনে উদাসীনতা একটু বেশী সময় ধরে থাকে, আর সুখ কিংবা আনন্দ হয় অনেকটা ফুলঝুরি বা আতসবাজির মতো যেটা বেশী সময় থাকে না। নিমিষেই আলো দিয়ে ফুঁড়িয়ে যায়। কিন্তু উদাসী অনেকটা আগরবাতির মতো। চারদিকে নিজের বাসনা বা গন্ধ ছড়িয়ে দেয়।
একথা অনস্বীকার্য যে তিনি যা-ই লিখেন না কেন, সেটা গান হোক, সংলাপ হোক, গল্প কিংবা উপন্যাস-চিত্রনাট্য হোক, তার লেখা প্রতিটি শব্দই জীবন্ত হয়ে ওঠে।
গুলজার যেমন অসাধারণ সব সৃষ্টিকর্ম উপহার দিয়েছেন, তেমনি তার অর্জনের পাল্লা হয়েছে ভারি। এক জীবনে যেন সব কিছুই অর্জন করে নিয়েছেন তিনি। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন পাঁচবার, রেকর্ড সংখ্যক ২১ বার পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার পুরস্কার; একবার অস্কার ও একবার গ্র্যামি আছে তার ঝুলিতে। এছাড়া ভারত সরকারের কাছ থেকে পদ্মভূষণ, এবং ভারতের চলচ্চিত্রে সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন গুলজার।উর্দু ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২৩ সালের জন্য ৫৮তম জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে সম্মানিত হলেন কবি,গীতিকার, পরিচালক গুলজার।
ব্যক্তি জীবনে গুলজার বিয়ে করেছেন অভিনেত্রী রাখিকে। তাদের একমাত্র সন্তান মেঘনা গুলজার। তিনিও এই সময়ের একজন আলোচিত নির্মাতা। যিনি ‘ফিলহাল’, ‘তালভার’ ও ‘রাজি’-এর মতো সিনেমা নির্মাণ করেছেন। সর্বশেষ মেঘনা গুলজার ‘ছপাক’ সিনেমাটি নির্মাণ করে প্রশংসিত হয়েছেন।

হিন্দি থেকে গুলজারের কয়েকটি কবিতা ও শায়েরী অনুবাদ করে দেখা যেতে পারে।

১)এসো তোমাকে কাঁধে তুলে নেই, তোমার ঠোঁট দিয়ে আমাকে চুমু দাও
চাঁদের কপালে চুমু দিতে
আজ রাতে দেখনি?
কনুই বাঁকালে কিভাবে
চাঁদ এত কাছে এসে গেছে।

২) দেখ, আস্তে আস্তে চল
দেখ, একবার দেখ।
পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে না কেন!
নির্জনে কাচের স্বপ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে
স্বপ্ন ভেঙে যায় কেউ দেখে না জেগে,
জেগে উঠলে কিছু স্বপ্ন মরে যাবে।

৩)দেখ, ধীরে ধীরে আরও ধীরে ধীরে হাঁট
দেখ, চিন্তা কর আর সাবধানে পা ফেলো
পায়ের শব্দ জোরে হওয়া উচিত নয়
একাকীত্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঁচের স্বপ্নে
স্বপ্ন ভেঙ্গে দেওয়া উচিত নয়, কেউ জেগে উঠবে না।
জেগে উঠলে যে কোনো স্বপ্ন মরে যাবে।
সুরেলা কথা বলো সুরেলা কথা বলো,
টক-মিষ্টি চোখের রসালো কথা।
রাতে চাঁদে মিছরি মেশান,
দিনের দুঃখগুলো নোনতা মনে হয়।
নোনতা চোখের মাতাল শব্দ,
ডুবন্ত ছায়াগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
সন্ধ্যার ঘ্রাণ যেন তোমার কাছে না পৌঁছায়,
অনুরণিত চোখের মাতাল শব্দ।
দেখো, ধীরে চল!
দেখো, ধীরে ধীরে চল, আরও ধীরে ধীরে,
দেখো, ভেবে চিন্তে সাবধানে পা ফেলো,
পায়ের শব্দ জোরে হওয়া উচিত নয়।
একাকীত্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঁচের স্বপ্ন,
কারো স্বপ্ন যেন ভেঙ্গে না যায়, কেউ জেগে না যায়,
জেগে উঠলে যে কোনো স্বপ্ন মরে যাবে।
অনেকবার দেখেছি মানুষের কাছে বিক্রি
বিক্রিতে প্রতিবারই প্রত্যাশা ভেঙ্গে যায়
জীবনের এই বাজারে ভাল, সবাই
গুনতে হলেই দেয় এবং নেয়।
কিন্তু প্রতিবারই কিছু স্মৃতি রেখে যায়
জীবনের এই বাজারে ভাল, সবাই
গুনতে হলেই দেয় ও নেয়।
কিন্তু প্রতিবারই কিছু স্মৃতি রেখে যায়
জীবনের এই বাজারে কয়েক বছর পর জানা যায়
আজও বাজার একইভাবে চলছে
আর আমরাও সবার মতো দৌড়াতে থাকলাম
জীবনের এই বাজারে..!!

( অনুবাদ: প্রাবন্ধিক)


গুলজারের লেখা কয়েকটা হিন্দি শায়েরীর অনুবাদ।
১.কেউ বুঝলে
একটা কথা বলি সাহেব..
একাকীত্ব একশো গুণ ভালো
নিকৃষ্ট মানুষের কাছ থেকে..
২.
গতকাল যা হয়েছে সবই তোমার
আজকের গল্প আমাদের
৩..
সেই ভালোবাসাও তোমার ছিল সেই ঘৃণাও তোমার।
কার কাছে আমরা আমাদের আনুগত্যের বিচার চাইব?
সে শহরও তোমার, সে আদালতও তোমার।
মেধা,মনন, চিন্তা চেতনা, ধৈর্য , অধ্যাবসায়ের বলে
গুলজার আজ আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল।
( অনুবাদঃ প্রাবন্ধিক)
গুলজারের বহুমাত্রিক প্রতিভার আলোকচ্ছটা স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে চিরকালের জন্য মনে করি।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


 


















৩৮

বের্শেম সৈনিক হলেও যুদ্ধটা মোটেই পছন্দ করে না। ১৯৪৪ সালের শেষ অবধি যা হোক করে হোক সে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটা থেকে বেঁচে যায়। নাইটক্লাবের ওয়েটার আর ককটেল বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করত সে। যুদ্ধের সময়ে নাইটক্লাবের পরিস্থিতি নিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে সে। প্রায় ১৫০০ রাতের ঘটনা দেখেছে সে।

সে জানে যে বেশির ভাগ পুরুষ যতটা মদ সহ্য হবে বলে ভাবে, তার চেয়ে অনেক কম খেয়ে মাতাল হয়ে যায়। তাছাড়া সারাজীবন অনেক পুরুষই নিজেদের বুনো মদ্যপ বলে মনে করে। নাইটক্লাবে যারা সঙ্গিনী নিয়ে আসে, তারা সঙ্গিনীদেরকেও এই ব্যাপারটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করাবার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে মদ্যপ বলতে যা বোঝায়, সেরকম পুরুষ খুব কম আছে। তারা যখন মদ্যপান করে, তখন সেটা দেখবার একটা আলাদা মজা আছে। যুদ্ধের সময়েও এমন পুরুষ সত্যিই বিরল।

এছাড়াও আরেকটা জিনিস সে লক্ষ্য করেছে যে একটা মানুষের বুকে অথবা গলায় সেঁটে দেওয়া পদকের এক টুকরো ধাতু সেই মানুষটাকে কিছুমাত্র বদলে দেয় না। অথচ অনেকেই এরকম ভাবে যে ওই টুকরোটা কিম্বা পোশাকের কারুকাজ এসব কিছু একটা ভীতু মানুষকে অসমসাহসী কিম্বা একটা মূর্খ মানুষকে বুদ্ধিমান বানিয়ে দেবে। কিন্তু বের্শেম লক্ষ্য করে দেখেছে যে সেরকম কিছু ঘটে না। যদি এইসব বাহ্যিক কাণ্ডকারখানা করে একটা মানুষকে বদলে দেওয়া যেত, তাহলে সেই বদলটা বড় জোর নেতিবাচক হতে পারে। তবে মানুষগুলোকে অবশ্য সে খুব বেশি হলে এক রাত বা দু’ রাত দেখেছে। অতীতে এদের কাউকেই সে চিনত না। তবে একটা ব্যাপার তার কাছে একদম পরিষ্কার যে এদের বেশির ভাগ মদ খেতেই পারে না। অথচ অনেক মদ গিলতে পারে, এরকম একটা হাবভাব করে। তাছাড়া একটু গিলেই এরা যখন মাতাল হয়, তখন আর কে হিসেব রাখবে যে কে কত গিলেছে? এরা মাতাল হয়ে গেলে, এদের কাণ্ডকারখানা দেখতে একটুও ভালো লাগে না তার। এই নাইটক্লাবে যুদ্ধের সময় প্রায় পনের শ’ রাত সে কাটিয়ে ফেলেছে। অনেক কিছু দেখেছে সে। তবে এই নাইটক্লাবে অবশ্য নিষিদ্ধ বা চোরাই জিনিস কেনাবেচার ক্ষেত্রে সেরকম কড়াকড়ি কোনো দিন ছিল না।

নাইটক্লাবে মদ কিম্বা ধূমপানের জন্য সিগারেট ইত্যাদি ছাড়াও মাঝে মাঝে খাবারদাবার বিক্রি হত। বের্শেমের বস ছিল এক আঠাশ বছরের ছোকরা, যার স্বাস্থ্য বেশ ভালো; অথচ ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর অবধি তাকে সৈনিকের ট্রেনিংও নিতে হয়নি, যুদ্ধেও যেতে হয়নি।

গোটা শহরটা যে বোমায় ধ্বংস হতে বসেছে, এইসব ব্যাপার নিয়ে বসের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। শহরের বাইরে জঙ্গলের কাছে বসের একটা প্রাসাদোপম বাংলো ছিল। শোনা যায় যে সেটাতে নাকি বাঙ্কারও ছিল। বিশেষ অতিথিদের নিয়ে গোপনে পার্টি করার জন্য বস তাদের গাড়ি করে নিয়ে যেত তার বাংলোর বাগানে।

বের্শেম যুদ্ধের সময়ে প্রায় পনেরশ রাত কাটিয়েছে নাইটক্লাবে। খুব খুঁটিয়ে সে সবকিছু লক্ষ্য করত। তাছাড়া বেশির ভাগ সময়ে তাকে কথা শুনে যেতে হত; নিজে কথা বলবার অবকাশ হত না সেরকম। যদিও একঘেয়ে লাগত। কিন্তু কিছু করার ছিল না। কত যে যুদ্ধের আক্রমণ আর চক্রব্যূহের মত ঘিরে ফেলবার ঘটনা সে শুনেছিল, সে কহতব্য নয়। তার মাঝে মাঝে মনে হত যে লিখে রাখলে কেমন হয়? কিন্তু অনেক, অনেক আক্রমণ, অনেক অনেক ঘিরে ফেলবার গল্প শুনেছিল সে। কত লিখবে? অনেক বীর যোদ্ধাদের দেখেছিল সে, যারা সব সময় পুরস্কার পাওয়া মেডেলগুলো পরত না। সীমান্তের ভাইল শহরের গল্প, আক্রমণের গল্প সব শুনে শুনে তার মনে হয়েছিল যে যুদ্ধের একদম হদ্দমুদ্দ জেনে নিচ্ছে সে। তবে মাতাল হয়ে সাধারণত সবাই সত্যি কথাই বলে। অর্থাৎ সেগুলো নেহাত গল্প ছিল না। সত্যি ঘটনা ছিল। বীর যোদ্ধাদের থেকে, বারের ওয়েট্রেসদের থেকে অনেক সত্যি ঘটনা শুনেছিল সে। ফ্রান্স, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া এসব জায়গা থেকে আসা অনেকগুলো মেয়েকেই ওয়েট্রেস হিসেবে দেখেছে সে নাইটক্লাবে। ওয়েট্রেসদের অনেকের সঙ্গেই ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যেত তার। ওদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে মদ খাওয়া… উফফ, সে একটা বেশ ব্যাপার বটে!

কিন্তু আপাতত সে আউয়েলব্যার্গ বলে একটা জায়গায় একটা খামারবাড়িতে চুপচাপ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে চোখে দূরবীন লাগিয়ে। বন্দুক ছাড়াও সঙ্গে আছে একটা স্কুল নোটবই, কিছু পেন্সিল আর একটা ঘড়ি। তার থেকে ঠিক দেড়শ মিটার দূরে বয়ে যাচ্ছে একটা নদী। নদীর ওপারে ভাইডেসহাইম বলে একটা জায়গা। সেই জায়গাটার উপরে নজর রাখতে হচ্ছে তাকে। তবে ভাইডেসহাইমে নজর রাখবার মত সেরকম কিছু ঘটছে না।

শহরটার সামনের দিকের প্রায় অর্ধেকটা জ্যাম কারখানার দেওয়াল দিয়ে ঘেরা এবং জ্যাম কারখানাটা এখন বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। মাঝেমধ্যে এক দুটো লোক দেখা যায় পথে। কালেভদ্রে কেউ কেউ পশ্চিম দিকে হাইডেসহাইমের দিকে যাচ্ছে। তারপর যেতে যেতে সরু রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ভাইডেসহাইমে কিছু কিছু লোক আঙুরের ক্ষেতে কিম্বা ফলের বাগানে কাজ করছে। দেখা যাচ্ছে যে লোকগুলো কাজ করছে। তবে সব কথাই কি নোটবুকে লিখে রাখতে হবে? যে বন্দুকের ভার দেওয়া হয়েছে তাকে, সেটার জন্য দিনে সাতটার বেশি গোলা বরাদ্দ নয়। দিনে সাতটা গোলা যদি সে খরচ না করতে পারে, তাহলে এই বন্দুকের জন্য গোলার বরাদ্দ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। এদিকে আবার হাইডেসহাইমের দিকে যেসব আমেরিকানরা ঘাঁটি গেড়েছে, তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে যেতে হলে ওই সাতখানা গোলা যথেষ্ট নয়। ওদের দিকে একখানা গোলা ছুঁড়লে ওরা একশখানা ছুঁড়ে জবাব দেয়। সেইজন্য ওদের দিকে গোলা ছোঁড়া একেবারে বারণ শুধু নয়, একদম নিষিদ্ধ। কোনো মানে হয় না ওদের দিকে গোলা ছোঁড়ার।

শুধু গোলা ছোঁড়া নয়, ওদের বিষয়ে নোট নেবারও কোনো মানে হয় না। বের্শেম তার নোটবুকে লিখে রেখেছে … ‘সকাল ১০.৩০ হাইডেসহাইমের দিক থেকে একটা আমেরিকান গাড়ি এসে ভাইডেসহাইমের জ্যাম কারখানার প্রবেশদ্বারের লাগোয়া একটা বাড়ি অবধি এলো। জ্যাম কারখানার সামনে গাড়িটা পার্ক করে রাখা থাকছে। গাড়িটা ফিরছে ১১.১৫।’

এই গাড়িটা রোজ আসছে। বন্দুকের থেকে মাত্র দেড়শ মিটার দূরে দাঁড়াচ্ছে রোজ। বন্দুকের নাগালের দূরত্বের মধ্যেই। কিন্তু ওই গাড়িটাতে গোলা ছোঁড়া হয় না। এই যে এত কিছু বের্শেম লিখে রেখেছে তার নোটবুকে, সেটারও কোনো মানে হয় না। সব সময় ওই গাড়িটা থেকে একজন আমেরিকান সৈনিক নেমে এসে ওই বাড়িটায় ঢোকে। ঘণ্টাখানেক থাকে। তারপর ফিরে যায়।

(চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in







এগারো

(রবিবাবুর বিবাহ ও তার জীবনের কথা।)



রবিবাবু স্কুলের কাছে বিবেকানন্দ আশ্রমে যেতেন মাঝে মাঝে।সেখানে শুনতেন মহারাজের কথা।তিনি বলতেন,রামকৃষ্ণ দেব বলেছিলেন "তোদের চৈতন্য হোক" । আবার শ্রীচৈতন্য দেব ভক্ত দের নাম সংকীর্তনের মাধ্যমে নিজের ভক্তির অর্ঘ্য শ্রীহরির চরণে নিবেদন করতে বলেছেন । সহজ পথ তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন । তাঁদের দেখানো পথে যেতে পারলেই মন নিয়ন্ত্রিত হয়ে মৃত্যু ভয় দূর হয় ।জয় শ্রী গৌরাঙ্গ বলে ঝাঁপিয়ে পর মন , বাড়ির কাছেই পাবে শ্রী বৃন্দাবন । তবু বিষয় বিষে জর্জরিত মানুষ পার্থিব সুখ কে আঁকড়ে বাঁচতে চায় ।

মানুষের মন ও মৃত্যুচেতনা বিষয়ে অনেক বিচিত্র ধারণা প্রাচীন কাল থেকে মায়ার চাদরে আচ্ছাদিত ।আইনস্টাইন থ্রি ডাইমেনশন থেকে ফোর ডাইমেনশনে সময় যোগ করেছিলেন ।আমার মতো অর্বাচীন মন নিয়ে আপনাদের কতটুকু ধারণা দিতে পারি বন্ধু । তবু আমার মনে হয় ফাইভ ডাইমেনশনে মন যুক্ত হবে ।শিশুর সারল্যে মন যখন কোনো কিছু ভালোবাসে সেই ভালোবাসা স্থায়ী হয়ে মনের মণিকোঠায় আজীবন আনন্দের দামামা বাজিয়ে চলে । সাধক মানুষ সিদ্ধিলাভের পরে জীবনের পার্থিব চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে থাকে । কবিতা গান নাটক উপন্যাস সবকিছু এই বিচিত্র মনের সৃষ্টি ।বন পুড়লে দাবানল সৃষ্টি করে আর মন পুড়ে সৃষ্টি করে গান কবিতা ছবি । একটা কবিতা বা গান সুর তোলে মনের মণিকোঠায় । সকল দুঃখ বেদনা সারিয়ে তুলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায় ।মন আজীবন মানুষের অভিভাবক হয়ে নির্দেশ দেয় সু পথে চলার ।

মন বলবেই মৃত্যু কে সহজেই স্বীকার করার কথা । মৃত্যু কে রোধ করার চেষ্টা করলে জীবনের গতিপথ যে বন্ধ হয়ে যাবে ।মৃত্যু ই তো জীবনের স্বাদ অমৃতময় করে তোলে ।অতএব সুখ দুঃখ আলো অন্ধকার সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হোক ।

মহাজ্ঞানী বুদ্ধদেব সন্তান হারা মাতাকে মৃত্যু প্রবেশ করেনি এমন বাড়ি থেকে একমুঠো সরিষা আনতে বলেছিলেন ।তিনি কি আনতে পেরেছিলেন । তাই বন্ধুদের কবি অসীম সরকারের একটা গানের লাইন শোনাই, " ও মন সওদাগর বিদেশে বাণিজ্যে এসে কেন বাঁধলি বসতঘর ;দেশের মানুষ দেশেই ফিরে চল"...আপন দেশ শ্রীহরির পাদপদ্মে সমর্পিত হোক আমাদের জীবন । শ্রীহরি আমার অন্তরে চৈতন্যের জাগরণ করে দাও, আমার অহংকার কেড়ে নাও ,আমাকে তোমার চরণে ঠাঁই দাও, এই হোক আমাদের প্রার্থনা ।

রবিবাবু মন দিয়ে কথাগুলো শোনেন।তার খুব ভাল লাগে শ্রীরামকৃষ্ণের কথা শুনতে। সন্ধে হলে তিনি বাড়ি ফিরলেন,দেখলেন কয়েকজন অপরিচিত লোক এসেছেন।রবিবাবুর বাবা বললেন,তাহলে আমরা আগামীকাল মেয়ে দেখে আসব।ফাইনাল কথা কালকেই বলব।

রবিবাবুও সম্মত হলেন।মেয়ে পছন্দ হলে তিনমাস পরে বিয়ে হয়ে গেল।এখন রবিবাবু বিবাহিত।

আশ্রমে যাওয়া এখন কমে গেছে।এখন শুধু বাজার,বাড়ি আর স্কুল।তারপর দশবছরের মধ্যে রবিবাবুর বাবা,মা পরলোকে চলে গেলেন।তার দুই পুত্রসন্তান স্কুলে ভর্তি হল।সময় থেমে থাকে না।

অভয়বাবুর সংসার ও মশালে জগদ্ধাত্রী পুজো।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শ‍্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(১৪)

বিকালের সামান্য আগে রামমোহন গঙ্গার পাড়ে নিয়মিত একটু হাওয়া খেতে বের হন। সতীদাহ নিবারণের বিল সরকারীভাবে পাশ হয়ে গেলেও শহর কলকাতার হাওয়াটি এখনও বেশ গরম।

শোভাবাজারের রাধাকান্ত দেব দায়িত্ব নিয়ে এই বিষয়টি কেন্দ্র করে এখনও একটা ঘোঁট পাকাতে চেয়ে বাইরে থেকে সনাতনীদের অন্যায়ভাবে মদত দিচ্ছেন।আসলে নবদ্বীপ থেকে ভাটপাড়া অবধি অনেক কূলীন ও বহুবিবাহে অভ্যস্ত সব ব্রাহ্মণদের দল ওঁদের মত কিছু রসদদারদের কাছ থেকেই নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকে বলে স্বভাবতঃই ওরা নব্য বাবুদের কাছে বিচার চেয়ে পরিবেশটিকে অযথা অস্থির করে তুলেছে।

এসব দেখে মাঝেমাঝে রামমোহনের নিজের ওপরেই ভীষণ রাগ হয়। সেই মনখারাপের হতাশাময় সময়টাতে অন্তত নির্জন গঙ্গার ধার থেকে একটু ঘুরে আসলে ঠান্ডা হাওয়ায় মনটা শান্তি পায়।

মির্জাপুর থেকে বেড়িয়ে তিনি তাঁর ফিটনের কোচোয়ানটিকে নিমতলা ঘাটের দিকে গাড়িটি একবার ঘোরাতে বললেন।

যদিও শ্মশান সংলগ্ন ঘাটটিতে শবানুগমন করতে আসা শোকগ্রস্ত মানুষেরা ছাড়া বিশেষ কেউ আসেনা তাও এখানে দিনে একটিও চিতা জ্বলছে না সেটা অবশ্য আশা করা কঠিন। তবুও তিনি এদিকটাতে যে কারণে প্রায়সই এসে থাকেন তার একটি কারণ হল নিমতলার কাছেই " সম্বাদ কৌমুদী " এর একটি ছাপাখানা আছে।

কাল রাতে এখানে কারা যেন এখানে আগুন লাগাতে এসেছিল বলে তিনি শুনেছেন।

গত একটি বছরে সতীদাহের বিপক্ষে তাঁরই কিছু রচিত প্রবন্ধগুলি এই সংবাদপত্রে নিয়মিত ছাপা হওয়ায় এখন এরাও সনাতনপন্থীদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। তাই এইভাবে প্রতিশোধ নিয়ে সমাজপতিরা নিজেরা অন্তত শেষবার মাথা তুলে একবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

তিনি এগিয়ে এসে যা দেখতে পেলেন তাতে বুঝতে পারলেন যে খবরটি নিজে একজন ফড়ে মারফৎ হলেও যা পেয়েছেন তা একেবারে মিথ্যা নয়।

দেখতে পেলেন ছাপাখানাটির একটি দিক খুব বাজে ভাবে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও এখন অর্ধভস্মীভূত আবহটি জনশূন্য।

বোঝাই যাচ্ছে যে ছাপাখানার মালিক আর অন্য কর্মচারীরা সব গোলমাল বুঝে চম্পট দিয়েছে। স্বয়ং রামমোহনকে হঠাৎ এদিকপানে আসতে দেখে একরকম ভূতের মত চমকে উঠে তাঁর কাছে এসে দাঁড়াল কম্পোজিটার দুলু কুন্ডু নামের এক প্রবীণ কর্মচারী।

কাঁচা পাকা চুলের প্রায় তটস্থ লোকটি যে এখনও যে এখানকার আশ্রয় ছেড়ে পালায়নি এটাই বড় আশ্চর্যের বিষয়। এবার লোকটি ভয়ে ভয়ে তাঁকে বলল, " কি সব্বোনাশের কান্ড বলুন দিকি! যাক্ আপনি তাহলে একোনো বেঁচে আচেন! বড়তলার জমিদার বাবুদের পাইকের দল এসে রাতে আমাদের ছাপাখানাটির ওপর চড়াও হয়েছিল! একোন ওরা আপনাকে একেনে দেকতে পেলে আর রক্কে থাকবেনি। আপনি মানী মানুষ!তাও আপনি পার পেয়ে যাবেন! কিন্তু আমি আপনার সাথে কথা কইচি এটা জানতে পারলে ওরা আমাকেও পুড়িয়ে মারবে। এইইইই নিন্ সতেরোটা প্রভাকর এখনো বেঁচে আচে...এগুলো সাথে করে নিয়ে আপনিও পালান গ্যে ! দুগ্গা..দুগ্গা! "

লোকটির ভীত চেহারাটি দেখে রামমোহনের খুব মায়া হল। উনি তক্ষুণি জোব্বার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কিছু স্বর্ণমুদ্রা বের করে লোকটির হাতে দিয়ে বললেন,

- " আহা বেরাদর! এই কটি মুদ্রা আজ আপনি আপাতত নিজের কাছে গচ্ছিত রাখুন। নিশ্চিন্ত থাকুন কল্য এই প্রতিষ্ঠানটি আইনমোতাবেক আমি নিজেই ক্রয় করে নেব ও আপনাকে কর্মে পুনর্বহাল করবো। এই যুগান্তকারী লড়াইএর দিনে আসলে ছোট বড় সবাইকে সংহত হয়ে একসাথে সংগ্রাম করতে হয়। তাই আপনিও আজ আমার মত এই যুদ্ধে একজন সৈনিক হলেন। সতীদাহ বিরোধী আইন পাশ হওয়ার পরও এখন দেখছি আরএকটি অন্য লড়াইয়ের সূচনা হয়েছে। তবে আশ্বাস দিলাম যে এই নির্ভীক মানুষটি সেই কঠিনতম দিনেও আপনাদের সবার পাশে আছে ও থাকবেও। বিদায়...শুভমস্তু!.."

কর্মচারীটির বিস্মিত চক্ষুদ্বয় আরও বেশী বিস্ফারিত হতে হতেই রামমোহন নিজের কঠিন থেকে কঠিনতর মুখশ্রীতে মির্জাপুরস্থিত বাসাবাড়ির দিকে ওঁর ফিটনটিকে এবার প্রত্যাবর্তনের জন্য গম্ভীর স্বরে আদেশ দিলেন।

....

মিত্রবর দ্বারকানাথ ইংরেজ কোম্পানীর বড় হোমরাচোমড়া সব কর্তাদের নিমন্ত্রণ জানিয়ে আজ রাতে বেলগাছিয়ার ভিলায় একটি বর্ণাঢ্য খানাপিনার আয়োজন করে ওঁকেও সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেছে। সেখানে উপস্থিত থেকে এক ফাঁকে এই ভস্মপ্রায় প্রেসটিকে সত্বর কেনার ব্যাপারে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলোচনাটিও ওর সাথে সেরে ফেলতে হবে। এসব বাণিজ্যিক বিষয়ে দ্বারকনাথ বড় চৌখস।

তবে এ নিয়ে আর কোন সন্দেহ নেই যে এবারে তাঁকে আরও সংবেদী হয়ে মস্তিষ্কের লড়াইতে নামতে হবে ও দরকার হলে বিলেতে গিয়েও প্রিভি কাউন্সেলকে আরো কড়া ভাষায় সব উঠে আসা দেশীয় দ্বন্দ্বের সমূহ জবাবটি দিয়ে আসতে হবে।

......

গোলকপতি দেখল ঐ মৃতপ্রায় বৃদ্ধের সাথে আসা লোকজনেরা সব আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। বোঝা যাচ্ছে যে অন্তর্জলির সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা সঙ্গীদের মনে কিছুটা হলেও যেন বিরক্তির উদ্রেক ঘটিয়েছে।

এরমধ্যে মৃতপ্রায় বৃদ্ধটির দু'জন বলশালী পুত্রদের সাথে সম্ভাব্য শবদাহকারী ডোমেদের দুটি দিনের পারিশ্রমিক নিয়ে একপ্রস্থ বাদানুবাদ হয়ে গেল।

গোলকপতি দেখল যে এসবের ফাঁকে প্রস্তাবিত এই সতীদাহের জন্য আনা বধূটিও একবার তার শৌচকার্য্যটি আড়ালে সাড়ার জন্য সামনের ঝোপড়াটির উদ্দেশ্যে অনেকক্ষণ আগে যে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল, এখনও সেই মেয়েটি তার মৃতপ্রায় স্বামীটির শিয়রে ফিরে আসেনি। সেটা কিন্তু তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের কেউ সেইভাবে টেরও পায়নি। অবশ্য এর মধ্যেই কিছু মাতব্বর গোছের সদস্য তাদের দুটি আঙুলের ফাঁকে পোড়ামাটির কল্কে জ্বালিয়ে পরমানন্দে গঞ্জিকা সেবনে উদ্যত হয়েছে।

অবাক লাগে যে এই মৃতপ্রায় বৃদ্ধ মানুষটি সত্যিই মরণোন্মুখ ও অন্তর্জলিতে শেষতম শয়ানে মৃত্যুর প্রহর গুণছে তা যেন সঙ্গী সাথীর দল আজ ভুলতে চেয়ে খানিকক্ষণের জন্য নেশায় মৌজ হতে চাওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করছে।

.....

গোলকপতি যেন এইরকম একটি সুযোগের অপেক্ষাতেই সারাদিন ছিল। সে তার কাঁধের উড়নীটির সাহায্যে নিজের মুখখানিকে ঢেকে আর বাড়তি কথা না বাড়িয়ে নদীটির পূর্বদিকে ওই ঝোপড়াটির দিকে দ্রুত এগিয়ে গেল।

এখন ওরও যেন মনে হচ্ছে যে নিজের এই অনির্দিষ্ট জীবনপ্রবাহ যেন খুব দ্রুত শেষ হয়ে আসছে এক ক্রমপ্রসন্নতার সমারোহে।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১০

ছংগামল বিদ্যালয় ইন্টার কলেজ স্থাপিত হয়েছিল যে উদ্দেশ্য নিয়ে তা’হল ‘দেশের নবীন নাগরিকদের মহান আদর্শের পথনির্দেশ এবং উত্তম শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উত্থান’।

আপনি যদি চকচকে কাগজে কমলা রঙে ছাপা কলেজের ‘সংবিধান এবং নিয়মাবলী’ পড়েন তাহলে বাস্তব জগতের মলিনতায় আচ্ছন্ন আপনার মন সত্যি সত্যি নির্মল এবং পবিত্র হয়ে যাবে। অবশ্যি ভারতের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অধ্যায়টুকু পড়লেও আপনার একই অনুভূতি হয়।

যেহেতু এই কলেজ রাষ্ট্রহিতের কথা ভেবে তৈরি হয়েছে তাই এখানে আর কিছু হোক না হোক, দলাদলি খুব আছে। তবে দলাদলির আয়তন ও ওজন দেখলে মনে হবে এমন কিছু নয়, কিন্তু যে অল্প সময়ে এটি কলেবরে বেড়েছে তাতে বলা যায় যে হ্যাঁ, কিছু কাজ তো হয়েছে। দু’তিন বছরেই এটি দলাদলির ব্যাপারে আশেপাশের কলেজগুলোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। আর কোন কোন বিষয়ে তো অখিল ভারতীয় গালাগালিস্তরের কম্পিটিশন করার যোগ্যতা দেখিয়েছে।

ম্যানেজিং কমিটিতে বৈদ্যজীর দাপট, কিন্তু এর মধ্যেই রামাধীন ভীখমখেড়ভীজি তাঁর একটি উপদল বানিয়ে নিয়েছেন। এরজন্যে ওনাকে অনেক তপস্যা করতে হয়েছে। বেশকিছু দিন ওঁর দলে একজনই সদস্য ছিল—ভীখমখেড়ভীজি উনি স্বয়ং। পরে একজন দুজন ওঁর দলে চলে গেল। এরপর কড়া মেহনতের ফলে কলেজের কর্মচারিদের মধ্যেও দু’দল তৈরি করা গেছে বটে, কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি। প্রিন্সিপাল সাহেব বৈদ্যজীর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল, কিন্তু উল্টোদিকে খান্না মাস্টার এখনও রামাধীনের দিকে ততটা হেলে পড়েনি। ছাত্রদের মধ্যেও কোন দলবিশেষের প্রতি নিষ্ঠার ভিত্তিতে স্পষ্ট ভাগাভাগি হয়নি। মাঝেমধ্যে গালাগালি মারপিট হচ্ছে বটে কিন্তু এখনও ওদের ঠিকমত পথ দেখানো যায়নি। এখনও কলেজের কাজকম্ম দলীয় উদ্দেশ্যে নাহয়ে ব্যক্তিগত যোগাযোগে হচ্ছিল, তাই ছেলেপুলের গুন্ডামির শক্তিও রাষ্ট্রের সার্বজনিক হিতের বদলে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছিল। এ’বিষয়েও দলাদলির রাজনীতির অনেক কাজ করার আছে।

এটা সত্যি যে কলেজে বৈদ্যজীকে ছেড়ে আর কারও দলাদলির বিশেষ অভিজ্ঞতা নেই।অন্যেরা কাঁচা খেলুড়ে, কিন্তু প্রতিভায় কম যায় না।বছরে দু’একবার ওদের প্রতিভার ছটা যখন ঝিকিয়ে ওঠে তখন তার যেইতরঙ্গ শহর অব্দি পৌঁছে যায়। এখানে কখনও কখনও এমন সব দাঁও-প্যাঁচ দেখা যায় যে দলাদলির বড় বড় অভিজ্ঞ খেলুড়েও হতভম্ব হয়ে যায়। গত বছর রামাধীন বৈদ্যজীকে এমনই এক প্যাঁচে ফেলেছিলেন। প্যাঁচ ব্যর্থ হল, কিন্তু তার চর্চা দূরে-দূরান্তরে ছড়িয়ে গেল।খবরের কাগজে এ’নিয়ে লেখা হল। তাতে একজন দলবাজির খেলুড়ে এমন অভিভুত হলে যে শহর থেকে দৌড়ে এসে দুটো দলেরই পি্ঠ চাপড়ে দিলেন। উনি ছিলেন একজন সিনিয়র খেলুড়ে, থাকতেন রাজধানীতেই। ওঁর জীবনের বিগত চল্লিশটি বছর উনি চব্বিশ ঘন্টা দলাদলিতেই মজে থাকতেন।উনি অখিল ভারতীয় স্তরের একজন নেতা এবং প্রতিদিন খবরের কাগজে ওঁর কোন না কোন বিষয়ে বিবৃতি বেরোয়। তাতে থাকে দেশপ্রেম এবং দলাদলির অদ্ভুত খিচুড়ি। উনি একবার কলেজে পায়ের ধূলো দিতেই লোকের ভরসা হল যে এখানে কলেজ বন্ধ হয়ে গেলেও দলাদলি বন্ধ হবে না। কথা হচ্ছে -দলাদলি কেন হল?

এই প্রশ্ন করা আর বৃষ্টি কেন হয়, সত্যি কথা কেন বলা উচিত, বস্তু কী অথবা ঈশ্বর কী জানতে চাওয়া- একই ব্যাপার। আসলে এটি একটি সামাজিক, মনোবৈজ্ঞানিক এবং প্রায় দার্শনিক প্রশ্ন। এর উত্তর পেতে গেলে আপনাকে আগে দর্শন বুঝতে হবে এবং দর্শন-শাস্ত্র জানার জন্যে আপনাকে প্রথমে হিন্দী সাহিত্যের কবি বা গদ্যলেখক হতে হবে।

সবাই জানে যে আমাদের কবি এবং গদ্যলেখকেরা আসলে এক একজন দার্শনিক। ওঁরা কবিতা এবং গদ্য লেখেন ফাউ হিসেবে। যেকোন ঘ্যানঘেনে উপন্যাস খুলে পাতা ওল্টালে দেখা যাবে যে নায়ক নায়িকার তপ্ত অধরে অধর রেখে বলছে—না, নিশা না। আমি এটা মানতে পারিনা। এ তোমার একান্ত ব্যক্তিগত সত্য হতে পারে, কিন্তু আমার সত্য নয়’।

ইতিমধ্যে নিশার ব্লাউজ মাটিতে লুটোচ্ছে।ও অস্ফুট স্বরে বলে, ‘কেন নিক্কু, তোমার সত্য আমার সত্যের থেকে আলাদা কেন’?

এটাকেই বলে ‘টাচ্‌’। এভাবেই নিশা ও নিক্কু’র হাজার মিটার দৌড় শুরু হয়। এবার নিশার ব্রা খসে গিয়ে মাটিতে লুটোয় এবং নিক্কু’র টাই ও শার্ট হাওয়ায় উড়ে যায়। এভাবে হোঁচট খেয়ে, একে অন্যের উপর হুমড়ি খেয়ে যখন মাঠের অন্য প্রান্তে টাঙানো ফিতেটাকে অবশেষে ‘সত্য’ ভেবে ছুঁয়ে ফেলে, তখন টের পায়—ওটা ‘সত্য’ নয়। ফের যুক্ত হওয়ার শৃংগার, তপ্ত অধর ইত্যাদি। কিছুক্ষণ পরে ওরা মাঠ ছাড়িয়ে জঙ্গলে পৌঁছে যায় এবং পাথরে ও কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে নগ্ন শরীরে প্রতিটি ঝোপে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়। এভাবে নগ্নতা, ঘ্যানঘ্যান, চুম্বন, লেকচার ইত্যাদির ভেতরে ওরা খুঁজে বেড়ায় এক খরগোসকে যার নাম ‘সত্য’।

এ’জাতীয় ফিলজফি প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাব্য ও কাহিনীতে রয়েছে। এ জন্যেই উপন্যাসটির পাঠক ফিলজফির ঝটকার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ভাবে—হিন্দিসাহিত্যের লেখকটি এতক্ষণ ধরে দুনিয়াভরের কথা বলে গেলেন কিন্তু ফিলজফি কোথায়? ব্যাপারটা কী? ব্যাটা ফ্রড নয়তো?

এটাও সত্যি যে ‘সত্য’ ‘অস্তিত্ব’ গোছের শব্দ শোনামাত্র আমাদের লেখক চেঁচিয়ে ওঠেন-“ শোন ভাইসকল, এখন গল্পের স্রোতকে এখানে থামিয়ে দিয়ে আমি তোমাদের খানিক ফিলজফি পড়াব, তবে তো বিশ্বাস হবে যে আমি আসলে ফিলজফার, ভাগ্যের ফেরে অল্পবয়েসে কুসঙ্গের প্রভাবে কবিতা লিখতাম।অতএব ভাইয়েরা, এই নাও এক ষোল পাতার ফিলজফির শক্‌।যদি আমার লেখা পড়তে পড়তে তোমাদের ভ্রম হয়ে থাকে যে অন্যদের মত ফিলজফি আমার ধাতে নেই, তাহলে সেটাকে এই নতুন ভ্রম দিয়ে খারিজ কর—‘।



বৈদ্যজী বেদান্ত দর্শনকে প্রায় সময় আয়ুর্বেদের চ্যাপ্টার বানিয়ে ফেলেন। ওঁর ভাষ্য অনুযায়ী দলাদলি হল পরমাত্মানুভুতির চরমদশারই আরেক নাম। তখন প্রত্যেক ‘ত্বম’ ‘অহম’কে, এবং প্রত্যেক ‘অহম’ সমস্ত ‘ত্বম’কে নিজের চেয়ে উচ্চতর আসনে অধিষ্ঠিত দেখে এবং নিজে সেখানে পৌঁছতে চায়। অর্থাৎ সমস্ত ‘ত্বম’ যত ‘অহম’ আছে তাদের নিজের জায়গায় টেনে নামিয়ে নিজেরা সবাই ‘অহম’ হতে চায়।

বেদান্ত হল আমাদের ঐতিহ্য, আর যেহেতু দলাদলির তাৎপর্য্য বেদান্তে খুঁজে পাওয়া যায়, তাই দলাদলিও আমাদের শাশ্বত, এবং এই দুয়ে মি্লেই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। স্বাধীনতার পর আমরা এমন অনেক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য খুঁজে বের করেছি। হাওয়াই জাহাজে চেপে ইউরোপ যাওয়ার সময়েও আমরা যাত্রার প্রোগ্রাম জ্যোতিষীকে দিয়ে বানিয়ে নিই, ফোরেন এক্সচেঞ্জ এবং ইনকাম ট্যাক্সের ঝঞ্ঝাট থেকে বাঁচতে বাবাজীর আশীর্বাদ নিই, স্কচ হুইস্কি খেয়ে ভগন্দর গজিয়ে গেলে চিকিৎসার জন্যে যোগাশ্রমে গিয়ে শ্বাস ফুলিয়ে পেট ভেতরে টেনে আসন করি। এভাবেই বিলিতি শিক্ষার দান গণতন্ত্র আমদানি করি, কিন্তু তার প্রয়োগ করি দিশি ঐতিহ্যের দলাদলি করে। আমাদের ইতিহাসের পাতা উলটে্ দেখুন, যুদ্ধপর্ব হোক কি শান্তিপর্ব, সব অবস্থাতেই দলাদলির ঐতিহ্য জ্বলজ্বল করছে।ইংরেজ রাজত্বের সময় ওদের খেদিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে কিছুদিন ভুলে ছিলাম বটে, স্বাধীন হতেই আরও অনেক ঐতিহ্যের সাথে একেও আমরা মাথায় তুলে নিয়েছি।এখন দলাদলির প্রগতির জন্যে আমরা অনেকগুলো পদ্ধতির সাহায্য নিচ্ছি-- যেমন ‘তুই বেড়াল না মুই বেড়াল’, লাথালাথি, জুতোপেটা, সাহিত্য-শিল্প কোনটাই বাদ পড়েনি। যে দেশ একসময় বেদান্তের জন্ম দিয়েছে আজ তারই এই প্রাপ্তি। সংক্ষেপে এই হল দলাদলির দর্শন, ইতিহাস ও ভূগোল।

ছংগামল কলেজে দলাদলির জন্যে এই সব আদিকারণ ছাড়াও অন্য একটি কারণ দায়ি। এখানকার লোকেদের ভাবনা হল সবসময় কিছু-না-কিছু হওয়া চাই। দেখুন, এখানে সিনেমা নেই, হোটেল নেই, কফি হাউস নেই, মারপিট, চাকুবাজি, পথদুর্ঘটনা, নিত্যি নতুন ফ্যাশনের মেয়েরা, এগজিবিশন, গরম গরম এবং গালাগালি ভরা সার্বজনিক সভাসমিতি—এসব কিস্যু নেই। লোকজন কোথায় যাবে? কী দেখবে? কী শুনবে? তাই কিছু-না-কিছু হওয়া চাই।

দিন চারেক আগে কলেজে একটা প্রেমপত্র পাওয়া গেল। একটি ছেলে লিখেছে কোন মেয়েকে। ছেলেটা চালাকি করে এমন ভাবে লিখেছে যে পড়লে মনে হবে আসলে মেয়েটির চিঠিতে লেখা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। কিন্তু এই চাল কাজে এল না। ছেলেটা বকুনি খেল, মার খেল, কলেজ থেকে বের করে দেয়া হল। তারপর ছেলের বাপ কথা দিল যে ওর ছেলে দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়বে না, এবং আরও কথা দিল যে কলেজের নতুন ব্লক তৈরির জন্যে পঁচিশ হাজার ইঁট দেবে। ব্যস, ছেলেটা ফের ভর্তি হয়ে গেল। যাই ঘটুক, এর প্রভাব কুল্লে চার দিন, তার বেশি নয়। এর আগে একটা ছেলের কাছে দেশি পিস্তল পাওয়া গেছল। তাতে কোন কার্তুজ ছিলনা এবং পিস্তলটা এত ফালতু যে দেশি কামারদের কারিগরি দক্ষতা্র কথা ভেবে চোখে জল এসে যায়। তবু কলেজে পুলিস এল এবং ছেলেটাকে ও ক্লার্ককে ধরে থানায় নিয়ে গেল- যদিও ক্লার্ক হলেন বৈদ্যজীর লোক। লোকজন উত্তেজনায় ছটফট করছিল -কিছু হবে, এবার চার-পাঁচ দিন ধরে কিছু না কিছু ঘটবে।কিন্তু সন্ধ্যে নাগাদ খবর এল যে ওটা পিস্তল না, একটা ছোটমত লোহার টুকরো । আর ক্লার্ককে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়নি, উনি নিজের ইচ্ছেয় বেড়াতে গেছলেন। এবং ছেলেটা গুন্ডামি করছিল না, বরং সুন্দর বাঁশি বাজাচ্ছিল। সন্ধ্যে নাগাদ যেই ছেলেটা বাঁশি বাজাতে বাজাতে এবং ক্লার্ক মশায় বেড়াতে বেড়াতে থানার বাইরে এলেন মানুষজন হতাশ হয়ে ভাবল—তাহলে কিছুই হয়নি। এর পর হাওয়ায় ভেসে এল সেই শাশ্বত প্রশ্ন- এবার কী হবে?

এই পরিবেশে লোকজনের নজর ছিল প্রিন্সিপাল সাহেব আর বৈদ্যজীর উপর। বৈদ্যজী তো মদনমোহন মালবীয় স্টাইলের পাগড়ি চাপিয়ে নিজের গদিতে গ্যাঁট হয়ে বসেছিলেন। কিন্তু প্রিন্সিপালকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন উনি সরসরিয়ে ল্যাম্পপোস্টের মাথায় চড়ে দুর থেকে কাউকে দেখে চেঁচাচ্ছেন- ‘দেখো, দেখো, ব্যাটার মাথায় কোন শয়তানি বুদ্ধি ঘুরছে’! ওঁর দৃষ্টিতে সন্দেহভরা, আসলে নিজের চেয়ার আঁকড়ে থাকা সবার মনেই ভয় যে কেউ না কেউ এসে ওকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে দেবে। লোকেরা এঁর দুর্বল জায়গাটা ধরে ফেলেছে এবং সেখানে খুঁচিয়ে ওনাকে এবং তার সঙ্গে বৈদ্যজীকে প্যাঁচে ফেলার তাল করছে।এদিকে এরাও মার খাবার ভয়ে আগে থেকেই মারার জন্যে মুখিয়ে রয়েছে।

ক’দিন আগে খান্না মাস্টারকে কেউ ফুসমন্তর দিয়েছে যে সব কলেজেই প্রিন্সিপালের সঙ্গে একটা ভাইস প্রিন্সিপালেরও পোস্ট থাকে। খান্না পড়াতেন ইতিহাস এবং সব থেকে সিনিয়র। সেই গুমরে একদিন বৈদ্যজীকে গিয়ে বলে এলেন যে ওনাকে ভাইস প্রিন্সিপাল বানিয়ে দেয়া হোক। বৈদ্যজী মাথা নেড়ে সায় দিলেন। বললেন- এ তো বেশ নতুন কথা। নবযুবকদের সবসময় নতুন নতুন চিন্তা করা উচিৎ। আমি সবরকম নতুন আইডিয়াকে উৎসাহ দিই। তবে এটা তো পরিচালক সমিতির এক্তিয়ারে। ওদের আগামী বৈঠকে এই প্রশ্নটি উঠলে আমি সমুচিত বিচার করব, কথা দিলাম। খান্না মাস্টার ভাবেননি যে পরিচালন সমিতির আগামী বৈঠক কখনও হয় না। উনি বার খেয়ে সাততাড়াতাড়ি ভাইস প্রিন্সিপাল পদে নিযুক্তির আবেদন বাবদ একটি দরখাস্ত মুসাবিদা করে প্রিন্সিপালকে ধরিয়ে দিয়ে অনুরোধ করলেন যেন পরিচালক সমিতির আগামী বৈঠকে এটি পেশ করা হয়।

খান্না মাস্টারের এই কারসাজিতে প্রিন্সিপাল হতভম্ব। বৈদ্যজীকে শুধোলেন- খান্না মাস্টারকে এই দরখাস্তটা লিখতে আপনি পরামর্শ দিয়েছেন?

এর জবাবে বৈদ্যজী তিনটে শব্দ উচ্চারণ করলেন- ওর বয়েসটা কম।

প্রিন্সিপাল ইদানীং শিবপালগঞ্জের রাস্তায় যার সঙ্গে দেখা হয় তাকেই ধরে অ্যান্থ্রোপলজি বোঝাতে থাকেন-‘সত্যি, আজকাল লোকজন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে’। খান্না মাস্টারের কারসাজির কথা বোঝাতে গিয়ে উনি হরদম কিছু প্রবাদবাক্যের ব্যবহার করছিলেন; যেমন ‘মুখে রামনাম, বগলে ছুরি’,’ আমার পোষা বেড়াল, আমাকেই খ্যাঁক খ্যাঁক’(যদিও বেড়াল কদাপি খ্যাঁক খ্যাঁক করে না),’পেছন থেকে ছুরি মারা’,’ব্যাঙের সর্দি’ এইসব। একদিন উনি গাঁয়ের চৌমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে রূপকথা বলার ঢঙে শুরু করলেন- একদিন এক ঘোড়ার খুরে নাল লাগানো হচ্ছিল। তাই দেখে কোলাব্যাঙের শখ হল—আমিই বা বাদ যাই কেন!অনেক কাকুতিমিনতির পর নাল লাগানোর লোকটি ব্যাঙের পায়ে একটা নাল ঠুকে দিল। তো ব্যাঙবাবাজি ওখানেই চিতপটাং ! তাই বলছিলাম, নকল করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

এই পঞ্চতন্ত্র রচনার পেছনেও সেই একই গল্প। আজ ভাইস প্রিন্সিপাল হতে চাইছে, কাল প্রিন্সিপাল হতে আবদার করবে। তার জন্যে পরিচালন সমিতির মেম্বারদের হাত করবে। মাস্টারদের মধ্যে নিজের একটা দল বানাবে। ছাত্রদের মারপিট করতে উসকে দেবে। উপর মহলে নালিশ করবে। ব্যাটা বজ্জাত হাড় বজ্জাত হবে।

বড় বড় কথা ভেতর-ফাঁকা,

শাক দিয়ে মাছ যায় কি ঢাকা!

বৈদ্যজীর কাছে রামাধীন ভীখমখেড়ভীজির চিঠি এসেছে। লেটারহেডের মোনোগ্রামের জায়গায় রয়েছে ওই দ্বিপদীটি। চিঠির সারমর্ম হল- গত তিনবছরে একবারও পরিচালক সমিতির বৈঠক হয়নি, আগামী দশদিনের মধ্যে বৈঠকটি ডাকা হোক। আর কলেজের সাধারণ সমিতির বার্ষিক সভা কলেজ শুরু হওয়ার দিন থেকে একবারও হয়নি। সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যাক। চিঠিতে এজেন্ডা আইটেমের মধ্যে ভাইস প্রিন্সিপাল পদ শুরু করার প্রস্তাবও রয়েছে।

প্রিন্সিপাল সাহেব বৈদ্যজীর ঘর থেকে ফিরে আসার সময় চিঠিটি নিজের পকেটে ঢোকাতেই হঠাৎ বড্ড গরম গরম লাগল।মনে হোল গায়ের জামাটা পুড়ে যাচ্ছে এবং চারপাশ থেকে আগুনের হলকা আসছে। একটা হলকার চোটে কোটটা জ্বলতে শুরু করেছে, আরেকটা হলকা শার্টের ভেতর থেকে নীচের দিকে বইতে বইতে প্যান্টের ভেতরে নামছে। এরকম বোধ হতেই ওঁর চলার বেগ বেড়ে গেল। হলকার তৃতীয় ধারাটি ওঁর চোখ কান নাকে লাল লাল চিহ্ন ছড়িয়ে মাথার খুলির সেই কোটরে ঢুকে গেল যেখানে বুদ্ধিশুদ্ধি থাকে।

কলেজের গেটের কাছে ওঁর রূপ্পন বাবুর সঙ্গে দেখা হল। উনি রূপ্পনের পথ আটকে বোঝাতে শুরু করলেন—’ দেখছ তো? খান্না এবার রামাধীনের খুঁটি ধরেছে। ভাইস প্রিন্সিপালগিরির শখ চড়েছে। শোন, একবার এক কোলাব্যাঙ দেখল কি ঘোড়ার পায়ে নাল লাগানো হচ্ছে, তখন ও ভাবল-’।

কিন্তু রূপ্পনবাবুর একটু তাড়া ছিল। কলেজ পর্ব সেরে অন্য কোোঁথাও যাচ্ছিলেন।বললেন,’ হ্যাঁ, জানি তো।আর ব্যাঙের গল্পটা সবাই জানে। তবে আপনাকে একটা কথা স্পষ্টাস্পষ্টি বলে দিচ্ছি। খান্নার জন্যে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু মনে হয়, কলেজে একজন ভাইস প্রিন্সিপাল হওয়া জরুরি। আপনি না থাকলে এখানকার মাস্টারগুলো কুকুরবেড়ালের মত খেয়োখেয়ি করতে থাকে। টিচার্স রুমে যা গুন্ডামি হয় তা আর কহতব্য নয়। ওই হ্যা-হ্যা, ঠ্যাঁ-ঠ্যাঁ, ফ্যাঁস-ফ্যাঁস’! এবার রূপ্পন একটু গম্ভীর হয়ে প্রায় আদেশের সুরে বললেন-‘প্রিন্সিপাল সা’ব! আমার মনে হয় আমাদের কলেজে একজন ভাইস প্রিন্সিপাল দরকার। খান্না সবচেয়ে সিনিয়র, ওকেই হ’তে দিন। সেরেফ নাম-কা-ওয়াস্তে, মাইনে তো বাড়বে না’।

প্রিন্সিপাল সাহেবের বুকের ভেতর এত জোরে ধক্‌ করে উঠল যেন লাফিয়ে ফুসফুসে ঢুকে পড়বে। “ভুলেও অমন কথা মুখে এনো না রূপ্পন বাবু! এই খান্না-টান্না বলে বেড়াচ্ছে যে তুমি নাকি ওদের সঙ্গে রয়েছ! এটা শিবপালগঞ্জ; ইয়ার্কি করলেও একটু ভেবেচিন্তে মুখ খুলতে হয়’।

“আমি যেটা উচিৎ সেটাই বলি। যাই হোক, পরে দেখা যাবে’খন”। বলতে বলতে রূপ্পনবাবু এগিয়ে গেলেন।

প্রিন্সিপাল সাহেব হড়বড়িয়ে নিজের কামরার ঢুকলেন। বেশ ঠান্ডা পড়েছে, কিন্তু উনি কোট খুলে ফেললেন। লেখাপড়ার সামগ্রী সাপ্লাইয়ের কোন দোকানের একটা ক্যালেন্ডার ঠিক ওঁর নাক বরাবর সামনের দেয়ালে টাঙানো রয়েছে। তাতে নগ্নবদন স্বচ্ছবসনা এক ফিলিম- অ্যাকট্রেস জনৈক পুরুষকে একটি লাড্ডুমতন কিছু নিবেদন করছে। পুরুষটির লম্বা লম্বা চুল, এক তুলে চোখ ঢাকার ভান করে এমন মুখভঙ্গী করছে যেন ঐ লাড্ডুটি খেলে ওর বদহজম হবে। এরা মেনকা ও বিশ্বামিত্র। খান্নাকে

প্রিন্সিপাল খানিকক্ষণ অপলক এদের দেখতে লাগলেন।হঠাৎ কলিংবেল না বাজিয়ে চেঁচিয়ে চাপরাশিকে ডাকলেন। ও এলে পরে বললেন-যাও, খান্নাকে ডেকে আন।

চাপরাশি রহস্যময় ঢঙে বলল, ‘ফিল্ডের দিকে গেছে। সঙ্গে মালবীয়জি’।

প্রিন্সিপাল চিড়বিড়িয়ে টেবিলের উপর রাখা কলমদানটাকে এক ধাক্কা মেরে আরেক মাথায় পাঠালেন। এই কলমদানটা কোন এডুকেশনাল এম্পোরিয়াম থেকে স্যাম্পল দিয়ে গেছল।কিন্তু প্রিন্সিপাল ওটাকে যেভাবে দুর দুর করলেন তাতে মনে হতে পারে এ’বছর এম্পোরিয়ামটা থেকে কলেজ কোন জিনিসপত্র কিনবে না।কিন্তু সেটা প্রিন্সিপালের উদ্দেশ্য ছিল না। উনি শুধু চাপরাশিকে এই মেসেজ দিতে চাইছিলেন যে এখন উনি চাপরাশির গুপ্তচরগিরির গোপন রিপোর্ট শুনতে উৎসুক নন। তাই উনি কড়া করে বললেন-আমি বলছি, খান্নাকে এক্ষুণি ডেকে আন।

চাপরাশির পরনে ধবধবে পাঞ্জাবি ও সাফসুতরো ধুতি, পায়ে খড়ম এবং কপালে তিলক। ও শান্তভাবে বলল,’ যাচ্ছি; ডেকে আনছি খান্নাকে। এত রেগে যাও কেন’?

প্রিন্সিপাল দাঁত কিটকিটিয়ে টেবিলের উপর রাখা একটি টিনের টুকরোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। টুকরোটাকে পালিশ করে একটা লালরঙা গোলাপ বানিয়ে দেয়া হয়েছে।পন্ডিত নেহেরুর পছন্দের গোলাপ, নীচে জুড়ে দেয়া হয়েছে দিন-তারিখ-মাস দেখার ক্যালেন্ডার। এটা বানিয়েছে একটি বিখ্যাত মদের কোম্পানি। এই ক্যালেন্ডারটি চারদিকে বিনে পয়সায় উপহার দেয়া হচ্ছে এই ভরসায় যে লোকে পন্ডিত নেহেরুর আদর্শের সঙ্গে এই শরাব কোম্পানিকেও মনে রাখবে। কিন্তু এখন এই ক্যালেন্ডারটি দেখে প্রিন্সিপাল সাহেবের মনে কোন প্রতিক্রিয়া হল না।পন্ডিত নেহেরুর গোলাপ ওঁর মনের ভার কমাতে পারেনি, আর ফেনিল বীয়রের গ্লাস কল্পনা করেও কোন উৎসাহ কোন উদ্দীপনা এলনা। উনি দাঁত পিসতে লাগলেন, পিসেই চললেন। হঠাৎ, চাপরাশির খড়মের আওয়াজ খালি চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে গেছে কি উনি হিসহিসিয়ে উঠলেন,’রামাধীন ওকে ভাইস প্রিন্সিপাল করে দেবে?ছ্যাঁচড় কোথাকার’! চাপরাশি ঘুরে দাঁড়াল। দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া আওয়াজে বলল,‘গালি দিচ্ছেন প্রিন্সিপাল সাহেব’’'?

--‘ঠিক আছে, ঠিক আছে; যাও, নিজের কাজে যাও’।

-- নিজের কাজই তো করছিলাম। আপনি বারণ করলে আর করছি না’।

প্রিন্সিপালের কপালে ভাঁজ পড়ল। উনি উলটো দেয়ালে আরেকটা ক্যালেন্ডারের দিকে মন দিলেন।চাপরাশি একইভাবে বলে চলল, ‘বলেন তোঁ খান্নাকে চোখে চোখে রাখা বন্ধ করে দিই’?

প্রিন্সিপালের মেজাজ চড়ে গেল, ‘চুলোয় যাও’!

চাপরাশি তেমনই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে।ডাঁটের মাথায় বলল,’ আমাকে খান্না-টান্না ভাববেন না যেন!চব্বিশ ঘন্টা খাটিয়ে নিন, পুষিয়ে যাবে। কিন্তু এই আবে-তাবে, তুইতোকারি একদম বরদাস্ত হয় না’।

প্রিন্সিপাল অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। চাপরাশি ফের বলল,’ শুনুন,আপনি বামুন তোঁ আমিও বামুন।নুন দিয়ে নুন কাটা যায় না, বলে দিলাম’।

প্রিন্সিপাল নরম পড়ে গেলেন।‘তোমার ভুল হয়েছে। তোমাকে না, খান্নাকে ছ্যাঁচড় বলেছি, মহা ছ্যাঁচড়! রামাধীনের সঙ্গে মিলে মিটিং ডাকার নোটিশ পাঠায়’? গালিটা যে খান্নাকে দেয়া সেটা বিশ্বাস করানোর উদ্দেশ ফের বললেন,’ছ্যাঁচড় কোথাকার’!

‘এখখুনি ডেকে আনছি’, চাপরাশিও নরম হল। খড়মের খট খট আওয়াজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। প্রিন্সিপালের চোখ এবার তৃতীয় এক ক্যালেন্ডারে আটকে গেছে। ওতে পাঁচ বছুরে দুটো বাচ্চা ইয়াবড় সব রাইফেল নিয়ে বরফের ওপর শুয়ে আছে। বোধহয় চীনে সৈন্যের অপেক্ষায়। এভাবে বড় শিল্পসম্মত ভাবে বিজ্ঞাপন করা হচ্ছে যে ওই কোম্পানিটির চটের ব্যাগ সবচেয়ে ভাল।

প্রিন্সিপাল ওই ক্যালেন্ডারটা দেখতে দেখতে ভাবছিলেন যে খান্নার ভাইস প্রিন্সিপালগিরির শখ না চাগিয়ে উঠলে জীবন কত সুন্দর হত।উনি ভুলে গেলেন যে সবারই কিছু-না-কিছু শখ থাকে। রামাধীন ভীখমখেড়ভীর শখ চিঠির গোড়ায় দু’লাইন উর্দু কবিতা লেখা। প্রিন্সিপালের নিজের শখ হোল অফিসের দেয়ালে নিত্যনতুন রঙীন ক্যলেন্ডার টাঙিয়ে রাখা। তেমনই চাপরাশির শখ হোল বুক চিতিয়ে বড় বড় কথা বলার। ক্লার্কের মতই ও বৈদ্যজীর দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয় যে!

প্রিন্সিপাল খান্না মাস্টারের আশার প্রতীক্ষায়। এরপর যা হবে তাকে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই দেবার প্রচেষ্টায় বারান্দায় ক্লার্ক সাহেব আড়ি পেতেছেন।দেয়ালের পেছনে জানলার ঠিক নীচে ড্রিল মাস্টার মৌজুদ। উনি পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করার বদলে বিড়ি ধরাতে ব্যস্ত। না, এরপর আর খান্না-প্রিন্সিপাল সংবাদের জনতার দরবারে পৌঁছনর আগে উপে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা রইলনা।

রাত্তিরে রঙ্গনাথ আর বদ্রী ছাতের কামরায় খাটিয়ায় গড়াতে গড়াতে এতোল বেতোল কথা শুরু করেছে। রঙ্গনাথ কথা শেষ করতে করতে বলল,’ খান্না আর প্রিন্সিপালের মধ্যে কী কথা হয়েছিল সেটা জানা যায়নি। ড্রিল মাস্টার জানলার নীচেই ছিল। খান্না চেঁচাচ্ছিল,”এই আপনার মনুষ্যত্ব”? ব্যস, ওইটুকুই শুনতে পেয়েছে’।

বদ্রীর হাঁই উঠছিল। বলল,’ প্রিন্সিপাল গালি দিয়ে থাকবে। জবাবে খান্না মনুষ্যত্ব -টত্ব বলে থাকবে। ও এভাবেই কথা বলে। শালা একনম্বরের বাঙরু’!

রঙ্গনাথ বলল।‘গালির জবাব তো জুতা’।

বদ্রী এর কোন উত্তর না দেওয়ায় ও ফের বলল,’ দেখছি- এখানে মনুষ্যত্বের কথা বলাই বেকার’।

বদ্রী ঘুমুবে বলে পাশ ফিরলো। তারপর গুড নাইট বলার স্টাইলে বলল,’ সে তো বুঝলাম। এখানে যে দুটো ক-খ-গ-ঘ পড়ে ফেলে সেই উর্দূ ঝাড়তে শুরু করে।কথায় কথায় খালি মনুষ্যত্ব-মনুষ্যত্ব!গলায় জোর না থাকলে সবাই মনুষ্যত্বের দোহাই দেয়’।

কথাটা ঠিক। শিবপালগঞ্জে আজকাল ‘মনুষ্যত্ব’এরই বাজার। দুকুরবেলা আমবনের ছায়ায় ছোঁড়াগুলো জুয়ো খেলে। যার জেতার সে জেতে, যে হারে সে চেঁচায়-এই বুঝি তোর মনুষ্যত্ব! জিততেই পেচ্ছাব চাগিয়ে উঠেছে? খালি ফোঁটা ফোঁটা টপকানোর অজুহাত খুঁজছিস?

আবার জেতাপার্টিও কখনও কখনও ‘মনুষ্যত্ব’ নিয়ে হামলে পড়ে। ‘একেই বলে মনুষ্যত্ব? এক বাজি হারতেই পিলপিলিয়ে গেলি? চারদিন ধরে খেলছি, আজ প্রথমবার দাঁও লাগল তো আমার পেশাব বন্ধ করিয়ে দিবি”?

তাড়ির দোকানে মজদুরের দল ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় দোলাতে থাকে। ১৯৬২তে চীনের অপ্রত্যাশিত বিশ্বাসঘাতকতায় যেমন ঝটকা লেগেছিল, প্রায় তেমনি হাবভাব করে বলতে থাকে,’বুধুয়া পাকা মকান বানিয়েছে রে! আজকাল কারখানাওলাদের দিন। বললাম, বাড়িতে অতিথি এসেছে, তাড়ি কেনার জন্যে দুটো টাকা দে। ব্যাটা সোজাসুজি হ্যাঁ-না করে পেছন ফিরে পাছা দেখিয়ে চলে গেল। এই কি মনুষ্যত্ব? নাগেশ্বর, তুমিই বল’।

অর্থাৎ রাজনীতিতে যেমন ‘নীতিবোধ’কে ধরা হয় তেমনই, ‘মনুষ্যত্ব’ শব্দটা শিবপালগঞ্জে চৌকস ও চালাক লোকদের লক্ষণ। তবে বদ্রী পালোয়ানের চোখে এটা গলার জোরের অভাব ছাড়া কিছু নয়। এইসব বকবক করতে করতে নৈতিকতা ব্যাপারটা রঙ্গনাথের ঘাড়ে চাপিয়ে বদ্রী ঘুমিয়ে পড়ল।

রঙ্গনাথ কম্বল জড়িয়ে শুয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আকাশপাতাল ভাবছিল।ছাদের দরজাটা খোলা, বাইরে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। খানিকক্ষণ ও সোফিয়া লোরেন এবং এলিজাবেথ টেলরের ধ্যান করল। তারপর মনে হোল এসব ক্যারেক্টার খারাপ হওয়ার লক্ষণ।তাই ও পাড়ার ধোপার মেয়ের ধ্যান শুরু করল। সেদিন ধোয়া কাপড়ের গাঁঠরি থেকে ওর কাপড় খোঁজার সময় ওর চোখ মেয়েটির হাতকাটা ব্লাউজে আটকে গেছল। খানিক পরে মনে হোল এটা আরও নোংরা, ফিরে এল ফিল্মের দুনিয়ায়। কিন্তু এবার জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম জেগে ওঠায় ও লিজ টেলরদের চিন্তা ছেড়ে ওয়াহিদা রেহমান ও সায়রা বানুর চিন্তায় ডুবে গেল। দু’চার মিনিট পর বুঝতে পারল যে সব ব্যাপারে বিদেশ থেকে প্রেরণা নেওয়া ঠিক নয়। আর ঠিকমত ধ্যান করলে দেশপ্রেমেও বড় মজা। হঠাৎ ওর ঘুম এসে গেল এবং অনেক চেষ্টার পরও সায়রা বানুর সমস্ত শরীরের চেয়ে ওর ধ্যানবিন্দু ক্রমশঃ ছোট আরও ছোট হয়ে গেল। কোত্থেকে এসে গেল কিছু বাঘ ও ভাল্লুক। ও একবার চেষ্টা করল কি সায়রা বানুর পুরো শরীর চেপে ধরে হিঁচড়ে নিয়ে আনবে, কিন্তু সায়রা বানু ওর হাত থেকে বার বার পিছলে গেল। এর মধ্যে বাঘ-ভালুকও কোথায় চলে গেল। তখন ওর মাথায় খান্না মাস্টারের চেহারাটা ভেসে উঠে ভেঙেচুরে গেল। খালি কানের মধ্যে একটা শব্দ টিপ টিপ করতে লাগল – মনুষ্যত্ব! মনুষ্যত্ব!

একবার মনে হোল— কেউ ফিসফিস করছে। তারপর মনে হোল এটা কেউ কোন মঞ্চের উপর থেকে গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করছে। এবার মনে হোল না, কোথাও দাঙ্গা লেগেছে, লোকজন ছোটাছুটি করছে আর বলছে- মনুষ্যত্ব! মনুষ্যত্ব!

ঘুমটা ভেঙে গেল। জেগে উঠতেই শুনতে পেল বাইরে খুব চেঁচামেচি হচ্ছে- চোর! চোর! চোর! পালিয়ে না যায়! পাকড়ো! পাকড়ো! চোর! চোর!

একটু পরে পরে আওয়াজ ফিরে ফিরে গানের ধুয়ো ধরছিল-চোর! চোর!

যেন গ্রামোফোনের পিন মুখড়ায় আটকে গেছে। ও দেখল, আওয়াজটা আসছে গাঁয়ের আরেক প্রান্ত থেকে।বদ্রী পালোয়ান খাটিয়া থেকে লাফিয়ে নেমেছে। ‘ছোটে বলছিল বটে, আজকাল একটা চোরের দল এ তল্লাটে ঘোরাফেরা করছে। মনে হচ্ছে আজ আমাদের গাঁয়ে ঢুকেছে’।

দুজনে তাড়াতাড়ি কাপড় পরে বাইরে বেরোল। কাপড় পরার মানে এ নয় যে বদ্রী চুড়িদার পাজামা ও শেরওয়ানি পরেছে। ঢিলে লুঙিটা কষে বেঁধে খালি গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিয়েছে, ব্যস্‌।রঙ্গনাথের এখনও ওর মত পরমহংস অবস্থা প্রাপ্ত হয়নি, তাই গায়ে একটা পাঞ্জাবি চড়িয়ে নিল।দরজা অব্দি যেতে যেতে ওদের চাল এবং হৃৎস্পন্দন দুইই বেড়ে গেল। এতক্ষণে চারদিকে শোনা যাচ্ছে -চোর! চোর! চোর!

হল্লাগুল্লা চীৎকার এমন পর্যায়ে উঠলো যে এটা ১৯২১ সালে ইংরেজ শুনলে নির্ঘাৎ ভারতে ছেড়ে পালিয়ে যেত।

দুজনে সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে এলো।বৈঠকখানা পার হয়ে বাইরে বেরোনোর সময় বদ্রী পালোয়ান রঙ্গনাথকে বলল, ‘তুমি ভেতর থেকে দোর বন্ধ করে ঘরেই থাক, আমি বাইরেটা দেখে আসি গে’। এরমধ্যে রূপ্পনবাবু কাঁধে ধুতির কোঁচা জড়িয়ে হড়বড়িয়ে ঘর থেকে এসে বললেন, “আপনারা ঘরে থাকুন, আমি বাইরে দেখতে যাচ্ছি”।

ভাবটা যেন চক্রব্যুহ ভেদ করতে যাচ্ছে। রঙ্গনাথ শহীদ হওয়ার ভান করে বলল, ‘ঠিক আছে, আপনারা যান, আমিই নাহয় ঘরে থাকবো’।

বাইরে ফুটফূটে জ্যোৎস্না, তিনটে লোক চোর! চোর! বলে ছুটতে ছুটতে গেল। ওদের পেছনে আরও দুটো ঠিক ওদের মত চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে গেল। তার পেছনে আরও একজন, সেই চিৎকার। এবার তিনজন, এদের সবার হাতে লাঠি। সবাই চিৎকার করছে, সবাই চোরকে তাড়া করছে। মিছিলের শেষভাগের একজনকে বদ্রী চিনতে পেরে দৌড়ে ওদের ধরে ফেলল।হেঁকে বলল,’ ক্যা রে? ছোটে? চোর কোথায়’? ছোটে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,’ আগে! আগে আগে পালাচ্ছে’! এরপর খানিকক্ষণ এখানে শান্তি। রূপ্পনবাবু ও রঙ্গনাথ বাইরের ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে ছাদে উঠে গেল। ইতিমধ্যে নীচের ঘরে বৈদ্যজীর ঘুম ভেঙেছে। গলা খাঁকরিয়ে আওয়াজ লাগালেন, ‘কে বটে’?

রূপ্পন জবাব দিল,’চোর, পিতাজী’।

বৈদ্যজী ঘাবড়ে গিয়ে হুঙ্কার দিলেন, ‘কে রুপ্পন? ছাদে গেছ নাকি’?

রূপ্পন বাইরের শোরগোলের সঙ্গে সমানতালে চেঁচিয়ে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আমিই। জেনেশুনে জিজ্ঞেস কর কেন? যাও, শান্তিতে ঘুমোও গে’।

বৈদ্যজী নিজের ছোটছেলের এমন মধুমাখা সম্ভাষণ শুনে চুপ মেরে গেলেন। রূপ্পন ও রঙ্গনাথ কান লাগিয়ে গাঁয়ের নানাদিক থেকে ভেসে আসা কোলাহল মন দিয়ে শুনতে লাগল।

এমন সময় ঘরের পেছন থেকে কারও আর্তনাদ ভেসে এল, ‘মেরে ফেলল রে’!

আবার চেঁচামেচি! কারও গলা শোনা গেল, ‘আরে ছেড়ে দে ছোটে, এ তো আমাদের ভগৌতি’!

‘ছাড়, এটাকে ছাড় বলছি! ওদিকে ! ওদিকে! চোর ওদিকে পালিয়েছে’।

কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অন্য কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে।“আরে কেন রাঁড়ির মত কেঁদে ভাসাচ্ছিস? এক ঘা লাঠিই তো!এতে এত ফোঁৎ ফোঁৎ করার কি হোল’?

কাঁদতে কাঁদতে অন্যজনের উত্তর,‘আমিও ছাড়ব না; দেখে নেব’।

আবার খুব চেঁচামেচি, হল্লাগোল্লা; ‘ওদিকে! ওদিকে! পালাতে দিস নে’। ডাইনে থেকে দে এক ঘা লাঠি! আরে লাফিয়ে উঠে মার! চোর শালা কি তোর বাপ লাগে’?

রঙ্গনাথের উত্তেজনার মাঝখানে হাসিও পাচ্ছিল। এ আবার কি নিয়ম! লাঠি মারার সময় বাপকে রেয়াত করতে হবে? ধন্য আমার ভারত, ধন্য রে তোর পিতৃভক্তি!

রূপ্পনবাবু বলল, ভগৌতি আর ছোটের মধ্যে কিছু একটা ক’দিন ধরে চলছিল। মনে হচ্ছে এই হট্টগোলের মাঝখানে ছোটে কিছু একটা করেছে’।

রঙ্গনাথ,’এ তো ভারি অন্যায়’।

রূপ্পন,’এর মধ্যে ন্যায় অন্যায়ের কি আছে? দাঁও লাগা নিয়ে কথা। ছোটে ব্যাটা দেখতে একদম ভোঁদু, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মহা ঘাগ’। দুজনে আবার চারদিকে নজর করে দেখে কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করল। রঙ্গনাথ বলল,’মনে হচ্ছে চোর পালিয়ে গেছে’।

‘প্রত্যেকবার এই তো হয়’।

রঙ্গনাথ ভাবল রূপ্পনের গ্রাম-প্রেম নিয়ে একটু আমড়াগাছি করা যাক।

‘শিবপালগঞ্জে চোর এসে কেটে পড়বে এ তো অসম্ভব। বদ্রীদাদা যখন গেছেন একটা-দুটো ধরেই ফিরবেন’।

রূপ্পন পুরনো দিনের কোন প্রবীণ নেতার মত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,’না গো রঙ্গনাথ দাদা। এখন ওই পালোয়ানির দিন গেছে। সে ছিল ঠাকুর দূরবীন সিংয়ের দিন। বড় বড় চোর শিবপালগঞ্জের নাম শুনতেই থরথরিয়ে কেঁপে উঠত’।

রূপ্পনবাবুর চোখ বীরপূজার আবেগে জ্বলে উঠল।কিন্তু কথাটা আর এগোল না। হৈ-হট্টগোল মিলিয়ে গিয়ে এখন আকাশ কাঁপিয়ে শোনা যাচ্ছে-জয়, বজরঙবলী কী জয়!

রঙ্গনাথ উৎসুক, ‘মনে হচ্ছে কোন চোর-টোর ধরা পড়েছে’।

রূপ্পনবাবুর ঠান্ডা জবাব,’ ধ্যাৎ, আমি গঞ্জহাদের খুব চিনি। ওরা চোরদের গাঁয়ের সীমানার বাইরে ভাগিয়ে দিয়েছে, ব্যস্‌। আরে চোরের দল যে এদের গাঁয়ের বাইরে তাড়িয়ে নিয়ে যায়নি সেটাই কি কম! সেই আনন্দে এরা জয়-জয়কার করছে’।

চাঁদনি রাত, রাস্তায় মানুষজন দু’এক জনের ছোট ছোট দলে গুজুর গুজুর করতে করতে আসছে যাচ্ছে। রূপ্পনবাবু ছাদের পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে দেখছিলেন। একটা দল নীচের থেকে আওয়াজ দিল, ‘জেগে থাকুন রূপ্পনবাবু! রাতভোর সাবধান থাকবেন’। রূপ্পন ওদের দিকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে বলল,’ যাও যাও, বেশি নকশাবাজি করতে হবেনা’।

এটা তো ভাল কথা, সুপরামর্শ। তবু রূপ্পন কেন খিঁচিয়ে উঠল? রঙ্গনাথ এর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি। একটু পরে ওই সুপরামর্শ গাঁয়ের এমাথা ওমাথা থেকে গুঞ্জরিত হল—জাগতে রহো! জাগতে রহো!

থেকে থেকে ওই ধ্বনি আর তার গুঞ্জন। এবার ওর সঙ্গে যুক্ত হোল হুইসিলের শব্দ। “ এই সীটি বাজছে কেন’?

রূপ্পনবাবু,’ কেন, পুলিশ আপনাদের শহরে সীটি বাজিয়ে টহলদারি করে না’?

‘আচ্ছা, পুলিশও এসে গেছে’?

“ আজ্ঞে; পুলিশই তো গ্রামবাসীদের সহযোগে ডাকাতদলের হামলার মোকাবিলা করল’।

রঙ্গনাথ হতভম্ব। “ডাকু’?

‘হ্যাঁ হ্যাঁ; ডাকু। এই চাঁদনি রাতে কি চোর আসে কখনও? এরা সব ডাকাত’। এবার রূপ্পনবাবু ঠা-ঠা করে হেসে বলল,’দাদা, এসব হোল গঞ্জহাদের চক্কর, বুঝতে সময় লাগে। আমি শুধু কাল সকালে খবরের কাগজে যা বেরোবে সেটা জানিয়ে দিলাম’।

একটা সীটি ঠিক ঘরের পাশের রাস্তায় শোনা গেল। রূপ্পন বলল, ‘মাস্টার মোতিরামের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে? পুরনো লোক। দারোগাজী ওঁকে খুব শ্রদ্ধা করেন। উনি দারোগাজিকে শ্রদ্ধা করেন। প্রিন্সিপাল ওই দুজনকেই শ্রদ্ধা করেন। কোন শালা এক পয়সার কাজ করে না, খালি একজন আরেকজনের শ্রদ্ধা করে সময় কাটায়।

‘ওই মাস্টার মোতিরাম হলেন শহরের কাগজটির বিশেষ প্রতিনিধি।যদি চোরকে ডাকু নাই বানালেন তো মাস্টার মোতিরাম হয়ে কী লাভ’?

রঙ্গনাথ হাসতে লাগল। হুইসিল ও ‘জাগতে রহো’ ক্রমশঃ দূরে মিলিয়ে গেল। এঘর ওঘর দরজা খোলার জন্যে লোকজনের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। ‘দরজাটা খুলে দে মুন্না’ থেকে ‘ শ্বশুর ব্যাটা মরে গেল নাকি’ এবং ‘আরে তোর বাপ বলছি, তখন থেকে চেঁচিয়ে মরছি’ গোছের সব শুরু হয়েছে। বৈদ্যজীর বাড়িতেও কেউ সদর দরজার শেকল ঝনঝনাচ্ছে। বাইরে বারান্দায় শোয়া একজন মুনিষ জোরে কেশে উঠল। রঙ্গনাথ বলল, ‘ বোধহয় বদ্রীদাদা, চলো তালা খুলে দিই’।

ওরা নীচে নেমে এল। তালা খুলতে খুলতে রূপ্পন বলল, ‘কে বটে’?

বদ্রীর হুংকার শোনা গেল, ‘খুলবি কিনা? কি কে-কে শুরু করেছিস’?

রূপ্পন তালা খুলতে খুলতে থেমে গেল। বলল,’ নাম বল’।

ওদিক থেকে বাজের আওয়াজ, ‘রূপ্পন, চুপচাপ ভালোয় ভালোয় খুলে দে বলছি’।

“ কে, বদ্রীদাদা’?

“ হ্যাঁ, হ্যাঁ, বদ্রী দাদা। খোল শিগগির”।

রূপ্পন হালকা হাতে তালা খুলতে খুলতে বলল,’ বদ্রীদাদা, বাপের নামটাও বলে ফেল’।

বদ্রীদাদা গালি দিতে দিতে বৈদ্যজীর নামটা বলল। রূপ্পন ফের বলল,’এবার নিজের ঠাকুর্দার নামটাও বলে দাও’।

বদ্রী ফের গালির সঙ্গে ঠাকুর্দার নাম বলল। আবার প্রশ্ন হল, ’বেশ, প্রপিতামহের নাম’?

বদ্রী দরজায় এক ঘুঁসি মেরে বলল, ‘তোকে আর খুলতে হবে না। আমি চললাম’।

-‘দাদা, দিনকাল খারাপ। বাইরে চোরবাটপাড় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাই জিগ্যেস করছি। সাবধানের মার নেই। ঠিক আছে, প্রপিতামহের নাম ভুলে গেছ তো বোল না। কিন্তু রেগে যাবার কী হোল? বেশি রাগলে লোকসান’।

এইভাবে রূপ্পনবাবু বদ্রীদাদার পরীক্ষে নিয়ে এবং ক্রোধে পাপ, ক্রোধে তাপ গোছের লেকচার দিয়ে তবে দরজাটা খুললেন। বদ্রী পালোয়ান বিছে বা চ্যালার মত হিলহিলিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। রূপ্পন ভালোমানুষের মত জানতে চাইল- কী হোল দাদা? সব ব্যাটা চোর পালিয়ে গেল?

বদ্রী কোন জবাব না দিয়ে দপদপিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের ঘরে চলে গেল।রূপ্পনবাবু নীচের ঘরে। রঙ্গনাথ আর বদ্রী খাটিয়ায় শুয়ে খালি দু’চোখের পাতা এক করেছে কি নীচে থেকে কেউ ডাকল -ওস্তাদ, নীচে নেমে এস; মামলা বড্ড গিচপিচ হয়ে গেছে।

বদ্রী উপরের দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়ল,- হোল কী ছোটে?ঘুমুতে দিবি নাকি সারারাত এখানেই হাল জুততে থাকবি?

ছোটে তেমনই চেঁচাল- ওস্তাদ, ঘুম-টুম গোলি মারো। এখন রিপোর্ট লেখানোর হাল হয়েছে। এদিকে সব শালা গলি গলিতে চোর-চোর চেঁচিয়ে বেরিয়েছে, ওদিকে এই সুযোগে কেউ হাত সাফ করেছে। গয়াদীনের ঘরে চুরি হয়ে গেছে। নীচে নেমে এস।

0 comments: