0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in




















২১

স্মৃতির শহর – ৭ – ফ্লোরেন্স

আচ্ছা মানুষের চিন্তার তরঙ্গের সঙ্গে কি ইন্টারনেটের দুনিয়ার কোনও সংযোগ থাকা সম্ভব? নাকি এজাতীয় ঘটনা ঘটলে তাকে আশ্চর্য সমাপতন বলে ধরে নিতে হবে? সমাপতন তো বটেই আর আশ্চর্য না বলে একে মহা আশ্চর্য বললে খুব ভুল হবে না।

এবারের কিস্তিটি লিখব বলে যখন মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি, স্মৃতির অন্দরমহলে চলছে ঘাঁটাঘাঁটি, একদিন ল্যাপটপের বোতাম টেপার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠল একটি ছবি। ছবিটি এক মনোরম সবুজ উন্মুক্ত চারণভূমির। দিগন্তে পাহাড়ের ছায়া। সেই গা-এলানো সবুজ প্রান্তরের ঠিক মাঝখানে একটি ভেড়ার দল। ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। অনুসন্ধিৎসা থেকে কোথাকার ছবি জানবার জন্য মাউসে যেই ক্লিক করেছি, চমকে গেলাম উত্তরটি চোখের সামনে ফুটে ওঠামাত্র। টাস্কানি!

ছোটোবেলায় ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে (তখনও মির্জা গলিব স্ট্রিট বলার রেওয়াজ হয়নি) বাবার অফিসে যেতাম। তার প্রায় লাগোয়া ছিল ঐতিহ্যশালী মোকাম্বো রেস্টুরেন্ট – আজও সেই রেস্টুরেন্ট সেখানেই আছে কিন্তু সেই অফিস বাড়িটি আর নেই। সে অন্য কাহিনি। তো সেই মোকাম্বোতে যাওয়া হত প্রায়ই আর গেলেই আমি খুঁজতাম চিকেন ফ্লোরেন্টিন! তখন অবশ্য উচ্চারণ করতাম ফ্লোরেন্টাইন আর জানতাম না এই নামের সঙ্গে ইতালির টাস্কানি প্রদেশের রাজধানী ফ্লোরেন্সের নিবিড় যোগাযোগ। এমনিতে এই রান্নাটি ফরাসি-ইতালিয় ঘরানার। যে সস এই পদটিতে মাংস বা মাছের সঙ্গে শাকের (পালং জাতীয়) স্বাদের মধ্যে রচনা করে এক অসামান্য ঢলাঢলির সম্পর্ক, তা মূলত ফরাসি গোত্রীয় বেশামেল। কিন্তু বেশামেল সসের মূল উপাদান ময়দা, মাখন আর দুধ। এই রান্নায় তার সঙ্গে মেশে চিজ – যে উপাদানটি পাশ্চাত্য রান্নায় ব্যবহার করার কোনও নির্দিষ্ট ব্যাকরণ আছে কিনা আমার জানা নেই। তাই এই সসটিকে উপাদেয় থেকে উপাদেয়তর করার জন্য কোন চিজ কতটা দেওয়া হবে, তা পুরোপুরি নির্ভর করে রন্ধনশিল্পীর ওপর। ফরাসিরা হয়ত এক্ষেত্রে বেছে নেবে গ্যুইয়ে আর ইতালিয়ানরা পারমিজিয়ানো। এতে স্বাদের তারতম্য বিচার করা মুশকিল, কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে এ ধরনের রান্নার ক্ষেত্রে চিজের একটা বড় ভূমিকা থেকে যাচ্ছে। এবার আসা যাক পদটির নির্মাণ প্রসঙ্গে। চিকেন ব্রেস্টগুলিকে প্রথমে নুন মরিচ মাখিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিতে হবে। এরপর একটি পুরু পাতের ফ্রাইং প্যান গ্যাসে বসিয়ে তাতে দিতে হবে মাখন। মাখনের ডেলাটা যখন গলে এসেছে সেইসময় চিকেন ব্রেস্টগুলিকে ময়দায় একটু ওলট পালট করে নিয়ে প্যানে দিতে হবে মাঝারি আঁচে। ওইভাবেই এক একদিক ভাজতে হবে অন্তত পাঁচ মিনিট। ভাজার পর একটি প্লেটে মাংসের টুকরোগুলি ভালো করে ফয়েলে মুড়ে সরিয়ে রাখতে হবে। এবার সস তৈরির পালা। ওই একই পাত্রে প্রথমে মাখন, তারপর একটু অলিভ অয়েল অতঃপর তাতে অল্প অল্প করে ময়দা মেশানো। ময়দার রংটি যখন সাদা থেকে হলুদের দিকে চলে যাচ্ছে, সেইসময় একটু একটু করে দুধ দিয়ে নেড়ে যেতে হবে সমানে, যাতে তলা ধরে না যায়। এরপর চিজ। এখন সস তৈরি। এবার আগে থেকে ভাপিয়ে রাখা পালং শাক মাখনের মধ্যে রসুন ফোড়ন দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে নিতে হবে। রান্না শেষ। এইবার সাজানোর পালা। একটি প্লেটে প্রথম পালং শাকের একটা বিছানা তৈরি করতে হবে। তার ওপর দিয়ে সাজিয়ে দিতে হবে মাংসের টুকরোগুলি। সবশেষে সসটি ছড়িয়ে দিয়ে ওপরে ছড়িয়ে দিতে হবে মিহি করে কুচনো পার্সলি। ব্যস কেল্লা ফতে! একটা বিষয় আমরা সবাই জানি। তা হল কলকাতার মতো একটা শহরের গড়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে এই পদ্গুলির জনপ্রিয় হয়ে ওঠার একটা সম্পর্ক আছে। সারা পৃথিবীর রন্ধনশৈলী নানা কারণে এসে মিশেছে এখানে আর অসামান্য সব পাচকদের কল্পনা থেকে জন্ম নিয়েছে এক একটি রত্ন। যা কালক্রমে লোকপ্রিয় হয়েছে কন্টিনেন্টাল কুইজিনরূপে। চিকেন (বা ফিশ) ফ্লোরেন্টিন তেমনই একটি। এ তালিকা ফুরনোর নয়। সময়বিশেষে তাই সেই সাম্রাজ্যের অন্দরমহলে প্রবেশ ঘটে যায় অজান্তে। স্বাভাবিক কারণেই। অনেক অনেক পরে এ জ্ঞান হয়েছে যে আদতে কন্টিনেন্টাল কুইজিন বলে কিছু হয় না। ইউরোপের প্রতিটি দেশের হেঁশেল সংস্কৃতি একেবারে ভিন্নধর্মী। আর ইতালিয়ান খাদ্যসংস্কৃতির প্রতি আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতা আর ঋণের কথা তো আমি কবুল করেছি বারবার। এ বিষয়ে ফরাসিদের খুঁতখুঁতুনির কথা বিশ্ববিদিত। কিন্তু ইতালিয়ানদের দাদাগিরি একটু আলাদা ধরনের। আমার মাথায় রান্নার পোকাটি সারাজীবনের জন্য ঢুকিয়ে দেওয়ায় যাঁর একটি বড় অবদান আছে, সেই এক এবং অদ্বিতীয় নাইজেলা লসন একবার বলেছিলেন, ‘ফরাসি রান্নায় রাঁধুনিই সব কিন্তু ইতালিয়ান হেঁশেলে রান্নাই আসল’। একটি বাক্যের মধ্যে এইভাবে দুটি এত সমৃদ্ধ রন্ধন-সংস্কৃতিকে ধরা সহজ নয়। সবাই পারে না। একমাত্র চাইনিজ ছাড়া আর কোনও বিশেষ রান্নাঘরের (ইতালিয়ান) এরকম সর্বব্যাপী প্রভাব আছে বলে মনে হয় না। রান্নার আসল মুনশিয়ানা যে সারল্যে আর টাটকা উপাদান ব্যবহারের মধ্যে। আর সামগ্রিকভাবে এই খাওয়া-দাওয়া নিয়ে একটা গোটা জাতের যে আবেগ আর প্রতিনিয়ত তা উদযাপনের যে ছবিটি ওদেশের সর্বত্র চোখে পড়ে আর মুগ্ধ হতে হয়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য।

ওরাৎসিওর সঙ্গে আলাপের পর থেকেই যে আদান-প্রদান শুরু হল, তা একে একে যেন খুলে দিচ্ছিল এতদিন ধরে বন্ধ হয়ে থাকা জানালাগুলি। সেবছর জার্মানি যাওয়ার একটা কথা হচ্ছিল কারণ অক্টোবরের ৬ তারিখ অলোকদা আশি বছর পূর্ণ করবেন। এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? আমাদের পুরনো বন্ধু পাপিয়া আর ওর বর মারিও থাকে রোমে। ওরাও অনেকদিন বলে আসছে ওদের কাছে যাওয়ার কথা। ঠিক করলাম অলোকদার সঙ্গে প্রথমে দেখা করব, তারপর কয়েকদিন ওদেশে কাটিয়ে চলে যাব ইতালি। রোম হয়ে চলে যাব ওরাৎসিওর সঙ্গে দেখা করতে। রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এয়ারপোর্টের বাইরে পা দিয়েই দেখলাম ওরা দুজন দাঁড়িয়ে – পাপিয়া আর মারিও নিতে এসেছে আমাদের। ওদের পিছনে রোমের নীল আকাশ। দ্য ভিঞ্চির ক্যানভাস যেন! শুধু তুলি ছোঁয়ানো বাকি। ‘প্রথম দর্শনেই প্রেম’ বলে যদি কিছু থাকে, সেটাই যে ঘটে গেল বুঝতে পারলাম শরীরের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ খেলে যাওয়াতে। এর পরবর্তী দশদিন সেবার কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কেটেছিল। ওদেশের স্থাপত্য, নিসর্গ এবং খাওয়া-দাওয়া – সব যেন কেমন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল অবচেতনে। আলাদা করতে পারিনি। মনে হয় চাইও নি।

পাপিয়াদের সঙ্গে একাধিকবার থাকার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, অতিথিরা পৌঁছনোর আগেই ওরা তাদের পরবর্তী গন্তব্য নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করে। তাদের আগ্রহ অনুযায়ী ঠিক করে দেয় রোম থেকে তাদের কোথায় কোথায় যাওয়া উচিত। সেদিনের ডিনার টেবিলে ঘোষণা হয়ে গেল আমাদের পরবর্তী যাত্রাসূচি। দেশ থেকে রওনা হওয়ার আগেই পাপিয়াদের বলেছিলাম আর যেখানেই যাই বা না যাই মিলানে একবার যেতেই হবে ওরাৎসিওর সঙ্গে দেখা করতে। সেই সাক্ষাতের কথা ইতিপূর্বেই লিখেছি। আমাদের এই গোটা ভ্রমণসূচি নির্মাণের কারিগর ছিলেন যিনি, সেই মারিও প্রায়ার প্রায় দুমাস আগে সব ট্রেন (আদুরে ইতালিয়ানে ত্রেনি) বুকিং সেরে রেখেছিলেন। সেই রুট ম্যাপে প্রথম যে জায়গাটির নাম চোখে পড়ল, তা হচ্ছে ফিরেনৎসে অর্থাৎ ফ্লোরেন্স।

রাত তখন প্রায় নটা। অক্টোবরের মাঝামাঝি। ফ্লোরেন্সের রাস্তায় দুজন। দেখে মনে হয় ট্রেন থেকে নেমেছে তারা। পৌঁছতে চায় মাথা গোঁজার জন্য আগে থেকেই বুক করে রাখা একটি হোস্টেলে। রাস্তায় তখন বেশ লোক কম। স্টেশন থেকে সেই হোস্টেলের দূরত্ব আগেভাগে যা মনে হয়েছিল, তা হাঁটাপথের মধ্যে। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি দেখা গেল অন্যরকম। প্রথমত তখনও ঠিকানা খোঁজার প্রয়োজনে বিদেশে রাস্তাঘাটে ইন্টারনেট ডেটা ব্যবহারের প্রশ্ন ছিল না আকাশছোঁয়া খরচের কারণে আর দ্বিতীয়ত পাশ্চাত্যে রাস্তার মানুষজনকে এই ধরনের প্রশ্ন করার রেওয়াজ নেই। তাও লজ্জার মাথা খেয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম একটা রেস্টুরেন্টে। সেখানে তখন উপচে পড়া ভিড়। উচ্চগ্রামে মিউজিক চলছে। চারপাশের কলরোল আর গ্লাসের আওয়াজে চাপা পড়ে যাচ্ছিল কাউন্টারে বসে থাকা মানুষটির প্রতি আমাদের জিজ্ঞাস্য। কোনোক্রমে যখন আমরা কী জানতে চাইছি বোঝানো গেল, তিনি বিরক্তিসহকারে বললেন যে তাঁর জানা নেই। অতএব আবার রাস্তায় আর আবার খোঁজা শুরু। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরপাক খাওয়ার পর যখন অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছনো গেল, তখন সময় অনেক গড়িয়ে গেছে আর শরীর অবসন্ন। এর পরও যা অপেক্ষা করছিল, তা হচ্ছে বহু ডাকাডাকির পর একজনের দরজা খুলে দেওয়া এবং আমাদের জন্য তিনতলার একটি ঘর বরাদ্দ করা। সব মালপত্র হিঁচড়ে অতটা তোলার পর সেদিন আর খেতে যাওয়ারও ক্ষমতা ছিল না। পরদিন একতলায় প্রাতরাশের জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটিতে হাজির হয়ে মনে হল কোনও যাদুদণ্ডের স্পর্শে যেন বদলে গেছে আগের রাত্রে ঘুমিয়ে থাকা জায়গাটি। এত লোক কোথা থেকে এল? তখনই মনে হল, খাওয়ার সময় মানেই তো ওদেশে উৎসব। লোক তো স্বাভাবিক কারণেই থাকবে। আরেকটা বিষয়ের প্রমাণ পেলাম। ওরাৎসিও একবার বলেছিল ইতালিয়ান ব্রেকফাস্ট একটু অন্যরকম। ইউরোপের অন্য অনেক দেশের মতো ঠিক মাংসঘেঁষা নয় বরং মিষ্টিজাতীয় নানান খাদ্যপদ – যার রকমারি প্রাচুর্যে অবাক হওয়া ছাড়া উপায়ান্তর থাকে না। আর থাকে ইতালিয়ান কফি। সে ও এক মারাত্মক আবেগ। সত্যি কফি, ওয়াইন, চিজ, সসেজ বা সালামি দিয়ে মোড়া এক অপরূপ হেঁশেলের নাম ইতালি।

একটি দুর্বল ছেলে। নাম তার ডেভিড। মেষপালক। শুধুমাত্র পাথর ছুঁড়ে সে গোলিয়াথ নামক অতিকায় এক দৈত্যের হাত থেকে রক্ষা করেছিল ইসরায়েলবাসীদের। এ অতি পরিচিত কাহিনি বাইবেলের। মাইকেলেঞ্জেলো বুওনারোতি এই কল্পকাহিনি থেকে সৃষ্টি করলেন এমন এক ভাস্কর্য, যা হয়ে উঠল চিরকালীন দৃপ্ত পৌরুষের প্রতীক। দোতলা বাড়ির সমান সেই শিল্পকাজের সামনে দাঁড়ালে অন্তত সেই সময়টুকুর জন্য জাগতিক আর সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যেতে বাধ্য। স্বপ্নোত্থিতের মতো ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে হেঁটে যাই বাসিলিকা দি সান্তা ক্রোচের দিকে, যেখানে ডেভিডের স্রষ্টার সঙ্গে পাশাপাশি শুয়ে আছেন গালিলেও, মাকিয়াভেলি, রসিনি, জেন্তিলে। এমনও কি হয়? এও কি এক সমাপতন? সর্বকালীন ইতালীয় গর্বের এই সৌধের ঠিক বাইরে যে চত্বর, সেখানে চোখে পড়ল একটি ছোট্ট কাফে যার বাইরে একটি বোর্ড, যাতে লেখা cantuccini e vin santo অর্থাৎ কান্তুচিনি এবং ভিন সান্তো।

বাঙালি মাত্রেই ধোঁয়াওঠা চায়ের কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে খাওয়ার যে বিলাসিতা আমাদের একান্ত আপন বলে জানতাম, ফ্লোরেন্সে সেদিন জানা হল এই গ্রহে আমাদেরও দোসর আছে। বিশেষ একধরনের বিস্কুট, যার প্রধান উপকরণ বাদাম, পাঁউরুটির আকারে তাকে দুবার বেক করা হয় মুচমুচে করার জন্য। অতঃপর তার নাম হয় বিস্কত্তি। সেই কান্তুচিনি খাওয়ার রেওয়াজ হল ভিন সান্তো ওরফে ‘পবিত্র সুরা’য় ডুবিয়ে ডুবিয়ে, আয়েশ করে। কলকাতা আর ফ্লোরেন্সের মধ্যে এমন একটি অবিচ্ছ্যেদ্য যোগসূত্র আবিষ্কার করে সেদিন কেমন লেগেছিল ভাষায় অনুবাদ করা কঠিন।

0 comments: