0

ধারাবাহিক - সুব্রত ঘোষ

Posted in


 










২য় পর্ব :

 উষ্ণ লোমে (Lomé)

চতুর্দিকে শুধু নারকেল গাছের ভীর। পায়ের নীচে পরিষ্কার সাদা বালির সমুদ্রতট। গরম হাওয়ার সঙ্গে এক অদ্ভুত ভেষজ গন্ধ ছড়িয়ে আছে। আমরা এখন লোমে শহরে। আর এই সমুদ্র সৈকত কোকো বীচ বলেই খ্যাত। আফ্রিকার তোগোল্যাস দেশের বড় আদরের এই সমুদ্র সৈকতটি। তাই অনেক অভাবেও এর যত্নের কোনো ত্রূটি হয় না। এখানে গাছের ছাওয়ায় কাঠের হেলান দেওয়া সুন্দর চেয়ার পাতা আছে। দু’ গাছের মধ্যে ঝোলানো হয়েছে হ্যামক। আমি তা’তেই শুয়ে শুয়ে সমুদ্র দেখছি। জর্জের লোমেতে আসবারই ছিল। এখানে এসেই ও সমুদ্রের জলের কাছে ছুটে গেছে। রীহা নামে একটি দুয়ালার মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ও আমাদের সঙ্গে এই কোকো বীচে এসেছে। রীহা ফরাসী ভাষার শিক্ষিকা। একটি প্রাণবন্ত যুবতী। ও লোমের একটা বিদ্যালয়ে পড়ায়। ওর বাবা, মা আর ভাইরা ক্যামেরুনে থাকে। দুয়ালাতে ও আমার ছবির  পোর্ট ফোলিও দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিল।

দুলতে দুলতে দেখতে পাচ্ছি রীহা দু’ গেলাস ডাবের সরবৎ নিয়ে আসছে। ওর মাথার চুলের বাহার দেখার মতো। টান টান কাল চাবুক চেহারাটা আরও উন্নত করে একটা গেলাস আমার দিকে তুলে ধরলো। মুখে এক অনাবিল সরল হাসি। ডাবের জলে কি সব যেন মিশিয়েছে, বুঝতে পারলাম না। কিন্তু মনে হোল যেন অমৃত পান করছি। বিদেশী পর্যটকদের কাছে এই সৈকত ভূমি যে স্বর্গ রূপে বিবেচিত হবে, এতে আর সন্দেহ কি । 

এই পর্যটন শিল্পের ওপর তোগো রা অনেকটাই নির্ভরশীল। আটলান্টিকের উপকূলবর্তী এই সব দেশগুলোরই অন্যতম প্রধান উপার্জনের উপায় পর্যটন। এই তোগো দেশটি ও গাল্ফ অফ গিনীর অন্তর্গত, যার দক্ষিণে অপার আটলান্টিক। এর উত্তরে বুরকিনা ফাসো, পশ্চিমে ঘানা, আর পূর্বে বেনা। এই সব দেশ গুলো দীর্ঘবছর ঔপনিবেশিকতার কবলে থাকার পর ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। অতি প্রাচীনকাল থেকে গাল্ফ অফ গিনীর এই দেশের মানুষদের দাসরূপে নিয়ে যাওয়া হতো ইওরোপের সব দেশে। একাদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে এই উপকূলের দেশগুলো দাস ব্যাবসার জন্যে পাশ্চাত্য সমাজে সর্বাধিক আকাঙ্খিত কেন্দ্রস্থেল পরিগণিত হয়েছিল। ক্যামেরুন, ঘানা, তোগো, মালি, আইভরি কোস্ট, গিনী- এই সব আটলান্টিকের তীর সংলগ্ন দেশ থেকে জাহাজ বোঝাই করে দাস রপ্তানী হতো শ্বেতাঙ্গ লোকেদের সেবায়। 

অথচ নিয়তির কি পরিহাস ! এই তোগো আর পাশের দেশ ঘানা র মিলিত উপকূল ভূমিকেই ‘Gold Coast’ বলা হয়। তার কারন, এই উপকূলেই সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল প্রচুর সোনার। সেই সোনার লোভে হিংস্র নেকড়ের মতো দলে দলে পশ্চিমের শ্বেতাঙ্গ দেশগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে এই উপকুলে। প্রথম কয়েক যুগ এখানকার মানুষেরা সোনার মূল্যই বুঝতো না। প্রচীন কালে তো আয়নার বদলে ওরা সোনা দিয়ে দিত। সেই থেকে ক্রমে ক্রমে সব সোনা ইওরোপে চলে যায়। যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে অনেক ক্ষয় ক্ষতি হলেও , Gold Coast এর এই স্বর্ণ ভান্ডারই ঐশ্বর্য্যশালী করে তোলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মতো দেশদের। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের আগে এই তোগোভূমি জার্মানীর দখলে ছিল। তারপর সব ইওরোপীয়ানরা জার্মানীর যথেচ্ছ ক্ষতি সাধনে তৎপর হয়ে উঠলো। বিশেষত: ব্রিটিশদের একমাত্র লক্ষ্য হল জার্মানীর হাত থেকে যত কলোনী  জায়গা আছে, সে সব ছিনিয়ে নেওয়া। জার্মানীর কাছ থেকে ব্রিটিশ ক্ষমতা নিয়েও নিল ১৯১৪ সালে। জার্মানীর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে লাগলো। আর দিকে দিকে ব্রিটিশের ইউনিয়ন জ্যাক উড়তে লাগলো। ক্ষমতা খানিকটা ভাগ হলো ফ্রান্সের সঙ্গে। এই তোগো ভূমিখন্ড ছিল অনেক বড়। এই ভূখন্ডের পশ্চিম থেকে পূ্র্বে যে প্রবাহমনা ভোল্টা নদী আটলান্টিকের শরীরে এসে মিলিত হয়েছে, সেই মিলন স্থানই Gold Coast, স্বর্ণ উপকূল। অনেকটা অংশ জুড়ে ফরাসী রাও আধিপত্য রেখেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে League of Nation ঘোষণা করলো যে, তোগোল্যান্ডের পূর্বভাগ  ফ্রান্সের দখলে আর পশ্চিমভাগের  মালিকানা রইলো ইংরেজদের। ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে ফরাসী আর ব্রিটিশ রা মিলে Territory Government বহাল করলো এই তোগোভূমিতে। Gold Coast পড়লো ব্রিটিশের আওতায়। দশ বছর পর ব্রিটিশদের অধিকৃত এই অংশকে তারা Dominion of the British Commonwealth দেশ হিসেবে মর্যাদা দিল। এর নতুন নাম হল ‘ঘানা’। ঘানা স্বাধীন দেশে রুপান্তরিত হলো ১৯৬০ খ্রীষ্টাব্দে। ফরাসী অধিকৃত অঞ্চলটি ও স্বাধীনতা পেল ঐ বছরেই । এর নামকরন হলো ‘তোগোল্যেস’, সংক্ষেপে ‘তোগো’।

এই সব নিয়ে আমার সঙ্গে জর্জের দীর্ঘ আলোচনা হলো। জর্জের ধারনা ভারতবর্ষকেও প্রায় একই অবস্থায় পরতে হয়েছিলো ব্রিটিশ শাষনে। কিন্তু ভারতবাসীদের সাহেবরা কখনো ক্রীতদাস বানাতে পারে নি। ভারতবর্ষ অনেক অবক্ষয় আর অন্ধকারের মধ্যেও অনেক উন্নত মননের, চিন্তার মানুষদের দেখেছে ঐ দু’শ বছরে। আমাদের দেশের শিক্ষা,আভিজাত্য, আধ্যাত্মিকতা,- এসব কিছু বিদেশী বণিকদের বিস্মিত করেছিল বৈ কি। জর্জের কাছে এসব অজানা ছিল। “আমরা কি এখন Gold Coast এর আশে পাশেই আছি ?” কথাটা জিজ্ঞেস করতেই দেখলাম রীহা তার গলার সোনার হারটা হাত দিয়ে দেখিয়ে হাসছে।

পরের দিন আমি আর জর্জ  রীহার স্কুল দেখতে গেলাম। বেশ অনেকটা ফাঁকা জায়গার ওপরে একটা মিশনারিদের  স্কুল। ওদের অফিসের একজন কর্মচারী আমাদের রীহার ক্লাসঘর টা দেখিয়ে দিল। আমরা লবি ধরে এগিয়ে যেতেই কয়েকটা ছোটো ছোটো বাচ্চা আমাদের দিকে এগিয়ে এল। খানিকটা এসেই থমকে গেল। বড় বড় সরল চোখে আমাদের দেখতে থাকলো। তারপরেই হঠাৎ খিল্ খিল্ করে হেসে এক ছুট। এ যেন এক মধুর অভ্যর্থনা। ওদের হাসি মিলিয়ে যেতেই সামনের এক ঘর থেকে শিশুদের সমস্বরে কিছু আবৃত্তি আর তার সঙ্গে জোরে জোরে তাল ঠোকার আওয়াজ শোনা গেল। সে ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম রীহা ক্লাসে পড়াচ্ছে। ওর সামনে ছোটো ছোটো বাচ্চারা ঘুরে নাচছে। কালো মিষ্টি বাচ্চাগুলো  তালে তালে হাত তালি দিয়ে একসঙ্গে সবাই কিছু বলছে। ভালো করে শোনার চেষ্টা করে বুঝলাম যে ওরা ফরাসী ব্যকরণ শিখছে। দেখলাম রীহা একটা গোলাপী রঙের লম্বা ঘেরের বুবু পরেছে। অনেক বাচ্চাই ওদের মাপের বুবু পড়েছে। বুবু (Boubou) এখানকার নিজস্ব জাতীয় পোশাক। অনেকটা কাপ্তানের মতো দেখতে। এই আটলান্টিকের ধারে পশ্চিম আফ্রিকার সব দেশের জাতীয় পোশাক এটাই। যদিও পাশ্চাত্ত পোশাক, আধুনিক জীন্স্ খুবই জনপ্রিয় এই কৃষ্ণাঙ্গ সমাজে। রীহা তার বাঁ হাত দিয়ে বুবুর এক কোনা ধরে সামনে পেছনে দুলে দুলে বলছে, ‘ Je porte un grand boubou’। বাচ্চারা সমস্বরে, ‘ Je porte un grand boubou’ বলেই হাতে তালি দিয়ে এক পাক ঘুরে যাচ্ছে। কয়েকটি বাচ্চা তাদের সামনে কাঠের ডেস্কের ওপরে চাপড় দিয়ে তাল ঠুকছে। সেই তালে রীহা বলে চলেছে বাচ্চাদের জন্য,’ Nous porton les grand boubous’। সমস্বরে প্রতিধ্বনিত হলো, ‘ Nous porton les grand boubous’। ক্রমে সবাই তালে একটা জোর দেওয়ার জন্য ‘porte’ কথাট দু’বার উচ্চারণ করতে লাগলো। বাঙলা করলে  -‘আমি একটা বড় বুবু পরেছি....তুমি একটা বড় বুবু পরেছো....আমরা বড় বুবু পরেছি ..ইত্যাদি...’। ’ওরা আসলে ফরাসী ভাষার ‘ক্রীয়া’ শিখছে, বিভিন্ন পুরুষে তার ধর্ম চিনছে। কি আনন্দ করেই না ওরা পড়া শিখছে। এ যেন এক performing art য়ের ক্লাস। জর্জ তো তা’ই মনে করেছিল। ও জিজ্ঞেস করলো, ‘ Is it a dance class?’ পরে আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম। রীহার ক্লাসের rythm আর দেহ সঞ্চালন এই অঞ্চলের সব মানুষের মধ্যে দেখা যায়। এই rythm এখানকার মানুষদের রক্তের মধ্যে প্রবাহীত। এই বিশ্বাস ক্রমেই আমার মধ্যে দৃঢ় হলো আরও যত দিন কাটতে লাগলো এই মহাসমুদ্রের তীরে।

  বুবু পরিহীত তোগো মহিলা

আমরা তিন জনে স্কুল থেকে বেরিয়ে পরলাম। রীহার আজ স্কুলে half day। তাই ওর ছুটি। একটা ট্যাক্সি ধরে আমরা ছুটলাম। উদ্দেশ্য প্রথমে  লাঞ্চ করা। খুব খিদে পেয়েছে। জর্জ অবশ্য মাঝ রাস্তায় নেমে গেল। ওর অন্যত্র যাওয়ার ছিল। শহরের ভেতরে একটা রেস্তোঁরা তে ট্যাক্সিটা দাঁড় করালো রীহা। রেস্তোঁরার উল্টো ফুটপাথের ওপরে দেখতে পেলাম মানু দিবাঙ্গোর একটা বিরাট cut out। ওর পুরো ছবিটা আফ্রিকার ম্যাপ জুরে রয়েছে। Air Africa র advertisement। চারিদিকে সব বিল বোর্ড এই ফরাসীতে লেখা। আমি রীহাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানেও মানু  জনপ্রিয় ?’ রীহা জানাল যে, শুধু এ দেশেই নয়। মানু র অসীম জনপ্রিয়তা পুরো আফ্রিকা জুড়ে। ইতিমধ্যে আমরা একটা টেবিল দখল করেছি। Waiter এসে মেনু কার্ড দিয়ে গেল। টেবিল সাজানো থেকে শুরু করে সমস্ত আদব কায়দা ফরাসী দেশের মতো। রীহা আমার কি খেতে ইচ্ছে তা’ জিজ্ঞেস করলো। আমি ওর পছন্দের খাবারই খেতে চাইলাম। আমি তোগোদের খাবার বিষয়ে সত্যি অজ্ঞ। রীহার নির্বাচীত খাবার টেবিলে এল। অদ্ভুত দেখতে একটা মাছের পদ। আটলান্টিকের উপকূলে Gulf of Guinea অঞ্চলে মাছ স্বাভাবিক ভাবেই খুব জনপ্রিয় খাদ্য। মাছগুলো ভালো করে ভেজে একটা চিলি সসে ডোবানো। তা’তে অনেটা টোম্যাটো আর পালং শাক দেওয়া। কিন্তু খেতে আমাদের পরিচীত স্বাদের থেকে অনেক ভিন্ন। ভাতে ক্রিম মেশানো চিনে বাদাম দেওয়া। এই ভাতকে বলে Riz sauce d’archide । আর খেলাম ফুফু। এ সব এদের নিত্য খাবার। সঙ্গে ছিল ফরাসী বাগ্যেৎ, মানে লম্বা রুটি। আগে থেকেই ছোটো ঝুড়িতে রাখা ছিল। ফুফু এখানকার খুব প্রচলিত খাদ্য। মূলোর মতো একজাতীয় লম্বা ভান্ডার মূলকে রান্না করে এই খাবার তৈরী হয়। এই মূলকে রান্না করে নরম পাক দিয়ে একটা ময়দার মতো তাল বানানো হয়। দেখতে অনেকটা আমাদের ইডলির মতো।  তারপর বাদাম পিষে একটা ঝোল বানানো হয়। এ দুইয়ের সমাহারই হলো ফুফু। বাদাম এদেশে প্রচুর পরিমানে হয়। এদের খাবারে বাদামের যথেচ্ছ ব্যবহার দেখলেই তা’ বোঝা যায়। 

Riz sauce d’archide

রেস্তোঁরা তে বেশ কিছু লোক খাবার খাচ্ছে। কিছু ফরাসী ও আছে। তোগো বাজনা বাজছে। লম্বা চেহারার waiter টি এসে জানতে চাইল যে আর কিছু আমাদের লাগবে কি’না। “আমি কি এই অল্প সময়ে তোগোল্যেসের কিছু দেখতে পাব ?.....”  এই কথা বলতে বলতে থেমে গিয়ে ওর দিকে তাকালাম। রীহা মাথা নেড়ে জানালো , আর কিছু নেবে না। আমারও আর কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হলোনা। আমি চেয়ারের পেছনে হেলান দিয়ে সামনে পা দু’টো এগিয়ে দিলাম। দু’পকেটে  হাত দু’টো রেখে শরীরাকে একটু টান টান করলাম। একটা তৃপ্তি অনুভব করলাম। হঠাৎ রীহা আমাকে কি একটা ইশারা করে বলার চেষ্টা করলো। বুঝতে না পেরে টেবিলের ওপর ঝুঁকে ওর দিকে তাকালাম। ও আমাক বোঝাল যে, আমার দু’ পকেটে হাত রেখে কথা বলা হয়তো আমার সম্পর্কে এখানে একটা খারাপ ধারনা তৈরী করবে। কারন এ দেশে দু’পকেটে হাত রেখে কথা বলা কে অভদ্র আচরন বলে গন্য করা হয়। আমি তো অবাক। আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই রীহা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, “চলো, একটা দারুন জায়গায় যাব।“ আমরায় রাস্তায় নেমে পড়লাম। রীহা ঠিক করেছে পা য়ে হেঁটে এখন আমরা যাব। আমাকে ওকেই অনুসরন করতে হবে। আমরা শহরের মধ্য দিয়ে হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো আমার জায়াগায় রবীন্দ্রনাথ থাকলে কি বলতেন,-“আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী !”

রীহা অবশ্যই সুন্দরী। আর ভীষণ স্বপ্রতিভ। যেন মসৃণ কোনো কালো পাথরে গড়া একটা তীক্ষ্ণ চেহারা। টানা টানা চোখ আর লম্বা গ্রীবা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই রীহা এ হেন এই ভবঘুরে বাঙালী ছবি আঁকিয়ে কে নিয়ে লোমে শহরে হাঁটছে। রীহার সব কিছু এখানে পরিচীত। সরু রাস্তা আবার বড় আকার নিল। আমরা একটা বড় বাজারের মতো জায়গায় এসে পড়লাম। আমি ঘর্মাক্ত হয়ে গেছি। এখানে ভীষণ গরম। এ জায়াগাটা আসলে একটা বিরাট বাজার । রীহা দের ভাষায় ‘ Grande super marche’। এই সুপার মার্কেটটি  ভীষণ জনপ্রিয় এখানে। মাইকে গান বাজছে। হকারদের চীৎকার। বহু জনসমাবেশে সমস্ত পরিবেশটা সরগরম। কত জামা কাপড়ের দোকান। তাদের সামনে রণপা য়ে চড়ে বিচিত্র সাজে মুখোশ পরে কয়েকজন প্রায় নেচে বেড়াচ্ছে। আমাদের দেশে এখন বিপননে সাহায্য করতে এইরকম প্রদর্শণ অবশ্য হয়ে থাকে। তবে আফ্রিকার এই অঞ্চলে এর চল বহু যুগ ধরে। ইতিমধ্যে রীহা এক জামার দোকানদারের সঙ্গে খুব হেসে হেসে কথা বলতে শুরু করলো। আমি ঝোলানো জামা গুলো দেখতে লাগলাম। বেশ কিছু জামায় বাটিকের design করা। চমৎকার লাগছে দেখতে। এই আটলান্টিকের পশ্চিম উপকূল অঞ্চলের দেশগুলোর boutique design এর খুব দীর্ঘ ট্রাডিশন। বড় বড় বুবু, পা জামা, টী শার্ট....সব হরেক রঙ্গীন পোশাকের মেলা। এই দৃ্ষ্টি নন্দন  বাজার ছেড়ে আবার হাঁটতে থাকলাম। পেছন থেকে কোনো এক হকার আমাদের উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে এগিয়ে এলো, ‘”Alors mon amie....sil vous plait”। বিক্রেতা ছেলেটা ওর দু’ হাতে ধরা অনেক গুলো কড়ি আর কাঠের মালা  কিনতে অনুরোধ করছিল। আমরা ওর অনুরোধ না রেখে এগিয়ে গেলাম।রীহা অনেক কথা বলে চলছিল। জেনে অবাক হয়েছিলাম যে, ও HIV-AIDS এর সচেতনতার জন্য কাজ করে এমন একটা সংস্থার সঙ্গে সক্রীয়ভাবে যুক্ত। এখানে লোকেদের বিয়ের আগে ও পরে অনেক বাচ্চা হয়। ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যা এ দেশের সব অগ্রগতির অন্তরায়। তার ওপরে রয়েছে নানান রোগের বিস্তার। AIDS য়ের হার অনেক বেশী এখানে। এতকিছু  কি করে সামলায় রীহা ? ওকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। আর ওর প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করছি।

আমরা অবশেষে রাস্তার ধারে একটা বেঞ্চে বসলাম। রীহার চেয়ে আমার নিজেকে বেশী ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছিল। এখানে যেমন বাজার দেখলাম, গড়িয়াহাট মনে পড়ে গেল।আমি রীহাকে কলকাতার গল্প করছিলাম।  ও খুব সাগ্রহে শুনছিল। আর মাঝে মাঝে অনাবশ্যক ভাবে হাসছিল। এমন সময় একটি লোক একটা ঠেলা করে নারকেল নিয়ে যাচ্ছিল। ও আমাদের দিকে তাকাতেই রীহা ওকে হাত নেড়ে ডাকল। লোকটা কাছে এল। কিছু বলার আগেই একটা বড় মাটির পাত্র বের করে তার থেকে কি একটা তরল একটা গ্লাসে ঢালতে শুরু করলো । রীহা লোকটাকে থামতে বলে কেমন এক দুষ্টু হাসি হাসলো । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ Local drinks, চলবে ?” আমি বললাম, “বিষ নয় তো ?” রীহা হেসে উঠে জবাব দিল, “ হতেও পারে”। পানীয়টির নাম ‘সোদাবে’ (Sodabe), তোগোদের খুব প্রিয়। রীহা এর উৎপত্তি, গুনাগুন –এই সব বোঝাতে লাগলো। আমি যে কোনো দেশের খাবার, পানীয় সেই দেশের মাটিতে বসে উপভোগ করতে ভালবাসি। রীহা তাও সবধান করলো, “ এতে কিন্তু নেশা হয়,মাথা ঝিম্ ঝিম্ করে।“ কোনো পরোয়া না করে হাত বাড়িয়ে দিলাম সোদাবের জন্য। লোকটা পানীয়টা তৈরী করে একটা নারকেল দু’ ভাগ করে  নারকেল মালার মধ্যে পানীয়টা  আমাদের দিল। স্ট্র দিয়ে মুখে নিতেই একটা তীব্র অচেনা স্বাদ টের পেলাম। প্রথমটা যেন আমায় একটা ধাক্কা মারলো। তারপর আস্তে আস্তে ভালো লাগলো। নারকেলের গন্ধটা বেশ বুঝতে পারছি। জিজ্ঞেস করে জানলাম, শুধু নারকেলের জলই না। এর মধ্যে আরও অনেক রহস্য আছে। নারকেল গাছের গা য়ের রসকে বেশ কিছুদিন মাটির পাত্রে রেখে জারিত করা হয়। সেই জারিত রসই এর মূল উপাদান। এই রসের সঙ্গে মেশানো হয় কাঁচা নারকেলের জল, যেটা চোখের সামনে একটু আগেই দেখলাম। আর অল্প আদার রস  এবং soda water যোগ করে  অদ্ভুত এক তাজা অনুভূতি আনা হয় এই তরলে। তাল গাছের রস হলে হয়তো ‘তাড়ি’ বলা হত। একে বাঙলায় কি বলত জানি না। রীহা অবশ্য বলল যে, আমাদের এই সরবতে অ্যালকহোলের মাত্রা নিমিত্ত মাত্র। রীহা এই পানীয় নিয়ে অনেক কথা বলল। এই সোদাবে তোগোদের সব উৎসব অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। সেখানে অবশ্য অ্যালকহোলের মাত্রা অনেক বেশী থাকে। রাস্তায় ফেরীওয়ালারা  ট্যুরিস্টদের পানীয় কে অনেক হাল্কা করে তৈরী করে। কিন্তু আকোদেস্সাওয়া (Akodessawa) র রাস্তায় ঢুকলে চরম নেশার সোদাবে না সেবন করে নিস্তার নেই। আকোদেস্সাওয়া তেই রয়েছে সর্ববৃহৎ ‘ভুডূ’ বাজার। এই ‘ভুডূ’ চর্চা এ অঞ্চলে সুপ্রাচীন। ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী , ব্যেনা ,তোগো আর ঘানার  কিছু অংশে এই আদিম ধর্মীয় রীতির উৎপত্তি। ঐ ভুডূ বাজার গেলে দেখা যায় সার দিয়ে রাখা বিভিন্ন পশুর মৃতদেহের ভীড়। কুমীরের দেহ, শেয়ালের খুলি, হায়নার পা, খুলি,....কি নেই। বিক্রি হয় ভুডূ ঠাকুর, পুতুলও বলা যায়। এই ঠাকুরদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ইওরোবা। এই ঠাকুরদের উপাসনা করা হয় ঐ মৃত পশুদের দেহাংশ দিয়ে। এক এক পশুর মৃত আত্মাদের থেকে এক এক রকমের শক্তি অর্জন করা হয়। উপাসনা করেন পূজারী। এই বিশেষ বাজারে পূজারীরও খোঁজ মেলে। কোন পূজোয় কোন জন্তুর কোন শরীরের অংশ লাগবে তা’ অভিজ্ঞ পুরুত ঠাকুরই ঠিক করে দেন। কালের যাত্রায় ক্যাথলিক ধর্মের কিছু প্রভাব এর ওপরে পরে। ঔপনিবেশিকতার দীর্ঘ চাপে এই অঞ্চলের বেশীরভাগ মানুষ খ্রিষ্টান ধর্মীয়। প্রায় ৩৭% মানুষ এখনো এই ভুডূ চর্চা করে। নানান দেশর লোক এই Fetish market টি দেখতে ছুটে আসে। 


ভুডু পুতুল
আমার ঐ বাজারে যাওয়ার ব্যপারে রীহা প্রবল আপত্তি করলো। সে আপত্তি ওর ক্যাথলিক  স্বত্তা থেকে এল কি না জানি না। তবে এ কথা তো সত্যি যে ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারনবশত: এই আদিম উপজাতিদের আর উপনিবেশের প্রভুদের ধর্ম বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। এই উপকূলের ক্রীতদাসদের মাধ্যমেই ‘ভুডূ’ ক্যারেবিয়ান দ্বীপমালায়, আমেরিকার ল্যুইসিয়ানায়, ইওরোপের বিভিন্ন অংশে পৌঁছে যায়। এই Voodooism নীগ্রো দলিত দাসদের একমাত্র শক্তির সম্বল হয়ে উঠেছিল। খ্রীষ্ঠানরা কালো দাসদের এই ধর্ম চর্চাকে ‘কালো যাদু’ বা হানিকর বিদ্যা বলে প্রচার করে এসেছে। আমরাও সেই প্রচারের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারি নি। কিন্তু তোগোদের এই ভুডূ চর্চা কোনো ক্ষতিকারক কাজে উৎসর্গীকৃত হয় না। এই উপাসনায় শুধু শক্তিকে আবাহন করা হয়। দুর্বলকে যেন ‘ভুডূ’ শক্তি যোগান, এই কামনাই করা হয়। আর ঐ  পশুদেহের বিভিন্ন অংশ দিয়ে বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ তৈরী হয়। বহু দরিদ্র আফ্রিকাবাসী ঐ ওষুধের ওপর নির্ভর করে। অতীতে আমাদের দেশ, চীন বা আরও অনেক প্রাচীন দেশে পশু-পাখির দেহাংশ দিয়ে আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরী খুব অপরিচীত নয়। আবার এও সত্য, ভারতবর্ষ  শল্য চিকিৎসা আর অস্ত্রপচারের মতো আধুনিক চিকিৎসা বহু যুগ আগেই আবিষ্কার করেছিল.....যখন ঐ উপনিবেশ প্রভুরা ‘ভুডূ’ র মতোই কিছু চর্চা করে দিন অতিবাহীত করতো।

ভুডু অনুষ্ঠান

রীহা ভুডূ চর্চা সমর্থন করে না। যদিও এই সব উপজাতিদের প্রতি ও যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। একটি ভুডূ পরিবারের একটি শিশুকে ও ভুডূ পুরোহিতদের হাত থেকে মুক্ত করে। শিশুটির শরীরে কিছু পবিত্র ভুডূ চিহ্ন খুঁজে পাওয়ায় প্রথা অনুযায়ী শিশুটিকে তার চার বছর বয়সে ভুডূ পুরোহিতদর হাতে চিরদিনের মতো তুলে দেওয়া হয়। পুরোহিতরা এই সব শিশুদের সংগ্রহ করে আগামী প্রজন্মের ভুডূ উপাসক তৈরী করে। ঐ ছেলেটির যখন ছয় বছর বয়স তখন রীহা তার সতীর্থদের নিয়ে তাকে প্রায় চুরি করে নিয়ে আসে। তাকে এখন এক বান্ধবীর কাছে রেখে বড় করছে। তার পড়াশোনার সব দায়িত্ত্ব রীহা নিজে নিয়েছে। তবুও রীহার আক্ষেপ যে, ও একটি মাত্র ছেলেরই দায়িত্ত্ব নিতে পেরেছে। আরও কত ছেলের জীবন অশিক্ষার অন্ধকারে এই ভুডূর মায়া জগতে শেষ হয়ে যায়।

একটা ট্যাক্সি নিয়ে রীহাকে ছেড়ে দিয়ে ঘরে ফিরবো ঠিক করলাম। ট্যাক্সি একটা ধরেও ফেললাম। অনেক অনেক মাইল ছুটছে ট্যাক্সি। সূর্য্য তখন পাটে। তোগো লেকের গা বেয়ে আমরা  ফিরছি । এই বিলটি এত বড় যে তার ওপার দেখা যায় না। এই বিশাল জলভূমির সঙ্গে কয়েকটি তন্বী সুন্দরী নদী যুক্ত হয়েছে। যেমন একটু পরেই দেখতে পেলাম সিও নদীর এক শাখাকে। রীহাই চিনিয়ে দিচ্ছিল। এ সমস্ত জলরাশি অনেকটা পথ ঘুরে মিশেছে সাগরে। সাগর পার থেকে একটা অদ্ভুত উষ্ণ বাতাস কোন এক অজানা সময়ে নিয়ে যাচ্ছে। মেঘের ভেতরে ডুবতে ডুবতে সূর্য্যের সোনালি ছটা ছিটকে ছিটকে পড়ছে। আমার পাশে রীহাকে সেই সোনালি ছটায় কি আশ্চর্য্য সুন্দর দেখাচ্ছে। এক অপূর্ব মানবিক রুপ তার। এ রুপ এসেছে তার দয়া, মমতা আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে। খুব অবাক লাগছিল ভেবে যে শতাব্দির পর শতাব্দি অত্যাচারীত হতে হতে শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এত বিশ্বাস, এত ভালবাসা, এত খুশী বেঁচে থাকতে পারে এ দেশে ! রীহাকে না দেখলে জানতেই পারতাম না।

*In a simple country homestead, passions simmer in the same manner as in a ‘civilized’ manor with all its comfort. We then realize that passion is not the sole prerogative of a given race that has reached a degree of civilization. To blossom, passion needs only the heart of man (Felix Couchoro, L’Esclave, 1929, p.23).

ফেলিক্স কূশোরো ( Felix Couchoro) তোগোল্যেসের বিখ্যাত মনিষী যার লেখার মধ্য দিয়ে এদেশের জনমানসের চেতনার প্রথম উন্মেষ ঘটে। তাঁর L’Esclave (Slave) বই টি শুধু তোগো দেশেই নয়, যথেষ্ট প্রভাব ফেলে খোদ ফরাসী দেশেও। ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দে  আমেরিকার লেখিকা হ্যারিয়েট বীচার স্টোয়ের লেখা ‘Uncle Tom’s Cabin’  এর পর প্রায় একই শক্তিতে ১৯২৯ এ  কূশোরোর এই লেখা সাদা সমাজকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তাদের অমানুষ বৃত্তিকে দেখিয়ে দেয়। কালো সমাজ তাদের অধিকার আর মর্যাদা রক্ষার প্রতি সরব হতে থাকে । পশ্চিম উপকূলে ফরাসী উপনিবেশগুলোয় L’Esclave য়ের  প্রভাব  দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

“তুমি নিশ্চয়ই কূশোরো পড়েছো, তাই না রীহা ?”- জিজ্ঞেস করতেই মুখের থেকে চুল সরাতে সরাতে ও উত্তর দিল – “ কূশোরো আমার ঈশ্বর”। এদিকে রীহার গন্তব্য স্থান এসে গেল। নদীটা শেষের মুখে। এখান থেকে বাঁদিক  ঘুরে এগোলেই আটলান্টিকের তীর। আমাকে ঐ দিক দিয়েই ফিরতে হবে। এখানে বাঁ দিকে নদী, ডান দিকে শহরের রাস্তা। রীহা নেমে দাঁড়াল। আমিও নামলাম। যেন একটা মোহনায় এসে দাঁড়িয়ছি আমরা। তারপর রীহা এগিয়ে এসে আমাকে ফরাসী কায়দায় বিদায় চুম্বনের ছোঁয়া দিল। মুহূর্তের জন্য মনে হল রীহার এই স্পর্শে  শুধুই ভদ্রতা নয়। এক আত্মিক আবেদনও অনুভব করলাম। চলে যেতে যেতে আমাকে বলল, “তুমি খুব ভাল মানুষ। এরকমই থেকো, বদলে যেও না”। 

ট্যাক্সি ছুটল সমুদ্র তীরের দিকে। মনে মনে বললাম, -“রীহা,আমি বোধহয় তোমার মত অত ভাল নই। সমাজের আমি কি উপকারে লাগি ! তুমি ভাল থেকো। তোমার মতো আরও রীহা যেন এ দেশে জন্মায়।“

রীহার সঙ্গে আমার আর কখনো যোগাযোগ হয় নি। জানতেও পারি নি, ও কেমন আছে। একটা ছোট্ট বালির কণার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি কত জায়গায়। এতগুলো বছর পরেও রীহাকে নিয়ে মনের মণিকোঠায় সেই একটুকরো সোনালি স্মৃতি আজও উজ্জ্বল রয়েছে।


দৃশ্য ঋণ - http://hirodelle325ducamer-net.over-blog.com/2016/04/cameroun-riz-sauce-d-arachides-le-delice-des-populations-beti.html


0 comments: