0

গল্প - সুস্মিতা হালদার

Posted in




















(১)

বছরের প্রথমদিনের দুপুর। তাও আবার সালটা ২০২১। মহামারীর প্রাদুর্ভাব তখনও কাটেনি। আবার শোনা যাচ্ছে নতুন স্ট্রেন নিয়ে রোগ ছড়াচ্ছে করোনা ভাইরাস। ব্রিটেন থেকে ভারতেও এখন চলে এসেছে। অস্তিকার কাছে অবশ্য এগুলো খবরের কাগজে বন্দি হয়ে থাকা খবরমাত্র। কী-ই আর হবে এসব ভেবে! জন্মেছে যখন মরতে তো হবেই। শুধু একটু সাবধানতা আর নিয়ম মেনে চলা— যাতে ওর থেকে অন্য লোকের কোনও ক্ষতি না হয়। নিজের জন্য এখন আর কিছু ভাবে না অস্তিকা। ভাবতে ভাবতে বিধ্বস্ত হয়ে ভাবাটা এখন ছেড়েই দিয়েছে। মাত্র বত্রিশ বছর বয়েসই জীবনটা হঠাৎ কেমন যেন থমকে গেল। না না, এ থমকানো শেষ নিঃশ্বাস ফেলা বোঝায় না! সে সৌভাগ্য আর হল কোথায় তার! অন্তত মরে বেঁচে থাকার চাইতে সত্যিকারের মৃত্যু অনেক ভালো। হ্যাঁ, অস্তিকার জীবনে এখন খালি মৃত্যুচিন্তাই আসে— তার জীবনটা পুরোটাই শুধু ভাঙার খেলা— যেটুকু গড়েছিল, তাও ভেঙে গেল। নাহ্, প্রেম-বিয়ে সংসার এসব কিছুই ভাঙেনি। একটা অতি অ-বাস্তব স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছে— যেটা তার কাছে প্রেম-বিয়ে-সংসারের সমান— লেখিকা হওয়ার স্বপ্ন—‘বড়’ সাহিত্যিক।

আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে ‘আনন্দবাজার’টা ভাঁজ করে রাখল অস্তিকা। আলগোছে এলোচুলে ঢিলে খোঁপা বেঁধে নিল। শীতকালে দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়ার পর ছাদে মাদুর পেতে বসে বসে খানিকক্ষণ খবরের কাগজটা পড়ে। আগে কলেজ থাকতে সময় হত না। শুধু শীতকালের ছুটির দিনগুলোয় দুপুর রোদে ছাদে মাদুর পেতে বসার অভ্যেসটুকু জিইয়ে রাখত। এ তার সেই উচ্চমাধ্যমিকের সময় থেকে ধরা অভ্যাস। তখন ‘টেস্ট’ পরীক্ষার পর তিনমাস শুধু ঘরে বসে পড়া। স্কুলে যেতে হত না। তারপর একেবারে উচ্চ-মাধ্যমিক। ‘টেস্ট’ পরীক্ষাটা ওই নভেম্বরের দিকে হত। পরীক্ষা শেষ হতেই জাঁকিয়ে শীত পড়ত। আর দুপুর রোদে ছাদে বসে বসে ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ পড়ত। সেই থেকেই শুরু — ওর সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্ন দেখার। ছোটবেলা থেকে টুকটাক লেখালেখি করার অভ্যাস অবশ্য ছিল। স্কুলের ম্যাগাজিনে, পাড়ার কালচারাল ক্লাবের ম্যাগাজিনে মাঝে-সাঝেই লেখা বেরোত। কিন্তু তখনও স্বপ্নটা সেভাবে জাঁকিয়ে ধরেনি মনকে। ক্লাস ইলেভেনে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিদ্যাপতির ‘রাধা’ চরিত্র পড়তে গিয়ে প্রথম প্রেমে পড়ে— সাহিত্যের। তারপর বাড়ির অমতে বিয়ে করার মতো বেছে নিল ‘সাহিত্য’কেই— অ্যাকাডেমিক ডিগ্রির জন্য। তবে ইংরেজি নিয়ে পড়ার প্রচন্ড ইচ্ছে থাকলেও ওদিকে গেল না— বাংলা নিয়ে পড়ল। বর্ধমান ইউনিভার্সিটি থেকে। যদিও বাংলা অনার্স মানে বেকার সন্তানই। আসলে সে বরাবরই বাংলা মিডিয়ামে পড়েছে। বাড়িতে ইংরেজি চর্চাও অতো নেই। সঠিক ইংরেজি লিখতে পারলে বা বুঝতে পারলেই তো আর হল না! ভাষাটার ওপর দখলও তো থাকা চায়। ইংরেজি গল্প-উপন্যাস-কবিতা সবই পড়ে সে, বুঝতেও পারে। তবুও মধ্যবিত্তয়ানা থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না, সংশয়-সঙ্কোচ কাটিয়ে। অগত্যা বাংলা নিয়েই পড়া। সেই সঙ্গে শুরু হল একরকম দাম্পত্য জীবন— সাহিত্যের সঙ্গে। বর্ধমান ইউনিভার্সিটির গোলাপবাগের ক্যাম্পাসে ক্লাস হত। পুরনো মোটা দেওয়ালগুলোর আনাচে-কানাচে এখনও যেন লেগে রয়েছে তার ফেলে আসা অনেক রোমান্টিক মুহূর্ত। গ্রাজুয়েশান করতে করতেই লিখে ফেলে একটা উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস। কোনো বড় পাব্লিশার বা পত্রিকায় নেয়নি। সাধারণ ছোট একটা পাব্লিশার থেকেই বের করে। তবে বিক্রি হল প্রচুর। কিন্তু সেটা ওর কাছে প্রচুর। প্রায় এক-দেড়শো কপি। একটু একটু করে স্বপ্নের দেওয়াল গড়তে থাকে অস্তিকা। এরপর ধরে ছোটগল্প, বড়গল্প, অণুগল্প, কবিতা। একটা নাটকও লিখে ফেলে। নাম দেয় ‘গুলঞ্চেরা’। বাবা-মেয়ের অন্যরকম মিষ্টি রসায়নের এক গল্প। সুরকার বাবার সৃষ্টি করা সুরে বাঁধা পড়ে মেয়ের বেড়ে ওঠা— শৈশব, কৈশোর, যৌবন। মেয়ে অটিজম আক্রান্ত। বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন। তার জগতে শুধু তার বাবা— তার প্রথম ভালোবাসার পুরুষ। খুব যত্ন নিয়ে গড়েছিল নাটকটা। মনস্তত্বের এক জটিল খেলায় নিজেকেও জড়িয়ে ফেলে অস্তিকা। একটু বেশিই আশা করেছিল তার জন্য। এই নাটকটা নিশ্চয় অনেকেরই ভালো লাগবে, তাই না? শুরু হল স্বপ্ন ভাঙার খেলা। নাটকটার কদর করতে পারলেন না প্রায় কেউই। উঠতি লেখিকা এরকম নাটক লিখেছেন, যেখানে নাটকের থ্রিডাইমেনশানে এসেছে সিনেমাটিক এফেক্ট। প্রোজেক্টর দিয়ে দেখানো হবে চরিত্রের মনের মধ্যে ফুটে ওঠা নানান ছবির প্রতিবিম্ব। পাশ্চাত্য নাটকের মতো স্টেজ ডেকরেশন। রিয়েল লাইফ সেট-ঘর, বিছানা, ডাইনিং রুম, অফিসঘর, দোকানঘর-এসব! ওয়েস্টার্ন ফোকের মিউজিকে বাংলা লিরিক্স দিয়ে থাকবে গান। এসব মানা যায় নাকি? স্বনামধন্য কোনো লেখিকা লিখলে বাংলা নাট্য-সাহিত্যের যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে প্রচার করা যেত। কিন্তু তা বলে কোথাকার কে অস্তিকা চোঙদার— তার আবার লেখা! আর নামটাই বা কীরকম চোঙদার— কেমন যেন চোঙের কথা মনে পড়ে যায়। হ্যাঁ, এসব অনেক কিছুই শুনতে হয়েছে অস্তিকাকে— আড়াল আবডাল থেকে। অনেক বড় বড় নাট্যগোষ্ঠীর কাছেও হাজির হয়েও গেছলো নাটকের স্ক্রিপ্ট নিয়ে। তাঁরা তো বড় মানুষ। সরাসরি খারাপভাবে কাওকে বলেন না। তাই মিষ্টি কথায় সুরেলা অপমানে বিদেয় দিয়েছিলেন অস্তিকাকে। পয়সার অভাব, সেট নেই, লোক নেই, “লোক পেলে জানাবো, ফোন নম্বর দিয়ে যান”— এসব ঠুনকো সান্ত্বনা দিয়ে। তারপর প্রায় এগারো-বারো বছর কেটে গেল, তাও কোনো ফোন এলো না। কেউই হয়তো লোকও পান নি, আর পয়সাও আসে নি। এমনি এমনিই নাট্যোৎসবে নাটকগুলো নামিয়ে দিচ্ছেন! ...হাসিও পায় অস্তিকার, অজুহাতগুলো ভাবলে। প্রায় দশ বছর অপেক্ষা করার পর এই গতবছরের আগের বছর মানে ২০১৯-এ একটা মাঝারি নাট্যোগোষ্ঠীর পত্রিকায় ছেপে বেরিয়েছে নাটকটা। সে-ও আর এক কাহিনী। নাটকের স্ক্রিপ্ট পড়ে তো কর্ণধারের খুব মনে ধরেছিল। অনেক প্রশংসাও করেছিলেন। প্রকাশিত হওয়ার পরে তিনি ভুলেই গেলেন কমপ্লিমেন্টারি কপিটা পাঠাতে। ‘আজ নয় কাল দেব’ করতে করতে পত্রিকার ওই সংখ্যার সবকটা কপিও শেষ হয়ে গেল। অস্তিকা নিজের চোখে দেখতেও পেল না তার সন্তানকে। জন্মের পর হাসপাতাল থেকে বাচ্চা চুরি হয়ে গেলে বা হারিয়ে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনেক দোষ হয়। কিন্তু লেখক-লেখিকার লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি একটা কপিও যদি না পান তাহলে তার দায়ভার কেন নেই প্রকাশক-সম্পাদকদের ওপর? আইন কি এক্ষেত্রে চোখে ঠুলি এঁটে আছে? একজন সাধারণ সাহিত্যিকের কি কোনও মানবাধিকার নেই? অভিমানটা উগরে দিয়েছিল একদিন রুহির কাছে। রুহি অস্তিকার পাড়ারই মেয়ে। ল’ নিয়ে পড়ে এখন প্র্যাকটিস করছে, মূলত কলকাতায় — শিয়ালদা আর ব্যাঙ্কশাল কোর্টে। অস্তিকার চেয়ে বছর পাঁচেক-এর ছোট।

—“আইন আছে, আবার নেই, মানে খানিকটা থেকেও নেই। ‘দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকি না’ টাইপ। কী বল তো, এই কপিরাইট অ্যাক্ট, 1957... এটা এখনও ইনফ্যান্সি স্টেজে আছে। অবশ্য আমাদের দেশে কোন আইনটাই আর শৈশব কাটিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে! বাচ্চাদের যেমন লজেন্স দিয়ে ভুলিয়ে এটা-সেটা করিয়ে নেয় বড়রা, আমাদের দেশে আইনের অবস্থাও তাই। যাঁর হাতে যত ‘লজেন্স’ বেশি তিনি বেশি খেলাচ্ছেন আইনকে। এসব কী বল তো, শুধু দেখে যেতে হয়। কিছু বলতে নেই।” রুহির কথাবার্তাগুলো এমন ধরনেরই। যেন ধারালো ছুরি! যদিও অস্তিকা একটু ভয়েই থাকে, রুহি এমন কটকট করে কথা বলে, যদি এসব কোনওদিন কোর্ট চত্বরে বা পাবলিক প্লেসে বলে দেয় তাহলে তো কেস কাছারিতে ফেঁসে যাবে! এই তো সবে শুরু ওর জীবনের! একটু সমঝে কথা বলতে পারে না! ওর কাছে নিজের দুঃখ অভিমানের কথাগুলো বললেও আবার বিপত্তি!

—“আরে ছাড়ো তো অস্তিকাদি। কেউ আমাকে ফাঁসাতে পারবে না। একদিকে ফাঁসালে আর একদিকে ঠিক বেরিয়ে আসার রাস্তা আছে। যাক গে ওসব ছাড়ো। তোমায় বলি কি দিনরাত সেই আশি বছরের বুড়িদের মতো ‘হায় হায়’ করে দীর্ঘশ্বাস না ফেলে নিজের একটা ব্লগ তৈরি করো। মনের আনন্দে লেখো আর পোস্ট করো। পাব্লিসিটি করার ব্যবস্থা হয়ে যাবে ঠিকই।”

রুহিও ঠিক বোঝে না অস্তিকার কষ্টের জায়গাটা। অবশ্য কেই-বা বুঝল ওকে? নিজেকে তো বোঝাতেই পারে না। আর এত অবাস্তব জগতে থাকলে মানুষ আর তার মনের নাগাল পায় কী করে! তাও রুহির কাছেই নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে বারবার।

—“আমি সস্তায় পাব্লিসিটি চাই না সে তো তুই জানিসই। সে চাইলে তো ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ এসবেই এই নিজের লেখা ছড়িয়ে বেড়াতাম। এগুলো ছড়ানোকে পাব্লিকেশন বলতে আমার রুচিতে বাধে।”

বড় অদ্ভুত রুচি অস্তিকার। লোকে যখন পড়াশোনা করে বড় বড় মাইনের চাকরির পিছনে দৌড়োয়, অস্তিকা তখন ‘সাধারণ’ সাহিত্যে একটা পর একটা ডিগ্রি অর্জন করে সরকারি কলেজে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে চাকরির পরীক্ষা দেয়। পেয়েও যায়। চাকরিটা নেহাত দরকার পেট চালানোর জন্য। সহজ পথ ছেড়ে বেছে নিয়েছে বড় জটিল একটা পথ— বড় সাহিত্যিক হওয়ার— পেশাদার সাহিত্যিক।

লেখা কোন পত্রিকা, ওয়েবজিন নিল না তো কি হয়েছে, ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ এসবে তো পোস্ট করাই যায়! কত কত শেয়ার হবে! লাইক পড়বে, কমেন্ট আসবে। কিন্তু অস্তিকার এসবে রুচি নেই। এগুলো সহজলভ্য যে! সে বাছে কঠিন পথটাই। তাই ভালো লাগে যখন কোন পত্রিকায় লেখা মনোনীত করে। ফেসবুকের হাজার হাজার কমেন্টের বদলে আলে-কালে আসে একজন ভক্ত-পাঠকের চিঠি বা ই-মেইল। পাব্লিশারদের কাছ থেকে জোগাড় করেন তাঁরা, অস্তিকা ই-মেইল আইডি। নিজেদের তাগিদেই। কেউ কেউ লেখা পড়ে ভালো লেগেছে এটুকু জানাতে মেইল পাঠান। কেউ বা আবার গবেষণার জন্য। হ্যাঁ, অস্তিকার মতো খুব সামান্য, অতি সাধারণ নাম-না-জানা লেখিকার লেখা পড়ে সেটা নিজের গবেষণার অঙ্গ করতে চান কেউ কেউ। হয়তো সেই গবেষণা খুব সাধারণ। তবু কোনও এম.ফিল. বা পি.এইচ.ডি. থিসিসে একটুখানি হলেও জায়গা পাচ্ছে তার লেখা, এই কি অনেকখানি পাওনা নয়?

—“ও দিদি, চালটা কতটা নেব?” রান্নার মেয়েটির ডাকে ঘোর কাটে অস্তিকার।

—“এখনই রাতের ভাত বসাচ্ছ? সবে তো তিনটে বাজে। একটু শুয়ে নাও। ওদিকে সন্ধে হলেই তো ঢুলতে থাকো।”

—“না, এই শীতের দিনে গড়ালে আর উঠতে মন করবে না। এক্কেবারে কাজ সেরে নেব সকাল সকাল করে।”

— “চলো নিচে। খানিক পরে যাচ্ছি। দেখতে হবে কতটা ভাত আছে। জামা-কাপড়গুলো তুলে নাও তো, শুকিয়ে গেছে। আর একটু গড়িয়ে নেবে তো নাও। তখন রান্না করতে করতেই গ্যাসের উপর এমন ঢুলে পড়ো আমার ভয় লাগে।”

দড়িতে শুকোতে দেওয়া জামা-কাপড়গুলো তুলতে তুলতে বলতে থাকে অস্তিকা। রান্নার মেয়েটি মানে সুজাতার হাতের কাপড়গুলো ধরিয়ে দেয়। মাদুরটা গোটাতে গিয়েও থেমে থাকে। না, আরেকটুখানি থাকাই যায়। অন্তত একটা ঘণ্টা। অন্যদিন এই সময় কিছু না কিছু পড়ে, না হলে লেখে। লকডাউনের পর থেকে প্রায় ন’মাসের অভ্যাস। গরমকালটায় নিজের ঘরেই পড়ত। শীত পড়তে ছাদে এসে বসা শুরু করেছে। দুপুর রোদটায়। আবার পাঁচটা থেকে ক্লাস নিতে হয়। আজ অবশ্য ক্লাস নেই। সুজাতাকে নিচে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে একটু গড়িয়ে নিল মাদুরটায়। শীতটা জাঁকিয়ে পড়েছে। গায়ের শালটা পা অবধি ঢেকে নিল।

(২)

মোবাইলটা অনেকক্ষণ থেকে বাজছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী’- এটা অস্তিকার ফোনের রিংটোন। চোখটা লেগে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য— ফোনটা বারবার বাজছে। ঘুমটা ভেঙে গেল।

—“হুঁ! বল রুদ্র।” ফোনটা রিসিভ করে অস্তিকা। গলায় একটু আতঙ্কের ছাপ। এই অসময়ে রুদ্রর ফোন! এখন তো ওর অফিস টাইম। আরও কিছু হয়েছে?

গত পাঁচ মাস ধরে ভীষণ ভয়ে আছে অস্তিকা। সবসময় যেন একটা ট্রমা কাজ করছে। কারোর কোনো ফোন এলেই আগে খারাপ কিছু একটা ভেবে বসে। আর শুভ্রনীলের ফোন এলে তো আরোই ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। পাঁচ-ছ’মাস হয়ে গেল তাও কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না ওর সঙ্গে। ওই তো প্রথম খবরটা দিয়েছিল।

—“অনেকদিন কল করা হয়নি। আজ ফ্রি আছি তাই করলাম। জাস্ট খোঁজখবর নিতে। বাই দ্য ওয়ে, হ্যাপি নিউ ইয়ার। এক্সপেক্ট করি, এবার ভালো কিছু হবে।”

—“আর ভালো…” ছোট্ট শ্বাস ফেলে অস্তিকা।

—“কী করছিস? এখন?”

—“এই শুয়েছিলাম। আজ তো ক্লাস নেই।”

—“ও সরি, বিরক্ত করলাম তাহলে। ঠিক আছে, বিশ্রাম নে, রাতে কল করব। বাই।”

না, শুভ্রনীল অস্তিকার বয়ফ্রেন্ডও নয়, হাজব্যান্ড নয়। বন্ধু, খুব ভালো বন্ধু। অবশ্য অস্তিকার একটা ক্ষীণ ইচ্ছে রয়েছে। শুভ্রনীলের সঙ্গে রুহির ফ্যামিলি সেটলমেন্ট করানোর। অস্তিকা এখনো পর্যন্ত নিজে বিয়ে করেনি। সুযোগ যে আসেনি তা নয়। বরং যতবারই এসেছে সে হেলায় ঠেলে দিয়েছে। কোনও পুরুষই তার মনে ধরে না। যে যৌবনে পা দিতে না দিতেই ‘পুরুষ’ গড়ে স্বপ্ন দিয়ে, আবেগ দিয়ে, বাস্তবের মাটিতে যদি সেই স্বপ্নের পুরুষকে না পায় তাহলে অন্য কাউকে গ্রহণ করে কী করে? যে কয়টা সম্বন্ধ এসেছিল সবকটাই কেমন যেন ম্যাদামারা। ছেলেগুলোর হয় বিরাট ‘ঘ্যাম’, না হলে মায়ের আঁচল ধরা ‘আহা রে, ভালো ছেলে’। কোথায় আর এলো তার স্বপ্নের পুরুষ— যে দুই বাহু দিয়ে আঁকড়ে ধরবে, পুরু ঠোঁট দু’খানার উষ্ণ স্পর্শে ভরে যাবে অস্তিকার চোখের পাতা—কপাল—চিবুক! যার গলায় ভেসে যাবে সেই সুর —“তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা তুমি আমার সাধের সাধনা”। অবশ্য এটা ছাড়াও আরো একটা কারণ রয়েছে। মানুষ বড্ড বেশী সভ্য হয়ে গিয়েছে। ‘Women Empowerment’-এর চক্করে পড়ে এতটাই সামাজিক জাগরণ হয়েছে যে ছেলেরা চাইছে তাদের স্ত্রীরা লাস্যময়ী একটি নারী মূর্তি হবে। চাকরি না করলেই ভালো। যদি চাকরি করে একান্তই তাহলে স্বামীর চাইতে স্ত্রীর ‘স্যালারি’টা যেন কম হয়। আর স্ত্রী চাকরি যেখানে-সেখানে করতে পারবে না। স্বামীর চাকরিস্থলের কাছেপিঠেই হতে হবে স্ত্রীর চাকরির জায়গা। অস্তিকা অপরূপা সুন্দরী নয়, লীলায়িত শারীরিক ভঙ্গিমাও তার আসে না। তার চেহারায় ‘বৌমা’, ‘স্ত্রী’, ‘প্রেমিকা’ এই গন্ধগুলোই খুব বেমানান। তার ওপর আবার সরকারি কলেজে পড়ায়। কাজেই বদলির চাকরি। এমন মেয়ে বিয়ের যোগ্য পাত্রী হতে পারে? তবে বিয়ে যে এই জীবনে করবেই না এমন ছুঁৎমার্গও তার নেই। শুধু আর একটু অপেক্ষা। এখন তো লোকে চল্লিশেও বিয়ে করে। নিজে এখনও পর্যন্ত বিয়ে না করলেও বিয়ে তার কাছে মন্দির-সমান পবিত্র। পরিবার শান্তির জায়গা। তাই খুব ইচ্ছে তাড়াতাড়িই শুভ্রনীলের সঙ্গে রুহির বিয়েটা হোক। কিন্তু কীভাবে ওদের দুজনের আলাপ করানো যায় ভেবে পাচ্ছে না। ঘটকালিতে সে বড্ড অপটু! কীসেই বা পটু সে? আজ অবধি ফেসবুকেই সড়গড় হতে পারল না। এই ঘটনাটা যদি না ঘটত, তাহলে তো ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলতো না। ঘটনা! সত্যি ‘ঘটনা’ই বটে।

—“যাক তাও এক চান্সে ফোনে পাওয়া গেছে তোকে। খুব আর্জেন্ট। মন দিয়ে শোন।” সেদিন শুভ্রনীলের গলাটা শুনেই বুকটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠেছিল। কিন্তু পোড়া গন্ধটা তখনও নাকে এসে ঠেকেনি।

—“কী হয়েছে?” হালকা মেজাজেই জিজ্ঞাসা করেছিল অস্তিকা।

—“তুই তুলসী চক্রবর্তীকে নিয়ে যে উপন্যাস লিখেছিস ওটা কি বেরিয়ে গেছে?”

—“ ‘এক বিদূষকের কড়চা’... ওটা? না। এখনও বেরোয়নি। নেক্সট উইকে বেরোবে। কেন?”

—“তোর পাব্লিশারের এফবি প্রোফাইল দেখ। উনি বইটার সংক্ষিপ্তসার দিয়ে একটা পোস্ট করেছেন। ওটা দেখে নন্দন দাশগুপ্ত প্রচন্ড ক্ষেপে গেছেন। ওঁর একটা নাটক ‘শুধু বিদূষক’ নাকি হুবহু কপি করা। মানে তুই জাস্ট ওঁর নাটক চুরি করেছিস।”

—“হোয়াট?” চিৎকার করে ওঠে অস্তিকা। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনি, “নন্দন দাশগুপ্তর কী নাটক? আমি তো দেখিইনি।... দুটো সৃষ্টির মিল তার মানে কি একটা আরেকটা থেকে চুরি করা?”

—“দেখ, এসব তো আমায় বলে লাভ নেই। উনি যথারীতি ফেসবুকে একটা এই নিয়ে পোষ্ট করে দিয়েছেন। উনি নাকি পাব্লিশারকে কল্ করেছিলেন। তোর পাব্লিশার আবার বলেছেন, “কী করবেন করে নিন। আমরাও দেখে নেব।” সত্যি মিথ্যা জানি না। কিন্তু তুই ইমিডিয়েটলি নন্দনবাবুকে ফোন কর। দেখ উনি সিনিয়র মানুষ, অনেক বয়স। আর নাটকের জগতে ওঁর প্রচুর নাম। তুই, আমি — আমরা ওঁর সঙ্গে লড়তে পারব না। ব্যাপারটা ক্ষমা চেয়ে মিটিয়ে দে।”

—“ক্ষমা? … আমি কোনও অপরাধ করিনি যে ক্ষমা চাইব। তবে ফোন করব, বোঝাব ওনাকে বিষয়টা। নাম্বারটা দে। ... ও, দাঁড়া, নাম্বারটা আমার কাছে ছিল মনে হয়। দেখছি।”

নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে রেখে নন্দন দাশগুপ্তকে ফোন করল অস্তিকা। প্রায় তিন-চারবার। উনি ফোন রিসিভ করেননি সেদিন। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজে সবটুকু লিখে জানায়ও। কিন্তু আজ অবধি সেই মেসেজ তিনি খুলেও দেখেননি।

প্রথমটায় ভেবেছিল রুহিকে ফোন করবে। কিন্তু ওকে সবসময় নিজের সমস্যার জড়ানোটা কি ঠিক? তাই আবার শুভ্রনীলকে ফোন করেছিল।

—“তোর ফেসবুক প্রোফাইল থেকে একটি বার দেখা যাবে কী বলেছেন উনি?”

শুভ্রনীল পাসওয়ার্ড দিতে চেয়েছিল কিন্তু অস্তিকাই সাহস করেনি। বলেছিল, “তুই স্ক্রিনশট পাঠাস পোস্টগুলোর।” মিডিয়া ট্রায়াল চলেছিল অস্তিকার প্রায় দিন পনেরো ধরে। গতবছর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে ‘লিপিমালা’ থেকে বেরোনোর কথা ছিল অস্তিকার উপন্যাস ‘এক বিদূষকের কড়চা’। বাংলা সিনেমা জগতের ছোট চরিত্রের বড় অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীকে নিয়ে। কিন্তু লিপিমালা সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় দেরি হয়। ঠিক হয়, ওই বছরেরই অক্টোবরের শেষের দিকে বেরোবে। লিপিমালা এই মর্মে একটি পোস্ট করেছে নিজের ফেসবুক পেজ থেকে, সংক্ষিপ্তসার দিয়ে। আর সেখানেই হয় বিপত্তি। অস্তিকার অপরাধ ছিল একটাই, উপন্যাসের বিষয়বস্তু সঙ্গে মিলে যাচ্ছে নামকরা নাট্যব্যক্তিত্ব নন্দন দাশগুপ্তের নাটক ‘শুধু বিদূষক’। অথচ অস্তিকা জানতই না নাটকটার বিষয়ে। সে যা লিখেছিল সবটাই নিজের গবেষণা থেকে।

—“কিন্তু তোমায় তো নন্দন কাকু দুটো টিকিট পাঠিয়েছিলেন নাটকটার। আমিই তো তোমায় দিয়েছিলাম। গতবছর মানে 2019-এর নভেম্বরের প্রথম শো ছিল। ওটা তো খুব পপুলার শো। ওঁর ফেসবুক পেজে ওটা নিয়ে প্রচুর পোস্ট আছে।” বলেছিল নন্দন বাবুর পরিচিত একটি ছেলে, সায়নদীপ।

—“সায়ন, তুই একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছিস, নাটকের টিকিট দেওয়া মানে কিন্তু এই নয় যে, নাটক দেখতে গেছি। অনেকে এরকম টিকিট দেন, সব তো আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। আর তাছাড়া কে কীসের ওপর নাটক করছেন এতো মনে রাখা সম্ভব? আর শোন, আমার আজ অবধি কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রোফাইল নেই। শুধু আমি না, আমার বাড়ির কোনো সদস্যেরই নেই। কাজেই ওঁর ২০১৯ সালের এফবি পোস্ট আমার দেখার প্রশ্নই আসে না।”

—“কিন্তু অস্তিকাদি, তুমি কি প্রমাণ করতে পারবে যে তুমি যাওনি নাটকটি দেখতে?”

—“উনিই কি পারবেন প্রমাণ করতে, যে আমি দেখতে গিয়েছিলাম নাটকটা। আছে সিসিটিভি ফুটেজ?” মুখে মুখে উত্তর দিয়েছিল অস্তিকা।

কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া সাইকোলজি যুক্তি বোঝেনা। মানুষ এখানে যা-ই দেখে তাই সত্যি বলে ধরে নেয়। সত্য-মিথ্যা বিচার করার মানসিকতাও থাকেনা। নিজেরাই হয়ে যায় এক-এক জন বিচারপতি। নিজেরাই আইন বানায় নিজেরাই আবার তা ব্যাখ্যা করে। যা দেখে রীতিমত ভয়ই পেয়ে যাবে সত্যিকারের জলজ্যান্ত আইন-কানুন। অস্তিকার তখনও পর্যন্ত কোনও ফেসবুক প্রোফাইল ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সবসময় দূরেই থাকত সে। তাই সমাজ মাধ্যমের দেওয়াল লিখনে তার বার্তাবহ হয়ে কেউ সত্যিটা পৌঁছানোর দায় নেয়নি। লিপিমালার প্রকাশক সম্রাট আদক অস্তিকার দিকে দোষ ঠেলে দিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। আর চাইবেন নাই বা কেন? একজন এত অনামী সাধারণ লেখিকার পাশে দাঁড়িয়ে কে-ই বা সামান্যতম উপকারটুকু করে? প্রচণ্ড কান্নায় চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল অস্তিকা। চোখের কোণে জলটুকু পর্যন্ত শুকনোই রয়ে গিয়েছিল। চোখের জলটাও কি তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছিল? তাহলে এই মুহূর্তে অপমানের ছোরায় ক্ষত-বিক্ষত হতে হতেও একবারও চোখে জল আসেনি কেন? শুধু গিলতে না পারা একটা দলাপাকানো ঢেলার মত কান্নাটা আটকে গিয়েছিল গলার কাছে। শাসিয়েছিলেন নন্দন বাবু, কপিরাইট ভায়োলেশেনের কেস করবেন বলে। শুভ্রনীলই পাঠিয়েছিল সেই পোস্টটার স্ক্রিনশটটা।

—“অস্তিকা প্লিজ তুই ফ্রন্টলাইনে আয়। তোর বক্তব্য রাখ। আমি তোর হয়ে পোস্ট করতে গিয়েছিলাম কিন্তু তাতে তো উল্টো কেচ্ছা হল।” শুভ্রনীলের গলাটাও সেদিন ভেজা ভেজা ঠেকেছিল। ও-ও কি তাহলে বুঝেছিল অস্তিকার কষ্টটা নাকি নিছক করুণা?

—“কিন্তু আমি কী বলব? আমি তো অ্যাকাউন্ট খুলতে, পোস্ট করতেও জানি না।”

—“আমি করে দিচ্ছি সবটাই। কিন্তু তুই শুধু পারমিশন দে তোর নামে অ্যাকাউন্ট খোলার।”

—“আমি একজন অ্যাডভোকেট-এর সঙ্গে কথা বলি আগে।”

—“দেখ, মব সাইকোলজি ল’ বোঝে না। পরে ওসব করবি। আগে তুই নিজে একটা পোস্ট কর। আমি আমার প্রোফাইলে সেটা শেয়ার করব। বুঝতে পারছিস না তোর ক্যারিয়ারে কী সাংঘাতিক এফেক্ট পড়তে চলেছে।” শুভ্রনীল চেষ্টা অনেক করছিল অস্তিকার সম্মান রক্ষার। নিজের প্রোফাইলে সত্যিটা জানিয়ে পোস্টও করেছিল একটা কিন্তু হিতে বিপরীত হয়। একজন পুরুষ একজন মহিলার হয়ে সাফাই গাইছে তার মানেই তো তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে তাই না? এমন অনেক ধরনের কমেন্ট আসতে থাকে শুভ্রনীলের সেই পোস্টে। দুটো সৃষ্টির অনিচ্ছাকৃত মিল সেই অপরাধে অস্তিকাকে শুধু “চোর চোর চোর চোর চোর চোর” বা ‘শুভ্রনীলের রক্ষিতা’, ‘সম্রাট বাবুর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত’ এইসব অনেক কিছু বলে আক্রমণ করা হয়েছিল। যাঁরা এসব বলেছিলেন তাঁরা সকলেই শিক্ষিত ব্যক্তি, রীতিমতো ভালো চাকরি বা কাজকর্ম করছেন। অনেকেই বিদগ্ধ সাহিত্যপ্রেমী বা শিল্পীও।


(৩)

ঘটনার দিন রাতের বেলা অস্তিকা ফোন করে রুহিকে। তখন রাত প্রায় বারোটা বাজে। রুহির কোর্ট তখনও পুরোদমে শুরু হয়নি। কোভিডের জন্য প্র্যাকটিসের অবস্থা খুব খারাপ। এইসময় অনেকটা ফাঁকা সময় পেয়েছে বলে জুডিশিয়ারির জন্য ও প্রিপারেশন নিচ্ছে। একাই পড়ছে কোনও প্রাইভেট টিউশন বা কোচিং নেয়নি।

—“পড়ছিলি?” স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে অস্তিকা।

— “হুঁ। বল। এবার শুতে যাব। আর আধা ঘন্টা মতো পড়ে নিয়ে।”

—“কথা বলা যাবে এখন?”

—“হ্যাঁ, বল না। কী হয়েছে?”

পুরো ঘটনাটাই খুলে বলেছিল রুহিকে। নিজের প্রোফাইল থেকে গিয়ে দেখেছিল রুহি নন্দন দাশগুপ্তের পোস্টগুলো, পাবলিশারকে ট্যাগ করা। ওঁর দাবি, ওঁর আইডিয়া চুরি করে লেখিকা বানিয়েছেন এই উপন্যাসটি। আইডিয়া চুরি? দারুণ ব্যাপার তো। নতুন করে কপিরাইট অ্যাক্ট লেখার ভার দেওয়া উচিত এই নন্দন দাশগুপ্তকে। মনে মনে ব্যঙ্গের হাসি হেসেছিল রুহি। যদিও নন্দন দাশগুপ্তের আইন সম্পর্কে অতি সচেতনতার করুণ অবস্থা দেখে একটু করুণাই হচ্ছিল রুহির, কিন্তু কমেন্ট দেখার পর ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। কেউ আসল ঘটনাটা না জেনে নন্দন দাশগুপ্তর তালে তাল মেলাচ্ছে। এত ঘৃণ্যতম ট্রোলিং, মিডিয়া ট্রায়াল! একটার পর একটা কমেন্ট নামাতে থাকে রুহি।

— “কে এই অস্তিকা চোঙদার, এঁর তো নামই তো জানি না। সাহিত্য জগতের কেউ কি আদৌ এঁকে চেনেন? একজন এতো অনামী হয়ে কিনা উপন্যাস লেখার শখ? আগে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে দেখাক। তারপর উপন্যাস লেখার ধৃষ্টতা দেখাবে।” যিনি এই কমেন্টটা করেছেন তিনি নিজেও একজন লেখিকা। তাঁর ফেসবুক ওয়াল জুড়ে রয়েছে তাঁর লেখা বইয়ের পোস্ট। প্রায় প্রতি মাসেই একটা করে বই বের করেছেন দেখা যাচ্ছে। তাও আবার ভূত-প্রেতাত্মা এসব নিয়ে। তবে ফ্যান-ফলোয়িং তো সাংঘাতিক! রুহি সাহিত্য প্রায় পড়েই না বলতে গেলে। শুধু অস্তিকা নিজের বা অন্যের যেগুলো দেয় বা পাঠায় সেগুলো ছাড়া। তাই ইনি বিখ্যাত না অ-বিখ্যাত তা বোঝার উপায় রুহির নেই। তবে মাসে মাসে বই! তাও কিনা বড় পোস্টে চাকরি করতে করতে? নিজে লেখেন? না কি অন্য কাওকে দিয়ে লিখিয়ে নিজের নামে ছাপান! ইচ্ছে হচ্ছিল রুহির এরকম একটা কমেন্ট করে দেয়, ঐ মহিলার আত্মপ্রচারের একটা পোস্টে।

—“একজন বাংলার অধ্যাপিকা এইটুকু শিক্ষা নেই যে কারোর আইডিয়া চুরি করে সৃজনশীলতা হয় না। বাঙালী হয়ে, বাংলা পড়িয়ে, এমন চৌর্যবৃত্তির পথ নিয়ে আপনি বাংলার অসম্মান করলেন। আপনি শিক্ষকের পদটাই কলুষিত করলেন। কী শেখাবেন ছাত্র-ছাত্রীদের? চৌর্যবৃত্তি? কী করে যে আপনার মতো মানুষ সরকারি কলেজে পড়ানোর জন্য সিলেক্টেড হন। আমাদের উচিত রাজ্য সরকারকে জানানো, যাতে ওঁকে ইমিডিয়েট শো কজ করা হয়।”

বাঃ অসাধারণ! রুহি ভাবে, “ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিং শুরু করতে গেলে একটা ভ্যালিড গ্রাউণ্ড থাকতে হয় রে মূর্খ! না হলে, নিজেই আইনের ফাঁপরে পড়বি। তখন যার চাকরি খাওয়ার প্ল্যান করছিস, তাকেই মোটা টাকার কম্পেসেশান দিতে হবে। এই অশিক্ষিতগুলো আসে কোত্থেকে?” নিজের মনেই বিড়বিড় করে রুহি।

—“এনার লেখা আমরা বয়কট করলাম। এই বই ছেপে বেরোলে পাব্লিশারকে ভিটেমাটি ছাড়া করে ছাড়ব। আমরা বিপ্লব করব।”

— “চোরের আবার বড় গলা। লেখিকাকে সামনে বসিয়ে লেখানো হোক দেখি কত মুরোদ। মুরোদ থাকে তো নিজের আইডিয়ায় লিখে দেখান।”

—“Koto taka diye boi ber korchen ini? Ke ei Astika Chongdar? Nami to suni ni konodin. Nandan sir er natok er kotha ki prokashok o janten na? naki prokashok pourusher sursurite abar onyo kono gondho pelen lekhikar modhye? Afterall lekhika to! Lekhok to non.”

আরো একটু নিচের দিকের একটা কমেন্টে দেখে, একজন একটা কবিতার স্ক্রিনশট নিয়ে সেটাকে অস্তিকার লেখা বলে চালাচ্ছে।

—“এই দেখুন লেখিকার লেখার নমুনা। এটা ওঁর নিজস্ব ‘আইডিয়া’।” তারপর স্ক্রিনশটটা অ্যাটাচ করা। স্ক্রিনশটটা জ়্যুম করে দেখল রুহি।

“গাছের তলে ছিলেম দাঁড়ায়ে

কৃষ্ণচূড়ার থোকা দেখে

মনটি গেছে হারায়ে

এমনু উড়ু উড়ু মনে

হঠাৎ বুঝি, চুলের কোণে

পড়ল ঝুপ ঝুপ

ভাবলাম, শিশির টুপ টুপ

না, শিশির নয়

করেছে একটি পাখি মলত্যাগ।

পাখির মলের ঘ্রাণ নিয়েই আমি চলি

বহু পথ হেঁটে, বুঝিলে কথাকলি?”

সাথেই সাথেই ব্রহ্মতালু জ্বলে ওঠে রুহির। সে যতটুকু জানে অস্তিকা তো কোনোদিনও কবিতা লেখেই নি। সাথে সাথে এই স্ক্রিনশটটার স্ক্রিনশট নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠায় রুহি। অস্তিকা তখন ‘অনলাইন’ ছিল। দু’মিনিটের মধ্যেই রুহিকে ফোন করে।

—“এটা আমার লেখা বলে ছড়িয়েছে?” জানতে চায় ও।

—“হ্যাঁ।”

—“সত্যি, কিছু বলার নেই। এটা একটা সাহিত্যসভায় সব কাজ শেষে আমরা কয়েকজন মিলে এমনি মজা করছিলাম। এখনকার ফেসবুকের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা চলছিল। সাহিত্যের মান যে কোথায় নেমে যাচ্ছে সেটা নিয়ে কথা হতে হতে একজন একটা ‘সোস্যাল মিডিয়ার কবি’ হিসেবে হাস্যকর কবিতা বানালেন। তখন আমি এটা মজা করে বলেছিলাম। একটা খাতায় সব এক-একজন এরকম লিখছিলেন। জাস্ট মজার ছলে। আমিও লিখেছিলাম। সেইটা আমার লেখার নমুনা হয়ে গেল? ভালো। মানুষের সাথে সাধারণ মজাও করা যাবে না আর!”

রুহি একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে, লাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে, মাউসটা স্ক্রল করতে করতে।

বাকি কমেন্টগুলো মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে গিয়েও বমি পেয়ে যাচ্ছিল রুহির। মানুষ এতটাও নিকৃষ্ট হতে পারে? একজন মহিলা সাহিত্যিকের অপরাধ খুঁটিয়ে বের করছেন এক পুরুষ নাট্যব্যক্তিত্ব— বিরাট একটা জয় তাঁর। আর সেই অভিযোগের সুযোগ নিয়ে সেই মহিলা সাহিত্যিককে ছিঁড়ে খাচ্ছে হাজার হাজার মহিলা-পুরুষের কমেন্ট। এই তাহলে মনুষ্য রুচি? যাঁরা নিজেদের ফেমিনিস্ট বলে দাবি করেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় লম্বা লম্বা পোস্ট করেন, তাঁরা সব কোথায় গেলেন এখন? সেইসব মহিলাদের তো একটা কমেন্টও দেখা গেল না। রুহি দেখল পোস্টটার প্রায় ৯০০ শেয়ার হয়ে গেছে। ২৪ ঘণ্টায় ৯০০ শেয়ার! এটা কি তার মানে আগে থেকে প্ল্যান করে করা? অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তি এতে লাইক করেছেন, শেয়ারও করেছেন। অথচ কারোর মনে এটা এল না ‘আইডিয়া’ আসলে ‘কপিরাইটেবল’ নয়।

—“তার মানে?” রুহির কথাটা শুনে জিজ্ঞাসা করেছিল অস্তিকা।

—“কপিরাইট জিনিসটা কী, বোঝো তো?”

—“হ্যাঁ।” ছোট্ট করে জবাব দেয় অস্তিকা।

—“লেখার স্বত্ত্ব। আমাদের যেমন নিজেদের ঘরবাড়ি ‘প্রপার্টি’ যার উপর আমাদের অধিকার আছে, সেরকম এই যে আমরা গান, গল্প, কবিতা লিখলে, ছবি আঁকলে তার ওপর আমাদের যে অধিকার বা স্বত্ত্ব তাই হল কপিরাইট। আমাদের দেশে কপিরাইট অ্যাক্ট,1957 দিয়ে এইটা রেগুলেটেড হয়। কপিরাইট পাওয়া যায় শুধুমাত্র এক্সপ্রেশনে, আইডিয়াতে নয়। তুমি নন্দন দাশগুপ্তর নাটক যদি ঝোঁপে দিতে পাই টু পাই, সেটা কপিরাইট ইনফ্রিজমেন্ট হত। দুটো লেখা বা সৃষ্টির বিষয়বস্তুগত সাদৃশ্য মানেই যে একটা অন্যটার কপি তা নয়। হাজার হাজার কেস ল’ আছে এটার ওপর। মানে সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্টের জাজমেন্ট। আর এটা তো খুব সাধারণ একটা যুক্তি। কমনসেন্স থেকেই বলা যায়। আইডিয়া বা বিষয়বস্তুর ওপর যদি কাউকে স্বত্ত্ব দিয়ে সেটা আটক করে রেখে দেওয়া হয় তাহলে তো পৃথিবীতে আর সাহিত্য, শিল্প সৃষ্টিই হবে না।”

একনাগাড়ে বলে চলে রুহি। অস্তিকা খানিক বোঝে, খানিক না। আইনের ব্যাপারে সে তেমন কিছুই বোঝে না। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরে আইনি জটিলতা মানেই ভয়ের কিছু একটা।

—“কিন্তু ওঁরা যে সব বলছেন কেস করবেন। আমার অপরাধটা কী সেটাই তো বুঝলাম না! থানা-পুলিশ করলে তো আমার চাকরি থাকবে না। খাব কী? তুই তো জানিস মা’র হার্টের অসুখ, বাবারও অনেক বয়েস হয়েছে। সব কেস-কাছারি শুনলে তো ওঁদের বাঁচিয়ে রাখতে পারব না। এখনও পর্যন্ত ওঁদের কিছু বলিনি। তুই প্লিজ একটু সাহায্য কর।”

— “অস্তিকাদি, আমি মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে এতগুলো কথা বলিনি। তুমি কেন ভেঙ্গে পড়ছ? উনি যেটা করেছেন সেটায় মানহানির মামলা করা উচিত তোমার। কলকাতা পুলিশের সাইবার সেলে জানাও আর ওর এই পোস্টটায় রিপোর্ট করো।”

—“তাতে হিতে বিপরীত হবে রে। এভাবে থামানো যাবে না।”

—“আমি কমেন্ট করব? লিগ্যাল পয়েন্ট বলে?”

রুহির প্রস্তাবে অস্তিকা খানিক ভাবল। তারপর ‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়েও ‘না’ বলল।

—“থাক, তোকে এরমধ্যে জড়াতে হবে না। আমায় বলে দে কী লিখতে হবে? আমি লিখে দিচ্ছি। একটা অ্যাকাউন্ট খুলে নেব।” লড়াইটা পুরোটা অস্তিকা একাই লড়েছিল। তার পরিচিত যতজন জানত ঘটনাটা কেউই এগিয়ে এসে ওর হয়ে দু’টো কথা বলতে রাজি হয়নি। সবাই কি ওকে অবিশ্বাস করেছিল? খুব খারাপ লেগেছিল অস্তিকার। যারা সমাজ সেবা করে বেড়ান এবং সেই মর্মে বাহারি পোস্ট করে বেড়ান সোশ্যাল মিডিয়াতে, তারা আজ অস্তিকার এই অবস্থায়, ‘সমাজসেবা’ শব্দের অর্থই বোধহয় ভুলে গিয়েছেন। কিংবা বড় বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সমাজসেবায়। যাঁরা ‘দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকি না’ মার্কা লোকেদের ট্রোল করেন সবকিছু থেকে গা বাঁচিয়ে চলার প্রবণতা দেখে, তাঁরাই নিশ্চিন্তে গা বাঁচিয়ে নিয়েছেন অস্তিকার সমস্যার সময়— ওর ‘সাতে-পাঁচে’ না থাকাটাই শ্রেয় মনে করেছেন।

কিন্তু একজনই ছিল ছায়াসঙ্গীর মতো— রুহি। উকিল মানুষ ও। মানুষের ঝামেলা যেচে নিজের কাঁধে নিয়ে সামলানোর অভ্যেস ওর আছে। এটাতেও তো টানা পনেরো দিন নানানভাবে চেষ্টা করেছে পাশে থেকে সাপোর্ট দিতে। উকিলের কাজই করেছিল, কিন্তু একটা পয়সাও নেয়নি। অস্তিকার প্রোফাইলে রিপোর্ট করেছে অনেকেই প্রোফাইল ডিলিট করে দেয় ফেসবুক। ওর কমেন্টগুলোও মুছে যায় ‘রিপোর্ট’ করার জন্য। আবারও খোলে অ্যাকাউন্ট, আবারও নিজের বক্তব্য জানায়। মিডিয়া ট্রায়ালের বোধহয় এটাই নিয়ম, বিনাবিচারে নিরপরাধকে অপরাধী সাব্যস্ত করার এক লালসাপূর্ণ খেলা! তার কণ্ঠরোধ করার অদ্ভুত প্রবৃত্তি। স্বৈরাচার মানুষের মজ্জায়, রক্তে বইছে। আইনকে ‘শিকার’ করে হাতের মুঠোয় আনতে পারার উন্মাদনাময় মাদকতায় মানুষ ভুলেই যায় সে যা করছে সেটি সত্যিই আইন গর্হিত অপরাধ। অস্তিকাকে আইনের ভয় যাঁরা দেখিয়েছেন তাঁরা কি নিজেরাই আইন লঙ্ঘন করেননি?

(৪)

তারপর থেকে প্রায় পাঁচ মাস কেটে গেছে। অস্তিকা একদিনের জন্যও কলম ধরতে পারেনি। লেখা আর আসছে না। ‘এক বিদূষকের কড়চা’ বইটা আর বেরোবে না। সম্রাটবাবু জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের ‘প্রতারণা’ করার জন্য অস্তিকার বই প্রকাশ করা সম্ভব নয় তাঁদের পক্ষে। এতে তাঁদের বয়কট করবেন পাঠককুল। শুধু তাই নয়, এরজন্য ‘লিপিমালা’-র আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি যা হয়েছে তার খেসারতও দিতে হয়েছে অস্তিকাকে। পুরনো অপ্রকাশিত লেখাগুলো পাঠিয়ে ছিল বিভিন্ন জায়গায় কিন্তু পরপর রিজেকশন আসে। দুটো অনলাইন পত্রিকায় লিখছিল নিয়মিত, তাঁরাও ওর লেখা নেওয়া বন্ধ করে দেন। একটা সংবাদপত্রে বিভিন্ন সামাজিক বিষয় নিয়ে বিশেষ ‘কলাম’-এ লেখালেখি করছিল তা প্রায় দু’বছর ধরে। এই ঘটনাটির পর তাঁরাও আর সুযোগ দিলেন না অস্তিকাকে। সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে সকলেই ধরে নিয়েছিলেন, অস্তিকা অপরাধী। সত্যিই বয়কট করা হয়েছিল ওকে। শুধু সাহস দেখিয়েছেন পাঠকরা, সাধারণ পাঠকসমাজ — যাঁরা সাহিত্যবলয়ের বাইরে। অবশ্য পাঠকের ভালোবাসা পাওয়াটাই তো তার জীবনের গলগ্রহ হয়ে উঠেছিল। সাহিত্য জীবনের প্রথম দিকে প্রথম উপন্যাসের পর একটা উদ্ভুতুড়ে শখ জেগেছিল অস্তিকার। গদ্য আর পদ্যের ছন্দ নিয়ে খেলা করার। একটা বই বের করেছিল। পদ্যের ধাঁচে লেখা গল্প— যা বাহ্যিকভাবে অন্ত্যমিলহীন ‘ছন্নছাড়া’ কবিতা কিন্তু আসলে গল্প। অনেকগুলো এরকম ছোট ছোট কাব্য-গল্প নিয়ে লেখা এই বই ছোট হলেও আলোড়ন ফেলেছিল সামান্য। সাধারণ পাঠককুলের মনেও ধরেছিল। বিক্রিও হয়েছিল কিন্তু সাহিত্য সমাজের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি এক উঠতি লেখিকার এইরকম ছন্নছাড়া এক্সপেরিমেন্ট। তবু খুব একটা বিতর্ক কিছু হয়নি। প্রবাসী এক পত্রিকায় পাঠিয়েছিল বইটা, রিভিউয়ের জন্য, প্রকাশকের কথামতো। সেইসূত্রেই আলাপ ওই পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে। সেখানেই বেরোয় প্রথম ছোটগল্প। সেই প্রথম খানিক নামকরা পত্রিকায় লেখা সুযোগ হয় তার। অনলাইন পত্রিকার সার্কুলেশন অনেক বেশি। কমেন্ট আসতে থাকে পাঠকদের থেকে। অন্যান্য লেখক-লেখিকাদের থেকেও অস্তিকার লেখায় কমেন্ট অনেক বেশি হয়। পাঠকের রেটিং-এ সেরা গল্পের জায়গাও পায় ওর প্রথম ছোটগল্প। লেখাটা বেরানোর বেশ কিছুদিন পর যখন এটা সেরা গল্পের জায়গা পেল, একজন লেখিকা যোগাযোগ করেছিলেন অস্তিকার সঙ্গে। তিনি অনেকদিন ধরে লিখছেন ওই পত্রিকায়— স্বাভাবিকভাবে সম্পাদকের সাথে ওঁর যোগাযোগও অনেকদিনের। সম্পাদকের থেকে অস্তিকা ইমেইল আইডি নিয়ে একটা মেইল পাঠিয়েছিলেন। অস্তিকার ছোটগল্পটি একেবারেই সাহিত্য মূল্যহীন এবং তার উচিত কীভাবে সাহিত্য চর্চা করতে হয়, গল্প-উপন্যাস লিখতে হয় সেটা শেখা, তারপর গল্প প্রকাশ করার কথা ভাবা। এসব জানাতেই মূলত মেইলটি করেন। বড় আশ্চর্য থেকে ঠেকেছিল বিষয়টা— কাকতালীয়ও বটে। এরপর তার আর কোনও লেখাই মনোনীত করেনি ওই পত্রিকাট। বদলে গিয়েছিল সম্পাদকের কথার ধরণও। এ-ও একরকমের বয়কটই ছিল ওই পত্রিকা তরফ থেকে। কিন্তু এক্ষেত্রে তার অপরাধ ঠিক কী? যার কাঁচা হাতে প্রথম ছোটগল্প মনোনীত করা হয় তার বয়সের সাথে পরিপক্ক হয়ে ওঠা লেখাগুলোর সবকটাই কি সত্যিই মানহীন ছিল? তাও না হয় মানা যায়, উঠতি লেখকদের একটা জায়গা পেতে হলে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরোতেই হবে। তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ এঁদের মতো মানুষদেরই করতে হয়েছে, আর অস্তিকাকে তো করতে হবেই। তবুও মনের মধ্যে একটা খটকা থেকেই যায়। এখন একটা নতুন চল শুরু হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই সেটা চলছে। উঠতি লেখকের বই বের করতে গেলে প্রকাশকরা ‘বইয়ের খরচা’টা চাইছেন লেখকের থেকে। দশ-বিশ-তিরিশ হাজার পর্যন্তও উঠেছেন অনেকে। তাঁরা যে একেবারে সাধারণ তা নয়। সাহিত্য জগতে বাজার ভালোই তাঁদের। রুহির কাছেই শুনেছে, কপিরাইট আইনে বলা আছে, লেখক রয়্যালটি পাবেন প্রকাশকের থেকে। আর এখানে উল্টে লেখককে বই ছাপাতে ‘ফাইনান্সিয়াল ইনভেস্টমেন্ট’ করতে হচ্ছে। বিনা পয়সায় উঠতি লেখকদের কাজ করে দেবেন এমন প্রকাশক সংখ্যা হাতেগোনা কয়টি মাত্র। আরো অদ্ভুত লাগে, ম্যানুস্ক্রিপ্ট পড়ে দেখার আগেই লেখক-লেখিকার সাথে টাকা-পয়সার ফয়সালা করে নিচ্ছেন এইসব প্রকাশকরা। যদি লেখক বলেন, “আমি টাকা দিয়ে কাজ করাতে পারব না”, তাহলে ম্যানুস্ক্রিপ্ট সেখানেই বাতিল। অস্তিকা ওর একটা নিজের গল্প-সংকলন নিয়ে দু’বছর ধরে অনেক ঘুরেছে প্রকাশকের কাছে গিয়ে গিয়ে। বড়রা তো এমনিতেই অনামী কারোর করবেন না। আর মাঝারিদের মধ্যে এই ট্রেণ্ড। অগত্যা একটা ছোট উঠতি পাব্লিশারকেই দিয়ে এসেছে। সেও আজ একবছর হতে চলল। ওরাও ফেলে রেখেছে। কে জানে, এই ‘ঘটনা’র পর ওরাও আর করতে রাজি হবে কিনা! তাও এতদিন পর্যন্ত কিছু মাঝারি মানের প্রকাশক বা পত্রিকাগুলো তো নিচ্ছিল, অস্তিকার লেখা— খুব বড় জায়গা না নিলেও। কিন্তু এখন তো ছোট-মাঝারি-বড় কেউই নিচ্ছে না। বয়কটটা তাহলে সবার তরফ থেকেই।

—“আচ্ছা, কিন্তু একটা বিষয় ঠিক বুঝলাম না। নন্দন দাশগুপ্ত হঠাৎ কেন তোমার পেছনে পড়লেন?” প্রশ্নটা একদিন করেই ফেলেছিল রুহি, “এদিকে তোমার মতো এত সাধারণ লিখিকার লেখা নাটকটা উনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বড় জায়গা তোমার লেখা নেয় না। তাহলে এখন এসে চুনোপুটিকে নিয়ে তাঁরা সকলে উঠে পড়ে লাগলেন কেন?”

—“ হ্যাঁ”, ছোট একটা ব্যঙ্গের হাসি হাসে অস্তিকা, “আমি যখন আমার ‘গুলঞ্চেরা’ নাটকটা নিয়ে ওঁর কাছে যাই, সে আজ ভাব প্রায় ১০-১১ বছর আগের কথা, কি আরও বেশি। তখন নন্দন বাবু প্রথমটায় একটু হেলা করেছিলেন। কিন্তু স্ক্রিপ্টটা পড়ে নিজেই ফোন করেছিলেন আমায়। আমায় প্রথম জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “তুমি থিয়েটার করো বা এই বিষয়ে চর্চা করো?” আমি বলেছিলাম, “না স্যার। আমি তো নাটক-টাটক করিনি কোনওদিন। সাহিত্য পড়তে গিয়ে পড়েছি মাত্র। আর নাটক দেখেছি। এসব থেকে যা যেটুকু মনে হয়েছে তার থেকেই লেখা। থিয়েটারের থিউরিটিক্যাল কিছুই জানি না। আপনার কোথাও কিছু ভুল মনে হলে আপনি ঠিকঠাক করে নিতে পারেন পারফরম্যান্সের সময়।” তারপর ওর গলার স্বরটা বড় অদ্ভুত ঠেকেছিল আমার। ওঁর কথাগুলো আমার জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি মনে হয়েছিল ক্ষণিকের জন্য হলেও। বলেছিলেন “ইটস অ্যান এক্সিলেন্ট ওয়ান, তোমার এই প্রতিভা গড গিফ্টেড। তোমার এই নাটক বাংলা নাট্য জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটা পদক্ষেপ। আমি চাই আমাদের নাট্যগোষ্ঠী এটা করুক। একটু কস্টলি হবে এটার পারফরম্যান্স, যা হোক সেটা কোনও কনসার্ন না।” এগুলো সব বলেছিলেন উনি।”

অস্তিকার সেদিনের কথাগুলো অন্য কারোর কাছে হয়তো ঠুনকো আত্মপ্রচার, না তো পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই মনে হত না। কিন্তু রুহি বুঝেছিল। তাই চুপচাপই ছিল, অস্তিকাকে কথা বলাবার সুযোগ দিয়ে। সন্তানের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার মতো ছোট ‘অ্যাচিভমেন্ট’ও তো মায়ের কাছে অনেক বড়, তাই না?

খানিক চুপ থেকে আস্তিকাই আবার শুরু করে।

—“আমার শিল্প সাহিত্যের জন্মগত ব্যুৎপত্তি আছে এই কথাটা প্রথম ওঁর থেকেই শুনেছিলাম। কিন্তু অদ্ভুত লাগে...” একটু থমকে যায়।

—“কী?” ছোট একটা প্রশ্ন করে রুহি, অস্ফুটে।

— “উনি চেয়েছিলেন আমার নাটকটা ওঁকে বিক্রি করে দিই। কিছু রয়্যালটি দেবেন, কিন্তু অথারশিপ থাকবে ওঁর, ওটা ওঁদের শো হিসেবে করানো হবে সবজায়গায়।”

— “তারপর?”

—“আমি রাজি হইনি। কোনো মা চাইবে তার সন্তানকে বিক্রি করে দিতে?”

—“ বুঝলাম। এইজন্য তোমার ওপর রাগ। কিন্তু এতবছর পর...”

—“আমি তখন পুরোপুরি না বলিনি। আমি বলেছিলাম ভেবে দেখছি, তারপর অন্য অনেক জায়গায় চেষ্টাচরিত্র করি। কিন্তু কোথাও নেয় না। সবই জানিস তুই এগুলো। ২০১৯ এর শুরুর দিকে একটা মাঝারি মানের নাট্যগোষ্ঠী, নাম বললে চিনবি কিনা জানিনা, তাও বলছি, কালপুরুষ, ওদের পত্রিকায় বের হয় নাটকটা। নন্দনবাবু দেখেছিলেন ওটা। সায়ন বলেছিল, উনি নাকি জিজ্ঞাসা করেছিলেন এটা কোথাও করানো হচ্ছে কিনা বা হয়েছে কিনা?”

—“ কিন্তু তার জন্য এভাবে… কিছু বলার নেই অস্তিকাদি।”

—“ আর একটা জিনিস শুনবি?

—“ আরেকটা? কী?”

—“এই যেটা নিয়ে এত ট্রোলিং, আইডিয়া হিসেবে দেখলে দুজনের মধ্যে প্রথম আইডিয়াটা আমার ছিল। ২০১৮য় একটা ছোট সাহিত্যসভায় গিয়েছিলাম যেখানে শুধু সাহিত্যিক নয়, নাট্যকার, নাট্যব্যক্তিত্ব তাঁরাও ছিলেন। নন্দনবাবুও আমন্ত্রিত ছিলেন। আমি দেখেছিলাম, কিন্তু সাহস করে কথা বলতে যাইনি। সায়নের খুব ঘনিষ্ঠ। ও আমায় নিয়ে গিয়ে কথা বলায়। তখন উনিই জিজ্ঞাসা করেন আমি কিছু নাটক লিখছি কিনা। তো বলেছিলাম এরকম তুলসী চক্রবর্তীকে নিয়ে লেখার ইচ্ছে আছে। ... ওটা নাটক হিসেবেই ভেবেছিলাম প্রথমে। কিন্তু পরে লিখতে গিয়ে দেখলাম অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। তাই উপন্যাস করি। উনি জানতেন আমি নাটকই লিখব। হয়তো তাই সাত তাড়াতাড়ি নামিয়ে ফেলেলেন সেটা। আমার উপন্যাস লেখা শেষ হবার আগেই।”

—“তাহলে এই কথাটা তুমি বলতে পারলে না?”

—“কাকে বলব? আর তাছাড়া পুরোটাই ভার্বাল হয়েছিল। রেকর্ড ছিল না। প্রমাণ কোথায় পাব?”

(৫)

—“নাঃ... এবার ওঠা যাক। আর ঘন্টার পর ঘন্টা আজেবাজে ভেবে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।”

নিজের মনেই বিড়বিড় করতে করতে মাদুর ছেড়ে উঠে পড়ে অস্তিকা। প্রায় চারটে বেজে গেছে। রোদ পড়তে শুরু করে দিয়েছে। আজকাল শীতেরদিনে চারটে বাজলেই চারদিকটা কেমন কুয়াশায় ঢেকে যায়। বেশ হুলহুলে কনকনে বাতাসটা। গায়ের শালটা ভালো করে মুড়িয়ে নিয়ে ফোনটা, খবরের কাগজ আর মাদুর হাতে নিয়ে নিচে নেমে এলো অস্তিকা। টুকটাক ঘরের কাজকর্ম সেরে, নিজের ঘরেই কলেজে কাজকর্ম নিয়ে বসল। অনলাইন ক্লাসে স্টুডেন্টদের চাইতে টিচারদের প্রেসার যেন বেড়ে গেছে। এখন টিচারদেরই একটা স্টুডেন্ট-স্টুডেন্ট ভাব এসে গেছে। অন্তত ওর তাই মনে হয়। স্টাডি মেটেরিয়াল তৈরি করে স্টুডেন্টদের পাঠানো, তারপর রোজ ক্লাসের রিপোর্ট তৈরি করা। অবশ্য কাজের চাপ থাকলে ওর ভালোই লাগে। নোটপ্যাডের স্ক্রিনে চোখ রেখে সাজাচ্ছিল একটা স্টাডি মেটিরিয়ালের ডিজাইনটা। এসময় আবার ফোন আসতে একটু বিরক্তই হয়। একটা আননোন নাম্বার। রিসিভ করে ফোনটা।

—“অস্তিকা চোঙদার বলছেন?” একটা মাঝবয়সি পুরুষের গলা। কে ঠিক বুঝতে পারল না।

—“হ্যাঁ। বলছি। বলুন।”

—“আমি ওয়াসিম আখতার বলছি, সেঁজুতি পাব্লিশিং হাউস থেকে।”

সেঁজুতি পাব্লিশিং হাউস থেকে ফোন? অনেকদিন আগে দেওয়া ছিল একটা গল্পের সংকলনের ম্যানুস্ক্রিপ্ট। ওর নিজেরই কতকগুলো ছোটগল্প নিয়ে। প্রায় এক বছরের উপর পড়ে আছে। ঘটনাটার আগে প্রকাশককে অনেকবার ফোন করেছে। গিয়েওছে সামনাসামনি কথা বলতে। কিন্তু প্রকাশকের দিক থেকে কোন সাড়াশব্দ ছিল না। আজ হঠাৎ ফোন? তাও নিজের থেকে?

—“হ্যাঁ, বলুন।” আলতো জবাব দেয় অস্তিকা। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কথা শুরু করলেন ওয়াসিম।

—“আপনার গল্প-সংকলন ‘পোড়ামাটির গল্প’ আমাদের রিভিউইয়ারা অ্যাপ্রুভ করেছেন। আমরা প্রকাশ করব। নেক্সট মানডে এটার কাজ হাতে দেব আমরা। আপনি কিছু অ্যাডিশন অলটারেশন করতে চান?”

অস্তিকার লেখা অ্যাপ্রুভ হয়েছে? এও কি বাস্তবে সম্ভব? কেমন একটা ছেঁড়া-ছেঁড়া ঘোরের মধ্যে উত্তর দেয় অস্তিকা।

—“আমি একবার ম্যানুস্ক্রিপ্টটা দেখে নিয়ে রাতের মধ্যে আপনাকে জানাচ্ছি। আর অনেক ধন্যবাদ। ভালো লাগলো আপনারা প্রকাশ করতে ইচ্ছুক দেখে।”

—“ওয়েলকাম। একটা বিষয়। আমরা তো ছোট পাব্লিশিং হাউস। জাস্ট কয়েক বছর হল স্টার্ট হয়েছে। সার্কুলেশন বাড়ছে। বাট, একটা জিনিস খোলাখুলিভাবে বলি। আমরা রয়্যালটি দিতে পারব না এখনই। এটা তো আপনার প্রথম কাজ আমাদের সাথে। আপনি যদি ভবিষ্যতে আমাদের সাথে আরও কাজ করতে থাকেন তখন পাবেন। সো প্লিজ কিছু মনে করবেন না এটায়।”

রয়্যালটি? আজ অবধি কোনো প্রকাশকের থেকেই সেটি পায়নি অস্তিকা। সে এখনও খুবই সাধারণ। কাজেই রয়্যালটি আশা করে না সে— অন্তত এখনই। বইটুকু শুধু ছেপে বের করুক, লোকে যেন পড়ে আর দু’চার জায়গায় রিভিউতে যেন পাঠায়— এটুকু হলেই অনেক পাওনা। ওয়াসিম আখতারের এই সামান্য ভদ্রতাটুকু অসামান্য মনে হল অস্তিকার।

—“না, না, সেসব নিয়ে মনে করার কিছু নেই।” অনেক কিছু বলবে ভেবেও শুধু শুকনো ভদ্রতাটাই বেরিয়ে এল অস্তিকার মুখ থেকে।

—“আর একটা কথা। আপনার আর কোনো ম্যানুস্ক্রিপ্ট রয়েছে আনপাবলিশড? তাহলে আমাদের দিতে পারেন। আপনার আরও লেখা আমরা ছাপাতে চাই।”

হয়তো এই প্রস্তাবটার জন্য প্রস্তুত ছিল না অস্তিকা। একটু ভেবে উত্তর দেয়।

—“হ্যাঁ, আছে। তুলসী চক্রবর্তীকে নিয়ে লেখা উপন্যাস, ‘এক বিদূষকের কড়চা’।”

নামটা শুনে কি একটু থমকালেন ওয়াসিম? অস্তিকার মনে একটা খটকা লাগল। উনি জানেন ‘ঘটনাটা’?

—“আচ্ছা, পাঠান। ছোট্ট জবাব দেন ওয়াসিম, “রাখলাম তাহলে। হ্যাভ আ গুড ডে।”

‘সেঁজুতি’ পাব্লিশিং হাউস প্রায় ছয়-সাত বছর আগে শুরু করেছে। ছোট পাবলিশারদের মধ্যে হলেও সার্কুলেশন বেশ ভালো ওদের। অল্প নামও হচ্ছে এখন। অস্তিকার কত বছর যেন হল এ জগতে ঢোকার? প্রায় দশ বছর। তাই না? না কি আরও বেশি? নাকি কম? হিসেবটা মেলানোর চেষ্টা করে অস্তিকা— বড্ড জটিল এই হিসেবটা। ‘সেঁজুতি’ কি সত্যিই গ্রহণ করবে ‘বয়কট’ হয়ে যাওয়া একজন অনামী সাহিত্যিককে?

0 comments: