প্রচ্ছদ নিবন্ধ - দীপঙ্কর রায়
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
জোড়া প্রবন্ধ
দীপঙ্কর রায়
মরদ আমার হারাঞ গেল গো
চাসনালার কথা মনে আছে? ধানবাদের চাসনালা? যেখানে এক কয়লা খনিতে তিন শতাধিক কয়লা শ্রমিকের সলিল সমাধি হয়? খননের কাজ চলছিল এক পরিত্যক্ত খনির আশি ফুট কয়লা স্তরের নীচে। হঠাৎ খনির ছাদ ভেঙ্গে পড়ে আর পরিত্যক্ত খনিতে জমে থাকা জলের বন্যা চাসনালা ভাসিয়ে দেয়, ডুবিয়ে দেয় অসহায় খনি শ্রমিকদের। দেশ বিদেশের অত্যাধুনিক কারিগরি প্রযুক্তি লাগিয়েও চাসনালা শুকনো করা যায়নি। বাঁচানো যায়নি ভেসে যাওয়া প্রাণ।
চাসনালায় ভেসে গেছিল প্রশস্ত খনি সুড়ঙ্গ, আর তার তেতাল্লিশ বছর পরে, মেঘালয়ের জয়ন্তীয়া পাহাড়ে ভেসে গেল ইঁদুরগর্তখনি। র্যাট হোল মাইন। জয়ন্তীয়ার কয়লা, পাহাড়ের গভীরে মাত্র তিন চার ফুটের স্তরে থাকে। মাটির অনেক নীচে থাকার দরুন প্রথাগত খনি প্রযুক্তিতে কয়লা তোলা যায়না। তাই ইঁদুরের মত গর্ত খোঁড়া হয় কয়লা স্তরে পৌঁছনর জন্য। সে গর্তে ঢোকে ছোটো চেহারার শ্রমিক, গুঁড়ি মেরে বা শুয়ে শুয়ে। অপরিসর সুড়ঙ্গ, প্রাগৈতিহাসিক প্রযুক্তি, আর গর্ত ধসে গেলেই জীবন্ত সমাধি। তবু পেটের দায় বড় দায়। ঝুঁকির দাম কিছু পয়সা।
ইঁদুর গর্তে কয়লা তোলা গ্রীন ট্রাইবুনাল বেআইনি ঘোষণা করে পাঁচ বছর আগে। শীর্ষ আদালত রায় দেয়, নতুন করে ইঁদুর গর্তে কয়লা তোলা যাবেনা, তবে যত কয়লা মজুত আছে খননের পর, সেটা পাঠানো যাবে অন্যত্র বাণিজ্যের স্বার্থে, নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে। সে সময় পেরিয়ে গেলেও মজুত শেষ হলনা। সময় সীমা বাড়ানো হল। তারপর আবার, আবার ... এই করে পেরিয়ে গেছে পাঁছ বছর, মজুত এখনো শেষ হয়নি।
প্রাশ্ন হল, কত কয়লা মজুত ছিল গুদামে, যা পাঁচ বছরেও শেষ হলনা? এ পোড়া দেশে প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা। তবু প্রশ্নটাই তো কেউ করেনা। অবশেষে পনের জন শ্রমিক ডুবে প্রমাণ করল, কয়লা তোলা অব্যাহত ছিল। ট্রাইবুনালের নির্দেশ আর শীর্ষ আদালতের মান্যতা, সব কিছুর চোখে ধুলো দিয়ে। অবিশ্যি যেখানে পাঁচ বছরে দু’ দুটো সরকারচোখ বন্ধ করে থাকে, সেখানে চোখে ধুলো দেবার দরকার তো নেই!
জয়ন্তীয়া পাহাড়ের ইঁদুর গর্তের মালিক ধরা পড়েছে। আইন এখন আইনের লম্বা পথে। একদিন সাজা হবে হয়তো। চাসনালার অভিযুক্তদের হয়েছিল। লম্বা সাঁইত্রিশ বছর পর এক বছরের জেল আর পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা। সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!
না, রাগ করবেননা। বরং একটা গান শুনি চলুন। ইউ টিউবে পেয়ে যাবেন, সেকালে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ...
রাতকে বিতাইলাম হো।।
দিনকে বিতাইলাম হো।।
তেবেও আমার মনের মানুষ আইলনা
এই চাসনালা খনিতে
মরদ আমার ডুব্যা গেল গো
এত প্রতিবাদের গান নয়! এ মানুষের দীর্ঘশ্বাস, যা শোনার মত মানুষও নেই। নাহলে চাসনালার তেতাল্লিশ বছর পরে জয়ন্তীয়া পাহাড়ের র্যাট হোলে আবার কারুর মরদ ডুবে যায় ?
তবু শুনুন একটু মন দিয়ে। যদি উদাসীনতা একটু কাটে... যদি প্রতিরোধের ভাষা খুঁজে পাওয়া যায়...!
ফুচকা
বাজি রেখে বলা যায় , ফুচকা খাননি এমন লোক নেই কলকাতায়। বাচ্ছা থেকে বুড়ো, আট থেকে আশি । আর ফুচকাওলার চেহারা চরিত্রে আমি অন্তত কোন পরিবর্তন দেখিনি আমার ষোল থেকে ষাটে। মলিন জামাকাপড়, ছিন্ন গামছা, লাল কাপড়ে ঢাকা ফুচকার ঝুড়ি , তিনটে ডেকচি। ওরই মধ্যে মেনু, ফুচকা, আলকাবলি , আলুর দম আর চুরমুর। পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল এবং এখনো আছে। ফুচকাওলা নোংরা হাতে আলু মাখে, সেই হাতেই পয়সা নেয় ইত্যাদি। আমার এক পাড়ার কাকা ভয় দেখাতেন তেঁতুল গোলা ড্রেনের জলে তৈরি। করপোরেশনের জল থাকতে পয়সা দিয়ে ড্রেনের জল কেন তুলবে প্রশ্ন করাতে উনি আমাকে ডেঁপো বলেছিলেন।
তো সে যাই হোক, এতদিন ফুচকা খেয়ে আমার অন্তত কোন দিন পেটের গোলমাল হয়নি। পরিচ্ছন্নতার পরীক্ষায় স্টার নম্বর পাওয়া রেস্টুরেন্টে একবার ফুচকা খেয়েছিলাম। ম্যাশড পট্যাটো আর ট্যামারিন্ড দিয়ে গেল আলাদা করে। তো সেটা আমার ফুচকা বলে মনে হলনা। আর কলকাতা কিম্বা রাজ্যের বাইরে খেয়েছি গোলগাপ্পা বা পানিপুরি। সেগুলোও আমার ফুচকা বলে মনে হয়নি।
ফুচকা হল ফুচকা। আটা আর সুজির সন্তুলিত মুচমুচে খোল, পুরটা অবশ্যই হাতে মাখতে হবে আলু, মটর সেদ্ধ, ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা লেবু আর চাট মশালা দিয়ে। জলটা হবে তেঁতুলের, কখনই পুদিনার নয়। বাঁ হাতে খোল ফুটো করে, পুর ভরে, তেঁতুল জলে ডুবিয়ে, শালপাতার বাটিতে দেবে, আর গালে ফেললে ফুচচ করে মিলিয়ে যাবে, তবেই ফুচকা। গোলগাপ্পার সাধ্য নেই গোলমালের। কলকাতার ফুচকা জিন্দাবাদ। তবে কলকাতার ফুচকাওলাদের বেশিরভাগই প্রতিবেশী রাজ্যের। স্বাদটা ওঁরা নিজের দক্ষতায় আপন করে নিয়েছেন বংশ পরম্পরায়।
কলকাতার পথখাবারের তালিকায় চাউমিনের চৈনিক আগ্রাসনের অনেক আগে ফুচকার জনপ্রিয়তায় আজ অর্ধশতাব্দী পরেও কোনো ভাটা নেই। শুধু, আগে খেতাম দশ পয়সায় চারটে আর এখন দশ টাকায় চারটে। আবার কিছুদিন আগে ফুচকা উৎসবও নাকি হলো।
ফুচকার ক্রমোত্তরণ হোক!
0 comments: