1

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in




















( ১ )

সারা স্কুলে হইচই পড়ে গেল একেবারে। হুড় হুড় করে ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে এল কয়েকটা ক্লাস থেকে। টিচাররা আবার জোর করে আটকে রেখেছে কোনো কোনো ক্লাসকে। আটকে পড়া ছেলে-মেয়েরা অস্থির হয়ে উঠেছে রীতিমতো।

ওপরের ক্লাসরুম থেকে আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে সবদিকে। কোণের ঘরটা ক্লাস ফাইভের। এখন তো অঙ্কের ক্লাস চলছে। সৌরেন সমাদ্দাদের গলা না? হেডমাস্টার বেরিয়ে এলেন বাইরে। তাঁকে দেখেই ছেলে-মেয়েরা আরও চেঁচাতে শুরু করেছে, "অঙ্কের স্যার খুব রেগে গেছেন। চেঁচাচ্ছেন।"

কিন্তু তাঁর চেঁচানোর কারণটা কী? সেটাই তো জানতে পারছেন না তিনি। বাধ্য হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছেন। তাঁর পিছু নিলেন আরো দুজন মাস্টারমশাই। নিচের তলার ছেলেরা তাঁদের পিছু নিয়ে উপরে উঠতে চাইছে। কিন্তু তপনবাবু হঠাৎ ফিরে তাকালেন নিচের দিকে। ওমনি সব হুড়মুড় করে পড়ল যে যার গায়ের উপর। হুলস্থুল বেঁধে গেল সিঁড়ি পথেই।

হঠাৎ সেই চিৎকার-চেঁচামেচি স্তব্ধ হয়ে গেল। সৌরেনবাবুর গলা শোনা যাচ্ছে না আর। ঘরের সামনে পা ফেলার আগে ভেতর থেকে ভেসে আসছে, "এবার তিনের দাগের অঙ্কটা কর দেখি। কেউ কারোর দেখবি না কিন্তু। এ ধরনের অঙ্ক পরীক্ষায়…"

মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই হেডমাস্টারের সঙ্গে ক্লাসে ঢুকলেন তপনবাবুরা। তাদের দেখে রীতিমতো জ্বলে উঠলেন, "এ রকম ছেলে আমি জীবনে দেখিনি। আগেও একদিন বারণ করেছি, শোনেনি। আজ আবার সেই একই কাণ্ড। মাথা কি আর ঠান্ডা রাখা যায়, আপনি বলুন?"

কী ঘটেছে? বা কে কি করেছে? সেটাই তো তাঁর অজানা, উত্তর দেবেন কী করে? হেড-মাস্টার সারা ক্লাসের দিকে একবার তাকিয়ে কোনো কিছুর আভাষ পেলেন না। কিন্তু সৌরেনবাবুকে দেখে তো বোঝাই যাচ্ছে, কিছু তো একটা ঘটেছে? শুরু করবেন কী দিয়ে? তবু ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশ্যে গম্ভীর গলায় ফেটে করলেন, "কে, কে এমন করেছিস?"

সৌরেন সমাদ্দার তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করলেন, "না, মানে স্যার, ওরা…"

"না, মানে কী? এভাবে সব পার পেয়ে যাবে নাকি?"

"না, স্যার, আমার কথাটা শুনুন…"

"না, সৌরেনবাবু এভাবে ছাড়লে ওরা লাই পেয়ে যাবে। এরপর মাথায় চড়ে বসবে সব।"

"স্যার…"

"উঠে দাঁড়া, উঠে দাঁড়া বলছি? ওঠ…"

চুপ করে রইল সবাই। মুখ চাওয়া-চাউয়ি করছে পরস্পরে।

সৌরেনবাবু এবার আর বাধা মানলেন না, "স্যার, এরা কেউ কিছু করেনি। ঐ বাইরের ছেলেটা।"

"মানে?"

"আজও গাছে উঠেছিল? বাগানের এই গাছটায়। বারণ করলেও শুনছে না।"

"তাতে আপনার কি?"

তপনবাবুও তাঁর সঙ্গে সায় দিলেন, "বাইরের ছেলের জন্য আপনার এত মাথা ব্যথা কিসের?"

"আছে, নইলে আর বলছি কেন? পড়ে গেলে একটা বিপদ ঘটবে না? তাছাড়া…"

তাঁর মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই তপন রায় বিরক্তি প্রকাশ করলেন, "ঘটলে ঘটবে। কার না কার ছেলে, সে তারা বুঝে নেবে, আপনি খামখা মাথা গরম করছেন কেন শুনি?"

হেডমাস্টার, তপনবাবুর অযাচিত উপদেশ সঙ্গে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের গুজুর ফুসুর… সৌরেন সমাদ্দারের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। চেঁচিয়ে উঠলেন জোরে, "এই কী হচ্ছে এসব? একটা অঙ্ক দিলে কেউ করতে পারে না, আবার গুজুর ফুসুর? এই, তুই দাঁত বের করছিস কেন? দাঁড়া… তোর হাসি একেবারে…"

কী বুঝেই সৌরেনবাবুকে থামিয়ে দিলেন হেডমাস্টার। বললেন, "আর মাত্র কয়েক মিনিট আছে। আপনি আমার সঙ্গে আসুন। এই তপন, তুমি ক্লাসটা একটু সামলে দাও। আপনি আসুন আমার সঙ্গে।"

কিন্তু ব্যাপারটায় কেমন যেন অপমানিত বোধ হতে লাগল তাঁর। বাধ্য হয়ে হেডমাস্টারের পিছু নিলেন। কয়েক মিনিট পরে ঘন্টা পড়ল। তপন রায়ও এসে পৌঁছলেন হেডমাস্টারের ঘরে।

সৌরেনবাবু ও হেডমাস্টারের মধ্যে কথা চলছিল। তপন রায়কে দেখেই হেডমাস্টার বলে উঠলেন, "ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং বুঝলে? একটু খেয়াল করতে হবে আমাদের। কিন্তু..."

"কিন্তু এবার কিসের? ওর নিশ্চয়ই অন্য মতলব আছে স্যার। ঐ দিকটায় আবার মেয়েরা বসে। ভেবে দেখুন!"

সৌরেন সমাদ্দারের কথা একবারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না। আবার সমর্থন যে করবে তেমনটা প্রমাণও নেই তাঁর হাতে। তবুও দ্বিধান্বিত হয়ে বললেন, "ঠিক আছে ব্যাপারটা আমি নজরে রাখব। আপনি এখন আসুন।"

তপন রায় তো অবাক! কী এমন ব্যাপার, যা নজরে রাখতে হবে? কৌতূহল চেপে বসেছে তাঁর মনে। কিছু একটা বলতে যাবেন, তার আগেই এইচ এম বলে উঠলেন, "এসো, বসো। দরকারি কথা আছে।"

তপন রায়ের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করলেন হেডমাস্টার। ধীর পদক্ষেপে বাইরে বেরিয়ে গেলেন সৌরেনবাবু।

( ২ )

নদীর জলে ঢিল এসে পড়ছে থেকে থেকে, টুপ… টুপ… গাছের মাথায় গনগনে রোদ। দু-একটা নৌকা ভেসে আছে মাখখানে। ওপারটা দেখা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অতটা স্পষ্ট নয়। কঞ্চির বোঝা মাথায় তুলে নিল মাধব। হাঁটতে শুরু করল পাড় ধরে।

যত এগিয়ে আসছে, স্কুলটা তত স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে তার চোখের তারায়। সেদিক থেকে নজর ফেরাতে ইচ্ছে করছে না তার। যেদিন থেকে সে এখানে এসেছে, সেদিন থেকেই স্কুলের ছবিটা যেন মনে গেঁথে গেছে একেবারে।

প্রথম দিনেই সে দিদিকে জিগ্যেস করেছিল, "ঐ উঁচু বাড়িটা কাদের রে?"

একটু দূরেই বসেছিল মাধবের বড়দি, অঞ্জনা। তার সামনেই জল চৌকি। কয়েকটা খাতা গোছানো রয়েছে তার উপর। একটা আবার মেলা রয়েছে তার হাতের নিচে। লেখা বন্ধ করে মাধরের দিকে তাকায়। ভায়ের হাতের ইশারা দেখে বলেছিল, "ও… ওটা? ওটা তো স্কুল।" বলেই আবার খাতায় লিখতে শুরু করে দেয়।

মাধবের মা'র কিন্তু তা নজর এড়ায়নি। ছেলের দিকে তাকিয়ে চুপিসাড়ে মাথা নাড়ে। মায়ের ইশারা বুঝতে বাকি থাকেনি মাধবের। অঞ্জনাকে কিছু একটা বলবে বলে কিন্তু মা'র নিষেধ তাকে প্রতিহত করে দিল।

বিকেল হতেই সে বেরিয়ে পড়ে। পিছন থেকে গলা ভেসে আসছে, "আরে, কোথায় চললি? নতুন জায়গা। কারোর সঙ্গে তো যা। আরে এই মাধব…"

শোনেনি মাধব।

পড়ন্ত বিকেলের রোদ্দুর তেজ হারিয়ে এখন আটকে আছে বাড়িটার মাথায়। নদীর পাড় ধরে এগিয়ে গেল মাধব। নজর কিন্তু সেদিকেই। সামনে এসে থমকে গেল সে। চোখ খিলখিল করে উঠল তার। সামনেই বড়ো তোরণ। বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা, কালিকাপুর উচ্চ-বিদ্যালয়। ফাঁকা স্কুল। কেউ কোথাও নেই। এর তিনতলার উপরে ঐ সিঁড়ির ছাদটাই, তার দিদির বাড়ি থেকেই দেখা যাচ্ছিল। নিচে স্কুলের গা ধরে ফুলের বাগান। কত রকমের ফুল। তার পাশে পাশে বড়ো বড়ো দেবদারু। সোজা উঠে গেছে উপরে। ভেতরের মাঠখানা বেশ বড়ো। স্কুলের গেট ধরে সে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছিল তার আগের স্কুলের সঙ্গে। না, কোথাও মিল খুঁজে পেল না সে।

তবে হ্যাঁ। তাদের নবতারা বিদ্যামন্দির এত বড়ো না হলেও এর থেকে কম নয়। সেখানেই তার ভর্তি হওয়ার কথা ছিল এবারে। দাদুর সঙ্গে একদিন ঘুরে দেখে এসেছিল সেটা। তার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল দুজনেই। "কিরে দাদুভাই, কেমন লাগছে? এবার পাশ করলে তোকে ভর্তি করে দেব এখানে। একলা আসতে পারবি তো?"

বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়েছিল মাধব, "হ্যাঁ, হ্যাঁ, পেরে যাব। সঙ্গে পাড়ার ছেলেরাও আসবে না। ও ভাবতে হবে না তোমাকে।"

যেদিন মাধবের রেজাল্ট বের হবে, সেদিন ক্লাসে বসেছিল অন্যদের সঙ্গে। গরমকাল। জোরে জোরে বাতাস বইছে। ফাঁকা স্কুলের মাঠ। ধূলো উড়ছে থেকে থেকে। তারই মধ্যে দিয়ে জোরে জোরে সাইকেল চালিয়ে আসছে একজন। মাধবের নজর পড়ল সেদিকে, "আরে, কাকা না!" বাইরে বেরিয়ে এল সে। সাইকেল এসে থামল গেটের সামনে, "তাড়াতাড়ি বাড়ি চ মাধো।"

"কেন? কি হয়েছে?"

"সে বাড়িতে গেলেই বুঝতে পারবি। সাইকেলে ওঠ। দেরি করিস না। ওঠ…"

একটু পরেই রেজাল্ট দেবে। তা না নিয়ে সে যায় কী করে? ইতস্তত করছে। কিন্তু কাকাকে মুখের উপর না বলতে তার সাহসে কুলাচ্ছে না। "রে-রেজাল্টটা নি-নিয়ে গে…"

কথা বলতে বলতে সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে তার কাকা। চড়ে বসল তার উপরে, "ও আমি কাল এসে নিয়ে যাব। তুই আগে বাড়ি চ…"

অগত্যা চেপে বসল সাইকেলে। পিছন ফিরে ফিরে স্কুলের দিকে বার বার তাকাচ্ছে। সাইকেল চলেছে দ্রুত গতিতে। কিছুক্ষণ পর নজরের আড়ালে চলে গেল স্কুল।

উঠোনে লোকজন ভর্তি। ঠাকমার কান্নার আওয়াজ কানে আসছে তার। ভিড় ঠেলে কাছে যেতেই, তাকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠেন, "ক-কতবার তো-তোকে দেখতে চেয়েছিল। প-পথের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কতবার 'মাধো'... 'মাধো' করে ডাকল। তারপরেই…"

দাদু অন্ত প্রাণ মাধবের। সেই কোন ছোটোবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। মুখটা এখন ঠিক করে মনেও পড়ে না। সেই দাদুই তার সব। সেই তার বাবা, সেই তার মা, সেই তার বন্ধু, সেই তার সুখ-দুঃখের চিরসাথী। দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে সব কিছু ঝাপসা হয়ে গেল তার। পিছন থেকে ন-কাকার হাত পড়ল তার কাঁধে, "শ্মশানে যাব, বাবার ইচ্ছা তুই-ই যেন তার মুখে আগুন দেস। চ… কাঁদিস না।"

শ্রাদ্ধের কাজকর্ম সারতেই মাধবের ঠিকানা হয় মায়ের কাছে, কালিকাপুর, হুগলীতে। এই প্রথম গ্রাম ছাড়া হল সে। গ্রাম ছেড়ে, ঠাকমাকে ছেড়ে, একেবারের জন্য। বছর পাঁচেক পর এই প্রথম মা'র কাছে আসে মাধব। অভাবের সংসার। লোকের বাড়ি কাজ করে দুবেলা। ততদিনে দিদির বিয়ে গেছে। একদিন রাতে খেতে বসে শোনায়, "তুই এখন থেকে দিদির বাড়ি থাকবি। দিদির শন-পাপড়ির কারবার।দেখাশোনা করবি এখন থেকে।"

বুকটা দুমড়ে গেল মাধবের। কী বলছে মা এসব? গালে ভাত তুলতে গিয়ে হাত নেমেই গেল পাতেই। "মা, আ-আমাকে আর স্কুলে ভর্তি করবে না?"

তার মা'র কথা সরল না মুখ থেকে। মাথা নিচু করে রইল। ভেতরটা যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে তার। কোনো উত্তর না পেয়ে মাধব মাথা নিচু করে আবার বলল, "দাদু থাকলে ঠিক ভর্তি করে দিত।"

ভাতের থালা ছেড়ে উঠে গিয়েছিল মাধব। সারারাত ঘুমতে পারেনি। বারবার রেজাল্টের কথা মনে পড়ছে। সেটা রেখে এসছিল ঠাকমার কাছে। বলে এসেছিল আসার সময়, "রেখে দাও। মা টাকা দিলে, ফিরে এসে নবতারায় ভর্তি হব।"

ফেরা আর হয়নি মাধবের।

দুদিন না কাটতে কাটতেই দিদিও ফিরিয়ে দিল তাকে। সেই থেকেই মা'র কাছে। সকাল হলেই বেরিয়ে যায় নদীর পাড়ে। স্কুলের সময়ে গিয়ে হাজির হয় বাগানে। কয়েকদিন ঝোপের আড়ালে বসে বসে তাকিয়ে থাকত ঘরগুলোর দিকে। ছেলেমেয়েদের চেঁচামেচি, মাস্টার দিদিমণির পড়ানোর গলা, কানে এলেই চোখ ছলছল করে উঠত তার। একদিন চড়ে বসল গাছের ডালে। সেখান থেকে বোর্ডটা দেখা যায় ভালো। একদিন চোখাচোখি হয় সৌরেনবাবুর সঙ্গে। ব্যস, বিপদ ঘনালো সেদিনই। রে রে করে উঠলেন সৌরেনবাবু, "কে রে ওখানে? ওখানে উঠেছিস কেন? নাম বলছি, নাম।"

কিছু না বলে মাধব হুড়হুড় করে নেমে গেল গাছ থেকে।

একদিন যায়, দুদিন যায়। মাধব নদীর পাড়ে ঘুরে ঘুরে বেরায়। জ্বালানি ভাঙে, এ বাগান সে বাগান থেকে। ডালপালা ভেঙ্গে নিয়ে গেলেই তবে তাদের রান্না হয়। কিন্তু মনের ভেতরে সেই কালিকাপুর উচ্চ বিদ্যালয় উঁকি দিয়ে বেড়ায়। স্কুলের পাশেই বাঁশঝাড়। সেখানে শুকনো কঞ্চির রাজত্ব যেন। সেটা যেন জ্বালানির স্বর্গ। গেলেই কেল্লাফতে। কিন্তু সেখানে গেলে স্কুলের ঘর, ছেলেমেয়েদের চেঁচামেচি, ক্লাস থেকে স্যারেদের গলা... কেমন যেন টেনে টেনে নিয়ে যায় তাকে। কান যেন খাড়া হয়ে থাকে সেসবে। কিন্তু ওদিনের পর থেকে কেমন একটা ভয়, সঙ্কোচ চেপে বসেছে তার মনে মনে। কিন্তু পা যেন তাকে টেনে টেনে নিয়ে যায় সেদিকে।

কঞ্চির তাড়া বাঁধতে বাঁধতে মন উছাটন হয়ে উঠল মাধবের। চুপিসাড়ে গিয়ে উঠল গাছে। সেই ডালে। ডাল টেনে টেনে আড়াল করে নিল চারপাশটা। কিন্তু কথায় বলে না, যেখানে ভুতের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। সৌরেনবাবু যে তক্কে তক্কে ছিলেন কে জানে? ক্লাস চলছে ক্লাসের মতো। মাধবের কান সেদিকে। চোখ রয়েছে ক্লাসের ভেতরে, বোর্ডে।

সৌরেনবাবু কখন যে এদিকে চলে এসেছি্লেন, টের পায়নি মাধব। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরও তিন চারজন ছাত্র। এমন সুযোগ যেন হাত ছাড়া করতে রাজি নন তিনি। এতদিনের ক্ষোভ আর চাপা থাকেনি- "তোর জন্যেই হেড-মাষ্টার সেদিন আমাকে হেয়ো করেছিলেন।

বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান

এবার পড়েছ ধরা বধিব পরান

ব্যাটা কোন ধান্ধায় আসছে, আমরা কি আর বুঝতে পারিনি? এই দেখিস, যেন পালাতে না পারে।"

ছেলেরা যেন মুখিয়া হয়ে ছিল। "স্যার, ও মনে হয় চুরি করতেই…"

"জানলা দিয়ে ব্যাগ হাতানোর ধান্ধা। বুঝলি না?"

"ওকে আগেও একদিন বারণ করেছি। শোনেনি। আবার এসেছে। নিশ্চয়ই ওর অন্য মতলব আছে।"

"এই নাম... নাম বলছি।"

মাধব জড়সড় হয়ে বসে আছে ডালে। পাশের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাদের চেঁচামেচিতে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল এ ক্লাস থেকে সে ক্লাসে। নিচ থেকে উপরে।

সৌরেনবাবু চেঁচাচ্ছেন, "কিরে নামবি, না উঠবে?"

মাধব ধীরে ধীরে নেমে এল নিচে। ছাত্ররা ঘিরে ধরল তাকে। পাঁচিলের ওপারে তখন অকেনেই জড়ো হয়ে গেছে। ছাত্রছাত্রী থেকে মাষ্টার- দিদিমণি সব সব। সবার চোখ সেদিকে। হেডমাষ্টার চেঁচাচ্ছেন, "সৌরেনবাবু ওকে ছেড়ে দিন। চলে আসুন..."

"না স্যার, ছাড়া যাবে না। মেয়েদের দিকে বসে থাকে, বুঝতে পারছেন না? ওর মতলব কিন্তু আলাদা।"

"আপনি চলে আসুন, অন্য ঝামেলা হতে পারে। ছেড়ে দিন।"

"এদের আপনি চেনেন না,স্যার। ওদিকের ইট ভাটার জিনিস এ। এর শিক্ষা দেওয়ার দরকার। এই ধর কান ধর… উঠ-বস কর... দাঁড়িয়ে রইলি কেন? উঠ-বস কর বলছি…"

চোখ ছলছল করছে মাধবের। এতগুলো ছেলেমেয়ের সন্দিহান চোখ তাকে যেন মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে।

"কিরে দাঁড়িয়ে রইলি? কর..."

কোনো কথা বলল না সে। কান ধরে উঠ-বস শুরু করে দিল সেখানেই। অট্টহাসিতে মুখরিত হতে লাগল সারা স্কুল, উপর থেকে নিচ।

চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে মাধবের। টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। ছেলেদের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে, মাথায় তুলে নিল কঞ্চির বোঝা।


( ৩ )

দু'দিন জ্বরে জ্বরে কাটল মাধবের। জ্বালানিও শেষের পথে। সকাল হতেই সে বেরিয়ে পড়ল। নদীর পাড়ে বসে থাকল অনেকক্ষণ। রাস্তায় ছেলেমেয়েদের দেখা যাচ্ছে। স্কুলের ইউনিফর্ম দেখেই বুকটা ছলাৎ করে ওঠে তার। লুকিয়ে গেল সে গাছের আড়ালে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। হঠাৎ কানে ভেসে এল, "স্যার, ভালো আছেন তো?"

উঁকি মারল মাধব। ফাঁকা রাস্তা। তারই একপাশে দাঁড়িয়ে দুজন। সাইকেলেই বসে মাটিতে পা ঠেকিয়ে কথা বলছেন সৌরেনবাবু, "হ্যাঁ ভালো, তুই?"

"ভালো। স্যার, আপনি সাইকেলে..."

"কয়েকমাস হল, এই স্টেশনের কাছে একটা ভাড়া নিয়েছি। ওখান থেকেই... তা তুই কি করছিস এখন?"

"একটা কোম্পানিতে বছর দুয়েক হল। সেলস ডিপার্টমেন্টে..."

"শোন না, অন্য কোনোদিন কথা বলিয়ে। আজ দেরি হয়ে গেছে একটু... আসছি।"

কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে গেল মাধব। খালি হাতে ফিরতেই তার মা তো অবাক। "কিরে জ্বালানি কোথায়? কোথায় ছিলি এতক্ষণ?"

"বিকেলে এনে দেইয়ে।" বলেই ঘরে ঢুকে গেল সে।

দুপুরে খেয়েই বেরিয়ে পড়ল। নদীর পাড় দিয়ে যেতে যেতে শুকনো ডালপালা ভেঙ্গে ভেঙ্গে দড়িতে বাঁধতে লাগল একে একে। আকাশটা হঠাৎ কালো হয়ে এল। টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে নদীর জলে। কালো হয়ে গেল চারদিক। ছুটির পরে ছেলেমেয়েরাও বেরিয়ে গেছে স্কুল থেকে। জোরে বৃষ্টি এলে জ্বালানিগুলোও ভিজে জাউ হয়ে যাবে একেবারে। মাধব অস্থির হয়ে উঠছে ভেতরে ভেতরে। পথের বাঁকেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একা। ওপাশে নদীর জল যেন উতলা হয়ে উঠছে। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বাঁধানো পাড়ের গায়ে। পালা ভাঙতে ভাঙতে ঝোপের আড়াল থেকে বারবার তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। ফাঁকা রাস্তা।

হঠাৎ তার নজর পড়ল ঝোপের ফাঁক থেকে। একটা সাইকেল এগিয়ে আসছে এদিকে। বেশ জোরে। এক হাতে ছাতা। স্টেশনের যাওয়ার শর্টকাট এটাই। চোখ খিলখিল করে উঠল মাধবের। হাতের মুঠো শক্ত হয়ে উঠল নিমেষেই। সাইকেল বাঁক নেওয়ার আগেই শুকনো ডাল ঢুকিয়ে দিল সামনের চাকায়। আছাড় খেয়ে পড়লেন নদীর পাড়ে। সাইকেল সমেত সৌরেনবাবু গড়িয়ে পড়লেন নদীর জলে।

শুধু স্রোতের টানে ছাতাটা ভেসে চলল।

মাধব বোঝা তুলে নিল মাথায়। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল জোরে।

1 comment:

  1. ছোটলোকের বাচ্চা পড়লাম। পড়তে পড়তে চোখ ভিজে গেল কখন। অনেক স্বপ্ন হারিয়ে যায় অভাবের তাড়নায়। তবে গল্পের শেষ টা অন্য রকম হলেই ভাল হত।

    ReplyDelete