0

গল্প - বিবি বসু

Posted in


গল্প


প্রসঙ্গঃ বইমেলা - কৃষ্টি, সৃষ্টি, অনাসৃষ্টি 
বিবি বসু



শীত এখন বসন্তের দুয়ারে পা ঘষছে। যেতে যেতে বেয়াড়া বাচ্ছার মতন থমকে দাঁড়াচ্ছে শীত। বসন্ত যতবার ভাবে পলাশ ফুটিয়ে এন্ট্রি নিই আর কবিকূল ঋতুরাজ, ঋতুরাজ করে বেশক আদিখ্যেতা করুক অ্যাটলিস্ট দোল পূর্ণিমা পর্যন্ত, শীত কিছুতেই মঞ্চ ছাড়ছে না। শালে, সোয়েটারে, জ্যাকেটে এসে আদুরে বেড়ালের মতন মুখ ঘষছে। শেষমেশ শীত, বসন্তকে ইমেলে জানালো, ‘যতদিন কলকাতার মিলন-মেলা প্রাঙ্গণে বই-মোচ্ছব চলছে, ততদিন কলকেতা ছেড়ে নড়ছিনি বাপু, হ্যাঁ!’
বসন্ত ভাবে, ‘বাপরে, গোটা কলকাতাবাসী শীতে মজে, শীতের কদিন তাদের মুখে নলেন পয়রা গুড়ের মত চটচটে একটা হাসি লেগে থাকে আর শীত কিনা মজেছে--- কি এক বই-মোচ্ছবে!ব্যাপারখান পরখ করে দেখতে হচ্ছে মাইরি!’
বসন্ত ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখা একটা জ্যাকেট টেনে বার করল তার মরচে পড়া ট্র্যাঙ্কের থেকে। চোখে আঁটল এক্কেবারে হদ্দ কালো সান-গ্লাস। শীত চিনে ফেললেই হয়েছে আর কি! দেবে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে। অসময়ের মাস্তানি সহ্য করবে কেন শীত!
বেশ চড়চড়ে দুপুরবেলা বসন্ত এসে হাজির কলকাতায়।গুগুল ম্যাপ বলছে জে.বি.এস হ্যাল্ডেন অ্যাভেন্যু। ম্যাপ মেনে পৌঁছেই হাঁ করা হতকুচ্ছিত টি-রেক্স দেখে বসন্তর ভুরুতে ভাঁজ। মনে একটা প্রশ্ন ঘাই মারল---আরে টেকেন অ্যাবাক(taken aback) এর বাংলাটা যেন কি! 
রাজপথের পেটের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ। সেই রাজপথ জঠর পেরিয়ে মোচ্ছব প্রাঙ্গণের দুয়ার। বসন্ত পৌঁছেই বলে ওঠে, ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’। শুনে ভাবলেশহীন ক.পু রা ফিরেও তাকায় না। বসন্ত ঢুকে পড়ে মেলা-উঠোনে। বাপরে কি জলুস! পলাশ, শিমূল, জারুল ফুটিয়েও এই জৌলুস তার নিজেরই নেই! চোখ ধাঁধিয়ে যায় এক্কেবারে। কানে তালাও লাগে মাঝে মাঝে। কে যেন মাইক্রোফোনে ইংরিজি ঘেঁষা বাংলায় কিসব বলে যাচ্ছে। 
বসন্ত ইতস্তত ঘোরাঘুরি করে---বড় বড় স্টলে কেউ দৃকপাতও করে না। বসন্তর চিরটাকাল মনোযোগ পাওয়া অভ্যেস। বাকি ঋতুরা তাই মাঝে মধ্যেই অ্যাটেনশন সিকার বলে গাল পাড়ে তাকে। অ্যাটেনশন না পেলে মনটা বড় দমে যায় যে তার! তাই পাত্তা না পেয়ে, ভুঁইফোড় প্রকাশনীর স্টলগুলোতে ঢুঁ মারতে যায় ঋতুরাজ।
এক প্রকাশনীর পাঁচ বিঘৎ স্কোয়ার ফুট ক্ষেত্রফল মাপের স্টলে ঢুকে পড়ে বসন্ত।
সে এক রই রই কাণ্ড! একি? ক্রেতার থেকে বিক্রেতা বেশী! ছয়খান ফোন একসাথে চমকাচ্ছে। বসন্তর ছবিও উঠে গেল নির্ঘাত। স্টলে ঢুকতেই এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ বলে ওঠেন, “এই মন্দিরা, উনি আমার বই কিনতে এসেছেন। ওনাকে আমার ‘তৈজস’ বইটা দিয়ে দে তো”।সাথে, সাথে বসন্তর হাতে ‘তৈজস’ এর এক কপি গুঁজে দেওয়া হল।বসন্ত হতবম্ভ। মিনমিন করে বলে, “ইয়ে মানে আমি ঠিক...”। লেখক উঠে এসে বলেন, “আরে, আপনি আমার বইটা নিতে এসেছেন, আমি ঠিক জানি। আসলে লোকমুখে এত প্রচার পেয়েছে বইটা কি বলবো”।
ততক্ষণে স্টলে একজন সুবেশা তরুণী ঢুকে পড়েছে---এই বছর তিরিশেক বয়স হবে বড়জোর। লেখক এবার বসন্তকে ছেড়ে সেই তরুণীকে দুহাতে জড়িয়ে ধরেন। স্নেহ বিগলিত ধারাস্নানে মেয়েটির যখন হাঁসফাঁস অবস্থা, ঠিক তখন নিজের বাঁ হাত দিয়ে ‘তৈজস’ এর আরেকটি কপি তরুণীর হাতে ধরিয়ে দেন লেখক। মেয়েটি বলে, “দাদাভাই, কত দাম?”
স্টল জুড়ে ফের সেই লেখকের গড়ানো গলা বাজে, “আরে, মঞ্জরী শুধু দাভাইয়ের বইটা কেন, দ্যাখ তোর বৌদিরও একটা বই বেরিয়েছে”। লেখক আবার বসন্তের দিকে ফিরে বলেন, “আমার মামাতো বোনের অভিন্নহৃদয় বন্ধু---শুধু আমার আর আমার স্ত্রীর লেখা বইটা কিনতে, সেই হালিশহর থেকে ছুটে এসেছে, বুঝলেন!”
‘কিনতে’ শব্দটা বসন্তের কানে খটাং করে লাগে! আরে, জড়ামড়ি দেখে তো মনে হয় বেশ নিকট সম্পর্ক, তাকেও বই কিনতে বলছে পয়সা দিয়ে! আজব কিস্যা মাইরি। সম্পর্ক নিকট না হলে ঐ হেন স্নেহ-ধারা-স্নানের পর মেয়েটি নির্ঘাত ঠাটিয়ে একটি চড় মারতো লেখকশ্রীর গালে। 
বোমকে গিয়ে মিনিটখানেক ভ্যাবলা মেরে যায় বসন্ত। সেই অগোছালো পলটুকুর সুযোগ নিয়ে লেখক ধাঁ করে এসে বসন্তর বাঁ হাতে তার স্ত্রীর লেখা কবিতার বই ‘পত্র’ ধরিয়ে দিয়ে যান।বুদ্ধিজীবীর পেটেন্ট নেওয়া ভঙ্গিমায় বলেন, “শুনুন, ‘পত্র’ না পড়লে ‘তৈজস’ পড়া অসম্পূর্ণ থাকে। আপনি পড়লে বুঝবেন, ‘তৈজস’ এর প্রতিটি কবিতার উত্তর ‘পত্রে’আছে---খানিকটা সওয়াল-জবাব ধরণের লেখা। এই বইটা নিন---ঋদ্ধ হবেন”।
বসন্ত আমতা, আমতা করে বলার চেষ্টা করে, “আজ্ঞে, আর কবিতা না--- এই গল্প, রম্য-রচনা যদি কিছু থাকে। অনেক বইই তো আপনাদের স্টলে সাজানো আছে দেখছি---বিভিন্নজনের লেখা...”। কথা শেষ করতে দেন না মহানুভব লেখকটি। প্রায় লাফিয়ে উঠে বসন্তর হাতে ‘শুক-সারি’ নামের একটি পত্রিকা ধরিয়ে দেন---“আরে রম্য-রচনা চাই? বলবেন তো। এই পত্রিকায় আমার একটি অনাস্বাদিতপূর্ব রম্যরচনা আছে আর আছে আমার স্ত্রীর লেখা একটি গল্প---পাঁচফোড়নের ঝাঁঝ। এই পত্রিকা নিয়ে যান---চোখ বুজে নিয়ে যান। বাংলা ভাষা কোন দিকে বাঁক নিচ্ছে স্পষ্ট বুঝতে পারবেন। র্্যাকের বাকি বইগুলো দেখতে হবে না আর। এই মন্দিরা বিল কাটতো---একটা তৈজস, একটা পত্র আর একটা শুক-সারি”।
বসন্ত বিল-কাউন্টারের কাছে এগোতে যাবে, এমন সময় এক ছিপছিপে মহিলা তাকে দেখে হাসেন। মহিলা দেখতে বেশ। হাসিটি কিঞ্চিৎ বিরক্তিকর---দাঁতের সাথে মাড়ি বেরিয়ে যায়। কেমন জানি দেখায়---ভূত ভূত মার্কা।
বসন্ত হাসি ফিরিয়ে দেয়। ব্যস, সাড়ে সব্বোনাশ! ক্রেতা ভেবে হেসেছিল, দ্যাখে ইনিও কবি। বাপরে, এরও কি স্বামী, ছেলেপুলে, বেয়াই, বোনাই, জগাই, মাধাই সবাই একটা করে বই বার করেছে না কি! ভাবতে, ভাবতেই দেখে মহিলা এগিয়ে আসছেন---সেই ই,টি মার্কা হাসিটা ঝুলছে ঠোঁটে। মুখ খোলেন, “রিভিউ পড়েছেন নিশ্চয়। প্রত্যেকদিন এক একজন ফেসবুকে রিভিউ দিচ্ছে। আমার সব দেখাই হয় না---ফ্যানের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে কি বলবো!”
শুনে বসন্ত ক্যাবলা হাসি টানে ঠোঁটে। মহিলা বলেন, ‘বইটা এই স্টলেই আছে, নিয়ে দেখতে পারেন’। বসন্ত আলগোছে ঘাড় কাত করে। মহিলা নিঃসঙ্কোচে বলেন, ‘এখন যদি নেন, তাহলে আমি সই করে দিতে পারি। এখানেই আছি এই আর কিছুক্ষণ---একটু বাদেই আবার অন্য স্টলে যেতে হবে সই করতে’। বলতে, বলতেই তিনি নিজের লেখা বইটি সেই মন্দিরাকে দিয়ে বলেন, ‘বিল কাট মন্দিরা, আমি সই করব’।
বসন্ত মনে মনে বলে,’হা হতোস্মি! আই অ্যাম বিয়িং মাগড। আর দু মিনিট দাঁড়ালেই কাতারে, কাতারে কবি ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর’। ওয়ালেট খুলে দাম মিটিয়ে দিতেই স্টলের নৈঋত কোণ থেকে রিনরিনে মিহি স্বরে কে বলে ওঠে, ’আরে, তৈজসের কবিকে দিয়েও সই করিয়ে নিন। লেখক স্বয়ং উপস্থিত। এমন সুযোগ ছাড়তে আছে?’ 


ঢেঁকি গিলে সেই তৈজস হাতে লেখকের কাছে এগিয়ে যায় বসন্ত।সেই কবিশ্রী তার গড়ানো গলায় চ আর ছ এর উপর আরো একটু স্ট্রেস দিয়ে বলে ওঠেন, ‘সই দিচ্ছি, কিন্তু একটা কথা---আমি ব্যাকডেটে সই করি ---এটাই আমার স্টাইল স্টেটমেন্ট’। 
থতমত খেয়ে যাওয়ায় বসন্তের হাত থেকে বইটা পড়ে যায়। লেখক নিজের হাতে তুলে সই করতে গিয়ে তারিখ দেন তিনদিন আগের। 
এবার বই কটা বগলদাবা করে বসন্ত স্টল থেকে বেরিয়ে পড়ে। প্রায় ছুটতে থাকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল আরেকটু হলে। একজন ধরে ফেলে বলেন, ‘আরে, পড়ে যাবেন যে দাদা, আসতে’। কৃ্তজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকাতেই, ভদ্রলোক হাত ধরে একটি স্টলে নিয়ে গিয়ে বসান বসন্তকে।‘বসুন, বসুন দাদা, জল খান’, বলে জলের বোতল এগিয়ে দেন সহৃদয় ভদ্রলোকটি।ঢকঢক করে খানিক জল খেয়ে, বাঁ হাত উলটে বসন্ত যেই ঠোঁট মুছতে গেছে, অমনি সেই সহৃদয় জন বলে ওঠেন, ‘আমার এবারের বইটা দেখেছেন’? 
বসন্ত মিশর দেশের মমির মতন স্থির হয়ে যায়। এ বিপদ থেকে বাঁচবার একমাত্র উপায় হচ্ছে বধির হয়ে যাওয়া। ফ্যালফ্যাল করে সামনের নতুন উৎপাতটির দিকে তাকায় বসন্ত। তিনি যেই পিছন ফিরে স্টিলের র্্যাক থেকে বই নামাতে গেছেন, বসন্ত উঠেই দে দৌড়। পিছনে সম্মিলিত গেল গেল রব। বঁড়শিতে গেঁথেও মাছ পালালো! দৌড়তে দৌড়তে বসন্ত স্পষ্ট শুনতে পেল, সেই সহৃদয় ব্যক্তিটি দাঁত কিড়মিড় করে বলছেন, ‘শালা বোকা...’। 
বাবারে আর এক পল ও এখানে নয়। কারা জানি হাঁক পাড়ছে,’হোল সেল, হোলসেল—মোটামোটা বই কম কম দাম’। তাদের পেরিয়ে দৌড়তে, দৌড়তে মাটির পশরা নিয়ে বসা কয়েক দোকানির মাটির ফুলদানি, টেরাকোটার দুল পায়ের চাপে খানখান করে দিয়ে বসন্ত বইমেলা থেকে বেরোবার পথ খোঁজে।ঐ তো দেখা যাচ্ছে গেট নম্বর টু।প্রায় গেটের কাছে এসে পড়েছে, কে যেন পিঠে হাত রাখে। বাবারে কি ঠাণ্ডা হাত! কঙ্কাল না কি! পরিচিত গলা বলে ওঠে, ’হতভাগা, আগে আগে এন্ট্রি মারবি ভেবেছিস?’ পরম আত্মীয় খুঁজে পাবার আনন্দে শীতের কন্ঠলগ্ন হয় বসন্ত। শীত বলে, ‘তোর ছদ্মবেশ ভালো হয়নি রে ছুটকু আর সান গ্লাসটাওতো ঐ কবতেওয়ালাদের স্টলে ফেলে এলি! যখন থেকে ঢুকেছিস, আমি পিছু নিয়েছি। রগড় দেখছিলাম’। 
বসন্ত মুখ ব্যাজার করে জুলজুল করে তাকায়। শীত হেসে বলে, ‘ভেবেছিস কি তুই একাই অ্যাটেনশন সিকার হয়ে থাকবি? দেখলি তো বাপেরও বাপ আছে! ফি বছর এই গালা সার্কাসের ঐ জোকারগুলোকে দেখবার জন্য এই কটা দিন আমার কলকাতা বাসের মেয়াদটা বাড়িয়ে নিই---তোকে কিছুতেই এন্ট্রি দি না। এখন যা বেটা, বাড়ি ফিরে জমিয়ে লেখ দিকি কি কি দেখলি---তারপর জুকুর পা ধরে আপ্লোডিয়ে দে। দেখিস আবার ফেসবুকে পেজ টেজ খুলে বুস্ট ফুস্ট করিস নি বাপ---তাহলেই আবার খরচা---এ রোগ কিন্তু সংক্রামক। যারা সামহালকে ছুটকু!’

0 comments: