0

সম্পাদকীয়

Posted in


অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
   জীবনানন্দ দাশ


আশৈশব লালিত সমস্ত নৈতিকতার নিরন্তর ভরাডুবি দেখতে দেখতে মনে হয় পংক্তিগুলি বুঝিবা এই মুহূর্তেই কলম নিঃসৃত। একসময় আমাদের বোঝানো হয়েছিল মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম। নিঃসন্দেহে। কিন্তু সেই মগজ ধোলাইয়ের ফল কী হয়েছিল, তা আমরা সবাই জানি। একাধিক প্রজন্মকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল অন্ধকার, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। তার জের এখনও বহমান। শিক্ষাক্ষেত্রে অভাবনীয় দুর্নীতির ফলে আমাদের অস্তিত্ব যখন বিপন্ন, আরেক তুঘলকি সিদ্ধান্ত স্তম্ভিত করে দিল আমাদের। দাবদাহের কারণে এক সরকারি নির্দেশিকার বলে এক পক্ষকাল বেড়ে গেল বিদ্যালয়গুলির গ্রীষ্মকালীন অবকাশ। এ ও হয়?

কোনও এক সময়ে তিনি বলেছিলেন, তিনি বেতন দেন, তাই বিদ্যালয় পরিচালনার বিষয়ে তিনিই শেষ কথা। তাই? নিশ্চয়ই! না হলে একতরফা সিদ্ধান্তে এমন একটি হিতাহিতবোধরহিত কাজ করা যায়? অনেকে এর পিছনে নানান অভিসন্ধি খুঁজছেন। সে অনুসন্ধানের দায় আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের অন্যতর একটা দায়িত্ব থেকে যায়। প্রশ্ন তোলার দায় তথা দায়িত্ব। আমাদের মধ্যে যাদের বয়স অন্তত পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ কি মনে করতে পারি গরমের এমন তীব্রতা আগে কখনও দেখা যায়নি? পরিসংখ্যান ও একই কথা বলবে। তাহলে? উত্তরগর্ভ সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা অথবা অগ্নিপথ বা সৃজিতের ফেলুদার বিশ্লেষণ করা একই রকম নিষ্প্রয়োজন। 

মা বলতেন, কোনও পরিস্থিতিতেই স্নিগ্ধতা হারিয়ে ফেলো না! হায়! সেই স্নিগ্ধতাই আজ হারিয়ে গেছে... জীবনের সর্বক্ষেত্র থেকেই...

তবুও অলীক আশায় বুক বাঁধি...
যে শৈশবের হাতে সমর্পিত আমাদের ভবিষ্যৎ, সেই শিশুদের মঙ্গল হোক!

সতর্ক থাকুন, সৃজনে থাকুন
শুভেচ্ছা অফুরান

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সজল কুমার মাইতি

Posted in





বাঙালি আড্ডাপ্রিয় জাতি। আড্ডা দিতে ভালবাসে। আর কেরানির চাকরি কিংবা পৈতৃক সম্পত্তির দেখভাল করা। এর বাইরে ব্যবসা বাণিজ্য? নৈব নৈব চ। বাঙালি ব্যবসায় বিমুখ। এই অভিযোগ বরাবরের। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে বাঙালির ব্যবসার ইতিহাস খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। ব্যবসার ঝুঁকি বহনের স্বাভাবিক ক্ষমতা বাঙালিদের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না। তবুও ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে বাঙালির ব্যবসায় কিছু কিছু উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের সন্ধান পাওয়া যায়।

স্বদেশী আন্দোলন, বাংলার নবজাগরণ ও শিল্পোদ্যোগ

লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ নীতির প্রতিবাদে ১৯০৫ সালে আপামর বাঙালি আন্দোলনে নামেন। বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে বাঙালি গর্জে ওঠে। বিদেশী জিনিস বর্জন ও স্বদেশী জিনিস ব্যবহার ও তৈরিতে উদ্যোগী হতে উৎসাহ দেখা যায় বাঙালির মধ্যে। বাংলায় নবজাগরণ এর ঢেউ এই সময়ে বাঙালির এই মানসিকতাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। রামমোহন রায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ও আরও অনেক মনীষী এই কাজে অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছেন। বিকল্প স্বদেশী জিনিস তৈরিতে বিভিন্ন বাঙালি মনীষা এগিয়ে আসেন। দেশীয় জিনিসের শিল্প গড়া ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনার সম্প্রসারনের মাধ্যমে জাতীয়তা বোধে উদ্বুদ্ধ করেন। দেশীয় জিনিস তৈরির জন্য কোম্পানি প্রবর্তন শুরু করেন। বাংলা স্বদেশী উদ্যোগপতির আবির্ভাব দেখতে পায় এই ব্রাহ্মমুহূর্তে। অগ্রনীদের মধ্যে মার্টিন বার্ন কোম্পানির স্যার রাজেন মুখার্জি ও বেঙ্গল কেমিক্যালের আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।

উনিশ শতকের বাঙালি উদ্যোগপতি

বিশ শতকের আগে ও বাঙালিকে উদ্যোগপতির ভূমিকায় দেখা গেছে। উনিশ শতকের প্রথমদিকে এক বিখ্যাত বাঙালিকে এই ভূমিকায় দেখা যায়। তিনি প্রিন্স দ্বারকা নাথ ঠাকুর। ব্রিটিশদের সঙ্গে যৌথভাবে বিভিন্ন কারবারে দ্বারকানাথের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বিশেষত ব্যাংক, বীমা ও জাহাজ ব্যবসায় তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি প্রথম ভারতীয় যিনি ব্যাংক ডিরেক্টর নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি প্রথম অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ম্যানেজিং এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিলেন। Carr,Tagore and Company এই ম্যানেজিং এজেন্সি। পাট, কয়লা, চা ও অন্যান্য অনেক শিল্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিল এই এজেন্সি। তিনি প্রথম বাংলায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। 'ব্যাংক অফ বেঙ্গল' নাম ছিল সেই ব্যাংকের। পরে এই ব্যাংক ' ইম্পিরিয়াল ব্যাংক' নামে পরিচিত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৫৫ সালের ১ লা জুলাই এই ব্যাংক বর্তমানে ভারতের সর্ববৃহৎ ব্যাংক 'স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া' নামে পরিবর্তিত হয়। এই Carr, Tagore and Company পরবর্তীকালে জলপরিবহনের ব্যবসায় ও নিযুক্ত হয়। কয়লা, গাঁজা ব্যবসায় ও দেখা এই কোম্পানির অংশগ্রহণ। এই কোম্পানি চীনা চা এর ব্যবসায় ও অংশগ্রহণ করে। চীনে গাঁজা রপ্তানিতে এই কোম্পানির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এই ব্যবসার উদ্যোগ হয়তো জাতীয়তা বোধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিল না, তবুও ব্যবসায় বাঙালির উদ্যোগ অস্বীকার করা যায় না।

জাতীয়তাবাদ ও বাংলার উদ্যোগপতি

বিশ শতকের শুরুর দিকের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র স্যার রাজেন ও প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। স্যার রাজেন মুখার্জি মিঃ মার্টিনের সঙ্গে অংশীদারিত্বে মার্টিন কোম্পানি গঠন করেন। পরে এই কোম্পানি মার্টিন বার্ন কোম্পানি নামে অধিক পরিচিতি লাভ করে। এই কোম্পানি বহু কীর্তির স্বাক্ষর রেখে গেছে। ত্রিপুরা, পলতা, আমেদাবাদ ও বেনারসে জলসরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলে ছিল এই কোম্পানি। আজকের কলকাতার বিভিন্ন হেরিটেজ সৌধ মার্টিন কোম্পানি তৈরি করেছিল। এদের মধ্যে টিপু সুলতান মসজিদ, গার্ডেন রিচ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বেলুড় মঠ, এসপ্ল্যানেড ম্যানশন, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, বিধানসভা ভবন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। একসময় কলকাতা মার্টিন সিটি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। এছাড়াও আরও অনেক উল্লেখযোগ্য নির্মানের কীর্তি এই কোম্পানির তালিকায় ছিল।

আর আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের বেঙ্গল কেমিক্যাল বিভিন্ন ওষুধ ও দ্রব্য নিয়ে তার গুরুত্ব এখনো বাংলায় ও বাঙালির হৃদয়ে স্থান করে রাখতে পেরেছে। ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইন এখনো সারা দেশে ও বিদেশে রপ্তানিতে এই কোম্পানির ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই কোম্পানি আমাদের দেশের সর্ববৃহৎ কেমিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ছিল এবং ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে এদেশে এই কোম্পানি পথিকৃৎ ছিল। এই কোম্পানির 'অ্যাকোয়াটাইকোটিস, ফিনাইল' এখনও জনপ্রিয় দ্রব্য হিসেবে বাজারে তার সুনাম বজায় রেখেছে।

এছাড়াও ১৯১৬ সালে কে সি দাশ ( ইনি বিখ্যাত মিষ্টির দোকানের প্রতিষ্ঠাতা নন), বি এন মৈত্র ও আর এন সেন তিন বাঙালি উদ্যোগপতি মিলে 'ক্যালকাটা কেমিক্যাল কোম্পানি' নামে এক ওষুধ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। স্বদেশী ওষুধ কোম্পানির চিন্তা ভাবনা থেকে এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠা। এই কোম্পানির দুটি উল্লেখযোগ্য প্রডাক্ট হল নিমজাত মার্গো সাবান ও ল্যাভেন্ডার ডিউ পাউডার আজও জনপ্রিয়। এই কে সি দাশ ছিলেন দক্ষিণ কলকাতার ভারতীয় জাজ রায় বাহাদুর তারক চন্দ্র দাশ ও মোহিনী দেবীর সন্তান। ইনি পেশায় কলেজ শিক্ষক ছিলেন। ১৯০৪ সালে কে সি দাশ শিক্ষার জন্য জাপান রওনা হন। সেখান থেকে আমেরিকা যাত্রা করেন। তাঁর এই শিক্ষার জন্য জলপানির ব্যবস্থা করেছিল ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্টিফিক ইন্ডাস্ট্রি। তিনি সেখানে বার্কলের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়াতে ভর্তি হন। পরে ১৯০৭ সালে তিনি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা ও শিক্ষাদানের পদ্ধতির কারনে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিদ্যায় সম্ভবত প্রথম ভারতীয় গ্রাজুয়েট ছিলেন কে সি দাশ ও সুরেন্দ্র মোহন বোস। এই কে সি অসংখ্য বাঙালি যুবককে আর্থিক সাহায্য করেছেন তাদের ব্যবসার স্বপ্ন সফল করার জন্য। তার মধ্যে যেমন হকার, স্ট্রীট ভেন্ডার আছে, তেমন আছে অনেক ছোট্ট ব্যবসায়ী। জাতীয়তা বোধে বাংলার গৌরবময় কীর্তি প্রতিষ্ঠার এই প্রয়াসে কে সির অবদান অনস্বীকার্য।

বার্কলে ও স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করা সুরেন্দ্র মোহন বোস ছিলেন বিখ্যাত সেই 'ডাকব্যাক কোম্পানি' র প্রতিষ্ঠাতা। ' বেঙ্গল ওয়াটার প্রুফ লিমিটেড ' নামে প্রথমে রেজিটার্ড করা হয়, 'ব্রান্ড নেম হিসেবে ' ডাকব্যাক' বাঙালির ঘরে ঘরে পরিচিতি লাভ করে। রবার দ্রব্য, জুতো, রেনকোট, হটব্যাগ আরও অনেক কিছু তৈরি করতো এই কোম্পানি।

এর বাইরে ও 'বেঙ্গল ইমিউনিটি' ভারতীয় পরিবেশে উপযোগী অ্যান্টি টক্সিন ওষুধ তৈরি করে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। তৎকালীন ইউরোপীয়দের মধ্যে এই এই ওষুধ বিস্ময়ের ও ঈর্ষার সৃষ্টি করেছিল। এই ' বেঙ্গল ইমিউনিটি' প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯১৯ সালে। এর মূল প্রবর্তকদের মধ্যে ছিলেন স্বনামধন্য ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, ডাঃ নীলরতন সরকার, স্যার কৈলাশ চন্দ্র বসু, ডাঃ চারুচন্দ্র বসু ও আরও অনেকে। বাঙালির এই উদ্যোগ সারা দেশের নজর কেড়েছিল। 'দেজ কেমিক্যাল' ওষুধ শিল্পে বাঙালি উদ্যোগপতির আর একটি অবদান। আজও ধীরেন দে এই প্রতিষ্ঠান সসম্মানে নিজের কীর্তি ও সুনাম বজায় রেখে দেশে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

সাইকেল শিল্পে 'সেন রালে কোম্পানি' র কীর্তি অক্ষয় হয়ে আছে। বাঙালির মন থেকে বিস্মৃতপ্রায় শিল্পোদ্যোগী সুধীর কুমার সেন সারা দেশে সস্তায় পরিবহনের এই যান উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই সময়ের বিখ্যাত রালে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে এই দেশে পরিবেশবান্ধব পরিবহনের ব্যবস্থার জন্য সেন মহাশয় আজও বাঙালির হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। দেশের লোকের মধ্যে এই যানকে জনপ্রিয় করতে সফল ও হয়েছিলেন।

এছাড়াও দেশলাই শিল্পে 'বন্দে মাতরম' প্রডাক্টের ক্ষেত্রেও বাঙালির অবদান অনস্বীকার্য। এই ম্যাচবক্স শিল্প মূলত কুটির শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছিল। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে নামে ' বন্দে মাতরম' এর প্রভাব দেখা যায়। বস্ত্রশিল্পে শ্রীরামপুরের 'বঙ্গলক্ষী কটন মিলস' ও বাঙালি উদ্যোগপতির দেশীয় জিনিসের প্রতি দেশবাসীর আবেগ বৃদ্ধির এক প্রয়াস। বিদেশী ল্যাঙ্গাশায়ারের কাপড়ের পরিবর্তে দেশের কাপড় দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করার বাঙালির এক অদম্য প্রচেষ্টা। এছাড়াও 'মোহিনী মিলস', 'বাউড়িয়া কটন মিলস' (১৮১৮) ও 'ফোর্ট গ্লস্টার কটন মিলস' (১৮৩০) বস্ত্রশিল্পে বাঙালি উদ্যোগপতির অবদান। স্বদেশী আন্দোলনে এই সকল শিল্প দেশীয় দ্রব্যের উৎপাদন ও বিক্রি বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল।

১৯০৫ সালে কলকাতার ট্যাংরা রোডে 'ক্যালকাটা পটারি' র পত্তন হয়। পরে ১৯১৯ সালে এটি 'বেঙ্গল পটারি' নামে নতুন কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়। মূলত খেলনা, ক্রকারি ও বৈদ্যুতিক ইনসুলেটার তৈরিতে নিযুক্ত ছিল এই কোম্পানি। পরবর্তী কালে আর্থিক সংকটের কারণে 'বেঙ্গল পটারি' কে অধিগ্রহণ করে দিল্লীর 'গোয়ালিয়র পটারি' ১৯৩৪ সালে। এম কে ভগত ছিলেন এই কোম্পানির সর্বময় কর্তা। সেই সময় বেঙ্গল পটারির কর্মী সংখ্যা ছিল ৬০০ এর ওপর। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে সরবরাহে এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ছিল। পরে জি কে ভগত, একজন আমেরিকা থেকে সিরামিক ইন্জিনিয়ারিং এ পাশ করা ব্যক্তি, এই কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

আমাদের দেশে প্রথমে গ্যাসবাতি ছিল। বিশ শতকের প্রায় মধ্যভাগে জমিদার পরিবারের তিন ভাই সুরেন, হেমেন ও কিরন শঙ্কর রায় ' বেঙ্গল ল্যাম্পস' নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে প্রথম এই দেশে ইলেকট্রিক বাল্ব ব্যবহারের সুযোগ করে দেন। এদের মধ্যে সুরেন ও কিরন জার্মানি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং পাশ করা। এরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে পাঠদান ও করেছেন। আর হেমেন ছিলেন দক্ষ প্রশাসক। বহু বিতর্কের জন্মদাতা এই বেঙ্গল ল্যাম্প আজও বাঙালির কাছে অচেনা নয়।

১৯১৯ সালে বাঙালি তথা সারা দেশবাসীকে বৈদ্যুতিক পাখার বাতাস খাওয়ার সুযোগ করে দেন বাঙালি উদ্যোগপতি ক্ষীরোদ বিহারী চক্রবর্তী। এই উদ্যোগে আর্থিক সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন ময়মনসিংহের মহারাজা রাজেন্দ্র কিশোর ও পাইকপাড়ার কুমার অরুণ সিং। এই ' ক্যালকাটা ফ্যানস কোম্পানি ' ডি সি ফ্যানের জনপ্রিয়তা এখনো শোনা যায়। বহু বছর ধরে এই ফ্যান বাঙালির ঘরে ঘরে শোভা পেত।

বিখ্যাত 'সুলেখা কালি কোম্পানি' র প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ননীগোপাল ও শঙ্করাচার্য মৈত্র ভাতৃদ্বয়। এই সুলেখা বহু বছর ধরে বাংলা তথা সারা দেশে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে গেছে। ছাপা বিশেষ করে আধুনিক ছাপা অর্থাৎ অফসেট প্রিন্টিং এর ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন সুবোধ মজুমদার। তিনি 'সরস্বতী প্রেস ' প্রতিষ্ঠা করে বাঙালির গর্বের ক্ষেত্র বাড়িয়েছেন। গ্রামীন এলাকায় ব্যাংকিং পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছিলেন। 'ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া ' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি বাঙালির অস্মিতা বৃদ্ধি করেছেন।

এছাড়াও হোসিয়ারি শিল্পে 'গোপাল হোসিয়ারি ' তার গুনমানের জন্য আজও জনপ্রিয়। ব্যাটারি শিল্পে 'ভারত ব্যাটারি ম্যানুফ্যাকচারিং' একসময় অতি পরিচিত নাম ছিল। পর্যটনে শ্রীপতি চরন কুন্ডুর ' কুন্ডু স্পেশাল ' সুনাম বজায় রেখে এখনো বর্ধমান। বেকারি শিল্পে ' আর্য বেকারি এন্ড কনফেকশনারি' একসময়ের পরিচিত নাম। শুরু ও শেষে মিষ্টি মুখ এখন আর বাঙালির একচেটিয়া নয়। প্রত্যেক ভারতীয়র এখন পরম্পরা। সেই মিষ্টি শিল্পে ও বাঙালির আসন তখনকার মতো এখনো বজায় আছে। কে শি দাসের রসগোল্লা ও নকুড়ের সন্দেশ এখনো তার গুনমান বজায় রেখে বাঙালির ব্যবসা বজায় রেখেছে।

এই সকল বাঙালি উদ্যোগপতি শুধু জাতীয়তাবাদী ছিলেন না, সারা দেশে যুবকদের কাছে এখন ও রোল মডেল। যে কঠিন পরিস্থিতিতে এদের অনেকেই বিদেশি ডিগ্রির অধিকারী হয়ে ও চাকরি সুখের নিদ্রায় মগ্ন না থেকে ব্যবসার ঝুঁকি ও টেনশন নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ও নিজের নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে গেছেন। এখনকার অনেককিছু পাওয়া বাঙালি যুবক তাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হলে আখেরে লাভবান হবে বাংলা ও বাঙালি।


তথ্য ঋণ:

রাধেশ্যাম রাংতা, 'দি রাইজ অফ করপোরেশনস ইন ইন্ডিয়া '
এন কে সেনগুপ্ত, ' গভর্নমেন্ট এন্ড বিজনেস'
কৌস্তভ ভট্টাচার্য এর বাঙালি উদ্যোগপতি এর ওপর আর্টিকেল
সৌম্য দাশগুপ্ত এর বাঙালি উদ্যোগপতির ওপর আর্টিকেল

0 comments:

1

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in




সময়কাল খৃষ্টপূর্ব দশম কি নবম শতক। সবে উত্তরের জনপদগুলি রাজ্যে পরিণত হতে শুরু করেছে। সবে কৃষক-ক্ষত্রিয় ভূপতিগণ উদ্বৃত্ত শস্যের বিপণন শুরু করেছেন। ফলে একটি স্থানীয় বিপণন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। একদিকে ভূপতি ও অন্যদিকে বণিক সম্প্রদায়। দু’য়ে মিলে একটি পরিবর্তিত অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠছে। ফলে, ভূপতিদের ক্ষমতাকে স্বীকার করছেন ব্রাহ্মণ ঋষিগণ। এতদিনের ক্ষমতার নিরঙ্কুশ আধিপত্য থেকে সরে সরে যাচ্ছেন তাঁরা। ফলে, একটি কূটনৈতিক সমাধানে ব্রতী হলেন ভারতের তৎকালীন ব্রাহ্মণ ও কৃষক-ক্ষত্রিয় কুল। তাঁরা স্থির করলেন, একাধিপত্যের পরিবর্তে একটি সংঘবদ্ধ আধিপত্য থাকুক। তাহলেই সকলের মঙ্গল।

এসময়ে নারীর অবস্থান নিয়ে ভাবতে গিয়ে চোখে পড়ল উপনিষদের দুটি কাহিনীতে। তাই নিয়েই এই নিবন্ধ।

এই সময় মিথিলার অধিপতি, তৎকালীন জনক বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন। তিনি মিথিলা নামক গণরাজ্যের নির্বাচিত প্রতিনিধি। বলে রাখা যাক, মিথিলার সমস্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিই ‘জনক’ উপাধিতে ভূষিত হতেন। তাঁকে ব্রাহ্মণ কৃষক বণিক, সকলকে নিয়ে থাকতে হয়। অত্যন্ত বলশালী, পরিশ্রমী, ও মেধাবী জনক গুরু যাজ্ঞবল্ক্যের কাছ থেকে ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করতে চান। কিন্তু গুরু কী চান? যাজ্ঞবল্ক্যের মনোজগতের এক অদ্ভুত সংঘাত নিয়ে এই রচনা, যে সংঘাতের কেন্দ্রে দুই নারী। গার্গী ও মৈত্রেয়ী। একজন তাঁর পত্নী। অন্যজন গার্গী, এক ঋষিকা। যিনি ব্রহ্মচারিণী আশ্রমবাসিনী ও যাজ্ঞবল্ক্যের সন্ন্যাসের অন্যতম কারণ।

জনক রাজর্ষি উপাধিধারী। গুরু যাজ্ঞবল্ক্যের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক। সে একদিন। ঋষিকে তিনি প্রশ্ন করছিলেন অগ্নিহোত্র বিষয়ে। যাজ্ঞবল্ক্য তাঁকে জানিয়েছিলেন, একে একে সূর্য চন্দ্র নক্ষত্র অস্তমিত হলে অগ্নিপ্রভাই জ্যোতি। মানুষ রাতের অন্ধকারে এই অগ্নির দ্বারাই কর্ম অব্যাহত রাখতে পারে। অগ্নিবলয়ের মধ্যে কোনও বন্যপ্রাণী আসেনা। তাদের শত শত জন্মের সংস্কার। অগ্নি দহন করে। তবে যাজ্ঞবল্ক্যর এই উত্তরে জনক খুশি হননি। দর্শন যদি না প্রতিভাত হয় তবে বিদ্যার মূল্য কি? তিনি জিজ্ঞেস করেছেন – আচার্য, যখন বাহিরের সব জ্যোতিই অস্তমিত তখন অন্তরে কি প্রভা বিরাজ করে? যাজ্ঞবল্ক্য বুঝেছেন। রাজা ব্রহ্মবিদ্যা চান। জনককে অদেয় কিছুই নেই। কিন্তু তিনি নিজে কি সেই অসীমকে ধারণা করতে পেরেছেন? তবু বললেন – আত্মজ্যোতিই শ্রেষ্ঠ জ্যোতি, রাজন। সেই আত্মজ্যোতি আসে আত্মার থেকে। সেই আত্মাকে সাধারণ মানুষও উপলব্ধি করতে পারে স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে। সেই হিরন্ময় পুরুষ আপনার অভিপ্রেত বিষয় সকল নির্মাণ করে স্বপ্নদ্রষ্টার চেতনায় মুদ্রিত করে দেন নিজের উপস্থিতি। য এষ সুপ্তেষু জাগর্তি, কামং কামং পুরুষো নির্মিমাণঃ, তদেব শুক্রং, তদ ব্রহ্ম, তদেব অমৃতমুচ্যতে। জনক তন্ময় হয়ে শোনেন। যাজ্ঞবল্ক্যকে মাঝে মাঝে তাঁর কবি মনে হয়। কাব্য রচনা করেন যেন! এ কি কল্পনা? নাকি উপলব্ধি? স্বপ্নে তো কত কিছুই দেখেন তিনি! কর্ষিত ক্ষেত্র, বহ্নিমান অরণ্য, রক্তচক্ষু নারী। এসবের অর্থ কী কে জানে! কিন্তু গুরু যে তাঁকে পরমত্ব দান করতে পারছেন না, তা জনক বোঝেন। কিন্তু বিশ্বাস রাখেন, একদিন যাজ্ঞবল্ক্য নিজে জানবেন ও তাঁকে জানাবেন।

একদিন রাজ্যের নানা চিন্তায় চিন্তিত জনক লক্ষ্য করলেন রাজসভায় প্রবেশ করছেন যাজ্ঞবল্ক্য। জনক তাঁর সহজাত বোধ দিয়ে বুঝেছেন, যাজ্ঞবল্ক্য অন্যরকম। তাই তাঁকে গুরু হিসেবে বরণ করেছেন। কিছুকাল আগেও এই আশ্রমিক ঋষি যথেষ্ট দরিদ্র ছিলেন। কোথাও কোনও দানের কথা শুনলেই হাজির হতেন। নিজের অর্জিত বিদ্যার থেকে কিছু দান করে চেয়ে নিতেন সমস্ত দেয়বস্তু। জনক দেখেছিলেন যাজ্ঞবল্ক্য সত্যিকারের বিদ্বান। তাঁর বিদ্যার কদর করে এমন কেউ নেই। তিনি তাই যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রচুর গোধন দিয়ে সুবর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা দিয়ে সুস্থিত করেছিলেন। ভেবেছিলেন ব্রহ্মজ্ঞ ঋষির এতেই ইহজগতের প্রয়োজন মিটবে। কিন্তু না। ন জাতু কামানাম উপভোগেন সাম্যতি। যাজ্ঞবল্ক্য আসছেন মানেই কিছু প্রার্থনা আছে। অথচ সত্যিই যাজ্ঞবল্ক্য ব্রহ্মবিদ। অন্তত সমগ্র ভারতবর্ষ সেকথা মানে। তাঁর আচার্যের তালিকায় নামগুলি দেখলেই বোঝা যায়। জিত্বা শৈলিনি, বর্কু বার্ষ্ণ, উদঙ্ক শৌল্বায়ন, সত্যকাম জাবাল, কে নয়! জনক সিংহাসন থেকে নেমে এসে তাঁকে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে বসালেন। যাজ্ঞবল্ক্য কিছু চিন্তিত। জনক জিজ্ঞেস করলেন – কি হয়েছে আচার্য? চিন্তিত কেন? কি হেতু রাজসভায় আগমন? পশু কামনায়? না আত্মবিষয়ক প্রশ্নকামনায়? যাজ্ঞবল্ক্য রাজসভায় এসে জনকের কাছে প্রশ্ন কামনা করেন, আর তার উত্তর দেন। জনক তখন বিদ্যাদানের পরিবর্তে ঋষিকে গোদান করেন। এইই প্রচলিত রীতি। আজ যাজ্ঞবল্ক্য বললেন – আপনি শুধু পুজ্য ও ধনী হয়েছেন তাই নয়, আপনি বেদজ্ঞ ও উপনিষদ উপদিষ্ট হয়েছেন। আপনি জানেন সেই অক্ষর, পুরুষ। হে জনক, আপনি তাঁকে জেনে অভয়প্রাপ্ত হন, এই কামনা করি। জনক অনুভব করছেন আজ ঋষি কিছু গুরুতর প্রার্থনা নিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন – আপনিও অভয় লাভ করুন আচার্য। এই বিদেহ আপনার নিজের রাজ্য। আমিও আপনার সেবক। এখন বলুন কি হেতু আগমন? যাজ্ঞবল্ক্য এই কথা ক’টির অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বললেন - আপনি একটি বিদ্দ্বজন সভার আয়োজন করুন রাজন। উত্তরাপথে আমার শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপনা প্রয়োজন। নাহলে ব্রাহ্মণত্বের অস্তিত্ব সঙ্কটে। কারণ ব্রাহ্মণত্বের ভিত্তি স্থিত হয়েছে পরম একক পুরুষের অস্তিত্বে। সেই ব্রহ্ম পুরুষ। অধুনা গার্গী বাচক্নবী ঘোষণা করছেন তিনি ব্রহ্মজ্ঞ। নারী কিভাবে ব্রহ্মজ্ঞ হবেন? সেই পরম এক যে পুরুষ! তিনিই উত্তমপুরুষ! কোনও নারীর অধিকার নেই ব্রহ্মবিদ্যায়। কিছুকাল হল নারীকে ব্রহ্মবিদ্যার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা চলছে। যবে থেকে আর্যপুরুষ অনার্য রমণীকে পত্নীরূপে বরণ করতে শুরু করেছে তবে থেকে রমণীকে বেদ অধ্যয়ন থেকে বিরত করার চেষ্টা সর্বস্তরে দেখা দিচ্ছে। তবু কিছু স্নেহশীল পিতা অণূঢ়া কন্যাকে নিজের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কখনও কোনও কোনও স্বামীও। যেমন যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর পত্নী মৈত্রেয়ীকে। যেমন গার্গীকে তাঁর পিতা।

তাঁর দুই পত্নীর মধ্যে কনিষ্ঠা, মৈত্রেয়ী, এমন বিদ্যা আয়ত্ত্ব করতে ভীষণ উৎসাহী। তিনি তাঁকে নানা উপায়ে বুঝিয়েছেন, নারীর গতি ষষ্ঠভূমি পর্যন্ত। সপ্তমভূমি পুরুষের অনুভব। নারীদেহে তা অসম্ভব। যাজ্ঞবল্ক্য ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে পড়ছেন। নারীমাত্রই, পত্নীমাত্রই স্বামীর সুখের জন্য, ভোগের জন্য সদা ব্যাপৃত থাকবে। এ বিধান নস্যাৎ করে মৈত্রেয়ী তাঁর স্বশাসিত অঞ্চলে প্রবেশ করছেন। মানুষের মর্যাদায়। নারী বলে নয়। কখনও তাঁর মনে হয় বলেন – ভদ্রে, এখানে তোমার প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু তাঁর ব্যাক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে একথা উচ্চারণ করা যায়না। তাই সময় মতন তাঁর সঙ্গে বেদাদি আলোচনা করেন। তিনি অনুভব করছেন, পূর্ব ও দক্ষিণের যোগিনীদের ধর্মাচরণের প্রভাব পড়ছে আর্য রমণীদের ওপরে। তাঁরা নারীর ধর্মাচরণের অধিকার পেতে এগিয়ে আসছেন। তবে কি সন্ন্যাস শ্রেয়তর? যাই হোক, আজকে যে কাজে এসেছেন সেটি বলতে শুরু করলেন।

জনক বুঝতে পেরেছেন। হ্যাঁ, এর আশু প্রতিকার প্রয়োজন। নারীর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করলে শত্রু বাড়বে। কমবে না। এরপর সম্পদেও নারী তার অধিকার জাহির করবে। রাজত্ব নিরাপদ থাকবেনা। তিনি যাজ্ঞবল্ক্যকে আশ্বস্ত করলেন। ‘মহামান্য, আপনি নিশ্চিন্ত হোন। আমি শীঘ্রই একটি যজ্ঞ ও প্রতিযোগিতা সভার আয়োজন করছি। মহাত্মা ঋষিগণ সেখানে উপস্থিত থেকে আপনার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করবেন’।

নিমন্ত্রন পেয়েছেন গার্গী। তাঁর আশ্রমের যে কতিপয় ছাত্র আছে তারা খুবই উৎসাহিত। আচার্যার সঙ্গে জনকের রাজসভায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গার্গী অবশ্য শান্ত।

মিথিলার রাজ দরবারে আজ তিলধারণের স্থান নেই। দারুনির্মিত স্তম্ভের উপর চিত্ররঞ্জিত আচ্ছাদন। সভাস্থলের মধ্যে একটি উঁচু বেদীতে নিমন্ত্রিত ঋষি ও ব্রাহ্মণগণ। রাজা আজ বহুদক্ষিণা যজ্ঞ করবেন। কুরু পাঞ্চাল থেকেও বহু জ্ঞানী গুনী ঋষি এসেছেন। জনক ঘোষণা করেছেন, আজকে যজ্ঞশেষে তিনি দশ পাদ করে সোনা দিয়ে বাঁধানো শিংয়ের এক হাজার দুগ্ধবতী গাভী তিনি দান করবেন। উদাত্ত স্বরে রাজঘোষক ঘোষণা করছেন, ব্রাহ্মণো ভগবন্তো যো ব ব্রহ্মিষ্ঠঃ স এতা উদজাতামিতি। উপস্থিত ব্রাহ্মণদের মধ্যে যিনি সম্পূর্ণ ব্রহ্মজ্ঞানী, তিনি নিয়ে যান এই গরুগুলি। বাইরে প্রান্তরে বেঁধে রাখা গাভীগুলির সোনার শিং সূর্যের আলোয় চকচক করছে। নিকটস্থ মানুষজন মনে মনে ভাবছেন, আহা, আর জন্মে ব্রাহ্মণ হবো। রাজার দান পাবো। এমন সুন্দর নধর গরুগুলি, তায় আবার সোনার শিং, পেলে জীবন পূর্ণ হয়ে যেত। তাদের সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে একটি কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। ‘সৌম্য সাম্যশ্রব, এই গরুগুলিকে তোমরা আশ্রমে নিয়ে যাও।’ কণ্ঠস্বর লক্ষ করে অত ভিড়ের মধ্যে সকলে সনাক্ত করলেন, এ যাজ্ঞবল্ক্যের কণ্ঠ। মনে মনে জ্বলে উঠলেন অশ্বল কহোল প্রমুখ ঋষিগণ। নিমেষে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি। ব্রাহ্মণরা উঠে দাঁড়ালেন। জনক চুপটি করে দেখতে থাকলেন। সকলেই একভাবে বলছেন। ‘একি! আপনি কি নিজেকে ব্রহ্মিষ্ঠ দাবী করেন নাকি?’ যাজ্ঞবল্ক্য সহাস্যে উত্তর দিলেন – বাপুরা, ব্রহ্মিষ্ঠকে নমস্কার করি। আপাতত আমার গরুগুলি বড়ই প্রয়োজন। আর যেভাবে দিবাকর উত্তাপ দিচ্ছেন তাতে এই দুপুরে গরুগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। এই রসিকতায় তাঁরা আরও রেগে গেলেন। সকলেই তর্কযুদ্ধ ঘোষণা করলেন। ব্রাহ্মণদের নির্দিষ্ট বেদীর এক কোণে বসে এই রঙ্গ দেখছিলেন এক নারী। অপেক্ষা করতে হবে তাঁকে। এই উত্তরবৈদিক কালে নারীরা ক্রমেই শক্তি হারাচ্ছেন। পুরুষের আধিপত্য নারীকে বিদ্যায় সম্পদে সামাজিক অবস্থানে ক্রমশ নীচে ঠেলে দিচ্ছে। তাই গার্গী চেষ্টা করে চলেছেন। যে বিদ্যায় শুধু পুরুষের অধিকার, আজীবন ব্রহ্মচারী থেকে সেই বিদ্যায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। পুরুষের ভুবনে নারীর নির্ভীক এবং বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ।

প্রথম প্রশ্ন করলেন ঋষি অশ্বল। ‘হে যাজ্ঞবল্ক্য, সব যখন মৃত্যুর অধীন, তখন এর হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?’ যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন – হোতা নামক ঋত্বিক, অগ্নি ও বাক্য দ্বারা, কারণ বাক্যই যজ্ঞের হোতা, বাক্যই অগ্নি, বাক্যই মুক্তির উপায়। একে একে আর্তভাগ, ভুজ্যু, উষস্ত, কহোল প্রভৃতি, কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতে লাগলেন। সেই অপেক্ষারতা নারী লক্ষ করলেন, প্রশ্নের আরও কঠিন উত্তর দিতে থাকলেন যাজ্ঞবল্ক্য। তাঁর অধরে একটি হাসি খেলে গেলো। সহজকে কঠিন করে তোলাই যাজ্ঞবল্ক্যের লক্ষ্য। শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ব্রাহ্মণরা বসে পড়লেন। দেখলেন জনক নিমন্ত্রণ করেছেন গার্গী বাচক্নবীকে। গর্গবংশীয় বচক্লু ঋষির এই কন্যা দারুন প্রজ্ঞার অধিকারিণী। তাঁর নাম ঘোষণা হলো। ঘোষক বললেন – হে বাচক্নবী গার্গী, আপনিই শেষ ঋষিকা। প্রশ্ন করতে চাইলে করতে পারেন। নতুবা যাজ্ঞবল্ক্যকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করা হবে।

গার্গী উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর পরনে শ্বেত কাষায় বস্ত্র। উত্তমাঙ্গে একটি উত্তরীয়। একটি শুভ্র উপবীত যেন তাঁকে অগ্নির ন্যায় ঘিরে আছে। তাঁর মাথায় একটি চূড়া করে কেশগুচ্ছ বাঁধা আছে। যাজ্ঞবল্ক্য লক্ষ করছেন এ নারীর সমস্ত আনন জুড়ে বিদ্যা ও প্রতিভার বিভা। শুধু কি তাই? সব ছাপিয়ে অন্য এক আলো যেন! নারী প্রশ্ন করবেন অনুমতি চাইলেন। হে উপস্থিত ব্রাহ্মণগণ, আপনারা অনুমতি প্রদান করুন। পিতৃসম ঋষির সঙ্গে তর্কে অবতীর্ণ হচ্ছেন, অনুমতি চাই। যাজ্ঞবল্ক্য প্রসন্ন কণ্ঠে বললেন – ভদ্রে, প্রশ্ন করো। গার্গী শুরু করলেন – মাত্র দুইটি প্রশ্ন করব আচার্য। যাজ্ঞবল্ক্য দক্ষিণ হস্তটি তুলে অভয় দিলেন।

গার্গী বললেন, হে আচার্য, আপনি নিশ্চয় এ সকল প্রশ্নের উত্তর সম্যক ভাবে জানেন, তবু আমার জিজ্ঞাসার কারণ ভিন্ন। সমবেত মণ্ডলীর সম্মুখে এ প্রশ্নের উত্তর দিলে আপনাকেই আমি শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করে নেবো। প্রথম প্রশ্নটি, জলে যদি সব ওতপ্রোত থাকে তবে জল কিসে অধিষ্ঠিত?

উঃ বায়ুতে।

প্রঃ বায়ু কিসে অধিষ্ঠিত?

উঃ অন্তরীক্ষে।

প্রঃ অন্তরীক্ষ কিসে?

উঃ গন্ধর্বলোকে।

একে একে সব পেরিয়ে ব্রহ্মলোক। গার্গী প্রশ্ন করলেন – তারপর? যাজ্ঞবল্ক্য ভিতরে আবার অস্থির বোধ করছেন। এ নারী কি অধ্যাত্মবিজ্ঞানে পারদর্শী? কিন্তু তিনি আর এগোতে দিলেন না। বললেন – তুমি অতিপ্রাক্ষী। আর প্রশ্ন কোরোনা। এরপর প্রশ্নাতীত স্থিতি। এরপর যা আছে তা ধারণা করতে গেলে তোমার মাথা খসে পড়বে। একথা উচ্চারণ করতে করতে যাজ্ঞবল্ক্য টের পাচ্ছেন, এতদিনে তিনি সমকক্ষ বিদ্বান পেয়েছেন। এ নারী ব্রহ্মবাদিনী। এতদিনে তাঁর সাধ পূর্ণ হয়েছে। অথচ ভয় হচ্ছে। ততক্ষণে গার্গী যাজ্ঞবল্ক্যের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছেন। সভায় উপস্থিত সকলেই ভেবেছেন আসলে গার্গীর সঙ্গে তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কীয় আলোচনা হয়েছে। তিনিও তাই অনুভব করেছেন। পৃথিবীর আদিতে জল। বিস্তীর্ণ জলভাগ একে ঘিরে রেখেছে। জলকে ঘিরে রেখেছে বায়ু। বা বায়ুমণ্ডল। বায়ুমণ্ডলের ওপরে আছে আকাশ বা অন্তরীক্ষ। গ্রহ নক্ষত্রের স্থান। অন্তরীক্ষের ওপরে গন্ধর্বলোক। দেবতাদের আবাস। অগণিত সৌরজগত ও ছায়াপথে ভরা। এরপরে অনন্ত অসীম। নিরালোক নিস্তব্ধ এক অবস্থিতি। মুখে বর্ণনা করা যায়না। ধারণা করা যায়না। অবাংমানসোগোচরম। ব্রহ্মলোক। যাজ্ঞবল্ক্য চিন্তিত মুখে গরুগুলি নিয়ে আশ্রমের দিকে যাত্রা করলেন। আরও কিছু বলেছে কি এই নারী? তবে কি সে আত্মবিদ্যার কথাই জানিয়েছে? যে আত্মবিদ্যা যাজ্ঞবল্ক্য জনককে শিক্ষা দিয়ে থাকেন? কিন্তু এ যে ফলিত বিদ্যা! যাজ্ঞবল্ক্য তো জানেন! জনক শুধুই শ্রোতা। তার উপলব্ধির জন্য যে চর্চা, যে জীবন যাপন প্রয়োজন তা জনকের কই? গার্গী বরং সে জীবন যাপন করেন। যাজ্ঞবল্ক্য নিজেও তো তা করেননা!

আশ্রমে চলেছেন গার্গীও। যাজ্ঞবল্ক্যের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে আনন্দ হয়েছে তাঁর। আহা! গরুগুলি বড় দরকার তাঁর। অত বড় আশ্রম। খাদ্যের প্রয়োজন আছে বৈকি! তিনি অত সোনাদানা নিয়ে করবেন কি? আজন্ম ব্রহ্মচারিণী ব্রহ্মবাদিনী নারীর এমন বিপুল সম্পদে কি প্রয়োজন? সংসারে তাঁর আকর্ষণ নেই তো!

চলতে চলতে তাঁর হাসিও আসছিল মনে। হায় যাজ্ঞবল্ক্য! শুধু বাইরেই খুঁজে গেলেন সেই অসীমের উপস্থিতি? তাই তো এত ঐশ্বর্যের প্রয়োজন হয় আপনার! এই তো দেহ! জল দিয়েই ওতপ্রোত! একে ঘিরে রেখেছে বায়ু। প্রাণ বায়ু। প্রাণ বায়ুর অধিষ্ঠান চিদাকাশে। অন্তরীক্ষে। এই অন্তরীক্ষে ধ্যানমগ্ন ঋষি দিব্যচক্ষে দেখতে থাকেন অন্তরজ্যোতি। নক্ষত্রলোক বা গন্ধর্বলোক। ভ্রূ মধ্যে তাঁর দর্শন। তারও ওপরে মস্তিষ্কের সহস্রদল পদ্মে, সহস্রারে, আছে ব্রহ্মলোক। শব্দহীন, আলোহীন। এক অদ্ভুত আনন্দময় অবস্থিতি। গার্গী অনুভব করেছেন। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্য কি করেননি? নাকি সবটাই বাগাড়ম্বর? তিনি আত্মবিদ্যার ব্যাখ্যাতা, অন্যতম মহান ঋষি। কিন্তু ফলিত জ্ঞানের বিভা কই? স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সত্যিই এর বেশি উন্মেষ না ঘটলে ধারণা অসম্ভব।

আজকাল, যজ্ঞ থেকে পুরস্কৃত হয়ে ফেরার পর থেকে যাজ্ঞবল্ক্য কিছু বিমনা হয়ে থাকেন। তবে কি গার্গী যা বলেছেন তা তিনি ধরতে পারেননি? কেমন প্রশান্ত মুখচ্ছবি ওই কন্যাসমা ঋষিকার! কি পেয়েছেন তিনি? যাজ্ঞবল্ক্য মনে মনে স্থির করতে চাইছেন। এত ধন সম্পত্তি তিনি তাঁর দুই স্ত্রীর মধ্যে ভাগ করে দেবেন। তারপর একাকী যাবেন তপস্যায়। আত্মজ্ঞানই লক্ষ। ফলিত বিদ্যার চর্চা এই সংসারে থেকে অসম্ভব। সম্ভবত গার্গীও সেইদিকেই নির্দেশ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তো ওই ঋষিকা জয়ী! তিনিই তো জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন ঘটালেন! যাজ্ঞবল্ক্য তো নিজের মধ্যে থাকা সেই অমৃতের সন্ধান না করে বাইরে স্বর্ণ ও গোধন, ভূমি ও যশ সঞ্চয় করে চলেছেন!

সেদিন প্রাতে সদ্যস্নাতা মৈত্রেয়ী এসে দাঁড়িয়েছেন। আচার্য ও পতি, যাজ্ঞবল্ক্য আজ বিশেষ কিছু বলবেন। তাঁর মনে সবসময় একটি শান্ত আনন্দ বিরাজ করে। তাঁর অগ্রজা সপত্নী কাত্যায়নী তাঁর চেয়ে বয়সেও অনেক বড়। গৃহকর্মে নিপুণা। আশ্রমমাতা। মৈত্রেয়ী তাঁর প্রতি মমতা অনুভব করেন। দূরে কাত্যায়নী তখন গাভীগুলির পরিচর্যার জন্য আশ্রমবালকদের নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি এলেন যাজ্ঞবল্ক্যের কাছে। এই সুন্দর সূর্যস্নাত প্রাতঃকাল। এখন তো প্রিয় সম্ভাষণের সময় নয়। তাহলে আচার্যই তাঁকে ডেকেছেন। মৈত্রেয়ী জিজ্ঞাসু চোখে চাইলেন। যাজ্ঞবল্ক্য বললেন—প্রিয়ে, আমি গার্হস্থ্য আশ্রম ত্যাগ করে সন্ন্যাস নেব। তোমার সম্মতি চাই। এই সময় তোমার সঙ্গে কাত্যায়নীর সম্পর্কও অবসান করতে চাই। আমরা ধারণা করতে পারি, মৈত্রেয়ী কী ভেবে ছিলেন। কাত্যায়নীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটি যেন যাজ্ঞবল্ক্যের ওপরেই নির্ভর। সেই সূত্রটি কেটে দিলে দুজনেই স্বাধীন নারী। একে অন্যের সপত্নী থাকবেন না। কেউ কারোর বশ্য থাকবেন না। এমনকি দুজনে যে এককালে এক পরিবারের সদস্য ছিলেন তাও বিস্মৃত হবেন। আমরা অবশ্য জানতে পারি না যে পরবর্তী কালে কাত্যায়নী ও মৈত্রেয়ী এই বিচ্ছেদ গ্রহণ করেছিলেন কিনা। সম্ভবত করেননি। কারণ পরে ব্যাক্ত করছি। যাজ্ঞবল্ক্য সম্পত্তির সুষ্ঠু বণ্টন করতে চাইলেন। দুই পত্নীর মধ্যে মৈত্রেয়ী বিদুষী। তাই তাঁর সঙ্গে পরামর্শে বসেছেন। এই প্রথম মৈত্রেয়ী ভিতরে ভিতরে আহত হলেন। কী সম্পদ বণ্টন করবেন ঋষি? কোন সম্পদে ঋষির অধিকার? আশ্রমের অসংখ্য সদস্যের প্রতিদিনের আহার ও আশ্রয় যিনি ব্যবস্থা করেন, এই পার্থিব সম্পদে তো তাঁরই অধিকার! সে তো কাত্যায়নী! ঋষি ব্রহ্মবিদ, আবার পার্থিব সম্পদকে নিজের জ্ঞান করেন? কই? মৈত্রেয়ী তো তা মনে করেন না? আহত মৈত্রেয়ী উত্তর দিলেন—যেনাহং নামৃতাস্যাম তেনাহং কিং কুর্য্যাম? হে ভগবন, যদিই বা ধনপরিপূর্ণা এই ধরিত্রী আমার হয়, আমি কি তা দিয়ে অমর হব? যাজ্ঞবল্ক্যের নতদৃষ্টি ভেসে উঠছে। পরাজয়, পরাজয়! তিনি হয়ত অস্ফুটে বলেছিলেন—না প্রিয়ে, আমি তোমাকে ইহজগতে দেহের প্রয়োজনে ব্যবহার্য ভোগের বস্তু দান করে যাবো। মৈত্রেয়ীর অন্তর হাহাকার করে উঠল। কি হবে এই ভোগ্যবস্তু দিয়ে? কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্য তাঁকে বোঝাতে চাইলেন, এই যা কিছু তোমার প্রিয় তা আসলে তোমার নিজের আত্মস্পৃহা। পতি প্রিয় আপন কামনার নিবৃত্তির কারণে। পুত্র প্রিয় ভোগের বাসনা যাতে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত গতি পায়, সেই কারণে। এভাবেই যা কিছু তুমি প্রিয় মনে করো তা আসলে তোমার নিজের চরিতার্থতায়। এই আত্মচরিতার্থতা আসলে আত্মাকে সন্তুষ্ট করা। এই আত্মা কী মৈত্রেয়ী? এই আত্মাকে জানাই আমাদের উদ্দেশ্য।

মৈত্রেয়ী বিস্ময়াহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। আঃ পুরুষ! তুমি কী অদ্ভুত দুর্বল যুক্তিজাল বিস্তার করেছ! আত্মা ও আত্মচরিতার্থতা এক? স্থুলদেহের ভোগ আর আত্মাকে জানার ইচ্ছা এক? কিন্তু উপনিষদ এ পর্যন্তই বলে। যাজ্ঞবল্ক্য সন্ন্যাসে গিয়ে ভোগ থেকে নিষ্কৃতি পেলেন কিনা আমরা জানি না। কিন্তু এটুকু অনুধাবন করতে পারি, দুই সহোদরার মতই কাত্যায়নী ও মৈত্রেয়ী সেই আশ্রমে থেকে গেলেন বাকি জীবন। একজন আশ্রমমাতা অন্যজন আচার্যা। যত সংগোপনেই থাকুক, কার্যত গার্গী ও মৈত্রেয়ী, এই দুই নারীর কাছে যাজ্ঞবল্ক্যের পরাজয়ের কথা লেখা রইল উপনিষদে।



তথ্যসূত্রঃ

• বৃহদারণ্যক উপনিষদ, স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত, উদ্বোধন

• লঙ্কাধীশ রাবণ, অনিন্দিতা মণ্ডল, খোয়াবনামা

[সাহিত্য আর সংবাদ শারদীয়া ২০২১]

1 comments:

0

প্রবন্ধ - ডঃ কৌশিক চট্টোপাধ্যায়

Posted in







নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহর সূচনালগ্ন থেকেই শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র৷রবীন্দ্রনাথ,কাজী নজরুল ,দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্র বহুবার এসেছেন এই শহরে৷ ভূমিপুত্র হিসাবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আজও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় ,পরবর্তীতে প্রমথ চৌধুরী (বীরবল), নারায়ন সান্যাল, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক,সাহিত্যিক গবেষকও শিক্ষক শ্রী সুধীর চক্রবর্তী এরকম অজস্র নাম আমাদের স্মরণে এলেও বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে গেছে যে নামটি তার নাম কল্লোল যুগের বিশিষ্ট কবি হেমচন্দ্র বাগচী ৷ এই বিরল কাব্যপ্রতিভা সম্পর্কে বাংলা সাহিত্য জগতেও এক অদ্ভুত উদাসীনতা আজও আমাদের বিষ্ময় জাগায়৷

১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯০৪ সালে নদীয়ার গোকুলনগরে হেমচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। ১০ বছর বয়েসে তিনি কৃষ্ণনগরের নিকট ঘূর্ণীতে আসেন ও কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল এ চতুর্থ শ্রেনীতে ভর্তি হন। ১৯২১ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ থেকে বি এস সি পাস করেন। কলেজ জীবন থেকেই কবিতা লিখতেন। বিজ্ঞান তার পছন্দের বিষয় না হওয়ায় কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বিএ পাস করেন ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ তে ভর্তি হন। বাংলা ও সংস্কৃত দুটি বিষয়ে এমএ করেছিলেন৷ভবানীপুরের পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতা করতেন ও পরে রাজশাহী কলেজে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে চলে যান।যদিও সেখানে অধ্যাপনার কাজ করেন মাত্র তিনমাস৷

ভাগ্যান্বেষণের উদ্দেশ্যে চলে আসেন কলকাতায় ৷এবং সমস্ত সঞ্চয় ভেঙে খুলে ফেলেন প্রকাশনা সংস্থা বাগচী এন্ড সন্স৷প্রকাশ করলেন তিনটি গ্রন্থ ৷জগদীশ গুপ্তের গল্প সংকলন,করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্য সংকলন "শতনরী" এবং সুনির্মল বসুর "ছন্দের টুংটাং"৷যদিও তা ব্যবসায়িক সাফল্য দেখেনি৷

এই সময় লিখতে থাকেন অসামান্য সব কবিতা ৷ তৎকালীন সেরা কবিদের তালিকায় তার নাম প্রথম সারিতে৷ মালদার আদিনা কলেজেও কিছুদিন কাজ করেছিলেন৷বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত, জীবনানন্দ দাস, সমর সেনের সঙ্গেও সখ্যতা ছিল এবং ভাবের আদানপ্রদান ঘটতো৷অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ছন্দে তার অনায়াস যাতায়াত মুগ্ধ করেছিল সাহিত্যপ্রেমী মানুষকে৷এছাড়াও ছিল অবিশ্বাস্য শব্দচয়ন ,রূপকল্প বা ইমেজারির দখল৷

১৩৩৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় দীপান্বিতা,১৩৩৯ তীর্থপথে এবং ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে মানসবিরহ নামের তিনটি কাব্যগ্রন্থ৷

অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন

"তিনি তো নাগরিক কবি ছিলেন না কিন্তু কল্লোল কালিকলমের ঘনিষ্ঠ দোসর ছিলেন৷"


কবিতার পাশাপাশি বিদেশী গল্পকারদের গল্প করেছেন অনুবাদ৷আমেরিকার সাহিত্যিক Francis Briel Hastle এর গল্পটি অনুবাদ করে ফেলেছেন নাম দিয়েছেন "রাঙামাটির দেশের একটি গান" (The idyl of Red gulch)অনুবাদ করেছিলেন ও হেনরীর দুটি গল্পও "পরাজিত নগরী " (The Defer of the City) এবং "পোষাক ও প্রেম" (Love on dress parade)৷ সমালোচনা করেছেন জীবনানন্দের "ধূসর পান্ডুলিপি"র এবং বুদ্ধদেব বসুর 'কঙ্কাবতী' ও 'সমুদ্রতীরে'র৷


১৯৪২ সালের পরই তিনি মানসিক সুস্থিতি হারিয়ে ফেলেন৷

ফিরে আসেন ঘূর্ণীতে ৷যে বাড়ী আমার বাড়ীর অনতিদূরে৷আমি ছোটবেলাতে দেখেছিও তাঁকে যদিও সে বয়সে তাঁকে বোঝার মত ক্ষমতা স্বাভাবিক ভাবেই ছিল না৷ কিন্তু তিনি তখন অতীতের ছায়া ৷ করুণ পরিণতি৷ রাস্তা দিয়ে আপন খেয়ালে হাঁটছেন কবি ৷উস্কো খুস্কো চুল উড়ছে ৷বিড় বিড় করে বলছেন ৷শোনা যাচ্ছে না৷ দেখা হলে মাথায় হাত রাখতেন ৷হাতের আঙ্গুলগুলি দীর্ঘ, অসম্ভব সুন্দর৷ পরবর্তীতে যদিও বাইরে আর বার হতে পারতেন না৷

"প্রলয় পয়োধি জল উতল সমুদ্র গর্জমান
তার মধ্যে তবু থাকে অচঞ্চল পরিসর শান্তি
সংক্ষুব্ধ সমাজ আর রুক্ষতম বাস্তবের ঢেউ
কোনো কোনো স্বপ্ন বাদী তার মধ্যে শান্তশ্রী সম্রাট"

বিশিষ্ট অধ্যাপক গবেষক সুধীর চক্রবর্তী হেমচন্দ্র বাগচীর কাব্য প্রতিভা স্মরণ করতে গিয়ে প্রথমেই বলছেন ৷তার কথায় "স্নিগ্ধবনগন্ধ আকুল মোহনার নাম কবি হেমচন্দ্র বাগচী৷

শ্যামল শোভার মধ্যেও হৃদয়ের কান্না থামেনা কিছুতেই
যে কবির ভালো লাগত "বিধ্বস্ত পল্লীর কাহিনী"৷যিনি সোচ্চারে বলে উঠতে পারেন "অগ্নিদগ্ধ শ্মশানের সৌন্দর্য-সমস্ত চেষ্টার অবসানের সুর...আমার বড় প্রিয়৷

কখনও বলে ওঠেন
"আমার এ কাব্যলোকে
কোথা হতে জানিনা কখন
বহে যায় বৈশাখের ঝড়
কঠিন কাঁকর লাগে-
মুখে লাগে সঞ্চিত জঞ্জাল৷"

শুধু পল্লী সমাজ নয় সামাজিক প্রেক্ষাপট, স্মৃতিচর্চা, প্রেম, স্বপ্নকল্পনা,নীড়ে ফেরার সুতীব্র পিপাসা,কখনো বিষাদে আবার কখনও চরম আশাবাদী হয়ে উঠেছে তার কাব্য৷ স্বকীয়তাবোধে এবং বিভিন্নতায় এ কবি স্বতন্ত্র৷কখনো কবির জন্মস্থান জলঙ্গী নদী স্থান করেছে কবিতায়৷এ অমোঘ পিছুটানকে ভোলা সম্ভব নয় কবির পক্ষে

"মন বেধে যায়
জলঙ্গীতে
কি ভঙ্গীতে
স্রোতের টানে
গানে গানে
পরাণ আমার কি যে করে!
বৃষ্টি ঝরে ! (বর্ষণময়ী)

বারবার ফিরে আসে বাহাদুরপুর, হাঁসাডাঞার বিল (জলাঙ্গীর বাঁক) কবিতায়৷

আবার "ছোটবেলার রান্নাঘরে" লিখেছেন
"পাঁচু সাজির ভিটের 'পরে ফুল ফুটেছে নেবুগাছে
আর কেহ নাই জনপ্রাণী গাছটি শুধু দাঁড়িয়ে আছে
উঠোনভরা দুর্ব্বাঘাসে
বাঁশের ডগার ছায়া আসে-
দলছাড়া এক মহিষ ঘুমায় রতন দাদার বাড়ীর কাছে;
আমার মৃগ, মনের মৃগ সেথায় যেতে পারলে বাঁচে!"

নেবু গাছ তো প্রান্তজনের ভাষা ৷তাকেই ফিরিয়ে আনলেন কবি, মনকে পাঠিয়ে সেই ছোটবেলার রান্নাঘরে৷ পাঁচু, রতনদাদা বা "সত্য মাস্টার" কবিতার সেই সত্য মাস্টার "তালি দেওয়া ছোট ছাতা ময়লা কাপড়,করুণ নয়নে শুধু চায়-"

এরা তো আমাদের চারপাশেরই চরিত্র, রক্তমাংসের মানুষ হয়ত বা প্রান্তজনও বটে৷

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সপ্ততিতম জন্মোৎসবে কবি লিখলেন "রবীন্দ্রনাথের প্রতি" কবিতায়

"তুমি রবি আকাশের, হিরণ্ময় রথ-সমাসীন-
বৈদুর্য্য-মুকুট শিরে, পিঙ্গল অরুণ -সারথি,-
সপ্ত তুরগের রশ্মি দৃঢ় মুষ্ঠিতলে-তূর্ণগতি
ধায় রথ, ছিন্নমেঘ বাষ্পপূর্ণ আবর্তে বিলীন,
জ্যোতিস্রোতে ভেসে যায় -এ উপমা আমাদের নহে!"


১৩৪২ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে "ম্লানমুখ" কবিতায় বলছেন

"ম্লান মুখ দেখনি কখনও-ম্লান মুখ
করুণ স্বপ্নের মত মুখ, শ্মশানে শবের মত মুখ,
-ম্লান মুখ
এ বিচিত্র ধরণীতে যা' কিছু সুন্দর, যা' কিছু করুণ
যা' কিছু উদার আর বেদনায় বিবশ অরুণ
মিশে আছে তরঙ্গিত যত দুঃখ -সুখ-
দেখ'নি তেমন ম্লান মুখ৷"

ঘূর্ণীর বাড়ীতে ফিরে আসার পর কবি হেমচন্দ্র বাগচী একটি পত্রিকা বের করেছিলেন নাম "বৈশ্বানর" ৷যদিও চারটি সংখ্যার পর তা বন্ধ হয়ে যায়৷এই পত্রিকাতেই শুরু করেছিলেন উপন্যাস" অনির্বাণ"৷যদিও তা অসমাপ্তই থেকে গেছে৷

কিছুই আর মনে রাখতে পারতেন না লিখতে পারতেন না কবিতা৷কবির হাত থেকে কবিতা না বের হবার যন্ত্রণা নিয়েই ছটফট করেছেন শেষ জীবন৷

১৯৮৬ সালে ৪ঠা এপ্রিল দীর্ঘ রোগভোগের পর অজান্তেই সকলের অগোচরে চলে গেলেন এই দরদী কবি ৷

১৯৩১-৪১ এই সময়টা সমালোচকরা মনে করেন কবি হেমচন্দ্র বাগচীর কবিজীবন চরম শিখরে উঠেছিল৷এই সময়েই যৌবনভিক্ষা, জলাঙ্গী বা সংস্কৃত কাব্যের নায়িকাদের প্রতি বা বহু আলোচিত"স্বপ্নো নু মায়া নু মতিভ্রম নু' কবিতাগুলি এই সময়েরই সৃষ্টি৷বুদ্ধদেব বসুর মতে তাঁর সনেটধর্মী "গীতিগুচ্ছ" কবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা৷ প্রায় পঁচিশটির মত বিদেশী কবিতার অনুবাদ করেছিলেন কবি ৷সবচেয়ে বেশী অনুবাদ করেছেন ওয়াল্টার ডি লা মেয়ার এর কবিতা ৷এছাড়াও করেছেন রিচার্ড আলডিংটন, রুবার্ট ব্রুক, জে ই ফ্লেকার, ইয়েটস, ইলিয়ট, ভি এইচ লরেন্স, গিবসন ,জেমস জয়েস প্রমুখ বিখ্যাত কবিদের কবিতার অনুবাদ৷


তাঁর কবিকৃতিকে এত স্বল্পপরিসরে বর্ণনা করা অসম্ভব৷

কবি বোধহয় বহুদর্শী হন৷ না হলে আমরা "সারাদিন কাটে একেলা" (২৩শে মাঘ,১৩৪০) কবিতায় পাচ্ছি "দীর্ঘজীবন কাটে একলা

করুণ হেলায়-..."

বা "প্রচন্ড আবর্তে তা'র চেয়ে আছি- পড়ে না নিমেষ!
প্রেম-সে কি সত্য নয় ?এবারের মত সবি শেষ?"
কবির মৃত্যু হয়না
তার চির শাশ্বত সৃষ্টি বেঁচে থাকে, চর্চা হয়৷
আমরাও যেন অতীত না ভুলে স্মরণ করি, চর্চা করি কবি হেমচন্দ্র বাগচীকে৷


তথ্যসূত্রঃ
হেমচন্দ্র বাগচীর কাব্য সংগ্রহ(১ম খন্ড)
কবি হেমচন্দ্র বাগচীঃ দূরের নক্ষত্র/মন্দিরা রায়
স্নিগ্ধবনগন্ধ আকুল মোহনার নাম কবি হেমচন্দ্র বাগচী/ সুধীর চক্রবর্তী (কবিতার কাগজ)

0 comments:

0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in



আমার ভারতবর্ষ
রাজারানি মন্দির

দেবতার নেশা থাকেনা। মন্দিরের থাকে। এমন একটা দেশে জন্মেছি যেখানে এই নেশার জোগান পথেঘাটে। মন্দিরের আটদিকের শিখরে যেমন দিকপালেরা মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, দেখে যান, অপলক পাথরের চোখ দিয়ে। আমি মানুষ সেভাবেই তাঁদের দেখে যাই। বুঁদ হয়ে ভাবি, এমন বন্ধু আর কে আছে?

সে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় একহাজার বছর ধরে। একভাবে, ত্রিভঙ্গমুদ্রায়, একটা সাজানো কুলুঙ্গির ফ্রেমে। দু'হাত মাথার উপর, ধরে আছে বৃক্ষশাখা। ওষ্ঠাধরের হাসিটি লিওনার্দো কোনওদিন দেখতে পেলে মোনালিসা আঁকা ছেড়ে দিয়ে পায়রা পুষতেন। তাহার নামটি শালভঞ্জিকা। তার চারপাশে অজস্র নায়িকা, যক্ষী, সুরসুন্দরী
নিরীহ দর্শকদের বেঁধে রাখে মোহমদির অপাঙ্গমায়ায়। দেবা না জানন্তি, আপ্তবাক্যের একটি পাথুরে প্রমাণ। মন্দিরটা তৈরি হয়েছিলো একাদশ-দ্বাদশ শতকে। কলিঙ্গ শিল্পস্থাপত্যের শেষ উজ্জ্বল নিদর্শন এবং একটি ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। এর জগমোহনটি নিখুঁত কলিঙ্গশৈলীর প্যাগোডাধর্মী হলেও এর বিমান বা শিখরটি পঞ্চরত্ন এবং অবিকল যে শৈলীটি মধ্যভারতের খাজুরাহো-কেন্দ্রিক চন্দেল স্থাপত্যের একটি মূর্ত রূপ। সম্ভবতঃ সারাদেশের একমাত্র পূর্ণ দেবালয়, যেখানে কোনও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হয়নি। এই মন্দিরটি সৌন্দর্যতত্ত্বের দিক দিয়ে এককথায় অনুপম। ঐতিহাসিক, শিল্প বা সমাজতত্ত্ব যে কোনও নিরিখেই হোক না কেন। সব কিছু নিয়ে এই নির্মাণটি একটি এনিগমা হয়ে রয়ে গেছে।
আমাদের দেশের মেয়েরা তো সততই সুন্দর। অর্ধেক আকাশ হয়ে বাকি আকাশটাকে ধরে রাখে। এটাও একটা নিজস্ব সৌন্দর্য। কিন্তু সামনে এসে দাঁড়ালে পুলকবাবুর গপ্পো। সেটা জানেন না বুঝি? একবার মান্না দে আর পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এক মফস্সলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন গাড়িতে। কারুর খোঁজও করছিলেন বোধ হয়। এমন সময় সামনের একটি বাড়িতে খোঁজ নেবার জন্য করাঘাত করতেই একটি মেয়ে দরজা খুলে এসে দাঁড়ালো। পুলকবাবুরা যাঁর খোঁজ করছিলেন তাঁর কথা আর মনে নেই। দরজার ফ্রেমে শুধু মেয়েটিই রয়েছে তখন। 'কী কথা তাহার সাথে' কিছুই মনে নেই তাঁর। গাড়িতে
ফিরে এসে মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলো অধরা কিছু শব্দ, লাইন করে। এভাবেই তৈরি হয়েছিলো মান্নাদার সেই অমোঘ প্রশ্নময় গানটি। " ও কেন এতো সুন্দরী হলো? আমি তো মানুষ !" আমাদের কলেজকালের শোনার, শোনানোর গান। ইমপ্রেস করে ফেলা গ্যারান্টিড। এখন মেয়েদের ইমপ্রেস করার ধরণটা বোধ হয় বদলে গেছে। তা যাক। জানিনা, জানিনা কেন এমন হয়? তুমি আর নেই সে তুমি।
এখানেই মজাটা। সেই মেয়েগুলো কিন্তু মন্দিরের গায়ে হাজার হাজার বছর ধরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনও ক্লান্ত হয়না। পুরোনো হয়না। সামনে গিয়ে যেই দাঁড়াই, ধক করে বুকে বাজে। "ও কেন এতো সুন্দরী হলো? আমি তো মানুষ !!"

রাজারানি মন্দিরের সামনে এসে হঠাৎ এসে দাঁড়ালে এই গানটাই মনে পড়ে যায়। নামটাই দেখা যাক না কেন? রাজারানি মানে রূপকথার মানুষ নয়। ওটা এক ধরণের বালিপাথরের নাম। যার মধ্যে হলুদ আর লালচে আভা পরস্পর জড়াজড়ি করে থাকে। মাপের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তেমন কিছু বিপুল নয়। বিশেষত সমকালীন পুরী জগন্নাথ মন্দির বা ভুবনেশ্বর লিঙ্গরাজ মন্দিরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলেনা। ১৭.৯ মিটার উঁচু পঞ্চরথ দেউলটির জগমোহন ত্রিস্তর। বিস্ময়করভাবে এই রেখদেউলটির নকশা 
খাজুরাহোর মন্দিরগুলির সঙ্গে মেলে। কলিঙ্গ শৈলির থেকে পৃথক। মন্দিরটির স্থাপত্য পঞ্চাঙ্গ রীতির। এর মধ্যে পাভগ, তালজঙ্ঘা, বন্ধন, উপরজঙ্ঘা এবং বারন্দা নামের পাঁচটি অংশ রয়েছে। ভিত্তিভূমির পাভগ অংশে আবার রয়েছে পাঁচটি অলংকৃত স্তর; খুর, কুম্ভ, পট্ট, কানি এবং বসন্ত। এর উপরের গণ্ডি ও শিখর অংশ ঘিরে রেখেছে ছোটো ছোটো অঙ্গশিখর। শীর্ষে যথারীতি আমলক ও কলস। জগমোহনটি বর্গাকার এবং নিরলংকার। সচরাচর অন্য সমস্ত কলিঙ্গ
মন্দিরের জগমোহন বা পীড় অংশটি বিশেষভাবে অলংকৃত থাকে এবং আয়তাকার। এই মন্দিরটির জগমোহন ও গর্ভগৃহ ব্যতিক্রমী নিদর্শন। এই দুই অংশ দেখলে মনে হবে হঠাৎ কোনও কারণে এর নির্মাণ পরিত্যক্ত হয়েছিলো। এই রকম একটি সাড়ম্বর প্রস্তুতির মন্দিরে গর্ভগৃহ শূন্য। প্রবেশপথে নাগ এবং নাগিনী মূর্তি ও শৈব দ্বারপাল সূচিত করছে এটি শিবমন্দির হিসেবেই নির্মিত হয়েছিলো। এর সঙ্গে লকুলীশ মূর্তির ভাস্কর্যও শৈব আনুগত্যের প্রতি নির্দেশ করে। সেই সূত্রেই ধারণা করা হয় কোনও রকম বিগ্রহরহিত হওয়া সত্ত্বেও মন্দিরটি ইন্দ্রেশ্বর শিবের প্রতিই উৎসর্গীকৃত ছিলো। কৃষ্ণচন্দ্র পাণিগ্রাহী বলেছেন একাম্রপুরাণে এই রকম উল্লেখ পাওয়া যায়।

মন্দিরটির নির্মাণ সময়কাল বিষয়ে বিভিন্ন পণ্ডিতেরা মোটামুটিভাবে একই সময় নির্দেশ করেছেন। ব্রাউনসাহেবের মতে এই মন্দিরটি অনন্ত-বাসুদেব মন্দিরের সমসাময়িক, অর্থাৎ এগারো বারো শতক নাগাদ। সরসীকুমার সরস্বতী এই মত সমর্থন করেন। ফার্গুসন সাহেব বলেছেন মন্দিরটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১১০৫ সালে। মন্দিরটির স্থাপত্যকলা যেহেতু মধ্যভারতের শৈলির অনুরূপ তাই একটা মত রয়েছে যে বুন্দেলখণ্ডের সোমবংশীয় রাজারাই প্রকৃত নির্মাতা। তবে টাকাপয়সা যেই জুগিয়ে থাকুক না কেন, এই মন্দিরটি কলিঙ্গের ভাস্কর ও স্থাপত্য শিল্পীদের জয়গান অবিরাম গেয়ে যাচ্ছে প্রায় হাজার বছর ধরে।

0 comments:

3

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















১৮


ফাইনহালস মার্চিং অর্ডারটা পড়তে থাকে।

‘এখনই!’ ফাইনহালস বলে… ‘এখনই… আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না!’ হাতে কাগজটা নিয়ে বলে ওঠে সে… ‘আমাদের দুজনের একইসঙ্গে মার্চিং অর্ডার… মানে একসঙ্গে’…

‘কেন? বোকা বোকা কথা বলবেন না!’ সার্জেন্ট চোখ সরু করে তার দিকে তাকিয়ে আলতো করে বলে ওঠে।

‘কটার সময়?’ ফাইনহালস বলে।

‘সাতটায়,’ জবাব দেয় ওটেন। সে উঠে এরই মধ্যে কোমরে বেল্ট বেঁধে পিঠের বোঝা গুছিয়ে রেখে দিয়েছে সামনের টেবিলে।

সার্জেন্ট টেবিলের সামনে বসে ড্রয়ারটা টেনে বের করে ওটেনের দিকে তাকায়।

‘একসঙ্গে নাকি আলাদা আলাদা…’ অবজ্ঞার সুরে বলে ওঠে সে… ‘এতকিছু ভাবতে আমার বয়ে গেছে। একবার আমার হেপাজত থেকে বেরিয়ে গেলে আর আমার কোনো দায়িত্ব নেই।’… কাঁধ ঝাঁকায় সার্জেন্ট… ‘আমি লিখে দেব যে একজন বেরিয়ে গেছে। ব্যস!’

‘আমি এখনই আমার ব্যাগ নিয়ে আসছি।’ ফাইনহালস বলে ওঠে।

উপরে উঠে ইলোনাকে দরজা বন্ধ করতে দেখে সে করিডোরে থমকে দাঁড়াল। ইলোনা দরজার হাতলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নাড়ল একবার। পোশাকের উপরে ভারি কোট চাপিয়েছে, মাথায় টুপি, হাতে ফাইনহালসের কিনে আনা সেই কেকের প্যাকেট। ফাইনহালসের মনে হল এই পোশাকে তাকে একদম অন্যরকম, একটু ভারিক্কি দেখাচ্ছে। কিন্তু যখনই সে মুখ ফিরিয়ে তাকাল, তার ঘাড় আর গলার রেখা দেখে সে এমনকিছু একটা অনুভব এলো তার মনে, যা অতীতে কোনো মেয়েকে দেখে জেগে ওঠেনি তার মনে। সে কি ভালবেসে ফেলেছে ইলোনাকে? এক অদ্ভুত অধিকারবোধ জেগে উঠেছে তার মনে। ইলোনা দরজাটা ঠিক মত বন্ধ হয়েছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করে দেখছে হাতলটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। তারপর হাঁটতে শুরু করলো সে করিডোর দিয়ে। ফাইনহালস দূর থেকে নিবিষ্টমনে দেখছিল তাকে। হঠাৎ চমকে উঠল যখন সে নিজেকে ইলোনার একদম সামনে আবিষ্কার করল; ইলোনা তার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে।

‘আপনি অপেক্ষা করবেন বলেছিলেন…’ সে বলল।

‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম একটা জরুরি কাজ। আমি নিচে আপনার জন্য লিখে রেখে যেতাম যে আমি এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরব।’ ইলোনা জবাব দিল।

‘আপনি সত্যি ফিরে আসতেন?’

‘হ্যাঁ’… ইলোনা মুচকি হাসে তার দিকে তাকিয়ে।

‘আমিও আপনার সঙ্গে যাবো,’… সে তড়িঘড়ি বলে ওঠে… ‘এক মিনিট অপেক্ষা করুন।’

‘আপনি যেতে পারবেন না। নাহ, দয়া করে আসবেন না আমার সঙ্গে…’ ইলোনা অদ্ভুতভাবে মাথা ঝাঁকায় … ‘আমি ঠিক ফিরব।’

‘কিন্তু আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?’

ইলোনা জবাব দেয়না। চারপাশে তাকায়। যদিও করিডোরটা একদম ফাঁকা, তবুও সে চারদিকে দেখে। এখন ডিনারের সময় হয়ে গেছে। ঘরগুলোর ভেতর থেকে একটা অস্ফুট গুঞ্জনের মত শব্দ ভেসে আসছে।

ইলোনা আবার তার দিকে তাকায়… ‘ঘেটোতে’ সে বলে ওঠে … ‘আমাকে আমার মায়ের সঙ্গে ঘেটোতে যেতে হবে।’ … বলে একদৃষ্টে সে তাকায় ফাইনহালসের দিকে।

‘কিন্তু… আপনি ওখানে গিয়ে কী করবেন?’

‘আমার আত্মীয়স্বজন অনেকে আছে সেখানে। তাদের কিছু জিনিসপত্র দিতে যেতে হবে সেখানে। এই কেকটাও তাদের দিয়ে আসব।’ সে কেকের প্যাকেটটা ধরে ফাইনহালসের দিকে দেখায়… ‘আশা করি আপনি ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণ হবেন না যদি আমি অন্য কাউকে এটা খেতে দিই!’

‘আপনার আত্মীয়স্বজন!’ ফাইনহালস এগিয়ে এসে ইলোনার হাত চেপে ধরে।

‘ছাড়ুন… যেতে দিন আমায়।’

ফাইনহালস ইলোনার সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে চাতালে দাঁড়ায়। কিন্তু চেপে ধরে থাকে তার হাত।

‘আপনার আত্মীয়স্বজন সবাই ইহুদী? আপনার মা?’

-‘হ্যাঁ। সবাই। আমিও… আমরা সবাই ইহুদী।’… ইলোনা ঘুরে দাঁড়ায়। … ‘এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন।’… ইলোনা হাত ছাড়িয়ে নেয়। মেরিমাতার মূর্তির সামনে রাখা ফুলদানি থেকে মূর্ছিত ফুলগুলি সাবধানে বেছে সরিয়ে নেয়। …‘আমাকে কথা দিন যে এই পাত্রে জল বদলে দেবেন। আমি আগামীকাল আসব না। আমাকে স্কুলে যেতে হবে। কথা দিন আমায়… সম্ভব হলে ফুলও বদলে দেবেন। কেমন?’

-‘আমি কথা দিতে পারছি না। আমায় আজ রাতের মধ্যেই চলে যেতে হবে। নয়তো…’

‘নয়তো আপনি আমায় কথা দিতেন?’

সে মাথা নাড়ে… ‘হ্যাঁ। আপনাকে খুশি করবার জন্য যেটা বলতেন করে দিতাম।’

‘শুধু আমাকে খুশি করবার জন্য?’ ইলোনা বলে ওঠে।

-‘আমি জানি না… করতাম ঠিকই!’ সে হাসে। তারপর গম্ভীর হয় … ‘তবে কিছু করবার সুযোগ পেলাম না।’ সে তীব্র উচ্চারণে বলে ওঠে।

তিনতলায় নেমে আসে তারা। ফাইনহালস একছুটে দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে ছড়ানো ছিটানো জিনিসপত্র তুলে নিয়ে ঠেসে দেয় নিজের পিঠের ন্যাপস্যাকে। তারপর বেল্ট বেঁধে দৌড়ে বেরিয়ে আসে বাইরে। ইলোনা ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে থমকে দাঁড়িয়ে আছে ১৯৩২ সালের ব্যাচের ছবিটার সামনে। তাকে চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছে।

‘কী হয়েছে?’ ফাইনহালস প্রশ্ন করে।

‘কিছু না’… সে শান্তভাবে জবাব দেয়… ‘আমি এই ছবিটার সামনে এসে স্মৃতিবিলাসী হতে চাই। কিন্তু পারি না। এই ছবিটা আর সেভাবে আমায় স্পর্শ করেনা। সম্পূর্ণ অচেনা ঠেকে সবকিছু আমার কাছে।’

‘চলুন এগিয়ে যাই!’

নারীটি দরজার বাইরে অপেক্ষা করবে কথা দিল। পুরুষটি দৌড়ে গেল অফিসে। হাতে নিল মার্চিং অর্ডার। ওটেন এর মধ্যে বেরিয়ে পড়েছে। সার্জেন্ট ফাইনহালসের জামার হাতা ধরে টানল… ‘কোথাও কোনো মুর্খামি করবেন না!’ বলে উঠল সে, ‘আমার শুভেচ্ছা জানবেন!’

‘ধন্যবাদ!’ বলে ফাইনহালস দৌড়ে বেরিয়ে এল। ইলোনা রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। সে তার হাত ধরে শহরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। কিন্তু বাতাসে একটা আর্দ্র ভাব, মিঠে সোঁদা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। তারা বড় রাস্তার সমান্তরালে শহরের ভিতরের শান্ত অলিগলি দিয়ে হাঁটতে লাগল। গলিগুলির পাশে ছোট ছোট বাড়িগুলির সামনে সাজানো বাগান।

‘এটা কী ভাবে সম্ভব যে আপনি এখনও ঘেটোর বাইরে আছেন?’ সে প্রশ্ন করল।

‘আমার বাবার জন্য। আমার বাবা সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। যুদ্ধে উচ্চসম্মান পেয়েছেন। দুটো পা হারাতে হয়েছে তাকে। কিন্তু তিনি গতকাল তার সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছেন শহরের সেনাধক্ষ্যের কাছে। সম্মান আর তার নকল পা, দুটোই বিশাল পার্সেল করে ফেরত পাঠানো হয়েছে।’ হঠাৎ ইলোনা তীব্রভাবে বলে… ‘আপনি চলে যান এখনই!’

‘কেন?’

‘আমি একা বাড়ি ফিরতে চাই।’

‘আমি সঙ্গে যাব।’

‘অসম্ভব। অর্থহীন কথা বলবেন না। আমার পরিবারের কেউ যদি আপনাকে দেখে’… ইলোনা তাকায় ফাইনহালসের দিকে… ‘তার পর আমি আর বেরতে পারব না ঘর থেকে।’

‘আপনি ঘুরে ফেরত আসবেন?’

‘হ্যাঁ’ সে শান্তভাবে উত্তর দেয়… ‘অবশ্যই। কথা দিলাম।’

‘একটি চুম্বন! একবার…’ পুরুষটি বলে।

নারীটি থমকে দাঁড়ায়। মুখ লাল হয়ে ওঠে তার। পথঘাট শূন্য, চুপচাপ। একটা দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় তারা। মূর্ছিত কিছু বেরি গাছের শাখা তাদের স্পর্শ করে।

‘চুম্বন… কেন?’ নারীটি নরমভাবে প্রশ্ন করে তাকায় তার দিকে। ফাইনহালসের মনে হচ্ছিল যে ইলোনা এখনই কান্নায় ভেঙে পড়বে… ‘আমি ভালবাসায় ভয় পাই!’

‘কেন?’ পুরুষটি মৃদুস্বরে জানতে চায়।

‘কারণ… অল্প কয়েকটা মুহূর্ত ছাড়া ভালবাসার কোনো অস্তিত্ব নেই।’

‘অল্প কয়েকটা মুহূর্ত ছাড়া সময়ও তো নেই আমাদের কাছে।’ সে নরমভাবে বলে, মাটিতে নামিয়ে রাখে পিঠের বোঝা। ইলোনার হাত থেকে প্যাকেটটা সরিয়ে নিয়ে রাখে তার বোঝার উপরে। তারপর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয় তারা। কানের লতিতে, কণ্ঠে সে চুম্বন করে নারীকে। নারীও তার গালে এঁকে দেয় ভীরু চুম্বন।

‘যেও না’… পুরুষটি ফিসফিস করে… ‘ছেড়ে যেও না আমায়। যুদ্ধের সময় বেশি এদিক ওদিক যাওয়া ঠিক নয়। থাকো, থাকো আমার কাছে।’

সে মাথা নাড়ে… ‘আমি পারব না। আমায় যেতেই হবে। আমার মা ভয়ে মরে যাবেন যদি আমি সময় মত না ফিরি।’

সে আবার তার গালে চুম্বন আঁকে এবং লক্ষ্য করে যে তার খুব ভালো লাগছে।

‘যেও না!’ পুরুষটি আবার বলে ওঠে।

ইলোনা তার কাঁধে মাথা রাখে। ঠোঁটের কোণে চুম্বন দেয় তাকে এবং অনুভব করে যে এই মুহূর্তগুলো খুবই উপভোগ্য হয়ে উঠছে তার কাছে।

বারবার চুম্বন করে তারা। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। নারীটি চিরকাল ভেবে এসেছে যে স্বামী, সন্তান সবকিছু নিয়ে পরিপূর্ণ সংসার হবে তার। সে চিরকাল সবকিছু নিয়ে সাজানো সংসারের কথা ভেবেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে সংসার, বাচ্চাকাচ্চা এসব কিছুই ভাবছে না। না, ভাবছে না। সে আবার পুরুষটিকে চুম্বন করছে আর ভাবছে যে আদৌ কি তাদের আবার দেখা হবে! এই ভাবনাটা তাকে ভালো লাগার সঙ্গে সঙ্গে আবার বিষণ্ণ করে তুলছে।

‘ছাড়ো’… সে ফিসফিস করে… ‘সত্যিই যেতে হবে আমায়… ‘

পুরুষটি নারীর কাঁধের উপর দিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। চারপাশ নিস্তব্ধ। রাজপথের কোলাহল দূর থেকে আবছা গুঞ্জনের মত শোনাচ্ছে। পথের ধারের গাছগুলি কেটে ছেঁটে ছোট করা। তার গলার উপরে ইলোনার হাতের স্পর্শ অনুভব করছে সে। হাতটা কত ছোট, অথচ একইসঙ্গে দৃঢ় এবং নরম।

‘যেও না।‘ সে বলে ওঠে… ‘থাকো, কিম্বা আমাকে যেতে দাও তোমার সঙ্গে। যা হয় হবে। তোমাকে একা ছাড়তে মন চাইছে না আমার। তুমি যুদ্ধ কেমন জিনিস, জান না। যারা এই যুদ্ধটা নির্মাণ করেছে, তাদেরও জান না। এক মুহূর্ত একা থাকা নিরাপদ নয় এখন, যদি না খুব প্রয়োজন হয়।’



(চলবে)

3 comments:

0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in




















২১

স্মৃতির শহর – ৭ – ফ্লোরেন্স

আচ্ছা মানুষের চিন্তার তরঙ্গের সঙ্গে কি ইন্টারনেটের দুনিয়ার কোনও সংযোগ থাকা সম্ভব? নাকি এজাতীয় ঘটনা ঘটলে তাকে আশ্চর্য সমাপতন বলে ধরে নিতে হবে? সমাপতন তো বটেই আর আশ্চর্য না বলে একে মহা আশ্চর্য বললে খুব ভুল হবে না।

এবারের কিস্তিটি লিখব বলে যখন মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি, স্মৃতির অন্দরমহলে চলছে ঘাঁটাঘাঁটি, একদিন ল্যাপটপের বোতাম টেপার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠল একটি ছবি। ছবিটি এক মনোরম সবুজ উন্মুক্ত চারণভূমির। দিগন্তে পাহাড়ের ছায়া। সেই গা-এলানো সবুজ প্রান্তরের ঠিক মাঝখানে একটি ভেড়ার দল। ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। অনুসন্ধিৎসা থেকে কোথাকার ছবি জানবার জন্য মাউসে যেই ক্লিক করেছি, চমকে গেলাম উত্তরটি চোখের সামনে ফুটে ওঠামাত্র। টাস্কানি!

ছোটোবেলায় ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে (তখনও মির্জা গলিব স্ট্রিট বলার রেওয়াজ হয়নি) বাবার অফিসে যেতাম। তার প্রায় লাগোয়া ছিল ঐতিহ্যশালী মোকাম্বো রেস্টুরেন্ট – আজও সেই রেস্টুরেন্ট সেখানেই আছে কিন্তু সেই অফিস বাড়িটি আর নেই। সে অন্য কাহিনি। তো সেই মোকাম্বোতে যাওয়া হত প্রায়ই আর গেলেই আমি খুঁজতাম চিকেন ফ্লোরেন্টিন! তখন অবশ্য উচ্চারণ করতাম ফ্লোরেন্টাইন আর জানতাম না এই নামের সঙ্গে ইতালির টাস্কানি প্রদেশের রাজধানী ফ্লোরেন্সের নিবিড় যোগাযোগ। এমনিতে এই রান্নাটি ফরাসি-ইতালিয় ঘরানার। যে সস এই পদটিতে মাংস বা মাছের সঙ্গে শাকের (পালং জাতীয়) স্বাদের মধ্যে রচনা করে এক অসামান্য ঢলাঢলির সম্পর্ক, তা মূলত ফরাসি গোত্রীয় বেশামেল। কিন্তু বেশামেল সসের মূল উপাদান ময়দা, মাখন আর দুধ। এই রান্নায় তার সঙ্গে মেশে চিজ – যে উপাদানটি পাশ্চাত্য রান্নায় ব্যবহার করার কোনও নির্দিষ্ট ব্যাকরণ আছে কিনা আমার জানা নেই। তাই এই সসটিকে উপাদেয় থেকে উপাদেয়তর করার জন্য কোন চিজ কতটা দেওয়া হবে, তা পুরোপুরি নির্ভর করে রন্ধনশিল্পীর ওপর। ফরাসিরা হয়ত এক্ষেত্রে বেছে নেবে গ্যুইয়ে আর ইতালিয়ানরা পারমিজিয়ানো। এতে স্বাদের তারতম্য বিচার করা মুশকিল, কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে এ ধরনের রান্নার ক্ষেত্রে চিজের একটা বড় ভূমিকা থেকে যাচ্ছে। এবার আসা যাক পদটির নির্মাণ প্রসঙ্গে। চিকেন ব্রেস্টগুলিকে প্রথমে নুন মরিচ মাখিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিতে হবে। এরপর একটি পুরু পাতের ফ্রাইং প্যান গ্যাসে বসিয়ে তাতে দিতে হবে মাখন। মাখনের ডেলাটা যখন গলে এসেছে সেইসময় চিকেন ব্রেস্টগুলিকে ময়দায় একটু ওলট পালট করে নিয়ে প্যানে দিতে হবে মাঝারি আঁচে। ওইভাবেই এক একদিক ভাজতে হবে অন্তত পাঁচ মিনিট। ভাজার পর একটি প্লেটে মাংসের টুকরোগুলি ভালো করে ফয়েলে মুড়ে সরিয়ে রাখতে হবে। এবার সস তৈরির পালা। ওই একই পাত্রে প্রথমে মাখন, তারপর একটু অলিভ অয়েল অতঃপর তাতে অল্প অল্প করে ময়দা মেশানো। ময়দার রংটি যখন সাদা থেকে হলুদের দিকে চলে যাচ্ছে, সেইসময় একটু একটু করে দুধ দিয়ে নেড়ে যেতে হবে সমানে, যাতে তলা ধরে না যায়। এরপর চিজ। এখন সস তৈরি। এবার আগে থেকে ভাপিয়ে রাখা পালং শাক মাখনের মধ্যে রসুন ফোড়ন দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে নিতে হবে। রান্না শেষ। এইবার সাজানোর পালা। একটি প্লেটে প্রথম পালং শাকের একটা বিছানা তৈরি করতে হবে। তার ওপর দিয়ে সাজিয়ে দিতে হবে মাংসের টুকরোগুলি। সবশেষে সসটি ছড়িয়ে দিয়ে ওপরে ছড়িয়ে দিতে হবে মিহি করে কুচনো পার্সলি। ব্যস কেল্লা ফতে! একটা বিষয় আমরা সবাই জানি। তা হল কলকাতার মতো একটা শহরের গড়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে এই পদ্গুলির জনপ্রিয় হয়ে ওঠার একটা সম্পর্ক আছে। সারা পৃথিবীর রন্ধনশৈলী নানা কারণে এসে মিশেছে এখানে আর অসামান্য সব পাচকদের কল্পনা থেকে জন্ম নিয়েছে এক একটি রত্ন। যা কালক্রমে লোকপ্রিয় হয়েছে কন্টিনেন্টাল কুইজিনরূপে। চিকেন (বা ফিশ) ফ্লোরেন্টিন তেমনই একটি। এ তালিকা ফুরনোর নয়। সময়বিশেষে তাই সেই সাম্রাজ্যের অন্দরমহলে প্রবেশ ঘটে যায় অজান্তে। স্বাভাবিক কারণেই। অনেক অনেক পরে এ জ্ঞান হয়েছে যে আদতে কন্টিনেন্টাল কুইজিন বলে কিছু হয় না। ইউরোপের প্রতিটি দেশের হেঁশেল সংস্কৃতি একেবারে ভিন্নধর্মী। আর ইতালিয়ান খাদ্যসংস্কৃতির প্রতি আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতা আর ঋণের কথা তো আমি কবুল করেছি বারবার। এ বিষয়ে ফরাসিদের খুঁতখুঁতুনির কথা বিশ্ববিদিত। কিন্তু ইতালিয়ানদের দাদাগিরি একটু আলাদা ধরনের। আমার মাথায় রান্নার পোকাটি সারাজীবনের জন্য ঢুকিয়ে দেওয়ায় যাঁর একটি বড় অবদান আছে, সেই এক এবং অদ্বিতীয় নাইজেলা লসন একবার বলেছিলেন, ‘ফরাসি রান্নায় রাঁধুনিই সব কিন্তু ইতালিয়ান হেঁশেলে রান্নাই আসল’। একটি বাক্যের মধ্যে এইভাবে দুটি এত সমৃদ্ধ রন্ধন-সংস্কৃতিকে ধরা সহজ নয়। সবাই পারে না। একমাত্র চাইনিজ ছাড়া আর কোনও বিশেষ রান্নাঘরের (ইতালিয়ান) এরকম সর্বব্যাপী প্রভাব আছে বলে মনে হয় না। রান্নার আসল মুনশিয়ানা যে সারল্যে আর টাটকা উপাদান ব্যবহারের মধ্যে। আর সামগ্রিকভাবে এই খাওয়া-দাওয়া নিয়ে একটা গোটা জাতের যে আবেগ আর প্রতিনিয়ত তা উদযাপনের যে ছবিটি ওদেশের সর্বত্র চোখে পড়ে আর মুগ্ধ হতে হয়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য।

ওরাৎসিওর সঙ্গে আলাপের পর থেকেই যে আদান-প্রদান শুরু হল, তা একে একে যেন খুলে দিচ্ছিল এতদিন ধরে বন্ধ হয়ে থাকা জানালাগুলি। সেবছর জার্মানি যাওয়ার একটা কথা হচ্ছিল কারণ অক্টোবরের ৬ তারিখ অলোকদা আশি বছর পূর্ণ করবেন। এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? আমাদের পুরনো বন্ধু পাপিয়া আর ওর বর মারিও থাকে রোমে। ওরাও অনেকদিন বলে আসছে ওদের কাছে যাওয়ার কথা। ঠিক করলাম অলোকদার সঙ্গে প্রথমে দেখা করব, তারপর কয়েকদিন ওদেশে কাটিয়ে চলে যাব ইতালি। রোম হয়ে চলে যাব ওরাৎসিওর সঙ্গে দেখা করতে। রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এয়ারপোর্টের বাইরে পা দিয়েই দেখলাম ওরা দুজন দাঁড়িয়ে – পাপিয়া আর মারিও নিতে এসেছে আমাদের। ওদের পিছনে রোমের নীল আকাশ। দ্য ভিঞ্চির ক্যানভাস যেন! শুধু তুলি ছোঁয়ানো বাকি। ‘প্রথম দর্শনেই প্রেম’ বলে যদি কিছু থাকে, সেটাই যে ঘটে গেল বুঝতে পারলাম শরীরের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ খেলে যাওয়াতে। এর পরবর্তী দশদিন সেবার কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কেটেছিল। ওদেশের স্থাপত্য, নিসর্গ এবং খাওয়া-দাওয়া – সব যেন কেমন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল অবচেতনে। আলাদা করতে পারিনি। মনে হয় চাইও নি।

পাপিয়াদের সঙ্গে একাধিকবার থাকার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, অতিথিরা পৌঁছনোর আগেই ওরা তাদের পরবর্তী গন্তব্য নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করে। তাদের আগ্রহ অনুযায়ী ঠিক করে দেয় রোম থেকে তাদের কোথায় কোথায় যাওয়া উচিত। সেদিনের ডিনার টেবিলে ঘোষণা হয়ে গেল আমাদের পরবর্তী যাত্রাসূচি। দেশ থেকে রওনা হওয়ার আগেই পাপিয়াদের বলেছিলাম আর যেখানেই যাই বা না যাই মিলানে একবার যেতেই হবে ওরাৎসিওর সঙ্গে দেখা করতে। সেই সাক্ষাতের কথা ইতিপূর্বেই লিখেছি। আমাদের এই গোটা ভ্রমণসূচি নির্মাণের কারিগর ছিলেন যিনি, সেই মারিও প্রায়ার প্রায় দুমাস আগে সব ট্রেন (আদুরে ইতালিয়ানে ত্রেনি) বুকিং সেরে রেখেছিলেন। সেই রুট ম্যাপে প্রথম যে জায়গাটির নাম চোখে পড়ল, তা হচ্ছে ফিরেনৎসে অর্থাৎ ফ্লোরেন্স।

রাত তখন প্রায় নটা। অক্টোবরের মাঝামাঝি। ফ্লোরেন্সের রাস্তায় দুজন। দেখে মনে হয় ট্রেন থেকে নেমেছে তারা। পৌঁছতে চায় মাথা গোঁজার জন্য আগে থেকেই বুক করে রাখা একটি হোস্টেলে। রাস্তায় তখন বেশ লোক কম। স্টেশন থেকে সেই হোস্টেলের দূরত্ব আগেভাগে যা মনে হয়েছিল, তা হাঁটাপথের মধ্যে। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি দেখা গেল অন্যরকম। প্রথমত তখনও ঠিকানা খোঁজার প্রয়োজনে বিদেশে রাস্তাঘাটে ইন্টারনেট ডেটা ব্যবহারের প্রশ্ন ছিল না আকাশছোঁয়া খরচের কারণে আর দ্বিতীয়ত পাশ্চাত্যে রাস্তার মানুষজনকে এই ধরনের প্রশ্ন করার রেওয়াজ নেই। তাও লজ্জার মাথা খেয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম একটা রেস্টুরেন্টে। সেখানে তখন উপচে পড়া ভিড়। উচ্চগ্রামে মিউজিক চলছে। চারপাশের কলরোল আর গ্লাসের আওয়াজে চাপা পড়ে যাচ্ছিল কাউন্টারে বসে থাকা মানুষটির প্রতি আমাদের জিজ্ঞাস্য। কোনোক্রমে যখন আমরা কী জানতে চাইছি বোঝানো গেল, তিনি বিরক্তিসহকারে বললেন যে তাঁর জানা নেই। অতএব আবার রাস্তায় আর আবার খোঁজা শুরু। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরপাক খাওয়ার পর যখন অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছনো গেল, তখন সময় অনেক গড়িয়ে গেছে আর শরীর অবসন্ন। এর পরও যা অপেক্ষা করছিল, তা হচ্ছে বহু ডাকাডাকির পর একজনের দরজা খুলে দেওয়া এবং আমাদের জন্য তিনতলার একটি ঘর বরাদ্দ করা। সব মালপত্র হিঁচড়ে অতটা তোলার পর সেদিন আর খেতে যাওয়ারও ক্ষমতা ছিল না। পরদিন একতলায় প্রাতরাশের জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটিতে হাজির হয়ে মনে হল কোনও যাদুদণ্ডের স্পর্শে যেন বদলে গেছে আগের রাত্রে ঘুমিয়ে থাকা জায়গাটি। এত লোক কোথা থেকে এল? তখনই মনে হল, খাওয়ার সময় মানেই তো ওদেশে উৎসব। লোক তো স্বাভাবিক কারণেই থাকবে। আরেকটা বিষয়ের প্রমাণ পেলাম। ওরাৎসিও একবার বলেছিল ইতালিয়ান ব্রেকফাস্ট একটু অন্যরকম। ইউরোপের অন্য অনেক দেশের মতো ঠিক মাংসঘেঁষা নয় বরং মিষ্টিজাতীয় নানান খাদ্যপদ – যার রকমারি প্রাচুর্যে অবাক হওয়া ছাড়া উপায়ান্তর থাকে না। আর থাকে ইতালিয়ান কফি। সে ও এক মারাত্মক আবেগ। সত্যি কফি, ওয়াইন, চিজ, সসেজ বা সালামি দিয়ে মোড়া এক অপরূপ হেঁশেলের নাম ইতালি।

একটি দুর্বল ছেলে। নাম তার ডেভিড। মেষপালক। শুধুমাত্র পাথর ছুঁড়ে সে গোলিয়াথ নামক অতিকায় এক দৈত্যের হাত থেকে রক্ষা করেছিল ইসরায়েলবাসীদের। এ অতি পরিচিত কাহিনি বাইবেলের। মাইকেলেঞ্জেলো বুওনারোতি এই কল্পকাহিনি থেকে সৃষ্টি করলেন এমন এক ভাস্কর্য, যা হয়ে উঠল চিরকালীন দৃপ্ত পৌরুষের প্রতীক। দোতলা বাড়ির সমান সেই শিল্পকাজের সামনে দাঁড়ালে অন্তত সেই সময়টুকুর জন্য জাগতিক আর সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যেতে বাধ্য। স্বপ্নোত্থিতের মতো ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে হেঁটে যাই বাসিলিকা দি সান্তা ক্রোচের দিকে, যেখানে ডেভিডের স্রষ্টার সঙ্গে পাশাপাশি শুয়ে আছেন গালিলেও, মাকিয়াভেলি, রসিনি, জেন্তিলে। এমনও কি হয়? এও কি এক সমাপতন? সর্বকালীন ইতালীয় গর্বের এই সৌধের ঠিক বাইরে যে চত্বর, সেখানে চোখে পড়ল একটি ছোট্ট কাফে যার বাইরে একটি বোর্ড, যাতে লেখা cantuccini e vin santo অর্থাৎ কান্তুচিনি এবং ভিন সান্তো।

বাঙালি মাত্রেই ধোঁয়াওঠা চায়ের কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে খাওয়ার যে বিলাসিতা আমাদের একান্ত আপন বলে জানতাম, ফ্লোরেন্সে সেদিন জানা হল এই গ্রহে আমাদেরও দোসর আছে। বিশেষ একধরনের বিস্কুট, যার প্রধান উপকরণ বাদাম, পাঁউরুটির আকারে তাকে দুবার বেক করা হয় মুচমুচে করার জন্য। অতঃপর তার নাম হয় বিস্কত্তি। সেই কান্তুচিনি খাওয়ার রেওয়াজ হল ভিন সান্তো ওরফে ‘পবিত্র সুরা’য় ডুবিয়ে ডুবিয়ে, আয়েশ করে। কলকাতা আর ফ্লোরেন্সের মধ্যে এমন একটি অবিচ্ছ্যেদ্য যোগসূত্র আবিষ্কার করে সেদিন কেমন লেগেছিল ভাষায় অনুবাদ করা কঠিন।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুব্রত ঘোষ

Posted in


 










২য় পর্ব :

 উষ্ণ লোমে (Lomé)

চতুর্দিকে শুধু নারকেল গাছের ভীর। পায়ের নীচে পরিষ্কার সাদা বালির সমুদ্রতট। গরম হাওয়ার সঙ্গে এক অদ্ভুত ভেষজ গন্ধ ছড়িয়ে আছে। আমরা এখন লোমে শহরে। আর এই সমুদ্র সৈকত কোকো বীচ বলেই খ্যাত। আফ্রিকার তোগোল্যাস দেশের বড় আদরের এই সমুদ্র সৈকতটি। তাই অনেক অভাবেও এর যত্নের কোনো ত্রূটি হয় না। এখানে গাছের ছাওয়ায় কাঠের হেলান দেওয়া সুন্দর চেয়ার পাতা আছে। দু’ গাছের মধ্যে ঝোলানো হয়েছে হ্যামক। আমি তা’তেই শুয়ে শুয়ে সমুদ্র দেখছি। জর্জের লোমেতে আসবারই ছিল। এখানে এসেই ও সমুদ্রের জলের কাছে ছুটে গেছে। রীহা নামে একটি দুয়ালার মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ও আমাদের সঙ্গে এই কোকো বীচে এসেছে। রীহা ফরাসী ভাষার শিক্ষিকা। একটি প্রাণবন্ত যুবতী। ও লোমের একটা বিদ্যালয়ে পড়ায়। ওর বাবা, মা আর ভাইরা ক্যামেরুনে থাকে। দুয়ালাতে ও আমার ছবির  পোর্ট ফোলিও দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিল।

দুলতে দুলতে দেখতে পাচ্ছি রীহা দু’ গেলাস ডাবের সরবৎ নিয়ে আসছে। ওর মাথার চুলের বাহার দেখার মতো। টান টান কাল চাবুক চেহারাটা আরও উন্নত করে একটা গেলাস আমার দিকে তুলে ধরলো। মুখে এক অনাবিল সরল হাসি। ডাবের জলে কি সব যেন মিশিয়েছে, বুঝতে পারলাম না। কিন্তু মনে হোল যেন অমৃত পান করছি। বিদেশী পর্যটকদের কাছে এই সৈকত ভূমি যে স্বর্গ রূপে বিবেচিত হবে, এতে আর সন্দেহ কি । 

এই পর্যটন শিল্পের ওপর তোগো রা অনেকটাই নির্ভরশীল। আটলান্টিকের উপকূলবর্তী এই সব দেশগুলোরই অন্যতম প্রধান উপার্জনের উপায় পর্যটন। এই তোগো দেশটি ও গাল্ফ অফ গিনীর অন্তর্গত, যার দক্ষিণে অপার আটলান্টিক। এর উত্তরে বুরকিনা ফাসো, পশ্চিমে ঘানা, আর পূর্বে বেনা। এই সব দেশ গুলো দীর্ঘবছর ঔপনিবেশিকতার কবলে থাকার পর ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। অতি প্রাচীনকাল থেকে গাল্ফ অফ গিনীর এই দেশের মানুষদের দাসরূপে নিয়ে যাওয়া হতো ইওরোপের সব দেশে। একাদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে এই উপকূলের দেশগুলো দাস ব্যাবসার জন্যে পাশ্চাত্য সমাজে সর্বাধিক আকাঙ্খিত কেন্দ্রস্থেল পরিগণিত হয়েছিল। ক্যামেরুন, ঘানা, তোগো, মালি, আইভরি কোস্ট, গিনী- এই সব আটলান্টিকের তীর সংলগ্ন দেশ থেকে জাহাজ বোঝাই করে দাস রপ্তানী হতো শ্বেতাঙ্গ লোকেদের সেবায়। 

অথচ নিয়তির কি পরিহাস ! এই তোগো আর পাশের দেশ ঘানা র মিলিত উপকূল ভূমিকেই ‘Gold Coast’ বলা হয়। তার কারন, এই উপকূলেই সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল প্রচুর সোনার। সেই সোনার লোভে হিংস্র নেকড়ের মতো দলে দলে পশ্চিমের শ্বেতাঙ্গ দেশগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে এই উপকুলে। প্রথম কয়েক যুগ এখানকার মানুষেরা সোনার মূল্যই বুঝতো না। প্রচীন কালে তো আয়নার বদলে ওরা সোনা দিয়ে দিত। সেই থেকে ক্রমে ক্রমে সব সোনা ইওরোপে চলে যায়। যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে অনেক ক্ষয় ক্ষতি হলেও , Gold Coast এর এই স্বর্ণ ভান্ডারই ঐশ্বর্য্যশালী করে তোলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মতো দেশদের। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের আগে এই তোগোভূমি জার্মানীর দখলে ছিল। তারপর সব ইওরোপীয়ানরা জার্মানীর যথেচ্ছ ক্ষতি সাধনে তৎপর হয়ে উঠলো। বিশেষত: ব্রিটিশদের একমাত্র লক্ষ্য হল জার্মানীর হাত থেকে যত কলোনী  জায়গা আছে, সে সব ছিনিয়ে নেওয়া। জার্মানীর কাছ থেকে ব্রিটিশ ক্ষমতা নিয়েও নিল ১৯১৪ সালে। জার্মানীর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে লাগলো। আর দিকে দিকে ব্রিটিশের ইউনিয়ন জ্যাক উড়তে লাগলো। ক্ষমতা খানিকটা ভাগ হলো ফ্রান্সের সঙ্গে। এই তোগো ভূমিখন্ড ছিল অনেক বড়। এই ভূখন্ডের পশ্চিম থেকে পূ্র্বে যে প্রবাহমনা ভোল্টা নদী আটলান্টিকের শরীরে এসে মিলিত হয়েছে, সেই মিলন স্থানই Gold Coast, স্বর্ণ উপকূল। অনেকটা অংশ জুড়ে ফরাসী রাও আধিপত্য রেখেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে League of Nation ঘোষণা করলো যে, তোগোল্যান্ডের পূর্বভাগ  ফ্রান্সের দখলে আর পশ্চিমভাগের  মালিকানা রইলো ইংরেজদের। ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে ফরাসী আর ব্রিটিশ রা মিলে Territory Government বহাল করলো এই তোগোভূমিতে। Gold Coast পড়লো ব্রিটিশের আওতায়। দশ বছর পর ব্রিটিশদের অধিকৃত এই অংশকে তারা Dominion of the British Commonwealth দেশ হিসেবে মর্যাদা দিল। এর নতুন নাম হল ‘ঘানা’। ঘানা স্বাধীন দেশে রুপান্তরিত হলো ১৯৬০ খ্রীষ্টাব্দে। ফরাসী অধিকৃত অঞ্চলটি ও স্বাধীনতা পেল ঐ বছরেই । এর নামকরন হলো ‘তোগোল্যেস’, সংক্ষেপে ‘তোগো’।

এই সব নিয়ে আমার সঙ্গে জর্জের দীর্ঘ আলোচনা হলো। জর্জের ধারনা ভারতবর্ষকেও প্রায় একই অবস্থায় পরতে হয়েছিলো ব্রিটিশ শাষনে। কিন্তু ভারতবাসীদের সাহেবরা কখনো ক্রীতদাস বানাতে পারে নি। ভারতবর্ষ অনেক অবক্ষয় আর অন্ধকারের মধ্যেও অনেক উন্নত মননের, চিন্তার মানুষদের দেখেছে ঐ দু’শ বছরে। আমাদের দেশের শিক্ষা,আভিজাত্য, আধ্যাত্মিকতা,- এসব কিছু বিদেশী বণিকদের বিস্মিত করেছিল বৈ কি। জর্জের কাছে এসব অজানা ছিল। “আমরা কি এখন Gold Coast এর আশে পাশেই আছি ?” কথাটা জিজ্ঞেস করতেই দেখলাম রীহা তার গলার সোনার হারটা হাত দিয়ে দেখিয়ে হাসছে।

পরের দিন আমি আর জর্জ  রীহার স্কুল দেখতে গেলাম। বেশ অনেকটা ফাঁকা জায়গার ওপরে একটা মিশনারিদের  স্কুল। ওদের অফিসের একজন কর্মচারী আমাদের রীহার ক্লাসঘর টা দেখিয়ে দিল। আমরা লবি ধরে এগিয়ে যেতেই কয়েকটা ছোটো ছোটো বাচ্চা আমাদের দিকে এগিয়ে এল। খানিকটা এসেই থমকে গেল। বড় বড় সরল চোখে আমাদের দেখতে থাকলো। তারপরেই হঠাৎ খিল্ খিল্ করে হেসে এক ছুট। এ যেন এক মধুর অভ্যর্থনা। ওদের হাসি মিলিয়ে যেতেই সামনের এক ঘর থেকে শিশুদের সমস্বরে কিছু আবৃত্তি আর তার সঙ্গে জোরে জোরে তাল ঠোকার আওয়াজ শোনা গেল। সে ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম রীহা ক্লাসে পড়াচ্ছে। ওর সামনে ছোটো ছোটো বাচ্চারা ঘুরে নাচছে। কালো মিষ্টি বাচ্চাগুলো  তালে তালে হাত তালি দিয়ে একসঙ্গে সবাই কিছু বলছে। ভালো করে শোনার চেষ্টা করে বুঝলাম যে ওরা ফরাসী ব্যকরণ শিখছে। দেখলাম রীহা একটা গোলাপী রঙের লম্বা ঘেরের বুবু পরেছে। অনেক বাচ্চাই ওদের মাপের বুবু পড়েছে। বুবু (Boubou) এখানকার নিজস্ব জাতীয় পোশাক। অনেকটা কাপ্তানের মতো দেখতে। এই আটলান্টিকের ধারে পশ্চিম আফ্রিকার সব দেশের জাতীয় পোশাক এটাই। যদিও পাশ্চাত্ত পোশাক, আধুনিক জীন্স্ খুবই জনপ্রিয় এই কৃষ্ণাঙ্গ সমাজে। রীহা তার বাঁ হাত দিয়ে বুবুর এক কোনা ধরে সামনে পেছনে দুলে দুলে বলছে, ‘ Je porte un grand boubou’। বাচ্চারা সমস্বরে, ‘ Je porte un grand boubou’ বলেই হাতে তালি দিয়ে এক পাক ঘুরে যাচ্ছে। কয়েকটি বাচ্চা তাদের সামনে কাঠের ডেস্কের ওপরে চাপড় দিয়ে তাল ঠুকছে। সেই তালে রীহা বলে চলেছে বাচ্চাদের জন্য,’ Nous porton les grand boubous’। সমস্বরে প্রতিধ্বনিত হলো, ‘ Nous porton les grand boubous’। ক্রমে সবাই তালে একটা জোর দেওয়ার জন্য ‘porte’ কথাট দু’বার উচ্চারণ করতে লাগলো। বাঙলা করলে  -‘আমি একটা বড় বুবু পরেছি....তুমি একটা বড় বুবু পরেছো....আমরা বড় বুবু পরেছি ..ইত্যাদি...’। ’ওরা আসলে ফরাসী ভাষার ‘ক্রীয়া’ শিখছে, বিভিন্ন পুরুষে তার ধর্ম চিনছে। কি আনন্দ করেই না ওরা পড়া শিখছে। এ যেন এক performing art য়ের ক্লাস। জর্জ তো তা’ই মনে করেছিল। ও জিজ্ঞেস করলো, ‘ Is it a dance class?’ পরে আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম। রীহার ক্লাসের rythm আর দেহ সঞ্চালন এই অঞ্চলের সব মানুষের মধ্যে দেখা যায়। এই rythm এখানকার মানুষদের রক্তের মধ্যে প্রবাহীত। এই বিশ্বাস ক্রমেই আমার মধ্যে দৃঢ় হলো আরও যত দিন কাটতে লাগলো এই মহাসমুদ্রের তীরে।

  বুবু পরিহীত তোগো মহিলা

আমরা তিন জনে স্কুল থেকে বেরিয়ে পরলাম। রীহার আজ স্কুলে half day। তাই ওর ছুটি। একটা ট্যাক্সি ধরে আমরা ছুটলাম। উদ্দেশ্য প্রথমে  লাঞ্চ করা। খুব খিদে পেয়েছে। জর্জ অবশ্য মাঝ রাস্তায় নেমে গেল। ওর অন্যত্র যাওয়ার ছিল। শহরের ভেতরে একটা রেস্তোঁরা তে ট্যাক্সিটা দাঁড় করালো রীহা। রেস্তোঁরার উল্টো ফুটপাথের ওপরে দেখতে পেলাম মানু দিবাঙ্গোর একটা বিরাট cut out। ওর পুরো ছবিটা আফ্রিকার ম্যাপ জুরে রয়েছে। Air Africa র advertisement। চারিদিকে সব বিল বোর্ড এই ফরাসীতে লেখা। আমি রীহাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানেও মানু  জনপ্রিয় ?’ রীহা জানাল যে, শুধু এ দেশেই নয়। মানু র অসীম জনপ্রিয়তা পুরো আফ্রিকা জুড়ে। ইতিমধ্যে আমরা একটা টেবিল দখল করেছি। Waiter এসে মেনু কার্ড দিয়ে গেল। টেবিল সাজানো থেকে শুরু করে সমস্ত আদব কায়দা ফরাসী দেশের মতো। রীহা আমার কি খেতে ইচ্ছে তা’ জিজ্ঞেস করলো। আমি ওর পছন্দের খাবারই খেতে চাইলাম। আমি তোগোদের খাবার বিষয়ে সত্যি অজ্ঞ। রীহার নির্বাচীত খাবার টেবিলে এল। অদ্ভুত দেখতে একটা মাছের পদ। আটলান্টিকের উপকূলে Gulf of Guinea অঞ্চলে মাছ স্বাভাবিক ভাবেই খুব জনপ্রিয় খাদ্য। মাছগুলো ভালো করে ভেজে একটা চিলি সসে ডোবানো। তা’তে অনেটা টোম্যাটো আর পালং শাক দেওয়া। কিন্তু খেতে আমাদের পরিচীত স্বাদের থেকে অনেক ভিন্ন। ভাতে ক্রিম মেশানো চিনে বাদাম দেওয়া। এই ভাতকে বলে Riz sauce d’archide । আর খেলাম ফুফু। এ সব এদের নিত্য খাবার। সঙ্গে ছিল ফরাসী বাগ্যেৎ, মানে লম্বা রুটি। আগে থেকেই ছোটো ঝুড়িতে রাখা ছিল। ফুফু এখানকার খুব প্রচলিত খাদ্য। মূলোর মতো একজাতীয় লম্বা ভান্ডার মূলকে রান্না করে এই খাবার তৈরী হয়। এই মূলকে রান্না করে নরম পাক দিয়ে একটা ময়দার মতো তাল বানানো হয়। দেখতে অনেকটা আমাদের ইডলির মতো।  তারপর বাদাম পিষে একটা ঝোল বানানো হয়। এ দুইয়ের সমাহারই হলো ফুফু। বাদাম এদেশে প্রচুর পরিমানে হয়। এদের খাবারে বাদামের যথেচ্ছ ব্যবহার দেখলেই তা’ বোঝা যায়। 

Riz sauce d’archide

রেস্তোঁরা তে বেশ কিছু লোক খাবার খাচ্ছে। কিছু ফরাসী ও আছে। তোগো বাজনা বাজছে। লম্বা চেহারার waiter টি এসে জানতে চাইল যে আর কিছু আমাদের লাগবে কি’না। “আমি কি এই অল্প সময়ে তোগোল্যেসের কিছু দেখতে পাব ?.....”  এই কথা বলতে বলতে থেমে গিয়ে ওর দিকে তাকালাম। রীহা মাথা নেড়ে জানালো , আর কিছু নেবে না। আমারও আর কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হলোনা। আমি চেয়ারের পেছনে হেলান দিয়ে সামনে পা দু’টো এগিয়ে দিলাম। দু’পকেটে  হাত দু’টো রেখে শরীরাকে একটু টান টান করলাম। একটা তৃপ্তি অনুভব করলাম। হঠাৎ রীহা আমাকে কি একটা ইশারা করে বলার চেষ্টা করলো। বুঝতে না পেরে টেবিলের ওপর ঝুঁকে ওর দিকে তাকালাম। ও আমাক বোঝাল যে, আমার দু’ পকেটে হাত রেখে কথা বলা হয়তো আমার সম্পর্কে এখানে একটা খারাপ ধারনা তৈরী করবে। কারন এ দেশে দু’পকেটে হাত রেখে কথা বলা কে অভদ্র আচরন বলে গন্য করা হয়। আমি তো অবাক। আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই রীহা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, “চলো, একটা দারুন জায়গায় যাব।“ আমরায় রাস্তায় নেমে পড়লাম। রীহা ঠিক করেছে পা য়ে হেঁটে এখন আমরা যাব। আমাকে ওকেই অনুসরন করতে হবে। আমরা শহরের মধ্য দিয়ে হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো আমার জায়াগায় রবীন্দ্রনাথ থাকলে কি বলতেন,-“আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী !”

রীহা অবশ্যই সুন্দরী। আর ভীষণ স্বপ্রতিভ। যেন মসৃণ কোনো কালো পাথরে গড়া একটা তীক্ষ্ণ চেহারা। টানা টানা চোখ আর লম্বা গ্রীবা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই রীহা এ হেন এই ভবঘুরে বাঙালী ছবি আঁকিয়ে কে নিয়ে লোমে শহরে হাঁটছে। রীহার সব কিছু এখানে পরিচীত। সরু রাস্তা আবার বড় আকার নিল। আমরা একটা বড় বাজারের মতো জায়গায় এসে পড়লাম। আমি ঘর্মাক্ত হয়ে গেছি। এখানে ভীষণ গরম। এ জায়াগাটা আসলে একটা বিরাট বাজার । রীহা দের ভাষায় ‘ Grande super marche’। এই সুপার মার্কেটটি  ভীষণ জনপ্রিয় এখানে। মাইকে গান বাজছে। হকারদের চীৎকার। বহু জনসমাবেশে সমস্ত পরিবেশটা সরগরম। কত জামা কাপড়ের দোকান। তাদের সামনে রণপা য়ে চড়ে বিচিত্র সাজে মুখোশ পরে কয়েকজন প্রায় নেচে বেড়াচ্ছে। আমাদের দেশে এখন বিপননে সাহায্য করতে এইরকম প্রদর্শণ অবশ্য হয়ে থাকে। তবে আফ্রিকার এই অঞ্চলে এর চল বহু যুগ ধরে। ইতিমধ্যে রীহা এক জামার দোকানদারের সঙ্গে খুব হেসে হেসে কথা বলতে শুরু করলো। আমি ঝোলানো জামা গুলো দেখতে লাগলাম। বেশ কিছু জামায় বাটিকের design করা। চমৎকার লাগছে দেখতে। এই আটলান্টিকের পশ্চিম উপকূল অঞ্চলের দেশগুলোর boutique design এর খুব দীর্ঘ ট্রাডিশন। বড় বড় বুবু, পা জামা, টী শার্ট....সব হরেক রঙ্গীন পোশাকের মেলা। এই দৃ্ষ্টি নন্দন  বাজার ছেড়ে আবার হাঁটতে থাকলাম। পেছন থেকে কোনো এক হকার আমাদের উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে এগিয়ে এলো, ‘”Alors mon amie....sil vous plait”। বিক্রেতা ছেলেটা ওর দু’ হাতে ধরা অনেক গুলো কড়ি আর কাঠের মালা  কিনতে অনুরোধ করছিল। আমরা ওর অনুরোধ না রেখে এগিয়ে গেলাম।রীহা অনেক কথা বলে চলছিল। জেনে অবাক হয়েছিলাম যে, ও HIV-AIDS এর সচেতনতার জন্য কাজ করে এমন একটা সংস্থার সঙ্গে সক্রীয়ভাবে যুক্ত। এখানে লোকেদের বিয়ের আগে ও পরে অনেক বাচ্চা হয়। ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যা এ দেশের সব অগ্রগতির অন্তরায়। তার ওপরে রয়েছে নানান রোগের বিস্তার। AIDS য়ের হার অনেক বেশী এখানে। এতকিছু  কি করে সামলায় রীহা ? ওকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। আর ওর প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করছি।

আমরা অবশেষে রাস্তার ধারে একটা বেঞ্চে বসলাম। রীহার চেয়ে আমার নিজেকে বেশী ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছিল। এখানে যেমন বাজার দেখলাম, গড়িয়াহাট মনে পড়ে গেল।আমি রীহাকে কলকাতার গল্প করছিলাম।  ও খুব সাগ্রহে শুনছিল। আর মাঝে মাঝে অনাবশ্যক ভাবে হাসছিল। এমন সময় একটি লোক একটা ঠেলা করে নারকেল নিয়ে যাচ্ছিল। ও আমাদের দিকে তাকাতেই রীহা ওকে হাত নেড়ে ডাকল। লোকটা কাছে এল। কিছু বলার আগেই একটা বড় মাটির পাত্র বের করে তার থেকে কি একটা তরল একটা গ্লাসে ঢালতে শুরু করলো । রীহা লোকটাকে থামতে বলে কেমন এক দুষ্টু হাসি হাসলো । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ Local drinks, চলবে ?” আমি বললাম, “বিষ নয় তো ?” রীহা হেসে উঠে জবাব দিল, “ হতেও পারে”। পানীয়টির নাম ‘সোদাবে’ (Sodabe), তোগোদের খুব প্রিয়। রীহা এর উৎপত্তি, গুনাগুন –এই সব বোঝাতে লাগলো। আমি যে কোনো দেশের খাবার, পানীয় সেই দেশের মাটিতে বসে উপভোগ করতে ভালবাসি। রীহা তাও সবধান করলো, “ এতে কিন্তু নেশা হয়,মাথা ঝিম্ ঝিম্ করে।“ কোনো পরোয়া না করে হাত বাড়িয়ে দিলাম সোদাবের জন্য। লোকটা পানীয়টা তৈরী করে একটা নারকেল দু’ ভাগ করে  নারকেল মালার মধ্যে পানীয়টা  আমাদের দিল। স্ট্র দিয়ে মুখে নিতেই একটা তীব্র অচেনা স্বাদ টের পেলাম। প্রথমটা যেন আমায় একটা ধাক্কা মারলো। তারপর আস্তে আস্তে ভালো লাগলো। নারকেলের গন্ধটা বেশ বুঝতে পারছি। জিজ্ঞেস করে জানলাম, শুধু নারকেলের জলই না। এর মধ্যে আরও অনেক রহস্য আছে। নারকেল গাছের গা য়ের রসকে বেশ কিছুদিন মাটির পাত্রে রেখে জারিত করা হয়। সেই জারিত রসই এর মূল উপাদান। এই রসের সঙ্গে মেশানো হয় কাঁচা নারকেলের জল, যেটা চোখের সামনে একটু আগেই দেখলাম। আর অল্প আদার রস  এবং soda water যোগ করে  অদ্ভুত এক তাজা অনুভূতি আনা হয় এই তরলে। তাল গাছের রস হলে হয়তো ‘তাড়ি’ বলা হত। একে বাঙলায় কি বলত জানি না। রীহা অবশ্য বলল যে, আমাদের এই সরবতে অ্যালকহোলের মাত্রা নিমিত্ত মাত্র। রীহা এই পানীয় নিয়ে অনেক কথা বলল। এই সোদাবে তোগোদের সব উৎসব অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। সেখানে অবশ্য অ্যালকহোলের মাত্রা অনেক বেশী থাকে। রাস্তায় ফেরীওয়ালারা  ট্যুরিস্টদের পানীয় কে অনেক হাল্কা করে তৈরী করে। কিন্তু আকোদেস্সাওয়া (Akodessawa) র রাস্তায় ঢুকলে চরম নেশার সোদাবে না সেবন করে নিস্তার নেই। আকোদেস্সাওয়া তেই রয়েছে সর্ববৃহৎ ‘ভুডূ’ বাজার। এই ‘ভুডূ’ চর্চা এ অঞ্চলে সুপ্রাচীন। ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী , ব্যেনা ,তোগো আর ঘানার  কিছু অংশে এই আদিম ধর্মীয় রীতির উৎপত্তি। ঐ ভুডূ বাজার গেলে দেখা যায় সার দিয়ে রাখা বিভিন্ন পশুর মৃতদেহের ভীড়। কুমীরের দেহ, শেয়ালের খুলি, হায়নার পা, খুলি,....কি নেই। বিক্রি হয় ভুডূ ঠাকুর, পুতুলও বলা যায়। এই ঠাকুরদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ইওরোবা। এই ঠাকুরদের উপাসনা করা হয় ঐ মৃত পশুদের দেহাংশ দিয়ে। এক এক পশুর মৃত আত্মাদের থেকে এক এক রকমের শক্তি অর্জন করা হয়। উপাসনা করেন পূজারী। এই বিশেষ বাজারে পূজারীরও খোঁজ মেলে। কোন পূজোয় কোন জন্তুর কোন শরীরের অংশ লাগবে তা’ অভিজ্ঞ পুরুত ঠাকুরই ঠিক করে দেন। কালের যাত্রায় ক্যাথলিক ধর্মের কিছু প্রভাব এর ওপরে পরে। ঔপনিবেশিকতার দীর্ঘ চাপে এই অঞ্চলের বেশীরভাগ মানুষ খ্রিষ্টান ধর্মীয়। প্রায় ৩৭% মানুষ এখনো এই ভুডূ চর্চা করে। নানান দেশর লোক এই Fetish market টি দেখতে ছুটে আসে। 


ভুডু পুতুল
আমার ঐ বাজারে যাওয়ার ব্যপারে রীহা প্রবল আপত্তি করলো। সে আপত্তি ওর ক্যাথলিক  স্বত্তা থেকে এল কি না জানি না। তবে এ কথা তো সত্যি যে ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারনবশত: এই আদিম উপজাতিদের আর উপনিবেশের প্রভুদের ধর্ম বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। এই উপকূলের ক্রীতদাসদের মাধ্যমেই ‘ভুডূ’ ক্যারেবিয়ান দ্বীপমালায়, আমেরিকার ল্যুইসিয়ানায়, ইওরোপের বিভিন্ন অংশে পৌঁছে যায়। এই Voodooism নীগ্রো দলিত দাসদের একমাত্র শক্তির সম্বল হয়ে উঠেছিল। খ্রীষ্ঠানরা কালো দাসদের এই ধর্ম চর্চাকে ‘কালো যাদু’ বা হানিকর বিদ্যা বলে প্রচার করে এসেছে। আমরাও সেই প্রচারের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারি নি। কিন্তু তোগোদের এই ভুডূ চর্চা কোনো ক্ষতিকারক কাজে উৎসর্গীকৃত হয় না। এই উপাসনায় শুধু শক্তিকে আবাহন করা হয়। দুর্বলকে যেন ‘ভুডূ’ শক্তি যোগান, এই কামনাই করা হয়। আর ঐ  পশুদেহের বিভিন্ন অংশ দিয়ে বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ তৈরী হয়। বহু দরিদ্র আফ্রিকাবাসী ঐ ওষুধের ওপর নির্ভর করে। অতীতে আমাদের দেশ, চীন বা আরও অনেক প্রাচীন দেশে পশু-পাখির দেহাংশ দিয়ে আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরী খুব অপরিচীত নয়। আবার এও সত্য, ভারতবর্ষ  শল্য চিকিৎসা আর অস্ত্রপচারের মতো আধুনিক চিকিৎসা বহু যুগ আগেই আবিষ্কার করেছিল.....যখন ঐ উপনিবেশ প্রভুরা ‘ভুডূ’ র মতোই কিছু চর্চা করে দিন অতিবাহীত করতো।

ভুডু অনুষ্ঠান

রীহা ভুডূ চর্চা সমর্থন করে না। যদিও এই সব উপজাতিদের প্রতি ও যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। একটি ভুডূ পরিবারের একটি শিশুকে ও ভুডূ পুরোহিতদের হাত থেকে মুক্ত করে। শিশুটির শরীরে কিছু পবিত্র ভুডূ চিহ্ন খুঁজে পাওয়ায় প্রথা অনুযায়ী শিশুটিকে তার চার বছর বয়সে ভুডূ পুরোহিতদর হাতে চিরদিনের মতো তুলে দেওয়া হয়। পুরোহিতরা এই সব শিশুদের সংগ্রহ করে আগামী প্রজন্মের ভুডূ উপাসক তৈরী করে। ঐ ছেলেটির যখন ছয় বছর বয়স তখন রীহা তার সতীর্থদের নিয়ে তাকে প্রায় চুরি করে নিয়ে আসে। তাকে এখন এক বান্ধবীর কাছে রেখে বড় করছে। তার পড়াশোনার সব দায়িত্ত্ব রীহা নিজে নিয়েছে। তবুও রীহার আক্ষেপ যে, ও একটি মাত্র ছেলেরই দায়িত্ত্ব নিতে পেরেছে। আরও কত ছেলের জীবন অশিক্ষার অন্ধকারে এই ভুডূর মায়া জগতে শেষ হয়ে যায়।

একটা ট্যাক্সি নিয়ে রীহাকে ছেড়ে দিয়ে ঘরে ফিরবো ঠিক করলাম। ট্যাক্সি একটা ধরেও ফেললাম। অনেক অনেক মাইল ছুটছে ট্যাক্সি। সূর্য্য তখন পাটে। তোগো লেকের গা বেয়ে আমরা  ফিরছি । এই বিলটি এত বড় যে তার ওপার দেখা যায় না। এই বিশাল জলভূমির সঙ্গে কয়েকটি তন্বী সুন্দরী নদী যুক্ত হয়েছে। যেমন একটু পরেই দেখতে পেলাম সিও নদীর এক শাখাকে। রীহাই চিনিয়ে দিচ্ছিল। এ সমস্ত জলরাশি অনেকটা পথ ঘুরে মিশেছে সাগরে। সাগর পার থেকে একটা অদ্ভুত উষ্ণ বাতাস কোন এক অজানা সময়ে নিয়ে যাচ্ছে। মেঘের ভেতরে ডুবতে ডুবতে সূর্য্যের সোনালি ছটা ছিটকে ছিটকে পড়ছে। আমার পাশে রীহাকে সেই সোনালি ছটায় কি আশ্চর্য্য সুন্দর দেখাচ্ছে। এক অপূর্ব মানবিক রুপ তার। এ রুপ এসেছে তার দয়া, মমতা আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে। খুব অবাক লাগছিল ভেবে যে শতাব্দির পর শতাব্দি অত্যাচারীত হতে হতে শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এত বিশ্বাস, এত ভালবাসা, এত খুশী বেঁচে থাকতে পারে এ দেশে ! রীহাকে না দেখলে জানতেই পারতাম না।

*In a simple country homestead, passions simmer in the same manner as in a ‘civilized’ manor with all its comfort. We then realize that passion is not the sole prerogative of a given race that has reached a degree of civilization. To blossom, passion needs only the heart of man (Felix Couchoro, L’Esclave, 1929, p.23).

ফেলিক্স কূশোরো ( Felix Couchoro) তোগোল্যেসের বিখ্যাত মনিষী যার লেখার মধ্য দিয়ে এদেশের জনমানসের চেতনার প্রথম উন্মেষ ঘটে। তাঁর L’Esclave (Slave) বই টি শুধু তোগো দেশেই নয়, যথেষ্ট প্রভাব ফেলে খোদ ফরাসী দেশেও। ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দে  আমেরিকার লেখিকা হ্যারিয়েট বীচার স্টোয়ের লেখা ‘Uncle Tom’s Cabin’  এর পর প্রায় একই শক্তিতে ১৯২৯ এ  কূশোরোর এই লেখা সাদা সমাজকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তাদের অমানুষ বৃত্তিকে দেখিয়ে দেয়। কালো সমাজ তাদের অধিকার আর মর্যাদা রক্ষার প্রতি সরব হতে থাকে । পশ্চিম উপকূলে ফরাসী উপনিবেশগুলোয় L’Esclave য়ের  প্রভাব  দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

“তুমি নিশ্চয়ই কূশোরো পড়েছো, তাই না রীহা ?”- জিজ্ঞেস করতেই মুখের থেকে চুল সরাতে সরাতে ও উত্তর দিল – “ কূশোরো আমার ঈশ্বর”। এদিকে রীহার গন্তব্য স্থান এসে গেল। নদীটা শেষের মুখে। এখান থেকে বাঁদিক  ঘুরে এগোলেই আটলান্টিকের তীর। আমাকে ঐ দিক দিয়েই ফিরতে হবে। এখানে বাঁ দিকে নদী, ডান দিকে শহরের রাস্তা। রীহা নেমে দাঁড়াল। আমিও নামলাম। যেন একটা মোহনায় এসে দাঁড়িয়ছি আমরা। তারপর রীহা এগিয়ে এসে আমাকে ফরাসী কায়দায় বিদায় চুম্বনের ছোঁয়া দিল। মুহূর্তের জন্য মনে হল রীহার এই স্পর্শে  শুধুই ভদ্রতা নয়। এক আত্মিক আবেদনও অনুভব করলাম। চলে যেতে যেতে আমাকে বলল, “তুমি খুব ভাল মানুষ। এরকমই থেকো, বদলে যেও না”। 

ট্যাক্সি ছুটল সমুদ্র তীরের দিকে। মনে মনে বললাম, -“রীহা,আমি বোধহয় তোমার মত অত ভাল নই। সমাজের আমি কি উপকারে লাগি ! তুমি ভাল থেকো। তোমার মতো আরও রীহা যেন এ দেশে জন্মায়।“

রীহার সঙ্গে আমার আর কখনো যোগাযোগ হয় নি। জানতেও পারি নি, ও কেমন আছে। একটা ছোট্ট বালির কণার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি কত জায়গায়। এতগুলো বছর পরেও রীহাকে নিয়ে মনের মণিকোঠায় সেই একটুকরো সোনালি স্মৃতি আজও উজ্জ্বল রয়েছে।


দৃশ্য ঋণ - http://hirodelle325ducamer-net.over-blog.com/2016/04/cameroun-riz-sauce-d-arachides-le-delice-des-populations-beti.html


0 comments: