0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



কখনো সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে
ঠিক যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা...

না না, হিসাব মেলাতেও চাইছি না। একদম দোরগোড়ায় কলকাতা বইমেলা, ২০১৯। এটা ঠিক হিসাব মেলানোর সময় নয়। তবুও হিসাব রাখতেই হয়। এক বইমেলা থেকে আর এক বইমেলা... মাঝের দিনগুলোয় বিস্তর টানাটানি, হাঁকাহাঁকি, দর কষাকষি, মূল্যবিচার... মন দিয়ে নিজের কাজ করা ছাড়া প্রমাণ করার কিচ্ছুটি নেই।

ঋতবাক পাবলিকেশনের কথা বলছি। এই এক বছরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, ঋতবাকের একটা বাংলাদেশ যোগাযোগ তৈরী হয়েছে সরাসরি। নিঃসন্দেহে, ভালো খবর। বেশ কিছু বাংলাদেশী কবি-সাহিত্যিকের বই প্রকাশ করা গেলো। সঙ্গে কানাডা - ইউ এস এ - মিডল ইস্টে স্থিতু হওয়া বাঙালি সাহিত্যানুরাগী সুহৃৎজনের উৎসাহে তৈরি হলো আরও কিছু বই... আমরাও উৎসাহী। সবচেয়ে বড়ো কথা, আমরা আশাবাদী, বেশ কিছু প্রথিতযশা সাহিত্যিকের খানকয়ের নির্মাণ নিয়ে। আক্ষরিক অর্থেই দিন গুণছি...সর্বোমোট ৭৫ এর কাছাকাছি টাইটেল নিয়ে, যার মধ্যে ৩২টাই আনকোরা। 

সব দেখাবো। বইমেলার ৩৩০ নম্বর স্টলে। আন্তরিক আমন্ত্রণ রইলো... পুরোনো-নতুন -সব বন্ধুদের। অপেক্ষায় থাকবো অধীর আগ্রহে...

অফুরন্ত উৎসাহ উদ্দীপনা ছুঁয়ে যাক আপনাকেও...

শুভেচ্ছা নিরন্তর...

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - দীপঙ্কর রায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


জোড়া প্রবন্ধ
দীপঙ্কর রায়



মরদ আমার হারাঞ গেল গো 

চাসনালার কথা মনে আছে? ধানবাদের চাসনালা? যেখানে এক কয়লা খনিতে তিন শতাধিক কয়লা শ্রমিকের সলিল সমাধি হয়? খননের কাজ চলছিল এক পরিত্যক্ত খনির আশি ফুট কয়লা স্তরের নীচে। হঠাৎ খনির ছাদ ভেঙ্গে পড়ে আর পরিত্যক্ত খনিতে জমে থাকা জলের বন্যা চাসনালা ভাসিয়ে দেয়, ডুবিয়ে দেয় অসহায় খনি শ্রমিকদের। দেশ বিদেশের অত্যাধুনিক কারিগরি প্রযুক্তি লাগিয়েও চাসনালা শুকনো করা যায়নি। বাঁচানো যায়নি ভেসে যাওয়া প্রাণ। 

চাসনালায় ভেসে গেছিল প্রশস্ত খনি সুড়ঙ্গ, আর তার তেতাল্লিশ বছর পরে, মেঘালয়ের জয়ন্তীয়া পাহাড়ে ভেসে গেল ইঁদুরগর্তখনি। র‍্যাট হোল মাইন। জয়ন্তীয়ার কয়লা, পাহাড়ের গভীরে মাত্র তিন চার ফুটের স্তরে থাকে। মাটির অনেক নীচে থাকার দরুন প্রথাগত খনি প্রযুক্তিতে কয়লা তোলা যায়না। তাই ইঁদুরের মত গর্ত খোঁড়া হয় কয়লা স্তরে পৌঁছনর জন্য। সে গর্তে ঢোকে ছোটো চেহারার শ্রমিক, গুঁড়ি মেরে বা শুয়ে শুয়ে। অপরিসর সুড়ঙ্গ, প্রাগৈতিহাসিক প্রযুক্তি, আর গর্ত ধসে গেলেই জীবন্ত সমাধি। তবু পেটের দায় বড় দায়। ঝুঁকির দাম কিছু পয়সা। 

ইঁদুর গর্তে কয়লা তোলা গ্রীন ট্রাইবুনাল বেআইনি ঘোষণা করে পাঁচ বছর আগে। শীর্ষ আদালত রায় দেয়, নতুন করে ইঁদুর গর্তে কয়লা তোলা যাবেনা, তবে যত কয়লা মজুত আছে খননের পর, সেটা পাঠানো যাবে অন্যত্র বাণিজ্যের স্বার্থে, নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে। সে সময় পেরিয়ে গেলেও মজুত শেষ হলনা। সময় সীমা বাড়ানো হল। তারপর আবার, আবার ... এই করে পেরিয়ে গেছে পাঁছ বছর, মজুত এখনো শেষ হয়নি। 

প্রাশ্ন হল, কত কয়লা মজুত ছিল গুদামে, যা পাঁচ বছরেও শেষ হলনা? এ পোড়া দেশে প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা। তবু প্রশ্নটাই তো কেউ করেনা। অবশেষে পনের জন শ্রমিক ডুবে প্রমাণ করল, কয়লা তোলা অব্যাহত ছিল। ট্রাইবুনালের নির্দেশ আর শীর্ষ আদালতের মান্যতা, সব কিছুর চোখে ধুলো দিয়ে। অবিশ্যি যেখানে পাঁচ বছরে দু’ দুটো সরকারচোখ বন্ধ করে থাকে, সেখানে চোখে ধুলো দেবার দরকার তো নেই! 

জয়ন্তীয়া পাহাড়ের ইঁদুর গর্তের মালিক ধরা পড়েছে। আইন এখন আইনের লম্বা পথে। একদিন সাজা হবে হয়তো। চাসনালার অভিযুক্তদের হয়েছিল। লম্বা সাঁইত্রিশ বছর পর এক বছরের জেল আর পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা। সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ! 

না, রাগ করবেননা। বরং একটা গান শুনি চলুন। ইউ টিউবে পেয়ে যাবেন, সেকালে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ... 

রাতকে বিতাইলাম হো।। 
দিনকে বিতাইলাম হো।। 
তেবেও আমার মনের মানুষ আইলনা 
এই চাসনালা খনিতে 
মরদ আমার ডুব্যা গেল গো 

এত প্রতিবাদের গান নয়! এ মানুষের দীর্ঘশ্বাস, যা শোনার মত মানুষও নেই। নাহলে চাসনালার তেতাল্লিশ বছর পরে জয়ন্তীয়া পাহাড়ের র‍্যাট হোলে আবার কারুর মরদ ডুবে যায় ? 

তবু শুনুন একটু মন দিয়ে। যদি উদাসীনতা একটু কাটে... যদি প্রতিরোধের ভাষা খুঁজে পাওয়া যায়...! 



ফুচকা 

বাজি রেখে বলা যায় , ফুচকা খাননি এমন লোক নেই কলকাতায়। বাচ্ছা থেকে বুড়ো, আট থেকে আশি । আর ফুচকাওলার চেহারা চরিত্রে আমি অন্তত কোন পরিবর্তন দেখিনি আমার ষোল থেকে ষাটে। মলিন জামাকাপড়, ছিন্ন গামছা, লাল কাপড়ে ঢাকা ফুচকার ঝুড়ি , তিনটে ডেকচি। ওরই মধ্যে মেনু, ফুচকা, আলকাবলি , আলুর দম আর চুরমুর। পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল এবং এখনো আছে। ফুচকাওলা নোংরা হাতে আলু মাখে, সেই হাতেই পয়সা নেয় ইত্যাদি। আমার এক পাড়ার কাকা ভয় দেখাতেন তেঁতুল গোলা ড্রেনের জলে তৈরি। করপোরেশনের জল থাকতে পয়সা দিয়ে ড্রেনের জল কেন তুলবে প্রশ্ন করাতে উনি আমাকে ডেঁপো বলেছিলেন। 

তো সে যাই হোক, এতদিন ফুচকা খেয়ে আমার অন্তত কোন দিন পেটের গোলমাল হয়নি। পরিচ্ছন্নতার পরীক্ষায় স্টার নম্বর পাওয়া রেস্টুরেন্টে একবার ফুচকা খেয়েছিলাম। ম্যাশড পট্যাটো আর ট্যামারিন্ড দিয়ে গেল আলাদা করে। তো সেটা আমার ফুচকা বলে মনে হলনা। আর কলকাতা কিম্বা রাজ্যের বাইরে খেয়েছি গোলগাপ্পা বা পানিপুরি। সেগুলোও আমার ফুচকা বলে মনে হয়নি। 

ফুচকা হল ফুচকা। আটা আর সুজির সন্তুলিত মুচমুচে খোল, পুরটা অবশ্যই হাতে মাখতে হবে আলু, মটর সেদ্ধ, ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা লেবু আর চাট মশালা দিয়ে। জলটা হবে তেঁতুলের, কখনই পুদিনার নয়। বাঁ হাতে খোল ফুটো করে, পুর ভরে, তেঁতুল জলে ডুবিয়ে, শালপাতার বাটিতে দেবে, আর গালে ফেললে ফুচচ করে মিলিয়ে যাবে, তবেই ফুচকা। গোলগাপ্পার সাধ্য নেই গোলমালের। কলকাতার ফুচকা জিন্দাবাদ। তবে কলকাতার ফুচকাওলাদের বেশিরভাগই প্রতিবেশী রাজ্যের। স্বাদটা ওঁরা নিজের দক্ষতায় আপন করে নিয়েছেন বংশ পরম্পরায়। 

কলকাতার পথখাবারের তালিকায় চাউমিনের চৈনিক আগ্রাসনের অনেক আগে ফুচকার জনপ্রিয়তায় আজ অর্ধশতাব্দী পরেও কোনো ভাটা নেই। শুধু, আগে খেতাম দশ পয়সায় চারটে আর এখন দশ টাকায় চারটে। আবার কিছুদিন আগে ফুচকা উৎসবও নাকি হলো। 

ফুচকার ক্রমোত্তরণ হোক! 

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী

Posted in

প্রবন্ধ


গীতারহস্যামৃতম 
ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী 


‘‘The world is a hellish place and bad writing is destroying the quality of suffering.’‘ – Tom Waits, Musician

এই লেখাটার মুখবন্ধে আর বিশেষ কিছু বলার নেই। টম সাহেবের ওপরের উক্তিটি আশা করি যথেষ্ট। তাই সাহসী পাঠক বন্ধুদের আর সাবধান করার প্রয়োজন মনে করি না। 

এখন কথা হচ্ছে এত কিছু থাকতে হঠাৎ গীতা কেন? কিন্তু আমার পাল্টা প্রশ্ন হচ্ছে, গীতা নয় কেন?? 

আসলে এই মধ্য প্রৌঢ় জীবনে এসে হঠাৎ উপলব্ধি হলো যে এই গীতা গ্রন্থটি ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় জ্ঞানে-অজ্ঞানে, ধর্ম-অধর্মের বেড়া ডিঙিয়ে আমাদের জীবনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।  

ভারতবর্ষ দার্শনিকদের দেশ। মায়ের পেট থেকে পড়েই ভারতীয় মাত্রেই দার্শনিক। তাই যখন এক শিশু ভিক্ষার্থীকে পেটে খিদে নিয়ে লোকাল ট্রেনে টিনের থালা বাজিয়ে, ‘‘সকলই তোমার-ই ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি / তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি’’ গাইতে শুনি তখন একই সঙ্গে আমার অফিসের অ্যাপ্রেইজাল রিভিউ মীটিং-এ আমার উপরওয়ালার সেই দার্শনিক উক্তিটাও মনে পড়ে যায় - ‘‘Hey man, forget all these silly things. You give your best & don’t bother about the results.’’ 

এই দুটি ক্ষেত্রেই আমার গীতায় কৃষ্ণের সেই বিখ্যাত শ্লোক দুটির স্মরণে আসে – 

‘‘অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্তত’’

(বিভূতি যোগ – ৮ম শ্লোকের মুখরা – 

‘‘আমি সকলের উৎপত্তির মূল, আমার দ্বারা সমস্ত চালিত হয়’’)

এবং

‘‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষূ কদাচন’’ 

(সাংখ্য যোগ – ৪৭তম শ্লোকের মুখরা – ‘‘কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে কদাচ নয়।’’)।

সাদামাটা বাঙলায় আর বিশুদ্ধ ইংরেজিতে শিশু ভিক্ষুকটি আর আমার উপরওয়ালা পর্যায়ক্রমে এই দুই শ্লোকের মানে আমাদের বেশ ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। 

পেটের তাগিদে আসমুদ্র-হিমাচল সফরে এই ধরণের প্রচুর অভিজ্ঞতা আমায় ‘‘গীতা নয় কেন?’’ এই কর্মকাণ্ডের অতলান্তিক সাগরে ঝাঁপ দিতে উজ্জীবিত করেছে। এবার সেই অতল সাগরের লোনা জলে যেখানে বহু বড় বড় হস্তী থই পায় না, সেখানে আমার মতো একজন অর্বাচীনের প্রবেশ যেন আমাকেই লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে। ইংরেজিতে সেই একটা কথা আছে না – Fools rush in where Angels fear to tread! 

আসলে বহু দানবিক কর্মকাণ্ডের একটা না একটা ভাল দিকও থাকে। 

আমাদের গ্রামের স্কুলের বাংলার মাষ্টারমশাই, যাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে আমার মনে মাতৃভাষার প্রতি যে পরমাণু পরিমাণ ভালবাসার জন্ম হয়েছিল, তাতেই আমি তাঁর কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। 


(২)

তাঁর বিশ্বাসের কথায় বলতে গেলে বলতে হয় যে যদি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকে ব্যপকতা আর ভয়াবহতার মাপকাঠিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অ্যাখ্যা দেওয়া যায়, তবে বলা যেতে পারে যে এই ভীষণতম যুদ্ধের সবচেয়ে পরম প্রাপ্তি হচ্ছে গীতা নামক মহাগ্রন্থটি। শ্ত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার স্বজন হারানো কুরুক্ষেত্রের শ্মশাণে দাঁড়িয়ে সমস্ত পার্টিসিপেটিং ইন্টারেস্টেড পার্টির গীতা-ই যে এক এবং অদ্বিতীয় সম্বল হতে পারত, সে বিষয়ে নিশ্চয় কারুর আপত্তি থাকার কথা নয়। 

এই চিন্তাধারা থেকেই স্কুল জীবনের সেই দিনটি থেকেই আমার গীতা মহাগ্রন্থের প্রতি ভালবাসার উদয় এবং আমার মতে গীতা মহাগ্রন্থটির সমকক্ষ বিশ্বে আর কোন দার্শনিক গ্রন্থ নেই। 

একটু মনোযোগসহ বর্তমান লেখাটার সঙ্গে এতদূর যদি কোন পাঠক এগিয়ে এসে থাকেন, তবে তিনি নিশ্চয় নজর করেছেন যে বর্তমানে আমি গীতাকে মহাগ্রন্থ বলে সম্মোধন করছি, ধর্মগ্রন্থ বলে নয়। বলা যেতে পারে এটি একটি আমার অতি সুচিন্তিত প্রয়াস মাত্র। আমার এই ধারনা কেন জন্ম নিয়ছে তা অবশ্য ক্রমশঃ প্রকাশ্য।

গীতা যুগে যুগে সারা বিশ্বে প্রচন্ড কৌতূহল ও উন্মাদনার সঞ্চার করে এসেছে এবং এখনও করে চলেছে। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, যে দার্শনিক চিন্তাধারার ওপর গীতার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত, সেই ধরণের উচ্চ মার্গের পথের নির্দেশ একমাত্র গীতা মহাগ্রন্থেই সহজলভ্য। পৃথিবীর আর কোন গ্রন্থ বা এপিক বা ধর্মগ্রন্থ দার্শনিকতার এই উচ্চতম মার্গের দিক নির্দেশ করতে পেরেছে কিনা, সেটা নিয়ে চা বা কফির কাপে তুফান তোলা যেতেই পারে। ব্যাপারটা আমজনতার প্রতিনিধি হিসেবে আমার মতো পটলবাবুর পক্ষে ছোট মুখে বড় কথা বলে মনে হতে পারে ভেবে আমি গুরুর গুরু মহাগুরু মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন সাহেবকে কোট করতেই পারি। দেখা যাক উনি গীতা সম্বন্ধে কি বলেছেন। উনি বলেছেন – 

‘‘When I read Gita and reflect about how God created the universe, 
everything else seems so superfluous.’’

গীতা মহাগ্রন্থের বয়সের গাছ-পাথর নেই। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের তুলনায় মহাগ্রন্থ গীতাকে মোটামুটি ভাবে পিতামহ ভীষ্ম বলা যেতে পারে। এই ব্যাপারে স্বামী বিবেকানন্দের The Parliament of Religions –Chicago-র বক্তৃতাটাকে একটু নাড়াচাড়া করা যাক। 

‘‘As different streams, having their sources in different places, all mingle their water in the sea, so, O Lord, the different paths which men take thro’ different tendencies, various though they appear, crooked or straight, all lead to Thee…

Whosoever comes to Me, thro’ whatsoever form, I reach him. All men are struggling many paths which in the end lead to Me.’’ 

বিবেকানন্দের বাণীর মূল সুরের উৎসে পৌঁছতে গেলে আমাদের দেখে নিতে হবে রাজবিদ্যা-রাজগুহ্য যোগ অধ্যায়ের ২৪তম শ্লোকের মুখবন্ধে শ্রীকৃষ্ণ কি বলেছেন। তিনি বলেছেন,

‘‘অহং হি সর্বযজ্ঞানাং ভোক্তা চ প্রভুরেব চ।’’

[ আমি সর্ব যজ্ঞের (সকল পূজার) ভোক্তা এবং প্রভু।]


(৩) 


এইবার গীতা মহাগ্রন্থে জ্ঞানযোগ অধ্যায়ের একাদশ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ কি বলেছেন দেখা যাক। উনি বলছেন, 

‘‘য়ে যথা মাং প্রপদন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।’’

(যারা যে ভাবে আমার শরণাপন্ন হয়, আমি তাদের সেভাবেই তুষ্ট করি। হে পার্থ, মনুষ্যগণ সর্বপ্রকারে আমার পথ অনুসরণ করে।) 

যাইহোক এবার মহাগ্রন্থ গীতাকে আমি আস্তিক মানুষ হয়েও ধর্মগ্রন্থ বলতে দ্বিধা করছি কেন – এই দশ লক্ষ টাকা দামি বিষয়টাকে নিয়ে আলোচনায় আসা যাক। 

অবশ্য তার আগে মহাগ্রন্থ গীতার পরিসংখ্যান জনিত কিছু তথ্যের বিশ্লেষণ করে দেখলে কেমন হয়? 

মহাগ্রন্থ গীতায় মোট আঠারোটি অধ্যায় আছে। এই আঠারোটি অধ্যায়ে মোট সাতশোটি (৭০০) শ্লোক আছে। তার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ নিজে পাঁচশ ছিয়াত্তরটি (৫৭৬) শ্লোক বলেছেন আর অর্জুন বলেছেন বিরাশিটা (৮২) শ্লোক। সঞ্জয় বলেছেন একচল্লিশটি (৪১) এবং ধৃতরাষ্ট্র মুখে উচ্চারিত হয়েছে মাত্র একটি (১) শ্লোক। 

প্রথম অধ্যায় হচ্ছে সাতচল্লিশটি (৪৭) শ্লোক সমন্বিত ‘‘অর্জুনবিষাদ’’ আর সর্বশেষ অধ্যায়টির নাম মোক্ষ যোগ, যা সর্ববৃহৎ অধ্যায় এবং এতে মোট আটাত্তরটি (৭৮) শ্লোক আছে। পুরুষোত্তমযোগ আর ভক্তিযোগ এই দুটি অধ্যায় একত্রে সর্বকনিষ্ঠ – প্রত্যেকটি মাত্র কুড়িটি (২০) শ্লোক সমৃদ্ধ। 

গীতায় শ্রীকৃষ্ণের কন্ঠে উচ্চারিত ৫৭৬টি শ্লোকের মধ্যে বেশ কিছু শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব এবং ভক্তিবাদের প্রদর্শন আছে। বহু শ্লোকের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ বারংবার ‘‘আমিই ব্রহ্মা, আমিই ইন্দ্র, বাসুদেব’’ ইত্যাদি বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছেন। এছাড়া শ্রীকৃষ্ণের মুখে ‘‘আমাকেই উপাসনা কর, যে আমাকে দ্বেষ করে তাঁকে আমি নরকে নিক্ষেপ কর’’ ইত্যাদি ভীতিপ্রদ শ্লোকেরও ব্যবহার দেখতে পাই। তা এই ধরণের ঈশ্বরিক বিভূতিযুক্ত ‘‘আমি’’ সর্বস্ব শ্লোকগুলো যদি তার্কিক জনগণের বিরোধিতায় আমজনতার ভক্তিবাদী পটলবাবুরা বাদ দিয়েও দেন, তবু তার পরেও সাত-দু-গুনে চোদ্দ-র চার-এর অঙ্কের মতো আমাদের হাতে পেন্সিল রূপে যা থেকে যায়, তা এক কথায় অতুলনীয়। 

যদি শতকরা হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ কথিত ৫৭৬টি শ্লোকের এক তৃতীয়াংশ শ্লোকেও তাঁর ঈশ্বরত্ব বিজ্ঞাপিত হয়ে থাকে (এই প্রসঙ্গে পুরো বিভূতিযোগের ৮২টি শ্লোকের মধ্যে তাঁর উচ্চারিত ৩৫টা শ্লোকই বোধহয় বাদ দেওয়া যায়), তবুও পড়ে থাকা প্রায় ৪০০ শ্লোক আস্তিক, নাস্তিক, মূক, বধির, অন্ধ, তার্কিক, ধনী, গরীব, আবালবৃদ্ধবনিতার শুধু জীবনদর্শনই নয়, বরং তার থেকে এমন একটা উচ্চ মার্গের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে, যা সমস্ত মানুষের জীবন যাত্রা এক সুস্থ, নির্মল, সুখী, এবং শান্তিময় পথের দিকে প্রবাহিত করে দিতে সক্ষম। 

হ্যাঁ, এইখানেই গীতার সার্থকতা আর ঠিক এই কারনেই গীতা একটি মহাগ্রন্থ রূপে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। 

ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে সত্যি নিজেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বলে মনে হতে পারে এই ভেবে যে মাত্র চারশতাধিক শ্লোকের সাহায্যে মহাগ্রন্থ গীতা নিজেকে আবালবৃদ্ধবনিতার দরবারে হাজির করতে পেরেছে।

(ক্রমশ)

0 comments:

0

প্রবন্ধ - নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী

Posted in

প্রবন্ধ


সেইসব মিথ্যাদেবী
নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী


ট্যারানটিনোর কিল বিল। নায়িকা বিট্রিক্স কিডো পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে খুনি বিলকে। খুঁজতে খুঁজতে সে পৌঁছে গেল বিলের বাবা, দালাল এস্তেবান ভিহাইওর কাছে। এস্তেবান ব্রিটিক্সের (উমা থরম্যান) সোনালি চুল দেখে নোংরা হাসল। তারপর বলল বিলের ছোটবেলার একটা ঘটনা। এস্তেবান বিলকে মেরিলিন মনরোর সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। বিল সেখানে হাঁ করে মনরোর দিকে তাকিয়ে ছিল। আর সমানে নিজের মুখে বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে চুষছিল।

এস্তেবান চুরুটের ধোঁয়ায় নোংরা হয়ে যাওয়া দাঁতে হেসে বলে - আমি তখনই জানতাম, ছেলে আমার সোনালি চুলের মেয়েদের পিছনে সারাজীবন পাগল হবে। 

বিট্রিক্স কিডোর চুল সোনালি। তার জীবন বরবাদ হয়ে গিয়েছিল বিলের পাগলের মতো ভালবাসায়।

দৃশ্যটা দেখতে দেখতে আমার বিজয়ের কথা মনে পড়ল। বিজয় আমার সাথে একই স্কুলে পড়ত। কাছাকাছি পাড়ায় থাকত। দূরদর্শনের সাদাকালো পোর্টেবল পর্দায় হেলেনের নাচ হোক বা বিন্দুর ছলাকলা, শশীকলার কোমর দুলিয়ে হাঁটা হোক বা অরুনা ইরানির ঘাগরা পড়ে ফর্সা পা দেখিয়ে নাচ, এই সবকিছু দেখতে দেখতে বিজয় মুখে বুড়ো আঙুল পুরে চুষত। 

টিভি দেখতে থাকা মাসি পিসিরা বিজয়কে বকাবকি করত, মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে কিছু বুঝে হি হি করে হাসত। আমরা ছোটরাও কিছু না বুঝে হাসতাম। বড় হয়ে বিজয় আমাকে উত্তর কলকাতার এক সিনেমা হলে করিশ্মা কাপুরের অশোকাতে সন সনা না দেখতে দেখতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল - ধুঃ শ্লা, ভ্যাম্পরা মাইরি হারিয়ে গেল।

আমি পর্দায় চোখ রেখে বলেছিলাম - কেন বস? নায়িকারা তো আছে। অসুবিধা কী?

বিজয় সিনেমায় ঢোকার আগে ঘটিগরম দিয়ে বিয়ার খাওয়ার ডেফারড ঢেঁকুর তুলে বলেছিল - ধুঃ শ্লা, হিরোইনের সাথে ভ্যাম্পের তুলনা। কিসে আর কিসে? তুই পারিস মাইরি। 

পর্দায় তখন লাল রঙের ধুতি আর কাঁচুলি পরে করিনা, অশোকার সামনে উদ্দন্ড নাচে ব্যস্ত। পর্দা থেকে চোখ ফেরান কষ্টকর ব্যাপার। তার মধ্যেই আমি অবাক হয়ে বিজয়ের দিকে তাকিয়েছিলাম। 

তখন নব্বইয়ের দশক চলছে। ভ্যাম্পদের যুগ শেষ হয়ে আসছে। দ্রুত উঠে আসছে আইটেম গার্লরা। সেই আইটেম গার্লদের সিনেমার সাথে দূরদূরাস্তের কোন সম্পর্ক থাকে না। তারা একটি দুষ্টু গানের সাথে দুষ্টু নাচের মেহমান হয় । এর কিছুদিন পরে অবস্থা আরও শোচনীয় হয় গেল। হিরোইনরা নিজেরাই আইটেম নাম্বার করে নিতে লাগল। বিজয়ের ভ্যাম্পরা রূপোলি পর্দার থিন সিলভার লাইনের অন্যদিকে চলে গেল। ছবিতে খলনায়িকারা হয়তো থাকল, কিন্তু ভ্যাম্পরা উধাও হয়ে গেল।

কথাটা অনেকটা সোনার পাথরবাটি ধাঁচের শোনাবে। একটু উদাহরণ দিলেও ঘটনাটা আরও ভালো বোঝান যাবে। ধরুন বাংলা সিনেমার গীতা দে বা হিন্দির মনোরমা। খিটখিটে ধরনের মা, মাসি, পিসি, বৌদি বা প্রতিবেশী। যারা আবার চরিত্রের প্রয়োজনে কখনও স্নেহশীলা হয়ে উঠছেন। এরা খলনায়িকা, অথবা স্ক্রিপ্টের ডিমান্ডে পার্শ্বচরিত্র। কিন্তু এরা ভ্যাম্প নন। 

ভ্যাম্প বলতে আমি সেই বিদ্রোহী, ডোন্ট কেয়ার চরিত্রকে বোঝাতে চাইছি, যে ছোটখাটো পোষাক পরত, খুব স্বাভাবিকভাবে মদ গাঁজা টানত, যাবতীয় আমোদ – আল্হাদ করত, শখ টখ মেটাত, আবার হয়তো তা মেটাতে গিয়ে সিনেমার শেষে মারাও পড়ত । তারা কখনও ক্যাবারে ডান্সার, কখনও ভিলেনের বাহুলগ্না রক্ষিতা, কখনও ছলাকলায় ভুলিয়ে হিরোকে ফাঁদে ফেলে পরপুরুষের সাথে রাত কাটাচ্ছে, । 

ভ্যাম্প বলতে আমি সেই বিশেষ ক্যারেকটারদের বোঝাচ্ছি যার দিকে তাকিয়ে আপনি উন্মুখ হতেন, অথচ মুখে কখনও ডাকতেন সিডাক্ট্রেস আবার কখনও সেক্সি বলতেন । কখনও সে বাইজি হয়ে নাচত, কখনও সে ক্লাবে ডান্স করত, আর সব জায়গায় সে ছিল সমানভাবে সাবলীল। 

হে পাঠক, ভ্যাম্প বলতে আমি সেই মেয়েটির কথা বলছি, যার নাম হতো লিল্লি, রোজি, কিটি, সাবিনা, সুজি, রিটা। যারা খুব সহজেই বিছানায় যেতে রাজি হতো, যাকে আপনি প্রকাশ্যে ঘৃণা করতেন, গোপনে ভালবাসতেন, সোজা চোখে তাকানোর চাইতে অপাঙ্গে দেখতে পছন্দ করতেন । হে সুধী, সিনেমায় যে চরিত্রের মধ্যে এই এক বা একাধিক গুণাবলী থাকত, এই লেখায় তিনিই ভ্যাম্প বলে বিবেচিতা হবেন। 

সিনেমার খলনায়কদের নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। যে কোন কারণেই ভ্যাম্পরা কিন্তু খুব বেশি সেখানে নেই। শুধু সেখানে নয়, বেশিরভাগ সময়েই সাধারণ মানুষের কাছে তারা একটু ব্রাত্য বা পর্দার রূপ নিয়েই থেকে গিয়েছেন। ভারতীয়দের স্বাভাবিক মানসিকতায় নারীদের দেবী হিসাবে দেখার স্বভাবকে এর কারণ হিসাবে ধরা যেতে পারে।(সে যতই ভারত মেয়েদের জন্যে ৪র্থ মোস্ট ডেঞ্জারাস প্লেস হোক না কেন বা বিভিন্ন শহরে সোনাগাছি বা কামাঠিপুরা বা জি বি রোড থাকুক না কেন!)

এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম বোধহয় হেলেন। সাংবাদিক জেরি পিন্টো তাকে নিয়ে লিখেছেন এইচ বম্ব। তাতে হেলেনের জীবনের বিস্তৃত বিবরণ আছে। তাকে নিয়ে মার্চেন্ট আইভরির ডকুমেন্টারি আছে। কিন্তু সেসব কথা পরে। আগে আসবে ভ্যাম্প হিসেবে দক্ষিণ ভারতীয় এক রমণীর কথা।

তাঁর নাম সিল্ক স্মিতা। সিল্ক স্মিতার একসময় ছবি বেরোত আনন্দবাজারে। সিনেমার পেজে। তার অভিনীত দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার হিন্দি ডাবিং। সিনেমার নাম রেশমা কী জওয়ানি, জওয়ানি সোলা সাল কী, পেট কা পাপ ইত্যাদি ইত্যাদি। সিল্ক স্মিতা সম্পর্কে একটা ছোট্ট ট্রিভিয়া। লায়ানম, যা পরে হিন্দিতে রিলিজ হয় রেশমা কী জওয়ানি নামে, উইকি জানাচ্ছে, অ্যাডাল্ট ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রিতে তা একটি কাল্ট ফিল্ম হিসেবে পরিচিত হয়েছে। সফটকোর পর্ণ সিনেমার মার্কেটে রেশমা কী জওয়ানি এখনও ভারতের একটি সবচেয়ে বেশি রোজগার করা সিনেমা।

তাঁকে আমার প্রথম দেখা সদমায়। কমল হাসন উটির এক স্কুলের শিক্ষক। স্মৃতি হারানো শ্রীদেবী তাঁর কাছে আশ্রয় পেয়েছেন। সিল্ক স্মিতা কমলের স্কুলের বয়স্ক হেডমাস্টারের স্ত্রী। কমলকে আসতে যেতে দেখেন। একটু মোটা ঠোঁট। হালকা ফাঁক করা। সামনের দিকের দাঁত দেখা যাচ্ছে সেখান দিয়ে। মোটা উরু। ততোধিক স্থূল নিতম্ব। তলপেটে হালকা ভুঁড়ির আভাষ। দু চোখে অন্তত আকাঙ্খা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন কমলের দিকে। 

মেনষ্ট্রিম সিনেমায় তাকে খুবই কম ব্যবহার করা হয়েছে। হলেও বেশিরভাগ সময়ে ভ্যাম্প হিসেবে। কিছুদিন আগে একটি বিদ্যা বালনের একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। বিতর্ক এড়াতে প্রযোজক, পরিচালক জানিয়েছিলেন সেটি শুধু সিল্ক স্মিতার জীবনী নয়। সিল্ক স্মিতা, ডিস্কো শান্তির মতো অনেক ভ্যাম্পদের জীবন নিয়ে একটি মিলিজুলি কাহিনি। 

সিল্ক স্মিতার সম্পর্কে কিছু কাহিনি এখনও দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা জগতে মিথের মতো চলে। সেসব অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া যায়। কিছু ঘটনা আমি শুনেছিলাম আমার এক বাঙালি বন্ধুর মুখে, যে কিনা আবার কিছুদিন ডাউন সাউথে গিয়েছিল নিজের ভাগ্যপরীক্ষা করতে। আমি আর আমার সেই বন্ধু দুজনেই স্ক্রিপ্ট লেখা শিখেছিলাম বিনয় রঙ্গনাথন আর অঞ্জুম রাজাবলি নামে দুই অত্যন্ত জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকারের কাছে। 

একটা ঘটনা হলো অনেকটা এরকম। শিবাজি গনেশণ সেটে ঢুকছেন। শিবাজি সেসময়ে দক্ষিণ ভারতে ইন্ডাষ্ট্রির বেতাজ বাদশা। অনেকটা আমাদের উত্তমকুমার বা তখন তাঁর চেয়েও আর একটু বড় মাপের। 

তা ব্যাপার হলো, তিনি সেটে ঢুকলেই সকলে উঠে দাঁড়াত। সন্মান জানাতে। সেটাই অলিখিত নিয়ম হয়ে গিয়েছিল সিনিয়র জুনিয়র সবার কাছে। সিল্ক বসে রইলেন। শিবাজি সেটা দেখলেন, অথচ সিল্কের কোন হেলদোল নেই। সকলেই সেটা খেয়াল করছে। বসে রইলেন ক্রশলেগ ভঙ্গিমায়। এক উরু আরেক উরুর উপর তোলা। কেউ তাকে পাশ থেকে বলল - কী করছ কী?

তিনি উত্তর দিলেন – আমার থাই, আমার থাইয়ের উপর দিয়ে বসে আছি। শিবাজি স্যারের উপর তো দিইনি। ওঁনার কিসের অসুবিধা?

অ্যাটিটিউড। একটি শব্দ, যে কোন ভ্যাম্পের ডিকশনারির সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কথা, তা প্রচুর পরিমাণে ছিল অন্ধ্রপ্রদেশের হদ্দ গ্রামের একটি প্রায় অনাহারে থাকা একটি মেয়ের। এদিকে দুবেলা খাওয়া জোটে না, ওদিকে শরীর তার নিজের নিয়মে বেড়ে যাচ্ছে। আপনা মাংসে হরিণা বৈরি ইত্যাদি ফর্মূলা মেনে তার মা বিয়ে দিল এক গরুর গাড়ির চালকের সাথে। সেখানেও সেই একই পেটের জ্বালা, নিত্যদিনের অশান্তি। একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে মেয়েটি মাদ্রাজের ট্রেণ ধরে কলিউডে আসার জন্যে। 

এরপর কাজের লোক, নায়িকার টাচ আপ গার্ল হয়ে সফট পর্ণ সিনেমার নায়িকা ও মেনষ্ট্রিমের ভ্যাম্প হওয়া। দুশো সিনেমায় অভিনয় আর প্রায় পাঁচশো সিনেমায় নাচ বা অ্যাপিয়ারেন্স। অবস্থা একসময় এমন যে, প্রযোজকেরা লাইন দিয়ে বসে থাকতেন ডেট পাবার জন্যে। তাদের সিনেমার হিরো কমল হাসন থেকে রজনীকান্ত যেই হোক না কেন, সিল্ক স্মিতার নাচের একটা দৃশ্য চাইই চাই। নইলে সিনেমা বাজারে কাটবে না। প্রতি নাচের দৃশ্যে পঞ্চাশ হাজার। সেই সময়কার। নিজের প্রোডাকশন খুলে লোকসান দু কোটি টাকা। সেই সময়কার হিসাবে। অ্যাটিটিউড না থাকলে এসব হয় না।

মানুষ কেমন ছিলেন সিল্ক? লেখাপড়া না জানলেও গড়গড়িয়ে ইংরেজি বলতেন। সেটে আসার ব্যাপারে অসম্ভব পাংচুয়াল ছিলেন। মারা যান অ্যালকোহলের সমস্যায়। ১৯৯৬ য়ে মৃত্যুর সময় অবধি করেছিলেন সতেরো বছরে পাঁচটি ভাষায় প্রায় পাঁচশো সিনেমা। যার মধ্যে বেশির ভাগই ছিল সফটকোর। মাত্র কয়েকটি সিনেমায় সুযোগ পেয়েছিলেন মেনষ্ট্রিমে অভিনয় করার। যার মধ্যে একটি অবশ্যই সদমা। দ্বিতীয় চরিত্রটি আরও জটিল। আলাইগাল ওইভাথিল্লাই , সেখানে তিনি তাঁর স্বামীকে সাহায্য করছেন তাদের কাজের লোকের শ্লীলতাহানি করতে, দরজায় পাহারা দিচ্ছেন যাতে লোকে কিছু জানতে না পারে। আবার একই সাথে স্বামীর এই নোংরামোতে তিনি ব্যথিত ও দুঃখিত। কমপ্লেক্স ক্যারেকটাইজেশন। আর প্রতিটিতেই ছিলেন অসম্ভব সাবলীল এই অভিনেত্রী। 

নাসরিন মুন্নি কবিরের - হেলেন অলওয়েজ আ স্টেপে দেখা দেখা যায় হাজার জাঁকজমকের পরেও হেলেন ক্যামেরার সামনে নাচাকে কখনই খুব একটা উপভোগ করেননি। যদিও ক্যামেরার সামনে তার লাস্যময়ী ভঙ্গিমা, উচ্ছল আনন্দের প্রকাশ, মোহময়ী নিস্পৃহতা দর্শককে কখনই এই বিরক্তি বুঝতে দেয়নি। কি অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা! সারাজীবন ধরে! 

একটি ফ্রানকো - বার্মিজ ছোট্ট মেয়ে তার মা এবং অন্য ভাইবোনদের সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আশ্রয় নেয় আসামে। আসাম থেকে কলকাতা হয়ে বোম্বে। ১৯৫১ তে রাজ কাপুরের আওয়ারা ছবিতে নাচেন দলের আর সকলের সাথে। রাজেশ খান্না থেকে শর্মিলা ঠাকুর, বলিউডে এঁদের হাত ধরে স্টারডমে পৌঁছে দিয়েছিলেন বর্ধমানের যে মানুষটি, সেই শক্তি সামন্ত ১৯৫৮ তে প্রথম বিগব্রেক দেন হেলেনকে তাঁর হাওড়া ব্রিজ ছবিতে।

কিন্তু বলিউডের ভ্যাম্পের সবচেয়ে বিখ্যাত নাম হেলেন হলেও ভ্যাম্পদের ইতিহাস অনেক বিস্তৃত। এবং শ্রীমতি হেলেন রিচার্ডসন খান সেই ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা। 

বলিউডে ভ্যাম্প হিসেবে মোটামুটি হেলেন ছাড়া আর মাত্র চারজনকে চিহ্নিত করা যায়। যার মধ্যে অবশ্যই ললিতা পাওয়ার ও মনোরমাকে রাখা যাবে না সঙ্গত কারণেই। যা এর মধ্যেই বলা হয়েছে। তাঁদের বাদ দিয়ে যারা বাকি থাকলেন তাঁরা হলেন নাদিরা, অরুণা ইরানি, বিন্দু ও শশীকলা। 

নাদিরা জন্মেছিলেন দক্ষিণ মুম্বইয়ের নাগপাড়া অঞ্চলের এক বাগদাদি ইহুদী পরিবারে। নাদিরার আসল নাম ফ্লোরেন্স (ফরহাট) এজকিয়েল।

তাঁর প্রথম ছবি দিলীপ কুমারের বিপরীতে আন, ১৯৫২তে। ১৯৫৫ তে আসে শ্রী ৪২০। এবং সেই বিখ্যাত গান। মুড় মুড় কে না দেখ। হাতে সিগার। ১৯৬০য়ে আরেক বিখ্যাত গান আজীব দাস্তান হ্যায় ইয়ে। যেখানে গানে একটিবারও লিপ না দিয়ে শুধু চোখ দিয়ে, তাকানোর বিভঙ্গে রাজকুমার আর মীনাকুমারীর সাথে পাল্লা দিয়ে গিয়েছেন তিনি। ১৯৫০ এবং ১৯৬০ ছিল নাদিরার সময় ভ্যাম্প হিসেবে। যার মধ্যে একটি চরিত্র ছিল জুলির সেই মা, যাঁর জন্যে তিনি বেস্ট সার্পোটিং অ্যাকট্রেস হিসেবে পুরস্কার পাবেন।

নাদিরা মারা যান বিভিন্ন অসুখে ভুগে। যার মধ্যে ছিল টিউবারকুলার মেনিন জাইটিস, প্যারালাইসিস এবং অত্যাধিক মদ্যপানজনিত কারণে লিভার ডিসঅর্ডার। দুবার বিবাহবিচ্ছেদের পরে একাই থাকতেন। দুই ভাইয়ের একজন থাকত আমেরিকায়, অন্যজন ইসরায়েলে। কোন সন্তানাদিও ছিল না। ফেব্রুয়ারীর এক বিষণ্ণ দিনে মুম্বইয়ের ভাটিয়া হসপিটালের কোন এক বেডে শুয়ে চলে যান একসময়ের মোহময়ী।

আবার একটা ছোট্ট ট্রিভিয়া, নাদিরা ছিলেন প্রথম অভিনেত্রী যাঁর ছিল একটি রোলস রয়েস গাড়ি।

২০০৭ এর পদ্মশ্রী সন্মানে ভূষিতা এবং ২০০৯ এর ভি শান্তারাম পুরস্কার পাওয়া শশীকলা যখন সিনেমায় আসেন তখন অন্য অনেক অভিনেত্রীর মতোই তাঁরও একটি মাত্র উদ্দেশ্য ছিল। যত বেশি সম্ভব সিনেমায় অভিনয় করতে হবে এবং যত বেশি সম্ভব টাকা রোজগার করতে হবে। ১৯৩২ এ শশীকলা জন্ম নেন সোলাপুরের এক হিন্দু মহারাষ্ট্রিয়ান ধনী এক পরিবারে। 

ছোটবেলায় তিনি ছিলেন বড়লোকের এক আদুরে মেয়ে। ছোট থেকেই নাচ গান অভিনয়ে পারদর্শী। অথচ একটু বড় হতেই তাঁর অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে গেল। ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় তাঁর বাবা নিঃস্ব হয়ে গেলেন। বোম্বেতে আসলেন এই আশায় যে, তাঁর ভাল নাচ গান জানা মেয়ে সেখানে ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রিতে যদি কিছু কাজকর্ম পায়। কিন্তু ইয়ে হ্যায় বোম্বে মেরি জাঁ। বরাবরই ভারতের সবচেয়ে প্রফেশন্যাল, সবচেয়ে নিষ্ঠুর এবং সবচেয়ে মায়াময় একটা শহর। যে শহর তাঁর অধিবাসীদের প্রতি মুহুর্তে টেস্ট করতে থাকে। বোম্বের পরীক্ষায় শশীকলার পরিবার ডাহা ফেল করল। তাঁদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। শশীকলা বাধ্য হলেন লোকের বাড়িতে কাজ করতে। এখানে তিনি লোকের বাড়িতে বাসন মাজেন, কাপড় ধোন, ঘর ঝাঁট দেন।

১৯৪৫ য়ে অভিনেত্রী নূরজাহানের সাথে তাঁর কোনভাবে আলাপ হয়। সেসময় জিনাত নামে একটি ছবির শুটিং চলছিল। যাঁর হিরোইন ছিলেন নূরজাহান। নূরজাহান তাঁর সোহর পরিচালক শওকত হুসেন রিজভিকে বলে টলে জিনাত ছবিতে কাওয়ালির দলে শশীকলাকে নামিয়ে দেন। শশীকলা সেই অভিনয় করে ২৫ টাকা রোজগার করেন। 

শশীকলার প্রথম বড় ব্রেক আসে জুগনু থেকে। শওকত সাহেব চারশো টাকা মাসমাইনেতে শশীকলাকে নিজের স্টুডিওতে চাকরি দেন। ঠিক যেসময় শশীকলা হিরোইন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছিলেন, সে সময় ভারত ভাগ হয়ে যায় । শশীকলার মেন্টর নূরজাহান ও শওকত হ হুসেন চলে যান পাকিস্তানে। শশীকলার আর হিরোইন হওয়া হয় না। আবার ফিরে যান স্ট্রাগলের রাস্তায়। পি. এন অরোরা, অমিয় চক্রবর্ত্তীর সিনেমায় ছোটখাট রোল করা শুরু করেন। একটু একটু করে রোল বাড়তে থাকে। ভি শান্তারাম সুযোগ দেন তিন বাত্তি চার রাস্তায়।

১৯৫৯ তে করেন সুজাতা বিমল রায়ের সাথে। ১৯৬২ তে করেন আরতি। মীনা কুমারী, অশোক কুমার এবং প্রদীপ কুমার। শশীকলার প্রথম নেগেটিভ রোল এবং ফিল্ম ফেয়ার জেতা। এরপর একের এক ভ্যাম্পের রোল। কখনও হিরোর হাতে হাসতে হাসতে গান গাইতে গাইতে মদের গ্লাস তুলে দেওয়া আবার কখনও ক্রুর, বাবলি, হার না মানা খলনায়িকা, যার চোখে সবসময় অমোঘ আহ্বাণ। যাকে চাইলেই সহজে পাওয়া যায়। প্রথমে তিনি হন ভ্যাম্প এবং তারপর চরিত্রাভিনেতা। ঠিক এসময়েই শশীকলার বিয়ে হয় ওমপ্রকাশ সায়গলের সাথে। 

বিয়ের পর দুটি মেয়ে হয়। আর তারপর শুরু হয় স্বামীর সাথে ঝগড়া ঝামেলা। জীবনে শান্তি পেতে শশীকলা সবকিছু ছেড়ে দেন। নিজের ঘর, সংসার, মেয়েদের, সবকিছু ছেড়েছুড়ে তিনি ঘর থেকে বার হয়ে আসেন।

অশীতিপর এই অভিনেত্রী জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছেন কলকাতায় মিশনারিজ অফ চ্যারিটিজের এবং বিভিন্ন সেবামূলক কাজে। বর্তমানে বড় মেয়ে ক্যান্সারে মারা যাবার পর, ছোট মেয়ে আর জামাইয়ের সাথে থাকেন। 

বলিউডি ভ্যাম্পদের দুনিয়ায় ৬০ - ৭০ এর দশকে উঠে আসে আর এক নাম। বিন্দু। পুরো নাম বিন্দু নানুভাই দেশাই। বিন্দুর বাবা নানুভাই ছিলেন একজন ছোটখাট ফিল্ম প্রোডিউসার। মা জোৎস্না একজন মঞ্চাভিনেত্রী। ১৯৬২ তে আনপড় ছবিতে অশিক্ষিত মালা সিনহার শিক্ষিত মেয়ের রোলে তার অভিনয় শুরু।

বিন্দু একজন সফল ভ্যাম্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন দো রাস্তে থেকে। এবং কাটি পতঙ্গের সেই বিখ্যাত লাইন - মেরা নাম হ্যায় শবনম, প্যার সে লোগ মুঝে শব্বো কঁহতে হ্যায় - বলে আশা পারেখকে ব্ল্যাকমেল করে তিনি সেই প্রতিষ্ঠাকে আরও দৃঢ় করেন। ইমতিহান, হওস এইসব সিনেমায় একটানা অভিনয় করে, আসে জঞ্জিরের সেই ঐতিহাসিক মোনা ডার্লিং।

অদ্ভূতভাবে বিন্দুর সিনেমায় আসা যেরকম সহজভাবে হয়েছিল তার জীবন কিন্তু তত সহজে কাটেনি। মাত্র তেরো বছর বয়সে তাঁর বাবা নানুভাই দেশাই মারা যান। ছয় বোন ও এক ভাইয়ের সংসারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব তার উপর এসে পড়ে। সৌভাগ্যক্রমে বিন্দু তার জীবনে পেয়েছেন চম্পকলাল জাভেরীকে। তার ছোটবেলা থেকে দুজনের প্রেম। চম্পকলালকে পরিবারের অমতে বিন্দুকে বিয়ে করায় তার পারিবারিক ব্যবসাপাতি থেকে বার করে দেওয়া হয়। ফিল্মের নাচ করতে গিয়ে বিন্দুর গর্ভস্থ শিশু মারা যাওয়ার পর বিন্দু মা হতে পারেননি। তিনি এবং তার স্বামী বর্তমানে পুণেতে থাকেন।

৭০ এর দশকে বিন্দু, অরুণা ইরানি এবং হেলেন, এই তিনজনকে বলিউডের আইটেম নাম্বার থেকে ক্যাবারে, ক্লাব ডান্স থেকে ভিলেনের ডেরার লাস্যনৃত্য করার সাবলীলতা বলিউডে ভ্যাম্পদের হোলি ট্রিনিটির পরিচিতি দেয়। 

বিন্দুকে অন্যভাবে ব্যবহার করার পিছনে অবদান আর এক বাঙালি পরিচালকের। রামগোপাল ভার্মা আর অনুরাগ কাশ্যপের বহু আগে লো বাজেটের সুপারহিট সিনেমা বানাতে যাঁর কোন জুড়ি ছিল না। হৃষীকেশ মুখার্জী। যাঁর অর্জুন পন্ডিত এবং অভিমানে বিন্দু প্রথম দেখান তার অভিনয় প্রতিভা। এর পরেই চৈতালিতে করেন একটি সম্পূর্ণ অন্যধরনের চরিত্র। অশোক কুমারের পঙ্গু স্ত্রীর ভূমিকায়। এবং সবগুলিতেই দেখান নন - সেক্সিটাইজড রোল বা যৌনতার সুড়সুড়ি না দেওয়া অভিনয়েও তিনি সমানভাবে দক্ষ।

অরুণা ইরানির বাবা ফেরুদিন ইরানির ছিল ছোট্ট একটা ড্রামা কোম্পানি। কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটত। তাঁর মাও ছিলেন একজন অভিনেত্রী । আট ভাইবোনের সংসার। গঙ্গা যমুনায় প্রথম শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়। মুখের মধ্যে প্রচুর পটেটো চিপস আর হাতে কোল্ডড্রিংকস নিয়ে সবে গুছিয়ে বসেছেন হঠাৎ দিলীপ কুমার বলে উঠলেন - এই মেয়ে, নিজের ডায়লগ বল। অরুণা ইরানি ডায়লগ বললেন। সিলেকশান হয়ে হয়ে গেল। 

কিন্তু এরপর আর তেমন কিছু হল না। পরের পর ফিল্মে ছোট ছোট রোল, মেয়েদের ভিড়ে নাচ করা। এরকমই একসময় মেহমুদের সাথে তাঁর কমেডি জোড়ি গড়ে ওঠে। আর সেখান থেকেই মেহমুদের পরিচালনায় বোম্বে টু গোয়াতে হিরোইনের রোল। বিপরীতে ঢ্যাঙা এক হিরো। নাম অমিতাভ বচ্চন। বোম্বে টু গোয়া সেসময় কতটা হিট হয়েছিল সেটা আলাদা ব্যাপার। তবে দুজন অভিনেতার জীবন এই ফিল্ম অন্যভাবে প্রভাবিত করেছিল। অরুনা ইরানি এই সিনেমার জন্যে নাচ শিখে হয়ে উঠলেন এক দক্ষ ডান্সার। এবং ভবিষ্যতে হেলেন, বিন্দু, ইরানি - সেই ট্রিনিটির সদস্য। 

আর ঢ্যাঙা হিরোটিকে নিজের ফিল্মে চান্স দেওয়ার আগে একটু দোনামোনা করছিলেন পরিচালক প্রকাশ মেহতা। তার ফিল্মের হিরোইন জয়া ভাদুড়ি এই অভিনেতাটিকে রেফার করেছেন। তবে প্রকাশ মেহতার প্রথম পছন্দ দেব আনন্দ বা রাজেশ খান্না। তাঁরা না হলে নিদেন পক্ষে শত্রুঘ্ন সিনহা। জঞ্জিরে প্রচুর ঝাড়পিট আছে। এই লম্বা ছেলেটি তা করতে পারবে কি না প্রকাশ মেহতার সন্দেহ ছিল। জয়া ভাদুড়ি এসময়েই পরিচালককে বলেন বোম্বে টু গোয়ায ছেলেটির করা মারপিটের দৃশ্যগুলো দেখতে। প্রকাশ দেখেন। এবং অমিতাভ বচ্চনকে হিরো হিসেবে জঞ্জিরে মনোনীত করেন। বাকিটা ইতিহাস।

ফিরে আসি অরুণা ইরানির কথায়। অরুণা ইরানির কেরিয়ার যখন ঠিক পাখা মেলবে মেলবে করছে, ঠিক তখনই ইন্ডাষ্ট্রিতে তাঁকে নিয়ে কিছু রটনা হয়। ব্যস ইরানির কেরিয়ার প্রায় শেষের মুখে পৌঁছে যায়। আস্তে আস্তে আবার তিনি ফিরে আসেন। প্রথমে পার্শ্বচরিত্রে। তারপর ভ্যাম্প হিসেবে। ববি, ক্যারাভ্যান, সরগম, ফকিরা, লাভ স্টোরি। ১৯৯০ এর দিকে তিনি মায়ের ভূমিকা করা শুরু করেন।

এবার আসবে ভ্যাম্পদের সেই সাম্রাজ্ঞীর কথা, যাঁর সময়কে আলাদাভাবে বলিউডে চিহ্নিত করা হয়। যে বিরল সন্মান বহু নায়ক নায়িকাও পান না। লতা মঙ্গেশকর যাঁর লিপে গান গেয়েছিলেন শুধুমাত্র এই কারণে যে তিনি বলিউডের একটা সময়কে মিস করতে চান নি। অথচ এই মহিলাই তাঁর ছোটোবেলায় একটা সময় পার করে এসেছেন যখন একটা দিনে জানতেন না, পরের দিন বেঁচে থাকবেন কি না! 

সাইরেন শুনে ছোটোবেলায় ব্যাঙ্কারে যেতে যেতে এমন অবস্থায় হয়েছে যে এই বয়েসেও সাইরেন শুনলে প্যানিক হয়। রেঙ্গুন থেকে আরও অনেকের সাথে মা আর ভাইয়ের সাথে বেরিয়েছিলেন ভারতে আসবেন বলে। খাওয়া দাওয়ার ঠিক নেই। হাঁটতে হাঁটতে পা ফুলে ঢোল। সময় লেগেছিল ছ থেকে সাতমাস। জঙ্গুলে রাস্তায় খেতেন ফুল, ঘাস, পোকামাকড়। যখন যা পাওয়া যায়। সেই অবস্থায় পৌঁছলেন ডিব্রুগড়। অপুষ্টি, অতিরিক্ত পরিশ্রম, অনাহারে, ডেঙ্গু, বেরিবেরিতে পেট ফুলে গেল। অসুস্থ হয়ে ভর্তি হলেন হাসপাতালে। ভাই মারা গেল। মাকে নিয়ে প্রথমে কলকাতায় তারপর এলেন মুম্বইতে।

কুক্কু মোরে ছিলেন একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ডান্সার এবং হেলেনের মায়ের পরিচিতা। তিনিই হেলেনকে ১৯৪৭- এ ৯ -১০ বছর বয়সে আওয়ারা, সাবিস্তান এইসব সিনেমায় কোরাস ডান্সারের সুযোগ করে দেন। 

৬০ এবং ৭০ এর দশকে প্রায় ৭০০ সিনেমায় হেলেন নেচেছেন। বিভিন্ন ভাষাভাষী চরিত্র পর্দায় ফুটিয়ে তোলেন। জনপ্রিয়তার অন্যতম রহস্য ছিল তাঁর সাজগোজ। বিভিন্নরকমের পরচুলা, কনট্যাক্ট লেন্স, পোষাক আশাকের অভিনব ব্যবহার। গুমনামে হয়েছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, এক সে বড়কর এক এ জার্মান স্পাই, হাওড়া ব্রিজে নাইট ক্লাব ডান্সার, ইনকারে গোয়ানিজ মেছেনী।

বলা হয়, যে কোন পেশায় কেউ যদি তাঁর সবটুকু ঢেলে দেয় তবে সে কোন পর্যায়ে যেতে পারে, হেলেন অবশ্যই তাঁর উদাহরণ। হেলেনই হলেন সেই আর্টিস্ট যিনি ক্যাবারে এবং বেলি ডান্সিং দুই ই হিন্দি সিনেমার জগতে ব্যাপকভাবে নিয়ে আসেন। ৮০ র দশকের দিকে বয়সের জন্য তার চাহিদা পড়তে থাকে। পদ্মা খান্না, জয়শ্রী টি, বিন্দু, অরুনা ইরানিরা অতি দ্রুত তার জায়গা নিয়ে নিতে থাকে। প্রথম বিয়ে প্রেম নারায়ন অরোরাকে। স্বামী পি এন অরোরা তাঁর টাকাপয়সা নিয়ে উড়িয়ে দেন, একটা সময়ে হেলেন বেশ অর্থকষ্টে পড়েন।

বর্তমানে তাঁর স্বামী সেলিম খান, তখন তাঁকে বিভিন্ন পরিচালকের কাছে রেফার করতে থাকেন, কিছু অন্যরকম রোল দেওয়ার জন্যে। ১৯৮১ তে তাঁরা বিয়ে করেন। তার মধ্যে ১৯৬৫, ৬৮ এবং ৭১ এ বেস্ট সাপোর্টিং রোলের জন্য নমিনেশন পান। তিনবারই ব্যর্থ হন। ১৯৭৯ তে লহু কে দো রঙ এর জন্যে ওই পুরস্কার পান। ২০০৯য়ে তিনি পান পদ্মশ্রী ।

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে এই ভ্যাম্পরা উধাও হয়ে গেলেন। আইটেম গার্লরা এসে খাল্লাস ধরনের নাচা গানা করতে লাগল। মুন্নির ঝন্ডু বামের সাথে সিনেমার কোন সম্পর্ক রইল না। মুন্নিদের দেখে শীলারাও বেশিদিন বসে রইল না। সিনেমার হিরোইনরা নিজেরাই জারা জারা কিস মি আর শীলা কি জোয়ানি দেখাতে শুরু করে দিল। ভ্যাম্প, আইটেম গার্ল আর হিরোইন মিলে অদ্ভূত এক খিচুড়ি শুরু হয়ে গেল। আর পাবলিকে হাতা নিয়ে পাতা পেড়ে সেই খিচুড়ি খেতে শুরু করে দিল। মাঝখান থেকে বেচারা বিজয়ের মতো পাবলিকেরা কাকে দেখে হাতের বুড়ো আঙুল চুষবে ঠিক করতে পারল না। এমনকি সাইজ জিরোর ধাক্কায় শেষ অবধি বুড়ো আঙুল না কড়ে আঙুল কোনটা চুষবে সেই ডিসিশন নিতেই কনফিউজড হয়ে গেল।

হিব্রু উপকথায় লিলিথের কথা আছে। আদমকে একা একা দেখে ঈশ্বর তৈরি করলেন এক নারীকে। তার নাম লিলিথ। ভালবাসার সময় আদম বলল - আমি তোমার উপরে থাকব। লিলিথ বলল - তা কেন? আমি তোমার সমান। আমাকেও ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। আমি তোমার উপরে থাকব। 

আদম লিলিথের উপর জোর করতে গেল। লিলিথ নিজের অধিকার জানে। নিজের শর্তে বাঁচে। লিভস উইথ হার ওন টার্মস। সে আদমকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। আদম বেচারা অবোধ। ঈশ্বর পিতার বাধ্য সন্তান। পিতার কাছে গেল নালিশ জানাতে। ঈশ্বর সব শুনে লিলিথকে ডাকলেন। বললেন - লিলিথ আদমের কথা শোন।

লিলিথ বলল - আমি আদমের সমান সমান। আমি যদি ওর কথা শুনি, তবে ওকেও আমার কথা শুনতে হবে। 

ঈশ্বর বললেন - তা কী করে হয়? ও তো পুরুষ। শক্তিমান। ওর কথা তোমায় শুনতে হবে সারাজীবন।

লিলিথ বলল - আমি নারী। আমিও শক্তিমান। আমি কারোর কথা শুনব না। 

এই বলে লিলিথ স্বর্গোদ্যান ছেড়ে চলে গেল। ঈশ্বর তখন আর এক দেবী সৃষ্টি করলেন। ইভ। ঈশ্বরের মনের মতো। আদমের বুকের হাড় দিয়ে তৈরি। তার বাধ্য। নম্র ভদ্র। গল্পের নায়িকা। 

আর লিলিথ সেই বিদ্রোহিনী হয়েই থাকল। দেবী হয়েও সে দেবী নয়। মিথ্যে মিথ্যে দেবী। 

এই ভ্যাম্পদের আমার অনেকটা লিলিথের মতো লাগে। সিল্ক স্মিতা, হেলেনরা যে সময় অভিনয় করেছেন, সে সময় মহিলাদের একটা নজরেই দেখা হতো। সাদা অথবা কালো। স্ক্রীনে তারা যদি ভাল হন তবে মানুষের ধারণা ছিল বাস্তবেও নিশ্চয়ই সকলে বাড়িতে পুজো করেন, লক্ষী ধরনের মহিলা। আর পর্দায় যদি খারাপ হয় তাহলে এ নিশ্চয়ই বাস্তবেও খারাপ মেয়ে। যদি ওঁরা এই সময়ে অভিনয় করতেন, তবে হয়তো এখনকার পরিণত দর্শক বা পরিচালক প্রযোজকদের কাছ থেকে আরও একটু সন্মান, আর একটু গ্রহনযোগ্যতা, আর একটু সুযোগ পেতেন ইন্ডাষ্ট্রির ভিতরে ও বাইরে। 

শশীকলা এক ইন্টারভিউয়ে একটা দামি কথা বলেছিলেন। কথাটা হল, একজন ভ্যাম্পকে সবসময় হিরোইনের থেকে বেশি সুন্দরী, সপ্রতিভ এবং অল্পবয়স্ক লাগতে হবে, তবেই না দর্শক থেকে হিরো সকলেই সেই ভ্যাম্পের দিকে ঝুঁকবে। 

তাই ভ্যাম্পের দক্ষতা অনেক সময়েই হিরোইনের চেয়ে একটু বেশি হলেও তারা কোনদিন দেবী হননি। তারা ছিলেন লিলিথের মতো। নিজের মতো করে বাঁচা এক নারী, লিভড উইথ হার ওন টার্মস। একজন মিথ্যাদেবী।


Refernces: 
Helen: The Life and Times of Bollywood H – Bomb: Jerry Pinto
Bollywood Baddies: Villains, Vamps and Henchman: Tapan K Ghosh
Silk Smitha: Saul Eadweard Helias
Wikipedia

0 comments:

0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ৯
শিবাংশু দে

আমি যে গান গেয়েছিলেম, মনে রেখো…. 

'.... আমাদের সময়কার কথা আলাদা। তখন কে ছিলো? ঐ তো গুণে গুণে চারজন। জর্জ, কণিকা, হেমন্ত, আমি। কম্পিটিশনের কোনও প্রশ্নই নেই। ' (একটি সাক্ষাৎকারে সুচিত্রা মিত্র) 


বাবার কাছে গল্প শুনেছি। সাতচল্লিশ-আটচল্লিশে সেন্ট পলস কলেজে পড়াকালীন তিনি সেখানে ছাত্রসংগঠনের সাংস্কৃতিক সচিব ছিলেন। সেই সময় ভবানীপুরের দীর্ঘ সুদর্শন ছেলেটি, যে গল্প লেখে (দেশ পত্রিকাতে ইতোমধ্যে তাঁর গল্প প্রকাশিত হয়ে গেছে) আর আবাল্য বন্ধু 'গায়ক' সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের চাপে এদিকওদিক গান গেয়ে বেড়ায়, তার কাছে বাবা'রা গিয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে কলেজ সোস্যালে গান গাইবার অনুরোধ নিয়ে। ততোদিনে অবশ্য তার বেশ কিছু রেকর্ডও করা হয়ে গেছে, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, কমল দাশগুপ্তের সুরে। ১৯৪৪ সালে সে নিজের সুরে প্রথম রেকর্ড করে, '' কথা কয়োনাকো, শুধু শোনো''। মোটামুটি এই সময়েই 'প্রিয় বান্ধবী' ছবিতে তার গাওয়া ''পথের শেষ কোথায়....'' বিশেষ লোকপ্রিয়তা পেয়ে যেতে কলাম্বিয়া কোমপানি তাকে দিয়ে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড করেছিলো। দু'টি গান, ''আমার আর হবে না দেরি'' আর '' কেন পান্থ এ চঞ্চলতা'' সত্তর বছর পরেও একুশ শতকের মানুষ শোনে। জর্জদা বলতেন, হেমন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেকেন্ড হিরো। প্রথম হিরো ছিলেন অবিসম্বাদী পঙ্কজকুমার। 


অনুষ্ঠানে পৌঁছোতে একটু দেরি হয়েছিলো যুবকটির। সেই শাদা হাতা গুটোনো শার্ট আর ধুতি, দীর্ঘ পদক্ষেপ। এসেই সোজা মঞ্চে, পর্দা ওঠার আগেই গান ধরা হয়ে গেলো তাঁর, '' আমার আর হবেনা দেরি ...'' । বাবার ভাষায় কলকাতার সতত অতিকথনশীল, প্রগলভ ছাত্রদল মূহুর্তে নিশ্চুপ। গায়নভঙ্গি পঙ্কজকুমারের মতো, কিন্তু পেশকারি অনেক আধুনিক । আর তাঁর কণ্ঠসম্পদ ? শৈশবকাল থেকে অসংখ্যবার শোনা ''আমার আর হবে না দেরি'', যা আমাদের শ্রবণে প্রায় একটি নৈসর্গিক সম্পদ, সম্পূর্ণ ভিন্ন মনোনিবেশ নিয়ে শুনছি এখন। এই গানটি রেকর্ড করার সময় হেমন্তের বয়স ছিলো মাত্র চব্বিশ বছর। তাঁর উচ্চারণ, ডিক্শন, সুর লাগানো, লয় ধরে রাখার পরিণত সামর্থ্য এবং সর্বোপরি সংযমবোধ, রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের এক নতুন ভাষ্য তৈরি করতে পেরেছিলো। মনে রাখতে হবে এই সময়কালে জর্জদা'র কোনও একক রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়নি। 


হেমন্তের 'শিক্ষক' বলতে শৈলেশ দত্তগুপ্ত, যাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রশিক্ষণের কোনও বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিলো বলে জানা যায়না। সাহানা দেবী, কনক দাশের রেকর্ড হয়তো শুনেছিলেন তিনি, কিন্তু তাকে তালিম বলা যায়না। তিনি ছিলেন পঙ্কজকুমারের 'কানশুনি' শাগির্দ। অভিজাত বৃত্তের বাইরে সাধারণ শ্রোতারা যে দুজন অসাধারণ শিল্পীর রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিজের বলে গ্রহণ করেছিলেন, সেই পঙ্কজকুমার মল্লিক আর কুন্দনলাল সহগল ছিলেন তাঁর পথপ্রদর্শক। কিন্তু আজ একই সময়ে এই তিনজনের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড শুনলে বেশ বিস্ময়বোধ হয়। যখন দেখি পঙ্কজকুমার তাঁর গায়নে, বিশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকের শিল্পীদের মতো সুর লাগানোর রেশ পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পারছেন না। যদিও রবীন্দ্রসঙ্গীতে স্পষ্ট উচ্চারণের যে বাধ্যতা পরবর্তীকালে অবশ্যকৃত্য হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিলো, তার ভগীরথ ছিলেন পঙ্কজকুমার । এ ছাড়া কুন্দনলালের বাংলা উচ্চারণের মধ্যে অনুকরনীয় নিশ্চয় কিছু ছিলোনা এবং তাঁর সুর লাগানোর ধরনটি ছিলো একান্তভাবে উর্দু গজলের ধাঁচে। এই দুজন 'দ্রোণাচার্যে'র রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার অভিজ্ঞতা স্বীকার করেও হেমন্ত কিন্তু সম্পূর্ণ নিজস্ব এবং সেকালের পক্ষে প্রায় চমকে দেওয়া একটা পরিশীলিত পরিবেশনার নমুনা পেশ করে ছিলেন। অথচ মজার কথা, তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ন পারদর্শিতার যে বিপুল স্বীকৃতি তিনি পেয়েছিলেন সাধারণ আম শ্রোতার থেকে, তার ভগ্নাংশ সাধুবাদও তিনি পান'নি 'এলিট' শ্রোতামহল থেকে।

আশির দশকে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের লোকপ্রিয় শৈলী বিষয়ে আলাপচারিতায় সুভাষ চৌধুরিকে বলেছিলেন, ''.... এক এক জন exceptional গায়কের গলায় আমরা গানের (রবীন্দ্রসঙ্গীতের) সুন্দর চেহারাটা বা শ্রেষ্ঠ চেহারাটা খুঁজে পাবো। অন্যদের ক্ষেত্রে পাবোনা এবং বিচারটা সব সময়েই Bestকে দিয়ে হবে। আরেকটা জিনিস- সব ঘরে ঘরে রবীন্দ্রসঙ্গীত চলছে- সেই ঘরে ঘরে গাওয়াটা তো আমরা প্রামাণ্য গাওয়া বলে ধরতে পারবো না।'' 

এখানে সুভাষ যোগ করেন, ''.. মুশকিল হচ্ছে কি - Popular গাইয়ের গলায় তো এটা Popular হচ্ছে। সেখানে এটার সাদামাটা চেহারা পাচ্ছি। খুব Popular গাইয়ে কিন্তু তিনি - সেখানে খুব সাদামাটা চেহারা পাচ্ছি।'' 

তখন সত্যজিৎ বলেন, ''..... এই তো হেমন্তই দেখনা (হাসি) অবশ্য এটা আবার উঠে গেল (হাসি)...... কিন্তু কথা হচ্ছে হেমন্তবাবুর গলায় ধরুন এটা নেই। একজন আমি বলছি যে এটা নেই-ই (জোর দিয়ে), সেক্ষেত্রে লোক কিন্তু হেমন্তবাবুর গলায় এটা শুনতে চাইছে। আপনি যে প্রশ্নটা তুলছেন সেটাতো চিরকালের আর্টের একেবারে গোড়ার প্রশ্ন। সাধারণ, মানে Lowest common denominator এর কাছে তার চেহারাটা কীরকম, তারা কী পছন্দ করছে, সে তো আমাদের সাহিত্যেও আছে, ফিল্মেও আছে, গানেও থাকবে। এটাতো নতুন কিছু না। কিন্তু তারা যখন classical গান শুনতে যাচ্ছে তারা তখন ভালটাই চাইবে - যারা classical গানের বোদ্ধা। কিন্তু যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত এসে যাচ্ছে সেখানে তো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে ঐখানেই যে খুব সাধারণ লোকেরা ঐ popular গানটাই পছন্দ করবে। এটা তো পাশাপাশি থাকবেই। এটার কোনও রাস্তা নেই।'' প্রসঙ্গত রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভবিষ্যত বিষয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনি বলেন, ''..... রবীন্দ্রসঙ্গীত in a pristine form, মানে ভালো form, রবীন্দ্রসঙ্গীতের চল তো থাকবেই।''

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে একটা প্রভাবশালী ও স্বীকৃত শ্রোতাগোষ্ঠীর কাছে হেমন্ত বা তাঁর গায়নভঙ্গি Exceptional বা Best নয়, সেটা নেহাৎ 'Popular' এবং এখানে Popular শব্দটি প্রকারান্তরে উৎকর্ষের অভাবই সূচিত করছে। আবার Pristine ফর্ম, যা কি না 'ভালো' form, সেটাই বা আদতে কী কী লক্ষণকে আশ্রয় করে গঠিত হয়? এখানে উল্লেখযোগ্য, যে দু'জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও স্বীকৃত শ্রোতা এই আলোচনাটি করছেন তাঁরা স্পষ্ট কোনও বিশেষ নজির উপস্থিত করছেন না, Pristine formটি আসলে কোন শিল্পী সঠিকভাবে ধারণ করতে পারেন। এই মোড়টিতে এসে আলোচনাটি একটি অন্ধগলিতে আটকে যায়, যেখানে শ্রোতারা আপন আপন শ্রবণ অভ্যেস ও অভিজ্ঞতাকে নির্ভুল ভেবে নিশ্চিন্ত থাকেন।


হেমন্ত বলতেন যে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষকের নাম 'স্বরবিতান'। তিনি দোকান থেকে স্বরবিতান কিনে আনতেন আর হারমোনিয়মে সুর টিপে গান বাঁধার মহলা চালিয়ে যেতেন। গুরুবাদী 'শুদ্ধতা'পন্থিদের পক্ষে রীতিমতো স্যাক্রিলেজ বলা যেতে পারে। কিন্তু যেকোনও গান, বিশেষতঃ রবীন্দ্রসঙ্গীত' যাঁদের কথা ভেবে রচিত হয়েছিলো , যদি তাঁরা শঙ্খ ঘোষের অভিজ্ঞতা অনুসারে শুধু 'মধ্যবিত্ত রুচিপ্রকৃতি'র মানুষই হ'ন, তাঁদের কাছে বিপুল সমাদর লাভ করেছিলো। একথা একশোভাগ সত্যি যে সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে ফেলে শিল্পের মূল্যায়ণ করা যায়না, কিন্তু সেই ফর্মুলাটি কি হেমন্তের রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে? সর্বকালের কথা বলতে পারিনা, কিন্তু আমার নিজের দেখা অন্ততঃ তিনপ্রজন্মের বাঙালি শ্রোতার প্রতিক্রিয়া দেখে বলতে পারি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন মানুষের হৃদয়ের গভীর তন্ত্রী'কে স্পর্শ করতে সক্ষম এবং তার নজির আমরা এখনও দেখতে পাই।


দূরদর্শন পূর্ববর্তী যুগে, যে সময় বাঙালি শ্রোতা বিভিন্ন ছোটোবড়ো আসরে সরাসরি শিল্পীদের থেকে বাংলাগান শোনার সুযোগ পেতো, তখন একটি প্রথা বেশ প্রত্যক্ষ ছিলো। শিল্পীরা অনুষ্ঠানের প্রথম নিবেদনটি শুরু করতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে। যাঁরা পূর্ণসময়ের বা বহুস্বীকৃত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ন'ন, তাঁরাও মুখবন্ধ হিসেবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকেই আশ্রয় করতেন শ্রদ্ধাসহকারে। এখনও হয়তো কেউ কেউ করে থাকেন। কয়েকজনের কথা আমার নিজের মনে আছে। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পিন্টু ভট্টাচার্য, নির্মলা মিশ্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা তো এই মূহুর্তে মনে পড়ছে। এই প্রথাটি প্রথম শুরু করেছিলেন হেমন্ত। প্রশ্ন উঠতে পারে পঙ্কজকুমার ন'ন কেন? তাঁর সমস্ত পরিবেশনায় তো রবীন্দ্রসঙ্গীত আবশ্যিক অংশ হয়ে থাকতো। এই প্রসঙ্গে বলা যায় পঙ্কজকুমারের সময় থেকে হেমন্তের সময়ের মধ্যে বাংলাগানে একটা বড়ো পালাবদল ঘটে গিয়েছিলো। হেমন্তের শ্রোতাদের মধ্যে রবীন্দ্রপ্রজন্মের মানুষ কেউ ছিলেন না বললেই চলে। উপরন্তু নানা আর্থসামাজিক কারণে শ্রোতাদের মানসিকতার ফ্রেমও আমূল বদলে গিয়েছিলো। নতুন প্রজন্মের বাঙালি শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের গান উপযুক্ত মর্যাদায় গ্রহণ করানোর জন্য যে ধরনের গ্ল্যামর কোশেন্ট প্রয়োজন ছিলো, হেমন্ত ব্যতীত সেই মূহুর্তে আমাদের মধ্যে আর কোনও শিল্পী ছিলেন না। তাঁর মাপের লোকপ্রিয় শিল্পীর যোগদান শিল্পবস্তুর মহিমা বিষয়ে শ্রোতার মনে অন্যধরণের তাৎপর্য বহন করে আনে। পরবর্তীকালে কিশোরকুমার এগিয়ে এলেও হেমন্ত ছিলেন তাঁদের পথিকৃৎ। এইখানে সত্যজিতের Pristine ঘরানার যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ কিশোর ছিলেন সত্যজিতের আশিসধন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। এখনও ভাবি, কিশোরকুমারের রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের মধ্যে এমন কী 'রাবীন্দ্রিক উৎকর্ষ' ছিলো, যা তিনি হেমন্তের রবীন্দ্রসঙ্গীতে খুঁজে পাননি? 

রবীন্দ্রসংগীত নামক শিল্পধারাটির একজন অতিস্বীকৃত দিগগজ সুবিনয় রায় হেমন্তের রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্বন্ধে বলেছিলেন, “হেমন্ত যেভাবে সুর লাগায় সেটা বাংলা গানের পক্ষে আদর্শ। সা রে গা মা দু’রকমভাবে লাগানো যায় গলা দিয়ে, একটা sophisticated, অন্যটা unsophisticated। হেমন্ত unsophisticatedভাবে সুর লাগায়। এর তুলনা নেই। ওর গান নির্বাচন অতুলনীয়। কোনটা ও justice করতে পারবে ওটা ঠিক বুঝতে পারে। তার বাইরে বেরোয় না। এই গুণ খুব কম শিল্পীর থাকে। তোরা ভাবিস হেমন্ত-র ক্লাসিক্যালের উপর দখল নেই - সেটা একদম ভুল। আমি তো বহুদিন ধরে ওর সঙ্গে মিশছি, আমি জানি। নিজে গলা দিয়ে ওই চর্চাটা করেনি, কিন্তু ভেতরে ক্লাসিক্যাল সেন্স প্রখর। ওর মত উচ্চারণ বাংলা গানে খুব কম শোনা যায়। ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়’, ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’ ভালো করে শুনিস, দেখবি মনে হবে ঝর্ণা বইছে”। (পুত্র সুরঞ্জন কথিত) 


এর পর আমাদের মতো অনধিকারীর কোনও মন্তব্য নিতান্ত বৃথা ও মূঢ় শোনাবে। অর্ধশতকেরও বেশি শোনার পর ব্যক্তি আমি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীতকে শুধুমাত্র সঙ্গীতপরিবেশনা হিসেবে ধরিনা। বহিরঙ্গে বিভ্রমজনক সারল্যের আড়ালে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিবেদিত শ্রোতার কাছে অগণন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। চিরকালীন হিরণ্ময় পাত্রে লুকিয়ে থাকা উপনিষদের সত্যের মতো যেন তাকে ধরে ফেললেও ধরা দেয়না। কোথাও যেন একটা কাচের দরজা থেকে যাচ্ছে স্রষ্টা ও শ্রোতার মধ্যে। হেমন্তের কাছে ছিলো ঐ দরজাটি খোলার চাবিকাঠি। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মসৃণভাবে উন্মোচিত করে শ্রোতাকে ভাসিয়ে দেওয়ার ধ্যান আমি তাঁর পরিবেশনায় পেয়ে যাই। যা শুধু আর 'গানশোনা' হয়ে থেকে যায়না। একজন তদ্গত শ্রোতা যে কথাটি একবার নিজের মতো করে জানিয়েছিলেন আমাদের। 

"....রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বসে, উনি যেন ঠিক গান নয়, সাধনায় বসতেন। আর ওঁর এই ভাবটা ছড়িয়ে পড়ত শ্রোতাদের মধ্যেও।

রঞ্জি স্টেডিয়ামের একটা অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে। মঞ্চে মহম্মদ রফি। দর্শক উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। তাদের উল্লাস সাগরের ঢেউকেও হার মানায়। তুমুল চিৎকারের মধ্যে মঞ্চ ছাড়লেন রফি।

এর পরেই উঠবেন হেমন্তদা। আমরা রুদ্ধশ্বাস। এমন উত্তাল জনতাকে কী করে বাগে আনবেন তিনি? মঞ্চে উঠলেন। হারমোনিয়াম ধরলেন। তার পরেই অতি পরিচিত সেই জলদগম্ভীর স্বরে বেজে উঠল— ‘আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিল…’।

তখন কোথায় সেই আছড়ে ওঠা সাগর-ঢেউ! মুহূর্তে কোন এক জাদুমন্ত্রের মায়ায় নিশুত রাতের নৈঃশব্দ্য ঘনিয়ে এল যেন…"
(পত্রিকা-সুবীর মজুমদার, ২০শে জুন ২০১৫)

সারাজীবনের অমেয় সঙ্গীতসিদ্ধি তাঁর জন্য হয়তো তেমন তাৎপর্য বহন করতো না। নিস্পৃহ প্রজ্ঞায় জীবনের সালতামামি করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, 

"....গুরুদেবের গান আমার মৃতসঞ্জীবনী। আমার সঙ্গীত জীবনে আমি যা কিছু পেয়েছি রবীন্দ্রকোষ থেকে। আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া বাঁচবো না।" 

একজন ইতর শ্রোতা হিসেবে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত ও বেঁচে থাকার মধ্যে এই সমীকরণটিই শেষ কথা মনে করি। কেন আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীতে দ্বিতীয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর পাইনি, সেই রহস্যটি এই বোধের উৎসেই রয়েছে।

0 comments:

0

ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in


ভৌতবাক


শিশির বাবুর গল্প
দীপারুণ ভট্টাচার্য


স্ত্রীর মৃত্যুর পর একা একা কলকাতায় থাকতে কিছুতেই মন চাইলো না শিশিরবাবুর। ছেলে চাকরি করে দিল্লিতে। তাছাড়া জুটমিলেও নিত্যদিনের অশান্তি। তাই চাকরি বদলে এক সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ নিয়ে শিশিরবাবু চলে এলেন রাজস্থানের যোদপুর জেলার মাথানিয়া গ্রামে।

এখানে মাইলের পর মাইল বালি আর পাথুরে জমি। তার উপরে এদিকে ওদিকে কাঁটা ঝোপ আর ফণীমনসার গাছ। যেখানে পাথর নেই সেখানে কিছু কিছু চাষ হয়। সেই জায়গাগুলোতেই গড়ে উঠেছে ছোটো ছোটো গ্রাম। দিনের বেলা প্রবল গরম হলেও রাতে বেশ ঠাণ্ডা এখানে। এখানে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের বেশ রমরমা। 

শিশিরবাবু যেখানে কাজ নিয়েছেন সেটিও মরুভূমির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিদ্যুৎ প্রকল্প। প্রায় চল্লিশ একর জমিতে একের পর এক লাগানো রয়েছে সোলার প্যানেল। দিনের বেলা সূর্যের আলো পড়তেই সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। সন্ধেবেলা আপনা আপনি বন্ধও হয়ে যায়। 

এখানে কর্মী বলতে ইঞ্জিনিয়ার রামশরণ, শিশিরবাবু আর বৃদ্ধ চৌকিদার, প্রফুল্ল। গেটের পাশে প্রফুল্লের ঘর। এসব অঞ্চলে চুরি আদৌ নেই। লোকে নিশ্চিতে ঘরের দরজা খুলে ঘুমায়। তাই প্রফুল্লের বিশেষ কাজ নেই। স্থানীয় এক গ্রামে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন শিশির আর রামশরণ। রামশরণের কাজ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের হিসেব রাখা, রিপোর্ট দেওয়া এবং যন্ত্রপাতির দেখভাল। সে সকাল আটটা থেকে সন্ধে ছয়টা পর্যন্ত কাজ করে। শিশিরবাবুর কাজ হল রাতের বেলায়। সোলার প্যানেলগুলোকে নিয়মিতভাবে মুছে পরিষ্কার করতে হয়। নইলে উৎপাদন কমে যায়। দিনের প্রবল গরমে কাজটা অত্যন্ত কঠিন। কাজ হয় রাত্রিবেলা। আশপাশের গ্রামের কিছু প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লোক কাজটা করে। এই কাজের দেখভালের ভার শিশিরবাবুর উপর। 

তিনি সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে থাকেন আর রাতের অন্ধকারে প্রকল্পের এদিক ওদিক ঘুরে সাফাই তদারকি করেন। ঘুম পেলে কন্ট্রোল রুমের বেঞ্চের উপর বিশ্রাম নিয়ে নেন। কাজটা মন্দ নয়। তবে সমস্যা হল কথাবার্তা বলা। জুটমিলে সারাদিনে কত লোকের সঙ্গে বকতে হতো। বাড়ি ফিরে পাড়া প্রতিবেশী থেকে শুরু করে ক্লাবের আড্ডা। কথা বলার লোককি কম ছিল। শিশিরবাবু ছিলেন ভূতের গল্প বলার স্পেসালিষ্ট। অন্ধকার ক্লাব ঘরে তার ভূতের গল্প শুনতে শুনতে কতজন যে ভিরমি খেয়েছে! এখানে তাই কথা না বলতে পারে তিনি কষ্ট পান।

আজ শিশিরবাবু এলেন সন্ধে ছয়টায়। একটু পড়ে রামশরণ বিদায় নিল। প্রফুল্লও তার ছোট্ট ঘরে গিয়ে রান্নার কাজে মন দিলো। সূর্য ডুবে যেতেই যান্ত্রিক শব্দ ক্রমে বন্ধ হয়ে এলো। শিশিরবাবু কন্ট্রোল রুমের আলো জ্বেলে একটা পত্রিকার পাতায় চোখ রাখতেই মেঘের গর্জন শুনতে পেলেন। এই মরুভূমি অঞ্চলে বছরে কয়েকদিনই মাত্র বৃষ্টি হয়। একটা সিগারেট ধরিয়ে জানলায় দাঁড়াতেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি নেমে পড়ল। আজ আর সাফাইওয়ালারা আসবে না। প্রয়োজন ও নেই। বৃষ্টিতেই সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে। খানিক পরে রাতের খাওয়া শেষ করে শিশিরবাবুও বেঞ্চের উপর লম্বা হলেন। দিনে ঘুমিয়েছিলেন বটে তবুও তার চোখ লেগে এল। 

যখন ঘুম ভাঙল তখন রাত প্রায় তিনটে বাজে। বাইরের হালকা জোৎসায় বেরিয়ে এলেন শিশিরবাবু। বেশ সুন্দর একটা হওয়া চলছে। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আসছে এদিক ওদিক থেকে। স্বভাব বসত একটা সিগারেট ধরিয়ে অন্য দিনের মতোই তিনি হাঁটতে শুরু করলেন সোলার প্যানেলের মধ্যে দিয়ে। হঠাৎ তার চোখে পড়লো এক জায়গায় কয়েক জন যেন বসে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। শিশিরবাবু মোটামুটি হিন্দি জানেন। সিগারেটের শেষ অংশটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভাঙা হিন্দিতে শিশিরবাবু বললেন, "তোদের কাজতো সব উপরওয়ালাই করে দিলো। তা তোরা এখানে বসে গুলতানি করছিস কেন? ঘরে শুয়ে ঘুমালেই তো পারতিস।" লোক গুলো কেবল একটু হাসল। শিশিরবাবু আবার বললেন, "বুঝেছি, তোদেরও আমার মতোই রাত জাগা অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই না।" আবার হালকা হাসির শব্দ শোনা গেল। শিশিরবাবু একটা পাথরের উপর বসে বললেন, "তোদের তাহলে একটা গল্পই শোনাই। শুনবি?" এবার মূর্তিগুলো একটু নড়ে চড়ে বসল। যেন তারা শিশিরবাবুকে ঘিরেই বসেছে গল্প শোনার লোভে। অন্ধকারের মধ্যে কয়েকটা অন্ধকারের দলা যেন আর এক অন্ধকারকে ঘিরে বসে আছে।

শিশিরবাবু গল্প শুরু করলেন, "তখন জুটমিলের চাকরি। একরাতে হঠাৎ যান্ত্রিক গোলমালের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। কর্মীদের মধ্যে অনেকেই বাড়ি চলে গেল। আমার বাড়ি অনেক দূরে, তাই ভাবলাম ভোরের ট্রেন ধরেই ফিরবো। হাতে খানিকটা সময় ছিলো। জুটমিলে পাশেই বয়ে চলেছে গঙ্গা। ভাবলাম বাকি রাতটুকু গঙ্গার ধারে বসে হওয়া খেয়েই কাটিয়ে দেওয়া যাক। একটা বেঞ্চে বসে সুন্দর সময় কেটে যেতে লাগলো। হঠাৎ দেখলাম গঙ্গায় একটা লোক ডিঙ্গি নৌকো নিয়ে মাছ ধরছে। মনে মনে ভাবলাম যদি কিছু তাজা মাছ লোকটার থেকে কিনে নিতে পারি তবে বাড়ি গেলে বউ দারুন খুশি হবে। পাড়ে গিয়ে একটা ডাক দিলাম, ও মাঝি ভাই মাছ বেচবে নাকি? লোকটা পাশের একটা ঘাটের দিকে আঙ্গুল দেখালো। যেন আমাকে ওই ঘাটেই যেতে বলছে সে। আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধীরে ধীরে সেই ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলাম। লোকটাও নৌকা নিয়ে আসতে লাগলো সেই দিকেই।

খানিকটা কাছে আসতেই দেখলাম তার ডিঙ্গি নৌক মাছে মাছে একদম ভরে গেছে। মাছ গুলোর উপর চাঁদের হালকা আলো পড়েছে। গলুইয়ের ভিতর থেকে সেই আভাই ঠিকরে পড়ছে চারিদিকে। নৌকা কাছে আসতেই মাঝি দুটো মাছ আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি মাছ দুটোকে সাবধানে ডাঙ্গায় রেখে টাকা এগিয়ে দিলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য লোকটা টাকা নিলো না। উল্টে আমার হাতটা ধরে বসল। তারপর আমার হাতের উপর হালকা ভাবে হাত বোলাতে লাগল। আমার সমস্ত গায়ে তখন রোমাঞ্চ খেলে যাচ্ছে। শরীরের রোম একে একে খাড়া হয়ে উঠেছে। কি এক অনির্বচনীয় উত্তেজনা যেন আমাকে ডাকছে নৌকোর দিকে। আমি এক পা এক পা করে নৌকোর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। আর সেই মাঝিও আমাকে হাত ধরে টানতে লাগল। এভাবে কতক্ষন ছিলাম জানিনা। হঠাৎ, 'চলে আয়' বলে মাঝি আমাকে এক হ্যাঁচকা টান দিল। আর সঙ্গে সঙ্গেই শুনলাম অনেক লোকের চিৎকার। জুটমিলের শ্রমিকরা ততক্ষনে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমায় তুলে আনতে। দেখলাম আমি গঙ্গায় হাবুডুবু খাচ্ছি। আমাকে পাড়ে এনে তুলতেই মূর্ছা গেলাম। 

পরে সুস্থ হয়ে শুনেছিলাম গঙ্গার ওই অঞ্চলে এক মেছো ভূত নাকি এমন ভাবেই লোককে মাছের লোভ দেখিয়ে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করে।"

এই পর্যন্ত বলে থামলেন শিশিরবাবু। তখন সবে ভোর হচ্ছে। একটু রহস্যময় হেসে শিশিরবাবু বললেন, "গল্পটা কেমন লাগলো তোদের?" আবার একটা নড়াচড়া উঠলো শ্রোতাদের মধ্যে। উঠল একটা মিহি হাসির শব্দ। একজন একটু নাকে নাকে বলল, "বাঙালি স্বজাতির গল্প শুনে ভালোই কাটলো সময়টা।" এরপর শ্রোতারা বেশ শব্দ করেই হাসতে লাগল আর একে একে অদৃশ্য হয়ে গেল। শিশিরবাবুর হাত থেকে সিগারেট আর দেশলাই পড়ে গেল। তিনি এবার সত্যি সত্যিই মূর্ছা গেলেন।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


সোয়ানার রহস্যময় মানুষ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 


যে জায়গাটায় আমাকে বসিয়েছিল লোকটা, সেখান থেকে উপত্যকার অসাধারণ দৃশ্যাবলী যেন পরতে পরতে খুলে গেলো চোখের সামনে। আল্পসের দৃশ্য দেখে প্রথমে বাক্যহারা হয়ে গেলাম, তারপর নানা রকম বিস্ময় ও প্রশংসাসূচক শব্দ বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে, তারপর আবার বাক্যহারা হয়ে গেলাম। কারণ, প্রকৃতির ঐ অপরূপ সৌন্দর্য বর্ণনা করবার জন্য কোনো ভাষা যথেষ্ট নয়। এমনকি ঐ লোকটাকেও যেন অন্যরকম ঠেকছিল ঐ নিস্তব্ধ সৌন্দর্যের মাঝখানে। মনে হচ্ছিল যেন একটা অন্য লোক! কী শান্ত, সৌম্যভাব! তাহলে কি ওঁর সম্বন্ধে যা শোনা যায় সেগুলো মিথ্যে? জানিনা কেন সেসব শোনা কথা মনে পড়তেই মনটা হঠাৎ একটা অস্বস্তিতে ভরে উঠলো। নাহ, এই জায়গাটা এত সুন্দর, যে সেসব অস্বস্তি আর অনাবশ্যক কৌতূহল কিছুক্ষণের মধ্যেই মন থেকে উধাও হয়ে গেলো। 

আল্পসের মন্টে জেনারাসো যাবার দুর্গম পথের মাঝখানের সেই উপত্যকার চাতালে এখনও কেউ গেলে হয়তো দেখতে পাবে যে পাথরের একটা গোল টেবিলমত উঁচু জায়গা আছে, যেটা ঘিরে একটু নিচু নিচু পাথরেরই বেঞ্চির মত বসবার জায়গা। ‘রহস্যময় লোক’টা আমার সামনে অসাধারণ খাবার দাবার সাজিয়ে দিল সেই পাথরের টেবিলের উপরে। ‘স্ত্রাকিনো দি লেকো’ চীজ ( গরুর দুধ থেকে তৈরি বিশেষ ধরণের ইতালিয়ান চীজ), সাদা নরম ইতালিয়ান রুটি, সালামি, জলপাই, ডুমুর, খোবানি, পাত্র ভর্তি লাল মদিরা যেটা সদ্য নিয়ে এসেছে ওঁর কেলার (পরে জেনেছিলাম ঐ বন্ধ দরজা গুহাটাই ওর কেলার, ভাঁড়ার সব কিছু) থেকে। ছাগলের চামড়ার পোশাক পরা লোকটার মুখোমুখি বসে, অবিন্যস্ত লম্বা ঢেউখেলানো চুল আর দাড়িওয়ালা মুখে ভয়ংকর সাঙ্ঘাতিক গোপনীয় কোনো ভাবের খেলা আমার চোখে ধরা পড়লনা; বরং সৌহার্দ্যপূর্ণ অদ্ভুত বিনীতভাব দেখেছিলাম তার চোখে। 

এই মুহূর্তে আর মনে নেই আমার, ঠিক কি কি বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলে ঐ প্রথম সাক্ষাতের এলাহি পানাহারের পুরো সময়টা কেটে গিয়েছিল। এক দুটো কথা মনে আছে যেমন, লোকটা চাইছিল যে আমি যেন ওকে ‘লুডোভিকো’ বলে সম্বোধন করি, মানে নাম ধরে ডাকি আর কি! লোকটা আর্জেন্টিনা নিয়ে অনেককিছু বলছিল। মাঝে যখন একবার অনেক নিচের উপত্যকার গির্জা থেকে ঘণ্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছিল, তখন লোকটা ভ্রু কুঁচকে নিজের মনে কী যেন বলে উঠেছিল। সম্ভবত ‘বিরক্তিকর’ বা ঐধরণের কোনো শব্দ। আমি একটু যে অবাক হইনি তা নয়। এক দুবার সেনেকার নাম উল্লেখ করেছিল। সুইজারল্যান্ডের রাজনীতি নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছিল। জার্মানি নিয়ে অনেককিছু জানতে চাইছিল লোকটা, যেহেতু সে দেশটা আমার জন্মভূমি। তবে যে কথাটা একেবারেই ভুলতে পারিনি সেটা হল যে বিদায় নিয়ে চলে আসবার সময় লোকটা বারবার বলেছিল যে আমাদের আবার নিশ্চয়ই দেখা হবে এবং আমাকে স্বাগত জানাতে সে সর্বদা প্রস্তুত। 
নিঃসন্দেহে লোকটার সম্বন্ধে ভীষণ কৌতূহল ছিল আমার। মানুষজনের কাছ থেকে নানা অদ্ভুত গালগল্প শুনে সেটা আরও বেড়েছিল। তবে এটা ঠিক যে সেরকম কোনো রহস্যের প্রতি আমার আকর্ষণ ছিলনা। আমার খালি মনে হত যে কি এমন ঘটেছিল ওর অতীতে যে ও ওইরকম একটা দুর্গম জায়গায় বাস করে! মনুষ্য সমাজ, প্রচলিত ধর্ম, আচার আচরণ এসবের থেকে দূরে থাকে। কেন? কি ওর ব্যক্তিগত জীবনদর্শন? কোথায় ওর অতীতের শিকড়? এরকম অজস্র প্রশ্ন আমার মনে জাগতো। 

আমি যতবার লুডোভিকোর সঙ্গে দেখা করেছি, একাই গিয়েছি। উপত্যকায় ওর গোরু ছাগল ভেড়ার দলের মধ্যে কিংবা ওর ঐ ডেরায়। একাই দেখা করেছি। দেখতাম ও কখনো দুধ দোয়াচ্ছে, কখনো আবার ছাগলভেড়ার বাচ্চাগুলোর পরিচর্যা করছে। মেষপালকের কাজ আর গোয়ালার কাজ লোকটা নিবিষ্টচিত্তে করে যেতো। গর্ভিণী কিংবা সদ্য মা হওয়া ছাগলের মাটিতে ঠেকে যাওয়া ভারি বাঁট দেখে সে খুশি হত, আসলে এই জীবগুলোর মধ্যেই সে খুঁজে পেয়েছিল নিজের জীবন এবং জীবিকা। ঐ গরু-ছাগল-ভেড়াগুলোই যেন ওর বন্ধু ছিল। একদিন একটা ছাগলের দিকে তাকিয়ে বলছিল সে, ‘দেখেছ কি দুষ্টুমি করছে? উফফ, ওর চোখভর্তি যেন আগুন! কত রাগ আর নালিশ পুষে রেখেছে আমার উপর!’ কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল লোকটার চোখেই যেন আমি আগুনের ঝলক দেখেছিলাম। আশার আগুন, ভালোবাসার আগুন। লোকটা দাঁত দেখিয়ে হাসলেও ওর হাসিতে কেমন যেন একটা বিষণ্ণতা লেগে থাকতো। অলসভাবে মাঝেমধ্যে সে তাকিয়ে থাকতো তার পশুর পালের দিকে, আবার কখনো বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে কোনো একটা দানবিক চেহারার বলদের স্বাস্থ্যপরীক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত। 
‘রহস্যময়’ লোকটা আবার কখনো বাঁশি বাজাতো। পাহাড়ের উপত্যকা ভরে উঠত বাঁশির সহজ সরল সুরের ওঠাপড়ায়। আমি বেশ কয়েকবার শুনেছি। হ্যাঁ, মনে পড়েছে; ওর সঙ্গে আমার সঙ্গীত নিয়েও আলোচনা হত। দেখেছি যে বেশ জ্ঞানগম্যি আছে ওর সে ব্যাপারেও। তবে যখন ও গরুভেড়ার পালের সঙ্গে থাকতো, তখন গরু ছাগলদের কাণ্ডকারখানা বা ওদের সঙ্গে ওর কীভাবে সময় কাটে, সেসব ছাড়া বিশেষ কোনো কথা বলতে শুনিনি। না, পশুদের মনোবিজ্ঞান নিয়ে সেরকম গুরুগম্ভীর আলোচনা বা অতীত ইতিহাস কিংবা মহাকাব্যের মেষপালকদের নিয়ে আলোচনা যে সবসময় করত, তা নয়। তবে মনে আছে একবার অ্যাপোলোকে নিয়ে পড়ল। সেই যে অ্যাডমেটোসের বাড়িতে, ট্রোজান রাজা লাওমেডনের সময়ে দেবতা অ্যাপোলো স্বয়ং ভৃত্য হয়ে মেষপালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সেই গল্প। 
-‘আমি খালি ভাবি যে কী যন্ত্রে বাজিয়ে তুলতেন অ্যাপোলো সেই অদ্ভুত সঙ্গীতের সুর যে গরুভেড়াছাগলের দল একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতো।’ লুডোভিকো বলেছিল একদিন, ‘উফফ, যদি শুনতে পেতাম!’ ঐসময় ওকে দেখে আমার একটু অদ্ভুত পাগলাটে গোছের মনে হয়েছিল বটে! তবে একদিক থেকে ভেবে দেখলে ব্যাপারটা অদ্ভুত তো বটেই। পশুর পালকে সুরের জালে আচ্ছন্ন করে রাখা, বিশ্রাম করতে পাঠানো, গানের সুরে শান্ত করে এদিক ওদিক ঘাস খাবার জন্য ছড়িয়ে দেওয়া, আবার একজায়গায় নিয়ে আসা বা সারিবদ্ধভাবে পেছনে পেছনে একসঙ্গে নিয়ে খামারে নিয়ে ফেরা, সবই নানারকম সুরের সাহায্যে- এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে বইকি! পশুদের মনে নিশ্চয়ই সঙ্গীতের প্রভাব বেশ গভীর। মেষপালকের বাজনার সুরের ব্যাপারটা খুব একটা সরলসিধে নয় সেটা আমারও পরে মনে হল। 

তবে সবসময় যে ওর সঙ্গে আমার প্রচুর গালগল্প হত, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। একবার এরকম হয়েছিল যে আমাদের দেখা হয়েছিল অথচ সেভাবে কোনো কথাই হয়নি।


(চলবে) 

গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা 

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী

Posted in


ধারাবাহিক


পায়ের শব্দ
সোমঙ্কর লাহিড়ী


১২

উত্তরগুলো টিভিতে আরও একজন দেখছিল। তার সামনে ছড়ান ছিটানো অনেক ইলেক্ট্রিকের আর ইলেকট্রনিক্সের কাজকর্ম করার জিনিসপত্র। একটা টুপির সামনের দিকের শেডের মতো অংশে আর কানের উপরে দুই পাশে গাঢ় নীল এল ই ডি লাগাবে বলে একটা মাপ মতো প্যানেলে এল ই ডি গুলোকে সাজাচ্ছিল আর টিভিতে সম্বিতের সাথে আনকাট অনুষ্ঠানে অ্যান্ডির ইন্টারভিউটা দেখছিল।

পাশের ঘর থেকে এক মহিলার কাঁপা কাঁপা গলা শোনা গেল,

খেতে দিবি না? অনেক তো রাত হল সেই কখন চা খেয়েছি, খিদে পেয়ে গেছে। খেতে দে না। কি রে বাবু, শুনতে পাচ্ছিস? অ বাবু খেতে দে না রে।

বাবু বিরক্ত হয়, 

চেঁচিয়ে জবাব দেয় এখন সবে আটটা বাজে। নটা বাজুক খেতে দিয়ে দেবো। এখন টিভি দেখো একটু।

সিরিয়াল চালিয়ে দে তাহলে।

টিভিটার দিকে তাকিয়ে দেখ, সিরিয়ালই তো চলছে।

না, না এই সিরিয়াল্টা দেখব না, অন্যটা করে দে না।

হাতের কাছে রিমোট রয়েছে তো পালটে নিলেই পারো।

তুই আয়না, একটু এই ঘরে, তোকে দেখি একটু।

নিকুচি করেছে তোমার একটু দেখার। কাজকম্ম করতে দেবেনা না কি?

ক পয়সা রোজগার করিস, মুরোদ তো জানা আছে, খাস তো আমার বাপের পয়সায়, অত কাজ দেখাসনি আমাকে, নেহাত হাত পা চলে না তাই, নইলে তোর মতো কুলাঙ্গার ছেলের মুখে মুতে দিই রে আমি।

ছেলেটা উঠে দাঁড়ায় নিজের কাজের টেবিল চেয়ার ছেড়ে, বেশ লম্বা, রোগা, হাত দুটো সুগঠিত, আর তাতে ধরা একটা তাতাল, সেটাকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢোকে। সেই মহিলার গলার শব্দে এবার কাঁপা ভাবটা আরো বেড়ে ওঠে,

তু তুই চলে যা, ছোটোলকের বাচ্ছা। আমাকে ছ্যাঁকা দিবি না বলে দিচ্ছি। কাছে আসবি না আমার। ও মা গো। আমায় মেরে ফেলল।

জীভ পুড়িয়ে দেবো একেবারে, সেই ছেলেটার হিংস্র গলা শোনা যায়।

মরো না কেন তুমি? জঞ্জাল কোথাকার। তুমি মরলে আমার হাড় জুড়োয়। দিনরাত্রি খালি খাইখাই। তা খাওয়ার জোগাড়টা করতে হবে তো? আর একবার খাওয়ার কথা বললে পরে না তোমার ঐ জীভ এই তাতাল দিয়ে পুড়িয়ে দেবো। 

তা দিবি না, সব রোয়াব ছুটিয়ে দেবো। উকীল ডেকে বাড়ি, ব্যাঙ্কের সব টাকা দিয়ে দেবো রামকৃষ্ণ মিশনকে। আমি মরলে তোকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বার করে দেবে।

রামকৃষ্ণ মিশনের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই তোমার এই একটা পায়রার খোপ তারা নিতে আসবে। চুপ করো তো। নটা বাজলে তারপরে খেতে দেবো। তার আগে খাই খাই করে চ্যাচালে মুখ একেবারে পুড়িয়ে দেবো বলে দিলাম। বজ্জাত মেয়েমানুষ কোথাকার।

ছেলেটা ঘর থেকে বেরিয়ে আবার নিজের ঘরে কাজে বসে। 

পাশের ঘর থেকে খেতে দে খেতে দে করে ঘ্যানঘ্যান চলতেই থাকে।

ছেলেটার রোজগার এখন স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার, প্রিন্টার, ইত্যাদি সারিয়ে। ছোটবেলা থেকে হাতের কাজ তাকে টানত, আনন্দ দিত। আর বাড়ির টিভি, দেওয়াল ঘড়ি ইত্যাদির মেকানিজম জানার তাগিদে মারও জুটত কপালে। 

জ্ঞান হয়ে ইস্তক দেখে এসেছে তার মা বসে বসে টিভি দেখছে, আর তার উপরে চ্যাঁচাচ্ছে। খাওয়ার আসত পাড়ার একটা হোম ডেলিভারী থেকে, অখাদ্য। সকাল বিকেল দু বেলা, সকালে দুধ মুড়ি খেয়ে আজীবন ইস্কুলে গেছে, ফিরে এসে ভাত খেয়ে থালা টিফিন ক্যারিয়ার মেজে ধুয়ে না রাখলে রাতের খাবার দিতে আসা বিশু মামা অবধি দুটো উড়ন চাঁটা দিয়ে দিত। পড়তে খুব একটা ভালো বা খারাপ কিছুই লাগত না। কারণ সারাদিন তার মায়ের চ্যাঁচানো তার চিন্তার অর্ধেক জুড়ে থাকত। আর বাকী অর্ধেক জুড়ে থাকত বিশুমামার মেয়ে মৌসুমি। 

এইসব ছেলে সাধারনত ক্লাস টুয়েল্ভ ড্রপ আউট হয়, আর না হলে দাঁতে দাঁত চেপে এমন লেখাপড়া করে যে একেবারে ছাদ ফুঁড়ে আকাশে মাথা ঠেকায়।

ছেলেটা ক্লাস টুয়েলভ ড্রপ আউটই ছিল। কারণ বেশী নাটকীয় কিছু নয়। বিশুমামা তার মায়ের টাকাপয়সা ব্যাঙ্ক থেকে এনে দিত। একদিন বাড়ি ফিরে শুনল তার মা কেমন একটা কুঁই কুঁই করে শব্দ করছে আর বিশুমামার মাথাটা তার নাইটির ভেতর থেকে বার করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। খুব বেশী কিছু করেনি বিশু মামার মাথাটা মায়ের নাইটির ভেতর থেকে বার করে লোহার আলমারির দরজায় একটা প্রবল ধাক্কায় ঠুকে দেয়। আর ঐ ধাক্কাটা আসতে চলেছে এটা বুঝতে পারার পরেই বিশুমামার চোখের আতঙ্কটা ছেলেটা দেখতে পায় আলমারির গায়ে লাগানো আয়নাটায়। তারপরেই প্রচন্ড শব্দ, আলমারির গায়ের কাঁচ ভাঙার শব্দ, বিশুমামার ফাটা কপাল, ফাটা নাক থেকে বেরিয়ে আসা রক্তের ধারা, পিছনে মায়ের চিৎকার। সবমিলিয়ে একটা যাতা ব্যাপার। ঐ রক্তাক্ত ভীত মানুষটাকে দেখতে দেখতে ছেলেটা বুঝতে পারল তার কাঠিন্য। আর বিশুমামাকে ছেড়ে দেওয়ার পর মুহুর্তে সেই দৌড়ে পালানো দেখার পরে বুঝল এবারে তাকেও দৌড়াতে হবে স্নান ঘরের দিকে। 

চুড়ান্ত সুখানুভুতির সময় অন্য কিছু চিন্তায় এলো না, শুধু ঐ ভয়ার্ত দুটো চোখ আর তারপরে ঐ রক্ত চোঁয়ানোর দৃশ্য দুটো ছাড়া।

তারপর থেকে বাড়িতেই বেশী সময় থাকত, রান্না বান্না থেকে ব্যাঙ্কের টাকা তোলা সব কিছু করে তারপরে দুপুরের দিকে মোবাইল সারান শেখা শুরু আর সেখান থেকে এই রোজগারে। 

ঘটনাটা নিয়ে তারাও বেশী কিছু করেনি, আর বিশুমামাও কিছু করেনি। পাড়ার লোকে জেনেছিল পা পিছলে আলমারির দরজায় মাথা ঠুকে এটা হয়েছে। তবে জল গড়াতেই থাকে লোকের চোখের আড়ালে। রাতে ঘরে বসে যখন কাজ করছে এমন সময় দুটো ছেলে এলো, রাত তখন এগারটা সাড়ে এগারটা হবে,

মোবাইল সারাস?

হ্যাঁ,

এটা দেখতো।

মাথা তুলে দেখল একজনের হাতে একটা সরু ফলার ছুরি, আর অন্য জনের হাতে একটা ব্লেড লাগান ক্ষুর। 

বাইরে আয়।

ছেলেটা বাইরে আসে। সাধারণত মস্তানিতে হাতেখড়ি হওয়ার কাজ হচ্ছে এইগুলো। আর তাদের দেখে বা তাদের হাতের অস্ত্র দেখে উল্টো দিকের লোকটা ভয় পাচ্ছে এটা সেই কুচে মস্তান গুলোর রোয়াব বাড়িয়ে দেয়। ছেলে দুটোর মধ্যে যেটার হাতে সরু ফলার ছুরিটা ছিল সে চোখে মুখে একটা হিংস্র ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল,

বিশুদাকে কেলিয়েছিলিস? কেলাবে চল, ওস্তাদ ডেকেছে।

কে ওস্তাদ? বিশুমামা?

অত কথা বলতে হবে না, চল।

ছেলেদুটো প্রথম ও শেষ ভুলটা এক সাথে করল। দুজনেই অন্ধকার রাস্তায় তাদের শিকারকে পিছনে ফেলে আগে হাঁটা ধরল। মস্তানিতে নতুন তো।

বাড়ি ফিরে ছেলেটা স্নানে গেছিল, নিজে এতটা আরাম এর আগে পায়নি। শুধু মনে পড়ছিল দূর থেকে আসা রাস্তার আলোয় দেখা ছেলেদুটোর আতঙ্কিত চোখগুলো। আর ঐ খুলি ফাটার ভোঁতা ঠক ঠক দুটো শব্দ, কানে লেগেছিল, বাথরুমেও।

পরদিন পুলিস যখন দুটো বডি নিয়ে যায় তখন তারা অবাকই হয়েছিল, কারণ মালদুটো তো গণেশের হয়েই কাজ করে। গণেশ ও কিছু হদিশ দিতে পারল না। দুটোরই গলারটুঁটি কাটা, আর কপাল আর মুখ থ্যাঁতলানো। প্রায় কুড়ি ফুট আগে একটা পোস্টে রক্তের দাগ পাওয়া গেছে। আর কিছুই সেরকম নেই।

গণেশ এসেছিল দিন পনের পরে, সেই রাতের বেলায়, তবে দল চালায় তো সব ঘাঁতঘোঁত জানা, তাই সোজাসুজি কাজের কথায় গেল,

বাদল আর খেপুকে তুই টপকেছিস?

আমি ঐ নামে কারোকে চিনি না।

আমি বেশী ন্যাকামো করি ও না পছন্দও করি না, আমি খবর না নিয়ে এত রাতে তোর কাছে মাজাকি মারতে এসেছি?

তাহলে প্রশ্নটা করছেন কেন?

বিশুর সাথে তোর কি হয়েছিল?

কিছু না।

আবার?

আমার মায়ের সাথে জোর করে বাজে কাজ করছিল।

তুই কেলিয়ে ফাটিয়ে দিয়েছিস? গণেশের মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

ছেলেটা চুপ করে থাকে।

গণেশ মেশিনটা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতটা কপালের সামনে স্যালুট করার মতো করে ঠেকিয়ে গর্বের সাথে বলে,

স্যালুট। যে ছেলে মায়ের ইজ্জতের জন্য জান লড়ায়, গণেশ তার কেনা গোলাম। তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না। আমি আছি। তোর নাম?

সঞ্জয়। 

খুব সাবধানে গণেশ ওকে ব্যবহার করবে বলে চিন্তা করে নিল দালের কাউকে কিছু জানালই না। একরাতে ফোন করল,

সঞ্জয় একটা কাজ করে দিবি? ভালো টাকার খাপ।

কি কাজ?

সব কথা ফোনে হয় না, কাল দুপুরে একবার আসতে পারবি?

কোথায়?

গণেশ ঠিকানাটা বলল,

ঠিক আছে। গেলে আবার মার ধোর দেবে না তো?

দিলে সেদিনই দিতাম, টপকে।

পরদিন নির্দিষ্ট হোটেলে গণেশের সঙ্গে সঞ্জয় মুখোমুখি বসল একটা ঘরে, গণেশ বলল বিয়ার টিয়ার কিছু খাবি?

খাইনা, কাজটা?

বলছি, বলছি 

কর্পোরেশনের এক কাউন্সিলারের চামচাকে কড়কানোর একটা কাজ আছে। করবি?

মেরে ফেলতে হবে?

আরে না না, তাহলে তো টপকানর কাজ বলতাম, সুপারি। এটা একটু ধরে কেলিয়ে ফাটিয়ে ফুটিয়ে দিতে হবে, মালটা দুটো প্রোমোটারকে টাকা নিয়ে ল্যাজে খেলাচ্ছে।

পুরো খবর চাই যে, কোথায় থাকে কি করে, সাথে মেশিন রাখে কি না। সঙ্গে বাউন্সার নিয়ে ঘোরে কি না?

গণেশ অবাক ও হয় আবার মনে মনে খুশীও হয়, একবারে পাকা প্লেয়ারদের মতো ভাঁজ মারছে। কে বলবে নতুন?

তুই জোগাড় করে নিবি?

টাকা লাগবে আর দিন পনের সময়। 

কড়কাতে অতদিন? আর কত টাকা লাগবে?

খোঁজ খবরের জন্য ত্রিশ হাজার, আর কাজের জন্য পঞ্চাশ। 

কেলিয়ে না পোঁদ দিয়ে আটা বার করে দেবো।

সেটা তুমি দিতেই পারো। তাহলে তোমার রেডী ছেলেদের পাঠাও, হ্যা হ্যা করতে করতে বাইক নিয়ে যাবে রুলিং পার্টির কাউন্সিলারের চামচাকে তার পার্টিঅফিসের সামনে রডের বাড়ি মারবে, মিডিয়া পুলিস সব করতে করতে তোমার প্রোমোটার ফাঁসবে, সে তোমায় টানবে, ব্যাস ব্যবসা চৌপট। 

আর তুই কি করবি?

তুমি প্রোমোটার দুটোর থেকে টাকা নেওয়ার সময় কি আমার নাম ঠিকানা বলে নিয়েছিলে? 

গণেশ হাসে, তারপরে সস্নেহে ওর হাতের উপরে নিজের হাত রেখে বলে, 

তোর বুদ্ধির দামই লাখ টাকা, লেগে থাক তোর হবে। বলে টাকা বার করে দেয়। 

সঞ্জয় প্রথমে লোকটার গতিবিধি জানার জন্য একটা ডিটেকটিভ এজেন্সির সাহায্য নিল। জানল লোকটা থাকে পিকনিক গার্ডেনের দিকে বটে, তবে ফুর্তি করতে যায় মুম্বাই রোডের একটা ডান্সবার কাম হোটেলে। বাঁধা ডান্সওয়লি আছে তার সাথে শোয়। 

সঞ্জয় দিন দুই ঘুরে ঘুরে সব জায়গা রেকি করল। মেয়েটাকে চিনল। তারপরে সেই হোটেলের একটা বেয়ারাকে টাকা দিয়ে হাত করে তার একসেট পোষাক কিনে নিল। তারপরে বেয়ারার পোষাক পরে এক সন্ধ্যায় ডান্সবারের দোতলাটা ঘুরে দেখল ঐ বেয়ারাটার সাথে। 

ফাইনাল দিনে লোকটা যখন তার বান্ধবীকে নিয়ে ঘরে ঢুকল সঙ্গে সঙ্গে একটা বেয়ারা হাতে একটা রুম ফ্রেসনার আর টয়লেট ক্লীনারের বোতল নিয়ে দরজায় নক করল, বিরক্ত মুখে দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সেই বেয়ারাটা বলল, সরি স্যার বাথরুমে একটু কমপ্লেন আছে, এখুনি হয়ে যাবে। এই বলে ঘরে ঢুকেই রুম ফ্রেসনারের বোতল থেকে সরাসরি সেই ডান্স বারের নর্তকীর চোখে মুখে স্প্রে করে দিল। চমকটা কাটার আগেই টয়লেট ক্লীনারের বোতল থেকে মিউরেটিক অ্যাসিড সোজা সেই লোকটার মুখে চোখের দিকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল। 

তারপরে নিজের পকেট থেকে একটা ক্লোরোফর্মের শিশি বার করে একটা রুমালে দিয়ে ছটফট করতে থাকা মেয়েটার আর লোকটার মুখে চেপে ধরল। 

রুমের দরজা বন্ধ করে সোজা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে হোটেলের গাড়ী রাখার জায়গাতে এসে নিজের গোঁফটা খুলে আর গ্লাভসটা খুলে পকেটে রাখল। সেখান থেকে মুম্বাই রোড। ভাড়া করা গাড়ি তাকে নিয়ে যখন তার বাড়ি ফিরে এলো তখন রাত মাত্র বারোটা। 

0 comments: