0

প্রবন্ধ - ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী

Posted in

প্রবন্ধ


গীতারহস্যামৃতম 
ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী 


‘‘The world is a hellish place and bad writing is destroying the quality of suffering.’‘ – Tom Waits, Musician

এই লেখাটার মুখবন্ধে আর বিশেষ কিছু বলার নেই। টম সাহেবের ওপরের উক্তিটি আশা করি যথেষ্ট। তাই সাহসী পাঠক বন্ধুদের আর সাবধান করার প্রয়োজন মনে করি না। 

এখন কথা হচ্ছে এত কিছু থাকতে হঠাৎ গীতা কেন? কিন্তু আমার পাল্টা প্রশ্ন হচ্ছে, গীতা নয় কেন?? 

আসলে এই মধ্য প্রৌঢ় জীবনে এসে হঠাৎ উপলব্ধি হলো যে এই গীতা গ্রন্থটি ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় জ্ঞানে-অজ্ঞানে, ধর্ম-অধর্মের বেড়া ডিঙিয়ে আমাদের জীবনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।  

ভারতবর্ষ দার্শনিকদের দেশ। মায়ের পেট থেকে পড়েই ভারতীয় মাত্রেই দার্শনিক। তাই যখন এক শিশু ভিক্ষার্থীকে পেটে খিদে নিয়ে লোকাল ট্রেনে টিনের থালা বাজিয়ে, ‘‘সকলই তোমার-ই ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি / তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি’’ গাইতে শুনি তখন একই সঙ্গে আমার অফিসের অ্যাপ্রেইজাল রিভিউ মীটিং-এ আমার উপরওয়ালার সেই দার্শনিক উক্তিটাও মনে পড়ে যায় - ‘‘Hey man, forget all these silly things. You give your best & don’t bother about the results.’’ 

এই দুটি ক্ষেত্রেই আমার গীতায় কৃষ্ণের সেই বিখ্যাত শ্লোক দুটির স্মরণে আসে – 

‘‘অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্তত’’

(বিভূতি যোগ – ৮ম শ্লোকের মুখরা – 

‘‘আমি সকলের উৎপত্তির মূল, আমার দ্বারা সমস্ত চালিত হয়’’)

এবং

‘‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষূ কদাচন’’ 

(সাংখ্য যোগ – ৪৭তম শ্লোকের মুখরা – ‘‘কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে কদাচ নয়।’’)।

সাদামাটা বাঙলায় আর বিশুদ্ধ ইংরেজিতে শিশু ভিক্ষুকটি আর আমার উপরওয়ালা পর্যায়ক্রমে এই দুই শ্লোকের মানে আমাদের বেশ ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। 

পেটের তাগিদে আসমুদ্র-হিমাচল সফরে এই ধরণের প্রচুর অভিজ্ঞতা আমায় ‘‘গীতা নয় কেন?’’ এই কর্মকাণ্ডের অতলান্তিক সাগরে ঝাঁপ দিতে উজ্জীবিত করেছে। এবার সেই অতল সাগরের লোনা জলে যেখানে বহু বড় বড় হস্তী থই পায় না, সেখানে আমার মতো একজন অর্বাচীনের প্রবেশ যেন আমাকেই লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে। ইংরেজিতে সেই একটা কথা আছে না – Fools rush in where Angels fear to tread! 

আসলে বহু দানবিক কর্মকাণ্ডের একটা না একটা ভাল দিকও থাকে। 

আমাদের গ্রামের স্কুলের বাংলার মাষ্টারমশাই, যাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে আমার মনে মাতৃভাষার প্রতি যে পরমাণু পরিমাণ ভালবাসার জন্ম হয়েছিল, তাতেই আমি তাঁর কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। 


(২)

তাঁর বিশ্বাসের কথায় বলতে গেলে বলতে হয় যে যদি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকে ব্যপকতা আর ভয়াবহতার মাপকাঠিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অ্যাখ্যা দেওয়া যায়, তবে বলা যেতে পারে যে এই ভীষণতম যুদ্ধের সবচেয়ে পরম প্রাপ্তি হচ্ছে গীতা নামক মহাগ্রন্থটি। শ্ত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার স্বজন হারানো কুরুক্ষেত্রের শ্মশাণে দাঁড়িয়ে সমস্ত পার্টিসিপেটিং ইন্টারেস্টেড পার্টির গীতা-ই যে এক এবং অদ্বিতীয় সম্বল হতে পারত, সে বিষয়ে নিশ্চয় কারুর আপত্তি থাকার কথা নয়। 

এই চিন্তাধারা থেকেই স্কুল জীবনের সেই দিনটি থেকেই আমার গীতা মহাগ্রন্থের প্রতি ভালবাসার উদয় এবং আমার মতে গীতা মহাগ্রন্থটির সমকক্ষ বিশ্বে আর কোন দার্শনিক গ্রন্থ নেই। 

একটু মনোযোগসহ বর্তমান লেখাটার সঙ্গে এতদূর যদি কোন পাঠক এগিয়ে এসে থাকেন, তবে তিনি নিশ্চয় নজর করেছেন যে বর্তমানে আমি গীতাকে মহাগ্রন্থ বলে সম্মোধন করছি, ধর্মগ্রন্থ বলে নয়। বলা যেতে পারে এটি একটি আমার অতি সুচিন্তিত প্রয়াস মাত্র। আমার এই ধারনা কেন জন্ম নিয়ছে তা অবশ্য ক্রমশঃ প্রকাশ্য।

গীতা যুগে যুগে সারা বিশ্বে প্রচন্ড কৌতূহল ও উন্মাদনার সঞ্চার করে এসেছে এবং এখনও করে চলেছে। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, যে দার্শনিক চিন্তাধারার ওপর গীতার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত, সেই ধরণের উচ্চ মার্গের পথের নির্দেশ একমাত্র গীতা মহাগ্রন্থেই সহজলভ্য। পৃথিবীর আর কোন গ্রন্থ বা এপিক বা ধর্মগ্রন্থ দার্শনিকতার এই উচ্চতম মার্গের দিক নির্দেশ করতে পেরেছে কিনা, সেটা নিয়ে চা বা কফির কাপে তুফান তোলা যেতেই পারে। ব্যাপারটা আমজনতার প্রতিনিধি হিসেবে আমার মতো পটলবাবুর পক্ষে ছোট মুখে বড় কথা বলে মনে হতে পারে ভেবে আমি গুরুর গুরু মহাগুরু মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন সাহেবকে কোট করতেই পারি। দেখা যাক উনি গীতা সম্বন্ধে কি বলেছেন। উনি বলেছেন – 

‘‘When I read Gita and reflect about how God created the universe, 
everything else seems so superfluous.’’

গীতা মহাগ্রন্থের বয়সের গাছ-পাথর নেই। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের তুলনায় মহাগ্রন্থ গীতাকে মোটামুটি ভাবে পিতামহ ভীষ্ম বলা যেতে পারে। এই ব্যাপারে স্বামী বিবেকানন্দের The Parliament of Religions –Chicago-র বক্তৃতাটাকে একটু নাড়াচাড়া করা যাক। 

‘‘As different streams, having their sources in different places, all mingle their water in the sea, so, O Lord, the different paths which men take thro’ different tendencies, various though they appear, crooked or straight, all lead to Thee…

Whosoever comes to Me, thro’ whatsoever form, I reach him. All men are struggling many paths which in the end lead to Me.’’ 

বিবেকানন্দের বাণীর মূল সুরের উৎসে পৌঁছতে গেলে আমাদের দেখে নিতে হবে রাজবিদ্যা-রাজগুহ্য যোগ অধ্যায়ের ২৪তম শ্লোকের মুখবন্ধে শ্রীকৃষ্ণ কি বলেছেন। তিনি বলেছেন,

‘‘অহং হি সর্বযজ্ঞানাং ভোক্তা চ প্রভুরেব চ।’’

[ আমি সর্ব যজ্ঞের (সকল পূজার) ভোক্তা এবং প্রভু।]


(৩) 


এইবার গীতা মহাগ্রন্থে জ্ঞানযোগ অধ্যায়ের একাদশ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ কি বলেছেন দেখা যাক। উনি বলছেন, 

‘‘য়ে যথা মাং প্রপদন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।’’

(যারা যে ভাবে আমার শরণাপন্ন হয়, আমি তাদের সেভাবেই তুষ্ট করি। হে পার্থ, মনুষ্যগণ সর্বপ্রকারে আমার পথ অনুসরণ করে।) 

যাইহোক এবার মহাগ্রন্থ গীতাকে আমি আস্তিক মানুষ হয়েও ধর্মগ্রন্থ বলতে দ্বিধা করছি কেন – এই দশ লক্ষ টাকা দামি বিষয়টাকে নিয়ে আলোচনায় আসা যাক। 

অবশ্য তার আগে মহাগ্রন্থ গীতার পরিসংখ্যান জনিত কিছু তথ্যের বিশ্লেষণ করে দেখলে কেমন হয়? 

মহাগ্রন্থ গীতায় মোট আঠারোটি অধ্যায় আছে। এই আঠারোটি অধ্যায়ে মোট সাতশোটি (৭০০) শ্লোক আছে। তার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ নিজে পাঁচশ ছিয়াত্তরটি (৫৭৬) শ্লোক বলেছেন আর অর্জুন বলেছেন বিরাশিটা (৮২) শ্লোক। সঞ্জয় বলেছেন একচল্লিশটি (৪১) এবং ধৃতরাষ্ট্র মুখে উচ্চারিত হয়েছে মাত্র একটি (১) শ্লোক। 

প্রথম অধ্যায় হচ্ছে সাতচল্লিশটি (৪৭) শ্লোক সমন্বিত ‘‘অর্জুনবিষাদ’’ আর সর্বশেষ অধ্যায়টির নাম মোক্ষ যোগ, যা সর্ববৃহৎ অধ্যায় এবং এতে মোট আটাত্তরটি (৭৮) শ্লোক আছে। পুরুষোত্তমযোগ আর ভক্তিযোগ এই দুটি অধ্যায় একত্রে সর্বকনিষ্ঠ – প্রত্যেকটি মাত্র কুড়িটি (২০) শ্লোক সমৃদ্ধ। 

গীতায় শ্রীকৃষ্ণের কন্ঠে উচ্চারিত ৫৭৬টি শ্লোকের মধ্যে বেশ কিছু শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব এবং ভক্তিবাদের প্রদর্শন আছে। বহু শ্লোকের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ বারংবার ‘‘আমিই ব্রহ্মা, আমিই ইন্দ্র, বাসুদেব’’ ইত্যাদি বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছেন। এছাড়া শ্রীকৃষ্ণের মুখে ‘‘আমাকেই উপাসনা কর, যে আমাকে দ্বেষ করে তাঁকে আমি নরকে নিক্ষেপ কর’’ ইত্যাদি ভীতিপ্রদ শ্লোকেরও ব্যবহার দেখতে পাই। তা এই ধরণের ঈশ্বরিক বিভূতিযুক্ত ‘‘আমি’’ সর্বস্ব শ্লোকগুলো যদি তার্কিক জনগণের বিরোধিতায় আমজনতার ভক্তিবাদী পটলবাবুরা বাদ দিয়েও দেন, তবু তার পরেও সাত-দু-গুনে চোদ্দ-র চার-এর অঙ্কের মতো আমাদের হাতে পেন্সিল রূপে যা থেকে যায়, তা এক কথায় অতুলনীয়। 

যদি শতকরা হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ কথিত ৫৭৬টি শ্লোকের এক তৃতীয়াংশ শ্লোকেও তাঁর ঈশ্বরত্ব বিজ্ঞাপিত হয়ে থাকে (এই প্রসঙ্গে পুরো বিভূতিযোগের ৮২টি শ্লোকের মধ্যে তাঁর উচ্চারিত ৩৫টা শ্লোকই বোধহয় বাদ দেওয়া যায়), তবুও পড়ে থাকা প্রায় ৪০০ শ্লোক আস্তিক, নাস্তিক, মূক, বধির, অন্ধ, তার্কিক, ধনী, গরীব, আবালবৃদ্ধবনিতার শুধু জীবনদর্শনই নয়, বরং তার থেকে এমন একটা উচ্চ মার্গের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে, যা সমস্ত মানুষের জীবন যাত্রা এক সুস্থ, নির্মল, সুখী, এবং শান্তিময় পথের দিকে প্রবাহিত করে দিতে সক্ষম। 

হ্যাঁ, এইখানেই গীতার সার্থকতা আর ঠিক এই কারনেই গীতা একটি মহাগ্রন্থ রূপে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। 

ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে সত্যি নিজেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বলে মনে হতে পারে এই ভেবে যে মাত্র চারশতাধিক শ্লোকের সাহায্যে মহাগ্রন্থ গীতা নিজেকে আবালবৃদ্ধবনিতার দরবারে হাজির করতে পেরেছে।

(ক্রমশ)

0 comments: