গল্প - মনোজ কর
Posted in গল্পএকাদশ পর্ব
পলাশি যুদ্ধের প্রস্তুতি
চন্দননগর জয়ের পরও ক্লাইভের মনে হল যে সামনে যে পরিকল্পনা রয়েছে তা কার্যকর করা খুব একটা সুবিধের হবে না। মিরজাফর এখনও দোলাচলচিত্ত। যদিও ইতিমধ্যেই মিরজাফরের সঙ্গে এই মর্মে প্রায় একমাস আগে চুক্তি হয়েছে যে সিরাজকে গদিচ্যুত করার এই চক্রান্ত কার্যকর করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে মিরজাফর এবং সেই হবে সিরাজ পরবর্তী নবাব। পরিবর্তে মিরজাফর ইংরেজ এবং অন্য চক্রান্তকারীদের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে সচেতন থাকবে। তবুও ক্লাইভের মন থেকে দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না।
ওয়াটস, ক্লাইভের একান্ত বিশ্বাসী সহকারী সবদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে এবং কোনও কিছু নজরে বা কানে এলে সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভকে তার সম্পর্কে অবহিত করছে। চন্দননগর জয়ের পর ক্লাইভ এবং ওয়াটসনের নেতৃত্বে আলোচনার জন্য সিরাজের প্রতিনিয়ত আমন্ত্রণ উপেক্ষা করে মিরজাফরকে কেন্দ্রে রেখে চক্রান্ত ঘনীভূত হচ্ছে মুর্শিদাবাদে। পাশ থেকে এই চক্রান্তে অংশগ্রহণ করেছে রাইদুর্লভ এবং ইয়ার লতিফ। ইয়ার লতিফ ইংরেজদের কাছে বিশ্বাসঘাতকতার বিনিময়ে সিংহাসনের দাবি করেছিল প্রথমে। পরবর্তীকালে মিরজাফর যুক্ত হওয়াতে লতিফের আবেদন বাতিল করে দিয়েছিল ইংরেজরা। এছাড়াও তাদের নিজস্ব ভঙ্গিমায় এই চক্রান্তে রসদ যোগাচ্ছে জগতশেঠ এবং ঘসেটি বেগম। আর আছে উমিচাঁদ। যদিও উমিচাঁদই ছিল মিরজাফরের সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তির অন্যতম রূপকার তবুও ক্লাইভ কিন্তু কখনই উমিচাঁদকে বিশ্বাস করতে পারেনি। ক্লাইভের অনুমান সত্যি প্রমাণ করে মিরজাফরের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর উমিচাঁদ এই চুক্তির গোপনীয়তা রক্ষার মূল্য হিসাবে ত্রিশ লক্ষ টাকা দাবি করল। ভয় দেখাল যে এর অন্যথা হলে খবর সিরাজের কানে তুলে দেবে সে। ক্লাইভের ভাষায় পৃথিবীর সর্বকালের সেরা শয়তান এই উমিচাঁদ। তার দ্বিচারিতার জন্য সে ইংরেজদের কাছে সন্দেহের পাত্র হয়েছে বারবার। তার সাহায্য নিলেও তার সুবিধাবাদী গতিবিধির ওপর কড়া নজর ছিল ইংরেজদের।
উমিচাঁদ দাবি করল যে সিরাজকে গদিচ্যুত করার পর তাকে যে ত্রিশলক্ষ টাকা দেওয়া হবে সে কথা চুক্তিতে স্পষ্ট করে লেখা থাকতে হবে। উমিচাঁদ চলে ডালে ডালে তো ক্লাইভ চলে পাতায় পাতায়। ক্লাইভ একটির বদলে দু’টি চুক্তিপত্র তৈরি করল। একটি সাদা কাগজে যার মধ্যে উমিচাঁদের কথা উল্লেখ করা নেই। অন্যটি লাল কাগজে যার মধ্যে উমিচাঁদের পাওনার কথা লেখা আছে। কিন্তু গোল বাধল এই নিয়ে যে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন এই লাল চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে রাজি হলনা। ক্লাইভ ওয়াটসনকে বোঝালো যে এই দ্বিতীয় চুক্তি নীতিবিরুদ্ধ হলেও কৌশলগত দিক থেকে এই চুক্তির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এটি একটি পবিত্র এবং প্রয়োজনীয় মিথ্যাচার। তাছাড়া চক্রান্তের ক্ষেত্রে কোনওরকম নৈতিকতা অপ্রাসঙ্গিক। যেন তেন প্রকারেণ যুদ্ধজয়ই একমাত্র লক্ষ্য। এই দীর্ঘ আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়াতে ক্লাইভ ঠিক করল লালচুক্তিতে ওয়াটসনের নকল স্বাক্ষর ব্যবহার করা হবে। এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। কারণ এই চুক্তিতে ওয়াটসনের স্বাক্ষর না থাকলে উমিচাঁদের সন্দেহ বাড়তে পারে এবং সেক্ষেত্রে চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। এই ঝুঁকি নেওয়া এখন অসম্ভব। কিন্তু এই জাল সইএর ঘটনা ওয়াটসনের কানে এলেও যুদ্ধের আগে এবং পরে কোনও প্রতিবাদ জানায়নি সে। ওয়াটসন ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেবল নিজের হাতে এই নকল চুক্তিপত্রে সই করতে চায়নি। পরবর্তীকালে কাউন্সিলে এই নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ক্লাইভ এই নীতিহীন কাজের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেয়। ফলে কাউন্সিল তাকে শুধু ক্ষমা করেনি প্রভূত প্রশংসাও করেছিল। ওয়াটসন স্বয়ং এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ অবগত হওয়ার পর ক্লাইভকে প্রশংসা করে জানিয়েছিল যে সে অত্যন্ত খুশি কারণ মিরজাফরের পক্ষে অনেকে যোগ দিচ্ছে। সে আশা করে এই যুদ্ধে ক্লাইভের জয় নিশ্চিত এবং তার দিক থেকে ক্লাইভকে অভিনন্দন জানানো কেবল সময়ের অপেক্ষা। আর সকলের মত পলাশি যুদ্ধের পর লুটের ভাগ তো ওয়াটসনেরও প্রাপ্য। সেই প্রাপ্য সংরক্ষিত রাখতে এই অন্যায়কে পিছন থেকে সমর্থন করা ছাড়া আর কী কোনও উপায় আছে? যেখানে অর্থ আহরণই মূল লক্ষ্য সেখানে নীতির কথা অবান্তর।
১৯শে মে ইংরেজদের স্বাক্ষরসম্বলিত সাদা এবং লাল দু’টি চুক্তিই মিরজাফরের কাছে পাঠানো হল । সিরাজের চোখ এড়িয়ে মুর্শিদাবাদে বসেই এই চক্রান্তের জাল বিস্তার করছিল সিরাজের দরবারের ইংরেজ প্রতিনিধি ওয়াটস। যুদ্ধের একসপ্তাহ আগে শিকারে যাবার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেনি ওয়াটস। মিরজাফরের সঙ্গে শেষ আলোচনা এবং দু’টি চুক্তিতেই মিরজাফরকে স্বাক্ষর করানোর গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় ওয়াটসের ওপর। পর্দানসীন মহিলার ছদ্মবেশে ভাড়া করা পাল্কিতে চড়ে মিরজাফরের জাফরগঞ্জের বাড়িতে গিয়ে এই গুরুদায়িত্ব পালন করে ওয়াটস।
চুক্তিস্বাক্ষর এই সুপরিকল্পিত এবং দীর্ঘস্থায়ী চক্রান্তের একটি পর্ব মাত্র। ক্লাইভের তথা ইংরেজদের লক্ষ্য কিন্তু সুদূরপ্রসারী। কলকাতা পুনরুদ্ধার এই সুদূরপ্রসারী অভিপ্রায় বাস্তব করার ক্ষেত্রে প্রথম এবং আবশ্যিক পদক্ষেপ ছিল। এখন বাংলা এবং পূর্বভারতে নিজেদের একচ্ছত্র ব্যবসার অধিকার কায়েমের জন্য প্রয়োজন যে ভাবেই হোক ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসিদের সমূলে ধ্বংস করা। সেই কাজ প্রায় সম্পূর্ণ। এবার তৃতীয় এবং এই অধ্যায়ের শেষ পদক্ষেপ নেবার সময়। এই ভূখন্ডে তাদের ব্যবসায় এবং ব্যবসার একচ্ছত্র অধিকার কায়েমের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধক সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুৎ করতে হবে যে কোনও মূল্যে। এই কাজ অত্যন্ত দ্রুত সমাধা করার প্রয়োজন কারণ তাদের কাছে খবর আছে সিরাজ এইমুহূর্তে ফরাসিদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টায় আছে। মিরজাফরের সঙ্গে গোপন চুক্তি এই পদক্ষেপের প্রথম ধাপ। ক্লাইভ জানত যে মিরজাফরকে দিয়ে চুক্তি সই করানো আর তাকে দিয়ে কাজ করানো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। এখনও যেতে হবে অনেকটা পথ। ক্লাইভ জানে এই যুদ্ধজয়ের একমাত্র অস্ত্র বিশ্বাসঘাতকতা যার নাম মিরজাফর। আর সেইজন্যই এত তোড়জোড় এবং চুক্তিস্বাক্ষর। কিন্তু মুস্কিল হল এই যে মিরজাফর এখন বেসুরে বাজছে। ক্লাইভের মনে হচ্ছে সযত্নে এবং বহুপরিশ্রমে সৃষ্ট এই ঐকতানে কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটছে। ক্লাইভ বুঝতে পারছে পায়ের নিচে মাটি ক্রমশ পিচ্ছিল হয়ে উঠছে।
চন্দননগর থেকে যাত্রা শুরু করার পর প্রতিদিন ক্লাইভ মিরজাফরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু মিরজাফর নিরুত্তর। বেশ কিছুদিন পরে গতকাল অর্থাৎ ১৭ই জুন মিরজাফরের কাছ থেকে একটা খবর এসেছে যার অর্থোদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। মিরজাফর জানিয়েছে যে সিরাজের সঙ্গে তার বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে এবং সে সিরাজকে কথা দিয়েছে যে কোনও অবস্থাতেই সে ইংরেজদের সাহায্য বা সমর্থন করবে না। কিন্তু চুক্তি কার্যকর করার ব্যাপারে সে কোনওরকম গাফিলতি করবে না। ক্লাইভ মিরজাফরের ব্যাপারে স্বভাবতই সন্দিহান। যে লোক তার নিজের দেশ এবং নবাবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে সে যে ক্লাইভের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে তার স্থিরতা কোথায়? টাকা এবং ক্ষমতার লোভে নিজেদের যে কোনও জায়গায় নামিয়ে নিয়ে যেতে পারে এরা। যারা কোনওরকম নীতির ধার ধারে না তাদের কাছে চুক্তিভঙ্গ তো সামান্য ব্যাপার। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসাবে ক্লাইভ কাশিমবাজার যাত্রা স্থগিত করে দিল। সিদ্ধান্ত নিল যতক্ষণ পর্যন্ত মিরজাফরের আচরণে এবং কাজে সে নিশ্চিত হয়ে তার প্রতি ভরসা করতে পারবে ততক্ষণ আর এগোবে না যে। চরম উৎকণ্ঠায় দু’দিন কেটে গেল। ইতিমধ্যে আজ ১৮ই জুন বর্ষা শুরু হয়ে গেল বাংলায়। শীত এবং বসন্ত অতিক্রান্ত হলে মার্চ মাসের মাঝামাঝি গরমের প্রকোপ বাড়তে থাকে এই অঞ্চলে। এইসময় একদিন উষ্ণ এবং আর্দ্র দক্ষিণ-পূর্ব হাওয়ার সঙ্গে মিলন ঘটে শীতল এবং শুষ্ক উত্তর-পশ্চিম হাওয়ার। জন্ম হয় বিধ্বংসী ঝড়ের যার নাম কালবৈশাখী। তার কিছু পরেই জুনের মাঝামাঝি বর্ষা নামে। এই বর্ষার গতিপ্রকৃতির ওপর নির্ভর করে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-মৃত্যু।
ইতিমধ্যে ক্লাইভ তার একান্ত বিশ্বস্ত মেজর কুটেকে পাঠিয়েছিল কাটোয়া ফোর্ট অভিযানে। পূর্ব বর্ধমানের অজয় নদের ধারে এই কাটোয়া দূর্গ। তখন ইংরেজরা কলকাতা কেড়ে নিয়েছে সিরাজের কাছ থেকে। সিরাজ পিছু হটেছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। তার কথা এবং আচরণে প্রাণের ভয়ে ইংরেজদের প্রতি বশ্যতাস্বীকারের অভিপ্রায় স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে প্রতিদিন। সিরাজের সৈন্যবাহিনী দ্বিধাগ্রস্থ। সুতরাং এই অবস্থায় যা ঘটার তাই ঘটল। ইংরেজ সেনাদের নদী অতিক্রম করতে দেখে সিরাজের সৈন্যরা নিজেদের অস্থায়ী ছাউনি পুড়িয়ে দিয়ে দূর্গ ছেড়ে চম্পট দিল। ১৮ই জুন কাটোয়া দূর্গ দখল করে কাটোয়া দূর্গ থেকেই পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা করছিল ক্লাইভ। কিন্তু মিরজাফরের আচরণে ও ইঙ্গিতে ক্লাইভের অবস্থা এই মুহূর্তে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা অসহায়। ১৯শে জুন কাটোয়া থেকেই ক্লাইভ ফোর্ট উইলিয়ামে বার্তা পাঠাল যে অবিলম্বে সেই সমস্ত ক্ষমতাবান ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে যারা ব্যবসাসূত্রে বা অন্য কোনও কারণে ইংরেজদের বন্ধু যাদের মধ্যে অবশ্যই আছে মোগলরাজের উজির গাজিউদ্দিন খাঁ যিনি পরবর্তী নবাব হিসাবে মিরজাফরের যোগ্যতা সম্পর্কে গোড়া থেকেই সন্দিহান। এই দু’দিন ক্লাইভকে খুবই ম্রিয়মান দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ক্লাইভ এখন নিজের চাকরি বাঁচাতে ব্যস্ত।
ক্লাইভ জানাল যে তার মনে হচ্ছে যে মিরজাফর যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে বা নবাবের বিরুদ্ধাচরণ করার মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলে তাহলে এই অভিযান বাধাপ্রাপ্ত হবে। সে জানাল যে সে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে মিরজাফর সিরাজের কবল থেকে বেরিয়ে আসে এবং ইংরেজদের পাশে এসে দাঁড়ায়। এই মুহূর্তে যুদ্ধস্থল হিসাবে সে পলাশিকেই নির্বাচন করেছে এবং একথা স্পষ্টভাবে মিরজাফরকে জানিয়ে দিয়েছে যে ইংরেজদের প্রতি তার বিশ্বস্ততা এবং দায়বদ্ধতার যথেষ্ট প্রমাণ না পেলে সে নদী অতক্রম করবে না। সে আরও জানাল যে এই পরিস্থিতিতে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে যাতে তার সৈন্যবাহিনীর মনোবল অটুট থাকে এবং বর্তমান পরিকল্পনা কার্যকর না হলে তাকে অন্য কোনও অন্তর্ঘাতের পরিকল্পনা করতে হবে অর্থাৎ মিরজাফরের মত অন্য কাউকে নবাবির লোভ দেখিয়ে ভাঙ্গিয়ে আনতে হবে।
২০শে জুন খবর পাওয়া গেল যে ওয়াট প্রেরিত জনৈক গুপ্তচর মিরজাফর এবং তার ছেলে মিরানের সঙ্গে গোপনে তাদের প্রাসাদে দেখা করেছে।যখন কথা চলছিল তখন হঠাৎ সিরাজের অনুগত কয়েকজন এসে পড়ায় আলোচনা বিঘ্নিত হয়। তবে সিরাজের লোকেদের বিভ্রান্ত করার জন্য মিরান চিৎকার করে জানায় যে ক্লাইভের বাহিনী যদি নদী অতক্রম করে তবে তার এবং ইংরেজ সৈন্যদের মুন্ডচ্ছেদ করা হবে। ক্লাইভ আর একটু নিশ্চিত হল যখন মিরজাফরের খুব সংক্ষিপ্ত চিঠি এসে পৌঁছল ঐ দিন সন্ধ্যায়। সেই চিঠিতে মিরজাফর জানিয়েছে যে পরেরদিন অর্থাৎ ২১শে জুন সে যাত্রা শুরু করবে এবং তার থাকার স্থান যেন ইংরেজ সৈন্যশিবিরের পাশেই করা হয়। এতদিন তার পক্ষে কোনওরকম সংবাদ প্রেরণ করা সম্ভব হয়নি। সিরাজের লোকেরা তার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে এবং সমস্ত রাস্তা জুড়ে সিরাজের লোকেরা পাহারায় আছে। ইংরেজ শিবিরে যোগদান করে সে সমস্ত খবর জানাবে। ততক্ষণ যেন ক্লাইভ এবং তার সেনাবাহিনী সাবধানে থাকে। মিরজাফরের চিঠি পেয়েও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারল না ক্লাইভ। এই চিঠিতে না আছে মিরজাফরের আগামী পরিকল্পনার ইঙ্গিত, না আছে ইংরেজদের পরবর্তী গতিবিধি সংক্রান্ত কোনও প্রস্তাব। অন্য কোনও উপায় না দেখে ক্লাইভ সিরাজ বিরোধী বর্ধমানের রাজা তিলকচাঁদকে এক হাজার অশ্বারোহী সৈনিক পাঠাবার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠাল। অনেক যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ক্লাইভ জানত যে প্রভূত সংখ্যায় অশ্বারোহী সৈন্য ছাড়া এই যুদ্ধে জয়লাভ অসম্ভব। বীরভূমের রাজা আসাদুজ্জামানের কাছেও তিনশ অশ্বারোহী সৈন্যের অনুরোধ জানিয়ে লিখল যে যদি তার বাহিনী সঠিক সময়ে তার কাছে এসে পৌঁছয় তবে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তার কাছ থেকে কোনওরকম খাজনা নেওয়া হবে না। প্রজাদের কাছ থেকে সংগৃহীত খাজনার পুরোটাই সে নিজের কাছে রাখতে পারবে। তাছাড়াও সৈন্য পাঠানোর যাবতীয় খরচ ইংরেজরা বহন করবে। যদিও ক্লাইভ তার শক্তিবৃদ্ধির এবং তার ছত্রছায়ায় সিরাজবিরোধী সমস্ত শক্তিকে একত্রিত করার সমস্ত রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তবুও আক্রমণের সম্ভাব্য দিন সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত নেবার অবস্থায় সে নেই। সিরাজের শিবিরের কোনও খবর তার কাছে নেই। ক্লাইভের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে চরম অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে। এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিৎ সেই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য ২০জন অফিসার বিশিষ্ট একটি যুদ্ধ পরিষদ গঠন করল ক্লাইভ। আলোচনার বিষয় হল,
প্রথমত, পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য কোম্পানি কাউন্সিলের নির্দেশ চাওয়ার প্রয়োজন আছে কি না?
দ্বিতীয়ত, এই মুহূর্তে সেনাবাহিনীর পক্ষে নদী পেরিয়ে কাশিমবাজার পৌঁছে যাওয়ায় ঝুঁকি পরিমাণ কতটা?
তৃতীয়ত, এই পরিস্থিতিতে আগে না এগিয়ে কাটোয়াতে ঘাঁটি পেতে বর্ষাটা কাটিয়ে দিয়ে তারপর এগোনো গেলে কী রকম হয়? দূর্গে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত করা আছে তাতে ১০০০০ সৈন্যের একবছর স্বচ্ছন্দে চলে যাবে। এর মধ্যে সিরাজের চিরশত্রু মারাঠা প্রধান বালাজি বাজিরাও এবং মারাঠা সেনাপ্রধানকে অনুরোধ জানিয়ে তাদের বহু যুদ্ধজয়ের সাফল্যমন্ডিত অশ্বারোহী বাহিনীকে নবাবের বিরুদ্ধে ইংরেজদের এই অভিযানে অংশগ্রহণ করানো যেতে পারে। এছাড়াও বর্ধমানের রাজার অশ্বরোহী সৈন্যেরাও এসে যাবে খুব শীঘ্রই। ক্লাইভের মাথায় এই ভাবনাটা খেলা করছিল অনেকদিন আগে থেকেই। মিরজাফরের দ্বিধাগ্রস্থতা এবং অনিশ্চয়তা ক্লাইভকে বাধ্য করল এই পথে চালিত হতে। বালাজি বাজিরাও বেশ কিছুদিন আগেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ক্লাইভের কাছে সাহায্যের বার্তা পাঠিয়েছিল। জানিয়েছিল দেড় লক্ষ মারাঠি সৈন্য নিয়ে নানাসাহেব স্বয়ং এই যুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে। নানাসাহেব লিখেছিল যে এই সাহায্য গ্রহণ করা ইংরেজদের কাছে ফরাসিদের বিতাড়ন করার ক্ষেত্রেও কার্যকরী ভূমিকা নেবে। ইংরেজরা জলপথে ফরাসিদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী সে কথা সত্য এবং নবাব এবং ফরাসিরা সে ব্যাপারে অবহিত। কিন্তু স্থলপথে ফরাসিরা ইংরেজদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী এবং ৫০০০০ পদাতিক সৈন্য নিয়ে জিন ল আগামী তিন-চার দিনের মধ্যেই কাশিমবাজার এসে পৌঁছবে।
যুদ্ধ পরিষদের বৈঠকে নিচের তলার অফিসারদের প্রথমে মতামত দেওয়ার প্রচলিত নীতি বদল করে ক্লাইভ নিজেই প্রথমে যুদ্ধ আপাতত বর্ষাকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখার প্রস্তাব দিল। কিন্তু বোঝা গেল যুদ্ধ পরিষদের অনেকেই অবিলম্বে যুদ্ধ শুরু করার পক্ষে। এদের মধ্যে অন্যতম মেজর কুটে। যেহেতু সর্বাধিনায়ক ক্লাইভ নিজের মতামত প্রথমেই জানিয়েছে সুতরাং অনেক অফিসারই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেজর কুটেকে সমর্থন জানাল না। অবশেষে ১৩-৭ ভোটে যুদ্ধ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেল যুদ্ধ পরিষদের বৈঠকে। কুটে কিন্তু হাল ছাড়বার পাত্র নয়। তার যুক্তি হল একের পর এক সাফল্য এসেছে ইংরেজ সেনাবাহিনীর। একের পর এক যুদ্ধ জয় করে ইংরেজ সেনাদের মনোবল এখন তুঙ্গে। পরের যুদ্ধ জয় করার জন্য তারা প্রস্তুত। যুদ্ধজয়ের নেশা তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আরেক যুদ্ধক্ষেত্রে। এমতাবস্থায় তাদের বসিয়ে দেওয়ায় অর্থ তাদের অভ্যাস এবং মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া। পরবর্তী কালে যুদ্ধের সময় সেই মনোবল বাড়ানো অসম্ভব। এই মুহূর্তে তাদের গতি তীব্র এবং দক্ষতা শাণিত। অকারণ দীর্ঘসূত্রতা তাদের গতি মন্থর এবং দক্ষতা হ্রাস করে দেবে। সুতরাং চরৈবতি। এছাড়াও ল-এর বাহিনী কাশিমবাজার পৌঁছে গেলে নবাবের শক্তি অনেক বেড়ে যাবে। তাছাড়াও চন্দননগর আক্রমণের সময় যে সমস্ত ফরাসিদের বন্দি করে এনে জোর করে ইংরেজ সেনাবাহিনীতে ঢোকানো হয়েছে তার বিন্দুমাত্র সুযোগ পেলে যুদ্ধক্ষেত্রে শিবির বদল করবে। এটাই স্বাভাবিক। যা করার ফরাসিরা পৌঁছনোর আগেই করতে হবে। কলকাতা থেকে কাটোয়ার দূরত্ব অনেক বেশি। যেহেতু ইংরেজ সৈন্যরা কাটোয়াতে স্বেচ্ছাবন্দি নবাবের লোকেরা আপ্রাণ চেষ্টা করবে কলকাতার সঙ্গে কাটোয়ার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে। তাদের বাধা দেওয়ার মত যথেষ্ঠ শক্তি কলকাতায় এখন নেই। সৈন্যরা এখন কাটোয়ায় আরাম করছে। একবার কলকাতা আর কাটোয়ার মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কাটোয়ার সেনাবাহিনী ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে। কুটের যুক্তি কেবলমাত্র সুচিন্তিত এবং বাস্তবসম্মতই নয় তার সাহস এবং দায়বদ্ধতা প্রশ্নাতীত এবং সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। ক্লাইভ নিজেও প্রকৃত অর্থে একজন সত্যিকারের নেতা। ক্লাইভ যুদ্ধজয়ের স্বার্থে যুদ্ধ পরিষদের সিদ্ধান্ত যে সিদ্ধান্ত আসলে ক্লাইভ নিজেই নিয়েছিল এবং পরিষদে পেশ করেছিল সেই সিদ্ধান্ত থেকেই সরে আসার ব্যাপারে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। প্রায় একঘন্টা পাশে নির্জন আমবাগানে চিন্তামগ্ন থাকার পর ফিরে এসে ক্লাইভ জানাল যে পরের দিন সকালে ইংরেজ সেনাবাহিনী নদী পেরিয়ে যাত্রা শুরু করবে। তবুও ক্লাইভের অন্তরে কোথাও যেন একটা অনিশ্চয়তা এবং ভয় দানা বেঁধে উঠেছে। কোম্পানি কাউন্সিলকে লেখা চিঠিতে ক্লাইভ জানাল যে মিরজাফরের নিরুত্তর থাকা তাকে বিব্রত করছে এবং সে জানে না এখন তার আশুকর্তব্য কী হওয়া উচিৎ। ইংরেজদের পক্ষ না নিলেও সে যেন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে - মিরজাফরের কাছ থেকে এই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি নেওয়ার কথা ভাবছে সে। তার কাছে খবর আছে সিরাজের সৈন্যসংখ্যা এখন ৮০০০। কিন্তু টাকা বাড়িয়ে এই সংখ্যা বাড়ানো সিরাজের কাছে অসুবিধেজনক নয়। কিন্তু ক্লাইভের বিশ্বাস যে কলকাতা পুনর্দখলের পর থেকে সিরাজ খুব ভয় পেয়ে আছে। সেক্ষেত্রে সিরাজের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রস্তাব আসা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে চন্দননগর দখলের পর সিরাজ আরও ভীত হয়ে পড়েছে। তবুও মোগল উজির গাজিউদ্দিন খান এবং সিরাজের চিরশত্রু বালাজি বাজিরাওকে সহযোগিতা এবং সাহায্যের জন্য আবেদন করা প্রয়োজন। কোম্পানি কাউন্সিল তার এই অনুরোধ রাখবে বলেই সে আশা করে।
পরবর্তীকালে ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ হাউস অফ কমনসে যখন ক্লাইভের ভারতে অবস্থানকালীন আচরণ সম্পর্কে পর্যালোচনা এবং জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল তখন ক্লাইভ বলেছিল যে যদি তার নিজের এবং যুদ্ধ পরিষদের সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে সেদিন সে মেজর কুটের প্রস্তাব মেনে না নিত তাহলে সেদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেওয়া হত। নিজের এবং যুদ্ধ পরিষদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে এই প্রস্তাব মেনে নেওয়া তার জীবনের অন্যতম সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।
মনোজবাবু, আমি আগেও বলেছি, প্রযুক্তিবিদ হয়ে আপনি ঐতিহাসিক গল্প লিখছেন, অবশ্যই তারিফ করতে হবে। এবং যথারীতি ভালো একটি ধারাবাহিক আপনি পাঠকদের উপহার দিচ্ছেন।
ReplyDeleteসুন্দর, সাবলীল গল্প -চ্ছলে ইতিহাসের কাহিনী।পড়তে গিয়ে ক্লান্তি আসেনা।তরতর করে এগিয়ে চলে।আরেকটু সমৃদ্ধ হলাম।
ReplyDeleteপরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
ঐতিহাসিক ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষন। কুট সাহেবের কূটনীতি!
ReplyDeleteমনোজদা, খুব ভালো লাগলো! অনেক নতুন কিছু জানলাম! মিরজাফর ছাড়া ও আরো অনেক রাজা, নবাব এই যুদ্ধে ক্লাইভের দলে ছিলেন! আমরা পড়েছি যে সাধারণ মানুষ ও সিরাজের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে পড়েছিল! যুদ্ধে ক্লাইভ হেরে গেলে, ভারতের ইতিহাসটাই পাল্টে যেত। ভালো হতো কিনা, সেটা তর্কের বিষয়! তবে মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় দেশের ক্ষতি হল না লাভ? আকর্ষণীয় বিষয়!
ReplyDelete