প্রবন্ধ - ডঃ কৌশিক চট্টোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধনদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহর সূচনালগ্ন থেকেই শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র৷রবীন্দ্রনাথ,কাজী নজরুল ,দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্র বহুবার এসেছেন এই শহরে৷ ভূমিপুত্র হিসাবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আজও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় ,পরবর্তীতে প্রমথ চৌধুরী (বীরবল), নারায়ন সান্যাল, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক,সাহিত্যিক গবেষকও শিক্ষক শ্রী সুধীর চক্রবর্তী এরকম অজস্র নাম আমাদের স্মরণে এলেও বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে গেছে যে নামটি তার নাম কল্লোল যুগের বিশিষ্ট কবি হেমচন্দ্র বাগচী ৷ এই বিরল কাব্যপ্রতিভা সম্পর্কে বাংলা সাহিত্য জগতেও এক অদ্ভুত উদাসীনতা আজও আমাদের বিষ্ময় জাগায়৷
১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯০৪ সালে নদীয়ার গোকুলনগরে হেমচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। ১০ বছর বয়েসে তিনি কৃষ্ণনগরের নিকট ঘূর্ণীতে আসেন ও কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল এ চতুর্থ শ্রেনীতে ভর্তি হন। ১৯২১ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ থেকে বি এস সি পাস করেন। কলেজ জীবন থেকেই কবিতা লিখতেন। বিজ্ঞান তার পছন্দের বিষয় না হওয়ায় কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বিএ পাস করেন ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ তে ভর্তি হন। বাংলা ও সংস্কৃত দুটি বিষয়ে এমএ করেছিলেন৷ভবানীপুরের পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতা করতেন ও পরে রাজশাহী কলেজে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে চলে যান।যদিও সেখানে অধ্যাপনার কাজ করেন মাত্র তিনমাস৷
ভাগ্যান্বেষণের উদ্দেশ্যে চলে আসেন কলকাতায় ৷এবং সমস্ত সঞ্চয় ভেঙে খুলে ফেলেন প্রকাশনা সংস্থা বাগচী এন্ড সন্স৷প্রকাশ করলেন তিনটি গ্রন্থ ৷জগদীশ গুপ্তের গল্প সংকলন,করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্য সংকলন "শতনরী" এবং সুনির্মল বসুর "ছন্দের টুংটাং"৷যদিও তা ব্যবসায়িক সাফল্য দেখেনি৷
এই সময় লিখতে থাকেন অসামান্য সব কবিতা ৷ তৎকালীন সেরা কবিদের তালিকায় তার নাম প্রথম সারিতে৷ মালদার আদিনা কলেজেও কিছুদিন কাজ করেছিলেন৷বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত, জীবনানন্দ দাস, সমর সেনের সঙ্গেও সখ্যতা ছিল এবং ভাবের আদানপ্রদান ঘটতো৷অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ছন্দে তার অনায়াস যাতায়াত মুগ্ধ করেছিল সাহিত্যপ্রেমী মানুষকে৷এছাড়াও ছিল অবিশ্বাস্য শব্দচয়ন ,রূপকল্প বা ইমেজারির দখল৷
১৩৩৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় দীপান্বিতা,১৩৩৯ তীর্থপথে এবং ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে মানসবিরহ নামের তিনটি কাব্যগ্রন্থ৷
অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন
"তিনি তো নাগরিক কবি ছিলেন না কিন্তু কল্লোল কালিকলমের ঘনিষ্ঠ দোসর ছিলেন৷"
কবিতার পাশাপাশি বিদেশী গল্পকারদের গল্প করেছেন অনুবাদ৷আমেরিকার সাহিত্যিক Francis Briel Hastle এর গল্পটি অনুবাদ করে ফেলেছেন নাম দিয়েছেন "রাঙামাটির দেশের একটি গান" (The idyl of Red gulch)অনুবাদ করেছিলেন ও হেনরীর দুটি গল্পও "পরাজিত নগরী " (The Defer of the City) এবং "পোষাক ও প্রেম" (Love on dress parade)৷ সমালোচনা করেছেন জীবনানন্দের "ধূসর পান্ডুলিপি"র এবং বুদ্ধদেব বসুর 'কঙ্কাবতী' ও 'সমুদ্রতীরে'র৷
১৯৪২ সালের পরই তিনি মানসিক সুস্থিতি হারিয়ে ফেলেন৷
ফিরে আসেন ঘূর্ণীতে ৷যে বাড়ী আমার বাড়ীর অনতিদূরে৷আমি ছোটবেলাতে দেখেছিও তাঁকে যদিও সে বয়সে তাঁকে বোঝার মত ক্ষমতা স্বাভাবিক ভাবেই ছিল না৷ কিন্তু তিনি তখন অতীতের ছায়া ৷ করুণ পরিণতি৷ রাস্তা দিয়ে আপন খেয়ালে হাঁটছেন কবি ৷উস্কো খুস্কো চুল উড়ছে ৷বিড় বিড় করে বলছেন ৷শোনা যাচ্ছে না৷ দেখা হলে মাথায় হাত রাখতেন ৷হাতের আঙ্গুলগুলি দীর্ঘ, অসম্ভব সুন্দর৷ পরবর্তীতে যদিও বাইরে আর বার হতে পারতেন না৷
"প্রলয় পয়োধি জল উতল সমুদ্র গর্জমান
তার মধ্যে তবু থাকে অচঞ্চল পরিসর শান্তি
সংক্ষুব্ধ সমাজ আর রুক্ষতম বাস্তবের ঢেউ
কোনো কোনো স্বপ্ন বাদী তার মধ্যে শান্তশ্রী সম্রাট"
বিশিষ্ট অধ্যাপক গবেষক সুধীর চক্রবর্তী হেমচন্দ্র বাগচীর কাব্য প্রতিভা স্মরণ করতে গিয়ে প্রথমেই বলছেন ৷তার কথায় "স্নিগ্ধবনগন্ধ আকুল মোহনার নাম কবি হেমচন্দ্র বাগচী৷
শ্যামল শোভার মধ্যেও হৃদয়ের কান্না থামেনা কিছুতেই
যে কবির ভালো লাগত "বিধ্বস্ত পল্লীর কাহিনী"৷যিনি সোচ্চারে বলে উঠতে পারেন "অগ্নিদগ্ধ শ্মশানের সৌন্দর্য-সমস্ত চেষ্টার অবসানের সুর...আমার বড় প্রিয়৷
কখনও বলে ওঠেন
"আমার এ কাব্যলোকে
কোথা হতে জানিনা কখন
বহে যায় বৈশাখের ঝড়
কঠিন কাঁকর লাগে-
মুখে লাগে সঞ্চিত জঞ্জাল৷"
শুধু পল্লী সমাজ নয় সামাজিক প্রেক্ষাপট, স্মৃতিচর্চা, প্রেম, স্বপ্নকল্পনা,নীড়ে ফেরার সুতীব্র পিপাসা,কখনো বিষাদে আবার কখনও চরম আশাবাদী হয়ে উঠেছে তার কাব্য৷ স্বকীয়তাবোধে এবং বিভিন্নতায় এ কবি স্বতন্ত্র৷কখনো কবির জন্মস্থান জলঙ্গী নদী স্থান করেছে কবিতায়৷এ অমোঘ পিছুটানকে ভোলা সম্ভব নয় কবির পক্ষে
"মন বেধে যায়
জলঙ্গীতে
কি ভঙ্গীতে
স্রোতের টানে
গানে গানে
পরাণ আমার কি যে করে!
বৃষ্টি ঝরে ! (বর্ষণময়ী)
বারবার ফিরে আসে বাহাদুরপুর, হাঁসাডাঞার বিল (জলাঙ্গীর বাঁক) কবিতায়৷
আবার "ছোটবেলার রান্নাঘরে" লিখেছেন
"পাঁচু সাজির ভিটের 'পরে ফুল ফুটেছে নেবুগাছে
আর কেহ নাই জনপ্রাণী গাছটি শুধু দাঁড়িয়ে আছে
উঠোনভরা দুর্ব্বাঘাসে
বাঁশের ডগার ছায়া আসে-
দলছাড়া এক মহিষ ঘুমায় রতন দাদার বাড়ীর কাছে;
আমার মৃগ, মনের মৃগ সেথায় যেতে পারলে বাঁচে!"
নেবু গাছ তো প্রান্তজনের ভাষা ৷তাকেই ফিরিয়ে আনলেন কবি, মনকে পাঠিয়ে সেই ছোটবেলার রান্নাঘরে৷ পাঁচু, রতনদাদা বা "সত্য মাস্টার" কবিতার সেই সত্য মাস্টার "তালি দেওয়া ছোট ছাতা ময়লা কাপড়,করুণ নয়নে শুধু চায়-"
এরা তো আমাদের চারপাশেরই চরিত্র, রক্তমাংসের মানুষ হয়ত বা প্রান্তজনও বটে৷
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সপ্ততিতম জন্মোৎসবে কবি লিখলেন "রবীন্দ্রনাথের প্রতি" কবিতায়
"তুমি রবি আকাশের, হিরণ্ময় রথ-সমাসীন-
বৈদুর্য্য-মুকুট শিরে, পিঙ্গল অরুণ -সারথি,-
সপ্ত তুরগের রশ্মি দৃঢ় মুষ্ঠিতলে-তূর্ণগতি
ধায় রথ, ছিন্নমেঘ বাষ্পপূর্ণ আবর্তে বিলীন,
জ্যোতিস্রোতে ভেসে যায় -এ উপমা আমাদের নহে!"
১৩৪২ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে "ম্লানমুখ" কবিতায় বলছেন
"ম্লান মুখ দেখনি কখনও-ম্লান মুখ
করুণ স্বপ্নের মত মুখ, শ্মশানে শবের মত মুখ,
-ম্লান মুখ
এ বিচিত্র ধরণীতে যা' কিছু সুন্দর, যা' কিছু করুণ
যা' কিছু উদার আর বেদনায় বিবশ অরুণ
মিশে আছে তরঙ্গিত যত দুঃখ -সুখ-
দেখ'নি তেমন ম্লান মুখ৷"
ঘূর্ণীর বাড়ীতে ফিরে আসার পর কবি হেমচন্দ্র বাগচী একটি পত্রিকা বের করেছিলেন নাম "বৈশ্বানর" ৷যদিও চারটি সংখ্যার পর তা বন্ধ হয়ে যায়৷এই পত্রিকাতেই শুরু করেছিলেন উপন্যাস" অনির্বাণ"৷যদিও তা অসমাপ্তই থেকে গেছে৷
কিছুই আর মনে রাখতে পারতেন না লিখতে পারতেন না কবিতা৷কবির হাত থেকে কবিতা না বের হবার যন্ত্রণা নিয়েই ছটফট করেছেন শেষ জীবন৷
১৯৮৬ সালে ৪ঠা এপ্রিল দীর্ঘ রোগভোগের পর অজান্তেই সকলের অগোচরে চলে গেলেন এই দরদী কবি ৷
১৯৩১-৪১ এই সময়টা সমালোচকরা মনে করেন কবি হেমচন্দ্র বাগচীর কবিজীবন চরম শিখরে উঠেছিল৷এই সময়েই যৌবনভিক্ষা, জলাঙ্গী বা সংস্কৃত কাব্যের নায়িকাদের প্রতি বা বহু আলোচিত"স্বপ্নো নু মায়া নু মতিভ্রম নু' কবিতাগুলি এই সময়েরই সৃষ্টি৷বুদ্ধদেব বসুর মতে তাঁর সনেটধর্মী "গীতিগুচ্ছ" কবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা৷ প্রায় পঁচিশটির মত বিদেশী কবিতার অনুবাদ করেছিলেন কবি ৷সবচেয়ে বেশী অনুবাদ করেছেন ওয়াল্টার ডি লা মেয়ার এর কবিতা ৷এছাড়াও করেছেন রিচার্ড আলডিংটন, রুবার্ট ব্রুক, জে ই ফ্লেকার, ইয়েটস, ইলিয়ট, ভি এইচ লরেন্স, গিবসন ,জেমস জয়েস প্রমুখ বিখ্যাত কবিদের কবিতার অনুবাদ৷
তাঁর কবিকৃতিকে এত স্বল্পপরিসরে বর্ণনা করা অসম্ভব৷
কবি বোধহয় বহুদর্শী হন৷ না হলে আমরা "সারাদিন কাটে একেলা" (২৩শে মাঘ,১৩৪০) কবিতায় পাচ্ছি "দীর্ঘজীবন কাটে একলা
করুণ হেলায়-..."
বা "প্রচন্ড আবর্তে তা'র চেয়ে আছি- পড়ে না নিমেষ!
প্রেম-সে কি সত্য নয় ?এবারের মত সবি শেষ?"
কবির মৃত্যু হয়না
তার চির শাশ্বত সৃষ্টি বেঁচে থাকে, চর্চা হয়৷
আমরাও যেন অতীত না ভুলে স্মরণ করি, চর্চা করি কবি হেমচন্দ্র বাগচীকে৷
তথ্যসূত্রঃ
হেমচন্দ্র বাগচীর কাব্য সংগ্রহ(১ম খন্ড)
কবি হেমচন্দ্র বাগচীঃ দূরের নক্ষত্র/মন্দিরা রায়
স্নিগ্ধবনগন্ধ আকুল মোহনার নাম কবি হেমচন্দ্র বাগচী/ সুধীর চক্রবর্তী (কবিতার কাগজ)
0 comments: